১১তম পাঠ
ইসলামের নবী (সা.)
ভূমিকা :
শত-সহাস্রাধিক আল্লাহর নবী ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে ও স্থানে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং মানব সম্প্রদায়ের হিদায়াত ও আধ্যাত্মিক পরিচর্যার ক্ষেত্রে নিজ নিজ ভূমিকা যথাযথ রূপে পালন করতঃ মানব সমাজে জাজ্বল্যমান কীর্তিসমূহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাদের প্রত্যেকেই কোন না কোন জনসমষ্টিকে সঠিক বিশ্বাস ও সমুন্নত মূল্যবোধের ভিত্তিতে পরিচর্যা ও প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন এবং অন্যদের জন্যে পরোক্ষ ভূমিকা রেখে গিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার তাওহীদি ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে ঐ সমাজের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
নবীগণের (আ.) মধ্যে হযরত নূহ (আ.),হযরত ইব্রাহীম (আ.),হযরত মুসা (আ.) ও হযরত ঈসা (আ.) মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে স্থান ও কাল উপযোগী ব্যক্তিগত ও সামাজিক নিয়ম-নীতি ও চারিত্রিক দায়িত্ব সমন্বিত ঐশী কিতাবসমূহ লাভ করেছিলেন এবং মানুষের নিকট উপস্থাপন করেছিলেন। কিন্তু এ কিতাবগুলো হয় কালের আবর্তে সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃত ও বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল অথবা যথেচ্ছা শব্দগত ও ভাবার্থগত বিচ্যুতিতে পতিত হয়েছিল। ফলে সকল ঐশী ধর্ম ও শরীয়তসমূহ বিকৃতরূপ ধারণ করেছিল । যেমন : মুসা (আ.) এর তৌরাতে অসংখ্য বিকৃতি পরিলক্ষিত হয়েছিল এবং ঈসার (আ.) ইঞ্জিল নামক কোন কিছুই অবশিষ্ট ছিলনা। বরং তার অনুসারী বলে পরিগণিত হত এমন কিছু ব্যক্তিবর্গের হস্তলিপিসমূহকে সংগ্রহ করে পবিত্র বাইবেল রূপে নামকরণ করা হয়েছে।
যে কোন নিরপেক্ষ ব্যক্তিই যদি প্রথম ও দ্বিতীয় সংস্করণ নামক পুস্তকদ্বয়ের (তৌরাত ও ইঞ্জিল) বিষয়বস্তুকে বিবেচনা করে তবে দেখতে পাবে যে,এ গুলো কোনটিই হযরত ঈসা ও মুসার (আ.) উপর অবতীর্ণ কিতাব নয়। যেমন : তৌরাত মহান আল্লাহকে (العیاذ بالله
) এমনভাবে মানুষের মত করে উপস্থাপন করে যে,তিনি অনেক বিষয়ে জ্ঞান রাখেন না
বা অনেকবার স্বীয় কর্মের জন্যে অনুতপ্ত হয়েছেন
অথবা তার এক বান্দার [হযরত ইয়াকুব (আ.)] সাথে কুস্তি লড়তে গিয়ে পারাস্তপ্রায় হয়ে,অবশেষে প্রতিপক্ষের নিকট অনুরোধ করেন তাকে ছেড়ে দিতে যাতে তার বান্দাগণ তাকে এ দুরবস্থায় দেখতে না পায়।
এ ছাড়া আল্লাহর নবীগণ (আ.) সম্পর্কেও একাধিক কুৎসার অবতারণা করেছে। (العیاذ بالله
) যেমন : অন্যের বিবাহিতা স্ত্রীর সাথে অপকর্মে লিপ্ত হওয়ার অপবাদ দেয়া হয়েছে হযরত দাউদের (আ.) উপর
অনুরূপ মদ পান ও মাহারামের সাথে অপকর্মে লিপ্ত হওয়ার অপবাদ দেয়া হয়েছে হযরত লুতকে (আ.)
। এ সকল মিথ্যাচার ছাড়াও হযরত মুসার (আ.) (তৌরাতের বাহক) মৃত্যু কোথায় এবং কিভাবে হয়েছে সে সম্পর্কে আলোচনা করেছে।
এ কিতাব হযরত মূসার (আ.) নিকট অবতীর্ণ হওয়া কিতাব নয়,তা প্রমাণের জন্যে শেষোক্ত বিষয়াটিই কি যথেষ্ট নয় ?
অপরদিকে ইঞ্জিলের অবস্থা আর ও লজ্জাষ্কর। কারণ প্রথমতঃ হযরত ঈসার (আ.) উপর অবতীর্ণ এমন কোন কিতাব খুঁজে পাওয়া যায় না। এমনকি স্বয়ং খ্রীষ্ট ধর্মের অনুসারীরাও এরূপ দাবি করেন না যে,বর্তমানে প্রচলিত ইঞ্জিল,সে কিতাবই যা মহান আল্লাহ হযরত ঈসার (আ.) উপর অবতীর্ণ করেছেন। বরং এর বিষয়বস্তুকে ঈসার (আ.) কয়েকজন সহচর কর্তৃক প্রদত্ত প্রতিবেদন বলে গণনা করা হয়ে থাকে। তদুপরি উক্ত কিতাবে মদ পাণের বৈধতা প্রদানসহ এর আবিষ্কারকে ঈসার (আ.) মু’
জিযাহরূপে বর্ণনা করা হয়েছে।
এককথায় বলা যায়,এ দু’
জন মহান নবীর (আ.) নিকট প্রেরিত ওহীসমূহ বিকৃত হয়ে গিয়েছে। ফলে সেগুলো মানব সম্প্রদায়কে হিদায়াত করতে স্বকীয় ভূমিকা রাখতে অপারগ। তবে কেন এবং কিরূপে এ সকল বিচ্যুতি ও বিকৃতি সংঘটিত হয়েছিল,সে ঘটনা অনেক বিস্তৃত,যার বর্ণনা দেয়ার সুযোগ এখানে নেই ।
খ্রীষ্টোত্তর ষষ্ট শতাদ্বীতে যখন সমগ্র বিশ্ব অত্যাচার ও অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল,হিদায়াত ও মুক্তির সকল আলোক বর্তিকাগুলো যখন নিভন্তপ্রায়,ঠিক এমনই সময় মহান আল্লাহ তার সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবীকে (সা.) তদানিন্তন সময়ের অন্ধকারতম ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে প্রেরণ করেছেন যাতে ওহীর জ্যোতির্ময় শিখা সর্বকালের জন্যে এবং সকল মানুষের জন্যে প্রজ্জলিত হয়। আর সেই সাথে চিরন্তন ও অবিক্রিত অপরিবর্তিত ঐশী কিতাবকে মানুষের নিকট পৌছে দেয়া যায় এবং প্রকৃত জ্ঞাতব্য,ঐশী প্রজ্ঞাসমূহ ও বিধি-বিধান সম্পর্কে মানব সম্প্রদায়কে অবহিত করা যায়। আর সেই সাথে সকল মানুষ ইহ ও পারলৌকিক কল্যাণের পথে পরিচালিত হয়।
আমিরুল মু’
মিনিন হযরত আলী (আ.) তার বক্তব্যের একাংশে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর নবীরূপে আত্মপ্রকাশের সমসাময়িক বিশ্বপরিস্থির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন :
মহান আল্লাহ মহানবীকে (সা.) এমন এক সময় রিসালাতের অধিকারী করেছিলেন যখন পূর্ববর্তী নবীগণ (আ.) থেকে সুদীর্ঘ সময় অতিবাহীত হয়ে গিয়েছিল,মানবকুল সুদীর্ঘ ও গভীর নিদ্রায় আবিষ্ট হয়ে পড়েছিল,বিশৃংখলার সলিতাগুলো সারা বিশ্বে জ্বলে উঠেছিল,কীর্তির বাঁধনগুলো পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল,যুদ্ধবিগ্রহের লেলিহান শিখা দাউদাউ করে জ্বলছিল,পাপ ও অজ্ঞতার তিমিরে নিমগ্ন ছিল সারা বিশ্ব,কপটতা ও প্রতারণা ছিল বিবস্ত্র,মানবজীবন বৃক্ষের শ্যামল পত্ররাজি শুষ্কপ্রায়,ফলধারণের কোন আশাই তাতে ছিল না,জলরাশি অতলে গিয়েছিল হারিয়ে,হিদায়াতের দীপগুলো হিমশীতল ও নিস্প্রভ হয়ে গিয়েছিল,অজ্ঞতা ও পথভ্রষ্টতার ধ্বজাগুলো স্ব-শব্দে ছিল উড্ডীয়মান,কদর্য ও হতভাগ্য মানব সম্প্রদায়ের উপর স্বীয় কুৎসিত রূপ নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিল। এ অন্যায় ও অন্ধকারাচ্ছন্ন অহন,যখন অনিয়ম ও বিশৃংখলা ব্যতীত কিছু বয়ে আনত না এবং জনগণের উপর যখন ভয়-ভীতি ও নিরপত্তাহীনতা আধিপত্য বিস্তার করেছিল তখন রক্তললুপ অসি ব্যতীত মানুষের কোন আশ্রয়স্থল ছিলনা।
ইসলামের নবীর (সা.) আবির্ভাবের সময় থেকে প্রত্যেক সত্যান্বেষী মানুষের জন্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি (খোদা পরিচিতির পর) হল,হযরত (সা.) এর নবুয়্যত ও রিসালাত সম্পর্কে
এবং পবিত্র ধর্ম ইসলামের উপর গবেষণা করা। এ বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথে অন্যান্য সঠিক বিশ্বাসসমূহকে প্রতিপাদনের এবং মূল্যবোধসমূহ ও এ বিশ্বের শেষাবধি সকল মানুষের দায়িত্ব সম্পর্কে বর্ণনা প্রদানের নিশ্চিত পথের সন্ধান পাওয়া যায় এবং বিশ্বদৃষ্টি ও মতাদর্শের অন্যান্য বিষয়সমূহের সমাধানের চাবিকাঠি হস্তগত হয়। আর সেই সাথে যুগপৎ পবিত্র কোরানের সত্যতা এবং মানবসম্প্রদায়ের নিকট বিদ্যমান বিচ্যুতি ও বিকৃতি থেকে সংরক্ষিত একমাত্র ঐশী পুস্তক হিসেবে এর বিশ্বস্ততাও প্রতিপন্ন হয়ে থাকে ।
ইসলামের নবীর (
সা.)
রিসালাতের প্রমাণ :
সাতাশতম পাঠে বলা হয়েছে যে,নবীগণের নবুয়্যত তিনটি উপায়ে প্রতিপাদনযোগ্য : একটি হল তাদের মন-মানসিকতা সম্পর্কে জানা ও নিশ্চিত সূত্রের ব্যবহার । দ্বিতীয়টি হল পূর্ববর্তী নবীগণের ভবিষ্যদ্বাণী। আর তৃতীয় উপায়টি হল মু’
জিযাহ প্রদর্শন।
ইসলামের নবী (সা.) এর ক্ষেত্রে তিনটি পদ্ধতিই প্রযোজ্য ছিল। মক্কার মানুষ হযরত (সা.) এর সুখ্যাতিপূর্ণ চল্লিশ বছরের জীবন-যাপন পদ্ধতি খুব নিকট থেকে পর্যবেক্ষণের সুযোগ পেয়েছিলেন। তার এ দীর্ঘ চল্লিশ বছরে এমন কোন ক্ষুদ্রতম বিষয় খুঁজে পাওয়া যায়নি যা অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল। উপরন্তু তার সত্যবাদিতা ও সদাচারের এমন পরিচয় তারা পেয়েছিলেন যে,তাকে“
আল-আমিন”
বা বিশ্বাসী উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। স্বভাবতঃই এ ধরনের ব্যক্তির পক্ষে মিথ্যা বলা ও মিথ্যা দাবি করার কোন সম্ভাবনা থাকে না।
অপরদিকে : পূর্ববতী নবীগণ (আ.) ও হযরতের (সা.) নবুয়্যতের সুসংবাদ প্রদান করেছিলেন।
এ জন্যে একদল আহলে কিতাব তার আবির্ভবের আশায় অপেক্ষমাণ ছিলেন এবং তার সুস্পষ্ট ও উল্লেখযোগ্য নিদর্শন সম্পর্কেও তারা অবগত ছিলেন।
এমনকি আরব মোশরেকরা বলত যে,হযরত ইসমাঈলের (আ.) সন্তানদের মধ্যে (যারা আরব সম্প্রদায় ও গোত্রসমূহের প্রতিষ্ঠাতা) এমন কেউ নবুয়্যত প্রাপ্ত হবেন যে,পূর্ববর্তী সকল নবী ও সকল তাওহীদি ধর্মকে সত্যায়িত করবেন।
ইহুদী ও নাসারাদের মধ্য থেকে একদল পণ্ডিত এ ভবিষ্যৎ বাণীর ভিত্তিতেই রাসূল (সা.) এর উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন
-যদিও অন্য একদল আবার কুমন্ত্রণা ও শয়তানী প্রবণতার কারণে দ্বীন ইসলামকে গ্রহণ থেকে বিরত থেকেছিল।
পবিত্র কোরান এ পদ্ধতি সম্পর্কে ইংগিত করতে গিয়ে বলে :
)
أَوَلَمْ يَكُنْ لَهُمْ آيَةً أَنْ يَعْلَمَهُ عُلَمَاءُ بَنِي إِسْرَائِيلَ(
এই নিদর্শনই কি তাদের জন্য যথেষ্ট নয় যা সম্পর্কে বনী ইসরাঈলের আলেমগণ বিশেষভাবে অবগত আছে!? (সূরা শুয়ারা-১৯৭)
বনী ইসরাঈলের আলেমদের মাধ্যমে এবং পূর্ববর্তী নবীগণের ভবিষ্যদ্বাণী ও পরিচয় করিয়ে দেয়ার ভিত্তিতে ইসলামের নবীর (সা.) পরিচয় লাভ একদিকে যেমনি সকল আহলে কিতাবের জন্যে হযরতের (সা.) রিসালাতের সত্যতার সুস্পষ্ট দলিল ছিল। অপরদিকে তেমনি সুসংবাদ প্রদানকারী নবীগণের সত্যবাদিতার এবং তদনুরূপ অন্যান্যদের জন্যে হযরত মুহম্মদ (সা.) এর সত্যতার,চূড়ান্ত ও তুষ্ট প্রমাণ রূপে পরিগণিত হত। কারণ এ ভবিষ্যদ্বাণীসমূহের সত্যতা এবং এর সাক্ষী ও হযরত (সা.) সম্পর্কে বর্ণিত নিদর্শনসমূহকে তারা স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ ও নিজেদের জ্ঞান দ্বারা উপলব্ধি করতেন।
বিস্ময়ের ব্যাপার হল এই যে,এ বিকৃত তৌরাত ও ইঞ্জিলেই এ ধরনের সুসংবাদগুলোকে নির্মূল করার সকল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এমন সকল বিষয় খুঁজে পাওয়া যায় যা সত্যান্বেষীদের জন্যে সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে। যেমন : ইহুদী ও নাসারা আলেমগণের মধ্যে অনেকেই যারা সত্যানুসন্ধিৎসু ছিলেন,তারা এ সকল বিষয় ও সুসংবাদের মাধ্যমেই হিদায়াত প্রাপ্ত হয়েছেন এবং পবিত্র দ্বীন ইসালামে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন।
অনুরূপ মহানবী (সা.) কর্তৃক অসংখ্য মু’
জিযাহ প্রদর্শিত হয়েছিল,যা ইতিহাস ও হাদীসগ্রন্থসমূহে সন্নিবেশিত হয়েছে এবং এ গুলোর অধিকাংশই বহুল আলোচিত হাদীসের অন্তর্গত’
হয়েছে।
তবে সর্বশেষ নবী ও তার চিরন্তন দ্বীনের পরিচয় দানের ক্ষেত্রে প্রভুর অনুগ্রহের দাবি হল : সমসাময়িক মানুষের জন্যে চূড়ান্ত রূপে দলিল -মু’
জিযাহসমূহ প্রদর্শন ও অন্যরা সংগতভাবে উদ্ধৃতিগত পথে ঐ গুলো সম্পর্কে অবগত হবে;তদুপরি এমন এক অমর ও চিরন্তন মু’
জিযাহ তাকে সম্প্রদান করবেন,যা সর্বদা সর্বযুগের বিশ্ববাসীর জন্যে চূড়ান্ত দলিল হিসেবে থাকবে। আর তা হল পবিত্র কোরান।
অতএব পরবর্তী পাঠে আমরা এ সম্মানিত গ্রন্থের অলৌকিকত্ব সম্পর্কে আলোচনা করব।