হোসাইনী আন্দোলনের উপাদান সমূহ
এটা সুস্পষ্ট যে,কারবালার স্মৃতিকে অমর এবং চিরজাগরুক করে রাখার পেছনে মূল কারণ হল এটা একটা শিক্ষণীয় ও অনুকরণীয় ঘটনা। এটা ছিল ইতিহাসের একটি জ্বলন্ত অধ্যায় যা থেকে অনাগতকালের মুক্তি কামী মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করে উপকৃত হবে। তাই আমরা সর্ব প্রথম ইতিহাসের এই খণ্ড অধ্যায়টুকুতে ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রবাহকে বিশ্লেষণ করতে চাই,তাহলে তা আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে ধরা দেবে।
এ অধ্যায়ে আমরা ইমাম হোসাইনের (আ.) আন্দোলনে বিদ্যমান উপাদানগুলো নিয়ে সার্বিক আলোচনা করবো। তারপর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি নিয়ে কিছু বিস্তারিত আলোচনা উপস্থাপন করবো।
হোসাইনী আন্দোলনে একাধিক উপাদানের উপস্থিতি ছিল। আর এ কারণেই দৈর্ঘ-প্রস্থে কিংবা ঐতিহাসিক দৃশ্যপটে কারবালার ঘটনা সুস্পষ্ট হলেও এ ঘটনার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ও তার কারণসমূহ নির্ণয় করতে গিয়ে মতভেদ ও জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। এই জটিলতার কারণ খোদ ঘটনা প্রবাহের জটিলতা এবং ঘটনায় একাধিক উপাদানের সমাবেশ। বিভিন্ন উপাদানের পরিপ্রেক্ষিতে ইমাম হোসাইনের (আ.) প্রতিক্রিয়া কখনো ছিল ইতিবাচক আবার কখনো নেতিবাচক। কখনো বা কেবল আত্মরক্ষামূলক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন;আবার কখনো প্রতিরক্ষামূলক।
ইয়াযিদের পক্ষ থেকে বাইয়াত নেয়ার জন্যে ইমামের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু ইমাম হোসাইন (আ.) তাদের বাইয়াতের প্রস্তাব নাকচ করে দেন। এখানে মূলত আত্মরক্ষা মূলক ভূমিকা গ্রহণ করেন। এরপর আসে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি। কুফায় আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে ইমামের (আ.) কাছে পৌছে যায় কুফাবাসীদের হাজার হাজার চিঠি । আর এক্ষেত্রে তাদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে ইমাম হোসাইন (আ.) ইতিবাচক সাড়া দিলেন। আবার অন্যত্র তিনি ইয়াযিদের বাইয়াতের আদেশ কিংবা কুফাবাসীদের দাওয়াত-কোনোদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সরাসরি স্বৈরাচারী সরকারের বিরোধিতায় নামেন।
মুসলিম শাসন ক্ষমতায় বসে যারা ইসলামের মূলেই কুঠারাঘাত করছিল,মুসলিম উম্মাহকে যারা-সংঘাতে জর্জরিত করে দিচ্ছিল,হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল বানাচ্ছিল-ইমাম হোসাইন (আ.) তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। মুসলমানদের দীন-ঈমানের আশু বিপদ সম্পর্কে তিনি সবাইকে হুশিয়ার করে দিলেন।
সবশেষে তিনি বললেন-আজ আর কোনো মুসলমানের মুখ বুজে বসে থাকা উচিত নয়। সাথে সাথে তিনি কারো সাহায্যের আশা বাদ দিয়েই নেমে পড়লেন।
এখানে এসে আমরা দেখি যে,ইয়াযিদের পক্ষে বাইয়াত চেয়ে পাঠানোর কথাও যেমন ইমাম হোসাইন (আ.) উল্লেখ করেননি তেমনি কুফাবাসীদের আমন্ত্রণ প্রসঙ্গেও তিনি কিছু বলেননি। তাহলে প্রকৃত ব্যাপার কি দাঁড়ালো? ইমাম হোসাইন (আ.) কি কেবল ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত করবেন না বলে,কিংবা কুফাবাসীদের সাহায্যের আশ্বাস পেয়েই বিদ্রোহ করতে উদ্যোগী হলেন? নাকি স্বৈরাচারী ও খোদাদ্রোহী সরকারকে উৎখাত করার জন্যেই তিনি আন্দোলন শুরু করলেন? এসব উপাদানের মেধ্যে বাস্তবিকপক্ষে কোনটি ইমাম হোসাইন (আ.) কে বিদ্রোহ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং কিসের ভিত্তিতেই বা ইমাম আন্দোলন করেছিলেন আমরা তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করবো।
ইয়াযিদের সাথে মোয়াবিয়ার এমন মৌলিক পার্থক্য ছিল যে,ইমাম হোসাইন (আ.) মোয়াবিয়ার সময়ে চুপ থাকলেন,অথচ ইয়াযিদ ক্ষমতাসীন হতে না হতেই তিনি আর একদণ্ড দেরী করলেন না? তাছাড়া ইমাম হাসান (আ.) মোয়াবিয়ার সাথে সন্ধি করতে রাজী হলেন কিন্তু ইমাম হোসাইন (আ.) ইয়াযিদের সাথে কোনো আপোষ করাকে‘‘
নাজায়েজ’’
বলে গণ্য করলেন।
এগুলো সবই কেবল । হোসাইনী আন্দোলন নিয়ে গবেষণা করলে এ ধরনের অসংখ্য প্রশ্ন দেখা দেয়। আমরা এখানে উদ্ধৃত প্রশ্নগুলোর উত্তর খুজতে চেষ্টা করবো। প্রকৃতপক্ষে উপরোক্ত তিনটি উপাদানের তিনটিই ইমাম হোসাইনের (আ.) আন্দোলনে বিদ্যমান। অর্থাৎ তার আন্দোলনের একটা অংশ বাইয়াত প্রসঙ্গকে কেন্দ্র করে,একটা অংশ আমন্ত্রণ প্রসঙ্গ নিয়ে এবং অপর অংশটি উদ্ভূত সামাজিক ফেতনা-ফ্যাসাদ ও বিদআতকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে।
প্রথমে আমরা বাইয়াত প্রসঙ্গটি নিয়ে আলোচনা করে দেখি যে,এটা হোসাইনী আন্দোলনে কতটুকু প্রভাব বিস্তারকরেছিল এবং এ পরিপ্রেক্ষিতে ইমাম হোসাইন (আ.) কি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। আরও দেখবো আরও দেখবো যে,যদি অন্য কোনো প্রসঙ্গ ব্যতিরেকে কেবল বাইয়াত প্রসঙ্গই সামনে আসতো তাহলে তখন ইমাম হোসাইন (আ.) কি ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাতেন।
মোয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ানের মুসলিম খিলাফত লাভের তিক্ত অভিজ্ঞতার সাথে আমরা সবাই কম-বেশী পরিচিত। ইমাম হাসানের (আ.) সহযোগীরা যখন তীব্র অনুৎসাহ প্রকাশ করলো তখন তিনি মোয়াবিয়ার সাথে সন্ধিচুক্তিতে আবদ্ধ হতে মনস্থ করলেন। কিন্তু সন্ধি সনদের কোথাও মোয়াবিয়ার খেলাফতকে স্বীকৃতি প্রদান সূচক কোনো বাক্যের উল্লেখ ছিল না ! বরং বলা হয়েছিল যে,মোয়াবিয়া একান্তই যদি হুকুমত করতে চায় তাহলে তা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত করুক। কিন্তু তারপর ক্ষমতা থাকবে মুসলমানদের হাতে। তারা যাকে উপযুক্ত মনে করবে তাকেই শাসক নির্বাচন করবে।
মোয়াবিয়ার যুগ পর্যন্ত মুসলিম শাসনে রাজতন্ত্রের কোনো প্রভাব ছিল না। তখন পর্যন্ত খলীফা নির্ধারণের ব্যাপারে মাত্র দুটো ধারণা প্রচলিত ছিল:
এক.
খেলাফত শুধু তারই অধিকার যাকে রাসূলুল্লাহ (সা.)আল্লাহর আদেশে মনোনীত করে গেছেন।
দুই
.জনগণ নিজেরাই তাদের খলিফা নির্বাচন করবে।
কিন্তু ইয়াযিদের যুগ থেকে খলীফা নির্ধারণের পূর্ব দুটি ধারণাকে অমান্য করে এক নতুন তৃতীয় প্রথার চলন ঘটানো হয় এবং প্রথমবারের মতো মুসলিম শাসন ব্যাবস্থাকে রাজতন্ত্রে পরিণত করা হয়। অর্থাৎ এখন থেকে খলীফা নির্ধারণে রাসূলের (সা.) নিয়োগের যেমন কোনো মূল্য নেই তেমনি জনগণের ক্ষমতাকেও হীন করা হল।
মোয়াবিয়ার সাথে সম্পাদিত সন্ধিপত্রে ইমাম হাসান (আ.) প্রদত্ত বিভিন্ন শর্তগুলোর মধ্যে একটি ছিল যে,মোয়াবিয়া মুসলমানদের ভবিষ্যত নিয়ে নাক গলাবে না। তার জন্যেই ইসলামকে যে মূল্য দিতে হয়েছে এতটুকুই যথেষ্ট । এরপর থেকে মুসলমানরা যেন দম ছেড়ে বাঁচতে পারে। মোট কথা মোয়াবিয়া যে ক’
দিন আছে সে ক’
দিন কষ্টে-শিষ্টে পার হলেই রক্ষা। এরপরে মুসলমানদের ভাগ্য নির্ধারণে মোয়াবিয়ার হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার থাকবে না।
কিন্তু মোয়াবিয়া তার চিরকালের স্বভাব অনুযায়ী এবারও ইমাম হাসানের (আ.) সাথে প্রতিশ্রুত সন্ধির প্রতিটি শর্তকেই পদদলিত করে তার হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে থাকে। এমন কি বিষ প্রয়োগে ইমাম হাসানকে (আ.) শহীদ করার মতো অমানুষিক কাজ করতেও সে দ্বিধা বোধ করেনি। মোয়াবিয়ার মূল অভিসন্ধি ছিল যে কোনো মূল্যে খেলাফতের চাবি উমাইয়া বংশের হাতছাড়া করা যাবে না। ঐতিহাসিকরা বলেন,মোয়াবিয়া এ লক্ষে এমন কিছু করে যেতে চেয়েছিল যাতে খেলাফতকে সুলতানী আকারে গড়ে তোলার পক্ষে গ্যারান্টি হয়ে থাকে। কিন্তু মোয়াবিয়া বুঝত যে,এ কাজ আপাতত সম্ভব ছিল না। তাই অনেক চিন্তা-ভাবনা এবং একান্ত বিশ্বস্তদের সাথে শলা-পরামর্শের পরও মোয়াবিয়া কোনো সুনির্দিষ্ট উপায় খুজে বের করতে ব্যর্থ হয়। সে এ ব্যাপারে খুব একটা আশাবাদী ছিল না। আর তার এ মতলব জনগণের সকাশে প্রকাশ করতেও সাহস পাচ্ছিল না।
ঐতিহাসিকদের মতে,সর্ব প্রথম যে ব্যক্তি মোয়াবিয়াকে এ ব্যাপারে আশাবাদ ও সফলতার নিশ্চয়তা প্রদান করে সে হল‘‘
মুগাইরা ইবনে শুবা’’
। অব মুগাইরার এ উদ্যোগের পিছনেও একটা দুরভিসন্ধি ছিল। সে আগ কুফার গভর্ণর ছিল। কিন্তু মোয়াবিয়া তাকে বরখাস্ত করায় সে খুব অসন্তষ্ট হয়। ধোকাবাজি ও ফন্দীবাজিতে ইতোমধ্যেই সে‘‘
আরবের চাম্পিয়ান’’
খ্যাতি লাভ করেছিল। শাসনযন্ত্রের এহেন সংকটাবস্থায় সে কুফার গভর্ণর পদ পুনরায় হাতে পাবার আশা নিয়ে এক ফন্দী করে বসলো। শামে এসে সে ইয়াজিদকে বললো-‘
কেন যে মোয়াবিয়া তোমার ব্যাপারে কুন্ঠা করছে বুঝতে পারছিনা,আর কত দেরী করবে?’
ইয়াযিদ বলল,‘
আমার বাবা ভয় পায়,কেননা এ কাজ হয়তো সফল নাও হতে পারে।’
সাথে সাথে মুগাইরা বলে উঠলো,না-না,অবশ্যই সম্ভব। ভয় কিসের? তোমাদের কথার অবাধ্য হবে এ সাহস কার আছে? শামের লোকজন মোয়াবিয়ার কথায় ওঠে আর বসে। মদীনায়ও যদি অমুককে পাঠানো হয় তাহলে সব শায়েস্তা হয়ে যাবে। আর বাকী থাকে কেবল কুফা। ঠিক আছে আমি নিজেই ওখানকার ভার নিচ্ছি ।
একথা শুনে ইয়াযিদ উৎসাহিত হলো এবং মোয়াবিয়ার কাছে ব্যাপারটা খুলে বললো। মোয়াবিয়া মুগাইরাকে ডেকে পাঠাল। বাকপটু মুগাইরা এ সুযোগের সদ্ব্যব্যাবহার করে তীক্ষ্ণ যুক্তি দিয়ে মোয়াবিয়াকে কাবু করে ছাড়লো। সে মোয়াবিয়াকে বোঝাতে সক্ষম হল যে,সবকিছুই অনুকুলে,ভয়ের কোনো কারণ নেই। আর কুফার ব্যাপারটা একটু জটিল হলেও তা দেখার ভার আমার ওপরই রইলো। অবশ্য এসব ষড়যন্ত্র ইমাম হাসানের (আ.) শাহাদাতের পর ও মোয়াবিয়ার শেষ বয়সেই সংঘটিত হয়।
এরপর ঘটে যায় অনেক ঘটনা। কুফা ও মদীনার জনগণ মানতে রাজী হল না। অগত্যা মোয়াবিয়া নিজে মদীনায় গিয়ে গণ্যমান্যদের,যেমনঃ ইমাম হোসাইন (আ.),আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর,আব্দুল্লাহ ইবনে উমর প্রমুখের সাথে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়। এসব আলোচনায় মোয়াবিয়া তাদেরকে বোঝাতে চেষ্টা করে যে,ইয়াযিদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়াটাই এখন ইসলামের জন্যে কল্যাণকর। কেননা ইয়াযিদ খলীফা হলে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ ও বিদ্রোহ দেখা দেব না। সুতরাং আপনারা এ প্রস্তাবে রাজী হয়ে যান। কার্যত শাসন ক্ষমতা আপনাদের হাতেই রইলো। কাজেই আপনারা আর দেরী না করে ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত করে ফেলুন। এভাবে নানা কথা বলে মোয়াবিয়া তাদেরকে রাজী করাতে চাইলো। কিন্তু কোনোমতেই সে তাদেরকে রাজী করাতে পারলো না। মোয়াবিয়া বিফল হল। এবার মদীনার মসজিদে গিয়ে তার শেষ প্রচেষ্টা চালালো। মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে মসজিদে দাড়িয়ে বললোঃ তোমাদের গণ্যমান্যরা আমার প্রস্তাব মেনে নিয়েছে। সুতরাং তোমরাও ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত করে ফলে। কিন্তু তারাও মোয়াবিয়াকে প্রত্যাখ্যান করে।
এই বিফলতার জন্যে মোয়াবিয়া মৃত্যুকালে ইয়াযিদ সম্পর্কে খুবই উদ্বিগ্ন ছিল। সে ইয়াজিদকে নসিহত করে যায়ঃ আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইরের কাছ থেকে বাইয়াত নেয়ার জন্যে এভাবে আচরণ করবে,আব্দুল্লাহ ইবনে উমরের সাথে ওভাবে আচরণ করবে,ইমাম হোসাইনের (আ.) সাথে এভাবে আচরণ করবে ইত্যাদি। মোয়াবিয়া বিশেষ করে ইমাম হোসাইনের (আ.) সাথে কোমল ব্যাবহার করার জন্যে ইয়াজিদকে নসিহত করে। কেননা ইমাম হোসাইন (আ.) নবীর সন্তান। জনগণ তাকে বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখে। তাই তার সাথে কোনো সংঘাতে যাওয়া আদৌ ঠিক হবে না। মোয়াবিয়া ভালভাবেই অবগত ছিল যে,যদি ইমাম হোসাইনের (আ.) সাথে সংঘাতে লিপ্ত হয় এবং তার রক্তে হাত লাল করে তাহলে ইয়াযিদের রাজত্বের আয়ু শেষ হয়ে যাবে। মোয়াবিয়া ধুর্ত বুদ্ধি দিয়ে বেশ ভবিষ্যৎ বাণীও করতে পারতো এবং খ্যাতিমান রাজনীতিকদের মতোই তা ফলে যেত। পক্ষান্তরে,ইয়াযিদ ছিল বয়সে অপরিপক্ক,বুদ্ধিতে আমড়া কাঠের ঢেকি আর রাজনীতিতে পুরোপুরি অনভিজ্ঞ । রাজকীয় ভোগ বিলাসে জীবন যাপন করে সে আরাম-আয়েশ ছাড়া কিছুই জানে না,যৌবনের অহংকারে ছিল গদগদ। পাশাপাশি ক্ষমতার লোভও তাকে আবিষ্ট করে ফেলে এবং এজন্য বিন্দু মাত্র ধৈর্য ধরার অবস্থাও তার ছিল না। তাই মোয়াবিয়ার মৃত্যুর অব্যববিহত পরেই সে এমন এক কাজ করে বসলো যাতে উমাইয়া খান্দানই সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হল। ইয়াযিদ দুনিয়া ছাড়া কিছুই বুঝতো না। কিন্তু এ ঘটনার পরিণতিতে দুনিয়াও হারিয়ে বসে। অপরপক্ষে ইমাম হোসাইন (আ.) শহীদ হয়ে তার মহান লক্ষে পৌঁছেন। তার আত্মিক-আধ্যাত্মিক সমস্ত লক্ষ্যই অর্জিত হয়। আর উমাইয়ারা সবকিছু হারিয়ে চরমভাবে পতনের সম্মুখীন হয়।
60 হিজরীর 15ই রজব তারিখে মোয়াবিয়ার মৃত্যু হলে ইয়াযিদ মদীনার গভর্নরকে চিঠি লিখে বাবার মৃত্যুর খবর জানায় এবং জনগণের কাছ থেকে তার অনুকূলে বাইয়াত নেবার আদেশ করে। ইয়াযিদ জানতো যে,মদীনাই সবকিছুর কেন্দ্র এবং সবাই মদীনার দিকে তাকিয়ে আছে। এ কারণে সে ঐ চিঠির ভিতরে একটা চিরকুটে ইমাম হোসাইনের (আ.) কাছ থেকে বাইয়াত নেবার জন্যে কড়া আদেশ দিয়ে পাঠায়। আরও বলে যে,ইমাম হোসাইন (আ.) যদি বাইয়াত করতে অস্বীকৃতি জানায় তাহলে তার মস্তক ছিন্ন করে তার কাছে পাঠিয়ে দিতে হবে।
এভাবে ইমাম হোসাইন (আ.) বাইয়াত তথা প্রথম সমস্যার সম্মুখীন হলেন। যে বাইয়াতের অর্থ হতো সকল ইয়াযিদী কার্যকলাপের স্বীকৃতি দেবার পাশাপাশি আরও দুটো নতুন বিদআত প্রথার স্বীকৃতি দেবারই নামান্তর। এক হলঃ ইয়াজিদকে মেনে নেবার প্রশ্ন নয়,বরং একটা বিদআত প্রথা বা রাজতন্ত্রকে মেনে নেয়া। দ্বিতীয়ত: ইয়াযিদ শুধু ফাসেক বা লম্পটই ছিল না-প্রকাশ্যে এবং জনগণের সকাশেই সে এসব ক্রিয়াকলাপ চালাতো। এরূপ ব্যক্তিকে মুসলিম খিলাফতে বসানো অর্থাৎ ইসলাম ও কোরআনের মুখেই কলংক লেপন। মোয়াবিয়াও ফাসেক ছিল বটে। কিন্তু সে একটা জিনিস ভালভাবেই অনুধাবন করতো যে,যদি তাদের রাজত্ব টিকিয়ে রাখতে হয় তাহলে বাহ্যিকভাবে অন্তত ইসলামী বেশভূষা বজায় রাখতে হবে। যদিও ইসলামকে ভাঙিয়েই তাদের এই আমীর-ইমারত। এশিয়া,আফ্রিকা,ইউরোপের বিভিন্ন জাতির অসংখ্য মানুষ বাগদাদ কিংবা শামের শাসনকে মেনে নিয়েছিলক্ষ্যকেবলমাত্র ইসলাম ও কোরআনের খাতিরেই। এ কারণে মোয়াবিয়ার মত চালাক রাজনীতিবিদরা বুঝতে পেরেছিল যে,এই মুসলিম সমাজকে দাবিয়ে রাখতে হলে তাদেরকে অন্তত জাহেরী চেহারাকে ইসলামী করে রাখতে হবে। নতুবা যদি ফাঁস হয়ে যেত যে,মুসলমানদের রক্ষকরা নিজেরাই ভ্রান্ত তাহলে সেদিনই তারা রুখে দাঁড়াতো।
কিন্তু ইয়াযিদের এ জ্ঞানটুকুও ছিল না। বরং প্রকাশ্যে ইসলাম ও মুসলমানদের অপমান করে কিংবা শরীয়তের বিধান লংঘন করে সে তৃপ্তি পেত। হয়তো মোয়াবিয়াও মদ পান করতো(
আল
-
গাদীর 10 খণ্ড
,
179 পাতা দ্রষ্টব্য
)
। কিন্তু তার প্রকাশ্যে লোকালয়ে বসে মদপান করার কিংবা মাতাল অবস্থায় মসজিদে ঢোকার মত কোনো সাক্ষ্য -প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া যায় না। কিন্তু ইয়াযিদের কাছে এসব ব্যাপার অত্যন্ত মামুলি মনে হতো। মদ্যপান,কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে আবোল-তাবোল বকা,বানর নিয়ে খেলা করা এ ধরনের অগণিত হারাম কাজকে সে হালাল মনে করতো। এ কারণেই ইমাম হোসাইন (আ.) বলেছিলেনঃ
و علی الاسلام السلام اذ قد بلیت الامة براع مثل یزید
‘
ইয়াযিদের মতো লোক যদি উম্মতের রক্ষক হয় তাহলে এখানেই ইসলামের ক্ষান্তি’
। (মাকতালুল মোকাররাম)
এককথায় ইয়াযিদ ও অন্যদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য ছিল। অন্যকথায় তা প্রকাশ করতে হলে বলতে হয় যে,স্বয়ং ইয়াযিদের অস্তিত্বই ছিল ইসলামের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রচার। আর এই ইয়াযিদ চায় ইমাম হোসাইনের (আ.) কাছ থেকে বাইয়াত নিতে !!! ইমাম হোসাইন (আ.) বাইয়াত করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলতেনঃ আমি কোন ক্রমেই ওদের হাতে হাত দেব না-আর ওরাও আমার থেকে বাইয়াত চাইেত নিরস্ত হবে না।
এভাবে বাইয়াত করাতে বা করার জন্যে তীব্য চাপের সৃষ্টি করা হয়। ইমাম হোসাইনের (আ.) মত ব্যক্তি বাইয়াত না করে স্বাধীনভাবে জনগণের মরেধ্য ঘুরে বেড়াবে এর চেয়ে বিপজ্জনক ওদের জন্যে আর কি হতে পারে? তাই ইমাম হোসাইনকে (আ.) ক্ষমা করা ইয়াযিদের জন্যে অসম্ভব হয়ে পড়ে। কেননা বাইয়াত না করে তিনি বুঝাতে চান যে,‘
আমি তোমাদেরকে মানি না,তোমাদের আইন-কানুন মেনে চলারও কোনো প্রয়োজন বোধ করি না। শুধু তাই নয়,এজন্যে আমি চুপ করে বসে থাকবো না,বরং তোমাদেরকে সমূলে উৎখাত করেই তবে ছাড়বো।’
আর উমাইয়াদেরকে সমূলে উৎখাত করার মতো ক্ষমতা একমাত্র ইমাম হোসাইনেরই (আ.) ছিল। এ সত্য বুঝতে পেরে ইয়াযিদ ইমাম হোসাইনের (আ.) কাছে বাইয়াত চেয়ে জোর তাগাদা পাঠায়। কিন্তু এসব তাগাদা এবং চাপের মুখে ইমাম হোসাইনের (আ.) করণীয় কি?
এ পর্যায়ে তিনি নেতিবাচক জবাব দিলেন। তারা বললঃ আপনাকে বাইয়াত করতে হবে।
ইমাম জবাব দিলেনঃ‘
না’
তারা বলল,‘
যদি বাইয়াত না করেন তাহলে মৃত্যু অনিবার্য’
ইমাম জবাবে বললেন,‘
মৃত্যু বরণ করতে রাজী আছি কিন্তু বাইয়াত করতে পারবো না।’
ইয়াযিদের আদেশ পেয়ে মদীনার গভর্ণর ইমাম হোসাইনকে (সা.) ডেকে পাঠাল। উমাইয়া গভর্ণররা সচরাচর নিষ্ঠুর প্রকৃতির হলেও মদীনার গভর্ণর ওয়ালীদ ছিল একটু ব্যতিক্রম। ইমাম হোসাইন (আ.) আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইরের সঙ্গে মসজিদুন্নবীতে বসে ছিলেন। খলীফার দূত এসে তাদের’
দু’
জনকেই গভর্ণরের সাথে দেখা করতে বলে। তারা দূতকে বললেন,‘
ঠিক আছে,তুমি ফিরে যাও। আমরা পরে আসছি।’
আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর ইমাম হোসাইনকে (আ.) জিজ্ঞাসা করলো,‘
হঠাৎ করে গভর্ণর আমাদেরকে ডেকে পাঠাল যে ! আপনার কি ধারণা?’
ইমাম জবাবে বললেন :
اظنّ انّ طاغیتهم قد هلک
‘
আমার মনে হচ্ছে মোয়াবিয়া পটল তুলেছে ও ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত করার জন্যে ই আমাদেরকে ডাকা হয়েছে।’
আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর সেদিনই রাতের অন্ধকারে অচেনা পথ ধরে মক্কায় এসে আশ্রয় নেয়। এদিকে ইমাম হোসাইন (আ.) বনী হাশিম বংশের কয়েকজন যুবককে সাথে নিয়ে দরবারে গেলেন। দরবারে ঢোকার আগে তিনি তাদেরকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে বললেন,‘
আমার ডাক না শোনা পর্যন্ত তোমাদের কেউ ভিতরে ঢ়ুকবে না।’
দরবারে ওয়ালীদের সাথে পাপিষ্ট মারওয়ানও ছিল। মারওয়ান এক সময় মদীনার গভর্ণর ছিল। ইমাম হোসাইনকে (আ.) দেখে ওয়ালীদ ইয়াযিদের চিঠি বের করলো। ইমাম জিজ্ঞেস করলেনঃ‘
কি চাও?’
ওয়ালিদ অত্যন্ত কোমলভাবে কথা বলতে শুরু করলঃ‘
জনগণ ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত করেছে। মোয়াবিয়ার বহু দিনের খায়েশও ছিল এটা হোক। তাছাড়া,বর্তমানে ইসলামের জন্যেও এটা কল্যাণকর। তাই আপনিও ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত করে ফেলুন। পরে আপনার কথামতো সব কিছুই চলবে। ত্রুটি-বিচ্যুতি সমাধান করে ফেলা হবে।’
ইমাম বললেন,‘
তোমরা কেন আমার কাছে বাইয়াত চাচ্ছ ? আল্লাহর জন্যে তো নয়,আমার বাইয়াতের মাধ্যমে তোমাদের শরীয়ত বিরোধী খিলাফতকে শরীয়তসিদ্ধ করার জন্যে ও তো নয়,বরং জনগণের জন্যে ই তো? ওয়ালিদ বলল,‘
হ্যাঁ,ঠিক বলেছেন।’
ইমাম বললেন,‘
তাহলে এই ফাকা দরবারে তিনজনের উপস্থিতিতে আমি বাইয়াত করি এতে তোমাদের কি লাভ হবে? বরং পরে হবে।’
ইমাম হোসাইন (আ.) যখন বেরিয়ে যাচ্ছিলেন তখন মারওয়ান আর সহ্য করতে না পেরে তেড়ে উঠল এবং ওয়ালীদকে দোষারোপ করে বললো,‘
কি বলছো। এখান থেকে চলে যাবার অর্থ তিনি বাইয়াত করবেন না। পরে আর বাইয়াত আদায় করাও সহজ হবে না। তুমি এক্ষুণি খলীফার আদেশ পালন কর।’
মারওয়ানের একথা শুনে ইমাম হোসাইন (আ.) ফিরে দাঁড়ালেন এবং তার জামার কলার ধরে উচুঁ করে ফেলে দিলেন। অতঃপর রাগের স্বরে বললেন,‘
এ ধরনের কথা বলার কোনো অধিকার তোমার নেই।’
(
দ্রঃ তারিখে তাবারী
;
6
/
189
,
কিতাবুল ইরশাদ 2
/
33
)
এ ঘটনার পর থেকে ইমাম হোসাইন (আ.) মাত্র তিনদিন মদীনায় কাটান। রাতের বলোয় তিনি রাসূলের (সা.) কবরে এসে দোয়া কালাম পড়তেন এবং আল্লাহর কাছে বলতেনঃ‘
হে মাবুদ,আমার সামনে এমন রাস্তা খুলে দিন যে রাস্তা আপনার পছন্দনীয়।’
তৃতীয় তথা শেষের দিন রাতের বলোয় ইমাম হোসাইন (আ.) যথারীতি নবীজির (সা.) মাজারে এলেন,অনেক দোয়া-কালাম পড়ে তিনি অঝোরে কাদতে লাগলেন এবং ক্লান্ত অবস্থায় এক সময় ওখানেই ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের ভিতরে স্বপ্নে দেখলেন যা প্রকৃতপক্ষে ইমাম হোসাইনের (আ.) চলার জন্যে পথের দিশা দিল। রাসূলুল্লাহর (সা.) কাছে প্রথমে তিনি জোর জবরদস্তি এবং অত্যাচার করার জন্যে উম্মতের বিরুদ্ধে নালিশ করলেন এবং এহেন দুর্দশা থেকে মুক্তির জন্যে তিনি মৃত্যু কামনা করলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা.) জবাবে বললেন :
یا حسین، انّ لک درجة عند الله لا تنالها الا بالشهادة
‘
হে হোসাইন! আল্লাহর নিকেট তোমার জন্য একটি মর্যাদা রয়েছে যা শাহাদাত ব্যতীত তুমি অর্জন করতে পারবে না।’
এবার ইমাম হোসাইন (আ.) তার করণীয় স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পরলেন। পরের দিন ভোর বলোতেই পরিবার-পরিজন নিয়ে মক্কাভিমুখে বেরিয়ে পড়লেন। তিনি কোনো আঁকা-বাকা বা অচেনা পথ বেছে নিলেন না বরং মদীনা থেকে মক্কায় যাবার সুপরিচিত পথ ধরেই এগিয়ে চললেন। তার সঙ্গীদের অনেকেই উৎকন্ঠা প্রকাশ করে বলেনঃ
یا ابن رسول الله ! لو طنکّبت الطریق الاعظم
‘
হে ইমাম! আপনি সোজা পথে না গিয়ে বরং কোনো অচেনা পথ দিয়ে চললেই বোধহয় ভাল করতেন। কেননা ইয়াযিদী গুপ্তচররা যে কোনো মুহুর্তে আপনার পথ রোধ করে একটা কলহ-বিবাদের সৃষ্টি করতে পারে।’
কিন্তু ইমাম হোসাইন (আ.) ছিলেন বীরেরবীর,তার সাহস ছিল খোদায়ী বিশ্বাসে ভরপুর। তাই সঙ্গীদের এ ধরনের কোনো আশংকায় দৃষ্টিপাত না করে তিনি চেনা পথেই অগ্রসর হলেন এবং বললেন,‘
আমি পলাতকের বেশ পরতে মোটেই আগ্রহী নই। এই চেনা পথেই যাব-আল্লাহ যা চায় তা-ই হবে।’
যাহোক হোসাইনী আন্দোলনে সর্ব প্রথম যে কারণ উপাদান হিসেবে কাজ করেছিল তা যে বাইয়াত প্রসঙ্গই ছিল তাতে কোনো দ্বিমত নেই। ইতিহাস থেকে এটাই প্রতীয়মান হয়। ইমাম হোসাইনের (আ.) কাছ থেকে বাইয়াত আদায় করার আদেশ জারী করে ইয়াযিদ বিশেষ চিঠিতে লিখেছিল :
خذ الحسین بالبیعة اخذا شدیدا
‘
ইমাম হোসাইনকে (আ.) কঠোরভাবে ধরে বাইয়াত আদায় করে ছাড়বে।’
(
মাকতালুল মোকাররামঃ 140
)
অপরদিকে ইমাম হোসাইন (আ.)ও কঠোরভাবে এ প্রস্তাব নাকচ করে দেন। তার এ সিদ্ধান্ত ছিল পাহাড়ের মতো অটল। তাই কারবালার ময়দানে
চরম দুর্দশায় ফেলে ইবনে সাদ ভেবেছিল এখন হয়তো ইমাম হোসাইন (আ.) আপোষ-রফা মেনে নেবেন। এ উদ্দেশ্যে এক আলোচনায় সে ইমাম হোসাইনকে (আ.) আপোষ করতে উদ্বুদ্ধ করে,কিন্তু কোনো প্রলোভনই ইমাম হোসাইনের (আ.) প্রতিজ্ঞায় ফাটল ধরাতে পারেনি। আশুরার দিনের বিভিন্ন ভাষ্য থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে,শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত ও ইমাম হোসাইন (আ.) তার সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। তিনি এক ভাষ্যে বলেন,.
لا، و الله لا اعطیکم بیدی اعطاء الذّلیل و لا اقرّ اقرار العبید.
‘
না। আল্লাহর কসম করে বলছি যে,কিছুতেই আমি তোমাদের হাতে হাত মিলাবো না। এমনকি আজ-এ দূরবস্থার মধ্যে পড়েও,স্বীয় সঙ্গী সাথীদের মৃত্যু নির্ঘাত জেনেও,পরিবার-পরিজনদের বন্দীদশা অনিবার্য জেনেও আমি আমার মহান লক্ষ্যকে তোমাদের কাছে বিকিয়ে দেব না।’
(
কিতাবুল ইরশাদঃ 346
)
ইমাম হোসাইনের (আ.) এই অসহযোগ নীতি তথা বিরুদ্ধবাদী ভূমিকা নেয়া শুরু হয় মোয়াবিয়ার আমলের শেষের দিক থেকেই। মোয়াবিয়ার মৃত্যুর সাথে সাথে বাইয়াত গ্রহণে ইয়াযিদের তাড়াহুড়ো এবং কড়াকড়ির ফলে ইমাম হোসাইনের (আ.) ভূমিকাও ত্বরান্বিত হয়।
দ্বিতীয় যে কারণ হোসাইনী আন্দোলনে উপাদান হিসেবে কাজ করেছে তা ছিল কুফাবাসীদের দাওয়াত প্রসঙ্গ । মূলতঃ ইমাম হোসাইনের (আ.) উপর পরিচালিত মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড কারবালার ভূমিতে সংঘটিত হবার পিছনে কুফাবাসীদের দাওয়াতই ছিল মুখ্য কারণ। 60 হিজরীতে মোয়াবিয়ার মৃত্যু হলে কুফাবাসীরা ইমাম হোসাইনকে (আ.) নিজেদের ইমাম বলে মেনে নেয় এবং সব ধরনের সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে তাকে কুফায় আসতে আমন্ত্রণ জানায়। ইমাম হোসাইন (আ.)ও তাদের দাওয়াত কবুল করেন এবং মক্কা ছেড়ে কুফাভিমুখে বেরিয়ে পড়েন’
। কিন্তু চপলমতি কুফাবাসীরা ইমামের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো এবং শেষ পর্যন্ত তারাই ইয়াযিদী বাহিনীর সাথে যোগ দিয়ে ইমাম হোসাইনকে (আ.) হত্যা করলো।
এ ইতিহাস যখন পড়া হয় তখন অনেকের মনে এ ধরনের ধারণা জন্মে যে,ইমাম হোসাইন (আ.) মদীনায় চুপচাপ বসেছিলেন-ভালই ছিলেন কোনো ঝুক্কি -ঝামেলা ছিল না। শুধু মাত্র যে কারণে তিনি মদীনা ছেড়ে বেরিয়ে আসনে তা হলো কুফাবাসীদের আহবান। তবে,এ ধারণা একবারেই ভিত্তিহীন। কেননা ইমাম হোসাইন (আ.) ইয়াযিদ ক্ষমতাসীন হবার অব্যবহিত পরেই অর্থাৎ ঐ রজব মাসেরই শেষার্ধ নাগাদ মক্কার পথে রওয়ানা হন এবং তখন কুফাবাসীদের কোনো চিঠিতো পৌঁছেইনি উপরন্তু মদীনায় কি ঘটছে এ সম্বন্ধে তারা (কুফাবাসীরা) কোনো সংবাদই তখনো জানতো না। ইমাম হোসাইন (আ.) বাইয়াত করতে অস্বীকার করার পর যখন মক্কায় এসে প্রবেশ করেন তার অনেক পরে কুফাবাসীরা এ সংবাদ শুনতে পায়। তারপরেই তারা ইমাম হোসাইনকে (আ.) সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পত্র পাঠায়। তাদের সমস্ত পত্র মক্কায় থাকাকালীন সময়েই ইমাম হোসাইনের (আ.) হাতে পৌঁছে।
অপরদিকে ইমাম হোসাইন (আ.) মদীনা ছেড়ে মক্কায় এসেছিলেন দুটো কারেণঃ
প্রথমতঃ
মক্কায় আল্লাহর ঘর অবস্থিত। শত্রুমিত্র নির্বিশেষে সবাই মক্কার প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাশীল ছিল। তাই ইমাম হোসাইন (আ.) অধিকতর নিরাপত্তার জন্যে মক্কাকেই বেছে নিলেন।
দ্বিতীয়তঃ
মক্কা ছিল দেশ-বিদেশের অসং মুসলমানের সমাগমস্থল। আর বিশেষ করে তখন ছিল রজব মাস। রজব ও শাবান এ’
মাসমূহল ওমরাহর মাস। তাছাড়া আরও কি দিন পরে শুরু হবে হজ্বের সমাগম। তাই ইমাম হোসাইন (আ.) মানুষের মধ্যে সত্য ইসলাম প্রচারের জন্যে এটাকে অত অল্প সময় বলে গণ্য করলেন।
কুফাবাসীদের চিঠি আসে ইমামের মক্কা নিবাসের দু’
মাস অতিক্রান্ত হবার পর। অথচ এর মধ্যে কতকিছূ ঘটে গেছে। বাইয়াত করতে অস্বীকৃতি জানানোর ফলে ইয়াযিদী গুপ্তচররা তাকে খুজে ফিরছিল। তাই,কুফাবাসীদের দাওয়াতই যে ইমাম হোসাইনের (আ.) আন্দোলনে মূল অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল একথা কোন ক্রমেই ঠিক নয়। এটা বড়জোর একটা উপাদান হিসেবে উল্লেখ করা যায়। ইতিহাসের বিচারে বলা যায় যে,ঐ তীব্র চাপের সময় কুফাবাসীদের সাহায্যের আশ্বাস ইমাম হোসাইনের (আ.) জন্যে কিছুটা অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল মাত্র ।
কুফা ছিল মুসলিম সাম্রাজ্যের বৃহত্তর প্রদেশগুলোর অন্যতম। হযরত ওমরের সময় স্থাপিত এ নগরী ছিল মূলতঃ মুসলিম বাহিনীরই নিবাস। তাই সামিরক দিক দিয়ে এ নগরীর গুরুত্ব ছিল অত্যাধিক। ইসলামী ভূ-খণ্ডের ভাগ্য নির্ধারণে এ নগরীর ভূমিকা অনস্বীকার্য হয়ে ওঠে। তাই,সেদিন কুফাবাসীরা যদি ইমাম হোসাইনের (আ.) সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করতো তাহলে হয়তো তিনি সশস্ত্র যুদ্ধেও জয়লাভ করতে পারতেন।
তখনকার কুফার সাথে মক্কা-মদীনার তুলনাই হতো না। এমন কি খোরাসানেরও না। কুফার মোকাবিলায় কেবল শামই ছিল শক্তিশালী । তাই কুফাবাসীদের দাওয়াত ইমামকে কেবল মক্কা ছেড়ে কুফায় যেতেই উদ্বুদ্ধ করে। অবশ্য মক্কাতেও কিছু সমস্যা ছিল। এ কারণে ইমাম হোসাইন (আ.) কুফাকেই মক্কার চেয়ে বেশী অনুকূল মনে করেন। মোট কথা কুফাবাসীদের দাওয়াত যেটুকু করতে পেরেছিল তাহলো ইমাম হোসাইন (আ.) মক্কার বদলে কুফাকেই তার আন্দোলনের কেন্দ্র হিসেবে বেছে নিলেন। কিন্তু এর বেশী কোনো অবদান এ প্রসঙ্গে ছিল না।
ইমাম হোসাইন (আ.) মক্কা ছেড়ে কুফায় রওয়ানা হলেন। কুফার সীমান্তে এসে তিনি হুরের বাহিনী দ্বারা বাধাগ্রস্থ হন। তিনি কুফাবাসীদেরকে বললেনঃ‘
তোমরা আমাকে সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি দিয়েছ। যদি না চাও তাহলে আমাকে ফিরে যেতে দাও।’
এই ফিরে যাবার অর্থ এটা ছিল না যে,তোমরা আমাকে সাহায্য করছো না,সুতরাং অগত্যা আমি ইয়াযিদের হাতে বাইয়াতই করে ফেলি। কখনই না। তিনি ইসলাম এবং মুসলমানদেরকে বাঁচাতেই ঘর ছেড়ে পথে নেমেছেন। কুফাবাসীরা বিশ্বাসঘাতকতা করলেও ইমাম হোসাইন (আ.) তার লক্ষ্যকে পরিত্যাগ করতে পারেন না। তিনি এই সীমালংঘনকারী ও স্বৈরাচারী সরকারকে উৎখাত না করে ক্ষান্ত হতে পারেন না। তার ওপর অনেক বড় দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। যে কোনো মূল্যেই তিনি এ দায়িত্ব পালন করতে চান। এ কারণে কুফাবাসীরা বিশ্বাসঘাতকতা করলেও ইমাম অন্য কোনো জায়গায় গিয়ে তার আন্দোলন অব্যাহত রাখতেন।
অবশ্য এটাও নিশ্চিতভাবে বলা যায় না যে,কুফাবাসীরা যদি ইমাম হোসাইনকে (আ.) আহবান না করতো তাহলে তিনি মক্কা কিংবা মদীনায়ই থেকে যেতেন। এমন হয়তো নাও করতে পারতেন। কেননা এ উভয় জায়গায়ই ইয়াযিদী গুপ্তচররা ষড়যন্ত্রের জাল বুনে রেখেছিল। ইতিহাস সাক্ষ দেয় যে,সে বছের হজ্বের সময় ইমাম হোসাইন (আ.) কে গুপ্তহত্যা করার জন্যে ইয়াযিদী গুপ্তচররা ইহরামের মধ্যেই অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছিল। তবে,ইমাম হোসাইন (আ.) তাদের অভিসন্ধি বুঝতে পারেন। নবীর (সা.) সন্তানকে আল্লাহর ঘরে ইবাদতের হালে,ইহরাম বাধা অবস্থায় হত্যা করবে-ইসলাম এবং মুসলমানদের জন্যে এর চেয়ে অবমাননাকর আর কি হতে পারে? এ কারণে ইমাম হোসাইন (আ.) হজব্রত অসমাপ্ত রেখেই মক্কা ত্যাগ করে কুফা অভিমুখে রওয়ানা হন। তাছাড়া অসংখ্য হাজীর মধ্যে একটা গুপ্ত হামলায় যদি ইমাম হোসাইন (আ.) নিহত হতেন তাহলে প্রসঙ্গেরক্ত বৃথা যাবার সম্ভাবনাই ছিল বেশী। কেননা পরে প্রচার চালানো হতো যে,ইমাম হোসাইনের (আ.) সাথে হয়তো কারো কুক্ষিগত মনোমালিণ্য ছিল,সে-ই তাকে হত্যা করে আত্মগোপন করেছে।
ইমাম হোসাইন (আ.) যে এসব দিক সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল ছিলেন একথা তার বিভিন্ন ভাষ্য থেকে পরিস্কার ধরা পড়ে। কুফার পথে জৈনক ব্যক্তি ইমামকে জিজ্ঞেস করলো;‘
চলে এলেন যে।’
তার একথার অর্থ ছিল যে-মদীনায় আপনি শান্তিতে ছিলেন। সেখানে আপনার নানার মাজার। রাসূলুল্লাহর (সা.) মাজারের পাশে থাকলে কেউই আপনাকে বিরক্ত করতো না। অথবা মক্কায় আল্লাহর ঘরে আশ্রয় নিলেই আপনি নিরাপদে থাকতেন,বেরিয়ে এসে আপনি বরং ভূল করেছেন এবং বিপদ বাড়িয়েছেন।
জবাবে ইমাম বলেন,‘
তোমার এ ধারণা ভূল। তুমি জান না যে,আমি যদি কোনো পশুর গর্ত গিয়েও আশ্রয় নেই তবুও ওরা আমাকে ছাড়বে না। ওদের সাথে আমার যে দ্বন্দ তার কোন সমাধান নেই। আপোষ-রফাও এখানে চলে না। ওরা আমার কাছ থেকে যেটা চায় কখনই তা আমি মেনে নিতে পারিনা আর আমি যেটা চাই সেটা ওদের পক্ষেও মেনে নেয়া অসম্ভব।
হোসাইনী আন্দোলনে সর্বশেষ যে কারণ উপাদান হিসাবে ভূমিকা রেখেছিল তা হলঃ‘‘
আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনিল মুনকার’’
অর্থাৎ‘
সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ।’
মদীনা থেকে বের হবার সময়েই তিনি তার এ লক্ষ্য নির্ধারণ করে নিয়েছিলেন। মোহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া ছিলেন ইমাম হোসাইনের (আ.) সৎ ভাই। তার একহাত পঙ্গু থাকায় জিহাদ করতে অসমর্থ ছিলেন বলে ইমাম হোসাইনের (আ.) সাথে আসতে পারেনিন। ইমাম হোসাইন (আ.) মদীনাতে একটা অসিয়তনামা লিখে তার হাতে দিয়ে এসেছিলেন। তাতে তিনি লেখেন,
هذا ما اوصی به الحسین بن علی اخاه محمدا المعروف بابن الحنیفة
‘
এটা হল ভাই মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়ার কাছে লেখা হোসাইন ইবনে আলীর (আ.) অসিয়তনামা।’
পরবর্তী কয়েকটি লাইনে ইমাম হোসাইন (আ.) আল্লাহর একত্ববাদ এবং রাসূলের (সা.) রিসালাতের প্রতি সাক্ষ প্রদান করলেন,কারণ ইমাম হোসাইন (আ.) জানতেন যে,তার হত্যার পর প্রচার করা হবে-ইমাম হোসাইন (আ.) দীন থেকে খারিজ হয়ে গিয়েছিলেন। তাই প্রথমেই তিনি দীনের প্রতি তার অবিচল থাকার প্রমাণ রেখে এবার ইয়াযিদের বিরুদ্ধে তার বিদ্রোহ এবং আন্দোলনের রহহ্য বর্ণনা করলেনঃ
انی ما خرجت اشرا و لا بطرا ولا مفسدا و لا ظالما انّما خرجت لطلب الاصلاح فی امّة جدّی، ارید ان امر بالمعروف و النهی عن المنکر و اسیر بسیرة جدّی و ابی علی ابن ابی طالب علیه السلام
‘
আমি যশ বা ক্ষমতার লোভে কিংবা ফেতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি করার জন্যে বিদ্রোহ করছি না। আমি আমার নানার উম্মতের মধ্যে সংস্কার করতে চাই,আমি চাই সৎকাজে উদ্বুদ্ধ করতে এবং অসৎকাজে বাধা দিতে। সর্বোপরি,আমার নানা এবং বাবা হযরত আলী (আ.) যে পথে চলেছেন সে পথেই চলতে চাই।(
দ্রঃ মাকতা
লু খারাযমী 1
/
188
)
এখানে কিন্তু বাইয়াত প্রসঙ্গেরও কোনো উল্লেখ নেই,আবার কুফাবাসীদের দাওয়াত প্রসঙ্গেরও উল্লেখ নেই। অর্থাৎ,এর মাধ্যমে ইমাম হোসাইন (আ.) বোঝাতে চেয়েছেন যে,উপরোক্ত ইস্যু না থাকলেও তিনি ইয়াজিদকে সহ্য করতেন না। দুনিয়ার মানুষ জেনে রাখুক যে,এ হোসাইন ইবনে আলীর (আ.) খ্যাতি অর্জনের কোনো লোভ নেই,ক্ষমতারও কোনো লোভ নেই। বরং তিনি একজন সংস্কারক। যুগ যুগ ধরে ইসলামে যে বিদআতের আচ্ছাদন সৃষ্টি করা হয়েছে-তিনি সে সব আচ্ছাদন ছিন্ন করে ইসলাম এবং মুসলমানদেরকে মুক্ত করতে চান।
الا و انّ الدّعی بن الدّعی قد رکز بین اثنین بین السلّة و الذّلّة، و هیهات منّا الذلّة یا ابی الله ذلك لنا و رسوله و المؤمنون و حجور طابت و طهورت.
‘
অধমের পুত্র আরেক অধম (ইবনে যিয়াদ) আমাকে আত্মসমর্পণ করা নতুবা যুদ্ধের হুমকি দেখাচ্ছে । নতি স্বীকার করা আমাদের কখনোই মানায় না। স্বয়ং আল্লাহ,তার রাসূল (সা.) ও মুমিনরা আমাদের নতি স্বীকারকে ঘৃণা করেন।’
(
দ্রঃ তুহাফুল উকুলঃ 241
)
ইমাম হোসাইনের (আ.) এই মহান ও ঐশী আত্মা তার সমস্ত প্রাণ ও রক্তদমাংসের সাথে একাকার ছিল। হোসাইন (আ.) থেকে তা পৃথক করা আদৌ সম্ভব ছিল না। ইয়াযিদী কমকাণ্ড মেনে নেয়ার আর বিন্দু মাত্র সহ্য ক্ষমতা ইমাম হোসাইনের (আ.) ছিল না। তাই তিনি এবার আক্রমণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন এবং ইয়াযিদী শক্তির উৎখাত করে ইসলাম এবং মুসলমানের মুক্তি দেয়াই তার এখন চুড়ান্ত লক্ষ্য ধার্য হল।