১৬তম পাঠ
ইমামত
ভূমিকা :
মহানবী (সা.) এর মদীনায় প্রত্যাবর্তনের পর এ শহরের জনগণের স্বতস্ফূর্ত সমর্থন ( যার ফলে সম্মানার্থে আনসার নামে ভূষিত হয়েছিলন) এবং মক্কা থেকে হিজরতকারী মুসলমানদের (মুহাজির) নিয়ে একটি ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা করে এর পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। আর মাসজিদুন্নাবী একদিকে যেমন উপসনালয় ও ঐশী রিসালাতের প্রচার,প্রশিক্ষণ ও আধ্যাত্মিক পরিচর্যার কেন্দ্র ছিল। অপরদিকে তেমনি মুহাজির ও সমাজের বঞ্চিত,নিগৃহীত মানুষের আশ্রয়স্থলও ছিল। এ মসজিদেই তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন ও জীবিকা নির্বাহের কর্মসূচী নেয়া হত। এখানেই বিচার-বিবাদের মীমাংসা এবং সামরিক সিদ্ধান্ত,যুদ্ধের জন্যে সৈন্য প্রেরণ,যুদ্ধের পৃষ্ঠপোষকতা ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গৃহীত হত। মোটকথা মানুষের ধর্মীয় ও পার্থিব সকল বিষয় মহানবী (সা.)-এর মাধ্যমেই পরিচালিত হত। মুসলমনরাও হযরত (সা.)-এর আদেশের আজ্ঞাবহ হওয়াটা নিজেদের নৈতিক দায়িত্ব মনে করতেন। কারণ মহান আল্লাহ রাজনৈতিক বিচার ও রাষ্ট্রীয় বিষয়ে হযরত (সা.)-এর নিঃশর্ত আনুগত্য করার আদেশ প্রদান
ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহেও তার আজ্ঞাবহ হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
অন্য কথায় : মহানবী (সা.) নবুয়্যত,রিসালাত এবং ইসলামের আহকাম প্রচার ও প্রশিক্ষণের দায়িত্ব ছাড়াও ইসলামী সমাজের নেতৃত্বের দয়িত্বে ও নিয়োজিত ছিলেন। বিচারকার্য ও সামরিক নেতৃত্ব ইত্যাদি এ থেকেই উৎকলিত হত। যেমনিকরে ইসলামে ইবাদত ও আচরণগত দায়িত্ব ছাড়াও রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক ও অধিকারগত ইত্যাদি কর্তব্যও বিদ্যমান,তেমনিকরে ইসলামের নবী (সা.) প্রচার,প্রশিক্ষণ ও (আধ্যত্মিক) পরিচর্যার দায়িত্ব ছাড়াও মহান আল্লাহর নিকট থেকে ঐশী বিধান প্রয়োগের ক্ষেত্রেও দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং সকল প্রকার প্রশাসনিক মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।
এটা অনস্বীকার্য যে,যদি কোন দ্বীন বিশ্বের শেষাবধি সকল প্রকার সামাজিক কর্তব্য পালনের দাবি করে তবে এ ধরনের বিষয়াদি সম্পর্কে উদাসীন থাকতে পারে না। অনুরূপ যে সমাজ এ দ্বীনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়,সে সমাজ এ ধরনের কোন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তব্য থেকে নিরুদ্দিষ্ট থাকবে,যা ইমামত নামে অভিষিক্ত,তাও হতে পারে না।
কিন্তু কথা হল মহানবী (সা.) এর তিরোধানের পর,কে এ দায়িত্ব লাভ করবেন ? এবং তা কার কাছ থেকে দায়িত্ব প্রাপ্ত হবেন ? মহান আল্লাহ এ মর্যাদা যেরূপে মহানবীকে (সা.) দিয়েছিলেন সেরূপে অন্য কাউকেও কি দিয়েছেন? এ দায়িত্বভার অন্য কারও গ্রহণের কোন বৈধতা রয়েছে কি ? নাকি মহান আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত এ মর্যাদা মহানবী (সা.)-এর জন্যেই নির্ধারিত ছিল এবং অতঃপর মুসলিম জনতাই তাদের ইমাম নির্বাচন করবে ও তাকে নিজেদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে স্থান দিবে,তা-ও বিধিসম্মত ? মানুষের কি এ ধরনের কোন অধিকার আছে ? না নেই ?
আর এটিই হল শিয়া ও সুন্নী সম্প্রদায়ের মধ্যে মূল বিরোধের বিষয়। অর্থাৎ একদিকে শিয়াদের বিশ্বাস যে ইমামত হল একটি ঐশী মর্যাদা,যা মহান আল্লাহ কর্তৃকই যথোপযুক্ত ও যোগ্যতম ব্যক্তিদেরকে প্রদান করা আবশ্যক। আর মহান আল্লাহ,মহানবী (সা.) এর মাধ্যমে এ কর্মটি সম্পাদন করেছেন এবং আমীরুল মু’
মিনিন আলীকে (আ.) তার উত্তরাধিকারী ঘোষনা করেছেন। অতঃপর তারই সন্তানদের মধ্য থেকে পরম্পরায় বারজনকে ইমামতের মর্যাদায় অভিসিক্ত করছেন। অপরদিকে সুন্নি সম্প্রদায়ের বিশ্বাস যে,ইমামত নবী (সা.)-এর তিরোধানের সাথে সাথে নবুয়্যত ও রিসালাতের মতই যবনিকায় পৌছেছে এবং এর পর থেকে ইমাম নির্বাচনের দায়িত্ব মানুষের উপর অর্পণ করা হয়েছে। এমনকি আহলে সুন্নাতের কোন কোন বিজ্ঞজন সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে,যদি কেউ অস্ত্রের ভয় দেখিয়েও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়,তবে তার আনুগত্য করাও অন্যান্যদের জন্যে অপরিহার্য!
স্পষ্টতঃই প্রতীয়মান হয় যে,এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি স্বৈরাচারী,অত্যাচারী ও প্রতারকদের অপরাধের জন্যে কতটা পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে এবং মুসলমানদের অবক্ষয় ও বিভেদের পথে কতটা সহায়ক হয়েছে!
প্রকৃতপক্ষে আহলে সুন্নাত ঐশী সম্পর্কহীন ইমামতের বৈধতা দিয়ে রাজনীতি থেকে ধর্মের পৃথকীকরণের প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছেন। আর শিয়া সম্প্রদায়ের বিশ্বাস,এটিই হচ্ছে ইসলামের সঠিক ও সত্য সুন্দর পথ থেকে এবং সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহর আনুগত্যের পথ থেকে বিচ্যুতির মূল কারণ। অনুরূপ শতসহস্র ধরনের বিচ্যুতি ও বিপথগামিতার সূতিকাগারও এখানেই,যেগুলো মহানবী (সা.) এর পরলোক গমনের পর থেকে মুসলমানদের মাঝে রূপ পরিগ্রহ করেছে এবং করবে।
অতএব প্রতিটি মুসলমানের জন্যেই কোন প্রকার অন্ধ অনুকরণ ও সাম্প্রদায়িক মনোভাব ব্যতিরেকে এ বিষয়টির উপর পরিপূর্ণ গবেষণা ও অনুসন্ধান চালানো অপরিহার্য।
আর সেই সাথে সত্য ও সঠিক মাযহাবের শনাক্তকরণের মাধ্যমে এর প্রচার ও প্রসারে সর্বশক্তি নিয়োগ করা উচিৎ।
উল্লেখ্য এ ব্যাপোরে ইসলামী বিশ্বের সামগ্রিক কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে এবং বিভিন্ন মাযহাবের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি করে ইসলামের শত্রুদের জন্যে সুযোগ করে দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এমন কোন কাজ করা যাবে না যা ইসলামী সমাজে ফাটল সৃষ্টি করবে এবং কাফেরদের বিরুদ্ধে নিজেদের পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র বিনষ্ট হবে। আর এ ক্ষতির অংশীদার মুসলমানরাই হবে,যার ফলশ্রুতি মুসলিম সমাজব্যবস্থার দুর্বলতা বৃদ্ধি ব্যতীত কিছই নয়। কিন্তু মুসলমানদের পারস্পরিক সহযোগিতা ও ঐক্য সংরক্ষণ যেন,সঠিক ও সত্য মাযহাবের অনুসন্ধান ও শনাক্তকরণের জন্যে,অনুসন্ধান ও গবেষনার সুষ্ঠ পথকে রুদ্ধ না করে ফেলে। আর ইমামতের বিষয়সমূহের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সুষ্ঠ পরিবেশ যেন ব্যাহত না হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে,এ বিষয়গুলোর সঠিক সমাধানের উপর মুসলমানদের ভাগ্য এবং ইহ ও পারলৌকিক কল্যাণ নির্ভর করে।
ইমামতের তাৎপর্য :
ইমামতের আভিধানিক অর্থ হল নেতা,পথপ্রদর্শক এবং যে কেউ কোন জনসমষ্টির নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহন করবে তাকেই ইমাম (امام
) বলা হয়ে থাকে -হোক সে সত্য পথের অনুসারী কিংবা মিথ্যা পথের অনুসারী। যেমন : পবিত্র কোরানে কাফেরদের পৃষ্ঠপোষকদের সম্পর্কে (ائمة
الکفر
) অর্থাৎ কাফেরদের নেতারা (সূরা তওবাহ-১২) কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। তদনুরূপ মুসল্লীরা নামাজের জন্যে যার পিছনে সমবেত হয়ে থাকেন,তাকে‘
ইমামুল জামা’
ত’
নামকরণ করা হয়।
কিন্তু কালামশাস্ত্রের পরিভাষায় ইমামত হল ইহ ও পরলৌকিক সকল বিষয়ে ইসলামী সমাজের সর্বময় ও বিস্তৃত নেতৃত্ব প্রদান। ইহলৌকিক শব্দটি ইমামতের পরিসীমার ব্যাপকতা বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। নতুবা ইসলামী সমাজে ইহলৌকিক বিষয়াদিও দ্বীন ইসলামেরই অন্তর্ভুক্ত।
শিয়া সম্প্রদায়ের মতে এ ধরনের নেতৃত্ব কেবলমাত্র তখনই বৈধ হবে,যখন তা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুমোদিত হবে। আর প্রকৃতপক্ষে (সহকারী হিসেবে নয়) যিনি এ মর্যাদার অধিকারী হবেন,তিনি আহকাম ও ইসলাম পরিচিতির বর্ণনার ক্ষেত্রে সকল প্রকার ভুল-ভ্রান্তি থেকে সংরক্ষিত থাকবেন। অনুরূপ তিনি সকল প্রকার গুনাহতে লিপ্ত হওয়া থেকে পবিত্র থাকবেন। বস্তুতঃ পবিত্র ইমাম,একমাত্র নবুয়্যত ও রিসালাত ব্যতীত মহানবীকে (সা.),মহান আল্লাহ প্রদত্ত সকল মর্যাদার অধিকারী হবেন। ইসলামের বিভিন্ন নিয়ম-কানুন বর্ণনার ক্ষেত্রে তার বক্তব্য যেমন নিঃশর্তভাবে গ্রহণযোগ্য,তেমনি প্রশাসনের বিভিন্ন বিষয়েও তার আদেশ পালন করাও অপরিহার্য।
এভাবে শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের মধ্যে ইমামতের ক্ষেত্রে তিনটি পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় :
প্রথমতঃ ইমামকে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্বাচিত হতে হবে।
দ্বিতীয়তঃ ইমামকে আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে এবং সকল প্রকার ভ্রান্তি থেকে মুক্ত থাকতে হবে।
তৃতীয়ত : ইমামকে গুনাহ থেকে পবিত্র থাকতে হবে ।
তবে মা’
সুম হওয়াটা ইমামতের সমকক্ষ নয়। কারণ শিয়া মাযহাবের মতে হযরত ফাতিমা যাহরাও (সালামুল্লাহ আলাইহা) মা’
সুম ছিলেন,যদিও তিনি ইমামতের আধিকারিণী ছিলেন না। অনুরূপ হযরত মারিয়াম (আ.) ও ইসমাতের অধিকারিণী ছিলেন এবং সম্ভবতঃ আল্লাহর ওলীগণের মধ্যেও অন্য কেউ এ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন,যদিও আমরা তাদের সম্পর্কে অবগত নই। বস্তুতঃ মা’
সুম ব্যক্তিগণের পরিচয় মহান আল্লাহ কর্তৃক উপস্থাপিত না হলে তাদেরকে চিনা সম্ভব নয়।