ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব(৩য় খণ্ড)

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব(৩য় খণ্ড)0%

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব(৩য় খণ্ড) লেখক:
: আব্দুল কুদ্দুস বাদশা
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: ইমাম হোসাইন (আ.)

  • শুরু
  • পূর্বের
  • 11 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 12811 / ডাউনলোড: 4430
সাইজ সাইজ সাইজ
ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব(৩য় খণ্ড)

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব(৩য় খণ্ড)

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

হোসাইনী আন্দোলনে অন্যতম উপাদান তাবলীগ

তাবলীগ -এর তাৎপর্য

মানুষের উক্তির মধ্যে যেমন সহজ অথবা দুর্বোধ্য হওয়া অর্থাৎ সরলভাবে একটিমাত্র অর্থপ্রকাশক কিম্বা বহুমাত্রিক ও একাধিক অর্থ প্রকাশক হওয়ার দিক থেকে পার্থক্য থাকে,তদ্রুপ মানুষের আন্দোলন ও বিপ্লবসমূহও একইভাবে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। আমাদের উক্তি দু প্রকারের হতে পারেঃ যে উক্তির একটিমা অর্থ থাকে আর যে উক্তির একাধিক অর্থ বা দিক থাকতে পারে। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো পবিত্র কোরআনের আয়াতসমূহ। কোরআন তার আয়াতমালাকে দু-ভাগে ভাগ করেছেঃ আয়াতে মুহকামাত তথা সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন আয়াত আর আয়াতে মুতাশাবিহাত তথা দ্ব্যর্থক আয়াত। প্রথম প্রকারের আয়াত হলো যার একটিমাত্র অর্থ থাকে। অর্থাৎ উক্ত ভাষা বা শব্দ থেকে একটার বেশী অর্থ পাওয়া যায় না। কিন্তু দ্বিতীয় প্রকারের আয়াত থেকে একই সময়ে কয়েকটি অর্থ প্রকাশ করা যেতে পারে। তবে আমরা যাতে সদৃশ্য অর্থাবলীর মধ্যে বিভ্রান্তির কবলে না পড়ি এজন্যে মুহকাম আয়াতগুলোকেই মানদণ্ড হিসাবে গণ্য করতে হবে। কারণ সেগুলোই হলো‘‘ উম্মুল কিতাব’’ তথা কিতাবের মূল স্বরূপ।

মানুষের আন্দোলনসমূহ এবং বিপ্লবসমূহও ঠিক তদ্রুপ। কোনো আন্দোলনের একটি মাত্র অর্থ বা লক্ষ্য থাকতে পারে আবার একাধিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্বলিতও হতে পারে। অর্থাৎ একই সময়ে একাধিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সে আন্দোলন পরিচালিত হয় আবার যেন সে সবগুলো লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পরিণতিতে একটি মূল লক্ষ্যে প্রত্যাবর্তিত হয়। এভাবে একটি আন্দোলন একই সময়ে বিভিন্ন দিক ও মাত্রা সম্বলিত হতে পারে।

ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর আন্দোলন হলো এরূপ একটি বহু মাত্রা এবং বহু দিক সম্বলিত আন্দোলন। এই যে ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর আন্দোলনকে ঘিরে নানান ব্যাখ্যা আর নানান মত,এর কারণ হলো এর মধ্যে একাধিক উপাদানের সমান্তরাল উপস্থিতি। আমরা যখন কিছু কিছু উপাদান এবং নিয়ামকের দিক বিবেচনায় এ আন্দোলনের দিকে তাকাই তখন দেখতে পাই যে ক্ষমতাসীন স্বৈরাচার ও শাসকগোষ্ঠীর অন্যায় দাবীর বিপরীতে কেবলই প্রতিবাদী দৃঢ়তা এবং একগুয়েমী অবাধ্যতা। এই দৃষ্টিকোণ থেকে এ আন্দোলনটি হলো এক নাকচ ঘোষণা এবং আত্ম-সমর্পণ না করা। আমরা সকলে জানি যে মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর এবং ইয়াযিদের ক্ষমতায় আরোহণ আর এ উদ্দেশ্যে যতসব চক্রান্ত চালানো হয় তারপর ইয়াযিদ অপরিহার্য মনে করলো যে ইসলামী বিশ্বের কতিপয় ব্যক্তিত্ব যাদের সর্বাগ্রে ছিলেন ইমাম হোসাইন (আঃ),যাকে নিয়ে ইয়াযিদের হিসাব নিকাশ ছিল সবচেয়ে বেশী,এদের থেকে বাইয়াত আদায় করা। তাহলে জনসাধারাণও সবাই চুপ হয়ে যাবে এবং প্রকৃতপক্ষে ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর নিকট থেকে একটি প্রতিশ্রুতি আদায় করতে সক্ষম হবে।

মুয়াবিয়ার মৃত্যু পর ইয়াযিদ কালক্ষেপণ না করে একটি চিঠি মদীনার গভর্ণর,তারই চাচাতো ভাই ওয়ালীদ ইবনে উতবা ইবনে আবি সুফিয়ানের কাছে প্রেরণ করে। তার মাধ্যমে সে মুয়াবিয়ার মৃত্যুর সংবাদ এবং নিজের ক্ষমতারোহনের কথা তাকে অবগত করে। আর আলাদা একটি চিরকুটে সে কয়েক জনের নাম লিখে পাঠায় যাদের শিরোনামে ছিল ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর নাম,তাদের কাছ থেকে অবশ্যই বাইয়াত গ্রহণ করার নির্দেশ দান করে। কিন্তু ইমাম হোসাইন (আঃ) বাইয়াত করতে রাজি হলেন না। তারপর আরো কয়েকদিন মদীনায় অবস্থান করার পর যখন তিনি বুঝতে পারলেন যে এরা ছেড়ে দেবার পাত্র নয়,তখন স্বীয় আহল পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে আল্লাহর পবিত্র নিরাপদ ঘরের অভিমুখে রওনা হন। অর্থাৎ রজব মাসের শেষ ভাগে মুয়াবিয়ার মৃত্যুর খবর মদীনায় পৌছে এবং ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর নিকট বাইয়াতের দাবী জানায়।

সম্ভবত 27 রজব ইমাম হোসাইন (আঃ) মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন এবং 3রা শাবান তারিখে মক্কায় প্রবেশ করেন। সেদিন তার জন্ম দিবসও ছিল। 8ই জিলহজ্ব অবধি তিনি সেখানে অবস্থান করেন। তবে কোনো অবস্থাতেই তিনি তার কাছে যে দাবী জানানো হয়েছিল তার প্রতি সাড়া দিতে রাজি হননি। এই নাকচ করে দেয়াটা হলো একটি উক্তি । যে উক্তি এই আন্দোলনকে এক বিশেষ প্রাণ দান করে। এ প্রাণসত্তাটি হলো যুগের শাসন ক্ষমতা দখলকারী এক স্বৈরাচারী দাবীর বিরুদ্ধে না বলা এবং আত্মসমর্পণ না করা।

এই আন্দোলনে ভূমিকা পালনকারী আরেকটি উপাদান হলো‘‘ সৎকাজের আদেশ আর অন্যায় কাজে নিষেধ’’ -এই নীতিটি । ইমাম হোসাইন ইবনে আলী (আঃ)-এর বক্তব্যে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট বিবৃতি রয়েছে। এমর্মে সাক্ষ্য প্রমাণও অনেক রয়েছে। অর্থাৎ যদি ধরে নেয়া হয় যে তার কাছে বাইয়াতের দাবী নাও করতো তাহলেও তিনি নীরব থাকতেন না।

আরেকটি উপাদান হলো হুজ্জাত তথা প্রমাণ পূর্ণ করা এবং চরম পত্র প্রদান করা। তৎকালে মুসলিম জাহানের তিনটি বড় কেন্দ্র ছিলঃ মদীনা-যা রসূলুল্লাহ (সাঃ) এর হিজরতের ভূমি নামে পরিচিত ছিল,শ্যাম-যা খেলাফতের ভূমি নামে পরিচিত ছিল এবং পূর্বে আমিরুল মুমিনীন আলী (আঃ) এর দারুল খেলাফত ছিল। এছাড়া এটা ছিল একটি নতুন শহর যা মুসলমান সৈন্যদের দ্বারা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাবের সময়ে স্থাপিত হয়েছিল এবং একে ইসলামী সৈন্যদের সেনানিবাসও বলা হতো। আর একারণে একে শ্যামের সমান বলে তুলনা করা হতো। এই শহরের অর্থাৎ মুসলিম সেনানিবাসের জনগণ যখন অবগত হলো ইমাম হোসাইন (আঃ) ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত করতে রাজি হননি তখন তাদের নিকট থেকে প্রায় আঠারো হাজার চিঠি এসে পৌঁছে ইমামের কাছে। চিঠি গুলোকে কেন্দ্রে পাঠায় এবং ঘোষণা করে যে আপনি যদি কুফায় আসনে তাহলে আমরা আপনাকে সাহায্য করবো। এখানে ইমাম হোসাইন (আঃ) ইতিহাসের দুই রাস্তার মোড়ে এসে উপনীতঃ যদি তাদের আহবানের প্রতি সাড়া না দেন তাহলে অনিবার্যভাবে ইতিহাসের রায়ে তিনি নিন্দিত হবেন। ভবিষ্যতের ইতিহাস তখন বিচার করে বলবে যে অভাবনীয় একটি অনুকূল পরিবেশ ছিল। কিন্তু ইমাম হোসাইন (আঃ) এ সুযোগকে কাজে লাগাতে পারেন নি। অথবা তিনি চাননি কিম্বা তিনি ভয় পেয়েছিলেন ইত্যাদি ইত্যাদি অপব্যাখ্যা। ইমাম হোসাইন (আঃ) যাতে এই লোকগুলো যারা এভাবে সাহায্যের হাত তার দিকে প্রসারিত করেছে,তাদের কাছে হুজ্জাত তথা প্রমাণকে চুড়ান্ত করতে পারেন এজন্যে তাদের আহবানে সাড়া জানান। ইতিপূর্বে যা বর্ণিত হয়েছে। এপর্যায়ে এই আন্দোলন আরেক সত্তা এবং আরেক রূপ ও বর্ণ ধারণ করে।

এই আন্দোলনের আরো একটি মাত্রা বা দিক হলো এর তাবলীগ তথা প্রচারের দিক। অর্থাৎ,এই আন্দোলন একই সাথে যেমন সৎকাজের আদেশ আর অসৎকাজের নিষেধ এবং একইসাথে যেমন প্রমাণ চুড়ান্তকরণ (ও যুগের স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর অন্যায় দাবীর কাছে আত্মসমর্পণ না করার ঘোষণা) তদ্রুপ এটা একটি প্রচার এবং বার্তাবাহীও বটে। ইসলামকে পরিচিত করা এবং চিনিয়ে দেবার এক আন্দোলনও বটে।

আলোচনার শুরুতে‘‘ তাবলীগ’’ এর সঠিক অর্থকে আগে ব্যাখ্যা করার দরকার। বিশেষ করে সৎকাজের আদেশ আর অসৎ কাজে নিষেধ-এই নীতির সাথে এর পার্থক্য কি সেটা নির্ধারণ করতে হবে যাতে বুঝা যায় যে,হোসাইনী আন্দোলনে তাবলীগ উপাদানটি আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনিল মুনকার উপাদান থেকে ভিন্ন ।

তাবলীগ এমন একটি শব্দ যা পবিত্র কোরআনে অনেক ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন কোরআন নবীগণের ভাষায় বর্ণনা করে যে,

) يَا قَوْمِ لَقَدْ اَبْلَغْتُكُمْ رِسَالَةَ رَبِّي وَ نَصَحْتُ لَكُمْ وَلَكِنْ لَا تُحِبُّونَ النَّاصِحِينَ(

‘‘ হে আমার সম্প্রদায়! আমি তোমাদের কাছে স্বীয় প্রতিপালকের বার্তা পৌছিয়েছি এবং তোমাদের মঙ্গল কামনা করেছি। কিন্তু তোমরা মঙ্গলাকাঙ্ক্ষীদের ভালোবাস না।’’ (আ রাফঃ 79)

কিম্বা নবীদের সম্পর্কে ইরশাদ করেঃ

 ) مَا عَلَي الرَّسُولِ اِلَّا الْبَلَاغُ(

‘‘ রসুলের উপর কোনো দায়িত্ব নেই কেবল পৌছিয়ে দেয়া ছাড়া।’’ (মায়িদাঃ 99)

মোদ্দকথা হলো,‘‘ বালাগ’’ ,‘‘ তাবলীগ ,‘‘ ইউবাল্লিগুনা’’ ইত্যাদি শব্দগুলো পবিত্র কোরআনে বহুল ব্যবহৃত হয়েছে। এই শব্দের অর্থ কি?  দুর্ভাগ্যেরকথা হলো বর্তমানে এই শব্দটি একটি করুণ পরিণতির শিকার হয়েছে। অর্থাৎ এক অশুভ এবং ঘৃণ্য অর্থ লাভ করেছে। এমন পরিস্থিতি হয়েছে যে আজ (উদাহরণস্বরূপ ফার্সী ভাষাভাষীদের কাছে তাবলীগ বলতে বুঝায় সত্য মিথ্যার তেলেসমাতি করা এবং প্রকৃতপক্ষে ঠগবাজি ও বোকা বানিয়ে মানুষের হাতে কোনো পন্য ধরিয়ে দেয়া। অর্থাৎ বোকা বানানোর অর্থেই এখন এর প্রয়োগ। আর একারণেই দেখা যায় যখন কেউ বলতে চায় যে এসবের কোনো ভিত্তি নেই তখন বলে দেয় যে জনাব,এসব কিছুই আসলে তাবলীগ,সবকিছুই মিথ্যা আর ধোকাবাজি। এজন্যে দেখতে পাই অনেকে ধর্মীয় ব্যাপারে এ শব্দটি প্রয়োগের পক্ষপাতি নয়। কিন্তু কথা হলো যদি কোনো শব্দের সঠিক অর্থ থাকে আর সেই সঠিক অর্থ পবিত্র  কোরআন এবং নাহজুল বালাগার মধ্যে প্রয়োগ হয়ে থাকে তাহলে উক্ত শব্দের অর্থ বিভ্রান্ত ঘটার অপরাধে সেটাকে শাস্তি দেয়া আমাদের উচিত হবে না। বরং সবসময় এর সঠিক অর্থটিই মানুষের কাছে বলা আমাদের কর্তব্য ।

تبلیغ (তাবলীগ) কথাটিوصول (উসুল) এবংایصال (ইসাল) কথা দুটির সাথে খুব নিকটবর্তী অর্থ বহন করে। আরবী ভাষায় অনেক ক্ষেত্রে এমন কিছু সূক্ষ্ণও নিখুঁত কাজ থাকে যা অন্য ভাষায় (এমনকি ফার্সীর মতো মিষ্টি ও সমৃদ্ধ ভাষাতেও) দেখা যায় না। আরবী ভাষায় একটি শব্দ হলোایصال (ইসাল) এবং আরেকটি শত্রুহলোابلاغ  (ইবলাগ)।ایصال (ইসাল) এর অর্থ কি? যেমন ধরুন,আমি কোনো এক কাপড়কেایصال (ইসাল) করেছি। এর অর্থ হবে আমি ওটাকে পৌছে দিয়েছি।ابلاغ (ইবলাগ) ফার্সী ভাষায় কি অর্থ দেয়? যদি বলা হয় যে অমুক জিনিসটাকেابلاغ (ইবলাগ) করেছি,সে ক্ষেত্রে ও বলি যে এর অর্থ হলো পৌছে দিয়েছি। ফার্সী ভাষায় এ উভয়ের বলোয় পৌছানো এবং পৌছে দেয়া অর্থে ব্যাবহার করা হয়ে থাকে। কিন্তু আরবী ভাষায়ایصال (ইসাল) কেابلاغ (ইবলাগ) এর স্থলে প্রয়োগ করা যায় না। তদ্রুপابلاغ (ইবলাগ) কেওایصال (ইসাল) এর স্থলে প্রয়োগ করা যায় না।ایصال  (ইসাল) শব্দটি সচরাচর কোনো জিনিসকে কারো হাত দ্বারা অথবা কারো আয়ত্বাধীনে পৗছানোর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। অর্থাৎ জড়বস্তুগত বিষয়ে। কেউ যদি একটি পার্সেলকে কারো নিকটে পৌছাতে চায়,এ ক্ষেত্রেایصال (ইসাল) শব্দকে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। কিম্বা কেউ যদি আপনার কাছে কোনো আমানত (বস্তুগত) রেখে থাকে এবং আপনি সে আমানতকে তার কাছে পৌছে দিতে চান,এ ক্ষেত্রে বলা হয় যে আমানতকে তার মালিকের নিকটایصال  (ইসাল) করেছে।

কিন্তুابلاغ (ইবলাগ) কথা কোনো চিন্তা কিম্বা বার্তাকে পৌছে দেবার সময় বলা হয়। অর্থাৎ কোনো জিনিসকে কারো মন,মানস,চিন্তা ও অন্তরে পৌছে দেবার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। একারণেابلاغ (ইবলাগ) এর বিষয়বস্তু কোনো জড়বস্তু হতে পারে না। অবশ্যই তা কোনো অজড় এবং আধ্যাত্মিক কিছু হতে হবে। একটি চিন্তা অথবা একটি অনুভব। অন্যকথায়,সাধারণতঃ কোনো বার্তা,সালাম বা অনুরূপ কোনো কিছু প্রেরণের ক্ষেত্রে এটি প্রয়োগ করা হয়। বলা হয় সালামابلاغ (ইবলাগ) করেছে,বার্তাابلاغ  (ইবলাগ) করেছে। যখন বার্তাابلاغ  (ইবলাগ) করে তখন কোনো চিন্তাকে অন্যদের কাছে পৌছায়। আর যখন সালামابلاغ  (ইবলাগ) করে তখন আবেগ ও ভক্তিকে পৌছায়। এরূপ বিষয়ের ক্ষেত্রেইابلاغ  (ইবলাগ) বাتبلیغ (তাবলীগ) কথাটি ব্যবহৃত হয়। আর পবিত্র কোরআন এই শব্দকে রেসালাত তথা বার্তাসমূহের বেলায় প্রয়োগ করেছে।

সুতরাং,تبلیغ (তাবলীগ) হলো কোনো বার্তাকে একজনের নিকট থেকে আরেক জনের নিকটে পৌছানো। ফার্সী ভাষায় যে পয়গম্বর (বা বার্তাবাহক) কথা এসেছে তা রাসুল শব্দের অনুবাদ। এর অর্থ হলো রেসালাতের মুবাল্লিগ তথা বার্তা প্রচারক। রেসালাত শব্দ এমন একটি শব্দ যা শুভ পরিণতি লাভ করেছে। অবশ্য আমরা রেসালাহ বলতে যেসব জিনিসকে বুঝি তা কোরআনে ব্যবহৃত রেসালাত এর থেকে ভিন্ন । আমরা সাধারনত কিছু লিখিত কাগজের সেট যার সমষ্টি একটি পুস্তকের মতো নয় সেটাকে রেসালাহ বলে থাকি। যদিও উক্ত রেসালাহ র বিষয়বস্তুর বার্তার সাথে কোনো সম্পর্ক নাও থাকে। যেমন ধরুন,কেউ একটি পুস্তিকা লিখলো কোনো ভাষার ব্যাকরণ সম্পর্কে,ফার্সী কিম্বা আরবীর। তখন বলা হয় যে অমুক লোক অমুক বিষয়ে একটি রেসালাহ লিখেছে। যদিও এ নামটি উক্ত বিষয়বস্তুর ( যেমন ভাষার ব্যাকরণ) সাথে সঙ্গতিশীল নয়। রেসালাহ কে এমন ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে হবে যেখানে কোনো বার্তা থাকবে। কিন্তু কেউ যদি কোনো জ্ঞানগত বা ভাষাগত সমস্যার সমাধান করে থাকে তাহলে সে কারো জন্য কোনো বার্তা আনেনি। এক্ষেত্রে এশব্দটি প্রয়োগ সঙ্গত নয়। কিন্তু সম্প্রতি রেসালাত শব্দটি ফার্সী ভাষায় ব্যাবহার করা হচ্ছে । যেমন বলা হয় অমুকের সমাজের প্রতি রোসালাত রয়েছে। অর্থাৎ,বর্তমানে যার সম্পর্কে অনুভব করা হয় যে স্বীয় সমাজের প্রতি তার কোনো দায়িত্ব রয়েছে যা তার পালন করা উচিত,তার ক্ষেত্রে বলা হয় যে,তার একটা রেসালাত রয়েছে। এই ভাষাটি কোরআনে রেসালাতকে যে ভাষায় প্রয়োগ করা হয়েছে তার সাথে যদি অনুরূপ নাও হয়,খুবই কাছাকাছি হবে। অর্থাৎ,এই অর্থটি কোরআনে ব্যবহৃত রেসালাত র অর্থের খুবই কাছাকাছি। ইরশাদ হচ্ছেঃ

 ) اَلَّذِينَ يُبَلِّغُونَ رِسَالَاتِ اللهِ وَ يَخْشَوْنَهُ وَ لَا يَخْشَوْنَ اَحَداً اِلَّا اللهُ(

 

‘‘ সেই নবীগণ আল্লাহর পয়গাম প্রচার করতেন ও তাকে ভয় করতেন। তারা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ভয় করতেন না। (আহযাবঃ 39)

এটা হলো বার্তাবাহকের জন্য সবচেয়ে বড় পূর্বশর্ত।

যখন প্রতিপন্ন হলো যেابلاغ (ইবলাগ) এবংتبلیغ  (তাবলীগ) এর অর্থ হলো বার্তা পৌছে দেয়া তখন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় যে,تبلیغ (তাবলীগ) যা কোরআনে এসেছে আর আমর বিল মারুফ এবং নাহী আনীল মুনকার -সেটাও যে কোরআনে এসেছ-এ দুটি আলাদা বিষয়। যদিও একে অপরের সাথে জড়িত,তবে বিষয় দুটি।

তাবলীগ হলো পরিচিত করার এবং উত্তমভাবে পৌছানোর পর্যায়। সুতরাং এটা হলো জানা বা পরিচিতর স্তর। কিন্তু আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনিল মুনকারের পর্যায়টি হলো কার্যকর এবং বাস্তবায়নের পর্যায়। তাবলীগ নিজেই একটি সার্বজনীন কর্তব্য সকল মুসলমানের জন্য । যেমনভাবে আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনিল মুনকারও এক সার্বজনীন কর্তব্য । তাবলীগের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রত্যেক মুসলমানের জন্য যে কর্তব্য রয়েছে সেটা হলো তার মধ্যে যেন এমন অনুভূতি কাজ করে যে তার স্থান থেকে সে যেন ইসলামের বার্তা বহন করে। কিন্তু যে কর্তব্যটি আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনিল মুনকার এর দৃষ্টিকোণ থেকে প্রত্যেক মুসলমানের ওপর রয়েছে তা হলো তার মধ্যে যেন এই অনুভূতি কাজ করে যে সেও একজন বাস্তবায়নকারী এবং সমাজে এই বার্তা বাস্তবায়নকারী শক্তির সেও একটি অংশ। একারণেই আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনিল মুনকার হলো এক বিষয়,আর তাবলীগ হলো ভিন্ন আরেকটি বিষয়। তাই হোসাইনী আন্দোলনে আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনিল মুনকার র মাত্রা তথা দিক ছাড়াও আরেকটি মাত্রা তথা দিক রয়েছে। আর সেটা হলো তাবলীগ। এই মুতাশাবিহ তথা দ্ব্যর্থক এবং বহুমাত্রিক আন্দোলন যে কাজটি করেছে তা হলো ইসলামের স্বরূপকে ঠিক যেভাবে আছে সেভাবেই পরিচিত করেছে। ইসলামের বার্তাকে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত ও উত্থাপিত করেছে। তাও আবার কতো দ্ব্যর্থহীন ও স্পষ্টভাবে! ইতিপূর্বেই বলা হয়েছে যে উক্তি দু প্রকারেরঃ মুহকাম তথা দ্ব্যর্থহীন আর মুতাশাবিহ তথা দ্ব্যর্থক। আরেকটি বিচারেও উক্তি দু প্রকারের হয়। যথাঃ স্বচ্ছ ও পরিণত উক্তি আর অস্বচ্ছ ও অপরিণত উক্তি ।

মুসলিম পণ্ডিতরা কিছু কিছু বাচনকে বিশুদ্ধ ও পরিণত বলে থাকেন। বিশুদ্ধ ও পরিণত বচন হলো সেটাই যা বক্তার মনোভাব ও উদ্দেশ্যকে উত্তম ও যথার্থভাবে শ্রোতার মন ও অনুভূতিতে পৌছাতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ এমন উক্তি যা প্রকৃতই বক্তার উদ্দেশ্যকে পৌছে দিতে পারে।

আন্দোলনও এরূপ। স্বচ্ছ আন্দোলন যেমন রয়েছে,অস্বচ্ছ আন্দোলনও তেমনি রয়েছে। স্বচ্ছ আন্দোলন হলো সেটা,যা,যে বার্তাকে মনসমুহ,চিন্তাসমূহ এবং অনুভূতিসমুহের কাছে পৌছাতে চায়,তাকে ভালোভাবে পৌছে দিতে সক্ষম হয়। এই দিক থেকে যখন তাকাই তখন দেখি যে,হোসাইনী আন্দোলনের চেয়ে অধিকতর,পরিণত এবং পৌছে দিতে সক্ষম কোনো আন্দোলনই খুজে পাওয়া যাবে না। এটা এমন এক আন্দোলন যা একদিক থেকে দেখা যায় যে স্থানিক ব্যপ্তির বিবেচনায় তা বিশ্বময় বিস্তৃতি লাভ করেছে। আবার কালের বিবেচনায় প্রায় চৌদ্দশ বছর পেরিয়ে এসেও আজ তার প্রভাব ও পৌছে দেবার শক্তি শুধু কমে যায়নি,তা নয়,বরং বলীয়ান হয়েছে। অসাধারণ শক্তিশালী এক আন্দোলন।

এপর্বে খোদ তাবলীগ সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা যাক যাতে ইমাম হোসাইন (আঃ) এর আন্দোলনে তাবলীগ উপকরণ কে সঠিকভাবে চিনতে এবং ব্যাখ্যা করতে পারি। তাবলীগ এর অর্থ ও তাৎপর্য ইতিপূর্বে অবগত হয়েছি। দেখা গেছে যে পবিত্র কোরআন তাবলীগ শব্দটির ওপর নির্ভর করেছে। নবীগেণর প্রেরণের দর্শন সম্পর্কে নাহজুল বালাগায় প্রসিদ্ধ একটি বাক্য রয়েছে। বাক্যটিতে বলা হয়েছেঃ

فَبَعَثَ فِيهِمْ رُسُلَهُ، وَ وَاتَرَ اِلَيْهِمْ اَنْبِيَائَهُ لِيَسْتَأْدُوهُمْ مِيثَاقَ فِطْرَتِهِ وَيُذَآّکرُوهُمْ مَنْسِيَّ نِعْمَتِهِ وَ يَحْتَجُّوا عَلَيْهِمْ بِالتَّبْلِيغِ—

আল্লাহ নবীগণকে একের পর এক প্রেরণ করলেন। কি জন্যে ? প্রথমতঃ এজন্যে যে আল্লাহ সৃষ্টিগতভাবে মানুষের স্বভাবে প্রতিশ্রুতি নিহিত রেখেছেন। (বলতে চান যে দীন কোনো চাপিয়ে দেয়া বিষয় নয় যে মানুষের ওপর আরোপ করা হবে,বরং মানুষের সহজাত আহবানের প্রতিই সাড়া দেয়া। আল্লাহ যে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন তা কোনো কাগজের নয়। অক্ষর,ধ্বণি কিম্বা বাইয়াতের মাধ্যমে নয়,বরং তকদীরের কলম দ্বারা,মানবের স্বভাব ও আত্মার গহীনে)। বলছেন যে,নবীগণ এসেছেন একথা বলতে যে,হে মানব! তোমরা তোমাদের সহজাত স্বভাব ও তোমাদের মধ্যে আল্লাহর প্রতি যে অস্বীকারবদ্ধতা হয়েছে,আমরা তোমাদের সে প্রতিশ্রুতি পালন দেখতে চাই। অন্য কিছু নয়।

وَ يُذَکِّرُوهُمْ مَنْسِيَّ نِعْمَتِهِ অর্থাৎ নবীরা হলেন স্মরণ করিয়ে দেবার জন্যে ।

وَ يَحْتَجُّوا عَلَيْهِمْ بِالتَّبْلِيغِ   আর আল্লাহর বার্তাকে মানুষের কাছে পৌছে দেন যাতে এর মাধ্যমে মানুষের জন্য হুজ্জাত বা দলীলকে পূর্ণ করেন।

وَ يُثيِرُوا لَهُمْ دَفائِنَ الْعُقُولِ

(কি অদ্ভুত বাক্যগুলো!)অর্থাৎ বলেছেন যে, মানুষের অভ্যন্তরে তথা বিবেক ও আত্মার মধ্যে গুপ্ত ধন লুকিয়ে রয়েছে। তাদের মগজে নিহিত রয়েছে চিন্তার গুপ্তধন। কিন্তু এসব গুপ্তধনকে ঢেকে ফেলেছে ধুলা ময়লার আস্তরণ। নবীগণ এসেছেন এসব ধুলা ময়লাকে ঝেড়ে ফলতে এবং মানুষের নিজের মধ্যে যেসব গুপ্তধন রয়েছে সেগুলো তাকে দেখিয়ে দিতে। প্রত্যেক ব্যক্তিই তার নিজের মন ও আত্মার ঘরের ভেতর মূল্যবান গুপ্তধনের অধিকারী রয়েছে কিন্তু সে তা থেকে বেমালুম বেখবর। নবীগণ মানুষকে তার এই মূল্যবান গুপ্তধনের সন্ধান দিতে চান যাতে প্রত্যেকে স্বতঃ প্রণোদিত হয়ে স্বতঃস্ফূর্ততার সাথে তার গুপ্তধন বের করে আনার কাজে ব্রতী হয়।( উদ্ধৃত বাণীটির জন্য দেখুন নাহজুল বালাগা , ফয়জুল ইসলাম , খুতবা 1 , অংশ 36 , পৃষ্ঠা 33 )

তাবলীগের এই যে ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হলো নবীগণ ছিলেন সে অর্থে মুবাল্লিগ। কিন্তু সকলে শরীয়ত প্রবর্তক ছিলেন না। একারণে আল্লাহর নবীগণ ছিলেন দুই শ্রেণীরঃ এক শ্রেণীর নবী হলেন যারা মুবাল্লিগ এবং শরীয়তেরও প্রবর্তক। আর আরেক শ্রেণীর নবী যারা শুধুই মুবাল্লিগ। শরীয়ত প্রবর্তনকারী নবী হলেন আইন ও বিধান প্রণয়ণকারী নবী যাদের সংখ্যা নিতান্তই কম ছিল। তাদের মোট সংখ্যা হলো পাঁচজন। যথাঃ হযরত নূহ,ইব্রাহীম,মূসা,ঈসা আর শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)। কিন্তু সকল নবীই ঐশী বার্তার মুবাল্লিগ তথা প্রচারক। যেমনভাবে তারা আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনিল মুনকার কারীও বটে। এই যে এক লক্ষ চব্বিশ হাজার নবী এসেছেন,প্রত্যেক নবীই মানুষের জন্যে আইন নিয়ে আসেননি। যারা আইন নিয়ে এসেছেন তারা সীমিত। অবশিষ্ট নবীরা সেই বার্তা পৌছানোর দায়িত্ব পালন করতেন যা শরীয়ত প্রবর্তনকারী নবীগণ নিয়ে এসেছেন। এরা হলেন তাবলীগের নবী। আর শেষনবীর পরে যেমন কোনো শরীয়তের নবীও আসবেন না তদ্রুপ কোনো তাবলীগের নবীও আসবেন না। কিন্তু মুবাল্লিগ থাকতে হবে। কিভাবে? যেহেতু শেষ যুগ হলো মানুষের প্রাপ্ত বয়স্ক ও পরিপূর্ণতার যুগ। এসময়ে ঐ যে দায়িত্ব এক লক্ষ চব্বিশ হাজার নবী (পাঁচজন ব্যতীত) পালন করতেন অর্থাৎ তাবলীগের কাজ (যদিও প্রকৃত অর্থে স্বয়ং আল্লাহই তা করতেন অর্থাৎ নবীদেরকে একাজ পালন করার জন্যে প্রেরণ করতেন),সেকাজ এখন সাধারণ মানুষকে পালন করতে হবে। অ-নবীরাই এখন সেকাজ পালন করবে,আলেম এবং অ-আলেমরাই এখন তা পালন করবে। আর এজন্যেই ইসলামের প্রকৃত মুবাল্লিগরা হলেন নবীদের নবী। অর্থাৎ,নবীদের বার্তাকে তারা মানুষের কাছে পৌছায়।

তবে,একটি বার্তার সফলতার পূর্বশত কি? ইসলাম নিজে কি একটি সফল বার্তা ছিল? যদি উত্তর ইতিবাচক হয় তাহলে এই সফলতার পেছনে রহস্য কি ছিল? একটি বার্তা সফল হওয়ার চারটি শর্ত রয়েছে। যদি সে শর্ত চারটি একত্রে জমা হয় তাহলেই উক্ত বার্তার সফলতা শতভাগ নিশ্চিত হবে। কিন্তু যদি তা একত্রে জমা না হয় তাহলে তখন বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করবে।

একটি বার্তা সফল হওয়ার প্রথম শর্ত হলো সেটা বুদ্ধিবৃত্তিক হওয়া এবং এর বিষয়বস্তুর শক্তিদীপ্ত হওয়া। অর্থাৎ উক্ত বার্তা মানুষের জন্যে কি নিয়ে এসেছ এবং মানুষের যুগ জিজ্ঞাসা স্মরণে কত সামঞ্জস্যশীল এবং কিভাবে তা পূরণ করতে সক্ষম হবে? মানুষের চাহিদার অন্ত নেই। মানিসক,চিন্তাগত,আবেগ অনুভূতিগত,ব্যবহারিক,সামাজিক,বস্তুগত ইত্যাদি ইত্যাদি। একটি বার্তা শুধু যে মানুষের চাহিদার বিরুদ্ধ হবে না তাই নয়,বরং,সে চাহিদাগুলোর অনুকূল ও সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। এক বার্তার প্রথম কথাই হলো তাকে যুক্তিসিদ্ধ হতে হবে। অর্থাৎ,মানুষের চিন্তা ও বুদ্ধির সাথে সঙ্গতিশীল। তা এমন হবে যেন মানুষের বুদ্ধির আকর্ষণ ক্ষমতাকে সে নিজের দিকে টেনে আনে। কেননা,কোনো বার্তা যদি মানুষের যুক্তি ও বুদ্ধির পরিপন্থি হয় এমনকি যদি আবেগপ্রসূতও হয় তাহলে তার স্থিতিকাল খুব সামান্যই থাকে। চিরকাল তা টিকতে পারে না। একারণে কোরআন সর্বদা চিন্তা ও অনুধ্যানের ওপর জোরারোপ করে থাকে। কোরআন কখনোই বুদ্ধি ও যুক্তিকে পরিত্যাগ করেনি। বরং,যুক্তি ও বুদ্ধিকে সব সময় নিজের জন্য একটি খুঁটি হিসাবে কাজে লাগিয়েছে এবং মানুষকে বুদ্ধি খাটানোর জন্যে আহবান জানিয়েছে।

তদ্রুপ,একটি বার্তা যাতে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী হয় এজন্য তাকে মানুষের আবেগের সাথে সামঞ্জস্যশীল হতে হবে। মানুষের একটি দিক রয়েছে যা তার বুদ্ধি ও চিন্তার দিক থেকে ভিন্ন । যার নাম আবেগ এবং যাকে উপেক্ষা করার জো নেই। বার্তাকে মানুষের এই আবেগের সাথে সামঞ্জস্যশীল হওয়া এবং ক্ষেত্রবিশেষে সেগুলোর উন্নত ও সূক্ষ্ণগুলোকে একটা পর্যায় পর্যন্ত পরিতৃপ্ত করা এবং মানুষের জীবনের বাস্তব প্রয়োজন সমূহের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া হলো ঐ বার্তার বিষয়বস্তুর বলীয়ান হওয়ার মূলকথা। যদি কোনো বার্তা মানুষের প্রাকৃতিক চাহিদাসমূহের বিরুদ্ধ হয় তাহলে সফল হতে পারবে না।

একটি হাদীস রয়েছে,ফেকাহ র মধ্যেও যার উদ্ধৃতি দেয়া হয়ে থাকে। রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ  الْاِسْلامُ يَعْلُو وَ لَا يُعْلَي عَلَيْهِ অর্থাৎ,ইসলামই বিজয়ী হয় এবং অন্যের ওপরে প্রতিষ্ঠা লাভ করে,কোনো কিছুই ইসলামের ওপর বিজয়ী হয় না।( নাহজুল ফাসাহা , পৃষ্ঠা 214 , হাদীস নং 1056 )

এটা হলো এমন একটি হাদীস যা ইসলামের সকল শ্রেণীর আলেমবৃন্দ সমান দৃষ্টিতে যার মূল্যায়ন করেছেন। ফেকাহর আলেমগণ যারা সবকিছুকেই ফেকহী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পছন্দ করেন,তারা এই হাদীসের থেকে এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে ইসলামে সামাজিক বিধি বিধানে এমন কোনো বিধান নেই যা পরিণামে অমুসলমানদেরকে মুসলমানদের উপর বিজয়ী করবে। ইসলাম এধরনের বিধানকে অনুমোদন করে না। উদাহরণস্বরূপ,ইসলামী সমাজে একজন আহলে যিম্মা (যেমন ইহুদী,খৃষ্টান কিম্বা যরথুষ্ট্রীয়) কি এমন মর্যাদা বা অবস্থায় উপনীত হতে পারে যে সে-ই শাসক হবে আর একজন মুসলমান হবে তার শাসনাধীন? কিম্বা একজন মুসলমানকে তার নিজের এখতিয়ারে নিয়ে নিবে? ফকীহবৃন্দ উত্তরে বলেন,:

 الْاِسْلامُ يَعْلُو وَ لَا يُعْلَي عَلَيْهِ অর্থাৎ ইসলামের হাত সব সময় উপরে থাকতে হবে। ইসলাম নীচের হাতকে কখনো মেনে নেয় না। এই নীতির ওপর ভিত্তি করে কতিপয় বিধান নিঃসরণ করে থাকেন।

কালাম শাস্ত্রের পণ্ডিতবর্গ আবার বিষয়টিকে দেখেন অন্যভাবে। তারা কালাম শাস্ত্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এর দিকে তাকান। (যেহেতু তাদের কাজ হলো যুক্তি প্রমাণ আর দলীল দস্তাবেজ নিয়ে একারণে) তারা বলেন যে,:الْاِسْلامُ يَعْلُو وَ لَا يُعْلَي عَلَيْهِ এর অর্থ হলো ইসলামের যুক্তি-প্রমাণ অন্য সব যুক্তি প্রমাণের চেয়ে শ্রেয়তর। যুক্তি-প্রমাণের ময়দানে ইসলামের যুক্তি প্রমাণই জয়যুক্ত হবে। এটা হলো উক্ত হাদীসের আরেক ধরনের ব্যাখ্যা । আবার যারা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এবিষটি মূল্যায়ন করেছেন তারা বলেনঃالْاِسْلامُ يَعْلُو وَ لَا يُعْلَي عَلَيْهِ অর্থাৎ,কার্যক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠতা ইসলামেরই। কারণ,ইসলামের বিধি বিধান অন্য যে কোনো বিধি বিধানের চেয়ে মানুষের চাহিদা ও প্রবৃত্তির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ফলে তার পথকে বাস্তবক্ষেত্রে সহজতর করে তোলে।

কেউ যখন স্বীয় প্রোপাগাণ্ডার মাধ্যমগুলোর দিকে তাকায়,উন্নত কলা-কৌশল,দক্ষ জনবল,ব্যাপক পরিকল্পনা,বিশাল বাজেট এবং সর্বোপরি তাদের ব্যাপকতা দেখে বলে ওঠে যে,তাদের প্রোপাগাণ্ডার এতসব কিছুর পরেও কি ইসলাম টিকে থাকতে পারে? সত্যিই আজব ব্যাপার! যখন আমাদের নিজেদের দিকে তাকাই তখন দেখি,তাবলীগের উপায় উপকরণের দিক দিয়ে আমরা একবারে শুন্যের কোঠায় রয়েছি। পৃথিবীর কোনো ধর্মই তাবলীগের উপকরণ আর মুবাল্লিগের দিক থেকে ইসলামের চেয়ে দুর্বল নয়। এমনকি ইহুদীরা যাদের সংখ্যা মুষ্টিমেয়,কিন্তু তাদের কোমর শক্ত করে বাধা। কিছু না হলেও অন্তত বিকৃতির দ্বারা। তাদের ইতিবাচক কিছু নেই যা দ্বারা মানুষদেরকে ইহুদীবাদের প্রতি আহবান জানাতে পারে। কিন্তু তাদের বিধ্বংসী ক্ষমতা প্রবল অন্য ধর্মগুলোকে বিনষ্ট করে দেবার জন্য । একজন ইহুদী তার জীবনভর ইসলামের কোনো একটি বিষয় নিয়ে গবেষণা চালায়। তার লক্ষ হলো কোনো একটি বিশ্ব বিদ্যালয়ে একটি আসন দখল করা। আর ঐ আসনে বসেই সে তার কাজ সেরে ফেলে। এমন একটি বই লিখবে এবং উক্ত বইয়ের মধ্যে সে তার নিজ চিন্তার প্রসার ঘটাবে। আপনারা কি জানেন যে বিশ্বে ইসলামিক ষ্টাডিজ এর নববই শতাংশেরও বেশি চেয়ার ইহুদীদের দখলে রয়েছে। অর্থাৎ বিশ্বে ইসলামের এক্সপার্টরা হলো সব ইহুদী! তাহলে বুঝতে হবে যে তাদের আঘাত শক্তি কতো জোরদার। ঐ হলো খৃষ্টানদের কথা আর এই হলো ইহুদীদের কথা।

কিন্তু এতসব কিছু সত্বেও,বিশ্বে কি হারে মানুষ মুসলমান হচ্ছে পত্র পত্রিকা খুললেই চোখে পড়বে। এটা কোন তাবলীগের জোরে? কোনো মুবাল্লিগও ছিল না। বড়জোর একটা রেডিও থেকে মাঝে মাঝে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশের অনুষ্ঠান শুনেছে হয়তো। আমি (ওস্তাদ মুতাহহারী) ইউরোপ ফেরত একজন খোঁজ-খবর রাখা ব্যক্তির সাথে এ বিষয় নিয়ে কথা বলেছিলাম। ভদ্রলোকটি যিনি বহু বছর ধরে ইউরোপে থাকেন তিনি লোমণ্ড সংবাদপত্রে বিগত কয়েক বছরে 14 মিলিয়ন লোকের মুসলমান হওয়া মর্মে প্রকাশিত খবরের প্রসঙ্গে জনৈক খৃষ্টান ব্যক্তির অভিমত তুলে ধরে বলেন যে ঐ খৃষ্টান লোকটি বলেছিল,লোমণ্ড-এর তথ্য ভুল। আসলে বিগত বছরগুলোতে মুসলমান হওয়া লোকের সংখ্যা পচিশ মিলিয়ন। লোকটি আরো বলে যে আফ্রিকায় দুইটি শক্তি ক্রমবর্ধমানঃ ইসলাম এবং কম্যুনিজম। খৃষ্টবাদ যতই তৎপরতা চালাক,উল্লেখযোগ্য বিস্তার ঘটেনি। যদিও তাদের প্রচার মাধ্যমসমূহ শক্তিশালী এবং ব্যাপক;পক্ষান্তরে ইসলামের প্রচারমাধ্যম দুর্বল। এর পার্থক্য হলো দুটোর বিষয়বস্তুর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। একটির বিষয়বস্তু শক্তিশালী এবং যুক্তিনির্ভর,আর অপরটির বিষয়বস্তু আবেগ নির্ভর। আবেগের দৃষ্টিতে তা খুবই শক্তিশালী। এর বিষয়বস্তু বাস্তবমুখী এবং মানুষের ব্যবহারিক জীবনাচার কেন্দ্রিক। পক্ষান্তরে অন্যটির বিষয়বস্তু হলো চাপিয়ে দেয়া। ইসলামের প্রথম কথাটি একজন পিপাসার্তের গলায় পানির মতো পরম আগ্রহে গলাধঃকরণ হয়। ইসলাম বলে, বুদ্ধিবৃত্তির দ্বারা আল্লাহ ও তার একত্ববাদকে প্রমাণিত করতে হবে। কিন্তু খৃষ্টবাদের প্রথম কথাই হলো বুদ্ধিবৃত্তিকে বিদায় করে ত্রিত্ববাদের কথা বলতে হবে।

মহররম ও আশুরাকে ঘিরে আলোচনা এতাটা বিস্তারিত করার উদ্দেশ্য হলো হোসাইনী বার্তাকে মানুষের কাছে পৌছানো। অতঃপর ব্যাখ্যা প্রদান করবো যে কিভাবে এ আন্দোলন ইসলামের বার্তা বহনকারী ছিল। অর্থাৎ ইমাম হোসাইন (আঃ) কিভাবে ইসলামের বার্তাকে বিশ্ববাসীর কাছে পৌছাতে সক্ষম হয়েছেন।

ইমাম হোসাইন (আঃ) 8ই জিলহাজ্ব তারিখে যখন ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা সহকারে হাজীরা দলে দলে মক্কায় প্রবেশ করছিল,আর ঠিক যে দিনটাতে তাদের আরাফাত ও মিনার দিকে যাত্রা করতে হয়,তখন তিনি মক্কা থেকে প্রস্থান করলেন। তিনি রওনা হয়ে গেলেন এবং ইবনে তাউসের মারফত বর্ণিত সেই বিখ্যাত ভাষণটি প্রদান করেন। এক মঞ্জিল অতিক্রম করে অন্য মঞ্জিলে পৌছিলেন এবং একসময় ইরাকের সীমান্তের নিকটবর্তী হলেন। কুফায় তখনও কি সংবাদ আল্লাহ মাবুদই ভালো জানেন। সেখানে হযরত মুসলিম ইবনে আকিলের ওপর নির্যাতনের করুণ কাহিনী ঘটে গেছে। ইমাম হোসাইন (আঃ) পথিমধ্যে এক ব্যক্তিকে দেখলেন কুফার দিক থেকে আসছে। ইমাম ক্ষণিক যাত্রাবিরিত করলেন তার সাথে কথা বলার জন্যে । বলা হয় যে,ঐ লোকটি ইমাম হোসাইন (আঃ) কে চিনতো। অপরদিকে সে কুফার করুণ ঘটনার খবর রাখতো। কাজেই সে বুঝতে পারলো যে যদি ইমাম হোসাইন (আঃ) এর নিকটে যায় তাহলে ইমাম নিশ্চয় তাকে কুফার সংবাদ জিজ্ঞাসা করবেন। তখন তাকে ঐ দুঃসংবাদের কথা জানাতে হবে। সে উক্ত খবর ইমামকে বলতে চাইলো না। অগত্যা নিজের রাস্তা ঘুরিয়ে দিলো এবং অন্য পথ দিয়ে অগ্রসর হলো। বিন আসাদ গোত্রীয় দুইজন লোক যারা হজ্জ পালনের জন্যে মক্কায় ছিল এবং ইতিমধ্যে তাদের হজ্জ পালন সমাপ্ত হয়ে গিয়েছিল,যেহেতু তারা ইমামকে সহযোগিতা করার মনস্থ করেছিল একারণে দ্রুততার সাথে পেছন থেকে রওনা হয়েছিল ইমাম হোসাইন (আঃ) এর কাফেলায় যুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে ।

এরা প্রায় এক মঞ্জিল পিছিয়ে ছিল। দেখা হয়ে গেল ঐ লোকটির সাথে যে কুফা থেকে আসছিল। পরস্পর নিকটবর্তী হওয়ার পর সালাম বিনিময়ের পরে আরবের প্রথা অনুযায়ী ইন্তিসাবের খবর জানতে চাইলো অর্থাৎ কে কোন গোত্রভূক্ত তার পরিচয় জানতে চাইলো। লোকটি বললো,আমি বনি আসাদ গোত্রের। তারা বললো,অবাক ব্যাপার! আমরাও তো বনি আসাদ গোত্রের! তাহলে বলো দেখি তোমার বাবা কে আর দাদা কে? সে উত্তর দিল। তারাও নিজেদের পরিচয় দিল। তখন মদীনা থেকে আসা লোক দুজন বললো,কুফার সংবাদ কি? সে বললোঃ সত্যি বলতে কি কুফার অবস্থা আসলে খুবই দুঃখজনক। ইমাম হোসাইন (আঃ) মক্কা থেকে কুফার দিকে যাচ্ছেন এবং পথিমধ্যে আমাকে দেখে তিনি থেমে যান কুফার সংবাদ নেবার উদ্দেশ্যে । কিন্তু আমি এ দুঃসংবাদ তাকে বলতে পারবো না বলে পাশ কাটিয়ে চলে এসেছি। তারপর সে কুফার সব ঘটনা এ দুজনকে খুলে বললো।

তারা দুজন চলতে চলতে ইমামের কাফেলায় পৌছে যায়। প্রথম মঞ্জিলে পৌছে তারা এ ব্যাপারে মুখ খুললো না। তারা অপেক্ষা করলো যতক্ষণ না ইমাম আরেকটি মঞ্জিলে অবতরণ করলেন এবং গতকাল তারা কুফার যে লোকটির সাথে পথিমধ্যে সাক্ষাত করেছিল তখন থেকে প্রায় চব্বিশ ঘন্টা অতিবাহিত হয়ে গেল। ইমাম তাবুর ভেতরে একদল সঙ্গী সাথী নিয়ে বসে আছেন। এমন সময় সে দুজন লোক সেখানে প্রবেশ করলো এবং আরজ করলো,হে ইমাম! আমাদের কাছে একটি সংবাদ রয়েছে। সেটাকে এখানেই সকলের সম্মুখে বলার অনুমতি দান করবেন নাকি আড়ালে শুনবেন? তিনি বললেন,আমি আমার সঙ্গীদের থেকে কিছুই গোপন করবো না। যে সংবাদই হোক এখানেই সকলের সামনে তা বলো। দু জনের একজন বললো,হে ইমাম! আমরা গতকাল যে লোকটি আপনাকে দেখে না থেমে পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছিল তার সাথে সাক্ষাত করেছি। সে একজন আস্থাশীল লোক। আমরা তাকে চিনি। আমাদেরই স্বগোত্রীয় বনি আসাদের লোক। আমরা তাকে কুফার সংবাদ জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে খুব খারাপ সংবাদ দিল। বললো,আমি কুফা থেকে এমন অবস্থায় বের হয়েছি যখন নিজের চোখে দেখেছি যে মুসলিম ইবনে আকিল এবং হানি ইবনে উরওয়াকে শহীদ করা হয়েছে। আর তাদের লাশকে পায়ে রশি বেঁধে গলিতে আর বাজারে টেনে বেড়ানো হচ্ছিল। ইমাম হযরত মুসলিমের শাহাদাতের সংবাদ শুনলেন। তার দুচোখ অশ্রুতে ভরে গেল। সাথে সাথে তিনি এই আয়াতখানি পাঠ করলেনঃ

) مِنَ الْمُؤْمِنِينَ رِجالٌ صَدَقُوا مَا عَاهَدُوا اللهَ عَلَيْهِ فَمِنْهُمْ مَنْ قَضَي نَحْبَهُ وَ مِنْهُمْ مَنْ يَنْتَظِرُ وَ مَا بَدَّلُوا تَبْدِيلاً(

অর্থাৎ,মুমীনদের মধ্যে কতক আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা পূর্ণ করেছে। তাদের কেউ কেউ মৃত্যু বরণ করেছে আর কেউ কেউ প্রতীক্ষা করছে। তারা তাদের সংকল্প মোটেই পরিবর্তন করেনি। (আহযাবঃ 23)

এমন অবস্থায় ইমাম কিন্তু বললেন না যে,কুফাকে যেহেতু কব্জা করে নিয়েছে আর মুসলিম ও হানীকে যেহেতু শহীদ করে ফেলেছে কাজেই আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে। আমরা পরাজিত হয়ে গেছি। কাজেই এখান থেকেই ফিরে যাই। বরং তিনি এমন এক বাক্য বললেন যা প্রতিপন্ন করে যে ব্যাপারটা অন্য কিছু । উপরোক্ত আয়াতটি সম্ভবতঃ আহযাবের যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। ইমাম বোঝালেন যে মুসলিম ইবনে আকিল তার কর্তব্য পালন করেছেন। এখন আমাদের পালা। কবির ভাষায়ঃ

کاروان شهيد رفت از پيش

وان ما رفته گير و مي انديش

‘‘ শহীদের কাফেলা আগই গেছে চলি

আমরা এখনো বেধে আছি চিন্তার খাতা খুলি’’

ইমামের একথা শুনে যারা দুর্বল চিত্তের ছিল এবং পার্থিব আশা নিয়ে ইমামের সঙ্গী হয়েছিল তারা প্রস্থান করে। (যেমনটা সব আন্দোলনেই দেখা যায়)।

 لَمْ يَبْقَ مَعَهُ اِلَّا اَهْلَ بَيْتِهِ وَ صَفْوَتِهِ

অর্থাৎ তার সাথে অবিশষ্ট থেকে গেল কেবল তার আহলে বাইত ও নিষ্ঠাবান সঙ্গীদল। যাদের সংখ্যা সে সময়ে খুবই কিঞ্চিত ছিল। (খোদ কারবালায় এসে কিছুসংখ্যক লোক যারা প্রথমে ধোকার শিকার হয়েছিল এবং ওমর ইবনে সা দের দলে যোগ দিয়েছিল তারা একজন একজন করে জাগ্রত হয়ে ইমামের সাথে এসে যোগদান করেছিল)। হয়তো বা বড়জোর কুড়ি জনের বেশী হবে না তারা। এমন অবস্থাতেই হযরত মুসলিম ইবনে আকিল এবং হানী ইবনে উরওয়ার মর্মান্তিক শাহাদাতের খবর এসে পৌছে। লিসানুল গাইব গ্রন্থের লেখক বলেন,কোনো কোনো ঐতিহাসিক বলেছেন,ইমাম হোসাইন (আঃ) যেহেতু কোনো কিছুকেই তার সঙ্গীদের কাছে গোপন করছিলেন না,কাজেই এই খবরটি শোনার পরে সমীচিন ছিল শিশু ও নারীদের তাঁবুতেও গিয়ে মুসলিমের সংবাদটা তাদেরকে প্রদান করা যখন তাদের মধ্যে অবস্থান করছিলো হযরত মুসলিমের পরিবার,তার ছোট শিশুরা,ছোট ভাইয়েরা,বোনেরা এবং আরো কতিপয় চাচাতো বোনেরা।

এখন কিভাবে ইমাম তাদেরকে এ সংবাদ জানাবেন। হযরত মুসলিমের ছোট একটি মেয়ে ছিল। ইমাম হোসাইন (আঃ) যখন বসলেন তাকে ডেকে পাঠালেন। তাকে আনা হলো। তিনি তাকে কোলে বসালেন এবং আদর করতে শুরু করলেন। কন্যাটি বুদ্ধিমতী ছিল। সে বুঝতে পারলো এ আদর কোনো সাধারণ আদর নয়। পিতৃসুলভ আদর। একারণে সে জিজ্ঞেস করলো,চাচাজী! যদি আমার বাবা মারা যান তাহলে আমাদের কি হবে? ইমাম তার একথায় বিগলিত হলেন। বললেন,মা আমার,আমি তোমার পিতার জায়গায় আছি। তার অবর্তমানে আমিই তোমার বাবার জায়গায় থাকবো। ইমাম পরিবারে কান্নার রোল পড়ে গেল। আকিলের সন্তানদের প্রতি উদ্দেশ্য করে ইমাম ঘোষণা দিলেন,হে আকিলের সন্তানেরা! তোমরা একজন মুসলিমকে উৎসর্গ করেছো। এটাই তোমাদের জন্য যথেষ্ট । এখন তোমরা চলে যেতে চাইেল চলে যেতে পারো। তারা প্রতিবাদের সুরে বলে উঠলো,হে ইমাম! আমরা এতক্ষণ কোনো মুসলিমকে শহীদ দান করিনি তখন আপনার সাথে ছিলাম। আর মুসলিমকে দান করে এখন আমরা ছেড়ে যাব? কক্ষনোই তা হতে পারে না। আমরা আপনার খেদমতে থেকে যাবো যতক্ষণ না মুসলিমের ভাগ্যে যা ঘটেছে আমাদের ভাগ্যেও তা ঘটে।