ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (২য় খণ্ড)

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (২য় খণ্ড)0%

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (২য় খণ্ড) লেখক:
: আব্দুল কুদ্দুস বাদশা
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: ইমাম হোসাইন (আ.)

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (২য় খণ্ড)

লেখক: শহীদ আয়াতুল্লাহ মুর্তাজা মোতাহহারী
: আব্দুল কুদ্দুস বাদশা
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 11232
ডাউনলোড: 3786

পাঠকের মতামত:

বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 12 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 11232 / ডাউনলোড: 3786
সাইজ সাইজ সাইজ
ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (২য় খণ্ড)

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (২য় খণ্ড)

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

হোসাইনী আন্দোলন মহান ও বীরত্বপূর্ণ আন্দোলন

বীরত্বপূর্ণ কথা হল সেই কথা যা দিয়ে মানুষের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বিপুল অনুপ্রেরণা ও অদম্য শক্তি যোগানো যায়। আর প্রকৃত বীরপুরুষ হলেন সেই ব্যাক্তি যার মধ্যে অন্যায় রোধের এ মানসিকতা জোয়ারের মতো উথলে পড়ে। যার মধ্যে মহত্ত্ব,ন্যায়পরায়ণতা,দৃঢ়তা,সততা,সত্যতা,অধিকার রক্ষায় কঠোরতা,সৎ-সাহস এবং মুক্তবুদ্ধি রয়েছে তিনিই হলেন আসল বীরপুরুষ।

কারবালা ঘটনার একপিঠে রয়েছে পাশিবক নৃশংসতা ও নরপিশাচের কাহিনী এবং এ কাহিনীর নায়ক ছিল ইয়াযিদ,ইবনে সা দ,ইবনে যিয়াদ এবং শিমাররা। আর অপর পিঠে ছিল একত্ববাদ,দৃঢ় ঈমান,মানবতা,সাহসিকতা,সহানুভূতি ও সহমর্মিতা এবং সত্য প্রতিষ্ঠায় আত্মদানের কাহিনী এবং এ কাহিনীর নায়ক আর ইয়াযিদরা নয়,বরং এ পিঠের নায়ক হলেন শহীদ সম্রাট ইমাম হোসাইন (আ.),তার ভগ্নি হযরত যয়নাব এবং তার ভাই হযরত আব্বাসরা,যাদেরকে নিয়ে বিশ্বমানবতা গৌরব করতে পারে। তাই কারবালা ঘটনার সমস্তটাই ট্রাজেডি বা বিষাদময় নয়। অবশ্য পৃথিবীতে বহু ঘটনাই ঘটেছে যেগুলোর কেবল একপিঠ রয়েছে অর্থাৎ এসব ঘটনা কেবলমাত্র দুঃখজনক ও শোকাবহ।

উদাহরণস্বরূপ,বিংশ শতাব্দীর তথাকথিত সভ্যতার লালন ভূমি ইউেরাপরে এক দেশ‘‘ বসিনয়ার’’ কথাই ধরা যাক-কেবল মুসলমানের গন্ধটুকু তাদের গায়ে থাকায় তাদের উপর চালানো হলো নির্মম গণহত্যা,নারী ধর্ষণ,ঘর-বাড়ী ধ্বংস.... ইত্যাদি ইত্যাদি। তাদের অপরাধ শুধু এটুকু যে,তারা ছিল মুসলমান। আর এ জন্যেই এটি দুঃখজনক যে,বিশ্বে আজ এতগুলো নিরাপত্তা সংস্থা রয়েছে যারা কুকুরের উপরে অত্যাচার করাকেও নিন্দা করে,রয়েছে মানবাধিকার সংস্থা জাতিসংঘ। অথচ এদের কোনটাকেই তোয়াক্কা না করে এক নিরস্ত্র-নিরীহ জাতিকে ধ্বংস করার পায়তারা চললো। কেউ তাদেরকে বাঁচাতে এগিয়ে এলো না। তাই এ ঘটনা সত্যিই দুঃখজনক। কিন্তু এ ঘটনার এই একটিমাত্রই পিঠ আছে যা কেবল নৃশংসতা ও পাশবিকতায় ভরা।

কিন্তু কারবালাকে এভাবে বিচার করলে অবশ্যই ভুল হবে। এ ঘটনার একটি কালো অধ্যায় ছিল সত্য,কিন্তু আরেকটি উজ্জ্বল অধ্যায়ও আছে। শুধু তাই নয়,এর উজ্জ্বল অধ্যায় কালো অধ্যায়ের চেয়ে শত-সহস্র গুণে ব্যাপক ও শ্রেষ্ঠ । শহীদ সম্রাট ইমাম হোসাইন (আ.) আশুরার রাতে তার সঙ্গী-সাথীদেরকে প্রশংসা করে বলেনঃ

فانّی لا اعلم اصحابا اوفی و لاخیرا من اصحابی

‘‘ আমি পৃথিবীতে তোমাদের চেয়ে বিশ্বস্ত ও উত্তম কোনো সহযোগীর সন্ধান পাইনি।’’ ( দ্রঃ তারিখে তাবারীঃ 6/238-9 , তারিখে কামেলঃ 4/24 ,বিহারুল আনোয়ারঃ 44তম খণ্ড,কিতাবুল ইরশাদঃ 231,এ লামুল অরাঃ 234,মাকতালু মোকাররামঃ 258,মাকতালু খারাযমীঃ 24)

তিনি কিন্তু বললেন না : আগামীকাল তোমাদেরকে নিরাপরাধভাবে হত্যা করা হবে। বরং তিনি এমন এক সনদপত্র পেশ করলেন যার মাধ্যমে তার সহযোগীরা বদরের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহর (সা.) সহযোগীদের চেয়েও মর্যাদাসম্পন্ন হলেন,তার পিতা হযরত আলী (আ.)-এর সহযোগীদের চেয়েও মর্যাদাসম্পন্ন হলেন। আম্বিয়াদের যারা সাহায্য করেছেন তাদেরকে উদ্দেশ্য করে পবিত্র কুরআনে বলা হচ্ছেঃ

وَكَأَيِّن مِّن نَّبِيٍّ قَاتَلَ مَعَهُ رِبِّيُّونَ كَثِيرٌ فَمَا وَهَنُوا لِمَا أَصَابَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّـهِ وَمَا ضَعُفُوا وَمَا اسْتَكَانُوا وَاللَّـهُ يُحِبُّ الصَّابِرِينَ

‘‘ কত নবী যুদ্ধ করেছেন,তাদের সাথে বহু আল্লাহওয়ালা ছিল। আল্লাহর পথে তাদের যে বিপর্যয় ঘটেছিল তাতে তারা হীনবল হয়নি ও নতি স্বীকার করেনি। আল্লাহ ধৈর্যশীলদেরকে পছন্দ করেন।’’ (আল ইমরানঃ 146)

অথচ ইমাম হোসাইন (আ.) প্রকারান্তরে তার সহযোগীদেরকে আম্বিয়াকেরামের এ সকল সহযোগীদের চেয়েও মর্যাদাসম্পন্ন বলে ঘোষণা দিয়েছেন।

সুতরাং আমরা যখন স্বীকার করলাম যে,কারবালার ঘটনায় দু টি পিঠ ছিল তখন গৌরবের এ পিঠ নিয়েও আমরা এক গবেষণা করে দেখতে চাই। পাশাপাশি এটিও আমাদের মেনে নিতে হবে যে,এতকাল ধরে আমরা কেবল কারবালার অন্ধকার ও কলুষতার দিকটা নিয়ে মাতামাতি করে বড় ভুল করেছি। কেননা,এতে করে আমরা মনের অজান্তেই ইয়াযিদদেরকে জয়ের মালা পরিয়েছি এবং তাদেরকেই নায়ক বানিয়েছি।

কেউ যদি ইমাম হোসাইনের (আ.) মর্মান্তিক শাহাদাত উপলক্ষে শোক মিছিল করে,অথচ অমানুষ ইয়াযিদের নামের পাশে সম্মানসূচক নানান শব্দও ব্যাবহার করে থাকে-তাহলে সে কারবালা থেকে কোন শিক্ষাই নিতে পারলো না। মহাপুরুষদের শ্রদ্ধা করা মানুষের এক সহজাত প্রবৃত্তি । অভ্যাসকে বিনষ্ট করার প্রচেষ্টা একান্তই বোকামি। কিন্তু মহাপুরুকে যেমন সম্মানভরে স্মরণ করা হয় তেমনি কাপুরুষকেও অবশ্যই ঘৃণা করা উচিত। কেননা,মহাপুরুষ ও কাপুরুষ উভয়কেই যদি আমরা শ্রদ্ধা করলাম-তাহলে হক আর বাতিলের মধ্যে আর কি-ই বা তফাৎ থাকলো? কাজেই,যে কেবল ইমাম হোসাইনের (আ.) মজলুমতাকে নিয়েই মূর্ছিত হবে সে যেমন ভুল করবে ঠিক তেমনিভাবে যে ইয়াজিদকে নায়ক বানিয়ে তার নামের পাশে সম্মানার্থক বিভিন্ন উপাধি ব্যাবহার করবে সেও একজন কাপুরুষকেই স্বীকৃতি দিল। যদিও আমরা সবাই ইমাম হোসাইনকে (আ.) শ্রদ্ধা করি।

দ্রুত পরিবর্তনশীল বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের ভাগ্য নিজের হাতেই গড়ার স্বার্থে হোসাইনী আন্দোলনের যথার্থ মূল্যায়নের মাধ্যমে আজ সেভাবেই এগিয়ে যাবার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য হয়ে উেঠেছ। সুখের ব্যাপার হল যে,মুসলমানরা ইদানীং এ ব্যাপারে যথেষ্ট ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।

যারা বীর তাঁদের আত্মা সাহসী। তারা তাদের এ সাহসকে নিজের দেশ ও জাতির স্বার্থে প্রয়োগ করে থাকে। কিন্তু যে বীর তার সাহসকে এমন কি মানবতার স্বার্থকে পেরিয়ে সমস্ত সৃষ্টিকুলের কল্যাণে প্রয়োগ করে-তিনি অবশ্যই আদর্শ ও অনুকরণীয়। কেননা তিনি সমস্ত শক্তি ও সাহসকে একমাত্র মহান অধিকর্তা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যেই কাজে লাগিয়েছেন। আর এ কারণেই এ বীরত্ব মহান ও পবিত্রও বটে।

ভীরু কোনিদন বীর হতে পারে না। নাদির শাহ,বখিতয়ার খিলজী,নেপোলিয়ান-এরা সবাই সাহসী। সাহস ছিল বলেই এরা দেশজয় করতে পেরেছিল। এদের সবারই দৃঢ় মনোবল ও দুর্দম সাহস ছিল। এরা বীরও ছিল বটে। কিন্তু তাদের এ সাহস-তাদের এ বীরত্ব পবিত্র ও মহৎ নয়। এদের সবাই হুকুমতের লোভে,পদের লোভে ও স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যেই সাহস দেখিয়েছে। এরা অন্য জাতির রক্ত নিংড়িয়ে নিজের নাম ইতিহাসে অমর করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। স্বদেশের কাছে সে হয়তো একজন মহাবীর,কিন্তু পরাজিত জাতির কাছে সে চরম শত্রু। নেপোলিয়ান ফরাসিদের চোখে হয়তো একজন মহান বীর,কিন্তু রুশ কিংবা ইংরেজদের কাছেও কি সে মহাবীরের সম্মান পাবে? -কখনই না। কারণ,সে রুশ ও ইংরেজদের মান-ইজ্জত পদদলিত করে ফ্রান্সের মর্যাদা বাড়াতে চেয়েছিল। এসব ব্যক্তি সাহসী বীর ছিলেন। কিন্তু তাদের বীরত্ব আত্মসিন্ধির বীরত্ব । নিজের স্বার্থ পুরণের বীরত্ব । একজন বড় সাম্রাজ্যবাদীর বীরত্ব । কিন্তু এ বীরত্ব তো কখনো মহৎ হতে পারে না। মহৎ ও পবিত্র বীরত্বের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন রকম। সে সব বৈশিষ্ট্য দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে যে,নেপোলিয়ান,ইস্কান্দার এরা মহান বীর ছিল না। মহান বীর হলো সেই ব্যক্তি যিনি নিজের স্বার্থ,দেশের স্বার্থ,জাতির স্বার্থ,এমন কি নিজের মহাদেশেরস্বার্থের জন্যেও বাহাদুরি দেখায় না। তার লক্ষ্য এসব দেশ-জাতির সীমানার উর্ধ্বে । সে কেবল হাকীকত ও সত্যকেই দেখে। সংক্ষেপে বলতে গেল বলতে হয় যে,সে সমস্ত মনুষ্যত্বও মানবতার জন্যে নিজের সাহস প্রয়োগ করে। উদাহরণস্বরূপ কোরআনের এই আয়াতটি উল্লেখ্য :

) قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلَىٰ كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلَّا نَعْبُدَ إِلَّا اللَّـهَ وَلَا نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلَا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللَّـهِ(

‘‘ বলুন,হে আহলে কিতাবগণ! এসো সে কথায় যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে একই;যেন আমরা আল্লাহ ব্যতীত কারো উপাসনা না করি,কোনো কিছুকেই তার শরীক না করি এবং আল্লাহ ব্যাতীত আমাদের কাউকে প্রতিপালক রূপে গ্রহণ না করি।’’ (আল ইমরানঃ 64)

অর্থাৎ তোমরা যারা আহলে কিতাব বলে দাবী করো! এসো আমরা সবাই এক সুরে কথা বলি;এক আকীদার স্বার্থে আমরা নিজেদেরকে বিলীন করে দেই,আমরা সবাই জোর কন্ঠে ঘোষণা করিঃ

الا نعبد الا الله

আমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও দাসত্ব মানি না।

و لا یتّخذ بعضا بعضا اربابا من دون الله

এসো শোষণ-নিপীড়নের অবসান ঘটাই,মানব পূজা বন্ধ করি,সমাজে ন্যায়-নীতি এবং সমতা ও সামঞ্জস্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করি। কোরআন বলেনি যে,এসো আমার ও তোমার জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে অপর এক জাতিকে শোষণ করি। এ ধরনের কোনো কথাই কোরআনে পাওয়া যাবে না। তাই কোনো আন্দোলন-কোনো বীরত্ব তখনই মহান ও পবিত্র হবে যখন তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যও পবিত্র ও মহান হবে,তা সমস্ত মানবতার পথে পরিচালিত হবে যেমনভাবে সূর্য তার আলো দিয়ে সমস্ত জাতি ও সব মানুষকেই উপকার প্রদান করে।

দ্বিতীয় যে বৈশিষ্ট্য কোনো আন্দোলন ও বিদ্রোহকে মহান করে তা হলো এমন এক বিশেষ পরিস্থিতিতে এ আন্দোলন অনুষ্ঠিত হবে যখন কোনো মানুষ এর ধারণাও করতে পারে না। ঘন অন্ধকারের মধ্যে এক খণ্ড আলোর ঝলকানি,ব্যাপক জুলুম-স্বৈরাচারের মধ্যে ন্যায়পরায়ণতার বজ্র আওয়াজ,চরম স্থবিরতার মধ্যে প্রকাণ্ড ধাক্কায় নিস্তব্ধ নিশ্চুপের মধ্যে হঠাৎ গর্জে ওঠা। উদাহরণস্বরূপ নমরুদের মতো একজন অত্যাচারী শোষক পৃথিবীকে গ্রাস করে ফেলে। কিন্তু আজীবন এ পিরিস্থিতি অব্যাহত থাকেনি। হঠাৎ করে একজন ইবরাহীমের (আ.) আবির্ভাব ঘটে ও নমরুদের কাল হয়ে দাঁড়ায়।

) إِنَّ إِبْرَاهِيمَ كَانَ أُمَّةً قَانِتًا(

‘‘ ইবরাহীম একাই এক অনুগত জাতি ছিলেন।’’ (নাহলঃ 120) তেমনি ফেরাউনের মতো একজন নির্দয় ও অহংকারীও রক্ষা পায়নি। কোরাআন ভাষায় :

) إِنَّ فِرْعَوْنَ عَلَا فِي الْأَرْضِ وَجَعَلَ أَهْلَهَا شِيَعًا يَسْتَضْعِفُ طَائِفَةً مِّنْهُمْ يُذَبِّحُ أَبْنَاءَهُمْ وَيَسْتَحْيِي نِسَاءَهُمْ(

‘‘ ফেরাউন দেশে পরাক্রমশালী হয়েছিল এবং সেখানকার অধিবাসীদেরকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করে তাদেরকে সে হীনবল করেছিল। তাদের পুত্রদেরকে সে হত্যা করতো এবং নারীদেরকে সে জীবিত রাখত।’’ (কাসাস-4)

কিন্তু এই পরাক্রমশালী ফেরাউনও টেকেনি। হঠাৎ করে একজন মূসা (আ) তার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন।

তারপর আরব যখন শোষণ-নিপীড়ন,মূর্তিপূজা,কন্যাসন্তানকে জীবিত হত্যা,রক্তপাত,দ্বন্দ-কলহ,ব্যভিচারে এবং অন্ধকারে ছেয়ে গেল তখন একজন মুহাম্মদের (সা.) আবির্ভাব হয় যিনি ফরিয়াদ করে বলতে থাকেনঃ

) قولوا لا اله الله تفلحون(

‘‘ বলো,আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই,তবেই তোমরা সুখী হতে পার।

আর আজ স্বৈরাচারী উমাইয়া সরকার স্বীয় স্বার্থসিন্ধির জন্যে সকল সাজ-সরঞ্জামে সজ্জিত হয়ে উঠে পড়ে লেগেছে। এমন কি ধর্মকে ভাঙ্গিয়েও সৈরতন্ত্রের ভিত গাড়তে উদ্যত হয়েছে,দুনিয়ালোভী হাদীস বর্ণনাকারীদেরকে টাকা দিয়ে কিনে তাদের সপক্ষে হাদীস জাল করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। বলা হয়,একজন দরবারী আলেম বলেছিলঃ

انّ الحسین قتل بسیف جدّه

‘‘ ইমাম হোসাইন (আ.) তার নানার তেলোয়ারের আঘাতেই নিহত হয়েছেন।’’ একথার মাধ্যমে সে বলতে চেয়েছিল যে,ইমাম হোসাইনের (আ.) নানার ধর্মমতেই তাকে হত্যা করা হয়েছে।

কিন্তু আমি (ওস্তাদ মোতাহারী) বলবো যে,এক অর্থে একথা ঠিকই। কেননা,বনি উমাইয়া ইসলামকে এমনভাবে তাদের শোষণ ও স্বৈরাচারের সেবায় নিয়োগ করতে পেরেছিল যে,একদল দুনিয়ালোভী ও নামমাত্র মুসলমানকে ইসলামী জিহাদের নামে ইমাম হোসাইনের (আ.) বিরুদ্ধে লিপ্ত করতে সক্ষম হয়।

و کل یتقرّبون الی الله بدمه

‘‘ তারা ইমাম হোসাইনের (আ.) বুকের রক্ত ঝরিয়ে আল্লাহর নৈকট্য পেতে চায়।’’ তারা ইমাম হোসাইনকে (আ.) হত্যা করতে পারার জন্যে শোকর আদায়স্বরূপ একাধিক মসিজদ নির্মাণ করে। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় যে,মানুষকে কিভাবে বিভ্রান্ত করা হয়েছিল।

এ রকম এক বিপর্যয়ের মুহুর্তে ইমাম হোসাইন (আ.) মুক্তির মশাল জ্বালিয়ে এগিয়ে এলেন। যখন মানুষের বাক স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়েছিল,মানুষের মতামত প্রকাশের কোনো সাহস ছিল না। কোনো সত্যি কথা বলাও যখন কারও সাহসে কুলাতোনা,এমন কি এর কোনো প্রতিরোধ অবাস্তবে পরিণত হয়-ঠিক সে মুহুর্তে ইমাম হোসাইন (আ.) বীরদর্পে বিরোধিতায় নামলেন,বজ্রকন্ঠে সত্যবাণীর স্লোগান তুলে দুনিয়া কাপিয়ে দিলেন। খোদাদ্রোহী স্বৈরাচারের মেরুদণ্ড গুঁড়িয়ে দিলেন। আর এ কারণেই তার আন্দোলন মহিমা লাভ করেছে। তার আন্দোলন কালের গন্ডী ছাড়িয়ে যুগ-যুগান্তরের মুক্তি কামী ও সত্যান্বেষী মানুষের জন্যে অনুকরণীয় আদর্শে পরিণত হয়েছে।

তৃতীয় যে বৈশিষ্ট্যটি হোসাইনী আন্দোলনকে মহতী ও পবিত্র করেছে তা হলো ইমাম হোসাইনের (আ.) দুরদর্শিতা ও উন্নত চিন্তাধারা। অর্থাৎ এ আন্দোলন এ কারণেই মহান যে,আন্দোলনকারী যা বুঝতে ও দেখতে পারেছন তা অন্য কেউ দেখতে পাচ্ছে না। ঐ প্রবাদ বাক্যেটির মতো বলতে হয় যে,অন্যরা আয়নায় যা দেখতে পাচ্ছে না তিনি খড়কুটোর মধ্যেই তা দেখছেন। তিনি তার একাজের সুদূর প্রসারী ভাব দেখতে পাচ্ছেন। তার চিন্তাধারা সমসাময়িক যেকানো চিন্তাশীল লোকের উর্ধ্বে । ইবনে আব্বাস,ইবনে হানাফিয়া,ইবনে উমর প্রমুখ হয়তো পুরোপুরি নিষ্ঠার সাথে ইমামকে (আ.) কারবালায় যেতে নিষেধ করিছিলেন। তাদের চিন্তার মান অনুযায়ী ইমামকে বাধা দেয়াই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু হোসাইন (আ.) যা দেখেছিলেন তারা তা দেখতে পাচ্ছিলেন না। তারা অত্যাসন্ন বিপদকেও যেমন অনুভব করছিলেন না তেমনি এ ধরনের আন্দোলন ও বিদ্রোহের সুদুরপ্রসারী ভাবকেও অনুধাবন করতে পারছিলেন না। কিন্তু ইমাম হোসাইন (আ.) সবকিছুই দিনের আলোর মতো দেখছিলেন। তিনি একাধিকবার বলেছেনঃ ওরা আমাকে হত্যা করবেই;আর আল্লাহর শপথ করে বলছি যে,আমার হত্যার পর ওদের অবস্থা বিপন্ন হবে। এ ছিল ইমাম হোসাইনের (আ.) তীক্ষ্ণ দুরদর্শিতা।

ইমাম হোসাইন (আ.) এক মহান ও পবিত্র আত্মার নাম। মূলত যখন কোন আত্মা মহান হয় তখন বেশী কষ্টের সম্মুখীন হয়। কিন্তু ছোট আত্মা অধিক নির্ঝঞ্জাটে থাকে। এ এক সার্বিক নিয়ম। ইবনে আব্বাসরা যদি ইমাম হোসাইনকে (আ.) বাধাও দেয় তবুও কি তিনি বিরত হতে পারেন! আরবের খ্যাতনামা কবি মোতানাববী এ প্রসঙ্গে সুন্দর একটি উক্তি করেছেন,তিনি বলেন :

تبعت فی مرادها الاجسام

و اذا کانت النفوس کبارا

 ‘‘ যখন কোনো আত্মা মহান হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই সে অন্যদের পরিত্রাণে ছোটে,অন্যদের জন্যে কষ্ট ও যন্ত্রণা বরণ করে নেয়। কিন্তু যার আত্মা ছোট সে কেবল নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ নিয়েই।’’ ( দিওয়ানে মোতানাববীঃ 2/267) ছোট আত্মা একটু ভাল খাবারের জন্যে চাটুকারও হতে রাজি। ছোট আত্মা ক্ষমতা বা খ্যাতির লোভে হত্যা-লুন্ঠনও করতে রাজি। কিন্তু যার রয়েছে মহান আত্মা ,সে শুকনো রুটি খেয়ে তৃপ্ত হয়,তারপর ঐ সামান্য আহার শেষে সারারাত জেগে আল্লাহর স্মরণে নিমগ্ন হয়। নিজের দায়িত্ব পালনে বিন্দুমাত্র গাফলতি করলে ভয়ে তার শরীর কাপতে থাকে। যার আত্মা মহান সে আল্লাহর পথে ও স্বীয় মহান লক্ষ্যে নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে চায়। আর এ পথে যখন সফলকাম হয় তখন আল্লাহকে শোকর করে। আত্মা মহান হলে আশুরার দিনে,এক শরীরে তিনশ ক্ষত সহ্য করতে হয়। যে শরীর ঘোড়ার পায়ে পয়মল হয় সে একটি মহান আত্মার জরিমানা দেয়,একটি বীর,সত্য পূজারী এবং শহীদের আত্মার জরিমানা দেয়।

এই মহান আত্মা বলে ওঠে আমি আমার রক্তে মূল্য দিতে চাই। শহীদ কাকে বলে? প্রতিদিন কত মানুষ নিহত হচ্ছে । কিন্তু তাদেরকে কেন শহীদ বলা হয় না? শহীদ শব্দটি ঘিরে কেন এক পবিত্রতার আবেশ পাওয়া যায়? কারণ শহীদ সেই ব্যক্তি যার এক মহান আত্মা আছে সে আত্মা এক মহান লক্ষ্যকে অনুসরণ করে। শহীদ সে ব্যক্তি যে স্বীয় ঈমান ও আকীদা রক্ষায় প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে,যে নিজের জন্যে তো নয়ই বরং মনুষ্যত্ব ও মানবতার স্বার্থে,সত্য ও হাকিকতের স্বার্থে চরমদুঃখ-দুর্দশা এমন কি মৃত্যুকেও সাদরে বরণ করে নেয়। শহীদ তার বুকের রক্ত দিতে চায় যেমনভাবে একজন ধনী তার ধনকে ব্যাংক বন্দী না করে তা সৎপথে দান-খয়রাত করে স্বীয় ধনের মূল্য দিতে চায়। সৎপথে ব্যয়িত প্রতিটি পয়সা যেমন লক্ষ -কোটি পয়সার মতো মূল্য লাভ করে তেমনি শহীদের প্রতি ফোটা রক্ত লক্ষ-কোটি ফোটায় পরিণত হয়। অনেকে হয়তো স্বীয় চিন্তাশক্তির মূল্য দেয় ও একটি আদর্শিক গ্রন্থ মানবকে উপহার দেয়। কেউ কেউ নিজের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে একটি উপকারী শিল্প মানুষকে উপহার দেয়। কিন্তু শহীদরা তাদের রক্ত দিয়ে মানবের শান্তি ও কল্যাণের পথকে মসৃণ ও সুনিশ্চিত করে।

এখন প্রশ্ন হলো: এদের মধ্যে কে মানবতাকে সবচেয়ে বেশী সেবা করলো ?

অনেকে হয়তো ধারণা করতে পারে যে,একজন লেখক বা একজন ধনী কিংবা একজন শিল্পীর সেবাই সবচেয়ে বেশী। কিন্তু আসলে এ ধারণা একবারেই ভুল। শহীদদের মতো কেউই মানুষকে তথা মানবতাকে সেবা করতে পারে না। শহীদরাই সমস্ত কন্টকময় পথ পেরিয়ে মানবতার মুক্তি ও স্বাধীনতাকে বয়ে নিয়ে আসে। তারাই ন্যায়-নীতিবান ও শান্ত সমাজ গড়ে দিয়ে যায় যাতে জ্ঞানীর জ্ঞান,লেখেকর কলম,ধনীর ধন,শিল্পীর শিল্প সুস্থ পরিবেশে বিনা বাধায় বিকাশ লাভ করতে পারে এবং মানবতা নিশ্চিন্তে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যেতে পারে। শহীদরাই প্রদীপের মতো একটি পরিবেশকে আলোকিত করে রাখে যাতে সবাই অনায়াসে পথ চলতে পারে।

পবিত্র কোরআন রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে একটি প্রদীপের সাথে তুলনা করেছে। জগতে অবশ্যই প্রদীপ থাকতে হবে। অন্ধকার জগত নীরব-বধির,জীবনযাত্রা সেখানে অচল। এ সম্বন্ধে প্রখ্যাত কবি পারভীন এ তেসামী সুন্দর একটি উপমার অবতারণা করেছেন। তিনি একজন দক্ষ শিল্পী ও একটি প্রদীপের কথোপকথনকে এভাবে চিত্রিত করেছেন-

شاهدي گفت به شمعی کامشب

دور ديوار مزين کردم

ديشب از شوق نخفتم يکدم

دوختم جامه و برتن کردم

کس ندانست چه سحر آميزی

به پرند از نخ و سوزن کردم

توبگرد هنرمن نرسی

زانکه من بذل سر وتن کردم

শিল্পী প্রদীপকে বলেঃ তুমি জান না,আমি গত রাতে এক মুহুর্তেও ঘুমাইনি। সারা রাত জেগে কত সুন্দর সুন্দর ফুল তুলেছি। আমার জামাটিকে ফুলবাগিচা বানিয়েছি। তুমি কখনোই আমার মতো ফুল তুলতে পারবে না। আমি আমার শরীরকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করতে অসামান্য দক্ষতা খরচ করেছি।

শিল্পীর একথা শুনে প্রদীপ একটু মুচকি হেসে বললোঃ

شمع خنديد که بس تيره شدم

تا ز تاريکيت ايمن کردم

پی پيوندگهرهای تو بس

گهر اشک بدامن کردم

توبگرد هنرمن نرسی

حاصل شوق تو خرمن کردم

তুমি যে দাবী করছো সারা রাত জেগে তোমার রুচি ও দক্ষতাকে ফুটিয়ে তুলেছো-এসবই ছিল আমার আত্ম -নিঃশেষ করার ফল। আমি তিলে তিলে ক্ষয় হয়েছি ও তোমাকে আলো দিয়েছি বলেই তো তুমি তোমার দক্ষতাকে সুচ ও সুতোয় আাকতে পেরেছো। তোমার এসব দক্ষতা আমার জীবনের বিনিময়েই সম্ভব হয়েছে। তারপর বলছে:

کارهايی که شمردی برمن

تو نکردی همه را من کردم

 ‘ তাই তুমি সারা রাত ধরে যা করেছ বলে দাবী করছো-এসবই আমি করেছি।

আজকে ইবনে সিনা-ইবনে সিনা হতো না,শেখ সাদী-শেখ সাদী হতো না,জাকারিয়া রাজী-জাকারিয়া রাজী হতে পারতো না যদি শহীদরা তাজা রক্ত খরচ করে ইসলামের চারাগাছকে সজীব না করতেন,ইসলামী সভ্যতাকে বাঁচিয়ে না রাখতেন। তাদের সমস্ত অস্তিত্বে একত্ববাদ, খোদাভীতি,ন্যায়পরায়ণতা,সৎসাহস আর বীরত্বে ভরপুর। তাই আমরা আজ যারা মুসলমান হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছি তারা সবাই এ শহীদদের প্রতি ঋণী। ইমাম হোসাইনের (আ.) রক্তের প্রতি নবীজীর (সা.) উম্মত ঋণী।

মনস্তত্ত্ববিদরা বিশেষ করে যারা মহামানবের জীবন চরত্রি লেখেন তারা বিভিন্ন ব্যক্তির মানসিকতা উদ্ধারের জন্যে এক চাবির খোজ করেন। তারা বলেন,প্রতিটি ব্যক্তিত্বের একটি নির্দিষ্ট চাবি রয়েছে,যদি ঐ চাবিটি খুজে পাওয়া যায় তাহলে ঐ ব্যক্তির জীবনের সঠিক ব্যাখ্যা করা যায়। অবশ্য এ কাজ খুব সহজ নয়। বিশেষ করে যারা বিরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। মিশেরর খ্যাতনামা চিন্তাবিদ আব্বাস মাহমুদ আক্কাদ‘‘ আবকারিয়াতুল ইমাম’’ নামে একটি বই রচনা করেছেন। সেখানে তিনি মত ব্যক্ত করেন যে,আমি হযরত আলীর (আ.) ব্যক্তিত্বের চাবি খুজে পেয়েছি। হযরত আলী (আ.) এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন যিনি যুদ্ধের ময়দানে,সাংসারিক জীবনে,ইবাদতের মেহরাবে,শাসনামলে সবক্ষেত্রেই এবং জীবনের প্রতিটি পদেই তিনি পৌরুষত্বের অধিকারী ছিলেন। পৌরুষত্ব সাহসিকতার অনেক উর্ধ্বে । মহাকবি রুমী 700 বছর আগেই ঘোষণা করে গেছেন যে,হযরত আলীর (আ.) ব্যক্তিত্বে সাহসিকতার উর্ধ্বে কিছু ছিল।

খন্দকের যুদ্ধে হযরত আলী (আ.) যখন আরবের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা উমার ইবনে আব্দুদকে ধরাশায়ী করে তার শিরচ্ছেদ করার জন্যে তার বুকে চেপে বসলেন তখন উমার ইবনে আব্দুদ রাগের চোটে হযরত আলীর (আ.) মুখে থুথু নিক্ষেপ করলো। হযরত আলী (আ.) উঠে দাঁড়ালেন এবং দু তিন পদক্ষেপে হেটে হেটে যখন শান্ত হলেন তখন পুনরায় তার বুকে চেপে বসলেন। উমার ইবনে আব্দুদ হযরত আলীর (আ.) আচরেণ আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো : আগের বার আমার গলা কাটতে এসে উঠে গেলে কেন? হযরত আলী (আ.) বললেন,তুমি যখন আমার মুখে থুথু দিলে তখন আমি খুব রেগে গিয়েছিলাম এবং এ রাগ ছিল আমার ব্যক্তিগত ক্রোধ থেকে। তাই আমি যদি তখন তোমাকে শিরচ্ছেদ করতাম তাহলে তাতে আমার ব্যক্তিগত ক্রোধেরও অংশ থাকতো। কিন্তু আমি চাই আল্লাহর শত্রুকে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যেই হত্যা করতে। নিজের ক্রোধবশত হত্যা করার কোনো খাহেশ আমার নেই। মাওলানা রুমী এ ঘটনাকে খুব চমৎকারভাবে কবিতার লাইনে বেধেছেন। তিনি বলেনঃ

در شجاعت شير ربانيستی

در مروت خود که داند کيستی

সাহসিকতায় তুমি আল্লাহর সিংহস্বরূপ কিন্তু পৌরুষত্ব ও বীরত্বের দিক থেকে তুমি কে তা কেউ বর্ণনা করতে অক্ষম। পৌরুষত্ব ও বীরত্বে তুমি অতুলনীয় এবং তা প্রকাশ করার জন্যে উপযুক্ত কোনো ভাষা নেই। ( ফি রেহাবে আয়েম্মেয়ে আহলে বাইত :3/97 , মানাকিবে ইবনে শহরে অশুবঃ 4/69 ,মাকতালু মোকাররমঃ 218, বিহারুল আনোয়ারঃ 45/238 ,ইরশাদে মুফিদঃ 225,এলোমুল ওরাঃ 230) ঐ মিশরীয় চিন্তাবিদও হযরত আলীর (আ.) এই পৌরুষত্বের দিকেই ইশারা করেছেন।

প্রকৃতপক্ষে কেউ যদি হযরত আলীর (আ.) কিংবা হযরত ইমাম হোসাইনের (আ.) মত মহাপুরুষদের ব্যক্তিত্বের চাবি উদ্ধার করতে পেরেছে বলে দাবী করে তাহলে তাদের এ দাবী অতিরঞ্জিত বৈ কিছু কিছুই নয়। গবেষণার পর শুধু যেটুকু বলা যায় তাহলো যে ইমাম হোসাইনের (আ.) ব্যক্তিত্বের চাবি পৌরুষত্ব,বীরত্ব,বিচক্ষণতা,মহত্ত্ব,দৃঢ়তা,অটলতা এবং সত্য পূজারীর মধ্যেই নিহিত রয়েছে।

ইমাম হোসাইনের (আ.) বাণী কমই আমাদের কাছে পৌছেছে। তবে যেটুকু আছে তা থেকেই তার এ মহান মানসিকতার স্পষ্ট প্রমাণ মেলে। ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কাছে জিজ্ঞেস করা হলো যে,আপনি যেসব কথা নিজ কানে রাসূলুল্লাহর (সা.) কাছ থেকে শুনেছেন তার থেকে দু একটি আমাদেরকে বলুন। তখন ইমাম হোসাইন (আ.) রাসূলুল্লাহর (সা.) শত-সহস্র বাণীর মধ্যে কোন বাণীটি নির্বাচন করলেন তা থেকেই সহজে ইমাম হোসাইনের (আ.) ব্যক্তিত্বের ধরন অনুধাবন করা যায়। ইমাম হোসাইন (আ.) বললেন,আমি নিজ কানে রাসূলুল্লাহর (সা.) মুখ থেকে যা শুনেছি তা হলোঃ

اِنَّ اللهَ تَعَالَی يُحِبُّ مَعَالِی الْاُمُورِ وَاَشْرَافَهَا وَ يَکْرَهُ سَفْسَافَهَا

‘‘ আল্লাহ বড় এবং মহান কাজকে পছন্দ করেন এবং নীচ কাজকে তিনি ঘৃণা করেন।’’ ( জামেউস সাগীর 1/75)

ইমাম হোসাইনের (আ.) মর্যাদা এবং মহত্ত্ব কোথায়! রাসূলুল্লাহর (সা.) বাণী থেকে কোনটি নির্বাচন করে নিলেন ? মূলত তিনি নিজেকেই তুলে ধরেছেন।

ইমাম হোসাইনের (আ.) প্রতিটি কথায় মনুষ্যত্ব ও মানবতার ইজ্জত সম্মান এবং মর্যাদা প্রতিফলিত হয়েছে। -

مَوْتُ فِی عِزٍّ خَيْرٌ مِنْ حَيَاةٍ فِی ذُلٍّ

অর্থাৎ,‘‘ সম্মানের মৃত্যু অপমানের জীবনের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।’’

অন্য এক বাণীতে তিনি বলেন :

 اِنَّ جَمِيعَ مَا طَلَعَتْ عَلَيْهِ الشَّمْسُ فِي مَشَارِقِ الْاَرْضِ وَ مَغَارِبِهَا بَحْرِهَا وَ بَرِّهَا وَ سَهْلِهَا وَجَبَلِهَا عِنْدَ وَلِيٍّ مِنْ اَوْلِيَاءِ اللهِ وَاَهْلِ الْمَعْرِفَةِ بِحَقِّ اللهِ آَفَيْئِ الظِّلَالِ.

যা কিছুর উপর সূর্য আলো দান করে-সারা দুনিয়া এবং তার বাসিন্দারা,সাগর-মাটি,পাহাড়-পর্বত-মরুভূমি এসব কিছুই একজন খোদাভক্ত এবং খোদা-পরিচিত ব্যক্তির কাছে একটি ছায়ার চেয়ে মূল্যবান কিছু নয়। এরপর তিনি বলেন :

اَلَا حُرٌّ يَدَعُ هَذِهِ اللُّمَاظَةَ لِاَهْلِهَا

  এমন কাউকে কি পাওয়া যাবে না যে দুনিয়া ও তার মধ্যে যা আছে তার প্রতি অনাসক্ত থাকবে? (লুমআতু মেন বালাগাতিল হোসাইন নাফাসুল মাহমুম)

যারা দুনিয়া নিয়ে মত্ত এং দুনিয়ার দাসত্ব করে তারা আসলে জানে না যে,এমন কিছু লুমাযাহ র মতো। লুমাযাহ -র অর্থ কী? মানুষ যখন ভাত খায় তখন তার দাঁতের ফাঁকে হয়তো এক টুকরো গোস্ত কিংবা এক টুকরো খাবার বেঁধে থাকে। যা খুঁচিয়ে বের করতে হয়। এই বেঁধে যাওয়া খাদ্য টুকরোকেই লুমাযাহ বলে। ইমাম হোসাইনের (আ.) চোখে ইয়াযিদ,ইয়াযিদের হুকুমত,ইয়াযিদের দুনিয়া সবকিছুই ঐ এক টুকরো লুমাযাহর মতো।

তারপর তিনি বলেনঃ‘‘ হে মানুষ! জেনে রেখো যে,জগতে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কিছু নেই যার কাছে তুমি নিজেকে সোপর্দ করতে পারো। যার কাছে তুমি নিজের আত্মা ও জীবনকে বেচে দিতে পারো। তোমরা দুনিয়ার কাছে নিজেকে বেচে দিও না,স্বাধীন ও মুক্ত মানুষ হও,দাসত্বের শৃঙ্খলে নিজেকে বেঁধে ফেলো না। ইসলামের অনুসারী হও। একমাত্র ইসলামই তোমাদেরকে মুক্তি ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিতে পারে। একমাত্র আল্লাহর ইবাদত কর। তাহলেই পরাধীনতার শৃঙ্খল তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউই উপাসনার যোগ্য নয়। একমাত্র আল্লাহকে উপাসনা করো তাহলে দুনিয়া নিজেই তোমাদের পদতলে সমাহিত হবে।’’

কারবালার পথে অনেকেই ইমাম হোসাইনকে (আ.) বলেছে যে,এ পথ বিপজ্জনক? আপনি বরং ফিরে যান। ইমাম হোসাইন (আ.) তাদের জবাবে এ কবিতা পড়েনঃ

سَاَمْضِي وَمَا بِالْمَوْتِ عَارٌ عَلَي الْفَتَي

اِذَا مَا نَوَي حَقّاً وَ جَاهَدَ مُسْلِماً

وَ وَاسَي الرِّجَالَ الصَّالِحِينَ بِنَفْسِهِ

وَ فَارَقَ مَثْبُوراً وَ خَالَفَ مُجْرِماً

اُقَدِّمُ نَفْسِي لَا اُرِيدُ بَقَائَهَا

لِتَلْقَي خَمِيساً فِي الْهَيَاجِ عَرَمْرَماً

فَاِنْ عِشْتُ لَمْ اَنْدَمْ وَاِنْ مِتُّ لَمْ اُلَمْ

آَفَي بِكَ ذُلا اَنْ تَعِيشَ وَ تُرْغَما

‘‘ আমাকে যেতে নিষেধ করছো? কিন্তু আমি অবশ্যই যাবো। আমাকে মৃত্যুর ভয় দেখাও? একজন বীরের কাছে কি মৃত্যু অপমানজনক? যে ব্যক্তি অসৎ ও নীচ লক্ষ্য নিয়ে যুদ্ধ করে এবং তাতেও পৌঁছতে পারে না এদের জন্যে মৃত্যু অপমানের হতে পারে। কিন্তু যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠতম কাজ অর্থাৎ সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে নিহত হয় তার জন্যে তো অপমানের হতে পারে না! তার রাস্তা সেই রাস্তা যেখান দিয়ে আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় ও সৎ বান্দারা চলেছেন।

সুতরাং যেহেতু আমার এ পথ হতভাগ্য,পাপিষ্ট ও দুর্ভাগা ইয়াযিদের বিরোধী পথ তাই আমাকে আমার এ পথে চলতে দাও। হয় বাঁচবো না হয় মরবো-এ দুটোর বাইরে তো আর কিছু নয়।

 فَاِنْ عِشْتُ لَمْ اَنْدَمْ যদি শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকি তাহলে কেউ তখন বলতে পারবে না যে,কেন বেঁচে আছেন?

وَاِنْ مِتُّ لَمْ اُلَمْ

‘‘ আর যদি মারা যাই তাহলেও কেউ আমাকে দোষারোপ করতে পারবে না যদি সে জানে আমি কি জন্যে নিহত হলাম ?’’

کفَي بِكَ ذُلا اَنْ تَعِيشَ وَ تُرْغَما

‘‘ কিন্তু জেনে রেখো যে জীবনের জন্যে সবচেয়ে অপমান হলো কেউ বেঁচে থাকবে বটে,কিন্তু লোকে তার কান ধরে উঠাবে আর বসাবে।’’ এ বক্তব্যেও পৌরুষত্ব ও বীরত্বের ছাপ পরিস্কার চোখে পড়ে। পথিমধ্যে আরেকটি বক্তৃতায় তিনি বলেন :

اَلَا تَرَوْنَ اَنَّ الْحَقَّ لَا يُعْمَلُ بِهِ وَاَنَّ الْباَطِلَ لَا يُتَنَاهَي عَنْهُ

তোমরা চোখে দেখছো না যে সত্যকে মেনে চলা হচ্ছে না ও বাতিলের বিরুদ্ধেও কেউ কিছু বলছে না?

اِنِّي لَا اَرَي الْمَوْتََ اِلَّا سَعَادَةً وَ الْحَيَاةَ مَعَ الظَّالِمِينَ اِلَّا بَرَماً

‘‘ আমি মৃত্যুকেই আমার জন্যে কল্যাণকর এবং জালেমদের সাথে বেঁচে থাকাকে অবমাননা ও লজ্জাকর মনে করি।’’