আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)41%

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড) লেখক:
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ: কিয়ামত

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 33 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 13336 / ডাউনলোড: 3529
সাইজ সাইজ সাইজ
আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)

লেখক:
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বাংলা

৯ম পাঠ

মৃত্যু থেকে ক্বিয়ামত

ভূমিকা :

আমরা জানি যে,আমরা আমাদের এ ক্ষুদ্র জ্ঞানে পরকালের ঘটনা প্রবাহ এবং পরম অদৃশ্য জগৎ সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা লাভ করতে অক্ষম। তাই কেবলমাত্র বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলের ভিত্তিতে যে একশ্রেণীর সামগ্রিক ধারণা লাভ করতে পারি এবং ওহীর মাধ্যমে পরকালের বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্বসমূহের যে পরিচয় পাওয়া যায়,তাতেই তুষ্ট থাকব। তবে পরজগতের বৈশিষ্ট্যসমূহ সম্পর্কে কখনো কখনো যে সকল পরিভাষা ব্যবহার করা হয় সম্ভবতঃ তা সাদৃশ্যার্থেই ব্যবহার করা হয়। ফলে ঐ সকল পরিভাষা শ্রবণের মাধ্যমে যে ধারণা লাভ হয়ে থাকে সম্ভবতঃ তা বাস্তব দৃষ্টান্তের সাথে সম্পূর্ণরূপে না-ও মিলতে পারে। আর এটা বর্ণনার অপারগতা নয় বরং আমাদের বোধের অক্ষমতার কারণেই হয়ে থাকে। নতুবা আমাদের মস্তিষ্কের কাঠামোকে বিবেচনা করতঃ যে সকল শব্দসমষ্টি ঐ সকল বাস্তবতার প্রদর্শক হতে পারে নিঃসন্দেহে তা ঐ সকল শব্দসমষ্টিই,যা পবিত্র কোরান নির্বাচন করেছে ।

যেহেতু কোরানের বর্ণনা পরকালের সূচনালগ্নকেও সমন্বিত করে সেহেতু মানুষের মৃত্যু থেকেই আমাদের আলোচনা শুরু করব।

সকল মানুষই মৃত্যুবরণ করবে :

পবিত্র কোরান গুরুতের সাথে উপস্থপন করে যে,সকল মানুষেরই(বরং সমস্ত জীবনেরই) মৃত্যুর সাদ গ্রহণ করতে হবে এবং এ পৃথিবীতে কোন কিছুই চিরস্থায়ীভাবে থাকবে না ।

) كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ (

যা কিছুই এখানে (পৃথিবীতে) বিদ্যমান,ধবংসপ্রাপ্ত হবে। (আর রাহমান-২৬)

) كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ (

প্রত্যেকেই মৃত্যুরস্বাদ আস্বাদন করবে। ( আল্ ইমরান-১৮৫)

মহানবীকে (সা.) উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে :

) إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُم مَّيِّتُونَ (

প্রকৃতপক্ষে তুমিও মৃত্যু বরণ করবে এবং তারাও মৃত্যুবরণ করবে। (যুমার-৩০)

) وَمَا جَعَلْنَا لِبَشَرٍ‌ مِّن قَبْلِكَ الْخُلْدَ أَفَإِن مِّتَّ فَهُمُ الْخَالِدُونَ (

আমি তোমার পূর্বেও কোন মানুষকে অনন্ত জীবন দান করিনি,সুতরাং তোমার মৃত্যু হলে তারা কি চিরজীবি হয়ে থাকবে ? (আম্বিয়া -৩৪)

অতএব মৃত্যু প্রত্যেক জীবনের জন্য এক সামগ্রিক ও অব্যতিক্রমধর্মী নিয়ম।

সমস্ত আত্মার হরণকারী :

পবিত্র কোরানে একদিকে আত্মার হরণকারী হিসেবে মহান আল্লাহর কথা উল্লেখ রয়েছে। যেমন বলা হয়েছে :

) اللَّـهُ يَتَوَفَّى الْأَنفُسَ حِينَ مَوْتِهَا (

আল্লাহই প্রাণ হরণ করেন জীবসমূহের,তাদের মৃত্যুর সময়। (যুমার -৪২)

অপরদিকে মৃত্যুর ফেরেশতাকে রূহ কবজ করার জন্যে আদিষ্ট বলে পরিচয় দেয়া হয়েছে :

) قُلْ يَتَوَفَّاكُم مَّلَكُ الْمَوْتِ الَّذِي وُكِّلَ بِكُمْ (

বল,তোমাদের জন্যে নিযুক্ত মৃত্যুর ফেরেশতা তোমাদের প্রাণ হরণ করবে। (সেজদা -১১)

অপর এক স্থানে প্রাণ হরণকারী হিসেবে ফেরেশতাগণ এবং প্রভু কর্তৃক প্রেরিতগণের কথা বর্ণনা  করা হয়েছে :

) حَتَّىٰ إِذَا جَاءَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ تَوَفَّتْهُ رُ‌سُلُنَا (

অবশেষে যখন তোমাদের কারও মৃত্যুকাল উপস্থিত হয় তখন আমার প্রেরিতরা তার মৃত্যু ঘটায়। (আনয়াম-৬১)

স্পষ্টতঃই যখন কোন কর্তা,অপর কোন কর্তার মাধ্যমে কোন কার্য সম্পাদন করে,তবে ঐ কার্যের কর্তারূপে উভয়কেই উল্লেখ করা সঠিক। অনুরূপ যদি দিতীয় কর্তাও অপর কোন কর্তার মাধ্যমে কার্য সম্পাদন করে,তবে তৃতীয় কর্তাকে কার্য সম্পাদনকারী হিসেবে গণনা করা সঠিক হবে। যেহেতু মহান আল্লাহ আত্মাসমূহের হরণকর্ম মৃত্যুর ফেরেশতার (ملک الموت ) মাধ্যমে সম্পন্ন করেন এবং তিনিও যেহেতু তার অনুগ্রত ফেরেশতাদের মাধ্যমে উক্ত কর্ম সম্পাদন করেন,সেহেতু উক্ত তিনজনকেই কার্যের সম্পাদনকারী হিসেবে মনে করা সঠিক।

সহজ ও কঠোরভাবে আত্মার হরণ :

পবিত্র কোরানে উল্লেখ করা হয়েছে যে,আল্লাহর নিযুক্তগণ সকল মানুষের প্রাণ একইভাবে গ্রহণ করেন না। বরং কারও কারও ক্ষেত্রে খুব সহজ ও সম্মানের সাথে এবং কারও কারও ক্ষেত্রে কঠোর ও অপমানের সাথে প্রাণ হরণ করে থাকেন। উদাহরণতঃ মু মিনগণের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে:

) الَّذِينَ تَتَوَفَّاهُمُ الْمَلَائِكَةُ طَيِّبِينَ يَقُولُونَ سَلَامٌ عَلَيْكُمُ (

ফেরেশতাগণ যাদের মৃত্যু ঘটায় আনন্দাবস্থায় (তাদেরকে) ফেরেশতাগণ বলবে, তোমাদের প্রতি শান্তি ( ও সম্মান )! ( নাহল -৩২)৩৩

আবার কাফেরদের সম্পর্কে বলে :

) وَلَوْ تَرَ‌ىٰ إِذْ يَتَوَفَّى الَّذِينَ كَفَرُ‌وا الْمَلَائِكَةُ يَضْرِ‌بُونَ وُجُوهَهُمْ وَأَدْبَارَ‌هُمْ (

তুমি যদি দেখতে পেতে ফেরেশতাগণ কাফেরদের মুখমণ্ডলে ও পৃষ্ঠদেশে আঘাত করে তাদের প্রাণ হরণ করছে ( আনফাল -৫০)৩৪

মৃত্যুকালে তওবাহ ও বিশ্বাস স্থাপণের কোন মূল্য নেই :

যখন কাফের ও পাপিষ্ঠদের মৃত্যু উপস্থিত হয় এবং পৃথিবীতে আর বেঁচে থাকার কোন আশা থাকে না তখন পূর্বে সম্পাদিত স্বীয় কর্ম সম্পর্কে অনুতপ্ত হয় এবং বিশ্বাস স্থাপন করে ও নিজের পাপের জন্যে তওবাহ করে। কিন্তু মহান আল্লাহর নিকট এ ধরনের বিশ্বাস ও তওবার কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই। পবিত্র কোরান এ সম্পর্কে বলে :

) يَوْمَ يَأْتِي بَعْضُ آيَاتِ رَ‌بِّكَ لَا يَنفَعُ نَفْسًا إِيمَانُهَا لَمْ تَكُنْ آمَنَتْ مِن قَبْلُ أَوْ كَسَبَتْ فِي إِيمَانِهَا خَيْرً‌ا (

যে দিন তোমার প্রতিপালকের কোন নিদর্শন আসবে সে দিন তার ঈমান কাজে আসবে না,যে ব্যক্তি পূর্বে ঈমান আনেনি কিংবা যে ব্যক্তি ঈমানের মাধ্যমে কল্যাণ অর্জন করেনি। (আনআম -১৫৮)

) وَلَيْسَتِ التَّوْبَةُ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السَّيِّئَاتِ حَتَّىٰ إِذَا حَضَرَ‌ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ إِنِّي تُبْتُ الْآنَ (…

তওবাহ তাদের জন্যে নয় যারা আজীবন মন্দ কাজ করে এবং তাদের কারও মৃত্যু উপস্থিত হলে সে বলে, আমি এখন তওবাহ্ করছি,......। ( নিসা -১৮)

ফেরাউনের বক্তব্যে উল্লেখিত হয়েছে যে,যখন (নীল নদের পানিতে) নিমজ্জিত হচ্ছিল,তখন বলছিল :

) آمَنتُ أَنَّهُ لَا إِلَـٰهَ إِلَّا الَّذِي آمَنَتْ بِهِ بَنُو إِسْرَ‌ائِيلَ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِينَ (

আমি বিশ্বাস করলাম যে,বনী ইসরাঈল যাতে বিশ্বাস করে -তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই এবং আমি আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত। ( ইউনূস-৯০)

এবং তার উত্তরে বলা হয় :

) آلْآنَ وَقَدْ عَصَيْتَ قَبْلُ وَكُنتَ مِنَ الْمُفْسِدِينَ(

এখন! ইতিপূর্বে তো তুমি অমান্য করেছি এবং তুমি অশান্তি সৃষ্টিকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে। (সূরা ইউনুস-৯১)

পৃথিবীতে ফিরে আসার ইচ্ছা :

অনুরূপ পবিত্র কোরান কাফের ও দুস্কৃতিকারীদের সম্পর্কে বর্ণনা করে যে,যখন তাদের মৃত্যু উপস্থিত হয় অথবা বিধ্বংসী আযাব তাদের উপর অবর্তীণ হয়,এই ইচ্ছা পোষণ করে : হায়! যদি পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারতাম এবং বিশ্বাসী ও সৎকর্মকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারতাম! অথবা মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে যে,আমাদেরকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে দিন,যাতে আমাদের পূর্ববর্তী কর্মসমূহের ক্ষতিপূরণ করতে পারি। কিন্তু এ ধরনের আকাংখা ও প্রার্থনার কোন কার্যকারিতা নেই ।৩৫ কোন কোন আয়াতে বর্ণিত হয়েছে যে,যদি তাদেরকে (পৃথিবীতে)ফিরিয়েও দেয়া হত তবে তারা পূর্বের প্রক্রিয়াই চালিয়ে যেত।৩৬ অনুরূপ ক্বিয়ামতের দিনেও এ ধরনের ইচ্ছা ও প্রার্থনা করবে,যার জবাব প্রাথমিকভাবেই নেতিবাচক হবে।

) حَتَّىٰ إِذَا جَاءَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ رَ‌بِّ ارْ‌جِعُونِ لَعَلِّي أَعْمَلُ صَالِحًا فِيمَا تَرَ‌كْتُ كَلَّا إِنَّهَا كَلِمَةٌ هُوَ قَائِلُهَا(

যখন তাদের কারও মৃত্যু উপস্থিত হয়,তখন সে বলে,হে আমার প্রতিপালক! আমাকে পুনরায় প্রেরণ কর,যাতে আমি সৎকর্ম করতে পারি,যা আমি পূর্বে করিনি। না,তা হওয়ার নয়। এটা তো তার একটি উক্তি মাত্র। (এবং এটা এমন এক আকাংখা,যা কখনোই কার্যকরী হবে না)। (মু মিনুন ৯৯-১০০)

) أَوْ تَقُولَ حِينَ تَرَ‌ى الْعَذَابَ لَوْ أَنَّ لِي كَرَّ‌ةً فَأَكُونَ مِنَ الْمُحْسِنِينَ (

অথবা শাস্তি প্রত্যক্ষ করলে যেন কাকেও বলতে না হয়, আহা,যদি একবার পৃথিবীতে আমার প্রত্যাবর্তন ঘটত,তবে আমি সৎকর্মপরায়ণ হতাম। ( যুমার-৫৮)

) وَلَوْ تَرَ‌ىٰ إِذْ وُقِفُوا عَلَى النَّارِ‌ فَقَالُوا يَا لَيْتَنَا نُرَ‌دُّ وَلَا نُكَذِّبَ بِآيَاتِ رَ‌بِّنَا وَنَكُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ (

যখন তাদেরকে অগ্নির পার্শ্বে দাঁড় করান হবে এবং তারা বলবে হায়! যদি আমাদের প্রত্যাবর্তন ঘটত তবে আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিদর্শনকে অস্বীকার করতাম না এবং আমরা মু মিনদের অন্তর্ভুক্ত হতাম। (আনআম -২৭

) إِذِ الْمُجْرِ‌مُونَ نَاكِسُو رُ‌ءُوسِهِمْ عِندَ رَ‌بِّهِمْ رَ‌بَّنَا أَبْصَرْ‌نَا وَسَمِعْنَا فَارْ‌جِعْنَا نَعْمَلْ صَالِحًا إِنَّا مُوقِنُونَ (

যখন অপরাধীরা তাদের প্রতিপালকের সম্মুখে অধোবদন হয়ে বলবে,হে আমাদের প্রতিপালক। আমরা প্রত্যক্ষ করলাম ও শ্রবণ করলাম;এখন তুমি আমাদেরকে পুনরায় প্রেরণ কর,আমরা সৎকর্ম করব,আমরা তো দৃঢ়বিশ্বাসী। (সেজদা-১২)

উল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে সুস্পষ্টতঃই প্রতীয়মান হয় যে,পরকাল নির্বাচন ও কার্য সম্পন্ন করার স্থান নয়। এমনকি যে দৃঢ়বিশ্বাস মৃত্যুর সময় অথবা পরজগতে অর্জিত হয়,মানুষের উৎকর্ষের পথে তারও কোন গুরুত্ব নেই এবং তা তাকে পুরস্কারের যোগ্যও করে তুলে না।

এভাবেই কাফের ও পাপিষ্ঠরা পৃথিবীতে ফিরে আসার ইচ্ছা পোষণ করে,যাতে স্বেচ্ছায় বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে ও যথোপযুক্ত কার্য সম্পন্ন করতে পারে।

বারযাখ

পবিত্র কোরানের আয়াত থেকে আমরা দেখতে পাই যে,মানুষ মৃত্যুর পর কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত একটি নির্দিষ্ট সময় কবর ও বারযাখে অতিবাহিত করবে এবং কিছুটা হলেও ভোগ ও বিলাস অথবা কষ্ট ও ক্লেশের অধিকারী হবে। অনেক রেওয়াতে এসেছে যে,বিশ্বাসী পাপীরা এ সময় তাদের পাপানুপাতে কিছু কষ্ট ও ক্লেশ ভোগের মাধ্যমে পবিত্র হয়,যাতে পরজগতে দায়ভার মুক্ত হতে পারে।

যেহেতু বারযাখ সম্পর্কিত আয়াতসমূহ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের দাবী রাখে,সেহেতু ঐগুলো সম্পর্কে আলোচনা না করে কেবলমাত্র একটি আয়াতের উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হচ্ছি। পবিত্র কোরানে বলা হয়েছে :

) وَمِن وَرَ‌ائِهِم بَرْ‌زَخٌ إِلَىٰ يَوْمِ يُبْعَثُونَ (

তাদের সম্মুখে (তাদের মৃত্যুর পর) বারযাখ থাকবে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত। (মু মিনুন-১০০)

১০ম পাঠ

পবিত্র কোরানে পুনরুত্থানের চিত্র

ভূমিকা :

পবিত্র কোরান থেকে জানা যায় যে,পরজগতের অস্তিত্বলাভ শুধুমাত্র মানুষের নবজীবন লাভের সাথেই সম্পর্কিত নয়। বরং মূলতঃ এ পার্থিব জগতের সকল নিয়মের পরিবর্তন ঘটে এবং অপর এমন এক জগৎ এক নতুন নিয়ম-শৃঙ্খলা নিয়ে প্রকাশ লাভ করে,যে জগৎ আমাদের ধারণাতীত এবং স্বভাবতঃই এ জগতের বিশেষত্ব সম্পর্কে আমাদের কোন সুস্পষ্ট জ্ঞান থাকতে পারে না। তখন সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যত মানুষ ছিল সকলেই একইসাথে জীবন লাভ করে এবং স্বীয় কৃতকর্মের ফল লাভ করে। আর বৈভব বা শাস্তির অধিকারী হয়।

যেহেতু এ আলোচনা সংশ্লিষ্ট আয়াতের সংখ্যা ব্যাপক এবং এগুলোর আলোচনার জন্যে বিস্তৃত সময়ের প্রয়োজন,তাই কেবলমাত্র ঐ আয়াতগুলোর অন্তর্গত বিষয়সমূহকে সংক্ষিপ্তাকারে উল্লেখ করেই তুষ্ট থাকব।

পৃথিবী, সমূদ্র ও পর্বতসমূহের অবস্থা :

পৃথিবীতে এক মহা ভূকম্পনের সৃষ্টি হবে৩৭ এবং যা কিছু ভূঅভ্যন্তরে আছে বের করে দিবে৩৮ ,এর বিভিন্ন অংশ ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যাবে৩৯ সমূদ্রসমূহ বিভক্ত হয়ে পড়বে৪০ ,পর্বতসমূহ গতিশীল৪১ ও ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে৪২ এবং বহমান বালুকারাশিতে পরিণত হবে৪৩ ,অতঃপর ধুনকৃত তুলার রূপ ধারণ করবে৪৪ অতঃপর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে৪৫ এবং গগনচুম্বী পর্বতসমূহ মরিচীকায় রূপ নিবে।৪৬

আকাশ ও নক্ষত্রসমূহের অবস্থা :

চন্দ্র৪৭ সূর্য৪৮ বৃহদাকার নক্ষত্রসমূহ,যাদের কোন কোনটি আমাদের সূর্যের লক্ষ লক্ষগুণ বৃহৎ ও উজ্জ্বল তাদের সকলেই নির্বাপিত ও তিমিরে পরিণত হবে।৪৯ ঐগুলোর গতির শৃংখলা বিনষ্ট হবে।৫০ যেমন : চন্দ্র ও সূর্য একাকার হয়ে যাবে৫১ এবং যে আকাশ এ পৃথিবীর উপর সুরক্ষিত ও দৃঢ় ছাদ সদৃশ তা দুর্বল,প্রকম্পিত৫২ ও বিদীর্ণ হবে এবং পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে৫৩ ,কুণ্ডলাকৃতি হয়ে পরস্পর ছড়িয়ে পড়বে৫৪ আকাশের জড় উপাদানগুলো গলিত ধাতুর রূপ ধারণ করবে৫৫ এবং বিশ্বের সর্বত্র ধুম্রাচ্ছন্ন ও মেঘাচ্ছন্ন হবে ।৫৬

মৃত্যু শানাই :

আর এ ধরনের পরিস্থিতিতেই মৃত্যু শানাই বেজে উঠবে। সকল জীবিত অস্তিত্বেরই মৃত্যু ঘটবে৫৭ এবং প্রকৃতি ভুবনে আর কোন জীবনের অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যাবে না। আর ভয়-ভীতি ও অনিশ্চয়তার ছায়া সকল মানুষের উপর নেমে আসবে৫৮ কিন্তু তারা ব্যতীত,যারা বাস্তবতা ও অস্তিত্বের রহস্য সম্পর্কে অবগত এবং যাদের আত্মাগুলো প্রভুর জ্ঞান ও প্রেমের গভীরে নিমজ্জিত।

জাগরণতুর্য এবং পুনরুত্থানের সূচনা :

অতঃপর অমর এ চিরন্তনতার অধিকারী অপর এক জগৎ অস্তিত্ব লাভ করবে ,ধরিত্রীর রূপ ঐশী জ্যোতির আলোকে আলোকিত হবে৬০ ,জাগরণতুর্য উচ্চনিনাদে বেজে উঠবে ,সকল মানুষ (এমনকি সকল পশু-পাখীও) এক মুহূর্তের মধ্যে পুনর্জীবন লাভ করবে ,হতভম্ভ ও হতচকিত পঙ্গপাল ও প্রজাপতির মত দ্রুত গতিতে প্রভুর দিকে ধাবিত হবে এবং সকলেই এক মহা ময়দানে উপস্থিত হবে । এমতাবস্থায় অধিকাংশেরই দাবী থাকবে যে,বারযাখে তাদের অবস্থান হয়েছিল একঘণ্টা,একদিন অথবা কয়েকদিন।

বারতম পত্র

২২ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

কোরআনের আয়াত হতে উপস্থাপিত প্রমাণসমূহ

আলহামদুলিল্লাহ্! আপনি তাঁদের অন্তর্ভুক্ত যাঁরা কোরআনের জ্ঞানে সম্যক জ্ঞাত এবং এর বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ দিক সম্পর্কে সচেতন। রাসূলের পবিত্র বংশধরগণ সম্পর্কে কোরআনে যেরূপ স্পষ্ট আয়াতসমূহ রয়েছে অন্য কারো সম্পর্কে সেরূপ স্পষ্ট আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে কি?

কোরআনের সুস্পষ্ট আয়াতসমূহে যেরূপ তাঁদের বিষয়ে বলা হয়েছে যে,পাপ ও পঙ্কিলতা হতে তাঁরা সম্পূর্ণ পবিত্র সেরূপ অন্য কারো বিষয়ে বলা হয়েছে কি?৫০

আয়াতে তাতহীর অন্য কারো বিষয়ে অবতীর্ণ হয়েছে কি? কোরআন তাঁদের ব্যতীত অন্য কারো প্রতি ভালবাসা পোষণকে ফরয ঘোষণা করেছে কি?৫১

হযরত জিবরাঈল (আ.) মোবাহিলার আয়াতটি তাঁরা ব্যতীত অন্য কারো জন্য এনেছেন কি? অবশ্যই না,বরং তাঁদের ব্যাপারেই বলেছেন,

বলুন,এসো আমরা আমাদের সন্তানদের,নারীদের ও নিজ সত্তাদেরকে আহবান করি এবং আল্লাহকে বলি মিথ্যাবাদীদের ধ্বংস করুন। (সূরা আলে ইমরান : ৬১)

هل أتى هل أتى بِمدح سواهم لا و مولى بذكرهم حلّاها

সূরা হাল আতা (সূরা দাহর) তাঁদের ব্যতীত অন্য কারো প্রশংসায় অবতীর্ণ হয় নি,বরং শুধু তাঁদের লক্ষ্য করেই অবতীর্ণ হয়েছে।

আহলে বাইত কি আল্লাহর রজ্জু নন যেখানে কোরআনে বলা হয়েছে-

) و اعتصموا بحبل الله جميعا ولا تفرّقوا(

তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না৫২

তাঁরা কি কোরআনে বর্ণিত সত্যপন্থী নন যেখানে আল্লাহ্ বলছেন,

 ( وكونوا مع الصادقين ) এবং সত্যপন্থীদের সঙ্গে থাক। (সূরা তওবা : ১১৯)

সত্যপন্থী বলতে আমাদের সূত্রে বর্ণিত হাদীসানুসারে নবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইত। ইবনে হাজার তাঁর আসসাওয়ায়েক গ্রন্থের ১১ অধ্যায়ে ৯০ পৃষ্ঠায় ৫ নং আয়াতের তাফসীরে ইমাম সাজ্জাদ (আ.) হতে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন যা আমি ৬ষ্ঠ পত্রে উল্লেখ করেছিলাম।

আল্লাহ্ কি তাঁদেরকে সিরাতুল্লাহ্ বলে উল্লেখ করেন নি-

) و إنّ هذا صراطي مستقيما فاتبعوه(

নিশ্চয়ই এটি আমার সরল সঠিক পথ, এ পথের অনুসরণ কর। (সূরা আনআম : ১৫৩)

অন্যরা আল্লাহর পথ নন। তাই বলেছেন,

) ولا تتبعوا السبل فتفرق بكم عن سبيله(

বিচ্ছিন্নতা ও বক্রতার পথসমূহ অবলম্বন কর না, তাহলে আল্লাহর পথ হতে দূরে সরে যাবে ৫৩

এবং কোরআনে বর্ণিত উলিল আমর কি তাঁরাই নন যেখানে বলা হয়েছে-

) يا ايها الذين آمنوا اطيعوا الله و اطيعوا الرسول و اولي الامر منكم(

হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূল ও তোমাদের মধ্যকার দায়িত্বশীলদের (উলিল আমরের) আনুগত্য কর   ৫৪

তাঁরাই কি কোরআনে বর্ণিত আহলুয যিকর নন-

) فسئلوا اهل الذكر ان كنتم لا تعلمون(

যদি তোমরা না জান তাহলে যারা জানে তাদেরকে জিজ্ঞেস কর। ৫৫

সূরা নিসার ১১৫ নং আয়াতে যে মুমিনদের বিবরণ দেয়া হয়েছে তাঁরাই কি সেই মুমিনীন নন? বলা হয়েছে- যে কেউ সত্য প্রকাশিত হবার পর নবীর বিরুদ্ধাচারণ করবে ও মুমিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ গ্রহণ করবে আমরা তাদেরকে সেই পথেই পরিচালিত করবো এবং অবশেষে জাহান্নামে প্রবেশ করাবো। ৫৬

তাঁরাই কি সেই ব্যক্তিবর্গ নন যারা আল্লাহর দিকে মানুষদের হেদায়েত করেন। যেমন সূরা রাদের ৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

) انما انت منذر و لكل قوم هاد(

নিশ্চয়ই আপনি কেবল ভয় প্রদর্শনকারী এবং প্রত্যেক জাতি ও গোত্রের জন্যই হেদায়েতকারী রয়েছে। ৫৭

এরাই কি সেই ব্যক্তিবর্গ নন যাঁদেরকে মহান আল্লাহ্ নিয়ামত দান করেছেন?

সূরা ফাতিহা যার অপর নাম হলো সাবয়ুল মাছানী এবং কোরআনে সেই সূরাতে আমাদের সরল সঠিক পথে ও যাদের প্রতি আপনি নিয়ামত দান করেছেন তাদের পথে পরিচালিত করুন বলতে কাদের পথকে বুঝানো হয়েছে?৫৮

সূরা নিসার ৬৯ নং আয়াতে মহান আল্লাহ্ বলেছেন,

যে কেউ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে,সে কিয়ামতের দিন তাঁদের সঙ্গে থাকবে যাঁদের ওপর আল্লাহ্ তাঁর নিয়ামতকে সম্পূর্ণ করেছেন,(তাঁরা হলেন) নবী,সিদ্দীক,শহীদ ও সৎ কর্মশীল বান্দাগণ।

নিঃসন্দেহে আহলে বাইতের ইমামগণ সিদ্দীক,শহীদ ও সালেহীনদের অন্তর্ভুক্ত। তবে কি আল্লাহ্ সর্বসাধারণের সার্বিক নেতা হিসেবে তাঁদেরকেই মনোনীত করেন নি? নবীর পরবর্তীতে মুসলমানদের নেতৃত্ব দানের ও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব শুধু তাঁদের জন্যই নির্ধারিত করেন নি?

যদি বিষয়টি না জানেন তবে দেখুন-

নিশ্চয়ই তোমাদের ওয়ালী (অভিভাবক) হলেন শুধু আল্লাহ্,তাঁর রাসূল এবং যারা ঈমান আনে,নামায কায়েম করে এবং রুকুরত অবস্থায় যাকাত দেয়। যারা আল্লাহ্,তাঁর রাসূল ও ঈমানদারদের অভিভাবকত্বকে মেনে নেয় তারাই জয়ী হবে,কারণ আল্লাহর দলই বিজয়ী হবে।৫৯  

মহান আল্লাহ্ ক্ষমা ও মাগফেরাতের শর্ত হিসেবে তওবা,ঈমান আনা,সৎ কর্ম করা ও আহলে বাইতের ইমামদের নেতৃত্বকে মেনে নেয়ার বিষয়টিকে উল্লেখ করেছেন যেমনটি সূরা ত্বহার ৮২ নং আয়াতে এসেছে-

আমি আমার ক্ষমাকে তওবার মাধ্যমে প্রত্যাবর্তন,ঈমান আনয়ন,সৎ কর্ম সম্পাদন এবং হেদায়েত প্রাপ্তির৬০ মধ্যেই রেখেছি (অর্থাৎ তারাই ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে যারা তওবা করেছে,ঈমান আনয়ন করেছে,সৎ কর্ম সম্পাদন করেছে এবং হেদায়েতপ্রাপ্ত হয়েছে)।

তাহলে তাঁদের বেলায়েত কি একটি আমানত নয় যা সূরা আহযাবের ৭২ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

আমরা আমানতকে আসমান,যমীন ও পর্বতের নিকট পেশ করেছিলাম কিন্তু তারা তা গ্রহণে অক্ষমতা প্রকাশ করেছিল এবং তারা বোঝা বহনের ভয় করছিল কিন্তু মানুষ তা গ্রহণ করেছিল। কারণ মানুষ (নিজের প্রতি) অত্যাচারী এবং অজ্ঞ।৬১  

তাঁদের (আহলে বাইতের) বেলায়েত ও অভিভাবকত্বকেই আল্লাহ্ কোরআনেسِلْمٌ (সিল্ম) বলে উল্লেখ করেছেন এবং সেখানে প্রবেশের জন্য সকলকে নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন, হে ঈমানদারগণ,সকলেই সমবেতভাবে সিল্ম বা শান্তি ও মুক্তির মধ্যে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। ৬২

তাঁদের বেলায়েত বা অভিভাবকত্বকেই কি মহান আল্লাহ্ কোরআনেنعيم (নাঈম) বলে উল্লেখ করেন নি যে বিষয়ে কিয়ামতের দিন প্রশ্ন করা হবে( ثم لتسئلن يومئذ عن النعيم )৬৩

রাসূল (সা.) কি তাঁদের বেলায়েতকে ঘোষণার জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন নি? এবং এ বিষয়ে রাসূলকে প্রদত্ত নির্দেশ অনেকটা রাসূলকে ভীতি প্রদর্শনের মত ছিল,নয় কি? যেখানে আল্লাহ্ বলেছেন,

হে রাসূল!যা আপনার প্রতিপালকের পক্ষ হতে আপনার ওপর অবতীর্ণ হয়েছে তা পূর্ণাঙ্গরূপে পৌঁছান। যদি তা না করেন আপনি আপনার রেসালতের দায়িত্বই পালন করেন নি এবং আল্লাহ্ আপনাকে মানুষ হতে (সম্ভাব্য বিপদ হতে) রক্ষা করবেন। ৬৪

রাসূল (সা.) গাদীর দিবসে এ বাণী প্রচারের জন্য কি ব্যাপক পদক্ষেপ নেন নি? পরিষ্কার ভাষায় পূর্ণাঙ্গরূপে বিষয়টিকে উপস্থাপন করেন নি? মহান আল্লাহ্ তখনই সূরা মায়েদার এ আয়াত নাযিল করেন- আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামতকে সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের মনোনীত দীন হিসেবে গ্রহণ করলাম। ৬৫

তাহলে কি আপনি জানেন না মহান আল্লাহ্ ঐ ব্যক্তি যে তাঁদের (আহলে বাইতের) বেলায়েত ও নেতৃত্বকে সরাসরি অস্বীকার করেছিল এবং নবীর সঙ্গে এ বিষয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিল তার সঙ্গে কিরূপ আচরণ করেছেন? ঐ ব্যক্তি চিৎকার করে বলেছিল, হে আল্লাহ্! যদি এটি সত্য ও আপনার পক্ষ হতে হয়ে থাকে,তবে আসমান হতে আমার ওপর পাথর বর্ষণ করুন এবং আজাব নাযিল করুন। আল্লাহ্পাক ঐ ব্যক্তিকে হস্তীবাহিনীর ন্যায় ধ্বংস করেন। তখনই এক ব্যক্তি চাইল সেই আজাব সংঘটিত হোক যা অবধারিত কাফিরদের জন্য এবং যার প্রতিরোধকারী কেউ নেই এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।৬৬ (*১৪)

অতিশীঘ্রই পুনরুত্থান দিবসে আহলে বাইতের বেলায়েত ও নেতৃত্বের বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে যেমনটি সূরা সাফ্ফাতের ২৪ নং আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছে( وقفوهم إنّهم مسئولون )’ এবং তাদেরকে থামাও,তারা জিজ্ঞাসিত হবে।৬৭ এটি আশ্চর্যের বিষয় নয় কারণ তাঁদের নেতৃত্ব ও বেলায়েত এমন একটি বিষয় যা ঘোষণার জন্য সকল নবীর আগমন ঘটেছে এবং তাঁরা বিশ্বে আল্লাহর সর্বোত্তম নিদর্শন। নবীদের স্থলাভিষিক্ত ওলী ও ঐশী প্রতিনিধিগণ মানুষের কাছে এ সত্যটি প্রকাশ করে গিয়েছেন,যেমন সূরা যুখরুফের ৪৫ নং আয়াতে এসেছে-

) وأسأل من أرسلنا من قبلك من رسلنا(

তোমার পূর্বে আমাদের রাসূলদের মধ্য থেকে যাদের প্রেরণ করেছিলাম তাদের নিকট এ বিষয়ে প্রশ্ন কর।৬৮

আহলে বাইত সম্পর্কে এ প্রতিশ্রুতি আল্লাহ্পাক আমি কি তোমাদের প্রভু নই -এর প্রতিশ্রুতি থেকেই গ্রহণ করেছেন যা সূরা আ রাফের ১৭২ নং আয়াতের তাফসীরে বর্ণিত হয়েছে।(*১৫) আয়াতটি হলো : আল্লাহ্ বনি আদম হতে তার জন্মের পূর্বে এ প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন (তার পৃষ্ঠদেশ হতে তাদের বের করে তাদের নিজেদের ওপর সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন) যে,আমি কি তোমাদের প্রভু নই? তারা বলল,হ্যাঁ। এ বিষয় আহলে সুন্নাহর হাদীসসমূহেও উল্লিখিত হয়েছে।

এবং আদম তাঁর স্রষ্টা হতে কয়েকটি বাক্য প্রাপ্ত হলেন,তার মাধ্যমে ক্ষমা চাইলেন এবং আল্লাহ্ তাঁর তওবাকে গ্রহণ করলেন। ৬৯

তাঁদের সম্পর্কে আল্লাহ্পাক বলেছেন, আল্লাহ্ তাদের (এ উম্মতকে) আজাব দান করবেন না যখন তুমি তাদের মধ্যে বর্তমান। ৭০

পৃথিবীর অধিবাসীদের জন্য তাঁরা নিরাপত্তাস্থল এবং আল্লাহর শাস্তি হতে বাঁচার মাধ্যম। তাঁরাই যে তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বের কারণে অন্যদের হিংসার পাত্র তা সূরা নিসার ৫৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে, মানুষকে (নবী ও তার পরিবারবর্গকে) আল্লাহ্ তাঁর নিয়ামত হতে যা দান করেছেন তারা তার প্রতি হিংসা করে। ৭১

তাঁদের বিষয়েই আল্লাহ্ বলেছেন, জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিবর্গ বলে : আমরা ঈমান এনেছি। ৭২

আমাদের জানা উচিত আ রাফের ব্যক্তিবর্গ তাঁরাই। এজন্য আল্লাহ্পাক বলেছেন, এবং আ রাফে একদল ব্যক্তি রয়েছেন যাদের চেহারা দেখে সবাই চিনবে। ৭৩

তাঁরাই আল্লাহ্ বর্ণিত সত্যবাদী ও প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী ব্যক্তিবর্গ। কোরআন বলেছে, মুমিনদের মধ্যে একদল লোক রয়েছে তারা আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পালন করেছে,তাদের একদল দায়িত্ব সম্পন্ন করেছে (শহীদ হয়েছে) এবং অপর দল অপেক্ষমান রয়েছে (তাদের সাথে মিলিত হবার),তারা তাদের সংকল্প কখনোই পরিবর্তন করে নি। ৭৪

তাঁদেরকেই আল্লাহ্ তাঁর গুণকীর্তনকারী বলে বর্ণনা করেছেন- আল্লাহ্ যে সকল গৃহকে মর্যাদায় উন্নীত করার এবং সেগুলোতে তাঁর নাম উচ্চারণ করার আদেশ দিয়েছেন,সেখানে (একদল লোক) সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। এমন লোকেরা,যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে,নামায কায়েম ও যাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখতে পারে না। তারা ভয় করে সেই দিনকে যেদিন অন্তর ও দৃষ্টিসমূহ উল্টে যাবে। ৭৫

তাদের ঘরসমূহ হলো সেই ঘরসমূহ যার সম্পর্কে আল্লাহ্পাক বলেছেন, আল্লাহ্ যেসব গৃহকে মর্যাদায় উন্নীত করার এবং যেগুলোতে তাঁর নাম উচ্চারণ করার আদেশ দিয়েছেন। ৭৬

তাঁদের সম্পর্কেই মহান আল্লাহ্ সূরা নূরের ৩৫ আয়াতে বলেছেন, তাদের উদাহরণ হলো কুলঙ্গি এবং তাদের অস্তিত্ব আমারই নূরের অস্তিত্ব।৭৭ অথচ আল্লাহর জন্য আসমান ও জমীনে সর্বোত্তম উদাহরণ বিদ্যমান এবং তিনি ক্ষমতাশালী ও প্রজ্ঞাবান।

তাঁরা আল্লাহ্ বর্ণিত অগ্রবর্তী নৈকট্যপ্রাপ্ত দল যেমনটি এ আয়াতে বলা হয়েছে-

( السّابقون السّابقون أولَائك المقرّبون)

অর্থাৎ অগ্রবর্তীগণ তো অগ্রবর্তীই,তারাই নৈকট্যশীল।৭৮

এবং সত্যবাদী,শহীদ,সাক্ষ্য প্রদানকারী এবং সৎ কর্মশীল বলতে তাঁদেরই বোঝানো হয়েছে।৭৯

আহলে বাইত এবং তাঁদের ইমামগণ সম্পর্কেই আল্লাহ্পাক বলেছেন,

( وممن خلقنا أمة يهدون بالْحقّ و به يعدلون)

আর যাদেরকে আমি সৃষ্টি করেছি তাদের মধ্যে একদল রয়েছে যারা সত্যের দিকে মানুষকে হেদায়েত করে (পথ দেখায়) এবং সে অনুযায়ী ন্যায়বিচার করে। ৮০

আহলে বাইতের অনুসারী এবং বিরোধী ও শত্রুদের সম্পর্কেই এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে-

( لا يستوي أصحاب النّار و أصحاب الْجَنَّة أصحاب الْجَنَّة هم الفائزون)

জাহান্নামের অধিবাসী এবং জান্নাতের অধিবাসীগণ সমান হতে পারে না। জান্নাতের অধিবাসীরাই সফলকাম।৮১

তাঁদের পক্ষের ও বিপক্ষের দল সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেছেন,

( أم نجعل الّذين آمنوا و عملوا الصّالِحات كالمفسدين في الأرض أم نجعل المتّقين كالفجّار)

আমি কি বিশ্বাসী ও সৎ কর্মশীলদেরকে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কাফেরদের সমতুল্য করে দেব,না খোদাভীরুদেরকে পাপাচারীদের সমান করে দেব? ৮২  

এই দু দল সম্পর্কে অন্যত্র বলেছেন,

( أم حسب الّذين اجترحوا السيّئات أن نجعلهم كالذين آمنوا و عملوا الصّالِحات سواء محياهم و مَماتُهم ساء ما يحكمون)

যারা দুষ্কর্ম উপার্জন করেছে তারা কি মনে করে আমি তাদেরকে সে লোকদের মত করে দেব যারা ঈমান আনে ও সৎ কর্ম করে ও তাদের জীবন ও মৃত্যু কি সমান হবে? ৮৩

আহলে বাইত ও তাঁদের অনুসারীদের সম্পর্কেই কোরআনে বলা হয়েছে-

( إنّ الّذين آمنوا و عملوا الصّالِحات أولَائك هم خيرُ البريّة)

যারা ঈমান এনেছে ও সৎ কর্ম করেছে তারাই শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি।৮৪

আহলে বাইত ও তাঁদের শত্রুদের সম্পর্কে কোরআনে বলা হয়েছে-

এই দু বাদী-বিবাদী,তারা তাদের পালনকর্তা সম্পর্কে বিতর্ক করে। অতএব,যারা কাফির তাদের জন্য আগুনের পোষাক তৈরী করা হয়েছে। তাদের মাথার ওপর ফুটন্ত পানি ঢেলে দেয়া হবে।৮৫

এবং আহলে বাইত ও তাঁদের শত্রুদের সম্পর্কেই এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে- মুমিন কি কখনো ফাসেকের মত হতে পারে? তারা সমান নয়। কিন্তু যারা ঈমান এনেছে ও সৎ কর্ম করেছে তাদের বাসস্থান হলো চিরস্থায়ী জান্নাত তাদের সৎ কর্মের বিনিময়স্বরূপ আর যারা গুনাহ করেছে তারা তাদের বাসস্থানকে জাহান্নামের মধ্যে প্রস্তুত করেছে। যখনই তারা চাইবে তা হতে বের হতে,তাদেরকে জোরপূর্বক ফিরিয়ে দেয়া হবে ও বলা হবে,যে জাহান্নামকে অস্বীকার করতে তার স্বাদ আস্বাদন কর।৮৬

অন্যত্র ঐ সকল ব্যক্তিবর্গ যারা হাজীদের পানি পান করানো ও কাবা শরীফের খাদেম হওয়ার কারণে অহংকার ও গর্ব পোষণ করতো তাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, তোমরা কি হাজীদের পানি সরবরাহ ও মসজিদুল হারাম আবাদকরণকে সেই লোকের সমান মনে কর যে ঈমান রাখে আল্লাহ্ ও শেষ দিনের প্রতি এবং যুদ্ধ করে আল্লাহর পথে? এরা আল্লাহর দৃষ্টিতে সমান নয়,আর আল্লাহ্ জালেম লোকদের হেদায়েত করেন না। ৮৭

তেমনিভাবে আল্লাহ্পাক আহলে বাইতের বিভিন্ন কঠিন পরীক্ষায় সফলতার কথা কোরআনে বর্ণনা করেছেন-

( و من النّاس من يشري نفسه ابتغاء مرضات الله و الله رءوف بالعباد)

এবং মানুষের মধ্যে একদল লোক আছে যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির বিনিময়ে নিজেদের জীবনকে বিক্রয় করে এবং আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু।৮৮

অন্যত্র বলেছেন, আল্লাহ্ মুমিনদের জীবন ও সম্পদকে বেহেশতের বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়েছেন। তারা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে,হত্যা করে ও নিহত হয়। এ প্রতিশ্রুতি সত্য ও অবশ্যম্ভাবী যা তাওরাত,ইঞ্জিল ও কোরআনে এসেছে- এবং আল্লাহ্ হতে কে অধিক ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী?

সুতরাং তোমরা আনন্দিত হও সে লেনদেনের ওপর যা তোমরা আল্লাহর সঙ্গে করেছ। তারা (এ মুমিনগণ) তওবাকারী,ইবাদতকারী,কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী,দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদকারী,রুকু ও সিজদাকারী,সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধকারী,আল্লাহর দেয়া সীমাসমূহের হেফাজতকারী। (সূরা তওবা : ১১১ ও ১১২)

যারা স্বীয় ধনসম্পদ ব্যয় করে (দান করে) রাত্রে ও দিনে,গোপনে ও প্রকাশ্যে। তাদের জন্য তাদের সওয়াব তাদের পালনকর্তার নিকট সংরক্ষিত। তাদের কোন আশঙ্কা নেই এবং তারা

চিন্তিতও হবে না। (বাকারা : ২৭৪)৮৯

তাঁরাই সত্যকে সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দিয়েছেন। আল্লাহ্ তার সাক্ষ্য প্রদান করে বলেছেন, যারা সত্য নিয়ে আগমন করেছে ও সত্যকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে,তারাই তো খোদাভীরু ও মুত্তাকী (পরহেজগার)।৯০

সুতরাং তাঁরাই রাসূল (সা.)-এর গোত্রের সর্বোচ্চ নিষ্ঠাবান এবং তাঁর সবচেয়ে নিকটাত্মীয় যাঁদের মহান আল্লাহ্ তাঁর বিশেষ অনুগ্রহের অন্তর্ভুক্ত করে বলেছেন,

( و أنذر عشيرتك الأقربين )“ এবং তোমার নিকটাত্মীয়দের ভীতি প্রদর্শন কর। এবং তাঁরাই কোরআনে বর্ণিত উলুল আরহাম বা নিকটাত্মীয় যেমনটি বলা হয়েছে সূরা আনফালের ৭৫ নং আয়াতে( أولوا الأرحام بعضهم أولى ببعض ) অর্থাৎ বস্তুত যারা নিকটাত্মীয় তারা পরস্পর অধিক হক্বদার এবং এদের সম্পর্কেই কোরআনে বলা হয়েছে তাঁদের মর্যাদা কিয়ামতের দিন বাড়িয়ে দেয়া হবে এবং নবীর সঙ্গে মিলিত হয়ে জান্নাতুন নাঈমে অবস্থান করবেন। এর প্রমাণ কোরআনের এ আয়াত যাতে বলা হয়েছে-

যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের পরিবার ও বংশের যারা তাদের (ঈমানের ক্ষেত্রে) অনুসরণ করেছে সেই বংশধরদেরও আমি তাদের সাথে মিলিত করে দেব এবং তাদের আমল হতে কিছুই কম করা হবে না। ৯১

তাঁরাই সেই ব্যক্তিবর্গ যাঁদের অধিকারকে আল্লাহ্ আদায় করতে বলেছেন-

وآت ذا القربىحقّه অর্থাৎ নিকটাত্মীয়দের অধিকার আদায় কর। তাঁরাই খুমসের অধিকারী যা আদায় না করলে তাঁদের হক্ব আমাদের ওপর কিয়ামতের দিনও থেকে যাবে- জেনে রাখো,তোমরা যা কিছু অর্জন কর,তার এক পঞ্চমাংশ আল্লাহ্,তাঁর রাসূল এবং তাঁর নিকটাত্মীয়,ইয়াতীম,অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরদের.। (সূরা আনফাল : ৪১)

তাঁরা ফাই সম্পদেরও অধিকারী কারণ আল্লাহ্ বলেছেন, যা মহান আল্লাহ্ জনপদবাসীদের কাছ থেকে রাসূলকে দিয়েছেন তা আল্লাহর,রাসূলের,তাঁর আত্মীয়-স্বজনের,ইয়াতিমদের,অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরদের। (সূরা হাশর : ৭)

নবীর আহলে বাইতকে সম্বোধন করে আল্লাহ্ বলেছেন,

( إنّما يريد الله ليذهب عنكم الرّجس أهل البيت و يطهّركم تطهيرا)

হে আহলে বাইত! নিশ্চয়ই আল্লাহ্ চান তোমাদের হতে পাপ পঙ্কিলতা দূরীভূত করতে ও সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে। (সূরা আহযাব : ৩৩)

তাঁদেরকেই আল্লাহ্ আলে ইয়াসিন বলে সম্বোধন করে সালাম দিয়েছেন-و سلام على الياسين অর্থাৎ আলে ইয়াসিনের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।৯২ (সূরা সাফ্ফাত : ১৩০)

তাঁরাই রাসূলের বংশধর যাঁদের ওপর দরূদ পড়াকে আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের জন্য নামাযে ওয়াজিব করেছেন-

﴿ إنّ الله و ملائكته يصلّون على النَّبِيّ يا أيّها الّذين آمنوا صلّوا عليه و سلّموا تسليما

নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর ওপর দরূদ পড়েন,হে ঈমানদারগণ! তোমরাও রাসূলের ওপর দরুদ পাঠ কর।৯৩

সাহাবীরা প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনার ওপর সালাম কিরূপে পাঠ করতে হবে জানি কিন্তু দরূদ কিরূপে পড়ব? রাসূল (সা.) বললেন, আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিও ওয়া আলা আলে মুহাম্মাদ অর্থাৎ হে আল্লাহ্! মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর বংশধরদের ওপর রহমত বর্ষণ কর।

এ হাদীস হতে বুঝা যায় আহলে বাইতের ওপর দরূদ পাঠও এই আয়াতের নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত। এ কারণেই আলেমগণ এই আয়াতকে আহলে বাইতের শানে বর্ণিত আয়াতের অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং ইবনে হাজার আসকালানী তাঁর আসসাওয়ায়েক গ্রন্থের ১১ অধ্যায়েও তাই করেছেন।৯৪

طوبى لهم তাদের জন্যই সুসংবাদ ও তাদের জন্যই চিরস্থায়ী বেহেশত এবং তার দ্বারগুলো উন্মুক্ত রয়েছে।৯৫

আরব কবি বলেছেন,

من يباريهم و في الشّمس معنى؟ مجهد متعب لمن باراها

কে পারে তাঁদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে অর্থাৎ সূর্যের সাথে যে প্রতিযোগিতা করে তার ওপরই ক্লান্ত ও শ্রান্তের অর্থ বর্তায় (অর্থাৎ সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে)।

আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে তাঁরা মনোনীত,আল্লাহর অনুমতিক্রমে পুণ্যকর্মে তাঁরা অন্যদের হতে অগ্রগামী। তাঁরা আল্লাহর কিতাবের উত্তরাধিকারী এবং তাঁদের সম্পর্কেই আল্লাহ্ বলেছেন,

অতঃপর কিতাবকে (আল কোরআন) তাঁর বান্দাদের মধ্যে মনোনীত ব্যক্তিদের হাতে সমর্পণ করলাম। আর বান্দাদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের ওপর জুলুম করেছে এবং তারা ইমামদের নেতৃত্বকে মেনে নেয় নি।

তাদের (বান্দাগণের) অনেকেই মধ্যপন্থী ও ন্যায়পরায়ণ এবং তারা আহলে বাইতের প্রতি ভালবাসা পোষণকারী। যেমন কোরআনে এসেছে-

এবং তাদের অনেকেই পুণ্যকর্মে অগ্রগামী হয়েছে এবং তারাই ইমাম। এটি একটি বড় নিয়ামত।৯৬

আহলে বাইতের ফজীলত বর্ণনা করে যে সকল আয়াত এসেছে তা বর্ণনার জন্য এ পর্যন্তই যথেষ্ট বলে মনে করেছি। তবে আপনার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি হযরত আলী (আ.)-এর শানে কোরআনে ৩০০ আয়াত বর্ণিত হয়েছে।৯৭

অন্য আরেকজন তাফসীরকারক বলেছেন, কোরআনের এক চতুর্থাংশ আয়াত আহলে বাইতের শানে বর্ণিত হয়েছে এবং এটি আশ্চর্যের কোন বিষয় নয়,কারণ আহলে বাইত ও কোরআন একই সত্তার দুই অংশ।

এখন পর্যন্ত যে সমস্ত স্পষ্ট আয়াত আপনার নিকট বর্ণনা করলাম তা কোরআনের মূল ও ভিত্তি( هُنَّ أُمُّ الْكِتَاب ) । এ আয়াতগুলো খুব সহজে গ্রহণ করুন (মেনে নিন)। আর ভক্তি ও উদারতার সাথে সূক্ষ্মভাবে এসব আয়াত অধ্যয়ন করুন এবং এসব আয়াত সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাবান মহান আল্লাহর বাণী হতে গ্রহণ করুন যে সম্পর্কে অন্য কোন জ্ঞানী ব্যক্তি আপনাকে অবগত করবে না।

ওয়াসসালাম

বারতম পত্র

২২ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

কোরআনের আয়াত হতে উপস্থাপিত প্রমাণসমূহ

আলহামদুলিল্লাহ্! আপনি তাঁদের অন্তর্ভুক্ত যাঁরা কোরআনের জ্ঞানে সম্যক জ্ঞাত এবং এর বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ দিক সম্পর্কে সচেতন। রাসূলের পবিত্র বংশধরগণ সম্পর্কে কোরআনে যেরূপ স্পষ্ট আয়াতসমূহ রয়েছে অন্য কারো সম্পর্কে সেরূপ স্পষ্ট আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে কি?

কোরআনের সুস্পষ্ট আয়াতসমূহে যেরূপ তাঁদের বিষয়ে বলা হয়েছে যে,পাপ ও পঙ্কিলতা হতে তাঁরা সম্পূর্ণ পবিত্র সেরূপ অন্য কারো বিষয়ে বলা হয়েছে কি?৫০

আয়াতে তাতহীর অন্য কারো বিষয়ে অবতীর্ণ হয়েছে কি? কোরআন তাঁদের ব্যতীত অন্য কারো প্রতি ভালবাসা পোষণকে ফরয ঘোষণা করেছে কি?৫১

হযরত জিবরাঈল (আ.) মোবাহিলার আয়াতটি তাঁরা ব্যতীত অন্য কারো জন্য এনেছেন কি? অবশ্যই না,বরং তাঁদের ব্যাপারেই বলেছেন,

বলুন,এসো আমরা আমাদের সন্তানদের,নারীদের ও নিজ সত্তাদেরকে আহবান করি এবং আল্লাহকে বলি মিথ্যাবাদীদের ধ্বংস করুন। (সূরা আলে ইমরান : ৬১)

هل أتى هل أتى بِمدح سواهم لا و مولى بذكرهم حلّاها

সূরা হাল আতা (সূরা দাহর) তাঁদের ব্যতীত অন্য কারো প্রশংসায় অবতীর্ণ হয় নি,বরং শুধু তাঁদের লক্ষ্য করেই অবতীর্ণ হয়েছে।

আহলে বাইত কি আল্লাহর রজ্জু নন যেখানে কোরআনে বলা হয়েছে-

) و اعتصموا بحبل الله جميعا ولا تفرّقوا(

তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না৫২

তাঁরা কি কোরআনে বর্ণিত সত্যপন্থী নন যেখানে আল্লাহ্ বলছেন,

 ( وكونوا مع الصادقين ) এবং সত্যপন্থীদের সঙ্গে থাক। (সূরা তওবা : ১১৯)

সত্যপন্থী বলতে আমাদের সূত্রে বর্ণিত হাদীসানুসারে নবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইত। ইবনে হাজার তাঁর আসসাওয়ায়েক গ্রন্থের ১১ অধ্যায়ে ৯০ পৃষ্ঠায় ৫ নং আয়াতের তাফসীরে ইমাম সাজ্জাদ (আ.) হতে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন যা আমি ৬ষ্ঠ পত্রে উল্লেখ করেছিলাম।

আল্লাহ্ কি তাঁদেরকে সিরাতুল্লাহ্ বলে উল্লেখ করেন নি-

) و إنّ هذا صراطي مستقيما فاتبعوه(

নিশ্চয়ই এটি আমার সরল সঠিক পথ, এ পথের অনুসরণ কর। (সূরা আনআম : ১৫৩)

অন্যরা আল্লাহর পথ নন। তাই বলেছেন,

) ولا تتبعوا السبل فتفرق بكم عن سبيله(

বিচ্ছিন্নতা ও বক্রতার পথসমূহ অবলম্বন কর না, তাহলে আল্লাহর পথ হতে দূরে সরে যাবে ৫৩

এবং কোরআনে বর্ণিত উলিল আমর কি তাঁরাই নন যেখানে বলা হয়েছে-

) يا ايها الذين آمنوا اطيعوا الله و اطيعوا الرسول و اولي الامر منكم(

হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূল ও তোমাদের মধ্যকার দায়িত্বশীলদের (উলিল আমরের) আনুগত্য কর   ৫৪

তাঁরাই কি কোরআনে বর্ণিত আহলুয যিকর নন-

) فسئلوا اهل الذكر ان كنتم لا تعلمون(

যদি তোমরা না জান তাহলে যারা জানে তাদেরকে জিজ্ঞেস কর। ৫৫

সূরা নিসার ১১৫ নং আয়াতে যে মুমিনদের বিবরণ দেয়া হয়েছে তাঁরাই কি সেই মুমিনীন নন? বলা হয়েছে- যে কেউ সত্য প্রকাশিত হবার পর নবীর বিরুদ্ধাচারণ করবে ও মুমিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ গ্রহণ করবে আমরা তাদেরকে সেই পথেই পরিচালিত করবো এবং অবশেষে জাহান্নামে প্রবেশ করাবো। ৫৬

তাঁরাই কি সেই ব্যক্তিবর্গ নন যারা আল্লাহর দিকে মানুষদের হেদায়েত করেন। যেমন সূরা রাদের ৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

) انما انت منذر و لكل قوم هاد(

নিশ্চয়ই আপনি কেবল ভয় প্রদর্শনকারী এবং প্রত্যেক জাতি ও গোত্রের জন্যই হেদায়েতকারী রয়েছে। ৫৭

এরাই কি সেই ব্যক্তিবর্গ নন যাঁদেরকে মহান আল্লাহ্ নিয়ামত দান করেছেন?

সূরা ফাতিহা যার অপর নাম হলো সাবয়ুল মাছানী এবং কোরআনে সেই সূরাতে আমাদের সরল সঠিক পথে ও যাদের প্রতি আপনি নিয়ামত দান করেছেন তাদের পথে পরিচালিত করুন বলতে কাদের পথকে বুঝানো হয়েছে?৫৮

সূরা নিসার ৬৯ নং আয়াতে মহান আল্লাহ্ বলেছেন,

যে কেউ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে,সে কিয়ামতের দিন তাঁদের সঙ্গে থাকবে যাঁদের ওপর আল্লাহ্ তাঁর নিয়ামতকে সম্পূর্ণ করেছেন,(তাঁরা হলেন) নবী,সিদ্দীক,শহীদ ও সৎ কর্মশীল বান্দাগণ।

নিঃসন্দেহে আহলে বাইতের ইমামগণ সিদ্দীক,শহীদ ও সালেহীনদের অন্তর্ভুক্ত। তবে কি আল্লাহ্ সর্বসাধারণের সার্বিক নেতা হিসেবে তাঁদেরকেই মনোনীত করেন নি? নবীর পরবর্তীতে মুসলমানদের নেতৃত্ব দানের ও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব শুধু তাঁদের জন্যই নির্ধারিত করেন নি?

যদি বিষয়টি না জানেন তবে দেখুন-

নিশ্চয়ই তোমাদের ওয়ালী (অভিভাবক) হলেন শুধু আল্লাহ্,তাঁর রাসূল এবং যারা ঈমান আনে,নামায কায়েম করে এবং রুকুরত অবস্থায় যাকাত দেয়। যারা আল্লাহ্,তাঁর রাসূল ও ঈমানদারদের অভিভাবকত্বকে মেনে নেয় তারাই জয়ী হবে,কারণ আল্লাহর দলই বিজয়ী হবে।৫৯  

মহান আল্লাহ্ ক্ষমা ও মাগফেরাতের শর্ত হিসেবে তওবা,ঈমান আনা,সৎ কর্ম করা ও আহলে বাইতের ইমামদের নেতৃত্বকে মেনে নেয়ার বিষয়টিকে উল্লেখ করেছেন যেমনটি সূরা ত্বহার ৮২ নং আয়াতে এসেছে-

আমি আমার ক্ষমাকে তওবার মাধ্যমে প্রত্যাবর্তন,ঈমান আনয়ন,সৎ কর্ম সম্পাদন এবং হেদায়েত প্রাপ্তির৬০ মধ্যেই রেখেছি (অর্থাৎ তারাই ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে যারা তওবা করেছে,ঈমান আনয়ন করেছে,সৎ কর্ম সম্পাদন করেছে এবং হেদায়েতপ্রাপ্ত হয়েছে)।

তাহলে তাঁদের বেলায়েত কি একটি আমানত নয় যা সূরা আহযাবের ৭২ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

আমরা আমানতকে আসমান,যমীন ও পর্বতের নিকট পেশ করেছিলাম কিন্তু তারা তা গ্রহণে অক্ষমতা প্রকাশ করেছিল এবং তারা বোঝা বহনের ভয় করছিল কিন্তু মানুষ তা গ্রহণ করেছিল। কারণ মানুষ (নিজের প্রতি) অত্যাচারী এবং অজ্ঞ।৬১  

তাঁদের (আহলে বাইতের) বেলায়েত ও অভিভাবকত্বকেই আল্লাহ্ কোরআনেسِلْمٌ (সিল্ম) বলে উল্লেখ করেছেন এবং সেখানে প্রবেশের জন্য সকলকে নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন, হে ঈমানদারগণ,সকলেই সমবেতভাবে সিল্ম বা শান্তি ও মুক্তির মধ্যে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। ৬২

তাঁদের বেলায়েত বা অভিভাবকত্বকেই কি মহান আল্লাহ্ কোরআনেنعيم (নাঈম) বলে উল্লেখ করেন নি যে বিষয়ে কিয়ামতের দিন প্রশ্ন করা হবে( ثم لتسئلن يومئذ عن النعيم )৬৩

রাসূল (সা.) কি তাঁদের বেলায়েতকে ঘোষণার জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন নি? এবং এ বিষয়ে রাসূলকে প্রদত্ত নির্দেশ অনেকটা রাসূলকে ভীতি প্রদর্শনের মত ছিল,নয় কি? যেখানে আল্লাহ্ বলেছেন,

হে রাসূল!যা আপনার প্রতিপালকের পক্ষ হতে আপনার ওপর অবতীর্ণ হয়েছে তা পূর্ণাঙ্গরূপে পৌঁছান। যদি তা না করেন আপনি আপনার রেসালতের দায়িত্বই পালন করেন নি এবং আল্লাহ্ আপনাকে মানুষ হতে (সম্ভাব্য বিপদ হতে) রক্ষা করবেন। ৬৪

রাসূল (সা.) গাদীর দিবসে এ বাণী প্রচারের জন্য কি ব্যাপক পদক্ষেপ নেন নি? পরিষ্কার ভাষায় পূর্ণাঙ্গরূপে বিষয়টিকে উপস্থাপন করেন নি? মহান আল্লাহ্ তখনই সূরা মায়েদার এ আয়াত নাযিল করেন- আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামতকে সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের মনোনীত দীন হিসেবে গ্রহণ করলাম। ৬৫

তাহলে কি আপনি জানেন না মহান আল্লাহ্ ঐ ব্যক্তি যে তাঁদের (আহলে বাইতের) বেলায়েত ও নেতৃত্বকে সরাসরি অস্বীকার করেছিল এবং নবীর সঙ্গে এ বিষয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিল তার সঙ্গে কিরূপ আচরণ করেছেন? ঐ ব্যক্তি চিৎকার করে বলেছিল, হে আল্লাহ্! যদি এটি সত্য ও আপনার পক্ষ হতে হয়ে থাকে,তবে আসমান হতে আমার ওপর পাথর বর্ষণ করুন এবং আজাব নাযিল করুন। আল্লাহ্পাক ঐ ব্যক্তিকে হস্তীবাহিনীর ন্যায় ধ্বংস করেন। তখনই এক ব্যক্তি চাইল সেই আজাব সংঘটিত হোক যা অবধারিত কাফিরদের জন্য এবং যার প্রতিরোধকারী কেউ নেই এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।৬৬ (*১৪)

অতিশীঘ্রই পুনরুত্থান দিবসে আহলে বাইতের বেলায়েত ও নেতৃত্বের বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে যেমনটি সূরা সাফ্ফাতের ২৪ নং আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছে( وقفوهم إنّهم مسئولون )’ এবং তাদেরকে থামাও,তারা জিজ্ঞাসিত হবে।৬৭ এটি আশ্চর্যের বিষয় নয় কারণ তাঁদের নেতৃত্ব ও বেলায়েত এমন একটি বিষয় যা ঘোষণার জন্য সকল নবীর আগমন ঘটেছে এবং তাঁরা বিশ্বে আল্লাহর সর্বোত্তম নিদর্শন। নবীদের স্থলাভিষিক্ত ওলী ও ঐশী প্রতিনিধিগণ মানুষের কাছে এ সত্যটি প্রকাশ করে গিয়েছেন,যেমন সূরা যুখরুফের ৪৫ নং আয়াতে এসেছে-

) وأسأل من أرسلنا من قبلك من رسلنا(

তোমার পূর্বে আমাদের রাসূলদের মধ্য থেকে যাদের প্রেরণ করেছিলাম তাদের নিকট এ বিষয়ে প্রশ্ন কর।৬৮

আহলে বাইত সম্পর্কে এ প্রতিশ্রুতি আল্লাহ্পাক আমি কি তোমাদের প্রভু নই -এর প্রতিশ্রুতি থেকেই গ্রহণ করেছেন যা সূরা আ রাফের ১৭২ নং আয়াতের তাফসীরে বর্ণিত হয়েছে।(*১৫) আয়াতটি হলো : আল্লাহ্ বনি আদম হতে তার জন্মের পূর্বে এ প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন (তার পৃষ্ঠদেশ হতে তাদের বের করে তাদের নিজেদের ওপর সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন) যে,আমি কি তোমাদের প্রভু নই? তারা বলল,হ্যাঁ। এ বিষয় আহলে সুন্নাহর হাদীসসমূহেও উল্লিখিত হয়েছে।

এবং আদম তাঁর স্রষ্টা হতে কয়েকটি বাক্য প্রাপ্ত হলেন,তার মাধ্যমে ক্ষমা চাইলেন এবং আল্লাহ্ তাঁর তওবাকে গ্রহণ করলেন। ৬৯

তাঁদের সম্পর্কে আল্লাহ্পাক বলেছেন, আল্লাহ্ তাদের (এ উম্মতকে) আজাব দান করবেন না যখন তুমি তাদের মধ্যে বর্তমান। ৭০

পৃথিবীর অধিবাসীদের জন্য তাঁরা নিরাপত্তাস্থল এবং আল্লাহর শাস্তি হতে বাঁচার মাধ্যম। তাঁরাই যে তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বের কারণে অন্যদের হিংসার পাত্র তা সূরা নিসার ৫৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে, মানুষকে (নবী ও তার পরিবারবর্গকে) আল্লাহ্ তাঁর নিয়ামত হতে যা দান করেছেন তারা তার প্রতি হিংসা করে। ৭১

তাঁদের বিষয়েই আল্লাহ্ বলেছেন, জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিবর্গ বলে : আমরা ঈমান এনেছি। ৭২

আমাদের জানা উচিত আ রাফের ব্যক্তিবর্গ তাঁরাই। এজন্য আল্লাহ্পাক বলেছেন, এবং আ রাফে একদল ব্যক্তি রয়েছেন যাদের চেহারা দেখে সবাই চিনবে। ৭৩

তাঁরাই আল্লাহ্ বর্ণিত সত্যবাদী ও প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী ব্যক্তিবর্গ। কোরআন বলেছে, মুমিনদের মধ্যে একদল লোক রয়েছে তারা আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পালন করেছে,তাদের একদল দায়িত্ব সম্পন্ন করেছে (শহীদ হয়েছে) এবং অপর দল অপেক্ষমান রয়েছে (তাদের সাথে মিলিত হবার),তারা তাদের সংকল্প কখনোই পরিবর্তন করে নি। ৭৪

তাঁদেরকেই আল্লাহ্ তাঁর গুণকীর্তনকারী বলে বর্ণনা করেছেন- আল্লাহ্ যে সকল গৃহকে মর্যাদায় উন্নীত করার এবং সেগুলোতে তাঁর নাম উচ্চারণ করার আদেশ দিয়েছেন,সেখানে (একদল লোক) সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। এমন লোকেরা,যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে,নামায কায়েম ও যাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখতে পারে না। তারা ভয় করে সেই দিনকে যেদিন অন্তর ও দৃষ্টিসমূহ উল্টে যাবে। ৭৫

তাদের ঘরসমূহ হলো সেই ঘরসমূহ যার সম্পর্কে আল্লাহ্পাক বলেছেন, আল্লাহ্ যেসব গৃহকে মর্যাদায় উন্নীত করার এবং যেগুলোতে তাঁর নাম উচ্চারণ করার আদেশ দিয়েছেন। ৭৬

তাঁদের সম্পর্কেই মহান আল্লাহ্ সূরা নূরের ৩৫ আয়াতে বলেছেন, তাদের উদাহরণ হলো কুলঙ্গি এবং তাদের অস্তিত্ব আমারই নূরের অস্তিত্ব।৭৭ অথচ আল্লাহর জন্য আসমান ও জমীনে সর্বোত্তম উদাহরণ বিদ্যমান এবং তিনি ক্ষমতাশালী ও প্রজ্ঞাবান।

তাঁরা আল্লাহ্ বর্ণিত অগ্রবর্তী নৈকট্যপ্রাপ্ত দল যেমনটি এ আয়াতে বলা হয়েছে-

( السّابقون السّابقون أولَائك المقرّبون)

অর্থাৎ অগ্রবর্তীগণ তো অগ্রবর্তীই,তারাই নৈকট্যশীল।৭৮

এবং সত্যবাদী,শহীদ,সাক্ষ্য প্রদানকারী এবং সৎ কর্মশীল বলতে তাঁদেরই বোঝানো হয়েছে।৭৯

আহলে বাইত এবং তাঁদের ইমামগণ সম্পর্কেই আল্লাহ্পাক বলেছেন,

( وممن خلقنا أمة يهدون بالْحقّ و به يعدلون)

আর যাদেরকে আমি সৃষ্টি করেছি তাদের মধ্যে একদল রয়েছে যারা সত্যের দিকে মানুষকে হেদায়েত করে (পথ দেখায়) এবং সে অনুযায়ী ন্যায়বিচার করে। ৮০

আহলে বাইতের অনুসারী এবং বিরোধী ও শত্রুদের সম্পর্কেই এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে-

( لا يستوي أصحاب النّار و أصحاب الْجَنَّة أصحاب الْجَنَّة هم الفائزون)

জাহান্নামের অধিবাসী এবং জান্নাতের অধিবাসীগণ সমান হতে পারে না। জান্নাতের অধিবাসীরাই সফলকাম।৮১

তাঁদের পক্ষের ও বিপক্ষের দল সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেছেন,

( أم نجعل الّذين آمنوا و عملوا الصّالِحات كالمفسدين في الأرض أم نجعل المتّقين كالفجّار)

আমি কি বিশ্বাসী ও সৎ কর্মশীলদেরকে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কাফেরদের সমতুল্য করে দেব,না খোদাভীরুদেরকে পাপাচারীদের সমান করে দেব? ৮২  

এই দু দল সম্পর্কে অন্যত্র বলেছেন,

( أم حسب الّذين اجترحوا السيّئات أن نجعلهم كالذين آمنوا و عملوا الصّالِحات سواء محياهم و مَماتُهم ساء ما يحكمون)

যারা দুষ্কর্ম উপার্জন করেছে তারা কি মনে করে আমি তাদেরকে সে লোকদের মত করে দেব যারা ঈমান আনে ও সৎ কর্ম করে ও তাদের জীবন ও মৃত্যু কি সমান হবে? ৮৩

আহলে বাইত ও তাঁদের অনুসারীদের সম্পর্কেই কোরআনে বলা হয়েছে-

( إنّ الّذين آمنوا و عملوا الصّالِحات أولَائك هم خيرُ البريّة)

যারা ঈমান এনেছে ও সৎ কর্ম করেছে তারাই শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি।৮৪

আহলে বাইত ও তাঁদের শত্রুদের সম্পর্কে কোরআনে বলা হয়েছে-

এই দু বাদী-বিবাদী,তারা তাদের পালনকর্তা সম্পর্কে বিতর্ক করে। অতএব,যারা কাফির তাদের জন্য আগুনের পোষাক তৈরী করা হয়েছে। তাদের মাথার ওপর ফুটন্ত পানি ঢেলে দেয়া হবে।৮৫

এবং আহলে বাইত ও তাঁদের শত্রুদের সম্পর্কেই এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে- মুমিন কি কখনো ফাসেকের মত হতে পারে? তারা সমান নয়। কিন্তু যারা ঈমান এনেছে ও সৎ কর্ম করেছে তাদের বাসস্থান হলো চিরস্থায়ী জান্নাত তাদের সৎ কর্মের বিনিময়স্বরূপ আর যারা গুনাহ করেছে তারা তাদের বাসস্থানকে জাহান্নামের মধ্যে প্রস্তুত করেছে। যখনই তারা চাইবে তা হতে বের হতে,তাদেরকে জোরপূর্বক ফিরিয়ে দেয়া হবে ও বলা হবে,যে জাহান্নামকে অস্বীকার করতে তার স্বাদ আস্বাদন কর।৮৬

অন্যত্র ঐ সকল ব্যক্তিবর্গ যারা হাজীদের পানি পান করানো ও কাবা শরীফের খাদেম হওয়ার কারণে অহংকার ও গর্ব পোষণ করতো তাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, তোমরা কি হাজীদের পানি সরবরাহ ও মসজিদুল হারাম আবাদকরণকে সেই লোকের সমান মনে কর যে ঈমান রাখে আল্লাহ্ ও শেষ দিনের প্রতি এবং যুদ্ধ করে আল্লাহর পথে? এরা আল্লাহর দৃষ্টিতে সমান নয়,আর আল্লাহ্ জালেম লোকদের হেদায়েত করেন না। ৮৭

তেমনিভাবে আল্লাহ্পাক আহলে বাইতের বিভিন্ন কঠিন পরীক্ষায় সফলতার কথা কোরআনে বর্ণনা করেছেন-

( و من النّاس من يشري نفسه ابتغاء مرضات الله و الله رءوف بالعباد)

এবং মানুষের মধ্যে একদল লোক আছে যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির বিনিময়ে নিজেদের জীবনকে বিক্রয় করে এবং আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু।৮৮

অন্যত্র বলেছেন, আল্লাহ্ মুমিনদের জীবন ও সম্পদকে বেহেশতের বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়েছেন। তারা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে,হত্যা করে ও নিহত হয়। এ প্রতিশ্রুতি সত্য ও অবশ্যম্ভাবী যা তাওরাত,ইঞ্জিল ও কোরআনে এসেছে- এবং আল্লাহ্ হতে কে অধিক ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী?

সুতরাং তোমরা আনন্দিত হও সে লেনদেনের ওপর যা তোমরা আল্লাহর সঙ্গে করেছ। তারা (এ মুমিনগণ) তওবাকারী,ইবাদতকারী,কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী,দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদকারী,রুকু ও সিজদাকারী,সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধকারী,আল্লাহর দেয়া সীমাসমূহের হেফাজতকারী। (সূরা তওবা : ১১১ ও ১১২)

যারা স্বীয় ধনসম্পদ ব্যয় করে (দান করে) রাত্রে ও দিনে,গোপনে ও প্রকাশ্যে। তাদের জন্য তাদের সওয়াব তাদের পালনকর্তার নিকট সংরক্ষিত। তাদের কোন আশঙ্কা নেই এবং তারা

চিন্তিতও হবে না। (বাকারা : ২৭৪)৮৯

তাঁরাই সত্যকে সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দিয়েছেন। আল্লাহ্ তার সাক্ষ্য প্রদান করে বলেছেন, যারা সত্য নিয়ে আগমন করেছে ও সত্যকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে,তারাই তো খোদাভীরু ও মুত্তাকী (পরহেজগার)।৯০

সুতরাং তাঁরাই রাসূল (সা.)-এর গোত্রের সর্বোচ্চ নিষ্ঠাবান এবং তাঁর সবচেয়ে নিকটাত্মীয় যাঁদের মহান আল্লাহ্ তাঁর বিশেষ অনুগ্রহের অন্তর্ভুক্ত করে বলেছেন,

( و أنذر عشيرتك الأقربين )“ এবং তোমার নিকটাত্মীয়দের ভীতি প্রদর্শন কর। এবং তাঁরাই কোরআনে বর্ণিত উলুল আরহাম বা নিকটাত্মীয় যেমনটি বলা হয়েছে সূরা আনফালের ৭৫ নং আয়াতে( أولوا الأرحام بعضهم أولى ببعض ) অর্থাৎ বস্তুত যারা নিকটাত্মীয় তারা পরস্পর অধিক হক্বদার এবং এদের সম্পর্কেই কোরআনে বলা হয়েছে তাঁদের মর্যাদা কিয়ামতের দিন বাড়িয়ে দেয়া হবে এবং নবীর সঙ্গে মিলিত হয়ে জান্নাতুন নাঈমে অবস্থান করবেন। এর প্রমাণ কোরআনের এ আয়াত যাতে বলা হয়েছে-

যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের পরিবার ও বংশের যারা তাদের (ঈমানের ক্ষেত্রে) অনুসরণ করেছে সেই বংশধরদেরও আমি তাদের সাথে মিলিত করে দেব এবং তাদের আমল হতে কিছুই কম করা হবে না। ৯১

তাঁরাই সেই ব্যক্তিবর্গ যাঁদের অধিকারকে আল্লাহ্ আদায় করতে বলেছেন-

وآت ذا القربىحقّه অর্থাৎ নিকটাত্মীয়দের অধিকার আদায় কর। তাঁরাই খুমসের অধিকারী যা আদায় না করলে তাঁদের হক্ব আমাদের ওপর কিয়ামতের দিনও থেকে যাবে- জেনে রাখো,তোমরা যা কিছু অর্জন কর,তার এক পঞ্চমাংশ আল্লাহ্,তাঁর রাসূল এবং তাঁর নিকটাত্মীয়,ইয়াতীম,অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরদের.। (সূরা আনফাল : ৪১)

তাঁরা ফাই সম্পদেরও অধিকারী কারণ আল্লাহ্ বলেছেন, যা মহান আল্লাহ্ জনপদবাসীদের কাছ থেকে রাসূলকে দিয়েছেন তা আল্লাহর,রাসূলের,তাঁর আত্মীয়-স্বজনের,ইয়াতিমদের,অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরদের। (সূরা হাশর : ৭)

নবীর আহলে বাইতকে সম্বোধন করে আল্লাহ্ বলেছেন,

( إنّما يريد الله ليذهب عنكم الرّجس أهل البيت و يطهّركم تطهيرا)

হে আহলে বাইত! নিশ্চয়ই আল্লাহ্ চান তোমাদের হতে পাপ পঙ্কিলতা দূরীভূত করতে ও সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে। (সূরা আহযাব : ৩৩)

তাঁদেরকেই আল্লাহ্ আলে ইয়াসিন বলে সম্বোধন করে সালাম দিয়েছেন-و سلام على الياسين অর্থাৎ আলে ইয়াসিনের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।৯২ (সূরা সাফ্ফাত : ১৩০)

তাঁরাই রাসূলের বংশধর যাঁদের ওপর দরূদ পড়াকে আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের জন্য নামাযে ওয়াজিব করেছেন-

﴿ إنّ الله و ملائكته يصلّون على النَّبِيّ يا أيّها الّذين آمنوا صلّوا عليه و سلّموا تسليما

নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর ওপর দরূদ পড়েন,হে ঈমানদারগণ! তোমরাও রাসূলের ওপর দরুদ পাঠ কর।৯৩

সাহাবীরা প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনার ওপর সালাম কিরূপে পাঠ করতে হবে জানি কিন্তু দরূদ কিরূপে পড়ব? রাসূল (সা.) বললেন, আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিও ওয়া আলা আলে মুহাম্মাদ অর্থাৎ হে আল্লাহ্! মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর বংশধরদের ওপর রহমত বর্ষণ কর।

এ হাদীস হতে বুঝা যায় আহলে বাইতের ওপর দরূদ পাঠও এই আয়াতের নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত। এ কারণেই আলেমগণ এই আয়াতকে আহলে বাইতের শানে বর্ণিত আয়াতের অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং ইবনে হাজার আসকালানী তাঁর আসসাওয়ায়েক গ্রন্থের ১১ অধ্যায়েও তাই করেছেন।৯৪

طوبى لهم তাদের জন্যই সুসংবাদ ও তাদের জন্যই চিরস্থায়ী বেহেশত এবং তার দ্বারগুলো উন্মুক্ত রয়েছে।৯৫

আরব কবি বলেছেন,

من يباريهم و في الشّمس معنى؟ مجهد متعب لمن باراها

কে পারে তাঁদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে অর্থাৎ সূর্যের সাথে যে প্রতিযোগিতা করে তার ওপরই ক্লান্ত ও শ্রান্তের অর্থ বর্তায় (অর্থাৎ সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে)।

আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে তাঁরা মনোনীত,আল্লাহর অনুমতিক্রমে পুণ্যকর্মে তাঁরা অন্যদের হতে অগ্রগামী। তাঁরা আল্লাহর কিতাবের উত্তরাধিকারী এবং তাঁদের সম্পর্কেই আল্লাহ্ বলেছেন,

অতঃপর কিতাবকে (আল কোরআন) তাঁর বান্দাদের মধ্যে মনোনীত ব্যক্তিদের হাতে সমর্পণ করলাম। আর বান্দাদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের ওপর জুলুম করেছে এবং তারা ইমামদের নেতৃত্বকে মেনে নেয় নি।

তাদের (বান্দাগণের) অনেকেই মধ্যপন্থী ও ন্যায়পরায়ণ এবং তারা আহলে বাইতের প্রতি ভালবাসা পোষণকারী। যেমন কোরআনে এসেছে-

এবং তাদের অনেকেই পুণ্যকর্মে অগ্রগামী হয়েছে এবং তারাই ইমাম। এটি একটি বড় নিয়ামত।৯৬

আহলে বাইতের ফজীলত বর্ণনা করে যে সকল আয়াত এসেছে তা বর্ণনার জন্য এ পর্যন্তই যথেষ্ট বলে মনে করেছি। তবে আপনার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি হযরত আলী (আ.)-এর শানে কোরআনে ৩০০ আয়াত বর্ণিত হয়েছে।৯৭

অন্য আরেকজন তাফসীরকারক বলেছেন, কোরআনের এক চতুর্থাংশ আয়াত আহলে বাইতের শানে বর্ণিত হয়েছে এবং এটি আশ্চর্যের কোন বিষয় নয়,কারণ আহলে বাইত ও কোরআন একই সত্তার দুই অংশ।

এখন পর্যন্ত যে সমস্ত স্পষ্ট আয়াত আপনার নিকট বর্ণনা করলাম তা কোরআনের মূল ও ভিত্তি( هُنَّ أُمُّ الْكِتَاب ) । এ আয়াতগুলো খুব সহজে গ্রহণ করুন (মেনে নিন)। আর ভক্তি ও উদারতার সাথে সূক্ষ্মভাবে এসব আয়াত অধ্যয়ন করুন এবং এসব আয়াত সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাবান মহান আল্লাহর বাণী হতে গ্রহণ করুন যে সম্পর্কে অন্য কোন জ্ঞানী ব্যক্তি আপনাকে অবগত করবে না।

ওয়াসসালাম

বারতম পত্র

২২ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

কোরআনের আয়াত হতে উপস্থাপিত প্রমাণসমূহ

আলহামদুলিল্লাহ্! আপনি তাঁদের অন্তর্ভুক্ত যাঁরা কোরআনের জ্ঞানে সম্যক জ্ঞাত এবং এর বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ দিক সম্পর্কে সচেতন। রাসূলের পবিত্র বংশধরগণ সম্পর্কে কোরআনে যেরূপ স্পষ্ট আয়াতসমূহ রয়েছে অন্য কারো সম্পর্কে সেরূপ স্পষ্ট আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে কি?

কোরআনের সুস্পষ্ট আয়াতসমূহে যেরূপ তাঁদের বিষয়ে বলা হয়েছে যে,পাপ ও পঙ্কিলতা হতে তাঁরা সম্পূর্ণ পবিত্র সেরূপ অন্য কারো বিষয়ে বলা হয়েছে কি?৫০

আয়াতে তাতহীর অন্য কারো বিষয়ে অবতীর্ণ হয়েছে কি? কোরআন তাঁদের ব্যতীত অন্য কারো প্রতি ভালবাসা পোষণকে ফরয ঘোষণা করেছে কি?৫১

হযরত জিবরাঈল (আ.) মোবাহিলার আয়াতটি তাঁরা ব্যতীত অন্য কারো জন্য এনেছেন কি? অবশ্যই না,বরং তাঁদের ব্যাপারেই বলেছেন,

বলুন,এসো আমরা আমাদের সন্তানদের,নারীদের ও নিজ সত্তাদেরকে আহবান করি এবং আল্লাহকে বলি মিথ্যাবাদীদের ধ্বংস করুন। (সূরা আলে ইমরান : ৬১)

هل أتى هل أتى بِمدح سواهم لا و مولى بذكرهم حلّاها

সূরা হাল আতা (সূরা দাহর) তাঁদের ব্যতীত অন্য কারো প্রশংসায় অবতীর্ণ হয় নি,বরং শুধু তাঁদের লক্ষ্য করেই অবতীর্ণ হয়েছে।

আহলে বাইত কি আল্লাহর রজ্জু নন যেখানে কোরআনে বলা হয়েছে-

) و اعتصموا بحبل الله جميعا ولا تفرّقوا(

তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না৫২

তাঁরা কি কোরআনে বর্ণিত সত্যপন্থী নন যেখানে আল্লাহ্ বলছেন,

 ( وكونوا مع الصادقين ) এবং সত্যপন্থীদের সঙ্গে থাক। (সূরা তওবা : ১১৯)

সত্যপন্থী বলতে আমাদের সূত্রে বর্ণিত হাদীসানুসারে নবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইত। ইবনে হাজার তাঁর আসসাওয়ায়েক গ্রন্থের ১১ অধ্যায়ে ৯০ পৃষ্ঠায় ৫ নং আয়াতের তাফসীরে ইমাম সাজ্জাদ (আ.) হতে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন যা আমি ৬ষ্ঠ পত্রে উল্লেখ করেছিলাম।

আল্লাহ্ কি তাঁদেরকে সিরাতুল্লাহ্ বলে উল্লেখ করেন নি-

) و إنّ هذا صراطي مستقيما فاتبعوه(

নিশ্চয়ই এটি আমার সরল সঠিক পথ, এ পথের অনুসরণ কর। (সূরা আনআম : ১৫৩)

অন্যরা আল্লাহর পথ নন। তাই বলেছেন,

) ولا تتبعوا السبل فتفرق بكم عن سبيله(

বিচ্ছিন্নতা ও বক্রতার পথসমূহ অবলম্বন কর না, তাহলে আল্লাহর পথ হতে দূরে সরে যাবে ৫৩

এবং কোরআনে বর্ণিত উলিল আমর কি তাঁরাই নন যেখানে বলা হয়েছে-

) يا ايها الذين آمنوا اطيعوا الله و اطيعوا الرسول و اولي الامر منكم(

হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূল ও তোমাদের মধ্যকার দায়িত্বশীলদের (উলিল আমরের) আনুগত্য কর   ৫৪

তাঁরাই কি কোরআনে বর্ণিত আহলুয যিকর নন-

) فسئلوا اهل الذكر ان كنتم لا تعلمون(

যদি তোমরা না জান তাহলে যারা জানে তাদেরকে জিজ্ঞেস কর। ৫৫

সূরা নিসার ১১৫ নং আয়াতে যে মুমিনদের বিবরণ দেয়া হয়েছে তাঁরাই কি সেই মুমিনীন নন? বলা হয়েছে- যে কেউ সত্য প্রকাশিত হবার পর নবীর বিরুদ্ধাচারণ করবে ও মুমিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ গ্রহণ করবে আমরা তাদেরকে সেই পথেই পরিচালিত করবো এবং অবশেষে জাহান্নামে প্রবেশ করাবো। ৫৬

তাঁরাই কি সেই ব্যক্তিবর্গ নন যারা আল্লাহর দিকে মানুষদের হেদায়েত করেন। যেমন সূরা রাদের ৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

) انما انت منذر و لكل قوم هاد(

নিশ্চয়ই আপনি কেবল ভয় প্রদর্শনকারী এবং প্রত্যেক জাতি ও গোত্রের জন্যই হেদায়েতকারী রয়েছে। ৫৭

এরাই কি সেই ব্যক্তিবর্গ নন যাঁদেরকে মহান আল্লাহ্ নিয়ামত দান করেছেন?

সূরা ফাতিহা যার অপর নাম হলো সাবয়ুল মাছানী এবং কোরআনে সেই সূরাতে আমাদের সরল সঠিক পথে ও যাদের প্রতি আপনি নিয়ামত দান করেছেন তাদের পথে পরিচালিত করুন বলতে কাদের পথকে বুঝানো হয়েছে?৫৮

সূরা নিসার ৬৯ নং আয়াতে মহান আল্লাহ্ বলেছেন,

যে কেউ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে,সে কিয়ামতের দিন তাঁদের সঙ্গে থাকবে যাঁদের ওপর আল্লাহ্ তাঁর নিয়ামতকে সম্পূর্ণ করেছেন,(তাঁরা হলেন) নবী,সিদ্দীক,শহীদ ও সৎ কর্মশীল বান্দাগণ।

নিঃসন্দেহে আহলে বাইতের ইমামগণ সিদ্দীক,শহীদ ও সালেহীনদের অন্তর্ভুক্ত। তবে কি আল্লাহ্ সর্বসাধারণের সার্বিক নেতা হিসেবে তাঁদেরকেই মনোনীত করেন নি? নবীর পরবর্তীতে মুসলমানদের নেতৃত্ব দানের ও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব শুধু তাঁদের জন্যই নির্ধারিত করেন নি?

যদি বিষয়টি না জানেন তবে দেখুন-

নিশ্চয়ই তোমাদের ওয়ালী (অভিভাবক) হলেন শুধু আল্লাহ্,তাঁর রাসূল এবং যারা ঈমান আনে,নামায কায়েম করে এবং রুকুরত অবস্থায় যাকাত দেয়। যারা আল্লাহ্,তাঁর রাসূল ও ঈমানদারদের অভিভাবকত্বকে মেনে নেয় তারাই জয়ী হবে,কারণ আল্লাহর দলই বিজয়ী হবে।৫৯  

মহান আল্লাহ্ ক্ষমা ও মাগফেরাতের শর্ত হিসেবে তওবা,ঈমান আনা,সৎ কর্ম করা ও আহলে বাইতের ইমামদের নেতৃত্বকে মেনে নেয়ার বিষয়টিকে উল্লেখ করেছেন যেমনটি সূরা ত্বহার ৮২ নং আয়াতে এসেছে-

আমি আমার ক্ষমাকে তওবার মাধ্যমে প্রত্যাবর্তন,ঈমান আনয়ন,সৎ কর্ম সম্পাদন এবং হেদায়েত প্রাপ্তির৬০ মধ্যেই রেখেছি (অর্থাৎ তারাই ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে যারা তওবা করেছে,ঈমান আনয়ন করেছে,সৎ কর্ম সম্পাদন করেছে এবং হেদায়েতপ্রাপ্ত হয়েছে)।

তাহলে তাঁদের বেলায়েত কি একটি আমানত নয় যা সূরা আহযাবের ৭২ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

আমরা আমানতকে আসমান,যমীন ও পর্বতের নিকট পেশ করেছিলাম কিন্তু তারা তা গ্রহণে অক্ষমতা প্রকাশ করেছিল এবং তারা বোঝা বহনের ভয় করছিল কিন্তু মানুষ তা গ্রহণ করেছিল। কারণ মানুষ (নিজের প্রতি) অত্যাচারী এবং অজ্ঞ।৬১  

তাঁদের (আহলে বাইতের) বেলায়েত ও অভিভাবকত্বকেই আল্লাহ্ কোরআনেسِلْمٌ (সিল্ম) বলে উল্লেখ করেছেন এবং সেখানে প্রবেশের জন্য সকলকে নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন, হে ঈমানদারগণ,সকলেই সমবেতভাবে সিল্ম বা শান্তি ও মুক্তির মধ্যে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। ৬২

তাঁদের বেলায়েত বা অভিভাবকত্বকেই কি মহান আল্লাহ্ কোরআনেنعيم (নাঈম) বলে উল্লেখ করেন নি যে বিষয়ে কিয়ামতের দিন প্রশ্ন করা হবে( ثم لتسئلن يومئذ عن النعيم )৬৩

রাসূল (সা.) কি তাঁদের বেলায়েতকে ঘোষণার জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন নি? এবং এ বিষয়ে রাসূলকে প্রদত্ত নির্দেশ অনেকটা রাসূলকে ভীতি প্রদর্শনের মত ছিল,নয় কি? যেখানে আল্লাহ্ বলেছেন,

হে রাসূল!যা আপনার প্রতিপালকের পক্ষ হতে আপনার ওপর অবতীর্ণ হয়েছে তা পূর্ণাঙ্গরূপে পৌঁছান। যদি তা না করেন আপনি আপনার রেসালতের দায়িত্বই পালন করেন নি এবং আল্লাহ্ আপনাকে মানুষ হতে (সম্ভাব্য বিপদ হতে) রক্ষা করবেন। ৬৪

রাসূল (সা.) গাদীর দিবসে এ বাণী প্রচারের জন্য কি ব্যাপক পদক্ষেপ নেন নি? পরিষ্কার ভাষায় পূর্ণাঙ্গরূপে বিষয়টিকে উপস্থাপন করেন নি? মহান আল্লাহ্ তখনই সূরা মায়েদার এ আয়াত নাযিল করেন- আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামতকে সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের মনোনীত দীন হিসেবে গ্রহণ করলাম। ৬৫

তাহলে কি আপনি জানেন না মহান আল্লাহ্ ঐ ব্যক্তি যে তাঁদের (আহলে বাইতের) বেলায়েত ও নেতৃত্বকে সরাসরি অস্বীকার করেছিল এবং নবীর সঙ্গে এ বিষয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিল তার সঙ্গে কিরূপ আচরণ করেছেন? ঐ ব্যক্তি চিৎকার করে বলেছিল, হে আল্লাহ্! যদি এটি সত্য ও আপনার পক্ষ হতে হয়ে থাকে,তবে আসমান হতে আমার ওপর পাথর বর্ষণ করুন এবং আজাব নাযিল করুন। আল্লাহ্পাক ঐ ব্যক্তিকে হস্তীবাহিনীর ন্যায় ধ্বংস করেন। তখনই এক ব্যক্তি চাইল সেই আজাব সংঘটিত হোক যা অবধারিত কাফিরদের জন্য এবং যার প্রতিরোধকারী কেউ নেই এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।৬৬ (*১৪)

অতিশীঘ্রই পুনরুত্থান দিবসে আহলে বাইতের বেলায়েত ও নেতৃত্বের বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে যেমনটি সূরা সাফ্ফাতের ২৪ নং আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছে( وقفوهم إنّهم مسئولون )’ এবং তাদেরকে থামাও,তারা জিজ্ঞাসিত হবে।৬৭ এটি আশ্চর্যের বিষয় নয় কারণ তাঁদের নেতৃত্ব ও বেলায়েত এমন একটি বিষয় যা ঘোষণার জন্য সকল নবীর আগমন ঘটেছে এবং তাঁরা বিশ্বে আল্লাহর সর্বোত্তম নিদর্শন। নবীদের স্থলাভিষিক্ত ওলী ও ঐশী প্রতিনিধিগণ মানুষের কাছে এ সত্যটি প্রকাশ করে গিয়েছেন,যেমন সূরা যুখরুফের ৪৫ নং আয়াতে এসেছে-

) وأسأل من أرسلنا من قبلك من رسلنا(

তোমার পূর্বে আমাদের রাসূলদের মধ্য থেকে যাদের প্রেরণ করেছিলাম তাদের নিকট এ বিষয়ে প্রশ্ন কর।৬৮

আহলে বাইত সম্পর্কে এ প্রতিশ্রুতি আল্লাহ্পাক আমি কি তোমাদের প্রভু নই -এর প্রতিশ্রুতি থেকেই গ্রহণ করেছেন যা সূরা আ রাফের ১৭২ নং আয়াতের তাফসীরে বর্ণিত হয়েছে।(*১৫) আয়াতটি হলো : আল্লাহ্ বনি আদম হতে তার জন্মের পূর্বে এ প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন (তার পৃষ্ঠদেশ হতে তাদের বের করে তাদের নিজেদের ওপর সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন) যে,আমি কি তোমাদের প্রভু নই? তারা বলল,হ্যাঁ। এ বিষয় আহলে সুন্নাহর হাদীসসমূহেও উল্লিখিত হয়েছে।

এবং আদম তাঁর স্রষ্টা হতে কয়েকটি বাক্য প্রাপ্ত হলেন,তার মাধ্যমে ক্ষমা চাইলেন এবং আল্লাহ্ তাঁর তওবাকে গ্রহণ করলেন। ৬৯

তাঁদের সম্পর্কে আল্লাহ্পাক বলেছেন, আল্লাহ্ তাদের (এ উম্মতকে) আজাব দান করবেন না যখন তুমি তাদের মধ্যে বর্তমান। ৭০

পৃথিবীর অধিবাসীদের জন্য তাঁরা নিরাপত্তাস্থল এবং আল্লাহর শাস্তি হতে বাঁচার মাধ্যম। তাঁরাই যে তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বের কারণে অন্যদের হিংসার পাত্র তা সূরা নিসার ৫৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে, মানুষকে (নবী ও তার পরিবারবর্গকে) আল্লাহ্ তাঁর নিয়ামত হতে যা দান করেছেন তারা তার প্রতি হিংসা করে। ৭১

তাঁদের বিষয়েই আল্লাহ্ বলেছেন, জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিবর্গ বলে : আমরা ঈমান এনেছি। ৭২

আমাদের জানা উচিত আ রাফের ব্যক্তিবর্গ তাঁরাই। এজন্য আল্লাহ্পাক বলেছেন, এবং আ রাফে একদল ব্যক্তি রয়েছেন যাদের চেহারা দেখে সবাই চিনবে। ৭৩

তাঁরাই আল্লাহ্ বর্ণিত সত্যবাদী ও প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী ব্যক্তিবর্গ। কোরআন বলেছে, মুমিনদের মধ্যে একদল লোক রয়েছে তারা আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পালন করেছে,তাদের একদল দায়িত্ব সম্পন্ন করেছে (শহীদ হয়েছে) এবং অপর দল অপেক্ষমান রয়েছে (তাদের সাথে মিলিত হবার),তারা তাদের সংকল্প কখনোই পরিবর্তন করে নি। ৭৪

তাঁদেরকেই আল্লাহ্ তাঁর গুণকীর্তনকারী বলে বর্ণনা করেছেন- আল্লাহ্ যে সকল গৃহকে মর্যাদায় উন্নীত করার এবং সেগুলোতে তাঁর নাম উচ্চারণ করার আদেশ দিয়েছেন,সেখানে (একদল লোক) সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। এমন লোকেরা,যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে,নামায কায়েম ও যাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখতে পারে না। তারা ভয় করে সেই দিনকে যেদিন অন্তর ও দৃষ্টিসমূহ উল্টে যাবে। ৭৫

তাদের ঘরসমূহ হলো সেই ঘরসমূহ যার সম্পর্কে আল্লাহ্পাক বলেছেন, আল্লাহ্ যেসব গৃহকে মর্যাদায় উন্নীত করার এবং যেগুলোতে তাঁর নাম উচ্চারণ করার আদেশ দিয়েছেন। ৭৬

তাঁদের সম্পর্কেই মহান আল্লাহ্ সূরা নূরের ৩৫ আয়াতে বলেছেন, তাদের উদাহরণ হলো কুলঙ্গি এবং তাদের অস্তিত্ব আমারই নূরের অস্তিত্ব।৭৭ অথচ আল্লাহর জন্য আসমান ও জমীনে সর্বোত্তম উদাহরণ বিদ্যমান এবং তিনি ক্ষমতাশালী ও প্রজ্ঞাবান।

তাঁরা আল্লাহ্ বর্ণিত অগ্রবর্তী নৈকট্যপ্রাপ্ত দল যেমনটি এ আয়াতে বলা হয়েছে-

( السّابقون السّابقون أولَائك المقرّبون)

অর্থাৎ অগ্রবর্তীগণ তো অগ্রবর্তীই,তারাই নৈকট্যশীল।৭৮

এবং সত্যবাদী,শহীদ,সাক্ষ্য প্রদানকারী এবং সৎ কর্মশীল বলতে তাঁদেরই বোঝানো হয়েছে।৭৯

আহলে বাইত এবং তাঁদের ইমামগণ সম্পর্কেই আল্লাহ্পাক বলেছেন,

( وممن خلقنا أمة يهدون بالْحقّ و به يعدلون)

আর যাদেরকে আমি সৃষ্টি করেছি তাদের মধ্যে একদল রয়েছে যারা সত্যের দিকে মানুষকে হেদায়েত করে (পথ দেখায়) এবং সে অনুযায়ী ন্যায়বিচার করে। ৮০

আহলে বাইতের অনুসারী এবং বিরোধী ও শত্রুদের সম্পর্কেই এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে-

( لا يستوي أصحاب النّار و أصحاب الْجَنَّة أصحاب الْجَنَّة هم الفائزون)

জাহান্নামের অধিবাসী এবং জান্নাতের অধিবাসীগণ সমান হতে পারে না। জান্নাতের অধিবাসীরাই সফলকাম।৮১

তাঁদের পক্ষের ও বিপক্ষের দল সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেছেন,

( أم نجعل الّذين آمنوا و عملوا الصّالِحات كالمفسدين في الأرض أم نجعل المتّقين كالفجّار)

আমি কি বিশ্বাসী ও সৎ কর্মশীলদেরকে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কাফেরদের সমতুল্য করে দেব,না খোদাভীরুদেরকে পাপাচারীদের সমান করে দেব? ৮২  

এই দু দল সম্পর্কে অন্যত্র বলেছেন,

( أم حسب الّذين اجترحوا السيّئات أن نجعلهم كالذين آمنوا و عملوا الصّالِحات سواء محياهم و مَماتُهم ساء ما يحكمون)

যারা দুষ্কর্ম উপার্জন করেছে তারা কি মনে করে আমি তাদেরকে সে লোকদের মত করে দেব যারা ঈমান আনে ও সৎ কর্ম করে ও তাদের জীবন ও মৃত্যু কি সমান হবে? ৮৩

আহলে বাইত ও তাঁদের অনুসারীদের সম্পর্কেই কোরআনে বলা হয়েছে-

( إنّ الّذين آمنوا و عملوا الصّالِحات أولَائك هم خيرُ البريّة)

যারা ঈমান এনেছে ও সৎ কর্ম করেছে তারাই শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি।৮৪

আহলে বাইত ও তাঁদের শত্রুদের সম্পর্কে কোরআনে বলা হয়েছে-

এই দু বাদী-বিবাদী,তারা তাদের পালনকর্তা সম্পর্কে বিতর্ক করে। অতএব,যারা কাফির তাদের জন্য আগুনের পোষাক তৈরী করা হয়েছে। তাদের মাথার ওপর ফুটন্ত পানি ঢেলে দেয়া হবে।৮৫

এবং আহলে বাইত ও তাঁদের শত্রুদের সম্পর্কেই এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে- মুমিন কি কখনো ফাসেকের মত হতে পারে? তারা সমান নয়। কিন্তু যারা ঈমান এনেছে ও সৎ কর্ম করেছে তাদের বাসস্থান হলো চিরস্থায়ী জান্নাত তাদের সৎ কর্মের বিনিময়স্বরূপ আর যারা গুনাহ করেছে তারা তাদের বাসস্থানকে জাহান্নামের মধ্যে প্রস্তুত করেছে। যখনই তারা চাইবে তা হতে বের হতে,তাদেরকে জোরপূর্বক ফিরিয়ে দেয়া হবে ও বলা হবে,যে জাহান্নামকে অস্বীকার করতে তার স্বাদ আস্বাদন কর।৮৬

অন্যত্র ঐ সকল ব্যক্তিবর্গ যারা হাজীদের পানি পান করানো ও কাবা শরীফের খাদেম হওয়ার কারণে অহংকার ও গর্ব পোষণ করতো তাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, তোমরা কি হাজীদের পানি সরবরাহ ও মসজিদুল হারাম আবাদকরণকে সেই লোকের সমান মনে কর যে ঈমান রাখে আল্লাহ্ ও শেষ দিনের প্রতি এবং যুদ্ধ করে আল্লাহর পথে? এরা আল্লাহর দৃষ্টিতে সমান নয়,আর আল্লাহ্ জালেম লোকদের হেদায়েত করেন না। ৮৭

তেমনিভাবে আল্লাহ্পাক আহলে বাইতের বিভিন্ন কঠিন পরীক্ষায় সফলতার কথা কোরআনে বর্ণনা করেছেন-

( و من النّاس من يشري نفسه ابتغاء مرضات الله و الله رءوف بالعباد)

এবং মানুষের মধ্যে একদল লোক আছে যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির বিনিময়ে নিজেদের জীবনকে বিক্রয় করে এবং আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু।৮৮

অন্যত্র বলেছেন, আল্লাহ্ মুমিনদের জীবন ও সম্পদকে বেহেশতের বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়েছেন। তারা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে,হত্যা করে ও নিহত হয়। এ প্রতিশ্রুতি সত্য ও অবশ্যম্ভাবী যা তাওরাত,ইঞ্জিল ও কোরআনে এসেছে- এবং আল্লাহ্ হতে কে অধিক ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী?

সুতরাং তোমরা আনন্দিত হও সে লেনদেনের ওপর যা তোমরা আল্লাহর সঙ্গে করেছ। তারা (এ মুমিনগণ) তওবাকারী,ইবাদতকারী,কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী,দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদকারী,রুকু ও সিজদাকারী,সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধকারী,আল্লাহর দেয়া সীমাসমূহের হেফাজতকারী। (সূরা তওবা : ১১১ ও ১১২)

যারা স্বীয় ধনসম্পদ ব্যয় করে (দান করে) রাত্রে ও দিনে,গোপনে ও প্রকাশ্যে। তাদের জন্য তাদের সওয়াব তাদের পালনকর্তার নিকট সংরক্ষিত। তাদের কোন আশঙ্কা নেই এবং তারা

চিন্তিতও হবে না। (বাকারা : ২৭৪)৮৯

তাঁরাই সত্যকে সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দিয়েছেন। আল্লাহ্ তার সাক্ষ্য প্রদান করে বলেছেন, যারা সত্য নিয়ে আগমন করেছে ও সত্যকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে,তারাই তো খোদাভীরু ও মুত্তাকী (পরহেজগার)।৯০

সুতরাং তাঁরাই রাসূল (সা.)-এর গোত্রের সর্বোচ্চ নিষ্ঠাবান এবং তাঁর সবচেয়ে নিকটাত্মীয় যাঁদের মহান আল্লাহ্ তাঁর বিশেষ অনুগ্রহের অন্তর্ভুক্ত করে বলেছেন,

( و أنذر عشيرتك الأقربين )“ এবং তোমার নিকটাত্মীয়দের ভীতি প্রদর্শন কর। এবং তাঁরাই কোরআনে বর্ণিত উলুল আরহাম বা নিকটাত্মীয় যেমনটি বলা হয়েছে সূরা আনফালের ৭৫ নং আয়াতে( أولوا الأرحام بعضهم أولى ببعض ) অর্থাৎ বস্তুত যারা নিকটাত্মীয় তারা পরস্পর অধিক হক্বদার এবং এদের সম্পর্কেই কোরআনে বলা হয়েছে তাঁদের মর্যাদা কিয়ামতের দিন বাড়িয়ে দেয়া হবে এবং নবীর সঙ্গে মিলিত হয়ে জান্নাতুন নাঈমে অবস্থান করবেন। এর প্রমাণ কোরআনের এ আয়াত যাতে বলা হয়েছে-

যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের পরিবার ও বংশের যারা তাদের (ঈমানের ক্ষেত্রে) অনুসরণ করেছে সেই বংশধরদেরও আমি তাদের সাথে মিলিত করে দেব এবং তাদের আমল হতে কিছুই কম করা হবে না। ৯১

তাঁরাই সেই ব্যক্তিবর্গ যাঁদের অধিকারকে আল্লাহ্ আদায় করতে বলেছেন-

وآت ذا القربىحقّه অর্থাৎ নিকটাত্মীয়দের অধিকার আদায় কর। তাঁরাই খুমসের অধিকারী যা আদায় না করলে তাঁদের হক্ব আমাদের ওপর কিয়ামতের দিনও থেকে যাবে- জেনে রাখো,তোমরা যা কিছু অর্জন কর,তার এক পঞ্চমাংশ আল্লাহ্,তাঁর রাসূল এবং তাঁর নিকটাত্মীয়,ইয়াতীম,অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরদের.। (সূরা আনফাল : ৪১)

তাঁরা ফাই সম্পদেরও অধিকারী কারণ আল্লাহ্ বলেছেন, যা মহান আল্লাহ্ জনপদবাসীদের কাছ থেকে রাসূলকে দিয়েছেন তা আল্লাহর,রাসূলের,তাঁর আত্মীয়-স্বজনের,ইয়াতিমদের,অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরদের। (সূরা হাশর : ৭)

নবীর আহলে বাইতকে সম্বোধন করে আল্লাহ্ বলেছেন,

( إنّما يريد الله ليذهب عنكم الرّجس أهل البيت و يطهّركم تطهيرا)

হে আহলে বাইত! নিশ্চয়ই আল্লাহ্ চান তোমাদের হতে পাপ পঙ্কিলতা দূরীভূত করতে ও সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে। (সূরা আহযাব : ৩৩)

তাঁদেরকেই আল্লাহ্ আলে ইয়াসিন বলে সম্বোধন করে সালাম দিয়েছেন-و سلام على الياسين অর্থাৎ আলে ইয়াসিনের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।৯২ (সূরা সাফ্ফাত : ১৩০)

তাঁরাই রাসূলের বংশধর যাঁদের ওপর দরূদ পড়াকে আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের জন্য নামাযে ওয়াজিব করেছেন-

﴿ إنّ الله و ملائكته يصلّون على النَّبِيّ يا أيّها الّذين آمنوا صلّوا عليه و سلّموا تسليما

নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর ওপর দরূদ পড়েন,হে ঈমানদারগণ! তোমরাও রাসূলের ওপর দরুদ পাঠ কর।৯৩

সাহাবীরা প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনার ওপর সালাম কিরূপে পাঠ করতে হবে জানি কিন্তু দরূদ কিরূপে পড়ব? রাসূল (সা.) বললেন, আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিও ওয়া আলা আলে মুহাম্মাদ অর্থাৎ হে আল্লাহ্! মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর বংশধরদের ওপর রহমত বর্ষণ কর।

এ হাদীস হতে বুঝা যায় আহলে বাইতের ওপর দরূদ পাঠও এই আয়াতের নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত। এ কারণেই আলেমগণ এই আয়াতকে আহলে বাইতের শানে বর্ণিত আয়াতের অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং ইবনে হাজার আসকালানী তাঁর আসসাওয়ায়েক গ্রন্থের ১১ অধ্যায়েও তাই করেছেন।৯৪

طوبى لهم তাদের জন্যই সুসংবাদ ও তাদের জন্যই চিরস্থায়ী বেহেশত এবং তার দ্বারগুলো উন্মুক্ত রয়েছে।৯৫

আরব কবি বলেছেন,

من يباريهم و في الشّمس معنى؟ مجهد متعب لمن باراها

কে পারে তাঁদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে অর্থাৎ সূর্যের সাথে যে প্রতিযোগিতা করে তার ওপরই ক্লান্ত ও শ্রান্তের অর্থ বর্তায় (অর্থাৎ সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে)।

আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে তাঁরা মনোনীত,আল্লাহর অনুমতিক্রমে পুণ্যকর্মে তাঁরা অন্যদের হতে অগ্রগামী। তাঁরা আল্লাহর কিতাবের উত্তরাধিকারী এবং তাঁদের সম্পর্কেই আল্লাহ্ বলেছেন,

অতঃপর কিতাবকে (আল কোরআন) তাঁর বান্দাদের মধ্যে মনোনীত ব্যক্তিদের হাতে সমর্পণ করলাম। আর বান্দাদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের ওপর জুলুম করেছে এবং তারা ইমামদের নেতৃত্বকে মেনে নেয় নি।

তাদের (বান্দাগণের) অনেকেই মধ্যপন্থী ও ন্যায়পরায়ণ এবং তারা আহলে বাইতের প্রতি ভালবাসা পোষণকারী। যেমন কোরআনে এসেছে-

এবং তাদের অনেকেই পুণ্যকর্মে অগ্রগামী হয়েছে এবং তারাই ইমাম। এটি একটি বড় নিয়ামত।৯৬

আহলে বাইতের ফজীলত বর্ণনা করে যে সকল আয়াত এসেছে তা বর্ণনার জন্য এ পর্যন্তই যথেষ্ট বলে মনে করেছি। তবে আপনার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি হযরত আলী (আ.)-এর শানে কোরআনে ৩০০ আয়াত বর্ণিত হয়েছে।৯৭

অন্য আরেকজন তাফসীরকারক বলেছেন, কোরআনের এক চতুর্থাংশ আয়াত আহলে বাইতের শানে বর্ণিত হয়েছে এবং এটি আশ্চর্যের কোন বিষয় নয়,কারণ আহলে বাইত ও কোরআন একই সত্তার দুই অংশ।

এখন পর্যন্ত যে সমস্ত স্পষ্ট আয়াত আপনার নিকট বর্ণনা করলাম তা কোরআনের মূল ও ভিত্তি( هُنَّ أُمُّ الْكِتَاب ) । এ আয়াতগুলো খুব সহজে গ্রহণ করুন (মেনে নিন)। আর ভক্তি ও উদারতার সাথে সূক্ষ্মভাবে এসব আয়াত অধ্যয়ন করুন এবং এসব আয়াত সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাবান মহান আল্লাহর বাণী হতে গ্রহণ করুন যে সম্পর্কে অন্য কোন জ্ঞানী ব্যক্তি আপনাকে অবগত করবে না।

ওয়াসসালাম

বারতম পত্র

২২ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

কোরআনের আয়াত হতে উপস্থাপিত প্রমাণসমূহ

আলহামদুলিল্লাহ্! আপনি তাঁদের অন্তর্ভুক্ত যাঁরা কোরআনের জ্ঞানে সম্যক জ্ঞাত এবং এর বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ দিক সম্পর্কে সচেতন। রাসূলের পবিত্র বংশধরগণ সম্পর্কে কোরআনে যেরূপ স্পষ্ট আয়াতসমূহ রয়েছে অন্য কারো সম্পর্কে সেরূপ স্পষ্ট আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে কি?

কোরআনের সুস্পষ্ট আয়াতসমূহে যেরূপ তাঁদের বিষয়ে বলা হয়েছে যে,পাপ ও পঙ্কিলতা হতে তাঁরা সম্পূর্ণ পবিত্র সেরূপ অন্য কারো বিষয়ে বলা হয়েছে কি?৫০

আয়াতে তাতহীর অন্য কারো বিষয়ে অবতীর্ণ হয়েছে কি? কোরআন তাঁদের ব্যতীত অন্য কারো প্রতি ভালবাসা পোষণকে ফরয ঘোষণা করেছে কি?৫১

হযরত জিবরাঈল (আ.) মোবাহিলার আয়াতটি তাঁরা ব্যতীত অন্য কারো জন্য এনেছেন কি? অবশ্যই না,বরং তাঁদের ব্যাপারেই বলেছেন,

বলুন,এসো আমরা আমাদের সন্তানদের,নারীদের ও নিজ সত্তাদেরকে আহবান করি এবং আল্লাহকে বলি মিথ্যাবাদীদের ধ্বংস করুন। (সূরা আলে ইমরান : ৬১)

هل أتى هل أتى بِمدح سواهم لا و مولى بذكرهم حلّاها

সূরা হাল আতা (সূরা দাহর) তাঁদের ব্যতীত অন্য কারো প্রশংসায় অবতীর্ণ হয় নি,বরং শুধু তাঁদের লক্ষ্য করেই অবতীর্ণ হয়েছে।

আহলে বাইত কি আল্লাহর রজ্জু নন যেখানে কোরআনে বলা হয়েছে-

) و اعتصموا بحبل الله جميعا ولا تفرّقوا(

তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না৫২

তাঁরা কি কোরআনে বর্ণিত সত্যপন্থী নন যেখানে আল্লাহ্ বলছেন,

 ( وكونوا مع الصادقين ) এবং সত্যপন্থীদের সঙ্গে থাক। (সূরা তওবা : ১১৯)

সত্যপন্থী বলতে আমাদের সূত্রে বর্ণিত হাদীসানুসারে নবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইত। ইবনে হাজার তাঁর আসসাওয়ায়েক গ্রন্থের ১১ অধ্যায়ে ৯০ পৃষ্ঠায় ৫ নং আয়াতের তাফসীরে ইমাম সাজ্জাদ (আ.) হতে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন যা আমি ৬ষ্ঠ পত্রে উল্লেখ করেছিলাম।

আল্লাহ্ কি তাঁদেরকে সিরাতুল্লাহ্ বলে উল্লেখ করেন নি-

) و إنّ هذا صراطي مستقيما فاتبعوه(

নিশ্চয়ই এটি আমার সরল সঠিক পথ, এ পথের অনুসরণ কর। (সূরা আনআম : ১৫৩)

অন্যরা আল্লাহর পথ নন। তাই বলেছেন,

) ولا تتبعوا السبل فتفرق بكم عن سبيله(

বিচ্ছিন্নতা ও বক্রতার পথসমূহ অবলম্বন কর না, তাহলে আল্লাহর পথ হতে দূরে সরে যাবে ৫৩

এবং কোরআনে বর্ণিত উলিল আমর কি তাঁরাই নন যেখানে বলা হয়েছে-

) يا ايها الذين آمنوا اطيعوا الله و اطيعوا الرسول و اولي الامر منكم(

হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূল ও তোমাদের মধ্যকার দায়িত্বশীলদের (উলিল আমরের) আনুগত্য কর   ৫৪

তাঁরাই কি কোরআনে বর্ণিত আহলুয যিকর নন-

) فسئلوا اهل الذكر ان كنتم لا تعلمون(

যদি তোমরা না জান তাহলে যারা জানে তাদেরকে জিজ্ঞেস কর। ৫৫

সূরা নিসার ১১৫ নং আয়াতে যে মুমিনদের বিবরণ দেয়া হয়েছে তাঁরাই কি সেই মুমিনীন নন? বলা হয়েছে- যে কেউ সত্য প্রকাশিত হবার পর নবীর বিরুদ্ধাচারণ করবে ও মুমিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ গ্রহণ করবে আমরা তাদেরকে সেই পথেই পরিচালিত করবো এবং অবশেষে জাহান্নামে প্রবেশ করাবো। ৫৬

তাঁরাই কি সেই ব্যক্তিবর্গ নন যারা আল্লাহর দিকে মানুষদের হেদায়েত করেন। যেমন সূরা রাদের ৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

) انما انت منذر و لكل قوم هاد(

নিশ্চয়ই আপনি কেবল ভয় প্রদর্শনকারী এবং প্রত্যেক জাতি ও গোত্রের জন্যই হেদায়েতকারী রয়েছে। ৫৭

এরাই কি সেই ব্যক্তিবর্গ নন যাঁদেরকে মহান আল্লাহ্ নিয়ামত দান করেছেন?

সূরা ফাতিহা যার অপর নাম হলো সাবয়ুল মাছানী এবং কোরআনে সেই সূরাতে আমাদের সরল সঠিক পথে ও যাদের প্রতি আপনি নিয়ামত দান করেছেন তাদের পথে পরিচালিত করুন বলতে কাদের পথকে বুঝানো হয়েছে?৫৮

সূরা নিসার ৬৯ নং আয়াতে মহান আল্লাহ্ বলেছেন,

যে কেউ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে,সে কিয়ামতের দিন তাঁদের সঙ্গে থাকবে যাঁদের ওপর আল্লাহ্ তাঁর নিয়ামতকে সম্পূর্ণ করেছেন,(তাঁরা হলেন) নবী,সিদ্দীক,শহীদ ও সৎ কর্মশীল বান্দাগণ।

নিঃসন্দেহে আহলে বাইতের ইমামগণ সিদ্দীক,শহীদ ও সালেহীনদের অন্তর্ভুক্ত। তবে কি আল্লাহ্ সর্বসাধারণের সার্বিক নেতা হিসেবে তাঁদেরকেই মনোনীত করেন নি? নবীর পরবর্তীতে মুসলমানদের নেতৃত্ব দানের ও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব শুধু তাঁদের জন্যই নির্ধারিত করেন নি?

যদি বিষয়টি না জানেন তবে দেখুন-

নিশ্চয়ই তোমাদের ওয়ালী (অভিভাবক) হলেন শুধু আল্লাহ্,তাঁর রাসূল এবং যারা ঈমান আনে,নামায কায়েম করে এবং রুকুরত অবস্থায় যাকাত দেয়। যারা আল্লাহ্,তাঁর রাসূল ও ঈমানদারদের অভিভাবকত্বকে মেনে নেয় তারাই জয়ী হবে,কারণ আল্লাহর দলই বিজয়ী হবে।৫৯  

মহান আল্লাহ্ ক্ষমা ও মাগফেরাতের শর্ত হিসেবে তওবা,ঈমান আনা,সৎ কর্ম করা ও আহলে বাইতের ইমামদের নেতৃত্বকে মেনে নেয়ার বিষয়টিকে উল্লেখ করেছেন যেমনটি সূরা ত্বহার ৮২ নং আয়াতে এসেছে-

আমি আমার ক্ষমাকে তওবার মাধ্যমে প্রত্যাবর্তন,ঈমান আনয়ন,সৎ কর্ম সম্পাদন এবং হেদায়েত প্রাপ্তির৬০ মধ্যেই রেখেছি (অর্থাৎ তারাই ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে যারা তওবা করেছে,ঈমান আনয়ন করেছে,সৎ কর্ম সম্পাদন করেছে এবং হেদায়েতপ্রাপ্ত হয়েছে)।

তাহলে তাঁদের বেলায়েত কি একটি আমানত নয় যা সূরা আহযাবের ৭২ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

আমরা আমানতকে আসমান,যমীন ও পর্বতের নিকট পেশ করেছিলাম কিন্তু তারা তা গ্রহণে অক্ষমতা প্রকাশ করেছিল এবং তারা বোঝা বহনের ভয় করছিল কিন্তু মানুষ তা গ্রহণ করেছিল। কারণ মানুষ (নিজের প্রতি) অত্যাচারী এবং অজ্ঞ।৬১  

তাঁদের (আহলে বাইতের) বেলায়েত ও অভিভাবকত্বকেই আল্লাহ্ কোরআনেسِلْمٌ (সিল্ম) বলে উল্লেখ করেছেন এবং সেখানে প্রবেশের জন্য সকলকে নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন, হে ঈমানদারগণ,সকলেই সমবেতভাবে সিল্ম বা শান্তি ও মুক্তির মধ্যে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। ৬২

তাঁদের বেলায়েত বা অভিভাবকত্বকেই কি মহান আল্লাহ্ কোরআনেنعيم (নাঈম) বলে উল্লেখ করেন নি যে বিষয়ে কিয়ামতের দিন প্রশ্ন করা হবে( ثم لتسئلن يومئذ عن النعيم )৬৩

রাসূল (সা.) কি তাঁদের বেলায়েতকে ঘোষণার জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন নি? এবং এ বিষয়ে রাসূলকে প্রদত্ত নির্দেশ অনেকটা রাসূলকে ভীতি প্রদর্শনের মত ছিল,নয় কি? যেখানে আল্লাহ্ বলেছেন,

হে রাসূল!যা আপনার প্রতিপালকের পক্ষ হতে আপনার ওপর অবতীর্ণ হয়েছে তা পূর্ণাঙ্গরূপে পৌঁছান। যদি তা না করেন আপনি আপনার রেসালতের দায়িত্বই পালন করেন নি এবং আল্লাহ্ আপনাকে মানুষ হতে (সম্ভাব্য বিপদ হতে) রক্ষা করবেন। ৬৪

রাসূল (সা.) গাদীর দিবসে এ বাণী প্রচারের জন্য কি ব্যাপক পদক্ষেপ নেন নি? পরিষ্কার ভাষায় পূর্ণাঙ্গরূপে বিষয়টিকে উপস্থাপন করেন নি? মহান আল্লাহ্ তখনই সূরা মায়েদার এ আয়াত নাযিল করেন- আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামতকে সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের মনোনীত দীন হিসেবে গ্রহণ করলাম। ৬৫

তাহলে কি আপনি জানেন না মহান আল্লাহ্ ঐ ব্যক্তি যে তাঁদের (আহলে বাইতের) বেলায়েত ও নেতৃত্বকে সরাসরি অস্বীকার করেছিল এবং নবীর সঙ্গে এ বিষয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিল তার সঙ্গে কিরূপ আচরণ করেছেন? ঐ ব্যক্তি চিৎকার করে বলেছিল, হে আল্লাহ্! যদি এটি সত্য ও আপনার পক্ষ হতে হয়ে থাকে,তবে আসমান হতে আমার ওপর পাথর বর্ষণ করুন এবং আজাব নাযিল করুন। আল্লাহ্পাক ঐ ব্যক্তিকে হস্তীবাহিনীর ন্যায় ধ্বংস করেন। তখনই এক ব্যক্তি চাইল সেই আজাব সংঘটিত হোক যা অবধারিত কাফিরদের জন্য এবং যার প্রতিরোধকারী কেউ নেই এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।৬৬ (*১৪)

অতিশীঘ্রই পুনরুত্থান দিবসে আহলে বাইতের বেলায়েত ও নেতৃত্বের বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে যেমনটি সূরা সাফ্ফাতের ২৪ নং আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছে( وقفوهم إنّهم مسئولون )’ এবং তাদেরকে থামাও,তারা জিজ্ঞাসিত হবে।৬৭ এটি আশ্চর্যের বিষয় নয় কারণ তাঁদের নেতৃত্ব ও বেলায়েত এমন একটি বিষয় যা ঘোষণার জন্য সকল নবীর আগমন ঘটেছে এবং তাঁরা বিশ্বে আল্লাহর সর্বোত্তম নিদর্শন। নবীদের স্থলাভিষিক্ত ওলী ও ঐশী প্রতিনিধিগণ মানুষের কাছে এ সত্যটি প্রকাশ করে গিয়েছেন,যেমন সূরা যুখরুফের ৪৫ নং আয়াতে এসেছে-

) وأسأل من أرسلنا من قبلك من رسلنا(

তোমার পূর্বে আমাদের রাসূলদের মধ্য থেকে যাদের প্রেরণ করেছিলাম তাদের নিকট এ বিষয়ে প্রশ্ন কর।৬৮

আহলে বাইত সম্পর্কে এ প্রতিশ্রুতি আল্লাহ্পাক আমি কি তোমাদের প্রভু নই -এর প্রতিশ্রুতি থেকেই গ্রহণ করেছেন যা সূরা আ রাফের ১৭২ নং আয়াতের তাফসীরে বর্ণিত হয়েছে।(*১৫) আয়াতটি হলো : আল্লাহ্ বনি আদম হতে তার জন্মের পূর্বে এ প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন (তার পৃষ্ঠদেশ হতে তাদের বের করে তাদের নিজেদের ওপর সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন) যে,আমি কি তোমাদের প্রভু নই? তারা বলল,হ্যাঁ। এ বিষয় আহলে সুন্নাহর হাদীসসমূহেও উল্লিখিত হয়েছে।

এবং আদম তাঁর স্রষ্টা হতে কয়েকটি বাক্য প্রাপ্ত হলেন,তার মাধ্যমে ক্ষমা চাইলেন এবং আল্লাহ্ তাঁর তওবাকে গ্রহণ করলেন। ৬৯

তাঁদের সম্পর্কে আল্লাহ্পাক বলেছেন, আল্লাহ্ তাদের (এ উম্মতকে) আজাব দান করবেন না যখন তুমি তাদের মধ্যে বর্তমান। ৭০

পৃথিবীর অধিবাসীদের জন্য তাঁরা নিরাপত্তাস্থল এবং আল্লাহর শাস্তি হতে বাঁচার মাধ্যম। তাঁরাই যে তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বের কারণে অন্যদের হিংসার পাত্র তা সূরা নিসার ৫৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে, মানুষকে (নবী ও তার পরিবারবর্গকে) আল্লাহ্ তাঁর নিয়ামত হতে যা দান করেছেন তারা তার প্রতি হিংসা করে। ৭১

তাঁদের বিষয়েই আল্লাহ্ বলেছেন, জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিবর্গ বলে : আমরা ঈমান এনেছি। ৭২

আমাদের জানা উচিত আ রাফের ব্যক্তিবর্গ তাঁরাই। এজন্য আল্লাহ্পাক বলেছেন, এবং আ রাফে একদল ব্যক্তি রয়েছেন যাদের চেহারা দেখে সবাই চিনবে। ৭৩

তাঁরাই আল্লাহ্ বর্ণিত সত্যবাদী ও প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী ব্যক্তিবর্গ। কোরআন বলেছে, মুমিনদের মধ্যে একদল লোক রয়েছে তারা আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পালন করেছে,তাদের একদল দায়িত্ব সম্পন্ন করেছে (শহীদ হয়েছে) এবং অপর দল অপেক্ষমান রয়েছে (তাদের সাথে মিলিত হবার),তারা তাদের সংকল্প কখনোই পরিবর্তন করে নি। ৭৪

তাঁদেরকেই আল্লাহ্ তাঁর গুণকীর্তনকারী বলে বর্ণনা করেছেন- আল্লাহ্ যে সকল গৃহকে মর্যাদায় উন্নীত করার এবং সেগুলোতে তাঁর নাম উচ্চারণ করার আদেশ দিয়েছেন,সেখানে (একদল লোক) সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। এমন লোকেরা,যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে,নামায কায়েম ও যাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখতে পারে না। তারা ভয় করে সেই দিনকে যেদিন অন্তর ও দৃষ্টিসমূহ উল্টে যাবে। ৭৫

তাদের ঘরসমূহ হলো সেই ঘরসমূহ যার সম্পর্কে আল্লাহ্পাক বলেছেন, আল্লাহ্ যেসব গৃহকে মর্যাদায় উন্নীত করার এবং যেগুলোতে তাঁর নাম উচ্চারণ করার আদেশ দিয়েছেন। ৭৬

তাঁদের সম্পর্কেই মহান আল্লাহ্ সূরা নূরের ৩৫ আয়াতে বলেছেন, তাদের উদাহরণ হলো কুলঙ্গি এবং তাদের অস্তিত্ব আমারই নূরের অস্তিত্ব।৭৭ অথচ আল্লাহর জন্য আসমান ও জমীনে সর্বোত্তম উদাহরণ বিদ্যমান এবং তিনি ক্ষমতাশালী ও প্রজ্ঞাবান।

তাঁরা আল্লাহ্ বর্ণিত অগ্রবর্তী নৈকট্যপ্রাপ্ত দল যেমনটি এ আয়াতে বলা হয়েছে-

( السّابقون السّابقون أولَائك المقرّبون)

অর্থাৎ অগ্রবর্তীগণ তো অগ্রবর্তীই,তারাই নৈকট্যশীল।৭৮

এবং সত্যবাদী,শহীদ,সাক্ষ্য প্রদানকারী এবং সৎ কর্মশীল বলতে তাঁদেরই বোঝানো হয়েছে।৭৯

আহলে বাইত এবং তাঁদের ইমামগণ সম্পর্কেই আল্লাহ্পাক বলেছেন,

( وممن خلقنا أمة يهدون بالْحقّ و به يعدلون)

আর যাদেরকে আমি সৃষ্টি করেছি তাদের মধ্যে একদল রয়েছে যারা সত্যের দিকে মানুষকে হেদায়েত করে (পথ দেখায়) এবং সে অনুযায়ী ন্যায়বিচার করে। ৮০

আহলে বাইতের অনুসারী এবং বিরোধী ও শত্রুদের সম্পর্কেই এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে-

( لا يستوي أصحاب النّار و أصحاب الْجَنَّة أصحاب الْجَنَّة هم الفائزون)

জাহান্নামের অধিবাসী এবং জান্নাতের অধিবাসীগণ সমান হতে পারে না। জান্নাতের অধিবাসীরাই সফলকাম।৮১

তাঁদের পক্ষের ও বিপক্ষের দল সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেছেন,

( أم نجعل الّذين آمنوا و عملوا الصّالِحات كالمفسدين في الأرض أم نجعل المتّقين كالفجّار)

আমি কি বিশ্বাসী ও সৎ কর্মশীলদেরকে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কাফেরদের সমতুল্য করে দেব,না খোদাভীরুদেরকে পাপাচারীদের সমান করে দেব? ৮২  

এই দু দল সম্পর্কে অন্যত্র বলেছেন,

( أم حسب الّذين اجترحوا السيّئات أن نجعلهم كالذين آمنوا و عملوا الصّالِحات سواء محياهم و مَماتُهم ساء ما يحكمون)

যারা দুষ্কর্ম উপার্জন করেছে তারা কি মনে করে আমি তাদেরকে সে লোকদের মত করে দেব যারা ঈমান আনে ও সৎ কর্ম করে ও তাদের জীবন ও মৃত্যু কি সমান হবে? ৮৩

আহলে বাইত ও তাঁদের অনুসারীদের সম্পর্কেই কোরআনে বলা হয়েছে-

( إنّ الّذين آمنوا و عملوا الصّالِحات أولَائك هم خيرُ البريّة)

যারা ঈমান এনেছে ও সৎ কর্ম করেছে তারাই শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি।৮৪

আহলে বাইত ও তাঁদের শত্রুদের সম্পর্কে কোরআনে বলা হয়েছে-

এই দু বাদী-বিবাদী,তারা তাদের পালনকর্তা সম্পর্কে বিতর্ক করে। অতএব,যারা কাফির তাদের জন্য আগুনের পোষাক তৈরী করা হয়েছে। তাদের মাথার ওপর ফুটন্ত পানি ঢেলে দেয়া হবে।৮৫

এবং আহলে বাইত ও তাঁদের শত্রুদের সম্পর্কেই এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে- মুমিন কি কখনো ফাসেকের মত হতে পারে? তারা সমান নয়। কিন্তু যারা ঈমান এনেছে ও সৎ কর্ম করেছে তাদের বাসস্থান হলো চিরস্থায়ী জান্নাত তাদের সৎ কর্মের বিনিময়স্বরূপ আর যারা গুনাহ করেছে তারা তাদের বাসস্থানকে জাহান্নামের মধ্যে প্রস্তুত করেছে। যখনই তারা চাইবে তা হতে বের হতে,তাদেরকে জোরপূর্বক ফিরিয়ে দেয়া হবে ও বলা হবে,যে জাহান্নামকে অস্বীকার করতে তার স্বাদ আস্বাদন কর।৮৬

অন্যত্র ঐ সকল ব্যক্তিবর্গ যারা হাজীদের পানি পান করানো ও কাবা শরীফের খাদেম হওয়ার কারণে অহংকার ও গর্ব পোষণ করতো তাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, তোমরা কি হাজীদের পানি সরবরাহ ও মসজিদুল হারাম আবাদকরণকে সেই লোকের সমান মনে কর যে ঈমান রাখে আল্লাহ্ ও শেষ দিনের প্রতি এবং যুদ্ধ করে আল্লাহর পথে? এরা আল্লাহর দৃষ্টিতে সমান নয়,আর আল্লাহ্ জালেম লোকদের হেদায়েত করেন না। ৮৭

তেমনিভাবে আল্লাহ্পাক আহলে বাইতের বিভিন্ন কঠিন পরীক্ষায় সফলতার কথা কোরআনে বর্ণনা করেছেন-

( و من النّاس من يشري نفسه ابتغاء مرضات الله و الله رءوف بالعباد)

এবং মানুষের মধ্যে একদল লোক আছে যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির বিনিময়ে নিজেদের জীবনকে বিক্রয় করে এবং আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু।৮৮

অন্যত্র বলেছেন, আল্লাহ্ মুমিনদের জীবন ও সম্পদকে বেহেশতের বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়েছেন। তারা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে,হত্যা করে ও নিহত হয়। এ প্রতিশ্রুতি সত্য ও অবশ্যম্ভাবী যা তাওরাত,ইঞ্জিল ও কোরআনে এসেছে- এবং আল্লাহ্ হতে কে অধিক ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী?

সুতরাং তোমরা আনন্দিত হও সে লেনদেনের ওপর যা তোমরা আল্লাহর সঙ্গে করেছ। তারা (এ মুমিনগণ) তওবাকারী,ইবাদতকারী,কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী,দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদকারী,রুকু ও সিজদাকারী,সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধকারী,আল্লাহর দেয়া সীমাসমূহের হেফাজতকারী। (সূরা তওবা : ১১১ ও ১১২)

যারা স্বীয় ধনসম্পদ ব্যয় করে (দান করে) রাত্রে ও দিনে,গোপনে ও প্রকাশ্যে। তাদের জন্য তাদের সওয়াব তাদের পালনকর্তার নিকট সংরক্ষিত। তাদের কোন আশঙ্কা নেই এবং তারা

চিন্তিতও হবে না। (বাকারা : ২৭৪)৮৯

তাঁরাই সত্যকে সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দিয়েছেন। আল্লাহ্ তার সাক্ষ্য প্রদান করে বলেছেন, যারা সত্য নিয়ে আগমন করেছে ও সত্যকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে,তারাই তো খোদাভীরু ও মুত্তাকী (পরহেজগার)।৯০

সুতরাং তাঁরাই রাসূল (সা.)-এর গোত্রের সর্বোচ্চ নিষ্ঠাবান এবং তাঁর সবচেয়ে নিকটাত্মীয় যাঁদের মহান আল্লাহ্ তাঁর বিশেষ অনুগ্রহের অন্তর্ভুক্ত করে বলেছেন,

( و أنذر عشيرتك الأقربين )“ এবং তোমার নিকটাত্মীয়দের ভীতি প্রদর্শন কর। এবং তাঁরাই কোরআনে বর্ণিত উলুল আরহাম বা নিকটাত্মীয় যেমনটি বলা হয়েছে সূরা আনফালের ৭৫ নং আয়াতে( أولوا الأرحام بعضهم أولى ببعض ) অর্থাৎ বস্তুত যারা নিকটাত্মীয় তারা পরস্পর অধিক হক্বদার এবং এদের সম্পর্কেই কোরআনে বলা হয়েছে তাঁদের মর্যাদা কিয়ামতের দিন বাড়িয়ে দেয়া হবে এবং নবীর সঙ্গে মিলিত হয়ে জান্নাতুন নাঈমে অবস্থান করবেন। এর প্রমাণ কোরআনের এ আয়াত যাতে বলা হয়েছে-

যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের পরিবার ও বংশের যারা তাদের (ঈমানের ক্ষেত্রে) অনুসরণ করেছে সেই বংশধরদেরও আমি তাদের সাথে মিলিত করে দেব এবং তাদের আমল হতে কিছুই কম করা হবে না। ৯১

তাঁরাই সেই ব্যক্তিবর্গ যাঁদের অধিকারকে আল্লাহ্ আদায় করতে বলেছেন-

وآت ذا القربىحقّه অর্থাৎ নিকটাত্মীয়দের অধিকার আদায় কর। তাঁরাই খুমসের অধিকারী যা আদায় না করলে তাঁদের হক্ব আমাদের ওপর কিয়ামতের দিনও থেকে যাবে- জেনে রাখো,তোমরা যা কিছু অর্জন কর,তার এক পঞ্চমাংশ আল্লাহ্,তাঁর রাসূল এবং তাঁর নিকটাত্মীয়,ইয়াতীম,অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরদের.। (সূরা আনফাল : ৪১)

তাঁরা ফাই সম্পদেরও অধিকারী কারণ আল্লাহ্ বলেছেন, যা মহান আল্লাহ্ জনপদবাসীদের কাছ থেকে রাসূলকে দিয়েছেন তা আল্লাহর,রাসূলের,তাঁর আত্মীয়-স্বজনের,ইয়াতিমদের,অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরদের। (সূরা হাশর : ৭)

নবীর আহলে বাইতকে সম্বোধন করে আল্লাহ্ বলেছেন,

( إنّما يريد الله ليذهب عنكم الرّجس أهل البيت و يطهّركم تطهيرا)

হে আহলে বাইত! নিশ্চয়ই আল্লাহ্ চান তোমাদের হতে পাপ পঙ্কিলতা দূরীভূত করতে ও সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে। (সূরা আহযাব : ৩৩)

তাঁদেরকেই আল্লাহ্ আলে ইয়াসিন বলে সম্বোধন করে সালাম দিয়েছেন-و سلام على الياسين অর্থাৎ আলে ইয়াসিনের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।৯২ (সূরা সাফ্ফাত : ১৩০)

তাঁরাই রাসূলের বংশধর যাঁদের ওপর দরূদ পড়াকে আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের জন্য নামাযে ওয়াজিব করেছেন-

﴿ إنّ الله و ملائكته يصلّون على النَّبِيّ يا أيّها الّذين آمنوا صلّوا عليه و سلّموا تسليما

নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর ওপর দরূদ পড়েন,হে ঈমানদারগণ! তোমরাও রাসূলের ওপর দরুদ পাঠ কর।৯৩

সাহাবীরা প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনার ওপর সালাম কিরূপে পাঠ করতে হবে জানি কিন্তু দরূদ কিরূপে পড়ব? রাসূল (সা.) বললেন, আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিও ওয়া আলা আলে মুহাম্মাদ অর্থাৎ হে আল্লাহ্! মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর বংশধরদের ওপর রহমত বর্ষণ কর।

এ হাদীস হতে বুঝা যায় আহলে বাইতের ওপর দরূদ পাঠও এই আয়াতের নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত। এ কারণেই আলেমগণ এই আয়াতকে আহলে বাইতের শানে বর্ণিত আয়াতের অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং ইবনে হাজার আসকালানী তাঁর আসসাওয়ায়েক গ্রন্থের ১১ অধ্যায়েও তাই করেছেন।৯৪

طوبى لهم তাদের জন্যই সুসংবাদ ও তাদের জন্যই চিরস্থায়ী বেহেশত এবং তার দ্বারগুলো উন্মুক্ত রয়েছে।৯৫

আরব কবি বলেছেন,

من يباريهم و في الشّمس معنى؟ مجهد متعب لمن باراها

কে পারে তাঁদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে অর্থাৎ সূর্যের সাথে যে প্রতিযোগিতা করে তার ওপরই ক্লান্ত ও শ্রান্তের অর্থ বর্তায় (অর্থাৎ সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে)।

আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে তাঁরা মনোনীত,আল্লাহর অনুমতিক্রমে পুণ্যকর্মে তাঁরা অন্যদের হতে অগ্রগামী। তাঁরা আল্লাহর কিতাবের উত্তরাধিকারী এবং তাঁদের সম্পর্কেই আল্লাহ্ বলেছেন,

অতঃপর কিতাবকে (আল কোরআন) তাঁর বান্দাদের মধ্যে মনোনীত ব্যক্তিদের হাতে সমর্পণ করলাম। আর বান্দাদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের ওপর জুলুম করেছে এবং তারা ইমামদের নেতৃত্বকে মেনে নেয় নি।

তাদের (বান্দাগণের) অনেকেই মধ্যপন্থী ও ন্যায়পরায়ণ এবং তারা আহলে বাইতের প্রতি ভালবাসা পোষণকারী। যেমন কোরআনে এসেছে-

এবং তাদের অনেকেই পুণ্যকর্মে অগ্রগামী হয়েছে এবং তারাই ইমাম। এটি একটি বড় নিয়ামত।৯৬

আহলে বাইতের ফজীলত বর্ণনা করে যে সকল আয়াত এসেছে তা বর্ণনার জন্য এ পর্যন্তই যথেষ্ট বলে মনে করেছি। তবে আপনার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি হযরত আলী (আ.)-এর শানে কোরআনে ৩০০ আয়াত বর্ণিত হয়েছে।৯৭

অন্য আরেকজন তাফসীরকারক বলেছেন, কোরআনের এক চতুর্থাংশ আয়াত আহলে বাইতের শানে বর্ণিত হয়েছে এবং এটি আশ্চর্যের কোন বিষয় নয়,কারণ আহলে বাইত ও কোরআন একই সত্তার দুই অংশ।

এখন পর্যন্ত যে সমস্ত স্পষ্ট আয়াত আপনার নিকট বর্ণনা করলাম তা কোরআনের মূল ও ভিত্তি( هُنَّ أُمُّ الْكِتَاب ) । এ আয়াতগুলো খুব সহজে গ্রহণ করুন (মেনে নিন)। আর ভক্তি ও উদারতার সাথে সূক্ষ্মভাবে এসব আয়াত অধ্যয়ন করুন এবং এসব আয়াত সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাবান মহান আল্লাহর বাণী হতে গ্রহণ করুন যে সম্পর্কে অন্য কোন জ্ঞানী ব্যক্তি আপনাকে অবগত করবে না।

ওয়াসসালাম


6

7

8

9

10

11

12