৯ম পাঠ
নবীগণের বিশেষত্বসমূহ
নবীগণের সংখ্যাধিক্য
:
এ পর্যন্ত পথপরিচিতি ও নবুয়্যতের তিনটি মূলবস্তু আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল। ইতিমধ্যে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌছেছি যে,ইহ ও পরকালীন সৌভাগ্যের জন্যে যে সকল জ্ঞাতব্য মানুষের জন্যে অপরিহার্য সে গুলোর সবগুলো সম্পর্কে অবগত হওয়া তার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে অসম্ভব সেহেতু প্রভুর প্রজ্ঞার দাবি হল -নবী অথবা নবীগণকে নির্বাচন করতঃ প্রযোজনীয় সকল বাস্তুবতা সম্পর্কে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিবেন যাতে অবিচ্যুত ও সঠিক অবস্থায় ঐ বিষয়গুলোকে অন্য সকল মানুষের নিকট পৌছাতে পারেন। অপরদিকে এ মনোনীত ব্যক্তিগণকে এরূপে মানুষের নিকট পরিচয় করাবেন,যাতে তাদের স্বপক্ষে চূড়ান্ত দলিল উপস্থাপিত হয় এবং এর সার্বজনীন পন্থা হল,মু’
জিযাহ প্রদর্শন।
উপরোক্ত বিষয়কে বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলের মাধ্যমে প্রমাণ করেছি। কিন্তু উল্লেখিত দলিলটিতে নবীগণের সংখ্যাধিক্য,কিতাবসমূহ ও ঐশী বিধানসমূহের কোন প্রমাণ উপস্থাপিত হয়নি। ধরা যাক,যদি মানুষের জীবন এরূপ হত যে,একজন নবী বিশ্বের শেষাবধি এমনভাবে সকল মানব সম্প্রদায়ের জিজ্ঞাসার জবাব দিতে পারতেন যে,সকল ব্যক্তি ও গোষ্ঠী ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় একই নবীর বাণীর মাধ্যমে নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে অবগত হতে পারত,তবে তা অযৌক্তিক হত না।
কিন্তু আমরা জানি যে,প্রথমতঃ প্রতিটি মানূষেরই (নবীগণেরও) আয়ুষ্কাল সীমাবদ্ধ। আর প্রভুর প্রজ্ঞার দাবিও এটা ছিলনা যে,সর্বপ্রথম নবীই পৃথিবীর শেষ লগ্ন পর্যন্ত জীবন-যাপন করবেন এবং সকল মানুষকেই ব্যক্তিগতভাবে পথনির্দেশ দিবেন।
দ্বিতীয়তঃ জীবনের শর্ত বিভিন্ন স্থান-কাল-পাত্র ভেদে একরকম নয় এবং জীবনের এ বৈচিত্রময়তা ও শর্তের পরিবর্তন এবং বিশেষ করে সামাজিক সম্পর্কের ক্রমবর্ধমান জটিলতা,বিধি-বিধান ও সামাজিক নীতির ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে নতুন নিয়ম প্রণয়নের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। যদি এ বিধিগুলো এমন কোন নবীর মাধ্যমে বর্ণিত হত যিনি সহস্র শতাব্দী পূর্বে নবুয়্যত লাভ করেছিলেন তবে তা অনর্থক কর্ম হত। এ ছাড়া নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ঐগুলোর রক্ষণ ও প্রচার খুবই কঠিন ও কষ্টসাধ্য কাজ।
তৃতীয়তঃ পূর্ববর্তী অধিকাংশ সময়ই নবীগণের প্রচার সামগ্রী এ রকম ছিলনা যে,একজন নবী স্বীয় বাণীগুলো সকল বিশ্ববাসীর নিকট পৌছাতে সক্ষম হতেন।
চতুর্থতঃ কোন জনসমষ্টিতে প্রেরিত এক নবীর বাণীসমূহ সময়ের আবর্তে বিভিন্ন কারণের প্রভাবে,ভ্রান্ত ব্যাখ্যা ও বিকৃতির সম্মুখীন হত এবং কালক্রমে একটি বিকৃত ধর্মে রূপ পরিগ্রহ করত। যেমন : ঈসা ইবনে মারিয়াম (আ.) এর তাওহীদি ধর্ম বা একত্ববাদী ধর্ম সময়ের পরিক্রমায় তৃতবাদী ধর্মে রূপান্তরিত হয়েছিল।
এ বিষয়টির আলোকে নবীগণের (আ.) এবং মানুষ ও সমাজের কোন কোন বিধি-নিয়মের সংখ্যাধিক্যের রহস্য উন্মোচিত হয়
-যদিও ঐ গুলোর সবগুলোই মৌলিক বিশ্বাস,চারিত্রিক মূল্যবোধ এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক সামগ্রিক নীতিমালার ক্ষেত্রে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।
যেমন : সকল ঐশী ধর্মেই নামাজ ছিল -যদিও তা সম্পাদনের প্রক্রিয়া ও কিবলাহ বিভিন্ন ছিল। অনুরূপ পরিমাণ ও ক্ষেত্রের বিভিন্নতা সত্ত্বেও যাকাত সম্প্রদান ব্যবস্থাও সর্বদাই ছিল।
যা হোক সকল নবীগণের (আ.) উপর বিশ্বাস স্থাপন,নবুয়্যতের স্বীকৃতির দিক থেকে তাদের মধ্যে পার্থক্য না করা তাদের সকল বাণী ও সকল জ্ঞাতব্য,যা কিছু তাদের নিকট প্রেরিত হয়েছে সেগুলোকে গ্রহণ করা এবং তাদের মধ্যে বৈষম্য না করা প্রত্যেক মানুষের জন্য অপরিহার্য।
অনুরূপ কোন নবী এবং তার কোন শরীয়ত ও আহকামকেই অস্বীকার করা বৈধ নয়। এমনকি তাদের যে কোন একজনকে অস্বীকার করা সকলকে অস্বীকার করার সমতুল্য;যেমন : প্রভুর কোন একটি আদেশকে অস্বীকার করা সকল আদেশের অস্বীকৃতির সমান।
তবে প্রত্যেক উম্মতের দায়িত্ব ও কর্তব্য সংশ্লিষ্ট নবী ও তার সময়ের আদেশ-নিষেধ অনুসারে কার্যকর হয়। এখানে একটি বিষয় স্মরণযোগ্য যে,উপরোক্ত প্রক্রিয়ায় মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি,নবীগণ ঐশীগ্রন্থ ও শরীয়তের বিভিন্নতার রহস্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হলেও এ সম্পর্কে কোন যথাযথ সূত্র হস্তগত করতে পারে না। যেমনি করে সে বিবেচনা করতে পারেনা যে,কোথায় এবং কখন অন্য কোন নবীর আবির্ভাব অথবা নতুন কোন শরীয়তের প্রবর্তন হওয়া উচিৎ। তবে এতটুকুই শুধু অনুধাবন করা যেতে পারে যে,যদি মানুষের জীবন ব্যবস্থা এমনটি হয় যে,কোন নবীর আহ্বান সারা বিশ্ববাসীর নিকট পৌছবে ও ভবিষ্যৎ বিশ্ববাসীদের জন্যে তার বাণী আবিকৃত ও সংরক্ষিত থাকবে এবং সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনে নতুন কোন শরীয়ত প্রবর্তনের ও এর পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে না তবে অন্য কোন নবীরও প্রয়োজনীয়তা থাকবে না।
নবীগণের সংখ্যা :
যেমনটি ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে,আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি নবীগণ ও ঐশী গ্রন্থসমূহের সংখ্যা নির্ধারণ করতে অপারগ এবং এ ধরনের বিষয়বস্তুর প্রমাণ,উদ্ধৃতিগত দলিল ব্যতীত অসম্ভব। পবিত্র কোরানে যদিও এ সম্পর্কে গুরুত্বারোপ করা হয় যে,মহান আল্লাহ সকল উম্মতের জন্যেই নবী প্রেরণ করেছেন।
কিন্তু নবীগণের সংখ্যা ও উম্মত সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বিবৃত হয়নি। শুধুমাত্র বিশোর্ধ সংখ্যক নবীর (আ.) নাম এবং অপর কিছু সংখ্যক নবীর কাহিনী সম্পর্কে (নাম না উল্লেখ করে) ইঙ্গিত করা হয়েছে।
কিন্তু পবিত্র আহলে বাইত (আলাইহিমুসসালাম আজমাইন) থেকে বর্ণিত রেওয়ায়েতে এসেছে যে,মহান আল্লাহ একলক্ষ চব্বিশ হাজার নবী প্রেরণ করেছেন
এবং তাদের ধারা আবুল বাশার বা মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু হয়ে হযরত মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আ’
লিহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে যবনিকা রেখা টেনেছে।
আল্লাহর প্রেরিত পুরুষগণ,নবী (نبی
) নামকরণ,যা মহান আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ উপাধি,তা ব্যতীতও নাজির (نذیر
) মুনজির (منذیر
) বাশির (بشیر
) ও মুবাশ্যির (مبشّیر
)
ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত হতেন এবং সালিহীন (صالحین
) ও মোখলাসিন (مخلصین
) রূপেও পরিগণিত হতেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার রিসালাতেরও অধিকারী ছিলেন এবং কোন কোন রেওয়ায়েতের ভাষায় এ ধরণের রাসূলগণের সংখ্যা তিনশত তের জন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আর এ জন্যে অমরা এখানে নবুয়্যত ও রিসালাতের তাৎপর্য এবং নবী (نبی
) ও রাসূলের (رسول
)মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করব।
নবুয়্যাত ও রিসালাত
:
রাসূল (رسول
) শব্দটির অর্থ হল সংবাদ বাহক। আর নবী (نبی
) শব্দটি যদিنبأ
উপাদান থেকে গঠিত হয়ে থাকে,তবে তার অর্থ হল‘
গুরুত্বপূর্ণ সংবাদের অধিকারী এবং যদিنبو
উপাদান থেকে সংগঠিত হয়ে থাকে,তবে তার অর্থ হল‘
সম্মানিত ও সমুন্নত মর্যাদার অধিকারী’
।
অনেকের মতে নবী শব্দটির অর্থ রাসূল শব্দটির অর্থ অপেক্ষা বিস্তৃততর। আর তা হল এরূপ : নবী অর্থ,যিনি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী প্রাপ্ত হয়েছেন -চাই তা অন্যের নিকট পৌছাতে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন বা না হন। কিন্তু রাসূল হলেন তিনিই যিনি প্রাপ্ত ওহী অপরের নিকট পৌছাতেও আদিষ্ট হয়েছেন।
কিন্তু এ দাবিটি সঠিক নয়। কারণ কোরানের কোন কোন আয়াতে‘
নবী বিশেষণটি রাসূল বিশেষণের অব্যবহিত পরই উল্লেখ হয়েছে।
অথচ উপরোক্ত বক্তব্য অনুসারে যে বিশেষণটি অপেক্ষাকৃত বিস্তৃততর অর্থবহ (নবী) সে বিশেষণটি বিশেষ অর্থ প্রকাশক বিশেষনের (রাসূল) পূর্বেই উল্লেখিত হওয়া উচিৎ। তাছাড়া ওহী প্রচারের ক্ষেত্রে রাসূলগণকেই (নবীদেরকে ব্যতীত) যে বিশেষভাবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে,সে সম্পর্কে কোন দলিল নেই। কোন কোন রেওয়ায়েতে এসেছে যে,নবূয়্যতের মর্যাদার অধিকারী ব্যক্তি ওহীর ফেরেস্তাকে নিদ্রাবস্থায় স্বপ্নযোগে দেখতে পান এবং জাগ্রত অবস্থায় শুধুমাত্র তার শব্দ শুনতে পান। কিন্তু রিসালাতের অধিকারী ব্যক্তি ওহীর ফেরেস্তাকে জাগ্রত অবস্থায়ও দেখতে পান।
উপরোক্ত পার্থক্যটিও শাব্দিক অর্থের দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না । তবে যা গ্রহণযোগ্য হতে পারে তা হল এই যে,নবী (نبی
) শব্দটি দৃষ্টান্তের (مصداق
) দিক থেকে (ভাবার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে) রাসূল (رسول
) শব্দটি অপেক্ষা বিস্তৃততর অর্থ বহন করে থাকে। অর্থাৎ সকল প্রেরিত পুরুষই নবুয়্যতের মর্যাদার অধিকারী। কিন্তু রিসালাতের অধিকার তাদের মধ্যে বিশেষ একশ্রেণীর জন্যে নির্দিষ্ট এবং পূর্বোল্লিখিত রেওয়ায়েত অনুসারে বাসূলগণের সংখ্যা ছিল তিনশত তের জন। স্বভাবতঃই তাদের মর্যাদা,অন্যান্য প্রেরিত পুরুষগণের চেয়ে উর্ধ্বে যেমনি করে রাসূলগণের সকলেই মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের দিক থেকে একরকম ছিলেন না।
তাদের মধ্যে কেউ কেউ ইমামতের সম্মানেও ভূষিত হয়েছিলেন।
পবিত্র কোরানে একদল নবীকে উলুল আজম (اولو العزم
) নামে পরিচয় দেয়া হয়েছে,
কিন্তু তাদের বিশেষত্বসমূহ সুনির্দিষ্টরূপে নির্দেশ করা হয়নি। তবে আহলে বাইত আলাইহিমুসসালাতু ওয়স্সালামের বর্ণনা থেকে যতটুকু জানা যায় তাতে দেখা যায় উলুল আজম পাঁচজন ছিলেন। তারা যথাক্রমে : হযরত নূহ (আ.),হযরত ইব্রাহীম (আ.),হযরত মূসা (আ.),হযরত ঈসা (আ.),হযরত মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ (সা.)
। আর তাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ (চূড়ান্ত ধৈর্য ও স্থৈর্য ছাড়াও) ছিল এই যে,তাদের প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র কিতাব ও শরীয়তের অধিকারী ছিলেন এবং সমসাময়িক কালের নবীগণ অথবা পরবর্তী নবীগণ,যতক্ষণ পর্যন্ত না অন্য কোন উলুল আজম রিসালাতের নিমিত্তে প্রেরিত হতেন বা নতুন কোন কিতাব ও শরীয়ত নিয়ে আসতেন তাদের শরীয়তের অনুসরণ করতেন।
একই সাথে সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়েছে যে,একই সময়ে দু’
নবীর আবির্ভাব সম্ভব। যেমন : হযরত লুত (আ.),হযরত ইব্রাহীমের (আ.) সমসাময়িক ছিলেন এবং হযরত হারুন (আ.),হযরত মুসার (আ.) সাথে যুগপৎ নবুয়্যত লাভ করেছিলেন। অনুরূপ হযরত ইয়াহ্ইয়া (আ.) ছিলেন হযরত ঈসার (আ.) সমসাময়িক।