32। রাজআত (পুনরাবর্তন) সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :
এ ক্ষেত্রে শিয়ারা তা-ই বিশ্বাস করে যা রাসূলের (সা.) আহলে বাইত (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। উক্ত বর্ণনা মতে মহান আল্লাহ একদল মৃতব্যক্তিকে পুনরায় পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনবেন পূর্বে ঠিক যে অবস্থায় তারা ছিল সে অবস্থায়। তখন মহান আল্লাহ একদলকে সম্মানিত করবেন এবং অপর দলকে লজ্জিত করবেন। তিনি সৎ কর্ম সম্পাদনকারীকে অসৎ কর্ম সম্পাদনকারীদের থেকে পৃথক করে দিবেন
,পৃথক করবেন অত্যাচারিত থেকে অত্যাচারীকে। আর ইমাম মাহদীর (সা.) আবির্ভাবের পর এ ঘটনা ঘটবে।
কাজেই পুনরাবর্তন ঘটবে না যদি না সে ঈমানের চুড়ান্ত শিখরে পৌঁছে কিংবা অনাচারের নিকৃষ্টতম স্তরে তলিয়ে যায়। এরপর তারা পুনরায় মৃত্যুবরণ করবে। অতঃপর তাদেরকে বিচার দিবসে পুনরায় জীবিত করা হবে এবং যার যার প্রাপ্তি অনুসারে পুরস্কার বা শাস্তি দেয়া হবে। এ কারণে পবিত্র কোরআনে যারা পৃথিবীতে দু
’
বার প্রত্যাবর্তন করেছিল তৃতীয়বার আসার জন্য তাদের ইচ্ছার কথা উল্লেখ করে মহান আল্লাহ বলেন-
“
তারা
বলবে
,হে
আমাদের
প্রভু
!
আপনি
আমাদেরকে
দু
’
বার
মৃত্যু
দিয়েছেন
এবং
দু
’
বার
জীবন
দিয়েছেন।
আমরা
আমাদের
দোষ
স্বীকার
করছি।
সুতরাং
এখান
থেকে
বের
হওয়ার
কোন
উপায়
আছে
কি
?”
(সুরা মুমিন -11)
হ্যাঁ
,পবিত্র কোরআনে এ পৃথিবীতেই রাজআত বা পুনরাবর্তনের সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে বক্তব্য এসেছে। এছাড়া পবিত্র আহলে বাইত (আ.) থেকেও এ সম্পর্কে একাধিক বর্ণনা এসেছে। শীয়াদের একটি ক্ষুদ্র অংশ ব্যতীত সকলেই এ ব্যাপারে একমত। শীয়াদের ঐ ক্ষুদ্রাংশের মতে রাজআতের অর্থ হলো অপেক্ষমান ইমামের (আ.) ফিরে আসার মাধ্যমে আহলে বাইতের (আ.) নিকট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং আদেশ নিষেধের অধিকার ফিরে আসা। লোকদের প্রত্যাবর্তন বা মৃত্যুর পর পূর্নজীবন লাভ নয়।
রাজআতের ব্যাপারটি আহলে সুন্নত কর্তৃক অস্বীকৃত হয়ে আসছে। তাদের মতে এটা হলো ধর্ম বিরোধী বিশ্বাস। তাদের হাদীস সংকলনকারীরা রাজআত সম্পর্কে বর্ণনাকারী রাবীদের (হাদীস বর্ণনাকারী) উপর দূর্নাম দিয়েছেন যাতে করে তাদের বর্ণনাকে তুচ্ছ জ্ঞান করা যায়। এমনকি তারা রাজআতে বিশ্বাসকারীদেরকে কাফের ও মোনাফেক অথবা তদপেক্ষা কুৎসিত কোন অ্যাখ্যা দিতে কুন্ঠাবোধ করেনি। সুন্নি কর্তৃক শীয়ারা ধিকৃত ও নিন্দিত হওয়ার একটি বড় কারণ হলো রাজআতের এ বিশ্বাস।
নিঃসন্দেহে এ ধরনের ব্যাখ্যা হলো সেই অস্ত্র যা পূর্বে বিভিন্ন ইসলামী দলগুলো পরস্পরকে অপবাদ দিতে ব্যবহার করত এবং যা নিয়ে বিবাদ করত। প্রকৃতপক্ষে পরস্পরকে দোষারোপ করার কোন কারণই আমরা দেখি না। কারণ
,রাজআতের প্রতি বিশ্বাস না তাওহীদের বিশ্বাসকে খর্ব করে
,আর না নবুওয়াতের বিশ্বাসকে। বরং এগুলোর সত্যতার উপর গুরুত্বারোপ করে। কেননা রাজআত হলো পুনরুত্থান দিবসের মতই মহান আল্লাহর অসীম ক্ষমতার প্রমাণ। এটি হলো মহানবী (সা.) এবং তার আহলে বাইতগণের (আ.) অনুসৃত মোজেযা (অলৌকিক ঘটনা) কিংবা ঈসা (আ.) কর্তৃক মৃতকে জীবিতকরণের মোজেযার মত বরং তার চেয়েও বড়। কারণ
,পচে গলে যাওয়া লাশকে জীবিত করা হয়। পবিত্র কোরআনের ভাষায়-
“
বলে যে
,কে নষ্ট হয়ে যাওয়া হাড়গুলোতে প্রাণ সঞ্চার করবে
?বলুন
,তিনিই যিনি তাকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলেন এবং তিনি সকল সৃষ্টি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত।
”
(সুরা ইয়াসীন- 79)
তবে যারা রাজআতকে অসার পুর্নজন্মবাদ (তানাসুখ) মনে করে অভিযোগ তুলছে তারা প্রকৃত পক্ষে এ তানাসুখ এবং শারীরিক পুনরুত্থানের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে নি। আর রাজআত হলো শারীরিক পুনরুত্থানের অনুপ্রকরণ। অপরদিকে তানাসুখ হলো পূর্বের দেহ ব্যতিরেকে অন্য কোন দেহে প্রত্যাবর্তন। অথচ শারীরিক পুনরুত্থানের অর্থ স্বতন্ত্র। কারণ
,এর মানে হলো পূর্বতন দেহে আত্মার প্রত্যাবর্তন। আর এরূপই হলো রাজআত বা পূনর্জীবন লাভ। যদি রাজাআত তানাসুখ হয়
,তবে ঈসা (আ.) কর্তৃক মৃতকে জীবন দানও তানাসুখ হবে। তদ্রূপ
,যদি রাজাআত তানাসুখ হয়
,তবে দৈহিক পুনরুত্থানও তানাসুখ হবে।
এখন রাজআতের উপর দুটি সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন।
প্রথমত : এটা ঘটা অসম্ভব এবং
দ্বিতীয়তঃ রাজআত সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসগুলো সঠিক নয়।
বর্ণিত সমস্যা দু
’
টিকে সঠিক ধরে নিলেও রাজআতের প্রতি বিশ্বাস এতটা ঘৃণ্য নয় যা শীয়াদের শত্রুরা করে থাকে। মুসলমানদের অন্যান্য দলগুলোর এমন কত বিশ্বাস আছে যা অসম্ভব কিংবা যা সঠিক উৎস দ্বারা প্রমাণিত হয়নি। অথচ এর কারণে কাফের বা ইসলাম থেকে বের করে দেয়া আবশ্যক হয়নি। আর এগুলোর উদাহরণও কম নয়। যেমন : নবী কর্তৃক ভুল-ত্রুটি ও পাপ হওয়া
,কোরআন অনাদি হওয়া
,কিংবা এ বিশ্বাস করা যে আল্লাহ যখন বললেন যে তিনি শাস্তি দিবেন
,তখন তিনি তা করতে বাধ্য (ওয়াযিব)
।
অথবা মহানবী (সা.) তার উত্তরসূরী নির্বাচন করেন নি ইত্যাদি।
যাহোক প্রাগুক্ত সমস্যাদ্বয়ের সত্যতার কোন ভিত্তি নেই।
‘
রাজআত অসম্ভব
’
এর জবাবে আমরা বলব- ইতিপূর্বে আমরা বলেছিলাম যে
,রাজআত হলো দৈহিক পনুরুত্থানের প্রকরণ। পার্থক্য শুধু এটুকু যে তা ইহকালেই হবে। সুতরাং সেই কিয়ামতের সম্ভাবনার দলিলই রাজআতকে প্রমাণিত করে। এখানে আশ্চার্যন্বিত হওয়ার কোন কারণ নেই। কেবলমাত্র ব্যতিক্রম এটুকু যে
,পার্থিব জীবনে আমরা এতে অভ্যস্ত নই। আমরা এর সংঘটিত হওয়ার কোন কারণ বা অন্তরায় সম্পর্কে জানিনা যে তা আমাদের একে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করার কাছাকাছি পৌঁছে দিবে। অপরদিকে মানুষের প্রকৃতি এরকম যে
,সে যাতে অভ্যস্ত নয় বা যার সাথে পরিচিত নয় তা গ্রহণ করা তার পক্ষে অসম্ভব। এটা সে রকম যে একদল কিয়ামত সম্পর্কে আশ্চার্যন্বিত হয়ে বলেছিল-
“
কে এ নষ্ট হাড়গুলোকে জীবন দিবে
?
”
(সুরা ইয়াসিন-78)
জবাবে বলা হয়েছিল -
“
যিনি প্রথমবার একে সৃষ্টি করেছিলেন তিনিই একে জীবন দিবেন এবং তিনি সকল সৃষ্টি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত।
”
(সুরা ইয়াসিন -79)
এমন এক পরিস্থিতিতে যেখানে রাজআতকে বিশ্বাস করার বা অগ্রাহ্য করার কোন বুদ্ধিবৃত্তিক দলিল না থাকে কিংবা শুধু খেয়ালের বশবর্তী হয়ে আমরা বলে থাকি এর কোন দলিল নেই
,সেখানে আমাদেরকে ওহীর উৎস থেকে প্রাপ্ত দলিলসমূহের শরণাপন্ন হতে হবে। পবিত্র কোরআনে কোন কোন মৃতব্যক্তির ক্ষেত্রে পৃথিবীতে রাজাআত সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে অকাট্য প্রমাণ মেলে। যেমন- হযরত ঈসা (আ.) কর্তৃক মৃতকে জীবিত কারণ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে এসেছে-
“
আমি আল্লাহর অনুমতিক্রমে অন্ধকে আলো দেই
,কুষ্ঠরোগীকে আরোগ্য দান করি আর মৃতকে জীবিত করি।
”
(সুরা আল এমরান -49)
অনুরূপ
,মহান আল্লাহর বাণী-
“
কিরূপে আল্লাহ একে জীবন দিবেন মৃত্যুর পর
?সুতরাং আল্লাহ তাকে একশত বছরের জন্য মৃত্যু দিলেন। অতঃপর তাকে জীবিত করলেন।
”
(সুরা বাকারা -259)
এছাড়া ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছিলাম-
“
হে প্রভু ! আমাদেরকে দু
’
বার মৃত্যু দিয়েছেন।
”
(সুরা মুমিন - 11)
অতএব মৃত্যুর পর পৃথিবীতে ফিরে আসা ব্যতীত এ আয়াতের কোন অর্থ করা যায় না। যদিও কোন কোন তাফসীরকারক এর অন্য ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছেন যা কোন বিশ্বস্ত রাবী থেকে বর্ণিত হয়নি এবং আয়াতের সাথে এর সামঞ্জস্য রক্ষা করে না।
যাহোক দ্বিতীয় সমস্যা যেখানে বলা হয়েছে যে এর স্বপক্ষে বর্ণিত হাদীসগুলো সঠিক নয় সে সম্পর্কে আমরা বলতে পারি যে
,এ কথাটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কারণ
,রাজআত আহলে বাইত (আ.) থেকে বর্ণিত বহুলালোচিত মোতাওয়াতির হাদীস দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বিষয় যার উপর বিশ্বাস রাখা প্রয়োজন।
তদুপরি এটা আশ্চর্যের বিষয় যে
,আহাম্মদ আমীনের মত একজন প্রখ্যাত লেখক যিনি বিজ্ঞ বলে দাবী করে থাকেন তিনি ফাজরুল ইসলাম নামক পুস্তকে লিখেছেন-
“
রাজআতের কথায় শীয়াদের অবয়বে ইহুদীবাদের প্রকাশ ঘটে।
”
আমরা তাকে বলব
,তাহলে পবিত্র কোরআনেও ইহুদীবাদ রাজাআতের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। কারণ পূর্বে যে সকল আয়াত উল্লেখ করেছি তাতে রাজআতের কথাই বর্ণিত হয়েছে।
আমরা তাকে আরো বলব যে
,প্রকৃতপক্ষে ইসলামের অনেক বিশ্বাস ও আহকামে ইহুদীবাদ ও খ্রীষ্টবাদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। কারণ
,মহানবী (সা.) ঐশী বিধানের যে দৃষ্টান্ত এনেছিলেন এখন তার অনেক বিধানকেই পরিত্যাগ করা হয়েছে বা অকার্যকর করা হয়েছে। সুতরাং ইসলামের বিশ্বাসে ইহুদীবাদ ও খ্রীষ্টবাদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তবে তা ইসলামের কোন ঘাটতি বা দোষ নয় যদি ধরেও নেয়া হয় যে
,রাজআত হলো ইহুদীবাদের বক্তব্য যা উক্ত লেখক দাবী করেছেন।
যাহোক রাজআত দ্বীনের এমন কোন মৌলিক বিষয় নয় যার উপর বিশ্বাস ও বিবেচনা আবশ্যক
,যদিও আমরা এতে বিশ্বাস করি সঙ্গত কারণেই। কারণ
,তা আহলে বাইতগণের (আ.) বর্ণনা থেকে সঠিকভাবে এসেছে। যাদেরকে আমরা মিথ্যাচার থেকে পবিত্র মনে করি। আর তা অদৃশ্যালোকের বিষয় যার সম্পর্কে সংবাদ দেয়া হয়েছে এবং তা সংঘটিত হতে কোন বাধা নেই।