১২তম পাঠ
পবিত্র কোরানের অলৌকিকত্ব
পবিত্র কোরান হল একটি মু’
জিযাহ :
পবিত্র কোরানই একমাত্র গ্রন্থ যা দৃঢ় কন্ঠে ও সুস্পষ্ট রূপে ঘোষণা করেছে যে,কেউই এর সমকক্ষ কোন গ্রন্থ আনতে সক্ষম হবে না। এমনকি যদি সমস্ত মানুষ ও জিন্ন সম্প্রদায় পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমেও চেষ্টা করে তথাপি এ ধরনের কর্ম সম্পাদনে সমর্থ্য হবে না।
তদুপরি সামগ্রিক কোরানের মত কোন গ্রন্থ যে আনতে পারবে না,কেবলমাত্র তা-ই নয়;বরং দশটি সূরা
এমনকি এক লাইন বিশিষ্ট একটি সূরাও আনতে অক্ষম।
অতঃপর অধিক গুরুত্বসহকারে সকলের সম্মুখে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আহ্বান জানিয়েছে এবং এ ধরনের কর্ম সম্পাদনে তাদের অক্ষমতাকে এ গ্রন্থ ও ইসলামের প্রিয় রাসূল (সা.) এর রিসালাতের ঐশ্বরিক হওয়ার দলিল বলে উল্লেখ করেছে।
অতএব এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই যে,এ পবিত্র গ্রন্থ নিজের মু’
জিযাহ হওয়ার দাবি করে এবং এর বাহক একে চিরন্তন মু’
জিযাহ ও স্বীয় নবুয়্যতের স্বপক্ষে সকল বিশ্ববাসীর জন্যে সর্বকালীন চূড়ান্ত দলিল হিসেবে বর্ণনা করেছেন। অদ্যাবধি চতুর্দশ শতাব্দী অতিক্রম হওয়ার পরও প্রভুর এ আহ্বান অহর্নিশ শত্রু ও মিত্রের প্রচার মাধ্যম থেকে বিশ্ববাসীর কর্ণগোচর হচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত নিজের স্বপক্ষে চূড়ান্ত দলিল উপস্থাপন করে চলছে ।
অপরদিকে আমরা জানি যে,ইসলামের নবী (সা.),তার প্রকাশ্য আহ্বানের প্রারম্ভেই অবাধ্য ও প্রতিহিংসাপরায়ণ শত্রুদের বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিলেন,যারা এ ঐশী ধর্মের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কোন প্রকারের প্রচেষ্টা ও পন্থা অবলম্বনেই পিছপা হয়নি। অবশেষে সর্বপ্রকারের ভয়-ভীতি ও প্রলোভনের কোন কার্যকারিতা না দেখে নিরাশ হয়ে হযরতকে (সা.) হত্যার জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করল। কিন্তু মহান আল্লাহর তত্বাবধানে রাতের অন্ধকারে গোপনে মদীনায় হিজরতের মাধ্যমে এ চক্রান্তটিও ব্যর্থতায় পর্যববসিত হয়। হিজরতের পরেও মোশরেক ও তাদের দোসর ইহুদীদের সাথে একাধিক যুদ্ধ-বিগ্রহের মাধ্যমে জীবনের পবিত্রতম অবশিষ্ট বছরগুলো অতিবাহিত করেন। রাসূলের (সা.) তিরোধানের পর থেকে অদ্যাবধি আভ্যন্তরীণ মোনাফিক ও বহিঃশত্রুরা এ ঐশী জ্যোতিশিখাকে নির্বাপিত করার জন্যে সদা সচেষ্ট ছিল এবং আছে। আর এ কর্মে তারা এমন কোন প্রকার পন্থা অবলম্বনেই কুন্ঠাবোধ করেনি বা করে না। আর পবিত্র কোরানের সমকক্ষ এমন কোন গ্রন্থ প্রণয়ন যদি তাদের পক্ষে সম্ভব হত,তবে কখনোই এ কর্ম থেকে তারা পিছপা হত না।
বর্তমান সময়েও বিশ্বের সকল বৃহত্তর রাষ্ট্রগুলো ইসলামকেই তাদের স্বৈরাচারী জালিম সরকারের বিরুদ্ধে প্রধান শত্রুরূপে চিহ্নিত করেছে এবং এর বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্যে সংকল্পবদ্ধ হয়েছে। আর এ জন্যে বৈষয়িক,রাজনৈতিক,বৈজ্ঞানিক ও সম্প্রচারগত ইত্যাদি সকল প্রকারের উপকরণই হাতে তুলে নিয়েছে। যদি সম্ভব হত তবে পবিত্র কোরানের কোন ক্ষুদ্রতম সূরা সদৃশ একটি লাইন প্রণয়নে প্রয়াসী হত এবং সকল সমষ্টিগত প্রচার মাধ্যম ও বিশ্বপ্রচার মাধ্যমে তা তুলে ধরত। কারণ এ কাজটি অপেক্ষাকৃত সহজ,স্বল্পতম ব্যয়সাপেক্ষ এবং ইসলাম ও এর সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ক্ষেত্রে সর্বাধিক ফলপ্রসূ।
অতএব সকল সত্যান্বেষী বিবেকবান মানুষই উপরোক্ত বিষয়টির আলোকে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে যে,পবিত্র কোরান হল একটি ব্যতিক্রমধর্মী ও অনানুকরণযোগ্য গ্রন্থ এবং কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পক্ষেই,কোন প্রকার শিক্ষা ও অনুশীলনের মাধ্যমেই এর সদৃশ কোন গ্রন্থ রচনা করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ এটি এমন একটি গ্রন্থ যা,মু’
জিযার সকল বৈশিষ্ট্যের (অলৌকিক হওয়া,ঐশ্বরিক ও অনানুকরণযোগ্য হওয়া,নবুয়্যতের সত্যতার প্রমাণস্বরূপ উপস্থাপিত হওয়া) অধিকারী। আর এ দৃষ্টিকোণ থেকে এটি মহানবী (সা.) এর আহ্বানের বৈধতার এবং ইসলামের সত্যতার স্বপক্ষে সর্বোৎকৃষ্ট ও চূড়ান্ত দলিল হিসেবে পরিগণিত হয়। মানব সম্প্রদায়ের উপর প্রভুর পক্ষ থেকে সর্বোৎকৃষ্ট নেয়ামত হল এটাই যে,এ সম্মানিতগ্রন্থকে এরূপে অবতীর্ণ করেছেন,যাতে চিরন্তন মু’
জিযাহরূপে সর্বদা বিদ্যমান থাকতে পারে এবং স্বীয় সঠিকতা ও সত্যতার স্বপক্ষে এমনভাবে দলিল উপস্থাপন করতে পারে,যাকে অনুধাবনের জন্যে কোন প্রকার শিক্ষা-দীক্ষার প্রয়োজন নেই;আর সকল মানুষের জন্যেই তা বোধগম্য ও গ্রহণযোগ্য হবে।
পবিত্র কোরানের অলৌকিক বিষয়সমূহ :
আমরা সংক্ষেপে ও নিশ্চিতরূপে জানতে পেরেছি যে,মর্যাদাবান কোরান হল আল্লাহর বাণী,যা অলৌকিকতাপূর্ণ। এখন আমরা এর অলৌকিক কিছু দিক তুলে ধরব :
ক) ভাষার প্রাঞ্ছলতা ও বাক্যালংকারের গভীরতা :
কোরানের প্রধান অলৌকিকত্ব হল তার ভাষার প্রাঞ্ছলতা (فصاحت
) ও বাক্যালংকারের গভীরতায় (بلاغت
)। অর্থাৎ মহান আল্লাহ তার অভিব্যাক্তিসমূহ প্রকাশের জন্য সর্বাবস্থায় পরম বাগ্মীতা,ভাষা শৈলীতা,সুন্দরতম গাঁথুনী,সুনিপুণতম সুরলহরী ব্যবহার করেছেন,যা উত্তমরূপে ও সুস্পষ্টরূপে,বাঞ্ছিত অর্থ শ্রোতা সাধারণের নিকট পৌছায়। আর সমুন্নত ও যথাযথ অর্থের সাথে সাযুজ্য রক্ষা করে এ ধরনের শব্দ ও বাক্যের সমাবেশ কেবলমাত্র তার জন্যেই সম্ভব,যিনি ভাষা শৈলীতা,সূক্ষ্ণ অর্থসমূহ ও এতদ্ভয়ের মধ্যে বিদ্যমান পারস্পরিক সম্পর্কের উপর যথেষ্ট দক্ষতা ও পারদর্শিতার অধিকারী এবং যিনি পারিপার্শিকতা ও কাংখিত অর্থের গুণাগুণ বিবেচনা করে,অবস্থা ও মানের দাবি বজায় রেখে সর্বোত্তম শব্দ ও বাক্যসমূহকে নির্বাচন করতে সক্ষম। আর প্রভুর পক্ষ থেকে ওহী ও ইলহাম ব্যতীত এ ধরনের জ্ঞানগত দক্ষতা অর্জন কোন মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়।
কোরানের আকর্ষণীয় সুরের সৌন্দর্য সমাহার ও আধ্যাত্মিকতা সকলের জন্যে এবং এর ভাষা শৈলিতা ও বগ্মিতা,আরবী ভাষা,তার প্রাঞ্জলতা ও বাক্যালংকারের কৌশল সম্পর্কে পারদর্শী ব্যক্তির জন্যে বোধগম্য। কিন্তু কোরানের ভাষা শৈলিতা ও বাগ্মিতার অলৌকিকত্ব,তার পক্ষেই অনুধাবন করা সম্ভব,যিনি বাগ্মিতা ও বাকপটুতার বিভিন্ন কৌশল সম্পর্কে পরম দক্ষতা ও পারদর্শিতায় অধিকারী।
আর এ রকম কোন ভাষা বিশেষজ্ঞ,অন্যান্য বাগ্মিতাপূর্ণ ও প্রাঞ্ছলতাপূর্ণ বক্তব্যের সাথে তুলনা করে স্বীয় যোগ্যতা পরীক্ষা করে থাকেন। আরব কবি,সাহিত্যিক ও গায়করা এ কর্মটি দক্ষতার সাথে সমাপ্ত করতেন। কারণ আরবদের বৃহত্তম শিল্প ছিল বাকপটুতা,যা কোরান অবতীর্ণ হওয়ার সময় চরম বিকাশ লাভ করেছিল এবং সর্বোৎকৃষ্ট কবিতাসমূহকে সমালোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ করে সর্বোৎকৃষ্ট কবিতাকে শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম হিসেবে নির্বাচন ও উপস্থাপন করতেন।
মূলতঃ প্রভুর প্রজ্ঞা ও অনুগ্রহের দাবি এটাই যে,প্রত্যেক নবীকে (আ.) সমসাময়িক কালের প্রচলিত জ্ঞান ও শিল্পের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ মু’
জিযাহ প্রদান করবেন,যাতে মানবকীর্তির উপর তার অলৌকিক শ্রেষ্ঠত্ব সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়। যেমন : ইমাম হাদী (আ.) এর নিকট ইবনে সিক্কিত জানতে চেয়েছিল :“
মহান আল্লাহ কেন মু’
জিযাহ হিসেবে হযরত মুসাকে (আ.) দিয়েছিলেন শুভ্রোজ্জল হাত ও ড্রাগণ বা বিশালাকার সর্পে রূপান্তরিত হতে সক্ষম যষ্টি এবং হযরত ঈসাকে (আ.) দিয়েছিলেন অসুস্থতা থেকে আরোগ্যদানের ক্ষমতা;আর ইসলামের নবীকে (সা.) দিয়েছিলেন পবিত্র কোরান ?”
জবাবে ইমাম হাদী (আ.) বললেন : হযরত মুসার (আ.) সময় প্রচলিত নৈপুণ্য ছিল যাদুবিদ্যার। আর এ জন্যে মহান আল্লাহ তাকে জনগণের ক্রিয়াকলাপের সদৃশ মু’
জিযাহ প্রদান করেছেন,যাতে ঐ রকম (মু’
জিযাহ) কর্ম সম্পাদনের ক্ষেত্রে নিজেদের অক্ষমতাকে উপলব্ধি করতে পারে। আবার হযরত ঈসার (আ.) সময় প্রচলিত ছিল নিপূণ চিকিৎসাবিদ্যা। তাই মহান আল্লাহ তাকে নিরাময়ের অযোগ্য রোগ থেকে মুক্তিদানের জন্যে মু’
জিযাহ দিয়েছেন,যাতে এর অলৌকিকত্ব সম্পর্কে উত্তমরূপে উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর সময় প্রচলিত ছিল বাগ্মিতা,শোকগাঁথা ও কাব্যিক নৈপূণ্য। এ দৃষ্টিকোণ থেকে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরানকে সুন্দরতম রূপে অবতীর্ণ করেছেন,যাতে এর আলৌকিকতাপূর্ণ শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে পরিজ্ঞাত হতে পারে।
তদানিন্তন সময়ের ওয়ালীদ ইবনে মু’
গাইরায়ে মাখযুমি,ওৎবাহ ইবনে রাবিয়া,তোফাইল ইবনে আমরের মত উচ্চতর পর্যায়ের ভাষাবিশারদগণও,কোরানের পরম বাগ্মিতা ও বাকপটুতার এবং মানুষের উৎকৃষ্টতম বাক্যালংকার সমন্বিত বক্তব্যের উপর এর শ্রেষ্ঠত্বের কথা নির্দিধায় স্বীকার করেছেন।
প্রায় এক শতাব্দী পর আবিল আওজা,ইবনে মুক্বফ্ফা,আবু শাকির দীসানী এবং আব্দুল মালিক বাসরির মত ব্যক্তিবর্গ সিদ্ধান্ত নিলেন কোরানের সাথে স্বীয় যোগ্যতার তুলনা করবেন। অতঃপর পূর্ণ এক বছর এ কর্মে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন,কিন্তু নূন্যতম কর্মও প্রদর্শন করতে পারেন নি। অবশেষে এ ঐশীগ্রন্থের বিরাটত্বের সম্মুখে অক্ষম ও হতবিহ্বল হয়ে পরজয় স্বীকার করে নিয়েছিলেন। যখন মসজিদুল হারামে তাদের এক বছরের কর্মের বিচার-বিশ্লেষণ চলছিল,তখন ইমাম সাদিক (আ.) তাদেরকে অতিক্রম করে যাচ্ছিলেন এবং কেরোনের এ আয়তটি আবৃতি করছিলেন :
)
قُلْ لَئِنِ اجْتَمَعَتِ الْإِنْسُ وَالْجِنُّ عَلَى أَنْ يَأْتُوا بِمِثْلِ هَذَا الْقُرْآنِ لَا يَأْتُونَ بِمِثْلِهِ وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيرًا(
বল,যদি এই কোরানের অনুরূপ কোরান আনয়নের জন্যে মানুষ ও জিন্ন সমবেত হয় এবং তারা পরস্পরকে সাহায্য করে,তবুও তারা এর অনুরূপ আনয়ন করতে পারবে না। (সূরা ইসরা -৮৮)
খ) নবীর (সা.) উম্মী হওয়া :
পবিত্র কোরান এমন এক গ্রন্থ যা তার ক্ষুদ্র কলেবরে বিভিন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞান,ব্যক্তিগত ও সামাজিক নীতিকে সমন্বিত করেছে। আর এ গুলোর প্রত্যেকটির পরিপূর্ণ পর্যালোচনার জন্যে একাধিক ।
বিশেষজ্ঞ পরিষদের প্রয়োজন যারা বর্ষ পরম্পরায় এ গুলোর উপর গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টায় রত হবেন এবং পর্যায়ক্রমে এতে সন্নিবেশিত রহস্যসমূহ উদঘাটন করবেন। আর অধিকতর অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন। কিন্তু সকল বাস্তবতা ও রহস্য উদঘাটন,ঐশীজ্ঞানের অধিকারী এবং মহান আল্লাহর অনুমোদিত ব্যক্তি ব্যতীত সম্ভব নয়।
এ বৈচিত্রের সমাহার যা সুগভীর ও সমুন্নত পরিচিতি,উচ্চতর ও অমূল্য চারিত্রিক নির্দেশনা,ন্যায় ও দৃঢ়তম আইন-কানুন,বান্দাদের জন্যে প্রজ্ঞাময় আচার নীতি,ব্যক্তিগত ও সামাজিক নিয়ম,সর্বাধিক লাভজনক উপদেশ,শিক্ষণীয় ঐতিহাসিক বিষয়,গঠনমূলক প্রশিক্ষণ ও পরিচর্যার সর্বোত্তম নীতিসমূহ,এককথায় মানুষের ইহ ও পরলৌকিক কল্যাণের জন্যে প্রয়োজনীয় সকল নীতিকে অভূতপূর্ব ও অভিনব পন্থায় এরূপে সমন্বিত করেছে যে,সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষ স্বীয় যোগ্যতানুযায়ী তা থেকে উপকৃত হতে পারে।
জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বাস্তবতার এ অপূর্ব সমন্বয় সাধন নিঃসন্দেহে সাধারণ মানুষের ক্ষমতা বহিভূর্ত কর্ম। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হল এই যে,এ অপূর্ব সমন্বয়ের অধিকারী গ্রন্থটি,এমন এক ব্যক্তির মাধ্যমে প্রকাশ লাভ করেছে যিনি জীবনে কখনোই পাঠশালায় যাননি,কারও কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেননি,পত্রপৃষ্ঠে কলম চালাননি এবং যিনি সভ্যতা ও সংস্কৃতির দূরপ্রান্তে অবস্থিত এক পরিবেশে প্রতিপালিত হয়েছিলেন। আরও অধিক আশ্চর্যের ব্যাপার হল এই যে,তার চল্লিশ বছরের জীবনে নবুয়্যত ঘোষিত হওয়ার পূর্বে এ ধরনের বক্তব্যের কিছুই শ্রুত হয়নি। এমন কি নবুয়্যতের সময়েও,যা কিছু ওহীরূপ বিবৃত হত,তা সর্বদা এমন এক বিশেষ পদ্ধতি ও সূত্র এবং সাজুয্য বজায় রাখত যা সুস্পষ্টরূপে তার অন্যসকল বক্তব্য থেকে স্বতন্ত্র ছিল। আর এ গ্রন্থ ও তার অন্যান্য বক্তব্যের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্টরূপে বোধগম্য ছিল।
পবিত্র কোরান এ বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করতে গিয়ে বলে :
)
وَمَا كُنْتَ تَتْلُو مِنْ قَبْلِهِ مِنْ كِتَابٍ وَلَا تَخُطُّهُ بِيَمِينِكَ إِذًا لَارْتَابَ الْمُبْطِلُونَ(
তুমি তো এর পূর্বে কোন কিতাব পাঠ করনি এবং সহস্তে কোন কিতাব লেখনি যে মিথ্যাচারীরা সন্দেহ পোষণ করবে। (সূরা আনকাবুত-৪৮)
অপর এক স্থানে বলা হয়েছে :
)
قُلْ لَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا تَلَوْتُهُ عَلَيْكُمْ وَلَا أَدْرَاكُمْ بِهِ فَقَدْ لَبِثْتُ فِيكُمْ عُمُرًا مِنْ قَبْلِهِ أَفَلَا تَعْقِلُونَ(
বল,আল্লাহর সেরূপ অভিপ্রায় হলে আমিও তোমাদের নিকট তা পাঠ করতাম না এবং তিনিও তোমাদেরকে এ বিষয়ে অবহিত করতেন না। আমি তো এর পূর্বে তোমাদের মধ্যে জীবনের দীর্ঘকাল অবস্থান করেছি,তবুও কি তোমরা বুঝতে পার না ? (সূরা ইউনূস -১৬)
খুব সম্ভবত : সূরা বাকারার নিম্নবর্ণিত আয়তটিও এ অলৌকিক বিষয়টির প্রতিই ইঙ্গিত করছে।
)
وَإِنْ كُنْتُمْ فِي رَيْبٍ مِمَّا نَزَّلْنَا عَلَى عَبْدِنَا فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِنْ مِثْلِهِ(
আমি আমার বান্দার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি তাতে তোমাদের কোন সন্দেহ থাকলে তোমরা তার অনুরূপ কোন সূরা আনয়ন কর। (সূরা বাকারা-২৩)
উপরোক্ত আয়তটিতে“
مثله
”
এর সাথে যুক্ত সর্বনামটি (ه
),“
عبدنا
”
(অর্থাৎ আমাদের মনোনিত বান্দা) শব্দটির দিকে প্রত্যাবর্তন করে।
সিদ্ধান্ত
:
(অসম্ভব সত্ত্বেও যদি) আমরা ধরে নিই যে,শত শত গবেষক ও বিশষজ্ঞ দলের পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমম্বয়ে এ ধরনের একটি পুস্তক প্রণয়ন সম্ভব,তবে কখনোই একজন নিরক্ষর ব্যক্তির পক্ষে,এ কর্ম সাধন সম্ভব বলে ধারণা করা যায় না।
অতএব এ বিচিত্র বৈশিষ্ট্য সমন্বিত গ্রন্থের প্রকাশ,বিশেষ করে এমন এক ব্যক্তির মাধ্যমে যিনি কারও নিকট শিক্ষা গ্রহণ করেননি নিঃসন্দেহে এর অলৌকিত্বের অপর একটি দিক।
(গ) সুঙ্গতি ও বিরোধহীনতা :
পবিত্র কোরান এমন এক গ্রন্থ,যা মহানবীর (সা.) তেইশ বছরের রিসালাতের জীবনে অবতীর্ণ হয়েছে। প্রিয় নবীর (সা.) জীবনের এ অধ্যায়টি ছিল সংকটময় উত্থান-পতন,তিক্ত-মধুর ঘটনা বহুল। অথচ এ বিস্ময়কর অস্থিতিশীল অবস্থা,পবিত্র কোরানের বিষয়বস্তুর সামঞ্জস্য ও অলৌকিক রীতি-পদ্ধতির উপর কোন প্রভাব ফেলেনি। আর বিষয়বস্তু ও গাঠনিক দিক থেকে এ সমন্বয় ও সামঞ্জস্য এর অলৌকিকত্বের অপর দু’
টি দিকের মতই একটি দিক বলে পরিগণিত। স্বয়ং পবিত্র কোরান এ সম্পর্কে বলে :
)
أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ وَلَوْ كَانَ مِنْ عِنْدِ غَيْرِ اللَّهِ لَوَجَدُوا فِيهِ اخْتِلَافًا كَثِيرًا(
তবে কি তারা কোরান সম্পর্কে অনুধাবন করে না ? এটা যদি অল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও পক্ষ থেকে হত তবে তারা তাতে অনেক অসঙ্গতি পেত। (সূরা নিসা-৮২)
ব্যাখ্যা : প্রত্যেক মানুষেরই কমপক্ষে দু’
ধরনের পরিবর্তন ঘটে থাকে। একটি হল,পর্যায়ক্রমে জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধির ফলে তার বক্তব্যে এর প্রতিফলন ঘটে। স্বভাবতঃই বিশ বছরের ব্যবধানে তার বক্তব্যসমূহের উল্লেখযোগ্য পার্থক্য লক্ষ্য করা যাবে। অপরটি হল,জীবনের বিচিত্র ঘটনাপ্রবাহ বিভিন্ন মানসিকতা,আবেগ ও অনুভূতি যেমন : আশা-নিরাশা,আনন্দ-বেদনা,উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও স্থৈর্যের সৃষ্টি করে। আর এ ঘটনাপ্রবাহের পরিবর্তন ব্যক্তির চিন্তা,কর্ম ও ব্যবহারে যথাযথ প্রভাব ফেলে এবং স্বভাবতঃই এ পরিবর্তনের তীব্রতা তার বক্তব্যের মানেও তীব্র প্রভাব ফেলে । প্রকৃত পক্ষে বক্তব্যের পরিবর্তন,বিভিন্ন মানসিক অবস্থার পরিবর্তনের অনুগামী,যা স্বয়ং প্রাকৃতিক ও সামাজিক অবস্থা পরিবর্তনের অনুগামী।
এখন যদি ধারণা করি যে,পবিত্র কোরান মহানীব (সা.) এরই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাপ্রসূত কীর্তি,যিনি উল্লিখিত পরিবর্তনশীল অবস্থার সীমানায় অবস্থান করেছেন,তবে তার জীবনের এ অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে সংগত কারণেই বিন্যাস ও বিষয়বস্তুতে যথেষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হওয়ার কথা। অথচ এ ধরনের কোন দ্বৈততার লেশমাত্র পবিত্র কোরানে নেই।
অতএব আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌছতে পারি যে,কোরানের বিষয়বস্তু ও অলৌকিক সাহিত্যমানের মধ্যে সুসংগতি ও বিরোধহীনতা এ পবিত্র গ্রন্থ যে,এক অটুট ও অসীম জ্ঞানের আধার থেকে রূপ লাভ করেছে,তারই অপর একটি নিদর্শন,যা প্রকৃতির উর্ধ্বে,পরিবর্তিত পরিস্থিতির অনুগত নয়।