ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল 0%

ইনসানে কামেল লেখক:
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

ইনসানে কামেল

লেখক: শহীদ অধ্যাপক মুর্তাজা মুতাহ্হারী
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 41083
ডাউনলোড: 6659

পাঠকের মতামত:

ইনসানে কামেল
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 83 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 41083 / ডাউনলোড: 6659
সাইজ সাইজ সাইজ
ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

মানুষের মধ্যে খোদাকে পাওয়ার জন্য বেদনা

و استعینو بالصّبر و الصلوة و أنّها لکبیرة إلا علی الخاشعین

মানুষ সব সময় নিজের জন্য নিজেই নৈতিকতার প্রবেশ পথ। মানুষ নিজেই নিজের জন্য নৈতিকতার প্রবেশ পথ- এ কথা বলার উদ্দেশ্য হলো নিজের অস্তিত্বের ভিতরেই সে আত্মিক জগতকে দেখে এবং উদ্ঘাটন করে। এটা এজন্য যে,মানুষের ভিতরে এমন কিছু আছে যা বস্তুজগতের মাপকাঠিতে বিচার করা যায় না। কেবল যে সকল প্রাচীন আলেম মারেফাতে নাফ্স (নাফসের পরিচিতি) বা মারেফাতে রূহ (আত্মার পরিচিতি)-এর কথা বলেছেন তারাই নন,বরং বর্তমানে যে সকল আলেম মারেফাতে নাফ্স -এর কথা বলছেন তারাও স্বীকার করেছেন যে,মানুষের মধ্যে এমন কিছু নিহিত আছে যা বস্তুজগতের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। এটার জন্য অন্য কোন মাপকাঠি প্রয়োজন।

রাসূল (সা.)-এর নিকট থেকে একটি হাদীস বহুল প্রচলিত-.

من عرف نفسه فقى عرف ربه

যে নিজেকে চিনতে পেরেছে সে নিজের প্রভুকে (আল্লাহ্) চিনতে পেরেছে।

পবিত্র কোরআন সৃষ্টি জগতের অন্য সকল বস্তু থেকে মানুষের বিষয়টি পৃথকভাবে বর্ণনা করেছে। কোরআন বলছে,

سنريهم آياتنا في الأفاق و في أنفسهم

আমরা আমাদের নিদর্শনগুলোকে জগতের চারিদিকে (প্রকৃতি জগতে) এবং তাদের (মানুষের)মধ্যে দেখাব। কোরআন মানুষের বিষয়টি স্বাধীনভাবে (আলাদাভাবে) বর্ণনা করেছে। এ আয়াতের ফলশ্রুতিতেইآفاقأنفسهم পরিভাষা দু টি সাহিত্যের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। বলা হচ্ছে বাইরের জগতের বিষয় (مسائل آفاق ) ও মানুষের অভ্যন্তরীণ বিষয়।

সম্ভবত কেউ প্রশ্ন করবেন কি বন্তু মানুষের সত্তায় রয়েছে যাকে বস্তু দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না? এ প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় এটা অত্যন্ত ব্যাপক বিষয়। এ বিষয়ে এখন আলোচনা করতে চাচ্ছি না।

মনুষ্যত্বকে মানুষ থেকে আলাদা করা যায়

মানুষের যে সকল বৈশিষ্ট্যকে বস্তুগত হিসেবে মাপা যায় না তার একটি এই বৈঠকে আলোচনা করব যা হলো মানবিক মূল্যবোধ,অন্যভাবে বললে মানুষের মনুষ্যত্ব। এটা আশ্চর্যের বিষয় যে,যেকোন বস্তুকে নিয়ে আমরা চিন্তা করি না কেন দেখব ঐ বস্তু থেকে তার গুণাবলী পৃথকযোগ্য নয়,যেমন নেকড়ে থেকে নেকড়ের স্বভাবকে পৃথক করা যায় না,তেমনিভাবে কুকুর বা ঘোড়া থেকে তাদের স্বভাব পৃথক করা অসম্ভব। আমরা এমন কোন ঘোড়া খুজে পাব না যার মধ্যে ঘোড়ার স্বভাব অনুপস্থিত। কিন্তু এটা সম্ভব যে,আমরা এমন মানুষ খুজে পাব যার মধ্যে মনুষ্যত্ব নেই। কারণ মনুষ্যত্বের জন্য যে উপাদান (যা আমাদের পূর্ববর্তী বৈঠকে আলোচনা করেছি) যা মানুষকে ব্যক্তিত্ব দানকরে (ব্যক্তিমানুষ নয়) প্রথমত তা যদিও মানুষ সম্পর্কিত ও এই পৃথিবীর সঙ্গে যুক্ত কিন্তু তা মানুষের বস্তুগত গঠনের জন্য নয়,বরং অবস্তুগত- যা পঞ্চ ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভবযোগ্য নয়। অন্যভাবে বললে মানুষের আত্মিকতার বিষয়,দৈহিক নয়। দ্বিতীয়ত যে বিষয়গুলো মানুষের মনুষ্যত্বের মাপকাঠি অর্থাৎ তার মানবিক ব্যক্তিত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড তা প্রকৃতির হাতে তৈরি হয় না,বরং কেবল মানুষ নিজের হাতেই তা তৈরি করতে পারে।

আমার এ কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য হলো এটা বুঝানো যে,মানুষের নিজের আত্মিক বিকাশের রূপক মানুষ নিজেই। নিজেই নৈতিকতার জগতে প্রবেশ করে। যেমন ইমাম আলী ইবনে মূসা আর-রেজা (আ.) বলেছেন,

لا يعرف هنالك إلا بما هیهنا

যা সেখানে (আত্মিক জগতে) আছে তা এখানে (মানুষের ভিতরে) কি আছে তা থেকেই জানা যাবে। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

যে বিষয়গুলোকে মানবিক মূল্যবোধ হিসেবে ধরা হয় এবং মানুষের নৈতিকতা ও মনুষ্যত্বের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত অনেক কিছুই এর অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এ সকল মূল্যবোধকে একটি মূল্যবোধের মধ্য আনা যায়। আর তা হলো মানবতার বেদনা । পৃথিবীতে যত মতবাদই মানবিক মূল্যবোধের ব্যাপারে আলোচনা করেছে দৈহিক বেদনার (যা অন্যান্য জীবও অনুভব করে) বাইরে অন্য এক ধরনের বেদনা মানুষের মধ্যে আছে বলে স্বীকার করে। সেটা হলো মানবিক বেদনা । এ মানবিক বেদনা টি কি?

আমরা বলেছি কেউ কেউ এটাকে শুধু মূল থেকে বিচ্ছিন্নতা ও পৃথিবীর পরিবেশের সঙ্গে মানুষের পরিচয়হীনতা ও অসামঞ্জস্যতার বেদনা বলেছেন। কেননা মানুষ এমন এক অস্তিত্ব যাকে তার মূল থেকে বিচ্ছিন্ন করে দূরবর্তী স্থানে (অন্য এক পৃথিবীতে) দায়িত্ব পালনের জন্য পাঠানো হয়েছে। এই আসল থেকে দূরে থাকাই তার মধ্যে প্রকৃত আবাসের প্রতি ভালবাসা,টান,আকুতি ও বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি সৃষ্টি করেছে। প্রকৃত আবাসে ফিরে যাওয়ার আগ্রহ অর্থাৎ স্রষ্টার দিকে প্রত্যাবর্তনের অনুভূতি জন্ম দিয়েছে। সে বেহেশত থেকে বিতাড়িত হয়ে এ ধুলার ধরণীতে এসেছে তাই আবার সেই প্রতিশ্রুত বেহেশতে ফিরে যেতে চায়। অবশ্য তার এ আগমন ভুল করে নয়,বরং দায়িত্ব পালনের জন্য ছিল। কিন্তু এ বিচ্ছিন্নতা তাকে সব সময় বেদনাক্লিষ্ট করেছে। এ মতবাদের মতে মানুষের বেদনা শুধু আল্লাহর জন্য,তার থেকে দূরে থাকার জন্য এবং সেই সত্যের নিকট (মহান রব্বুল আলামীনের২৪ নিকট) প্রত্যাবর্তনের আশা থেকে সৃষ্ট। মানুষ পূর্ণাঙ্গতার যে পর্যায়েই পৌছে থাকুক না কেন তারপরও সে অনুভব করে সেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌছেনি।

মানুষ সর্বোচ্চ পূর্ণতার প্রত্যার্শী

একটি কথা প্রচলিত যে,মানুষ সব সময় সে জিনিসই চায় যা তার নিকটে নেই। এটা খুবই আশ্চর্যের বিষয়। যা তার নেই তা পেতে চায়। কিন্তু যখন সে জিনিসটি পায় আস্তে আস্তে সেটার প্রতি আগ্রহ কমে যায়। এটা প্রকৃতিতে একটি অযৌক্তিক বিষয় যে,কোন সৃষ্টিতে কিছুর প্রতি আকর্ষণ আছে কিন্তু যখন তা লাভ করে তখন নিজ থেকে সে বস্তুকে বিকর্ষণ করে।

এক ব্যক্তি একটি ঘটনা বলেছিল। একটি বিদেশী জাদুঘরে ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। বিছানার উপরঘুমন্ত একজন খুব সুন্দর রমণীর একটি মূর্তি লক্ষ্য করলাম আর এক সুন্দর যুবকের মূর্তি যার এক পা ঐ বিছানার উপর আর অন্য পা মাটিতে রাখা। যুবকটি তার মুখ বিপরীত দিকে ফিরিয়ে রেখেছে,দেখে মনে হচ্ছে যেন সে পালিয়ে যাচ্ছে। এটা দেখার পর এর অর্থ আমি বুঝতে পারলাম না যে,কেন ভাস্কর এ নারী ও পুরুষের মূর্তিতে একে অপরের প্রতি আসক্ত না দেখিয়ে বরং পুরুষ মূর্তিটিকে নারীর প্রতি অনাসক্ত দেখিয়েছেন। যিনি এই ভাস্কর্যগুলো ব্যাখ্যা করছিলেন তাকে জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন, এ যুগল মূর্তি প্লোটোর প্রসিদ্ধ একটি চিন্তা থেকে নেয়া হয়েছে- মানুষ যে প্রেমিকার প্রতি আসক্ত থাকে প্রথম দিকে তার প্রতি প্রচণ্ড আসক্তি ও আকর্ষণ সহকারে ধাবিত হয়,কিন্তু যখনই সেটাকে লাভ করে তখনই এ আকর্ষণ ও আসক্তির মৃত্যু ঘটে। তখন তার প্রতি অনাসক্তি দেখা দেয় ও তা থেকে পালিয়ে যেতে চায়।

কেন এ রকম হয়? দৃশ্যত এ বিষয়টি অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিক মনে হয়। কিন্তু যারা এ বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেছেন,এ বিষয়টির সমাধান পেয়েছেন। তারা বলেছেন,মানুষ এমন এক অস্তিত্ব যা সীমিত কোন বস্তুর প্রেমিক হতে পারে না। সে অস্থায়ী বস্তুর প্রেমিক হতে চায় না। যে বস্তু স্থান ও কালের পরিসীমায় সীমাবদ্ধ তা তার প্রকৃত আকাঙ্ক্ষিত বস্তু নয়। মানুষ অপরিসীম পূর্ণত্বের প্রেমিকর,অন্য কিছুর নয়। সে অসীম সত্তা মহাসত্য খোদার প্রেমিক। যে ব্যক্তি আল্লাহকে অস্বীকার করে,তাকে গালি দেয় সে নিজেও জানে না তার সত্তার গভীরে সে ঐ অপরিসীম পূর্ণ সত্তার প্রেমিক; কিন্তু সে পথহারিয়ে ফেলেছে,প্রেমিককে ভুলে গেছে।

মহিউদ্দীন আরাবী বলেন,

ما أحبّ أحد غیر خالقه

কোন মানুষই স্রষ্টা (আল্লাহ্) ব্যতীত অন্য কাউকে ভালবাসেনি।

এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে কোন ব্যক্তিকে পাওয়া যায়নি যে আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কিছুকে ভালবেসেছে।.

و لکنّه تعالی احتجب تحت اسم زینب و سعاد و غیر ذلک

কিন্তু আল্লাহ্ তাবারাক ওয়া তায়ালা যয়নাব,সোয়াদ বিভিন্ন নামের মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন।

মজনু ভাবে,সে লাইলীর প্রেমিক,কিন্তু সে নিজের সত্তার সম্পর্কে বেখবর। এ জন্যই মহিউদ্দীন আরাবী বলেন,নবিগণ এ জন্য আসেননি যে,মানুষকে আল্লাহর ভালবাসা ও ইবাদত শিক্ষা দেবেন(যেহেতু এগুলো মানুষের ফেতরাতের অন্তর্ভুক্ত),বরং তারা এসেছেন এজন্য যে,তারা মানুষকে বক্র ও সরল পথ চিনিয়ে দেবেন। তারা বলতে এসেছেন, হে মানব! তোমরা সীমাহীন পূর্ণত্বের প্রত্যাশী,কিন্তু তোমরা মনে কর অর্থ বা পদমর্যাদা বা কোন নারী সেই পূর্ণত্ব। তোমরা ঐ অপরিসীম পূর্ণ সত্তা ছাড়া অন্য কিছুই চাও না কিন্তু ভুল করে অন্য কিছুর পেছনে ছুটছো। রাসূলগণ এসেছেন মানুষকে এ ভুল থেকে বের করে আনার জন্য।

মানুষের বেদনা খোদাকে পাওয়ার বেদনা। যদি ভুলের পর্দা চোখের উপর থেকে সরে যায় তাহলে মানুষ তার আসল প্রেমিককে খুজে পাবে। তখন সেও এমন আসক্তি নিয়ে ইবাদত করবে যেমন আমরা আলীকে দেখি।

কেন কোরআন এ কথা বলছে,

) ألا بذکر الله تطمئنّ القلوب(

জেনে রাখ,কেবল আল্লাহর স্মরণেই হৃদয় প্রশান্তি লাভ করে।

এখানেبذکر الله পূর্বে আনা হয়েছে সীমাবদ্ধ করার জন্য যে,একমাত্র এর মাধ্যমেই মানুষের হৃদয় প্রশান্তি লাভ করে এবং অস্থিরতা ও কষ্ট থেকে মুক্তি লাভ করে। মহান আল্লাহর স্মরণ ও সান্নিধ্য লাভের মাধ্যমেই কেবল প্রশান্তি লাভ করা যায়। কোরআন বলছে,মানুষ যদি ভাবে,অর্থ-সম্পদ লাভের মাধ্যমে সে প্রশান্তি লাভ করবে,অস্থিরতা ও মনঃকষ্ট থেকে মুক্তি লাভ করবে তবে সে ভুল করবে। কোরআন এটা বলছে না যে,তোমরা এগুলোর পেছনে ধাবিত হয়ো না,বরং বলছে এগুলোকে অবশ্যই অর্জন করতে হবে। কিন্তু যদি মনে করে যে,এগুলোর মাধ্যমে প্রশান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করা যায় না। বরং যখন মানুষ এগুলো লাভ করে তখন অনুভব করে যে,ভুল করেছে। যা সে চেয়েছিল তা এতে নেই। তাই শুধু আল্লাহর স্মরণে অন্তঃকরণ শান্তি লাভ করে। অধিকাংশ মতবাদই এ চিন্তা থেকে দূরে।

কোন কোন মতবাদ তাদের মানব বেদনাকে খোদাকে পাওয়ার বেদনার উপর ভিত্তি না করে খোদার সৃষ্টির জন্য বেদনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। কেউ কেউ এটাও বলেন যে,মানুষের খোদাকে পাওয়ার বেদনা,এটা আবার কি? উদাহরণস্বরূপ একটি পত্রিকার কথা বলছি যার আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল খোদা না মানুষ? কেউ বলছে খোদা,কেউ বলছে মানুষ,কেউ বা খোদা ও মানুষ দু টিই। কিন্তু আমি কাউকে দেখিনি যিনি বলেছেন আল্লাহ্ ও মানুষ একটি অপরটি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। যদি আল্লাহ না থাকেন তাহলে মানুষও নেই। আমরা যতক্ষণ মানুষের ভেতরে খোদাকে পাওয়ার বেদনাকে না বুঝব,যতক্ষণ না আল্লাহর দিকে যাত্রা করব ততক্ষণ মানবতার জন্য বেদনাও নিষ্ফল হবে।