আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)

আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)0%

আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড) লেখক:
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ: নবুয়্যত

আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ মুহাম্মদ তাকী মিসবাহ্ ইয়াযদী
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ:

ভিজিট: 16122
ডাউনলোড: 4035

পাঠকের মতামত:

বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 32 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 16122 / ডাউনলোড: 4035
সাইজ সাইজ সাইজ
আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)

আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)

লেখক:
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বাংলা

আক্বায়েদ শিক্ষা

দ্বিতীয় খণ্ড

মূলঃ আয়াতুল্লাহ্ মুহাম্মদ তাকী মিসবাহ্ ইয়াযদী

অনুবাদঃ মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন

প্রকাশনায়ঃ

আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা

নবুয়্যতের প্রসংগ কথা

দ্বিতীয় খণ্ড

১ম পাঠ

নবুয়্যতের প্রসংগ কথা

ভূমিকা:

আমরা ইতিপূর্বে জেনেছি যে,একজন বিচক্ষণ মানুষের মত জীবন-যাপন করার নিমিত্তে যে সকল মৌলিকতম বিষয়সমূহের সমাধান করা প্রত্যেক বুদ্ধিমান ও বিবেকবান মানুষের জন্যেই অপরিহার্য সেগুলো নিম্বরূপ:

১। মানুষ ও বিশ্বজগতের অস্তিত্ব কার থেকে ? এবং এ গুলোর নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব কার ?

২। জীবনের পরিশেষ এবং মানুষের চূড়ান্ত গন্তব্য কোথায় ?

৩। প্রকৃত সৌভাগ্য ও পূর্ণতালাভের জন্যে সঠিক পথের সন্ধান প্রাপ্তির উপর মানুষের যে নির্ভরশীলতা,তা কোন বিশ্বস্ত মাধ্যমে অর্জিত হয়ে থাকে? এবং তা কার নিয়ন্ত্রণাধীন ?

এ প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর সে মৌলিক ভিত্তিত্রয়ে (তাওহীদ,নবুয়্যত,পুনরুত্থান বা ক্বিয়ামত) বিদ্যমান,যেগুলো প্রতিটি ঐশী ধর্মেরই মৌলিকতম বিশ্বাসরূপে পরিগণিত ।

এ পুস্তকের প্রথম খণ্ডে আমরা খোদা পরিচিতির উপর আলোচনা করেছি এবং এ উপসংহারে পৌঁছেছি যে,সকল সৃষ্ট বিষয়ই একক সৃষ্টিকর্তার নিকট থেকে অস্তিত্ব লাভ করেছে এবং সকলেই তারই প্রজ্ঞাপূর্ণ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে;কেউই কোন অবস্থাতে বা কোন কর্মে বা কোন স্থানে অথবা কালেই তার অমুখাপেক্ষী নয়।

এ বিষয়টিকে আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলের মাধ্যমে প্রমাণ করেছিলাম এবং উল্লেখ করেছিলাম যে,এ ধরনের বিষয়বস্তুকে শুধুমাত্র বুদ্ধিবৃত্তিকভাবেই প্রমাণ করা যায়। কারণ বিশ্বাসগত পরিচিতিু থেকে এবং আল্লাহর কালাম থেকে যুক্তি প্রদর্শন কেবলমাত্র তখনই যুক্তিযুক্ত হবে,যখন খোদার অস্তিত্ব,তার কালাম এবং ঐ কালামের বিশ্বাসযোগ্যতা বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তির মাধ্যমে প্রতিপাদিত হবে। যেমন: নবী (সা.) ও ইমামগণের (আ.) বক্তব্যের গ্রহণযোগ্যতা,তাদের নবুয়্যত ও ইমামতের প্রমাণ এবং তাদের বক্তব্যের সত্যতার প্রমাণের উপর নির্ভরশীল।

অতএব মূল নবুয়্যতকেও বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তির মাধ্যমেই প্রমাণ করা উচিৎ-যদিও পবিত্র কোরানের সত্যতা প্রমাণ করার পর আমরা এ বিষয়ের স্বপক্ষে উক্ত ঐশী উৎস থেকে উদ্ধৃতি দিতে পারি। অনুরূপ পুনরুত্থানের (معاد ) বিষয়টিকে ওহীর উদ্ধৃতির মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে -যদিও মূল পুনরুত্থান তত্বটি,বুদ্ধিবৃত্তিক ও উদ্ধৃতিগত (نقلی ) উভয়ভাবেই প্রতিপাদনযোগ্য।

অতএব এ দু টি বিষয়কে (নবুয়্যত ও পুনরুত্থান) ব্যাখ্যায়িত করার জন্য সর্বাগ্রে নবুয়্যত ও পুনরুত্থানের মূল বিষয়টিকে বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে। অতঃপর যখন ইসলামের প্রবর্তকের (অর্থাৎ হযরত মুহাম্মদ (সা.) ) নবুয়্যত এবং পবিত্র কোরানের সত্যতা প্রতিপন্ন হবে,তখন এ দু টি বিষয়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্যে কোরান এবং সুন্নাহ্ থেকে উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে। কিন্তু পরস্পর স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করাই উল্লেখিত বিষয়দ্বয়ের অনুধাবনের জন্যে অপেক্ষাকৃত বেশী উপযোগী ও হৃদয়গ্রাহী। তাই প্রচলিত নিয়মানুসারে প্রথমে নবুয়্যাত সম্পর্কে আলোচনা করব। অতঃপর পুনরুত্থানের বিষয়টি তুলে ধরব। এখানে উল্লেখ্য যে,যদি কোন কোন ক্ষেত্রে কোন প্রামাণ্য বিষয়ের শরণাপন্ন হতে হয় তবে তাকে মূল বিষয় হিসেবে যথাস্থানে প্রতিপাদন করব।

বিষয়বস্তুর আলোচনার উদ্দেশ্য :

এ বিষয়ের আলোচনার প্রধান উদ্দেশ্য এই যে,অস্তিত্বের স্বরূপ সম্পর্কে এবং সঠিক জীবনধারা সম্পর্কে পরিচিতি লাভের জন্যে ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধিবৃত্তি ভিন্ন অপর একটি পন্থা বিদ্যমান,যেখানে ভুল-ত্রুটির কোন অবকাশ নেই। আর এ পন্থাটি হল ওহী (وحی ),যা প্রকারান্তরে ঐশী শিক্ষার সাথে সম্পর্কিত এবং তা আল্লাহর কোন কোন নির্বাচিত বান্দাগণের জন্যে নির্ধারিত। সাধারণ মানুষ এ ওহীর স্বরূপ সম্পর্কে অবগত নন। কারণ তারা এরূপ কোন দৃষ্টান্ত স্বীয় অভ্যন্তরে খুজে পান না। তবে বিভিন্ন আলামত ও ইঙ্গিত থেকে ওহীর অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত হন এবং ওহী লাভ সম্পর্কে আম্বিয়াগণের (আ.) দাবির স্বীকৃতি প্রদান করে থাকেন। স্বভাবতঃই যখন কারও উপর ওহীর অবতরণ সম্পর্কে নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায় তখন অন্যান্যদের দায়িত্ব হল তার মাধ্যমে যে নিদের্শ অবতীর্ণ হয়েছে তাকে গ্রহণ করা ও তদানুসারে কর্ম সম্পাদন করা। কেউই এ ওহীর বিরোধিতা করে অব্যাহতি পাবে না,যদি না তা কোন নির্দিষ্ট স্থান,কাল ও পাত্রের জন্যে নির্ধারিত হয়।

অতএব এ খণ্ডের মূল আলোচিত বিষয়গুলো হল:

নবীগণের (আ.) নবুয়্যত ঘোষণার গুরুত্ব,ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত সকল প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে এ ওহীর পবিত্রতার গুরুত্ব,এমনকি মানুষের নিকট পৌঁছান অবস্থায়ও এর অবিকৃতির গুরুত্ব। অন্যকথায়:ওহীর গ্রহণ ও পৌছে দেয়ার ক্ষেত্রে নবীগণের (আ.) পবিত্রতার (عصمت ) অপরিহার্যতা এবং তৎসম অপরের জন্যে তাদের নবুয়্যতের প্রমাণবহ পন্থার অনিবার্যতা।

বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তির মাধ্যমে ওহী ও নবুয়্যতের মূল বিষয়সমূহের সমাধানের পর অন্যান্য বিষয়সমূহের পালা আসে। যেমন:নবীগণের (আ.) সংখ্যাধিক্য,ঐশী গ্রন্থসমূহ,সর্বশেষ নবী ও ঐশী গ্রন্থের নির্ধারণ,তদনুরূপ তার উত্তরাধিকারী নির্বাচন।

কিন্তু এ বিষয়গুলোর সবগুলোকে বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করা সহজসাধ্য নয়। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উদ্ধৃতিগত (نقلی ) ও বিশ্বাসগত (تعبدی ) যুক্তির অবতারণা করা অনিবার্য।

কালামশাস্ত্রে গবেষণার পদ্ধতি :

সাম্প্রতিক আলোচনার ভিত্তিতে দর্শন ও কালামশাস্ত্রের মধ্যে পার্থক্যগুলো সুস্পষ্ট হয়েছে। কারণ দর্শন শুধুমাত্র ঐ সকল বিষয় সম্পর্কেই আলোচনা করে থাকে,যেগুলো বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তির মাধ্যমে প্রতিপাদনযোগ্য। অপরদিকে কালামশাস্ত্র ঐ বিষয়গুলোকেই সমন্বিত করে,যেগুলো উদ্ধৃতিগত ও বিশ্বাসগত যুক্তির সাহায্য ব্যতীত প্রতিপাদন যোগ্য নয়।

অন্যকথায় : দর্শন ও কালামশাস্ত্রের আলোচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে সম্পর্ক হল,ছেদক সম্পর্ক (العموم و الخصوص المطلق )। অর্থাৎ দর্শন ও কালামশাস্ত্রের আলোচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে কিছু কিছু অভিন্ন হওয়া সত্বেও (যেগুলো বুদ্ধিবৃত্তিক প্রক্রিয়ায় প্রমাণ করা হয়) উভয়েরই কিছু কিছু স্বতন্ত্র আলোচ্য বিষয় রয়েছে। তবে দর্শনের স্বতন্ত্র আলোচ্য বিষয়গুলো বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতিতেই প্রমাণিত হয়,যা কালামশাস্ত্রের অন্তর্গত আলোচ্য বিষয়ের ব্যতিক্রম। কারণ কালামশাস্ত্রের বিষয়গুলো উদ্ধৃতিগত ও বিশ্বাসগত যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণিত হয়। মোদ্দাকথা কালামশাস্ত্রের গবেষণা পদ্ধতি হল যুগ্ম ও সমম্বিত পদ্ধতি। এ শাস্ত্রে বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতি যেমন প্রয়োগ হয়,তেমনি বিশ্বাসগত পদ্ধতিও ব্যবহৃত হয়।

পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে,দর্শন ও কালামশাস্ত্রের মধ্যে দু টি মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। যথা :

১। উভয়েই অভিন্ন আলোচ্য বিষয়ের (যেমন : খোদা পরিচিতি) অধিকারী হলেও কিছু কিছু স্বতন্ত্র আলোচ্য বিষয়ের অধিকারী,যেগুলো সংশ্লিষ্ট শাস্ত্র ভিন্ন অপরটির আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত হয় না।

২। দর্শনশাস্ত্রে সকল বিষয়কে বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতিতে প্রমাণ করা হয়ে থাকে,যা কালামশাস্ত্রের ব্যতিক্রম -যেখানে কিছু কিছু বিষয় (যেমন : দর্শন ও কালামশাস্ত্রের অভিন্ন বিষয়সমূহ) বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতিতে,কিছু কিছু বিষয় (যেমন : ইমামত) উদ্ধৃতিগত পদ্ধতিতে,আবার কিছু কিছু বিষয় (যেমন : পুনরুত্থানের মূল বিষয়টি) উপরোল্লিখিত এ উভয় পদ্ধতিতেই প্রমাণ করা হয়ে থাকে।

স্মরণ থাকা প্রয়োজন যে,কালামশাস্ত্রের স্বতন্ত্র বিষয়সমূহ,যেগুলো উদ্ধৃতগত ও বিশ্বাসগত পদ্ধতিতে প্রমাণিত হয়,সেগুলো এক শ্রেণীর নয়। বরং একশ্রেণীর বিষয়সমূহ,বিশেষকরে রাসূল (সা.) এর উক্তি আচার-ব্যবহারের (সুন্নত) সত্যতা,প্রত্যক্ষভাবে পবিত্র কোরানের আয়াতসমূহের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে (অবশ্য বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলের মাধ্যমে পবিত্র কোরানের সত্যতা প্রমাণিত হওয়ার পর)। অতঃপর অপর কিছু বিষয়,যেমন : হযরত রাসূল (সা.) এর উত্তরাধিকারী নির্বাচন ও পবিত্র ইমামগণের (আ.) বক্তব্যের সঠিকত্ব,মহানবী (সা.) এর বক্তব্য থেকে প্রমাণিত হয়। এ ছাড়া অন্য আর এক শ্রেণীর বিষয়সমূহ,ইমামগণের (আ.) বক্তব্য থেকে উদ্ধৃতি প্রদানের মাধ্যমে প্রমাণ করা হয়ে থাকে।

এটা স্বতঃসিদ্ধ যে,উদ্ধৃতিগত যুক্তির মাধ্যমে যে ফলাফল অর্জিত হয় তা একমাত্র তখনই গ্রহণযোগ্য হবে যখন এগুলোর সনদ চূড়ান্ত ও সুস্পষ্ট হবে।

২য় পাঠ

মানুষের জন্যে ওহী ও নবুয়্যতের প্রয়োজনীয়তা

নবীগণকে প্রেরণের আবশ্যকতা :

এ বিষয়টি নবুয়্যতের আলোচনার মৌলিকতম বিষয় বলে পরিগণিত। এ বিষয়টিকে প্রমাণ করার জন্যে এমন একটি দলিলের অবতারণা করতে হবে,যা নিম্মলিখিত ভূমিকাত্রয়ের উপর নির্ভরশীল :

১। মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য হল এই যে,স্বাধীন নির্বাচনাধীন কর্মকাণ্ড ও স্বীয় উৎকর্ষের পথ অতিক্রমের মাধ্যমে এমন চূড়ান্ত পূর্ণতা অর্জন করা,যা একমাত্র স্বাধীন নির্বাচনাধীন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই অর্জিত হয়। অর্থাৎ মানুষকে এ জন্যেই সৃষ্টি করা হয়েছে যে,সে মহান আল্লাহর উপাসনা ও আনুগত্যের মাধ্যমে তার রহমত ও অনুগ্রহভাজন হতে পারবে,যা পরিপূর্ণ মানুষের জন্যে নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রভুর প্রজ্ঞাপূর্ণ ইচ্ছা প্রকৃতপক্ষে মানুষের পূর্ণতা ও সৌভাগ্যকে সমন্বিত করেছে। কিন্তু মানুষের এ সমুন্নত ও অমূল্য সৌভাগ্য যেখানে স্বাধীন নির্বাচনাধীন কর্মকাণ্ড ব্যতীত অর্জিত হয় না,সেখানে মানুষের জীবনপথ দু ধারার সম্মুখে অবস্থান লাভ করেছে,যাতে তার জন্যে নির্বাচন ও মনোনয়নের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় এবং স্বভাবতঃই এদের একটি হল দুর্দশা ও শাস্তির পথ,যা সঙ্গত কারণেই (মৌলিকভাবে নয়) প্রভুর ইরাদার বিষয়ে পরিণত হয়।

এ ভূমিকাটি প্রভুর প্রজ্ঞা ও আদলের (প্রথম খণ্ডের ১১ ও ২০ নং পাঠ) আলোচনায় প্রসঙ্গতঃ সুস্পষ্টরূপে বর্ণিত হয়েছে।

২। সচেতনভাবে স্বাধীন নির্বাচনের জন্যে,কর্ম সম্পাদনের ক্ষমতা ও বাস্তবে ঐ সকল কর্মকাণ্ডের উপযুক্ত ক্ষেত্রের যোগান এবং ঐ গুলোর প্রতি আভ্যন্তরীণ ঝোঁক বা আকর্ষণ ছাড়াও সুকর্ম ও কুকর্ম,উপযুক্ত ও অনুপযুক্ত পথের সঠিক পরিচিতির প্রয়োজন। মানুষ তখনই স্বীয় উৎকর্ষের পথকে স্বাধীন ও সচেতনভাবে নির্বাচন করতে পারবে,যখন এর উদ্দেশ্য ও এ উদ্দেশ্যে পৌছার পথ সম্পর্কে এবং এর উত্থান-পতন,ভাঙ্গা-গড়া ও ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে অবগত থাকবে। অতএব প্রভুর প্রজ্ঞার দাবি হল,উল্লেখিত পরিচিতিসমূহ সম্পর্কে অবহিতকরণের জন্যে উপযুক্ত মাধ্যমকে মানুষের অধিকারে প্রদান করা। নতুবা এমন কারও মত হবে যে,কোন অতিথিকে অতিথিশালায় নিমন্ত্রণ করল,অথচ ঐ অতিথিশালায় পৌছার পথ সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দিল না। আর এ ধরনের আচরণ নিঃসন্দেহে প্রজ্ঞার পরিপন্থী ও অনাকাংখিত বলে পরিগণিত হবে।

এ ভূমিকাটির সুস্পষ্ট এবং অধিকতর ব্যখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই ।

৩। ইন্দ্রিয় ও জ্ঞানের সাহায্যে অর্জিত মানুষের সাধারণ ও পারিপার্শিক পরিচিতি,জীবনের প্রয়োজনসমূহ মিটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও সকল প্রকারের ব্যক্তিগত ও সামাজিক,বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক,ইহলৌকিক ও পারলৌকিক প্রকৃত কল্যাণ ও পূর্ণতার পথের শনাক্তকরণের জন্যে যথেষ্ট নয়। অতএব এ ঘাটতি পূরণের জন্যে যদি অপর কোন পথ না থাকত,তবে মানব সৃষ্টির পশ্চাতে প্রভুর উদ্দেশ্যের প্রতিফলন ঘটত না।

উপরোক্ত তিনটি ভূমিকা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌছতে পারি যে,সার্বিক উৎকর্ষের পথ পরিচিতির জন্যে,ইন্দ্রিয় ও জ্ঞান ছাড়াও অপর একটি উপায় মানুষের অধিকারে অর্পণ করা প্রভুর প্রজ্ঞা বা হিকমতেরই দাবি;যাতে মানব সম্প্রদায় প্রত্যক্ষভাবে অথবা কোন ব্যক্তির মাধ্যমে কিংবা অন্য কোন ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে,এ থেকে লাভবান হতে পারে আর তা হল ওহীর মাধ্যম,যা নবীগণের (সা.) অধিকারে প্রদান করা হয়েছে এবং তারা প্রত্যক্ষভাবে ও অন্যান্যরা তাদের মাধ্যমে তা থেকে লাভবান হয়ে থাকে। আর এভাবে মানুষ চূড়ান্ত পূর্ণতা ও কল্যাণের জন্যে যা কিছু প্রয়োজন সে সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে।

এ ভূমিকাত্রয়ের মধ্যে শেষোক্ত ভূমিকাটি সম্পর্কে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ থাকতে পারে। ফলে ঐ বিষয়টি সম্পর্কে আরও অধিক ব্যাখ্যা প্রদানের প্রয়োজন মনে করছি,যাতে সার্বিক পূর্ণতার পথে মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ও ওহীর উপর তার নির্ভরশীলতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণার সৃষ্টি হয়।

মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা :

সার্বিকভাবে জীবনের সঠিক কর্মসূচীর শনাক্তকরণের জন্যে মানব অস্তিত্বের প্রারম্ভ ও তার অস্তিত্বের জন্যে সম্পন্ন ক্রিয়াদি,অন্যান্য অস্তিত্বশীলের সাথে তার যে সম্বদ্ধ,একই শ্রেণীর ও অন্যান্য শ্রেণীর সৃষ্ট বিষয়াদির সাথে তার যে সম্পর্ক বিদ্যমান এবং তার কল্যাণ ও অকল্যাণের ক্ষেত্রে এ বহুবিধ সম্পর্কের যে প্রভাব ইত্যাদি সকল কিছু সম্পর্কে অবগত হওয়া অপরিহার্য। অনুরূপ বিভিন্ন প্রকার লাভ-ক্ষতি ও কল্যাণ-অকল্যাণ ইত্যাদির জ্ঞান লাভ ও মূল্যায়নের প্রয়োজন,যাতে শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে বৈচিত্রময় বিশেষত্বের অধিকারী এবং বিভিন্ন পরিবেশ ও সমাজে বসবাসকারী মিলিয়ন মিলিয়ন সংখ্যক মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট জ্ঞান লাভ করা যায়। কিন্তু এ সমস্ত বিষয়াদি সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ একজন বা কয়েকজনের জন্যে শুধু দুঃসাধ্যই নয় বরং শত-সহস্র সংখ্যক মানবিক বিভাগে বিশেষজ্ঞ সমষ্টিও,এ ধরণের কোন জটিল সূত্রের আবিষ্কার এবং সুনির্দিষ্ট ও সংরক্ষিত নিয়মরূপে উপস্থাপন করতে অক্ষম যাতে মানুষের ব্যক্তিগত,সামাজিক,বস্তুগত,মানসিক,ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণের নিশ্চয়তা বিধিত হতে পারে এবং কল্যাণ ও অকল্যাণের সাংঘর্ষিক পর্যায়ে (যা অধিকাংশ সময়ই পরিদৃষ্ট হয়) অপেক্ষাকৃত গুরুত্বপূর্ণটি অগ্রাধিকার পেতে পারে। মানব সভ্যতার দীর্ঘ ইতিহাসে নিয়ম-নীতির পরিবর্তন ধারা শত-সহস্র বিশেষজ্ঞ ও গবেষকের সহস্রাব্দীর প্রচেষ্টা ও গবেষণার ফলেও যে অদ্যাবধি সঠিক,পরিপূর্ণ ও সার্বিক নিয়ম-ব্যবস্থার আবিষ্কারে অপারগ তা তারই প্রমাণবহ। অনুনরূপ নীতি প্রণয়নের বিশ্বসভায় সর্বদা নিজেদের গড়া বিধানের দুর্বলতা সম্পর্কে অবগত হয় এবং কোন না কোন ধারার রহিতকরণ,পরিবর্তন,পরিবর্ধন বা ব্যাখ্যার মাধ্যমে সংস্করণ ও পূর্ণতা বিধানে প্রয়াসী হয়।

আমাদেরকে ভুলে গেলে চলবেনা যে,এ (প্রচলিত) বিধানসমূহের প্রণয়নেও প্রভুর নিয়ম ব্যবস্থা ও ঐশী বিধানের যথেষ্ট শরণাপন্ন হতে হয়েছে। অনুরূপ লক্ষ্যণীয় যে,পৃথিবীর সকল আইনবিদ ও নীতিনির্ধারকের সকল প্রচেষ্টা ও গুরুত্ব শুধুমাত্র পার্থিব ও সামাজিক কল্যাণকে ঘিরেই ছিল ও আছে এবং কখনোই পারলৌকিক কল্যাণ অথবা পার্থিব ও বস্তুগত লাভ-ক্ষতির বিষয়সমূহ বিবেচিত হয়নি ও হয় না। আবার এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে বিবেচনা করতে চাইলেও কখনোই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌছতে পারেননি। কারণ বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে পার্থিব ও বস্তুগত কল্যাণ-অকল্যাণকে একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত চিহ্নিত করা গেলেও আধ্যাত্মিক ও পারলৌকিক কল্যাণের বিষয়াদি ঐন্দ্রিক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নির্ধারণযোগ্য নয়। তদনুরূপ ঐ গুলোর যথাযথ মূল্যায়ন এবং বস্তুগত ও পার্থিব কল্যাণের সাথে বিরোধপূর্ণ অবস্থায় অপেক্ষাকৃত গুরুত্বপূর্ণটিকে শানাক্তকরণও সম্ভব নয়।

এানব প্রণীত প্রচলিত নিয়ম-নীতির আলোকে শত-সহস্রাব্দী পূর্ব মানুষের জ্ঞান সম্পর্কে কার্যকর ধারণা পাওয়া যেতে পারে এবং এ চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যেতে পারে যে,প্রাথমিক যুগের মানুষ জীবনের সঠিক কর্মসূচী বিধানের ক্ষেত্রে আধুনিক যুগের মানুষের চেয়ে অনেক অক্ষম ছিল। আবার যদি মনেও করা হয় যে,আধুনিক যুগের মানুষ সহস্র সহস্রাব্দীর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সঠিক,পূর্ণ ও ব্যাপক বিধান ব্যবস্থার জ্ঞান লাভে সক্ষম হয়েছে এবং এ বিধান ব্যবস্থাই পারলৌকিক ও অনন্ত সৌভাগ্যের নিশ্চয়তা দিতে সক্ষম। তথাপি এ প্রশ্নের অবকাশ থাকে যে,ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় বিলয়ন বিলিয়ন মানুষকে তাদের অজ্ঞতার উপর ছেড়ে দেয়া কিরূপে প্রভুর প্রজ্ঞার সাথে ও মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে ?

উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে,সূচনালগ্ন থেকে শেষাবধি মানব সৃষ্টির পশ্চাতে বিদ্যমান উদ্দেশ্য তখনই বাস্তবায়নযোগ্য হবে যখন জীবনের বাস্তবতা এবং ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত দায়িত্ব সম্পর্কে জ্ঞান লাভের জন্যে ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধিবৃত্তি ভিন্ন অপর একটি মাধ্যমের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকবে। আর তা ওহী ব্যতীত অন্য কিছু নয়।

প্রসঙ্গক্রমে সুস্পষ্ট হয়েছে যে,মানব সম্প্রদায়ের প্রথম ব্যক্তিও আল্লাহর নবী হবেন। যাতে জীবনের সঠিক কর্মসূচী সম্পর্কে তিনি পরিচিতি লাভ করতে পারেন এবং সৃষ্টির উদ্দেশ্য স্বয়ং তার ক্ষেত্রেও বাস্তবায়িত হয় ও তৎপর অন্যান্য মানুষ তার মাধ্যমে হিদায়াত প্রাপ্ত হয়। আর এটা উল্লেখিত প্রমাণেরই দাবি।

নবীগণকে প্রেরণের উপকারিতা :

আল্লাহর নবীগণ মানুষের প্রকৃত পূর্ণতার সঠিক পথনির্দেশনা প্রদান এবং ওহী লাভ ও মানুষের নিকট তার প্রচার ছাড়াও মানুষের উৎকর্ষ সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। এগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হল :

১। এমন অনেক বিষয় রয়েছে যে,মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি সেগুলোকে অনুধাবন করতে সক্ষম। কিন্তু হয় যথেষ্ট সময় ও অভিজ্ঞতার অভাবে অথবা বস্তুগত বিষয়াদির প্রতি গুরুত্বারোপ ও পাশবিক প্রবৃত্তির আধিক্যের কারণে এগুলো সম্পর্কে বিস্মৃত ও অজ্ঞতায় পতিত হয় কিংবা কুশিক্ষা ও অপপ্রচারের কারণে সেগুলো লোকচক্ষুর আড়ালে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এ ধরনের বিষয়াদিও নবীগণ কর্তৃক বিবৃত হয় এবং উত্তর উত্তর স্মরণ করিয়ে দেয়ার মাধ্যমে সে গুলোর সার্বিক বিস্মৃতিতে বাধা প্রদান করা হয়। একই সাথে সঠিক ও যৌক্তিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ভ্রমাত্মক যুক্তির অবতারণা ও কুশিক্ষাকে প্রতিরোধ করা হয়।

এখানেই নবীগণকে মুযাক্যির (مذکر = যিনি স্মরণ করিয়ে দেন),নাযির (نذیر = ভয় প্রদর্শনকারী) এবং পবিত্র কোরানকে যিকর (ذکر =স্মরণ),যিকরা (ذکری ) ও যিকরাহ (ذکرة ) নামকরণের সার্থকতা প্রতিপন্ন হয়ে থাকে।

لیستأدوهم میثاق فطرته و یذکّر و هم منسیّ نعمة و یحتجّوا علیهم بالتبلیغ

আমীরুল মু'মিনীন হযরত আলী (আ.) নবুয়্যতের রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে বলেন : অর্থাৎ মহান আল্লাহ স্বীয় পয়গাম্বরগণকে উত্তর উত্তর প্রেরণ করেছেন যাতে ফিতরাতের বিনিময়ে মানুষকে সৃষ্টিকর্তার আনুগত্যের জন্য আহ্বান করতে পারেন,অজস্র বিস্মৃত নিয়ামতের কথা তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে পারেন এবং প্রচার ও সত্য বর্ণনা করে তাদের প্রতি দায়িত্ব সম্পাদন করতে পারেন।

২। মানুষের পরিচর্যা,বিকাশ ও উৎকর্ষের ক্ষেত্রে আচরণগত আদর্শের অস্তিত্ব হল একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাহী,যার গুরুত্ব মনোবিজ্ঞানে প্রমাণিত হয়েছে। আল্লাহর নবীগণ পরিপূর্ণ মানুষ ও

ঐশী প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব হিসেবে সর্বোত্তমভাবে এ দায়িত্ব পালন করেন এবং মানুষকে বিভিন্ন মুখি শিক্ষা ও জ্ঞানদান ছাড়াও তাদের প্রশিক্ষণ ও পরিশুদ্ধিতেও ভূমিকা রাখেন। আমরা জানি যে,পবিত্র কোরানে প্রশিক্ষণ ও পরিশুদ্ধি শব্দদ্বয় যুগ্মভাবে স্মরণ করা হয়েছে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে পরিশুদ্ধিকে (تذکیه ),এমনকি প্রশিক্ষণের (تعلیم ) উপরও অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।

৩। মানব সমাজে নবীগণের উপস্থিতির অপর একটি সুফল হল,তারা উপযুক্ত পরিস্থিতিতে মানুষের সামাজিক,রাজনৈতিক ও আইনগত নেতৃত্ব প্রদান করে থাকেন। নিঃসন্দেহে পবিত্র ব্যক্তিত্বের নেতৃত্ব হল,কোন সমাজের জন্যে মহান প্রভুর এক পরম অনুগ্রহ,যার মাধ্যমে নানা প্রকার সামাজিক অসঙ্গতি ও অনাচারের প্রতিরোধ করা হয় এবং সমাজ বিরোধ,বিভ্রান্তি ও বিশৃংখলতা থেকে মুক্তি পায়। আর এ ভাবেই সমাজ বাঞ্ছিত পূর্ণতা ও উৎকর্ষের দিকে পরিচালিত হয়।