৭ম পাঠ
মু’
জিযাহ
নবুয়্যতকে প্রমাণের উপায়সমূহ :
নবুয়্যত অধ্যায়ের তৃতীয় মূল আলোচ্য বিষয়টি হল এই যে,সত্য নবীগণের দাবির সত্যতাকে এবং মিথ্যা নবীদের দাবির অসারতাকে কিরূপ অন্যদের জন্যে প্রমাণ করা যেতে পারে ?
নিঃসন্দেহে যদি এমন কোন দুষ্কৃতিকারী ও গুনাহে কলুষিত ব্যক্তি নবূয়্যতের দাবি করে,যার কুপ্রবনতার কুৎসিত দিকগুলোকে বুদ্ধিবৃত্তি অনুধাবন করতে পারে,তবে এমন কোন ব্যক্তির দাবির কোন বিশ্বাসযোগ্যতা ও সত্যতা থাকবে না এবং নবীগণের জন্যে বর্ণিত ইসমাতের শর্তের আলোকে তার এ দাবির অসারতা প্রমাণ করা সম্ভব -বিশেষ করে যদি এমন কোন বিষয়ের দিকে আহবান করে,যা বুদ্ধিবৃত্তি ও ফিতরাত বিরোধী হয় অথবা যদি তার বক্তব্য স্ববিরোধী হয়।
অপরদিকে কোন ব্যক্তির এমন সুখ্যাতিপূর্ণ অতীত বিদ্যমান যে,নিরপেক্ষ ব্যক্তিরা তার দাবির সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারে -বিশেষ করে বুদ্ধিবৃত্তি যদি তার আহবানকৃত বিষয়ের সত্যতার সাক্ষ্য প্রদান করে। অনুরূপ,অন্য কোন নবীর ভবিষ্যদ্বানী ও পরিচয় করিয়ে দেয়ার মাধ্যমেও কোন ব্যক্তির নবুয়্যতকে এরূপে প্রমাণ করা সম্ভব,যার ফলে সত্যানুসন্ধিৎসু ব্যক্তিদের জন্যে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে না।
কিন্তু যদি কোন সম্প্রদায়ের নিকট কারও নবুয়্যতের সত্যতা প্রমাণের জন্য বিশ্বাসযোগ্য কোন সূত্র না থাকে অথবা অপর কোন নবী কর্তৃক ঐ ব্যক্তির নবুয়্যতের সুসংবাদ ও অনুমোদন প্রাপ্তির সংবাদ ঐ জনগোষ্ঠীর নিকট যদি না পৌছে থাকে তবে তার নবুয়্যতের প্রমানের জন্য অন্য কোন উপায়ের প্রয়োজনীয়তা থাকাটা স্বাভাবিক । আর তাই মহান আল্লাহ তার পরিপূর্ণ প্রজ্ঞার আলোকে এ পথটি উন্মুক্ত করেছেন এবং নবীগণকে এমন কিছু মু’
জিযাহ দান করেছেন,যেগুলো তাদের দাবির সত্যতাকে নির্দেশ করে। আর এ দৃষ্টিকোণ থেকেই ঐগুলোকে আয়াত (ایات
)
বা নিদর্শনসমূহ নামকরণ করা হয়েছে।
অতএব সত্য নবীগণের (আ.) দাবির সত্যতাকে তিনভাবে প্রমাণ করা যেতে পারে। যথা :
১। বিশ্বাসযোগ্য সূত্রসমূহ থেকে,যেমন : আজীবন সত্যবাদীতা ও সঠিক পথে থাকা সত্যপথ থেকে অবিচ্যুত থাকা ও ন্যায়পরায়ণ থাকা। তবে এ উপায়টি ঐ সকল নবীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যারা বর্ষ পরম্পরায় জনগণের মাঝে জীবন-যাপন করেছেন এবং যারা সংশ্লিষ্ট সমাজে চারিত্রিক দিক থেকে সুপরিচিত। কিন্তু যদি কোন নবী শৈশবে বা যৌবনে এবং জনগণ কর্তৃক তার ব্যক্তিত্ব ও সুনির্দিষ্ট চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহ শনাক্ত হওয়ার পূর্বেই রিসালাতের অধিকারী হন তবে উল্লেখিত পদ্ধতিতে তার দাবির সত্যতা প্রমাণ করা সম্ভব নয়।
২। পূর্ববর্তী বা সমসাময়িক কোন নবী কর্তৃক পরিচয় উপস্থাপনার মাধ্যমে : এ পদ্ধতিও ঐ জনসমষ্টির জন্যেই প্রযোজ্য যারা অন্য কোন নবীকে শনাক্ত করতে পেরেছেন এবং তার প্রদত্ত সুসংবাদ ও অনুমোদন সম্পর্কে অবগত হতে পেরেছেন। স্বভাবতঃই এ পথটি পূর্ববর্তী নবীর জন্যেও প্রযোজ্য নয়।
৩। মু’
জিযাহ প্রদর্শনের মাধ্যমে যা বিস্তৃত ও সার্বজনীনভাবে কার্যকরী। ফলে আমরা এ পদ্ধতিটির আলোচনায় মনোনিবেশ করব।
মু’
জিযাহর সংজ্ঞা :
মু’
জিযাহ বলতে বুঝায় -অলৌকিক কোন বিষয়কে,যা মহান আল্লাহর ইচ্ছায় নবুয়্যতের দাবিদার কোন ব্যক্তির মাধ্যমে প্রদর্শিত হয় এবং যা তার দাবির সত্যতার নিদর্শন স্বরূপ।
লক্ষ্যণীয় যে,এ সংজ্ঞাটিতে তিনটি বিষয় সন্নিহিত আছে। যথা :
ক) এমন কিছু অলৌকিক বিষয়ের অস্তিত্ব রয়েছে যেগুলো সাধারণ ও জ্ঞাত কোন কারণের মাধ্যমে অস্তিত্ব লাভ করে না।
খ) এ অলৌকিক বিষয়সমূহের মধ্যে কতিপয় আল্লাহর বিশেষ ইচ্ছা ও অনুমতিক্রমে নবীগণ কর্তৃক সম্পাদিত হয়।
গ) এ ধরনের অলৌকিক বিষয়সমূহই কেবল নবীগণের দাবির সত্যাতার নিদর্শন হতে পারে। আর তখন এগুলোকে পরিভাষাগত অর্থে মু’
জিযাহ (معجزه
) নামকরণ করা হয়ে থাকে।
এখন আমরা উপরোক্ত সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত বিষয়ত্রয় সম্পর্কে আলোচনায় মনোনিবেশ করব।
অলৌকিক বিষয়সমূহ :
এ বিশ্বে যে সকল বিষয় সংঘটিত হয়,সেগুলোর মধ্যে অধিকাংশই এমন সকল কারণের মাধ্যমে অস্তিত্বে আসে যেগুলোকে বিভিন্ন পরীক্ষাগারে শনাক্তকরণ সম্ভব। যেমন : পদার্থবিদ্যা,রসায়নবিদ্যা ও জীববিদ্যার অন্তর্ভূক্ত অধিকাংশ বিষয়। কিন্তু বিরল ক্ষেত্রসমূহে এ অলৌকিক বিষয়সমূহের কিছু কিছু অন্য কোনভাবে সংঘটিত হয় এবং ঐগুলোর সঠিক কারণসমূহকে ঐন্দ্রিয় পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্তকরণ ও পর্যবেক্ষণ করা যায় না। কারণ এ ধরনের বিষয়সমূহের ক্ষেত্রে অন্য এক শ্রেণীর নির্বাহক কার্যকর। যেমন : যোগীদের বিভিন্ন বিস্ময়কর কর্মকাণ্ড ইাত্যাদি। বিভিন্ন বিদ্যায় পারদর্শী ব্যক্তিবর্গ সাক্ষ্য প্রদান করেন যে,এ সকল কর্মকাণ্ড বস্তুগত ও অভিজ্ঞতালব্ধ নিয়মের ভিত্তিতে সংঘটিত হয় না। আর এ ধরনের বিষয়সমূহই অলৌকিক বিষয় (خارق العادة
) নামে পরিচিত।
প্রভু কর্তৃক সংঘটিত অলৌকিক ঘটনা
:
অলৌকিক ঘটনাসমূহকে সার্বিকভাবে দু’
ভাগে বিভক্ত করা যায়। একটি হল ঐ সকল ঘটনা যাদের কারণসমূহ সাধারণ না হলেও ঐ সকল অসাধারণ কারণসমূহ মোটামুটি মানুষের আওতাধীন এবং বিশেষ প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনের মাধ্যমে ঐ গুলোকে অর্জন করা সম্ভব। যেমন : যোগীদের কর্মকাণ্ড। আর অপরটি হল ঐ সকল অলৌকিক ঘটনা যেগুলোর বাস্তবায়ন প্রভুর বিশেষ অনুগ্রহ ও অনুমতির সাথে সংশ্লিষ্ট এবং ঐ গুলোর অধিকার মহান আল্লাহর সাথে সম্পর্কহীন ব্যক্তিদেরকে প্রদান করা হয় না। অতএব উপরোক্ত দ্বিতীয় শ্রেণীর অলৌকিক ঘটনাসমূহের দু’
টি মৌলিক বিশেষত্ব বিদ্যমান। যথা :
প্রথমতঃ শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণযোগ্য নয় এবং দ্বিতীয়তঃ অপেক্ষাকৃত বৃহত্তর শক্তির দ্বারা প্রভাবিত হয় না ও অন্য কোন নির্বাহকের নিকট পরাভূত হয় না ।
আর এ ধরনের অলৌকিক বিষয়সমূহ একমাত্র আল্লাহর নির্বাচিত ব্যক্তিবর্গেরই অধীন এবং কখনোই বিপথগামী ও কলুষিতদের নাগালে আসে না। কিন্তু শুধুমাত্র নবীগণের জন্যেই নির্দিষ্ট নয়। বরং কখনো কখনো আল্লাহর অন্যান্য ওলীগণও এগুলোর অধিকারী হতে পারেন। এ দৃষ্টিকোণ থেকে কালামশাস্ত্রের পরিভাষায় বর্ণিত (দ্বিতীয় শ্রেণীর) সকল অলৌকিক ঘটনাকে মু’
জিযাহ বলা হয় না এবং এ ধরনের যে সকল কর্মকাণ্ড নবীগণ ব্যতীত অন্য কারও মাধ্যমে সংঘটিত হয় সেগুলোকে সাধারণত কেরামত নামকরণ করা হয়ে থাকে। যেমন : প্রভু প্রদত্ত অসাধারণ জ্ঞান শুধুমাত্র নবুয়্যতের ওহী সংশ্লিষ্ট নয় এবং যখন এ ধরনের জ্ঞান (নবী ভিন্ন) অন্য কাউকে প্রদত্ত হয়,তখন এলহাম (الهام
),তাহ্দিস (تحدیث
) ইত্যাদি নামকরণ করা হয়।
যা হোক এ দু’
ধরনের (ঐশ্বরিক ও অনৈশ্বরিক) অলৌকিক ঘটনাসমূহকে শনাক্তকরণের উপায় জ্ঞাত হল অর্থাৎ যে সকল অলৌকিক ঘটনা শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণযোগ্য অথবা যদি অন্য কোন কিছুর মাধ্যমে ঐগুলোর সংঘটন ও অগ্রগতিকে রোধ করা যায় এবং ঐগুলোর প্রভাব নস্যাৎ করা যায় তবে ঐগুলো প্রভু কর্তৃক সংঘটিত অলৌকিক বিষয়সমূহের অন্তর্ভুক্ত নয়। যেমন : কোন ব্যক্তির দুস্কৃতি ও অন্যায় বিশ্বাস ও চরিত্রকে মহান আল্লাহর সাথে তার সম্পর্কহীনতার এবং তার কর্মগুলো শয়তানী ও স্বেচ্ছাচারী হওয়ার নিদর্শনরূপে গণনা করা যেতে পারে।
এখানে অন্য একটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করাটা যুক্তিযুক্ত মনে করছি। আর তা হল এই যে,ঐশ্বরিক অলৌকিক ঘটনাসমূহের কর্তা হিসেবে মহান আল্লাহকে মনে করা যেতে পারে (সকল সৃষ্ট বিষয় যেমন : সাধারণ ঘটনাসমূহের কর্তৃত্ব ব্যতীতও) -এ দৃষ্টিকোণ থেকে যে,ঐ গুলোর সংঘটন তার বিশেষ অনুমতির সাথে সম্পর্কিত।
অনুরূপ ঐগুলোর মাধ্যম হিসেবে উদাহরণতঃ ফেরাস্তাগণ অথবা নবীগণের সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করা যেতে পারে। আর তা এ দৃষ্টিকোণ থেকে যে,তারা মাধ্যম হিসাবে বা নিকটবর্তী কর্তা হিসেবে ভূমিকা রাখেন। যেমন করে পবিত্র কোরান মৃতদেরকে জীবিতকরণ,অসুস্থকে আরোগ্যদান এবং পাখী সৃষ্টিকে ঈসার (আ.) কর্তৃত্ব বলে উল্লেখ করেছে।
সুতরাং এ দু’
ধরনের কর্তৃত্বের উদ্ধৃতি দেয়ার মধ্যে বিরোধ ও বৈপরীত্য নেই। কারণ প্রভুর কর্তৃত্ব বান্দাদের কর্তৃত্বের উল্লম্বে অবস্থান করে।
নবীগণের মু’
জিযাহর বৈশিষ্ট্য :
মু’
জিযাহর সংজ্ঞায় তৃতীয় যে বিষয়টি সম্পর্কে ইংগিত করা হয়েছে তা এই যে,মু’
জিযাহ নবীগণের দাবির সত্যতার নিদর্শনস্বরূপ। এ দৃষ্টিকোণ থেকে,যখন অলৌকিক বিষয়সমূহকে কালামশাস্ত্রের পরিভষায় মু’
জিয়াহ নামকরণ করা হয় যখন প্রভুর বিশেষ অনুমতির প্রমাণ ছাড়াও নবীগণের নবুয়্যতের দলিলস্বরূপ সংঘটিত হয়। আর এর ভাবার্থের কিছুটা সম্প্রসারণ করলে,ঐ সকল অলৌকিক বিষয়কেও সমন্বিত করে,যা ইমামতের দাবির সত্যতার প্রমাণ হিসেবে সংঘটিত হয়ে থাকে। আর এভাবে কেরামত (کرامت
) পরিভাষাটি অন্যান্য ঐশ্বরিক অলৌকিক বিষয়সমূহ,যেগুলো আল্লাহর ওলীগণের মাধ্যমে,যাদুকর ভাগ্যগণক ও যোগীদের বিভিন্ন কর্মের মত শয়তানী ও কুমন্ত্রণাপ্রসূত অলৌকিক বিষয়সমূহের প্রতিকুলে সংঘটিত হয়। এ ধরনের (শয়তানী) কর্মগুলো একদিকে যেমন শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণযোগ্য,অপরদিকে তেমনি বৃহত্তর শক্তির নিকট পরাভূত হয় এবং সাধারণতঃ ঐগুলোর অনৈশ্বরিকতার প্রমাণ,সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাস ও আচরণে প্রতিফলিত হয়।
এখানে স্মরণযোগ্য যে,নবীগণের (আ.) মু’
জিযাহসমূহ যা প্রত্যক্ষভাবে প্রমাণ করে তা হল তাদের নবুয়্যতের দাবির সত্যতা। কিন্তু রিসালাতের বিষয়বস্তুর সঠিকতা এবং আদিষ্ট বিষয়সমূহের আনুগত্যের অপরিহার্যতা অপ্রত্যক্ষভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যভাবে বলা যায় : নবীগণের নবুয়্যতকে বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলের মাধ্যমে এবং তাদের সংবাদের বিষয়বস্তুর বিশ্বস্ততা বিশ্বাসগত (تعبدی
) দলিলের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়।