১২তম পাঠ
দুনিয়া ও আখেরাতের সম্পর্ক
ভূমিকা :
ইতিপূর্বে আমরা জেনেছি যে,মানুষের জীবন কেবলমাত্র দ্রুত অপসৃয়মান এ পার্থিব জীবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং পুনরায় পরকালে জীবন লাভ করবে এবং চিরকাল সেথায় বেঁচে থাকবে। অনুরূপ জানতে পেরেছি যে,পরকালীন জীবনই হল প্রকৃত ও সত্যিকারের জীবন। মূলতঃ পার্থিব জীবন এদিক থেকে পরকালীন জীবনের তুলনায় জীবন নামকরণেরই অযোগ্য। এমন নয় যে,পরকালীন জীবনের অর্থ ভাল বা মন্দ নাম অথবা কাল্পনিক বিষয় বা কোন সর্বসম্মতিক্রমে স্বীকৃত বিষয়।
এখন পার্থিব ও পরকালীন জীবনের মধ্যে তুলনা ও এতদ্ভয়ের মধ্যে সম্পর্কের প্রকৃতি নির্ধারণের পালা এসেছে। তবে পূর্ববর্তী পাঠসমূহের আলোচনা প্রসঙ্গে এ সম্পর্কের প্রকৃতি কিছুটা হলেও প্রতীয়মান হয়েছে। কিন্তু বিদ্যমান নানাবিধ বক্রচিন্তার কথা বিবেচনা করে এ বিষয়ের উপর বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করা প্রয়োজন মনে করছি। আর বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলসমূহ ও কোরানের বক্তব্যসমূহের মাধ্যমে দুনিয়া ও আখেরাতের মধ্যে কিরূপ সম্পর্ক বিদ্যমান,তা পরিষ্কার হওয়া জরুরী ।
দুনিয়া আখেরাতের শস্যক্ষেত্র
:
এখানে যে বিষয়টি সর্বাধিক গুরুতের সাথে বিবেচনা করতে হবে,তা হল : পরকালীন জীবনের সুঃখ,দুঃখ পৃথিবীতে মানুষের আচার-ব্যবহারের অনুগামী। এমনটি নয় যে,পরকালীন বৈভব অর্জনের জন্যে ঐ জগতেই চেষ্টা ও শ্রম ব্যয় করতে হবে এবং যারা অধিক দৈহিক শক্তি ও তীক্ষ্ণচিন্তার অধিকারী,তারা অধিক নেয়ামত ভোগ করতে পারবেন অথবা কেউ কেউ প্রতারণার মাধ্যমে অপরের অর্জিত বৈভব অপব্যবহার করতে পারবেন;যেমনটি কোন কোন নির্বোধ ব্যক্তি ধারণা করে এবং পরজগৎকে পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন বলে মনে করে।
পবিত্র কোরানের ভাষায় কোন কোন কাফেরের উদ্ধৃতি তুলে ধরা হয়েছে :
)
وَمَا أَظُنُّ السَّاعَةَ قَائِمَةً وَلَئِنْ رُدِدْتُ إِلَى رَبِّي لَأَجِدَنَّ خَيْرًا مِنْهَا مُنْقَلَبًا(
(দুনিয়াপূজারী ব্যক্তি বলল) আমি মনে করি না যে,ক্বিয়ামত হবে,আর আমি যদি আমার প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবৃত্ত হই-ই,তবে আমি তো নিশ্চয়ই এটা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট স্থান পাব। (কাহ্ফ-৩৬)
অন্য এক প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে যে,
)
وَمَا أَظُنُّ السَّاعَةَ قَائِمَةً وَلَئِنْ رُجِعْتُ إِلَى رَبِّي إِنَّ لِي عِنْدَهُ لَلْحُسْنَى(
আমি মনি করি না যে,কিয়ামত সংঘটিত হবে,আর আমি যদি আমার প্রতি পালকের নিকট প্রত্যাবর্তিত হই-ও,তার নিকট তো আমার জন্যে কল্যাণই থাকবে। (ফুসসিলাত-৫০)
এ ধরনের ব্যক্তিরা মনে করেছেন যে,পরকালীন জীবনেও পৃথিবীর মতই স্বীয় চেষ্টায় অসংখ্য নেয়ামতের অধিকারী হতে পারবেন অথবা ধারণা করেছেন যে,এ পার্থিব জীবনে সুখ-সমৃদ্ধির অধিকারী হওয়া,তার প্রতি মহান আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের নিদর্শন,সুতরাং পরকালেও এ ধরনের অনুগ্রহেরই অধিকারী হবেন !
যা হোক যদি কেউ পরকালীন জগৎকে পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন জগতরূপে বিবেচনা করে থাকেন এবং পৃথিবীতে যে সুকর্ম ও দুষ্কর্ম সম্পাদন করেছেন আখেরাতের নেয়ামত ও শাস্তির জন্যে এর কোন প্রভাব আছে বলে মনে না করেন তবে যে পরকাল সকল ঐশী ধর্মেরই মৌলিক বিশ্বাস,তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেননি। কারণ এ মূলনীতিটি পার্থিব জগতে সম্পাদিত কর্মের পুরস্কার ও শাস্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। আর এ দৃষ্টিকোণ থেকেই পৃথিবীকে আখেরাতের বাজার বা আখেরাতের শস্যক্ষেত্র বলে আখ্যায়িত করা হয়। সুতরাং এখানে শ্রম দিতে হবে,বীজ বপন করতে হবে,প্রচেষ্টা চালাতে হবে এবং ফসল ও সম্পদ পরজগতে লাভ করতে হবে।
পুনরুত্থানের স্বপক্ষে উপস্থাপিত দলিলের দাবী এবং কোরানের বক্তব্যও তা-ই,যার জন্যে কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই।
পার্থিব বৈভবসমূহ পরকালীন সুখ-সমৃদ্ধির কারণ নয় :
কেউ কেউ মনে করেন যে,ধন-সম্পদ,সন্তান-সন্তুতি ও অন্যান্য পার্থিব আরাম,আয়াশের উপকরণ,আখেরাতেও সুখ-সমৃদ্ধির কারণ হবে এবং সম্ভবতঃ মৃতদের সাথে স্বর্ণ,রৌপ্য ও মূল্যবান পাথরসমূহ,এমনকি খাদ্যসমাগ্রী সমাধিস্থকরণের ব্যাপারটি এ ধরনের চিন্তা-ভাবনা থেকেই উৎসারিত।
পবিত্র কোরান গুরুত্বারোপ করে যে,ধন-দৌলত,সন্তান-সন্ততি স্বয়ং (তাদের কাজ-কর্ম বিবেচনা না করে) মহান আল্লাহর নৈকট্যের কারণ হবে না,
বা পরকালে কাউকে লাভবান করবে না।
মূলতঃ এ ধরনের পার্থিব সম্পর্ক ও উপকরণ পরকালে ছিন্ন ও বিলুপ্ত হয়ে যাবে
প্রত্যেকেই স্বীয় ধন-সম্পদ ত্যাগ করবে
এবং সম্পূর্ণ একাকীই মহান আল্লাহর নিকট উপস্থিত হবে।
কেবলমাত্র আত্মিক ও ঐশি সম্পর্কই প্রতিষ্ঠিত থাকবে । সুতরাং যে সকল মু’
মিন তাদের স্ত্রী,সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনদের সাথে ঈমানী সম্পর্ক স্থাপন করে থাকেন,তারা বেহেশতে একত্রে বসবাস করবেন ।
অতএব উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে,পৃথিবী ও আখেরাতের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক পার্থিব বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্কের মত নয় এবং এমনটি নয় যে,যে কেউ পৃথিবীতে ক্ষমতা ও শক্তিধর,সুন্দর,প্রফুল্ল,ভাগ্যবান ও অনন্দচিত্তের অধিকারী,তিনি পরকালে ও সেরকমই পরিগণিত হবেন। নতূবা ফেরাউন ও কারুনরা অধিকতর পরকালীন সুখ-সমৃদ্ধির অধিকারী হওয়াই যুক্তিসঙ্গত হত। বরং যারা পৃথিবীতে অক্ষম,দরিদ্র,কষ্ট-ক্লীষ্ট জীবন-যাপন করেন কিন্তু প্রভুর প্রতি সকল দায়িত্ব সম্পাদন করেন,তারা পরকালে সবল,সুন্দর,সক্ষম বলে পরিগণিত হবেন এবং অনন্ত বৈভবের অধিকারী হবেন।
)
وَمَنْ كَانَ فِي هَذِهِ أَعْمَى فَهُوَ فِي الْآخِرَةِ أَعْمَى وَأَضَلُّ سَبِيلًا(
আর যে ব্যক্তি এখানে অন্ধ,সে আখিরাতেও অন্ধ এবং অধিকতর পথভ্রষ্ট। ( ইসরা-৭২)
কোন কোন ব্যক্তি ধারণা করেছেন : উপরোল্লিখিত আয়াতটি দলিল প্রদর্শন করে যে,পার্থিব সুস্থতা ও সৌভাগ্য পরকালীন সুস্থতা ও সৌভাগ্যের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছেন যে,উপরোক্ত আয়াতে অন্ধতের মানে বাহ্যিক চক্ষুর অন্ধত্ব নয় বরং এর অর্থ হল অন্তরচক্ষুর অন্ধত্ব। যেমন : অপর এক আয়াতে বলা হয়েছে :
)
فَإِنَّهَا لَا تَعْمَى الْأَبْصَارُ وَلَكِنْ تَعْمَى الْقُلُوبُ الَّتِي فِي الصُّدُورِ(
বস্তুতঃ চক্ষু তো অন্ধ নয়,বরং অন্ধ হচ্ছে বক্ষস্থিত হৃদয়। (হাজ্জ-৪৬)
অপর এক স্থানে এসেছে :
)
وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنْكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَى قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِي أَعْمَى وَقَدْ كُنْتُ بَصِيرًا(
যে আমার স্মরণে বিমুখ তাহার জীবন-যাপন হবে সংকুচিত এবং আমি তাকে ক্বিয়ামতের দিন উত্থিত করব অন্ধ অবস্থায়। সে বলবে,‘
হে আমার প্রতিপালক! কেন আমাকে অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করলেন? আমি তো ছিলাম চক্ষুষ্মান। তিনি বলবেন,‘
এরূপই আমার নিদর্শনাবলী তোমার নিকট এসেছিল,কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবে আজ তুমিও বিস্মৃত হলে। (তোহা- ১২৪-১২৬)
অতএব পরকালে অন্ধতের কারণ হল,ইহকালে মহান আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে বিস্মৃত হওয়া,বাহ্যিকচক্ষুর অন্ধত্ব নয়। সুতরাং ইহ ও পরকালের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক,কারণ ও কার্যের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্কের মত নয়।