আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)0%

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড) লেখক:
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ: কিয়ামত

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ মুহাম্মদ তাকী মিসবাহ্ ইয়াযদী
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ:

ভিজিট: 12782
ডাউনলোড: 3251

পাঠকের মতামত:

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 33 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 12782 / ডাউনলোড: 3251
সাইজ সাইজ সাইজ
আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)

লেখক:
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বাংলা

আক্বায়েদ শিক্ষা

তৃতীয় খণ্ড

মূলঃ আয়াতুল্লাহ্ মুহাম্মদ তাকী মিসবাহ্ ইয়াযদী

অনুবাদঃ মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন

প্রকাশনায়ঃ

আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা

আমুজেশে আক্বায়েদ

মূলঃ আয়াতুল্লাহ্ মুহাম্মদ তাকী মিসবাহ্ ইয়াযদী

অনুবাদঃ মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন

প্রকাশনায়ঃ

আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা

প্রকাশ:

আরাবী ১৪২৪

বাংলা ১৪১০

ইংরেজী ২০০৩

 

পুনরুত্থান দিবস পরিচিতি

তৃতীয় খণ্ড

১ম পাঠ

পুনরুত্থান দিবসের পরিচিতির গুরুত্ব

ভূমিকা :

এ পুস্তকের প্রারম্ভে দ্বীন ও এর মৌলিক বিশ্বাসসমূহের (তাওহীদ,নবুয়্যত ও পুনরুত্থান) উপর— অনুসন্ধানের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেছি এবং উল্লেখ করেছি যে,মানুষের জীবন মানবীয় হওয়ার ব্যাপারটি উল্লেখিত বিষয়গুলোর প্রকৃত সমাধানের উপর নির্ভরশীল। প্রথম খণ্ডে খোদা পরিচিতি,দ্বিতীয় খণ্ডে পথপ্রদর্শক পরিচিতি ও পথনির্দেশিকা পরিচিতি (নবুয়্যত ও ইমামত) সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এখন আমরা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পুনরুত্থান বা মাআদ (معاد ) সম্পর্কে পুনরুত্থান দিবসের পরিচিতির গুরুত্ব শিরোনামে আলোচনায় মনোনিবেশ করব।

প্রারম্ভেই এ মৌলিক বিশ্বাসের বিশেষত্ব এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে তার ভূমিকা বর্ণনা করব। অতঃপর বিশ্লেষণ করব যে,মাআদের প্রকৃত ধারনালাভ বিমূর্ত ও অমর আত্মার (روح ) প্রতিৃ বিশ্বাস স্থাপনের সাথে সম্পর্কিত। যেমনকরে অস্তিত্ব পরিচিতি একক প্রভুর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন ব্যতীত অপূর্ণ থাকে,তেমনি মানব পরিচিতিও অমর রূহের বিশ্বাস ব্যতীত অসমাপ্ত থাকে। অবশেষে পুনরুত্থানের মৌলিক বিষয়সমূহকে এ পুস্তকের প্রচলিত রীতিতে ব্যাখ্যা করব ।

পুনরুত্থান দিবসের প্রতি বিশ্বাসের গুরুত্ব :

প্রয়োজন ও চাহিদার যোগান দান,মূল্যবোধ অর্জন এবং পরিশেষে চূড়ান্ত সৌভাগ্য ও উৎকর্ষে পৌঁছাই হল মানুষের কর্মানুরাগের কারণ। আর কর্মের মান ও গুণ এবং এগুলোর দিকনির্দেশনার প্রক্রিয়া বিভিন্ন উদ্দেশ্য নির্ধারণের উপর নির্ভরশীল এবং জীবনের সকল প্রচেষ্টা ঐ সকল উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যেই সম্পাদিত হয়ে থাকে ।

অতএব জীবনের সঠিক লক্ষ্য নির্ধারণ,কার্যক্রমের দিকনির্দেশনা প্রদান ও কর্ম নির্বাচনের ক্ষেত্রে মৌলিক ভূমিকা রাখে। প্রকৃতপক্ষে জীবনের অনুসৃত নীতি নির্ধারণের নির্বাহক,স্বীয় বাস্তবতা,উৎকর্ষ ও কল্যাণ সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ধরন থেকে রূপলাভ করে। ফলে যিনি শুধুমাত্র বস্তুগত উপাদানসমূহ ও এ গুলোর জটিল ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার সমষ্টিকেই স্বীয় জীবনের বাস্তবতা বলে মনে করেন এবং নিজ জীবনকে সীমাবদ্ধ পার্থিব ইহকালীন জীবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ বলে ভাবেন এবং ভোগ,বিলাস ও স্বাচ্ছন্দ্যকে এ ইহকালীন জীবনের চাওয়া-পাওয়া ব্যতীত কিছু ভাবতে পারেন না,তবে তিনি তার জীবনের কর্মসূচীকে এমনভাবে সজ্জিত করবেন,যা কেবলমাত্র পার্থিব চাহিদা পূরণ করবে। অপরদিকে যিনি জীবনের বাস্তবতাকে বস্তুগত বিষয়ের উর্ধ্বে বলে মনে করেন এবং মৃত্যুই জীবনের পরিসমাপ্তি নয় বলে জানেন ;বরং মনে করেন যে,মৃত্যু হল এ নশ্বর পার্থিব জীবন থেকে অবিনশ্বর জীবনে পদার্পণের পথে একটি স্থানান্তর বিন্দু এবং যিনি স্বীয় সঠিক আচার-আচরণকে অশেষ কল্যাণ ও উৎকর্ষের মাধ্যম বলে মনে করেন,তবে তিনি তার জীবনের কর্মসূচীকে এমন ভাবে বিন্যাস করবেন,যাতে পরকালীন জীবনে অধিকতর লাভবান হতে পারেন। ফলে পার্থিব জীবনের কষ্ট ও বিফলতা, তাকে হতাশ ও নিরাশ করতে পারে না এবং স্বীয় কর্তব্য সম্পাদন,অনন্ত সৌভাগ্য ও উৎকর্ষের পথে প্রচেষ্টা চালানো থেকে তাকে বিরত রাখতে পারে না।

এ দু ধরনের মানব পরিচিতি শুধুমাত্র মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের উপর প্রভাব ফেলে না বরং তাদের সামাজিক জীবন ও পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। এছাড়া পরকালীন জীবন এবং চিরন্তন সাচ্ছন্দ্য ও শাস্তির প্রতি বিশ্বাস,অপরের অধিকার সংরক্ষণ ও দুস্থ মানবতার সেবার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আর যে সমাজে এ ধরনের বিশ্বাস বিরাজমান,সে সমাজে ন্যায়ভিত্তিক কোন কানুন প্রবর্তন করতে এবং অন্যের প্রতি অন্যায় ও অত্যাচার প্রতিরোধ করতে অপেক্ষাকৃত কম বল প্রয়োগ করতে হয়। স্বভাবতঃই এ বিশ্বাস যতই বিশ্বজনীন ও সার্বজনীন হতে থাকবে,ততই আন্তর্জাতিক সমস্যাসমূহ হ্রাস পেতে থাকবে।

উপরোল্লিখিত বিষয়টির উপর ভিত্তি করে পুনরুত্থানের বিষয় ও এ সম্পর্কে অনুসন্ধান ও গবেষণার গুরুত্ব সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়। এমনকি শুধুমাত্র তাওহীদের বিশ্বাস (পুনরুত্থানে বিশ্বাস ব্যতীত),জীবনের কাংখিত দিকনির্দেশনার পথে পরিপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। আর এখানেই সকল ঐশী ধর্ম,বিশেষকরে পবিত্র ইসলাম ধর্ম কর্তৃক এ মৌলিক বিশ্বাসের প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করার এবং মানুষের অন্তরে এর বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করার জন্যে নবীগণের (আ.) অপরিসীম প্রচেষ্টার রহস্য উদঘাটিত হয়।

পারলৌকিক জীবনের প্রতি বিশ্বাস,একমাত্র তখনই মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক আচার- আচরণের দিকনির্দেশনা প্রদানের ব্যাপারে স্বীয় ভূমিকা পালন করতে পারবে যখন ইহলৌকিক কর্ম-কাণ্ড ও পরলৌকিক সুখ-দুঃখের মধ্যে একপ্রকার কার্য-কারণগত সম্পর্ক বিদ্যমান বলে গৃহীত হবে এবং ন্যূনতমপক্ষে পারলৌকিক বৈভব ও শাস্তি,ইহলৌকিক সুকর্ম ও দুষ্কর্মের ফলশ্রুতিরূপে পরিগণিত হবে। নতুবা যদি এরূপ মনে করা হয় যে,পরলৌকিক সুখ-সমৃদ্ধি,এ বিশ্বেই লাভ করা সম্ভব (যেমনকরে পার্থিব সুখ-সমৃদ্ধি এ পৃথিবীতেই লাভ করা সম্ভব),তবে পারলৌকিক জীবনের প্রতি বিশ্বাস,ইহলৌকিক জীবনের কর্মকাণ্ডের দিকনির্দেশনায় স্বকীয়তা বিবর্জিত হবে। কারণ এরূপ ধারণা পোষণ করার অর্থ হবে : এ বিশ্বে সুখ-সমৃদ্ধি অর্জনের নিমিত্তে সচেষ্ট হওয়া উচিৎ এবং পরলৌকিক সমৃদ্ধি লাভ করার জন্যে মরণোত্তর জীবনেই বা পরপারেই সচেষ্ট হতে হবে।

অতএব পুনরুত্থান ও পরলৌকিক জীবনের বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি এ দু লোকের (ইহ ও পারলৌকিক) জীবনের সম্পর্ক এবং অনন্ত সুখ-দুঃখের পথে ঐচ্ছিক ক্রিয়াকলাপের যে প্রভাব বিদ্যমান তা-ও প্রমাণ করতে হবে।

পুনরুত্থান দিবস সংক্রান্ত বিষয়ের প্রতি কোরানের গুরুত্বারোপ :

কোরানের এক তৃতীয়াংশেরও বেশী আয়াত অনন্ত জীবন সংক্রান্ত : এক শ্রেনীর আয়াত পরকালে বিশ্বাসের আবশ্যকতার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে অপর শ্রেণীর আয়াত পরকালকে অস্বীকার করার ফল সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তৃতীয় শ্রেণীর আয়াতে পরকালীন অনন্ত বৈভব সম্পর্কে এবং চতুর্থ শ্রেণীর আয়াতে অনন্ত শাস্তি সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে।

অনুরূপ সুকর্ম ও কুকর্মের সাথে ঐগুলোর পরকালীন ফলাফল সম্পর্কেও অসংখ্য আয়াতে আলোচিত হয়েছে। এছাড়া একাধিক পদ্ধতিতে পুনরুত্থানের সম্ভাবনা ও আবশ্যকতা সম্পর্কেও গুরুত্বারোপ ও বর্ণনা করা হয়েছে। আর সেই সাথে কিয়ামত বা বিচার দিবসকে বিস্মৃত হওয়া বা ভুলে যাওয়াই,পুনরুত্থান দিবসকে অস্বীকারকারীদের বিভিন্ন দুষ্কর্ম ও বিচ্যুতির উৎস হিসেবে গণনা করা হয়েছে। কোরানের বিভিন্ন আয়াত থেকে আমরা পাই যে,পায়গাম্বরগণের (আ.) বক্তব্য ও জনগণের সাথে তর্ক-বিতর্কের একটা প্রধান অংশ জুড়ে ছিল মাআদ বা পুনরুত্থানের ব্যাপার। এমনকি এটুকু বললেও অত্যুক্তি হবে না যে,এ মূল বিষয়টির প্রতিপাদনের জন্যে তাদের প্রচেষ্টা তাওহীদকে প্রতিষ্ঠা করার চেয়েও অধিক ছিল। কারণ অধিকাংশ মানুষই এ মৌলিক বিষয়টিকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বেশী বিরোধীতা করেছিল। এ বিরোধিতার কারণকে নিম্নরূপে দু টি সংক্ষিপ্তাকারে প্রকাশ করা যেতে পারে : একটি হল,সকল প্রকার অদৃশ্য ও অস্পৃশ্য বিষয়কে অস্বীকার করার সাধারণ কারণ। আর অপরটি হল,কেবলমাত্র মাআদ বা পুনরুত্থান সম্পর্কিত অর্থাৎ উচ্ছৃংখলতা ও উদাসীনতা দায়িত্বহীনতার প্রতি ঝোঁক। কারণ যেমনটি ইতিপূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে যে,কিয়ামত ও বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাস দায়িত্ববোধ,ক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সীমারেখা মেনে চলা,অত্যাচার ও সীমালংঘন এবং দূর্নীতি ও পাপাচারে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত রাখার শক্তিশালী সহায়ক। আর এর অস্বীকৃতির মাধ্যমে কামনা,বাসনা ও স্বেচ্ছাচারিতার পথ উন্মুক্ত হয়ে থাকে। পবিত্র কোরানে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে :

) يَحْسَبُ الْإِنسَانُ أَلَّن نَّجْمَعَ عِظَامَهُ بَلَىٰ قَادِرِ‌ينَ عَلَىٰ أَن نُّسَوِّيَ بَنَانَهُ بَلْ يُرِ‌يدُ الْإِنسَانُ لِيَفْجُرَ‌ أَمَامَهُ(

মানুষ কি মনে করে যে,আমি তার অস্থিসমূহ (গলে যাবার পর) একত্রিত করতে পারব না? বস্তুতঃ আমি তার আংগুলীর অগ্রভাগ পর্যন্ত (প্রথমবারের মত) পুনর্বিন্যস্ত করতে সক্ষম। তবুওু মানুষ তার সম্মুখে যা আছে তা অস্বীকার করতে চায়। (কিয়ামাহ ৩-৫)

আর পুনরুত্থান দিবসকে অস্বীকার করার মত এ ধরনের মন মানসিকতা প্রকৃতপক্ষে তাদের মধ্যে খুজে পাওয়া যায়,যারা তাদের বক্তব্যে ও লিখনিতে পুনরুত্থান ও পরকাল এবং এ সম্পর্কিত কোরানের অন্যান্য বক্তব্যকে এ পার্থিব ঘটনাপ্রবাহ ও জাতি বা গোষ্ঠীসমূহের পুনর্জাগরণ ও শ্রেণী বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা কিংবা মর্তের স্বর্গ গড়ার সাথে তুলনা করতে সচেষ্ট অথবা চেষ্টা করেন পরকাল বা এতদসংশ্লিষ্ট অন্যান্য ভাবার্থসমূহকে শুধুমাত্র মূল্যবোধগত ভাবার্থ বা বিশ্বাসগত অথবা কাল্পনিক বিষয় বলে ব্যাখ্যা প্রদান করতে। কোরান এ ধরনের লোকদেরকে মানব শয়তান নবীগনের শত্রু বলে চিহ্নিত করেছে। এরা তাদের মনোহর ও প্রতারনামূলক বক্তব্যের মাধ্যমে মানুষের হৃদয় হরণ করে এবং মানুষকে সঠিক বিশ্বাস ও ঐশী বিধানের উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ থেকে দূরে রাখে।

) وَكَذَٰلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا شَيَاطِينَ الْإِنسِ وَالْجِنِّ يُوحِي بَعْضُهُمْ إِلَىٰ بَعْضٍ زُخْرُ‌فَ الْقَوْلِ غُرُ‌ورً‌ا وَلَوْ شَاءَ رَ‌بُّكَ مَا فَعَلُوهُ فَذَرْ‌هُمْ وَمَا يَفْتَرُ‌ونَ(

এরূপে,মানব ও জিনের মধ্যে শয়তানদেরকে প্রত্যেক নবীর শত্রু করেছি,প্রতারণার উদ্দেশ্যে তাদের একে অন্যকে চমকপ্রদ বাক্য দ্বারা প্ররোচিত করে;যদি তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করতেন (জোরপূর্বর্ক তাদেরকে বিরত রাখতেন) তবে তারা এটা করত না (কিন্তু আল্লাহ চান মানুষ সঠিক ও ভ্রান্তপথ নির্বাচন করার ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকুক) সুতরাং তুমি তাদেরকে ও তাদের মিথ্যা রচনাকে বর্জন কর। (সূরা আনআম ১১২)

) وَلِتَصْغَىٰ إِلَيْهِ أَفْئِدَةُ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَ‌ةِ وَلِيَرْ‌ضَوْهُ وَلِيَقْتَرِ‌فُوا مَا هُم مُّقْتَرِ‌فُونَ(

এবং তারা এই উদ্দেশ্যে প্ররোচিত করে যে,যারা পরকালে বিশ্বাস করে না,তাদের মন যেন তার প্রতি অনুরাগী হয় এবং তাতে যেন তারা পরিতুষ্ট হয়,আর তারা যে অপকর্ম করে তারা যেন তাই করতে থাকে। ( সূরা আনাআম -১১৩)

উপসংহার :

কোন ব্যক্তি যাতে তার জীবনে এমন পথ নির্বাচন করতে পারে যে,প্রকৃত সৌভাগ্য ও উৎকর্ষ অর্জন করা যায়,তবে তাকে ভেবে দেখা উচিৎ মৃত্যুর সাথেই কি কোন মানুষের জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে,না কি অপর কোন জীবন এ জীবনের পরে বিদ্যমান? এ পৃথিবী থেকে অপর কোন জগতে স্থানান্তরিত হওয়ার অর্থ কি এক শহর থেকে অপর শহরে ভ্রমণের মত যে,জীবন ধারণের যাবতীয় সরঞ্জামাদি ঐ স্থানেই সংগ্রহ করতে পারে,নাকি এ ইহলৌকিক জীবন,পরবর্তী জীবনের সুখ-দুঃখের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে এবং পরবর্তী জীবনের ভূমিকা স্বরূপ,যার ফলে সকল কর্ম এখানেই সম্পন্ন করতে হবে এবং চূড়ান্ত ফল ওখানে লাভ করতে হবে ?

এ প্রশ্নগুলোর সমাধান না হওয়া পর্যন্ত জীবনের জন্যে সঠিক পথ ও সঠিক অনুসৃত নীতি ও কর্মসূচী নির্বাচনের পালা আসে না। কারণ যতক্ষণ পর্যন্ত গন্তব্য নির্ধারণ না হবে,সেখানে পৌঁছার পথও নির্ধারণ করা যাবে না।

পরিশেষে স্মরণযোগ্য যে,এ ধরনের জীবনের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা যতই দুর্বল হোক না কেন,তা-ই সচেতন ও জ্ঞানী ব্যক্তির জন্যে যথেষ্ট,যা তাকে এ সম্পর্কে অনুসন্ধান ও গবেষণায় বাধ্য করে। কারণ সম্ভাব্যতার পরিমা অপরিসীম।

২য় পাঠ

পুনরুত্থানের বিষয়টি রূহের সাথে সম্পর্কিত

জীবন্ত অস্তিত্বে একত্বের ভিত্তি :

মানুষের শরীর সকল প্রাণীর মতই একাধিক কোষের সমষ্টি যাদের প্রত্যেকটিই সর্বদা রাসায়নিক পরিবর্তন,রূপান্তর ও বিবর্তিত অবস্থায় আছে। এদের সংখ্যাও জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পরিবর্তনশীল এবং এমন কোন মানুষ পাওয়া যাবে না যার জীবনে শরীর গঠনকারী উপাদানসমূহ পরিবর্তন হয়নি অথবা যার কোষের সংখ্যা সর্বদা ধ্রুব।

অতএব প্রাণীদেহে এবং বিশেষকরে মানুষের দেহে সংগঠিত এই পরিবর্তন ও রূপান্তরের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্ন হতে পারে যে,কিসের ভিত্তিতে (একই দেহের একাধিক পরিবর্তন সত্বেত্ত) এ পরিবর্তিত বিষয়গুলোকে অভিন্ন অস্তিত্বরূপে গণনা করা যেতে পারে যদিও তার অঙ্গসমূহ আজীবন অসংখ্য রূপান্তরের সম্মুখীন হয়েছিল ?

এ প্রশ্নের যে সহজ উত্তরটি দেয়া হয় তা হল : সকল প্রকার জীবন্ত অস্তিত্বেরই একত্বের ভিত্তি হল,তাদের একই সময়ের এবং বিভিন্ন সময়ের অঙ্গ-প্রতঙ্গসমূহের মধ্যে সংযোগ। যদিও দেহের কোষসমূহ ক্রমান্বয়ে মৃত্যু লাভ করে এবং নতুন কোষসমূহ ঐগুলোর স্থান দখল করে,তথাপি এ পরিবর্তিত ধারার সংযুক্তিকে অভিন্ন বিষয় বলে গণনা করা যেতে পারে।

কিন্তু এ জবাবটি সন্তোষজনক উত্তর হতে পারে না। কারণ আমরা যদি ইটের তৈরী কোন একটি ইমারতকে কল্পনা করি যার ইটগুলোকে ক্রমানয়ে এরূপে পরিবর্তন করা হল যে,কিছুদিন পর পূর্ববর্তী কোন ইটই তাতে অবশিষ্ট রইল না,তবে এ নতুন ইটের সমষ্টিকে ঠিক পূর্বের সে ইমারতই বলে মনে করা যাবে না,যদিও বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ ধরনের বক্তব্য শুধুমাত্র তাদের পক্ষ থেকে বিবৃত হয়,যারা সমষ্টির অংশসমূহের পরিবর্তন সম্পর্কে কোন খবর রাখেন না। প্রাগুক্ত প্রশ্নটির জবাবটিকে নিম্নরূপে সম্পূরণ করা যেতে পারে : উল্লেখিত ক্রমানুগতিক পরিবর্তন কেবলমাত্র তখনই কোন সমষ্টির অভিন্নতার ক্ষেত্রে কোন প্রকার বিপত্তি সৃষ্টি করে না যখন তা কোন এক স্বভাবজাত ও আভ্যন্তরীণ নির্বাহীর ভিত্তিতে সম্পন্ন হবে -যেমনটি জীবন্ত অস্তিত্বের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়। তবে ইমারতের ইটসমূহের পরিবর্তন বাহ্যিক ও গাঠনিক নির্বাহীর মাধ্যমে অর্জিত হয় আর এ দৃষ্টিকোণ থেকে অভিন্নতা ও প্রকৃত একাত্বতাকে অংশসমূহের পরিবর্তন ধারায় ঐগুলোর সগোত্র বলে মনে করা যায় না।

এ জবাবটি সেই স্বভাবজাত একক নির্বাহীর গ্রাহ্যতার উপর নির্ভরশীল যা পরিবর্তন ধারায় সর্বদা অবশিষ্ট থাকে এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগত ও অংশগত বিন্যাস ও শৃংখলাকে রক্ষা করে । অতএব স্বয়ং এ নির্বাহী সম্পর্কেই প্রশ্ন আসে যে,প্রকৃতপক্ষে তা কী ? এর একাত্বতার ভিত্তিই বা কী ?

প্রসিদ্ধ দার্শনিক মতবাদানুসারে সকল প্রাকৃতিক অস্তিত্বের একাত্বতার ভিত্তি হল,প্রকৃতি (طبیعت ) অথবা গঠন (صورت ) নামক এক অস্পৃশ্য ও সরল (بسیط ) ( অর্থাৎ যা যৌগিক নয় ) বিষয়,যা বস্তুর পরিবর্তনে পরিবর্তিত হয় না। জীবন্ত অস্তিত্বে যে খাদ্যগ্রহণ,বিকাশ ও প্রজনন প্রক্রিয়ার মত বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপ সম্পন্ন হয়,তাকে নাফস (نفس ) বা আত্মা নামকরণ করা হয়।

প্রচীন দার্শনিকগণ উদ্ভিদ ও প্রাণীর নাফস বা আত্মাকে বস্তুগত (مادّی ) এবং মনুষ্য আত্মা বা নাফসকে অবস্তুগত’(مجرد ) বলে মনে করতেন। কিন্তু ইসলামী দার্শনিকদের অনেকেই,বিশেষকরে সাদরুল মুতা ল্লেহীন শিরাজী প্রাণীর নাফসকেও এক পর্যায়ের অবস্তুগত বলে মনে করেছেন এবং চেতনা ও প্রত্যয়কে অবস্তুগত অস্তিত্বের নির্দেশনা ও অপরিহার্যতা বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু বস্তু বাদীরা,যারা অস্তিত্বকে শুধুমাত্র বস্তু ও বস্তুর বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে সীমাবদ্ধ বলে মনে করেন,তারা অস্পৃশ্য রূহ বা আল্লাহ্কে অস্বীকার করে থাকেন। আধুনিক বস্তুবাদীরা (যেমন : পোষ্টিবিষ্টরা) প্রকৃতপক্ষে সকল প্রকার অস্পৃশ্য (অর্থাৎ যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়) বিষয়কেই অস্বীকার করেন বা অস্পৃশ্য বিষয়কে অন্ততঃ বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করা যায় না বলে মনে করেন। ফলে তারা প্রকৃতি বা অস্পৃশ্য গঠনকে গ্রহণ করেন না। আর স্বভাবতঃই একাত্বতার ভিত্তি সম্পর্কেও তাদের নিকট কোন সঠিক জবাব নেই।

যেহেতু উদ্ভিদে একাত্বতার ভিত্তি হল উদ্ভিজ্জ আত্মা,সেহেতু উদ্ভিজ্জ জীবন উপযুক্ত বস্তুতেু বিশেষ উদ্ভিদীয় গঠন ও আত্মার অস্তিত্বের আওতায় থাকে। আর যখনই বস্তুর এ উপযুক্ততা (বা গ্রহণক্ষমতা) বিলুপ্ত হয়,তখনই এ উদ্ভিদীয় গঠন ও আত্মারও বিস্মৃতি ঘটে। আবার যদি সেই বস্তু পুনরায় নতুনভাবে উদ্ভিজ্জ গঠন গ্রহণ করার যোগ্যতা অর্জন করে,তবে তা নতুন এক উদ্ভিদীয় আত্মার অধিকারী হয়। কিন্তু পুরাতন ও নতুন উদ্ভিদের মধ্যে পরিপূর্ণ সাদৃশ্য থাকা সত্বেও,প্রকৃতার্থে এগুলো অভিন্ন নয় এবং সূক্ষ্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে নতুন উদ্ভিদকে,পূর্বোক্ত উদ্ভিদ রূপেই মনে করা যায় না।

তবে প্রাণী ও মানুষের নাফস বা আত্মা যেহেতু অবস্তুগত,সেহেতু দেহ বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও অবশিষ্ট থাকতে পারে এবং পুনরায় যখন দেহের সাথে সম্পর্ক স্থাপিত হয়,তখন ঠিক সেই ব্যক্তির একত্বতা ও অভিন্নতাকে রক্ষা করতে সক্ষম,যেরূপে মৃত্যুর পূর্বেও রূহ বা আত্মার ভিত্তিতে এ ব্যক্তির একত্বতা ও অভিন্নতা বজায় ছিল এবং দৈহিক উপাদানের পরিবর্তন ব্যক্তির বিভিন্নতার কারণ হয়নি। কিন্তু যদি কেউ প্রাণী ও মানুষের অস্তিত্বকে শুধুমাত্র এ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য দেহে ও দৈহিক বৈশিষ্ট্যের । মধ্যেই সীমাবদ্ধ বলে মনে করে থাকেন এবং রূহকেও কোন এক বা সমষ্টিগত বৈশিষ্ট্যের ফল বলে গণনা করে থাকেন,এমনকি একে অস্পৃশ্য গঠন মনে করলে ও বস্তুগত বলে গণনা করেন,যা এর অঙ্গ-প্রতঙ্গের বিলুপ্তির সাথে সাথে বিনষ্ট হয়,তবে এ ধরনের ব্যক্তির পক্ষে পুনরুত্থানের সঠিক ধারণা লাভ করা সম্ভব নয়। কারণ যদি ধারণা করা হয় যে,দেহ জীবনের জন্যে নতুনভাবে উপযুক্ততা অর্জন করেছে,তবে তাতে নতুন বৈশিষ্ট্য ও গুণের আবির্ভাব ঘটে। ফলে একাত্বতার বা অভিন্নতার (এটা তা-ই) আর কোন প্রকৃত ভিত্তির অস্তিত্ব থাকে না। কারণ ধারণা করা হয়েছে যে,পূর্বতন সকল বৈশিষ্ট্যই সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয়েছে এবং নতুন বৈশিষ্ট্যসমূহ রূপ লাভ করেছে।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে,একমাত্র তখনই মৃত্যু পরবর্তী জীবনকে সঠিক রূপে অনুধাবন করা যাবে,যখন রূহকে দেহ ও দৈহিক বৈশিষ্ট্য ভিন্ন অন্য কোন বিষয় বলে মনে করা হবে। এমনকি একে বস্তু গঠন,যা দেহে অনুপ্রবেশ করেছে এবং দেহের অবস্থানের সাথে সাথে বিনষ্ট হয়ে যায় তা-ও মনে করা যাবে না।

 

অতএব সর্বপথমে রূহের (روح ) অস্তিত্বকে স্বীকার করতে হবে। দ্বিতীয়ত : রূহকে এক সত্ত্বাগত বিষয় ( Essence) বলে মনে করতে হবে,দেহ সমন্ধীয় বলে মনে করা যাবে না। তৃতীয়তঃ দেহ বিনষ্ট হওয়ার পরও একে স্বাধীন ও অবশিষ্ট থাকার যোগ্য বলে মনে করতে হবে ;অনুপ্রবেশকার্রী গঠনের মত নয় (পারিভাষিক অর্থে বস্তুতে সমাপতিত হওয়া) যে,দেহ বিনষ্ট হওয়ার সাথে সাথে বিনষ্ট হয়ে যাবে ।

মানুষের অস্তিত্বে আত্মার অবস্থান :

অপর একটি বিষয় যা এখানে স্মরণ করব তা হল এই যে,দেহ ও আত্মার সমন্বয়ে মানুষের গঠন দু টি মৌলের সমন্বয়ে গঠিত অন্যান্য রাসায়নিক যৌগের মত নয়। উদাহরণতঃ অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের সমন্বয়ে পানি গঠিত হয়,যাদের পারস্পরিক বিভাজনের ফলে একটি সমগ্র’ হিসাবে ঐ যৌগের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু রূহ বা আত্মা হল মানুষের মূলসত্তা এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তা বিদ্যমান থাকবে ততক্ষণ মনুষ্যত্ব এবং ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব সংরক্ষিত থাকবে। আর এ কারণেই দেহের কোষসমূহের পরিবর্তনের ফলে ব্যক্তির একত্বতার বা অভিন্নতার কোন ক্ষতি হয় না। কারণ মানুষের প্রকৃত একত্বতার ভিত্তি হল,তার সেই আত্মার একত্ব ।

পবিত্র কোরান এ বাস্তবতার প্রতি ইঙ্গিত করতে গিয়ে, পুনরুত্থান বা মাআদের অস্বীকারকারী যারা বলত : মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহ বিধ্বস্ত হওয়ার পর কিরূপে তার পক্ষে নতুন জীবনলাভ সম্ভব? তাদের জবাবে বলে :

) قُلْ يَتَوَفَّاكُم مَّلَكُ الْمَوْتِ الَّذِي وُكِّلَ بِكُمْ (

বলুন (তোমরা বিলুপ্ত হবেনা বরং) তোমাদের জন্যে নিযুক্ত মৃত্যুর ফেরেস্তা তোমাদের প্রাণ হরণ করবে। (সূরা সিজদাহ-১১)

অতএব প্রত্যেকেরই মনুষ্যত্ব ও ব্যক্তিত্বের ভিত্তি হল তা-ই, যা মৃত্যুর ফেরেস্তা কব্জা বা হরণ করেন; দৈহিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে নয় যেগুলো মাটির সাথে মিশে যায়।