41। ইসলামী ঐক্যের আহবান সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :
ইসলামের মাহাত্ত্ব ও একে অক্ষত রাখার ব্যাপারে কঠোর ইচ্ছার ক্ষেত্রে আহলে বাইতগণ (আ.) বিখ্যাত ছিলেন। তারা মানুষকে ইসলামের সম্মান
,মুসলিম ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব রক্ষা করতে এবং নিজেদের মধ্যে সকল প্রকার শত্রুতা ও হিংসা বিদ্বেষ অন্তর থেকে দূর করতে আহবান করতেন।
আমীরুল মূমিনীন হযরত ইমাম আলীর (আ.) সাথে পূর্ববর্তী খলিফাদের আচরণ ভুলে যাওয়ার মত নয়। যদিও ঐ মহাত্মা নিজেকে খেলাফতের অধিকারী মনে করতেন এবং তাদেরকে খেলাফত হরণকারী বলে জানতেন। তথাপি ইসলামী ঐক্য রক্ষার জন্য তাদের সাথে তিনি সম্পর্ক রক্ষা করতেন। এমনকি তিনি যে রাসূল (সা.) কর্তৃক খেলাফতের নিযুক্ত হয়েছিলেন তা তিনি এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত প্রকাশ ও বর্ণনা করেননি। কেবলমাত্র যখন হুকুমত তার কাছে এসেছে তখন বর্ণনা করেছেন। আর রাহবাহ নামে খ্যাত দিবসে যেদিন রাসূল (সা.) এর ঐ সকল জীবিত সাহাবীদের নিকট সাক্ষী চেয়েছিলেন যারা গাদীর দিবসে রাসূল (সা.) কর্তৃক তার নিযুক্তির ঘটনা দেখেছেন এবং শুনেছেন যাতে তারা তার নিযুক্তির বিষয়ে সাক্ষ্য দিতে পারেন।
হযরত আলী (আ.) যা কিছু ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য লাভজনক ও কল্যাণকর
,তা তার পূর্ববর্তী খলিফাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র কুন্ঠাবোধ করতেন না। যেমনটি তিনি তার এক খোতবায় তার সময়কালের পূর্বের হুকুমত সম্পর্কে ইশারা করেছেন। তিনি বলেন-
“
যদি ইসলাম ও মুসলমানদেরকে সাহায্য না করি তবে আমার ভয় হচ্ছিল যে ইসলামে ফাঁটল ধরবে ও ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে।
”
যেমন হযরত আলীর (আ.) পূর্ববর্তী খলিফাদের খেলাফতের সময়কালে তার (আ.) পক্ষ থেকে কথায় ও কর্মে কখনোই এটা পরিদৃষ্ট হয়নি যে
,তিনি তাদের খেলাফতকে দুর্বল করতে চেয়েছেন কিংবা ক্ষতি করতে চেয়েছেন। যদিও তিনি খলিফাদের কর্মকান্ডের প্রতি নজর রাখতেন তথাপি স্বীয় অন্তরাত্মার উপর তার নিয়ন্ত্রণ থাকার কারণে গৃহকোণে আসন গ্রহণ করেছিলেন। তার এ সকল নিরবতা ও নিয়ন্ত্রণ একমাত্র এ জন্যই ছিল যে
,বিশ্বজনীন ইসলাম রক্ষা পায় কিংবা এজন্য যে
,ইসলাম ও মুসলমানদের ঐক্যের প্রাসাদের কোন ক্ষতি না হয় বা তা বিনষ্ট না হয়। হযরতের (আ.) এ বিবেচনার ব্যাপারটি সকলেই বুঝত। আর তাই ওমর ইবনে খাত্তাব প্রায় বলতেন-
“
এমন কোন সমস্যায় পড়িনি যেখানে আবুল হাসান (আ.) (আলী) ছিলেন না এবং সমাধান দেননি।
”
কিংবা বলতেন-
“
যদি আলী না থাকত তবে ওমর ধ্বংস হয়ে যেত।
”
ইমাম হাসান (আ.) এর অনুসৃত পদ্ধতি ভুলে যাওয়ার মত নয় যে কিরূপে তিনি ইসলামকে রক্ষা করার জন্য মোয়াবিয়ার সাথে চুক্তি করেছিলেন। কারণ তিনি দেখলেন যে যুদ্ধের পীড়াপিড়ি মহান আল্লাহর অতি ভারী বস্তু কোরআন ও ইসলামী হুকুমত অর্থাৎ সত্যিকারের ইসলাম বিলুপ্ত হত
,এমনকি চিরতরে ইসলামের নাম পর্যন্ত মুছে যেত। আর তাই তিনি ইসলামের ইমারত ও নাম রক্ষাকে যুদ্ধের উপর প্রাধান্য দিয়েছিলেন। যদিও দ্বীন ও মুসলমানদের কুখ্যাত শত্রু এবং হযরতের (আ.) প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী শত্রু মোয়াবিয়ার সাথে এ চুক্তির ফলে বনি হাশেমও ইমামের (আ.) অনুসারীরা উন্মুক্ত তরবারী নিয়ে খিমা থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন এবং অধিকার না নিয়ে খিমায় ফিরতে নারাজ ছিলেন। কিন্তু ইসলামের বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষাই ছিল ইমাম হাসান (আ.) এর নিকট সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও শ্রেয়।
কিন্তু ইমাম হুসাইনের (আ.) পদ্ধতি ছিল ইমাম হাসানের (আ.) ব্যতিক্রম। তিনি আন্দোলন করেছিলেন। কারণ তিনি দেখলেন যে
,বনি উমাইয়্যার হুকুমত এমন পথে যাচ্ছে যদি এভাবে এগুতে থাকে এবং কেউ যদি তাদের কুকর্মগুলো প্রকাশ না করে দেয়
,তবে তারা ইসলামকে ধ্বংস করে ফেলবে এবং ইসলামের মাহাত্ত্বকে নষ্ট করে ফেলবে। আর এ কারণেই বনি উমাইয়্যার জুলুম-অত্যাচারকে ও শত্রুতাকে ইতিহাসের পাতায় লেপন করে দিয়েছেন। আর তাদের স্বরূপ উন্মোচন করে দিয়েছেন যার ফলে নিশ্চিতরূপেই ঘটনা প্রবাহ সেদিকেই প্রবাহিত হয়েছিল যেদিকে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) চেয়েছিলেন।
যদি তার পবিত্র সংগ্রাম ও আন্দোলন না থাকত তবে ইসলাম এমনভাবে মুছে যেত যে ইতিহাস এ দ্বীনকে বাতিল ধর্ম বলে বিবেচনা করত।
ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় শীয়ারা যে ইমাম হুসাইন (আ.) ও তার বিপ্লবের কথা প্রতিবছর বিভিন্নভাবে স্মরণ করতে আগ্রহী হয় তার কারণও এটাই। এ দৃষ্টিকোণ থেকেই তারা চায় একদিকে জুলুম ও অত্যাচারকে নির্মূল করতে ইমাম হুসাইনের (আ.) আন্দোলনের চেতনাকে উজ্জীবিত করতে এবং তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে জাগ্রত করতে
,অপরদিকে হুসাইনী আশুরাকে স্মরণ করার ব্যাপারে ইমাম হুসাইনের (আ.) পরের ইমামগণের (আ.) আদেশের আনুগত্য করতে।
বিশ্বে ইসলামের মাহাত্ত্বকে অক্ষুন্ন রাখার ব্যাপারে আহলে বাইতগণের (আ.) আগ্রহ ইমাম সাজ্জাদ (আ.) এর জীবনালেখ্য সুষ্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয় যদিও তিনি তাদের ঘোরতর দুশমনদের রাজত্বে বসবাস করতেন। কারণ হযরত সাজ্জাদ (আ.) তার পরিবারবর্গের উপর সীমাহীন লাঞ্ছনা
,গঞ্ছনা সত্বেও কারবালার বেদনা বিধূর ঘটনা এবং তার বংশধর ও পিতার সাথে কৃত বনি উমাইয়্যার স্বেচ্ছাচারী আচরণের ব্যাপারে শোক প্রকাশ করতেন। তদুপরি তিনি নিরবে নির্জনে এবাদত করতেন ও মুসলিম সেনাদের বিজয়
,ইসলামের সম্মান
,নিরাপত্তা ও মুসলমানদের কল্যাণের জন্য দোয়া করতেন। ইতিপূর্বেও আমরা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম যে
,ইসলামের শিক্ষাকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ইমাম সাজ্জাদের (আ.) একমাত্র অস্ত্র ছিল দোয়া। কারণ হযরত সাজ্জাদ (আ.) দোয়ার মাধ্যমেই তার অনুসারীদেরকে শিখিয়েছিলেন যে
,কিরূপে ইসলামী সেনা ও মুসলমানদের জন্য দোয়া করতে হবে।
ইমাম সাজ্জাদ (আ.) সহীফায়ে সাজ্জাদিয়ার সাতাশ নম্বর দোয়ায়
‘
সীমান্তরক্ষীদের দোয়া
’
নামে একটি দোয়ায় এরূপ বলেন-
“
প্রভু হে! মোহাম্মদ (সা.) ও তার আহলের (আ.) প্রতি দূরুদ প্রেরণ কর এবং তাদেরকে (সীমান্ত রক্ষীদেরকে) সংখ্যায় অধিক কর। অস্ত্রের (মোকাবেলায়) তাদেরকে বিজয় দান কর। তাদের রক্ষিত প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা কর। শত্রুদের অনিষ্ঠ থেকে তাদের ভূখণ্ডকে রক্ষা কর। তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব দান কর। তাদের বিষয় আশয়কে স্বীয় করুণায় পূর্ণ কর। তাদের সহায়ক শক্তিকে অবিরামভাবে প্রেরণ কর। একমাত্র তুমিই তাদের খরচাদির দায়িত্ব নাও। আর তোমার সাহায্য দ্বারা তাদেরকে শক্তিশালী কর। ধৈর্য ও স্থৈর্য দান করার মাধ্যমে কৌশলের শিক্ষা দিয়ে তাদেরকে দয়া কর।
”
অতঃপর কাফেরদেরকে অভিশাপ দিয়ে এরূপ বলতে থাকেন-
“
হে আল্লাহ! হে প্রভু! তাদের অবস্থানকে শক্তিশালী কর (অর্থাৎ মুসলমানদের শহরগুলোকে ইসলামের সৈন্যদের মাধ্যমে রক্ষা কর)
,আর তাদের ধন সম্পদ উত্তর উত্তর বৃদ্ধি কর
,তোমার বন্দেগী ও এবাদতের ফলে শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করা থেকে তাদেরকে মুখাপেক্ষীহীন কর
,শত্রুদের সাথে লড়াই করা থেকে তাদেরকে মুক্তি দাও যাতে শান্তিমত তোমার এবাদতে মশগুল হতে পারে
,যাতে করে পৃথিবীতে তোমার এবাদত ব্যতীত তাদের আর কোন কাজ না থাকে এবং তাদের মস্তক তোমা ব্যতীত আর কারো জন্য যেন মাটিতে রাখতে না হয়।
”
ইমাম সাজ্জাদ (আ.) তার এ সুদীর্ঘ ও সাহিত্যমান সমৃদ্ধ শ্রুতিমধুর দোয়ায় ইসলামের সৈন্যদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বর্ণনা করেছেন যাতে তারা চারিত্রিক মূল্যবোধের অধিকারী হবে এবং তারা পরিপূর্ণ দৃঢ়তার সাথে শত্রুদের মোকাবিলা করে। হযরত (আ.) এ দোয়ার বিষয়বস্তুতে ইসলামের সমর শিক্ষা এবং এ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন। আর শত্রুদের সাথে সংঘর্ষের সময় রণকৌশল ও সমর নীতি শিক্ষা দিয়েছেন। পাশাপাশি স্মরণ করিয়ে দেন যে
,যুদ্ধের সকল পর্যায়ে আল্লাহর উপর নির্ভর করতে হবে এবং গুনাহ থেকে দূরে থাকতে হবে। আর তারা একমাত্র আল্লাহর জন্যই যুদ্ধ করবে। একথা যেন কখনোই ভুলে না যায়। অন্যান্য ইমামগণের (আ.) নীতি তাদের সময়কালের শাসকদের মোকাবেলায় এরূপই ছিল যদিও তাদেরকে সর্বদা শত্রুদের অত্যাচার এবং নিষ্ঠুর ও চরম দূর্ব্যবহার মোকাবেলা করতে হয়েছে। কিন্তু যখন তারা বুঝতে পারলেন সত্যিকারের শাসন ভার তাদের নিকট ফিরে আসবে না তখন ধর্মীয় শিক্ষা ও চারিত্রিক প্রশিক্ষণদানে আত্ম নিয়োগ করেছেন এবং তাদের অনুসারীদেরকে সমুন্নত প্রতিষ্ঠান ও মাযহাব সম্পর্কে জ্ঞান দান করেছেন।
কিন্ত এখানে একটি বিষয় স্মরণ করতে হবে যে
,ইমামগণের (আ.) সমসাময়িক আলাভী ও অন্যান্যদের পক্ষ থেকে যে আন্দোলন ও বিপ্লবের প্রচেষ্টা হয়েছিল তা তাদের (আ.) ইচ্ছা বা অনুমতি মোতাবেক হয়নি। বরং স্পষ্ঠতঃ এগুলো তাদের আদেশ ও ইচ্ছার পরিপন্থী ছিল। কারণ ইমামগণ (আ.) ইসলামী হুকুমতের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে অন্য সকলের চেয়েও অধিক এমনকি বনি আব্বাস থেকেও বেশী সচেষ্ট ছিলেন।
আমাদের এ বক্তব্যের স্বপক্ষে শিয়াদের প্রতি ইমাম মূসা ইবনে জাফরের (আ.) ওসীয়ত তুলে ধরব যেখানে তিনি বলেন-
“
বাদশাহদের আনুগত্য পরিহার করে নিজেদেরকে হীন করো না। যদি ঐ বাদশারা ন্যায়পরায়ণ হয় তবে তাদের টিকে থাকাটা কামনা করো
;আর যদি অত্যাচারী ও স্বেচ্ছাচারী হয় তবে আল্লাহর কাছে তার জন্য সংশোধন কামনা করো। কারণ তোমাদের কল্যাণ
,তোমাদের বাদশাদের কল্যাণের সাথে জড়িত। আর ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ দয়ালু পিতার মত। সুতরাং তোমরা তোমাদের জন্য যা পছন্দ কর তাদের জন্য তা পছন্দ কর। আর তোমাদের জন্য তোমরা যা পছন্দ কর না তা তার জন্যও পছন্দ কর না।
”
আর এটিই ছিল দেশ রক্ষার জন্য বাদশাহদের সুস্থতা কামনার জন্য আদেশ দেয়ার কারণ। কিন্তু ইদানিং কালের কোন কোন লেখক বড় ধরনের খিয়ানত করে চলেছে। তারা তাদের লেখায় শিয়াদেরকে এক গোপন ধ্বংসাত্মক দল বলে উল্লেখ করেছে। কত বড় খেয়ানত এ ধরনের লেখকরা করছে
?
এটাই সঠিক যে
,মুসলমান মাত্রই যারা নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে আহলে বাইতের (আ.) অনুসরণ করে তারা অত্যাচারী শত্রুদের অত্যাচারের সম্মুখীন হয়। স্বেচ্ছাচারী
,অন্যায়কারী
,পাপচারীর সাথে তাদের সম্পর্ক ভাল না
;তারা অত্যাচারীদেরকে (কিছু কিছু ভাল কর্মে) সহযোগিতা করলেও তাদের প্রতি ঘৃণা ও নিন্দার দৃষ্টিতে তাকায়
;আর বংশপরম্পরায় সর্বদা এ কৌশল অবলম্বন করে চলে। কিন্তু এ ধরনের আচরণের অর্থ এ নয় যে
,শিয়াদেরকে ষড়যন্ত্রকারী ও প্রতারক বলে জানতে হবে। কারণ কখনোই শিয়াদের কৌশল এ নয় যে
,ইসলামের নামে যে হুকুমত মানুষের উপর রাজত্ব করে চলছে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে কিংবা তার বদনাম করবে। গোপনে বা প্রকাশ্যে শিয়ারা কোনভাবেই মুসলিম জনগণকে গাফেল করাটা সমীচীন মনে করে না। ঐ মুসলমানদের মাযহাব বা পথ যা-ই হোক না কেন তা শিয়াদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ তারা এ পন্থা স্বীয় ইমামগণ (আ.) থেকেই শিখেছে।
তাদের দৃষ্টিতে সকল মুসলমানের যারা আল্লাহর কিতাবসমূহ ও ইসলামের নবীর (সা.) নবুওয়াতকে স্বীকার করে তাদের ধন সম্পদ
,মালিকানা
,রক্ত
,ইজ্জত সবকিছু জবরদখলের হাত থেকে নিরাপদ। কোন মুসলমানের সম্পদ ভোগ করাই শীয়াদের দৃষ্টিতে বৈধ নয় তার অনুমতি ব্যতীত। কারণ মুসলমানরা ইসলামের দৃষ্টিতে পরস্পরের ভাই। সুতরাং তারা তাদের ভাইয়ের অধিকার সম্পূর্ণরূপে সংরক্ষণ করবে যার আলোচনা পরবর্তীতে করা হবে।