১ম পাঠ
নবুয়্যতের প্রসংগ কথা
ভূমিকা:
আমরা ইতিপূর্বে জেনেছি যে,একজন বিচক্ষণ মানুষের মত জীবন-যাপন করার নিমিত্তে যে সকল মৌলিকতম বিষয়সমূহের সমাধান করা প্রত্যেক বুদ্ধিমান ও বিবেকবান মানুষের জন্যেই অপরিহার্য সেগুলো নিম্বরূপ:
১। মানুষ ও বিশ্বজগতের অস্তিত্ব কার থেকে ? এবং এ গুলোর নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব কার ?
২। জীবনের পরিশেষ এবং মানুষের চূড়ান্ত গন্তব্য কোথায় ?
৩। প্রকৃত সৌভাগ্য ও পূর্ণতালাভের জন্যে সঠিক পথের সন্ধান প্রাপ্তির উপর মানুষের যে নির্ভরশীলতা,তা কোন বিশ্বস্ত মাধ্যমে অর্জিত হয়ে থাকে? এবং তা কার নিয়ন্ত্রণাধীন ?
এ প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর সে মৌলিক ভিত্তিত্রয়ে (তাওহীদ,নবুয়্যত,পুনরুত্থান বা ক্বিয়ামত) বিদ্যমান,যেগুলো প্রতিটি ঐশী ধর্মেরই মৌলিকতম বিশ্বাসরূপে পরিগণিত ।
এ পুস্তকের প্রথম খণ্ডে আমরা খোদা পরিচিতির উপর আলোচনা করেছি এবং এ উপসংহারে পৌঁছেছি যে,সকল সৃষ্ট বিষয়ই একক সৃষ্টিকর্তার নিকট থেকে অস্তিত্ব লাভ করেছে এবং সকলেই তারই প্রজ্ঞাপূর্ণ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে;কেউই কোন অবস্থাতে বা কোন কর্মে বা কোন স্থানে অথবা কালেই তার অমুখাপেক্ষী নয়।
এ বিষয়টিকে আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলের মাধ্যমে প্রমাণ করেছিলাম
এবং উল্লেখ করেছিলাম যে,এ ধরনের বিষয়বস্তুকে শুধুমাত্র বুদ্ধিবৃত্তিকভাবেই প্রমাণ করা যায়। কারণ বিশ্বাসগত পরিচিতিু থেকে এবং আল্লাহর কালাম থেকে যুক্তি প্রদর্শন কেবলমাত্র তখনই যুক্তিযুক্ত হবে,যখন খোদার অস্তিত্ব,তার কালাম এবং ঐ কালামের বিশ্বাসযোগ্যতা বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তির মাধ্যমে প্রতিপাদিত হবে। যেমন: নবী (সা.) ও ইমামগণের (আ.) বক্তব্যের গ্রহণযোগ্যতা,তাদের নবুয়্যত ও ইমামতের প্রমাণ এবং তাদের বক্তব্যের সত্যতার প্রমাণের উপর নির্ভরশীল।
অতএব মূল নবুয়্যতকেও বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তির মাধ্যমেই প্রমাণ করা উচিৎ-যদিও পবিত্র কোরানের সত্যতা প্রমাণ করার পর আমরা এ বিষয়ের স্বপক্ষে উক্ত ঐশী উৎস থেকে উদ্ধৃতি দিতে পারি। অনুরূপ পুনরুত্থানের (معاد
) বিষয়টিকে ওহীর উদ্ধৃতির মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে -যদিও মূল পুনরুত্থান তত্বটি,বুদ্ধিবৃত্তিক ও উদ্ধৃতিগত (نقلی
) উভয়ভাবেই প্রতিপাদনযোগ্য।
অতএব এ দু’
টি বিষয়কে (নবুয়্যত ও পুনরুত্থান) ব্যাখ্যায়িত করার জন্য সর্বাগ্রে নবুয়্যত ও পুনরুত্থানের মূল বিষয়টিকে বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে। অতঃপর যখন ইসলামের প্রবর্তকের (অর্থাৎ হযরত মুহাম্মদ (সা.) ) নবুয়্যত এবং পবিত্র কোরানের সত্যতা প্রতিপন্ন হবে,তখন এ দু’
টি বিষয়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্যে কোরান এবং সুন্নাহ্ থেকে উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে। কিন্তু পরস্পর স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করাই উল্লেখিত বিষয়দ্বয়ের অনুধাবনের জন্যে অপেক্ষাকৃত বেশী উপযোগী ও হৃদয়গ্রাহী। তাই প্রচলিত নিয়মানুসারে প্রথমে নবুয়্যাত সম্পর্কে আলোচনা করব। অতঃপর পুনরুত্থানের বিষয়টি তুলে ধরব। এখানে উল্লেখ্য যে,যদি কোন কোন ক্ষেত্রে কোন প্রামাণ্য বিষয়ের শরণাপন্ন হতে হয় তবে তাকে মূল বিষয়’
হিসেবে যথাস্থানে প্রতিপাদন করব।
বিষয়বস্তুর আলোচনার উদ্দেশ্য :
এ বিষয়ের আলোচনার প্রধান উদ্দেশ্য এই যে,অস্তিত্বের স্বরূপ সম্পর্কে এবং সঠিক জীবনধারা সম্পর্কে পরিচিতি লাভের জন্যে ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধিবৃত্তি ভিন্ন অপর একটি পন্থা বিদ্যমান,যেখানে ভুল-ত্রুটির কোন অবকাশ নেই। আর এ পন্থাটি হল‘
ওহী’
(وحی
),যা প্রকারান্তরে ঐশী শিক্ষার সাথে সম্পর্কিত এবং তা আল্লাহর কোন কোন নির্বাচিত বান্দাগণের জন্যে নির্ধারিত। সাধারণ মানুষ এ ওহীর স্বরূপ সম্পর্কে অবগত নন। কারণ তারা এরূপ কোন দৃষ্টান্ত স্বীয় অভ্যন্তরে খুজে পান না। তবে বিভিন্ন আলামত ও ইঙ্গিত থেকে ওহীর অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত হন এবং ওহী লাভ সম্পর্কে আম্বিয়াগণের (আ.) দাবির স্বীকৃতি প্রদান করে থাকেন। স্বভাবতঃই যখন কারও উপর ওহীর অবতরণ সম্পর্কে নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায় তখন অন্যান্যদের দায়িত্ব হল তার মাধ্যমে যে নিদের্শ অবতীর্ণ হয়েছে তাকে গ্রহণ করা ও তদানুসারে কর্ম সম্পাদন করা। কেউই এ ওহীর বিরোধিতা করে অব্যাহতি পাবে না,যদি না তা কোন নির্দিষ্ট স্থান,কাল ও পাত্রের জন্যে নির্ধারিত হয়।
অতএব এ খণ্ডের মূল আলোচিত বিষয়গুলো হল:
নবীগণের (আ.) নবুয়্যত ঘোষণার গুরুত্ব,ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত সকল প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে এ ওহীর পবিত্রতার গুরুত্ব,এমনকি মানুষের নিকট পৌঁছান অবস্থায়ও এর অবিকৃতির গুরুত্ব। অন্যকথায়:ওহীর গ্রহণ ও পৌছে দেয়ার ক্ষেত্রে নবীগণের (আ.) পবিত্রতার (عصمت
) অপরিহার্যতা এবং তৎসম অপরের জন্যে তাদের নবুয়্যতের প্রমাণবহ পন্থার অনিবার্যতা।
বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তির মাধ্যমে ওহী ও নবুয়্যতের মূল বিষয়সমূহের সমাধানের পর অন্যান্য বিষয়সমূহের পালা আসে। যেমন:নবীগণের (আ.) সংখ্যাধিক্য,ঐশী গ্রন্থসমূহ,সর্বশেষ নবী ও ঐশী গ্রন্থের নির্ধারণ,তদনুরূপ তার উত্তরাধিকারী নির্বাচন।
কিন্তু এ বিষয়গুলোর সবগুলোকে বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করা সহজসাধ্য নয়। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উদ্ধৃতিগত (نقلی
) ও বিশ্বাসগত (تعبدی
) যুক্তির অবতারণা করা অনিবার্য।
কালামশাস্ত্রে গবেষণার পদ্ধতি :
সাম্প্রতিক আলোচনার ভিত্তিতে দর্শন ও কালামশাস্ত্রের মধ্যে পার্থক্যগুলো সুস্পষ্ট হয়েছে। কারণ দর্শন শুধুমাত্র ঐ সকল বিষয় সম্পর্কেই আলোচনা করে থাকে,যেগুলো বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তির মাধ্যমে প্রতিপাদনযোগ্য। অপরদিকে কালামশাস্ত্র ঐ বিষয়গুলোকেই সমন্বিত করে,যেগুলো উদ্ধৃতিগত ও বিশ্বাসগত যুক্তির সাহায্য ব্যতীত প্রতিপাদন যোগ্য নয়।
অন্যকথায় : দর্শন ও কালামশাস্ত্রের আলোচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে সম্পর্ক হল,ছেদক সম্পর্ক
(العموم و الخصوص المطلق
)। অর্থাৎ দর্শন ও কালামশাস্ত্রের আলোচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে কিছু কিছু অভিন্ন হওয়া সত্বেও (যেগুলো বুদ্ধিবৃত্তিক প্রক্রিয়ায় প্রমাণ করা হয়) উভয়েরই কিছু কিছু স্বতন্ত্র আলোচ্য বিষয় রয়েছে। তবে দর্শনের স্বতন্ত্র আলোচ্য বিষয়গুলো বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতিতেই প্রমাণিত হয়,যা কালামশাস্ত্রের অন্তর্গত আলোচ্য বিষয়ের ব্যতিক্রম। কারণ কালামশাস্ত্রের বিষয়গুলো উদ্ধৃতিগত ও বিশ্বাসগত যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণিত হয়। মোদ্দাকথা কালামশাস্ত্রের গবেষণা পদ্ধতি হল যুগ্ম ও সমম্বিত পদ্ধতি। এ শাস্ত্রে বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতি যেমন প্রয়োগ হয়,তেমনি বিশ্বাসগত পদ্ধতিও ব্যবহৃত হয়।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে,দর্শন ও কালামশাস্ত্রের মধ্যে দু’
টি মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। যথা :
১। উভয়েই অভিন্ন আলোচ্য বিষয়ের (যেমন : খোদা পরিচিতি) অধিকারী হলেও কিছু কিছু স্বতন্ত্র আলোচ্য বিষয়ের অধিকারী,যেগুলো সংশ্লিষ্ট শাস্ত্র ভিন্ন অপরটির আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত হয় না।
২। দর্শনশাস্ত্রে সকল বিষয়কে বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতিতে প্রমাণ করা হয়ে থাকে,যা কালামশাস্ত্রের ব্যতিক্রম -যেখানে কিছু কিছু বিষয় (যেমন : দর্শন ও কালামশাস্ত্রের অভিন্ন বিষয়সমূহ) বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতিতে,কিছু কিছু বিষয় (যেমন : ইমামত) উদ্ধৃতিগত পদ্ধতিতে,আবার কিছু কিছু বিষয় (যেমন : পুনরুত্থানের মূল বিষয়টি) উপরোল্লিখিত এ উভয় পদ্ধতিতেই প্রমাণ করা হয়ে থাকে।
স্মরণ থাকা প্রয়োজন যে,কালামশাস্ত্রের স্বতন্ত্র বিষয়সমূহ,যেগুলো উদ্ধৃতগত ও বিশ্বাসগত পদ্ধতিতে প্রমাণিত হয়,সেগুলো এক শ্রেণীর নয়। বরং একশ্রেণীর বিষয়সমূহ,বিশেষকরে রাসূল (সা.) এর উক্তি আচার-ব্যবহারের (সুন্নত) সত্যতা,প্রত্যক্ষভাবে পবিত্র কোরানের আয়াতসমূহের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে (অবশ্য বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলের মাধ্যমে পবিত্র কোরানের সত্যতা প্রমাণিত হওয়ার পর)। অতঃপর অপর কিছু বিষয়,যেমন : হযরত রাসূল (সা.) এর উত্তরাধিকারী নির্বাচন ও পবিত্র ইমামগণের (আ.) বক্তব্যের সঠিকত্ব,মহানবী (সা.) এর বক্তব্য থেকে প্রমাণিত হয়। এ ছাড়া অন্য আর এক শ্রেণীর বিষয়সমূহ,ইমামগণের (আ.) বক্তব্য থেকে উদ্ধৃতি প্রদানের মাধ্যমে প্রমাণ করা হয়ে থাকে।
এটা স্বতঃসিদ্ধ যে,উদ্ধৃতিগত যুক্তির মাধ্যমে যে ফলাফল অর্জিত হয় তা একমাত্র তখনই গ্রহণযোগ্য হবে যখন এগুলোর সনদ চূড়ান্ত ও সুস্পষ্ট হবে।