আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)16%

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড) লেখক:
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ: কিয়ামত

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 33 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 14016 / ডাউনলোড: 3737
সাইজ সাইজ সাইজ
আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)

লেখক:
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বাংলা

আক্বায়েদ শিক্ষা

তৃতীয় খণ্ড

মূলঃ আয়াতুল্লাহ্ মুহাম্মদ তাকী মিসবাহ্ ইয়াযদী

অনুবাদঃ মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন

প্রকাশনায়ঃ

আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা

আমুজেশে আক্বায়েদ

মূলঃ আয়াতুল্লাহ্ মুহাম্মদ তাকী মিসবাহ্ ইয়াযদী

অনুবাদঃ মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন

প্রকাশনায়ঃ

আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা

প্রকাশ:

আরাবী ১৪২৪

বাংলা ১৪১০

ইংরেজী ২০০৩

 

পুনরুত্থান দিবস পরিচিতি

তৃতীয় খণ্ড

১ম পাঠ

পুনরুত্থান দিবসের পরিচিতির গুরুত্ব

ভূমিকা :

এ পুস্তকের প্রারম্ভে দ্বীন ও এর মৌলিক বিশ্বাসসমূহের (তাওহীদ,নবুয়্যত ও পুনরুত্থান) উপর— অনুসন্ধানের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেছি এবং উল্লেখ করেছি যে,মানুষের জীবন মানবীয় হওয়ার ব্যাপারটি উল্লেখিত বিষয়গুলোর প্রকৃত সমাধানের উপর নির্ভরশীল। প্রথম খণ্ডে খোদা পরিচিতি,দ্বিতীয় খণ্ডে পথপ্রদর্শক পরিচিতি ও পথনির্দেশিকা পরিচিতি (নবুয়্যত ও ইমামত) সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এখন আমরা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পুনরুত্থান বা মাআদ (معاد ) সম্পর্কে পুনরুত্থান দিবসের পরিচিতির গুরুত্ব শিরোনামে আলোচনায় মনোনিবেশ করব।

প্রারম্ভেই এ মৌলিক বিশ্বাসের বিশেষত্ব এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে তার ভূমিকা বর্ণনা করব। অতঃপর বিশ্লেষণ করব যে,মাআদের প্রকৃত ধারনালাভ বিমূর্ত ও অমর আত্মার (روح ) প্রতিৃ বিশ্বাস স্থাপনের সাথে সম্পর্কিত। যেমনকরে অস্তিত্ব পরিচিতি একক প্রভুর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন ব্যতীত অপূর্ণ থাকে,তেমনি মানব পরিচিতিও অমর রূহের বিশ্বাস ব্যতীত অসমাপ্ত থাকে। অবশেষে পুনরুত্থানের মৌলিক বিষয়সমূহকে এ পুস্তকের প্রচলিত রীতিতে ব্যাখ্যা করব ।

পুনরুত্থান দিবসের প্রতি বিশ্বাসের গুরুত্ব :

প্রয়োজন ও চাহিদার যোগান দান,মূল্যবোধ অর্জন এবং পরিশেষে চূড়ান্ত সৌভাগ্য ও উৎকর্ষে পৌঁছাই হল মানুষের কর্মানুরাগের কারণ। আর কর্মের মান ও গুণ এবং এগুলোর দিকনির্দেশনার প্রক্রিয়া বিভিন্ন উদ্দেশ্য নির্ধারণের উপর নির্ভরশীল এবং জীবনের সকল প্রচেষ্টা ঐ সকল উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যেই সম্পাদিত হয়ে থাকে ।

অতএব জীবনের সঠিক লক্ষ্য নির্ধারণ,কার্যক্রমের দিকনির্দেশনা প্রদান ও কর্ম নির্বাচনের ক্ষেত্রে মৌলিক ভূমিকা রাখে। প্রকৃতপক্ষে জীবনের অনুসৃত নীতি নির্ধারণের নির্বাহক,স্বীয় বাস্তবতা,উৎকর্ষ ও কল্যাণ সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ধরন থেকে রূপলাভ করে। ফলে যিনি শুধুমাত্র বস্তুগত উপাদানসমূহ ও এ গুলোর জটিল ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার সমষ্টিকেই স্বীয় জীবনের বাস্তবতা বলে মনে করেন এবং নিজ জীবনকে সীমাবদ্ধ পার্থিব ইহকালীন জীবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ বলে ভাবেন এবং ভোগ,বিলাস ও স্বাচ্ছন্দ্যকে এ ইহকালীন জীবনের চাওয়া-পাওয়া ব্যতীত কিছু ভাবতে পারেন না,তবে তিনি তার জীবনের কর্মসূচীকে এমনভাবে সজ্জিত করবেন,যা কেবলমাত্র পার্থিব চাহিদা পূরণ করবে। অপরদিকে যিনি জীবনের বাস্তবতাকে বস্তুগত বিষয়ের উর্ধ্বে বলে মনে করেন এবং মৃত্যুই জীবনের পরিসমাপ্তি নয় বলে জানেন ;বরং মনে করেন যে,মৃত্যু হল এ নশ্বর পার্থিব জীবন থেকে অবিনশ্বর জীবনে পদার্পণের পথে একটি স্থানান্তর বিন্দু এবং যিনি স্বীয় সঠিক আচার-আচরণকে অশেষ কল্যাণ ও উৎকর্ষের মাধ্যম বলে মনে করেন,তবে তিনি তার জীবনের কর্মসূচীকে এমন ভাবে বিন্যাস করবেন,যাতে পরকালীন জীবনে অধিকতর লাভবান হতে পারেন। ফলে পার্থিব জীবনের কষ্ট ও বিফলতা, তাকে হতাশ ও নিরাশ করতে পারে না এবং স্বীয় কর্তব্য সম্পাদন,অনন্ত সৌভাগ্য ও উৎকর্ষের পথে প্রচেষ্টা চালানো থেকে তাকে বিরত রাখতে পারে না।

এ দু ধরনের মানব পরিচিতি শুধুমাত্র মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের উপর প্রভাব ফেলে না বরং তাদের সামাজিক জীবন ও পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। এছাড়া পরকালীন জীবন এবং চিরন্তন সাচ্ছন্দ্য ও শাস্তির প্রতি বিশ্বাস,অপরের অধিকার সংরক্ষণ ও দুস্থ মানবতার সেবার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আর যে সমাজে এ ধরনের বিশ্বাস বিরাজমান,সে সমাজে ন্যায়ভিত্তিক কোন কানুন প্রবর্তন করতে এবং অন্যের প্রতি অন্যায় ও অত্যাচার প্রতিরোধ করতে অপেক্ষাকৃত কম বল প্রয়োগ করতে হয়। স্বভাবতঃই এ বিশ্বাস যতই বিশ্বজনীন ও সার্বজনীন হতে থাকবে,ততই আন্তর্জাতিক সমস্যাসমূহ হ্রাস পেতে থাকবে।

উপরোল্লিখিত বিষয়টির উপর ভিত্তি করে পুনরুত্থানের বিষয় ও এ সম্পর্কে অনুসন্ধান ও গবেষণার গুরুত্ব সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়। এমনকি শুধুমাত্র তাওহীদের বিশ্বাস (পুনরুত্থানে বিশ্বাস ব্যতীত),জীবনের কাংখিত দিকনির্দেশনার পথে পরিপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। আর এখানেই সকল ঐশী ধর্ম,বিশেষকরে পবিত্র ইসলাম ধর্ম কর্তৃক এ মৌলিক বিশ্বাসের প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করার এবং মানুষের অন্তরে এর বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করার জন্যে নবীগণের (আ.) অপরিসীম প্রচেষ্টার রহস্য উদঘাটিত হয়।

পারলৌকিক জীবনের প্রতি বিশ্বাস,একমাত্র তখনই মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক আচার- আচরণের দিকনির্দেশনা প্রদানের ব্যাপারে স্বীয় ভূমিকা পালন করতে পারবে যখন ইহলৌকিক কর্ম-কাণ্ড ও পরলৌকিক সুখ-দুঃখের মধ্যে একপ্রকার কার্য-কারণগত সম্পর্ক বিদ্যমান বলে গৃহীত হবে এবং ন্যূনতমপক্ষে পারলৌকিক বৈভব ও শাস্তি,ইহলৌকিক সুকর্ম ও দুষ্কর্মের ফলশ্রুতিরূপে পরিগণিত হবে। নতুবা যদি এরূপ মনে করা হয় যে,পরলৌকিক সুখ-সমৃদ্ধি,এ বিশ্বেই লাভ করা সম্ভব (যেমনকরে পার্থিব সুখ-সমৃদ্ধি এ পৃথিবীতেই লাভ করা সম্ভব),তবে পারলৌকিক জীবনের প্রতি বিশ্বাস,ইহলৌকিক জীবনের কর্মকাণ্ডের দিকনির্দেশনায় স্বকীয়তা বিবর্জিত হবে। কারণ এরূপ ধারণা পোষণ করার অর্থ হবে : এ বিশ্বে সুখ-সমৃদ্ধি অর্জনের নিমিত্তে সচেষ্ট হওয়া উচিৎ এবং পরলৌকিক সমৃদ্ধি লাভ করার জন্যে মরণোত্তর জীবনেই বা পরপারেই সচেষ্ট হতে হবে।

অতএব পুনরুত্থান ও পরলৌকিক জীবনের বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি এ দু লোকের (ইহ ও পারলৌকিক) জীবনের সম্পর্ক এবং অনন্ত সুখ-দুঃখের পথে ঐচ্ছিক ক্রিয়াকলাপের যে প্রভাব বিদ্যমান তা-ও প্রমাণ করতে হবে।

পুনরুত্থান দিবস সংক্রান্ত বিষয়ের প্রতি কোরানের গুরুত্বারোপ :

কোরানের এক তৃতীয়াংশেরও বেশী আয়াত অনন্ত জীবন সংক্রান্ত : এক শ্রেনীর আয়াত পরকালে বিশ্বাসের আবশ্যকতার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে অপর শ্রেণীর আয়াত পরকালকে অস্বীকার করার ফল সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তৃতীয় শ্রেণীর আয়াতে পরকালীন অনন্ত বৈভব সম্পর্কে এবং চতুর্থ শ্রেণীর আয়াতে অনন্ত শাস্তি সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে।

অনুরূপ সুকর্ম ও কুকর্মের সাথে ঐগুলোর পরকালীন ফলাফল সম্পর্কেও অসংখ্য আয়াতে আলোচিত হয়েছে। এছাড়া একাধিক পদ্ধতিতে পুনরুত্থানের সম্ভাবনা ও আবশ্যকতা সম্পর্কেও গুরুত্বারোপ ও বর্ণনা করা হয়েছে। আর সেই সাথে কিয়ামত বা বিচার দিবসকে বিস্মৃত হওয়া বা ভুলে যাওয়াই,পুনরুত্থান দিবসকে অস্বীকারকারীদের বিভিন্ন দুষ্কর্ম ও বিচ্যুতির উৎস হিসেবে গণনা করা হয়েছে। কোরানের বিভিন্ন আয়াত থেকে আমরা পাই যে,পায়গাম্বরগণের (আ.) বক্তব্য ও জনগণের সাথে তর্ক-বিতর্কের একটা প্রধান অংশ জুড়ে ছিল মাআদ বা পুনরুত্থানের ব্যাপার। এমনকি এটুকু বললেও অত্যুক্তি হবে না যে,এ মূল বিষয়টির প্রতিপাদনের জন্যে তাদের প্রচেষ্টা তাওহীদকে প্রতিষ্ঠা করার চেয়েও অধিক ছিল। কারণ অধিকাংশ মানুষই এ মৌলিক বিষয়টিকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বেশী বিরোধীতা করেছিল। এ বিরোধিতার কারণকে নিম্নরূপে দু টি সংক্ষিপ্তাকারে প্রকাশ করা যেতে পারে : একটি হল,সকল প্রকার অদৃশ্য ও অস্পৃশ্য বিষয়কে অস্বীকার করার সাধারণ কারণ। আর অপরটি হল,কেবলমাত্র মাআদ বা পুনরুত্থান সম্পর্কিত অর্থাৎ উচ্ছৃংখলতা ও উদাসীনতা দায়িত্বহীনতার প্রতি ঝোঁক। কারণ যেমনটি ইতিপূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে যে,কিয়ামত ও বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাস দায়িত্ববোধ,ক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সীমারেখা মেনে চলা,অত্যাচার ও সীমালংঘন এবং দূর্নীতি ও পাপাচারে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত রাখার শক্তিশালী সহায়ক। আর এর অস্বীকৃতির মাধ্যমে কামনা,বাসনা ও স্বেচ্ছাচারিতার পথ উন্মুক্ত হয়ে থাকে। পবিত্র কোরানে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে :

) يَحْسَبُ الْإِنسَانُ أَلَّن نَّجْمَعَ عِظَامَهُ بَلَىٰ قَادِرِ‌ينَ عَلَىٰ أَن نُّسَوِّيَ بَنَانَهُ بَلْ يُرِ‌يدُ الْإِنسَانُ لِيَفْجُرَ‌ أَمَامَهُ(

মানুষ কি মনে করে যে,আমি তার অস্থিসমূহ (গলে যাবার পর) একত্রিত করতে পারব না? বস্তুতঃ আমি তার আংগুলীর অগ্রভাগ পর্যন্ত (প্রথমবারের মত) পুনর্বিন্যস্ত করতে সক্ষম। তবুওু মানুষ তার সম্মুখে যা আছে তা অস্বীকার করতে চায়। (কিয়ামাহ ৩-৫)

আর পুনরুত্থান দিবসকে অস্বীকার করার মত এ ধরনের মন মানসিকতা প্রকৃতপক্ষে তাদের মধ্যে খুজে পাওয়া যায়,যারা তাদের বক্তব্যে ও লিখনিতে পুনরুত্থান ও পরকাল এবং এ সম্পর্কিত কোরানের অন্যান্য বক্তব্যকে এ পার্থিব ঘটনাপ্রবাহ ও জাতি বা গোষ্ঠীসমূহের পুনর্জাগরণ ও শ্রেণী বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা কিংবা মর্তের স্বর্গ গড়ার সাথে তুলনা করতে সচেষ্ট অথবা চেষ্টা করেন পরকাল বা এতদসংশ্লিষ্ট অন্যান্য ভাবার্থসমূহকে শুধুমাত্র মূল্যবোধগত ভাবার্থ বা বিশ্বাসগত অথবা কাল্পনিক বিষয় বলে ব্যাখ্যা প্রদান করতে। কোরান এ ধরনের লোকদেরকে মানব শয়তান নবীগনের শত্রু বলে চিহ্নিত করেছে। এরা তাদের মনোহর ও প্রতারনামূলক বক্তব্যের মাধ্যমে মানুষের হৃদয় হরণ করে এবং মানুষকে সঠিক বিশ্বাস ও ঐশী বিধানের উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ থেকে দূরে রাখে।

) وَكَذَٰلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا شَيَاطِينَ الْإِنسِ وَالْجِنِّ يُوحِي بَعْضُهُمْ إِلَىٰ بَعْضٍ زُخْرُ‌فَ الْقَوْلِ غُرُ‌ورً‌ا وَلَوْ شَاءَ رَ‌بُّكَ مَا فَعَلُوهُ فَذَرْ‌هُمْ وَمَا يَفْتَرُ‌ونَ(

এরূপে,মানব ও জিনের মধ্যে শয়তানদেরকে প্রত্যেক নবীর শত্রু করেছি,প্রতারণার উদ্দেশ্যে তাদের একে অন্যকে চমকপ্রদ বাক্য দ্বারা প্ররোচিত করে;যদি তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করতেন (জোরপূর্বর্ক তাদেরকে বিরত রাখতেন) তবে তারা এটা করত না (কিন্তু আল্লাহ চান মানুষ সঠিক ও ভ্রান্তপথ নির্বাচন করার ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকুক) সুতরাং তুমি তাদেরকে ও তাদের মিথ্যা রচনাকে বর্জন কর। (সূরা আনআম ১১২)

) وَلِتَصْغَىٰ إِلَيْهِ أَفْئِدَةُ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَ‌ةِ وَلِيَرْ‌ضَوْهُ وَلِيَقْتَرِ‌فُوا مَا هُم مُّقْتَرِ‌فُونَ(

এবং তারা এই উদ্দেশ্যে প্ররোচিত করে যে,যারা পরকালে বিশ্বাস করে না,তাদের মন যেন তার প্রতি অনুরাগী হয় এবং তাতে যেন তারা পরিতুষ্ট হয়,আর তারা যে অপকর্ম করে তারা যেন তাই করতে থাকে। ( সূরা আনাআম -১১৩)

উপসংহার :

কোন ব্যক্তি যাতে তার জীবনে এমন পথ নির্বাচন করতে পারে যে,প্রকৃত সৌভাগ্য ও উৎকর্ষ অর্জন করা যায়,তবে তাকে ভেবে দেখা উচিৎ মৃত্যুর সাথেই কি কোন মানুষের জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে,না কি অপর কোন জীবন এ জীবনের পরে বিদ্যমান? এ পৃথিবী থেকে অপর কোন জগতে স্থানান্তরিত হওয়ার অর্থ কি এক শহর থেকে অপর শহরে ভ্রমণের মত যে,জীবন ধারণের যাবতীয় সরঞ্জামাদি ঐ স্থানেই সংগ্রহ করতে পারে,নাকি এ ইহলৌকিক জীবন,পরবর্তী জীবনের সুখ-দুঃখের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে এবং পরবর্তী জীবনের ভূমিকা স্বরূপ,যার ফলে সকল কর্ম এখানেই সম্পন্ন করতে হবে এবং চূড়ান্ত ফল ওখানে লাভ করতে হবে ?

এ প্রশ্নগুলোর সমাধান না হওয়া পর্যন্ত জীবনের জন্যে সঠিক পথ ও সঠিক অনুসৃত নীতি ও কর্মসূচী নির্বাচনের পালা আসে না। কারণ যতক্ষণ পর্যন্ত গন্তব্য নির্ধারণ না হবে,সেখানে পৌঁছার পথও নির্ধারণ করা যাবে না।

পরিশেষে স্মরণযোগ্য যে,এ ধরনের জীবনের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা যতই দুর্বল হোক না কেন,তা-ই সচেতন ও জ্ঞানী ব্যক্তির জন্যে যথেষ্ট,যা তাকে এ সম্পর্কে অনুসন্ধান ও গবেষণায় বাধ্য করে। কারণ সম্ভাব্যতার পরিমা অপরিসীম।

২য় পাঠ

পুনরুত্থানের বিষয়টি রূহের সাথে সম্পর্কিত

জীবন্ত অস্তিত্বে একত্বের ভিত্তি :

মানুষের শরীর সকল প্রাণীর মতই একাধিক কোষের সমষ্টি যাদের প্রত্যেকটিই সর্বদা রাসায়নিক পরিবর্তন,রূপান্তর ও বিবর্তিত অবস্থায় আছে। এদের সংখ্যাও জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পরিবর্তনশীল এবং এমন কোন মানুষ পাওয়া যাবে না যার জীবনে শরীর গঠনকারী উপাদানসমূহ পরিবর্তন হয়নি অথবা যার কোষের সংখ্যা সর্বদা ধ্রুব।

অতএব প্রাণীদেহে এবং বিশেষকরে মানুষের দেহে সংগঠিত এই পরিবর্তন ও রূপান্তরের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্ন হতে পারে যে,কিসের ভিত্তিতে (একই দেহের একাধিক পরিবর্তন সত্বেত্ত) এ পরিবর্তিত বিষয়গুলোকে অভিন্ন অস্তিত্বরূপে গণনা করা যেতে পারে যদিও তার অঙ্গসমূহ আজীবন অসংখ্য রূপান্তরের সম্মুখীন হয়েছিল ?

এ প্রশ্নের যে সহজ উত্তরটি দেয়া হয় তা হল : সকল প্রকার জীবন্ত অস্তিত্বেরই একত্বের ভিত্তি হল,তাদের একই সময়ের এবং বিভিন্ন সময়ের অঙ্গ-প্রতঙ্গসমূহের মধ্যে সংযোগ। যদিও দেহের কোষসমূহ ক্রমান্বয়ে মৃত্যু লাভ করে এবং নতুন কোষসমূহ ঐগুলোর স্থান দখল করে,তথাপি এ পরিবর্তিত ধারার সংযুক্তিকে অভিন্ন বিষয় বলে গণনা করা যেতে পারে।

কিন্তু এ জবাবটি সন্তোষজনক উত্তর হতে পারে না। কারণ আমরা যদি ইটের তৈরী কোন একটি ইমারতকে কল্পনা করি যার ইটগুলোকে ক্রমানয়ে এরূপে পরিবর্তন করা হল যে,কিছুদিন পর পূর্ববর্তী কোন ইটই তাতে অবশিষ্ট রইল না,তবে এ নতুন ইটের সমষ্টিকে ঠিক পূর্বের সে ইমারতই বলে মনে করা যাবে না,যদিও বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ ধরনের বক্তব্য শুধুমাত্র তাদের পক্ষ থেকে বিবৃত হয়,যারা সমষ্টির অংশসমূহের পরিবর্তন সম্পর্কে কোন খবর রাখেন না। প্রাগুক্ত প্রশ্নটির জবাবটিকে নিম্নরূপে সম্পূরণ করা যেতে পারে : উল্লেখিত ক্রমানুগতিক পরিবর্তন কেবলমাত্র তখনই কোন সমষ্টির অভিন্নতার ক্ষেত্রে কোন প্রকার বিপত্তি সৃষ্টি করে না যখন তা কোন এক স্বভাবজাত ও আভ্যন্তরীণ নির্বাহীর ভিত্তিতে সম্পন্ন হবে -যেমনটি জীবন্ত অস্তিত্বের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়। তবে ইমারতের ইটসমূহের পরিবর্তন বাহ্যিক ও গাঠনিক নির্বাহীর মাধ্যমে অর্জিত হয় আর এ দৃষ্টিকোণ থেকে অভিন্নতা ও প্রকৃত একাত্বতাকে অংশসমূহের পরিবর্তন ধারায় ঐগুলোর সগোত্র বলে মনে করা যায় না।

এ জবাবটি সেই স্বভাবজাত একক নির্বাহীর গ্রাহ্যতার উপর নির্ভরশীল যা পরিবর্তন ধারায় সর্বদা অবশিষ্ট থাকে এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগত ও অংশগত বিন্যাস ও শৃংখলাকে রক্ষা করে । অতএব স্বয়ং এ নির্বাহী সম্পর্কেই প্রশ্ন আসে যে,প্রকৃতপক্ষে তা কী ? এর একাত্বতার ভিত্তিই বা কী ?

প্রসিদ্ধ দার্শনিক মতবাদানুসারে সকল প্রাকৃতিক অস্তিত্বের একাত্বতার ভিত্তি হল,প্রকৃতি (طبیعت ) অথবা গঠন (صورت ) নামক এক অস্পৃশ্য ও সরল (بسیط ) ( অর্থাৎ যা যৌগিক নয় ) বিষয়,যা বস্তুর পরিবর্তনে পরিবর্তিত হয় না। জীবন্ত অস্তিত্বে যে খাদ্যগ্রহণ,বিকাশ ও প্রজনন প্রক্রিয়ার মত বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপ সম্পন্ন হয়,তাকে নাফস (نفس ) বা আত্মা নামকরণ করা হয়।

প্রচীন দার্শনিকগণ উদ্ভিদ ও প্রাণীর নাফস বা আত্মাকে বস্তুগত (مادّی ) এবং মনুষ্য আত্মা বা নাফসকে অবস্তুগত’(مجرد ) বলে মনে করতেন। কিন্তু ইসলামী দার্শনিকদের অনেকেই,বিশেষকরে সাদরুল মুতা ল্লেহীন শিরাজী প্রাণীর নাফসকেও এক পর্যায়ের অবস্তুগত বলে মনে করেছেন এবং চেতনা ও প্রত্যয়কে অবস্তুগত অস্তিত্বের নির্দেশনা ও অপরিহার্যতা বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু বস্তু বাদীরা,যারা অস্তিত্বকে শুধুমাত্র বস্তু ও বস্তুর বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে সীমাবদ্ধ বলে মনে করেন,তারা অস্পৃশ্য রূহ বা আল্লাহ্কে অস্বীকার করে থাকেন। আধুনিক বস্তুবাদীরা (যেমন : পোষ্টিবিষ্টরা) প্রকৃতপক্ষে সকল প্রকার অস্পৃশ্য (অর্থাৎ যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়) বিষয়কেই অস্বীকার করেন বা অস্পৃশ্য বিষয়কে অন্ততঃ বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করা যায় না বলে মনে করেন। ফলে তারা প্রকৃতি বা অস্পৃশ্য গঠনকে গ্রহণ করেন না। আর স্বভাবতঃই একাত্বতার ভিত্তি সম্পর্কেও তাদের নিকট কোন সঠিক জবাব নেই।

যেহেতু উদ্ভিদে একাত্বতার ভিত্তি হল উদ্ভিজ্জ আত্মা,সেহেতু উদ্ভিজ্জ জীবন উপযুক্ত বস্তুতেু বিশেষ উদ্ভিদীয় গঠন ও আত্মার অস্তিত্বের আওতায় থাকে। আর যখনই বস্তুর এ উপযুক্ততা (বা গ্রহণক্ষমতা) বিলুপ্ত হয়,তখনই এ উদ্ভিদীয় গঠন ও আত্মারও বিস্মৃতি ঘটে। আবার যদি সেই বস্তু পুনরায় নতুনভাবে উদ্ভিজ্জ গঠন গ্রহণ করার যোগ্যতা অর্জন করে,তবে তা নতুন এক উদ্ভিদীয় আত্মার অধিকারী হয়। কিন্তু পুরাতন ও নতুন উদ্ভিদের মধ্যে পরিপূর্ণ সাদৃশ্য থাকা সত্বেও,প্রকৃতার্থে এগুলো অভিন্ন নয় এবং সূক্ষ্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে নতুন উদ্ভিদকে,পূর্বোক্ত উদ্ভিদ রূপেই মনে করা যায় না।

তবে প্রাণী ও মানুষের নাফস বা আত্মা যেহেতু অবস্তুগত,সেহেতু দেহ বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও অবশিষ্ট থাকতে পারে এবং পুনরায় যখন দেহের সাথে সম্পর্ক স্থাপিত হয়,তখন ঠিক সেই ব্যক্তির একত্বতা ও অভিন্নতাকে রক্ষা করতে সক্ষম,যেরূপে মৃত্যুর পূর্বেও রূহ বা আত্মার ভিত্তিতে এ ব্যক্তির একত্বতা ও অভিন্নতা বজায় ছিল এবং দৈহিক উপাদানের পরিবর্তন ব্যক্তির বিভিন্নতার কারণ হয়নি। কিন্তু যদি কেউ প্রাণী ও মানুষের অস্তিত্বকে শুধুমাত্র এ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য দেহে ও দৈহিক বৈশিষ্ট্যের । মধ্যেই সীমাবদ্ধ বলে মনে করে থাকেন এবং রূহকেও কোন এক বা সমষ্টিগত বৈশিষ্ট্যের ফল বলে গণনা করে থাকেন,এমনকি একে অস্পৃশ্য গঠন মনে করলে ও বস্তুগত বলে গণনা করেন,যা এর অঙ্গ-প্রতঙ্গের বিলুপ্তির সাথে সাথে বিনষ্ট হয়,তবে এ ধরনের ব্যক্তির পক্ষে পুনরুত্থানের সঠিক ধারণা লাভ করা সম্ভব নয়। কারণ যদি ধারণা করা হয় যে,দেহ জীবনের জন্যে নতুনভাবে উপযুক্ততা অর্জন করেছে,তবে তাতে নতুন বৈশিষ্ট্য ও গুণের আবির্ভাব ঘটে। ফলে একাত্বতার বা অভিন্নতার (এটা তা-ই) আর কোন প্রকৃত ভিত্তির অস্তিত্ব থাকে না। কারণ ধারণা করা হয়েছে যে,পূর্বতন সকল বৈশিষ্ট্যই সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয়েছে এবং নতুন বৈশিষ্ট্যসমূহ রূপ লাভ করেছে।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে,একমাত্র তখনই মৃত্যু পরবর্তী জীবনকে সঠিক রূপে অনুধাবন করা যাবে,যখন রূহকে দেহ ও দৈহিক বৈশিষ্ট্য ভিন্ন অন্য কোন বিষয় বলে মনে করা হবে। এমনকি একে বস্তু গঠন,যা দেহে অনুপ্রবেশ করেছে এবং দেহের অবস্থানের সাথে সাথে বিনষ্ট হয়ে যায় তা-ও মনে করা যাবে না।

 

অতএব সর্বপথমে রূহের (روح ) অস্তিত্বকে স্বীকার করতে হবে। দ্বিতীয়ত : রূহকে এক সত্ত্বাগত বিষয় ( Essence) বলে মনে করতে হবে,দেহ সমন্ধীয় বলে মনে করা যাবে না। তৃতীয়তঃ দেহ বিনষ্ট হওয়ার পরও একে স্বাধীন ও অবশিষ্ট থাকার যোগ্য বলে মনে করতে হবে ;অনুপ্রবেশকার্রী গঠনের মত নয় (পারিভাষিক অর্থে বস্তুতে সমাপতিত হওয়া) যে,দেহ বিনষ্ট হওয়ার সাথে সাথে বিনষ্ট হয়ে যাবে ।

মানুষের অস্তিত্বে আত্মার অবস্থান :

অপর একটি বিষয় যা এখানে স্মরণ করব তা হল এই যে,দেহ ও আত্মার সমন্বয়ে মানুষের গঠন দু টি মৌলের সমন্বয়ে গঠিত অন্যান্য রাসায়নিক যৌগের মত নয়। উদাহরণতঃ অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের সমন্বয়ে পানি গঠিত হয়,যাদের পারস্পরিক বিভাজনের ফলে একটি সমগ্র’ হিসাবে ঐ যৌগের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু রূহ বা আত্মা হল মানুষের মূলসত্তা এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তা বিদ্যমান থাকবে ততক্ষণ মনুষ্যত্ব এবং ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব সংরক্ষিত থাকবে। আর এ কারণেই দেহের কোষসমূহের পরিবর্তনের ফলে ব্যক্তির একত্বতার বা অভিন্নতার কোন ক্ষতি হয় না। কারণ মানুষের প্রকৃত একত্বতার ভিত্তি হল,তার সেই আত্মার একত্ব ।

পবিত্র কোরান এ বাস্তবতার প্রতি ইঙ্গিত করতে গিয়ে, পুনরুত্থান বা মাআদের অস্বীকারকারী যারা বলত : মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহ বিধ্বস্ত হওয়ার পর কিরূপে তার পক্ষে নতুন জীবনলাভ সম্ভব? তাদের জবাবে বলে :

) قُلْ يَتَوَفَّاكُم مَّلَكُ الْمَوْتِ الَّذِي وُكِّلَ بِكُمْ (

বলুন (তোমরা বিলুপ্ত হবেনা বরং) তোমাদের জন্যে নিযুক্ত মৃত্যুর ফেরেস্তা তোমাদের প্রাণ হরণ করবে। (সূরা সিজদাহ-১১)

অতএব প্রত্যেকেরই মনুষ্যত্ব ও ব্যক্তিত্বের ভিত্তি হল তা-ই, যা মৃত্যুর ফেরেস্তা কব্জা বা হরণ করেন; দৈহিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে নয় যেগুলো মাটির সাথে মিশে যায়।

৩য় পাঠ

আত্মার বিমূর্তনতা

ভূমিক :

ইতিমধ্যেই আমরা জেনেছি যে,মাআদ বা পুনরুত্থানের বিষয়টি আত্মার সাথে সম্পর্কিত। অর্থাৎ কেবলমাত্র তখনই বলা যাবে যে, মৃত্যুর পর যিনি (পুনরায়) জীবিত হয়ে থাকবেন,তিনি সেই পূর্বের ব্যক্তিই যখন তার আত্মা,তার দেহ বিনষ্ট হয়ে যাবার পরও অবশিষ্ট থাকবে। অন্যভাবে বলা যায় : সকল মানুষই,বস্তুগতদেহ ছাড়া ও এক অবস্তুগত সত্বার অধিকারী,যা দেহ থেকে স্বাধীন হওয়ার যোগ্যতা রাখে এবং তার মনুষ্যত্ব ও ব্যক্তিত্বও এর উপর নির্ভরশীল। নতুবা ঐ ব্যক্তির জন্যে নতুন কোন জীবনের ধারণা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না।

অতএব পুনরুত্থান ও এতদসম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়ের উপর আলোচনা করার পূর্বে এ বিষয়টিকে প্রতিপাদন করতে হবে। আর এ দৃষ্টিকোণ থেকেই এ পাঠে আমরা কেবলমাত্র এ বিষয়টির উপরই আলোকপাত করব এবং একে প্রমাণের জন্যে দু ধরনের যুক্তির অবতারণা করব : একটি হল বুদ্ধিবৃত্তিক এবং অপরটি হল ওহীর মাধ্যমে

আত্মার বিমূর্তনতার স্বপক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলসমূহ :

প্রাচীনকাল থেকেই দার্শনিক ও চিন্তাবিদগণ রূহ (روح ) বা আত্মা (দর্শনের পরিভাষায় যাকে নাফ্স বলা হয়১০ )সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা করেছেন। বিশেষ করে ইসলামী দার্শনিকগণ বিষয়ের উপর অধিক গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন এবং তাদের দর্শন সম্পর্কিত পুস্তকসমূহের বিশেষ অংশ জুড়ে এ বিষয়টি স্থান পেলেও, তারা এ বিষয়টির শিরোনামে পৃথক পৃথক পুস্তক-পুস্তিকাও লিখেছিলেন। আর সেই সাথে যারা রূহকে দৈহিক সংঘটনসমূহের ( Accidents ) মধ্যে একটি সংঘটন (Accident ) বলে মনে করেন অথবা বস্তুগত গঠন (দৈহিক উপাদানের অনুসারী) বলে গণনা করেন,তাদের বক্তব্যকে একাধিক যুক্তির মাধ্যমে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।

স্পষ্টতঃই এ ধরনের বিষয়ের উপর বিস্তারিত আলোচনা করা এ পুস্তক সংশ্লিষ্ট নয়। ফলে এ বিষয়টির উপর কিছুটা আলোকপাত করেই তুষ্ট থাকব। আর চেষ্টা করব এ বিষয়ের উপর সুস্পষ্ট ও একই সাথে সুদঢ় বক্তব্য উপস্থাপন করতে। একাধিক বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলের সমন্বয়ে এ বক্তব্যটির উপস্থাপন নিম্নলিখিত ভূমিকার মাধ্যমে সূচনা করব :

আমরা আমাদের নিজ নিজ চর্মের রং ও দেহের গঠনকে সচক্ষে পর্যবেক্ষণ করি এবং বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কোমলতা ও কর্কশতাকে স্পর্শেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অনুভব করতে পারি। আমাদের দেহাভ্যন্তরস্থ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্পর্কে পরোক্ষভাবে অবহিত হতে পারি। কিন্তু ভয়-ভীতি,অনুগ্রহ ক্রোধ,ইচ্ছা ও আমাদের চিন্তাকে ইন্দ্রিয়ের সাহায্য ব্যতীতই অনুধাবন করে থাকি। অনুরূপ যে আমা হতে এ অনুভব,অনুভূতির মত মানসিক অবস্থা প্রকাশ পায়,তাকেও কোন প্রকার ইন্দ্রিয়ের সাহায্য ব্যতিরেকেই উপলব্ধি করতে পারি।

সুতরাং মানুষ দু প্রকার অনুভূতির অধিকারী : এক প্রকারের অনুভূতি হল,যার জন্যে ইন্দ্রিয়ের উপর নির্ভর করতে হয় এবং অপর শ্রেণী হল,যার জন্যে ইন্দ্রিয়ের প্রয়োজন হয় না।

অপর একটি বিষয় হল : ইন্দ্রিয়ানুভূতি যে,বিভিন্ন প্রকার ভুল-ভ্রান্তিতে পতিত হয় তার আলোকে বলা যায়,প্রাগুক্ত প্রথম শ্রেণীর অনুভূতি,দ্বিতীয় শ্রেণীর অনুভূতির ব্যতিক্রমে ত্রুটি-বিচ্যুতিতে পতিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণীর অনুভূতিতে ভুল-ত্রুটি ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কোন অবকাশ থাকে না। যেমন : কেউ হয়ত সন্দেহ করতে পারে যে,তার চামড়ার রং যে রকম দেখছে ঠিক সেরকমটি কি না। কিন্তু কেউই সন্দেহ করতে পারে না যে,সে কোন চিন্তা করে কি না,সিদ্ধান্ত নিয়েছে কি না,সন্দেহ করছে কি না ।

আর এ বিষয়টিই দর্শনে এ ভাবে বর্ণিত হয় যে,স্বজ্ঞাত সতঃলব্ধ জ্ঞান(Intuitive Knowledge) প্রত্যক্ষভাবে স্বয়ং বাস্তবতার সাথে সমন্ধ স্থাপন করে। ফলে ত্রুটি- বিচ্যুতির কোন সুযোগ থাকে না। কিন্তু অভিজ্ঞতালব্ধ বা অর্জিত জ্ঞান (Empirical Knowledge ) অনুভূতিক গঠনের (Form ) মাধ্যমে অর্জিত হয়। ফলে স্বভাবতঃই সন্দেহ ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ থাকে।

অর্থাৎ মানুষের সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য জ্ঞান হল স্বজ্ঞাত ও প্রত্যক্ষ জ্ঞান,যা নাফ্স বা আত্মার জ্ঞান,আবেগ,অনুভূতি ও অন্যান্য সকল মানসিক অবস্থাকে সমন্বিত করে । অতএব উপলব্ধি ও চিন্তার ধারক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী এ আমা র অস্তিত্বে কখনোই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকতে পারে না -যেমনিকরে ভয়,অনুগ্রহ,ক্রোধ,চিন্তা ও ইচ্ছার অস্তিত্বে কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ থাকে না।

এখন প্রশ্ন হল : এই আমা কি সেই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও বস্তুগত দেহ এবং মানসিক অবস্থা কি দেহ সংঘটিত;নাকি তাদের অস্তিত্ব দেহ ভিন্ন অন্য কিছু -যদিও আমা দেহের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত এবং নিজের অনেক কর্মই দেহের মাধ্যমে সম্পাদন করে থাকে;এছাড়া দেহ কর্তৃক প্রভাবিত হয় ও দেহকে প্রভাবিত করে ?

উল্লেখিত ভূমিকাটির আলোকে এর জবাব খুব সহজেই আমরা পেতে পারি। কারণ :

প্রথমত : আমা কে স্বজ্ঞাত জ্ঞানে উপলব্ধি করব;কিন্তু দেহকে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে চিনতে হবে। অতএব আমা (নাফস ও রূহ) দেহ ভিন্ন অন্য বিষয়।

দ্বিতীয়ত : আমা এমন এক অস্তিত্ব,যা যুগযুগান্তরে একত্বতার বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃত ব্যক্তিত্বসহ অবশিষ্ট থাকে এবং এ একত্বতা ও ব্যক্তিত্বকে আমরা ভুল-ত্রুটি বিবর্জিত স্বজ্ঞাত জ্ঞানের মাধ্যমে খুজে পাই। অথচ দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহ অসংখ্যবার পরিবর্তিত হয় এবং পূর্ববর্তী ও উত্তরবর্তী অংশের একত্ব ও অভিন্নতার (এটা তা-ই) জন্যে কোন প্রকার প্রকৃত ভিত্তিরই অস্তিত্ব নেই।

তৃতীয়ত : আমা এক সরল (بسیط ) ও অবিভাজ্য অস্তিত্ব।

উদাহরণতঃ একে দু অর্ধ আমা তে বিভক্ত করা সম্ভব নয়। অথচ দেহের অঙ্গসমূহ বিবিধ এবং বিভাজনোপযোগী।

চতুর্থত : কোন মানসিক অবস্থাই যেমন : অনুভূতি ইচ্ছা ইত্যাদি বস্তুগত বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ বিস্তৃতি ও বিভাজন ইত্যাদির অধিকারী নয়। আর এ ধরনের কোন অবস্তুগত বিষয়কে বস্তু (দেহ) সংঘটন বলে গণনা করা যায় না। অতএব এ সংঘটনের বিষয় (موضوع ) হল অবস্তুগত সত্তা (مجرد )।

রূহের অস্তিত্ব ও স্বাধীনতা এবং মৃত্যুর পরও এর অবশিষ্ট থাকার স্বপক্ষে নির্ভরযোগ্য ও মনোহর যুক্তিসমূহের মধ্যে একটি হল সত্য স্বপ্নসমূহ,যার মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তি তাদের মৃত্যুর পর সঠিক সংবাদসমূহ স্বপ্নদর্শনকারীর নিকট পৌঁছিয়েছেন। অনুরূপ আত্মাসমূহকে ডেকে পাঠানো,যা চূড়ান্ত ও উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্তসমূহ সহকারে একথার স্বপক্ষেই দলিল উপস্থাপন করে। এছাড়া আল্লাহর ওলীগণের কেরামত,এমনকি যোগীদের কোন কোন কর্মের কথাও আত্মা ও এর বিমূততার প্রমাণসরূ উল্লেখ করা যেতে পারে। এ বিষয়ের উপর লিখিত পৃথক পৃথক পুস্তক রয়েছে।

কোরান থেকে দলিলাদি :

কোরানের ভাষায় মানুষের আত্মা সম্পর্কে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই যে,রূহ অসীম মর্যাদার প্রান্ত থেকে মহান আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত হয়। যেমনটি মানব সৃষ্টির প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে :

) وَنَفَخَ فِيهِ مِن رُّ‌وحِهِ (

এবং তাতে রূহ ফুকে দিয়েছেন তার নিকট হতে। (সূরা সেজদা-৯)

অর্থাৎ দেহ গঠন করার পর নিজের (আল্লাহর) সাথে সম্পর্কিত রূহ তাতে প্রদান করলেন,খোদার জাত (ذات ) থেকে নয়,যার ফলে খোদা মানুষে স্থান্তরিত হবেন (মহান আল্লাহ আমাদেরকে এ ধরনের চিন্তা থেকে রক্ষা করুন)।

অনুরূপ হযরত আদমের (আ.) সৃষ্টি সম্পর্কে বলা হয়েছে :

( وَنَفَخت فِيهِ مِن رُّ‌وحِهِ)

এবং তাতে আমার রূহ সঞ্চার করলাম। (হিজর -২৯) এবং (সাদ-৭২)

এছাড়া অপর কিছু আয়াত থেকে আমরা দেখতে পাই যে,রূহ দেহ বা দৈহিক বৈশিষ্ট্য ও সংঘটন ব্যতীত অন্য বিষয় এবং তা দেহ ব্যতীতই অবশিষ্ট থাকার যোগ্যতা রাখে। যেমন : কাফেরদের বক্তব্য উল্লেখ করতে গিয়ে বলাহয় যে,তারা বলত :

) إِذَا ضَلَلْنَا فِي الْأَرْ‌ضِ أَإِنَّا لَفِي خَلْقٍ جَدِيدٍ(

আমরা (মৃত্যু বরণ এবং) মৃত্তিকায় পর্যবসিত হলেও এবং আমাদের শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গ মৃত্তিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লেও কি আমাদেরকে আবার নতুন করে সৃষ্টি করা হবে? (সেজদা-১০)

মহান আল্লাহ জবাব দিলেন :

) قُلْ يَتَوَفَّاكُم مَّلَكُ الْمَوْتِ الَّذِي وُكِّلَ بِكُمْ ثُمَّ إِلَىٰ رَ‌بِّكُمْ تُرْ‌جَعُونَ(

বল,(তোমরা নিখোঁজ হবে না বরং) তোমাদের জন্যে নিযুক্ত মৃত্যুর ফেরেস্তা তোমাদের প্রাণ হরণ করবে। অবশেষে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের দিকে প্রত্যাবর্তন করবে। (সোজদা-১১)

অতএব মানুষের স্বরূপের ভিত্তি মূলে রয়েছে তার আত্মা বা রূহ,যা মৃত্যুর ফেরেস্তা কর্তৃক হরণ করা ও সংরক্ষিত হয়ে থাকে;দেহের বিভিন্ন অংশ,যেগুলো বিধ্বস্ত ও মৃত্তিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে,তা নয়।

অপর এক স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে :

 ) اللَّـهُ يَتَوَفَّى الْأَنفُسَ حِينَ مَوْتِهَا وَالَّتِي لَمْ تَمُتْ فِي مَنَامِهَا فَيُمْسِكُ الَّتِي قَضَىٰ عَلَيْهَا الْمَوْتَ وَيُرْ‌سِلُ الْأُخْرَ‌ىٰ إِلَىٰ أَجَلٍ مُّسَمًّى(

আল্লাহই জীবসমূহের প্রাণ হরণ করেন তাদের মৃত্যুর সময় এবং যাদের মৃত্যু আসেনি তাদের প্রাণও নিদ্রার সময়। অতঃপর যার জন্যে মৃত্যুর সিদ্ধান্ত করেন তার প্রাণ তিনি রেখে দেন এবং অপরগুলি এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে ফিরিয়ে দেন। (সূরা যুমার -৪২)

অত্যাচারীদের মৃত্যুর প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলা হযেছে :

 ) إِذِ الظَّالِمُونَ فِي غَمَرَ‌اتِ الْمَوْتِ وَالْمَلَائِكَةُ بَاسِطُو أَيْدِيهِمْ أَخْرِ‌جُوا أَنفُسَكُمُ(

যখন জালিমরা মৃত্যু যন্ত্রণায় থাকবে এবং ফেরেস্তাগণ হাত বাড়িয়ে বলবে,তোমাদের প্রাণ বের কর । (আনআম-৯৩)

এ আয়াতসমূহ এবং অপর আয়াতসমূহ থেকে (সংক্ষিপ্ততা বজায় রাখার জন্যে,এ গুলোর উল্লেখ থেকে বিরত থাকছি) আমরা দেখতে পাই যে,প্রত্যেকেরই ব্যক্তিত্ব ও স্বাতন্ত্র্য এমন কিছুতে বিদ্যমান যা মহান আল্লাহ ও মৃত্যুর ফেরেস্তাগণ বা রূহ কব্জাকারী ফেরেস্তাগণ হরণ করে থাকেন এবং দেহের বিনাশের ফলে মানুষের ব্যক্তিত্বের একত্বতার ও রূহের বিদ্যমানতার কোন ক্ষতি করে না।

উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রিক্ষিতে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে,প্রথমতঃ মানুষে রূহ (روح ) ও আত্মা নামক কিছু বিদ্যমান। দ্বিতীয়তঃ মানুষের আত্মা অবশিষ্ট থাকার ও দেহ থেকে স্বাধীন হওয়ার যোগ্যতা রাখে,বস্তুসংঘটন ও বস্তুগত গঠনের (صور مادّی ) মত অবস্থানের বিলুপ্তির সাথে সাথে বিনাশ হয়ে যায় না। তৃতীয়তঃ সকলের স্বরূপ ও স্বাতন্ত্রিকতা তার আত্মার উপর নির্ভরশীল। অন্যকথায় : প্রত্যেক মানুষেরই বাস্তবতা বা প্রকৃত অবস্থা হল,তার আত্মায় এবং দেহ সেখানে আত্মার অধীনে সরঞ্জামের ভূমিকা রাখে মাত্র।

৪র্থ পাঠ

মাআদ বা পুনরুত্থানের প্রতিপাদন

ভূমিকা :

এ পুস্তকের প্রারম্ভেই আমরা উল্লেখ করেছিলাম যে,পুনরুত্থানে বিশ্বাস ও পরকালীন জগতে প্রত্যেক মানুষের জীবনলাভের বিশ্বাস,প্রতিটি ঐশী ধর্মেরই মৌলিকতম বিশ্বাসসমূহের অন্যতম। আল্লাহ্ প্রেরিত পুরুষগণ এ বিষয়টির উপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন এবং মানুষের হৃদয়ে এর বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করার জন্যে অপরিসীম শ্রম ব্যয় করেছিলেন।

পবিত্র কোরানে পুনরুত্থান (معاد ) ন্যায়পরায়ণতা (عدل ) ও একক খোদার প্রতি বিশ্বাস সমান গুরুত্ব পেয়েছে এবং বিশটিরও অধিক সংখ্যক আয়াতে (আল্লাহ) ওالیوم الاخر   (ওয়াল ইয়াওমূল আখির) একইসাথে ব্যবহার করা হয়েছে (পরকালীন জীবন সম্পর্কে বর্ণিত যে দু সহস্রাধিক আয়াত এসেছে তা ব্যতীত)।

এ খণ্ডের শুরুতেই বিচার দিবসের পরিচিতির উপর গবেষণার গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম এবং ব্যাখ্যা করেছিলাম যে,পুনরুত্থানের সঠিক ধারণা,আত্মা বা রূহকে স্বীকার করার উপর নির্ভরশীল,যা প্রত্যেক মানুষেরই স্বরূপের ভিত্তি এবং যা মৃত্যুর পরও অবশিষ্ট থাকে,যার ফলে বলা যায় : যে ব্যক্তি পরলোকগমণ করে,ঠিক সে ব্যক্তিই পুনরায় পরকালে জীবন লাভ করবে। অতঃপর এ ধরনের রূহ বা আত্মার অস্তিত্বকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও ওহীভিত্তিক দলিলের মাধ্যমে প্রমাণ করেছি,যাতে মানুষের অনন্ত জীবন শীর্ষক মূল আলোচনার ক্ষেত্র প্রস্তত হয়। এখন এ গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয়টির প্রতিপাদনের পালা এসেছে।

রূহ বা আত্মার বিষয়টি যেরূপ দু ভাবে (বুদ্ধি বৃত্তিক ও ওহী) প্রমাণিত হয়েছে সেরূপ এ বিষয়টিও দু ভাবেই প্রতিপাদনযোগ্য। আমরা এখানে পুনরুত্থানের প্রয়োজনীয়তার উপর দু টি বুদ্ধিবৃত্তিক দলিল উপস্থাপন করব। অতঃপর পুনরুত্থানের সম্ভাবনা ও প্রয়োজনীয়তার উপর পবিত্র কোরানের বক্তব্যের কিছু অংশ তুলে ধরব।

প্রজ্ঞাভিত্তিক দলিল :

খোদা পরিচিতি খণ্ডে আমরা আলোচনা করেছিলাম যে,প্রভুর সৃষ্টি উদ্দেশ্যহীন ও অনর্থক নয়,বরং কল্যাণ ও পূর্ণতার প্রতি যে অনুরাগ প্রভুর সত্তায় (ذات ) বিদ্যমান। মূলতঃ স্বয়ং সত্তায় এবং অনুবর্তনক্রমে এর প্রভাব,যা কল্যাণ ও পূর্ণতার একাধিক স্তরবিশিষ্ট,তার সাথে সম্পর্কযুক্ত। ফলে তিনি এ বিশ্বকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যে,যথাসম্ভব সর্বাধিক পূর্ণতা ও কল্যাণ তাতে অর্জিত হয়। আর এ কারণেই আমরা মহান প্রভুর প্রজ্ঞা বা হিকমত নামক গুণটি প্রমাণ করেছি,যার দাবী হল সৃষ্ট বিষয়সমূহকে তাদের চূড়ান্ত ও যথোপযুক্ত উৎকর্ষে পৌঁছানো। কিন্তু বস্তুগত বিশ্বে রয়েছে বিভিন্ন অসামঞ্জস্যতা এবং বস্তুগত অস্তিত্বসমূহের কল্যাণ ও পূর্ণতার ক্ষেত্রে বিদ্যমান পারস্পরিক বিরোধ। প্রজ্ঞাময় প্রভুর পরিচালনায় সৃষ্ট বিষয়াদি এরূপে বিন্যাসিত হয়েছে যে,সামগ্রিকভাবে ঐগুলো সর্বাধিক কল্যাণ ও পূর্ণতার অধিকারী হতে পারে। অন্যকথায় : বিশ্ব সুশৃংখলিত বিন্যাস ব্যবস্থার অধিকারী হতে পারে। আর এ দৃষ্টিকোণ থেকেই বিভিন্ন উপাদান ও এগুলোর সংখ্যা,গুণ,ক্রিয়া,প্রতিক্রিয়া ও গতি এমনভাবে বিন্যাস করা হয়েছে যে,প্রাণী ও উদ্ভিদরাজি সৃষ্টির ক্ষেত্র এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে মানুষ (যা এ বিশ্বের পূর্ণতম অস্তিত্ব) সৃষ্টির ক্ষেত্র প্রস্তত হয়। অপরদিকে যদি এ বিশ্বকে এরূপে সৃজন করা হত যে,জীবিত অস্তিত্বসমূহের সৃষ্টি ও উৎকর্ষ অসম্ভব হয়ে পড়ত,তবে তা প্রভুর প্রজ্ঞার পরিপন্থী হত।

এখন আমরা বলব : মানুষ অমর আত্মার অধিকারী এবং সে এমন অনন্ত ও চিরন্তন পূর্ণতা বা কামালতের অধিকারী হতে সক্ষম যে,তা অস্তিত্বগত মর্যাদা ও মূল্যবোধের দিক থেকে বস্তুগত পূর্ণতার সাথে অতুলনীয়। যদি মানুষের জীবন কেবলমাত্র এ পার্থিব জীবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়,তবে তা স্রষ্টার প্রজ্ঞার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে না। বিশেষকরে তা এ দৃষ্টিকোণ থেকে যে,পার্থিব জীবন অপরিসীম শ্রান্তি,দুর্ভোগ ও দুর্যোগপূর্ণ এবং অধিকাংশ সময়ই দুর্ভোগ ও দুঃখ-দুর্দশা ভোগ ব্যতীত কোন কিছুর সাধ ও আনন্দ উপভোগ করা সম্ভব হয় না;যেমনিকরে হিসাবী ব্যক্তিদেরকে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে,এ সীমাবদ্ধ সুখের বিনিময়ে এ সমস্ত কষ্ট ও ক্লেশ ভোগের মূল্যায়ন হয় না। আর এ ধরনের হিসাবের ফলেই জীবনের ব্যর্থতা ও নিরর্থকতা অনুভূত হয়। এমনকি কেউ কেউ পার্থিব জীবনের প্রতি স্বভাবজাত আকর্ষণ থাকা সত্ত্বেও আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। প্রকৃতই যদি মানুষের জীবনে অনবরত কষ্ট ও শ্রম ব্যতীত কিছুই না থাকত এবং প্রাকৃতিক ও সামাজিক সমস্যার সাথে প্রতিনিয়ত সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়,যাতে এক মুহুর্ত আনন্দ ও সম্ভোগ পেতে পারে;অতঃপর সীমাহীন শ্রান্তিতে নিদ্রায় ঢলে পড়বে,যাতে নবোদ্যমে কর্ম সম্পাদনের জন্যে শরীর প্রস্তত হতে পারে;আর এ ভাবে নিত্য নতুন কর্ম সম্পাদন করবে,যাতে এক চিলতে রুটি উপার্জন করতে পারে এবং কিঞ্চিৎকাল সে রুটির স্বাদ আসস্বাদন করতে পারে এবং অতঃপর কিছুই না ! তবে এ ধরনের ক্ষতিকর ও বিষাদময় ধারাবাহিকতাকে বুদ্ধিবৃত্তি গ্রহণ করত না বা মনোনীত করত না। এ ধরনের জীবনের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল : সেই গাড়ী চালকের মত,যে তার গাড়ীকে পেট্রোল পাম্পের নিকট পৌঁছাতে ও পেট্রোল ভর্তি করতে চেষ্টারত,অতঃপর এ পেট্রোল খরচ করে অন্য এক পেট্রোল পাম্পের নিকট পৌঁছাবে এবং এ প্রক্রিয়া ততক্ষণ পর্যন্ত চলবে যতক্ষণ পর্যন্ত না তার গাড়ীটি অক্ষম ও বিনষ্ট হবে অথবা অন্য কোন গাড়ী বা প্রতিবন্ধকের সাথে সংঘর্ষে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে !

স্পষ্টতঃই এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির যুক্তিগত ফল মানুষের জীবনের অন্তঃসার শুন্যতা বৈ কিছু নয়।

অপরদিকে মানুষের একটি সহজাত প্রবণতা হল অমর ও চিরস্থায়ী থাকার বাসনা। যা মহান প্রভুর উদারহস্ত তার প্রকৃতিতে (فطرت ) গচ্ছিত রেখেছে এবং যা সেই বর্ধিত গতিশক্তির অধিকারী,যে গতিশক্তি তাকে অনন্তের দিকে ধাবিত করে ও সর্বদা এ গতির ক্ষিপ্রতা প্রদান করে। এখন যদি মনে করা হয় যে,এ ধরনের গতির শেষফল ক্ষিপ্রতার চূড়ান্ত পর্যায়ে কোন এক প্রস্তর খণ্ডের সাথে সংঘর্ষ ঘটা ও বিধ্বস্ত হওয়া ব্যতীত কিছু নয়,তবে কি এ ধরনের বর্ধিত শক্তির অস্তিত্ব,প্রাগুক্ত ফলশ্রুতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে ?

অতএব বর্ণিত সহজাত প্রবণতা একমাত্র তখনই প্রভুর প্রজ্ঞার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হবে,যখন এ জীবন ছাড়াও মরণোত্তর অপর এক জীবন তার অপেক্ষায় থাকবে।

উপরোল্লিখিত দু টি ভূমিকার সমন্বয়ে (অর্থাৎ প্রভুর প্রজ্ঞা এবং মানুষের জন্যে অনন্ত জীবনের সম্ভাবনা ) আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে,পার্থিব এ সীমাবদ্ধ জীবনের পরে,অপর এক জীবনের অস্তিত্ব থাকা আবশ্যক,যাতে প্রভুর প্রজ্ঞার পরিপন্থী না হয়।

অনুরূপ অমরত্ব লাভের প্রবণতাকে অপর একটি ভূমিকারূপে গ্রহণ করতঃ প্রভুর প্রজ্ঞার সমন্বয়ে,একে অপর একটি দলিলরূপে বিবেচনা করা যেতে পারে।

প্রসঙ্গক্রমে এটাও সুস্পষ্ট হয়েছে যে,মানুষের অনন্ত জীবন অপর এমন এক নিয়মের অধীন হতে হবে। যেখানে পার্থিব জীবনের মত (সুখ-শান্তি) কষ্ট ও শ্রান্তি মিশ্রিত হবে না। নতুবা পার্থিব এ জীবনের পরিধি যদি অসীম পর্যন্তও বিস্তৃত হওয়া সম্ভব হয়,তবে তা প্রভুর প্রজ্ঞার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হবে না।

ন্যায়পরায়ণতাভিত্তিক দলিল :

এ পৃথিবীতে মানুষ সুকর্ম ও কুকর্ম নির্বাচন ও সম্পাদনের ক্ষেত্রে স্বাধীন : একদিকে এমন কিছু মানুষ আছে,যারা সর্বদা আল্লাহর উপাসনায় ও তার সৃষ্টির কল্যাণে নিজ জীবন উৎসর্গ করেন। অপরদিকে এমন কিছু দুস্কৃতকারী আছে,যারা তাদের শয়তানী কুপ্রবৃত্তিরর চাহিদা মিটাতে নিকৃষ্টতম ও জঘন্যতম অপরাধে লিপ্ত হয়। মূলতঃ এ বিশ্বে মানুষের সৃষ্টি,একাধিক প্রবৃত্তি ও প্রবণতায় এবং ইচ্ছাশক্তি ও নির্বাচনে তাকে সুসজ্জিতকরণ,বুদ্ধিবৃত্তিক ও উদ্ধৃতিগত জ্ঞানের আলোকে তাকে সন্নিবেশিতকরণ,তার জন্যে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্র প্রস্তুতকরণ এবং তাকে সত্য ও মিথ্যা বা কল্যাণ ও অকল্যাণের দ্বিধাবিভক্ত পথে স্থাপনের উদ্দেশ্য হল,তাকে অসংখ্য পরীক্ষার সম্মুখীন করা। আর এ ভাবে সে স্বীয় উৎকর্ষের পথকে নিজ ইচ্ছায় নির্বাচন করতঃ নিজ ইচ্ছাধীন কর্মের ফল বা পুরস্কার ও শাস্তি প্রাপ্ত হবে। প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীতে মানুষের জন্যে সর্বদাই রয়েছে পরীক্ষা এবং পৃথিবী হল তার স্বরূপের প্রস্ফুটন ও আত্মগঠনের সময়। এমনকি (এ পার্থিব) জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত সে এ পরীক্ষা ও দায়িত্ব পালন থেকে মুক্ত নয়।

কিন্তু আমরা দেখতে পাই যে,এ বিশ্বে সুকর্ম ও দুষ্কর্ম সম্পাদনকারী নিজ নিজ কর্মের পুরস্কার ও শাস্তি ভোগ করে না। বরং দুস্কৃতকারী অধিক বৈভবের অধিকারী ছিল এবং আছে। মূলতঃ পার্থিব জীবন অধিকাংশ কর্মেরই পুরস্কার বা শাস্তি লাভের অযোগ্য,যেমনঃ যে ব্যক্তি শতসহস্র মানুষকে হত্যা করেছে,তার উপর একাধিকবার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা সম্ভব নয় এবং নিঃসন্দেহে অপরসংখ্যক অত্যাচারের শাস্তি তাকে প্রদান করা সম্ভব হয়নি। অথচ প্রভুর ন্যায়পরায়ণতার১১ দাবী হল,যে কেউ ন্যূনতম পরিমাণ সুকর্ম ও কুকর্ম সম্পাদন করবে,তাকে অবশ্যই এর ফল ভোগ করতে হবে।

অতএব এ ধরিত্রী যেমন মানুষের জন্যে কর্ম ও পরীক্ষাস্থল তেমনি অপর এক জীবনেরও অস্তিত্ব থাকা আবশ্যক। যেখানে সে তার কৃতকর্মের জন্যে পুরস্কার বা শাস্তি ভোগ করবে এবং প্রত্যেকেই তার যথোপযুক্ত প্রাপ্তি লাভ করবে। আর কেবল তখনই প্রভুর ন্যায়পরায়ণতা বাস্তব রূপ লাভ করবে।

প্রসঙ্গক্রমে উপরোক্ত আলোচনার আলোকে এটাও সুস্পষ্ট হয়েছে যে,পরকাল লক্ষ্যনির্বাচন ও কর্ম সম্পাদনের স্থান নয়। পরবর্তীতে এ প্রসঙ্গে অনেক বিষয়েরই আলোচনা আসবে।

৫ম পাঠ

পবিত্র কোরানে পুনরুত্থান দিবস

ভূমিকা :

পুনরুত্থানের স্বপক্ষে এবং একে প্রত্যাখ্যানকারীদের বিরুদ্ধে প্রমাণস্বরূপ পবিত্র কোরানের উপস্থাপিত আয়াতসমূহকে পাঁচ শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। যথা :

১। ঐ সকল আয়াত যেগুলোতে উল্লেখ করা যায় যে,মাআদ বা পুনরুত্থানের অস্বীকার করণের স্বপক্ষে কোন দলিল নেই। এ আয়াতসমূহ পুনরুত্থানের বিরুদ্ধবাদীদের নিরমস্রীকরণ করে থাকে।

২। ঐ সকল আয়াত,যেগুলো পুনরুত্থানের অনুরূপ ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে থাকে,যার ফলে এর অসম্ভাব্যতার ধারণা অপনোদিত হয়।

৩। ঐ সকল আয়াত,যেগুলো পুনরুত্থানকে অস্বীকারকারীদের ভ্রান্ত ধারণাকে বর্জন করে এবং এর সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনাকে প্রতিষ্ঠা করে।

৪। ঐ সকল আয়াত,যেগুলো পুনরুত্থানকে প্রভুর এক আবশ্যকীয় ও অনিবার্য প্রতিশ্রুতিরূপে উল্লেখ করা হয়েছে এবং প্রকৃতপক্ষে পুনরুত্থানের সংঘটনকে সত্য সংবাদবাহকের সংবাদের মাধ্যমে প্রমাণ করা হয়ে থাকে।

৫। ঐ সকল আয়াত,যেগুলোতে পুনরত্থানের আবশ্যকতার স্বপক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। মূলত : প্রথম তিন শ্রেণী হল পূনরুত্থানের সম্ভাবনা সম্পর্কিত এবং অবশিষ্ট দু'শ্রেণী হল এর সংঘটনের আবশ্যকীয়তা সম্পর্কিত।


3

4

5

6

7

8

9

10

11

12