শিয়া প্রবণতা ও ইসলাম

শিয়া প্রবণতা ও ইসলাম33%

শিয়া প্রবণতা ও ইসলাম লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: আমার দেশ বাংলাদেশ সোসাইটি
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

  • শুরু
  • পূর্বের
  • 18 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 13874 / ডাউনলোড: 5690
সাইজ সাইজ সাইজ
শিয়া প্রবণতা ও ইসলাম

শিয়া প্রবণতা ও ইসলাম

লেখক:
প্রকাশক: আমার দেশ বাংলাদেশ সোসাইটি
বাংলা

(আর এখানে তিনটি আলোচনা রয়েছে)

একদম শুরু থেকেই যে দুই প্রধান দৃষ্টিভঙ্গি মহানবীর জীবদ্দশায় ইসলামী উম্মাহর বিকাশ লাভের পাশাপাশি বিকাশ লাভ করেছিল তা হলঃ

প্রথমতঃ ধর্মীয় কৃচ্ছসাধনায় নিবিষ্টতা,ধর্মীয় দৃঢ়তা এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধানের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য ও আত্মসমর্পণে বিশ্বাসী দৃষ্টিভঙ্গি ।

দ্বিতীয়তঃ ঐ দৃষ্টিভঙ্গি,যা বিশ্বাস করে যে,ধর্মে বিশ্বাস কেবলমাত্র ইবাদত ও অদৃশ্য জগতের বিশেষ কোন ক্ষেত্রে ভক্তি,আনুগত্য ও নিবিষ্টতার মাঝেই সীমাবদ্ধ এবং প্রাগুক্ত ক্ষেত্র ব্যতীত জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে কল্যাণ,স্বার্থ ও সুবিধানুসারে ধর্মীয় বিধি-বিধানের পরিবর্তন ও ভারসাম্যপূর্ণ করণের ভিত্তিতে ইজতিহাদ এবং যথেচ্ছা হস্তক্ষেপ করা বৈধ ও সম্ভব ।

সাহাবাগণ মুসলিম উম্মাহর বিশ্বাসী ও গৌরবোজ্জ্বল অগ্রগামী প্রজন্ম হিসেবে মুসলিম উম্মাহর বিকাশের সর্বোত্তম উৎস হওয়া সত্ত্বেও এমনকি মানব ইতিহাসে মহানবীর নিজ হাতে গড়া প্রজন্মের চেয়ে অধিকতর উত্তম,সম্ভ্রান্ত এবং পবিত্র কোন আদর্শিক প্রজন্ম না দেখা গেলেও আমরা মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশায়ই এমন এক ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রবণতার অস্তিত্ব মেনে নেয়ার আবশ্যিকতা প্রত্যক্ষ করি যা কল্যাণকামিতা ও সুবিধার আলোকে পুঙ্খানুপঙ্খরূপে ধর্মীয় বিধি-বিধান পালন করার চাইতে ইজতিহাদ এবং পরিবেশ পরিস্থিতি থেকে ফায়দা বা সুবিধা ভোগ করার বিষয়টিকে অত্যধিক প্রাধান্য দিতে ইচ্ছুক । আর এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রবণতার কারণেই মহানবী (সা.)-কে অনেক ক্ষেত্রে এমনকি তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্তে  মৃত্যুশয্যায় শায়িত হয়েও তিক্ততা সহ্য করতে হয়েছে । সামনে এতদসংক্রান্ত আরো বর্ণনা ও বিবরণ আসবে । তবে আরেকটি দৃষ্টিভঙ্গি বা প্রবণতা ছিল যা ধর্মীয় দৃঢ়তা,ধর্মের প্রতি চূড়ান্ত আত্মসমর্পণবোধ এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধি-বিধানের নিরঙ্কুশ ও নিঃশর্ত আনুগত্যে বিশ্বাসী ।

মুসলমানদের মাঝে ইজতিহাদী দৃষ্টিভঙ্গি বা প্রবণতার প্রসার লাভের অন্যতম একটি কারণ হয়তো এটাও হতে পারে যে,এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি,যে স্বার্থ-সুবিধা বা কল্যাণ মানুষ উপলব্ধি ও পরিমাপ করতে সক্ষম তদনুসারে যথেচ্ছা ভোগ করার প্রবণতার সাথে পূর্ণ সংগতিসম্পন্ন। পক্ষান্তরে যে বিধানের মর্মার্থ বা সারবত্বা সে উপলব্ধি করতে অক্ষম তা পালন করা তার স্বভাব ও প্রবৃত্তির পরিপন্থী । আর বড় বড় সাহাবার মাঝে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাবের মত কঠিন হৃদয়ের অধিকারী ব্যক্তিত্ব ছিলেন যাঁরা এ দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তা ও প্রতিনিধিত্বকারী । হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব মহানবীর সাথে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হয়েছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট শরয়ী দলীল-প্রমাণের বিপক্ষে ইজতিহাদও করেছেন । যে পর্যন্ত তিনি (হযরত উমর) প্রত্যক্ষ করতেন যে,ফায়দা বা কল্যাণকামিতার ক্ষেত্রে তিনি তাঁর ইজতিহাদে ভুল করেননি (অর্থাৎ তাঁর ইজতিহাদ ফায়দা বা কল্যাণ পরিপন্থী নয়) সে পর্যন্ত তিনি এমনকি নাস বা স্পষ্ট শরয়ী দলীল-প্রমাণের বিপক্ষেও ইজতিহাদ করার বৈধতায় বিশ্বাস করতেন । আর এতদপ্রসঙ্গে হুদাইবিয়ার সন্ধির ব্যাপারে তাঁর আচরণ ও নীতি অবস্থান৫০ এবং এ সন্ধির বিপক্ষে তাঁর যুক্তি প্রদানের বিষয়টি আমরা বিবেচনা করে দেখতে পারি । একইভাবে আযানের ক্ষেত্রে তাঁর গৃহীত পদক্ষেপ ও আযান থেকেحی علی خیر العمل বাদ দেয়া এবং যখন মহানবী (সা.) মুত আতুল হজ্ব৫১ বা হজ্বে তামাত্তুর বিধান দেন তখন মহানবীর এ বিধানের ব্যাপারে নীতি অবস্থান ইত্যাদি সব কিছুই ছিল নাস বা স্পষ্ট শরয়ী দলীল- প্রমাণের মোকাবেলায় তাঁর গৃহীত ইজতিহাদী পদক্ষেপ ।৫২

আর এ দৃষ্টিভঙ্গিদ্বয় মহানবী (সা.)-এর জীবনের শেষভাগে কোন এক দিনে তাঁরই সামনে প্রকাশিত হয়ে গিয়েছিল । হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস থেকে সহীহ আল বুখারীতে বর্ণিত আছে যে,তিনি বলেছেন, মহানবীর ওফাত তথা মৃত্যু নিকটবর্তী হলে একদিন ঘরে অনেক লোক উপস্থিত ছিল।আর তাদের মধ্যে উমর ইবনুল খাত্তাবও ছিলেন,তখন মহানবী (সা.) বললেন, এসো আমি তোমাদের জন্য এমন কিছু লিখে দিব যার পর তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না । তখন হযরত উমর বলে উঠলেন, মহানবীর উপর রোগযন্ত্রণা তীব্র আকার ধারণ করেছে । আর তোমাদের কাছে তো কোরানই রয়েছে । আমাদের জন্য আল্লাহর কিতাব তথা কোরানই যথেষ্ট । হযরত উমরের এ কথায় ঘরে উপস্থিত লোকদের মধ্যে মত-পার্থক্যের সৃষ্টি হল । তারা ঝগড়া করতে লাগল । তাদের মধ্যে কোন কোন ব্যক্তি বলল, তোমরা তাঁর নিকটবর্তী হও । নবী (সা.) তোমাদের জন্য এমন কিছু লিখে দিয়ে যাবেন যার পর তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না । আবার কেউ কেউ হযরত উমর যা বলেছিলেন তাই বলল । এর ফলে মহানবীর সান্নিধ্যে বাক-বিতন্ডা,অযথা কথা-বার্তা,হট্টগোল,ঝগড়া-বিবাদ এবং মতপার্থক্য চরম আকার ধারণ করলে মহানবী (সা.) তীব্র অসন্তুষ্ট হয়ে তাদেরকে বললেন, আমার কাছ থেকে তোমরা সবাই বের হয়ে যাও। ৫৩ প্রাগুক্ত ঘটনাটি ঐ দৃষ্টিভঙ্গিদ্বয়ের ব্যাপকতা এবং এতদুভয়ের অন্তর্নিহিত অন্তর্দ্বন্দ্ব ও পার্থক্যের মাত্রা নিরূপণ ও প্রমাণ করার জন্য একাই যথেষ্ট ।

এ ইজতিহাদী দৃষ্টিভঙ্গি যে কতটা গভীরতা ও ব্যাপকতা লাভ করেছিল তার একটি চিত্র তুলে ধরার জন্য উসামা বিন যায়েদকে সেনাপতি নিযুক্ত করার ব্যাপারে সাহাবাদের মধ্যে যে তর্ক-বিতর্ক,ক্ষোভ ও মতপার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছিল তা উপরোক্ত ঘটনার সাথে যোগ করতে পারি । এক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর স্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও এ ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল । যার ফলে মহানবী (সা.) অসুস্থাবস্থায় ঘর থেকে বের হয়ে জনসমক্ষে ভাষণ দান করেছিলেন এবং বলেছিলেন, হে লোক সকল উসামাকে সমরাধিনায়ক নিযুক্ত করার ব্যাপারে তোমাদের কারো কারো কথা (আপত্তি,ক্ষোভ,অসন্তোষ) আমার কাছে পৌঁছেছে । আর উসামাকে আমি সেনাপতি নিযুক্ত করেছি সে ব্যাপারে তোমরা যদি কটাক্ষ ও তিরষ্কার করতে থাক তাহলে তো তোমরা এর আগেও তার পিতাকে সমরাধিনায়ক নিযুক্ত করার ব্যাপারেও আমাকে কটাক্ষ ও নিন্দা করেছিলে। আল্লাহর শপথ,নিশ্চয়ই যায়েদ সেনাপতি হওয়ার যোগ্য এবং তার পুত্র উসামাও তারপর আমীর বা সেনাপতি হওয়ার যোগ্য । ৫৪

মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশায় এ দৃষ্টিভঙ্গিদ্বয়ের মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্ব ও পার্থক্য তাঁর (সা.) তিরোধানের পরও ইসলাম প্রচার কার্যক্রমের নেতৃত্ব সংক্রান্ত মুসলমানদের গৃহীত পদক্ষেপসমূহেও ব্যাপকাকারে প্রতিফলিত হয়েছে । তাই যারা ধর্মীয় বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে নিঃশর্ত অনুসরণ (تعبد ) সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তা ও প্রতিনিধিত্বকারী তারা কোন ধরনের সিদ্ধান্তহীনতা এবং ভারসাম্যকরণ প্রক্রিয়া ছাড়াই মহানবীর হাদীসে এ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করার যথাযথ কারণও খুজে পেয়েছেন

তবে ইজতিহাদী দৃষ্টিভঙ্গির দৃষ্টিতে তখনই মহানবী (সা.) কর্তৃক প্রদত্ত পদ্ধতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া এর পক্ষে সম্ভব যখন এ দৃষ্টিভঙ্গির ধারণা মতে ইজতিহাদী প্রক্রিয়া এমন এক পদ্ধতি পেশ করবে যা উদ্ভূত পরিস্থিতির সাথে মহানবীর প্রদত্ত পদ্ধতি অপেক্ষাও অধিকতর সংগতিসম্পন্ন হবে ।

আর এভাবে আমরা দেখতে পাই যে,মহানবীর ওফাত বা তিরোধানের সময় থেকেই শিয়া মাযহাবের প্রত্যক্ষ উৎপত্তি হয়েছে । তখন ঐ সকল মুসলমানই শিয়া বলে পরিচিত হয়েছে যারা কার্যতঃ ইসলামের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের তত্ত্ব মেনে নিয়েছিল । আর এ তত্ত্বটিকে মহানবী (সা.) স্বয়ং তাঁর ওফাতের পরপরই সরাসরি বাস্তবায়িত করার প্রক্রিয়া শুরু করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন । আর শিয়া দৃষ্টিভঙ্গি,ইমাম আলীর নেতৃত্ব ও ইমামত সংক্রান্ত তত্ত্বটি নিষ্ক্রিয় ও বানচাল করে শাসন-কর্তৃত্ব অন্য ব্যক্তির হাতে অর্পণ করার ব্যাপারে সকীফা বনী সায়েদার চত্বরে যে উদ্যোগ গৃহীত হয়েছিল তা প্রত্যাখ্যান করার মাধ্যমে বাস্তবরূপ পরিগ্রহ করে । আব্বান বিন তাগলীব থেকে আল্লামা তাবারসী ইহতিজাজ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন,আব্বান বলেছেন, আমি ইমাম জাফর বিন মুহাম্মদ আস-সাদেক (আ.)-কে বললাম, আপনার জন্য আমার প্রাণ কোরবান (উৎসর্গ) হোক । মহানবীর সাহাবাদের মধ্যে কি এমন কোন ব্যক্তি ছিলেন যিনি হযরত আবু বকরের শাসন কর্তৃত্বকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন? তিনি (আ.) বললেন, যারা হযরত আবু বকরকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তারা ছিলেন সংখ্যায় ১২ জন । মুহাজিরদের মধ্য থেকে খালিদ বিন সাঈদ বিন আবিল আস,সালমান আল-ফারেসী,আবুযার গিফারী,মিকদাদ বিন আসওয়াদ,আম্মার বিন ইয়াসির,বুরাইদাহ আল-আসলামী এবং আনসারদের মধ্যে আবুল হাইসান ইবনে আত্-তিহান,উসমান ইবনে হুনাইফ,খুযাইমাহ বিন সাবিত যুশ-শাহাদাতাইন,উবাই বিন কাব এবং আবু আইয়ুব আল-আনসারী । (দ্র: আল্লামা আত্-তাবারসী প্রণীত আল-ইহতিজাজ ১ম খণ্ড,পৃ: ৭৫ ও ১৮৬,মুআস্সাসাহ আল-আ লামী,বৈরুত কর্তৃক মুদ্রিত/১৯৮৩;তারীখুল ইয়াকুবী,২য় খণ্ড পৃ: ১০৩)

কেউ কেউ হয়তো বলতে পারে যে,শিয়া দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে নিছক একনিষ্ঠা সহকারে শরয়ী দলীল-প্রমাণ অনুসরণ করার বাস্তব নমুনা । আর এ শিয়া দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে রয়েছে অন্য দৃষ্টিভঙ্গি যা ইজতিহাদের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে । আর এর অর্থ এটাই দাঁড়ায় যে,শিয়া মাযহাব ইজতিহাদ প্রত্যাখ্যানকারী এবং শিয়া মতাবলম্বীগণ ইজতিহাদ করার অনুমতি দেয় না । অথচ আমরা দেখতে পাই যে,এরাই (শিয়া মতাবলম্বীগণ) আবার শরীয়তের খুঁটি-নাটি বিষয়ে সর্বদা ইজতিহাদের চর্চা অব্যাহত রেখেছে !!!

উত্তর : যে ইজতিহাদের চর্চা শিয়ারা করে এবং যা শিয়াদের দৃষ্টিতে শুধু জায়েযই নয় বরং ওয়াজিবে কেফায়াহ তা হল শরয়ী দলীল থেকে শরয়ী বিধি-বিধান (হুকুম-আহকাম) প্রণয়ন করা। আর তা মুজতাহিদের ব্যক্তিগত অভিমত ও অভিরুচি অনুসারে শরয়ী দলীল অথবা মুজতাহিদের কল্পিত (অনুমিত) কোন ফায়দা বা কল্যাণকামিতার পরিপ্রেক্ষিতে ইজতিহাদ নয় । কারণ এ ধরনের ইজতিহাদ অবৈধ । আর শিয়া দৃষ্টিভঙ্গি এতদ অর্থে ইজতিহাদের যে কোন ধরনের চর্চাকে প্রত্যাখ্যান করে ।

ইসলামের একদম প্রাথমিক যুগ থেকেই দৃষ্টিভঙ্গিদ্বয়ের উদ্ভব নিয়ে আলোচনা করলে আমরা দেখতে পাব যে,উক্ত দৃষ্টিভঙ্গিদ্বয়ের একটি হচ্ছে শরয়ী দলীল অনুসরণের ক্ষেত্রে নিষ্ঠা ও নিবিষ্টতা সম্বলিত দৃষ্টিভঙ্গি এবং অপরটি হচ্ছে ইজতিহাদের দৃষ্টিভঙ্গি । আর এ ক্ষেত্রে ইজতিহাদের অর্থ হচ্ছে শরয়ী দলীল গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করার ইজতিহাদ ।

যে কোন ব্যাপক সংস্কারপন্থী রিসালত বা মিশন যা একদম গোঁড়া থেকেই সকল দূনীতি,বিশৃঙ্খলা এবং অন্যায়ের আমূল সংস্কার সাধনের প্রচেষ্টা চালায় তার ছত্রছায়ায় উক্ত দৃষ্টিভঙ্গিদ্বয়ের উদ্ভব একান্ত স্বাভাবিক ঘটনা । কেননা এ ধরনের মিশন পূর্ব হতে থেকে যাওয়া জাহেলী ধ্যান-ধারণাসমূহ,নতুন রিসালত বা মিশনের প্রতি প্রতিটি ব্যক্তির একাত্মতার মাত্রা এবং তার ভক্তি ও ভালবাসার পর্যায়ানুসারে বিভিন্ন হারে বা মাত্রায় প্রভাবিত হয়ে থাকে । আর এভাবে আমরা জানতে পারি যে,শরয়ী দলীল অনুসরণ করার ক্ষেত্রে একনিষ্ঠতা ও নিবিষ্টতা প্রদর্শনকারী দৃষ্টিভঙ্গিই আসলে রিসালত বা মিশনের সাথে চূড়ান্ত পর্যায়ের একাত্মতা,পূর্ণ আত্মসমর্পণ ও উৎসর্গের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে । এ দৃষ্টিভঙ্গি শরয়ী দলীলের সীমারেখার মধ্যে ইজতিহাদ এবং তা থেকে শরয়ী বিধি-বিধান প্রণয়ণ করার চেষ্টা-প্রচেষ্টাকে কখনোই অস্বীকার বা প্রত্যাখ্যান করে না । এ প্রসঙ্গে আরো একটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত দেয়া জরুরী । আর তা হচ্ছে যে,শরয়ী দলীল অনুসরণ করার ক্ষেত্রে নিবিষ্টতার অর্থ কখনোই নিষ্ক্রিয়তা, স্থবিরতা (বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতার অবসান) এবং বুদ্ধিহীনতা নয় যা মানব জীবনের বিবর্তন, বিকাশ,উন্নতি এবং সংস্কার প্রক্রিয়ার বিভিন্ন কার্যকারণ ও সমুদয় প্রয়োজনীয় উপাদানের পরিপন্থী । কেননা শরয়ী দলীল অনুসরণ করার ক্ষেত্রে নিবিষ্টতা বা তা আব্বুদের অর্থই হচ্ছে ধর্ম অনুসরণ করার ক্ষেত্রে একনিষ্ঠতা ও নিবিষ্টতা এবং আংশিকভাবে নয় বরং পূর্ণরূপে দ্বীন বা ধর্মকে আঁকড়ে ধরা । আর এ দ্বীন বা ধর্মের ভিতরেই আছে নমনীয়তার যাবতীয় প্রয়োজনীয় মৌল ও উপাদান,যুগের সাথে চলার শক্তি এবং সবধরনের সংস্কার ও বিবর্তনের যাবতীয় প্রয়োজনীয় মৌল ও উপাদান ধারণ করার ক্ষমতা (সামর্থ) । তাই ধর্ম ও শরয়ী দলীল অনুসরণ করার ক্ষেত্রে একনিষ্ঠতা ও নিবিষ্টতার অর্থই হচ্ছে ঐ সকল মৌল বা উপাদানের মধ্যে যা কিছুরই সৃজনশীলতা,উদ্ভাবনী শক্তি এবং সংস্কারকামিতা রয়েছে সেগুলোর ক্ষেত্রে একনিষ্ঠতা ও নিবিষ্টতা । (দ্র: আল-মাআলিমুল জাদীদাহ লিল উসূল পৃ: ৪৮০) । এ সব কিছুই হচ্ছে ইসলাম প্রচার কার্যক্রমের অবকাঠামোর মধ্যে একান্ত স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে তাশাইয়ু শব্দের ব্যাখ্যা সম্বলিত কিছু সর্বসাধারণ লেখ বা চিত্র ।

১-শূরা পদ্ধতির জন্য উম্মতের প্রস্তুতি ছিলনা : মহানবী (সা.) ইসলাম প্রচার কার্যের ভবিষ্যৎ চিন্তা-ভাবনা করেই তাঁর ওফাতের পরে শূরা বা পরামর্শ ব্যবস্থা থেকে সরাসরি উৎসারিত নেতৃত্ব-ধারার সাথে ইসলাম প্রচার কার্যক্রমের নেতৃত্ব-ধারাকে জড়িত করার লক্ষ্যে বাস্তবে যদি কোন ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েই থাকতেন তাহলে এ ইতিবাচক পদক্ষেপের জন্য যে সব বিষয় অপরিহার্য ও অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তন্মধ্যে সবচেয়ে সুস্পষ্ট বিষয়টি নিঃসন্দেহে এই হত যে,তিনি (সা.) পরামর্শ ব্যবস্থা এবং এর সার্বিক আইনগত পরিসীমা ও দিক সম্পর্কে সমগ্র উম্মাহ্ এবং প্রচারকদেরকে অবশ্যই অবহিত করতেন এবং এ ব্যবস্থাটি মেনে নেয়ার জন্য মুসলিম উম্মাহকে মানসিক ও চিন্তাগতভাবে প্রস্তুতও করতেন । এখানে উল্লেখ্য যে, তৎকালীন মুসলিম সমাজটি ছিল কতিপয় গোত্রের সমষ্টি । আর এ সব গোত্র ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে পারস্পরিক পরামর্শ বা শূরাভিত্তিক কোন রাজনৈতিক পরিবেশ ও প্রক্রিয়ায় বসবাস করতে একদম অভ্যস্ত ছিল না, শুধু তাই নয় বরং তারা গোত্রপতিদের কঠোর নিয়ন্ত্রিত অবস্থার মধ্যেই জীবন যাপন করত; সেখানে পেশীবল,ধনবল এবং বংশগৌরবই বহুলাংশে প্রাধান্য লাভ করত। (দ্রঃ- ডঃ আব্দুল আযীয আদ্-দাওরী প্রণীত আন্ নুযমু আল ইসলামিয়াহ্ পৃঃ ৭,নাজীব প্রেস,বাগদাদ ১৯৫০ সালে মুদ্রিত,ডঃ সুবহী আস্-সালেহ্ প্রণীত আন্ নুযম আল ইসলামিয়াহ্ পৃঃ ৫০,দারুল ইল্ম লিল্ মালাঈন কর্তৃক ১৯৫০ সালে মুদ্রিত)

অতএব,আমরা বেশ সহজেই বুঝতে পারছি যে,মহানবী (সা.) শূরা বা পরামর্শ ব্যবস্থার সমুদয় আইনগত ব্যাখ্যা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ধারণার সাথে মুসলিম উম্মাহকে পরিচিত করার কোন উদ্যোগই গ্রহণ করেননি । অথচ এ ধরণের পদক্ষেপ যদি বাস্তবে নেয়া হত তাহলে তা স্বভাবতঃই মহানবী (সা.)-এর মুখনিঃসৃত বাণী বা হাদীসসমূহে বর্ণিত হত এবং মুসলিম উম্মাহর চিন্তার-চেতনায় অথবা অন্ততঃপক্ষে শূরা বা পরামর্শ ব্যবস্থা প্রবর্তন ও বাস্তবায়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে মুসলিম উম্মাহর প্রথম প্রজন্ম অর্থাৎ মুহাজির ও আনসারদের চিন্তা-চেতনা ও মানসিকতায় অবশ্যই প্রতিফলিত হত । আর এটাই ছিল স্বাভাবিক । কিন্তু আমরা মহানবী (সা.)-এর হাদীসসমূহে শূরা বা পরামর্শ ব্যবস্থার কোন আইনগত সুস্পষ্ট চিত্রই খুজে পাই না ।

এরপর আমরা উম্মাহর মানসিকতায় অথবা উম্মাহর প্রথম প্রজন্মের ধ্যান-ধারণায়ও এ ধরনের পরিচিতিকরণ প্রক্রিয়ার কোন ইঙ্গিত অথবা সুস্পষ্ট প্রতিফলন প্রত্যক্ষ করি না । অথচ এ প্রজন্মটির মাঝে দু ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাবধারা বিদ্যমান ছিল । যার একটির নেতৃত্বে ছিলেন মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইত (আ.) আর অন্যটির পুরোধায় ছিল সকীফার ঘটনা এবং খেলাফতের সমর্থক । আর খেলাফত ও সকীফার ঘটনার উৎপত্তি হয়েছিল কার্যতঃ মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পরেই ।

তবে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট যে,প্রথম ভাবধারাটি অসিয়ত ও ইমামতে বিশ্বাস এবং মহানবী (সা.)-এর কুরাবাহ বা আত্মীয়তার উপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করত । আর শূরা বা পরামর্শ ব্যবস্থা সংক্রান্ত কোন বিশ্বাসই এর মাঝে পরিলক্ষিত হত না ।

দ্বিতীয় ভাবধারাটির উৎপত্তি,বিকাশ এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিদ্যমান নিদর্শন ও দলীল-প্রমাণাদি থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রতীয়মান হয় যে,এ ভাবধারাটিও শূরা বা পরামর্শ ব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিল না এবং উক্ত পরামর্শ ব্যবস্থার ভিত্তিতে বাস্তবে এর কোন কর্মতৎপরতাই ছিল না । আর ঠিক এই একই জিনিস আমরা মহানবী (সা.) এর ওফাতকালীন সময়ের মুহাজির ও আনসার প্রজন্মের সবার মধ্যেই প্রত্যক্ষ করি ।

আর তখনই বিষয়টির গুরুত্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায় যখন আমরা প্রত্যক্ষ করি যে,হযরত আবু বকরের অসুস্থতা তীব্র আকার ধারণ করলে তিনি হযরত উমরকে তাঁর মৃত্যুর পরে খলীফা মনোনীত করলেন এবং হযরত উসমানকে তা লিখারও নির্দেশ দিলেন। আর হযরত উসমান অসিয়তে লিখেছিলেন, পরম করুণাময় আল্লাহর নামে । আর এটা হচ্ছে মুমিন ও মুসলমানদের প্রতি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর খলীফা আবু বকরের প্রতিজ্ঞা পত্র । তোমাদের উপর সালাম । আমি তোমাদের সমীপে মহান আল্লাহর প্রশংসা করছি । আমি তোমাদের জন্য উমর ইবনুল খাত্তাবকে খলীফা মনোনীত করলাম। তোমরা তাঁর কথা শুনবে এবং তাঁর আনুগত্য করবে । (দ্রঃ- ইবনে মানযূর প্রণীত মুখতাসার তারীখে দিমাশ্ক ১৮তম খণ্ড,পৃঃ ৩১০,তারীখুত তাবারী ২য় খণ্ড পৃঃ ২৫২)

আব্দুর রহমান ইবনে আওফ হযরত আবু বকরের কাছে এসে বললেন, হে মহান রসুলের খলীফা! আপনি কেমন আছেন? হযরত আবু বকর বললেন, আমি আমার মৃত্যুর পর খলীফা নিযুক্ত করেছি যখন তোমরা দেখতে পেলে যে, তোমাদের মধ্য থেকে একজনকে আমি খলীফা মনোনীত করেছি আর তখনই তোমরা আমার যা হয়েছে তা আরো বাড়িয়ে দিলে তোমাদের সবারই নাসিকা ফুলে মোটা হয়ে গেছে কেননা তোমরা সবাই তোমাদের নিজেদের জন্য খেলাফত প্রত্যাশা করছ

(দ্রঃ- তারীখুল ইয়া কুবী ২য় খণ্ড পৃঃ ১২৬, তারীখ ইবনে আসাকির ১৮তম খণ্ড পৃঃ ৩১০, তারীখুত তাবারী ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ৫২)

এ ধরনের উত্তরাধিকারী মনোনয়ন এবং এতদসংক্রাস্ত বিরোধিতার প্রকাশ্য নিন্দাবাদ থেকে প্রতীয়মান হয় যে,খলীফা শূরা ব্যবস্থার যৌক্তিকতা সম্পর্কে মোটেও চিন্তা-ভাবনা করতেন না  । আর তিনি মনে করতেন যে,খলীফা মনোনীত করাটা তাঁর অধিকার । আর এ ধরনের নিযুক্তি ও মনোনয়নের কারণে নতুন খলীফার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা মুসলমানদের উপর ফরয হয়ে যায় । তাই খলীফা আবু বকর তাদেরকে নতুন খলীফার কথা শুনতে ও তাঁর আনুগত্য করতে আদেশ দিয়েছিলেন । সুতরাং খলীফার এ উক্তি কেবলমাত্র সাদামাটা প্রস্তাব বা নিছক স্মরণ করিয়ে দেয়ার ঘটনাই ছিল না;বরং তা ছিল নিযুক্তি,বাধ্যবাধকতা এবং আদেশ । আমরা আরো লক্ষ্য করি যে,খলীফা উমর মনে করতেন মুসলমানদের জন্য নতুন খলীফা মনোনীত করা তাঁর দায়িত্ব ও অধিকার । তাই তিনি খলীফা নির্বাচিত করার ব্যাপারে অন্য সকল মুসলমানের প্রকৃত ভূমিকা অস্বীকার করে কেবলমাত্র ছয় জনের মাঝেই খলীফা নির্বাচনের বিষয়টি স্থির করেছিলেন । আর এর অর্থ দাঁড়ায় যে,ঠিক যেমনভাবে খলীফা মনোনীত করার ব্যাপারে প্রথম খলীফার অনুসৃত প্রক্রিয়ায় শূরা বা পরামর্শ ব্যবস্থার কোন প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয়নি ঠিক তেমনি এ ব্যবস্থার কোন যৌক্তিকতাও উত্তরাধিকারী বা খলীফা নির্বাচন করার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় খলীফার অনুসৃত পদ্ধতিতে আদৌ প্রতিফলিত হয়নি ।

জনগণ হযরত উমরের কাছে তাঁর পরবর্তী উত্তরাধিকারী বা খলীফা মনোনীত করার ব্যাপারে অনুরোধ করলে তিনি বলেছিলেন, যদি আমি দু জনের একজনকে জীবিত পেতাম তাহলে এ বিষয়টি (ফতঅর্থাৎ খেলা)  তার জন্য স্থির করে দিতাম এবং এক্ষেত্রে তার উপর আস্থা স্থাপন করতাম । দু জনের একজন আবু হুযাইফার দাস সালেম এবং অন্যজন আবু উবায়দা বিন জাররাহ্ । আর যদি সালেম জীবিত থাকত তাহলে খেলাফতের ব্যাপারে শূরা বা পরামর্শ পরিষদ নিযুক্ত করতাম না । ১৪

হযরত আবু বকর মৃত্যূ শয্যায় শায়িতাবস্থায় আব্দুর রহমান ইবনে আওফকে বলেছিলেন, আমি মহানবী (সা.)-কে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম যে,(মহানবীর পরে) কে খলীফা হবে অর্থাৎ খেলাফত কার হবে? যার ফলে এ বিষয়ে আর কোন দ্বন্দ্ব-সংঘাত থাকবে না ।১৫ ..তবে আনসারগণ যখন সকীফায় সা দ বিন উবাদাকে খলীফা বা আমীর নিযুক্ত করার জন্য মিলিত হয়েছিল তখন তাদের মধ্য থেকে একজন বলেছিল : কোরাইশ বংশীয় মুহাজিরগণ যদি তা মেনে না নিয়ে বলে যে : আমরাই মুহাজির এবং আমরাই মহানবীর জ্ঞাতি-গোত্র এবং তাঁর উত্তরাধিকারী আর এরপরও যদি তাদের মধ্য থেকে কোন দল এ কথা বলে যে : আমাদের মধ্য থেকে একজন নেতা ও তোমাদের মধ্য থেকে একজন নেতা হবে তবুও আমরা এ ব্যাপারে তাদের (কোরাইশদের) প্রস্তাবটি কখনোই মেনে নিব না । ১৬

হযরত আবু বকর তখন বক্তৃতায় বলেছিলেন, আমরা (মুহাজির) সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছি আর এক্ষেত্রে সকল জনগণ আমাদের পিছনে (অর্থাৎ তারা আমাদের পরে ইসলাম গ্রহণ করেছে) । আমরা মহানবীর জ্ঞাতি-গোত্র এবং আরবদের মধ্যে আমরাই সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত । ১৭

আর যখন আনসারগণ তাদের ও মুহাজিরদের মধ্যে খেলাফত পর্যায়ক্রমিক হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল তখন হযরত আবু বকর তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, মহানবী (সা.) যখন নবুওয়াত প্রাপ্ত হলেন তখন পিতৃধর্ম ত্যাগ করা আরবদের জন্য খুবই কষ্টকর হয়েছিল । তাই তারা তাঁর (সা.) বিরুদ্ধাচারণ করেছিল এবং তাঁকে কষ্ট দিয়েছিল । মহান আল্লাহ তাঁর গোত্রের মধ্য থেকে প্রথম দিককার মুহাজিরগণকে মহানবী (সা.)-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন এরং তাঁকে মেনে নেয়ার বিশেষ তৌফিক দিয়েছিলেন । আর তারাই প্রথম যারা পৃথিবীতে আল্লাহর ইবাদত করেছিল । তারাই ছিল তাঁর বন্ধু এবং রক্তজ জ্ঞাতি-গোত্র । সুতরাং তাঁর (সা.) পরে খেলাফতের ব্যাপারে তাদেরই অধিকার অন্য সকলের চেয়ে বেশী । একমাত্র জালেম ব্যতীত আর কেউ খেলাফতের ব্যাপারে তাদের সাথে দ্বন্দ্ব করতে পারে না।১৮ যখন হাব্বাব বিন মুনযির আনসারদেরকে খেলাফত দৃঢ় করে আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য উদ্বুদ্ধ করছিল এবং বলছিল, তোমরা নিজেদের হাতের ক্ষমতা ধরে রাখ। জনগণ নিঃসন্দেহে তোমাদের দলে এবং ছায়ায় রয়েছে। যদি এরা (মুহাজিরগণ) অস্বীকার করে তাহলে আমাদের মধ্য থেকে একজন আমীর হবে আর তাদের মধ্য থেকে আরেকজন আমীর হবে। তখন হযরত উমর তার কথা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, দূর হোক,দূর হোক,একই খাপে কখনও দু টি তলোয়ার থাকতে পারে না । হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর রাজত্ব ও প্রশাসনে একমাত্র মিথ্যাবলম্বী,পাপাশ্রয়ী এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত অভাগা ছাড়া আর কোন্ ব্যক্তি আমাদের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে চায় ? অথচ আমরাই তাঁর বন্ধু,জ্ঞাতি ও নিকট আত্মীয়। ১৯

খলীফা নিযুক্ত করার ব্যাপারে প্রথম ও দ্বিতীয় খলীফার অনুসৃত পদ্ধতি,ঐ পদ্ধতির ব্যাপারে সাধারণ মুসলমানদের আপত্তি ও অভিযোগ না থাকা এবং সকীফা দিবসে প্রথম প্রজন্মের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের (মুহাজির ও আনসার) যুক্তির উপর প্রভাব বিস্তারকারী দলীয় মানসিকতা, কেবলমাত্র নিজেদের মধ্যে রাষ্ট্রীয় ও শাসন ক্ষমতা সীমাবদ্ধ রাখা এবং প্রশাসনে আনসারদের অংশগ্রহণ করতে না দেয়ার মানসিকতা সম্বলিত মুহাজিরদের দৃষ্টিভঙ্গি,মহানবীর জ্ঞাতি-গোত্রকে তাঁর উত্তরাধীকারী হওয়ার ক্ষেত্রে অন্যান্য আরবদের তুলনায় অত্যধিক প্রাধান্য দিয়ে থাকে-এমন সব বংশীয় কারণের উপর গুরত্বারোপ,আনসারদের অনেকেরই দু জন আমীরের অস্তিত্ব (একজন আনসারদের মধ্য থেকে অন্যজন মুহাজিরদের মধ্য থেকে) মেনে নেয়ার মানসিকতা এবং মহানবীর পরে খলীফা কে হবে-এতদসংক্রান্ত বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন না করার কারণে (সকীফার দিবসে খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণকারী) হযরত আবু বকরের আফসোস ও পরিতাপ-এসব কিছু থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত ও স্পষ্ট হয়ে যায় যে,মুসলিম উম্মাহর এই অগ্রগণ্য প্রজন্মটি (যাদের মধ্যে সেই অংশটিও রয়েছে যাঁরা মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পরে শাসনভার গ্রহণ করেছিলেন) কখনো শূরা ব্যবস্থার কথা চিন্তাও করত না এবং এ ব্যবস্থা সংক্রান্ত সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট ধারণাও তাদের ছিল না । অতএব,আমরা কিভাবে ভাবতে পারি যে,মহানবী (সা.) বিধিসম্মত ও চিন্তাগতভাবে শূরা বা পরামর্শ ব্যবস্থা সম্পর্কে মুসলিম উম্মাহকে সচেতন করার ব্যবস্থা নিয়েছিলেন এবং আনসার-মুহাজির প্রজন্মকে এ ব্যবস্থার ভিত্তিতে তাঁর ওফাতের পরে ইসলাম প্রচার কার্যক্রমের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য প্রস্তুত করেছিলেন? অতঃপর উক্ত আনসার-মুহাজির প্রজন্মের কাছে শূরা ব্যবস্থার বাস্তবায়ন অথবা সুনির্দিষ্ট কোন অর্থ আমরা খুঁজে পাই না । অন্যদিকে আমাদের পক্ষে ভাবা মোটেও সম্ভব নয় যে,মহানবী (সা.) নিজেই এ ব্যবস্থা কায়েম করেছেন এবং আইনগত ও ভাবগতভাবে তা সুনির্দিষ্ট করে ব্যাখ্যাও করেছেন । পরিশেষে,তিনি (সা.) এ ব্যবস্থা সম্পর্কে মুসলমানদেরকে মোটেও সচেতন ও পরিচিত করে যাননি ।

অতএব,এখানে যা বর্ণনা করা হল তা থেকে প্রমাণিত হয় যে,মহানবী (সা.) উম্মাহর কাছে একটি বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে শূরা ব্যবস্থাটি উত্থাপন করেননি । কারণ শূরার গুরুত্বের প্রতি দৃষ্টিপাত করেই শূরা বা পরামর্শ ব্যবস্থার কথা উত্থাপন,অতঃপর সকল মুসলমানের কাছে সবদিক থেকে তা গোপন ও অখ্যাত থেকে যাওয়া স্বভাবতঃই সম্ভব নয় ।

আর যে বিষয়টি থেকে এ সত্যটির সর্বাধিক ব্যাখ্যা আমরা পেতে পারি তা থেকে আমরা দেখতে পাই যে:

প্রথমতঃ যে পরিবেশে মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াত প্রাপ্তির আগে কোন রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা বাস্তবে প্রবর্তিত হয়নি সে পরিবেশে শূরা ব্যবস্থা স্বভাবতঃই একটি নতুন ব্যবস্থা বলে পরিগণিত হয়ে থাকবে । অতএব,যেমনভাবে আমরা বর্ণনা করেছি ঠিক তেমনিভাবে এ ব্যবস্থা সংক্রান্ত একটি প্রগাঢ় ও সুগভীর সচেতনতাবোধ সৃষ্টি করা অত্যাবশ্যক ।

দ্বিতীয়তঃ চিন্তামূলক ক্ষেত্রে শূরা হচ্ছে একটি দুর্বোধ্য বিষয় যা অতি সাধারণভাবে আলোচিত হওয়া যথেষ্ট নয় । কারণ শূরার বাস্তবায়নের সম্ভাবনা রয়েছে । আর যে পর্যন্ত শূরার সমুদয় খঁটিনাটি বিষয়,বিধি-বিধান ও নিয়ম-কানুন এবং শূরা বা পরামর্শ সভায় মতপার্থক্য দেখা দিলে শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য প্রদানের মাপকাঠি ও নিয়মাবলীর বিশদ বিবরণ না দেয়া হবে,সে পর্যন্ত কেবলমাত্র এভাবে অতি সাদামাটাভাবে তা (শূরা) আলোচিত হওয়া যথেষ্ট নয় । আর এক্ষেত্রে সংখ্যা ও পরিমাপের ভিত্তিতে,নাকি গুণ ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতে এ মাপকাঠিসমূহের মান নির্ধারিত হবে ?

এ ধরনের যা কিছু শূরার সীমারেখা সংক্রান্ত ধারণাকে সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করে এবং মহানবীর ওফাতের সাথে সাথে তা বাস্তবায়নযোগ্য করে তা সবকিছুই বর্ণিত হওয়া আবশ্যক ছিল ।

তৃতীয়তঃ নিঃসন্দেহে আমরা পরামর্শ ব্যবস্থা থেকে প্রকৃতপক্ষে মুসলিম উম্মাহ্ কর্তৃক পারস্পরিক পরামর্শ এবং প্রশাসনের ভাগ্য নির্ধারণের দ্বারা যে কোন ভাবে শাসন ক্ষমতার বাস্তবায়নের একটি ব্যাখ্যা পেতে পারি । তাই এটা হচ্ছে এক ধরনের দায়িত্ব যা বিরাট সংখ্যক লোকের সাথে জড়িত যারা শূরা বা পরামর্শ পরিষদের আওতাধীন । আর এর অর্থ দাঁড়ায় যে, শূরা ব্যবস্থা যদি শরয়ী হুকুম বা বিধানই হত যা মহানবীর ওফাতের পরপরই কার্যকর করা ওয়াজিব তাহলে তা অবশ্যই ঐ সকল লোকের (যারা শূরার আওতাধীন) অধিকাংশের কাছে উত্থাপিত হওয়া আবশ্যক হয়ে যেত । কারণ শূরার ব্যাপারে তাদের মনোভাব ইতিবাচক আর তাদের প্রত্যেকেরই এ ব্যাপারে কিছু না কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে । আর এসব বিষয় থেকে প্রমাণিত হয় যে,উম্মাহর কাছে মহানবী কর্তৃক তাঁর ওফাতের পরে তাঁরই বিকল্পস্বরূপ শূরা ব্যবস্থা উত্থাপন করা ছিল অত্যন্ত জরুরী বিষয়।

আর সেজন্য তাঁর করণীয় ছিল (এ ব্যবস্থার সঠিক বাস্তবায়নের লক্ষ্যে) বিপুল হারে, গভীরভাবে এবং ব্যাপক পরিসরে সাধারণ মানসিক প্রস্তুতি নেয়া,সব ধরনের ফাঁক-ফোঁকড়, রন্ধ্র ও ছিদ্র বন্ধ করা এবং শূরা বা পরামর্শ ব্যবস্থা সংক্রান্ত ধারণার বাস্তব রূপ দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রদান করা । আর এ পর্যায়ে,মহানবী (সা.) কর্তৃক জনসমক্ষে ব্যাপক ও গভীরভাবে পরামর্শ ব্যবস্থা সংক্রান্ত ধারণার উত্থাপন এবং এরপর মহানবীর ওফাতের সময় পর্যন্ত তাঁর সমসাময়িক সকল মুসলমানের কাছে এ ধারণার যাবতীয় আলামত ও নিদর্শন বিস্মৃত হওয়া সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব ।

আবার কেউ কেউ ধারণা করতে পারে যে,মহানবী (সা.) শূরা ব্যবস্থা সংক্রান্ত ধারণাটি অবশ্যই ইতিবাচক পদক্ষেপের ক্ষেত্রে পরিমাণ ও গুণগত দিক থেকে কাঙ্খিত মাত্রায় এবং মুসলমানদের কাছে গ্রহণীয় পরিসরেই উত্থাপন করেছিলেন । তবে হঠাৎ করে উদ্ভূত বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং অন্যান্য কারণে প্রকৃত সত্য ও বাস্তবতা ঢাকা পড়ে গেছে । আর এর ফলে জনগণ শূরা বা পরামর্শ ব্যবস্থা এবং তৎসংক্রান্ত যাবতীয় খুটি-নাটি বিধি-বিধান ও বিবরণ সম্পর্কে যা কিছু শুনেছিল তা গোপন করতে বাধ্য হয়েছে ।

কিন্ত এ ধারণাটি আদৌ বাস্তবসম্মত নয় । কেননা ঐ সকল রাজনৈতিক চাপ ও কারণ সম্পর্কে যত কিছুই বলা হোক না কেন তা সাধারণ সাহাবাদের অন্তর্ভুক্ত করে না যারা মহানবীর ওফাতের পরপরই রাজনৈতিক ঘটনাবলী এবং সকীফার পিরামিড (খেলাফত) নির্মাণের ক্ষেত্রে কোন আবদানই রাখেনি । তাদের ভূমিকাও ছিল নিতান্ত গৌণ । যতই রাজনৈতিক নিষ্পেষণ ও আগ্রাসনের শিকার হোক না কেন এ ধরনের লোকেরাই সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হয়ে থাকে ।

অতএব,শূরা ব্যবস্থা সংক্রান্ত ধারণা যদি কাঙ্খিত মাত্রায় মহানবী (সা.) কর্তৃক উত্থাপিত হত তাহলে শূরা সংক্রান্ত মহানবীর স্পষ্ট উক্তি শোনার পর বিষয়টি কেবলমাত্র কতগুলো রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ের সমর্থকদের মাঝেই সীমিত থাকত না । বরং বিভিন্ন স্তরের জনতা তা শুনে থাকত এবং যেভাবে ইমাম আলী (আ.)-এর মর্যাদা ও গুণাবলী এবং প্রতিনিধিত্ব ও নির্বাহী ক্ষমতা সংক্রান্ত মহানবী (সা.)-এর হাদীসসমূহ কার্যতঃ বিভিন্ন সাহাবী সূত্রে বর্ণিত হয়েছে ঠিক সেভাবে শূরা সংক্রান্ত মহানবীর হাদীসসমূহও সর্বসাধারণ সাহাবা কর্তৃক স্বাভাবিকভাবে অবশ্যই বর্ণিত হত । হযরত আলী (আ.)-এর মর্যাদা,গুণাবলী,প্রতিনিধিত্ব ও নির্বাহী ক্ষমতা(وصایة ) এবং প্রামাণিক কর্তৃত্ব(مرجعیت ) সম্পর্কে মহানবী (সা.) থেকে সাহাবীদের সূত্রে বর্ণিত শত শত হাদীস রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ের প্রবল বাঁধা ও চাপ এবং তৎকালীন বহুল প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির পরিপন্থী হওয়া সত্ত্বেও আমাদের কাছে কিভাবে পৌঁছাল? অথচ শূরা ব্যবস্থা সংক্রান্ত হাদীসসমূহের উল্লেখযোগ্য কোন অংশই কেন আমাদের কাছে পৌঁছাল না?!!আর এমনকি যারা প্রচলিত প্রধান দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থন করত,তারাও বহুলাংশে গৃহীত রাজনৈতিক পদক্ষেপসমূহের ক্ষেত্রে নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য করত । এমনকি এক দলের বিরুদ্ধে আরেক দলের শূরা বা পরামর্শ ব্যবস্থার শ্লোগান তোলার ফায়দা থাকা সত্ত্বেও আমরা কখনো প্রত্যক্ষ করিনি যে,কোন দল মহানবী (সা.) থেকে শোনা একটি বিধান হিসেবে শূরা ব্যবস্থার ধুঁয়ো তুলেছে । উদাহরণস্বরূপঃ হযরত আবু বকর যখন হযরত উমরকে খলীফা মনোনীত করলেন তখন এ মনোনয়নের বিপক্ষে হযরত তালহা নীতি-অবস্থান গ্রহণ এবং এ ব্যাপারে তিনি প্রতিবাদ ও তাঁর অসন্তুষ্টিও ব্যক্ত করেছিলেন।২০ এতদসত্ত্বেও হযরত তালহা খলীফা আবু বকরের এ মনোনয়নের বিরুদ্ধে শূরা কার্ড (ورقة الشوری )ব্যবহার করার কথা মোটেও ভাবেননি । তিনি খলীফা আবু বকরের এ পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা ও সমালোচনা করতে গিয়ে মোটেও চিন্তা করেননি যে,খলীফা আবু বকর মহানবী (সা.) বর্ণিত শূরা ব্যবস্থা এবং নির্বাচন পরিপন্থী কাজ করেছেন ।

১-শূরা পদ্ধতির জন্য উম্মতের প্রস্তুতি ছিলনা : মহানবী (সা.) ইসলাম প্রচার কার্যের ভবিষ্যৎ চিন্তা-ভাবনা করেই তাঁর ওফাতের পরে শূরা বা পরামর্শ ব্যবস্থা থেকে সরাসরি উৎসারিত নেতৃত্ব-ধারার সাথে ইসলাম প্রচার কার্যক্রমের নেতৃত্ব-ধারাকে জড়িত করার লক্ষ্যে বাস্তবে যদি কোন ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েই থাকতেন তাহলে এ ইতিবাচক পদক্ষেপের জন্য যে সব বিষয় অপরিহার্য ও অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তন্মধ্যে সবচেয়ে সুস্পষ্ট বিষয়টি নিঃসন্দেহে এই হত যে,তিনি (সা.) পরামর্শ ব্যবস্থা এবং এর সার্বিক আইনগত পরিসীমা ও দিক সম্পর্কে সমগ্র উম্মাহ্ এবং প্রচারকদেরকে অবশ্যই অবহিত করতেন এবং এ ব্যবস্থাটি মেনে নেয়ার জন্য মুসলিম উম্মাহকে মানসিক ও চিন্তাগতভাবে প্রস্তুতও করতেন । এখানে উল্লেখ্য যে, তৎকালীন মুসলিম সমাজটি ছিল কতিপয় গোত্রের সমষ্টি । আর এ সব গোত্র ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে পারস্পরিক পরামর্শ বা শূরাভিত্তিক কোন রাজনৈতিক পরিবেশ ও প্রক্রিয়ায় বসবাস করতে একদম অভ্যস্ত ছিল না, শুধু তাই নয় বরং তারা গোত্রপতিদের কঠোর নিয়ন্ত্রিত অবস্থার মধ্যেই জীবন যাপন করত; সেখানে পেশীবল,ধনবল এবং বংশগৌরবই বহুলাংশে প্রাধান্য লাভ করত। (দ্রঃ- ডঃ আব্দুল আযীয আদ্-দাওরী প্রণীত আন্ নুযমু আল ইসলামিয়াহ্ পৃঃ ৭,নাজীব প্রেস,বাগদাদ ১৯৫০ সালে মুদ্রিত,ডঃ সুবহী আস্-সালেহ্ প্রণীত আন্ নুযম আল ইসলামিয়াহ্ পৃঃ ৫০,দারুল ইল্ম লিল্ মালাঈন কর্তৃক ১৯৫০ সালে মুদ্রিত)

অতএব,আমরা বেশ সহজেই বুঝতে পারছি যে,মহানবী (সা.) শূরা বা পরামর্শ ব্যবস্থার সমুদয় আইনগত ব্যাখ্যা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ধারণার সাথে মুসলিম উম্মাহকে পরিচিত করার কোন উদ্যোগই গ্রহণ করেননি । অথচ এ ধরণের পদক্ষেপ যদি বাস্তবে নেয়া হত তাহলে তা স্বভাবতঃই মহানবী (সা.)-এর মুখনিঃসৃত বাণী বা হাদীসসমূহে বর্ণিত হত এবং মুসলিম উম্মাহর চিন্তার-চেতনায় অথবা অন্ততঃপক্ষে শূরা বা পরামর্শ ব্যবস্থা প্রবর্তন ও বাস্তবায়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে মুসলিম উম্মাহর প্রথম প্রজন্ম অর্থাৎ মুহাজির ও আনসারদের চিন্তা-চেতনা ও মানসিকতায় অবশ্যই প্রতিফলিত হত । আর এটাই ছিল স্বাভাবিক । কিন্তু আমরা মহানবী (সা.)-এর হাদীসসমূহে শূরা বা পরামর্শ ব্যবস্থার কোন আইনগত সুস্পষ্ট চিত্রই খুজে পাই না ।

এরপর আমরা উম্মাহর মানসিকতায় অথবা উম্মাহর প্রথম প্রজন্মের ধ্যান-ধারণায়ও এ ধরনের পরিচিতিকরণ প্রক্রিয়ার কোন ইঙ্গিত অথবা সুস্পষ্ট প্রতিফলন প্রত্যক্ষ করি না । অথচ এ প্রজন্মটির মাঝে দু ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাবধারা বিদ্যমান ছিল । যার একটির নেতৃত্বে ছিলেন মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইত (আ.) আর অন্যটির পুরোধায় ছিল সকীফার ঘটনা এবং খেলাফতের সমর্থক । আর খেলাফত ও সকীফার ঘটনার উৎপত্তি হয়েছিল কার্যতঃ মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পরেই ।

তবে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট যে,প্রথম ভাবধারাটি অসিয়ত ও ইমামতে বিশ্বাস এবং মহানবী (সা.)-এর কুরাবাহ বা আত্মীয়তার উপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করত । আর শূরা বা পরামর্শ ব্যবস্থা সংক্রান্ত কোন বিশ্বাসই এর মাঝে পরিলক্ষিত হত না ।

দ্বিতীয় ভাবধারাটির উৎপত্তি,বিকাশ এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিদ্যমান নিদর্শন ও দলীল-প্রমাণাদি থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রতীয়মান হয় যে,এ ভাবধারাটিও শূরা বা পরামর্শ ব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিল না এবং উক্ত পরামর্শ ব্যবস্থার ভিত্তিতে বাস্তবে এর কোন কর্মতৎপরতাই ছিল না । আর ঠিক এই একই জিনিস আমরা মহানবী (সা.) এর ওফাতকালীন সময়ের মুহাজির ও আনসার প্রজন্মের সবার মধ্যেই প্রত্যক্ষ করি ।

আর তখনই বিষয়টির গুরুত্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায় যখন আমরা প্রত্যক্ষ করি যে,হযরত আবু বকরের অসুস্থতা তীব্র আকার ধারণ করলে তিনি হযরত উমরকে তাঁর মৃত্যুর পরে খলীফা মনোনীত করলেন এবং হযরত উসমানকে তা লিখারও নির্দেশ দিলেন। আর হযরত উসমান অসিয়তে লিখেছিলেন, পরম করুণাময় আল্লাহর নামে । আর এটা হচ্ছে মুমিন ও মুসলমানদের প্রতি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর খলীফা আবু বকরের প্রতিজ্ঞা পত্র । তোমাদের উপর সালাম । আমি তোমাদের সমীপে মহান আল্লাহর প্রশংসা করছি । আমি তোমাদের জন্য উমর ইবনুল খাত্তাবকে খলীফা মনোনীত করলাম। তোমরা তাঁর কথা শুনবে এবং তাঁর আনুগত্য করবে । (দ্রঃ- ইবনে মানযূর প্রণীত মুখতাসার তারীখে দিমাশ্ক ১৮তম খণ্ড,পৃঃ ৩১০,তারীখুত তাবারী ২য় খণ্ড পৃঃ ২৫২)

আব্দুর রহমান ইবনে আওফ হযরত আবু বকরের কাছে এসে বললেন, হে মহান রসুলের খলীফা! আপনি কেমন আছেন? হযরত আবু বকর বললেন, আমি আমার মৃত্যুর পর খলীফা নিযুক্ত করেছি যখন তোমরা দেখতে পেলে যে, তোমাদের মধ্য থেকে একজনকে আমি খলীফা মনোনীত করেছি আর তখনই তোমরা আমার যা হয়েছে তা আরো বাড়িয়ে দিলে তোমাদের সবারই নাসিকা ফুলে মোটা হয়ে গেছে কেননা তোমরা সবাই তোমাদের নিজেদের জন্য খেলাফত প্রত্যাশা করছ

(দ্রঃ- তারীখুল ইয়া কুবী ২য় খণ্ড পৃঃ ১২৬, তারীখ ইবনে আসাকির ১৮তম খণ্ড পৃঃ ৩১০, তারীখুত তাবারী ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ৫২)

এ ধরনের উত্তরাধিকারী মনোনয়ন এবং এতদসংক্রাস্ত বিরোধিতার প্রকাশ্য নিন্দাবাদ থেকে প্রতীয়মান হয় যে,খলীফা শূরা ব্যবস্থার যৌক্তিকতা সম্পর্কে মোটেও চিন্তা-ভাবনা করতেন না  । আর তিনি মনে করতেন যে,খলীফা মনোনীত করাটা তাঁর অধিকার । আর এ ধরনের নিযুক্তি ও মনোনয়নের কারণে নতুন খলীফার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা মুসলমানদের উপর ফরয হয়ে যায় । তাই খলীফা আবু বকর তাদেরকে নতুন খলীফার কথা শুনতে ও তাঁর আনুগত্য করতে আদেশ দিয়েছিলেন । সুতরাং খলীফার এ উক্তি কেবলমাত্র সাদামাটা প্রস্তাব বা নিছক স্মরণ করিয়ে দেয়ার ঘটনাই ছিল না;বরং তা ছিল নিযুক্তি,বাধ্যবাধকতা এবং আদেশ । আমরা আরো লক্ষ্য করি যে,খলীফা উমর মনে করতেন মুসলমানদের জন্য নতুন খলীফা মনোনীত করা তাঁর দায়িত্ব ও অধিকার । তাই তিনি খলীফা নির্বাচিত করার ব্যাপারে অন্য সকল মুসলমানের প্রকৃত ভূমিকা অস্বীকার করে কেবলমাত্র ছয় জনের মাঝেই খলীফা নির্বাচনের বিষয়টি স্থির করেছিলেন । আর এর অর্থ দাঁড়ায় যে,ঠিক যেমনভাবে খলীফা মনোনীত করার ব্যাপারে প্রথম খলীফার অনুসৃত প্রক্রিয়ায় শূরা বা পরামর্শ ব্যবস্থার কোন প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয়নি ঠিক তেমনি এ ব্যবস্থার কোন যৌক্তিকতাও উত্তরাধিকারী বা খলীফা নির্বাচন করার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় খলীফার অনুসৃত পদ্ধতিতে আদৌ প্রতিফলিত হয়নি ।

জনগণ হযরত উমরের কাছে তাঁর পরবর্তী উত্তরাধিকারী বা খলীফা মনোনীত করার ব্যাপারে অনুরোধ করলে তিনি বলেছিলেন, যদি আমি দু জনের একজনকে জীবিত পেতাম তাহলে এ বিষয়টি (ফতঅর্থাৎ খেলা)  তার জন্য স্থির করে দিতাম এবং এক্ষেত্রে তার উপর আস্থা স্থাপন করতাম । দু জনের একজন আবু হুযাইফার দাস সালেম এবং অন্যজন আবু উবায়দা বিন জাররাহ্ । আর যদি সালেম জীবিত থাকত তাহলে খেলাফতের ব্যাপারে শূরা বা পরামর্শ পরিষদ নিযুক্ত করতাম না । ১৪

হযরত আবু বকর মৃত্যূ শয্যায় শায়িতাবস্থায় আব্দুর রহমান ইবনে আওফকে বলেছিলেন, আমি মহানবী (সা.)-কে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম যে,(মহানবীর পরে) কে খলীফা হবে অর্থাৎ খেলাফত কার হবে? যার ফলে এ বিষয়ে আর কোন দ্বন্দ্ব-সংঘাত থাকবে না ।১৫ ..তবে আনসারগণ যখন সকীফায় সা দ বিন উবাদাকে খলীফা বা আমীর নিযুক্ত করার জন্য মিলিত হয়েছিল তখন তাদের মধ্য থেকে একজন বলেছিল : কোরাইশ বংশীয় মুহাজিরগণ যদি তা মেনে না নিয়ে বলে যে : আমরাই মুহাজির এবং আমরাই মহানবীর জ্ঞাতি-গোত্র এবং তাঁর উত্তরাধিকারী আর এরপরও যদি তাদের মধ্য থেকে কোন দল এ কথা বলে যে : আমাদের মধ্য থেকে একজন নেতা ও তোমাদের মধ্য থেকে একজন নেতা হবে তবুও আমরা এ ব্যাপারে তাদের (কোরাইশদের) প্রস্তাবটি কখনোই মেনে নিব না । ১৬

হযরত আবু বকর তখন বক্তৃতায় বলেছিলেন, আমরা (মুহাজির) সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছি আর এক্ষেত্রে সকল জনগণ আমাদের পিছনে (অর্থাৎ তারা আমাদের পরে ইসলাম গ্রহণ করেছে) । আমরা মহানবীর জ্ঞাতি-গোত্র এবং আরবদের মধ্যে আমরাই সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত । ১৭

আর যখন আনসারগণ তাদের ও মুহাজিরদের মধ্যে খেলাফত পর্যায়ক্রমিক হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল তখন হযরত আবু বকর তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, মহানবী (সা.) যখন নবুওয়াত প্রাপ্ত হলেন তখন পিতৃধর্ম ত্যাগ করা আরবদের জন্য খুবই কষ্টকর হয়েছিল । তাই তারা তাঁর (সা.) বিরুদ্ধাচারণ করেছিল এবং তাঁকে কষ্ট দিয়েছিল । মহান আল্লাহ তাঁর গোত্রের মধ্য থেকে প্রথম দিককার মুহাজিরগণকে মহানবী (সা.)-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন এরং তাঁকে মেনে নেয়ার বিশেষ তৌফিক দিয়েছিলেন । আর তারাই প্রথম যারা পৃথিবীতে আল্লাহর ইবাদত করেছিল । তারাই ছিল তাঁর বন্ধু এবং রক্তজ জ্ঞাতি-গোত্র । সুতরাং তাঁর (সা.) পরে খেলাফতের ব্যাপারে তাদেরই অধিকার অন্য সকলের চেয়ে বেশী । একমাত্র জালেম ব্যতীত আর কেউ খেলাফতের ব্যাপারে তাদের সাথে দ্বন্দ্ব করতে পারে না।১৮ যখন হাব্বাব বিন মুনযির আনসারদেরকে খেলাফত দৃঢ় করে আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য উদ্বুদ্ধ করছিল এবং বলছিল, তোমরা নিজেদের হাতের ক্ষমতা ধরে রাখ। জনগণ নিঃসন্দেহে তোমাদের দলে এবং ছায়ায় রয়েছে। যদি এরা (মুহাজিরগণ) অস্বীকার করে তাহলে আমাদের মধ্য থেকে একজন আমীর হবে আর তাদের মধ্য থেকে আরেকজন আমীর হবে। তখন হযরত উমর তার কথা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, দূর হোক,দূর হোক,একই খাপে কখনও দু টি তলোয়ার থাকতে পারে না । হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর রাজত্ব ও প্রশাসনে একমাত্র মিথ্যাবলম্বী,পাপাশ্রয়ী এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত অভাগা ছাড়া আর কোন্ ব্যক্তি আমাদের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে চায় ? অথচ আমরাই তাঁর বন্ধু,জ্ঞাতি ও নিকট আত্মীয়। ১৯

খলীফা নিযুক্ত করার ব্যাপারে প্রথম ও দ্বিতীয় খলীফার অনুসৃত পদ্ধতি,ঐ পদ্ধতির ব্যাপারে সাধারণ মুসলমানদের আপত্তি ও অভিযোগ না থাকা এবং সকীফা দিবসে প্রথম প্রজন্মের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের (মুহাজির ও আনসার) যুক্তির উপর প্রভাব বিস্তারকারী দলীয় মানসিকতা, কেবলমাত্র নিজেদের মধ্যে রাষ্ট্রীয় ও শাসন ক্ষমতা সীমাবদ্ধ রাখা এবং প্রশাসনে আনসারদের অংশগ্রহণ করতে না দেয়ার মানসিকতা সম্বলিত মুহাজিরদের দৃষ্টিভঙ্গি,মহানবীর জ্ঞাতি-গোত্রকে তাঁর উত্তরাধীকারী হওয়ার ক্ষেত্রে অন্যান্য আরবদের তুলনায় অত্যধিক প্রাধান্য দিয়ে থাকে-এমন সব বংশীয় কারণের উপর গুরত্বারোপ,আনসারদের অনেকেরই দু জন আমীরের অস্তিত্ব (একজন আনসারদের মধ্য থেকে অন্যজন মুহাজিরদের মধ্য থেকে) মেনে নেয়ার মানসিকতা এবং মহানবীর পরে খলীফা কে হবে-এতদসংক্রান্ত বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন না করার কারণে (সকীফার দিবসে খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণকারী) হযরত আবু বকরের আফসোস ও পরিতাপ-এসব কিছু থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত ও স্পষ্ট হয়ে যায় যে,মুসলিম উম্মাহর এই অগ্রগণ্য প্রজন্মটি (যাদের মধ্যে সেই অংশটিও রয়েছে যাঁরা মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পরে শাসনভার গ্রহণ করেছিলেন) কখনো শূরা ব্যবস্থার কথা চিন্তাও করত না এবং এ ব্যবস্থা সংক্রান্ত সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট ধারণাও তাদের ছিল না । অতএব,আমরা কিভাবে ভাবতে পারি যে,মহানবী (সা.) বিধিসম্মত ও চিন্তাগতভাবে শূরা বা পরামর্শ ব্যবস্থা সম্পর্কে মুসলিম উম্মাহকে সচেতন করার ব্যবস্থা নিয়েছিলেন এবং আনসার-মুহাজির প্রজন্মকে এ ব্যবস্থার ভিত্তিতে তাঁর ওফাতের পরে ইসলাম প্রচার কার্যক্রমের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য প্রস্তুত করেছিলেন? অতঃপর উক্ত আনসার-মুহাজির প্রজন্মের কাছে শূরা ব্যবস্থার বাস্তবায়ন অথবা সুনির্দিষ্ট কোন অর্থ আমরা খুঁজে পাই না । অন্যদিকে আমাদের পক্ষে ভাবা মোটেও সম্ভব নয় যে,মহানবী (সা.) নিজেই এ ব্যবস্থা কায়েম করেছেন এবং আইনগত ও ভাবগতভাবে তা সুনির্দিষ্ট করে ব্যাখ্যাও করেছেন । পরিশেষে,তিনি (সা.) এ ব্যবস্থা সম্পর্কে মুসলমানদেরকে মোটেও সচেতন ও পরিচিত করে যাননি ।

অতএব,এখানে যা বর্ণনা করা হল তা থেকে প্রমাণিত হয় যে,মহানবী (সা.) উম্মাহর কাছে একটি বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে শূরা ব্যবস্থাটি উত্থাপন করেননি । কারণ শূরার গুরুত্বের প্রতি দৃষ্টিপাত করেই শূরা বা পরামর্শ ব্যবস্থার কথা উত্থাপন,অতঃপর সকল মুসলমানের কাছে সবদিক থেকে তা গোপন ও অখ্যাত থেকে যাওয়া স্বভাবতঃই সম্ভব নয় ।

আর যে বিষয়টি থেকে এ সত্যটির সর্বাধিক ব্যাখ্যা আমরা পেতে পারি তা থেকে আমরা দেখতে পাই যে:

প্রথমতঃ যে পরিবেশে মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াত প্রাপ্তির আগে কোন রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা বাস্তবে প্রবর্তিত হয়নি সে পরিবেশে শূরা ব্যবস্থা স্বভাবতঃই একটি নতুন ব্যবস্থা বলে পরিগণিত হয়ে থাকবে । অতএব,যেমনভাবে আমরা বর্ণনা করেছি ঠিক তেমনিভাবে এ ব্যবস্থা সংক্রান্ত একটি প্রগাঢ় ও সুগভীর সচেতনতাবোধ সৃষ্টি করা অত্যাবশ্যক ।

দ্বিতীয়তঃ চিন্তামূলক ক্ষেত্রে শূরা হচ্ছে একটি দুর্বোধ্য বিষয় যা অতি সাধারণভাবে আলোচিত হওয়া যথেষ্ট নয় । কারণ শূরার বাস্তবায়নের সম্ভাবনা রয়েছে । আর যে পর্যন্ত শূরার সমুদয় খঁটিনাটি বিষয়,বিধি-বিধান ও নিয়ম-কানুন এবং শূরা বা পরামর্শ সভায় মতপার্থক্য দেখা দিলে শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য প্রদানের মাপকাঠি ও নিয়মাবলীর বিশদ বিবরণ না দেয়া হবে,সে পর্যন্ত কেবলমাত্র এভাবে অতি সাদামাটাভাবে তা (শূরা) আলোচিত হওয়া যথেষ্ট নয় । আর এক্ষেত্রে সংখ্যা ও পরিমাপের ভিত্তিতে,নাকি গুণ ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতে এ মাপকাঠিসমূহের মান নির্ধারিত হবে ?

এ ধরনের যা কিছু শূরার সীমারেখা সংক্রান্ত ধারণাকে সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করে এবং মহানবীর ওফাতের সাথে সাথে তা বাস্তবায়নযোগ্য করে তা সবকিছুই বর্ণিত হওয়া আবশ্যক ছিল ।

তৃতীয়তঃ নিঃসন্দেহে আমরা পরামর্শ ব্যবস্থা থেকে প্রকৃতপক্ষে মুসলিম উম্মাহ্ কর্তৃক পারস্পরিক পরামর্শ এবং প্রশাসনের ভাগ্য নির্ধারণের দ্বারা যে কোন ভাবে শাসন ক্ষমতার বাস্তবায়নের একটি ব্যাখ্যা পেতে পারি । তাই এটা হচ্ছে এক ধরনের দায়িত্ব যা বিরাট সংখ্যক লোকের সাথে জড়িত যারা শূরা বা পরামর্শ পরিষদের আওতাধীন । আর এর অর্থ দাঁড়ায় যে, শূরা ব্যবস্থা যদি শরয়ী হুকুম বা বিধানই হত যা মহানবীর ওফাতের পরপরই কার্যকর করা ওয়াজিব তাহলে তা অবশ্যই ঐ সকল লোকের (যারা শূরার আওতাধীন) অধিকাংশের কাছে উত্থাপিত হওয়া আবশ্যক হয়ে যেত । কারণ শূরার ব্যাপারে তাদের মনোভাব ইতিবাচক আর তাদের প্রত্যেকেরই এ ব্যাপারে কিছু না কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে । আর এসব বিষয় থেকে প্রমাণিত হয় যে,উম্মাহর কাছে মহানবী কর্তৃক তাঁর ওফাতের পরে তাঁরই বিকল্পস্বরূপ শূরা ব্যবস্থা উত্থাপন করা ছিল অত্যন্ত জরুরী বিষয়।

আর সেজন্য তাঁর করণীয় ছিল (এ ব্যবস্থার সঠিক বাস্তবায়নের লক্ষ্যে) বিপুল হারে, গভীরভাবে এবং ব্যাপক পরিসরে সাধারণ মানসিক প্রস্তুতি নেয়া,সব ধরনের ফাঁক-ফোঁকড়, রন্ধ্র ও ছিদ্র বন্ধ করা এবং শূরা বা পরামর্শ ব্যবস্থা সংক্রান্ত ধারণার বাস্তব রূপ দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রদান করা । আর এ পর্যায়ে,মহানবী (সা.) কর্তৃক জনসমক্ষে ব্যাপক ও গভীরভাবে পরামর্শ ব্যবস্থা সংক্রান্ত ধারণার উত্থাপন এবং এরপর মহানবীর ওফাতের সময় পর্যন্ত তাঁর সমসাময়িক সকল মুসলমানের কাছে এ ধারণার যাবতীয় আলামত ও নিদর্শন বিস্মৃত হওয়া সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব ।

আবার কেউ কেউ ধারণা করতে পারে যে,মহানবী (সা.) শূরা ব্যবস্থা সংক্রান্ত ধারণাটি অবশ্যই ইতিবাচক পদক্ষেপের ক্ষেত্রে পরিমাণ ও গুণগত দিক থেকে কাঙ্খিত মাত্রায় এবং মুসলমানদের কাছে গ্রহণীয় পরিসরেই উত্থাপন করেছিলেন । তবে হঠাৎ করে উদ্ভূত বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং অন্যান্য কারণে প্রকৃত সত্য ও বাস্তবতা ঢাকা পড়ে গেছে । আর এর ফলে জনগণ শূরা বা পরামর্শ ব্যবস্থা এবং তৎসংক্রান্ত যাবতীয় খুটি-নাটি বিধি-বিধান ও বিবরণ সম্পর্কে যা কিছু শুনেছিল তা গোপন করতে বাধ্য হয়েছে ।

কিন্ত এ ধারণাটি আদৌ বাস্তবসম্মত নয় । কেননা ঐ সকল রাজনৈতিক চাপ ও কারণ সম্পর্কে যত কিছুই বলা হোক না কেন তা সাধারণ সাহাবাদের অন্তর্ভুক্ত করে না যারা মহানবীর ওফাতের পরপরই রাজনৈতিক ঘটনাবলী এবং সকীফার পিরামিড (খেলাফত) নির্মাণের ক্ষেত্রে কোন আবদানই রাখেনি । তাদের ভূমিকাও ছিল নিতান্ত গৌণ । যতই রাজনৈতিক নিষ্পেষণ ও আগ্রাসনের শিকার হোক না কেন এ ধরনের লোকেরাই সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হয়ে থাকে ।

অতএব,শূরা ব্যবস্থা সংক্রান্ত ধারণা যদি কাঙ্খিত মাত্রায় মহানবী (সা.) কর্তৃক উত্থাপিত হত তাহলে শূরা সংক্রান্ত মহানবীর স্পষ্ট উক্তি শোনার পর বিষয়টি কেবলমাত্র কতগুলো রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ের সমর্থকদের মাঝেই সীমিত থাকত না । বরং বিভিন্ন স্তরের জনতা তা শুনে থাকত এবং যেভাবে ইমাম আলী (আ.)-এর মর্যাদা ও গুণাবলী এবং প্রতিনিধিত্ব ও নির্বাহী ক্ষমতা সংক্রান্ত মহানবী (সা.)-এর হাদীসসমূহ কার্যতঃ বিভিন্ন সাহাবী সূত্রে বর্ণিত হয়েছে ঠিক সেভাবে শূরা সংক্রান্ত মহানবীর হাদীসসমূহও সর্বসাধারণ সাহাবা কর্তৃক স্বাভাবিকভাবে অবশ্যই বর্ণিত হত । হযরত আলী (আ.)-এর মর্যাদা,গুণাবলী,প্রতিনিধিত্ব ও নির্বাহী ক্ষমতা(وصایة ) এবং প্রামাণিক কর্তৃত্ব(مرجعیت ) সম্পর্কে মহানবী (সা.) থেকে সাহাবীদের সূত্রে বর্ণিত শত শত হাদীস রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ের প্রবল বাঁধা ও চাপ এবং তৎকালীন বহুল প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির পরিপন্থী হওয়া সত্ত্বেও আমাদের কাছে কিভাবে পৌঁছাল? অথচ শূরা ব্যবস্থা সংক্রান্ত হাদীসসমূহের উল্লেখযোগ্য কোন অংশই কেন আমাদের কাছে পৌঁছাল না?!!আর এমনকি যারা প্রচলিত প্রধান দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থন করত,তারাও বহুলাংশে গৃহীত রাজনৈতিক পদক্ষেপসমূহের ক্ষেত্রে নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য করত । এমনকি এক দলের বিরুদ্ধে আরেক দলের শূরা বা পরামর্শ ব্যবস্থার শ্লোগান তোলার ফায়দা থাকা সত্ত্বেও আমরা কখনো প্রত্যক্ষ করিনি যে,কোন দল মহানবী (সা.) থেকে শোনা একটি বিধান হিসেবে শূরা ব্যবস্থার ধুঁয়ো তুলেছে । উদাহরণস্বরূপঃ হযরত আবু বকর যখন হযরত উমরকে খলীফা মনোনীত করলেন তখন এ মনোনয়নের বিপক্ষে হযরত তালহা নীতি-অবস্থান গ্রহণ এবং এ ব্যাপারে তিনি প্রতিবাদ ও তাঁর অসন্তুষ্টিও ব্যক্ত করেছিলেন।২০ এতদসত্ত্বেও হযরত তালহা খলীফা আবু বকরের এ মনোনয়নের বিরুদ্ধে শূরা কার্ড (ورقة الشوری )ব্যবহার করার কথা মোটেও ভাবেননি । তিনি খলীফা আবু বকরের এ পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা ও সমালোচনা করতে গিয়ে মোটেও চিন্তা করেননি যে,খলীফা আবু বকর মহানবী (সা.) বর্ণিত শূরা ব্যবস্থা এবং নির্বাচন পরিপন্থী কাজ করেছেন ।


4

5

6

7

8

9