ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল 0%

ইনসানে কামেল লেখক:
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

ইনসানে কামেল

লেখক: শহীদ অধ্যাপক মুর্তাজা মুতাহ্হারী
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 41080
ডাউনলোড: 6659

পাঠকের মতামত:

ইনসানে কামেল
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 83 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 41080 / ডাউনলোড: 6659
সাইজ সাইজ সাইজ
ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

জীবনের শেষ মুহূর্তগুলোতে ইমাম আলী (আ.)

আলী (আ.)-এর জীবনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও আশ্চর্যজনক সময় তার জীবনের শেষ দু দিন। তার জীবনের কয়েকটি পর্যায় রয়েছে- তার জন্ম থেকে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ইন্তেকাল পর্যন্ত,রাসূলল্লাহর নবুওয়াত থেকে হিজরত পর্যন্ত,হিজরত থেকে রাসূলের ইন্তেকাল পর্যন্ত,রাসূলল্লাহর ইন্তেুকাল থেকে নিজের খেলাফত প্রাপ্তির পূর্বের ২৫ বছর এবং খেলাফত প্রাপ্তির পর সাড়ে চার বছর। এর বাইরেও তার জীবনের আরেকটি পর্যায় রয়েছে যা তিন দিনেরও কম সময়ের,কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর মুহূর্তগুলো এখানে দেখা যায়। সেটা হলো আলী (আ.) যখন তরবারীর আঘাতে শয্যাশায়ী হলেন তখন থেকে ওফাত পর্যন্ত। তিনি যে এক পূর্ণ মানুষ তা এখানেই প্রকাশিত হয়। তিনি যখন মৃত্যুর মুখোমুখি তখন মৃত্যুর প্রতি তার প্রতিক্রিয়া কি? যখন তরবারী তার কপালে আঘাত হানলো তখন তিনি দু টিু বাক্য বলেছেন। একটি এ ব্যক্তিকে ধর ,অপরটিفزت و ربّ الکعبة কাবার প্রভুর শপথ! আমি সফলকাম হয়েছি- শাহাদাত আমার জন্য সফলতা

আলী (আ.)-কে এনে বিছানায় শোয়ানো হলো। চিকিৎসক আসির ইবনে আমর যিনি কুফায় আঘাত বিষয়ক খ্যাতিমান বিশেষজ্ঞ ছিলেন তিনি আমীরুল মুমিনীনের চিকিৎসার জন্য আসলেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বুঝতে পারলেন,তরবারীতে বিষ মিশ্রিত ছিল এবং বিষ তার রক্তে প্রবেশ করেছে। তাই চিকিৎসায় লাভ হবে না এটা নিশ্চিত হয়ে নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করলেন। সাধারণত যে রোগীর আরোগ্যের সম্ভাবনা নেই তাকে এ কথা বলা হয় না। কিন্তু আসির জানতেন,আলী (আ.) অন্য দশজনের মতো নন। তাই তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমীরুল মুমিনীন,যদি কোন অসিয়ত থেকে থাকে তাহলে তা ঘোষণা করুন।

হযরত উম্মে কুলসুম (আলীর কন্যা) এ কথা শুনে ইবনে মুলজিমকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমার পিতা তোর কি ক্ষতি করেছিল যে,তার প্রতি এ আচরণ করেছিস? আল্লাহ্ চাইলে আমার পিতা যদি সুস্থ হয়ে উঠেন,তোর চেহারা কলঙ্কিত করে দেবেন। যখন উম্মে কুলসুম এ কথা বললেন তখন ইবনে মুলজিম (আল্লাহর রহমত থেকে তাকে বঞ্চিত করুন) জবাব দিল, আমি তরবারীটা এক হাজার দিরহাম দিয়ে কিনেছি,আর এক হাজার দিরহামের বিষ ওটাতে মাখিয়েছি। যে পরিমাণ বিষ ওটাতে মাখিয়েছি যদি কুফার সকল মানুষের মাথায় আঘাত করি তাহলে তারা মৃত্যুবরণ করবে। তাই তোর বাবার বেঁচে থাকার কোন সম্ভাবনা নেই তা জেনে রাখ।

আলী (আ.)-এর অলৌকিকত্ব এখানেই প্রকাশিত হয়। তিনি তার অসিয়তে বলেন,বন্দির প্রতি সঠিক আচরণ কর।,

یا بنی عبد المطلب لا الفینّکم تخوضون دماء المسلمین خوصا، تقولون قتل امیر المؤمنین ألا لا تقتلنّ بن الا قاتلی

আব্দুল মুত্তালিবের সন্তানেরা তোমরা এমন যেন না কর,যখন আমি পৃথিবী থেকে বিদায় নেব তখন মানুষের উপর হামলা কর এ অজুহাতে যে,আমীরুল মুমিনীনকে শহীদ করা হয়েছে। অমুকের এটার পেছনে হাত ছিল,অমুক এ কাজে উৎসাহিত করেছে। এ সকল কথা বলে বেড়াবে না,বরং আমার হত্যাকারী এ ব্যক্তি। ইমাম হাসান (আ.)-কে বললেন, বাবা হাসান! আমার মৃত্যুর পর এ বিষয়ের সম্পূর্ণ দায়িত্ব তোমার। যদি চাও আমার হত্যাকারীকে মুক্তি দেবে তাহলে মুক্তি দিও,যদি চাও কেসাস গ্রহণ করবে তাহলে লক্ষ্য রাখবে,সে তোমার পিতাকে একটি আঘাত করেছে,তাকেও একটি আঘাত করবে। যদি তাতে মৃত্যুবরণ করে তো করল,নতুবা ছেড়ে দেবে। (নাহজুল বালাগাহ্,পত্র নং ৪৭)

তারপর আবার বন্দির চিন্তায় মগ্ন। বন্দিকে ঠিক মতো খেতে দিয়েছ তো? পানি দিয়েছ খেতে? ঠিক মতো দেখাশোনা কর ওর। কিছু দুধ তার জন্য আনা হলে কিছুটা খেয়ে বললেন,বাকীটা বন্দিকে দাও। এটাই আলী (আ.)-এর আচরণ তার শত্রুর সাথে। এ জন্যই মাওলানা রুমী বলেছেন,

সাহসিকতায় তুমি শেরে খোদা জানি

পৌরুষত্বে কি তিনি,জানেন শুধুই অন্তর্যা মী।

এখানেই আলীর পৌরুষত্ব ও মানসিকতার সর্বোচ্চ স্তরের প্রকাশ ঘটেছে। আলী মৃত্যু শয্যায় শায়িত,প্রতি মুহূর্তে তার অবস্থার অবনতি ঘটছে,বিষ তার পবিত্র শরীরে প্রতিক্রিয়া করছে। তার সঙ্গীরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত,সবাই ক্রন্দনরত,চারিদিকে ক্রন্দনের শব্দ,কিন্তু আলী (আ.)-এর মুখ হাস্যোজ্জ্বল। তিনি বলছেন,

وَاللَّهِ ما فَجَاءَنِي مِنَ الْمَوْتِ وارِدٌ كَرِهْتُهُ، وَ لا طالِعٌ اءَنْكَرْتُهُ، وَ ما كُنْتُ إِلا كَقارِبٍ وَرَدَ، وَ طالِبٍ وَجَدَ

আল্লাহর শপথ! যা আমার নিকট এসেছে (মৃত্যু) এমন কিছু নয় যে,আমি তা অপছন্দ করি। আল্লাহর পথে শাহাদাত সব সময়ই আমার নিকট সর্বাধিক ঈর্ষান্বিত বস্তু ছিল,আমার জন্য শাহাদাত এমন বস্তু যেন কোন ব্যক্তি যার জন্য আকাঙ্ক্ষিত ছিল তা পেয়েছে। আমার জন্য এর চেয়ে উত্তম কি হতে পারে যে,ইবাদতরত অবস্থায় শহীদ হব? (নাহজুল বালাগাহ্,পত্র নং ২৩),

وَ ما كُنْتُ إِلا كَقارِبٍ وَرَدَ، وَ طالِبٍ وَجَدَ

অতঃপর এমন এক উদাহরণ এনেছেন যে উদাহরণের সঙ্গে আরবরা খুবই পরিচিত। আরবরা বেদুইনদের মতো যাযাবর জীবন যাপন করত। যতদিন কোন স্থানে পানি ও তাদের মেষ,উট ইত্যাদির জন্য ঘাস ও লতা জাতীয় উদ্ভিদ পেত ততদিন সেখানে থাকত; তারপর অন্য স্থানে পানি ও ঘাস পেলে সেখানে চলে যেত। যেহেতু মরুভূমিতে প্রচণ্ড গরম সেহেতু রাত্রিতে পানির সন্ধানে ঘুরে বেড়াত।قارب পানির অনুসন্ধানকারী ব্যক্তিকে বলা হয়। আলী তার সহযোগীদের উদ্দেশ্য করে বলছেন, আমার সঙ্গীরা! গভীর রাতে পানির অনুসন্ধানকারী ব্যক্তি আকস্মিকভাবে পানির সন্ধান পেয়ে যেমন উল্লাসিত হয় আমিও তেমন শাহাদাতের সুযোগ পেয়ে আনন্দিত। আমার উদাহরণ সেই প্রেমিকের মত যে তার ভালবাসার বস্তুটি লাভ করেছে।

রাত্রির শেষলগ্ন আমায় দিল দুঃখ থেকে মুক্তি

অর্ধরাত্রিতে যেন পেলাম আবে হায়াতের পরিতৃপ্তি।

কি পবিত্র এ রাত,আনন্দে আমার মন ভরে গিয়েছিল

শবে কদরে আমার ভাগ্যে যা লেখা হয়েছিল।

এ কবিতার প্রথম দু লাইন-فزت و ربّ الکعبة এর অর্থ । আলী (আ.)-এর সবচেয়ে উষ্ণ উক্তিগুলো যেন তার জীবনের শেষ দু দিনে উচ্চারিত হয়েছে। তিনি ১৯ রমযানের ফজরের ওয়াক্তের কিছু পরেইআঘাতপ্রাপ্ত হন এবং ২১ তারিখের রাত্রির দ্বিপ্রহরে স্রষ্টার নিকট তার পবিত্র আত্মার প্রত্যাবর্তন ঘটে।

শেষ মুহর্তগুলোতে সবাই তার চারপাশে সমবেত হয়েছে। বিষের প্রতিক্রিয়ায় তিনি বারবার বেহুশূ হয়ে পড়ছেন। কিন্তু যখনই জ্ঞান ফিরে পাচ্ছেন তখনই তার কণ্ঠে হেকমতপূর্ণ উপদেশ ও নসিহত উচ্চারিত হচ্ছে। তার শেষ উপদেশ যা অত্যন্ত উষ্ণতাপূর্ণ ও গুরুত্ববহুল তা তিনি বিশটি বাক্যে বর্ণনা করেছেন। প্রথমে ইমাম হাসান (আ.),এরপর ইমাম হুসাইন (আ.),তারপর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের লক্ষ্য করে বলেছেন। ইমাম হাসান,ইমাম হুসাইন (আ.),আলী (আ.)-এর অন্যান্য সন্তানসহ আমরা সকলেই,এমনকি কিয়ামত পর্যন্ত যারা আসবে আলী তাদের উদ্দেশ্যে এ বক্তব্য দিয়েছেন। এ বাক্যগুলোতে ইসলামকে যেন পূর্ণভাবে বর্ণনা করেছেন- সামগ্রিকভাবে উপস্থাপনকরেছেন।

اَللَّهَ اللَّهَ فِي الأَيْتَامِ ، وَ اللَّهَ اللَّهَ فِي الْقُرْآنِ، وَ اللَّهَ اللَّهَ في جيرَانِكُمْ، وَ اللَّهَ اللَّهَ فِي بَيْتِ رَبِّكُمْ، وَ اللَّهَ اللَّهَ فِي الصَّلاَةِ، وَ اللَّهَ اللَّهَ فِي الزَّكَاةِ

(বিহারুল আনওয়ার,৯ম খণ্ড,পৃ. ৭৪৬ ও নাহজুল বালাগাহ্,পত্র নং ৪৭)

তিনি একে একে সব বর্ণনা করছেন। আল্লাহ্,আল্লাহ্,ইয়াতীমদের ব্যাপারে সতর্ক থেক; আল্লাহ্,আল্লাহ্,কোরআনকে আঁকড়ে ধর; আল্লাহ্,আল্লাহ্,প্রতিবেশীদের ব্যাপারে দায়িত্বের কথা মনে রেখ;নামায,রোযা,হজ্ব,যাকাত...। সবাই আলী (আ.)-এর মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। হঠাৎ লক্ষ্য করলেন আলীর চেহারা পরিবর্তিত হয়ে গেছে,তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। সবাই কান পেতে আছে তিনি আর কি বলেন। সবাই দেখছেন আলী (আ.) উচ্চৈঃস্বরে পড়ছেন, আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লালাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহ্।

و لا حول و لا قوة إلا بالله العلی العظیم

বিভিন্ন মতাদর্শের দৃষ্টিতে পূর্ণ মানব

) هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُبِينٍ(

যে কোন মতাদর্শের প্রবক্তা যখনই কোন মতাদর্শ উপস্থাপন করেছেন একই সঙ্গে তার নিজের দৃষ্টিতে পূর্ণ মানবের অথবা মানুষের পূর্ণত্বের বিষয়টিও উপস্থাপন করেছেন। ঐ বিষয়কে আখলাক বলা হয়। তাদের মতে আখলাখ বা নৈতিকতা জ্ঞান নয়; বরং শিল্প বা কৌশল। অর্থাৎ আখলাক কিরূপ হওয়া উচিত তা নিয়ে আলোচনা করে। বাস্তবে মানুষ কিরূপ অবস্থায় বিরাজ করছে তা আখলাকের বিষয়বস্তু নয়। সামগ্রিক যে বৈশিষ্ট্যগুলো মানুষের মধ্যে থাকা উচিত বা যে বৈশিষ্ট্যগুলো লাভ করলে সে সর্বোত্তম মানুষে পরিণত হবে ও বলা যাবে যে,সে মানবিকতার সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করেছে সেটাই পূর্ণ মানবের প্রতিকৃতি।

বৃদ্ধিবৃত্তিক ( আকলগত) মতাদর্শ

বিভিন্ন মতাদর্শের প্রবক্তাদের দৃষ্টিতে পূর্ণ মানব বা ইনসানে কামেল সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গিকে কয়েকটি মৌলিক ভাগে ভাগ করা যায়। তার একটি বুদ্ধিবৃত্তি বা আকল ভিত্তিক মতাদর্শ। যারা খুব বেশি বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষকে দেখেন তারা এ দলের অন্তর্ভুক্ত। তারা মানুষের মূল উপাদান আকল ব্যতীত অন্য কিছু নয় বলে মনে করেন। বুদ্ধিবৃত্তি অর্থ চিন্তাশক্তি বা চিন্তা করার ক্ষমতা। অতীতের দার্শনিকদের মধ্যে অনেকেই,যেমন বু আলী সিনা এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন। তারা চিন্তা করতেন,প্রজ্ঞাবান মানুষই পূর্ণ মানুষ এবং মানুষের পূর্ণতা তার প্রজ্ঞার মধ্যে নিহিত।

প্রজ্ঞা বলতে তারা কি বুঝাতেন? প্রজ্ঞা বলতে কি তারা যাকে আমরা বর্তমানে বিজ্ঞান বলি তা বুঝতেন? না,বরং তারা প্রজ্ঞা বলতে (ব্যবহারিক নয় তত্ত্বগত প্রজ্ঞা) অস্তিত্ব জগৎ থেকে সামগ্রিক যেরূপটি আমরা বুঝি তা-ই বুঝতেন। এটা বিজ্ঞান নয়,যেহেতু বিজ্ঞান অস্তিত্বের একটি অংশের প্রতিচ্ছবি মাত্র। যাতে করে দর্শন ও বিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য পরিষ্কার হয এজন্য একটি উদাহরণ পেশ করছি।

ধরুন,আপনি তেহরান শহর সম্পর্কে ধারণা পেতে চান। দু ভাবে আপনি এ ধারণা পেতে পারেন। প্রথমত আপনি তেহরান সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা লাভ করতে পারেন,কিন্তু অস্পষ্ট। দ্বিতীয়ত আপনার ধারণা আংশিক,তবে নির্দিষ্ট ও স্পষ্ট। কখনো তেহরান সম্পর্কে আপনার ধারণা পৌরসভার একজন প্রকৌশলীর মতো। তাকে বলেন তেহরান শহরের একটা মানচিত্র আঁকুন। তিনি আপনার জন্য হয়তো একটি মানচিত্র আঁকবেন যার মধ্যে শহরের মহল্লা,পথগুলো,চৌরাস্তা,পার্ক ইত্যাদি মোটামুটি অধিকভাবে কাগজের উপর এঁকে দেখাবেন। যেমন এখানে নিয়াভারন,ওখানে তাজরিস,ওপাশে শাহ আবদুল আজিম ইত্যাদি অর্থাৎ তেহরান সম্পর্কে একটা সাধারণ ও সার্বিক ধারণা আপনাকে দেবেন,কিন্তু এ ধারণা স্পষ্ট নয়। যদিও তিনি সম্পূর্ণ তেহরানের বিষয়ে আপনাকে তথ্য দিয়েছেন এবং সমগ্র তেহরানের মানচিত্র আপনার জন্য এঁকেছেন,কিন্তু তাতে আপনি আপনার বাড়ীটি যা এ শহরে রয়েছে তা খুজে পাবেন না। ঐ প্রকৌশলীও তা বলতে পারবেনঁ না।

কিন্তু কোন এক ব্যক্তি হয়তো জানেন না তেহরানের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ কত,কতটি চৌরাস্তা ও রাজপথ রয়েছে; তেহরানের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো কোথায়,এ শহরে কতটি পাহাড় রয়েছে,কিন্তু এ শহরের কোন এক বিশেষ এলাকা বা মহল্লার বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করলে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ঐ এলাকার বর্ণনা সে আপনাকে দান করবে। যেমন এ মহল্লায় কতটি গলি রয়েছে,গলিগুলোর মধ্যে কোন সংযোগ আছে কিনা,প্রতি গলিতে কতটি বাড়ী রয়েছে,এমনকি দালানগুলোর কোনটি হলুদ,কোনটি সাদা,কোনটি লাল রংয়ের সবই সে জানে।

যদি ঐ প্রকৌশলী যিনি এ শহর সম্পর্কে সার্বিক ধারণা রাখেন তাকে এ মহল্লার গলিগুলোর ব্যাপারে প্রশ্ন করেন তাহলে দেখবেন তিনি হয়তো এর কিছুই জানেন না। এ শহরের বিভিন্ন অংশ সম্পর্কেও তার জানা নেই।

দার্শনিক তাকেই বলা হয় যিনি অস্তিত্ব জগতের ব্যাপারে সার্বিকভাবে গবেষণা ও পড়াশোনা করেন। তিনি অস্তিত্বের মূলকে জানতে চান,এর সমাপ্তি কোথায় তা জানতে চান- জানতে চান এ অস্তিত্ব জগতের উপর ক্রিয়াশীল সার্বিক কানুনগুলো কি। কিন্তু এই দার্শনিককে যদি আপনি বিশেষ কোনবৃক্ষ,প্রাণী বা খনিজ অথবা পৃথিবী ও সূর্যের বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রশ্ন করেন হয়তো দেখবেন তিনি কোন তথ্যই জানেন না।

দার্শনিকের নিকট প্রজ্ঞার অর্থ অস্তিত্ব জগৎ সম্পর্কে সার্বিক ধারণা। বিশ্ব জগৎ সম্পর্কে যে সার্বিক ধারণা একজন বিজ্ঞের মানসপটে প্রতিফলিত হয় অথবা সমগ্র অস্তিত্ব জগৎ যে অস্পষ্টরূপে কোন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তির বুদ্ধিবৃত্তিতে ধরা দেয় সেটাই দার্শনিকের জ্ঞান। একজন দার্শনিকের দৃষ্টিতে মানুষের পূর্ণতা এটাই যে,সে সমগ্র অস্তিত্ব জগতকে তার বুদ্ধিবৃত্তিতে প্রতিফলিত করবে। তার এ জ্ঞান আংশিক নয় যে,অস্তিত্ব জগতের এক অংশ সম্পর্কে সে জ্ঞাত অন্য অংশ সম্পর্কে নয়। এ বিষয়টিকে তারা এভাবে সংজ্ঞায়িত করেন,

صیروة الإنسان عالما عقلیا مضاهیا العینی

বাস্তব পৃথিবীর অনুরূপ বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্বের মানুষ হওয়া অর্থাৎ মানুষ বহির্বিশ্বের বিপরীতে নিজে একবিশ্ব হবে। তবে ঐ বহির্বিশ্ব হলো বাস্তব বিশ্ব,আর মানুষের ভেতরের বিশ্ব হলো বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্ব।

যে কেউ জ্ঞান করেছে আহরণ

এক বিশ্ব তারই অনুরূপ করেছে ধারণ।

কবিতার এ ছত্র এটাই বলতে চায়।

দর্শনের ধারণায় পূর্ণ মানব তিনিই যার বুদ্ধিবৃত্তি পূর্ণতায় পৌছেছে এ অর্থে যে,অস্তিত্ব জগতের আকৃতি ও প্রকৃতি তার বুদ্ধিবৃত্তিতে পূর্ণরূপে ধরা দিয়েছে। কিন্তু কিসের মাধ্যমে? চিন্তার মাধ্যমে,দলিল-প্রমাণ ও যুক্তির মাধ্যমে সে এখানে পৌছেছে।

কিন্তু দর্শন এখানেই পরিতৃপ্ত নয়। তারা বলেন প্রজ্ঞা দু ধরনের : এক,তত্ত্বগত প্রজ্ঞা অর্থাৎ বিশ্বজগতের পরিচয় লাভ যেভাবে আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি; দুই,ব্যবহারিক প্রজ্ঞা। ব্যবহারিক প্রজ্ঞা কি? ব্যবহারিক প্রজ্ঞা (ব্যবহারিক প্রজ্ঞাও বুদ্ধিবৃত্তির সাথে সম্পর্কিত) হলো মানুষের সকল প্রবৃত্তি,শক্তিও ক্ষমতার উপর বুদ্ধিবৃত্তির প্রাধান্য ও নিয়ন্ত্রণ। (আমাদের নৈতিকতা সম্পর্কিত গ্রন্থগুলো অধ্যয়ন করলে দেখবেন,নৈতিকতার আলোচনাগুলো সক্রেটিয় নৈতিকতা । সক্রেটিয় নৈতিকতায় সব সময়ই বুদ্ধিবৃত্তির উপর নির্ভর করা হয়েছে। যেমন মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি তার প্রবৃত্তির উপর প্রাবল্য লাভ করেছে নাকি প্রবৃত্তি বুদ্ধিবৃত্তির উপর?) যদি আপনি তাত্ত্বিক প্রজ্ঞায় চিন্তা ও যুক্তির মাধ্যমে যেমন ভাবে বলা হয়েছে ঠিক তেমনভাবে বিশ্বকে আপনার চিন্তার জগতে প্রতিফলিত করতে পারেন সে সাথে ব্যবহারিক প্রজ্ঞার ক্ষেত্রে আপনার বুদ্ধিবৃত্তিকে নাফ্স বা প্রবৃত্তির উপর বিজয় দান করতে পারেন এমনভাবে যে,আপনার প্রবৃত্তি ও কামনা বুদ্ধিবৃত্তির নিয়ন্ত্রণে থাকে তখন আপনাকে পূর্ণ মানব বা ইনসানে কামেল বলা যাবে। এই মতবাদকে আকলের মতবাদ বা বুদ্ধিবৃত্তিক প্রজ্ঞার মতবাদ বলা হয়। পরবর্তী বৈঠকগুলোতে এ মতবাদগুলো সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করব। প্রথমে মতবাদগুলোকে ব্যাখ্যা করব। অতঃপর ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গির আলোচনা রাখব।

প্রেম বা ভালবাসার মতাদর্শ

পূর্ণ মানব সম্পর্কিত অন্যতম মতবাদ হলো প্রেম বা ভালবাসার মতবাদ। প্রেমের মতবাদ যাকে এরফানও বলা হয়। এ মতবাদ মানুষের পূর্ণতাকে প্রেম বলে জানে। প্রেম বলতে এখানে স্রষ্টা বা আল্লাহ্ তায়ালার প্রতি ভালবাসা বোঝানো হয়েছে। মানুষকে জানতে হবে প্রেম কিভাবে তাকে সেই মহাসত্যের নিকট পৌছে দেয়। বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদ গতির মতবাদ নয়,বরং চিন্তাগত মতবাদ (প্রজ্ঞাবান দার্শনিক গতির কথা বলেন না,বরং তার ধারণায় সকল গতিই চিন্তাগত)। এর বিপরীতে প্রেমের মতবাদ গতির মতবাদ। কিন্তু এ গতি সমান্তরাল নয়,বরং লম্বিক ও আরোহ গতি। প্রাথমিকভাবে মানুষ যখন পূর্ণতায় পৌছতে চায় তার গতি ঊর্ধ্ব বা আরোহী হওয়া উচিত অর্থাৎ আল্লাহর দিকে আরোহণ ও উড্ডয়ন।

তারা বিশ্বাস করেন এখানে চিন্তা,বুদ্ধিবৃত্তি ও যুক্তির অবকাশ নেই। এখানে শুধু আত্মার কার্যক্রমও গতি রয়েছে এবং আত্মার এ গতি আল্লাহ্য় গিয়ে পৌছে। সমস্যা এখানেই সৃষ্টি হয়েছে যে, মানুষ আল্লাহর নিকট পৌছায় - এর অর্থ কি? যদিও তারা তাদের এ বাণীকে বিভিন্ন স্থানে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন,কিন্তু সে সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক মতাদর্শের তীব্র সমালোচনা করেছেন।

আমাদের (ফার্সী) সাহিত্যের খুবই আকর্ষণীয় একটি আলোচনা বুদ্ধিবৃত্তি ও প্রেমের দ্বন্দ্ব নিয়ে আবর্তিত হয়েছে। মূলত আরেফরা এ বিষয়টি নিয়ে অধিক আলোচনা রেখেছেন এবং সব সময়ই প্রেমকে বুদ্ধিবৃদ্ধির উপর বিজয়ী ঘোষণা করেছেন।

খোদাপ্রেমের মতবাদ মানুষের পূর্ণতায় পৌছার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিকে যথেষ্ট বলে মনে করে না। তারা বলেন,বুদ্ধিবৃত্তি মানুষের অস্তিত্বের একটি অংশ মাত্র- পূর্ণ অস্তিত্ব নয়। চক্ষু যেমন মানুষের অন্যতম মাধ্যম,বুদ্ধিবৃত্তিও তাই। মানুষের সত্তা তার বুদ্ধিবৃত্তি নয়,বরং মানুষের সত্তা হলো তার আত্মা এবং আত্মা খোদাপ্রেমের প্রতিভূ- যেখানে তার প্রতি যাত্রা ব্যতীত অন্য কিছুই নেই। এ কারণেই এ মতবাদে বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদ ও বুদ্ধিবৃত্তিকে সমালোচনা করা হয়। কবি হাফেজ এ বিষয়টি সুন্দরভাবেবর্ণনা করেছেন-

প্রেমের শরাব পেতে চাই আমি আকলের মূল্যে

সেই তো ধন্য যে এ ব্যাবসা করলে।

আরেফগণ সব সময়ই প্রেমাকুল হওয়াকে বুদ্ধিবৃদ্ধির উপর প্রাধান্য দেন। তাদের নিজস্ব কিছু বক্তব্য ও কথা রয়েছে। তাদের নিকট একত্ববাদের বিশেষ অর্থ রয়েছে,একত্ববাদ তাদের নিকট অস্তিত্বসমূহের একতা (ওয়াহ্দাতে উজুদ)। এ একত্ববাদ এমন যে,যদি কোন মানুষ সেখানে পৌছায় তাহলে সব কিছুরই অন্য রকম অর্থ অনুভব করে। এ মতবাদে পূর্ণ মানব অবশেষে খোদার অনুরূপ হয়ে যায়। তাদের ভাষায় প্রকৃত পূর্ণ মানব খোদ স্রষ্টা এবং যে মানুষই কামেল মানুষ হয়,নিজে বিলীন হয়ে খোদায় পৌছায়। এ মতবাদ সম্পর্কে আমরা পরবর্তীতে আলোচনা করব।

শক্তি বা ক্ষমতার মতবাদ

অন্য একটি মতবাদ পূর্ণ মানবের রূপ উপস্থাপন করে যা বুদ্ধিবৃত্তি বা ভালোবাসার উপর প্রতিষ্ঠিত নয়,বরং ক্ষমতা বা শক্তির উপর প্রতিষ্টিত। পূর্ণ মানব তাদের ভায়ায় ক্ষমতাবান মানুষ এবং পূর্ণতার অর্থ ক্ষমতা ছাড়া কিছু নয়।

প্রাচীনকালে গ্রীসে একদল ব্যক্তি ছিল যাদের সন্দেহবাদী বলা হয়। তারা এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে বলত যে,সত্য অর্থ ক্ষমতা। যার ক্ষমতা আছে সত্যও তার সঙ্গে। যেখানেই ক্ষমতা আছে সত্যও সেখানে। দুর্বলতা ও ক্ষমতাহীনতা অসত্যের সমান। তাদের ভাষায় ন্যায় ও অন্যায়ের কোন অর্থ নেই। তাই তাদের উৎস হতো শক্তিমত্তা ও ক্ষমতা। তাদের বিশ্বাস মানুষের উচিত তাদের সমগ্র চেষ্টাকে ক্ষমতা ও শক্তি অর্জনের জন্য ব্যয় করা। শক্তি ও ক্ষমতার কোন সীমারেখায় তারা বিশ্বাসী নয়।

দু শতাব্দী পূর্বে জার্মান দাশনিক নী চে বা নীটসে এ মতবাদের পুনর্জন্ম দান করেন। তার মতে সত্য ভালো , সততা ও আমানতদারী ভালো , মানবকল্যাণ ভালো এগুলো মূল্যহীন কথা। যে দুর্বলতার হাত ধর,সাহায্য কর এ কেমন কথা,বরং তাকে পারলে লাথি মেরে নীচে ফেলে দাও। দুর্বলতার চেয়ে বড় অন্যায় কিছু আছে নাকি? যেহেতু সে দুর্বল তাই তুমিও তার মাথায় পাথর ভাঙ্গ। নী চে যিনি নিজেও খোদা ও দীন বিরোধী তার মতে ধর্ম এ দুর্বলরাই সৃষ্টি করেছে। তার এ মত ঠিক কার্ল মার্কসের মতের বিপরীত যিনি মনে করেন ক্ষমতাবানরাই ধর্মের সৃষ্টি করেছে যাতে করে দুর্বলদের নিজেদের অধীনে রাখতে পারে।

নী চের মতে দুর্বলরা ধর্মের সৃষ্টি করেছে যাতে করে ক্ষমতাবানদের শক্তি ও ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করা যায়। তার মতে দান,অনুগ্রহ,মানবতা,কল্যাণ,ন্যায়,সততা,প্রেম এগুলো মানুষের মধ্যে প্রচার করে ধর্ম মানুষের প্রতি খিয়ানত করেছে। এ ভাবেই ক্ষমতাবানদের প্রতারিত করে তাদের ক্ষমতাকে সীমিত করে রেখেছে।

নী চে বলছেন,ধর্মসমূহ আহবান জানায় প্রবৃত্তির সঙ্গে সংগ্রামের জন্য। কেন আমরা প্রবৃত্তির সঙ্গে সংগ্রাম করতে যাব? ধর্ম বলে আত্মার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজেকে গড়া উচিত যাতে সাম্যের মনোভাব সৃষ্টি হয়। সাম্য কি? সাম্য এক অর্থহীন বস্তু। সব সময়ই উচিত এক দল ক্ষমতাবান থাকা এবং আরেকদল তাদের অনুগত থাকা। অনুগত দলকে তাদের জীবন ও শ্রম ব্যয় করে ক্ষমতাবানদের জন্য কাজ করা উচিত যাতে ক্ষমতাশীলরা উন্নতি করতে পারে,উন্নত শক্তির মানুষ তৈরি করতে পারে।

ধর্ম বলে,পুরুষ ও নারী মানবীয় বৈশিষ্ট্যে সাম্যের দাবিদার। তার মতে এটাও অর্থহীন। পুরুষ শক্তিশালী ও নারী থেকে শ্রেষ্ঠ। নারী পুরুষের জন্য সৃষ্ট,এ ছাড়া নারীর কোন মূল্য নেই। নারী-পুরুষের সাম্য এটা ভুল। এ মতবাদ প্রকৃতপক্ষে শ্রেষ্ঠ মানব ও পূর্ণ মানব বলতে ক্ষমতাবান মানুষ বোঝে এবং পূর্ণতা ক্ষমতা ও শক্তির সমান বলে মনে করে।