আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)

আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)0%

আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড) লেখক:
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ: নবুয়্যত

আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ মুহাম্মদ তাকী মিসবাহ্ ইয়াযদী
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ:

ভিজিট: 16133
ডাউনলোড: 4035

পাঠকের মতামত:

বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 32 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 16133 / ডাউনলোড: 4035
সাইজ সাইজ সাইজ
আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)

আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)

লেখক:
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বাংলা

নবীগণের পবিত্রতার গূঢ় রহস্য :

এ পাঠের শেষ অংশে নবীগণের (আ.) পবিত্রতার রহস্য সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা যথোপযুক্ত মনে করছি ।

ওহী লাভের ক্ষেত্রে তাদের পবিত্রতার রহস্য হল,মূলতঃ ওহীর অনুধাবন যা ভুল-ত্রুটি সমন্বিত নয় এবং যিনি তা লাভ করলেন তিনি এমন এক বিশেষ বাস্তব জ্ঞানের অধিকারী,যা তিনি প্রত্যক্ষভাবে লাভ করেছেন। একইভাবে ওহী প্রেরণকারীর সাথে ওহীর সম্পর্ককেও (ফেরেস্তা মধ্যস্থতায় থাকুক বা না থাকুক) তিনি উপলব্ধি করে থাকেন। পবিত্র কোরান এ সম্পর্কে বলে :

) مَا كَذَبَ الْفُؤَادُ مَا رَأَى(

যা সে দেখেছে তার অন্তকরণ তা অস্বীকার করেনি। (সূরা নাজম -১১)

এটা কখনোই সম্ভব নয় যে,ওহীর গ্রাহক দ্বিধাগ্রস্ত থাকবেন যে,ওহী পেলেন কি-না? অথবা কে তাকে ওহী করেছেন ? কিংবা তার বিষয়বস্তু কী ? যদিও কোন কোন কাল্পনিক গল্পে এসেও থাকে যে,কোন নবী তার নবুয়্যতের ব্যাপারে সন্দিগ্ধ হয়েছে কিংবা ওহীর বিষয়বস্তুকে অনুধাবন করেননি অথবা ওহী প্রেরণকারীকে চিনতে পারেননি,তবে তা চরম মিথ্যাবাদিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর এ ধরনের মিথ্যাচার তো সে কথার মত যে,কেউ স্বীয় অস্তিত্ব সম্পর্কে অথবা বিবেক সম্পন্ন বিষয়াদি সম্পর্কে সন্দেহ করে !

যা হোক প্রভুর দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে (মানুষের নিকট প্রভুর বাণী পৌছে দেয়া) নবীগণের (আ.) পবিত্রতার গূঢ় রহস্য সম্পর্কে আলোচনা করার জন্যে কিছূটা ভূমিকা দেয়া প্রয়োজন। আর তা হল :

মানুষের স্বাধীন নির্বাচনাধীন কর্মকাণ্ডগুলো এভাবে বাস্তবায়িত হয় যে,কোন কাংখিত বিষয়ের প্রতি মানুষের অভ্যন্তরে এক অনুরাগ সৃষ্টি হয় এবং বিভিন্ন কারণের উপস্থিতিতে এর প্রতি আন্দোলিত হয়। অতঃপর বিভিন্ন জ্ঞান ও উপলব্ধির আলোকে কাংখিত উদ্দেশ্যে পৌছার পথ নির্বাচন করে এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মগুলো সম্পাদন করে থাকে। অপরদিকে একাধিক প্রবৃত্তি ও প্রবণতার সমাবেশ হলে এদের মধ্যে সর্বোত্তম ও গুরুত্বপূর্ণ টিকে শনাক্তকরণ ও নির্বাচন করার চেষ্টা করে । কিন্তু কখনো কখনো জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার ফলে অপেক্ষাকৃত উৎকৃষ্টতর বিষয়ের মূল্যায়ন ও শনাক্তকরণে ব্যর্থ হয়। অথবা উৎকৃষ্ট বিষয়সমূহ সম্পর্কে অজ্ঞতা ও উদাসীনতা বা বদাভ্যাস ও কুপ্রবণতার কারণে কুপ্রবৃত্তিকে নির্বাচন করে থাকে কিংবা সঠিক চিন্তা করার ও উৎকৃষ্টতরটি নির্বাচন করার কোন অবকাশ তার থাকে না।

অতএব মানুষ বাস্তবতাকে যত ভালভাবে চিনবে,ঐগুলো সম্পর্কে যতবেশী জ্ঞাত হবে কিংবা যতবেশী গুরুত্ব প্রদান করবে এবং স্বীয় প্রবৃত্তি ও প্রবণতাসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে যতটা দৃঢ় প্রত্যয়ের অধিকারী হবে,সঠিক নির্বাচনের ক্ষেত্রেও ততটা সফল হবে ও ত্রুটি-বিচ্যুতিসমূহ থেকে ততোধিক নিরাপদে থাকবে ।

আর এ কারণেই প্রতিভাবান ব্যক্তিবর্গ প্রয়োজনীয় জ্ঞান,দৃষ্টিভঙ্গি ও সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে উৎকর্ষ ও কল্যাণের এমন স্তরে পৌছতে সক্ষম হন যা নিষ্পাপত্বের সীমানার অতি নিকটবর্তী এবং এমনকি কুকর্ম ও গুনাহকে নিজেদের কল্পনায়ও স্থান দেন না। যেমন : কোন জ্ঞানী ব্যক্তিই বিষাক্ত ও জীবন নাশক ঔষধসমূহ কিংবা নোংরা ও পচা বস্তু খাওয়ার চিন্তা করতে পারেন না ।

এখন মনে করি যে,বাস্তবতাকে চিনার জন্যে কোন ব্যক্তির প্রতিভা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছেছে এবং তিনি আত্মিক পরিশুদ্ধির সর্বোচ্চ স্তরে আরোহণ করেছেন। যেমনটি পবিত্র কোরানের ভাষায়( يَكَادُ زَيْتُهَا يُضِيءُ وَلَوْ لَمْ تَمْسَسْهُ نَارٌ ) অর্থাৎ নির্ভেজাল যয়তুনের তৈলের মত এমন নির্মল ও দাহ্য,যেন আগুনের সংস্পর্শ ব্যতীতই স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রজ্জলন প্রায় অবস্থা। আর এ ধরনের তীক্ষ্ণ প্রতিভা ও আত্মিক পরিশুদ্ধির কারণে মহান আল্লাহর আধ্যাত্মিক পরিচর্যার ছায়াতলে আশ্রয় পেয়ে থাকেন এবং রূহুল কুদস বা পবিত্র আত্মা কর্তৃক সহায়তা পেয়ে থাকেন। আর এরূপ ব্যক্তিই অবর্ণনীয় গতিতে উৎকর্ষ বা কামালের পথ অতিক্রম করবেন;অর্থাৎ শতাব্দীর পথ এক রাতে অতিক্রম করবেন এবং শৈশবে,এমনকি মার্তৃগর্ভেও অন্য সকলের উপর শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হবেন। সকল গুনাহ ও পাপাচারের কদর্যতা এ ধরনের ব্যক্তিবর্গের নিকট এতই সুস্পষ্ট,যা অন্যের জন্যে বিষপান ও নিকৃষ্ট দুর্গন্ধযুক্ত খাবার গ্রহণের ক্ষতির মত স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়ে থাকে। আর যেমন করে একজন সাধারণ মানুষ উল্লেখিত কর্ম সম্পাদন থেকে বিরত থাকতে বাধ্য নন,তেমনি পবিত্র বান্দাগণের গুনাহ থেকে বিরত থাকাও কোনভাবেই তাদের এখতিয়ারের সাথে কোন বিরোধ সৃষ্টি করে না।

৬ষ্ঠ পাঠ

কয়েকটি ভ্রান্ত ধারণার জবাব

কয়েকটি ভ্রান্ত ধারণার জবাব :

নবীগণের পবিত্রতা সম্পর্কে বিভিন্ন ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। এখন আমরা সেগুলোর উল্লেখ করতঃ জবাব প্রদান করব :

১। প্রথম ভ্রান্ত ধারণাটি হল এই যে,মহান আল্লাহ যদি নবীগণকে (আ.) পাপাচারে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত রাখেন,যার অপরিহার্য অর্থ হল দায়িত্ব পালনের নিশ্চয়তা বিধান। তবে এ অবস্থায় তাদের কোন স্বাধীন বিশেষত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় না এবং দায়িত্ব পালনের জন্যে ও পাপাচার থেকে বিরত থাকার জন্যে কোন পুরস্কারের উপযুক্ত হতে পারেন না। কারণ যদি মহান আল্লাহ অন্য কোন ব্যক্তিকেও মা সুমরূপে নির্বাচন করতেন তবে তিনিও তাদের মতই হতেন।

এ বিষয়টির জবাব পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে পাওয়া যায় এবং তা হল এই যে,মা সুম হওয়ার অর্থ দ্বায়িত্ব পালনে ও গুনাহ থেকে বিরত থাকায় বাধ্য থাকা নয় (যেমনটি পূর্ববর্তী পাঠে সুস্পষ্ট হয়েছে)। অনুরূপ মা সুমগণের (আ.) জন্যে মহান আল্লাহকে রক্ষাকারী বলে জানার অর্থ,তাদের স্বাধীন নির্বাচনাধীন কর্মের দলিলকে অস্বীকার করা নয়। কারণ যদিও সব কিছুই পরিশেষে প্রভুর সুনির্ধারিত ইরাদার সাথে সম্পর্কিত হয় (যেমনটি একত্ববাদের আলোচনায় ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে) এবং যেখানে কোন কর্ম সম্পাদনে প্রভুর পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ ও করুণা থাকবে সেখানে উক্ত কর্মের সাথে তার সম্পর্ক হবে কিন্তু প্রভুর ইরাদা মানুষের ইরাদার উল্লম্বে অবস্থান করে অনুভূমে নয় কিংবা পরস্পরের প্রতিস্থাপক রূপেও নয়।

কিন্তু মা সুমগণের (আ.) প্রতি প্রভুর বিশেষ অনূগ্রহ অন্যান্য কারণ,শর্ত ও উপকরণ,যেগুলো বিশেষ ব্যক্তিবর্গের জন্যে সরবরাহ করা হয় সেগুলোর মতই তাদের দায়িত্বকে গুরুতর করে এবং তদনুরূপ তাদের কর্মের পুরস্কার যেরূপ বৃদ্ধি পায় তেমনি বিরোধিতা হেতু শাস্তিও। আর এভাবেই তাদের পুরস্কার ও শাস্তির মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়,যদিও স্বীয় এখ্তিয়ারের সদ্ব্যবহারের কারণে কখনোই তারা শাস্তিপ্রাপ্ত হবেন না। এ ধরনের ভারসাম্যের দৃষ্টান্ত সকল ব্যক্তিবর্গ যারা বিশেষ অনুগ্রহ প্রাপ্ত,তাদের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়। যেমন : মহানবীর (সা.) পরিবারবর্গ ও আলেমগণের দায়িত্ব স্পর্শকাতর ও গুরুতর।১২ আর তাই তাদের সুকর্মের পুরস্কার যেমন অধিকতর,তেমনি পাপাচারের (লিপ্ত হলে) শাস্তিও।১৩ এ কারণেই যে কেউ আধ্যাত্মিকভাবে যত উচ্চে আরোহণ করবে তার জন্যে অধঃপতনের আশংকা এবং ভুল-ভ্রান্তির ভয়-ভীতিও ততোধিক।

২। অপর ভ্রান্ত ধারণাটি হল : নবীগণ (আ.) ও অন্যান্য মা সুমিনের (আ.) দোয়া ও মোনাজাত থেকে যতটুকু জানা যায় তাতে পরিদৃষ্ট হয় যে,তারা নিজেদেরকে গুনাহগার মনে করেছেন এবং এ জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। আর এ ধরনের স্বীকারোক্তি থাকা সত্ত্বেও কিরূপে তাদেরকে মাসুম বলা যাবে ?

এর জবাব এই যে,হযরত মা সুমিন (আ.) যারা মর্যাদার দিক থেকে উৎকর্ষ ও প্রভুর সান্নিধ্যের অধিকারী এবং নিজেদের অন্য সকলের চেয়ে অধিক দায়িত্বের অধিকারী মনে করতেন। এমনকি তাদের প্রিয় আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও প্রতি মনোনিবেশ করাই বেশ বড় রকমের গুনাহ বলে গণনা করতেন এবং এ জন্যেই বিনীত ও ক্ষমাপ্রার্থী হতেন। ইতিপূর্বেই বলা হয়েছে যে,নবীগণের পবিত্রতার অর্থ এ নয় যে,সকল কর্ম যেগুলোকে কোনভাবে গুনাহ নামকরণ করা যায়,সেগুলো থেকে বিরত থাকা। বরং তাদের পবিত্রতার অর্থ হল,অনিবার্য কর্তব্যের বিরোধীতা করা থেকে ও শরীয়ত নিষিদ্ধ কর্মে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকা।

৩। তৃতীয় ভ্রান্ত ধারণাটি হল : কোরানের একটি আয়াতে নবীগণের (আ.) পবিত্রতা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে,তারা মোখলাসিনের (مخلصین ) অন্তর্ভুক্ত এবং শয়তান তাদের কাছে কোন কিছু আশা করে না। অথচ স্বয়ং পবিত্র কোরানেই নবীগণের উপর শয়তানের প্রভাব সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন :

) يَا بَنِي آدَمَ لَا يَفْتِنَنَّكُمُ الشَّيْطَانُ كَمَا أَخْرَجَ أَبَوَيْكُمْ مِنَ الْجَنَّةِ(

হে বনী আদম ! শয়তান যেন তোমাদেরকে কিছুতেই বিভ্রান্ত না করে যেভাবে তোমাদের পিতা-মাতাকে জান্নাত হতে বহিষ্কৃত করেছিল। (সূরা আ রাফ -২৭)

উল্লেখিত আয়াতটিতে শয়তান কর্তৃক হযরত আদম (আ.) ও হাওয়াকে প্রতারিত করার মাধ্যমে বেহেস্ত থেকে বহিষ্কারের কথা বলা হয়েছে । অন্য একটি আয়াতে হযরত আয়্যূবের (আ.) বক্তব্য তুলে ধরা হয়। যথা :

) أَنِّي مَسَّنِيَ الشَّيْطَانُ بِنُصْبٍ وَعَذَابٍ(

শয়তানতো আমাকে যন্ত্রণা ও কষ্টে ফেলেছে। (সূরা সাদ -৪১)

অনুরূপ অপর একটি আয়াতে সকল নবীগণের (আ.) জন্যে এক ধরনের শয়তানী আবেশের প্রমাণ পাওয়া যায়। যথা :

) وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ وَلَا نَبِيٍّ إِلَّا إِذَا تَمَنَّى أَلْقَى الشَّيْطَانُ فِي أُمْنِيَّتِهِ(

আমি তোমার পূর্বে যে সমস্ত রাসূল ও নবী প্রেরণ করেছি,তাদের যে কেউ যখনই কিছু আকাংখা করেছে তখনই শয়তান তার আকাংখায় কিছু প্রক্ষিপ্ত করেছে। (সূরা হাজ্জ -৫২)

এর জবাব এই যে,উক্ত আয়াতগুলোর কোনটিতেই নবীণের (আ.) যে,সকল কর্ম শয়তানের প্ররোচনায় অপরিহার্য দায়িত্বের লংঘন বলে পরিগণিত হতে পারে তার উল্লেখ নেই। তবে সূরা আ রাফের ২৭ নম্বর আয়াতে নিষিদ্ধ বৃক্ষ থেকে ভক্ষণের ব্যাপারে শয়তানের প্ররোচনা সম্পর্কে বলা হয়েছে,যা হারামভুক্ত কোন নিষেধ ছিল না। বরং শুধুমাত্র আদম (আ.) ও হাওয়াকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছিল যে,ঐ বৃক্ষ থেকে আহার গ্রহণ করা জান্নাত থেকে বহিস্কৃত হওয়া ও পৃথিবীতে অবরোহণের কারণ হবে। কিন্তু শয়তানের প্ররোচনা তাদের এ দিকনির্দেশনামূলক (ارشادی ) নিষেধের সীমালংঘনের কারণ হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে ঐ জগৎ,কর্তব্যের জগৎ ছিল না এবং তখনও কোন শরীয়ত নাযিল হয় নি। অপরদিকে সূরা সাদের ৪১ নম্বর আয়াতে,শয়তানের মাধ্যমে হযরত আয়্যূবের (আ.) উপর যে কষ্ট ও যন্ত্রনা আপতিত হয়েছিল সে সম্পর্কে ইঙ্গিত রয়েছে এবং আল্লাহর আদেশ-নিষেধ অমান্য করার ব্যাপারে কোন প্রমাণ উক্ত আয়াতে নেই। আবার সূরা হাজ্জের ৫২ নম্বর আয়াতটি এমন সকল প্রতিবন্ধকতা সংশ্লিষ্ট,যা শয়তান নবীগণের (আ.) কর্মতৎপরতার ক্ষেত্রে এবং মানুষের হিদায়াতের ক্ষেত্রে তাদের আকাংখার পথে সৃষ্টি করে। কিন্তু অবশেষে মহান আল্লাহ তার সকল চক্রান্ত ও প্রবঞ্চনাকে নস্যাত করে সত্য ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করেন ।

৪। চতুর্থ ভূল ধারণাটি হল : সূরা তোহার ১২১ তম আয়াতে হযরত আদম (আ.) এর পাপ সম্পর্কে এবং একই সূরার ১১৫ তম আয়াতে তার ভ্রান্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে। তাহলে এ ধরনের পাপ ও ভ্রান্তি কিরূপে হযরত আদমের (আ.) ইসমাত বা পবিত্রতার সাথে সম্পর্কযুক্ত হতে পারে ? এ ভ্রান্ত ধারণাটির জবাব পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট হয়েছে যে,পাপ ও ভ্রান্তি অপরিহার্য কর্তব্যের লংঘন ছিল না।

৫। পঞ্চম ভ্রান্ত ধারণাটি হল এই যে,পবিত্র কোরানে কোন কোন নবীগণের (আ.) মিথ্যা বলা সম্পর্কে উল্লেখ হয়েছে। যেমন : সূরা সাফ্ফাতের ৮৯ তম আয়াতে হযরত ইব্রাহীমের (আ.) বক্তব্য থেকে বলা হয় :

) فَقَالَ إِنِّي سَقِيمٌ(

অতঃপর সে বলল, আমি অসুস্থ

অথচ তিনি অসুস্থ ছিলেন না। অনুরূপ সূরা আম্বিয়ার ৬৩ তম আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে :

) قَالَ بَلْ فَعَلَهُ كَبِيرُهُمْ هَذَا(

তিনি বললেন : বরং এদের প্রধানই তো এ কাজটি করেছে।

অথচ স্বয়ং ইব্রাহীমই (আ.) মূর্তিগুলোকে ভেংগেছিলেন,আবার সূরা ইউসুফের ৭০ তম আয়াতে বলা হয়েছে :

) ثُمَّ أَذَّنَ مُؤَذِّنٌ أَيَّتُهَا الْعِيرُ إِنَّكُمْ لَسَارِقُونَ(

অতঃপর এক আহবায়ক চীৎকার করে বলল : হে যাত্রীদল! তোমরা নিশ্চয়ই চোর।

অথচ হযরত ইউসুফের (আ.) ভাইগণ চৌর্যবৃত্তিতে লিপ্ত হননি। এর জবাব এই যে,এ ধরনের বক্তব্য যেগুলো কোন কোন রেওয়ায়েতের মতে তৌরিয়াহ (যার অন্য অর্থ হল,ইরাদা করা) নামকরণ করা হয়ে থাকে,সেগুলো অপেক্ষাকৃত বৃহওর কল্যাণের স্বার্থে ব্যক্ত হয়েছিল এবং কোন কোন আয়াত অনুসারে বলা যেতে পারে ঐগুলো ঐশী ইলহামের মাধ্যমেই সংঘটিত হয়েছিল,যেমন : হযরত ইউসুফের (আ.)-এর কাহিনীতে বলা হয় :

) كَذَلِكَ كِدْنَا لِيُوسُفَ(

এভাবে আমি ইউসুফকে কৌশল শিক্ষা দিয়েছিলাম। (সূরা ইউসুফ -৭৬)

যা হোক এ ধরনের মিথ্যা (তৌরিয়াহ),গুনাহ বা ইসমাত বিরোধী নয়।

৬। ষষ্ঠ ভ্রান্ত ধারণাটি হল : হযরত মুসার (আ.) ঘটনায় এসেছে যে,বনি ইসরাঈলের এক ব্যক্তির সাথে কলহে লিপ্ত কিবতীর এক ব্যক্তিকে হযরত মুসা (আ.) হত্যা করেছিলেন। আর এ কারণেই মিশর থেকে পলায়ন করেছিলেন এবং যখন মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ফেরাউন ও তার সঙ্গীদেরকে আহবান করার জন্যে আদিষ্ট হয়েছিলেন,তখন বলেছিলেন :

) وَلَهُمْ عَلَيَّ ذَنْبٌ فَأَخَافُ أَنْ يَقْتُلُونِ(

আমার বিরুদ্ধে তো তাদের অভিযোগ আছে;আমি আশংকা করি তারা আমাকে হত্যা করবে। (সূরা শুয়ারা -১৪ )

অতঃপর উল্লেখিত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে ফেরাউনের কর্ণগোচর করা হলে,তার জবাবে হযরত মুসা (আ.) বলেন :

) فَعَلْتُهَا إِذًا وَأَنَا مِنَ الضَّالِّينَ(

আমি তো এটা করেছিলাম তখন,যখন আমি ছিলাম অজ্ঞ। (সূরা শুয়ারা -২০)

অতএব এ ঘটনাটি কিরূপে নবুয়্যতের ঘোষণার পূর্বেও নবীগণের ইসমাতের ধারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে ?

এর উত্তর হল এই যে,প্রথমতঃ কিবতীর ঐ ব্যক্তির হত্যাকাণ্ড ইচ্ছাকৃত ছিল না। বরং মুষ্টাঘাতের ফলে দূর্ঘটনাবশতঃ ঘটেছিল। দ্বিতীয়তঃولهم علی ذنب অর্থাৎ আমার বিরুদ্ধে তো তাদের অভিযোগ আছে এ কথাটিতে ফেরাউন সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়েছে যার অর্থ হল তারা আমাকে [মুসা (আ.)] হত্যাকারী ও অপরাধী মনে করে এবং ভয় করি যে,তারা আমাকে প্রতিশোধ স্বরূপ হত্যা করবে। তৃতীয়তঃو انا من الضالین অর্থাৎ যখন আমি ছিলাম অজ্ঞ এ কথাটি হয় ফেরাউন সম্প্রদায়ের সাথে আপোসরফা করার জন্যে বলা হয়েছে যে, ধরা যাক তখন আমি বিপথগামী ছিলাম কিন্তু এখন মহান আল্লাহ আমাকে হিদায়াত করেছেন এবং চূড়ান্ত যুক্তি-প্রমাণ সহকারে তোমার নিকট পাঠিয়েছেন অথবা (ضلال ) অর্থাৎ বিপথগামী শব্দটি এ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে যে,উক্ত কর্মের পরিণতি সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিলেন। মুসা (আ.) কর্তৃক আল্লাহর অপরিহার্য আদেশের লংঘনের কোন প্রমাণ নেই।

৭। সপ্তম ভ্রান্ত ধারণাটি হল : সূরা ইউনূসের ৯৪ তম আয়াতে মহানবীকে (সা.) উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে :

) فَإِنْ كُنْتَ فِي شَكٍّ مِمَّا أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ فَاسْأَلِ الَّذِينَ يَقْرَءُونَ الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِكَ لَقَدْ جَاءَكَ الْحَقُّ مِنْ رَبِّكَ فَلَا تَكُونَنَّ مِنَ الْمُمْتَرِينَ(

আমি তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি তাতে যদি তুমি সন্দিগ্ধচিত্ত হও তবে তোমার পূর্বের কিতাব যারা পাঠ করে তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর;তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে তোমার নিকট সত্য বিষয় এসেছে। তুমি কখনো সন্দিগ্ধচিত্তদের অন্তর্ভূক্ত হয়ো না।

অনুরূপ সূরা বাকারার-১৪৭ তম,সূরা আলে ইমরানের-৬০ তম,সূরা আনআমের-১১৪ তম,সূরা হুদের-১৭ তম এবং সূরা সাজদার-২৩ তম আয়াতেও তাকে সন্দেহ ও দ্বিধাগ্রস্ত হতে নিষেধ করা হয়েছে। অতএব কিরূপে বলা যেতে পারে যে,ওহীর উপলব্ধি সন্দেহাতীত ও দ্বিধাহীন ?

এর জবাব হলঃ উল্লেখিত আয়াতসমূহে হযরতের (সা.) দ্বিধাগ্রস্ততার কোন প্রমাণ নেই। বরং এ প্রমাণ বহন করে যে,মহানবীর রিসালাত এবং কোরানর ও এর বিষয়বস্তুর সত্যতায় কোন দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবকাশ নেই। প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের উক্তির উদ্দেশ্য হল এরূপ যে,দ্বার নাড়লে দেয়াল শুনে।

ایاک اعنی و اسمعی یا جارة

৮। অষ্টম ভ্রান্ত ধারণাটি হল : পবিত্র কোরানে নবী (সা.)-এর এমন কিছু গুনাহ সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে যা মহান আল্লাহ ক্ষমা করেছিলেন। যেমন : বলা হয়েছে যে,

) لِيَغْفِرَ لَكَ اللَّهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ(

যেন আল্লাহ তোমার অতীত ও ভবিষ্যৎ ত্রুটিসমূহ মার্জনা করেন। (সূরা ফাতহ-২)

জবাব এই যে,এ আয়াতে উল্লেখিত (ذَنْبِ ) অপরাধের অর্থ হল এমন সকল গুনাহ যা মোশরেকরা মহানবীর (সা.) উপর হিজরতের পূর্বে ও পরে আরোপ করেছিল। যেমনঃ তাদের দেবতাদেরকে অবজ্ঞা করা ইত্যাদি। আর ক্ষমা করার অর্থ হল ঐ সকল কর্মের সম্ভাব্য কুপ্রভাব থেকে রক্ষাকরণ এবং এর প্রমাণ হল এই যে,মক্কা বিজয়কে ঐগুলোর (মোশরেক কর্তৃক আরোপিত অপরাধ) ক্ষমা হিসেবে গণ্য করে বলা হয়েছে :

) إِنَّا فَتَحْنَا لَكَ فَتْحًا مُبِينًا(

নিশ্চয় আমি তোমাকে দিয়েছি সুস্পষ্ট বিজয়। (সূরা ফাত্হ -১)

আর নিঃসন্দেহে যদি ঐ সকল গুনাহের অর্থ প্রকৃতই গুনাহ হত তবে সে সকল গুনাহের ক্ষমার জন্যে কোনভাবেই মক্কা বিজয়কে কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হত না ।

৯। নবম ভ্রান্ত ধারণাটি হল : পবিত্র কোরান হযরত মুহাম্মদ (সা.) কর্তৃক তার পালকপুত্র যাইদের তালাক প্রাপ্তা স্ত্রীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে বলে :

) وَتَخْشَى النَّاسَ وَاللَّهُ أَحَقُّ أَنْ تَخْشَاهُ(

তুমি লোকনিন্দার ভয় করছিলে অথচ আল্লাহকেই ভয় করা তোমার পক্ষে অধিকতর সংগত ছিল। (সূরা আহযাব-৩৭)

অতএব কিরূপে এ ধরনের ব্যাখ্যা ইসমাতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে ?

জবাব হল : নবী (সা.) এ ভয়ে ভীত ছিলেন যে,মহান আল্লাহ কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে অন্ধকার যুগের একটি কুপ্রথার (পালক পুত্রকে,সত্যিকার পুত্রের সমান মনে করা) অপসারণের চেষ্টা করলে,জনগণ ইমানের দুর্বলতার কারণে একে নবীর (সা.) ব্যক্তিগত চাহিদা বলে মনে করবে যা দ্বীনের ব্যাপারে তাদের দ্বিধাদ্বন্দ্বের কারণ হতে পারে। মহান আল্লাহ তার প্রিয় নবীকে অবহিত করেন যে,এ কুপ্রথার উচ্ছেদ গুরুত্বপূর্ণ এবং এ ভ্রান্ত ধারণার বিরুদ্ধে নবী (সা.) এর কার্যকর সংগ্রামের ক্ষেত্রে তার (আল্লাহর) ইরাদার বিরোধিতা করার ভয় অপেক্ষাকৃত বেশী উপযোগী। অতএব এ আয়াত কোন ভাবেই নবী (সা.) এর তিরস্কার হওয়ার প্রমাণ বহন করে না।

১০। দশম ভ্রান্ত ধারণাটি হল : পবিত্র কোরান কোন কোন ক্ষেত্রে মহানবীকে (সা.) তিরস্কার করেছে। যেমন : যুদ্ধে অংশ গ্রহণ না করার ব্যাপারে নবী (সা.) কর্তৃক কোন কোন ব্যক্তিকে অনুমতি দান প্রসঙ্গে বলা হয় :

) عَفَا اللَّهُ عَنْكَ لِمَ أَذِنْتَ لَهُمْ(

আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করেছেন। কেন সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদীদেরকে চিনার আগেই তাদেরকে অনুমতি দিলে? (সূরা তওবাহ ৪৩)

অনুরূপ কোন কোন স্ত্রীকে তুষ্ট করার জন্যে কিছু হালাল বিষয়কে (নিজের জন্য) নিষিদ্ধ করা প্রসঙ্গে বলে :

) يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ لِمَ تُحَرِّمُ مَا أَحَلَّ اللَّهُ لَكَ تَبْتَغِي مَرْضَاتَ أَزْوَاجِكَ(

হে নবী ! আল্লাহ তোমার জন্যে যা কিছু বৈধ করেছেন,তোমার স্ত্রীগণের সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে কেন তা নিজের জন্য অবৈধ করছো? (সূরা তাহরীম -১)

তাহলে এ ধরনের তিরস্কার কিরূপে তার ইসমাতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে ?

এর জবাব এই যে,এ ধরনের উক্তির অর্থ হল তিরস্কারের আড়ালে প্রশংসা করা। আর এর মাধ্যমে নবী (সা.) এর অপরিসীম উদারতা ও অনুগ্রহের প্রমাণ মিলে যে,মোনাফেক ও কলুষিত হৃদয়ের মানুষকেও তিনি নিরাশ করতেন না এবং তাদের গোপন অপরাধের পর্দা উন্মোচন করতেন না। অনুরূপ স্ত্রীগণের তুষ্টি এ জন্যে ছিল যে,তিনি স্বীয় চাওয়া-পাওয়ার চেয়ে স্ত্রীগণের চাওয়া-পাওয়ার অগ্রাধিকার দিতেন এবং মোবাহ বিষয়কে শপথের মাধ্যমে নিজের জন্যে নিষিদ্ধ করে ছিলেন -এ রূপ নয় যে,(العیذ بالله ) মহান আল্লাহর আদেশকে পরিবর্তন করেছিলেন এবং কোন হালালকে মানুষের জন্যে হারাম করেছিলেন।

প্রকৃতপক্ষে এ আয়াতগুলো এক দৃষ্টিকোণ থেকে ঐ সকল আয়াতের মত,যেগুলো কাফেরদের হিদায়াতের ব্যাপারে নবী (সা.) এর অবর্ণনীয় আন্তরিক ইচ্ছার ইংগিত বহন করে। যেমন :

) لَعَلَّكَ بَاخِعٌ نَفْسَكَ أَلَّا يَكُونُوا مُؤْمِنِينَ(

তারা ঈমান আনছে না এ কারনেই মনে হচ্ছে অতিমনোকষ্টে নিজের জীবনকে বিপন্ন করবে! (সূরা শুয়ারা-৩)

অথবা ঐ আয়তটি যাতে মহান আল্লাহর ইবাদতের ক্ষেত্রে নবী (সা.) এর অপরিসীম যন্ত্রণা সহ্য করা সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে।

) طه مَا أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْقُرْآنَ لِتَشْقَى(

তা হা,তোমাকে ক্লেশ দেয়ার জন্যে আমি তোমার নিকট কোরান অবতীর্ণ করিনি। (সূরা তোহা-১-২)

অতএব তা মহানবী (সা.) এর ইসমাতের সাথে সাংঘর্ষিক নয়।