ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল 0%

ইনসানে কামেল লেখক:
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

ইনসানে কামেল

লেখক: শহীদ অধ্যাপক মুর্তাজা মুতাহ্হারী
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 41090
ডাউনলোড: 6659

পাঠকের মতামত:

ইনসানে কামেল
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 83 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 41090 / ডাউনলোড: 6659
সাইজ সাইজ সাইজ
ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

অস্তিত্ববাদী মতবাদের পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন

) يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّـهَ وَلْتَنظُرْ‌ نَفْسٌ مَّا قَدَّمَتْ لِغَدٍ وَاتَّقُوا اللَّـهَ إِنَّ اللَّـهَ خَبِيرٌ‌ بِمَا تَعْمَلُونَ وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ نَسُوا اللَّـهَ فَأَنسَاهُمْ أَنفُسَهُمْ أُولَـٰئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ (

(সূরা হাশর : ১৮ ও ১৯)

আমরা গত বৈঠকের শেষ পর্যায়ে অন্য একটি মতবাদ যাকে বর্তমান কালের সবচেয়ে নতুন মতবাদগুলোর একটি বলা যেতে পারে,সে দৃষ্টিতে পূর্ণ মানবের রূপ কিরূপ তার প্রতি ইশারা করেছি।

এ মতবাদটি স্বাধীনতাকে মানুষের পূর্ণতার মানদণ্ড অথবা মানুষের অস্তিত্বের প্রকৃত মূল্যবোধ বলে মনে করে। এ মতবাদের প্রবক্তাদের বিশ্বাস এ বিশ্বজগতে একমাত্র স্বাধীন অস্তিত্ব হলো মানুষ অর্থাৎ মানুষ কোন বাধ্যবাধকতার আওতাভূক্ত নয়,তাই তার উপর কিছুই চাপিয়ে দেয়া যায় না। পুরাতন দার্শনিকদের ভাষায়- সে এ সৃষ্টিজগতে একটি স্বাধীন অস্তিত্ব যে কারো বাধ্য ও পরাধীন নয়। তাদের কারো কারো মতে মানুষ ব্যতীত আর সকল কিছুই বাধ্য,তারা কার্যকারণের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। কিন্তু মানুষকে কোন বিধানই,এমনকি কার্যকারণ বিধানও বাধ্য করতে পারে না।

অস্তিত্বই মূল - অস্তিত্ববাদী মতবাদে এ ধারণার রূপ

এ মতবাদ অন্য একটি তত্ত্বে বিশ্বাস করে,আর তা হলো স্বাধীন এ মানুষ বিশেষ কোন প্রকৃতি নিয়ে সৃষ্ট হয়নি। বিশ্বজগতে অন্য সকল সৃষ্টি বিশেষ প্রকৃতি ও সত্তায় সৃষ্ট হয়েছে। যেমন পাথর পাথর হিসেবেই সৃষ্ট হয়েছে,সে পাথর ভিন্ন অন্য কিছু হতে পারে না,যেমন সে মাটির ঢিলা হতে পারে না। বিড়াল বিড়ালের প্রকৃতি নিয়ে জন্মেছে,ঘোড়া ঘোড়ার প্রকৃতি নিয়ে জন্মেছে। কিন্তু মানুষ এরূপ বিশেষ কোন প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে সৃষ্টি হয়নি। বরং সে নিজে যে প্রকৃতি ধারণ করবে সে প্রকৃতিই লাভ করবে। মানুষের স্বাধীনতার সীমা এটা যে,সে নিজের প্রকৃতি নিজেই তৈরি করবে। এ বিষয়টিকে তারা অস্তিত্বই মূল বা বস্তুসত্তার উপর অস্তিত্বের প্রাধান্য বলেছেন।

অস্তিত্ব মূল,বস্তুই মূল- এ পরিভাষাগুলো আমাদের দর্শনে বেশ পুরাতন। প্রায় সাড়ে তিনশ বছর পূর্বে সাদরুল মুতাআল্লেহীনের সময় হতে এ আলোচনা চলে এসেছে। কিন্তু মুসলিম দার্শনিকরা অস্তিত্ব মূল বা বস্তুসত্তা মূল শুধু বিশেষ ক্ষেত্রেই বলেন না বরং তারা সকল বস্তুর ক্ষেত্রেই এ আলোচনাটি করে থাকেন। তাদের দৃষ্টিতে অস্তিত্বই মূল বিষয়টি ভিন্ন একটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু মানুষ যে বিশেষ কোন প্রকৃতির অধিকারী নয় বলে অন্যান্য অস্তিত্ববান প্রাণী ও বস্তু হতে ভিন্ন এবং নিজেই নিজের প্রকৃতির নির্ধারক- ইসলামী দর্শনে এ বিষয়টি আরো জোরালো যুক্তিতে উপস্থাপিত হয়েছে,২৬১ অবশ্য ভিন্নভাবে ও ভিন্ন পরিভাষায়। বিশেষত সাদরুল মুতাআল্লেহীনের দর্শনে বিষয়টি অত্যন্ত সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।

অস্তিত্ববাদীরা ভিন্নভাবে বিষয়টি প্রমাণ করলেও এ কথাটি সত্য ও সঠিক যে,মানুষের নির্দিষ্ট কোন প্রকৃতি নেই,বরং সে প্রকৃতি অর্জন করে নিজ প্রচেষ্টায়।

আমাদের ধর্মে পূর্ববর্তী জাতিতে রূপান্তর,বর্তমান সময়ের মানুষের চারিত্রিক দিক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এবং কিয়ামতে মানুষের পুনরুত্থানের আলোচনায় বলেছে,সে দিন মানুষ বিভিন্নরূপে পুনরুত্থিত হবে। তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকই মানুষরূপে পুনরুত্থিত হবে এবং অধিকাংশই বিভিন্ন পশুর আকৃতিতে পুনরুত্থিত হবে। এ বিষয়গুলো এ কথাকে সত্য বলে প্রমাণ করে। যদিও সকল মানুষ ফিতরাতের উপর জন্মগ্রহণ করেছে অর্থাৎ মানুষ হওয়ার যোগ্যতা ও প্রতিভা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে,তদুপরি তার জীবনের প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়ে সে অমানুষে পরিণত হতে পারে। এটা বাস্তব। (এ বিষয়টি নবীনরা অন্যভাবে অনুধাবন করেছে যদিও তা অনেক প্রাচীন। আমি এ বিষয়ে এখানে বেশি আলোচনা করতে চাচ্ছি না।)

যা হোক মানুষ যে স্বাধীন ও দায়িত্বসম্পন্ন প্রাণী হিসেবে সৃষ্ট- এ মতবাদের এ কথাটি ঠিক। আপনারা জানেন,মুসলমানদের মধ্যে দু দল ভিন্নমুখী দু টি বিশ্বাসের অধিকারী ছিল। আশাআরীরা জাবর বা বাধ্যতায় এবং মু তাযিলারা সম্পূর্ণ স্বাধীনতায় বিশ্বাস করত। শিয়া এ দু য়ের মধ্যপন্থায় বিশ্বাসী। তারা আশাআরীদের মতো সম্পূর্ণ বাধ্যতায় বা মু তাযিলাদের ন্যায় পূর্ণ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী নয়। অস্তিত্ববাদীরা যা বলে তা মূলত মুতাযিলাদের সম্পূর্ণরূপে দায়িত্ব হস্তান্তর বা পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদানের ধারণারই রূপ। ইসলামের মধ্যে পূর্ণ স্বাধীনতা নয়,তবে অবশ্যই স্বাধীনতা রয়েছে,যেমনটি ইমামদের হতে বর্ণিত হয়েছে-

 لا جبر و لا تفویض بل أمر بین أمرین অর্থাৎ বাধ্যতাও নয়,পূর্ণ স্বাধীনতাও নয়,বরং এ দু য়ের মাঝামাঝি। বর্তমানে বস্তুবাদীরা মূলত বাধ্যতায় বিশ্বাস করে অস্তিত্ববাদীদের পূর্ণ স্বাধীনতার বিশ্বাসের বিপরীতে। কিন্তু ইসলাম মধ্যপন্থায় বিশ্বাসী। মানুষের সে পর্যন্ত স্বাধীনতা রয়েছে যাতে সে বাধ্যতায় পতিত না হয়,কিন্তু এর অর্থ পূর্ণ স্বাধীনতা নয়। মানুষ অন্যান্য প্রাণীর বিপরীতে বিশেষ প্রকৃতির অধিকারী নয় বরং তার প্রকৃতি পরিবর্তনশীল বিধায় বিশেষ প্রকৃতি সে অর্জন করতে পারে- এ কথাটি খুবই সত্য।

মানুষের নির্ভরতা ও বিভিন্ন সত্তার সঙ্গে সংযুক্ততার ফল

এ মতবাদ মানুষের স্বাধীনতার বিষয়ে অন্য একটি তত্ত্বেও বিশ্বাসী। সেটা হচ্ছে নির্ভরতা ও সংযুক্ততার ফল। তারা প্রথমে স্বাধীনতাকে দার্শনিক যুক্তিতে উপস্থাপন করে বলেন,মানুষ স্বাধীনরূপে সৃষ্টি হয়েছে,এমনকি সে নিজের প্রকৃতি নিজেই গঠন করতে পারে। অতঃপর তারা বলেন,যা কিছু মানুষের স্বাধীনতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও এর বিরোধী তা মানুষকে মনুষ্যত্ব হতে দূরে নিক্ষেপ করে ও মানবতার সঙ্গে অপরিচিত করে তোলে।

মানুষ সত্তাগতভাবেই স্বাধীন হিসেবে সৃষ্ট হয়েছে। কোন কোন সময় কিছু প্রভাবক,যেমন কোন কিছুর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা মানুষের স্বাধীনতাকে হরণ করে। এ মতবাদের মতে মানুষ যদি কোন কিছুর সাথে সম্পর্কিত হওয়ার মাধ্যমে তার কাছে দায়বদ্ধ বা তার দাস ও অনুগত হয়ে পড়ে,তবে সে মনুষ্যত্বের সীমা হতে বেড়িয়ে পড়ে। কারণ সে তার স্বাধীনতাকে হারিয়েছে। যেহেতু মানুষ মুক্ত-স্বাধীন এক অস্তিত্ব সেহেতু যে কোন কিছুর অধীন হওয়ার অর্থ স্বাধীনতা বর্জিত হওয়া। 

মানুষ কোন কিছুর সংশ্লিষ্টতা বা অধীনতাকে মেনে নিলে কয়েকটি বিষয় উদ্ভূত হয়। প্রথমত মানুষ যখন কোন বস্তুর,যেমন অর্থের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে তখন অর্থ তার জীবনে প্রথম ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় এবং মানুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করে তার নিজ সত্তা হতে অসচেতন করে তোলে। বস্তু সংশ্লিষ্টতা মানুষের স্বাধীনতা হরণ করে। বস্তু আসক্তি মানুষকে তার সত্তা সম্পর্কে অসচেতন করে ফেলে। তাই সে নিজ সম্পর্কে চিন্তা করে না,বরং ঐ বস্তুর চিন্তায় নিমগ্ন হয়,সে আত্ম সচেতন সত্তা হতে আত্মবিস্মৃত ও অসেচতন সত্তায় পরিণত হয় এবং এটা মনুষ্যত্বের স্খলন। মানুষ তৎসংশ্লিষ্ট বস্তু সম্পর্কে নিখুত তথ্য প্রদানে সক্ষম হলেও নিজের সম্পর্কে অসচেতনতার কারণে আপনসত্তা সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রদানে অক্ষম।

দ্বিতীয়ত এ সংশ্লিষ্টতা মানুষকে মানবীয় মূল্যবোধ হতে দূরে নিক্ষেপ করে এবং সে ঐ সংশ্লিষ্ট বস্তু বা বিষয়ের মূল্য সংরক্ষণে নিয়োজিত হয়। অর্থলোলুপ কোন ব্যক্তির নিকট মানবীয় মূল্যবোধ সমূহের কোন গুরুত্ব নেই এবং প্রকৃতপক্ষে তার নিকট তার নিজেরই কোন মূল্য নেই। আত্মসম্মান ও মর্যাদাতার চিন্তায় কোন ভূমিকা রাখে না। মুক্তি ও স্বাধীনতার ধারণা তার মনে কোন রেখাপাত করে না,তার চিন্তায় একমাত্র উপাস্য বস্তু ঐ অর্থ। অর্থাৎ অর্থের মূল্য তার নিকট গুরুত্ব পেলেও নিজস্ব মূল্যবোধগুলো তার নিকট গুরুত্ব রাখে না। এ মূল্যবোধগুলো তার নিকট মৃত এবং ঐ বস্তুর মূল্য তার নিকট জীবন্ত হয়ে উঠে।

তৃতীয়ত বস্তু সংশ্লিষ্টতা মানুষকে ঐ বস্তুর দাসে পরিণত করে তার হাতে বন্দি করে ফেলে। ঐ বস্তুর সাথে যেহেতু সে আবদ্ধ সেহেতু তার উন্নয়নের পথ বাঁধাগ্রস্ত। যেমন কোন প্রাণী একটি খুটি বা বৃক্ষের সঙ্গে রশি দিয়ে বাঁধা থাকলে তার স্থানান্তরের পরিধি সীমিত হয়ে পড়ে বা একটি মোটরগাড়ি শৃঙ্খলাবদ্ধ হলে তার গতি ব্যাহত হয় তেমনি বস্তু সংশ্লিষ্টতা মানুষের পূর্ণতার পথের গতিকে রুদ্ধ করে দেয়,তার গতি কে স্থিতি তে পরিণত করে। দার্শনিক পরিভাষায় তার সাইরুরাত লা সাইরুরাত এ কখনো কখনো কাইলুনাত বা স্থবিরতায় পর্যবসিত হয়।এ

মতবাদ অনুসারে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের ধারণা

সুতরাং আমরা জানলাম,এ মতবাদের দৃষ্টিতে মানবের প্রকৃত সত্তা হলো তার স্বাধীনতাবোধ। অন্যভাবে বললে,সকল মানবীয় মূল্যবোধের মাতা ও প্রাণ হলো স্বাধীনতা। মানুষ যদি তার মনুষ্যত্বকে সংরক্ষণ করতে চায়,তবে অবশ্যই তাকে তার স্বাধীনতাকে সংরক্ষণ করতে হবে। আর স্বাধীনতা সংরক্ষণের জন্য তাকে পূর্ণিমার চাঁদের রূপে মুগ্ধ হওয়া বা প্রেমের দাসে পরিণত হওয়া চলবে না।

এ বিশ্ব-পুষ্পোদ্যানে একটি ফুলই যথেষ্ট আমার জন্য

ঐ ঘাসে ঘেরা দেবদারুর একটু ছায়াই আমার কাম্য

হে খোদা! তোমার গৃহ হতে আমায় পাঠিয়ো না বেহেশতে

তোমার গৃহে আশ্রয় লাভ অধিক আকাঙ্ক্ষার এ বিশ্ব হতে।

এ মতবাদের দৃষ্টিতে মানুষকে পূর্ণ ও নিরঙ্কুশ মুক্ত ও স্বাধীন হতে হবে। এ ক্ষেত্রে এ মতবাদ সম্পূর্ণরূপে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের বিপরীতে অবস্থান করছে যদিও তারা উভয়েই আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাসী নয়। অস্তিত্ববাদীদের মতে দু টি কারণে আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস তাদের চিন্তার পরিপন্থী; প্রথমত আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করলে আমাদের ভাগ্যে (قضا و قدر ) বিশ্বাস করতে হবে। আর ভাগ্যে বিশ্বাস অর্থ মানুষের স্থির প্রকৃতি বা বাধ্যবাধকতায় (جبر ) বিশ্বাস। যদি আল্লাহর অস্তিত্ব থাকে,তবে মানুষকে ঐ আল্লাহর জ্ঞানে বিশেষ প্রকৃতির অধিকারী হতে হবে অর্থাৎ সে আর অনির্দিষ্ট প্রকৃতির থাকছে না আবার আল্লাহর অস্তিত্বের কারণে মানুষের উপর ভাগ্যের বাধ্যবাধকতা চলে আসে এবং তার কোন স্বাধীনতা থাকে না। সুতরাং আমরা যখন স্বাধীনতাকে গ্রহণ করেছি তখন আল্লাহর অস্তিত্বকে গ্রহণ করতে পারি না।

দ্বিতীয়ত আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস শুধু আমাদের স্বাধীনতা হরণ করে না,বরং তার প্রতি বিশ্বাস অর্থ একই সাথে তার সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া এবং যে কোন রকম সংশ্লিষ্টতা বা সংযুক্তিই স্বাধীনতা বিরোধী। বিশেষত আল্লাহ্ সংশ্লিষ্টতা অন্য সকল সংযুক্তি হতে উচ্চ পর্যায়ের সংশ্লিষ্টতা। কবির ভাষায়-

আমি তোমার সঙ্গে আবদ্ধ তাই সব আবদ্ধতা হতে মুক্ত

আমি তোমার চুক্তিতে আবদ্ধ তাই তা ভঙ্গের আশংকামুক্ত।

যদি কেউ আল্লাহর সঙ্গে আবদ্ধ হয়,তবে তা কখনই বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়। তাই এ মতবাদ এ আবদ্ধতাকে অস্বীকার করে।

এ মতবাদ সম্পর্কে দু টি দৃষ্টিকোণ হতে আলোচনা করা যেতে পারে। প্রথমত এ মতবাদের বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্বাধীনতা পরিপন্থী যা একটি ভ্রান্ত ধারণা। আমার বস্তুবাদের প্রতি ঝুকে পড়ার কারণসমূহ এবং মানুষ ও তার ভাগ্য নামক গ্রন্থ দু টিতে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা প্রদান করে বলেছি যে,বিষয়টি এরূপ নয়,যা তারা ধারণা করেন। কাযা ও কাদর বা ভাগ্যসম্পর্কে তাদের ধারণা বৃদ্ধা মহিলাদের ধারণার মতো। এরা কাযা ও কাদর বোঝেননি। নতুবা ইসলামী দৃষ্টিকোণে কাযা ও কাদরের বিষয়টি এমনরূপে রয়েছে যা মানুষের স্বাধীনতার পরিপন্থী নয়। যা হোক এটা আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। বরং এখানে আমাদের আলোচ্য বিষয় দ্বিতীয় দিকটি নিয়ে যেখানে তারা বলছেন,যে কোন বস্তুর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা স্বাধীনতা বিরোধী,এমনকি যদি সে সংশ্লিষ্টতা আল্লাহর সঙ্গেও হয়। এখানে এ বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনা করব।

পূর্ণতা হলো নিজ হতে নিজ’- এর দিকে যাত্রা

আপনারা এমন কোন অস্তিত্বের কথা চিন্তা করুন যা পূর্ণতার পথ অতিক্রম করছে। একটি ফুলগাছ ভূমি হতে অঙ্কুরিত হয়ে অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করে তবেই পূর্ণতায় পৌছায়। একটি প্রাণীর জননকোষ উৎপত্তি হতে পূর্ণতায় পৌছা পর্যন্ত অর্থাৎ দুর্বল একটি অস্তিত্ব হতে পূর্ণ ও সবল অস্তিত্বে পরিণত হওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন অবস্থা অতিক্রম করে। এ বৃক্ষ বা প্রাণী কোন্ অবস্থা হতে কোন্ অবস্থার দিকে যাত্রা করে? সে কি নিজ হতে অপর -এর দিকে যাত্রা করে? অর্থাৎ সে কি নিজ হতে আগন্তুক -এ পরিণত হয়,নাকি অন্য হতে অন্য -তে পরিণত হয় নাকি তার এ যাত্রা নিজ হতে নিজ -এর দিকে যাত্রা?

যদি বলি,সে নিজ হতে আগন্তুক -এ পরিণত হচ্ছে,তবে বলতে হবে যতক্ষণ সে পরিবৃদ্ধি অর্জন করেনি ততক্ষণ তার স্বসত্তা বহাল ছিল। যখন পরিবৃদ্ধি অর্জন শুরু করল তখনই স্বসত্তা হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। পূর্ববর্তী দার্শনিকদের অনেকেই বলেছেন,পরিবর্তন ভিন্নসত্তার জন্ম দেয় অর্থাৎ পরিবর্তনর্’‘ ভিন্নসত্তা য় রূপান্তরের শামিল যদিও কথাটি সত্য নয়।

বরং সত্য হলো একটি ফুল গাছের বীজ বা মানুষের জননকোষ প্রথম মুহূর্ত হতে যাত্রা করেূ পূর্ণতায় পৌছা পর্যন্ত যে ধাপগুলো অতিক্রম করে তার সবই নিজ হতে নিজ -এর দিকেই যাত্রা অর্থাৎ সেই সত্তারই পরিবর্ধিত রূপ সে লাভ করে। একই সত্তা তার প্রথম,মধ্যবর্তী ও শেষ পর্যায়ে বিদ্যমান রয়েছে। যতই সে পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হয় ততই সে স্বকীয় মূল সত্তা লাভ করে। সে অপূর্ণ স্বসত্তা হতে পূর্ণ স্বসত্তার দিকে যাত্রা করে। এই বৃক্ষটি আত্মসচেতনতা ব্যতিরেকেই তার পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যায়। যদি বৃক্ষটি আত্মবোধ সম্পন্ন হতো,তবে নিশ্চয়ই তার মধ্যে পূর্ণতার প্রতি আকর্ষণ থাকত। সকল সৃষ্টিই সহজাতভাবে পূর্ণতার আকাঙ্ক্ষী। বৃক্ষও তার পূর্ণতার প্রতি আসক্ত,এমনকি কারো কারো মতে প্রাণহীন বস্তুসমূহও পূর্ণতার আকাঙ্ক্ষী। সকলেই তার নিজস্ব চূড়ান্ত পূর্ণতার প্রত্যাশী।

সুতরাং কোন বস্তুর নিজ পূর্ণতার প্রতি সংলগ্নতা ও সম্পর্ক সারটারের দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে ভিন্ন সত্তায় পরিণত হওয়া নয় বরং স্বকীয় সত্তার বিকাশ ও পূর্ণতা যা তাকে অধিক নিজ সত্তার দিকে পরিচালিত করে। যদি মানুষের স্বাধীনতা এমন হয় যে,সে নিজ চূড়ান্ত লক্ষ্য ও পূর্ণতা হতেও স্বাধীন হতে চায়,তবে এ স্বাধীনতাই তাকে নিজের নিকট আগন্তুক করে তোলে ও ভিন্ন সত্তায় পরিণত করে এবং এ ধরনের স্বাধীনতা মানুষের পূর্ণতার পরিপন্থী। স্বাধীনতার অর্থ যদি এতটা ব্যাপক হয় যে,মানুষের পূর্ণতা হতেও স্বাধীন হওয়া বুঝায়,তবে এর অর্থ দাঁড়াবে মানুষের অপূর্ণ সত্তা তার পূর্ণসত্তা হতেও পূর্ণতর। তাই আমাদের দেখতে হবে এ স্বাধীনতা আমাদের আপন সত্তা হতে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে নাকি এ বস্তু সংশ্লিষ্টতা?

এ মতবাদে ভিন্ন সত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ও আপন সত্তার পূর্ণতর রূপের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার মধ্যে পার্থক্য করা হয়নি। আমরাও এটা বিশ্বাস করি যে,ভিন্ন সত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা মানুষের সত্তার পরিবর্তন ও রূপান্তর ঘটায়। আমরা যদি দেখি কেন সকল ধর্মই মানুষকে দুনিয়ার প্রতি আসক্ত হতে নিষেধ করেছে? এ কারণে যে,বস্তুবাদিতা ও দুনিয়া প্রেম ভিন্ন সত্তার প্রতিই প্রেম যা তার মানবীয় মূল্যবোধের ধ্বংস সাধন করে। কিন্তু যে বিষয়টি মানুষের পূর্ণতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তা কোন অপরিচিত ও ভিন্ন সত্তা নয়,বরং তা তার স্বকীয় সত্তা এবং স্বসত্তার প্রতিই আসক্তি। এ সংশ্লিষ্টতা মানুষকে আত্মবিস্মৃত ও অসচেতন করে না। স্বসত্তা প্রীতি স্থবিরতা নয়,গতি স্থিতিতে পরিণত হওয়াও নয় যে,বলা যাবে সে আপন মূল্যবোধকে হারিয়েছে,বরং এটা তার পূর্ণতার প্রতি আসক্তি ও সংশ্লিষ্টতা যা তাকে গতি দান করে ও চূড়ান্ত পূর্ণতার দিকে পরিচালিত করে।

স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ মতবাদের ভুল ধারণা

সারটারকে বলতে চাই,দু ভাবে আমরা বলতে পারি স্রষ্টা তার সৃষ্টি হতে ভিন্ন নয়। প্রথমত আল্লাহর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ভিন্ন সত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা নয় যে,এ সম্পর্ক তার সত্তাকে ভুলিয়ে দেবে। কারণ যে কোন বস্তুর স্রষ্টা যা কর্তৃকারণ বা উৎপত্তি দানকারী কর্তা তা ঐ বস্তুসত্তা হতেও ঐ বস্তুর নিকটবর্তী। ঐ বস্তুর সত্তাটি অস্তিত্বগতভাবেই তার স্রষ্টার উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল এবং তার অস্তিত্বে টিকে থাকাও তদ্রূপ। ইসলামী দর্শন অত্যন্ত বলিষ্ঠ যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে বিষয়টি প্রমাণ করেছে।

কোরআন বলছে,وَنَحْنُ أَقْرَ‌بُ إِلَيْهِ مِنكُمْ وَلَـٰكِن আমরা তোমাদের হতেও তার নিকটবর্তী। (সূরা ওয়াকেয়াহ্ : ৮৫) তোমাদের নিজ হতে তোমাদের সত্তা সম্পর্কে আমরা অধিক অবগতই শুধু নই,বরং আমাদের সত্তা তোমাদের সত্তা হতে তোমাদের অধিক নিকটবর্তী। কোরআনের এ কথাটি খুবই অর্থবহ ও আশ্চর্যজনক। সকলেই বলে,আমিই আমার সত্তার সর্বাধিক নিকট,কিন্তু কোরআন বলছে,আল্লাহ সকল বস্তুর সত্তা হতে ঐ বস্তুর অধিক নিকটে। সুতরাং আল্লাহ্ সকল বস্তুসত্তা হতে ঐ বস্তুর জন্য অধিকতর আপন সত্তা সংশ্লিষ্ট। অবশ্য এ বিষয়টি বুঝা বেশ কঠিন ও উচ্চতর দার্শনিক প্রাজ্ঞজনোচিত।(ইসলাম যে কথা বলেছে মানবিক জ্ঞান সে স্থানে আরো সহস্র বছরেও পৌছতে পারবে না।) হযরত আলী (আ.) বলেছেন,

داخل فی الأشیاء لا بالممازجة، خارج عن الأشیاء لا بالمباینة

আল্লাহ্ ঐ বস্তুসত্তার বাইরে নন এবং তা হতে পৃথক নন,তবে ঐ বস্তুসত্তার অভ্যন্তরেও তার অবস্থান নয় যে,বলা যাবে তার সঙ্গে মিশ্রিত لیس فی الأشیاء بوالج و ما منها بخارج (নাহজুল বালাগাহ্,খুতবা নং ১৮৪)

দ্বিতীয়ত কোরআন যে বলছে মানুষকে অবশ্যই আল্লাহর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রাখতে হবে এর কারণ সে আল্লাহকে মানুষের পূর্ণতার সর্বশেষ গন্তব্য বলে জানে এবং তার যাত্রা আল্লাহর দিকেই বলে মনে করে। সুতরাং আল্লাহর প্রতি মনোযোগ ও আকর্ষণ মূলত তার আপন সত্তার পূর্ণতার দিকেই মনোযোগ ও আকর্ষণ। একটি বীজের পূর্ণ বৃক্ষ হওয়ার আসক্তি যেরূপ এটাও সেরূপ। আল্লাহর দিকে মানুষের যাত্রা তার নিজ সত্তার দিকেই যাত্রা এবং অপূর্ণ আপন সত্তা হতে পূর্ণ আপন সত্তার দিকেই পদক্ষেপ।

তাই যারা আল্লাহকে অন্য বস্তুর সঙ্গে তুলনা করেছে তারা ভুল করে ভেবেছে যে,আল্লাহর প্রতি আকর্ষণ নিজ মূল্যবোধকে বিস্মৃত হওয়া ও স্থবিরতার শামিল।