কারবালার ঘটনা পরিপূর্ণ ইসলামের বাস্তব প্রতিফলন
কোন কোন বাক্য আছে যার একই সাথে একাধিক অর্থ করা যায় এবং প্রতিটি অর্থই সঠিক বলে গণ্য হয়। কারবালার ঘটনা ও ঠিক তেমনি একটি বহু অর্থবোধক ঘটনা। তাই এ ঘটনারও একাধিক ব্যাখ্যা করা সম্ভব। এ কারণে আমরা দেখি যে,কারবালার ঘটনা নিয়ে অনেক ধরনের মতবাদই পেশ করা হয়েছে। কেউ কেউ এ কে একটা মর্মান্তিক ও বিষাদময় ঘটনা বলে ব্যাখ্যা করেছেন,কেউ কেউ এটিকে ইমাম হোসাইনের (আ.) অসীম বীরত্বের পরিচয় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আবার,কেউ এটিকে স্রেফ এক রাজনৈতিক ব্যাপার বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। এ থেকে কারবালা ঘটনাটির বহুমাত্রিকতা সহজেই ধরা পড়ে। তাই এ ঘটনা সম্পর্কে নানা মুনির নানা মত হলেও হয়তো তাদের ব্যাখ্যাগুলোর কোনটাই মিথ্যা নয়। তবে এ ব্যাখ্যাগুলোর কোনটিই
এককভাবে কারবালা ঘটনাকে পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা করতে পারেনি। প্রতিটি দৃষ্টিভঙ্গিই এ ঘটনার একটি দিককে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। ব্যাপারটি ঠিক ছয় অন্ধের হাতি দেখার কাহিনীর মতোই বলা যায়। ছয় অন্ধের মধ্যে যে হাতির কান ধরেছিল সে মনে করলো হাতিটি পাখার মতো,যে হাতির পা ছুয়েছিল সে ভাবলো হাতিটি খুঁটির মতো। আর যে হাতির শুড় ধরেছিল সে ভাবলো হাতি এক মোটা দড়ির মতো। একিদক থেকে বিচার করলে তাদের প্রত্যেকের এই ধারণা সঠিক ছিল। তারা হাতির যে অঙ্গগুলো ছুয়েছিল সেগুলো সত্যিকার অর্থে পাখা,খুঁটি কিংবা মোটা দড়ির মতোই ছিল। কিন্তু পরিপূর্ণ অর্থে তাদের এ ধারণাগুলো যথেষ্ট নয়। কেননা হাতির পরিপূর্ণ রূপটি তাদের কেউই চিহ্নিত করতে পারেনি,বরং হাতির এক আংশিক রূপকেই তারা তুলে ধরেছে।
কারবালার ঘটনা ও যে পরিপূর্ণ ও আসল চেহারায় কেমন ছিল,স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তিই তা উদঘাটন করতে পেরেছেন। আর অধিকাংশ ব্যক্তিই কারবালা ঘটনার একটি দিক বিশেষকে নিয়ে মূল্যায়ন করেছেন। এতক্ষণ ধরে আমরাও যে এটিকে একটি আন্দোলন বা একটি বিপ্লব বলে আখ্যায়িত করেছি সে ও ছিল কারবালার ঘটনার একটি দিক মাত্র । ইমাম হোসাইনের (আ.) শুধু বিদ্রোহ বললে তা সীমিত ও অংশবিশেষের অর্থকে প্রকাশকরে। সুতরাং আন্দোলন,বিদ্রোহ,বিপ্লব এ শিরোনামগুলোর পরিবর্তে‘‘
কারবালার ঘটনা’’
এ শিরোনাম ব্যাবহার করতে পারি। তাহলে হয়তো কারবালার ঘটনার সব ক’
টি দিককে শামিল করা যেতে পারে।
আমরা যদি পরিপূর্ণ ইসলামকে বাস্তবে দেখতে চাই তাহলে ইমাম হোসাইন (আ.) -এর এই মহান বিপ্লবের দিকেই তাকাতে হবে। তিনি কারবালার ময়দানে ইসলামের বাস্তব চিত্র একেছেন,সুদক্ষ শিল্পীর মতো তিনি ইসলামকে প্রতিমূর্ত করেছেন। এ জীবন্ত ও প্রাণবন্ত । কোনো প্রাণহীন ও শুস্ক প্রতিমূর্তির মতো নয়। তাই এ ঘটনার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করার সাথে সাথেই যে কোনো অনুভূতিসম্পন্ন মানুষই নিজের অজ্ঞাতে বলতে বাধ্য হবে যে,এটি কোন সহসা ঘটে যাওয়া ঘটনা নয়,বরং সুক্ষচিন্তা ও পরিকল্পনামাফিক এক আদর্শিক ঘটনার অবতারণা করা হয়েছে কারবালায়। আর এ আদর্শের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন স্বয়ং নবীদৌহিত্র এই ইমাম হোসাইন (আ.)। তাই প্রতি বছর এই হোসাইনী আদর্শকে সঠিক মূল্যায়ন ও উপযুক্ত মর্যাদা প্রদর্শনের মাধ্যমে ইসলামের এই জীবন্ত মুর্তিকে অক্ষয় রাখা প্রত্যেক মুসলমানেরই কর্তব্য ।
কারবালার ঘটনায় নারী-পুরুষ,শিশু-বৃদ্ধ,কালো-ধলো,আরব-অনারব,অভিজাত-গরীব সবারই ভূমিকা রয়েছে। যেন ইসলামের পরিপূর্ণ চেহারাটিকে ফুটিয়ে তোলার জন্যে মহান আল্লাহর সুদক্ষ হাত দিয়ে নকশা আঁকা হয়েছিল! এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। এ ঘটনায় নারীর ভূমিকা বলতে কেবলমাত্র হযরত জয়নাবের ভূমিকা ছিল তা নয়। তিনি ছাড়াও একাধিক মহিলা এ ঘটনায় ভূমিকা রেখেছিলেন। এমন কি কারবালার শহীদদের মধ্যে একজন নারীও ছিলেন। এছাড়া আরও দু’
জন মহিলা রীতিমত যুদ্ধের ময়দানে চলে আসেন। পরে অবশ্য ইমাম হোসাইন (আ.) তাদেরকে ফিরিয়ে আনেন। অনেক মহিলাই এ ঘটনায় সাহসী ভূমিকা রাখেন এবং কত মা তাদের নিজের সন্তানকে স্বহস্তে আল্লাহর পথে উৎসর্গ করেন।
এ অধ্যায়ে আমরা কারবালা ঘটনার এক সার্বিক ও সামষ্টিক চিত্র ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করবো।
এ ঘটনার তৌহিদী,আধ্যাত্মিক ও পবিত্রতার দিকগুলো তুলে ধরতে মক্কায় উচ্চারিত ইমাম হোসাইনের (আ.) বক্তৃতার এ দুটো লাইনই যথেষ্ট বলে মনে করি। তিনি বলেনঃ
رضی الله و الله رضانا اهل البیت
‘‘
আমরা নিজেরা কিছু পছন্দ করি না। আল্লাহ আমাদের জন্যে যেটা পছন্দ করেছেন সেটিই আমাদের পছন্দ অর্থাৎ আল্লাহর পছন্দই পছন্দ । আল্লাহ আমাদের জন্যে যে পথ নির্বাচিত করেছেন আমরা সে পথকেই পছন্দ করি।’’
(
বিহারুল আনওয়ারঃ 44
/
367
,
মাকতালুল মোকাররামঃ 193
,
আল লুহুফঃ 25
,
কাশফুল গোম্মাহঃ 2
/
29
)
ইমাম হোসাইনের (আ.) জীবনের শেষ মুহুর্তের কথাগুলোতেও এই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি ঘটে। একটির পর একটি তীরের আঘাতে ইমাম হোসাইন (আ.) যখন ক্ষত-বিক্ষত হয়ে শক্তিহীন হয়ে পড়েন এবং ঘোড়ার পিঠ থেকে মাটিতে পড়ে যান সে সময়ে বলেনঃ
رضا بقضائک و تسلیما لامرک، و لا معبود سواک، یا غیاث المستغیثین
‘‘
(হে আল্লাহ ) আপনার বিচারে আমি সন্তুষ্ট এবং আপনার আদেশর প্রতি আমি আত্মসমর্পিত। আপনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই,হে অসহায়দের সহায়।’’
(
মাকতালুল মোকাররামঃ 357
)
ইমাম জাফর সাদেক (আ.) বলেনঃ তোমরা ফরয ও নফল নামাযে সূরা আল-ফাজর পড়ো। এ সূরাটি আমার পূর্ব পুরুষ হযরত ইমাম হোসাইনের (আ.) সূরা। জিজ্ঞেস করা হলোঃ কী উপলক্ষে এটি আপনার পূর্ব পুরুষ ইমাম হোসাইনের (আ.) সূরা? ইমাম জাফর সাদেক (আ.) বললেন,এ সূরার শেষ আয়াতটির বাস্তব রূপ ইমাম হোসাইন (আ.)। আয়াত হলোঃ
)
يَا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ ﴿٢٧﴾ ارْجِعِي إِلَىٰ رَبِّكِ رَاضِيَةً مَّرْضِيَّةً ﴿٢٨﴾ فَادْخُلِي فِي عِبَادِي ﴿٢٩﴾ وَادْخُلِي جَنَّتِي(
‘‘
হে প্রশান্ত চিত্ত ! তুমি সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে তোমার প্রভূর কাছে ফিরে এসো। অত:পর আমার বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত হও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ করো।’’
(
আল
-
ফাজরঃ
27
-
30
)
আশুরার পবিত্র রাতটুকু কী অবস্থায় কাটালেন ইমাম হোসাইন (আ.)! তিনি কেবল নামায,দোয়া,কালাম,কোরআন মজীদ তেলাওয়াত,আল্লাহর সাথে শেষবারের মতো অনুনয়-বিনয় করার জন্যেই এই রাতটি অবসর চেয়ে নিয়েছিলেন। এমন কি আশুরার দিনেও ইমাম হোসাইনের (আ.) পরম ভক্তি ও স্বস্তিতে নামায পড়ার মধ্যে এ ঘটনার তৌহিদী ও ইবাদতী দিকটি ও চরমভাবে প্রকাশ পায়। আগেও উল্লিখিত হয়েছে,ইমাম হোসাইন (আ.) তার নিকটাত্মীয় স্বীয় ও বেশ কিছু সঙ্গী-সাথী আশুরার দিনে দুপুরের পর থেকে শহীদ হন। পরে যখন নামাযের সময় হলো তখন আবু আস-সায়দাবী নামক একজন সঙ্গী এসে ইমাম হোসাইনকে (আ.) বললেনঃ হে রাসূলুল্লাহর (আ.) সন্তান! আমাদের জীবনের শেষ আরজ হলো শেষবারের মতো আপনার পিছনে দাড়িয়ে একবার জামাআতে নামায পড়বো। চারদিক থেকে যখন বৃষ্টির মতো তীর আসছে তখন ইমাম হোসাইন (আ.) মরুভূমির মাঝখানে অবশিষ্ট গুটিকতেক সঙ্গী-সাথী নিয়ে নামাযে দাঁড়ালেন। যেন আল্লাহর ধ্যানে ডুবে গেলেন! পৃথিবীতে কী হচ্ছে তা তাদের জানা নেই। একবার চিন্তা করলেই বোঝা যাবে এ নামায কি নামায ছিল! একজন ইউরোপীয়ান ঐতিহাসিকও বলেনঃ ঐ মুহুর্তেও ইমাম হোসাইন (আ.) এমন নামায পড়লেন দুনিয়াতে যার কোনো নজীর নেই।
এ দৃষ্টিকোণ থেকে তাকালে দেখা যাবে যে,ইমাম হোসাইনের (আ.) আন্দোলন একটি পুরোপুরি আধ্যাত্মিক এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের আন্দোলন। এখানে একমাত্র লিল্লাহিয়াত এবং নিষ্ঠা ছাড়া অন্য কিছুই নেই। একদিকে কেবল ইমাম হোসাইন (আ.) এবং অপর দিকে আল্লাহ। এর মধ্যে অন্য কারো আনাগোনা নেই।
যদি আরেকটি দৃষ্টিকোণ থেকে লক্ষ্য করা হয় তাহলে দেখা যাবে যে,ইমাম হোসাইন (আ.) এমন একজন অটল ও দৃঢ়সংকল্প বিদ্রোহী যিনি অত্যাচারী ও স্বৈরাচারী অবৈধ শাসক মহলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন যাকে কোনো উপায়েই অবদমিত করা সম্ভব নয়। তার মুখ থেকে যেন অগ্নিবাণী বের হচ্ছে,একাধারে যিনি মান,সম্মান,মুক্তি,স্বাধীনতারও দাবি জানাচ্ছেন। তিনি বলেছেনঃ
‘‘
আল্লাহর শপথ করে বলছি যে,কক্ষোণই আমি তোমাদের কাছে নতি স্বীকার করবো না কিংবা দাস-দাসীদের মতো পালিয়েও যাব না। এ কাজ আমার পক্ষে অসম্ভব।
هیهات منّا الذلّة
-
“
নতি স্বীকার আমাদের মানায় না।
’’
তিনি আরো বলেনঃ
لا اری الموت الا سعادة والحیاة مع الظالمین الا برما
‘‘
আমি মৃত্যূর মধ্যে কল্যাণ ছাড়া অর কিছুই দেখি না এবং অত্যাচারীদের সাথে বেঁচে থাকার মধ্যে অপমান ছাড়া আর কিছুই দেখি না।’’
এসব বজ্র বাণী একই স্থানে বলেছেন। এগুলোর দিকে তাকালে শুধু সাহস,বীরত্ব,দৃঢ়তা এবং আরবদের ভাষায় অসম্মতি ও অস্বীকৃতি ছাড়া অন্য কিছুই চোখে পড়ে না। ইবনে আবীল হাদীদ একজন প্রসিদ্ধ পণ্ডিত। তিনি বলছেন,ইমাম হোসাইন‘
সাইয়েদুল ইবাতسیّد الابات
অর্থাৎ যারা জোর-জুলুমের কাছে নতি স্বীকার করে না তাদের সরদার। এখানে কেবলই প্রতিবাদ,বিদ্রোহ,হুমকি আর অস্বীকৃতি।
কিন্তু অন্য আরেকটি দৃষ্টিকোণ থেকে তাকালে দেখা যাবে যে,ইামাম হোসাইন (আ.) প্রকৃতই একজন শান্তিকামী,মঙ্গলকামী। এ দৃষ্টিতে তিনি এমন একজন ব্যক্তি যে তার শত্রুদের দুর্ভাগ্য ও অধঃপতন দেখে কষ্ট অনুভব করেন। তাদের জাহান্নামে যেতে দেখে তিনি নিজেই উদ্বিগ্ন হন। এখানে এসে বীরত্বের দুর্দমতা একজন শান্ত উপদেশদাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এমন কি আশুরার দিনেও ইমাম হোসাইন (আ.) ও তার সঙ্গীরা শত্রুদের কি পরিমাণ উপদেশ দিয়েছেন! তাদের দুর্গতি দেখে ইমাম হোসাইনের (আ.) পবিত্র অস্তিত্ব কষ্ট অনুভব করে। তিনি চান এখনই যেন তাদের টনক নড়ে এবং সমূহ ধ্বংসের হাত থেকে পরিত্রাণ লাভ করে। এমন কি একটি লোকও এই দুর্গতির আগুনে পুরে মরুক এটি ইমাম হোসাইন (আ.) দেখতে চান না। ইমাম হোসাইন (আ.) তার নানার উদাহরণ ছিলেন। সূরা তাওবার 128 নং আয়াতে বলা হচ্ছেঃ
)
لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِّنْ أَنفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُم بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ(
‘‘
তোমাদের বিপদগামিতা তার (রাসূলের) জন্যে খুবই কষ্টদায়ক। সব সময় তোমাদের মঙ্গল চান।’’
অথচ ইয়াযিদী বাহিনী বুঝতে পারে না যে,তাদের এ দুর্গতি ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্যে কত কষ্ট দায়ক! কিন্তু ইমাম হোসাইন (আ.) কিভাবে এ কষ্ট দুর করবেন? তিনি ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হলেন। পুনরায় ফিরে এসে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সেই পাগড়িটা মাথায় পরে নিলেন। এবার তিনি ঘোড়ায় চড়ে শত্রুদের কাছে আসলেন। যদি একজনকেও এই আগুনের অভিযাত্রী বাহিনী থেকে মুক্তি দেয়া যায় এই আশায় তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্তও চেষ্টা ছাড়েননি। এ দৃষ্টিতে ইমাম হোসাইন (আ.) কত দরদী বন্ধু ! তার মধ্যে কতই ভালবাসা-মহববত। এমন কি,যে শত্রুরা একটু পরেই তাকে হত্যা করবে তাদেরকেও তিনি সত্যিই ভালবাসেন।
এবার ইসলামের নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ ঘটনাকে পর্যবেক্ষণ করা যাক।এ দৃষ্টিতে দেখেল মনে হবে যে,কারবালার ঘটনায় ইসলামের চরিত্র অংকিত হয়েছে। সংক্ষেপে আমরা কারবালার ঘটনার তিনটি নৈতিক গুনের দিকে দৃষ্টিপাত করবঃ পৌরুষত্ব,ত্যাগ ও বিস্বস্ততা।
প্রথমত‘
পৌরুষত্ব’
-শব্দটির একটি বিশেষ অর্থ রয়েছে। এ অর্থ সাহসিকতার চেয়েও উর্ধ্বে। খন্দকের যুদ্ধের সময় আরবের নামকরা যোদ্ধা উমর ইবনে আব্দুদের সামনে যখন কেউ আসতে সাহস পায়নি তখন হযরত আলী (আ.) এগিয়ে গেলেন। এ ছিল হযরত আলীর (আ.) সাহসিকতার পরিচয়। কিন্তু উমর ইবনে আব্দুদকে ধরাশায়ী করে হযরত আলী (আ.) যখন তার বুকে চেপে বসলেন এবং ইবনে আব্দদু ক্রোধের চোটে হযরত আলীর (আ.) মুখে থুতু নিক্ষেপ করলো তখন হযরত আলী (আ.) তার বুক থেকে উঠে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণ পর তিনি শান্ত হয়ে ফিরে এলেন। এই বীরত্বকেই পৌরুষত্ব বলে। ঠিক তেমনিভাবে ইমাম হোসাইন (আ.) যে ঐ মুহুর্তেও পিপাসার্ত শত্রুকে পানি দান করলেন-এর অর্থই পৌরুষত্ব । আশুরার দিন ভোরবেলায় সর্ব প্রথম যে ব্যক্তি ইমাম পরিবারের তাবুর দিকে আসে সে ছিল শিমার। শিমার তার পিছন দিক থেকে এসে দেখলো যে,তাবুগুলো সব মুখোমুখি করে গাড়া হয়েছে এবং এর পিছন দিকে পরিখা খনন করে তার মধ্যে কাটাযুক্ত কাঠ জমা করে আগুন জ্বালানো হয়েছে। এ অবস্থা দেখে শিমারের পিছন দিক থেকে অতর্কিতে হামলা করার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয় এবং সে তখন অশালীন ভাষায় গালি-গালাজ শুরু করে। শিমারের ব্যাবহারে ক্ষিপ্ত হয়ে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর একজন সঙ্গী এসে বললেনঃ হে ইমাম ! আপনি অনুমতি দিন,আমি একটি তীরের আঘাতে ওকে পরপারে পাঠিয়ে দিই। ইমাম (আ.) বললেনঃ‘‘
না। সঙ্গী বললেনঃ আমি ওকে চিনি। ও কি জঘন্য জাতের লোক,কত বড় ফাসেক ও লম্পট তা আমি জানি। ইমাম (আ.) বললেনঃ‘‘
তা হোক। কিন্তু আমরা কখনও আগে শুরু করবো না। এমন কি তাতে আমাদের লাভ হলেও।’’
এ ছিল ইসলামের বিধান। এ সম্পর্কিয় একাধিক ঘটনা রয়েছে। এখানে সিফফিনের যুদ্ধের এক ঘটনা উল্লেখযোগ্য । কুরাইব ইবনে সাব্বাহ নামক মোয়াবিয়ার বাহিনীর একজন সৈন্য ময়দানে হাজির হয়ে আস্ফালন করে বলতে লাগলোঃ কার সাহস আছে! এসো দেখি! হযরত আলীর (আ.) বাহিনী থেকে একজন সাহসী সেনা এগিয়ে গেল। কুরাইব তাকে পরাজিত করলো ও তার লাশ এক পাশে রেখে দিয়ে আরেকজনকে আহবান করলো। হযরত আলীর (আ.) বাহিনী থেকে আরও একজন সেনা এগিয়ে গেল। কুরাইব তাকেও হত্যা করলো ও তক্ষুণি ঘোড়া থেকে নেমে এই লাশকে আগের লাশের উপরে এনে রাখলো। পুনরায় আরেকজনকে আহবান করলো এবং এভাবে পর পর চারজনকে হত্যা করে তাদের লাশগুলোকে একটির পর একটি তুলে রাখলো। ঐতিহাসিকরা লিখেছেন যে,এ ব্যাক্তির বাহু ও আঙ্গুলগুলো এতই শক্তিশালী ছিল যে,সে এক পয়সাকে হাতে নিয়ে পিষে দলা করে ফলতে পারতো। আরও বলা হয়েছে যে,কুরাইবের আস্ফালন দেখে হযরত আলীর (আ.) বাহিনীর প্রথম সারির লোকেরা পিছে সরে গিয়েছিল। এ পর্যায়ে হযরত আলী (আ.) নিজেই ময়দানে এলেন ও এক আক্রমণেই কুরাইবকে ধরাশায়ী করে ফেললেন। তারপর তার লাশকে একপাশে রেখে বললেন :
আর কেউ আছে? এভাবে মুয়াবিয়া বাহিনীর চারজনকে হত্যা করে তাদের লাশগুলোকেও একের পর একটি তুল রাখলেন। তারপর কোরআনের এই আয়াত পড়লেনঃ .
)
ﷲفَمَنِ اعْتَدَىٰ عَلَيْكُمْ فَاعْتَدُوا عَلَيْهِ بِمِثْلِ مَا اعْتَدَىٰ عَلَيْكُمْ(
‘‘
যে কেউ তোমাদেরকে আক্রমণ করবে তোমরাও তাকে অনুরূপ আক্রমণ করবে এবং আল্লাহকে ভয় করে চলবে।’’
(
বাকারা
-
194
)
এবার হযরত আলী (আ.) মুয়াবিয়া বাহিনীকে উদ্দেশ্য করে বললেন?
‘‘
তোমরা যদি যুদ্ধ আরম্ভ না করতে তাহলে আমরাও যুদ্ধে নামতাম না। এখন যেহেতু তোমরা শুরুই করলে তখন আমরাও যুদ্ধ করবো।’’
ইমাম হোসাইন (আ.) এ রকম ছিলেন। তিনি আশুরার দিন এমন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে,শত্রুরাই প্রথম যুদ্ধ আরম্ভ করবে। তারপর তিনি আক্রমণ করার অনুমতি দেবেন। এ ছিল পৌরুষত্ব -যা সাহসিকতার অনেক উর্ধ্বে ।