আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)

আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)0%

আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড) লেখক:
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ: নবুয়্যত

আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ মুহাম্মদ তাকী মিসবাহ্ ইয়াযদী
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ:

ভিজিট: 16127
ডাউনলোড: 4035

পাঠকের মতামত:

বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 32 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 16127 / ডাউনলোড: 4035
সাইজ সাইজ সাইজ
আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)

আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)

লেখক:
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বাংলা

২০তম পাঠ

হযরত মাহদী (আ.)

ভূমিকা :

পূর্ববর্তী পাঠসমূহে প্রসঙ্গক্রমে আমরা দ্বাদশ ইমামের (আ.) নাম সম্বলিত কয়েকটি হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম। এছাড়াও শিয়া ও সুন্নী উৎস থেকে এমন অসংখ্য রেওয়ায়েত রয়েছে যেগুলোর কোন কোনটিতে মহানবী (সা.) থেকে শুধুমাত্র তাদের সংখ্যা বর্ণিত হয়েছে। আবার কোন কোনটিতে এ কথাটিও সংযুক্ত আছে যে,তাদের সকলেই কোরাইশ বংশের। অপর কিছুতে আবার তাদের সংখ্যাকে বনি ইসরাঈলের গোত্রপতিদের সমসংখ্যক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার কোন কোনটিতে বর্ণিত হয়েছে যে,তাদের মধ্যে নয়জন,ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সন্তান। অতঃপর আহলে সুন্নতের কোন কোন রেওয়ায়েত এবং শিয়া উৎস থেকে বর্ণিত কোন কোন মুতাওয়াতির হাদীসে তাদের প্রত্যেকের নাম বর্ণিত হয়েছে।১৫৭ অনুরূপ শিয়া উৎস থেকে আরও অনেক হাদীসে আছে যাতে প্রত্যেক ইমামের (আ.) ইমামত সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে এ ক্ষুদ্রপরিসরে এগুলোর দৃষ্টান্ত তুলে ধরা সম্ভব নয়।১৫৮

ফলে এ অধ্যায়ের সর্বশেষ পাঠে আমরা দ্বাদ্বশতম ইমাম হযরত মাহদীর (আ.) (আল্লাহ তার আত্মপ্রকাশ ত্বরান্বিত করুন) সম্পর্কে আলোচনায় মনোনিবেশ করব এবং সংক্ষিপ্ত কলেবর রক্ষার স্বার্থে শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর প্রতি ইঙ্গিত করব।

বিশ্বব্যাপী ঐশী শাসনব্যবস্থা :

ইতিমধ্যেই আমরা জেনেছি যে,নবীগণের (আ.) আবির্ভাবের মূল ও প্রধাণ উদ্দেশ্য হল সচেতন ও স্বাধীনভাবে বিকাশ ও পূর্ণতা লাভের জন্যে উপযুক্ত ক্ষেত্র সৃষ্টি করা যা ওহীর মাধ্যমে মহান আল্লাহ মানুষের জন্যে বাস্তবায়ন করেছেন। এছাড়া অপর কিছু উদ্দেশ্যও ছিল যেগুলোর মধ্যে যোগ্য ব্যক্তির বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ,আত্মিক ও মানসিক পরিচর্যার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। সর্বোপরি মহান নবীগণ (আ.) খোদাভীরুতা ও ঐশী মূল্যবোধের ভিত্তিতে আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং সারা বিশ্বময় ন্যায়-নীতির বিস্তারে সচেষ্ট ছিলেন। আর এ পথে তাদের প্রত্যেকেই যথাসম্ভব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অবস্থান ও কালে আল্লাহর ঐশী শাসনব্যবস্থার প্রবর্তনে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু তাদের কারও জন্যেই সমগ্র বিশ্বব্যাপী ঐশী শাসনব্যবস্থা প্রচলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত ছিল না।

তবে উপযুক্ত ক্ষেত্র সৃষ্টি না হওয়ার অর্থ,নবীগণের (আ.) জ্ঞান ও কার্যক্রমের সীমাবদ্ধতা অথবা পরিচালনা ও নেতৃত্বের ক্ষেত্রে অক্ষমতা নয়। অনুরূপ নবীগণের (আ.) আবির্ভাবের পশ্চাতে প্রভুর উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়নি তা-ও নয়। কারণ,ইতিপূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে যে,মানব সম্প্রদায়ের মুক্ত বিকাশ ও পূর্ণতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করাই হল প্রভুর উদ্দেশ্য । যেমনটি পবিত্র কোরানেও বর্ণিত হয়েছে :

) لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى اللَّهِ حُجَّةٌ بَعْدَ الرُّسُلِ(

যাতে রাসূলগণ আসার পর আল্লাহর বিরুদ্ধে মানুষের কোন অভিযোগ না থাকে। (সূরা নিসা-১৬৫)

সুতরাং সত্য ধর্ম গ্রহণে ও ঐশী নেতৃবর্গকে অনুসরণে বাধ্য করা মহান আল্লাহর উদ্দেশ্য নয়। ফলে উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায়,প্রভুর মূল উদ্দেশ্য সফল হয়েছে।

অপরদিকে মহান আল্লাহ ঐশী গ্রন্থসমূহে বিশ্বের সর্বত্র ঐশী হুকুমতের বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যাকে মানব সম্প্রদায়ের বৃহত্তর পরিসরে সত্য দ্বীন গ্রহণের ক্ষেত্র সম্পর্কে একপ্রকার ভবিষ্যদ্বাণী বলা যেতে পারে। যখন মানব সম্প্রদায় সকল প্রতিষ্ঠান ও সকল শাসন ব্যবস্থা থেকে নিরাশ হয়ে পড়বে তখন সুনির্বাচিত ব্যক্তি ও ব্যক্তিসমষ্টির মাধ্যমে প্রভুর অদৃশ্য সাহায্যে,বিশ্বময় ঐশী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার পথ থেকে সকল প্রকার অন্তরায় ও প্রতিবন্ধকতা দূর করতঃ অত্যাচারিত,নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানবতার দ্বারে ন্যায় ও সুবিচার পৌঁছে দেয়া হবে। বলা যেতে পারে তখন সর্বশেষ নবীকে (সা.) প্রেরণ এবং তার বিশ্বজনীন ও চিরন্তন ধর্মের প্রবর্তনের পশ্চাতে প্রভুর চূড়ান্ত উদ্দেশ্যু সফল হবে। কারণ তার সম্পর্কেই বলা হয়েছে :

) لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ( ….

অপর সমস্ত দ্বীনের উপর জয়যুক্ত করার জন্যে ১৫৯

ইমামত হল নবুয়্যতের পরিসমাপক এবং খাতামিয়্যাতের পশ্চাতে হিকমাতস্বরূপ -এর ভিত্তিতে এ উপসংহারে উপনীত হওয়া যায় যে,প্রভুর উদ্দেশ্য সর্বশেষ ইমামের মাধ্যমেই বাস্তবরূপ লাভ করবে। আর এটি হল,সে বিষয় যা মুতাওয়াতির হাদীসসমূহে ইমাম মাহদী (আ.) (আমাদের আত্মা তার জন্যে উৎসর্গ হোক) সম্পর্কে গুরুত্বসহকারে উল্লেখ করা হয়েছে।

এখানে সর্বপ্রথমে এ ধরনের হুকুমতের সুসংবাদবাহী আয়াতসমূহকে পবিত্র কোরান থেকে উল্লেখ করব। অতঃপর এ সম্পর্কিত কিছু রেওয়ায়েতের প্রতি ইংগিত করব।

আল্লাহর প্রতিশ্রুতি :

মহান আল্লাহ পবিত্র কোরানে উল্লেখ করেছেন :

) وَلَقَدْ كَتَبْنَا فِي الزَّبُورِ مِنْ بَعْدِ الذِّكْرِ أَنَّ الْأَرْضَ يَرِثُهَا عِبَادِيَ الصَّالِحُونَ(

আমি উপদেশের পর যবুরে লিখে দিয়েছি যে,আমরা যোগ্যতা সম্পন্ন বান্দাগণ পৃথিবীর অধিকারী হবে। (সূরা আম্বিয়া-১০৫)

সূরা আ রাফের অপর একটি আয়াতে (১২৮-নং) হযরত মুসা (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে,নিশ্চয়ই একদা মহান আল্লাহর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হবে।

অপর এক স্থানে ফিরাউন,যে মানুষকে হীনবল করেছিল,তার কাহিনী উল্লেখপূর্বক বলা হয়েছে :

) وَنُرِيدُ أَنْ نَمُنَّ عَلَى الَّذِينَ اسْتُضْعِفُوا فِي الْأَرْضِ وَنَجْعَلَهُمْ أَئِمَّةً وَنَجْعَلَهُمُ الْوَارِثِينَ(

আমি ইচ্ছা করলাম,সে দেশে যাদেরকে হীনবল করা হয়েছিল,তাদেরকে অনুগ্রহ করতে;তাদেরকে নেতৃত্ব দান করতে ও দেশের অধিকারী করতে। (সূরা কাসাস-৫)

এ আয়াতটি বনি ইসরাঈল সম্পর্কে এবং ফিরাউনের থাবা থেকে মুক্তি লাভের পর ক্ষমতার অধিকারী হওয়া সম্পর্কে নাযিল হলেও( অর্থাৎ আমি ইচ্ছা করলাম) কথাটি প্রভুর অব্যাহত ইচ্ছা বা ইরাদার ইঙ্গিত বহন করে। আর এ দৃষ্টিকোণ থেকে অধিকাংশ হাদীস অনুযায়ী উল্লেখিত আয়াতটি ইমাম মাহ্দীর (আ.) (আল্লাহ তার আবির্ভাব ত্বরানিত করুণ) অগমনের প্রতি ইঙ্গিত বহন করে বলে বর্ণিত হয়েছে।

অনুরূপ অপর এক স্থানে মুসলমানদেরকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে :

) وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَى لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُمْ مِنْ بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا يَعْبُدُونَنِي لَا يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًا وَمَنْ كَفَرَ بَعْدَ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ(

তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে,তিনি তাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্ব দান করবেন,যেমন তিনি প্রতিনিধিত্ব দান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তী গণকে এবং তিনি অবশ্যই তাদের জন্যে সুদৃঢ় করবেন তাদের দ্বীনকে যা তিনি তাদের জন্যে মনোনীত করেছেন এবং তাদের ভয়-ভীতির পরিবর্তে তাদেরকে অবশ্যই নিবাপত্তা দান করবেন। তারা আমার ইবাদত করবে,আমার কোন শরীক করবে না,অতঃপর যারা অকৃতজ্ঞ হবে তারা তো সত্যত্যাগী। (সুরা নূর- ৫৫)

আর হাদীসে এসেছে যে,এ প্রতিশ্রুতি পরিপূর্ণ দৃষ্টান্ত সহকারে হযরত মাহ্দীর (আ.) (আল্লাহ তার আবির্ভাব ত্বরান্বিত করুন) সময় বাস্তবরূপ লাভ করবে।১৬০

অনুরূপ অপর এক শ্রেণীর হাদীস,কিছু আয়াতানুসারে১৬১ হযরত মাহদী (আ.) এর প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে। সংক্ষিপ্ততা বজায় রাখার স্বার্থে ঐগুলোর উল্লেখকরণ থেকে বিরত থাকব।১৬২

রেওয়ায়েত সমূহ :

হযরত মাহ্দী (আ.) (আল্লাহ তার আবির্ভাব ত্বরানিত করুন) সম্পর্কে শিয়া এবং সুন্নী উৎস থেকে হযরত মহানবী (সা.) থেকে যে সকল হাদীস বর্ণিত হয়েছে,সেগুলো মুতাওয়াতিরের সীমানা ছাড়িয়ে গিয়েছে। আর শুধুমাত্র যে সকল হাদীস আহলে সুন্নাতের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর সত্যতা স্বীকার করার ক্ষেত্রে তাদের নিজেদের আলেমদের সংখ্যাও তাওয়াতুরের পর্যায়ে পৌছেছে তাদের একদল আলেমের বিশ্বাস যে,হযরত মাহ্দী (আ.)-এর ব্যাপারে ইসলামের সকল মাযহাব ও ফিরকার মধ্যে মতৈক্য বিদ্যমান।১৬৩ আহলে সুন্নাতের কোন কোন আলেম হযরত মাহ্দী (আ.) ও তার আবির্ভাবের আলামত সম্পর্কে গ্রন্থও লিখেছেন।১৬৪ এখন আহলে সুন্নাত কর্তৃক বর্ণিত কিছু হাদীস তুলে ধরব। উদাহরণস্বরূপ : মহানবী (সা.) থেকে কিছু হাদীস বর্ণিত হয়েছে : যদিও পৃথিবীর আয়ুস্কাল একদিনের বেশী অবশিষ্ট না থাকে তবু মহান আল্লাহ ঐ দিনটিকে এমন সুদীর্ঘ করবেন,যাতে আমার আহলে বাইতের মধ্য থেকে আমার নামের অনুরূপ নামধারী কোন ব্যক্তি হুকুমত করতে পারে (এবং পৃথিবীকে তদনুরূপ ন্যায়নীতিতে পূর্ণ করবে যদনুরূপ অন্যায় ও অত্যাচারে পরিপূর্ণ ছিল)১৬৫

উম্মে সালমাহ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে,আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন : মাহ্দী আমার বংশধর থেকে এবং ফাতিমার (সা.) সন্তানদের অন্তর্ভূক্ত ।১৬৬

আর ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত হয়েছে যে,মহানবী (সা.) বলেছেন : নিশ্চয়ই আলী আমার পর উম্মতের ইমাম এবং তার সন্তানদের মধ্যে কায়িমুল মুনতাযার [ ইমাম মাহদী (আ.) ] থাকবে। যখন তার আবির্ভাব হবে তখন তিনি পৃথিবীকে ঐরূপ ন্যায়নীতিতে পরিপূর্ণ করবেন যেরূপ অন্যায়ে পরিপূর্ণ ছিল।১৬৭

লোকান্তর ও এর গূঢ় রহস্য :

দ্বাদশতম ইমামের বিশেষত্বসমূহের মধ্যে তার লোকান্তরিত হওয়ার ঘটনাটি অন্যতম,যা শিয়া মাযহাব কর্তৃক আহলে বাইত (আ.) থেকে বর্ণিত রেওয়ায়েতে গুরুত্ব সহাকারে উল্লেখ করা হয়েছে। উদাহরণতঃ হযরত আব্দুল আযিম হাসানি,ইমাম মুহম্মদ তাক্বি (আ.) থেকে,যিনি তার পূর্বসুরিগণ (আ.) থেকে এবং তার পূর্বসুরিগণ (আ.) আমিরুল মু মিনিন হযরত আলী (আ.) থেকে বর্ণর্না করেছেন : আমাদের উত্তরাধিকারী সুদীর্ঘ সময় লোকান্তরিত থাকবে,তখন আমাদের অনুসারীগণকে দেখতে পাবে ক্ষুধার্থ প্রাণী যেরূপ চারণভূমির সন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়ে,সেরূপ তার সন্ধানে রত থাকবে কিন্তু তার সন্ধান পাবে না। জেনে রাখ,তাদের মধ্যে যে কেউ তার দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে এবং তার ইমামের লোকান্তরের সময় আপন হৃদয়কে কলুষতামুক্ত রাখবে কিয়ামতের দিবসে আমার সাথে আমার মর্যাদায় অবস্থান করবে। অতঃপর তিনি বলেন : যখন আমাদের উত্তরাধিকারী আত্মপ্রকাশ করবে তখন তার উপর অন্য কারও অধিকার বহাল থাকবে না (অর্থাৎ অত্যাচারী শাসকের কোন আধিপত্য তার উপর থাকবে না)। আর এ কারণে গোপনে তার জন্ম হবে এবং লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকবে।১৬৮

অনুরূপ ইমাম সাজ্জাদ (আ.) তার পিতা থেকে এবং তার পিতা [ইমাম হুসাইন (আ.)] আমীরুল মু মিনিন (আ.) থেকে বর্ণনা করেছেন :

আমাদের উত্তরাধিকারীর দু টি গাইবাত রয়েছে যার একটি অপরটি অপেক্ষা দীর্ঘ এবং শুধুমাত্র যারা দৃঢ় বিশ্বাস ও সঠিক জ্ঞানের অধিকারী হবে তারাই তার ইমামতের উপর বিদ্যমান থাকবে।১৬৯

এখন আমরা,গাইবাতের রহস্য সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হওয়ার জন্যে পবিত্র ইমামগণের (আ.) অতীত ঘটনার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করব।

আমরা জানি যে,রাসূল (সা.)-এর পর অধিকাংশ মানুষ,প্রথমে আবু বকরের কাছে অতঃপর ওমরের কাছে এবং তৎপর ওছমানের কাছে বাইয়াত করেছিলেন। তবে ওছমানের শাসনকালের শেষ দিকে অন্যায় বৈষম্যের ফলে সৃষ্ট ব্যাপক দুর্নীতির কারণে জনগণ বিদ্রোহী হয়ে তাকে হত্যা করতঃ আমীরুল মু মিনিন আলী (আ.)-এর নিকট আনুগত্য প্রকাশ করেছিল।

হযরত আলী (আ.) যিনি মহান আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.) কর্তৃক মনোনীত খলিফা ছিলেন,তিনি পূর্ববর্তী খলিফাত্রয়ের শাসনামলে নবীন ইসলামী সমাজের কল্যাণার্থে নিরব ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং শুধুমাত্র কর্তব্য ও দায়িত্ববোধ ব্যতিত কোন অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেননি। এমতাবস্থায় ইসলাম ও মুসলমানদের কল্যাণে কোন পদক্ষেপ নিতেও কুন্ঠাবোধ করেননি। অপরদিকে তার কয়েক বছরের শাসনামল উষ্ট্রারোহী (জংগে জামাল),মোয়াবিয়ার (সিফ্ফিন) ও খাওয়ারেজদের (নাহরাওয়ান) সাথে যুদ্ধে অতিবাহিত হয়েছে। অবশেষে খাওয়ারেজীদেরই একজনের মাধ্যমে শাহাদাত বরণ করেন।

অনুরূপ ইমাম হাসান (আ.) ও মোয়াবিয়ার নির্দেশে বিষাক্রান্ত হন এবং মোয়াবিয়ার মৃত্যুর পর তার পুত্র ইয়াযিদ,যে ইসলামের সুস্পষ্ট নিয়মের প্রতিও ভ্রুক্ষেপ করত না,সে-ও উমাইয়্যাদের সিংহাসনে আরোহণ করে। আর এভাবে ক্রমান্বয়ে ইসলামের কোন নাম ঠিকানাও অবশিষ্ট ছিল না। আর এ কারণে ইমাম হুসাইনের (আ.) পক্ষে,এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া কোন উপায় ছিল না। তিনি নিজের নির্মম শাহাদাতের মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে কিছুটা হলেও সাবধানতা ও সচেতনতা সৃষ্টি করেছিলেন এবং ইসলামকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। তথাপি ইসলামের ন্যায়নীতিপূর্ণ শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্যে সামাজিক পরিবেশ রূপ পরিগ্রহ করেনি। ফলে অন্যান্য ইমামগণ (আ.) ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের সংহতকরণ,ইসলামের বিধি-বিধান,জ্ঞান ও আত্মিক পরিচর্যাগত দিকের প্রচার ও প্রসার এবং যোগ্য ব্যক্তিদের আত্মিক পরিশুদ্ধকরণে মনোনিবেশ করেছিলেন। আবার অনুকল পরিস্থিতিতে গোপনে জনগণকে অত্যাচারী ও স্বেচ্ছাচারীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য আহ্বান করতেন। আর একই সাথে তাদেরকে বিশ্বব্যাপি ঐশী শাসনব্যবস্থার বিষয়ে আশাবাদী করে তুলতেন। অবশেষে তারা পরস্পরায় শাহাদাত বরণ করেছিলেন।

যা হোক পবিত্র ইমামগণ (আ.) আড়াই শতাদ্বী ধরে অবর্ণনীয় সমস্যা ও সংকটের মধ্যেও ইসলামের প্রকৃত শিক্ষাকে মানুষের নিকট তুলে ধরতে পেরেছিলেন -কিছুটা সাধারণভাবে,আবার কিছুটা বিশেষভাবে বিশ্বস্ত অনুসারী ও একান্ত ব্যক্তিবর্গের জন্যে। আর এভাবেই ইসলামী শিক্ষা,সমাজের সর্বস্তরে প্রচার ও প্রসার লাভ করেছিল এবং মুহাম্মদী শরীয়তের নিশ্চয়তা বিধিত হয়েছিল। একই সাথে ইসলামী দেশসমূহের কোন কোন অংশে অত্যাচারী শাসকবর্গের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার জন্যে সংগঠনও রূপ লাভ করেছিল এবং অন্তঃতপক্ষে কিছুটা হলেও অত্যাচার ও স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পেরেছিল।

তবে স্বেচ্ছাচারী শাসকদের ভয় ও উদ্বেগ বৃদ্ধির কারণ হল,হযরত মাহ্দীর (আ.) আবির্ভাবের প্রতিশ্রুতি,যা তাদের অস্তিত্বকে হুমকির সম্মুখীন করেছে। ফলে ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-এর সমসাময়িক শাসকবর্গ তাকে কঠোর প্রহরার মধ্যে রেখেছিল,যাতে তার কোন সন্তান জন্মগ্রহণ করলে,তৎক্ষণাৎ শহীদ করতে পারে। এ জন্যেই স্বয়ং হযরত হাসান আসকারীকেও (আ.) তার যৌবনেই তারা শহীদ করেছিল।

কিন্তু প্রভুর প্রত্যয় ছিল এটাই যে,হযরত মাহ্দী (আ.) জন্মগ্রহণ করবেন এবং মানবতার মুক্তির জন্যে সঞ্চিত থাকবেন। আর এ কারণেই তার পিতার জীবদ্দশায় (পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত) শিয়াদের মধ্যে বিশিষ্ট কয়েকজন ব্যতীত১৭০ ,অন্য কেউ তাকে দেখেননি এবং তিনি তার মহান পিতার শাহাদাতের পর চারজন ব্যক্তির মাধ্যমে জনসাধারণের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন,যাদের প্রত্যেকেই পরম্পরায় প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা লাভ করেছিলেন। অতঃপর অনির্দিষ্টকালের জন্যে গাইবাতে কোবরা শুরু হয়েছে এবং যে দিন মানব সমাজ বিশ্বজনীন ঐশী শাসন ব্যবস্থাকে গ্রহণের জন্যে প্রস্তুত হবে,সেদিন মহান আল্লাহর নির্দেশে তিনি আত্ম প্রকাশ করবেন।

অতএব হযরত মাহ্দীর (আ.) গাইবাতের প্রকৃত রহস্য হল এই যে,স্বেচ্ছাচারী ও অত্যাচারীদের দুস্কৃতি থেকে নিরাপদ থাকা। এছাড়া কোন কোন রেওয়ায়েতে অন্যান্য হিকমতের প্রতিও ইঙ্গিত করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে মানুষকে পরীক্ষা করার বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। অর্থাৎ চূড়ান্ত দলিল সুস্পষ্টরূপে বর্ণিত হওয়ার পর মানুষ কতটা অবিচলতা ও দৃঢ়তা প্রদর্শন করে তা পরীক্ষা করা।

তবে লোকান্তরের সময় মানুষ হযরত মাহ্দীর (আ.) করুণা থেকে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত হয়নি এবং কোন এক রেওয়ায়েতের ভায়ায় -মেঘের আড়ালে বিদ্যমান সূর্যের১৭১ ন্যায় কিছুটা হলেও তার দ্যুতি মানুষের নিকট পৌছে। যেমনকরে অসংখ্য মানুষ (যতই অপরিচিত অবস্থায়ই হোক না কেন) তার সাক্ষাৎ লাভ করে ধন্য হয়েছিলেন এবং বস্তুগত ও অবস্তুগত সমস্যাসমূহের সমাধানে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে হযরত মাহ্দী (আ.)-এর বিদ্যমানতা হল মানুষের আস্থাশীলতা ও অনুপ্রেরণার গুরুত্বপূর্ণ কারণ যাতে আত্মসংশোধণের মাধ্যমে হযরত মাহ্দী (আ.)-এর আত্মপ্রকাশের জন্যে নিজেদেরকে প্রস্তুত করতে পারে।