ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল 11%

ইনসানে কামেল লেখক:
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

ইনসানে কামেল
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 83 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 42391 / ডাউনলোড: 7058
সাইজ সাইজ সাইজ
ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

9

আত্মসচেতনতা খোদা সচেতনতা

আল্লাহ্ মানুষের এত নিকটবর্তী যে,মানুষের আল্লাহ্ সচেতনতা আত্মসচেতনতা একই বস্তু। যখন মানুষ আত্মসচেতন হবে তখন সে খোদা সচেতন না হয়ে পারে না। এটা অসম্ভব যে,মানুষ আত্মসচেতন হবে,অথচ খোদা সচেতন হবে না। কোরআন বলছে,

( وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ نَسُوا اللَّـهَ فَأَنسَاهُمْ أَنفُسَهُمْ أُولَـٰئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ )

তোমরা তাদের মতো হয়ো না যারা আল্লাহকে ভুলে গিয়েছে আর তাই আল্লাহ্ তাদের আত্মবিস্মৃত করে দিয়েছেন,তারাই অবাধ্য।

যে কেউ আল্লাহকে ভুলে গেছে সে কার্যত নিজেকেই ভুলে গেছে। মানুষ তখনই নিজেকে ফিরে পাবে যখন তার স্রষ্টাকে ফিরে পাবে। যদি মানুষ তার স্রষ্টাকে ভুলে যায় তাহলে সে তার সত্তাকেই ভুলে যায়। তাই কোরআন অস্তিত্ববাদীদের বিপরীত কথা বলে। তারা বলে,যদি মানুষ খোদা সচেতন হয় তবে সে আত্মবিস্মৃত হয়। আর কোরআন বলে,মানুষ তখনই আত্মসচেতন হতে পারে যখন সে খোদাসচেতন হয়। এটা মানবিকতার সর্বোচ্চ মর্যাদার যথার্থ ব্যাখ্যা যা কোরআন আশ্চর্যজনকভাবে বর্ণনা করেছে।

কোরআন বলছে,মানুষ কখনো কখনো নিজেকেই হারিয়ে ফেলে অর্থাৎ তার সত্তাই পরাজিত হয়। সে বলছে,সবচেয়ে বড় পরাজয় এটা নয় যে,মানুষ অর্থ বা সম্পদ হারায়,এমনকি যে ব্যক্তি তার স্বাধীনতা হারিয়ে অন্যের দাসে পরিণত হয় বা তার নীতি ও পবিত্রতা বিসর্জন দেয় তার পরাজয়ও বড় পরাজয় নয়,বরং বড় পরাজয় হলো মানুষের তার সত্তাকে হারানো। যখন মানুষ নিজেকে হারিয়ে ফেলে তখন সে সব কিছুকেই হারিয়েছে। আর যখন সে নিজেকে খুজে পায় তখন সে সব কিছুকেই অর্জন করে।

ইবাদতের দর্শন কি? ইবাদতের দর্শন হচ্ছে মানুষ আল্লাহকে অর্জনের মাধ্যমে নিজেকে অর্জন করবে। এ দর্শন আত্মসত্তা অর্জন ও প্রকৃত আত্মসচেতনতা লাভের দর্শন যে অর্থ কোরআন বর্ণনা করেছে এবং ইসলামী মতাদর্শের অনুসারী ব্যতীত অন্য কেউ তা অর্জনে সক্ষম হয়নি। কখনো একজন মহিউদ্দিন আরাবীর জন্ম হয় এবং তিনি মানুষের আত্মসচেতনতার বিষয়টির ব্যাখ্যা প্রদান করেন। পরবর্তীতে তার ছাত্রদের মধ্য থেকে মাওলানা রুমীর মতো ব্যক্তিদের আবির্ভাব ঘটে যারা কোরআন অবতীর্ণের ছয়শ বছর পর কোরআন হতে এ বিষয়টির ব্যাখ্যা প্রদানে সক্ষম হন। যদিও তারা কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার ছয়শ বছর পর এসেছেন,কিন্তু বর্তমান দার্শনিকদের হতে সাতশ বছর পূর্বে এ ব্যাখ্যা প্রদানের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। মাওলানা রুমী মানুষের আত্মসচেতনতা যে খোদা সচেতনতা হতে ভিন্ন নয় তা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন,

আত্মসচেতনতা তাই প্রাণের দাবি জেনো হে পথিক

সেই প্রাণ শক্তিশালী যার আত্মসচেতনতা ততোধিক।

মাওলানা রুমী প্রাণকে আত্মসচেতনতার সমার্থক বলে উল্লেখ করে বলছেন,যে যত আত্মসচেতন সে তত শক্তিশালী। মানুষের প্রাণ অন্যান্য প্রাণী হতে শক্তিশালী। কারণ তার আত্মসচেনতা তাদের হতে অধিক। অতঃপর তিনি আরো গভীরে প্রবেশ করে বলেছেন,মানুষ তখনই আত্মসচেতন হতে পারে যখন সে খোদা সচেতন হয়।

সুতরাং যারা মনে করছেন,যে কোন বস্তুসংশ্লিষ্টতা স্বাধীনতা পরিপন্থী তাদের বলছি,হ্যাঁ,যে কোন বস্তু সংশ্লিষ্টতা স্বাধীনতার অন্তরায় একমাত্র খোদা সংশ্লিষ্টতা ব্যতীত। কারণ খোদা সংশ্লিষ্টতা আত্মসংশ্লিষ্টতার পূর্ণতর রূপ। আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক ব্যতীত স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়। সুতরাং খোদা সচেতনতা অপরিহার্যরূপে আত্মসচেতনতার সর্বোচ্চ পর্যায়। মানুষ তার একাকিত্ব ও ইবাদতে যতবেশি আল্লাহর প্রতি মনোযোগী হবে ও তাকে স্মরণ করবে তত বেশি সে নিজেকে চিনতে পারবে।

অনেক মহৎ ব্যক্তিবর্গ এ পথেই আধ্যাত্মিক আত্মসচেতনতার উচ্চতর পর্যায়ে পৌছে ছিলেন। প্রায় পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে একজন মহান ব্যক্তি যিনি একজন বড় মুজতাহিদ ও নাজাফ হতে শিক্ষা লাভ করেছিলেন এবং একজন শরীয়ত বিশারদ আরেফও ছিলেন তিনি হলেন মির্জা জাওয়াদ মেলকি তাবরীজী। তিনি মরহুম হোসেইন কুলি হামেদানির ছাত্র। তিনি কোমের অধিবাসী ও প্রায় পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে ইন্তেকাল করেন। তার লিখিত গ্রন্থগুলোতে যেখানে তিনি নিজ আত্মসচেতনতার বিবরণ দিয়েছেন সেখানে আধ্যাত্মিক আত্মসচেতনার আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন,মানুষ নিজ সত্তাকে অনুধাবন করতে পারে এবং তিনি আরো উল্লেখ করেছেন,তিনি এমন ব্যক্তিকে চেনেন যিনি স্বপ্নে আত্মসচেতনতাকে অনুধাবন করে জাগরিত হওয়ার পরও আত্ম অভ্যন্তরে তার রেশ অব্যাহতভাবে অনুভব করেন (তিনি নিজেই সে ব্যক্তি,অথচ বলেননি)। এই আত্মসচেতনতা প্রকৃত অর্থে খোদাসচেতনতার একটি শাখা এবং এটা প্রকৃত ইবাদত ছাড়া অর্জন করা সম্ভব নয়। একজন মনোবিজ্ঞানী সহস্র বছর মনোগবেষণা চালিয়েও এ প্রকৃত আত্মসচেতনতায় পৌছতে পারে না। হযরত আলীর একটি বাণী অত্যন্ত আশ্চর্যজনক। তিনি বলেছেন,

عجبت لمن ینشد ضالته و قد أضلّ نفسه فلا یطلبها

আমি ঐ ব্যক্তি হতে আশ্চর্য বোধ করি যে কোন সম্পদ হারিয়ে ফেললে তা পাওয়ার জন্য সর্বক্ষণ ব্যতিব্যস্ত থাকে,অথচ নিজ সত্তাকে হারিয়ে ফেললেও তার সন্ধান করে না।

কেন সে নিজেকে খোঁজে না? হে মানব! তুমি জান না তুমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছ। যাও নিজেকে সন্ধান কর। কারণ তোমার সত্তা হারিয়ে যাওয়া সকল বস্তু হতে অধিক মূল্যবান।

কয়েকটি সমস্যার জবাব

আল্লাহর প্রতি ঈমান মানবীয় মূল্যবোধের বিস্মৃতির কারণ- এ কথার জবাবে বলতে চাই,ভিন্ন সত্তার মাঝে হারিয়ে যাওয়া মানুষের প্রকৃত মূল্যবোধগুলোকে ভুলে যাওয়ার কারণ,এটা ঠিক। কিন্তু যা আপন সত্তারই পূর্ণতম রূপ তা মানুষের মাঝে মানবীয় মূল্যবোধের অধিকতর বিকাশের সহায়ক উপাদান। এ কারণেই যে সকল ব্যক্তি ইবাদতের পথে উচ্চ পর্যায়ে পৌছেন,তাদের মাঝে সকল মানবীয় মূল্যবোধ শক্তিশালী হয়ে উঠে। তাদের বুদ্ধিবৃত্তি আরো ধারালো,তাদের ভালোবাসা গভীরতর,মানসিক শক্তি আরো উন্নত,আত্মসম্মানবোধ আরো তীক্ষ্ণ এবং তাদের মানুষের মাঝে বসবাসের ক্ষমতা অধিকতর হয়। কারণ এ সকল বিষয় পরম সত্তা অর্থাৎ আল্লাহর গুণেরই প্রকাশ।

খোদা সম্পৃক্ততা মানবীয় বিকাশের প্রতিবন্ধক- এ কথার জবাবে বলব,তারা মনে করেছেন,আল্লাহ্ একটি বৃক্ষের মতো,তাই যদি আল্লাহর সাথে কেউ সম্পৃক্ত হয় সে কোন সসীম বস্তুর দ্বারা সীমিত হয়ে পড়েছে ফলে তার গতিসীমা রুদ্ধ হয়েছে। অস্তিত্ববাদীদের বলব,আল্লাহ্ হচ্ছেন অপরিসীম প্রকৃত সত্তা। কখনো মানুষ একটি সীমিত ক্ষেত্রে,উদাহরণস্বরূপ একশ বর্গকিলোমিটারে বন্দি হয়ে রয়েছে- এটা মানুষের জন্য সীমাবদ্ধতা। কারণ সে বলতে পারে,আমি যে সীমাকে অতিক্রম করেছি তার শেষে সীমার প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। কিন্তু যদি মানুষকে কোন সীমাহীন ক্ষেত্রে বন্দি করা হয়,তবে তাকে পরিসীমিত করা হয়নি,কারণ সীমাহীন ক্ষেত্র গতিরুদ্ধ নয়। অর্থাৎ হে মানব! তুমি যদি অসীমের দিকে যাত্রা কর,তবেই পূর্ণতায় পৌছবে। আল্লাহ্ এক অপরিসীম সত্তা। তাই পূর্ণতম মানুষ যিনি শেষ নবী (সা.) তিনিও যদি অনন্তকাল অগ্রসর হতে থাকেন তার যাত্রা শেষ হবে না।আল্লাহ্ এমন এক অস্তিত্ব যার শেষ সীমা নেই। তাই মানুষের পূর্ণতার ক্ষেত্রে একমাত্র অসীম যাত্রাপথ হলো তার দিকে যাত্রা।

আলেমদের মধ্যে এ বিষয়ে আলোচনা রয়েছে যে,আমরা যে নবীর উপর দরুদ ও সালাওয়াত পড়ি- এর অর্থ কি এবং আল্লাহর নিকট নবীর জন্য রহমত ও কল্যাণ কামনার কি প্রভাব রয়েছে? কেউ কেউ বলেন,প্রকৃতপক্ষে পূর্ণ মানব নবীর জন্য রহমতের প্রার্থনা এ জন্য যে,নবী প্রতি মুহূর্তে গমনাবস্থায় রয়েছেন। অনন্তকাল তিনি এক অসীম লক্ষ্যের দিকে গতিশীল রয়েছেন। সুতরাং পরম প্রভুর সঙ্গে সম্পৃক্ততা মানুষের গতি স্থবিরতায় পর্যবসিত হওয়া নয়।

লক্ষ্যের পূর্ণতা ও মাধ্যমের পূর্ণতা

অস্তিত্ববাদীরা লক্ষ্য এবং মাধ্যমের মধ্যে একটি ভুল করেছেন। স্বাধীনতা মানুষের জন্য একটি পূর্ণতা। কিন্তু স্বাধীনতা মাধ্যমগত পূর্ণতা,লক্ষগত পূর্ণতা নয়। মানুষের লক্ষ্য স্বাধীন হওয়া নয়,কিন্তু তাকে স্বাধীন হতে হবে এজন্য যে,যাতে সে পূর্ণতায় পৌছতে পারে। যেহেতু স্বাধীনতা অর্থ পথ নির্বাচনের অধিকার এবং অস্তিত্বশীল প্রাণীদের মধ্যে মানুষ একমাত্র স্বাধীন অস্তিত্ব,বিধায় তাকে নিজের পথ নিজেই নির্বাচন করতে হবে। অন্যভাবে বলা যায়,মানুষকে নিজ হতেই নিজেকে খুজতে হবে।

মানুষ মুক্ত ও স্বাধীন,কিন্তু মানুষ স্বাধীন বলেই পূর্ণতায় পৌছেছে নাকি পূর্ণতার পথকে নির্বাচনের অধিকার লাভ করেছে এজন্য যে,যাতে পূর্ণতায় পৌছতে পারে। মানুষ স্বাধীনতার মাধ্যমে পূর্ণতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছতে পারে আবার এর মাধ্যমে সর্বনিম্ন পর্যায়েও নেমে যেতে পারে।

স্বাধীন অস্তিত্ব সেই অস্তিত্ব যার নিয়ন্ত্রণ-রজ্জু তার হাতে দেয়া হয়েছে। তাকে বলা হয়েছে,হে মানব! তুমি পূর্ণতাপ্রাপ্ত অস্তিত্ব,তুমি প্রকৃতি ও অস্তিত্ব জগৎ সম্পর্কে জ্ঞাত,তুমি ব্যতীত অন্য সকল অস্তিত্ব অপূর্ণ ও নিয়ন্ত্রিত।

( إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيلَ إِمَّا شَاكِرً‌ا وَإِمَّا كَفُورً‌ا )

আমরা পথ প্রদর্শন করেছি,হয় সে শোকর গুজার ও কৃতজ্ঞ হবে নতুবা অকৃতজ্ঞ। আমরা তোমাকে পথ প্রদর্শন করেছি কিন্তু তোমার নিজেকেই এ পথ নির্বাচন করতে হবে।

স্বাধীনতা স্বয়ং মানুষের পূর্ণতা নয়,বরং মানুষের পূর্ণতার মাধ্যম। অর্থাৎ মানুষ স্বাধীন না হলে পূর্ণতায় পৌছতে সক্ষম হতো না। কারণ বাধ্যতার মধ্য দিয়ে পূর্ণতা অর্জন সম্ভব নয়। তাই স্বাধীনতা মাধ্যমগত পূর্ণতা,লক্ষগত নয়।

স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বিরুদ্ধবাদিতাও আনুগত্যের ন্যায়। যেহেতু মানুষ স্বাধীন সেহেতু সে অবাধ্য ও বিরোধী হতে পারে অর্থাৎ যে কোন বাধ্যবাধকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তাকে অস্বীকার করতে পারে। অন্যরা ভেবেছেন,এ অবাধ্যতা ও বিরুদ্ধাচরণও পূর্ণতা এবং যে কোন আনুগত্যের বিরোধিতা ও পূর্ণতা।

তারা অবাধ্যতার সত্তাগত মূল্য দিয়েছেন। ফলে এ মতবাদের পরিণতি বিশৃঙ্খলতায় পর্যবসিত হয়েছে । কারণ কোন মতবাদ অবাধ্যতাকে মূল্যবোধ মনে করলে তা শৃঙ্খলার জন্ম দিতে পারে না। স্বয়ং এ মতবাদের প্রবক্তা সারটার তার ও তার মতবাদের উপর আরোপিত এ অভিযোগকে খণ্ডন করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। ইসলামী মতাদর্শে বিরোধিতার সম্ভাবনা আছে বলেই মানুষের মূল্য রয়েছে অর্থাৎ মানুষ বিরোধিতা করতে পারে,আবার আনুগত্যও করতে পারে,সে যেমন উচ্চতর পর্যায়ে পৌছতে পারে তেমনি নিম্নতর পর্যায়েও নেমে যেতে পারে। যারা (যে সকল অস্তিত্ব) বিরুদ্ধাচরণে সক্ষম নয় তারা মানুষ হতে উচ্চতর সৃষ্টি নয় যেহেতু তারা এ ক্ষমতারই অধিকারী নয়। আনুগত্য ও বিরোধিতা পরস্পর ভারসাম্য পরিমাপক বলেই এগুলো পূর্ণতার মাধ্যম। অন্য সৃষ্টি এরূপ শক্তি ও ক্ষমতা রাখে না বলেই স্বাধীন ও মুক্ত নয়।

এজন্যই বিরুদ্ধাচরণের পর তওবার মাধ্যমে প্রত্যাবর্তন মানুষের জন্য একটি পূর্ণতা। বিরুদ্ধাচরণের পর প্রত্যাবর্তন আছে বলেই আল্লাহ্ পাকের অন্যতম সুন্দর নামغفور বা ক্ষমাশীল বাস্তবে রূপ নেয়। যদি বিরোধিতা না থাকত তাহলে তওবা বা প্রত্যাবর্তনও থাকত না,তখন আমরা আল্লাহর গফুর নামের পরিচয় পেতাম না। বিরোধিতা পতন এবং তওবা প্রত্যাবর্তন ও পতন হতে মুক্তি। তাই বিরুদ্ধাচরণের পর প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে আল্লাহর ক্ষমাশীলতা বাস্তব রূপ নেয়।

রেওয়ায়েতে এসেছে,আল্লাহ্পাক বলেছেন, আমি পৃথিবীতে যে মানবকূলকে সৃষ্টি করেছি তারা যদি বিরুদ্ধাচরণ ও গুনাহ না করত,তবে অন্য কোন প্রাণীদের সৃষ্টি করতাম যারা অন্যায় ও পাপ করে তওবা করবে যাতে আমি তাদের ক্ষমা করতে পারি। সুতরাং বিরুদ্ধাচরণ নিজে সত্তাগত মূল্যের দাবিদার নয়,তবে তওবা একটি মূল্যবোধ।

স্বাধীনতা অর্থ কোন প্রতিবন্ধক,বাধ্যবাধকতা ও শর্তহীনতা। আমি স্বাধীন,তাই নিজ পূর্ণতার পথকে স্বাধীনভাবে অতিক্রম করতে পারি। শুধু স্বাধীন হওয়ার কারণেই পূর্ণতায় পৌছেছি তা সঠিক নয়। তাই স্বাধীনতা পূর্ণতার পূর্বশর্ত,কিন্তু নিজেই পূর্ণতা নয়। যে অস্তিত্বকে স্বাধীনভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে ও তার পূর্ণতার পথের সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করা হয়েছে সে স্বাধীনতার সেই পর্যায়ে পৌছেছে যাতে করে পূর্ণতার ঐ পথকে অতিক্রম করতে পারে। স্বাধীনতার বিশেষ পর্যায়ে পৌছানো পূর্ণতার পথ অতিক্রমের প্রাথমিক ধাপ।

তাই এ মতবাদের প্রথম ভুল হলো তারা মনে করেছেন,আল্লাহর অস্তিত্বের সঙ্গে মানুষের স্বাধীনতা ও এখতিয়ারের বৈপরীত্য রয়েছে। তাদের দ্বিতীয় ভুল হলো তাদের ধারণা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও সম্পৃক্ততা অন্যান্য বস্তুর সঙ্গে সম্পৃক্ততার ন্যায় স্থবিরতা,বিচ্যুতি ও মূল্যবোধের পতন সৃষ্টি করে। তাদের তৃতীয় ভুল হলো তারা স্বাধীনতাকে মানুষের পূর্ণতার লক্ষ্য মনে করেছেন,অথচ স্বাধীনতা পূর্ণতার প্রাথমিক ধাপ।

স্বাধীনতা কি পূর্ণতা? নিঃসন্দেহে স্বাধীনতা ব্যতীত মানুষ পূর্ণতায় পৌছতে পারে না। আল্লাহ্পাক মানুষকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন,যে স্বাধীনতা ও এখতিয়ারকে ব্যবহার করে তার পূর্ণতার পথকে অতিক্রম করবে। স্বাধীনতা ও এখতিয়ার ব্যতীত এ পথ অতিক্রম করা সম্ভব নয়। যদি বাধ্যবাধকতা আসে,তবে পূর্ণতার এ পথ যেন সে অতিক্রমই করেনি।

ইসলামী পরিভাষায় স্বাধীনতা

এখানে স্বাধীনতা সম্পর্কে ইসলামে যে ব্যাখ্যা এসেছে তা আলোচনা করব। ইসলাম স্বাধীনতাকে অন্যতম মানবীয় মূল্যবোধ বলে স্বীকার করেছে। তবে এ মূল্যবোধ ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয় বা এ স্বাধীনতা উদ্ভাবিত কোন পরিভাষাও নয় বরং এটা এর প্রকৃত অর্থে একটি মূল্যবোধ। নাহজুল বালাগার দীর্ঘতমপত্র মালিক আশতারের প্রতি হযরত আলীর পত্র। এর ঠিক পরে একটি অসিয়তনামা রয়েছে যা তিনি ইমাম হাসান (আ.)-কে লিখেছেন। এর একটি বাক্য হলো

أکرم نفسک عن کلّ دنیّة و إن ساقتک إلی الرّغائب فإنّک تعتاض بما تبذل من نفسک عوضا

:(নাহজুল বালাগাহ্,পত্র ৩১) তোমার আত্মাকে সকল নীচতা ও অপমান হতে সম্মানিত রাখ (নিজ আত্মসম্মানকে হেফাজত কর,কখনও তা বিকিয়ে দিও না)

 فإنّک تعتاض بما تبذل من نفسک عوضا যেমনটি কোরআন বলেছে সবচেয়ে বড় পরাজয় নিজেকে হারানোর পরাজয়,তেমনি আলী (আ.)ও বলেছেন, হে পুত্র! যে কোনবস্তুই তুমি বিক্রি কর অথবা হারাও তার মূল্য নির্ধারণ সম্ভব,কিন্তু এমন এক বস্তু যার বিক্রিয়মূল্য নির্ধারণ সম্ভব নয় তা হলো তোমার সত্তা ও আত্মসম্মান। যদি সমগ্র পৃথিবীও তোমাকে দেয়া হয় তবু তা তার সমতুল্য নয়।

আলীর সন্তান ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন, কেবল একটি বস্তু তোমার প্রাণ ও সত্তার বিনিময় হতে পারে,আর তা হলো আল্লাহ্পাক। আল্লাহর নিকট নিজের প্রাণ বিক্রী করা যায় আর তার বিনিময়ে আল্লাহকে গ্রহণ করা যায়। কিন্তু বিশ্বজগতের কোন কিছুই প্রাণের বিনিময় হতে পারে না। এ পত্রেই হযরত আলী বলেছেন,

و لا تکن عبد غیرک فقد جعلک الله حرّا

হে পুত্র! অন্যের দাস হয়ো না। কারণ আল্লাহ্ তোমাকে স্বাধীন হিসেবে সৃষ্টি করেছেন।    নাহজুল বালাগাহ্ থেকে আরেকটি উদ্ধৃতির আলোচনা করে আমার বক্তব্য শেষ করব। হযরত আলী (আ.) ইবাদতসমূহের স্তর বিন্যাস করে বলেছেন, মানুষ ইবাদতের ক্ষেত্রে তিন পর্যায়ের : একদল আল্লাহর শাস্তি ও আজাবের ভয়ে তাকে ইবাদত করে যাতে তিনি তাদের শাস্তি না দেন; তাদের ইবাদত একজন দাসের ন্যায়,যে তার মনিবের ভয়ে কাজ করে। তাই এর তেমন কোন মূল্য নেই। একদল বেহেশতের আশায় আল্লাহর ইবাদত করে,তারা শুনেছে আল্লাহর এমন বেহেশত রয়েছে যার তলদেশে ঝরণা ধারা প্রবাহিত( تَجْرِ‌ي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ‌ ) তাতে হুররা রয়েছে,পাখির সুস্বাদু মাংস রয়েছে(لهم طیر مما یشتهون ),তাই তারা হুর,পাখির মাংস আর মণি-মুক্তার লোভে আল্লাহর ইবাদত করে যাতে এগুলো অর্জন করতে পারে। আলী (আ.) বলেছেন, تلک عبادة التّجار এটি ব্যবসায়ীদের ইবাদত যারা মুনাফার লোভে কাজ করে। কিন্তু একদল লোক আল্লাহকে কৃতজ্ঞ চিত্তে শোকর আদায়ের লক্ষ্যে ইবাদত করে। তারা না বেহেশতের লোভে,না জাহান্নামের শাস্তির ভয়ে আল্লাহর ইবাদত করে,তারা শুধু আল্লাহকেই চায়।

মানুষের অন্যতম মানবিক বিষয় হলো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। মানুষের বিবেক বলে,আল্লাহ্পাকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত,চাই বেহেশত থাকুক বা না থাকুক এবং জাহান্নাম থাকুক বা না থাকুক। তাই সে তার ইবাদত করবে।

তিনি কি স্বয়ং নবী (সা.) নন যিনি এত ইবাদত করতেন যে,তার পবিত্র পা ফুলে যেত। তাকে প্রশ্ন করা হলো, হে রাসূলাল্লাহ্ আল্লাহ্পাক আপনার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন তদুপরি আপনি কেন এত ইবাদত করেন? তিনি জবাব দিলেন, কেউ আল্লাহর ইবাদত করলে তা কি কেবল বেহেশতের আশায় ও জাহান্নামের ভয়ে করে থাকে?

(ألا أکون عبدا شکورا ) তবে কি আমি তার কৃতজ্ঞ বান্দা হব না?

সুতরাং প্রথম দলের ইবাদত দাসের ইবাদতের ন্যায় এবং দ্বিতীয় দলের ইবাদত ব্যাবসায়ীর ন্যায়। তৃতীয় দল স্বাধীন ব্যক্তির ন্যায় ইবাদতকারী। আলী (আ.)-এর যুক্তিতে স্বাধীন মানুষ এমনকি বেহেশত ও জাহান্নামের সঙ্গেও সংযুক্ত নয়,বরং এগুলো থেকেও সে মুক্ত। তার সংযুক্ততা রয়েছে শুধু আল্লাহর সঙ্গে।

যদিও ইচ্ছা ছিল স্বতন্ত্র এক বৈঠকে এ পর্যন্ত সমগ্র বক্তব্যকে সংক্ষেপে বর্ণনা করে ইসলামের পূর্ণমানবের নমুনা পেশ করব,কিন্তু তা সম্ভব হলো না। তবে এই মতবাদগুলোর আলোচনার মাঝে ইসলামের পূর্ণ মানবের রূপও বর্ণনা করেছি। যা হতে বোঝা যায় ইসলাম একপেশে মূল্যবোধকে ধারণ করে না,বরং ইসলাম তার চোখ দিয়ে সকল মূল্যবোধকে দেখতে পায়। তাই দর্শন পূর্ণ মানবের ক্ষেত্রে যা বলেছে ইসলাম অনেক পূর্বেই তার উল্লেখ করেছে ও দেখেছে। তদ্রূপ শক্তির মতবাদ,সামষ্টিক মালিকানার মতবাদ,স্বাধীনতার মতবাদসহ অন্যান্য মতবাদ পূর্ণ মানবের যে রূপ উপস্থাপন করেছে ইসলাম সেগুলো অপেক্ষা অনেক উত্তম ও পূর্ণরূপে তা উপস্থাপন করেছে এবং এ সকল মতবাদের যে ত্রুটিগুলো রয়েছে ইসলামের ক্ষেত্রে সেগুলো প্রযোজ্য নয়। এ বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি সর্বব্যাপী ও পূর্ণ। তাই আমাদের নিকট প্রমাণিত হয় যে,ইসলাম আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে।

এ মতবাদগুলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানিগণ উপস্থাপন করেছেন তদুপরি ইসলামের মোকাবিলায় এগুলো বর্ণহীন হয়ে পড়ে। তাই যদিও নবী (সা.) পৃথিবীর বিরল ব্যক্তিত্ব তদুপরি তার মতো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাহীন ও অক্ষর জ্ঞান না শেখা একজন ব্যক্তির জন্য এরূপ পূর্ণ রূপ উপস্থাপন অসম্ভব বিষয়। এ থেকে বোঝা যায়,তিনি মানব ক্ষমতার ঊর্ধ্বে কোন শক্তি হতে এ শিক্ষা লাভ করেছিলেন এবং আল্লাহ্ হতেই তা এসেছে- অন্য সকল মতবাদের উপর এ মতবাদের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। অন্যান্য মতবাদের সঙ্গে তুলনার মাধ্যমে প্রকৃতরূপে তা আমাদের নিকট স্পষ্ট হয়।

لا حول ولا قوّة إلا بالله العلی العظیم

স্রষ্টার বাইরে সৃষ্টির অস্তিত্ব নেই

এখানে প্রসঙ্গতঃ বলে রাখা প্রয়োজন যে , আমরা বাস্তব জগতে যা কিছু সৃষ্টি করি সে ক্ষেত্রে আসলে আমরা সৃষ্টি করি না , সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিতে রূপান্তর ঘটাই মাত্র। আমাদের বাস্তব সৃজনক্ষমতার প্রয়োগের বা সৃষ্টিকর্ম সম্পাদনের স্বরূপ হচ্ছে এই যে , আমরা যা কল্পনা করি তার ভিত্তিতে বাস্তব জগতে বিরাজমান সৃষ্টিতে রূপান্তর ঘটিয়ে তার (কল্পনার) অনুরূপ করি মাত্র। কিন্তু প্রকৃত সৃষ্টি তা-ই যা বিদ্যমান উপাদান ছাড়াই সৃষ্টি করা হয় অর্থাৎ শূন্য থেকে সৃষ্টি করা হয়। অতএব , আমরা যা কল্পনা করি তা-ই আমাদের প্রকৃত সৃষ্টি। এরূপ সৃষ্টি তার অস্তিত্বলাভ , স্থিতি , ধারাবাহিকতা রক্ষা , বিনাশ ও পুনঃপ্রত্যাবর্তনের জন্য তার স্রষ্টার (কল্পনাকারীর) ওপর নির্ভরশীল। স্রষ্টার অস্তিত্বের বাইরে তার স্বাধীন অস্তিত্ব অকল্পনীয়।

এ থেকে আমরা এ উপসংহারে উপনীত হতে পারি যে , সৃষ্টিমাত্রই তার অস্তিত্বলাভ , স্থিতি , ধারাবাহিকতা রক্ষা , বিনাশ ও পুনঃপ্রত্যাবর্তনের জন্য স্বীয় স্রষ্টার ওপর নির্ভরশীল। স্রষ্টার অস্তিত্বের বাইরে তার কোনো অস্তিত্ব নেই , যদিও সে স্রষ্টার অংশ নয়। পরম স্রষ্টা অপরিহার্য সত্তার সাথে তাঁর সৃষ্ট সৃষ্টিলোকের সম্পর্কও এ ধরনেরই।

পরম স্রষ্টার সৃষ্টিবৈচিত্র্য

যে স্রষ্টা সীমাহীন জ্ঞান , ইচ্ছাশক্তি ও সৃজনক্ষমতার অধিকারী সে পরম স্রষ্টার সৃষ্টি শুধু সংখ্যাগত দিক থেকে নয় , বরং গুণগত ও মাত্রাগত দিক থেকেও এতো বেশী ও এতো বৈচিত্র্যপূর্ণ হওয়াই স্বাভাবিক যা আমাদের সীমিত কল্পনাশক্তি দ্বারা কল্পনা করাও সম্ভব নয়।

ইতিপূর্বে আমরা অস্তিত্বের দার্শনিক বিভাজনের কথা উল্লেখ করেছি এবং সে ক্ষেত্রে প্রচলিত দার্শনিক বিভাজন থেকে কিছুটা (কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ) ভিন্নমত পোষণ করে এভাবে বিভাজন করেছি: অস্তিত্ব দু রকম: অপরিহার্য ও সম্ভব ; সম্ভব অস্তিত্ব হয় অবস্তুগত , নয়তো প্রায় বস্তুগত , নয়তো বস্তুগত। এখানে আরো অনেক বিভাগ চিন্তা করা যায়। যেমন: বস্তুগত সৃষ্টি দু রকমের: জড় ও প্রাণশীল। প্রাণশীল সৃষ্টি দু রকম: বদ্ধ ও মুক্ত। উদ্ভিদ হচ্ছে বদ্ধ এবং অন্যান্য প্রাণশীল সৃষ্টি মুক্ত। মুক্ত প্রাণশীল সৃষ্টি হয় স্বাধীন বিচরণক্ষমতাহীন (যেমন: লোহিত কণিকা , শ্বেত কণিকা ও রোগজীবাণু) , নয়তো স্বাধীন বিচরণক্ষমতা সম্পন্ন। শেষোক্ত গোষ্ঠী হয় পুরোপুরি সহজাত প্রবৃত্তি চালিত (যেমন: মশা-মাছি) , নয়তো বুদ্ধিমান। বুদ্ধিমান প্রাণী হয় বিচারবুদ্ধি ও কল্পনাশক্তির অধিকারী (মানুষ) , নয়তো এ ক্ষমতার অধিকারী নয়।

অবস্তুগত ও প্রায় বস্তুগত সৃষ্টির মধ্যেও নিঃসন্দেহে বহুবিধ বিভাজন সম্ভব - যে সম্পর্কে আমাদের ধারণা খুবই সীমিত। এরূপ সৃষ্টি ব্যক্তিসত্তাসম্পন্ন ও ব্যক্তিসত্তাবিহীন হতে পারে। আবার জ্যামিতিক সত্যগুলো অর্থাৎ দ্বিমাত্রিক , একমাত্রিক ও শূন্যমাত্রিক অস্তিত্ব , গাণিতিক সংখ্যা , তরঙ্গ , চৌম্বক ক্ষেত্র , মানবমস্তিষ্কের কল্পিত সৃষ্টি , সুর , সৌন্দর্য ইত্যাদি অবস্তুগত সত্যকে কোন্ পর্যায়ে ফেলা যায় সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার।

এ তো গেলো এমন সৃষ্টির কথা যা কম - বেশী আমাদের বিচারবুদ্ধির ধারণক্ষমতার আওতাভুক্ত। এর বাইরে আরো বিভিন্ন মাত্রার ( Dimension)কতো রকম সৃষ্টি রয়েছে তা আমাদের পক্ষে চিন্তা করাও সম্ভব নয়।

বন্দিত্ব নাকি স্বাধীনতা ?

পরম স্রষ্টা যেমন বস্তুগত , অবস্তুগত , প্রায় বস্তুগত ও প্রাণশীল সৃষ্টিনিচয় সৃষ্টি করেছেন , তেমনি সৃষ্টি করেছেন প্রাকৃতিক বিধিবিধান। তিনি মাধ্যাকর্ষণ ও মহাকর্ষণ শক্তি এবং মৌলিক ও যৌগিক সৃষ্টিসমূহের জন্য সুনির্দিষ্ট গঠন-ফর্মুলা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এভাবে তিনি তাঁর সৃষ্টিজগৎকে সুনিয়ন্ত্রিত ও সুশৃঙ্খল করেছেন। এছাড়া তিনি প্রাণশীল সৃষ্টির জন্য সহজাত প্রবণতা সৃষ্টি করেছেন এবং কতক সৃষ্টিকে বুদ্ধিমত্তা দিয়েছেন ও জ্ঞানার্জনের যোগ্যতা দিয়েছেন। তিনি কতক প্রাণশীল সৃষ্টিকে বিচরণের স্বাধীনতা ও ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন এবং মানুষকে দিয়েছেন সর্বোচ্চ স্বাধীনতা , এমনকি প্রাকৃতিক বিধান ও সহজাত প্রবণতার বিরোধিতা বা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার স্বাধীনতা। ফলে প্রাকৃতিক বিধিবিধান ও সহজাত প্রবণতা দ্বারা অন্যান্য প্রাণীর স্বাধীনতা যতোখানি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে , মানুষের স্বাধীনতা ততোখানি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে না।

কিন্তু মানুষের স্বাধীনতার স্বরূপ নিয়ে অনেকে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছেন। কেউ কেউ মানুষকে নিরঙ্কুশ স্বাধীন বলে দাবী করেছেন , কেউ কেউ তাকে স্রষ্টার ইচ্ছার ক্রীড়নক গণ্য করেছেন এবং তার স্বাধীনতাকে পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। একদল বলছেন , আমরা যখন প্রাকৃতিক বিধিবিধানের সীমাবদ্ধতা ব্যতিরেকে মানবিক ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা অনুভব করি না , বরং স্বাধীনতা অনুভব করি , তখন আমরা পুরোপুরি স্বাধীন। অপর দল বলছেন , সৃষ্টিপ্রকৃতির নিখুঁত শৃঙ্খলার মধ্যে স্বাধীনতার অবকাশ থাকতে পারে না। বরং আমরা রেকর্ডকৃত কার্টুন-চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ন্যায় পূর্বসম্পাদিত ভূমিকার পর্দায় নিক্ষিপ্ত দৃশ্যসম বৈ নই ; আগামীতে আমি কোন্ ভূমিকায় আবির্ভূত হবো তা না জানলেও এতে সন্দেহ নেই যে , পূর্বে নির্ধারিত করে রাখা দৃশ্যে ও ভূমিকায়ই আবির্ভূত হবো। তাঁরা আরো বলেন যে , ভবিষ্যৎদ্রষ্টা সৃষ্টিকর্তা তো জানেনই ভবিষ্যতে আমার ভূমিকা কী হবে , অতএব , আমার পক্ষে তার অন্যথা করা সম্ভব নয়।

এ দুই মতের ধারকরা দুই প্রান্তিকতায় পৌঁছে গেছেন ; একদেশদর্শিতার কারণে তাঁরা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন।

বাস্তবে আমরা কী অনুভব করি ? আমরা একদিকে যেমন স্বাধীনতা অনুভব করি , অন্যদিকে সীমাবদ্ধতাও অনুভব করি ; স্বাধীনতা ও সীমাবদ্ধতা কোনোটিই নিরঙ্কুশভাবে অনুভব করি না।

বিশেষ করে যারা স্বাধীনতার ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছেন তাঁরা এমন দাবীও করে থাকেন যে , আমরা যে স্বাধীনতা অনুভব করছি , আসলে আমাদেরকে এরূপ অনুভব করতে বাধ্য করা হচ্ছে। তাঁদের এ ধারণা এ কারণে গ্রহণযোগ্য নয় যে , মানুষের যদি স্বাধীনতা না-ই থাকবে অথচ তাকে স্বাধীনতা অনুভব করতে বাধ্য করা হবে , তাহলে তা হবে এক ধরনের অন্যায় ও প্রতারণা। কিন্তু পরম পূর্ণতার অধিকারী স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির সাথে অন্যায় ও প্রতারণার আশ্রয় নেবেন এরূপ দুর্বলতা থেকে তিনি প্রমুক্ত।

অন্যদিকে স্বাধীনতার অনুভূতি যেমন অকাট্য ও সর্বজনীন , স্বাধীন অনুভব করতে বাধ্য করার অনুভূতি তদ্রূপ সর্বজনীন নয়। অর্থাৎ যারা মনে করছেন যে , আসলে আমরা স্বাধীন নই , তাঁরাও নিজেদেরকে স্বাধীন অনুভব করছেন , তবে কোনো কোনো যুক্তির ভিত্তিতে স্বীয় অনুভূতির বিপরীতে ধারণা করছেন যে , আমরা যা অনুভব করছি তা ঠিক নয় , বরং আমাদেরকে এরূপ অনুভব করতে বাধ্য করা হয়েছে। এ দাবী হচ্ছে বাস্তব অনুভূতির বিপরীত জ্ঞানগত বিতর্কের দাবী মাত্র এবং তার উৎস হচ্ছে ধারণা । অতএব , এ ধারণা যেমন সর্বজনীন নয় , তেমনি তা অকাট্যও নয়। আর ধারণাজাত বিতর্কিত দাবীর ভিত্তিতে সর্বজনীন অকাট্য অনুভূতির সত্যতায় সন্দেহ পোষণ করা চলে না।

যারা স্বাধীনতার অনুভূতিকে অস্বীকার করেন তাঁদের একটি যুক্তি হচ্ছে এই যে , এটা সৃষ্টিজগতের শৃঙ্খলার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু ঝুকিপূর্ণ হলেও স্বাধীন এক্তিয়ার সম্পন্ন সৃষ্টির অস্তিত্ব তার সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিক্ষমতার ব্যাপকতাই প্রমাণ করে , যার অনুপস্থিতিতে তাঁর সৃষ্টিক্ষমতা অপেক্ষাকৃত সীমিত প্রতিভাত হতো।

মানুষের স্বাধীনতার অনুভূতি অস্বীকারকারীদের আরেকটি যুক্তি হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার ভবিষ্যৎ জ্ঞানের যুক্তি। [এ প্রসঙ্গে ইতিপূর্বে বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে সৃষ্টি ও ব্যবস্থাপনার প্রক্রিয়া শিরোনামে কিছুটা সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে।] এর জবাবে বলতে হয় যে , আমরা সৃষ্টিকর্তার ভবিষ্যৎ জ্ঞানের স্বরূপ অবগত নই। অতএব , সে যুক্তিতে আমরা আমাদের অনুভূত স্বাধীনতাকে অস্বীকার করতে পারি না।

আমরা সৃষ্টিকর্তার জ্ঞানের স্বরূপ অনুধাবনে অক্ষম , তবে এর কয়েকটি দিক আমাদের বিচারবুদ্ধির নিকট অকাট্যভাবে প্রতিভাত। যেহেতু সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকার্যক্রম মানে হচ্ছে তাঁর ইচ্ছার বাস্তবায়ন এবং তিনি যা ইচ্ছা করেন তা সংশ্লিষ্ট স্থান , কাল , পাত্রপাত্রী , অবস্থা , কারণ ও প্রক্রিয়া সহ অনিবার্য হয়ে যায় , সেহেতু তিনি যদি সমগ্র ভবিষ্যত কে একবারে ইচ্ছা করেন তাহলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটা অনিবার্য হয়ে যায়। তাহলে অতঃপর আর তাঁর কিছুই করার থাকে না এবং তাঁর অন্য সমস্ত গুণ প্রয়োগ হারিয়ে ফেলে। কারণ , তিনি যা ইচ্ছা করে রেখেছেন তার বাইরে নতুন কিছুই তিনি করবেন না। কিন্তু বিচারবুদ্ধি সৃষ্টিকর্তার সীমাহীন সৃষ্টিক্ষমতার ও সীমাহীন মাত্রার অন্যান্য গুণের প্রয়োগ হারিয়ে ফেলার ধারণা গ্রহণ করে না। কারণ , তা তাঁর এ সব গুণ ও ক্ষমতার ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করে। অতএব , সৃষ্টিক্ষমতা সহ তাঁর সকল গুণের অনবরত কার্যকরিতা অনস্বীকার্য বিষয়। এমতাবস্থায় এমন অসংখ্য ক্ষেত্র থাকতে হবে যে বিষয়ে তিনি ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোনো ধরনেরই ইচ্ছা করেন নি , যে সব ক্ষেত্র ভবিষ্যতে তাঁর ইচ্ছা করা বা না-করার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। এই ক্ষেত্রসমূহেরই একটি হতে পারে সৃষ্টির স্বাধীনতার আওতাভুক্ত ভবিষ্যৎ ক্ষেত্র। অর্থাৎ কতক ক্ষেত্রে সৃষ্টি ভবিষ্যতে কী করবে সে ব্যাপারে স্রষ্টা কোনো কিছু ইচ্ছা করা থেকে বা সেদিকে মনোযোগ (توجه ) প্রদান করা থেকে বিরত থাকতে পারেন। কারণ , তিনি সেদিকে মনোযোগ প্রদান করলে তিনি যেভাবে মনোযোগ প্রদান করবেন সেভাবে তা ঘটা অনিবার্য হয়ে যাবে। বলা বাহুল্য যে , সমগ্র ভবিষ্যতের প্রতি মনোযোগ প্রদান করতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও তিনি এভাবে কতক ক্ষেত্রকে মনোযোগের বাইরে রাখতে এবং সৃষ্টির জন্য স্বাধীনতার একটি ক্ষেত্র নিশ্চিত করতে পুরোপুরি সক্ষম।

দ্বিতীয়তঃ সৃষ্টিকর্তা যেমন কতক বিষয় সরাসরি বা কারণ ও ফলশ্রুতি বিধির দ্বারা স্থির করে দিয়েছেন তেমনি কতক বিষয় স্থির করে না দিয়ে শর্তাধীন করে দিতে পারেন , যেমন: অমুক ব্যক্তি এ কাজ করলে ফল এই হবে এবং তা না করলে বা তার পরিবর্তে অমুক কাজ করলে ফল ঐ রকম হবে। অতঃপর ব্যক্তি স্বাধীন ইচ্ছা দ্বারা যা করবে তার ফলটি অকাট্য হয়ে যাবে এবং তার বিকল্প সম্ভাবনাটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কারণ , সম্ভব অস্তিত্ব (সৃষ্টি ও কাজ উভয়ই) অস্তিত্বলাভ করার ক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে এই যে , তা অস্তিত্বলাভের পূর্ণ কারণ ঘটলে তার অস্তিত্বলাভ অনিবার্য হয়ে যায় এবং পূর্ণ কারণ না ঘটা পর্যন্ত তার অস্তিত্বলাভ অসম্ভব থাকে। এরূপ শর্তাধীন স্থিরকরণ সৃষ্টিকর্তার সৃজনক্ষমতার বৈচিত্র্যেরই পরিচায়ক।

তৃতীয়তঃ ক্ষেত্রবিশেষে স্বাধীন সৃষ্টির অতীত কার্যকলাপ ও প্রাকৃতিক বিধিবিধানের দ্বারা তার ভবিষ্যৎ এমনভাবেও নির্ধারিত হয়ে যেতে পারে যে , সে ক্ষেত্রে দ্বৈত সম্ভাবনার সুযোগ না-ও থাকতে পারে। অর্থাৎ সৃষ্টি আগে যে স্বাধীনতার অধিকারী ছিলো তা বিলুপ্ত বা সঙ্কুচিত হয়ে যেতে পারে। এরূপ ক্ষেত্রে স্রষ্টা নিশ্চিত জানেন যে , ঐ ব্যক্তি এ কাজ করবে ও তার ফল এরূপ হবে ; এর অন্যথা হবে না। কিন্তু স্রষ্টার এ ভবিষ্যৎজ্ঞানের কারণে এ কথা বলা চলে না যে , স্রষ্টা তাকে এ কাজে বাধ্য করেছেন। একজন শিক্ষক যদি একজন ছাত্র সম্পর্কে নিশ্চিত জানেন যে , সে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হবে , তো এ কারণে বলা চলে না যে , শিক্ষকের ঐ ছাত্র সংক্রান্ত ভবিষ্যৎজ্ঞানের কারণেই এ ছাত্রটি অকৃতকার্য হয়েছে।

অবশ্য আগেও যেমন বলা হয়েছে , মানুষের এ স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ নয়। প্রাকৃতিক বিধিবিধানের কথা বাদ দিলেও পারিবারিক , সামাজিক , সাংস্কৃতিক ও মানব-জাত অন্যান্য কার্যকারণ তার এ স্বাধীনতাকে সীমিত করে ফেলে , কিন্তু তার স্বাধীনতাকে পুরোপুরি হরণ করতে পারে না। শেষ পর্যন্ত তার জন্য স্বাধীনতার ক্ষেত্র কমবেশী থেকেই যায়। এমনকি মানুষ যখন অনন্যোপায় হয়ে আত্মহত্যা করে তখনো কার্যতঃ সে তার স্বাধীন এ্খতিয়ারকেই কাজে লাগায়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে , মানুষের স্বাধীনতার নিয়ন্ত্রণ কি কেবল প্রাকৃতিক ও মানব-জাত কার্যকারণের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে ? এখানে পরম জ্ঞানী স্রষ্টার কি করণীয় কিছু নেই ? অন্য কথায় , তিনি কি সৃষ্টির কার্যক্রমে আদৌ হস্তক্ষেপ করবেন না ? বিচারবুদ্ধি এ ব্যাপারে কী বলে ?

বস্তুতঃ স্বাধীনতা হচ্ছে পরম পূর্ণতার অধিকারী অপরিহার্য সত্তার বৈশিষ্ট্য। সেই স্বাধীনতা তিনি তাঁর সসীম অপূর্ণ সৃষ্টি মানুষকে প্রদান করেছেন। যদিও এ স্বাধীনতা ব্যবহারের জন্য মানুষকে বিচারবুদ্ধি দেয়া হয়েছে , তথাপি দুর্বল ও অপূর্ণ হবার কারণেই এ স্বাধীনতা ব্যবহার করতে গিয়ে তার ভুল হবার আশঙ্কা থেকেই যায়। তাই বিচারবুদ্ধির দাবী হচ্ছে , ক্ষেত্রবিশেষে , বিশেষ করে সমগ্র সৃষ্টিলোক বা মানবপ্রজাতির স্বার্থে অপরিহার্য হলে , তেমনি মানুষ তাঁর কাছে সাহায্য চাইলে ও তাঁর বিবেচনায় সে সাহায্য পাওয়ার উপযুক্ত হলে তিনি সৃষ্টির স্বাধীন কর্মক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করবেন। (তবে এটা করা তাঁর জন্য অপরিহার্য গণ্য করা যায় না এবং সর্বাবস্থায়ই তিনি হস্তক্ষেপ বা সাহায্য করবেন এটাও ভাবা যায় না। কারণ , তাহলে সৃষ্টির স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যাবে।)

বিষয়টি কয়েকটি উপমার সাহায্যে সহজে বুঝা যেতে পারে।

প্রথম উপমা: একজন পিতা তাঁর শিশু সন্তানকে খেলার জন্য একটি বল দিলেন , সাথে সাথে তিনি তাকে নদীর কিনারে গিয়ে খেলতে নিষেধ করলেন। কিন্তু শিশুটি নদীর কিনারে গিয়ে খেলতে লাগলো। কারণ , তার পিতা তাকে নদীর কিনারে গিয়ে খেলতে নিষেধ করলেও তার সেখানে যাওয়া ও খেলার পথ রুদ্ধ করেন নি ; ধরুন , পিতা তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে পারতেন , কিন্তু তিনি তা করেন নি। এমতাবস্থায় খেলার সময় শিশুটির বলটি ছিটকে নদীতে পড়ে গেলো। এখন পিতা কী করবেন ? এ অবস্থায় শিশুটি পিতাকে বলটি তুলে দিতে বলতে পারে , বা না-ও বলতে পারে। উভয় অবস্থায়ই পিতা চাইলে বলটি তুলে দিতে পারেন , বা তা তুলে আনার আগেই অনেক দূরে চলে যাওয়ায় তিনি তাকে আরেকটি নতুন বল কিনে দিতে পারেন ও আগেকার ঘটনার পুনরাবৃত্তির ব্যাপারে কঠোরভাবে সতর্ক করে দিতে পারেন। অবশ্য তিনি চাইলে কোনো কারণে বলটি তুলে দেয়ার চেষ্টা না-ও করতে পারেন বা নতুন বল কিনে দেয়া থেকেও বিরত থাকতে পারেন। তবে সাধারণতঃ তিনি প্রথম বারের ক্ষেত্রে বা শিশুর বয়স ও আরো কিছু বিষয় বিবেচনা করে বলটি তুলে দেন বা নতুন একটি বল কিনে দেন।

অথবা ধরুন , একটি বাড়ীর চতুর্দিকে পানিভর্তি গভীর খাদ ; পিতা শিশুকে খাদে নামতে , এমনকি তার কাছে যেতেও নিষেধ করলেন , বললেন: খাদে নামলে বা তাতে পড়ে গেলে ডুবে মরবে। কিন্তু শিশু শিশু হওয়ার কারণেই পিতার কথার গুরুত্ব বুঝলো না এবং খেলতে খেলতে খাদের কিনারে গিয়ে অসাবধানতাবশতঃ বা পা পিছলে তাতে পড়ে গেলো অথবা কৌতুহলবশে তাতে নেমে গেলো এবং ফলে সে পানিতে ডুবে গেলো। এ অবস্থায় পিতা খাদে নেমে তাকে তুলে আনলেন , ফলে সে বেঁচে গেলো , কিন্তু নাকে , কানে ও পেটে দুর্গন্ধযুক্ত পচা পানি ঢুকে যাওয়ায় সে শুধু তাৎক্ষণিক কষ্ট আর ভোগান্তির শিকারই হলো না , বরং অসুস্থ হয়ে পড়লো।

আবার এমনও হতে পারে যে , খাদটি এতোই গভীর ছিলো যে , তার তলদেশ থেকে তুলে আনতে আনতে সে মারা গেলো। হতে পারে যে , খাদটি খুব বেশী গভীর না হলেও খাদের পানি খুব বেশী দূষিত থাকায় ঐ বিষাক্ত পানি পেটে যাবার কারণেই সে মারা গেলো অথবা মারা না গেলেও সে কঠিন রোগে আক্রান্ত হলো এবং তার জীবনীশক্তি হ্রাস পেলো।

ক্ষেত্রবিশেষে খাদের মধ্যে কাঁটা বা ভাঙ্গা কাঁচ থাকতে পারে যার ফলে সে মারাত্মকভাবে আহত হতে পারে এবং বেঁচে গেলেও বিকলাঙ্গ হয়ে যেতে পারে। অবশ্য সে কষ্ট ও ভোগান্তির শিকার বা অসুস্থ বা বিকলাঙ্গ হওয়ায় অথবা মারা যাওয়ায় এ ঘটনাটা অন্য শিশুদের জন্য শিক্ষণীয় হলো।

আবার এমনও হতে পারে যে , শিশুটি এক পা খাদে ফেলতে উদ্যত হওয়ার সাথে সাথেই , অথবা এমনকি খাদের কিনারে যেতেই বাবা তাকে ধরে ফেললো ও সেখান থেকে দূরে সরিয়ে আনলো এবং এভাবে ধরে নিয়ে আসার কাজটা প্রহারসমেতও হতে পারে যাতে সে ভবিষ্যতে এ কাজের পুনরাবৃত্তি করা থেকে বিরত থাকে।

অথবা মনে করুন , কোনো জাহাযের সারেং যাত্রীদেরকে ডেকের কিনারে যেতে নিষেধ করলেন এবং বলে দিলেন যে , পানিতে হাঙ্গর ও কুমীর আছে। কিন্তু কতক যাত্রী তাঁর কথা শুনলো না। তারা ডেকের কিনারে গিয়ে দাঁড়ালো এবং তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ পানিতে পড়ে গেলো , আর ডুবুরী নেমে উদ্ধার করার আগেই তাদেরকে কুমীর এসে টেনে নিয়ে গেলো বা হাঙ্গর এসে ছিন্নভিন্ন করে ফেললো।

অথবা সাঁতার জানা এক ব্যক্তি প্রয়োজনের তাগিদে সাঁতরে নদী পাড়ি দিলো , কিন্তু কিনার থেকে পাঁচ , সাত বা দশ হাত দূরে পৌঁছতেই সাঁতরাবার শক্তি হারিয়ে ফেললো। তখন সে সাহায্য চাইতে বা না চাইতেই কিনারে থাকা লোকদের মধ্য থেকে কেউ নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে তীরে তুলে আনলো। কিন্তু অপর এক ব্যক্তি ভালো সাঁতার না জানা সত্ত্বেও অন্যদের নিষেধ উপেক্ষা করে অহঙ্কার অথবা বোকামি বশতঃ এক মাইল প্রশস্ত নদী পাড়ি দিতে গিয়ে সিকি বা অর্ধ বা পৌনে এক মাইল পৌঁছার পর সাঁতরাবার শক্তি হারিয়ে ফেললো এবং লোকদের কাছে সাহায্য চাইলো , কিন্তু কেউ তাকে সাহায্য করতে গেলো না , কারণ , সে অন্যদের সদুপদেশ না শুনে নিজের জন্য বিপদ ডেকে এনেছে। তাই কেউ তাকে সাহায্যের হক্বদার মনে করে নি , অথবা সাহায্য পৌঁছার আগেই তার মারা যাওয়া নিশ্চিত জেনে তাকে উদ্ধারের চেষ্টা অর্থহীন মনে করে তারা তাকে উদ্ধারের চেষ্টা থেকে বিরত থাকলো। অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষে তার কাছাকাছি কোনো নৌকা বা স্পীড-বোট থাকলে তিরস্কার করেও তাকে দয়া দেখাতে পারে। তেমনি সে যদি নদীর তীরের খুবই কাছাকাছি এসে যায় , ধরুন বিশ গজের মধ্যে এসে যায় , সে ক্ষেত্রে তার হঠকারিতা বা বোকামির জন্য তিরস্কার করলেও কেউ দয়া করে তাকে তীরে তুলে আনতে পারে।

অবশ্য মানুষের আচরণে আমরা দেখতে পাই যে , অন্যদের পক্ষ থেকে উচ্চারিত সতর্কবাণী ও কৃত কল্যাণকামনা উপেক্ষা করে অথবা নির্বুদ্ধিতাবশতঃ যারা নিজেদেরকে বিপদে নিক্ষেপ করে তাদের সকলের ক্ষেত্রে বা একই ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রতি বারই কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে না। কারণ , সে ক্ষেত্রে সতর্কবাণী ও কল্যাণকামনা উপেক্ষা করে নিজেকে বিপদে নিক্ষেপ করতে কেউই দ্বিধা করতো না এবং এর ফলে সতর্কবাণী ও কল্যাণকামনা অর্থহীন হয়ে যেতো। অবশ্য সাহায্য চেয়ে ফরিয়াদ করলে সাহায্য লাভের সম্ভাবনা বেশী থাকে , তবে তা-ও নিশ্চিত নয়।

মোদ্দা কথা , সৃষ্টিকর্তা তাঁর এ দুর্বল সৃষ্টিকে স্বাধীনতা দেয়ার পর নিরঙ্কুশভাবে তার নিজের ওপর ছেড়ে দেবেন এবং তার প্রতি দৃষ্টি রাখবেন না ও তার কাজে ইতিবাচক হস্তক্ষেপ করবেন না - বিচারবুদ্ধি এটা মানতে পারে না। বিশেষ করে মানবপ্রকৃতি তার নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কঠিন সঙ্কটময় মুহূর্তে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে সৃষ্টিকর্তার নিকট আশ্রয় ও সাহায্য কামনা করে। এমতাবস্থায় তার প্রত্যাশা ও প্রার্থনা যদি অন্যায় , অযৌক্তিক বা অবাস্তব না হয় তাহলে সৃষ্টিকর্তা তাকে সাহায্য করবেন এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে সর্বাবস্থায়ই তিনি তাকে সাহায্য করবেন বা তার এক্তিয়ারাধীন কাজে হস্তক্ষেপ করবেনই এমনটি মনে করাও ঠিক হবে না। কারণ , তিনি সাহায্য বা হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য নন। তিনি যদি সাহায্য বা হস্তক্ষেপ করেন , তো সেটা সৃষ্টির অধিকার নয় , বরং তাঁর অনুগ্রহ।

অন্যদিকে কোনো মানুষের বা কোনো মানবগোষ্ঠীর স্বাধীনতার অপব্যবহারমূলক নেতিবাচক পদক্ষেপের উদ্যোগ যদি সমগ্র সৃষ্টিলোক বা পৃথিবী বা মানবপ্রজাতির জন্য এমনই ধ্বংসাত্মক হয় যার ফলে সৃষ্টির লক্ষ্য ব্যর্থ হয়ে যাবার আশঙ্কা থাকে , সে ক্ষেত্রে বিচারবুদ্ধির দাবী এটাই যে , সৃষ্টিকর্তা সেখানে হস্তক্ষেপ করবেন এবং ধ্বংসকামী ঐ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নেতিবাচক উদ্যোগকে বানচাল করে দেবেন।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে , যেহেতু সৃষ্টিকর্তা ইতিবাচক , সেহেতু সৃষ্টির কাজে তাঁর হস্তক্ষেপও সর্বাবস্থায়ই ইতিবাচক হবে , কখনোই নেতিবাচক হবে না - এটাই বিচারবুদ্ধির দাবী। অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষে সৃষ্টিকর্তার কোনো কোনো হস্তক্ষেপ আপতঃদৃষ্টিতে নেতিবাচক বলে মনে হতে পারে , কিন্তু পিতা কর্তৃক তার দুষ্ট শিশুকে প্রহার করার ন্যায় অথবা চিকিৎসক কর্তৃক কারো শরীরের পচনধরা অঙ্গ কেটে ফেলার ন্যায় উদ্দেশ্য ও পরিণামফলের বিচারে তাঁর সে দৃশ্যতঃ নেতিবাচক হস্তক্ষেপ অবশ্যই ইতিবাচক।

স্রষ্টার বাইরে সৃষ্টির অস্তিত্ব নেই

এখানে প্রসঙ্গতঃ বলে রাখা প্রয়োজন যে , আমরা বাস্তব জগতে যা কিছু সৃষ্টি করি সে ক্ষেত্রে আসলে আমরা সৃষ্টি করি না , সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিতে রূপান্তর ঘটাই মাত্র। আমাদের বাস্তব সৃজনক্ষমতার প্রয়োগের বা সৃষ্টিকর্ম সম্পাদনের স্বরূপ হচ্ছে এই যে , আমরা যা কল্পনা করি তার ভিত্তিতে বাস্তব জগতে বিরাজমান সৃষ্টিতে রূপান্তর ঘটিয়ে তার (কল্পনার) অনুরূপ করি মাত্র। কিন্তু প্রকৃত সৃষ্টি তা-ই যা বিদ্যমান উপাদান ছাড়াই সৃষ্টি করা হয় অর্থাৎ শূন্য থেকে সৃষ্টি করা হয়। অতএব , আমরা যা কল্পনা করি তা-ই আমাদের প্রকৃত সৃষ্টি। এরূপ সৃষ্টি তার অস্তিত্বলাভ , স্থিতি , ধারাবাহিকতা রক্ষা , বিনাশ ও পুনঃপ্রত্যাবর্তনের জন্য তার স্রষ্টার (কল্পনাকারীর) ওপর নির্ভরশীল। স্রষ্টার অস্তিত্বের বাইরে তার স্বাধীন অস্তিত্ব অকল্পনীয়।

এ থেকে আমরা এ উপসংহারে উপনীত হতে পারি যে , সৃষ্টিমাত্রই তার অস্তিত্বলাভ , স্থিতি , ধারাবাহিকতা রক্ষা , বিনাশ ও পুনঃপ্রত্যাবর্তনের জন্য স্বীয় স্রষ্টার ওপর নির্ভরশীল। স্রষ্টার অস্তিত্বের বাইরে তার কোনো অস্তিত্ব নেই , যদিও সে স্রষ্টার অংশ নয়। পরম স্রষ্টা অপরিহার্য সত্তার সাথে তাঁর সৃষ্ট সৃষ্টিলোকের সম্পর্কও এ ধরনেরই।

পরম স্রষ্টার সৃষ্টিবৈচিত্র্য

যে স্রষ্টা সীমাহীন জ্ঞান , ইচ্ছাশক্তি ও সৃজনক্ষমতার অধিকারী সে পরম স্রষ্টার সৃষ্টি শুধু সংখ্যাগত দিক থেকে নয় , বরং গুণগত ও মাত্রাগত দিক থেকেও এতো বেশী ও এতো বৈচিত্র্যপূর্ণ হওয়াই স্বাভাবিক যা আমাদের সীমিত কল্পনাশক্তি দ্বারা কল্পনা করাও সম্ভব নয়।

ইতিপূর্বে আমরা অস্তিত্বের দার্শনিক বিভাজনের কথা উল্লেখ করেছি এবং সে ক্ষেত্রে প্রচলিত দার্শনিক বিভাজন থেকে কিছুটা (কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ) ভিন্নমত পোষণ করে এভাবে বিভাজন করেছি: অস্তিত্ব দু রকম: অপরিহার্য ও সম্ভব ; সম্ভব অস্তিত্ব হয় অবস্তুগত , নয়তো প্রায় বস্তুগত , নয়তো বস্তুগত। এখানে আরো অনেক বিভাগ চিন্তা করা যায়। যেমন: বস্তুগত সৃষ্টি দু রকমের: জড় ও প্রাণশীল। প্রাণশীল সৃষ্টি দু রকম: বদ্ধ ও মুক্ত। উদ্ভিদ হচ্ছে বদ্ধ এবং অন্যান্য প্রাণশীল সৃষ্টি মুক্ত। মুক্ত প্রাণশীল সৃষ্টি হয় স্বাধীন বিচরণক্ষমতাহীন (যেমন: লোহিত কণিকা , শ্বেত কণিকা ও রোগজীবাণু) , নয়তো স্বাধীন বিচরণক্ষমতা সম্পন্ন। শেষোক্ত গোষ্ঠী হয় পুরোপুরি সহজাত প্রবৃত্তি চালিত (যেমন: মশা-মাছি) , নয়তো বুদ্ধিমান। বুদ্ধিমান প্রাণী হয় বিচারবুদ্ধি ও কল্পনাশক্তির অধিকারী (মানুষ) , নয়তো এ ক্ষমতার অধিকারী নয়।

অবস্তুগত ও প্রায় বস্তুগত সৃষ্টির মধ্যেও নিঃসন্দেহে বহুবিধ বিভাজন সম্ভব - যে সম্পর্কে আমাদের ধারণা খুবই সীমিত। এরূপ সৃষ্টি ব্যক্তিসত্তাসম্পন্ন ও ব্যক্তিসত্তাবিহীন হতে পারে। আবার জ্যামিতিক সত্যগুলো অর্থাৎ দ্বিমাত্রিক , একমাত্রিক ও শূন্যমাত্রিক অস্তিত্ব , গাণিতিক সংখ্যা , তরঙ্গ , চৌম্বক ক্ষেত্র , মানবমস্তিষ্কের কল্পিত সৃষ্টি , সুর , সৌন্দর্য ইত্যাদি অবস্তুগত সত্যকে কোন্ পর্যায়ে ফেলা যায় সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার।

এ তো গেলো এমন সৃষ্টির কথা যা কম - বেশী আমাদের বিচারবুদ্ধির ধারণক্ষমতার আওতাভুক্ত। এর বাইরে আরো বিভিন্ন মাত্রার ( Dimension)কতো রকম সৃষ্টি রয়েছে তা আমাদের পক্ষে চিন্তা করাও সম্ভব নয়।

বন্দিত্ব নাকি স্বাধীনতা ?

পরম স্রষ্টা যেমন বস্তুগত , অবস্তুগত , প্রায় বস্তুগত ও প্রাণশীল সৃষ্টিনিচয় সৃষ্টি করেছেন , তেমনি সৃষ্টি করেছেন প্রাকৃতিক বিধিবিধান। তিনি মাধ্যাকর্ষণ ও মহাকর্ষণ শক্তি এবং মৌলিক ও যৌগিক সৃষ্টিসমূহের জন্য সুনির্দিষ্ট গঠন-ফর্মুলা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এভাবে তিনি তাঁর সৃষ্টিজগৎকে সুনিয়ন্ত্রিত ও সুশৃঙ্খল করেছেন। এছাড়া তিনি প্রাণশীল সৃষ্টির জন্য সহজাত প্রবণতা সৃষ্টি করেছেন এবং কতক সৃষ্টিকে বুদ্ধিমত্তা দিয়েছেন ও জ্ঞানার্জনের যোগ্যতা দিয়েছেন। তিনি কতক প্রাণশীল সৃষ্টিকে বিচরণের স্বাধীনতা ও ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন এবং মানুষকে দিয়েছেন সর্বোচ্চ স্বাধীনতা , এমনকি প্রাকৃতিক বিধান ও সহজাত প্রবণতার বিরোধিতা বা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার স্বাধীনতা। ফলে প্রাকৃতিক বিধিবিধান ও সহজাত প্রবণতা দ্বারা অন্যান্য প্রাণীর স্বাধীনতা যতোখানি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে , মানুষের স্বাধীনতা ততোখানি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে না।

কিন্তু মানুষের স্বাধীনতার স্বরূপ নিয়ে অনেকে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছেন। কেউ কেউ মানুষকে নিরঙ্কুশ স্বাধীন বলে দাবী করেছেন , কেউ কেউ তাকে স্রষ্টার ইচ্ছার ক্রীড়নক গণ্য করেছেন এবং তার স্বাধীনতাকে পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। একদল বলছেন , আমরা যখন প্রাকৃতিক বিধিবিধানের সীমাবদ্ধতা ব্যতিরেকে মানবিক ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা অনুভব করি না , বরং স্বাধীনতা অনুভব করি , তখন আমরা পুরোপুরি স্বাধীন। অপর দল বলছেন , সৃষ্টিপ্রকৃতির নিখুঁত শৃঙ্খলার মধ্যে স্বাধীনতার অবকাশ থাকতে পারে না। বরং আমরা রেকর্ডকৃত কার্টুন-চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ন্যায় পূর্বসম্পাদিত ভূমিকার পর্দায় নিক্ষিপ্ত দৃশ্যসম বৈ নই ; আগামীতে আমি কোন্ ভূমিকায় আবির্ভূত হবো তা না জানলেও এতে সন্দেহ নেই যে , পূর্বে নির্ধারিত করে রাখা দৃশ্যে ও ভূমিকায়ই আবির্ভূত হবো। তাঁরা আরো বলেন যে , ভবিষ্যৎদ্রষ্টা সৃষ্টিকর্তা তো জানেনই ভবিষ্যতে আমার ভূমিকা কী হবে , অতএব , আমার পক্ষে তার অন্যথা করা সম্ভব নয়।

এ দুই মতের ধারকরা দুই প্রান্তিকতায় পৌঁছে গেছেন ; একদেশদর্শিতার কারণে তাঁরা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন।

বাস্তবে আমরা কী অনুভব করি ? আমরা একদিকে যেমন স্বাধীনতা অনুভব করি , অন্যদিকে সীমাবদ্ধতাও অনুভব করি ; স্বাধীনতা ও সীমাবদ্ধতা কোনোটিই নিরঙ্কুশভাবে অনুভব করি না।

বিশেষ করে যারা স্বাধীনতার ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছেন তাঁরা এমন দাবীও করে থাকেন যে , আমরা যে স্বাধীনতা অনুভব করছি , আসলে আমাদেরকে এরূপ অনুভব করতে বাধ্য করা হচ্ছে। তাঁদের এ ধারণা এ কারণে গ্রহণযোগ্য নয় যে , মানুষের যদি স্বাধীনতা না-ই থাকবে অথচ তাকে স্বাধীনতা অনুভব করতে বাধ্য করা হবে , তাহলে তা হবে এক ধরনের অন্যায় ও প্রতারণা। কিন্তু পরম পূর্ণতার অধিকারী স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির সাথে অন্যায় ও প্রতারণার আশ্রয় নেবেন এরূপ দুর্বলতা থেকে তিনি প্রমুক্ত।

অন্যদিকে স্বাধীনতার অনুভূতি যেমন অকাট্য ও সর্বজনীন , স্বাধীন অনুভব করতে বাধ্য করার অনুভূতি তদ্রূপ সর্বজনীন নয়। অর্থাৎ যারা মনে করছেন যে , আসলে আমরা স্বাধীন নই , তাঁরাও নিজেদেরকে স্বাধীন অনুভব করছেন , তবে কোনো কোনো যুক্তির ভিত্তিতে স্বীয় অনুভূতির বিপরীতে ধারণা করছেন যে , আমরা যা অনুভব করছি তা ঠিক নয় , বরং আমাদেরকে এরূপ অনুভব করতে বাধ্য করা হয়েছে। এ দাবী হচ্ছে বাস্তব অনুভূতির বিপরীত জ্ঞানগত বিতর্কের দাবী মাত্র এবং তার উৎস হচ্ছে ধারণা । অতএব , এ ধারণা যেমন সর্বজনীন নয় , তেমনি তা অকাট্যও নয়। আর ধারণাজাত বিতর্কিত দাবীর ভিত্তিতে সর্বজনীন অকাট্য অনুভূতির সত্যতায় সন্দেহ পোষণ করা চলে না।

যারা স্বাধীনতার অনুভূতিকে অস্বীকার করেন তাঁদের একটি যুক্তি হচ্ছে এই যে , এটা সৃষ্টিজগতের শৃঙ্খলার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু ঝুকিপূর্ণ হলেও স্বাধীন এক্তিয়ার সম্পন্ন সৃষ্টির অস্তিত্ব তার সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিক্ষমতার ব্যাপকতাই প্রমাণ করে , যার অনুপস্থিতিতে তাঁর সৃষ্টিক্ষমতা অপেক্ষাকৃত সীমিত প্রতিভাত হতো।

মানুষের স্বাধীনতার অনুভূতি অস্বীকারকারীদের আরেকটি যুক্তি হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার ভবিষ্যৎ জ্ঞানের যুক্তি। [এ প্রসঙ্গে ইতিপূর্বে বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে সৃষ্টি ও ব্যবস্থাপনার প্রক্রিয়া শিরোনামে কিছুটা সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে।] এর জবাবে বলতে হয় যে , আমরা সৃষ্টিকর্তার ভবিষ্যৎ জ্ঞানের স্বরূপ অবগত নই। অতএব , সে যুক্তিতে আমরা আমাদের অনুভূত স্বাধীনতাকে অস্বীকার করতে পারি না।

আমরা সৃষ্টিকর্তার জ্ঞানের স্বরূপ অনুধাবনে অক্ষম , তবে এর কয়েকটি দিক আমাদের বিচারবুদ্ধির নিকট অকাট্যভাবে প্রতিভাত। যেহেতু সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকার্যক্রম মানে হচ্ছে তাঁর ইচ্ছার বাস্তবায়ন এবং তিনি যা ইচ্ছা করেন তা সংশ্লিষ্ট স্থান , কাল , পাত্রপাত্রী , অবস্থা , কারণ ও প্রক্রিয়া সহ অনিবার্য হয়ে যায় , সেহেতু তিনি যদি সমগ্র ভবিষ্যত কে একবারে ইচ্ছা করেন তাহলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটা অনিবার্য হয়ে যায়। তাহলে অতঃপর আর তাঁর কিছুই করার থাকে না এবং তাঁর অন্য সমস্ত গুণ প্রয়োগ হারিয়ে ফেলে। কারণ , তিনি যা ইচ্ছা করে রেখেছেন তার বাইরে নতুন কিছুই তিনি করবেন না। কিন্তু বিচারবুদ্ধি সৃষ্টিকর্তার সীমাহীন সৃষ্টিক্ষমতার ও সীমাহীন মাত্রার অন্যান্য গুণের প্রয়োগ হারিয়ে ফেলার ধারণা গ্রহণ করে না। কারণ , তা তাঁর এ সব গুণ ও ক্ষমতার ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করে। অতএব , সৃষ্টিক্ষমতা সহ তাঁর সকল গুণের অনবরত কার্যকরিতা অনস্বীকার্য বিষয়। এমতাবস্থায় এমন অসংখ্য ক্ষেত্র থাকতে হবে যে বিষয়ে তিনি ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোনো ধরনেরই ইচ্ছা করেন নি , যে সব ক্ষেত্র ভবিষ্যতে তাঁর ইচ্ছা করা বা না-করার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। এই ক্ষেত্রসমূহেরই একটি হতে পারে সৃষ্টির স্বাধীনতার আওতাভুক্ত ভবিষ্যৎ ক্ষেত্র। অর্থাৎ কতক ক্ষেত্রে সৃষ্টি ভবিষ্যতে কী করবে সে ব্যাপারে স্রষ্টা কোনো কিছু ইচ্ছা করা থেকে বা সেদিকে মনোযোগ (توجه ) প্রদান করা থেকে বিরত থাকতে পারেন। কারণ , তিনি সেদিকে মনোযোগ প্রদান করলে তিনি যেভাবে মনোযোগ প্রদান করবেন সেভাবে তা ঘটা অনিবার্য হয়ে যাবে। বলা বাহুল্য যে , সমগ্র ভবিষ্যতের প্রতি মনোযোগ প্রদান করতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও তিনি এভাবে কতক ক্ষেত্রকে মনোযোগের বাইরে রাখতে এবং সৃষ্টির জন্য স্বাধীনতার একটি ক্ষেত্র নিশ্চিত করতে পুরোপুরি সক্ষম।

দ্বিতীয়তঃ সৃষ্টিকর্তা যেমন কতক বিষয় সরাসরি বা কারণ ও ফলশ্রুতি বিধির দ্বারা স্থির করে দিয়েছেন তেমনি কতক বিষয় স্থির করে না দিয়ে শর্তাধীন করে দিতে পারেন , যেমন: অমুক ব্যক্তি এ কাজ করলে ফল এই হবে এবং তা না করলে বা তার পরিবর্তে অমুক কাজ করলে ফল ঐ রকম হবে। অতঃপর ব্যক্তি স্বাধীন ইচ্ছা দ্বারা যা করবে তার ফলটি অকাট্য হয়ে যাবে এবং তার বিকল্প সম্ভাবনাটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কারণ , সম্ভব অস্তিত্ব (সৃষ্টি ও কাজ উভয়ই) অস্তিত্বলাভ করার ক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে এই যে , তা অস্তিত্বলাভের পূর্ণ কারণ ঘটলে তার অস্তিত্বলাভ অনিবার্য হয়ে যায় এবং পূর্ণ কারণ না ঘটা পর্যন্ত তার অস্তিত্বলাভ অসম্ভব থাকে। এরূপ শর্তাধীন স্থিরকরণ সৃষ্টিকর্তার সৃজনক্ষমতার বৈচিত্র্যেরই পরিচায়ক।

তৃতীয়তঃ ক্ষেত্রবিশেষে স্বাধীন সৃষ্টির অতীত কার্যকলাপ ও প্রাকৃতিক বিধিবিধানের দ্বারা তার ভবিষ্যৎ এমনভাবেও নির্ধারিত হয়ে যেতে পারে যে , সে ক্ষেত্রে দ্বৈত সম্ভাবনার সুযোগ না-ও থাকতে পারে। অর্থাৎ সৃষ্টি আগে যে স্বাধীনতার অধিকারী ছিলো তা বিলুপ্ত বা সঙ্কুচিত হয়ে যেতে পারে। এরূপ ক্ষেত্রে স্রষ্টা নিশ্চিত জানেন যে , ঐ ব্যক্তি এ কাজ করবে ও তার ফল এরূপ হবে ; এর অন্যথা হবে না। কিন্তু স্রষ্টার এ ভবিষ্যৎজ্ঞানের কারণে এ কথা বলা চলে না যে , স্রষ্টা তাকে এ কাজে বাধ্য করেছেন। একজন শিক্ষক যদি একজন ছাত্র সম্পর্কে নিশ্চিত জানেন যে , সে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হবে , তো এ কারণে বলা চলে না যে , শিক্ষকের ঐ ছাত্র সংক্রান্ত ভবিষ্যৎজ্ঞানের কারণেই এ ছাত্রটি অকৃতকার্য হয়েছে।

অবশ্য আগেও যেমন বলা হয়েছে , মানুষের এ স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ নয়। প্রাকৃতিক বিধিবিধানের কথা বাদ দিলেও পারিবারিক , সামাজিক , সাংস্কৃতিক ও মানব-জাত অন্যান্য কার্যকারণ তার এ স্বাধীনতাকে সীমিত করে ফেলে , কিন্তু তার স্বাধীনতাকে পুরোপুরি হরণ করতে পারে না। শেষ পর্যন্ত তার জন্য স্বাধীনতার ক্ষেত্র কমবেশী থেকেই যায়। এমনকি মানুষ যখন অনন্যোপায় হয়ে আত্মহত্যা করে তখনো কার্যতঃ সে তার স্বাধীন এ্খতিয়ারকেই কাজে লাগায়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে , মানুষের স্বাধীনতার নিয়ন্ত্রণ কি কেবল প্রাকৃতিক ও মানব-জাত কার্যকারণের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে ? এখানে পরম জ্ঞানী স্রষ্টার কি করণীয় কিছু নেই ? অন্য কথায় , তিনি কি সৃষ্টির কার্যক্রমে আদৌ হস্তক্ষেপ করবেন না ? বিচারবুদ্ধি এ ব্যাপারে কী বলে ?

বস্তুতঃ স্বাধীনতা হচ্ছে পরম পূর্ণতার অধিকারী অপরিহার্য সত্তার বৈশিষ্ট্য। সেই স্বাধীনতা তিনি তাঁর সসীম অপূর্ণ সৃষ্টি মানুষকে প্রদান করেছেন। যদিও এ স্বাধীনতা ব্যবহারের জন্য মানুষকে বিচারবুদ্ধি দেয়া হয়েছে , তথাপি দুর্বল ও অপূর্ণ হবার কারণেই এ স্বাধীনতা ব্যবহার করতে গিয়ে তার ভুল হবার আশঙ্কা থেকেই যায়। তাই বিচারবুদ্ধির দাবী হচ্ছে , ক্ষেত্রবিশেষে , বিশেষ করে সমগ্র সৃষ্টিলোক বা মানবপ্রজাতির স্বার্থে অপরিহার্য হলে , তেমনি মানুষ তাঁর কাছে সাহায্য চাইলে ও তাঁর বিবেচনায় সে সাহায্য পাওয়ার উপযুক্ত হলে তিনি সৃষ্টির স্বাধীন কর্মক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করবেন। (তবে এটা করা তাঁর জন্য অপরিহার্য গণ্য করা যায় না এবং সর্বাবস্থায়ই তিনি হস্তক্ষেপ বা সাহায্য করবেন এটাও ভাবা যায় না। কারণ , তাহলে সৃষ্টির স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যাবে।)

বিষয়টি কয়েকটি উপমার সাহায্যে সহজে বুঝা যেতে পারে।

প্রথম উপমা: একজন পিতা তাঁর শিশু সন্তানকে খেলার জন্য একটি বল দিলেন , সাথে সাথে তিনি তাকে নদীর কিনারে গিয়ে খেলতে নিষেধ করলেন। কিন্তু শিশুটি নদীর কিনারে গিয়ে খেলতে লাগলো। কারণ , তার পিতা তাকে নদীর কিনারে গিয়ে খেলতে নিষেধ করলেও তার সেখানে যাওয়া ও খেলার পথ রুদ্ধ করেন নি ; ধরুন , পিতা তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে পারতেন , কিন্তু তিনি তা করেন নি। এমতাবস্থায় খেলার সময় শিশুটির বলটি ছিটকে নদীতে পড়ে গেলো। এখন পিতা কী করবেন ? এ অবস্থায় শিশুটি পিতাকে বলটি তুলে দিতে বলতে পারে , বা না-ও বলতে পারে। উভয় অবস্থায়ই পিতা চাইলে বলটি তুলে দিতে পারেন , বা তা তুলে আনার আগেই অনেক দূরে চলে যাওয়ায় তিনি তাকে আরেকটি নতুন বল কিনে দিতে পারেন ও আগেকার ঘটনার পুনরাবৃত্তির ব্যাপারে কঠোরভাবে সতর্ক করে দিতে পারেন। অবশ্য তিনি চাইলে কোনো কারণে বলটি তুলে দেয়ার চেষ্টা না-ও করতে পারেন বা নতুন বল কিনে দেয়া থেকেও বিরত থাকতে পারেন। তবে সাধারণতঃ তিনি প্রথম বারের ক্ষেত্রে বা শিশুর বয়স ও আরো কিছু বিষয় বিবেচনা করে বলটি তুলে দেন বা নতুন একটি বল কিনে দেন।

অথবা ধরুন , একটি বাড়ীর চতুর্দিকে পানিভর্তি গভীর খাদ ; পিতা শিশুকে খাদে নামতে , এমনকি তার কাছে যেতেও নিষেধ করলেন , বললেন: খাদে নামলে বা তাতে পড়ে গেলে ডুবে মরবে। কিন্তু শিশু শিশু হওয়ার কারণেই পিতার কথার গুরুত্ব বুঝলো না এবং খেলতে খেলতে খাদের কিনারে গিয়ে অসাবধানতাবশতঃ বা পা পিছলে তাতে পড়ে গেলো অথবা কৌতুহলবশে তাতে নেমে গেলো এবং ফলে সে পানিতে ডুবে গেলো। এ অবস্থায় পিতা খাদে নেমে তাকে তুলে আনলেন , ফলে সে বেঁচে গেলো , কিন্তু নাকে , কানে ও পেটে দুর্গন্ধযুক্ত পচা পানি ঢুকে যাওয়ায় সে শুধু তাৎক্ষণিক কষ্ট আর ভোগান্তির শিকারই হলো না , বরং অসুস্থ হয়ে পড়লো।

আবার এমনও হতে পারে যে , খাদটি এতোই গভীর ছিলো যে , তার তলদেশ থেকে তুলে আনতে আনতে সে মারা গেলো। হতে পারে যে , খাদটি খুব বেশী গভীর না হলেও খাদের পানি খুব বেশী দূষিত থাকায় ঐ বিষাক্ত পানি পেটে যাবার কারণেই সে মারা গেলো অথবা মারা না গেলেও সে কঠিন রোগে আক্রান্ত হলো এবং তার জীবনীশক্তি হ্রাস পেলো।

ক্ষেত্রবিশেষে খাদের মধ্যে কাঁটা বা ভাঙ্গা কাঁচ থাকতে পারে যার ফলে সে মারাত্মকভাবে আহত হতে পারে এবং বেঁচে গেলেও বিকলাঙ্গ হয়ে যেতে পারে। অবশ্য সে কষ্ট ও ভোগান্তির শিকার বা অসুস্থ বা বিকলাঙ্গ হওয়ায় অথবা মারা যাওয়ায় এ ঘটনাটা অন্য শিশুদের জন্য শিক্ষণীয় হলো।

আবার এমনও হতে পারে যে , শিশুটি এক পা খাদে ফেলতে উদ্যত হওয়ার সাথে সাথেই , অথবা এমনকি খাদের কিনারে যেতেই বাবা তাকে ধরে ফেললো ও সেখান থেকে দূরে সরিয়ে আনলো এবং এভাবে ধরে নিয়ে আসার কাজটা প্রহারসমেতও হতে পারে যাতে সে ভবিষ্যতে এ কাজের পুনরাবৃত্তি করা থেকে বিরত থাকে।

অথবা মনে করুন , কোনো জাহাযের সারেং যাত্রীদেরকে ডেকের কিনারে যেতে নিষেধ করলেন এবং বলে দিলেন যে , পানিতে হাঙ্গর ও কুমীর আছে। কিন্তু কতক যাত্রী তাঁর কথা শুনলো না। তারা ডেকের কিনারে গিয়ে দাঁড়ালো এবং তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ পানিতে পড়ে গেলো , আর ডুবুরী নেমে উদ্ধার করার আগেই তাদেরকে কুমীর এসে টেনে নিয়ে গেলো বা হাঙ্গর এসে ছিন্নভিন্ন করে ফেললো।

অথবা সাঁতার জানা এক ব্যক্তি প্রয়োজনের তাগিদে সাঁতরে নদী পাড়ি দিলো , কিন্তু কিনার থেকে পাঁচ , সাত বা দশ হাত দূরে পৌঁছতেই সাঁতরাবার শক্তি হারিয়ে ফেললো। তখন সে সাহায্য চাইতে বা না চাইতেই কিনারে থাকা লোকদের মধ্য থেকে কেউ নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে তীরে তুলে আনলো। কিন্তু অপর এক ব্যক্তি ভালো সাঁতার না জানা সত্ত্বেও অন্যদের নিষেধ উপেক্ষা করে অহঙ্কার অথবা বোকামি বশতঃ এক মাইল প্রশস্ত নদী পাড়ি দিতে গিয়ে সিকি বা অর্ধ বা পৌনে এক মাইল পৌঁছার পর সাঁতরাবার শক্তি হারিয়ে ফেললো এবং লোকদের কাছে সাহায্য চাইলো , কিন্তু কেউ তাকে সাহায্য করতে গেলো না , কারণ , সে অন্যদের সদুপদেশ না শুনে নিজের জন্য বিপদ ডেকে এনেছে। তাই কেউ তাকে সাহায্যের হক্বদার মনে করে নি , অথবা সাহায্য পৌঁছার আগেই তার মারা যাওয়া নিশ্চিত জেনে তাকে উদ্ধারের চেষ্টা অর্থহীন মনে করে তারা তাকে উদ্ধারের চেষ্টা থেকে বিরত থাকলো। অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষে তার কাছাকাছি কোনো নৌকা বা স্পীড-বোট থাকলে তিরস্কার করেও তাকে দয়া দেখাতে পারে। তেমনি সে যদি নদীর তীরের খুবই কাছাকাছি এসে যায় , ধরুন বিশ গজের মধ্যে এসে যায় , সে ক্ষেত্রে তার হঠকারিতা বা বোকামির জন্য তিরস্কার করলেও কেউ দয়া করে তাকে তীরে তুলে আনতে পারে।

অবশ্য মানুষের আচরণে আমরা দেখতে পাই যে , অন্যদের পক্ষ থেকে উচ্চারিত সতর্কবাণী ও কৃত কল্যাণকামনা উপেক্ষা করে অথবা নির্বুদ্ধিতাবশতঃ যারা নিজেদেরকে বিপদে নিক্ষেপ করে তাদের সকলের ক্ষেত্রে বা একই ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রতি বারই কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে না। কারণ , সে ক্ষেত্রে সতর্কবাণী ও কল্যাণকামনা উপেক্ষা করে নিজেকে বিপদে নিক্ষেপ করতে কেউই দ্বিধা করতো না এবং এর ফলে সতর্কবাণী ও কল্যাণকামনা অর্থহীন হয়ে যেতো। অবশ্য সাহায্য চেয়ে ফরিয়াদ করলে সাহায্য লাভের সম্ভাবনা বেশী থাকে , তবে তা-ও নিশ্চিত নয়।

মোদ্দা কথা , সৃষ্টিকর্তা তাঁর এ দুর্বল সৃষ্টিকে স্বাধীনতা দেয়ার পর নিরঙ্কুশভাবে তার নিজের ওপর ছেড়ে দেবেন এবং তার প্রতি দৃষ্টি রাখবেন না ও তার কাজে ইতিবাচক হস্তক্ষেপ করবেন না - বিচারবুদ্ধি এটা মানতে পারে না। বিশেষ করে মানবপ্রকৃতি তার নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কঠিন সঙ্কটময় মুহূর্তে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে সৃষ্টিকর্তার নিকট আশ্রয় ও সাহায্য কামনা করে। এমতাবস্থায় তার প্রত্যাশা ও প্রার্থনা যদি অন্যায় , অযৌক্তিক বা অবাস্তব না হয় তাহলে সৃষ্টিকর্তা তাকে সাহায্য করবেন এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে সর্বাবস্থায়ই তিনি তাকে সাহায্য করবেন বা তার এক্তিয়ারাধীন কাজে হস্তক্ষেপ করবেনই এমনটি মনে করাও ঠিক হবে না। কারণ , তিনি সাহায্য বা হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য নন। তিনি যদি সাহায্য বা হস্তক্ষেপ করেন , তো সেটা সৃষ্টির অধিকার নয় , বরং তাঁর অনুগ্রহ।

অন্যদিকে কোনো মানুষের বা কোনো মানবগোষ্ঠীর স্বাধীনতার অপব্যবহারমূলক নেতিবাচক পদক্ষেপের উদ্যোগ যদি সমগ্র সৃষ্টিলোক বা পৃথিবী বা মানবপ্রজাতির জন্য এমনই ধ্বংসাত্মক হয় যার ফলে সৃষ্টির লক্ষ্য ব্যর্থ হয়ে যাবার আশঙ্কা থাকে , সে ক্ষেত্রে বিচারবুদ্ধির দাবী এটাই যে , সৃষ্টিকর্তা সেখানে হস্তক্ষেপ করবেন এবং ধ্বংসকামী ঐ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নেতিবাচক উদ্যোগকে বানচাল করে দেবেন।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে , যেহেতু সৃষ্টিকর্তা ইতিবাচক , সেহেতু সৃষ্টির কাজে তাঁর হস্তক্ষেপও সর্বাবস্থায়ই ইতিবাচক হবে , কখনোই নেতিবাচক হবে না - এটাই বিচারবুদ্ধির দাবী। অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষে সৃষ্টিকর্তার কোনো কোনো হস্তক্ষেপ আপতঃদৃষ্টিতে নেতিবাচক বলে মনে হতে পারে , কিন্তু পিতা কর্তৃক তার দুষ্ট শিশুকে প্রহার করার ন্যায় অথবা চিকিৎসক কর্তৃক কারো শরীরের পচনধরা অঙ্গ কেটে ফেলার ন্যায় উদ্দেশ্য ও পরিণামফলের বিচারে তাঁর সে দৃশ্যতঃ নেতিবাচক হস্তক্ষেপ অবশ্যই ইতিবাচক।


13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27