বার্তা পৌঁছানোর উপকরণাদি ও মাধ্যমসমূহ
একটি বার্তার সফলতা নির্ভর করে চারটি শর্তের উপর। সেগুলোর মধ্যে প্রথমটি হলো খোদ বার্তার বিষয়সার। অর্থাৎ বার্তা হতে হবে সমৃদ্ধ ও আধ্যাত্মিক শক্তিতে বলীয়ান। কোরআনের পরিভাষায় যাকে বলা হয় হক্কানী তথা সত্যনিষ্ঠ বার্তা। এটা হলো এমন একটা শর্ত যা বার্তা বাহকের সাথে সম্পৃক্ত নয়। আর এই যে খোদ বার্তার সত্যনিষ্ঠ হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর ভূমিকা রয়েছে এ ব্যাপারে বৈজ্ঞানিক,মানসিক এবং মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে যেমন কোনো সংশয়ের অবকাশ নেই,তদ্রুপ দীনি এবং মযহাবী দৃষ্টিকোণ থেকেও কোনো সংশয়ের অবকাশ নেই। পবিত্র কোরআন এ দিকটির ওপর নির্ভর করে যে,একটি বিষয় যদি সত্যনিষ্ঠ ও বাস্তব হয় তাহলে খোদ ঐ বাস্তবসত্য হওয়াটাই তার স্থায়িত্বের কারণ হয়। পক্ষান্তরে কোনো বার্তার অন্তসারশুন্য হওয়া বা মিথ্যা ও বাতিল হওয়াটাই তার ধ্বংসের কারণ হয় যা তাকে ভেতর থেকে কুরে কুরে নিঃশেষ করে ফেলে। পবিত্র কোরআনে এ সংক্রান্ত একটি উপমা রয়েছে। ইরশাদ হচ্ছেঃ
)
نزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَسَالَتْ أَوْدِيَةٌ بِقَدَرِهَا فَاحْتَمَلَ السَّيْلُ زَبَدًا رَّابِيًا وَمِمَّا يُوقِدُونَ عَلَيْهِ فِي النَّارِ ابْتِغَاءَ حِلْيَةٍ أَوْ مَتَاعٍ زَبَدٌ مِّثْلُهُ كَذَٰلِكَ يَضْرِبُ اللَّـهُ الْحَقَّ وَالْبَاطِلَ فَأَمَّا الزَّبَدُ فَيَذْهَبُ جُفَاءً وَأَمَّا مَا يَنفَعُ النَّاسَ فَيَمْكُثُ فِي الْأَرْضِ كَذَٰلِكَ يَضْرِبُ اللَّـهُ الْأَمْثَالَ(
অর্থাৎ,তিনি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন। অতঃপর স্লোতধারা প্রবাহিত হতে থাকে নিজ নিজ পরিমাণ অনুযায়ী। অতঃপর,স্লোতধারা স্ফীত ফেনারাশি উপরে নিয়ে আসে এবং অলঙ্কার ও তৈজসপত্রের জন্য যে বস্তুকে আগুনে উত্তপ্ত করে,তাতেও তেমনি ফেনারাশি থাকে। এমনিভাবে আল্লাহ সত্য ও অসত্যের দৃষ্টান্ত প্রদান করেন। অতএব ফেনা তো শুকিয়ে লুপ্ত হয়ে যায়। আর যা মানুষের উপকারে আসে তা জমিতে অবশিষ্ট থাকে। আল্লাহ এমনিভাবে দৃষ্টান্তসমূহ বর্ণনা করেন। (রাদ : 17)
এ আয়াতে প্রথমে বৃষ্টি নামার এবং পানির ঢলে বান ডাকার বর্ণনা দেবার পর এবং সে বানের তোড়ে ছোট-বড় সব গর্ত-নালা প্রত্যেকে তাদের ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী পানিতে পূর্ণ হওয়া এবং পানির স্লোত বয়ে চলা কালে কিভাবে তার ওপর ফেনার আস্তরণ জমে যায় যে আস্তরণ কখনো কখনো পানির উপরিভাগকে পুরোপুরি আচ্ছাদিত করে ফেলে ইত্যাদি বর্ণনা তুলে ধরার পর বলেঃ কিন্তু ফেনা অবশেষে বিদুরিত হয়। আর যা কিছু মানুষের জন্য লাভজনক ও উপকারী অর্থাৎ মূল পানিগুলোই শুধু অবশিষ্ট রয়ে যায়। অতঃপর বলেঃ এ উপমাটি হলো হক ও বাতিলের উপমা।
একটি বার্তা সফল হওয়ার আরো অনেক নিয়ামক রয়েছে যেগুলো অবশ্য খোদ বার্তার সারবস্তুর সাথে সম্পৃক্ত নয়। একটি বার্তা যখন চায় এক আত্মা থেকে আরেক আত্মায় পৌছবে এবং জনমানুষের আত্মাগুলিতে প্রবেশ করবে,একটি সমাজকে স্বীয় আধ্যাত্মিক প্রভাবে প্রভাবান্বিত করবে তখন নিঃসন্দেহে বার্তাবাহকদের দরকার রয়েছে,যারা সে বার্তাকে পৌছে দেব। একারণে,বার্তাবাহকদের মধ্যে যেসব গুণবৈশিষ্ট্য ও যোগ্যতা থাকা বাঞ্ছনীয় সেটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ বা নিয়ামক হলো সেই সব উপকরণ এবং মাধ্যম,বার্তা পৌছাবার জন্যে যেগুলোকে ব্যাবহার করা হয়। একজন বার্তাপ্রবাহকের নিঃসন্দেহে কি উপকরণ এবং হাতিয়ার ও মাধ্যমের দরকার য দ্বারা সে যে বার্তা পৌছে দেবার জন্যে আদিষ্ট হয়েছে সেটা জনগণের কাছে (ইবলাগ) বা পৌছাতে সক্ষম হয়। আর চতুর্থ কারণ তথা নিয়ামক হলো বার্তাপ্রবাহকের Method বা পদ্ধতি এবং কৌশল ও অভিরুচি। অর্থাৎ কি উপায়ে সে বার্তা পৌছাবে। সুতরাং যে চারটি নিয়ামক কারণ একটি বার্তার সফলতা বা ব্যর্থতার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে সেগুলো হলো যথাঃ
1. বার্তার বিষয়সার (অর্থাৎ তা সমৃদ্ধ ও ন্যায়নিষ্ঠ হওয়া)
2. বার্তাবাহকের নিজস্ব বিশেষ ব্যক্তিত্ব
3. বার্তা পৌছানোর উপকরণাদি
4. বার্তা পৌছানোর কলা-কৌশল
এখানে‘
বার্তা পৌছানোর উপকরণাদি’
বিষয়ে আলোচনাটি ধরে এগিয়ে যাওয়া যাক। একটি বার্তা যদি মানুষের কাছে পৌছতে চায় তাহলে নিঃসন্দেহে উপায় উপকরণাদির প্রয়োজন রয়েছে। কারণ,উপকরণ ছাড়া একস্থানে বসে থেকে কখনো আরেক জনের অন্তরে কোনো বার্তাকে অঙ্কিত করে দেয়া সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে নূন্যতম যে উপকরণ কাজে না লাগালে নয় তা হলো বাকশক্তি এবং কথার মাধ্যম। শব্দ উচ্চারণ করে কিম্বা বক্তৃতা করে অথবা কবিতা আবৃতির মাধ্যমে অথবা কোনো প্রবন্ধ লিখে। মোটকথা কোনো না কোনো উপকরণ দরকার। একজন বক্তার জন্য তার আসনটি (মেম্বার) একটি উপকরণ,তদ্রুপ মাক্রোফোনটিও একটি উপকরণ ইত্যাদি শত সহস্র উপকরণের কথা থাকতে পারে একটি বার্তা পৌছানোর জন্য ।
তবে একটি কথা রয়েছে। সেটা হলো পৌছে দেবার বার্তাটি যদি হয় ঐশী বার্তা তাহলে সেক্ষেত্রে যে কোনো উপকরণকেই কাজে লাগানো যাবে না। অর্থাৎ যাতে ঐশী বার্তা পৌছানো হয় এবং যেহেতু উদ্দেশ্যও পুত-পবিত্র কাজেই আমাদের এমনটা ভাবা ঠিক হবে না যে উপকরণ যা-ই হোক না কেন আমরা একাজে তা ব্যাবহার করতে পারবো। চাই সে উপকরণ বৈধ হোক আর অবৈধ। বলা হয়ে থাকে যে اَلْغَايَةُ تُبَرِّرُ الْمَبَادِي
অর্থাৎ,‘‘
ফলাফলসমূহ উপকরণাদিকে বৈধ করে দেয়।’’
অর্থাৎ উদ্দেশ্য সঠিক হলেই আর উপকরণের বাছবিচার প্রয়োজন নেই। কিন্তু এহেন নীতি পরিত্যাজ্য । আমরা যদি একটি পবিত্র কাজের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করি তাহলে একটি পবিত্র উপকরণ কিম্বা কমপক্ষে একটি বৈধ উপকরণকে কাজে লাগাতে পারি। কিন্তু যদি অবৈধ হয় তাহলে তার আশ্রয় নেয়া যাবে না। আমরা কখনো কখনো দেখতে পাই যে কিছু কিছু লক্ষ্য যেগুলো নিজে বৈধ এবং ন্যায়নীতিপূর্ণ,কিন্তু সেগুলোর জন্যে এমনসব উপকরণ ব্যাবহার করা হয় যেগুলো নীতিবিরুদ্ধ এবং অবৈধ। এর থেকে বুঝা যায় যে যারা দেখাতে চায় যে আমাদের এমন এমন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য রয়েছে আর এগুলো হলো তার উপকরণ,আসলে ঐ উপকরণগুলোই তাদের লক্ষ্য । উদাহরণ হিসাবে বলা যায়,আগেকার যুগে একটি বিষয় ছিল যাকে বলা হতো‘
শাবিহখানি’
। তেহরানে এটা বেশি বেশি ছিল। এটা হলো কারবালার ঘটনাবলীর উপর একটি কার নাট্যাভিনয়। কারবালার ঘটনাবলী নাটকের মাধ্যমে তুলে ধরার মূল বিষয়ে কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু আমরা দেখতে পেতাম যে আস্তে আস্তে মূল শাবিহখানির বিষয়টিই মানুষের উদ্দেশ্যে পরিণত হয়েছিল। যেন তখন আর ইমাম হোসাইন (আঃ) এবং কারবালার কাহিনী তুলে ধরা বা সে সব হৃদয়বিদারক ঘটনাকে চিত্রায়িত করা কাজ ছিল না। শাবিহখানির মধ্যে তখন শত সহস্র বিষয় যুক্ত হয়ে পড়ে যেগুলো আর যাই হোক,কারবালার ঘটনাবলীর সাথে অন্তত মিলতো না। কত যে খেয়ানত,কত যে মিথ্যাচার,ধোকাবাজি আর রিপুচর্চা এসব শাবিহখানির মধ্যে ঢুকে পড়েছিল যে সন্দেহাতীতভাবে বলা যায় কখনো কখনো সেগুলো হারাম কাজ হয়ে যেত! কোনো নিয়মনীতির প্রতিই যেন তার দায়বদ্ধতা নয়। আর এটা নিয়ে বিজ্ঞ দীনি আলেমবর্গের সাথে একটা বিরোধ লেগেই থাকতো। তারা এগুলোকে বরদাশত করতেন না। এমনকি পবিত্র কোম শহরেও শাবিহখানির নামে এসব উপহাসমূলক কল্পকাহিণী চালু হয়ে পড়ে। আয়াতুল্লাহ বুরুজার্দীর মারজাইয়্যাত লাভের প্রথমদিকে যখন তার অসাধারণ প্রতাপ ছিল তখন একবার মহররমের আগে তাকে জানানো হলো যে আমাদের শাবিহখানির অবস্থা এরকম। তিনি তাদেরকে আমন্ত্রণ জানালেন। প্রত্যেক হেইয়্যাত তথা আযাদারী দলের নেতারা তার আমন্ত্রণে আসলো। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন,আপনারা কার তাকলীদ করেন? সকলে উত্তর দিল যে আমরা আপনারই তাকলীদ করি। তিনি বললেন,যদি আমার তাকলীদ করে থাকেন তাহলে আমার ফতোয়া হলো এই যে শাবিহখানিকে আপনারা এই অবস্থায় পরিণত করেছেন,এটা হারাম কাজ। তখন তারা খুবই স্পষ্টরূপে আয়াতুল্লাহ বুরুজার্দীকে জানিয়ে দিল যে,মুহতারাম,আমরা সারা বছর আপনারই তাকলীদ করি বটে;কিন্তু এই তিন চারটে দিন কোন ক্রমে আপনার তাকলীদ করবো না!! তারা একথা বলেই সেখান থেকে প্রস্থান করলো এবং তাদের মারজায়ে তাকলীদের কথার প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপই করলো না। তাহলে বোঝা গেল যে এখানে উদ্দেশ্য ইমাম হোসাইন (আঃ) বা ইসলাম নয়। বরং তাদের উদ্দেশ্য হলো ঐ নাট্যাভিনয় যা থেকে তাদের অন্য কোনো ফায়দা রয়েছে। কিম্বা কমপক্ষে মজা তো উপভোগ করতে পারে! এটা ছিল এর পুরাতন রূপ।
আর এর আধুনিক রূপ হলো আমরা বর্তমানে যেটা দেখতে পাই কোনো সুফী দরেবেশর জন্য কিছূকাল অন্তর অন্তর একটা বড় সমাবেশ অনুষ্ঠিত করা দেশের অভ্যন্তরে কিম্বা বাইরে,কোনো বড় দরেবশ যেমন মাওলানা রুমির নামে। দেখতে পাই যে কি একটা বলে যা তাদের ভাষায়‘‘
সামা’’
যদিও খোদ এই সামা নিয়েও অনেক কথা রয়েছে। ঐ সামা’
র মজিলস বৈধ নাকি অবৈধ আমি সে বিষয়ে কথা বলতে চাই না। তবে এতটুকু নিশ্চিত যে উক্ত সামা’
র মজিলস এরূপ ছিল না যে গোটা কতেক নাচনে আর ঢুলি যাদের মাথায় ইরফানের মরমী অর্থই বোধগম্য নয়,তারা সেখানে অংশগ্রহণ করবে! পরবর্তিতে আমরা দেখতে পাই যে (তৎকালীন শাহ সরকার কর্তৃক) মাওলানা রুমীর 700তম জন্মবার্ষিকী পালনের নামে যে কংগ্রেসের আয়াজন করেছে সেখানে যে একটিমাত্র কাজ করা হয় তাহলো একদল নাচনে কে এনে তথাকথিত সামা’
র মজিলস অনুষ্ঠিত করা,একটি রিপুচর্চার মজলিস তাও আবার মাওলানা রুমির শানে।
উদ্দেশ্য যদি বৈধ হয়ে থাকে তাহলে উপায় উপকরণও বৈধ হতে হবে। অপরদিকে আবার একদল রয়েছে যাদেরকে বৈধ উপকরণ ব্যবহারের জন্য হাজার কষ্ট করেও রাজি করানো যায় না। এই মাইক্রোফোনের কথাই ধরুন। যখন প্রথম এটা তৈরী হয় তখন কতইনা এর বিরোধিতা করা হয়! যদিও শব্দের জন্যে মাইক্রোফোন হলো চোখের জন্য চশমার তুল্য কিম্বা কানের জন্য ইয়ার-ট্রাম্পেট তুল্য। যদি মানুষের কান ভার থাকে তাহলে এক ইয়ার-ট্রাম্পেট স্থাপন করে। এর অর্থ হলো আগে শুনতো না,এখন শুনতে পায়। আগে কোরআনকে শুনতে পেত না,এখন কোরআনকে ভালোমতো শুনতে পায়। গালিগালাজকেও আগে শুনতো না,এখন গালিগালাজকেও ভালোমতো শুনতে পায়। কিন্তু এটা তো ইয়ার-ট্রাম্পেট এর সাথে সম্পর্কিত না। মােইক্রোফোনের বেলায়ও সেই একই কথা। মাইক্রোফোন তো আর হারাম কাজের বিশেষ উপকরণ নয়। সেই উপকরণই ব্যাবহার করা হারাম যার দ্বারা কেবল হারাম কাজ ছাড়া আর কিছুই সাধিত হয় না। যেমন‘‘
ক্রুশ’’
চিহ্নটি । যা দ্বারা শিরকের প্রতীক ছাড়া আর কিছুই বুঝায় না। মূর্তিও তদ্রুপ। কিন্তু যেসব জিনিস দ্বারা হারাম কাজও করা যায় আবার হালাল কাজও করা যায় সেগুলো হারাম হবে কেন?
জনৈক ওয়াজকারী বলতেন,মাইক আবিস্কার হওয়ার প্রথমদিকের একটি ঘটনা। আমরাও নতুন নতুন মাইকে কথা বলা শুরু করেছি। (সত্যি বলতে কি এই মাইক ওয়াজকারীদের ওপর আসলেই অনেক দাবীদার। যদি ত্রিশবছর আগে লক্ষ্য করেন তাহলে দেখা যাবে যে সত্তর বছর বয়স হয়েছে এমন ওয়াজকারী খুবই কম ছিল। বেশীরভাগ ওয়াজকারীই চল্লিশ-পঞ্চাশবছর বয়সেই কোনো একভাবে মৃত্যুবরণ করতেন। আর এর পেছনে একটি কারণ ছিল এই মাইক না থাকা। ফলে তাদের অনেক জোরে জোরে কথা বলতে হতো। তখন গাড়ীঘোড়াও তো ছিল না যে তারপর গাড়ীতে চেপে বসবে। গাধা বা খচ্চরের পিঠে সওয়ার হতেন। আর শীতের সময় এটা তাদের জন্য খুব খারাপ হতো। ফলে তাদের অধিকাংশই যুবক বয়সেই মৃত্যুর কবলে পড়তেন। এক্ষমতাবস্থায় মাইক তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে) কিন্তু তখনো মাইক প্রচলন লাভ করেনি। কথা ছিল আমি এক বৃহৎ মজলিসে বক্তব্য রাখবো। সেখানে মাইকও রাখা হয়েছিল। আমার আগে জনৈক বক্তা মেম্বারে ওঠেন। মেম্বারে উঠেই তিনি বললেন,এই শয়তানের গোরটাকে এখান থেকে নিয়ে যাও। শয়তানের গোরটাকে সরিয়ে ফেলা হলো। আমি দেখলাম যদি সহ্য করি এবং কথা না বিল তাহলে এই শয়তানের গোরটাকে তো নিয়ে গেছে,পরবর্তিতেও একে আর ব্যাবহার করা যাবে না। তিনি বলেন যে,আমি যেইমাত্র মেম্বারে আরোহণ করলাম,বললাম,ঐ শয়তানের জীনটাকে আনা।
মোটকথা,এধরনের নিরেট মন-মানসিকতা আর শুস্ক চিন্তা-ভাবনা অবান্তর। মাইকের কোনো দোষ নেই। রেডিও,টেলিভিশন,ফিল্ম ইত্যাদি নিজ পরিসরে কোনো দুষ্ট নয়। এর বিষয়সার কি হবে? রেডিওতে যা বলা হবে সেটা কি হবে? টেলিভিশনে যা দেখানো হবে তা কি হবে? ফিল্মে যা দর্শন করা হবে তা কি হবে? এ ক্ষেত্রে মানুষের আর শুস্কতার পরিচয় দেয়া উচিত নয় এবং যে জিনিস নিজ পরিসরে হারাম নয় বরং বৈধ,সেটাকে একটা অবৈধ হিসাবে প্রতিপন্ন করা উচিত নয়। ইসলামের ইতিহাসে তৎকালীন যুগে যেসব উপকরণ ছিল সেগুলোর কেমন ব্যাবহার হয়েছে এবং সেসব উপকরণ ইসলামের বার্তা পৌছানোর কাজে কি অসাধারণ অবদান রেখেছে সে সম্পর্কে জানতে হলে এ বিষয়টির দিকে মনোযোগ প্রদান করতে হবে। কখনো কি পবিত্র কোরআন মজিদের আয়াতমালার বিশুদ্ধতা ও স্বচ্ছতা,এগুলোর প্রঞ্জলতা এবং আকর্ষণীয়তার ব্যাপারে চিন্তা করেছেন? কোরআন দুটি বৈশিষ্ট্যের অধিকারীঃ একটি হলো এর বিষয়বস্তুর বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ হক্কানী তথা সত্যনিষ্ঠতা। আর দ্বিতীয়টি হলো সৌন্দর্যময়তা।
কোরআন তার অর্ধেক সফলতা এপথ ধরেই অর্জন করেছে। সৌন্দর্যময়তা ও শিল্পশৈলিতা। কোরআনের বিশুদ্ধতা রয়েছে যা মানবের উর্দ্ধে । কোরআনের এই প্রভাব-প্রতাপ তার সৌন্দর্যের দান। কোনো উক্তির বিশুদ্ধতা এবং সৌন্দর্যই সেই উক্তি কে অপরের কাছে পৌছে দেবার জন্য সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম। স্বয়ং কোরআনও তার এই বিশুদ্ধতা এবং সৌন্দর্যকে নিয়ে কতই না গর্ব করে এবং এ ব্যাপারে কতই না কথা বলে! আসলে কোরআনের আয়াতমালার প্রভাব সম্পর্কে স্বয়ং কোরআনেই কতো আলোচনা এসেছে! এই প্রভাব হলো কোরআনের রীতি পদ্ধতি সম্পর্কিত অর্থাৎ এর বিশুদ্ধতা ও সৌন্দর্য।
)
اللَّـهُ نَزَّلَ أَحْسَنَ الْحَدِيثِ كِتَابًا مُّتَشَابِهًا مَّثَانِيَ تَقْشَعِرُّ مِنْهُ جُلُودُ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ ثُمَّ تَلِينُ جُلُودُهُمْ وَقُلُوبُهُمْ إِلَىٰ ذِكْرِ اللَّـهِ ذَٰلِكَ هُدَى اللَّـهِ يَهْدِي بِهِ مَن يَشَاءُ(
অর্থাৎ,আল্লাহ কিতাব তথা উত্তম বাণী অবতীর্ণ করেছেন,যা সামঞ্জস্যপূর্ণ,পুনঃ পুনঃ গঠিত। এতে তাদের লোম কাটা দিয়ে ওঠে চামড়ার উপর,যারা তাদের পালনকর্তাকে ভয় করে। এরপর তাদের চামড়া ও অন্তর আল্লাহর স্মরণে বিনম্র হয়। এটাই আল্লাহর পথনির্দেশ। এর মাধ্যমে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথ প্রদর্শন করেন। ( যুমারঃ 23)
এই যে একটি হাকিকত তথা সারসত্য বিষয় যা বিদ্যমান ছিল এবং বিদ্যমান রয়েছে,কোরআন সে ব্যাপারে বর্ণনা করছে। উক্তি সমূহের মধ্যে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট এবং সুন্দরতম হলো-মাছানি কিতাব। (মাছানির অর্থ যাই হোক না কেন) تَقْشَعِرُّ جُلُودُ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ
অর্থাৎ,যাদের অন্তরে প্রতিপালকের ভয় থেকে একটি অনুভূতি রয়েছে,যখন তারা কোরআনকে শ্রবণ করে তখন কাঁপতে শুরু করে। তাদের শরীরের চামড়া মুষড়ে পড়ে,
)
ثُمَّ تَلِينُ جُلُودُهُمْ وَ قُلُوبُهُمْ اِلَي ذِآکرِ اللهِ(
আরেকটি আয়াতে এসেছেঃ
)
اِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ اِذَا ذُآکرَ اللهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَ اِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ اِيمَاناً وَ عَلَي رَبِّهِمْ يَتَوَکَّلُونَ(
অর্থাৎ,যারা ঈমানদার তারা এমন যে,যখন আল্লাহর নাম নেয়া হয় তখন ভীত হয়ে পড়ে তাদের অন্তর। আর যখন তাদের সামনে পাঠ করা হয় কালাম,তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং তারা স্বীয় প্রতিপালকের প্রতি ভরসা পোষণ করে। (আনফাল 2)
অথবা কিছু আয়াতে সেসকল ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে যারা কোরআনের আয়াত শোনার সময় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ।
)
يَخِرُّونَ لِلْاَذْقَانِ سُجَّداً(
অর্থাৎ,তারা নতমস্তকে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে। (ইসরাঃ 107)
কিম্বা কিছু খৃষ্টানদের ব্যাপারে বর্ণনা করে যেঃ
)
إذَا سَمِعُوا مَا اُنْزِلَ اِلَي الرَّسُولِ تَرَي اَعْيُنَهُمْ تَفِيضُ مِنَ الدَّمْعِ(
অর্থাৎ,তারা রাসূলের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে,তা যখন শুনে,তখন আপনি তাদের চোখ অশ্রু সজল দেখতে পাবেন। (মায়িদা 83)
আসলে হাবাশার বিপ্লব কিভাবে সংঘটিত হয়? হাবাশার বিপ্লবের সূচনা হয় কি থেকে? হাবাশা মুসলমান হয়ে যায় কেন এবং এই ইসলামের উৎপত্তি হয় কোত্থেকে? কোরআন এবং এর সৌন্দর্য ছাড়া কি অন্য কিছু ছিল? সেদিনকার সে ঘটনায় হযরত জাফর ইবনে আবি তালিব হাবাশায় ঐ সভায় প্রবেশ করলেন,রাজকীয় গাম্ভীর্যতা চারপাশে,তিনি শুরু করলেন পবিত্র কোরআন (সুরা তাহা) থেকে তেলাওয়াত করতে। মুহুর্তেই গোটা আসর বিস্ময়ে জেগে উঠলো। এ জাগরণের কারণ কি ছিল?! কোরআন বিশুদ্ধতা ও বর্ণনা শক্তি এবং প্রঞ্জলতা ও আকর্ষণীয়তা আর প্রভাব ক্ষমতার দিক থেকে এমনভাবে রচিত যে অন্তরসমূহের উপরে এরূপে প্রভাব বিস্তার করে।
আমিরুল মুমিনীন আলী (আঃ) এর জনগণের মাঝে সফলতার একটি কারণ হলো তার ভাষার বিশুদ্ধতা।‘
নাহজুল বালাগা’
-আজ যা সংকলনের এক সহাস্রাব্দকাল অতিক্রান্ত হতে চলেছে অর্থাৎ গ্রন্থাকারে রূপলাভ করার সময় থেকে এক হাজার বছর কেটে গেছে,আর মূল খোতবাসমূহ উচ্চারিত হওয়ার পর থেকে প্রায় চৌদ্দশ’
বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু সেই প্রাচীন আমলেও কি আর বর্তমান যুগেও কি,তার শীর্ষ স্থান বজায় রেখেছে। আমি এক সময় একটা সমীক্ষা চালিয়েছিলাম। দেখতে পাই যে স্বয়ং আমিরুল মুমিনীন (আঃ) এর যুগ থেকে অদ্যাবধি আরবের সকল সাহিত্যিক ও ভাষাবিদ আমিরুল মুমিনীন (আঃ)-এর বিশুদ্ধ ও উৎকৃষ্ট ভাষার সামনে কুর্ণিশ জানিয়ে এসেছে ।
বলা হয় যে,মিশরে কয়েকবছর আগে‘
শাকিল আরসেলান’
যাকে‘‘
আমিরুল বাইয়্যান’’
তথা বাগ্মী সম্রাট বলে আখ্যায়িত করা হতো-তার সম্মানে এক সম্বর্ধনা সভার আয়াজন করা হয়েছিল। এ সভায় বক্তাদের মধ্যে একজন তার বক্তৃতায় শাকিল আরসেলানের প্রশংসা তুলে ধরতে গিয়ে এক পর্যায়ে তাকে হযরত আলী (আঃ)-এর সাথে তুলনা করে বলে যে,শাকিল আরসেলান হলেন আমাদের যুগের আমিরুল বাইয়্যান যেমনভাবে আলী ইবনে আবি তালিব ছিলেন তার যুগের আমিরুল বাইয়্যান অর্থাৎ বাগ্মী সম্রাট। যখন স্বয়ং শাকিল আরসেলান বক্তৃতা মঞ্চে আরোহন করলেন,প্রচণ্ড ক্ষুধা অবস্থায় বললেন,এসব আজগুবি কথাবার্তা বলা হচ্ছে কেন?! আমাকে আলী ইবনে আবি তালিবের সাথে তুলনা করছেন?! আমি আলীর জুতোর ফিতার সমানও হতে পারবো না। আমার বয়ান কোথায় আর হযরত আলীর বয়ান কোথায়?! আমাদের যুগেও এমন এমন লোক দেখি নির্মল পবিত্র অন্তরের অধিকারী,যখন হযরত আলীর বক্তৃতা শ্রবণ করে,মনের অজান্তে তাদের চোখ থেকে অশ্রু প্রবাহিত হয়। এটা তাহলে কি? বক্তৃতার সৌন্দর্য থেকেই। স্বয়ং হযরত আলীর জামানায় এধরনের নজীর অনেক পাওয়া যায়।
হযরত আলী (আঃ) এর‘‘
খুতবাতুল গাররা’’
তথা দীপ্ত ভাষণটি যা দৃশ্যতঃ মরুভূমিতে উচ্চারিত হয়েছিল,সে সম্পর্কে লেখা রয়েছে যে,যখন ভাষণ শেষ হয় তখন সমবেত সবাই সেভাবেই অশ্রু ঝরিয়ে যাচ্ছিল।‘‘
হাম্মাম’’
নাম্মী জনৈক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি আমীরুল মুমিনীনের কাছে আবেদন জানালেন যে,মুত্তাকী লোকদের পরিচয় কি আমাকে ব্যাখ্যা দিন। প্রথমে ইমাম এড়িয়ে যেতে চাইলেন এবং দু-তিনটি বর্ণনা দিয়ে থেমে গেলেন। কিন্তু হাম্মাম তুষ্ট হলেন না। বললেন,আরো জানতে চাই। আপনি পরিপূর্ণভাবে মুত্তাকীর চিত্র আমার জন্য চিত্রায়িত করুন। এবার হযরত আলী (আঃ) ঐ মজলিসেই শুরু করলেন মুত্তাকীদের পরিচয় ব্যাখ্যা করতে;মুত্তাকীরা তাদের রাত অতিবাহিত করে এভাবে,তাদের দিন কাটে এভাবে,তাদের বস্ত্র এরূপ,লোকজনের সাথে মেলামেশার ক্ষেত্রে তারা এরূপ,তাদের কোরআন পড়া এরূপ। আমি (ওস্তাদ শহীদ মুতাহহারী) একবার গণনা করে দেখেছিলাম,চল্লিশটি বাক্যের মাধ্যমে মুত্তাকীদের একশ’’
ত্রিশটি গুণবৈশিষ্ট্য ঐ মজলিসে ব্যাখ্যা করেন। ঐ লোকটি এই বর্ণনা যতই শুনছিলেন ততই তার আসক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছিল। অতঃপর একসময় জোরে চিৎকার করে ওঠেন এবং সেখানেই মৃত্যু বরণ করেন। আমিরুল মুমিনীন বললেন : هَكَذَا تَصْنَعُ الْمَوَاعِظُ الْبَالِغَةُ بِاَهْلِهَا
-
অর্থাৎ বক্তৃতা যদি বিশুদ্ধ হয় আর অন্তর যদি গ্রহী হয় তাহলে এরূপ করে থাকে।(
নাহজুল বালাগা
,
ফয়জুল ইসলাম
,
খোতবা নং 184
,
খোতবা
-
ই হাম্মাম নামে প্রসিদ্ধ
,
পৃষ্ঠা
-
618
)
দোয়া দরুদের কথাও বলা যায়। দোয়াসমূহের মধ্যে মানুষ আল্লাহর সাথে কথা বলে থাকে। নিছক শব্দ বা উক্তির কোনো প্রভাব থাকে না। কিন্তু আমাদের দোয়াসমুহ পরিপূর্ণতম বিশুদ্ধতা এবং সৌন্দর্যের অধিকারী। কেন? কারণ,দোয়ার ঐ সৌন্দর্য যেন একটা মাধ্যম হয় যাতে দোয়ার বিষয়বস্তুকে মানুষের অন্তরে পৌছাতে সক্ষম হয়। কেন বলা হয় যে মুয়াজ্জিন সুকন্ঠের হওয়া মুস্তাহাব? এটা তো ইসলামী ফেকাহর কথা।‘‘
আল্লাহু আকবার’’
কে সুকন্ঠে বলা হোক আর কর্কশ কণ্ঠে বলা হোক-অর্থ তো আর বদলে যায় না। কিম্বা‘‘
আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’
কে সুকন্ঠে বলা হোক আর কর্কশ কন্ঠে বলা হোক-অর্থ তো আর পরিবর্তন হয়না। কিন্তু মানুষ যখন‘‘
আল্লাহু আকবার’’
কে কোনো কর্কশ কন্ঠ থেকে না শুনে বরং কোনো সুললিত কন্ঠ থেকে শ্রবণ করে তখন তার অন্তরে অন্যরূপে প্রভাব ফেলে।
শেখ সাদী এক কাহিনী বর্ণনা করেনঃ তিনি বলেন যে এক শহরে একজন মুয়াজ্জিন ছিল খুবই কর্কশ গলার। সে ঐ কর্কশ কন্ঠে আযান দিচ্ছিল। একসময় তাকিয়ে দেখলো যে এক ইহুদী তার জন্যে উপেঢৗকন নিয়ে উপস্থিত হলো এবং বললো এই সামান্য উপহারটুকু গ্রহণ করবে? মুয়াজ্জিন বললোঃ কেন? সে বললোঃ কারণ,তুমি আমার বড় একটি উপকার করেছ। মুয়াজ্জিন বললোঃ কি উপকার! আমি তো কোনোই উপকারই তোমার জন্যে করিনি। ইহুদী তখন বললোঃ আমার একটি কন্যা রয়েছে যে ইদানীং ইসলাম ধর্মের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছিল। কিন্তু তুমি যখন আযান দিচ্ছিলে তখন তোমার মুখ থেকে আল্লাহু আকবার ধ্বনি শুনে এখন সে ইসলাম থেকে বিমুখ হয়ে গেছে। তাই আমি তোমার জন্যে এই উপহারটি নিয়ে এসেছি। কারণ আমার মেয়েকে মুসলমান হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে তুমি আমার বড়ই উপকার করেছ।
মোটকথা এ বিষয়টি নিজেই একটি বিষয়।
ইবনে সীনা তার‘‘
মাকামাতুল আরেফীন’’
গ্রন্থে মানুষের জন্য আত্মিক সংযুতি কখন সৃষ্টি হয় সে সম্পর্কে খুবই উত্তম ও সুক্ষ্ণ বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন এবং এর কতিপয় কারণ উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে একটি হলো যথাঃ اَلْكَلامُ الْوَاعِظُ مِنْ قَائِلٍ زَآکيٍّ
অর্থাৎ উপদেশ বাণী যখন কোনো পবিত্র বক্তার মুখ থেকে নিঃসৃত হয়। অর্থাৎ প্রথম কথা হলো স্বয়ং উপদেশদাতা (ওয়াজকারী) কে শুদ্ধ ও পবিত্র অন্তরের অধিকারী হতে হবে। অতঃপর বলেনঃ بِعِبَارَةٍ بَلِيغَةٍ وَ نَغْمَةٍ رَخِيمَةٍ
অর্থাৎ উক্ত ওয়াজকারীর কন্ঠ হতে হবে সুললিত,সুকন্ঠ । যাতে শ্রোতার মনে উত্তমরূপে রেখাপাত করতে সক্ষম হয়। ওয়াজকারীর কথা বিশুদ্ধ হতে হবে তাহলে শ্রোতার অন্তরে প্রভাব ফেলবে। স্বয়ং বক্তার চেহারা সুরতও এ প্রভাব ফেলার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখে। এ আলোচনা করার উদ্দেশ্য একটাই। আর তাহলো যাতে বুঝা যায় যে অর্থ পৌছানো,নিজেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এগুলো হলো উপকরণ তথা মাধ্যম,এগুলোই বৈশিষ্ট্য আর পদ্ধতি। এই উপকরণ ও মাধ্যমগুলোই বার্তাকে চতুর্দিকের ব্যক্তি তথা জনতার কাছে পৌছে দেবে।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলতে হয়। স্বয়ং কোরআন পড়ার বিষয়টি কিরূপ? অবশ্য কোরআন আযানের মতো নয়। আযানের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে যে একজন আযান দেবার জায়গায় আরোহণ করবে এবং আযান প্রদান করবে। আর তাকে সুকন্ঠের অধিকারী হতে হবে। কিন্তু কোরআনকে সবাই পড়ে। যারাই কোরআন পড়ে তাদের কর্তব্য হলো যথাসম্ভব সুন্দরভাবে পড়া। এতে যেমন স্বয়ং কারীর অন্তরে উত্তম প্রভাব ফেলে,তদ্রুপ শ্রোতার অন্তরেও। কোরআনে এই যে নির্দেশ এসেছেঃ
)
وَ رَتِّلِ الْقُرآنَ تَرْتِيلاً(
অর্থাৎ, কোরআন আবৃত্তি করুন তারতীল তথা সুবিন্যস্তভাবে এবং স্পষ্টভাবে। (মুযযাম্মিলঃ 4)-এর অর্থ কি? অর্থাৎ যখন কোরআন পড়বেন তখন যেন শব্দাবলীকে এমন দ্রুততার সাথে পড়বেন না যে সেগুলো পরস্পর জোড়া লেগে যায়। আবার এমন বিরিত দিয়ে পড়বেন না যে এক শব্দ আরেকটি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। এমনভাবে সেগুলো পড়তে হবে যেন কেউ বলে দিচ্ছে আর আপনি তা শুনে শুনে পাঠ করছেন। কিম্বা আপনি যেন নিজের সাথে নিজে কথা বলছেন। আরফগণের ভাষায়,মানুষের উচিত কোরআনকে সবসময় এমনভাবে পাঠ করা যে সে যেন মনে করে বক্তা হলেন আল্লাহ আর শ্রোতা সে নিজে। সে স্বয়ং আল্লাহর নিকট থেকে সরাসরি একথাগুলো শুনছে এবং গ্রহণ করছে।
আল্লামা ইকবাল লাহোরী বলেন,আমার পিতা আমাকে একটি কথা বলেন যা আমার ভাগ্য গড়ার কাজে অসাধারণ প্রভাব ফেলেছিল। তিনি বর্ণনা করেন যে একিদন আমি আমার কক্ষে বসে কোরআন পাঠ করার কাজে ব্যস্ত ছিলাম। এমন সময় আমার পিতা সে কক্ষের সামনে দিয়ে যাওয়ার পথে থেমে গেলেন এবং আমার দিকে তাকিয়ে বললেনঃ মুহাম্মাদ! কোরআনকে এমনভাবে পাঠ করো যেন স্বয়ং তোমার উপরেই তা অবতীর্ণ হয়েছে। তখন থেকে আমি যখনই কোরআন খুলে বসি এবং আয়াতগুলোকে পাঠ করি তখনই আমি মনে করি যে,এ হলেন আমার আল্লাহ যিনি আমার সাথে অর্থাৎ মুহাম্মাদ ইকবালের সাথে কথা বলছেন।
এক হাদীসে রয়েছেঃ
تَغَنَّوْا بِالْقُرْآنِ
অর্থাৎ কোরআনকে গানে গানে ( সূরে সূরে) পাঠ করো।(
বিহারুল আনায়ার
,
খণ্ড 92
,
পৃষ্ঠ
-
191
;
জামেউল আখবার
,
অধ্যায় 23
,
পৃষ্ঠা
-
57
)
এমর্মে কয়েকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যেটা নিশ্চিত করে বলা যায় তাহলো এর বক্তব্য-তোমরা কোরআনকে খুবই সুরেলা কন্ঠে পাঠ করো। অবশ্য সেসব সুর যেগুলো আনন্দ ফুর্তির আসরের গান বাজনা সদৃশ্য এবং যৌন সুড়সুড়িকর সেগুলো তো অবধারিতভাবে হারাম এবং শরীয়ত বিরোধী। কিন্তু যেসব সুর মানুষের আত্মিক অবস্থার সাথে সমঞ্জস্যশীল তেমন সুরে হওয়া বাঞ্ছনীয়। স্মরণ রাখতে হবে যে পবিত্র কোরআনের অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে সুর ধারণ করার ক্ষেত্রে । এটাও কোরআনের এক মুজিজা। তবে সে সুর আত্মিক ও আধ্যাত্মিক। কোনো যৌন সুড়সুড়িকর সুর নয়। অবশ্য এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত দেবেন কোনো বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি ।
আব্দুল বাসেতের কোরআন তেলাওয়াত কেন দেশ দেশ এত জনপ্রিয়? কারণ,আব্দুল বাসেত তার মোহনীয় কন্ঠে সুললিত সুরে এবং তেলাওয়াতের যথাযথ নিয়ম কানুন মেনে যে সূরাকে যেমন সুরে পড়তে হবে ঠিক সেভাবে পড়তে জানেন এবং পড়ে থাকেন। আমাদের মাসুম ইমামগণের সম্পর্কেও বিশেষ করে ইমাম যয়নুল আবেদীন এবং ইমাম মোহাম্মদ বাকের (আঃ) সম্পর্কে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে তারা যখন কোরআন তেলাওয়াত করতেন,সুমধুর ও চিত্তাকর্ষক কন্ঠে ,তখন সে আওয়াজ গলিপথে ছড়িয়ে পড়তো। আর যারা সে পথে চলাচল করতো তারা সে সুর শুনে বিমোহিত হয়ে পড়তো। থেমে যেত তাদের পথ চলা। ইমাম (আঃ) এর দরজা পাশে ভীড় জমে যেত আর সে ভীড়ে পথ বন্ধ হয়ে যেত। এমনকি যারা পানি সরবরাহ করতো (সে আমলে চলন ছিল কিছু কিছু লোক মশক কাঁধে নিয়ে কুপ থেকে পানি তুলে মানুষের ঘরে ঘরে সরবরাহ করতো। মদীনায় শুধুই কুপ ছিল। পানির নহর ছিল না।) এবং সংখ্যায়ও নিতান্ত কম ছিল না,তারা কাঁধে পানির মশক নিয়েই যখন ইমাম (আঃ) এর বাড়ীর সামনে দিয়ে অতিক্রম করতে যেত,তখন ইমাম (আঃ) এর সুমধুর কন্ঠ শুনে তাদের পা চলার শক্তি হারিয়ে ফেলতো। ঐ পানি ভরা ভারী মশকগুলো কাঁধে নিয়েই তারা দাড়িয়ে দাড়িয়ে কোরআন তেলাওয়াত শ্রবণে নিমগ্ন হয়ে যেত যতক্ষণ না ইমাম (আঃ) এর তেলাওয়াত শেষ হতো। এসব কিছু থেকে কি বেরিয়ে আসে? ঐশী বার্তা পৌছানোর জন্যে বৈধ উপকরণ বা মাধ্যমকে কাজে লাগানো। ইমাম (আঃ) কেন কোরআনকে এভাবে সুমধুর সুরে তেলাওয়াত করতেন? কারণ তিনি চেয়েছিলেন এই মাধ্যম দ্বারা তাবলীগের কাজ করতে। কোরআনকে মানুষের কাছে পৌছাতে। কেউ যখন ইসলামের ব্যাপারে কবিতা সম্পর্কে অধ্যয়ন করে তখন অদ্ভুত বিষয়াদি দেখতে পায়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কবিতার সাথে লড়াইও করেছেন আবার কবিতাকে প্রচলনও করেছেন। সেই সব কবিতার সাথে লড়াই করেছেন যেগুলো আজকের ভাষায় প্রতিশ্রুতিশীল ছিল না। অর্থাৎ সেগুলো কোনো উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য সম্বলিত কবিতা ছিল না। নিছক কল্পনা আর খেয়াল,সময় কাটানোর মাধ্যম,মিথ্যাচারে ভরা। যেমন কেউ কবিতা আবৃত্তি করতো কারো বল্লমের প্রশংসায় কিম্বা কারো ঘোড়ার প্রশংসায়। কেউ বা আবার কবিতা আবৃত্তি করতো প্রেয়সীর তিলকের প্রশংসায় অথবা ধনীলোকের প্রশংসা করতো তার অর্থের আশায়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কঠোরভাবে এজাতীয় কবিতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। বলেছেনঃ
لَاَنْ يَمْتَلِيَ جَوْفُ رَجُلٍ قَيْحاً خَيْرٌ لَهُ مِنْ اَنْ يَمْتَلِيَ شِعْراً
অর্থাৎ যদি মানুষের পেট বমি দ্বারা ভরা থাকে সেটাও বরং ভালো ফালতু কবিতায় ভরা থাকার চেয়ে।(
নাহজুল ফাসাহা
,
পৃষ্ঠা 470
,
হাদীস নং 2215
)
কিন্তু আবার তিনিই বলেছেনঃ
اِنَّ مِنَ الشِّعْرِ لَحِكْمَةً
অর্থাৎ কিছু কিছু কবিতা রয়েছে প্রজ্ঞাপূর্ণ।(
আল গাদীর
,
খণ্ড 2
,
পৃষ্ঠা 9
)
সব কবিতাকে ফালতু বলা হয়নি। বরং কিছু কিছু কবিতা রয়েছে বাস্তবতা সমৃদ্ধ ।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার সভাসদদের মধ্যে কয়েকজন কবিকেও রেখেছিলেন। তাদের মেধ্যে একজন হলেন হাসসান বিন সাবিত। দুই প্রকার কবিতার মধ্যে প্রভেদকরণ শুধু কেবল রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর হাদীসেই আসেনি। বরং পবিত্র কোরআনেও এ ব্যাপারে বর্ণনা রয়েছে। ইরশাদ হচ্ছেঃ
)
وَالشُّعَرَاءُ يَتَّبِعُهُمُ الْغَاوُونَ أَلَمْ تَرَ أَنَّهُمْ فِي كُلِّ وَادٍ يَهِيمُونَ وَأَنَّهُمْ يَقُولُونَ مَا لَا يَفْعَلُونَ إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ(
-অর্থাৎ,বিভ্রান্ত লোকেরাই কবিদের অনুসরণ করে। তুমি কি দেখ না যে,তারা প্রতি ময়দানেই উদভ্রান্ত হয়ে ফিরে? এবং এমন কথা বলে যা তারা করে না। তবে,তাদের কথা ভিন্ন যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে।(
শুআরা
224
-
227
)
এমনও কবি ছিল যাদেরকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অথবা পবিত্র ইমামগণ (আঃ) ঊৎসাহিত করতেন। কিন্তু কোন ধরনের কবিরা? যারা কবিতার সুন্দর আভরণে ইসলামের বার্তাকে এবং এর সারত্তাকে জনগণের কাছে তুলে ধরতো। নিঃসন্দেহে কবিতা যে কাজ করতে পারে,একটি প্রবন্ধ দ্বারা তা করা যায় না। কারণ,কবিতা হলো যুগের চেয়ে সৌন্দর্যময়। কবিতার ছন্দ থাকে,থাকে অন্তরাত্মা যা সূর ধারণ করতে সক্ষম। মস্তিস্ক তা মুখস্ত করতে সক্ষম। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বীয় সভাসদের একজন হাসসান বিন সাবিতকে বললেনঃ
لَا تَزَالُ مُؤَيِّداً بِرُوحِ الْقُدُسِ ، مَا ذَبَبْتَ عَنَّا اَهْلَ الْبَيْتِ
অর্থাৎ,পবিত্র আত্মা তোমাকে ততক্ষণ অবিধ সমর্থন করে যাবে যতক্ষণ তুমি যে পথে (অর্থাৎ আহলে বাইত) রয়েছ তা থেকে বিপথগামী না হবে।(
আল
-
গাদীর
,
খণ্ড 2
,
পৃষ্ঠা 34
)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একথাগুলো বলেন একজন কবি সম্পর্কে।
মাসুম ইমামদের (আঃ) সময়কার কবিরা কতই না অবদান রেখেছেন! আমাদের ইসলামের ইতিহাসে আরবী,ফার্সী ও অন্যান্য ভাষায় অনেক বীরত্বগাঁথা ও একত্ববাদী কবিতা রয়েছে। অসাধারণ উপদেশময় সেসব কবিতা। এগুলো সবই হলো ইসলামী সংস্কৃতির ফলস্বরূপ। কবিতার যে প্রভাব রয়েছে,যুগের তা নেই। আর নাহজুল বালাগার বিস্ময় হলো এটাই যে গদ্য,কিন্তু বিশুদ্ধতা আর সৌন্দর্যতায় কবিতার সমকক্ষ বা তার চেয়েও বেশী। ফার্সী ভাষায় আপনি এক পৃষ্ঠাও লেখা খুজে পাবেন না যা শেখ সাদীর এক পৃষ্ঠা কবিতার সমকক্ষ হবে। যদিও মানোর্ত্তীর্ণ লেখা বহু রয়েছে। যেমন,খাজা আব্দুল্লাহ আনসারীর কালেমাতে কেসার কিম্বা সাদীর কথা-সাহিত্য । মাওলানা জালালুদ্দীন রুমি তার ঐ অসাধারণ পাণ্ডিত্য ও দক্ষতা সত্বেও যখন তার ওয়াজের মজলিসে যাবেন,দেখবেন যে তার কবিতার তুলনায় কথার বয়ানগুলো কিছুই না। আরবী ভাষায়ও এমন কোনো গদ্য রীতির লেখা নেই যার মধ্যে নাহজুল বালাগার মতো অসাধারণ শক্তিমত্তা প্রত্যক্ষ করা যায়। কবিতা তার নিজ আদলে অনেক অবদানই রাখতে সক্ষম হয়েছে এবং অনেক অবদান রাখতে সক্ষম। আবার মন্দ কবিতাও খুবই মন্দ হতে পারে যেমনভাবে ভালো কবিতাও অনেক ভালো হতে পারে। হিকমতের কবিতা,তৌহিদের কবিতা,পরকালের কবিতা,নবুওয়াতের কবিতা,রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রশংসার কবিতা,মাসুম ইমাগণ এবং পবিত্র কোরআনের প্রশংসায় কবিতা,শোক-মার্সিয়ার কবিতা ইত্যাদি কবিতাসমূহ যদি ইমামদের যুগের কবিতার মতো ভালো হয় তাহলে তা অত্যন্ত প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে।
আল্লামা ইকবাল লাহোরী প্রকৃতই একজনবান পণ্ডিত ছিলেন। তিনি এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন যিনি ইসলামের ক্ষেত্রে নিজের জন্যে এক রেসালাত তথা দায়িত্ব অনুভব করতেন। আর এ রেসালাত পৌছানোর জন্যে তিনি যে উপকরণকে কাজে লাগিয়েছিলেন তা হলো কবিতা। ফার্সী ভাষার কবিদের মধ্যে বিশেষ করে সাম্প্রতিক কালের কবিদের মধ্যে লক্ষ্য নিয়ে চলেছেন এমন কবি হিসাবে নিঃসন্দেহে আল্লামা ইকবালের কোনো জুড়ি নেই। কবিতা যদি কবির জন্যে মাধ্যম হয়ে থাকে তার লক্ষ্যের জন্যে ,তাহলে তার কোনো তুলনা হয় না। আল্লামা ইকবাল যেখানে সঙ্গীতের প্রয়োজন ছিল সেখানে সঙ্গীত রচনা করতেন। তার বিখ্যাত যে সঙ্গীতটি আরবীতে অনুবাদ করা হয়েছে সেটা উর্দুতেই তিনি রচনা করেছিলেন। এখন ফার্সী ভাষায়ও তা অনুবাদ করা হয়েছে। কি অসাধারণ সঙ্গীত খানি। আমি (ওস্তাদ মুতাহহারী) নিজে একাধিকবার এটি শুনে ক্রন্দন করেছি,অনেককে কাদতেও দেখেছি। আমরা সঙ্গীতকে কাজে লাগাবো না কেন? এগুলো সবই হলো মাধ্যম। এসব মাধ্যম থেকে উদাসীন থাকা আজ আর চলে না। আধুনিক যুগে এমন সব মাধ্যম আবিস্কৃত হয়েছে যা আগের আমলে ছিল না। শুধু আগেকার যুগের উপকরণ নিয়ে আমরা ক্ষান্ত থাকবো কেন? আমাদের কেবল দেখতে হবে যে কোন উপকরণটি শরীয়ত স্বীকৃত আর কোনটি শরীয়ত স্বীকৃত নয়।
স্বয়ং ইমাম হোসাইন (আঃ) ঐ উত্তপ্ত মরু প্রান্তরে স্বীয় বার্তাকে পৌছানোর জন্য এবং ইসলামের বার্তাকে পৌছানোর জন্য যে যে উপকরণ এবং মাধ্যমকে ব্যাবহার করা সম্ভব ছিল তার সবগুলোই তিনি কাজে লাগিয়েছেন। ইমামের মক্কা থেকে কারবালা পর্যন্ত এবং কারবালায় প্রবেশ করার পর থেকে শাহাদাত বরণ পর্যন্ত তার ভাষণসমূহ অসাধারণ অনুপ্রেরণাদায়ক,আবেগময় এবং অসাধারণ সৌন্দর্যময় আর সাবলীল ও বিশুদ্ধ ভাষা সমৃদ্ধ । এদিক থেকে কেবলমাত্র যে ব্যক্তি আমিরুল মুমিনীন আলী (আঃ) এর প্রতিদ্বন্দী তিনি হলেন ইমাম হোসাইন (আঃ)। এমনকি কেউ কেউ বলে থাকেন যে আশুরার দিনের ইমাম হোসাইন (আঃ) এর ভাষণসমুহ আমিরুল মুমিনীনের ভাষণসমূহের চেয়েও ঊৎকৃষ্টতর। তিনি যখন মক্কা ছেড়ে বের হয়ে আসতে চাইলেন তখন লক্ষ্য করুন কি উৎকৃষ্ট ভাষা আর কি সুন্দর ও বিশুদ্ধ বাচনের মাধ্যমে তিনি স্বীয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে তুলে ধরলেন।
মানুষকে আরবী ভাষা শিখতে হবে;তবেই কেবল পবিত্র কোরআন,রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর বাণীমালায়,মাসুম ইমামগণের ভাষণে এবং খোতবা আর দোয়া-কালামের মধ্যে নিহিত এই অপরূপ সৌন্দর্যকে অবলোকন করতে পারবে। ইমামের এসব ভাষণগুলো অনুবাদ করলে যথার্থ রূপে অর্থ প্রকাশ করে না। তিনি বলছেনঃ মৃত্যু হলো মানুষের গলায় অলঙ্কারের ন্যায়। একজন মানুষের জন্যে মৃত্যু ততখানি সৌন্দর্যময় যেমনটা সৌন্দর্য ফুটে ওঠে যুবতীর গলায় অলঙ্কার পরিধান করলে। হে লোক সকল! আমি সবকিছুর মায়া ত্যাগ করেছি,আমি আত্মত্যাগের নেশায় মত্ত ,আমি আমার পূর্বসূরীদের সাক্ষাতে ততটাই আসক্ত যতটা আসক্ত ছিলেন নবী ইয়াকুব তার ইউসুফকে সাক্ষাতের জন্য । অতঃপর তিনি যে তার ভবিষ্যত সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন এবং কেউ যেন মনে না করে যে তিনি দুনিয়ার বাহ্যিক বিজয় লাভ করার আশায় চলেছেন,না বরং তিনি ভবিষ্যতকে সচক্ষে দেখতে পাচ্ছিলেন যে ঐ মরু মাঝে কিভাবে মানুষরূপী নেকড়েগুলো সারি বেধেছ এবং কিভাবে তাকে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলছে,এ বিষয়টি জানিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে তিনি বলেনঃ
رِضَي اللهِ، رِضَانَا اَهْلُ الْبَيْتِ
অর্থাৎ,আমরা আহলে বাইত আল্লাহ যেটাতে সন্তুষ্ট হন তাতেই সন্তুষ্ট থাকি।(
বিহারুল আনোয়ার
,
খণ্ড 44
,
পৃষ্ঠা 367
;
মাকতালু মুকাররাম
,
পৃষ্ঠা 193
,
আল লুহুফ
,
পৃষ্ঠা 25
,
কাশফুল গুম্মাহ
,
খণ্ড 2
,
পৃষ্ঠা 29
)
এটা হলো সেই রাস্তা যা আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং তিনি পছন্দ করেছেন। সুতরাং আমরা এ পথকেই বেছে নেব। আল্লাহর সন্তুষ্টিই আমাদের সন্তুষ্টি । কেবলমাত্র তিন চার লাইনের বেশী নয়। কিন্তু একটি বইয়ের চেয়েও বেশী প্রভাব ফেলে। শেষ মুহুর্তে তিনি মানুষের কাছে ইবলাগ করতে (তথা পৌছে দিতে) চান যে আমি কি বলতে চাই আর তোমাদের কাছ থেকে কি প্রত্যাশা করি। তাই তিনি বলেনঃ যে ব্যক্তি বুকের রক্তকে আমাদের পথে উৎসর্গ করতে তৈরী আছে এবং স্বীয় প্রতিপালকের সাক্ষাত লাভ করার সংকল্প রাখে সে যেন প্রস্তুত থাকে। আগামীকাল সকালে আমরা রওনা হব। আশুরার রাতে পবিত্র তেলাওয়াতের মুগ্ধকর সুর শুনতে পাই,মৌমাছির গুঞ্জরণের মতো দোয়া মোনাজাতের গুনগুনানী ভেসে আসে যা শত্রুর অন্তরকেও বিমোহিত করে দেয় এবং তাদেরকে নিজের প্রতি আকর্ষণ করে। যে সাহাবীদল মদীনা থেকে ইমামের সঙ্গে এসেছিলেন তাদের সংখ্যা খুবই কম ছিল। হয়তো কুড়ি জন হতে পারে। কেননা একদল তো পথিমধ্যে আলাদা হয়ে চলে যায়। বাহাত্তর জন শহীদের অনেকেই কারবালায় এসে যোগদান করেছিলেন। অনেকে আবার ইবনে সা’
দের দল থেকে পৃথক হয়ে ইমামের বাহিনীতে যোগ দেয়। এদের মধ্যে একদল হলো তারা,যারা আশুরার রাতে এসব খিমার পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় তাদের কানে ভেসে আসছিল মিষ্টি মধুর গুঞ্জরণের ধ্বনি,কোরআনের তেলাওয়াত,সিজদা আর রুকুর যিকির, সুরা হামদ। এই ধ্বনিই তাদেরকে আকৃষ্ট করে এবং তাদেরকে টেনে নিয়ে যায়। অর্থাৎ ইমাম হোসাইন (আঃ) ও তার সাহাবীবগ যে প্রকার মাধ্যমকেই অধিকতর কাজে লাগোনো সম্ভব ছিল তার সবগুলোকেই কাজে লাগিয়েছেন। অন্যান্য মাধ্যম ও উপকরণের কথায়ও যাব। স্বয়ং দৃশ্যগুলোকেও ইমাম এমনভাবে বিন্যস্ত করেন যে মনে হবে যেন কোনো ঐতিহাসিক দৃশ্যকে মঞ্চস্থ করার উদ্দেশ্যেই এভাবে সাজিয়েছেন যাতে কিয়ামত অবধি এক শিহরণ জাগানো দৃশ্য হিসাবে ইতিহাসে অক্ষয় থেকে যায়।
ইতিহাসে লেখা রয়েছে যে,যতক্ষণ পর্যন্ত সাহাবীরা বেঁচে ছিলেন,এমনকি তাদের একজন অবশিষ্ট থাকা পর্যন্ত ও আহলে বাইতের তথা ইমাম হোসাইন (আঃ) এর সন্তানবর্গ,ভাই-ভাতিজা প্রমুখের কোনো একজনকেও ময়দানে যেত দেননি। তাদের কথা ছিল,হে ইমাম! আমাদের দায়িত্বকে আগে পালন করার সুযোগ দিন। তারপর আমরা যখন থাকবো না তখন আপনি যেটা ভালো মনে করেন সেটাই করবেন। অপরদিকে নবী (সাঃ) এর আহলে বাইতও অপেক্ষায় ছিলেন কখন তাদের পালা আসবে। ইমামের সাহাবীদের মধ্যে সর্বশেষ ব্যক্তি যখন শহীদ হন তখন নবী পরিবারের যুবকদের মধ্যে সহসা উলুধ্বণি পড়ে গেল। সবাই স্ব স্ব জায়গা ছেড়ে উঠে পড়লেন। লেখা রয়েছে যেঃ
فَجَعَلَ يُودَعُ بَعْضَهُمْ بَعْضاً
অর্থাৎ তারা পরস্পরকে বিদায় জানাচ্ছিলেন,এক অপরের গলায় হাত রেখে পরস্পরের মুখে চুম্বন করছিলেন।
আহলে বাইতের যুবকদের মধ্যে সর্ব প্রথম যিনি ইমামের নিকট থেকে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি লাভ করেন তিনি হলেন তার যুবক পুত্র হযরত আলী আকবার। যার ব্যাপারে স্বয়ং ইমাম হোসাইন (আঃ) সাক্ষ্যদান করেছেন যে দেহের গড়ণ,চেহারা-চিরত্র আর চলায় বলায় আলী আকবার ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর অধিকতর সদৃশ। তিনি যখন কথা বলতেন মনে হতো যেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কথা বলছেন। এত বেশী মিল ছিল যে ইমাম হোসাইন (আঃ) নিজে বলেন,হে আল্লাহ! তুমিই ভালো জানো যে যখন আমরা নবীজীকে দেখার জন্যে উদগ্রীব হয়ে পড়তাম তখন এই যুবকের দিকে তাকাতাম। সে ছিল রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর পূর্ণ প্রতিচ্ছবির দর্পণ। এবার সেই যুবকই এলেন পিতার সম্মুখে।
বললেন,বাবা! আমাকে অনুমতি দিন। অনেক সাহাবী বিশেষ করে যুবকদের সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে তারা যখন অনুমতি গ্রহণের উদ্দেশ্যে ইমামের কাছে উপস্থিত হচ্ছিলেন তখন ইমাম কোনো না কোনো ভাবে তাকে নিঃরত করার জন্য ব্যাখ্যা তুলে ধরছিলেন। যেমন হযরত কাসিমের কাহিনী যা সকলের জানা রয়েছে। কিন্তু যখন হযরত আলী আকবার উপস্থিত হলেন তখন তিনি শুধুই কেবল স্বীয় মাথাকে নীচু করলেন। যুবক পুত্র ময়দানে রওনা হয়ে যায়। বর্ণিত রয়েছে যে ইমামের চক্ষুদ্বয় যখন অর্ধ নির্মিলিত অবস্থায় ছিলঃ
ثُمَّ نَظَرَ اِلَيْهِ نَظَرَ آئِسٍ
অর্থাৎ তিনি তার দিকে তাকালেন এমন ভঙ্গিতে যেভাবে একজন নিঃরাশ ব্যক্তি তার যুবক পুত্রের দিকে তাকায়।(
আল
-
লুহুফ
,
পৃষ্ঠা 47
)
ইমাম নিঃরাশার সাথে তার যুবক পুত্রের দিকে তাকালেন,কয়েক ধাপ তার পিছে পিছেও এগিয়ে গেলেন। আর ঠিক এই সময়ে তিনি বলে ওঠেনঃ হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থেকো যে এমন এক যুবক আজ এদের বিরুদ্ধে রওনা হয়েছে যে ছিল তোমার নবীর চেহারার সাথে সবচেয়ে বেশি সদৃশ । অতঃপর তিনি ওমর ইবনে সা’
দকেও একটি কথা বলেন। উচ্চঃস্বরে চিৎকার করে বললেন যেন ইবনে সা’
দ বুঝতে পারে। বললেনঃ
يَابْنَ سَعْدٍ قَطَعَ اللهُ رَحِمَكَ
অর্থাৎ,হে ইবনে সা’
দ! আল্লাহ যেন তোমার বংশকে নির্বংশ করে যেমনভাবে আমার এই সন্তান থেকে আমাকে নির্বংশ করলে।(
আল
-
লুহুফ
,
পৃষ্ঠা 47
,
মাকতালু আলী আকবার
-
মুকাররাম
,
পৃষ্ঠা 76
,
মাকতালুল হোসাইন
-
মুকাররাম
,
পৃষ্ঠা 321
,
মাকতালুল হোসাইন
-
খরাযমী
,
খণ্ড 2
,
পৃষ্ঠা 30
,
বিহারুল আনোয়ার
,
খণ্ড 45
,
পৃষ্ঠা 43
)
ইমাম হোসাইন (আঃ) এর এই বদ্দোয়ার পর দুই তিন বছরের বেশী দেরী হয়নি,এর মধ্যেই মোখতার,ওমর ইবনে সা’
দকে হত্যা করেন। এমন সময়ে যখন ওমর ইবনে সা’
দের পুত্র মোখতারের দরবারে এসেছিল তার পিতার জন্য সুপারিশ করতে। ওমর ইবনে সা’
দের মস্তককে একটি কাপড়ে ঢেকে সভায় আনা হয় এবং মোখতারের সামনে রাখা হয়। তখনই তার পুত্র এসেছিল পিতার জন্য সুপারিশ করতে। একসময় বলা হলো যে মস্তকটি এখানে রাখা আছে সেটাকে তুমি কি চেন? যখন কাপড় সরিয়ে ফেলা হলো দেখতে পেল যে তারই বাবার মাথা। মনের অজান্তেই কখন সে সেখান থেকে উঠে চলে যেতে লাগলো। সাথে সাথে মোখতার নির্দেশ দিলেন,ওকেও ওর বাবর সাথে যুক্ত করে দাও।
এভাবেই হযরত আলী আকবার ময়দানে যাত্রা করেন। ঐতিহাসিকগণ সকলে ঐক্যমত পোষণ করেন যে হযরত আলী আকবার অতুলনীয় সাহসিকতা আর বীরত্বের সাথে লড়াই চালিয়ে যান। কিছু যুদ্ধ করার পর তিনি ফিরে আসনে তার মহান পিতার নিকটে যা ইতিহাসে একটি চিরন্তন ধাঁ ধাঁ হয়েই থাকবে যে কি কারণে তিনি ফিরে এসেছিলেন এবং তার উদ্দেশ্যকি ছিল? এসে বললেন,বাব! বড়ই পিপাসা। পিপাসা আমাকে শেষ করে দিচ্ছে । এই অস্ত্রের ভারও আমাকে পরিশ্রান্ত করে ফেলেছে। এক কাতরা পানি যদি আমার গলায় স্পর্শ করে তাহলে আমি শক্তি সঞ্চার করে পুনরায় আক্রমণ চালাতে পারবো। এই কথাগুলো ইমামের কলিজায় আগুন ধরিয়ে দেয়। তিনি বলেন, পুত্র আমার! দেখ,আমার মুখ তোমার মুখের চাইেতও শুস্ক । তবে আমি তোমাকে ওয়াদা দিলাম যে শীঘ্রই তুমি তোমার নানা নবীর হাতে পানি পান করবে। এই যুবক আবারো চলেন ময়দানে এবং লড়াই চালিয়ে যান।
হামিদ ইবনে মুসলিম নাম্মী জৈনক ব্যক্তি ছিল হাদীসের রেওয়ায়েতকারী। কারবালার ময়দানে সে উপস্থিত ছিল একজন সংবাদদাতার মতো। অবশ্য যুদ্ধে সে অংশগ্রহণ করেনি। তবে বেশিরভাগ ঘটনাবলীকে সে বর্ণনা করেছে। তার বর্ণনায় এসেছ যে,আমি এক ব্যক্তির পাশে ছিলাম। যখন আলী আকবার আক্রমণ করছিলেন তখন সবাই পালিয়ে যাচ্ছিল। এ দেখে লোকটি অসন্তুষ্ট হলো কারণ সে নিজেও একজন বীর। শপথ করে বললো,যদি ঐ যুবক আমার নিকট দিয়ে অতিক্রম করে তাহলে আমি ওর পিতাকে পুত্র হারানোর শোক বেদনায় নিমজ্জিত করবই। আমি তাকে বললাম,তোমার এতে কি কাজ। ছেড়ে দাও,শেষ পর্যন্ত তো তাকে হত্যা করা হবেই। সে বললো,না। আলী আকবার যখন অগ্রসর হলেন তার পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় লোকটি গুপ্ত হামলার মতো বর্শা দ্বারা এমন সজোরে আঘাত করলো যে আলী আকবার নিশ্চল হয়ে পড়লেন। হাতদুটি ঘোড়ার গলায় জড়িয়ে ধরে নিজের ভারসাম্য রাখার প্রচেষ্টা করলেন। এমন সময় চিৎকার করে বলে উঠলেন,
يَا اَبَتَاه هَذَا جَدِّي رَسُولِ اللهِ
অর্থাৎ,হে বাবা! এখনই আমি নানা রসূলকে মনের চোখ দ্বারা দেখতে পাচ্ছি পানি পান করছি।(
বিহারুল আনোয়ার
,
খণ্ড 45
,
পৃষ্ঠা 44
,
মাকতালুল হোসাইন খরাজমী
,
খণ্ড 2
,
পৃষ্ঠা 31
)
ঘোড়া হযরত আলী আকবারকে এমনভাবে শত্রুদের মাঝে নিয়ে গেল (যেহেতু বাস্তবে ঐ ঘোড়ার আর কোনো সওয়ারী ছিল না) যে এখানে এসে অদ্ভুত একটি কথা লেখা রয়েছে :
فَاحْتَمَلَهُ الْفَرَسُ اِلَي عَسْكَرِ الْاَعْدَاءِ فَقَطَّعُوهُ بِسُيُوفِهِمْ اِرْباً ارْباً
অর্থাৎ,অতঃপর ঘোড়া তাকে বহন করে নিয়ে গেল শত্রু সেনার অভ্যন্তরে। আর তারা তাকে টুকরো টুকরো করে কেটে ছাড়ে।(
মাকতালুল হোসাইন
-
মুকাররাম
,
পৃষ্ঠা 324
,
মাকতালুল আওয়াসিম
,
পৃষ্ঠা 95
,
বিহারুল আনোয়ার খণ্ড 45
,
পৃষ্ঠা 44
,
মাকতালুল হোসাইন
-
খরাজমী
,
খণ্ড 2
,
পৃষ্ঠা 242
)