প্রভুর বিচারব্যবস্থার বহিঃপ্রকাশ এবং পারস্পরিক সম্পর্কোচ্ছেদ :
ঐ জগতে সকল বাস্তবতা স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হবে
এবং প্রভুর শাসন ব্যবস্থা ও রাজত্ব চূড়ান্ত রূপ ধারণ করবে
আর সৃষ্টির উপর এমন আতংকের ছায়া নেমে আসবে যে,কারোই উচ্চবাচ্য করার কোন সামর্থ্য থাকবে না ।
প্রত্যেকেই নিজ নিজ অদৃষ্টের চিন্তায় ব্যস্ত থাকবে এবং এমনকি সন্তানরা পিতা-মাতা থেকে,নিকটজন ও আত্মীয়-স্বজন পরস্পর থেকে পলায়ন করবে ।
মূলত: আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন হবে
এবং পার্থিবলাভ ও শয়তানী মানদণ্ডের ভিত্তিতে যে সকল বন্ধন স্থাপিত হয়েছিল,সে সকল সম্পর্ক শত্রুতায় পরিণত হবে ।
ইতিপূর্বে কৃত অপরাধের জন্যে অনুতাপ ও অনুশোচনায় হৃদয় আবিষ্ট হবে ।
প্রভুর ন্যায়দণ্ড :
অতঃপর প্রভুর ন্যায়দণ্ডভিত্তিক বিচারালয় রূপ লাভ করবে এবং সকল বান্দাদের কৃতকর্ম উপস্থিত হবে
,আমলনামাসমূহ বিতরণ করা হবে
,কোন কর্তার কৃতকর্ম এতটা সুস্পষ্ট যে,কাউকে জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন হবে না যে,কী করেছে ?
এ বিচারালয়ে ফেরেশতাগণ,নবীগণ ও আল্লাহর নির্বাচিতগণ সাক্ষীরূপে উপস্থিত হবেন ।
এমনকি মানুষের হস্ত,পদ এবং ত্বকও সাক্ষ্য প্রদান করবে ।
সকল মানুষের হিসাব পুঙ্খানুপঙ্খ রূপে ও প্রভুর ন্যায়দণ্ডের ভিত্তিতে পরিমাপ করা হবে
এবং ন্যায় ও আদলের ভিত্তিতে তাদের বিচার করা হবে ।
প্রত্যেকেই তার চেষ্টা ও শ্রমের ফল লাভ করবে ।
সৎজনকে তার কর্মের দশগুণ বেশী পুরস্কার প্রদান করা হবে
এবং কেউই কারও বোঝা বহন করবে না।
কিন্তু যারা অন্যান্যদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে,তারা নিজেদের পাপ ছাড়াও পথভ্রষ্টদের পাপও স্বীয় স্কন্ধে ধারণ করবে ।
(তাদের পাপ লাঘব তো হবেই না) উপরন্তু তাদের নিকট থেকে (তাদের পাপকর্মের পরিবর্তে) কোন বিনিময় গ্রহণ করা হবে না
এবং (তাদের জন্যে) কারও সুপারিশ গ্রহণ করা হবে না ।
কেবলমাত্র তাদের সুপারিশই গ্রহণ করা হবে,যারা মহান আল্লাহর অনুমতি প্রাপ্ত হবেন এবং তারা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির মানদণ্ডের ভিত্তিতে শাফায়াত করবেন ।
অনন্ত জীবনের পথে :
অতঃপর আল্লাহর আদেশ ঘোষণা করা হলে
সৎকর্ম সম্পাদনকারী ও অন্যায়কারীরা পরস্পর থেকে পৃথক হয়ে যাবে।
বিশ্বাসীগণ আনন্দিত ও হাস্যেজ্জ্বল বদনে বেহেশতে
এবং অবিশ্বাসীরা অপমানিত,লাঞ্ছিত ও মলিনবদনে দোযখের পথে যাত্রা করবে ।
সকলেই দোযখের পথ অতিক্রম করবে ।
তবে বিশ্বাসীগণের বদন থেকে জ্যোতি নির্গত হবে এবং স্বীয় পথকে উজ্জ্বল করবে
আর কাফের ও মুনাফিকরা অন্ধকারে পতিত হবে।
যে মুনাফিকরা পৃথিবীতে মু’
মিনদের সাথে মিশে ছিল,তারা মু’
মিনগণের নিকট তাদের দিকে ফিরে তাকাতে ফরিয়াদ করবে,যাতে তাদের জ্যোতি ব্যবহার করে মুক্তির পথ খুজে বের করতে পারে। মু’
মিনদের পক্ষ থেকে জবাব দেয়া হবে“
জ্যোতি লাভ করতে পশ্চাতে (পৃথিবীতে) ফিরে যাও! মুনাফিকরা বলবে : আমরা কি পৃথিবীতে তোমাদের সাথে ছিলাম না ? জবাবে বলা হবে : কেন,তবে বাহ্যিকভাবে আমাদের সাথে ছিলে। কিন্তু নিজেদেরকে পরিবেষ্টিত করেছিলে এবং তোমাদের অন্তরগুলো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও নির্মমতায় জড়িয়ে পড়েছিল। আর অদ্য তোমাদের সকল ক্রিয়া নিষ্পন্ন হয়ে গিয়েছে এবং তোমাদের থেকে ও কাফেরদের থেকে (শাস্তির) বিকল্প হিসেবে কিছুই গ্রহণ করা হবে না। অবশেষে কাফের ও মুনাফিকদেরকে নরক গহ্বরে নিক্ষেপ করা হবে।
যখন বিশ্বাসীগণ বেহেশতের নিকটবর্তী হবে তখন এর দ্বারগুলো খুলে যাবে এবং রহমতের ফেরেশতারা তাদেরকে স্বাগতম জানাতে আসবে। তারা সম্মান ও সালামের সাথে তাদেরকে (মু’
মিনগণকে) অনন্তসৌভাগ্যের সুসংবাদ দিবে
অপরদিকে যখন কাফের ও মুনাফিকরা দোযখের নিকটবর্তী হবে,তখন এর দ্বারগুলোও খুলে যাবে এবং আযাবের ফেরেশতারা তাদেরকে রূঢ়তাসহকারে ভর্ৎসনা করবে। তারা (আযাবের ফেরেশতারা) অনন্তশাস্তির প্রতিশ্রুতি দিবে।
বেহেশত :
বেহেশতে বিস্তৃত কাননসমূহ,প্রশস্ত আকাশসমূহের ছায়ায়,বিস্তৃত ভূমির উপর অবস্থান করবে,
যে গুলোতে নানাবিধ বৃক্ষরাজি,সকল প্রকার পরিপক্ক ফল (বেহেশতবাসীর) নাগালের মধ্যে অবস্থান করবে।
আর থাকবে আড়ম্বরপূর্ণ ইমারতসমূহ
,স্বচ্ছ পানি
এবং পবিত্র পেয়,দুগ্ধ ও মধুর ঝর্ণাধারা ।
এ ছাড়া যা কিছুই বেহেশতবাসীর কাংখিত,
বরং তাদের যাঞ্চারও অধিক বৈভবে পরিপূর্ণ থাকবে ঐ বেহেশত ।
বেহেশতবাসীগণ বিভিন্ন প্রকার সৌন্দর্য ও চিত্রাংকিত মসৃন রেশমী পোশাকে সজ্জিত হয়ে
মণিমুক্তা খচিত আরামদায়ক সুকোমল সজ্জায় পরস্পরের মুখোমুখী অবস্থানে হেলান দিয়ে বসে থাকবে
এবং প্রভুর প্রশংসা ও তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে ।
অনর্থক কোন কথা বলবে না বা শুনবে না ।
হিমেল বা তপ্ত বাতাস কোনটিই তাদেরকে কষ্ট দিবে না ।
তাদের থাকবে না কোন দুর্ভোগ,ক্লান্তি ও বিষাদ
কিংবা থাকবে না কোন ভয় ও বেদনা
অথবা থাকবে না তাদের কোন হিংসা বা ক্রোধ।
সুদর্শন সেবকগণ তাদের চারপাশে পরিভ্রমণরত থাকবে ।
স্বর্গীয় সুন্দর পানপাত্র থেকে তাদেরকে পান করানো হবে,যা তাদের বর্ধিত আনন্দ ও উপভোগের কারণ হবে এবং কোন প্রকার র্দুদৈবই তাদেরকে স্পর্শ করবে না ।
নানাবিধ ফল-মূল ও পাখীর মাংস তারা ভক্ষণ করবে ।
নিষ্কলুষ অপরূপ সুদর্শনা ও দয়াশীলা সঙ্গীগণের কোমল স্পর্শে তারা হবে ধন্য ।
সবকিছুর উর্ধ্বে তারা প্রভুর পক্ষ থেকে আত্মিক তুষ্টির মত নেয়ামতের অধিকারী হবে ।
তারা তাদের প্রভুর করুণা ও দয়ায় ধন্য হবে,যা তাদেরকে মহার্ঘ্যে নিমজ্জিত করবে এবং কারও পক্ষেই সে আনন্দের সীমা নির্ধারণ করা সম্ভব নয় ।
আর এ অতুলনীয় সৌভাগ্য,অবর্ণনীয় বৈভব এবং প্রভুর অনুগ্রহ,তুষ্টি ও সান্নিধ্য সর্বদা সেথায় বিরাজ করবে
,যা কখনোই শেষ হবে না ।
দোযখ :
দোযখ সে সকল কাফের ও মুনাফিকদের আবাসস্থল,যাদের অন্তরে ঈমানের কোন প্রকার জ্যোতিরই অস্তিত্ব নেই ।
আর এ দোযখের ধারণক্ষমতা এত বেশী যে,সমস্ত অন্যায়কারীদেরকে ধারণ করার পরও বলবে‘
هذا من مزید
’
অর্থাৎ আরও আছে কি ?
সেথায় আছে শুধু আগুন আর আগুন,শাস্তি আর শাস্তি !
আগুনের লেলিহান শিখাগুলো সবদিক থেকে (জাহান্নামীদেরকে) গ্রাস করবে। আর কর্ণবিদারী,ক্রোধানিত গর্জনে দোযখবাসীর ভয়-ভীতির মাত্রা বৃদ্ধি পাবে ।
কদাকার,ভগ্ন কৃষ্ণকায়,কুৎসিৎ চেহারার এ দোযখবাসীরা এমন কি দোযখের ফেরেস্তাদের চেহারায়
ও কোন প্রকার দয়া করুনা ও নমনীয়তার ছোঁয়া দেখতে পাবে না ।
নরকবাসীরা লোহার গলাবন্ধ,জিঞ্জির দ্বারা বাঁধা থাকবে ।
আগুন তাদের আপদমস্তক গ্রাস করবে
এবং স্বয়ং তারাই সে আগুনের ইন্ধন হবে ।
নরকের এহেন পরিবেশে নরকবাসীদের ক্রন্দন,চিৎকার,আহাজারী এবং নরক প্রহরীদের হুংকার ব্যতীত কিছুই শুনতে পাওয়া যাবে না।
পাপীদের আপদমস্তকে ফুটন্ত পানি ঢালা হবে। ফলে তাদের দেহের অভ্যন্তরভাগও গলে যাবে ।
যখনই পিপাসার প্রচণ্ডতা ও প্রদাহে পানি প্রার্থনা করবে তখনই উত্তপ,কলুষিত ও দুর্গন্ধময় পানি তাদেরকে প্রদান করা হবে,যা তারা গোগ্রাসে পান করবে ।
তাদের খাবার হবে যাক্কুম বৃক্ষের ফল,যা আগুন থেকে জন্ম গ্রহণ করে। আর এ ফল ভক্ষণে তাদের অভ্যন্তরের যন্ত্রণা অধিকমাত্রায় বৃদ্ধি পাবে।
তাদের পোশাক হবে এক প্রকার কৃষ্ণকায় পদার্থ থেকে তৈরীকৃত,যা আঠালো এবং তাদের দুর্ভোগবৃদ্ধির কারণ হবে ।
তাদের সঙ্গী হবে শয়তান ও পাপিষ্ঠ জীনরা যাদের কাছ থেকে তারা পলায়ন করতে চাইবে ।
আর তারা পরস্পর পরস্পরকে অভিশাপ ও অভিসম্পাত করবে ।
যখনই তারা মহান আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতে চাইবে,তখন দূর হও,চুপ কর,ইত্যাদি বাক্য দ্বারা তাদেরকে স্তব্ধ করে দেয়া হবে ।
অতঃপর দোযখের প্রহরীদের শরণাপন্ন হয়ে বলবে যে ,তোমরা আল্লাহর কাছে চাও,যাতে আমাদের শাস্তি কিছুটা হ্রাস করে।”
উত্তরে শ্রবণ করবে : মহান আল্লাহ কি নবীগনকে (আ.) প্রেরণ করেননি? এবং তোমাদেরকে কি তারা চূড়ান্ত দলিল প্রদর্শন করেননি ?”
অতঃপর তারা মৃত্যু কামনা করবে। জবাবে বলা হবে যে,“
তোমরা অনন্তঃকাল দোযখে অবস্থান করবে ।
যদিও মৃত্যু তাদেরকে সর্বদিক থেকে আগ্রাসন করবে,কিন্তু তারা মরবে না ।
যতবারই তাদের শরীরের চামড়া ঝলসে যাবে,ততবারই নতুন চামড়া সৃষ্টি হবে;আর এ ভাবে তাদের আযাব চলতে থাকবে ।
বেহেশতবাসীদের নিকট থেকে কিঞ্চিৎ পানি ও খাবার ভিক্ষা করলে বলা হবে,‘
মহান আল্লাহ বেহেশতের নেয়ামত তোমাদের জন্যে নিষিদ্ধ করেছেন ।
বেহেশতবাসীগণ তাদেরকে জিজ্ঞাসা করবে,তোমাদের এ দুর্ভাগ্যের কারণ কী এবং কী কারণে তোমাদেরকে দোযখে নিক্ষেপ করা হয়েছে ? জবাবে দোযখবাসীরা বলবে,আমরা মহান আল্লাহর এবাদত ও সালাত পাঠ করতাম না এবং নিঃস্ব ও দরিদ্রদেরকে সাহায্য করতাম না,পাপীষ্ঠদের সহযোগিতা করতাম,আর কিয়ামতের দিনকে অস্বীকার করতাম ।
অতঃপর দোযখবাসীরা পরস্পরের সাথে কলহে লিপ্ত হবে ।
বিপথগামীরা,যারা তাদেরকে বিপথগামী করেছে,তাদেরকে বলবে : তোমরাই আমাদেরকে বিপথগামী করেছিলে। তারা জবাবে বলবে : তোমরা স্বেচ্ছায় আমাদেরকে অনুসরণ করেছিলে ।
অধীনস্থরা ক্ষমতাধরদেরকে বলবে : তোমরাই আমাদের এ হতভাগ্যের জন্যে দায়ী। তারা জবাবে বলবে : আমরা কি তোমাদেরকে জোরপূর্বক তোমাদের সত্য পথ থেকে বিরত রেখেছিলাম ।
অবশেষে শয়তানকে বলবে : তুই-ই আমাদের বিপথগামীতার কারণ। সে জবাবে বলবে : মহান আল্লাহ তোমাদেরকে সত্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন,তোমরা তা অগ্রাহ্য করেছ। আর আমি মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম,তোমরা তা গ্রহণ করেছিলে। সুতরাং আমাকে ভৎসনা করার পরিবর্তে,তোমাদের নিজেদেরকে ভৎসনা কর। অদ্য আমরা কেউই কারও উপকারে আসতে পারব না ।
আর এভাবে নিজেদের কুফরি ও অবাধ্যতার শাস্তি ভোগ ব্যতীত তাদের আর কোন উপায় থাকবে না এবং অনন্তকাল তারা সেথায় আযাব ভোগ করতে থাকবে ।