জীবনের শেষ মুহূর্তগুলোতে ইমাম আলী (আ.)
আলী (আ.)-এর জীবনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও আশ্চর্যজনক সময় তার জীবনের শেষ দু’
দিন। তার জীবনের কয়েকটি পর্যায় রয়েছে- তার জন্ম থেকে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ইন্তেকাল পর্যন্ত,রাসূলল্লাহর নবুওয়াত থেকে হিজরত পর্যন্ত,হিজরত থেকে রাসূলের ইন্তেকাল পর্যন্ত,রাসূলল্লাহর ইন্তেুকাল থেকে নিজের খেলাফত প্রাপ্তির পূর্বের ২৫ বছর এবং খেলাফত প্রাপ্তির পর সাড়ে চার বছর। এর বাইরেও তার জীবনের আরেকটি পর্যায় রয়েছে যা তিন দিনেরও কম সময়ের,কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর মুহূর্তগুলো এখানে দেখা যায়। সেটা হলো আলী (আ.) যখন তরবারীর আঘাতে শয্যাশায়ী হলেন তখন থেকে ওফাত পর্যন্ত। তিনি যে এক পূর্ণ মানুষ তা এখানেই প্রকাশিত হয়। তিনি যখন মৃত্যুর মুখোমুখি
তখন মৃত্যুর প্রতি তার প্রতিক্রিয়া কি? যখন তরবারী তার কপালে আঘাত হানলো তখন তিনি দু’
টিু বাক্য বলেছেন। একটি‘
এ ব্যক্তিকে ধর’
,অপরটিفزت و ربّ الکعبة
‘
কাবার প্রভুর শপথ! আমি সফলকাম হয়েছি- শাহাদাত আমার জন্য সফলতা’
।
আলী (আ.)-কে এনে বিছানায় শোয়ানো হলো। চিকিৎসক আসির ইবনে আমর যিনি কুফায় আঘাত বিষয়ক খ্যাতিমান বিশেষজ্ঞ ছিলেন তিনি আমীরুল মুমিনীনের চিকিৎসার জন্য আসলেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বুঝতে পারলেন,তরবারীতে বিষ মিশ্রিত ছিল এবং বিষ তার রক্তে প্রবেশ করেছে। তাই চিকিৎসায় লাভ হবে না এটা নিশ্চিত হয়ে নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করলেন। সাধারণত যে রোগীর আরোগ্যের সম্ভাবনা নেই তাকে এ কথা বলা হয় না। কিন্তু আসির জানতেন,আলী (আ.) অন্য দশজনের মতো নন। তাই তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,“
আমীরুল মুমিনীন,যদি কোন অসিয়ত থেকে থাকে তাহলে তা ঘোষণা করুন।”
হযরত উম্মে কুলসুম (আলীর কন্যা) এ কথা শুনে ইবনে মুলজিমকে উদ্দেশ্য করে বললেন,“
আমার পিতা তোর কি ক্ষতি করেছিল যে,তার প্রতি এ আচরণ করেছিস? আল্লাহ্ চাইলে আমার পিতা যদি সুস্থ হয়ে উঠেন,তোর চেহারা কলঙ্কিত করে দেবেন।”
যখন উম্মে কুলসুম এ কথা বললেন তখন ইবনে মুলজিম (আল্লাহর রহমত থেকে তাকে বঞ্চিত করুন) জবাব দিল,“
আমি তরবারীটা এক হাজার দিরহাম দিয়ে কিনেছি,আর এক হাজার দিরহামের বিষ ওটাতে মাখিয়েছি। যে পরিমাণ বিষ ওটাতে মাখিয়েছি যদি কুফার সকল মানুষের মাথায় আঘাত করি তাহলে তারা মৃত্যুবরণ করবে। তাই তোর বাবার বেঁচে থাকার কোন সম্ভাবনা নেই তা জেনে রাখ।”
আলী (আ.)-এর অলৌকিকত্ব এখানেই প্রকাশিত হয়। তিনি তার অসিয়তে বলেন,বন্দির প্রতি সঠিক আচরণ কর।,
یا بنی عبد المطلب لا الفینّکم تخوضون دماء المسلمین خوصا، تقولون قتل امیر المؤمنین ألا لا تقتلنّ بن الا قاتلی
“
আব্দুল মুত্তালিবের সন্তানেরা তোমরা এমন যেন না কর,যখন আমি পৃথিবী থেকে বিদায় নেব তখন মানুষের উপর হামলা কর এ অজুহাতে যে,আমীরুল মুমিনীনকে শহীদ করা হয়েছে। অমুকের এটার পেছনে হাত ছিল,অমুক এ কাজে উৎসাহিত করেছে। এ সকল কথা বলে বেড়াবে না,বরং আমার হত্যাকারী এ ব্যক্তি।”
ইমাম হাসান (আ.)-কে বললেন,“
বাবা হাসান! আমার মৃত্যুর পর এ বিষয়ের সম্পূর্ণ দায়িত্ব তোমার। যদি চাও আমার হত্যাকারীকে মুক্তি দেবে তাহলে মুক্তি দিও,যদি চাও কেসাস গ্রহণ করবে তাহলে লক্ষ্য রাখবে,সে তোমার পিতাকে একটি আঘাত করেছে,তাকেও একটি আঘাত করবে। যদি তাতে মৃত্যুবরণ করে তো করল,নতুবা ছেড়ে দেবে।”
(নাহজুল বালাগাহ্,পত্র নং ৪৭)
তারপর আবার বন্দির চিন্তায় মগ্ন। বন্দিকে ঠিক মতো খেতে দিয়েছ তো? পানি দিয়েছ খেতে? ঠিক মতো দেখাশোনা কর ওর। কিছু দুধ তার জন্য আনা হলে কিছুটা খেয়ে বললেন,বাকীটা বন্দিকে দাও। এটাই আলী (আ.)-এর আচরণ তার শত্রুর সাথে। এ জন্যই মাওলানা রুমী বলেছেন,
“
সাহসিকতায় তুমি শেরে খোদা জানি
পৌরুষত্বে কি তিনি,জানেন শুধুই অন্তর্যা মী।”
এখানেই আলীর পৌরুষত্ব ও মানসিকতার সর্বোচ্চ স্তরের প্রকাশ ঘটেছে। আলী মৃত্যু শয্যায় শায়িত,প্রতি মুহূর্তে তার অবস্থার অবনতি ঘটছে,বিষ তার পবিত্র শরীরে প্রতিক্রিয়া করছে। তার সঙ্গীরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত,সবাই ক্রন্দনরত,চারিদিকে ক্রন্দনের শব্দ,কিন্তু আলী (আ.)-এর মুখ
হাস্যোজ্জ্বল। তিনি বলছেন,
وَاللَّهِ ما فَجَاءَنِي مِنَ الْمَوْتِ وارِدٌ كَرِهْتُهُ، وَ لا طالِعٌ اءَنْكَرْتُهُ، وَ ما كُنْتُ إِلا كَقارِبٍ وَرَدَ، وَ طالِبٍ وَجَدَ
“
আল্লাহর শপথ! যা আমার নিকট এসেছে (মৃত্যু) এমন কিছু নয় যে,আমি তা অপছন্দ করি। আল্লাহর পথে শাহাদাত সব সময়ই আমার নিকট সর্বাধিক ঈর্ষান্বিত বস্তু ছিল,আমার জন্য শাহাদাত এমন বস্তু যেন কোন ব্যক্তি যার জন্য আকাঙ্ক্ষিত ছিল তা পেয়েছে। আমার জন্য এর চেয়ে উত্তম কি হতে পারে যে,ইবাদতরত অবস্থায় শহীদ হব?”
(নাহজুল বালাগাহ্,পত্র নং ২৩),
وَ ما كُنْتُ إِلا كَقارِبٍ وَرَدَ، وَ طالِبٍ وَجَدَ
অতঃপর এমন এক উদাহরণ এনেছেন যে উদাহরণের সঙ্গে আরবরা খুবই পরিচিত। আরবরা বেদুইনদের মতো যাযাবর জীবন যাপন করত। যতদিন কোন স্থানে পানি ও তাদের মেষ,উট ইত্যাদির জন্য ঘাস ও লতা জাতীয় উদ্ভিদ পেত ততদিন সেখানে থাকত; তারপর অন্য স্থানে পানি ও ঘাস পেলে সেখানে চলে যেত। যেহেতু মরুভূমিতে প্রচণ্ড গরম সেহেতু রাত্রিতে পানির সন্ধানে ঘুরে বেড়াত।قارب
পানির অনুসন্ধানকারী ব্যক্তিকে বলা হয়। আলী তার সহযোগীদের উদ্দেশ্য করে বলছেন,“
আমার সঙ্গীরা! গভীর রাতে পানির অনুসন্ধানকারী ব্যক্তি আকস্মিকভাবে পানির সন্ধান পেয়ে যেমন উল্লাসিত হয় আমিও তেমন শাহাদাতের সুযোগ পেয়ে আনন্দিত। আমার উদাহরণ সেই প্রেমিকের মত যে তার ভালবাসার বস্তুটি লাভ করেছে।”
“
রাত্রির শেষলগ্ন আমায় দিল দুঃখ থেকে মুক্তি
অর্ধরাত্রিতে যেন পেলাম আবে হায়াতের পরিতৃপ্তি।
কি পবিত্র এ রাত,আনন্দে আমার মন ভরে গিয়েছিল
শবে কদরে আমার ভাগ্যে যা লেখা হয়েছিল।”
এ কবিতার প্রথম দু’
লাইন-فزت و ربّ الکعبة
এর অর্থ । আলী (আ.)-এর সবচেয়ে উষ্ণ উক্তিগুলো যেন তার জীবনের শেষ দু’
দিনে উচ্চারিত হয়েছে। তিনি ১৯ রমযানের ফজরের ওয়াক্তের কিছু পরেইআঘাতপ্রাপ্ত হন এবং ২১ তারিখের রাত্রির দ্বিপ্রহরে স্রষ্টার নিকট তার পবিত্র আত্মার প্রত্যাবর্তন ঘটে।
শেষ মুহর্তগুলোতে সবাই তার চারপাশে সমবেত হয়েছে। বিষের প্রতিক্রিয়ায় তিনি বারবার বেহুশূ হয়ে পড়ছেন। কিন্তু যখনই জ্ঞান ফিরে পাচ্ছেন তখনই তার কণ্ঠে হেকমতপূর্ণ উপদেশ ও নসিহত উচ্চারিত হচ্ছে। তার শেষ উপদেশ যা অত্যন্ত উষ্ণতাপূর্ণ ও গুরুত্ববহুল তা তিনি বিশটি বাক্যে বর্ণনা করেছেন। প্রথমে ইমাম হাসান (আ.),এরপর ইমাম হুসাইন (আ.),তারপর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের লক্ষ্য করে বলেছেন। ইমাম হাসান,ইমাম হুসাইন (আ.),আলী (আ.)-এর অন্যান্য সন্তানসহ আমরা সকলেই,এমনকি কিয়ামত পর্যন্ত যারা আসবে আলী তাদের উদ্দেশ্যে এ বক্তব্য দিয়েছেন। এ বাক্যগুলোতে ইসলামকে যেন পূর্ণভাবে বর্ণনা করেছেন- সামগ্রিকভাবে উপস্থাপনকরেছেন।
اَللَّهَ اللَّهَ فِي الأَيْتَامِ ، وَ اللَّهَ اللَّهَ فِي الْقُرْآنِ، وَ اللَّهَ اللَّهَ في جيرَانِكُمْ، وَ اللَّهَ اللَّهَ فِي بَيْتِ رَبِّكُمْ، وَ اللَّهَ اللَّهَ فِي الصَّلاَةِ، وَ اللَّهَ اللَّهَ فِي الزَّكَاةِ
(বিহারুল আনওয়ার,৯ম খণ্ড,পৃ. ৭৪৬ ও নাহজুল বালাগাহ্,পত্র নং ৪৭)
তিনি একে একে সব বর্ণনা করছেন।“
আল্লাহ্,আল্লাহ্,ইয়াতীমদের ব্যাপারে সতর্ক থেক; আল্লাহ্,আল্লাহ্,কোরআনকে আঁকড়ে ধর; আল্লাহ্,আল্লাহ্,প্রতিবেশীদের ব্যাপারে দায়িত্বের কথা মনে রেখ;নামায,রোযা,হজ্ব,যাকাত...।”
সবাই আলী (আ.)-এর মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। হঠাৎ লক্ষ্য করলেন আলীর চেহারা পরিবর্তিত হয়ে গেছে,তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। সবাই কান পেতে আছে তিনি আর কি বলেন। সবাই দেখছেন আলী (আ.) উচ্চৈঃস্বরে পড়ছেন,“
আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লালাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহ্।”
و لا حول و لا قوة إلا بالله العلی العظیم