আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)

আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)13%

আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড) লেখক:
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ: নবুয়্যত

  • শুরু
  • পূর্বের
  • 32 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 16816 / ডাউনলোড: 4315
সাইজ সাইজ সাইজ
আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)

আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)

লেখক:
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বাংলা

৯ম পাঠ

নবীগণের বিশেষত্বসমূহ

নবীগণের সংখ্যাধিক্য :

এ পর্যন্ত পথপরিচিতি ও নবুয়্যতের তিনটি মূলবস্তু আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল। ইতিমধ্যে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌছেছি যে,ইহ ও পরকালীন সৌভাগ্যের জন্যে যে সকল জ্ঞাতব্য মানুষের জন্যে অপরিহার্য সে গুলোর সবগুলো সম্পর্কে অবগত হওয়া তার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে অসম্ভব সেহেতু প্রভুর প্রজ্ঞার দাবি হল -নবী অথবা নবীগণকে নির্বাচন করতঃ প্রযোজনীয় সকল বাস্তুবতা সম্পর্কে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিবেন যাতে অবিচ্যুত ও সঠিক অবস্থায় ঐ বিষয়গুলোকে অন্য সকল মানুষের নিকট পৌছাতে পারেন। অপরদিকে এ মনোনীত ব্যক্তিগণকে এরূপে মানুষের নিকট পরিচয় করাবেন,যাতে তাদের স্বপক্ষে চূড়ান্ত দলিল উপস্থাপিত হয় এবং এর সার্বজনীন পন্থা হল,মু জিযাহ প্রদর্শন।

উপরোক্ত বিষয়কে বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলের মাধ্যমে প্রমাণ করেছি। কিন্তু উল্লেখিত দলিলটিতে নবীগণের সংখ্যাধিক্য,কিতাবসমূহ ও ঐশী বিধানসমূহের কোন প্রমাণ উপস্থাপিত হয়নি। ধরা যাক,যদি মানুষের জীবন এরূপ হত যে,একজন নবী বিশ্বের শেষাবধি এমনভাবে সকল মানব সম্প্রদায়ের জিজ্ঞাসার জবাব দিতে পারতেন যে,সকল ব্যক্তি ও গোষ্ঠী ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় একই নবীর বাণীর মাধ্যমে নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে অবগত হতে পারত,তবে তা অযৌক্তিক হত না।

কিন্তু আমরা জানি যে,প্রথমতঃ প্রতিটি মানূষেরই (নবীগণেরও) আয়ুষ্কাল সীমাবদ্ধ। আর প্রভুর প্রজ্ঞার দাবিও এটা ছিলনা যে,সর্বপ্রথম নবীই পৃথিবীর শেষ লগ্ন পর্যন্ত জীবন-যাপন করবেন এবং সকল মানুষকেই ব্যক্তিগতভাবে পথনির্দেশ দিবেন।

দ্বিতীয়তঃ জীবনের শর্ত বিভিন্ন স্থান-কাল-পাত্র ভেদে একরকম নয় এবং জীবনের এ বৈচিত্রময়তা ও শর্তের পরিবর্তন এবং বিশেষ করে সামাজিক সম্পর্কের ক্রমবর্ধমান জটিলতা,বিধি-বিধান ও সামাজিক নীতির ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে নতুন নিয়ম প্রণয়নের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। যদি এ বিধিগুলো এমন কোন নবীর মাধ্যমে বর্ণিত হত যিনি সহস্র শতাব্দী পূর্বে নবুয়্যত লাভ করেছিলেন তবে তা অনর্থক কর্ম হত। এ ছাড়া নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ঐগুলোর রক্ষণ ও প্রচার খুবই কঠিন ও কষ্টসাধ্য কাজ।

তৃতীয়তঃ পূর্ববর্তী অধিকাংশ সময়ই নবীগণের প্রচার সামগ্রী এ রকম ছিলনা যে,একজন নবী স্বীয় বাণীগুলো সকল বিশ্ববাসীর নিকট পৌছাতে সক্ষম হতেন।

চতুর্থতঃ কোন জনসমষ্টিতে প্রেরিত এক নবীর বাণীসমূহ সময়ের আবর্তে বিভিন্ন কারণের প্রভাবে,ভ্রান্ত ব্যাখ্যা ও বিকৃতির সম্মুখীন হত এবং কালক্রমে একটি বিকৃত ধর্মে রূপ পরিগ্রহ করত। যেমন : ঈসা ইবনে মারিয়াম (আ.) এর তাওহীদি ধর্ম বা একত্ববাদী ধর্ম সময়ের পরিক্রমায় তৃতবাদী ধর্মে রূপান্তরিত হয়েছিল।

এ বিষয়টির আলোকে নবীগণের (আ.) এবং মানুষ ও সমাজের কোন কোন বিধি-নিয়মের সংখ্যাধিক্যের রহস্য উন্মোচিত হয়২৩ -যদিও ঐ গুলোর সবগুলোই মৌলিক বিশ্বাস,চারিত্রিক মূল্যবোধ এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক সামগ্রিক নীতিমালার ক্ষেত্রে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।২৪ যেমন : সকল ঐশী ধর্মেই নামাজ ছিল -যদিও তা সম্পাদনের প্রক্রিয়া ও কিবলাহ বিভিন্ন ছিল। অনুরূপ পরিমাণ ও ক্ষেত্রের বিভিন্নতা সত্ত্বেও যাকাত সম্প্রদান ব্যবস্থাও সর্বদাই ছিল।

যা হোক সকল নবীগণের (আ.) উপর বিশ্বাস স্থাপন,নবুয়্যতের স্বীকৃতির দিক থেকে তাদের মধ্যে পার্থক্য না করা তাদের সকল বাণী ও সকল জ্ঞাতব্য,যা কিছু তাদের নিকট প্রেরিত হয়েছে সেগুলোকে গ্রহণ করা এবং তাদের মধ্যে বৈষম্য না করা প্রত্যেক মানুষের জন্য অপরিহার্য।২৫ অনুরূপ কোন নবী এবং তার কোন শরীয়ত ও আহকামকেই অস্বীকার করা বৈধ নয়। এমনকি তাদের যে কোন একজনকে অস্বীকার করা সকলকে অস্বীকার করার সমতুল্য;যেমন : প্রভুর কোন একটি আদেশকে অস্বীকার করা সকল আদেশের অস্বীকৃতির সমান।২৬ তবে প্রত্যেক উম্মতের দায়িত্ব ও কর্তব্য সংশ্লিষ্ট নবী ও তার সময়ের আদেশ-নিষেধ অনুসারে কার্যকর হয়। এখানে একটি বিষয় স্মরণযোগ্য যে,উপরোক্ত প্রক্রিয়ায় মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি,নবীগণ ঐশীগ্রন্থ ও শরীয়তের বিভিন্নতার রহস্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হলেও এ সম্পর্কে কোন যথাযথ সূত্র হস্তগত করতে পারে না। যেমনি করে সে বিবেচনা করতে পারেনা যে,কোথায় এবং কখন অন্য কোন নবীর আবির্ভাব অথবা নতুন কোন শরীয়তের প্রবর্তন হওয়া উচিৎ। তবে এতটুকুই শুধু অনুধাবন করা যেতে পারে যে,যদি মানুষের জীবন ব্যবস্থা এমনটি হয় যে,কোন নবীর আহ্বান সারা বিশ্ববাসীর নিকট পৌছবে ও ভবিষ্যৎ বিশ্ববাসীদের জন্যে তার বাণী আবিকৃত ও সংরক্ষিত থাকবে এবং সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনে নতুন কোন শরীয়ত প্রবর্তনের ও এর পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে না তবে অন্য কোন নবীরও প্রয়োজনীয়তা থাকবে না।

নবীগণের সংখ্যা :

যেমনটি ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে,আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি নবীগণ ও ঐশী গ্রন্থসমূহের সংখ্যা নির্ধারণ করতে অপারগ এবং এ ধরনের বিষয়বস্তুর প্রমাণ,উদ্ধৃতিগত দলিল ব্যতীত অসম্ভব। পবিত্র কোরানে যদিও এ সম্পর্কে গুরুত্বারোপ করা হয় যে,মহান আল্লাহ সকল উম্মতের জন্যেই নবী প্রেরণ করেছেন।২৭ কিন্তু নবীগণের সংখ্যা ও উম্মত সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বিবৃত হয়নি। শুধুমাত্র বিশোর্ধ সংখ্যক নবীর (আ.) নাম এবং অপর কিছু সংখ্যক নবীর কাহিনী সম্পর্কে (নাম না উল্লেখ করে) ইঙ্গিত করা হয়েছে।২৮ কিন্তু পবিত্র আহলে বাইত (আলাইহিমুসসালাম আজমাইন) থেকে বর্ণিত রেওয়ায়েতে এসেছে যে,মহান আল্লাহ একলক্ষ চব্বিশ হাজার নবী প্রেরণ করেছেন২৯ এবং তাদের ধারা আবুল বাশার বা মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু হয়ে হযরত মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আ লিহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে যবনিকা রেখা টেনেছে।

আল্লাহর প্রেরিত পুরুষগণ,নবী (نبی ) নামকরণ,যা মহান আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ উপাধি,তা ব্যতীতও নাজির (نذیر ) মুনজির (منذیر ) বাশির (بشیر ) ও মুবাশ্যির (مبشّیر )৩০ ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত হতেন এবং সালিহীন (صالحین ) ও মোখলাসিন (مخلصین ) রূপেও পরিগণিত হতেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার রিসালাতেরও অধিকারী ছিলেন এবং কোন কোন রেওয়ায়েতের ভাষায় এ ধরণের রাসূলগণের সংখ্যা তিনশত তের জন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।৩১

আর এ জন্যে অমরা এখানে নবুয়্যত ও রিসালাতের তাৎপর্য এবং নবী (نبی ) ও রাসূলের (رسول )মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করব।

নবুয়্যাত ও রিসালাত :

রাসূল (رسول ) শব্দটির অর্থ হল সংবাদ বাহক। আর নবী (نبی ) শব্দটি যদিنبأ উপাদান থেকে গঠিত হয়ে থাকে,তবে তার অর্থ হল গুরুত্বপূর্ণ সংবাদের অধিকারী এবং যদিنبو উপাদান থেকে সংগঠিত হয়ে থাকে,তবে তার অর্থ হল সম্মানিত ও সমুন্নত মর্যাদার অধিকারী

অনেকের মতে নবী শব্দটির অর্থ রাসূল শব্দটির অর্থ অপেক্ষা বিস্তৃততর। আর তা হল এরূপ : নবী অর্থ,যিনি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী প্রাপ্ত হয়েছেন -চাই তা অন্যের নিকট পৌছাতে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন বা না হন। কিন্তু রাসূল হলেন তিনিই যিনি প্রাপ্ত ওহী অপরের নিকট পৌছাতেও আদিষ্ট হয়েছেন।

কিন্তু এ দাবিটি সঠিক নয়। কারণ কোরানের কোন কোন আয়াতে নবী বিশেষণটি রাসূল বিশেষণের অব্যবহিত পরই উল্লেখ হয়েছে।৩২ অথচ উপরোক্ত বক্তব্য অনুসারে যে বিশেষণটি অপেক্ষাকৃত বিস্তৃততর অর্থবহ (নবী) সে বিশেষণটি বিশেষ অর্থ প্রকাশক বিশেষনের (রাসূল) পূর্বেই উল্লেখিত হওয়া উচিৎ। তাছাড়া ওহী প্রচারের ক্ষেত্রে রাসূলগণকেই (নবীদেরকে ব্যতীত) যে বিশেষভাবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে,সে সম্পর্কে কোন দলিল নেই। কোন কোন রেওয়ায়েতে এসেছে যে,নবূয়্যতের মর্যাদার অধিকারী ব্যক্তি ওহীর ফেরেস্তাকে নিদ্রাবস্থায় স্বপ্নযোগে দেখতে পান এবং জাগ্রত অবস্থায় শুধুমাত্র তার শব্দ শুনতে পান। কিন্তু রিসালাতের অধিকারী ব্যক্তি ওহীর ফেরেস্তাকে জাগ্রত অবস্থায়ও দেখতে পান।৩৩

উপরোক্ত পার্থক্যটিও শাব্দিক অর্থের দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না । তবে যা গ্রহণযোগ্য হতে পারে তা হল এই যে,নবী (نبی ) শব্দটি দৃষ্টান্তের (مصداق ) দিক থেকে (ভাবার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে) রাসূল (رسول ) শব্দটি অপেক্ষা বিস্তৃততর অর্থ বহন করে থাকে। অর্থাৎ সকল প্রেরিত পুরুষই নবুয়্যতের মর্যাদার অধিকারী। কিন্তু রিসালাতের অধিকার তাদের মধ্যে বিশেষ একশ্রেণীর জন্যে নির্দিষ্ট এবং পূর্বোল্লিখিত রেওয়ায়েত অনুসারে বাসূলগণের সংখ্যা ছিল তিনশত তের জন। স্বভাবতঃই তাদের মর্যাদা,অন্যান্য প্রেরিত পুরুষগণের চেয়ে উর্ধ্বে যেমনি করে রাসূলগণের সকলেই মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের দিক থেকে একরকম ছিলেন না।৩৪ তাদের মধ্যে কেউ কেউ ইমামতের সম্মানেও ভূষিত হয়েছিলেন।৩৫

পবিত্র কোরানে একদল নবীকে উলুল আজম (اولو العزم ) নামে পরিচয় দেয়া হয়েছে,৩৬ কিন্তু তাদের বিশেষত্বসমূহ সুনির্দিষ্টরূপে নির্দেশ করা হয়নি। তবে আহলে বাইত আলাইহিমুসসালাতু ওয়স্সালামের বর্ণনা থেকে যতটুকু জানা যায় তাতে দেখা যায় উলুল আজম পাঁচজন ছিলেন। তারা যথাক্রমে : হযরত নূহ (আ.),হযরত ইব্রাহীম (আ.),হযরত মূসা (আ.),হযরত ঈসা (আ.),হযরত মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ (সা.)৩৭ । আর তাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ (চূড়ান্ত ধৈর্য ও স্থৈর্য ছাড়াও) ছিল এই যে,তাদের প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র কিতাব ও শরীয়তের অধিকারী ছিলেন এবং সমসাময়িক কালের নবীগণ অথবা পরবর্তী নবীগণ,যতক্ষণ পর্যন্ত না অন্য কোন উলুল আজম রিসালাতের নিমিত্তে প্রেরিত হতেন বা নতুন কোন কিতাব ও শরীয়ত নিয়ে আসতেন তাদের শরীয়তের অনুসরণ করতেন।

একই সাথে সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়েছে যে,একই সময়ে দু নবীর আবির্ভাব সম্ভব। যেমন : হযরত লুত (আ.),হযরত ইব্রাহীমের (আ.) সমসাময়িক ছিলেন এবং হযরত হারুন (আ.),হযরত মুসার (আ.) সাথে যুগপৎ নবুয়্যত লাভ করেছিলেন। অনুরূপ হযরত ইয়াহ্ইয়া (আ.) ছিলেন হযরত ঈসার (আ.) সমসাময়িক।

কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় :

এ আলোচনার শেষাংশে আমরা নবুয়্যতের উপর কয়েকটি বিষয়ের প্রতি ইংগিত করব :

ক) নবীগণ পরস্পর পরস্পরকে সত্যায়িত করতেন এবং পরবর্তী নবীর আবির্ভাবের সুসংবাদ প্রদান করতেন।৩৮ অতএব যদি কেউ নবুয়্যতের দাবি করে অথচ পূর্ববর্তী অথবা সমসাময়িক নবীদেরকে অস্বীকার করে তবে সে মিথ্যাবাদী বৈ কিছু নয়।

খ) আল্লাহর নবীগণ স্বীয় দায়িত্ব পালনের জন্যে মানুষের নিকট কোন প্রতিদান আশা করতেন না।৩৯ তবে একমাত্র ইসলামের নবীই (সা.) রিসালাতের বিনিময়ে স্বীয় আহলে বাইতের (আ.) জন্যে মানুষের নিকট তাদের আনুগত্য ও ভালবাসা (مودّة ) কামনা করেছিলেন,যার অর্থ হল তাদেরকে অনুসরণের জন্যে গুরুত্বারোপ করা। প্রকৃতপক্ষে এর সুফল উম্মতের দিকেই প্রত্যাবর্তন করে।

) قُلْ لَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِلَّا الْمَوَدَّةَ فِي الْقُرْبَى(

বল, আমি এর বিনিময়ে তোমাদের নিকট হতে আমার নিকট আত্মীয়ের সৌহার্দ্য ব্যতীত অন্য কোন প্রতিদান চাই না । (সূরা শুরা -২৩)

) قُلْ مَا سَأَلْتُكُمْ مِنْ أَجْرٍ فَهُوَ لَكُمْ إِنْ أَجْرِيَ إِلَّا عَلَى اللَّهِ(

বল, আমি তোমাদের নিকট কোন পারিশ্রমিক চেয়ে থাকলে তা তোমাদেরই;আমার পুরস্কার তো আছে আল্লাহর নিকট । (সূরা সাবা -৪৭)

গ) কোন কোন নবী আল্লাহর পক্ষ থেকে বিচার ও শাসনকার্যের মত দায়িত্বও লাভ করেছিলেন। উদাহরণতঃ পূর্ববর্তী নবীগণের মধ্যে হযরত দাউদ (আ.) ও হযরত সোলায়মানের (আ.) নাম স্মরণ করা যেতে পারে। এ ছাড়া সূরা নিসার ৬৪ তম আয়াত,যাতে সকল রাসূলেরই অনুসরণ নিরঙ্কুশভাবে মানুষের জন্যে অপরিহার্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে তা থেকে আমরা বলতে পারি যে,সকল রাসূলই এ ধরনের মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।

ঘ) জিন সম্প্রদায় যারা প্রকারান্তরে স্বাধীন ও দায়িত্বশীল সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত এবং সাধারণতঃ মানুষের দৃষ্টির আড়ালে অবস্থান করে,তারা কোন কোন নবীর (আ.) আহবান সম্পর্কে অবগত হতেন। এ সম্প্রদায়ের ভাল ও পুণ্যবান নবীগণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতেন। তাদের মধ্যে হযরত মুসা (আ.) ও হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর অনুসারী বিদ্যমান।৪০ আবার এদের মধ্যে কেউ কেউ ইবলিসের অনুসরণ করে আল্লাহর নবীগণকে অস্বীকার করেছে।৪১

১০ম পাঠ

জনগণ ও নবীগণ

ভূমিকা :

পবিত্র কোরান যখন পূর্ববর্তী নবীগণকে স্মরণ করে,তাদের দীপ্তিময় ও কল্যাণময় জীবনের প্রান্ত থেকে কিঞ্চিৎ বর্ণনা করে এবং ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত সকল প্রকারের বিচ্যুতির মরিচা থেকে তাদের জীবন ইতিহাসের উজ্জ্বল অধ্যায়গুলোকে মুক্তভাবে উপস্থাপন করে তখন নবীগণের (আ.) প্রতি বিভিন্ন উম্মতের প্রতিক্রিয়া বা ভূমিকা সম্পর্কেও আলোক পাত করার জন্যে উদার হস্ত থাকে। পবিত্র কোরান একদিকে যেমন নবীগণের (আ.) বিপরীতে মানুষের ভূমিকা এবং তাদের বিরোধিতার কারণ সম্পর্কে আলোচনা করে,অপরদিকে তেমনি হিদায়াত ও আধ্যাত্মিক পরিচর্যার ক্ষেত্রে নবীগণ (আ.) কর্তৃক অবলম্বিত পদ্ধতি এবং কুফর,শিরক ও বিচ্যুতির বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রাম সম্পর্কেও আলোকপাত করে। তদনুরূপ বিশেষ করে নবীগণের সাথে জনগণের পারস্পরিক সম্পর্কের দৃষ্টিকোণ থেকে সামাজিক পরিকল্পনা সম্পর্কে আলোচনা করে যা অসংখ্য শিক্ষণীয় বিষয়কে ধারণ করেছে। এ আলোচ্য বিষয়টি যদিও মূল বিশ্বাসগত ও কালামশাস্ত্রগত বিষয়ের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত নয়,তবু একদিকে যেমন নবুয়্যত সম্পর্কে বিভিন্ন জিজ্ঞাসার জবাব দানের পাশাপাশি এ সম্পর্কে অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবসান ঘটায় অপরদিকে তেমনি শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক পরিচর্যার জন্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে মানুষ যে শিক্ষা লাভ করে তাতে অভূতপূর্ব গুরুত্ব বহন করে। আর এ দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচ্য পাঠে আমরা এগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করব।

৩য় পাঠ

কয়েকটি প্রশ্নের জবাব

কয়েকটি প্রশ্নের জবাব :

নবুয়্যতের অপরিহার্যতা সম্পর্কে যে প্রমাণটি উপস্থাপন করা হয়েছে তার উপর একাধিক প্রশ্ন ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ থাকতে পারে। এখন আমরা সেগুলোর অবতারণা ও উত্তর দানের চেষ্টা করব :

১। যদি মহান আল্লাহর প্রজ্ঞার দাবি এটাই হয় যে,নবীগণের নবুয়্যতের মাধ্যমে সকল মানুষ হিদায়াত প্রাপ্ত হবে,তবে কেন তাদের সকলেই এক বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থানে প্রেরিত হয়েছে এবং পৃথিবীর অন্যান্য স্থান এ অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে? বিশেষ করে প্রাচীনকালে যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সংবাদ আদান-প্রদানের মাত্রা ছিল খুবই সীমাবদ্ধ,ধীর গতির এবং সম্ভবতঃ এমন কোন জাতি বা গোষ্ঠী থাকতে পারে যারা নবীগণের আহ্বান সম্পর্কে কোনভাবেই অবগত ছিল না।

জবাব : প্রথমতঃ নবীগণের আবির্ভাব কোন নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ ছিল না এবং পবিত্র কোরানের আয়াত থেকে আমরা এ প্রমাণ পাই যে,প্রতিটি গোত্র ও জাতির জন্যেই কোন না কোন নবী ছিলেন। যেমন :

) وَإِنْ مِنْ أُمَّةٍ إِلَّا خَلَا فِيهَا نَذِيرٌ(

এবং এমন কোন সম্প্রদায় নেই যার নিকট সর্তককারী প্রেরিত হয়নি। (সূরাঃ ফাতির -২৪) অনুরূপ,

) وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ(

এবং আল্লাহর ইবাদত করার ও তাগুতকে বর্জন করার নির্দেশ দেয়ার জন্যে আমি তো প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল পাঠিয়েছি। (সূরাঃ নাহল-৩৬)

পবিত্র কোরানে যদিও মুষ্টিমেয় কিছু নবীগণের (আ.) নাম উল্লেখ হয়েছে,তবে তার অর্থ এ নয় যে,নবীগণের সংখ্যাও তা-ই ছিল। বরং স্বয়ং পবিত্র কোরানেই সুস্পষ্টরূপে বর্ণিত হয়েছে যে,এমন অনেক নবী ছিলেন যাদের নাম এ পবিত্র কিতাবে উল্লেখ হয়নি। যেমন :

) وَرُسُلًا لَمْ نَقْصُصْهُمْ عَلَيْكَ(

এবং অনেক রাসূল যাদের কথা তোমাকে বলিনি। (সূরা : নিসা ১৬৪)

দ্বিতীয়ত : উল্লেখিতি প্রমাণটির দাবি ছিল এই যে,ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধিবৃত্তি বহির্ভূত অপর কোন মাধ্যমও থাকা উচিৎ,যার মাধ্যমে মানুষ হিদায়াত প্রাপ্ত হবে। কিন্তু হিদায়াত প্রাপ্তি দু টি শর্তে কোন ব্যক্তির ক্ষেত্রে বাস্তবরূপ লাভ করে থাকে। একটি হল : ব্যক্তি স্বয়ং প্রভু কর্তৃক প্রদত্ত এ নিয়ামত বা অনুগ্রহ থেকে লাভবান হতে চাইবেন। অপরটি হল : অন্যরা এ হিদায়াতের পথে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবেন না। অধিকাংশ মানুষ স্বেচ্ছাচারিতার কারণে হিদায়াত প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন,তেমনি অপর সিংহভাগ আবার প্রচারের প্রসারে প্রতিবন্ধকতার ফলে বঞ্চিত হয়েছেন। আমরা জানি আল্লাহর প্রেরিত পূরুষগণ এ প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের জন্যে সদা সচেষ্ট ছিলেন এবং আল্লাহর শক্রদের সাথে,বিশেষ করে শক্তিধর ও দাম্ভিকদের সাথে সংগ্রামরত ছিলেন। আর আল্লাহর বাণী প্রচার ও মানুষকে হিদায়াতের পথে নবীগণের মধ্যে অনেকেই নিজ জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করেছিলেন। কোন কোন ক্ষেত্রে যদি অনুসারী ও সহযোগী সংগ্রহ করতে পারতেন তবে অত্যাচারী ও স্বৈরাচারীদের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিতেও কুণ্ঠাবোধ করতেন না। আর এ অত্যাচারী ও স্বৈরাচারী শ্রেণীই হল দ্বীনের প্রসারের ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধক।

এখানে স্মরণযোগ্য যে,মানবীয় উৎকর্ষের পথ স্বাধীন নির্বাচনাধীন হওয়ার অপরিহার্য অর্থ হল : এ সকল ঘটনাগুলো এমনভাবে রূপ পরিগ্রহ করবে যে,সুপথ ও কুপথের নির্বাচনের ক্ষেত্রে সত্যপন্থী ও মিথ্যাপন্থীদের জন্যে উম্মুক্ত থাকবে। তবে স্বৈরাচারী ও মিথ্যাবাদীর প্রভাব যদি এমন স্থানে পৌছে যে,অপরের হিদায়াতের পথ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায় এবং কোন সমাজে সত্যের আলোকবর্তিকা সম্পূর্ণরূপে নির্বাপিত হয়ে যায় তবে ঐ অবস্থায় মহান আল্লাহ কোন না কোন অদৃশ্য উপায়ে ও অসাধারণ পথে সত্যের অনুসারীগণকে সাহায্য করে থাকেন।

সিদ্ধান্ত : যদি এ ধরনের কোন প্রতিবন্ধকতা নবীগণের (আ.) প্রচারের পথে না থাকত তবে তাদের আহ্বান সকল বিশ্ববাসীর কর্ণগোচর হত এবং ওহী ও নবুয়্যতের মাধ্যমে এ হিদায়াতের ঐশী অনুগ্রহ থেকে উপকৃত হত। অতএব অধিকাংশ মানুষের হিদায়াত প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হওয়ার অপরাধ তাদের উপরই বর্তায়,যারা নবীগণের আহ্বানের এবং প্রচার ও প্রসারের পথে বাধা সৃষ্টি করেছিল।

২। যদি নবীগণ মানব সম্প্রদায়ের উৎকর্ষের পথকে সুগম করার জন্যে নবুয়্যত লাভ করে থাকেন তবে কেন তাদের আগমন সত্বেও এত অপরাধ ও অনাচারের উদ্ভব হয়েছে এবং অধিকাংশ মানুষ অধিকাংশ সময়ই কুফর ও গুণাহে লিপ্ত হয়েছে;এমনকি ঐশী ধর্মসমূহের অনুসারীদের পরস্পরের মধ্যেও শত্রুতা ও বিরোধের সৃষ্টি হয়েছে এবং রক্তক্ষয়ী ও ধ্বংসাত্বক যুদ্ধ-বিগ্রহ সংঘটিত হয়েছে? মহান প্রভুর প্রজ্ঞার দাবি কি এটা ছিল না যে,মহান আল্লাহ অন্য কোনভাবে এ সকল অনাচার ও বিশৃংখলার পথ রোধ করবেন যাতে ন্যূনতমপক্ষে ঐশীধর্মসমূহের অনুসারীগণ পরস্পর কলহে লিপ্ত না হয়?

জবাব : মানুষের স্বাধীন বিশেষত্বযুক্ত উৎকর্ষের উপর চিন্তা করলে উপরোক্ত প্রশ্নের জবাব স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়। কারণ,যেমনটি বলা হয়েছে যে,প্রভুর প্রজ্ঞার দাবি হল স্বাধীনভাবে (বাধ্যতামূলক নয়) উৎকর্ষ লাভের সকল ক্ষেত্র ও শতের্র যোগান দিবেন যাতে সত্যানুসন্ধিৎসুগণ সত্যপথ শনাক্ত করতঃ সে পথ পরিক্রমণের মাধ্যমে উৎকর্ষ ও সৌভাগ্য লাভ করতে পারে। কিন্তু এ ধরনের উৎকর্ষের জন্যে শর্ত ও কারণের উপস্থিতির অর্থ এ নয় যে,সকল মানুষ ঐগুলোর সদ্ব্যবহার করে বাধ্যতামূলক সঠিক পথ বেছে নিবে। পবিত্র কোরানের ব্যাখ্যানুসারে,মহান আল্লাহ মানব সম্প্রদায়কে সঙ্গত শর্তেই এ পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন যে,তাদের মধ্যে কারা উত্তম কর্ম সম্পাদন করে তা পরীক্ষা করবেন। অনুরূপ পবিত্র কোরানে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে যে,যদি মহান আল্লাহ চাইতেন তবে সকলকেই সরল পথে পরিচালনা করতে পারতেন এবং বিচ্যুতি ও বক্রতার পথকে সম্পূর্ণরূপে রোধ করতে পারতেন। কিন্তু এ অবস্থায় নির্বাচনের কোন সুযোগই অবশিষ্ট থাকত না এবং মানুষের আচরণ মানবিক মূল্যবোধ বর্জিত হত। আর সেই সাথে স্বাধীন ও নির্বাচন ক্ষমতার অধিকারী মানব সৃষ্টির পথে প্রভুর উদ্দেশ্য ব্যাহত হত।

সিদ্ধান্ত : অন্যায়,ব্যভিচার,কুফর ও গুণাহের প্রতি মানুষের ঝোঁক হল ব্যক্তিগত স্বেচ্ছাচারিতারই প্রমাণবহ। আর এ ধরনের অসদাচরণের ক্ষমতা তার সৃষ্টি রহস্যের মধ্যেই নিহিত রয়েছে এবং ঐগুলোর আনুসঙ্গিক ফলাফল,তাদেরই অনুগামী। প্রভুর ইরাদা মূলতঃ মানুষের উৎকর্ষকেই সমন্বিত করলেও,যেহেতু এ সমন্বয় স্বাধীনতার শর্তাধীন,সেহেতু স্বেচ্ছাচারিতা থেকে উৎসারিত অধঃপতন ও বিচ্যুতিকে প্রতিহত করে না। সর্বোপরি প্রভুর প্রজ্ঞার দাবি এ নয় যে,চাক বা না চাক স্বীয় চাওয়া পাওয়া ও ইরাদার বিরুদ্ধে সঠিক পথে পরিচালিত হবে ।

৩। প্রভুর প্রজ্ঞার দাবি হল এই যে,মানব সম্প্রদায় অধিকতর ও উত্তমরূপে উৎকর্ষ ও সৌভাগ্যের দিকে এগিয়ে যাবে। তাহলে এটাই কি শ্রেয়তর নয় যে,মহান আল্লাহ প্রকৃতির রহস্যসমূহকে ওহীর মাধ্যমে মানুষের নিকট প্রকাশ করবেন যাতে বিভিন্ন প্রকার নেয়ামত লাভ করে মানুষ স্বীয় উৎকর্ষের পথে দ্রুত এগিয়ে যেতে পারে? যেমনকরে গত কয়েক শতাব্দীতে অনেক প্রাকৃতিক শক্তি,কারণ ও দৈনন্দিন সামগ্রীর আবিষ্কার সভ্যতার বিকাশে বিস্ময়কর ভূমিকা পালন করেছে এবং শারীরিক সুস্থতা ও বিভিন্ন ব্যাধির বিরুদ্ধে সংবাদ বিনিময়,যোগযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রেও অমূল্য পরিবর্তন এনেছে। এটা অনস্বীকার্য যে,নবীগণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কারের মাধ্যমে ও সুখ-শান্তির উপকরণ সরবরাহের মাধ্যমে যদি মানুষকে সাহায্য করতেন তবে নিজেদের সামাজিক প্রভাব ও রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে উত্তমরূপে তাদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছতে পারতেন।

জবাব : ওহী ও নবুয়্যতের মূল প্রয়োজন ঐ সকল ক্ষেত্রেই,যেখানে মানুষ পরিচিতির সাধারণ মাধ্যম দ্বারা ঐগুলোকে শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয় এবং ঐগুলো সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার ফলে প্রকৃত উৎর্ষের পথ নির্ধারণ করে সে পথ পরিক্রমণে অপারগ হয়। অন্যকথায় : নবীগণের (আ.) মূল দায়িত্ব এই যে,মানব সম্প্রদায়কে সঠিক দিকনির্দেশনা পাবার ও উৎকর্ষ লাভের পথে সহায়তা করা যাতে সর্বাবস্থায় স্বীয় কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে পারে এবং কাংখিত লক্ষ্যে পৌঁছতে তাদের সকল শক্তি ও সামর্থ্য ব্যয় করতে সক্ষম হয় -হোক সে যাযাবর সম্প্রদায় ও খিমাবাসী কিংবা হোক মহাসাগর অভিযাত্রী ও মহাকাশচারী। কিন্তু তাদেরকে মানুষের প্রকৃত মূল্যবোধসমূহ সম্পর্কে জানতে হবে। জানতে হবে মহান আল্লাহর ইবাদতের ক্ষেত্রে তাদের কী কর্তব্য বয়েছে,কী দায়িত্ব রয়েছে তাদের পরস্পরের প্রতি কিংবা স্বগোত্রের ও অন্য গোত্রের সৃষ্টের প্রতি,যাতে ঐ কর্তব্যগুলো যথাস্থানে সম্পাদনের মাধ্যমে প্রকৃত উৎকর্ষ ও অনন্ত সৌভাগ্যের অধিকারী হতে পারে। অপরদিকে শক্তি ও সামর্থ্যরে বিভিন্নতা,প্রাকৃতিক ও প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধা কোন বিশেষ সময়ে বা বিভিন্ন কালে,কোন বিশেষ কারণানুসারে প্রকাশ লাভ করে এবং প্রকৃত উৎকর্ষ ও চিরন্তন ভাগ্যলিপির ক্ষেত্রে কোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে না। যেমন : আজকের যুগের বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি বস্তুগত ও পার্থিব উন্নয়নের কারণ হলেও,মানুষের আধ্যাত্মিক ও মানসিক উৎকর্ষের ক্ষেত্রে কোন প্রভাব ফেলেনি। বরং নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে,এ কথা বললেও অত্যুক্তি হবে না।

সিদ্ধান্ত : প্রভুর প্রজ্ঞার দাবি হল এই যে,মানব সম্প্রদায় বস্তুগত বৈভবসমূহকে ব্যবহার করে পার্থিব জীবন নির্বাহ করবে এবং বুদ্ধিবৃত্তি ও ওহীর মাধ্যমে স্বীয় পরিক্রমণের পথকে প্রকৃত উৎকর্ষ ও চিরন্তন সৌভাগ্যের দিকে পরিচালিত করবে। কিন্তু শারীরিক ও আত্মিক সামর্থের বিভিন্নতা;অনুরূপ প্রাকৃতিক ও সামাজিক শর্তসমূহের বৈচিত্রময়তা;তদনুরূপ জ্ঞান ও বিজ্ঞান থেকে লাভবান হওয়ার ক্ষেত্রে সাতন্ত্রিকতা ইত্যাদি একাধিক কারণ ও সুনিদিষ্ট শর্তের অধীন,যা কার্যকারণ বিধি মোতাবেক উৎপত্তি লাভ করে। আর এ বিভিন্নতা,মানুষের চিরন্তন ভাগ্যলিপি নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোন ভূমিকা পালন করে না । বরং তা কতইনা উত্তম যে,কোন ব্যক্তি বা সমষ্টি এক অনাড়ম্ভর জীবনাতিবাহিত করেছেন এবং বৈষয়িক ও পার্থিব বৈভব থেকে ন্যূনতম স্বাদ গ্রহণ করেছেন। আর এমতাবস্থায় উৎকর্ষ ও সৌভাগ্যের সমুন্নত শিখরে স্থান লাভ করেছেন। অপরদিকে কতইনা হতভাগ্য সে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর,যারা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও জীবন উপকরণের অধিকারী হওয়া সত্বেও অকৃতজ্ঞতা,দাম্ভিকতা ও অপরের প্রতি অত্যাচার ও অন্যায়ের ফলে নিকৃষ্টতম নরকে পতিত হয়েছে।

তবে আল্লাহ প্রেরিত পূরুষগণ মূল দায়িত্ব পালন (অর্থাৎ প্রকৃত উৎকর্ষ ও অনন্ত সৌভাগ্যের পথে পরিচালনা) ব্যতীত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যময় পার্থিব জীবন-যাপনের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট সহযোগিতা করেছিলেন এবং যেখানেই প্রভুর প্রজ্ঞা প্রয়োজন মনে করেছে সেখানেই কিছুটা হলেও অজ্ঞাত বাস্তবতা ও রহস্যের পর্দা উম্মোচন করেছে,যেমনটি হযরত দাউদ (আ.),সোলায়মান (আ.) ও যুলক্বারনাইনের (আ.) জীবদ্দশায় পরিলক্ষিত হয়। এ ছাড়া আল্লাহর নবীগণ সমাজের তত্ত্বাবধান ও সফলভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রেও সচেষ্ট ছিলেন -যেমনটি হযরত ইউসূফ (আ.) মিশরে সম্পাদন করেছিলেন। কিন্তু এ সমুদয় কর্মের সবগুলোই ছিল তাদের মূল দায়িত্ব ভিন্ন বাড়তি খেদমত ।

অনুরূপ আল্লাহর নবীগণ তাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে কোন বৈজ্ঞানিক,অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব ও প্রতিপত্তি প্রয়োগ করেননি সেক্ষেত্রে বলতে হয় : নবীগণের (আ.) মূল লক্ষ্য (যেমনটি ইতিপূর্বেও একাধিকবার বলা হয়েছে) সচেতন ও স্বাধীনভাবে নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। আর যদি বল প্রয়োগের মাধ্যমে বিপ্লব করতে চাইতেন তবে মানুষের স্বাভাবিক আধ্যাত্মিক বিকাশলাভ ও স্বাধীনভাবে উৎকর্ষ লাভ ঘটত না। বরং জনগণ শক্তি ও চাপের নিকট আত্মসমর্পণ করে তাদের অনুসরণ করত -- প্রভুর প্রতি অনুরাগবশতঃ ও স্বাধীন নির্বাচনের মাধ্যমে নয়। আমীরুল মু'মেনীন আলী (আ.) এ প্রসঙ্গে বলেন :

যদি মহান আল্লাহ চাইতেন তবে নবীগণের আবির্ভারের সময় তাদের জন্যে স্বর্ণ-রৌপ্য ও মণিমুক্তার ভাণ্ডার উন্মুক্ত করে দিতেন,ফল-মূলে পরিপূর্ণ বাগান তাদের অধিকারে প্রদান করতেন এবং আকাশে উড্ডয়নরত পক্ষীকুল ও ভূমিতে বিচরণরত সকল কিছুকেই তাদের সেবায় নিয়োজিত করতেন। আর যদি তা-ই করতেন তবে পরীক্ষা ও পুরস্কারের ক্ষেত্র ব্যাহত হত এবং যদি চাইতেন নবীগণকে এমন দুর্লভ ক্ষমতা ও অটুট সম্মান,রাজ্য ও শাসনক্ষমতার অধিকারী করতেন যে,অন্যান্যরা লোভ ও ভীতির বশবর্তী হয়ে তাদের আনুগত্য প্রকাশ করবে এবং দাম্ভিকতা ও স্বেচ্ছাচারিতা থেকে দূরে থাকবে,তবে ঐ অবস্থায় প্রবৃত্তি ও মূল্যবোধসমূহ এক সমান হত। কিন্তু মহান আল্লাহ এমনটি চেয়েছেন যে,নবীগণের (আ.) অনুসরণ,তাদের কিতাবসমূহকে স্বীকার করা ও তাদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ নিখুতভাবে ও একমাত্র খোদাপ্রীতির ফলেই ঘটবে। আর পরীক্ষা যত বৃহত্তর হবে,প্রভু কর্তৃক প্রদত্ত পুরস্কার ও প্রতিদানের পরিমাণও ততবেশী বৃদ্ধি পাবে। তবে যদি কোন জনসমষ্টি স্বাধীন নির্বাচন ও অনুরাগের বশবর্তী ও সত্য ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হয়ে আল্লাহর অনুগত সমাজ প্রতিষ্ঠা করে এবং ঐশী উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্যে বিশেষ করে অন্যায়,অত্যাচার নির্মূল করার জন্য ও মু'মেনগণের অধিকার সংরক্ষণের জন্যে বিভিন্ন শক্তি ও প্রতিপত্তির আশ্রয় নেয়,তবে তা অনাকাংখিত হবে না;যার উদাহরণ হযরত সোলায়মানের (আ.) শাসন ব্যবস্থায় পরিলক্ষিত হয়।


3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15