ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল 11%

ইনসানে কামেল লেখক:
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

ইনসানে কামেল
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 83 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 42379 / ডাউনলোড: 7055
সাইজ সাইজ সাইজ
ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

মানুষের নৈতিকতা

মানবসত্তা ও তার স্বরূপ সম্পর্কে বিশেষ মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হলেও এ বিষয়ের সাথেই সংশ্লিষ্ট অন্য একটি বিষয়ে কোন মতপার্থক্য লক্ষ্য করা যায় না। আর তা হলো এমন বিষয়ের অস্তিত্ব যা বস্তু বা বস্তুগত নয়- যাকে নৈতিকতা নামকরণ করা যেতে পারে এবং যা মানুষকে মূল্যবোধ ও ব্যক্তিত্ব দান করে। মানুষ বলতে তার এই বৈশিষ্ট্য ধারণকেই বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যদি তাকে এ বৈশিষ্ট্য থেকে পৃথক করা হয় তাহলে পশুর সাথে তার কোন পার্থক্য থাকে না। অন্যভাবে বলা যায়,মানুষের মনুষ্যত্ব তার বাহ্যিক দেহাবয়বে নয় যে,কারো একটি মাথা,দু টি কান,প্রশস্ত নখ,পরিমিত উচ্চতা ও যা ইচ্ছে তা-ই করুক না কেন তাকে মানুষ বলা যাবে। না,তেমনটি নয়। শেখ সা দী যথার্থই বলেছেন,

দেহ তোমায় মহান করে না,করে যা আত্মায়,

হৃদয় রাঙানো পোশাকে তোমার সৌন্দর্য নয়,

নয় তাতে মনুষ্য পরিচয়।

চক্ষু,কণ্ঠ,জিহ্বা আর নাসিক্যে যদি হয় মনুষ্য পরিচয়,

কি তফাৎ বল দেয়ালের ঐ ছবি আর মানবসত্তায়?

যদি এ সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অধিকারীকেই মানুষ বলা হয়,তবে সকলেই মানুষ (আমরা দৈনন্দিন জীবনে মানুষ থাকা ও মানুষ হওয়া এ কথাগুলো ব্যবহার করি,এমনকি এ দৃষ্টান্ত ধর্মীয় ছাত্রদের মধ্যেও ব্যাবহৃত হয়,যেমন মোল্লা হওয়া কত সহজ,কিন্তু মানুষ হওয়া কত কঠিন!) হিসেবেই মায়ের গর্ভ থেকে পৃথিবীতে জন্ম নিত। কিন্তু না। মানুষ হওয়া মানে হলো বিশেষ গুণ,চরিত্র ও অর্থের অধিকারী হওয়া। যার ফলে তাকে মানুষ বলা যায় এবং সে মূল্যবোধ ও ব্যক্তিত্ব অর্জন করে। ইদানিংএ সকল বিষয়ই (যার উপস্থিতি মানুষকে মূল্যবোধ দান করে আর যার অনুপস্থিতি তাকে পশুর সামিল করে)- মানবিক মূল্যবোধ নামে পরিচিত।

অদ্যকার এ সভায় আমার বক্তব্যকে পূর্ববর্তী সভার আলোচ্য বিষয়ের ধারাবাহিকতায় অনুবর্তন করব। উল্লেখ্য যে,ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত বিচ্যুতিসমূহকে দু ভাগে ভাগ করা যায়। এক ধরনের বিচ্যুতি আছে যাতে মূল্যবোধহীনতা মূল্যবোধ -এর বিপরীতে অবস্থান নেয়। যেমন : অন্যায় ন্যায়ের বিরুদ্ধে,ভয়-ভীতি মুক্তির বিরুদ্ধে,খোদার প্রতি উদাসীনতা ও উচ্ছৃঙ্খলতা খোদার উপাসনা ও শৃঙ্খলতার বিরুদ্ধে; অজ্ঞতা ও মূখতা জ্ঞান,বিবেক ও প্রজ্ঞার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তবে সম্ভবত অধিকাংশ বিচ্যুতিই উল্লিখিত ধরনের নয় যাতে মূল্যবোধহীনতা মূল্যবোধের বিপরীতে অবস্থান নেয়। যেখানে মূল্যবোধহীনতা মূল্যবোধের বিপরীতে অবস্থান নেয় সেখানে প্রথমোক্তটি (মূল্যবোধহীনতা) অপনোদিত হয়। মানবকুলের অধিকাংশ বিচ্যুতিই নদীর জোয়ার ভাটার মতই। কখনো কখনো কোন বিশেষ মূল্যবোধ অপর মূল্যবোধসমূহ অপেক্ষা এতটা প্রবৃদ্ধি লাভ করে যে,অন্যান্য মূল্যবোধকে ধ্বংস করে ফেলে। যেমন : সংযম ও ধর্মানুরাগ একটি মূল্যবোধ যা মনুষ্যত্বের মানদণ্ডসমূহের মধ্যেও একটি। কিন্তু কখনো কখনো দেখা যায় কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যুহদের (দুনিয়া বিমুখতা) প্রতি এতটা ঝুকে পড়ে যে,তাতে বিলীন হয়ে যায় এবং অন্য সব কিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। অবশেষে এমন এক মানুষে পরিণত হয় যার একটি অঙ্গই (যেমন : নাক) প্রবৃদ্ধি লাভ করে এবং অন্যান্য অঙ্গ অপরিবর্তিত থেকে যায়।

কষ্ট এবং তার ফল

চরম বস্তুবাদী মতবাদগুলোও এক নৈতিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী- এ ভূমিকা দিয়ে বলা যেতে পারে সকল মানবীয় মূল্যবোধ এক বিশেষ প্রেক্ষাপটে সারসংক্ষিপ্ত হয় যা নিজেই একটি শাখায় পরিণত হয় এবং তা এমন এক প্রেক্ষাপট যা আরেফগণের পরিভাষায় যেমনটি এসেছে তেমনি এসেছে সমসাময়িক আলেমগণের পরিভাষায়ও। তবে আরেফগণের পূর্বেই তা ইসলামের মূল পাঠ্যসমূহে ব্যবহৃত হয়েছে। আর ঐ প্রেক্ষাপটকে এভাবে বর্ণনা করা যায় যে,মূলত মনুষ্যত্বের প্রকৃত মানদণ্ড তা-ই যার ফলে কষ্ট কষ্ট প্রাপক -কে ব্যাখ্যা করা যায়। মানুষ এবং অন্যের (প্রাণীর) মধ্যে পার্থক্য হলো যে,সে কষ্ট ও বেদনাকে অনুভব করে। কিন্তু অন্যান্য প্রাণী তা পশুই হোক কিংবা মানুষের দেহাবয়বে মনুষ্যত্বহীন মানবই হোক- কষ্টের অনুভূতি সম্পন্ন নয়।

অতএব,প্রারম্ভেই কষ্ট সম্পর্কে আলোচনা করব। হয়তো প্রথমত একটা আশ্চর্য বিষয় মনে হবে যে,এর মানে কি?

অবশ্য স্মরণযোগ্য,আমরা কষ্ট এবং কষ্টের উৎস এ দু য়ের মধ্যে ভুল অর্থ করি। যেমন কোন অসুখ বা জখমের মন্দের কারণ হলো জীবাণু; আর তার উপস্থিতিই হলো অসুখ বা জখম- যা দেহে অনুপ্রবেশ করে কষ্টের সৃষ্টি করে। অনুরূপ কোন ক্ষত যা অন্ত্রে হয় এবং মানুষ তার ব্যথা অনুভব করে তা ঐ ক্ষতের ফলেই। বেদনা মানুষের জন্য অস্বস্তির হলেও জ্ঞান ও জাগরণের কারণও বটে,এমনকি শারীরিক ব্যথা যা মানুষ বা পশুর জন্য অভিন্ন তাও মানুষের জ্ঞান এবং জাগরণের কারণ। যখন কারো মাথা ব্যথা হয় তখন এটা ধারণা করা অসম্ভব যে,কোন কারণ ব্যতিরেকেই ব্যথার সৃষ্টি হয়েছে। ব্যথা অনুভূত হওয়ার ফলে মাথার কোন অসুস্থতা বা ক্ষত সম্পর্কে মানুষ অবগত হয় এবং তখন তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে ঠিক যেন কোন কারখানা বা গাড়ীর সূচকের মতো। যেমন কোন সূচক তৈলের পরিমাণ ইঙ্গিত করে আবার কোনটি পানির তাপমাত্রার পরিমাণ। যদি কোন সূচক ইঙ্গিত করে যে,পানির তাপমাত্রা খুব উচ্চে আছে তাহলে সেটা কি ভালো না খারাপ? অবশ্যই তা ভালো। কারণ তা আপনাকে গাড়ীর অবস্থা সম্পর্কে খবর দেয় বা সতর্ক করে দেয়। যদি ব্যথা বা এর অনুভূতি মানুষের মধ্যে না থাকত তবে প্রথমত এর সম্পর্কে অবগত হতো না। দ্বিতীয়ত এ ব্যথা মানুষকে এক নিযুক্ত কর্মচারীর মতো উপায় অনুসন্ধানের জন্য বাধ্য করে এবং তাকে তড়িৎ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আহবান করে। যেহেতু ব্যথা আছে তা তাকে অস্বস্তিকর করে তুলে এবং নিয়মিত তাকে বলে যেভাবেই হোক এ ব্যথার উপশম করো।

সুতরাং ব্যথা এমনকি শারীরিক বা আঙ্গিক হলেও তাতে অনুগ্রহ আছে,অনুভূতি আছে,আছে জ্ঞান ও জাগরণ। অবগতি ও জাগরণ সর্ববস্থায়ই উত্তম,এমনকি তা শারীরিক কোন ক্ষত সম্পর্কে হলেও। এ প্রসঙ্গে মোল্লা অপূর্বই বলেছেন,

অনুতাপ ও তিক্ততায় জর্জড়িত যে পীড়িত

পীড়ার ক্ষণের সবটুকুতেই সে হয় আলোড়িত

তাই জেনে রাখ,এ সত্যটুকু হে সত্যানুরাগী

তিক্ততা যার জীবনে আছে,সে-ই পেয়েছে সুগন্ধ অমৃতলোভী

যে যতটুকু জাগরিত ততটুকুই ব্যথিত

যে যতটুকু হয় অনুতপ্ত,ততটুকই হয় বিমর্ষিত।

অতঃপর এখানে এসে বাকচাতুর্য প্রদর্শন করেন এবং বলেন,ব্যথিতের বেদন ব্যথিত ছাড়া আর কেউ অনুভব করতে পারে না। বিশেষ করে সে এ বিষয়ে আর সকলের চেয়ে বেশি অবগত। বেদনাহীনতা মানে উদাসীনতা; বোধহীনতা,অনুভূতিহীনতা বা অবোধ্যতা। অপরদিকে বেদনার উপলব্ধি মানে হলো জ্ঞাতী,জাগরণ,বোধগম্যতা এবং বেদনাহীনতা যার অর্থ অজ্ঞতা।

যদি মানুষের জীবনে দু টি পর্যায় থাকে- বেদনাহীনতা ও অজ্ঞতা এবং তার বিপরীতে বেদনা ও বোধ্যতা- তবে কোনটিকে নির্বাচন করবে? মানুষ বেদনা ও বোধ্যতাকে প্রধান্য দিবে,না অজ্ঞতা বা নির্বুদ্ধিতা ও বেদনাহীনতাকে? নিশ্চয়ই বুদ্ধিদীপ্ত কষ্টকর জীবন নির্বোধ সুখকর জীবনের চেয়ে শ্রেয়তর।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়,স্হুল শূকর হওয়ার চেয়ে দুর্বল সক্রেটিস হওয়া অনেক উত্তম। অর্থাৎ যদি মানুষ জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান হয় কিন্তু বঞ্চিত,তবে তা এক নির্বোধ শূকর- যার জন্য সকল কিছুই সহজলভ্য তার চেয়ে অনেক উত্তম।

জ্ঞানের প্রতি অভিযোগ

একটি বিষয় আমাদের সাহিত্যকর্মে পরিলক্ষিত হয় যা হলো জ্ঞান সম্পর্কে অভিযোগ। আমরা সাহিত্যকর্মে- বিশেষ করে আমাদের কবিতাসমূহে খুব বেশি দেখতে পাই যে,অনেকেই জ্ঞানের প্রতি অভিযোগ করে বলেছেন, হায়,যদি আমার জ্ঞান না থাকত! কি লাভ জ্ঞানের অধিকারী হয়ে,আর সমাজে জ্ঞানী,সতর্ক এবং সংবেদনশীল হয়ে? এই সংবেদনশীলতা,জ্ঞান আর সতর্কতাই মানুষের অশান্তির কারণ।

আমার বুদ্ধি ও বিবেকই জীবনের শত্রু আমার

হায়,যদি উন্মুক্ত না হতো দৃষ্টি আমার,শ্রবণ আমার।

আরেক জন বলেছেন,

জ্ঞানী হয়ো না- বেদনায় হবে উন্মাদ

উন্মাদ হও- তোমার সমব্যথী হবে জ্ঞানীজন।

অর্থাৎ এ ধরনের লোকেরা জীবনের উন্মাদনাপূর্ণ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে,দুঃখ-দুর্দশাপূর্ণ জীবন যা জ্ঞান,চিন্তা ও অনুভূতি সম্পন্ন তার উপর প্রাধান্য দান করেন। কিন্তু এ কথাগুলো ভ্রান্ত ধারণার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। যে ব্যক্তি মনুষ্যত্বের ধাপে উন্নীত হয়েছে এবং কষ্ট ও সংবেদনশীলতার অর্থ অনুভব করতে পেরেছেন,তিনি কখনো বলবেন না, আমার বুদ্ধি ও বিবেকই জীবনের শত্রু আমার বরং নবী (সা)-এর হাদীস থেকে বলবেন-

صدیق کلّ امریء عقله و عدوّه جهله

প্রত্যেকেরই প্রকৃত বন্ধু তার বিবেক (আকল) আর তার সত্যিকারের শত্রু তার অজ্ঞতা (জাহেল)। (উসূলুল কাফী,১ম খণ্ড,পৃ. ১১)

যিনি বলেছেন আমার বুদ্ধি ও বিবেকই জীবনের শত্রু আমার এবং বুদ্ধি ও বিবেক থেকে উৎসারিত দুঃখ-কষ্টকে এভাবে অভিযুক্ত করেছেন; অনুমান করা যায় তিনি অজ্ঞতা থেকে উৎসারিত দুঃখ-কষ্টকে অনুভব করেননি,যদি তাই হতো তবে এ কথাগুলো বলতেন না। হ্যাঁ,যদি ব্যথার কারণ না থাকে এবং মানুষ ব্যথা অনুভব না করত,তবে ব্যথার কারণ বিদ্যমান না থাকার ফলে ব্যথা না থাকাটাই শ্রেয় হতো। কিন্তু যদি ব্যথার কারণ বিদ্যমান থাকে বা ব্যথার উৎস থাকে,অথচ মানুষ ব্যথা অনুভব নাকরে,তবে তার জন্য দুরবস্থাই বয়ে আনবে। মানুষের শারীরিক অসুস্থতার ব্যপারটিও তাই। যে সকল অসুস্থতায় ব্যথা বা অস্বস্তি অনুপস্থিতি থাকে তা মানুষকে নীরবে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেয়। কারণ সে তখনই কেবল বুঝতে পারে যখন নিরাময় তার নাগালের বাইরে চলে যায়। প্রাণঘাতী ক্যান্সারে মানুষের মৃত্যুর কারণও এটাই। ক্যান্সার হলে অন্তত প্রাথমিক পর্যাযে অস্বস্তি অনুভূত হয় না। যদি প্রাথমিক পর্যায়েই অস্বস্তি অনুভূত হতো তবে হয়তো রক্ত বা লসিকায় প্রবেশের পূর্বেই সম্পূর্ণরূপে নিমূল করা যেত। আর ক্যান্সারের ভয়াবহতার কারণ এটাই- নীরবে,নিঃশব্দে মানুষের দেহে তার অনুপ্রবেশ ঘটে।

সুতরাং মানুষের অমূল্য সম্পদগুলোর মধ্যে একটি মূল্যবান সম্পদ হলো ব্যথার অনুভূতি থাকা। তাই ব্যথা খারাপ কিছু বলে একে উপেক্ষা করা যায় না।

মানুষ ও ব্যথা

মানুষের ক্ষেত্রে ব্যথা কি? যদি কারো মাথা ব্যথা হয়,তাহলে তা এ দৃষ্টিকোণ থেকে নয় যে,সে মানুষ। কারণ একটি চতুস্পদ প্রাণীরও (যেমন দুম্বা ) মাথা ব্যথা হতে পারে। মানুষের হাত-পায়ের ব্যথা অন্যান্য প্রাণীর অঙ্গের ব্যথার মতোই। কিন্তু যারা মানুষের ব্যথা এবং ব্যথার ধারক হিসেবে মানুষ- এ সম্পর্কে কথা বলছেন তাদের লক্ষ্য এ ব্যথা নয়,বরং সে ব্যথা যা মানুষের জন্য অমূল্য রত্ন এবং তা অন্য কিছু।

একদল লোক (যেমন আরেফগণ) ব্যথাকেই মানুষের মধ্যে অনুসন্ধান করেন এবং নিয়মিত যার পবিত্রতা রক্ষা করেন- তা হলো মহান আল্লাহর অনুসন্ধান। তারা বলেন,এ ব্যথা একমাত্র মানুষেরই বৈশিষ্ট্যগত ব্যাপার,এমনকি ফেরেশতাদের উপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ হলো মানুষের ব্যথা আছে,ফেরেশতাদের ব্যথা নেই।

ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ সেই বাস্তবতা যার মধ্যে বিধাতার ফু উদগত হয়েছে,অন্য এক ভূবন থেকে যার আবির্ভাব ঘটেছে এবং প্রকৃতিতে যে সকল বস্তু রয়েছে তার সাথে সে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। এখানে সে এক বিশেষ ধরনের নির্বাসন,ভিন্নতা ও সকল সৃষ্টির সাথে বৈসাদৃশ্য অনুভব করে। এর কারণ প্রতিটি জিনিসই ধ্বংসশীল,পরিবর্তনশীল এবং নিরাসক্তিযুক্ত,কিন্তু মানুষের মধ্যে রয়েছে অমরত্বের এক বিশেষ সম্ভাবনা। আর এ ব্যথা (খোদার অনুসন্ধান) তা-ই যা মানুষকে মহান আল্লাহর ইবাদত ও উপাসনার দিকে পরিচালিত করে। অনুরূপ আপন চাওয়া-পাওয়ার আর্তি মহান প্রভুর কাছে প্রকাশ করার,তার সান্নিধ্য লাভ করার এবং মূলে ফিরে যাওয়ার দিকে মানুষকে আকর্ষণ করে।

মানুষের কষ্ট সম্পর্কিত কয়েকটি দৃষ্টান্ত

লক্ষ্য করবেন,কি রকম দৃষ্টান্ত আমাদের এরফানশাস্ত্রে এ সম্পর্কে দৃষ্টিগোচর হয়েছে! কখনো উদাহরণস্বরূপ বলা হয়,একটি তোতাপাখি হিন্দুস্থানের অরণ্য থেকে এনে খাঁচায় বন্দী করা হয়েছে। সে সব সময় উদ্বিগ্ন থাকে কখন এ খাঁচা ভাঙবে? কখন সে ফিরবে আপন কুলায়? কখনো মানুষকে একটি মোরগ যে তার বাসা থেকে দূরে চলে গেছে তার সাথে তুলনা করা হয়। এমনি একটি চমৎকার তুলনা মৌলভী রুমী তার মাসনভীর প্রথমে উল্লেখ করেছেন। তিনি মানুষকে সেই বাঁশের সাথে তুলনা করেছন যাকে তার জন্মস্থান থেকে কেটে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। তদবধি সে সারাক্ষণ ক্রন্দনরত। তার এ ক্রন্দন,আর্তনাদ যেন তার জন্মভূমির বিরহ ব্যথাকে চিত্রিত করে।

শোন ঐ বাঁশের বাঁশীর করুণ কাহিনী

সে করছে বর্ণন তার বিরহগীতি

যখন আমায় করেছে বিচ্ছিন্ন জন্মস্থান থেকে

আর্তনাদ আর ক্রন্দন ধ্বনি বিমর্ষিত করেছে নারী আর নরে।

ইচ্ছে করে হৃদয় বিদীর্ণ করি বিরহে

বলি বেদনার মর্মকথা হৃদয় নিনাদে।

অতঃপর বলেন,

যেন দু টি সুখ রয়েছে আমার

একটি তার লুকিয়ে আছে ওষ্ঠাধরে।

কখনো মৌলভী একটু ভিন্নতা দিয়ে উপমিত করেন-

হস্তী যখন ঘুমায়; স্বপনে দেখে হিন্দুস্থান

গাধা কখনো দেখে না হিন্দুস্থান

কারণ হিন্দুস্থান যে নয় তার জন্মস্থান।

কথিত আছে,যে হাতীকে হিন্দুস্থান থেকে আনা হয়,তাকে সব সময় একটা কঠোর অবস্থার মধ্যে রাখা হয় যাতে করে সে হিন্দুস্থানের স্মরণে নিজেকে ব্যস্ত না রাখতে পারে। মৌলভী এখানে বলেন,একমাত্র হাতীই হিন্দুস্থানকে স্বপ্নে দেখে,কারণ সে হিন্দুস্থান থেকে এসেছে। গাধা কখনো হিন্দুস্থানকে স্বপ্নে দেখে না। কারণ সে হিন্দুস্থান থেকে আগমন করেনি। প্রকৃতপক্ষে তিনি বলতে চান,একমাত্র মানুষই অন্য এক জগতে প্রত্যাবর্তনের জন্য উৎকণ্ঠিত হয়,যার রয়েছে আধ্যাত্মিকতা ভিত্তিক ব্যথা-বেদনা; বেদনার আর্তিতে সে খুজে ফিরে সত্য ও মহান প্রভুর দিকে প্রত্যাবর্তনের পথ। তারই রয়েছেুঁ মুক্তির নিমিত্তে বেদনা,মহাসত্যের সাথে পুনর্মিলনের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা।

শেষ নবী (ছ্বাঃ) ও কোরআন মজীদের অপরিহার্যতা

ইয়াহূদী ও খৃস্টানরা হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)কে আল্লাহর মনোনীত নবী হিসেবে ও কোরআন মজীদকে আল্লাহর প্রেরিত গ্রন্থ হিসেবে স্বীকার করে না। সেই সাথে ইয়াহূদীরা হযরত ঈসা ( আঃ)কেও নবী হিসেবে স্বীকার করে না। এ দু টি ধর্মীয় জনগোষ্ঠী নিজেদেরকে নবী-রাসূলগণের ( আঃ) ও ঐশী কিতাবের অনুসরণকারী বলে দাবী করে থাকে। কিন্তু খৃস্টানরা বিগত প্রায় দুই হাজার বছর কালের মধ্যে এবং ইয়াহূদীরা আরো বেশীকালের মধ্যে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে কোনো নবীর আগমন ও কোনো আসমানী কিতাব নাযিলের দাবী ও প্রয়োজনীয়তাকে বিবেচনায় নেয় নি।

এমতাবস্থায় ইয়াহূদী ও খৃস্টানদের জন্য বিচারবুদ্ধির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কতগুলো প্রশ্নের জবাব প্রদান করা অপরিহার্য বলে মনে করি। প্রশ্নগুলো হচ্ছে :

এক : হযরত ঈসা ( আঃ)-এর পূর্বে বা তাঁর মাধ্যমে কি নবুওয়াতের ধারাবাহিকতা পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়েছে এবং মানুষের কাছে কি ঐশী প্রত্যাদেশের সর্বশেষ ও পূর্ণাঙ্গ প্রত্যাদেশ ঐ সময়ই পৌঁছে গিয়েছিলো ? পৌঁছে গিয়ে থাকলে তা কোথায় ? ইয়াহূদীদের অনুসৃত বাইবেলের পুরাতন নিয়ম অথবা খৃস্টানদের অনুসৃত পুরাতন নিয়ম ও ইনজীল্ হিসেবে দাবীকৃত বাইবেল্-ই কি সেই পূর্ণাঙ্গ ও সর্বশেষ ঐশী কিতাব ? যদি তা-ই হয়ে থাকে তো তাহলে ঐ দুই কিতাবে নবুওয়াতের ধারাবাহিকতার সমাপ্তি ও ঐ দু টি কিতাবের পূর্ণাঙ্গ ও সর্বশেষ ঐশী কিতাব হওয়ার কথা উল্লেখ নেই কেন ? তাহলে সে গ্রন্থকে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে তার মূল ভাষায় অবিকৃত ও সংরক্ষিত রাখা হয় নি কেন ? তেমনি তা সংশ্লিষ্ট নবী বা নবীদের দ্বারা কিতাব হিসেবে সর্বজনীন বিচারবুদ্ধির কাছে প্রত্যয় সৃষ্টিকারী রূপে মুতাওয়াতির্ সূত্রে ও অকাট্য ঐতিহাসিক প্রমাণ্যতা সহকারে আমাদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয় নি কেন ? বিচারবুদ্ধির দাবী অনুযায়ী এটা কি সৃষ্টিকর্তার জন্য অপরিহার্য নয় যে , নবুওয়াতের ধারার পরিসমাপ্তি ঘটানোর পর তিনি তাঁর পরিপূর্ণ পথনির্দেশকে যে কোনো প্রকার বিকৃতি ও সংশয়ের হাত থেকে রক্ষা করবেন ?

দুই : নবুওয়াতের ধারাবাহিকতা যদি শেষ হয়ে গিয়ে থাকবে এবং মানবজাতির জন্য আর কোনো নবীর প্রয়োজনীয়তা না থাকবে তাহলে শেষ নবী কে ? তিনি নিজেকে শেষ নবী হিসেবে ঘোষণা করেন নি কেন ? করে থাকলে সে ঘোষণা কোথায় ? তার প্রামাণ্যতাই বা কী ? বাইবেলের পুরাতন নিয়ম নতুন নিয়ম এ উভয় অংশের বিভিন্ন পুস্তকে যে একাধিক মহাপুরুষের আবির্ভাব সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে তা কি নবুওয়াতের ধারাবাহিকতা হযরত ঈসা ( আঃ)-এর পূর্বে বা তাঁর মাধ্যমে সমাপ্ত না হওয়ার প্রমাণ বহন করে না ? তাহলে বাইবেলের বিভিন্ন পুস্তকে যাদের আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে তা কা র বা কা দের সম্বন্ধে ? খৃস্টানদের দাবী অনুযায়ী হযরত ঈসা ( আঃ) যে পারাক্লিতাস্ -এর আগমনের অগ্রিম সুসংবাদ দিয়ে গিয়েছেন তা যদি তাঁর নিজের পুনরাগমন সম্পর্কে হয়ে থাকে (যদিও তা নয় , কারণ , তিনি আমি আসবো বলেন নি) সে ক্ষেত্রে বিগত প্রায় দুই হাজার বছরেও তিনি আসেন নি কেন ? এমতাবস্থায় এ দীর্ঘ সময়ের মানুষদের মধ্যে যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে তাদের পথভ্রষ্টাতার দায়-দায়িত্ব কা র ?

তিন : হযরত ঈসা ( আঃ)-এর পূর্বে বা তাঁর মাধ্যমে যদি নবুওয়াতের ধারাবাহিকতা শেষ না হয়ে থাকবে এবং ঐশী পথনির্দেশও যদি পূর্ণতাপ্রাপ্ত না হয়ে থাকবে , আর যে সব ঐশী পথনির্দেশ ঐ সময় পর্যন্ত অবতীর্ণ হয়েছিলো তা-ও যখন মূল ভাষায় ও অবিকৃতভাবে বর্তমান নেই এমতাবস্থায় কি বিগত প্রায় দুই হাজার বছরেও কোনো নবীর আগমন ও কোনো ঐশী কিতাব নাযিল্ হওয়া অপরিহার্য ছিলো না ?

মানুষের জন্য কোনো অবিকৃত ঐশী পথনির্দেশ মওজূদ থাকবে না অথচ সৃষ্টিকর্তা প্রায় দুই হাজার বছরেও কোনো ঐশী পথনির্দেশ সহ কোনো নবীকে পাঠাবেন না - মানুষের প্রতি এহেন নির্দয়তা প্রদর্শন করা কি পরম পূর্ণতার অধিকারী দয়াময় ও মেহেরবান সৃষ্টিকর্তার পক্ষে সম্ভব ? ঐশী কিতাব বলে দাবী করে কোরআন-পূর্ববর্তী যে সব কিতাব পেশ করা হচ্ছে সেগুলোর অবস্থা যখন (প্রামাণ্যতার অভাব , মূল ভাষায় না থাকা , হ্রাস-বৃদ্ধি ও জঘন্যতার সংমিশ্রণের কারণে) এমন যে , সেগুলোকে ঐশী কিতাব বলে এবং সেগুলোতে নবী হিসেবে উল্লেখকৃত ব্যক্তিদেরকে নবী হিসেবে প্রত্যয়ের সাথে গ্রহণ করা সুস্থ বিচারবুদ্ধির পক্ষে সম্ভব হয় না এমতাবস্থায় নতুন পথনির্দেশ সহ কোনো নতুন নবীর আগমন ছাড়া মানবতার মুক্তির কোনো পথ থাকে কি ?

অবশ্য খৃস্টানরা দাবী করে থাকে যে , খোদার পুত্র যীশূ [হযরত ঈসা ( আঃ)] তাঁর ভক্ত ও অনুসারীদের পাপের বোঝা কাঁধে তুলে নিয়ে শূলে মৃত্যুবরণ করে তাদের মুক্তির ব্যবস্থা করে গিয়েছেন। কিন্তু সুস্থ বিচারবুদ্ধির কাছে তাদের এ দাবী অগ্রহণযোগ্য , কারণ , তাদের এ দাবী (খোদার পুত্র থাকা) একেশ্বরবাদবিরোধী , অংশীবাদী , অযৌক্তিক , বিচারবুদ্ধিবিরোধী কুসংস্কারাচ্ছন্ন মিথ্যা দাবী। কারণ , খোদার পুত্র থাকার যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে পারা তো দূরের কথা , তারা যেখানে যীশূ নামের কোনো ঐতিহাসিক ঐস্তিত্বকেই বিচারবুদ্ধির কাছে প্রত্যয় সৃষ্টিকারী প্রামাণ্য পন্থায় প্রমাণ করতে সক্ষম নয় , তখন তাঁর মাধ্যমে তাঁর ভক্ত-অনুসারীদের মুক্তির মতো আজগুবী দাবী কী করে বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে ? বিশেষ করে তাদের এ দাবী অত্যন্ত বিপজ্জনক দাবী। কারণ , একজন মানুষ যতোই পাপাচারে নিমজ্জিত হোক , কেবল যীশূকে খোদার পুত্র বলে অন্ধ বিশ্বাস পোষণ করলে এবং তাঁকে ভালোবাসলেই যদি মুক্তি পাওয়া যায় তাহলে দ্বীন-ধর্ম ও খোদার পক্ষ থেকে নবী প্রেরণের কোনো প্রয়োজন ও যৌক্তিকতাই থাকে না। মানুষ আক্ষরিক অর্থে এ বিশ্বাস পোষণ করলে মানুষের হাতে সমগ্র মানব প্রজাতি সহ এ পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেতো।

এমতাবস্থায় বিগত প্রায় দুই হাজার বছরে অর্থাৎ খৃস্টীয় প্রথম শতাব্দীর মাঝামাঝিকালের পরে কোনো সময় যদি ঐশী পথনির্দেশ সহ কোনো নবী বা নবীগণ আগমন করে থাকেন তো তিনি বা তাঁরা কে বা কা রা এবং তাঁর বা তাঁদের আনীত ঐশী পথনির্দেশ কোথায় ?

অতএব , এটা নিঃসন্দেহ যে , হযরত ঈসা ( আঃ)-এর আগে বা তাঁর মাধ্যমে নবুওয়াত্ ও ঐশী পথনির্দেশ নাযিলের ধারা শেষ হয় নি। সুতরাং তাঁর পরে কেউ নবুওয়াতের দাবী করলে এবং ঐশী কিতাব বলে দাবী করে কোনো কিতাব পেশ করলে সে দাবী অবশ্যই পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

এ ব্যাপারে বিতর্কের অবকাশ নেই যে , হযরত ঈসা ( আঃ) আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে সমুন্নত লোকে নীত হবার (এবং খৃস্টান ও ইয়াহূদীদের মতে , নিহত হবার) পর বিগত প্রায় দু হাজার বছরে যে সব ব্যক্তি নবুওয়াতের দাবী করেছেন এবং ঐশী কিতাব হিসেবে দাবী করে নতুন কিতাব পেশ করেছেন তাঁদের মধ্যে একমাত্র হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর মধ্যে নবীর গুণাবলী পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান ছিলো এবং একমাত্র কোরআন মজীদেই পূর্ণতম ঐশী গ্রন্থের বৈশিষ্ট্যসমূহ বিদ্যমান রয়েছে।

সর্বজনস্বীকৃত অকাট্য ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) ছিলেন একজন নিরক্ষর ব্যক্তি - যিনি নবুওয়াত দাবী করার পূর্বে দীর্ঘ চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত মক্কাহর জনগণের মাঝে বসবাস করেন এবং সেখানকার সকলের কাছে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি অত্যন্ত সৎ ও উত্তম চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত থাকলেও জ্ঞানী , গুণী , দার্শনিক , সমাজসংস্কারক বা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি অথবা কবি , সাহিত্যিক , বাচনশিল্পী বা বাগ্মী কোনোটাই ছিলেন না। হঠাৎ করে চল্লিশ বছর বয়সকাল থেকে তিনি পরম জ্ঞানে পরিপূর্ণ কোরআন নামে এক কিতাব পর্যায়ক্রমিকভাবে উপস্থাপন করতে শুরু করলেন। কিন্তু তিনি নিজে এ কিতাব রচনার বাহাদুরী দাবী করলেন না , বরং এ কিতাবকে আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কিতাব হিসেবে পেশ করলেন। এ কিতাব স্বীয় ঐশিতার দাবী প্রমাণের লক্ষ্যে এই বলে চ্যালেঞ্জ প্রদান করলো যে , লোকেরা যদি এ কিতাবকে মানুষের রচিত বলে মনে করে তাহলে তারা যেন এর যে কোনো সূরাহর (এমনকি ক্ষুদ্রতম সূরাহর) সমমানসম্পন্ন একটি সূরাহ্ রচনা করে নিয়ে আসে এবং প্রয়োজনে এ কাজের জন্য দুনিয়ার সমস্ত মানুষের কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণ করে। কিন্তু মধ্যম আয়তনের এ কিতাবখানির বক্তব্যের সংক্ষিপ্ততা , রচনাশৈলী , বাগ্মিতা , জ্ঞানগর্ভতা ও পথনির্দেশ এমনই অনন্য যে , আজ পর্যন্ত সে চ্যালেঞ্জ কেউ একক বা যৌথভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয় নি।

এহেন ব্যক্তিকে নবী হিসেবে না মানা এবং এহেন কিতাবকে আল্লাহর কিতাব হিসেবে না মানা সুস্থ বিচারবুদ্ধির অধিকারী কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কেবল অন্ধ বিদ্বেষ অথবা পার্থিব লাভ-লোভ ও প্রবৃত্তির দাসত্বই এ সত্য গ্রহণ করা থেকে কাউকে বিরত রাখতে পারে।

এ মহাগ্রন্থ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)কে শেষ নবী এবং নিজেকে সমগ্র মানবজাতির জন্য অনন্তকালীন পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান ও সকল কিছুর পূর্ণ জ্ঞানের আধার (تبيانا لکل شيء ) বলে উল্লেখ করেছে। অতএব , এ গ্রন্থের নাযিল্ সমাপ্ত হওয়ার ও হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর ইন্তেকালের পরে ক্বিয়ামত পর্যন্ত আর কোনো নতুন ব্যক্তি নবুওয়াতের দায়িত্বে অভিষিক্ত হতে ও নতুন কোনো ঐশী কিতাব নাযিল্ হতে পারে না। এ কারণেই বিগত প্রায় চৌদ্দশ বছরে যে সব ব্যক্তি নবুওয়াত্ দাবী করেছে এবং ঐশী কিতাব হিসেবে দাবী করে কিতাব পেশ করেছে , এমনকি অমুসলিম মনীষীদের নিকটও তাদের সে সব দাবী আদৌ বিবেচনাযোগ্য বলে পরিগণিত হয় নি।

এ প্রসঙ্গে মীর্যা গোলাম আহমদ কাদীয়ানীকে নবী হিসেবে গ্রহণকারী নিজেদের জন্য আহমাদীয়াহ্ পরিচয় গ্রহণকারী ও মুসলিম উম্মাহর কাছে কাদীয়ানী নামে সমধিক পরিচিত ধর্মীয় গোষ্ঠীটির দাবীর অসারতার ওপর অত্যন্ত সংক্ষেপে আলোকপাত করছি।

প্রথমতঃ আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান সম্বলিত গ্রন্থ কোরআন মজীদ নাযিল্ হওয়ার পরে নতুন কোনো পথনির্দেশক ওয়াহীর ও কোনো নতুন নবীর প্রয়োজন নেই। এমতাবস্থায় কোনো নবী প্রেরণ ও কোনো পথনির্দেশক ওয়াহী নাযিল্ করা হবে একটি বাহুল্য কাজ। আর বলা বাহুল্য যে , পরম জ্ঞানময় আল্লাহ্ তা আলা কোনো বাহুল্য কাজ করার মতো দুর্বলতা থেকে মুক্ত।

উল্লেখ্য যে , এখানে ওয়াহী বলতে আমরা পারিভাষিক অর্থে যে পথনির্দেশক ওয়াহী তা-কেই বুঝাচ্ছি - যা লোকদেরকে পথনির্দেশ প্রদানের লক্ষ্যে নবী-রাসূলগণের ( আঃ) নিকট নাযিল্ হতো এবং যা তাঁদের ওপর নবুওয়াতের দায়িত্ব অর্পিত হওয়ার প্রমাণ বহন করে। এ পারিভাষিক অর্থ ছাড়া ওয়াহী শব্দের যে সব আভিধানিক অর্থ রয়েছে , যেমন : প্রাণীকুলের সহজাত প্রবণতা , প্রত্যক্ষ অনুভূতি ( intuition), স্বপ্নযোগে কোনো সত্য জানতে পারা বা কোনো সমস্যার সমাধান লাভ , হঠাৎ করেই কারো মনে কোনো কোনো সমস্যার সমাধান বা গূঢ় সত্য জাগ্রত হওয়া (ইলহাম্) ইত্যাদি - যা শুধু মু মিনের বেলায়ই ঘটে না , অনেক সময় কাফেরের বেলায়ও ঘটে থাকে - তা আমাদের এখানকার আলোচ্য বিষয় নয়।

দ্বিতীয়তঃ কাদীয়ানীরা দাবী করে যে , হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)কে যেহেতু কোরআন মজীদে খাতামুন্নাবীয়্যীন্ অর্থাৎ নবীগণের সীলমোহর বলা হয়েছে সেহেতু তাঁর মোহর ধারণ করে নতুন নবী আগমনের পথ খোলা রয়েছে। কিন্তু তাদের এ কথা দ্বারা হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর পরে নতুন কোনো নবীর আবির্ভাবের সম্ভাবনা প্রমাণিত হয় না। কারণ , হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) নবীগণের সীলমোহর - এ কথার মানে হচ্ছে , তিনি যাদেরকে নবী হিসেবে উল্লেখ করেছেন কেবল তাঁদের নবী হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত ধারণা বা ইয়াক্বীন পোষণ করতে হবে ; এদের বাইরে কারো নবুওয়াত দাবীর সত্যতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়ার কোনোই উপায় নেই।

অতএব , কোরআন মজীদে ও অকাট্যভাবে ছ্বহীহ্ হিসেবে প্রমাণিত হাদীছে যাদেরকে নবী বলে উল্লেখ করা হয়েছে তাঁরা নিঃসন্দেহে নবী। তাঁর পরে নবী হিসেবে আসবেন বলে কতক ব্যক্তির নাম-পরিচয় যদি কোরআন মজীদে উল্লেখ থাকতো বা তিনি বলে যেতেন তাহলে এ ধরনের ব্যক্তিদের আবির্ভাবের পর অবশ্যই তাদেরকে নবী বলে মানতে হতো। কিন্তু এমন কোনো নবীর আবির্ভাব সম্বন্ধে না কোরআন মজীদে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে , না হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করে যান। সুতরাং হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর পরে নতুন কোনো নবীর আবির্ভাবের প্রশ্নই ওঠে না।

কাদীয়ানীরা হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর মোহর ধারণ করে নতুন নবী আগমনের অর্থ বলে দাবী করেছে যে , নতুন নবী হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)কে নবী বলে স্বীকার করবেন। কিন্তু এটা একটা হাস্যস্কর অপযুক্তি। কারণ , এর দ্বারা নতুন নবুওয়াতের দাবীদার ব্যক্তি কর্তৃক হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর সীলমোহর ধারণ করা বুঝায় না , বরং নতুন নবুওয়াতের দাবীদার ব্যক্তি কর্তৃক হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর ওপর নবুওয়াতের স্বীকৃতিসূচক সীলমোহর প্রয়োগ করা বুঝায় - যা থেকে তিনি মুখাপেক্ষিতাহীন।

বস্তুতঃ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)কে নবী বলে স্বীকার করাই যদি কোনো ব্যক্তির নবুওয়াত-দাবীর সত্যতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট হতো তাহলে যে কোনো ভণ্ড-প্রতারকের জন্যই নবী সাজার পথ উন্মুক্ত হয়ে যেতো। কিন্তু বিচারবুদ্ধির নিকট এ ধরনের হাস্যস্কর অপযুক্তির বিন্দুমাত্র গ্রহণযোগ্যতা নেই।

মোদ্দা কথা , যেহেতু কোরআন মজীদের দাবী ও বিচারবুদ্ধির রায় অনুযায়ী হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর আবির্ভাবের পূর্বে নবুওয়াতের ধারাবাহিকতা শেষ হয় নি এবং পূর্ণাঙ্গ , সর্বশেষ ও সংরক্ষিত ঐশী গ্রন্থ নাযিল্ হয় নি , অন্যদিকে তাঁর পরে বিগত প্রায় দেড় হাজার বছরে নবুওয়াতের দাবীদার কোনো ব্যক্তির দাবী ও উপস্থাপিত গ্রন্থ সর্বজনীন বিচারবুদ্ধি ও কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে বিবেচনাযোগ্য বলে পরিগণিত হয় নি , তেমনি স্বয়ং কোরআন মজীদ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)কে সর্বশেষ নবী এবং কোরআন মজীদকে সংরক্ষিত ও পরিপূর্ণ পথনির্দেশ সম্বলিত ঐশী কিতাব হিসেবে দাবী করেছে , তেমনি কোরআনের কোনো সূরাহর সমমানসম্পন্ন কোনো নতুন সূরাহ্ রচনা কোনো মানুষ বা সকল মানুষের পক্ষেও সম্ভব হয় নি সেহেতু হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) ও কোরআন মজীদ সংক্রান্ত এ দাবী গ্রহণ করে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।

দু টি ভিত্তিহীন অভিযোগ

কোরআন-বিরোধীরা , বিশেষ করে খৃস্টান পণ্ডিত ও পাশ্চাত্য জগতের প্রাচ্যবিদগণ কোরআন মজীদের বিরুদ্ধে দু টি অভিযোগ উত্থাপন করে থাকে।

একটি অভিযোগ এই যে , কোরআন তার পূর্ববর্তী আসমানী কিতাব সমূহের তেলাওয়াত্ বাতিল করে দিয়েছে এবং ঐ সব কিতাবের কতক বিধিবিধান পরিবর্তন করে দিয়েছে। তাদের মতে , কোরআন যদি আল্লাহর কিতাবই হবে তাহলে ইতিপূর্বে আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কিতাব সমূহের তেলাওয়াত্ বাতিল ও কতক বিধান পরিবর্তন করবে কেন ? তাদের দ্বিতীয় অভিযোগ হচ্ছে , কোরআনে কতক স্ববিরোধী কথা আছে ; আল্লাহর কিতাব হলে তাতে স্ববিরোধী কথা থাকবে কেন ?

তাদের উত্থাপিত প্রথম অভিযোগের দু টি অংশ : পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের তেলাওয়াত্ বাতিল করা হলো কেন এবং কতক বিধানে পরিবর্তন সাধন করা হলো কেন ?

বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে তাদের এ অভিযোগ বিবেচনাযোগ্য নয়। কারণ , প্রথমতঃ পূর্ববর্তী ঐশী কিতাব সমূহে একদিকে যেমন ব্যাপকভাবে বিকৃতি ঘটেছে - যা তারা নিজেরাও স্বীকার করতে বাধ্য , অন্যদিকে তা মূল ভাষায় বর্তমান নেই। ক্ষেত্রবিশেষে মূল ভাষা থেকে হারিয়ে যাবার পর অন্য ভাষার অনুবাদ থেকে পুনরায় মূল ভাষায় অনূদিত হয়েছে। সুতরাং মূল ভাষায় যেভাবে নাযিল্ হয়েছিলো সেভাবে না থাকায় এবং মূল ভাষায় থাকা বা না-থাকা প্রশ্নে বিতর্কের অবকাশ থাকলেও এবং কোনো কোনেটি যদি মূল ভাষায় বর্তমান থেকেও থাকে তথাপি সেগুলোতে আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কথার সাথে মানুষের কথা মিশ্রিত হওয়ার ফলে ঐ সব কিতাবের কথাগুলো আর আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কথা নেই। সুতরাং সেগুলো আর পবিত্র ঐশী বাণী হিসেবে তেলাওয়াতযোগ্য নেই।

দ্বিতীয়তঃ ঐ সব কিতাবের বিকৃতি কেবল তার পাঠ ( text)-এর পঠন - পাঠনের মধ্যেই ঘটে নি , বরং বিধি - বিধানের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। অন্যদিকে ঐ সব কিতাবের কোনোটিই স্থান ও কাল নির্বিশেষে সমগ্র মানবজাতির জন্য নাযিল্ হয় নি , বরং মানবসভ্যতার বিকাশের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর জন্য ভিন্ন ভিন্ন নবী - রাসূল প্রেরণ করা হয় এবং তাদের জন্য নাযিলকৃত কিতাব সমূহে কতক স্থায়ী বিধানের পাশাপাশি কতক বিধান শামিল করা হয়েছিলো একান্তভাবেই তাদের নিজস্ব ও সাময়িক প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে। এছাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর অপরাধের শাস্তি হিসেবে বা তাদের ঈমান ও আনুগত্য পরীক্ষার লক্ষ্যেও কতক বিধান নাযিল্ করা হয়েছিলো।

বলা বাহুল্য যে , স্থান ও কাল নির্বিশেষে ক্বিয়ামত্ পর্যন্ত সমগ্র মানবজাতির জন্য অনুসরণীয় ঐশী বিধান হিসেবে সেগুলোর কোনোই কার্যকরিতা ছিলো না। অবশ্যঃ সন্দেহ নেই যে , ঐ সব গ্রন্থের সবগুলো ঐশী বিধানই স্থান-কাল ও গোষ্ঠীর জন্য নাযিলকৃত সাময়িক বিধান ছিলো না এবং যে সব স্থায়ী বিধান ছিলো তার সবগুলোই যে বিকৃত হয়ে গিয়েছিলো তা নয় ; কতক বিধান অবশ্যই অবিকৃত অবস্থায় র য়ে গিয়েছে। কিন্তু স্থান-কাল ও বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে ক্বিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় বিধান হিসেবে কেবল ঐ বিধানগুলোই যথেষ্ট ছিলো না , বরং আরো অনেক বিধানের প্রয়োজন ছিলো। এমতাবস্থায় সামগ্রিক বিধানের গ্রন্থ হিসেবে ঐ সব গ্রন্থের ব্যবহার হতো এক ধরনের জটিলতা সৃষ্টিকারী কাজ এবং নতুন নাযিলকৃত গ্রন্থের পাশাপাশি ঐ সব গ্রন্থের ব্যবহারের কোনোই উপযোগিতা ছিলো না। এ কারণেই ঐ সব গ্রন্থের স্থায়ী বিধানগুলোকে কোরআনের অন্তর্ভুক্ত করে পুনরায় নাযিল্ করা বা স্বয়ং হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর বিধানিক আচরণের মাধ্যমে অব্যাহত রাখাই (যেমন : খাৎনাহর বিধান) যথেষ্ট ছিলো। [স্মর্তব্য যে , কোরআনের ঘোষণা অনুযায়ী হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) কোরআনের বাইরে যে সব নীতিগত , আইনগত বা শিক্ষণীয় তথা নবুওয়াতের দায়িত্বসংশ্লিষ্ট যে সব কথা বলতেন তার কোনোটিই তাঁর প্রবৃত্তি থেকে বলতেন না , বরং আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত ওয়াহী হিসেবে বলতেন - যাকে ওয়াহীয়ে গ্বায়রে মাত্লূ (পঠন-অযোগ্য ওয়াহী) বলা হয়।]

পূর্ববর্তী আসমানী কিতাব সমূহে প্রদত্ত বিভিন্ন বিধিবিধান এবং সে সব কিতাবের আয়াত্ ভুলিয়ে দেয়া বা সে সবের তেলাওয়াত রহিত করে দেয়ার বিরুদ্ধে ইয়াহূদী ও খৃস্টানদের উত্থাপিত আপত্তির জবাবে আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেন :

) م َا نَنْسَخْ مِنْ آيَةٍ أَوْ نُنْسِهَا نَأْتِ بِخَيْرٍ مِنْهَا أَوْ مِثْلِهَا(

আমি কোনো আয়াতকে তার চেয়ে অধিকতর উত্তম বা তার অনুরূপ (আয়াত্) আনয়ন ব্যতীত কোনো আয়াত্ রহিত করে দেই না বা ভুলিয়ে দেই না। (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : 106)

এ প্রসঙ্গে আমরা ইতিপূর্বে ক্বিয়ামত পর্যন্ত স্থান-কাল নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য সর্বশেষ স্থায়ী বিধান দিতে গিয়ে পূর্ববর্তী কতক বিধিবিধানে রদবদল সাধনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছি। এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন যে , কতক বিধিবিধান হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কাজ বা বস্তুর প্রকৃতিগত অনিবার্য দাবী। এরূপ ক্ষেত্রে বিধান অপরিবর্তিত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। উদাহরণস্বরূপ , যে সব কাজ বা খাদ্য-পানীয় মানুষের জন্য শারীরিক , মানসিক , নৈতিক , চারিত্রিক বা আত্মিক ক্ষতি ডেকে আনে তা অবশ্যই হারাম হওয়া উচিত এবং এ কারণে প্রথম মানুষ হযরত আদম ( আঃ) থেকে শুরু করে শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) পর্যন্ত সকল নবী-রাসূলের ( আঃ) শরী আতেই তা হারাম ছিলো। যেমন : মিথ্যা বলা , চুরি-ডাকাতি , যেনা , নরহত্যা , মাদক দ্রব্য সেবন ইত্যাদি।

কিন্তু অন্য অনেক বিধানের ক্ষেত্রগুলো এমন যে , এ সব ক্ষেত্রে বিধানের জন্য কোনো প্রাকৃতিক মানদণ্ড নেই , ফলে স্থান-কাল নির্বিশেষে অভিন্ন বিধান হওয়া অপরিহার্য নয়। এ সব ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা আলা চাইলে কোনো বিধানকে স্থায়ীভাবেও দিতে পারেন , আবার চাইলে কোনো বিধানকে অস্থায়ীভাবেও দিতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ , ইবাদত-বন্দেগী সংক্রান্ত বিধি-বিধান - যা দ্বারা আল্লাহ্ তা আলার প্রতি বান্দাহর আনুগত্য পরীক্ষা করাই উদ্দেশ্য। যেমন : ইবাদত দৈনিক কতো বার ও কোন্ নিয়মে করতে হবে তার কোনো প্রাকৃতিক মানদণ্ড নেই ; আল্লাহ্ তা আলা যেভাবে চান বান্দাহ্কে সেভাবেই তা আঞ্জাম দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা আলা বিভিন্ন নবীর সময় বিভিন্ন ধরনের হুকুম দিলে তা তাঁর অধিকার।

অনুরূপভাবে সামাজিক বিধি-বিধান এবং অপরাধের শাস্তি বা দণ্ডবিধানেরও কোনো প্রাকৃতিক মানদণ্ড নেই। এ সব ক্ষেত্রেও আল্লাহ্ যখন যেভাবে চান হুকুম দিতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ , আল্লাহ্ তা আলা যদি যেনার শাস্তি চাবূকের একশ ঘা নির্ধারণ না করে দু বা পঞ্চাশ ঘা নির্ধারণ করে দিতেন তাহলেও কারো কিছু বলার ছিলো না।

এছাড়া আল্লাহ্ তা আলা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে পরীক্ষা করার বা শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্যে অস্থায়ী বিশেষ বিধান নাযিল্ করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ বানী ইসরাঈলের জন্য শনিবারের বিধান ও চর্বি ভক্ষণ হারাম করার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

শেষ নবী (ছ্বাঃ) ও কোরআন মজীদের অপরিহার্যতা

ইয়াহূদী ও খৃস্টানরা হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)কে আল্লাহর মনোনীত নবী হিসেবে ও কোরআন মজীদকে আল্লাহর প্রেরিত গ্রন্থ হিসেবে স্বীকার করে না। সেই সাথে ইয়াহূদীরা হযরত ঈসা ( আঃ)কেও নবী হিসেবে স্বীকার করে না। এ দু টি ধর্মীয় জনগোষ্ঠী নিজেদেরকে নবী-রাসূলগণের ( আঃ) ও ঐশী কিতাবের অনুসরণকারী বলে দাবী করে থাকে। কিন্তু খৃস্টানরা বিগত প্রায় দুই হাজার বছর কালের মধ্যে এবং ইয়াহূদীরা আরো বেশীকালের মধ্যে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে কোনো নবীর আগমন ও কোনো আসমানী কিতাব নাযিলের দাবী ও প্রয়োজনীয়তাকে বিবেচনায় নেয় নি।

এমতাবস্থায় ইয়াহূদী ও খৃস্টানদের জন্য বিচারবুদ্ধির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কতগুলো প্রশ্নের জবাব প্রদান করা অপরিহার্য বলে মনে করি। প্রশ্নগুলো হচ্ছে :

এক : হযরত ঈসা ( আঃ)-এর পূর্বে বা তাঁর মাধ্যমে কি নবুওয়াতের ধারাবাহিকতা পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়েছে এবং মানুষের কাছে কি ঐশী প্রত্যাদেশের সর্বশেষ ও পূর্ণাঙ্গ প্রত্যাদেশ ঐ সময়ই পৌঁছে গিয়েছিলো ? পৌঁছে গিয়ে থাকলে তা কোথায় ? ইয়াহূদীদের অনুসৃত বাইবেলের পুরাতন নিয়ম অথবা খৃস্টানদের অনুসৃত পুরাতন নিয়ম ও ইনজীল্ হিসেবে দাবীকৃত বাইবেল্-ই কি সেই পূর্ণাঙ্গ ও সর্বশেষ ঐশী কিতাব ? যদি তা-ই হয়ে থাকে তো তাহলে ঐ দুই কিতাবে নবুওয়াতের ধারাবাহিকতার সমাপ্তি ও ঐ দু টি কিতাবের পূর্ণাঙ্গ ও সর্বশেষ ঐশী কিতাব হওয়ার কথা উল্লেখ নেই কেন ? তাহলে সে গ্রন্থকে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে তার মূল ভাষায় অবিকৃত ও সংরক্ষিত রাখা হয় নি কেন ? তেমনি তা সংশ্লিষ্ট নবী বা নবীদের দ্বারা কিতাব হিসেবে সর্বজনীন বিচারবুদ্ধির কাছে প্রত্যয় সৃষ্টিকারী রূপে মুতাওয়াতির্ সূত্রে ও অকাট্য ঐতিহাসিক প্রমাণ্যতা সহকারে আমাদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয় নি কেন ? বিচারবুদ্ধির দাবী অনুযায়ী এটা কি সৃষ্টিকর্তার জন্য অপরিহার্য নয় যে , নবুওয়াতের ধারার পরিসমাপ্তি ঘটানোর পর তিনি তাঁর পরিপূর্ণ পথনির্দেশকে যে কোনো প্রকার বিকৃতি ও সংশয়ের হাত থেকে রক্ষা করবেন ?

দুই : নবুওয়াতের ধারাবাহিকতা যদি শেষ হয়ে গিয়ে থাকবে এবং মানবজাতির জন্য আর কোনো নবীর প্রয়োজনীয়তা না থাকবে তাহলে শেষ নবী কে ? তিনি নিজেকে শেষ নবী হিসেবে ঘোষণা করেন নি কেন ? করে থাকলে সে ঘোষণা কোথায় ? তার প্রামাণ্যতাই বা কী ? বাইবেলের পুরাতন নিয়ম নতুন নিয়ম এ উভয় অংশের বিভিন্ন পুস্তকে যে একাধিক মহাপুরুষের আবির্ভাব সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে তা কি নবুওয়াতের ধারাবাহিকতা হযরত ঈসা ( আঃ)-এর পূর্বে বা তাঁর মাধ্যমে সমাপ্ত না হওয়ার প্রমাণ বহন করে না ? তাহলে বাইবেলের বিভিন্ন পুস্তকে যাদের আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে তা কা র বা কা দের সম্বন্ধে ? খৃস্টানদের দাবী অনুযায়ী হযরত ঈসা ( আঃ) যে পারাক্লিতাস্ -এর আগমনের অগ্রিম সুসংবাদ দিয়ে গিয়েছেন তা যদি তাঁর নিজের পুনরাগমন সম্পর্কে হয়ে থাকে (যদিও তা নয় , কারণ , তিনি আমি আসবো বলেন নি) সে ক্ষেত্রে বিগত প্রায় দুই হাজার বছরেও তিনি আসেন নি কেন ? এমতাবস্থায় এ দীর্ঘ সময়ের মানুষদের মধ্যে যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে তাদের পথভ্রষ্টাতার দায়-দায়িত্ব কা র ?

তিন : হযরত ঈসা ( আঃ)-এর পূর্বে বা তাঁর মাধ্যমে যদি নবুওয়াতের ধারাবাহিকতা শেষ না হয়ে থাকবে এবং ঐশী পথনির্দেশও যদি পূর্ণতাপ্রাপ্ত না হয়ে থাকবে , আর যে সব ঐশী পথনির্দেশ ঐ সময় পর্যন্ত অবতীর্ণ হয়েছিলো তা-ও যখন মূল ভাষায় ও অবিকৃতভাবে বর্তমান নেই এমতাবস্থায় কি বিগত প্রায় দুই হাজার বছরেও কোনো নবীর আগমন ও কোনো ঐশী কিতাব নাযিল্ হওয়া অপরিহার্য ছিলো না ?

মানুষের জন্য কোনো অবিকৃত ঐশী পথনির্দেশ মওজূদ থাকবে না অথচ সৃষ্টিকর্তা প্রায় দুই হাজার বছরেও কোনো ঐশী পথনির্দেশ সহ কোনো নবীকে পাঠাবেন না - মানুষের প্রতি এহেন নির্দয়তা প্রদর্শন করা কি পরম পূর্ণতার অধিকারী দয়াময় ও মেহেরবান সৃষ্টিকর্তার পক্ষে সম্ভব ? ঐশী কিতাব বলে দাবী করে কোরআন-পূর্ববর্তী যে সব কিতাব পেশ করা হচ্ছে সেগুলোর অবস্থা যখন (প্রামাণ্যতার অভাব , মূল ভাষায় না থাকা , হ্রাস-বৃদ্ধি ও জঘন্যতার সংমিশ্রণের কারণে) এমন যে , সেগুলোকে ঐশী কিতাব বলে এবং সেগুলোতে নবী হিসেবে উল্লেখকৃত ব্যক্তিদেরকে নবী হিসেবে প্রত্যয়ের সাথে গ্রহণ করা সুস্থ বিচারবুদ্ধির পক্ষে সম্ভব হয় না এমতাবস্থায় নতুন পথনির্দেশ সহ কোনো নতুন নবীর আগমন ছাড়া মানবতার মুক্তির কোনো পথ থাকে কি ?

অবশ্য খৃস্টানরা দাবী করে থাকে যে , খোদার পুত্র যীশূ [হযরত ঈসা ( আঃ)] তাঁর ভক্ত ও অনুসারীদের পাপের বোঝা কাঁধে তুলে নিয়ে শূলে মৃত্যুবরণ করে তাদের মুক্তির ব্যবস্থা করে গিয়েছেন। কিন্তু সুস্থ বিচারবুদ্ধির কাছে তাদের এ দাবী অগ্রহণযোগ্য , কারণ , তাদের এ দাবী (খোদার পুত্র থাকা) একেশ্বরবাদবিরোধী , অংশীবাদী , অযৌক্তিক , বিচারবুদ্ধিবিরোধী কুসংস্কারাচ্ছন্ন মিথ্যা দাবী। কারণ , খোদার পুত্র থাকার যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে পারা তো দূরের কথা , তারা যেখানে যীশূ নামের কোনো ঐতিহাসিক ঐস্তিত্বকেই বিচারবুদ্ধির কাছে প্রত্যয় সৃষ্টিকারী প্রামাণ্য পন্থায় প্রমাণ করতে সক্ষম নয় , তখন তাঁর মাধ্যমে তাঁর ভক্ত-অনুসারীদের মুক্তির মতো আজগুবী দাবী কী করে বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে ? বিশেষ করে তাদের এ দাবী অত্যন্ত বিপজ্জনক দাবী। কারণ , একজন মানুষ যতোই পাপাচারে নিমজ্জিত হোক , কেবল যীশূকে খোদার পুত্র বলে অন্ধ বিশ্বাস পোষণ করলে এবং তাঁকে ভালোবাসলেই যদি মুক্তি পাওয়া যায় তাহলে দ্বীন-ধর্ম ও খোদার পক্ষ থেকে নবী প্রেরণের কোনো প্রয়োজন ও যৌক্তিকতাই থাকে না। মানুষ আক্ষরিক অর্থে এ বিশ্বাস পোষণ করলে মানুষের হাতে সমগ্র মানব প্রজাতি সহ এ পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেতো।

এমতাবস্থায় বিগত প্রায় দুই হাজার বছরে অর্থাৎ খৃস্টীয় প্রথম শতাব্দীর মাঝামাঝিকালের পরে কোনো সময় যদি ঐশী পথনির্দেশ সহ কোনো নবী বা নবীগণ আগমন করে থাকেন তো তিনি বা তাঁরা কে বা কা রা এবং তাঁর বা তাঁদের আনীত ঐশী পথনির্দেশ কোথায় ?

অতএব , এটা নিঃসন্দেহ যে , হযরত ঈসা ( আঃ)-এর আগে বা তাঁর মাধ্যমে নবুওয়াত্ ও ঐশী পথনির্দেশ নাযিলের ধারা শেষ হয় নি। সুতরাং তাঁর পরে কেউ নবুওয়াতের দাবী করলে এবং ঐশী কিতাব বলে দাবী করে কোনো কিতাব পেশ করলে সে দাবী অবশ্যই পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

এ ব্যাপারে বিতর্কের অবকাশ নেই যে , হযরত ঈসা ( আঃ) আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে সমুন্নত লোকে নীত হবার (এবং খৃস্টান ও ইয়াহূদীদের মতে , নিহত হবার) পর বিগত প্রায় দু হাজার বছরে যে সব ব্যক্তি নবুওয়াতের দাবী করেছেন এবং ঐশী কিতাব হিসেবে দাবী করে নতুন কিতাব পেশ করেছেন তাঁদের মধ্যে একমাত্র হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর মধ্যে নবীর গুণাবলী পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান ছিলো এবং একমাত্র কোরআন মজীদেই পূর্ণতম ঐশী গ্রন্থের বৈশিষ্ট্যসমূহ বিদ্যমান রয়েছে।

সর্বজনস্বীকৃত অকাট্য ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) ছিলেন একজন নিরক্ষর ব্যক্তি - যিনি নবুওয়াত দাবী করার পূর্বে দীর্ঘ চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত মক্কাহর জনগণের মাঝে বসবাস করেন এবং সেখানকার সকলের কাছে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি অত্যন্ত সৎ ও উত্তম চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত থাকলেও জ্ঞানী , গুণী , দার্শনিক , সমাজসংস্কারক বা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি অথবা কবি , সাহিত্যিক , বাচনশিল্পী বা বাগ্মী কোনোটাই ছিলেন না। হঠাৎ করে চল্লিশ বছর বয়সকাল থেকে তিনি পরম জ্ঞানে পরিপূর্ণ কোরআন নামে এক কিতাব পর্যায়ক্রমিকভাবে উপস্থাপন করতে শুরু করলেন। কিন্তু তিনি নিজে এ কিতাব রচনার বাহাদুরী দাবী করলেন না , বরং এ কিতাবকে আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কিতাব হিসেবে পেশ করলেন। এ কিতাব স্বীয় ঐশিতার দাবী প্রমাণের লক্ষ্যে এই বলে চ্যালেঞ্জ প্রদান করলো যে , লোকেরা যদি এ কিতাবকে মানুষের রচিত বলে মনে করে তাহলে তারা যেন এর যে কোনো সূরাহর (এমনকি ক্ষুদ্রতম সূরাহর) সমমানসম্পন্ন একটি সূরাহ্ রচনা করে নিয়ে আসে এবং প্রয়োজনে এ কাজের জন্য দুনিয়ার সমস্ত মানুষের কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণ করে। কিন্তু মধ্যম আয়তনের এ কিতাবখানির বক্তব্যের সংক্ষিপ্ততা , রচনাশৈলী , বাগ্মিতা , জ্ঞানগর্ভতা ও পথনির্দেশ এমনই অনন্য যে , আজ পর্যন্ত সে চ্যালেঞ্জ কেউ একক বা যৌথভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয় নি।

এহেন ব্যক্তিকে নবী হিসেবে না মানা এবং এহেন কিতাবকে আল্লাহর কিতাব হিসেবে না মানা সুস্থ বিচারবুদ্ধির অধিকারী কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কেবল অন্ধ বিদ্বেষ অথবা পার্থিব লাভ-লোভ ও প্রবৃত্তির দাসত্বই এ সত্য গ্রহণ করা থেকে কাউকে বিরত রাখতে পারে।

এ মহাগ্রন্থ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)কে শেষ নবী এবং নিজেকে সমগ্র মানবজাতির জন্য অনন্তকালীন পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান ও সকল কিছুর পূর্ণ জ্ঞানের আধার (تبيانا لکل شيء ) বলে উল্লেখ করেছে। অতএব , এ গ্রন্থের নাযিল্ সমাপ্ত হওয়ার ও হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর ইন্তেকালের পরে ক্বিয়ামত পর্যন্ত আর কোনো নতুন ব্যক্তি নবুওয়াতের দায়িত্বে অভিষিক্ত হতে ও নতুন কোনো ঐশী কিতাব নাযিল্ হতে পারে না। এ কারণেই বিগত প্রায় চৌদ্দশ বছরে যে সব ব্যক্তি নবুওয়াত্ দাবী করেছে এবং ঐশী কিতাব হিসেবে দাবী করে কিতাব পেশ করেছে , এমনকি অমুসলিম মনীষীদের নিকটও তাদের সে সব দাবী আদৌ বিবেচনাযোগ্য বলে পরিগণিত হয় নি।

এ প্রসঙ্গে মীর্যা গোলাম আহমদ কাদীয়ানীকে নবী হিসেবে গ্রহণকারী নিজেদের জন্য আহমাদীয়াহ্ পরিচয় গ্রহণকারী ও মুসলিম উম্মাহর কাছে কাদীয়ানী নামে সমধিক পরিচিত ধর্মীয় গোষ্ঠীটির দাবীর অসারতার ওপর অত্যন্ত সংক্ষেপে আলোকপাত করছি।

প্রথমতঃ আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান সম্বলিত গ্রন্থ কোরআন মজীদ নাযিল্ হওয়ার পরে নতুন কোনো পথনির্দেশক ওয়াহীর ও কোনো নতুন নবীর প্রয়োজন নেই। এমতাবস্থায় কোনো নবী প্রেরণ ও কোনো পথনির্দেশক ওয়াহী নাযিল্ করা হবে একটি বাহুল্য কাজ। আর বলা বাহুল্য যে , পরম জ্ঞানময় আল্লাহ্ তা আলা কোনো বাহুল্য কাজ করার মতো দুর্বলতা থেকে মুক্ত।

উল্লেখ্য যে , এখানে ওয়াহী বলতে আমরা পারিভাষিক অর্থে যে পথনির্দেশক ওয়াহী তা-কেই বুঝাচ্ছি - যা লোকদেরকে পথনির্দেশ প্রদানের লক্ষ্যে নবী-রাসূলগণের ( আঃ) নিকট নাযিল্ হতো এবং যা তাঁদের ওপর নবুওয়াতের দায়িত্ব অর্পিত হওয়ার প্রমাণ বহন করে। এ পারিভাষিক অর্থ ছাড়া ওয়াহী শব্দের যে সব আভিধানিক অর্থ রয়েছে , যেমন : প্রাণীকুলের সহজাত প্রবণতা , প্রত্যক্ষ অনুভূতি ( intuition), স্বপ্নযোগে কোনো সত্য জানতে পারা বা কোনো সমস্যার সমাধান লাভ , হঠাৎ করেই কারো মনে কোনো কোনো সমস্যার সমাধান বা গূঢ় সত্য জাগ্রত হওয়া (ইলহাম্) ইত্যাদি - যা শুধু মু মিনের বেলায়ই ঘটে না , অনেক সময় কাফেরের বেলায়ও ঘটে থাকে - তা আমাদের এখানকার আলোচ্য বিষয় নয়।

দ্বিতীয়তঃ কাদীয়ানীরা দাবী করে যে , হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)কে যেহেতু কোরআন মজীদে খাতামুন্নাবীয়্যীন্ অর্থাৎ নবীগণের সীলমোহর বলা হয়েছে সেহেতু তাঁর মোহর ধারণ করে নতুন নবী আগমনের পথ খোলা রয়েছে। কিন্তু তাদের এ কথা দ্বারা হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর পরে নতুন কোনো নবীর আবির্ভাবের সম্ভাবনা প্রমাণিত হয় না। কারণ , হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) নবীগণের সীলমোহর - এ কথার মানে হচ্ছে , তিনি যাদেরকে নবী হিসেবে উল্লেখ করেছেন কেবল তাঁদের নবী হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত ধারণা বা ইয়াক্বীন পোষণ করতে হবে ; এদের বাইরে কারো নবুওয়াত দাবীর সত্যতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়ার কোনোই উপায় নেই।

অতএব , কোরআন মজীদে ও অকাট্যভাবে ছ্বহীহ্ হিসেবে প্রমাণিত হাদীছে যাদেরকে নবী বলে উল্লেখ করা হয়েছে তাঁরা নিঃসন্দেহে নবী। তাঁর পরে নবী হিসেবে আসবেন বলে কতক ব্যক্তির নাম-পরিচয় যদি কোরআন মজীদে উল্লেখ থাকতো বা তিনি বলে যেতেন তাহলে এ ধরনের ব্যক্তিদের আবির্ভাবের পর অবশ্যই তাদেরকে নবী বলে মানতে হতো। কিন্তু এমন কোনো নবীর আবির্ভাব সম্বন্ধে না কোরআন মজীদে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে , না হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করে যান। সুতরাং হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর পরে নতুন কোনো নবীর আবির্ভাবের প্রশ্নই ওঠে না।

কাদীয়ানীরা হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর মোহর ধারণ করে নতুন নবী আগমনের অর্থ বলে দাবী করেছে যে , নতুন নবী হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)কে নবী বলে স্বীকার করবেন। কিন্তু এটা একটা হাস্যস্কর অপযুক্তি। কারণ , এর দ্বারা নতুন নবুওয়াতের দাবীদার ব্যক্তি কর্তৃক হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর সীলমোহর ধারণ করা বুঝায় না , বরং নতুন নবুওয়াতের দাবীদার ব্যক্তি কর্তৃক হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর ওপর নবুওয়াতের স্বীকৃতিসূচক সীলমোহর প্রয়োগ করা বুঝায় - যা থেকে তিনি মুখাপেক্ষিতাহীন।

বস্তুতঃ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)কে নবী বলে স্বীকার করাই যদি কোনো ব্যক্তির নবুওয়াত-দাবীর সত্যতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট হতো তাহলে যে কোনো ভণ্ড-প্রতারকের জন্যই নবী সাজার পথ উন্মুক্ত হয়ে যেতো। কিন্তু বিচারবুদ্ধির নিকট এ ধরনের হাস্যস্কর অপযুক্তির বিন্দুমাত্র গ্রহণযোগ্যতা নেই।

মোদ্দা কথা , যেহেতু কোরআন মজীদের দাবী ও বিচারবুদ্ধির রায় অনুযায়ী হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর আবির্ভাবের পূর্বে নবুওয়াতের ধারাবাহিকতা শেষ হয় নি এবং পূর্ণাঙ্গ , সর্বশেষ ও সংরক্ষিত ঐশী গ্রন্থ নাযিল্ হয় নি , অন্যদিকে তাঁর পরে বিগত প্রায় দেড় হাজার বছরে নবুওয়াতের দাবীদার কোনো ব্যক্তির দাবী ও উপস্থাপিত গ্রন্থ সর্বজনীন বিচারবুদ্ধি ও কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে বিবেচনাযোগ্য বলে পরিগণিত হয় নি , তেমনি স্বয়ং কোরআন মজীদ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)কে সর্বশেষ নবী এবং কোরআন মজীদকে সংরক্ষিত ও পরিপূর্ণ পথনির্দেশ সম্বলিত ঐশী কিতাব হিসেবে দাবী করেছে , তেমনি কোরআনের কোনো সূরাহর সমমানসম্পন্ন কোনো নতুন সূরাহ্ রচনা কোনো মানুষ বা সকল মানুষের পক্ষেও সম্ভব হয় নি সেহেতু হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) ও কোরআন মজীদ সংক্রান্ত এ দাবী গ্রহণ করে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।

দু টি ভিত্তিহীন অভিযোগ

কোরআন-বিরোধীরা , বিশেষ করে খৃস্টান পণ্ডিত ও পাশ্চাত্য জগতের প্রাচ্যবিদগণ কোরআন মজীদের বিরুদ্ধে দু টি অভিযোগ উত্থাপন করে থাকে।

একটি অভিযোগ এই যে , কোরআন তার পূর্ববর্তী আসমানী কিতাব সমূহের তেলাওয়াত্ বাতিল করে দিয়েছে এবং ঐ সব কিতাবের কতক বিধিবিধান পরিবর্তন করে দিয়েছে। তাদের মতে , কোরআন যদি আল্লাহর কিতাবই হবে তাহলে ইতিপূর্বে আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কিতাব সমূহের তেলাওয়াত্ বাতিল ও কতক বিধান পরিবর্তন করবে কেন ? তাদের দ্বিতীয় অভিযোগ হচ্ছে , কোরআনে কতক স্ববিরোধী কথা আছে ; আল্লাহর কিতাব হলে তাতে স্ববিরোধী কথা থাকবে কেন ?

তাদের উত্থাপিত প্রথম অভিযোগের দু টি অংশ : পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের তেলাওয়াত্ বাতিল করা হলো কেন এবং কতক বিধানে পরিবর্তন সাধন করা হলো কেন ?

বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে তাদের এ অভিযোগ বিবেচনাযোগ্য নয়। কারণ , প্রথমতঃ পূর্ববর্তী ঐশী কিতাব সমূহে একদিকে যেমন ব্যাপকভাবে বিকৃতি ঘটেছে - যা তারা নিজেরাও স্বীকার করতে বাধ্য , অন্যদিকে তা মূল ভাষায় বর্তমান নেই। ক্ষেত্রবিশেষে মূল ভাষা থেকে হারিয়ে যাবার পর অন্য ভাষার অনুবাদ থেকে পুনরায় মূল ভাষায় অনূদিত হয়েছে। সুতরাং মূল ভাষায় যেভাবে নাযিল্ হয়েছিলো সেভাবে না থাকায় এবং মূল ভাষায় থাকা বা না-থাকা প্রশ্নে বিতর্কের অবকাশ থাকলেও এবং কোনো কোনেটি যদি মূল ভাষায় বর্তমান থেকেও থাকে তথাপি সেগুলোতে আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কথার সাথে মানুষের কথা মিশ্রিত হওয়ার ফলে ঐ সব কিতাবের কথাগুলো আর আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কথা নেই। সুতরাং সেগুলো আর পবিত্র ঐশী বাণী হিসেবে তেলাওয়াতযোগ্য নেই।

দ্বিতীয়তঃ ঐ সব কিতাবের বিকৃতি কেবল তার পাঠ ( text)-এর পঠন - পাঠনের মধ্যেই ঘটে নি , বরং বিধি - বিধানের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। অন্যদিকে ঐ সব কিতাবের কোনোটিই স্থান ও কাল নির্বিশেষে সমগ্র মানবজাতির জন্য নাযিল্ হয় নি , বরং মানবসভ্যতার বিকাশের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর জন্য ভিন্ন ভিন্ন নবী - রাসূল প্রেরণ করা হয় এবং তাদের জন্য নাযিলকৃত কিতাব সমূহে কতক স্থায়ী বিধানের পাশাপাশি কতক বিধান শামিল করা হয়েছিলো একান্তভাবেই তাদের নিজস্ব ও সাময়িক প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে। এছাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর অপরাধের শাস্তি হিসেবে বা তাদের ঈমান ও আনুগত্য পরীক্ষার লক্ষ্যেও কতক বিধান নাযিল্ করা হয়েছিলো।

বলা বাহুল্য যে , স্থান ও কাল নির্বিশেষে ক্বিয়ামত্ পর্যন্ত সমগ্র মানবজাতির জন্য অনুসরণীয় ঐশী বিধান হিসেবে সেগুলোর কোনোই কার্যকরিতা ছিলো না। অবশ্যঃ সন্দেহ নেই যে , ঐ সব গ্রন্থের সবগুলো ঐশী বিধানই স্থান-কাল ও গোষ্ঠীর জন্য নাযিলকৃত সাময়িক বিধান ছিলো না এবং যে সব স্থায়ী বিধান ছিলো তার সবগুলোই যে বিকৃত হয়ে গিয়েছিলো তা নয় ; কতক বিধান অবশ্যই অবিকৃত অবস্থায় র য়ে গিয়েছে। কিন্তু স্থান-কাল ও বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে ক্বিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় বিধান হিসেবে কেবল ঐ বিধানগুলোই যথেষ্ট ছিলো না , বরং আরো অনেক বিধানের প্রয়োজন ছিলো। এমতাবস্থায় সামগ্রিক বিধানের গ্রন্থ হিসেবে ঐ সব গ্রন্থের ব্যবহার হতো এক ধরনের জটিলতা সৃষ্টিকারী কাজ এবং নতুন নাযিলকৃত গ্রন্থের পাশাপাশি ঐ সব গ্রন্থের ব্যবহারের কোনোই উপযোগিতা ছিলো না। এ কারণেই ঐ সব গ্রন্থের স্থায়ী বিধানগুলোকে কোরআনের অন্তর্ভুক্ত করে পুনরায় নাযিল্ করা বা স্বয়ং হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর বিধানিক আচরণের মাধ্যমে অব্যাহত রাখাই (যেমন : খাৎনাহর বিধান) যথেষ্ট ছিলো। [স্মর্তব্য যে , কোরআনের ঘোষণা অনুযায়ী হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) কোরআনের বাইরে যে সব নীতিগত , আইনগত বা শিক্ষণীয় তথা নবুওয়াতের দায়িত্বসংশ্লিষ্ট যে সব কথা বলতেন তার কোনোটিই তাঁর প্রবৃত্তি থেকে বলতেন না , বরং আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত ওয়াহী হিসেবে বলতেন - যাকে ওয়াহীয়ে গ্বায়রে মাত্লূ (পঠন-অযোগ্য ওয়াহী) বলা হয়।]

পূর্ববর্তী আসমানী কিতাব সমূহে প্রদত্ত বিভিন্ন বিধিবিধান এবং সে সব কিতাবের আয়াত্ ভুলিয়ে দেয়া বা সে সবের তেলাওয়াত রহিত করে দেয়ার বিরুদ্ধে ইয়াহূদী ও খৃস্টানদের উত্থাপিত আপত্তির জবাবে আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেন :

) م َا نَنْسَخْ مِنْ آيَةٍ أَوْ نُنْسِهَا نَأْتِ بِخَيْرٍ مِنْهَا أَوْ مِثْلِهَا(

আমি কোনো আয়াতকে তার চেয়ে অধিকতর উত্তম বা তার অনুরূপ (আয়াত্) আনয়ন ব্যতীত কোনো আয়াত্ রহিত করে দেই না বা ভুলিয়ে দেই না। (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : 106)

এ প্রসঙ্গে আমরা ইতিপূর্বে ক্বিয়ামত পর্যন্ত স্থান-কাল নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য সর্বশেষ স্থায়ী বিধান দিতে গিয়ে পূর্ববর্তী কতক বিধিবিধানে রদবদল সাধনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছি। এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন যে , কতক বিধিবিধান হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কাজ বা বস্তুর প্রকৃতিগত অনিবার্য দাবী। এরূপ ক্ষেত্রে বিধান অপরিবর্তিত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। উদাহরণস্বরূপ , যে সব কাজ বা খাদ্য-পানীয় মানুষের জন্য শারীরিক , মানসিক , নৈতিক , চারিত্রিক বা আত্মিক ক্ষতি ডেকে আনে তা অবশ্যই হারাম হওয়া উচিত এবং এ কারণে প্রথম মানুষ হযরত আদম ( আঃ) থেকে শুরু করে শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) পর্যন্ত সকল নবী-রাসূলের ( আঃ) শরী আতেই তা হারাম ছিলো। যেমন : মিথ্যা বলা , চুরি-ডাকাতি , যেনা , নরহত্যা , মাদক দ্রব্য সেবন ইত্যাদি।

কিন্তু অন্য অনেক বিধানের ক্ষেত্রগুলো এমন যে , এ সব ক্ষেত্রে বিধানের জন্য কোনো প্রাকৃতিক মানদণ্ড নেই , ফলে স্থান-কাল নির্বিশেষে অভিন্ন বিধান হওয়া অপরিহার্য নয়। এ সব ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা আলা চাইলে কোনো বিধানকে স্থায়ীভাবেও দিতে পারেন , আবার চাইলে কোনো বিধানকে অস্থায়ীভাবেও দিতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ , ইবাদত-বন্দেগী সংক্রান্ত বিধি-বিধান - যা দ্বারা আল্লাহ্ তা আলার প্রতি বান্দাহর আনুগত্য পরীক্ষা করাই উদ্দেশ্য। যেমন : ইবাদত দৈনিক কতো বার ও কোন্ নিয়মে করতে হবে তার কোনো প্রাকৃতিক মানদণ্ড নেই ; আল্লাহ্ তা আলা যেভাবে চান বান্দাহ্কে সেভাবেই তা আঞ্জাম দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা আলা বিভিন্ন নবীর সময় বিভিন্ন ধরনের হুকুম দিলে তা তাঁর অধিকার।

অনুরূপভাবে সামাজিক বিধি-বিধান এবং অপরাধের শাস্তি বা দণ্ডবিধানেরও কোনো প্রাকৃতিক মানদণ্ড নেই। এ সব ক্ষেত্রেও আল্লাহ্ যখন যেভাবে চান হুকুম দিতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ , আল্লাহ্ তা আলা যদি যেনার শাস্তি চাবূকের একশ ঘা নির্ধারণ না করে দু বা পঞ্চাশ ঘা নির্ধারণ করে দিতেন তাহলেও কারো কিছু বলার ছিলো না।

এছাড়া আল্লাহ্ তা আলা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে পরীক্ষা করার বা শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্যে অস্থায়ী বিশেষ বিধান নাযিল্ করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ বানী ইসরাঈলের জন্য শনিবারের বিধান ও চর্বি ভক্ষণ হারাম করার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।


4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27