৩য় পাঠ
আত্মার বিমূর্তনতা
ভূমিক :
ইতিমধ্যেই আমরা জেনেছি যে,মাআদ বা পুনরুত্থানের বিষয়টি আত্মার সাথে সম্পর্কিত। অর্থাৎ কেবলমাত্র তখনই বলা যাবে যে,‘
মৃত্যুর পর যিনি (পুনরায়) জীবিত হয়ে থাকবেন,তিনি সেই পূর্বের ব্যক্তিই’
যখন তার আত্মা,তার দেহ বিনষ্ট হয়ে যাবার পরও অবশিষ্ট থাকবে। অন্যভাবে বলা যায় : সকল মানুষই,বস্তুগতদেহ ছাড়া ও এক অবস্তুগত সত্বার অধিকারী,যা দেহ থেকে স্বাধীন হওয়ার যোগ্যতা রাখে এবং তার মনুষ্যত্ব ও ব্যক্তিত্বও এর উপর নির্ভরশীল। নতুবা ঐ ব্যক্তির জন্যে নতুন কোন জীবনের ধারণা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না।
অতএব পুনরুত্থান ও এতদসম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়ের উপর আলোচনা করার পূর্বে এ বিষয়টিকে প্রতিপাদন করতে হবে। আর এ দৃষ্টিকোণ থেকেই এ পাঠে আমরা কেবলমাত্র এ বিষয়টির উপরই আলোকপাত করব এবং একে প্রমাণের জন্যে দু’
ধরনের যুক্তির অবতারণা করব : একটি হল বুদ্ধিবৃত্তিক এবং অপরটি হল ওহীর মাধ্যমে’
।
আত্মার বিমূর্তনতার স্বপক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলসমূহ :
প্রাচীনকাল থেকেই দার্শনিক ও চিন্তাবিদগণ রূহ (روح
) বা আত্মা (দর্শনের পরিভাষায় যাকে নাফ্স বলা হয়
)সম্পর্কে
ব্যাপক
আলোচনা
করেছেন।
বিশেষ
করে
ইসলামী
দার্শনিকগণ
এ
বিষয়ের
উপর অধিক গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন এবং তাদের দর্শন সম্পর্কিত পুস্তকসমূহের বিশেষ অংশ জুড়ে এ বিষয়টি স্থান পেলেও,
তারা এ বিষয়টির শিরোনামে পৃথক পৃথক পুস্তক-পুস্তিকাও লিখেছিলেন। আর সেই সাথে যারা রূহকে দৈহিক সংঘটনসমূহের (
Accidents
)
মধ্যে একটি সংঘটন
(Accident
) বলে মনে করেন অথবা বস্তুগত গঠন (দৈহিক উপাদানের অনুসারী) বলে গণনা করেন,তাদের বক্তব্যকে একাধিক যুক্তির মাধ্যমে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
স্পষ্টতঃই এ ধরনের বিষয়ের উপর বিস্তারিত আলোচনা করা এ পুস্তক সংশ্লিষ্ট নয়। ফলে এ বিষয়টির উপর কিছুটা আলোকপাত করেই তুষ্ট থাকব। আর চেষ্টা করব এ বিষয়ের উপর সুস্পষ্ট ও একই সাথে সুদঢ় বক্তব্য উপস্থাপন করতে। একাধিক বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলের সমন্বয়ে এ বক্তব্যটির উপস্থাপন নিম্নলিখিত ভূমিকার মাধ্যমে সূচনা করব :
আমরা আমাদের নিজ নিজ চর্মের রং ও দেহের গঠনকে সচক্ষে পর্যবেক্ষণ করি এবং বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কোমলতা ও কর্কশতাকে স্পর্শেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অনুভব করতে পারি। আমাদের দেহাভ্যন্তরস্থ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্পর্কে পরোক্ষভাবে অবহিত হতে পারি। কিন্তু ভয়-ভীতি,অনুগ্রহ ক্রোধ,ইচ্ছা ও আমাদের চিন্তাকে ইন্দ্রিয়ের সাহায্য ব্যতীতই অনুধাবন করে থাকি। অনুরূপ যে‘
আমা’
হতে এ অনুভব,অনুভূতির মত মানসিক অবস্থা প্রকাশ পায়,তাকেও কোন প্রকার ইন্দ্রিয়ের সাহায্য ব্যতিরেকেই উপলব্ধি করতে পারি।
সুতরাং মানুষ দু’
প্রকার অনুভূতির অধিকারী : এক প্রকারের অনুভূতি হল,যার জন্যে ইন্দ্রিয়ের উপর নির্ভর করতে হয় এবং অপর শ্রেণী হল,যার জন্যে ইন্দ্রিয়ের প্রয়োজন হয় না।
অপর একটি বিষয় হল : ইন্দ্রিয়ানুভূতি যে,বিভিন্ন প্রকার ভুল-ভ্রান্তিতে পতিত হয় তার আলোকে বলা যায়,প্রাগুক্ত প্রথম শ্রেণীর অনুভূতি,দ্বিতীয় শ্রেণীর অনুভূতির ব্যতিক্রমে ত্রুটি-বিচ্যুতিতে পতিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণীর অনুভূতিতে ভুল-ত্রুটি ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কোন অবকাশ থাকে না। যেমন : কেউ হয়ত সন্দেহ করতে পারে যে,তার চামড়ার রং যে রকম দেখছে ঠিক সেরকমটি কি না। কিন্তু কেউই সন্দেহ করতে পারে না যে,সে কোন চিন্তা করে কি না,সিদ্ধান্ত নিয়েছে কি না,সন্দেহ করছে কি না ।
আর এ বিষয়টিই দর্শনে এ ভাবে বর্ণিত হয় যে,স্বজ্ঞাত সতঃলব্ধ জ্ঞান(Intuitive Knowledge)
প্রত্যক্ষভাবে স্বয়ং বাস্তবতার সাথে সমন্ধ স্থাপন করে। ফলে ত্রুটি- বিচ্যুতির কোন সুযোগ থাকে না। কিন্তু অভিজ্ঞতালব্ধ বা অর্জিত জ্ঞান (Empirical Knowledge
) অনুভূতিক গঠনের (Form
) মাধ্যমে অর্জিত হয়। ফলে স্বভাবতঃই সন্দেহ ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ থাকে।
অর্থাৎ মানুষের সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য জ্ঞান হল স্বজ্ঞাত ও প্রত্যক্ষ জ্ঞান,যা নাফ্স বা আত্মার জ্ঞান,আবেগ,অনুভূতি ও অন্যান্য সকল মানসিক অবস্থাকে সমন্বিত করে । অতএব উপলব্ধি ও চিন্তার ধারক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী এ‘
আমা’
র অস্তিত্বে কখনোই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকতে পারে না -যেমনিকরে ভয়,অনুগ্রহ,ক্রোধ,চিন্তা ও ইচ্ছার অস্তিত্বে কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ থাকে না।
এখন প্রশ্ন হল : এই‘
আমা’
কি সেই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও বস্তুগত দেহ এবং মানসিক অবস্থা কি দেহ সংঘটিত;নাকি তাদের অস্তিত্ব দেহ ভিন্ন অন্য কিছু -যদিও‘
আমা’
দেহের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত এবং নিজের অনেক কর্মই দেহের মাধ্যমে সম্পাদন করে থাকে;এছাড়া দেহ কর্তৃক প্রভাবিত হয় ও দেহকে প্রভাবিত করে ?
উল্লেখিত ভূমিকাটির আলোকে এর জবাব খুব সহজেই আমরা পেতে পারি। কারণ :
প্রথমত :‘
আমা’
কে স্বজ্ঞাত জ্ঞানে উপলব্ধি করব;কিন্তু দেহকে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে চিনতে হবে। অতএব‘
আমা’
(নাফস ও রূহ) দেহ ভিন্ন অন্য বিষয়।
দ্বিতীয়ত :‘
আমা’
এমন এক অস্তিত্ব,যা যুগযুগান্তরে একত্বতার বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃত ব্যক্তিত্বসহ অবশিষ্ট থাকে এবং এ একত্বতা ও ব্যক্তিত্বকে আমরা ভুল-ত্রুটি বিবর্জিত স্বজ্ঞাত জ্ঞানের মাধ্যমে খুজে পাই। অথচ দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহ অসংখ্যবার পরিবর্তিত হয় এবং পূর্ববর্তী ও উত্তরবর্তী অংশের একত্ব ও অভিন্নতার (এটা তা-ই) জন্যে কোন প্রকার প্রকৃত ভিত্তিরই অস্তিত্ব নেই।
তৃতীয়ত :‘
আমা’
এক সরল (بسیط
) ও অবিভাজ্য অস্তিত্ব।
উদাহরণতঃ একে দু’
অর্ধ‘
আমা’
তে বিভক্ত করা সম্ভব নয়। অথচ দেহের অঙ্গসমূহ বিবিধ এবং বিভাজনোপযোগী।
চতুর্থত : কোন মানসিক অবস্থাই যেমন : অনুভূতি ইচ্ছা ইত্যাদি বস্তুগত বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ বিস্তৃতি ও বিভাজন ইত্যাদির অধিকারী নয়। আর এ ধরনের কোন অবস্তুগত বিষয়কে বস্তু (দেহ) সংঘটন বলে গণনা করা যায় না। অতএব এ সংঘটনের বিষয় (موضوع
) হল অবস্তুগত সত্তা (مجرد
)।
রূহের অস্তিত্ব ও স্বাধীনতা এবং মৃত্যুর পরও এর অবশিষ্ট থাকার স্বপক্ষে নির্ভরযোগ্য ও মনোহর যুক্তিসমূহের মধ্যে একটি হল সত্য স্বপ্নসমূহ,যার মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তি তাদের মৃত্যুর পর সঠিক সংবাদসমূহ স্বপ্নদর্শনকারীর নিকট পৌঁছিয়েছেন। অনুরূপ আত্মাসমূহকে ডেকে পাঠানো,যা চূড়ান্ত ও উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্তসমূহ সহকারে একথার স্বপক্ষেই দলিল উপস্থাপন করে। এছাড়া আল্লাহর ওলীগণের কেরামত,এমনকি যোগীদের কোন কোন কর্মের কথাও আত্মা ও এর বিমূততার প্রমাণসরূ উল্লেখ করা যেতে পারে। এ বিষয়ের উপর লিখিত পৃথক পৃথক পুস্তক রয়েছে।
কোরান থেকে দলিলাদি :
কোরানের ভাষায় মানুষের আত্মা সম্পর্কে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই যে,রূহ অসীম মর্যাদার প্রান্ত থেকে মহান আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত হয়। যেমনটি মানব সৃষ্টির প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে :
)
وَنَفَخَ فِيهِ مِن رُّوحِهِ
(
এবং তাতে রূহ ফুকে দিয়েছেন তার নিকট হতে। (সূরা সেজদা-৯)
অর্থাৎ দেহ গঠন করার পর নিজের (আল্লাহর) সাথে সম্পর্কিত রূহ তাতে প্রদান করলেন,খোদার জাত (ذات
) থেকে নয়,যার ফলে খোদা মানুষে স্থান্তরিত হবেন (মহান আল্লাহ আমাদেরকে এ ধরনের চিন্তা থেকে রক্ষা করুন)।
অনুরূপ হযরত আদমের (আ.) সৃষ্টি সম্পর্কে বলা হয়েছে :
(
وَنَفَخت فِيهِ مِن رُّوحِهِ)
এবং তাতে আমার রূহ সঞ্চার করলাম। (হিজর -২৯) এবং (সাদ-৭২)
এছাড়া অপর কিছু আয়াত থেকে আমরা দেখতে পাই যে,রূহ দেহ বা দৈহিক বৈশিষ্ট্য ও সংঘটন ব্যতীত অন্য বিষয় এবং তা দেহ ব্যতীতই অবশিষ্ট থাকার যোগ্যতা রাখে। যেমন : কাফেরদের বক্তব্য উল্লেখ করতে গিয়ে বলাহয় যে,তারা বলত :
)
إِذَا ضَلَلْنَا فِي الْأَرْضِ أَإِنَّا لَفِي خَلْقٍ جَدِيدٍ(
আমরা (মৃত্যু বরণ এবং) মৃত্তিকায় পর্যবসিত হলেও এবং আমাদের শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গ মৃত্তিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লেও কি আমাদেরকে আবার নতুন করে সৃষ্টি করা হবে? (সেজদা-১০)
মহান আল্লাহ জবাব দিলেন :
)
قُلْ يَتَوَفَّاكُم مَّلَكُ الْمَوْتِ الَّذِي وُكِّلَ بِكُمْ ثُمَّ إِلَىٰ رَبِّكُمْ تُرْجَعُونَ(
বল,(তোমরা নিখোঁজ হবে না বরং) তোমাদের জন্যে নিযুক্ত মৃত্যুর ফেরেস্তা তোমাদের প্রাণ হরণ করবে। অবশেষে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের দিকে প্রত্যাবর্তন করবে। (সোজদা-১১)
অতএব মানুষের স্বরূপের ভিত্তি মূলে রয়েছে তার আত্মা বা রূহ,যা মৃত্যুর ফেরেস্তা কর্তৃক হরণ করা ও সংরক্ষিত হয়ে থাকে;দেহের বিভিন্ন অংশ,যেগুলো বিধ্বস্ত ও মৃত্তিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে,তা নয়।
অপর এক স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে :
)
اللَّـهُ يَتَوَفَّى الْأَنفُسَ حِينَ مَوْتِهَا وَالَّتِي لَمْ تَمُتْ فِي مَنَامِهَا فَيُمْسِكُ الَّتِي قَضَىٰ عَلَيْهَا الْمَوْتَ وَيُرْسِلُ الْأُخْرَىٰ إِلَىٰ أَجَلٍ مُّسَمًّى(
আল্লাহই জীবসমূহের প্রাণ হরণ করেন তাদের মৃত্যুর সময় এবং যাদের মৃত্যু আসেনি তাদের প্রাণও নিদ্রার সময়। অতঃপর যার জন্যে মৃত্যুর সিদ্ধান্ত করেন তার প্রাণ তিনি রেখে দেন এবং অপরগুলি এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে ফিরিয়ে দেন। (সূরা যুমার -৪২)
অত্যাচারীদের মৃত্যুর প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলা হযেছে :
)
إِذِ الظَّالِمُونَ فِي غَمَرَاتِ الْمَوْتِ وَالْمَلَائِكَةُ بَاسِطُو أَيْدِيهِمْ أَخْرِجُوا أَنفُسَكُمُ(
যখন জালিমরা মৃত্যু যন্ত্রণায় থাকবে এবং ফেরেস্তাগণ হাত বাড়িয়ে বলবে,তোমাদের প্রাণ বের কর । (আনআম-৯৩)
এ আয়াতসমূহ এবং অপর আয়াতসমূহ থেকে (সংক্ষিপ্ততা বজায় রাখার জন্যে,এ গুলোর উল্লেখ থেকে বিরত থাকছি) আমরা দেখতে পাই যে,প্রত্যেকেরই ব্যক্তিত্ব ও স্বাতন্ত্র্য এমন কিছুতে বিদ্যমান যা মহান আল্লাহ ও মৃত্যুর ফেরেস্তাগণ বা রূহ কব্জাকারী ফেরেস্তাগণ হরণ করে থাকেন এবং দেহের বিনাশের ফলে মানুষের ব্যক্তিত্বের একত্বতার ও রূহের বিদ্যমানতার কোন ক্ষতি করে না।
উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রিক্ষিতে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে,প্রথমতঃ মানুষে রূহ (روح
) ও আত্মা নামক কিছু বিদ্যমান। দ্বিতীয়তঃ মানুষের আত্মা অবশিষ্ট থাকার ও দেহ থেকে স্বাধীন হওয়ার যোগ্যতা রাখে,বস্তুসংঘটন ও বস্তুগত গঠনের (صور مادّی
) মত অবস্থানের বিলুপ্তির সাথে সাথে বিনাশ হয়ে যায় না। তৃতীয়তঃ সকলের স্বরূপ ও স্বাতন্ত্রিকতা তার আত্মার উপর নির্ভরশীল। অন্যকথায় : প্রত্যেক মানুষেরই বাস্তবতা বা প্রকৃত অবস্থা হল,তার আত্মায় এবং দেহ সেখানে আত্মার অধীনে সরঞ্জামের ভূমিকা রাখে মাত্র।