তাবলীগ (বা প্রচার) পদ্ধতি প্রসঙ্গে
হোসাইনী আন্দোলনের বিভিন্ন দিকের মধ্যে একটি দিক হচ্ছে এর তাবলীগ তথা প্রচারমূলক দিক। এখানে‘
তাবলীগ’
শব্দটি তার প্রকৃত তাৎপর্যে ব্যবহৃত হয়েছে,বর্তমান যুগে প্রচলিত অর্থে নয়। তাবলীগ বা প্রচার মানে জনগণের নিকট প্রচারকের নিজের বাণীকে পৌঁছে দেয়া এবং‘
ইসলাম প্রচার’
মানে স্বয়ং ইসলামকে পৌঁছে দেয়া। অন্যকথায়,মানুষের কাছে ইসলামের আহবান পৌঁছে দেয়া। এবার দেখা দরকার যে,হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) তার এ আন্দোলনে কোন বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন,বিশেষ করে যার তাবলীগি গুরুত্ব রয়েছে। অর্থাৎ এ দৃষ্টিকোণ থেকে তার যথেষ্ট প্রচারমূলক গুরুত্ব রয়েছে যে,হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) এ পদ্ধতির আশ্রয় নিয়ে স্বীয় লক্ষ্যকে এবং তার কন্ঠ থেকে ইসলামের যে প্রকৃত ফরিয়াদ বেরিয়ে আসছিলো তা সর্বোত্তমভাবে জনগণের নিকট পৌঁছে দেন।
এ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে প্রথমেই আজকের দিনে যাকে‘
পদ্ধতি’
(method) বা‘
কর্মপদ্ধতি’
বলা হয়-যা আসলে এক বিদেশী পরিভাষা,সে সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করা প্রয়োজন মনে করছি।
বস্তুতঃ যে কোনো কাজে সাফল্যের অন্যতম শর্ত হচ্ছে সঠিক কর্মপদ্ধতি নির্বাচন। উদাহরণস্বরূপ,আপনারা দেখতে পাচ্ছেন যে,চিকিৎসা বিজ্ঞান একটি বিশেষ ধরনের বিজ্ঞান,কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকগণ বা আস্ত্রোপাচারকারীগণ পরস্পর থেকে পৃথক বিভিন্ন পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করে থাকেন এবং তাদের কারো কারো অনুসৃত পদ্ধতি অন্যদের অনুসৃত পদ্ধতি থেকে অধিকতর সাফল্যের অধিকারী বলে প্রমাণিত হয়েছে।
আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রাচীন জ্ঞান-বিজ্ঞান এর সন্ধিকাল সম্পর্কিত এক আলোচনা বিদ্যমান রয়েছে। আমরা দেখতে পাই যে,কালের একটি অধ্যায়কে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগ নামে অভিহিত করা হয়। অবশ্য জ্ঞান বিজ্ঞানকে পুরনো বা প্রাচীন ও নতুন বা আধুনিক নামে অভিহিত করা চলে না,তবে একটি যুগকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন বা আধুনিক যুগ বলে নামকরণ করা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে ,জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রাচীন যুগের সাথে এর আধুনিক যুগের পার্থক্য কী? আধুনিক যুগে বিজ্ঞান অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ও অবিশ্বাস্য ভাবে উন্নতি করেছে। মনে হচ্ছে যেন সহসাই বিজ্ঞানের চাকার সামনে থেকে একটি বাধাকে অপসারণ করা হয়েছে এবং এর ফলে বিজ্ঞান অত্যন্ত দ্রুত গতিতে পথ চলতে শুরু করেছে,অথচ প্রাচীন কালে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার গতি ছিলো মন্থর। কিন্তু আধুনিক যুগে এরূপ দ্রুত গতির কারণ কী? তা কি এই যে,লুই পাস্তুর প্রমুখ আধুনিক যুগের বিজ্ঞানীগণ বোক্বরাত (বিখ্যাত গ্রীক চিকিৎসা বিজ্ঞানী),জালিনুস (বিখ্যাত গ্রীক চিকিৎসা বিজ্ঞানী),ও ইবনে সীনার ন্যায় প্রাচীন বিজ্ঞানীগণের তুলনায় অধিকতর প্রতিভার অধিকারী ছিলেন? অন্যকথায়,এর কারণ কি এই যে,আধুনিক বিশ্বে এমন সব অসাধারণ ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটেছে প্রাচীন কালে যে ধরনের ব্যক্তিত্ব ও চিন্তাবিদের আবির্ভাব ঘটে নি? না,মোটেই তা নয়। হয়তোবা আজকের দিনে এমন একজন লোকও পাওয়া যাবে না যে দাবী করবে যে,পাস্তুর বা অন্যান্য আধুনিক বিজ্ঞানীর প্রতিভা এরিষ্টোটল,প্লোটো,ইবনে সীনা,বোক্বরাত,জালিলুস বা খাজা নাসিরুদ্দীন তুসী’
র তুলনায় বেশী। তবে তা সত্বেও আধুনিক বিজ্ঞানীদের কাজের ও সাফল্যের গতি অনেক বেশী। এর রহস্য কী?
বলা হয়,এর রহস্য এই যে,বিজ্ঞানীদের কাজের পদ্ধতি সহসাই পরিবর্তিত হয়ে যায়। বিজ্ঞানীদের গবেষণার পদ্ধতি যখন পরিবর্তিত হয়ে গেলো তখন বিজ্ঞানের অগ্রগতির গতি বেড়ে গেলো। বস্তুতঃ কাজের পদ্ধতি সাফল্যের ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করে। এমনটাও হতে পারে যে,আপনি একজন অত্যন্ত প্রতিভাবান ও সুচতুর কর্মঠ ব্যক্তির হাতে একটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ দায়িত্ব ন্যস্ত করলেন। কিন্তু তিনি সে প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সাফল্যের অধিকারী হলেন না। অতঃপর একই প্রতিষ্ঠানে এমন এক ব্যক্তিকে তার স্থলে নিয়োগ করলেন যিনি স্মরণশক্তি ,সচেতনতা,প্রতিভা ও কোনো কিছু ভালোভাবে বুঝতে পারার ক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তির সমপর্যায়ের নন,কিন্তু এই শেষোক্ত ব্যক্তি অধিকতর উত্তমরূপে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করলেন। এর কারণ এই যে,তার কাজের পদ্ধতি অধিকতর উত্তম।
এ প্রসঙ্গে আমরা অধিকতর সুস্পষ্ট উদাহরণ দিতে পারি। আমরা এ ধরনের বহু লোককে দেখেছি যাদের সচেতনতা,মেধা-প্রতিভা ও স্মরণশক্তি অনেক বেশী। কিন্তু শেখার ক্ষেত্রে তাদের সাফল্যের মাত্রা কম। অথচ এমন অনেক লোক শেখার ক্ষেত্রে তাদের তুলনায় অধিকতর সাফল্যের অধিকারী যাদের সচেতনতা,স্মরণশক্তি ও কর্মক্ষমতা প্রথমোক্তদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত নিম্ন পর্যায়ের। এর কারণ কী? এর কারণ এই যে,এই দ্বিতীয়োক্ত ব্যক্তিদের কাজের পদ্ধতি অধিকতর উত্তম। উদাহরণস্বরূপ,একজন লোক প্রখর স্মরণশক্তির অধিকারী এবং তিনি দিনরাতে ষোল ঘন্টা পরিশ্রম করেন। কিন্তু তার কাজের ধরন কী? তিনি একটি গ্রন্থকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন এবং এরপর সাথে সাথেই তিনি আরেকটি গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন। অথচ এই প্রথম গ্রন্থটি এক বিষয়ের এবং দ্বিতীয় গ্রন্থটি ভিন্ন এক বিষয়ের। এরপর তিনি অন্য একটি গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন এবং পরে অন্য একটি বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করেন। তিনি এভাবে এলোমেলো ও বিশৃঙ্খলভাবে এগিয়ে চলেন। অন্য দিকে এক ব্যক্তি হয়তো আট ঘন্টার বেশী পড়াশুনা করেন না। কিন্তু তিনি যখন কোনো গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন তখন অত্যন্ত মনোযোগের সাথে অধ্যয়ন করেন;তাড়াহুড়া করে না। দ্বিতীয়তঃ তিনি কোনো পঠণীয় বিষয়কে একবার পড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেন না। তিনি আরো একবার গ্রন্থটিকে অধ্যয়ন করেন। তিনি যে গ্রন্থটি অধ্যয়ন করেছেন তার বিষয়বস্তু তার মস্তিস্কে প্রবেশ না করা পর্যন্তি তিন অন্য কোনো গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন না। তিনি অবশ্য এখানেই থেমে থাকেন না,বরং তিনি এ গ্রন্থে যে সব বিষয় অধ্যয়ন করেছেন তার মধ্যে যে সব বিষয়কে তিনি খুব ভালো জিনিস বলে দেখতে পেয়েছেন ও প্রয়োজনীয় বলে মনে করেছেন সেগুলোকে কাগজের বুকে সুবিন্যস্তভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। অর্থাৎ তিনি তার অর্জিত জ্ঞানকে লিখিত আকারে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন যার ফলে সারা জীবনে তিনি যখনই প্রয়োজন মনে করবেন তখনই তাতে চোখ বুলালে বিষয়গুলো তার পুরোপুরি স্মরণ হবে। এভাবে তিনি একটি গ্রন্থের অধ্যয়ন ও তা থেকে নোট করার কাজ সমাপ্ত করার পর একই বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট আরো বিভিন্ন গ্রন্থ একই নিয়মে অধ্যয়ন করেন। এভাবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কিছু দিন অধ্যয়ন করার পর তিনি এ বিষয়ে অধিকতর অধ্যয়নের প্রয়োজনীয়তা থেকে মুখাপেক্ষিতাহীন হয়ে যান। এরপর তিনি অন্য একটি বিষয়ের ওপরে গ্রন্থাবলী অধ্যয়নের কাজ শুরু করেন।
এর বিপরীতে যে ব্যক্তি আজ এ গ্রন্থ ,কাল ঐ গ্রন্থ ও পরশু অপর একটি বিষয়ের অধ্যয়ন করেন তিনি হচ্ছেন ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে ব্যক্তি খাবার খেতে এসে এখান থেকে এক লোকমা,ওখান থেকে এক লোকমা,অন্য এক ধরনের খাবার থেকে চার লোকমা,চতুর্থ এক ধরনের খাবার থেকে পাঁচ লোকমা ভক্ষণ করে। এভাবে সে তার পাকস্থলীকে ধ্বংসঠিকরে ফেলে। এতে তার কোনো ফায়দাই হয় না। বস্তুতঃ এ বিষয়টি কর্মপদ্ধতির সাথে সংশ্লিষ্ট ।
এভাবেই সঠিক ও প্রকৃত অর্থে তাবলীগ মানে জনগণের নিকট কোনো বাণী পৌঁছে দেয়া ও তাদেরকে বিষয়টির সাথে পরিচিত করে তোলা। তাদেরকে বাণীটির ব্যাপারে ওয়াকেফহাল করা,এতে বিশ্বাসী করে তোলা,তাদের মধ্যে এর প্রতি আগ্রহ তৈরী করা ও এর প্রতি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। কোনো বাণী মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করা প্রয়োজন। কারণ,কেবল সঠিক পন্থার অনুসরণ করা হলেই একটি বাণীর প্রচার সফল হওয়া সম্ভব। সঠিক পদ্ধতির বিপরীত পদ্ধতি অনুসরণ করা হলে যে ইতিবাচক ফল পাওয়া থেকে বঞ্চিত হতে হবে শুধু তা-ই নয়,বরং তার বিপরীত ফল পাওয়া যাবে। মানুষ যখন কোনো বিষয়ের প্রতি গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করে ও তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করে এবং এরপর এ বিষয় সম্পর্কিত কোরআন মজীদের আয়াতের সন্ধান করে এবং এতদসংশ্লিষ্ট আয়াত নিয়ে চিন্তাগবেষণা করে তখন সে দেখতে পায় যে,কোরআন মজীদের আয়াত থেকে এ সংক্রান্ত কী কী বিষয় ( POINTS) পাওয়া যেতে পারে। প্রতিটি বিষয়ের ক্ষেত্রেই এ পদ্ধতি প্রযোজ্য ,যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তাবলীগ বা প্রচার।
পদ্ধতির ক্ষেত্রে কোরআন মজীদ যে সব বিষয়ের ওপর গুরুত্ব প্রদান করেছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছেاَلْبَلَاغُ الْمُبِينُ
(আল-বালাগুল মুবীন ) কথাটির ব্যবহার। অর্থাৎ অত্যন্ত সুক্ষ্ণ ভাবে ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বক্তব্যকে পৌঁছে দিতে হবে। এ পরিভাষায় যে সুস্পষ্টভাবে পৌঁছে দেয়ার কথা বলা হয়েছে তার দ্বারা কী বুঝানো হয়েছে? এর লক্ষ্য হচ্ছে বাঞ্চিতভাবে,সহজ-সরলভাবে ও দুর্বোধ্যতা ছাড়াই বাণীটিকে পৌঁছে দিতে হবে যাতে শ্রোতা খুব সহজেই তা বুঝতে পারে।
কঠিন,জটিল ও দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলা,অনেক বেশী পরিভাষা ব্যবহার করা এবং এমন সব বাক্য ব্যবহার করা যা বুঝার জন্য বছরের পর বছর পড়াশুনা করতে হবে-এটা হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর প্রচার পদ্ধতিতে ছিলো না। তিনি এমনই সহজ-সরল ও সুস্পষ্টভাবে তার বক্তব্য তুলে ধরতেন যে,তা বড় বড় পণ্ডিত ও মনীষীগণ যেমন বুঝতে পারতেন তেমনি নিরক্ষর লোকেরাও‘
তাদের অনুধাবন ক্ষমতা অনুযায়ী’
তা সঠিকভাবেই বুঝতে পারতো। (এটা বলছি না যে,সকলে একই মাত্রায় বুঝতে পারতো।)
যে মুবাল্লিগ বা দীন প্রচারক নবী-রাসূলগণের (আঃ) ভাষায় কথা বলতে চান এবং তাদের পথে পথ চলতে চান তার প্রচার অবশ্যই‘
বালাগুল মুবীন’
হতে হবে। এ হচ্ছে‘
মুবীন’
-এর তাৎপর্যের একটি দিক। তবে এখানে আরো কয়েকটি সম্ভাবনাও রয়েছে। (আর সম্ভবতঃ এ সম্ভাবনাগুলোর সবগুলোই সঠিক।) এ সম্ভাবনাগুলোর অন্যতম হচ্ছে‘
মুবীন’
মানে কোনোরূপ রাখঢাক না করে কথা বলা। অর্থাৎ নবী-রাসূলগণ (আঃ) কঠিন ও জটিল ভাষায় কথা বলতেন না শুধু তা-ই নয়,বরং লোকদের সাথে খোলাখুলি কথা বলতেন ও কোনোরূপ রাখঢাক না করে তাদের কাছে স্বীয় বক্তব্য উপস্থাপন করতেন। তারা আকারে-ইঙ্গিতে কথা বলতেন না। তারা যদি মনে করতেন যে,কোনো বিষয়ে মানুষের সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন তাহলে অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায়ই তা তুলে ধরতেন। যেমন,তারা বলতেনঃ–
)
اَ تَعْبُدُونَ مَا تَنْحِتُونَ(
‘‘
তোমরা কি সেই জিনিসের উপাসনা করছো যাকে নিজেরাই তৈরী করেছো?’’
(সূরা আস-সাফ্ফাতঃ 95)
প্রচারের ক্ষেত্রে কোরআন মজীদ দ্বিতীয় যে বিষয়টির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে কোরআনের নিজের ভাষায় তা হচ্ছেنُصْح
(নুছহ)। আমরা সাধারণতঃ‘
নুছহ’
কে‘
কল্যাণ কামনা’
অর্থে অনুবাদ করি। অবশ্য এ অর্থটাও সঠিক। কিন্তু দৃশ্যতঃ‘
কল্যাণ কামনা’
‘
নুছহ’
-এর আক্ষরিক অর্থ নয়,বরং‘
নুছহ’
শব্দের অর্থটির আবশ্যিক অনুষঙ্গ । দৃশ্যতঃنُصْح
(নুছহ) শব্দটিغَشّ
(গ্বাশ) শব্দের বিপরীত অর্থ প্রকাশ করে। উদাহরণ স্বরূপ ধরুন, আপনি কারো কাছে দুধ বিক্রি করতে চান। হয়তো আপনি তাকে খাঁটি দুধ সরবরাহ করবেন। অথবা,খোদা না করুন,পানি মেশানো দুধ সরবরাহ করবেন। অথবা আপনি কাউকে একটি স্বর্ণমুদ্রা দিতে চান;এ ক্ষেত্রে হয়তো আপনি তাকে খাঁটি স্বর্ণের মুদ্রা দেবেন (যাতে খাদের পরিমাণ সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্র মাত্রায় থাকে)। অথবা,খোদা না করুন,হয়তো অনেক বেশী খাদ মেশানো (গ্বাশ্যুক্ত ) স্বর্ণের মুদ্রা দেবেন।‘
নুছহ’
হচ্ছে ঠিক এর বিপরীত। সেই ব্যক্তিই প্রকৃত‘
নাছেহ’
(নুছহকারী) যে পরিপূর্ণ আন্তরিকতার অধিকারী।‘
তাওবাতুন নাছুহ’
মানে খালেছ তওবা। মুবাল্লিগ ( প্রচারক) কে নাছেহ,খালেছ ও মোখেলছ (একনিষ্ঠতা ও আন্তরিকতার অধিকারী) হতে হবে। অর্থাৎ তিনি যখন দীনের দাওয়াত দেবেন তখন তার অন্তরে শ্রোতার কল্যাণ কামনা ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্যই থাকবে না।
আল্লাহর দ্বীনের প্রচারের ক্ষেত্রে উদ্দেশ্যের সততার পাশাপাশি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে একনিষ্ঠতা ও আন্তরিকতা। বলা হয়েছেঃ
اَلنَّاسُ کُلُّهُمْ هَالِکُونَ اِلَّا الْعَالِمُونَ وَ الْعَالِمُونَ هَالِکُونَ اِلَّا الْعَامِلوُنَ وَالْعَامِلُونَ هَالِکُونَ اِلَّا الْمُخْلِصُونَ وَالْمُخْلِصُونَ عَلَی خَطَرٍ عَظِيمٍ.
‘‘
সকল মানুষই ধ্বংসের কবলে নিক্ষিপ্ত একমাত্র আলেমগণ ছাড়া,আলমদের সকলেই ধ্বংসের কবলে নিক্ষিপ্ত একমাত্র আমলকারীগণ ছাড়া,আমলকারীদের সকলেই ধ্বংসের কবলে নিক্ষিপ্ত একমাত্র মোখলেছ (একনিষ্ঠ) গণ ছাড়া,আর মোখলেছগণ বিরাট ঝুকির মধ্যে রয়েছে।’’
বর্ণিত হয়েছে যে,মরহুম আয়াতুল্লাহ বুরুজার্দী (আল্লাহ তার মকামকে উচ্চতর করুন) যখন শেষবারের মতো অসুস্থ হয়ে পড়েন (যার দু’
একিদন পরে তিনি ইন্তেকাল করেন) তখন যারা তার কাছে ছিলেন তাদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি বললেনঃ‘‘
আপনার নিজের স্মরণের জন্য এবং অন্যদের নিছহতের জন্য কিছু বলুন।’’
জবাবে তিনি বললেনঃ‘‘
জনাব,গেলাম কিন্তু কিছুই করলাম না,আর স্তুপীকৃত করলাম কিন্তু আল্লাহর কাছে জমা করি নি।’’
উপস্থিত ব্যক্তিদের একজন মনে করলেন যে,তিনি এটা বিনয় বশতঃ বলছেন,তাই তিনি বললেনঃ‘‘
হুজুর,আপনি এ কথা কেন বলছেন?’’
তারপর তিনি বলতে লাগলেন যে,আল–
হামদুলিল্লাহ আপনি এই করেছেন,সেই করেছেন,মসিজদ তৈরী করেছেন,মাদ্রাসা তৈরী করেছেন,দ্বীনী জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছেন ইত্যাদি। তিনি একথা বললে আয়াতুল্লাহ বুরুজার্দী উপস্থিত সকলের দিকে ফিরে নিম্নোক্ত হাদীছটি পাঠ করলেন এবং নীরব হলেনঃ
خَلِّصِ الْعَمَلَ فَاِنَّ النَّاقِدَ بَصِيرٌ بَصِيرٌ
‘‘
তোমার আমলকে নির্ভেজাল করো, কারণ সমালোচক সেই রকেমর অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী ঠিক যেমনটি হওয়া উচিৎ।’’
(
মাওয়ায়িযুল আদিদাহ
,
পৃষ্ঠাঃ 124
)
বস্তুতঃ ইখলাছ (একনিষ্ঠতা ও আন্তরিকতা) কোনো ছোটখাটো বিষয় নয়। এ কারণেই কোরআন মজীদে দৃশ্যতঃ সকল নবী-রাসূলের (আঃ) জবানীতেই বলা হয়েছেঃ
)
مَا اَسْئَلُکُمْ عَلَيْهِ مِنْ اَجْرٍ(
‘‘
আমি এর ( দ্বীনের দাওয়াতের) জন্য তোমাদের নিকট থেকে কোনোরূপ পারিশ্রমিক চাই না।’’
(সূরা সোয়াদঃ 86) অর্থাৎ যেহেতু আমি তোমাদের কল্যাণকামী সেহেতু এ কারণেই তোমাদের নিকট দ্বীনের প্রচার করছি। বস্তুতঃ নাছেহ বা কল্যাণকামীর জন্য পরিপূর্ণ আন্তরিকতা ও একনিষ্ঠতা (ইখলাছ) থাকা অপরিহার্য।
অন্য একটি বিষয় হচ্ছে মোতাকাল্লেফ (مُتَکَلِّفْ
) না হওয়া।تَکَلُّفْ
(তাকাল্লুফ ) শব্দটি (যা থেকেمُتَکَلِّفْ
শব্দটি নিস্পন্ন হয়েছে) বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষেتَکَلُّفْ
-এর অর্থ নিজের সাথে বাঁধা বা জড়িত করা। অর্থাৎ মানুষ যখন কোনো কিছুকে জোর করে নিজের সাথে বাঁধে তখন সে কাজকেتَکَلُّفْ
বলা হয়। এটা কথা বা বক্তব্য সম্পর্কেও ব্যবহার করা হয়। কোনো লোক যখন সহজ-সরল ও গতিশীল তথা প্রাঞ্জল ভাষায় কথা বলার পরিবর্তে কঠিন কঠিন ও দুর্বোধ্য শব্দাবলী ব্যবহার করে তখন তাকে মোতাকাল্লেফ বলা হয়।
হাদীছে আছে,এক ব্যক্তি হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর সামনে কথা বলতে গিয়ে কঠিন কঠিন ও দুর্বোধ্য শব্দাবলী ব্যবহার করছিলো। তখন রাসূলে আকরাম (সাঃ) বললেনঃ
اَنَا وَ اَتْقِيَاءُ اُمَّتِی بُرَآءٌ مِنَ التَّکَلُّفِ
‘‘
আমি ও আমার উম্মাতের মধ্যকার মুত্তাকী লোকেরা তাকাল্লুফ থেকে মুক্ত ।’’
মূলতঃ তাকাল্লুফ ও ফাছাহাত (فَصَاحَتْ
-প্রঞ্জলতা) সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। প্রকৃতপক্ষে ফাছাহাত মানেই হচ্ছে ভাষার গতিশীলতা-যার দাবী হচ্ছে এই যে,তা কঠিনতা,দুর্বোধ্যতা ও জড়তা থেকে মুক্ত হবে। দ্বীন প্রচার সম্পর্কে কোরআন মজীদে নবী-রাসূলগণ (আঃ)-এর জবানীতে এরশাদ হয়েছেঃ
)
مَا اَنَا مِنَ الْمُتَکَلِّفِينَ(
‘‘
আমি মোতাকাল্লেফদের (যারা কথার ফুলঝুরি ছুটায়) অন্তর্ভুক্ত নই।’’
(সূরা সোয়াদঃ 86)
মুফাসসিরগণের ভাষ্য অনুযায়ী,এ বাকে বাহ্যতঃ এটা বলতে চাওয়া হয় নি যে,আমি কথা বলার ক্ষেত্রে মোতাকাল্লেফ নই। বরং এ কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে,আমি যা বলছি তার ব্যাপারে মোতাকাল্লেফ নই অর্থাৎ আমি এমন নই যে,যে বিষয়ে জানি না জোর করে সে বিষয়ে জানার ভান করে কথা বলবো। আমার কাছে সুস্পষ্ট নয় এমন কোনো বিষয়ে মানুষের সামনে কথা বলছি না।
উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীর-গ্রন্থ‘‘
মাজমা‘
উল বায়ান’’
-এ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘
উদ থেকে বর্ণিত হয়েছে,তিনি বলেনঃ
اَيُّهَا النَّاسُ مَنْ عَلِمَ شَيْئاً فَلْيَقُلْ وَ مَنْ لَمْ يَعْلَمْ فَلْيَقُلِ اللهُ اَعْلَمُ فَاِنَّ مِنَ الْعِلْمِ اَنْ يَقُولَ لِمَا لَا يَعْلَمُ اللهُ اَعْلَمُ.
‘‘
হে লোক সকল! যে ব্যক্তি যা জানে সে যেন তা বলে,আর যা জানে না সে ব্যাপারে যেন বলেঃ আল্লাহই অধিকতর অবগত। নিঃসন্দেহে এ-ও জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত,যে বিষয়ে জানে না সে বিষয়ে বলবে যে,আল্লাহই অধিকতর অবগত।’’
অতঃপর তিনি এ আয়াত পাঠ করেনঃ
)
قُلْ مَا اَسْئَلُکُمْ عَلَيْهِ مِنْ اَجْرٍ وَ مَا اَنَا مِنَ الْمُتَکَلِّفِينَ(
‘‘
(হে রাসূল!) বলুন,আমি এর ( দ্বীনের দাওয়াতের) জন্য তোমাদের নিকট থেকে কোনোরূপ পারিশ্রমিক চাই না। আর আমি মোতাকাল্লেফদের (যারা কথার ফুলঝুরি ছুটায়) অন্তর্ভুক্ত নই।’’
(
মাজমাউল বাইয়্যান
,
খণ্ড 8
,
পৃষ্ঠা 486
)
এ থেকে সুস্পষ্ট যে,হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর অন্যতম শীর্ষস্থানীয় সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘
উদ مَا اَسْئَلُکُمْ عَلَيْهِ مِنْ اَجْرٍ
থেকে এ অর্থ গ্রহণ করেন যে,যা জানেন তা লোকেদেরকে বলবেন এবং যা জানেন না তা বলবেন না। বরং বলবেন যে,এ বিষয়ে জানি না।
বিখ্যাত সুবক্তা ইবনে জওযী একবার তিন ধাপ বিশিষ্ট একটি মিম্বারে বসা ছিলেন। এ সময় একজন মহিলা এসে তাকে একটি বিষয়ে প্রশ্ন করলেন। ইবনে জওযী জবাবে বললেনঃ‘‘
আমি জানি না।’’
মহিলা বললেনঃ‘‘
তুমি যখন জানো না তখন তিন ধাপ উপরে উঠেছো কেন?’’
জবাবে তিনি বললেনঃ‘‘
এই তিন ধাপ উপরে উঠেছি সেই সব বিষয়ে বলার জন্য যেগুলো আমি জানি কিন্তু আপনি জানেন না। আর যে সব বিষয়ে আমি জানি না সেগুলোর জন্য যদি মিম্বার তৈরী করা হতো তাহলে তা চাঁদ পর্যন্ত পৌঁছে যেতো।’’
শেখ আনছারী ছিলেন শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরামের অন্যতম। তিনি একদিকে যেমন ফিকাহ ও উছুলের ক্ষেত্রে প্রকৃতই একজন মোহাক্কেক (গবেষক) ও প্রথম শ্রেণীর আলেম ছিলেন,তেমনি ছিলেন তাকওয়ার অধিকারী। এ কারণে অনেকে তার সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে কিছুটা অতিশয়োক্তি করে ফেলতেন। যেমন,বলা হতোঃ হুজুরের কাছে যা কিছুই জিজ্ঞেস করো না কেন,তা-ই তার জানা আছে;এটা অসম্ভব যে,কোনো বিষয়ে তিনি জানবেন না। (তিনি ছিলেন শুশ্তারের অধিবাসী। কথিত আছে যে,তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত খুযেস্থানের আঞ্চলিক উচ্চারণে কথা বলতেন।) তাকে যে সব শারয়ী বিষয়ে প্রশ্ন করা হতো তিনি মুজতাহিদ হওয়া সত্বেও কোনো কোনো সময় তার কোনো বিষয় তার মনে থাকতো না। যখনই কোনো প্রশ্নের উত্তর তার মনে না থাকতো তখন তিনি অত্যন্ত জোরে বলতেনঃ‘‘
জানি না।’’
এর উদ্দেশ্য ছিলো এই যে,শ্রোতাগণ ও তার শিষ্যগণ যাতে বুঝতে পারেন যে,কোনো বিষয়ে জানা না থাকলে তা স্বীকার করার মধ্যে লজ্জার কোনো কারণ নেই। অন্য দিকে তাকে যে বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হতো সে সম্পর্কে জানা থাকলে তিনি আস্তে জবাব দিতেন এবং তার কন্ঠস্বর কেবল ততটুকু উচু হতো যাতে প্রশ্নকর্তা বুঝতে পারে। কিন্তু জানা না থাকলে জোরে জোরে বলতেনঃ‘‘
জানি না,জানি না,জানি না।’’
কোরআন মজীদ নবী-রাসূলগণ (আঃ)-এর প্রচারের পদ্ধতি সম্পর্কে অপর যে বিষয়টি উল্লেখ করেছে তা হচ্ছে বিনয় (যা অহঙ্কারের বিপরীত)। যে ব্যক্তি লোকদের কাছে কোনো বাণী পৌঁছাতে চান,বিশেষ করে মহান আল্লাহ বাণী পৌঁছাতে চান তার অবশ্যই পুরোপুরি বিনয়ী হওয়া উচিৎ। অর্থাৎ তার জন্যে আমিত্বের অহঙ্কার বর্জন করা এবং লোকেদেরকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য। তাকে বিনয়ের মূর্ত প্রতীক হতে হবে। কোরআন মজীদে হযরত (আঃ)-এর জবানীতে তার কওমের একদল লোককে সম্বোধন করে এরশাদ হয়েছেঃ .
)
اَوَعَجِبْتُمْ اَنْ جَاءَکُمْ ذِکْرٌ مِنْ رَبِّکُمْ عَلَی رَجُلٍ مِنْکُمْ
(
.
‘‘
এটা কি তোমাদেরকে বিস্মিত করছে যে,তোমাদের মধ্যকার এক ব্যক্তির ওপর তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যিকর (আল্লাহর বাণী) এসেছে?’’
(
সূরা আ
’
রাফঃ 61
)
উপরোক্ত আয়াতে‘‘
তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে’’
(مِنْ رَبِّکُمْ
) কথাটির ব্যবহার বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য । এ কথাটির ব্যবহার থেকে সুস্পষ্ট যে,হযরত (আঃ)‘‘
আমার প্রতিপালক’’
বলতে চান নি। কারণ,এরূপ বললে তার মধ্যে এমন এক ভাব প্রকাশ পেতো যে,তিনি তার প্রতিপালকের দিকে অন্যদেরকে আহবান করছেন। অন্য কথায়,তারা এমন তুচ্ছ লোক যে‘‘
প্রতিপালক’’
কে‘‘
তোমাদের প্রতিপালক’’
বলা চলে না। এরপর তিনি বলেন‘‘
তোমাদের মধ্যকার এক ব্যক্তির ওপর’’
عَلَی رَجُلٍ مِنْکُمْ
অর্থাৎ আমি নিজেও তোমাদেরই একজন।
আপনারা লক্ষ্য করুন এ আয়াতে একজন নবীর কতখানি বিনয়ের পরিচয় রয়েছে। অনুরূপভাবে হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) কে সম্বোধন করে মহান আল্লাহ এরশাদ করেনঃ
)
قُلْ اِنَّمَا اَنَا بَشَرٌ مِثْلُکُمْ يوُحَی اِلَیَّ(
‘‘
(হে রাসূল!) বলুন,অবশ্যই আমি তোমাদের মতোই একজন মানুষ,তবে আমার ওপর ওহী নাযিল হয়।’’
অর্থাৎ তোমাদের মতো একজন মানুষের ওপরই এ ওহী নাযিল হয়েছে। এরপর এরশাদ হয়েছেঃ
)
أَنَّمَا إِلَـٰهُكُمْ إِلَـٰهٌ وَاحِدٌ فَمَن كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا
(
‘‘
অবশ্যই তোমোদের ইলাহ একজন মাত্র ইলাহ । অতএব,যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সাক্ষাতের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে সে যেন উত্তম কর্ম সম্পাদন করে এবং স্বীয় প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকে শরীক না করে।’’
(
সূরা কাহাফঃ 110
)
দীন প্রচারের সাথে সম্পর্কিত আরেকটি বিষয় হচ্ছে বন্ধু সুলভ ও নম্র আচরণ করা এবং রূঢ়তা পরিহার করা। যে ব্যক্তি মানুষের কাছে কোনো বাণী পৌঁছাতে চায়,বিশেষ করে যে মহান আল্লাহর বাণী পৌঁছাতে চায় এবং কামনা করে যে,তারা তা পছন্দ করুক ও এর ওপর ঈমান আনুক,তাকে অবশ্যই নম্র ভাষী হতে হবে এবং নম্রতার সাথে কথা বলতে হবে।
বস্তুতঃ বস্তুগত সামগ্রীর ন্যায় কথাও নরম ও শক্ত হতে পারে। কোনো কোনো সময় মানুষ কোনো বক্তব্য সহজভাবেই গ্রহণ করে ঠিক যেভাবে কোনো কোনো খাদ্যদ্রব্য সহজেই গলাধঃকরণ করতে পারে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর বিপরীত অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ একটি বক্তব্য গ্রহণ করা তাদের পক্ষে খুবই কঠিন হয়;এটা যেন কোনো কাঁটাযুক্ত বস্তু গলাধঃকরণের ন্যায়। কথা যদি খুবই কর্কশ হয় বা তাতে যদি বহু রকমের আকার-ইঙ্গিত থাকে তাহলে লোকদের পক্ষে তা গ্রহণ করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে।
মহান আল্লাহ যখন হযরত মূসা ও হযরত হারুন (আঃ) কে ফেরাউনের নিকট পাঠালেন তখন তাদেরকে যেসব নির্দেশ দান করেন তার মধ্যে অন্যতম ছিলো দাওয়াতের পদ্ধতি। মহান আল্লাহ এরশাদ করেনঃ
)
فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَّيِّنًا لَّعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَىٰ
(
‘‘
আর তার সাথে নরমভাবে কথা বলো,হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে।’’
(সূরা তা হাঃ 44) অর্থাৎ যদিও ফেরাউন সার্বিক অর্থেই একজন উদ্ধত অহঙ্কারী লোক তথাপি তার সামনেও এবং এ ধরনের যে কোনো লোকের সামনেই নম্রভাবে কথা বলতে হবে এবং নম্র ভাষায় আল্লাহর দীনের দাওয়াত দিতে হবে। কারণ,এমনও হতে পারে যে,সে উপদেশ গ্রহণ করবে এবং তার প্রতিপালককে ভয় করবে। আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী হযরত মূসা ও হযরত হারুন (আঃ) ফেরাউনের নিকট সেভাবেই নম্রতার সাথে দাওয়াত পেশ করেন,কিন্তু ফেরাউন সে দাওয়াত গ্রহণ করার মতো লোক ছিলো না।
মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআন হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) কে সম্বোধন করে এরশাদ করেনঃ
)
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللَّـهِ لِنتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّـهِ إِنَّ اللَّـهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ(
‘‘
আল্লাহর অনুগ্রহে আপনি তাদের প্রতি নম্র । আর আপনি যদি তাদের প্রতি কঠোরহৃদয় হতেন তাহলে অবশ্যই তারা আপনার চারদিক থেকে দূরে সরে যেতো। অতএব,আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিন ও তাদের জন্য (আল্লাহর নিকট) ক্ষমার আবেদন করুন। আর (সামষ্টিক) কাজকর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন,অতঃপর যখন স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন তখন আল্লাহর ওপর ভরসা করুন;নিঃসন্দেহে আল্লাহ (তার ওপর) ভরসাকারীদের ভালোবাসেন।’’
(সূরা আল ইমরানঃ 159)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) লোকদের সাথে নম্র আচরণ করতেন এবং তাদের সাথে নম্র ভাবে কথা বলতেন। তার আচরণ ও কথা উভয়ই ছিলো নম্র এবং উভয় ক্ষেত্রেই তিনি রূঢ়তা পরিহার করে চলতেন। তার কথা বলার ধরন সম্পর্কে অনেক ঘটনা বর্ণিত হয়েছে তা থেকে প্রমাণিত হয় যে,তিনি কীভাবে কথা বলার ক্ষেত্রে রূঢ়তা পরিহার করে চলতেন। কথা ও আচরণে এ নম্রতার গুরুত্ব এতই বেশী যে কারণে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সমগ্র কোরআন মজীদের বাহক,এত সব মু‘
জিযা ও অন্য সকল গুণের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তাকে সম্বোধন করে আল্লাহ তা‘
আলা বলছেন যে,আপনি নম্রতার অধিকারী না হলে ও কঠোর হৃদয় হলে লোকেরা আপনার চারদিক থেকে সরে যেতো;বস্তুতঃ আপনার নম্রতা দীনের প্রচার ও লোকদের হেদায়াত লাভের ক্ষেত্রে-তাদের আল্লাহর পরিচয় লাভ ও ঈমান আনয়নে বিরাট প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করেছে। এ প্রসঙ্গে বহু ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।
শেখ সা‘
দী বলেনঃ
درشتی و نرمی بهم در به است
|
|
چو رَگزن که جرّاح و مرهم نه است
|
‘‘
কঠোরতা ও নম্রতার একত্র সমাবেশই উত্তম
শিঙ্গা লাগাতে যখম করে যে মলমও লাগায় সে।’’
অবশ্য এখানে আমরা কঠোরতা সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই না। এ দ্বিপদীটি এ কারণে উদ্ধৃত করেছি যে,এ আমাদের উদ্দেশ্যের কাছাকাছি। নম্রতার সাথে কঠোরতা থাকারও কি প্রয়োজন নেই? বস্তুতঃ রূঢ়তা ও সহিংসতা এবং কঠোরতার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। ঝর্ণাধারার তলেদেশে যেসব নুড়ি পাথর পড়ে আছে তার ওপর দিয়ে বছরের পর বছর প্রচুর পানি প্রবাহিত হয়ে গেছে এবং এগুলোকে ক্ষয় করে ফেলেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেউ যখন ঝর্ণার তলদেশ থেকে এরূপ নুড়ি পাথর হাতে তুলে নেয় সে দেখতে পায় যে,সেগুলো আগের মতোই শক্তও কঠিন,কিন্তু মসৃণ-যা ধরলে মানুষের হাতে সামান্যতম কষ্টও অনুভূত হয় না। শুধু তা-ই নয়,বরং মনে হবে যে,নিজের গায়ের জামার ওপরে হাত বুলালে যত কর্কশতা অনুভূত হয় এসব নুড়ি পাথরের ওপর হাত বুলালে তত কর্কশতাও অনুভব করে না। যে তলোয়ারকে রেত দিয়ে অনেক বেশী ঘষা হয়েছে তাতেও এক ধরনের নম্রতা ও মসৃণতা আছে,এমনকি অনেক ক্ষেত্রে এরূপ তলোয়ারকে স্পিং-এর ন্যায় বাঁকা করা যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও তা কঠিন বটে কঠোরতার অধিকারী হওয়া,দৃঢ়তার অধিকারী হওয়া,বীরত্বের অধিকারী হওয়া ও আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় না করা কর্কশতা ও সহিংসতা থেকে ভিন্ন বিষয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একদিকে যেমন লোকদের সাথে আচরণ ও কথা বলার ক্ষেত্রে বিনয় ও নম্রতার অধিকারী ছিলেন,অন্য দিকে স্বীয় পথের ব্যাপারে ছিলেন আপোসহীন। তিনি আল্লাহ ছাড়া আর কাউকেই ভয় করতেন না।
দীন প্রচারকের আরেকটি গুণ হচ্ছে সাহসিকতা। দীন প্রচারকদের এ গুণ সম্পর্কে কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছেঃ
)
اَلَّذِينَ يُبَلِّغُونَ رِسَالَاتِ اللهِ وَ يَخْشَوْنَهُ وَ لَا يَخْشَوْنَ اَحَداً اِلَّا الله(
.
‘‘
যারা আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেয় ও তাকে ভয় করে এবং আল্লাহ ব্যতীত আর কাউকেই ভয় করে না।’’
(সূরা আহযাবঃ 39) বস্তুতঃ তারা আল্লাহকে ভয় করেন বলেই তার বাণী পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র এদিক-সেদিক করেন না এবং তাতে কোনোরূপ হ্রাস-বৃদ্ধি করেন না,সত্য পথ থেকে বঞ্চিত হন না। কিন্তু দীন প্রচারকের একটি গুণ যে,
)
لَا يَخْشَوْنَ اَحَداً اِلَّا الله(
(আল্লাহ ব্যতীত আর কাউকেই ভয় করে না।)-এ বৈশিষ্ট্য এখন খুব কম লোকের মধ্যেই লক্ষ্য করা যায়।
নবী-রাসূলগণ (আঃ) কর্তৃক দীন প্রচারের ক্ষেত্রে অনুসৃত পদ্ধতির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে,তারা বলতেনঃ দীনের দাওয়াত পৌঁছে দেয়া ছাড়া আমাদের ওপর আর কোনো দায়িত্ব নেই। তারা বলতেনঃ আমরা আল্লাহর বান্দা,আল্লাহর রাসূল ও আল্লাহর বাণীর বাহক। যাজকরা যেমনটি করতেন-এবং সম্ভবতঃ এখনো করেন-নবী-রাসূলগণ (আঃ) সেভাবে লোকেদেরকে সরাসরি বেহেশত বা দোযখের সার্টিফিকেট দেয়ার জন্য আগমন করেন নি। তারা এ ধরনের সনদ দান করতেন না যদিও তাদের নবী-রাসূল হওয়ার ব্যাপারে তাদের নিজেদের বিন্দুমাত্র সংশয় ছিলো না। বরং তারা সাধারণভাবে বিষয়াদি তুলে ধরতেন। কিন্তু কেউ যদি প্রশ্ন করতো যে,আমার শেষ পরিণতি কেমন হবে? তাহলে তারা জবাব দিতেনঃ আল্লাহ জানেন। গুপ্ত বিষয়ে জিজ্ঞেস করলেও তারা বলতেনঃ আল্লাহ জানেন;তোমার শেষ পরিণতি কী হবে স্বয়ং আল্লাহ তা‘
আলাই ভালো জানেন।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাহাবী ওসমান বিন মায‘
উন সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে,রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মদীনায় হিজরেতর পর পরই তিনিও হিজরত করেন। তিনি ছিলেন মদীনায় ইন্তেকালকারী প্রথম মুহাজির। তার ইন্তেকালের পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে জান্নাতুল বাকী‘
তে দাফন করার জন্য নির্দেশ দেন এবং সেদিন থেকেই জান্নাতুল বাকী‘
গোরস্থানে পরিণত হয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ওসমান বি মায‘
উনকে খুবই ভালোবাসতেন এবং সকলেরই তা জানা ছিলো।
আমীরুল মু’
মিনীন হযরত আলী (আঃ)‘‘
নাহজুল বালাগ্বা’’
য় এরশাদ করেনঃ
کَانَ لِی فَبِمَا مَضَی اَخٌ فِی اللهِ، وَ کَانَ يُعَظِّمُهُ فِی عَيْنِی صِغَرُ الدُّنْيَا فِی عَيْنِهِ.
‘‘
অতীতে আমার একজন দীনী ভাই ছিলো আর যে জিনিস তাকে আমার চোখে মহান করে তুলে ধরে তা হচ্ছে ,তার চোখে এ দুনিয়াটা ছিলো খুবই তুচ্ছ।’’
(
নাহজুল বালাগা
,
হিকমাতঃ 281
,
পৃষ্ঠাঃ 1225
)
‘‘
নাহজুল বালাগ্বা’’
র ভাষ্যকারগণ বলেছেন,এখানে হযরত আমীরুল মু’
মিনীন তার দীনী ভাই বলতে ওসমান বি মায‘
উনকে বুঝিয়েছেন। হযরত আমীরুল মু’
মিনীনের পুত্রদের একজনের নাম ওসমান। তার নামকরণ প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে যে,তিনি জন্ম গ্রহণ করলে হযরত আমীরুল মু’
মিনীন বলেনঃ আমি আমার ভাই ওসমান বি মায‘
উ-এর নামে তার নামকরণ করবো। এভাবে তিনি ওসমান বি মায‘
উ-এর স্মৃতিকে সদাজাগ্রত রাখতে চান।
এরূপ একজন ব্যক্তি দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন। তিনি তখন একজন আনসারের গৃহে জীবন যাপন করতেন। সে গৃহে একজন মহিলা ছিলেন যিনি তার খেদমত করতেন যার নাম ছিলো উম্মে‘
আলা;সম্ভবতঃ তিনি তার আনসার ভাইয়ের স্ত্রী ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ওসমান বি মায‘
উ-এর নামাযে জানাযা পড়ার জন্য এলেন। এ ক্ষেত্রে তিনি সেই সব কাজ করেন যা তিনি তার সর্বাধিক ঘনিষ্ঠ সাহাবীদের বেলায় করতেন। সহসা উম্মে‘
আলা ওসমান বি মায‘
উন-এর লাশের দিকে মুখ করে বললেনঃ
هَنِيّاً لَکَ الْجَنَّةُ
’‘
বেহেশত তোমার জন্য উপভোগ্য হোক।’’
তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উম্মে‘
আলার দিকে ফিরে কঠোর কণ্ঠে বললেনঃ‘‘
কে তোমার নিকট এহেন অঙ্গীকার করেছে?’’
উম্মে‘
আলা বললেনঃ‘‘
হে আল্লাহর রাসূল! তিনি আপনার সাহাবী। যেহেতু আপনি তাকে এত ভালোবাসতেন এ কারণে আমি এ কথা বলেছি।’’
তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ আয়াতটি পাঠ করলেনঃ
)
قُلْ مَا کُنْتُ بِدْعاً مِنَ الرُّسُلِ وَ مَا اَدْرِی مَا يُفْعَلُ بِی وَ لَا بِکُمْ(
‘‘
(হে রাসূল!) বলে দিন,আমি নতুন ধরনের কোনো রসূল নই;আমি জানি না আমার সাথে ও তোমাদের সাথে কীরূপ আচরণ করা হবে।’’
(সূরা আহকাফঃ9) এর তাৎপর্য অত্যন্ত সুগভীর। অনুরূপভাবে সূরা আল-জিন-এর শেষ আয়াতে এরশাদ হয়েছেঃ
)
قُلْ اِنِّی لَا اَمْلِکُ لَکُمْ ضَرّاً وَ لَا رَشَداً. قُلْ اِنِّی لَنْ يُجِيرَنِی مِنَ اللهِ
اَحَدٌ وَ لَنْ اَجِدَ مِنْ دُونِهِ مُلْتَحَداً
(
.
‘‘
(হে রাসূল!) বলে দিন,তোমাদের ক্ষতি করার বা কল্যাণ করার কোনো ক্ষমতাই আমার নেই। বলে দিন,আল্লাহর মোকাবিলায় কেউই আমাকে আশ্রয় দান করতে সক্ষম হবে না এবং আমি তার নিকটে ছাড়া অন্য কোনো আশ্রয়স্থল পাবো না।’’
(
সূরা জিনঃ 21
-
22
)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রচার পদ্ধতির আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে লোকদের অবস্থার পার্থক্যের প্রতি দৃষ্টি রাখা। জাহেলিয়াতের যুগে আরব জনগণের মধ্যে এক অদ্ভুত ধরনের শ্রেণীপ্রথা বিদ্যমান ছিলো। তখন এমনকি দরিদ্রদেরকেও মানুষ বলে গণ্য করা হতো না,দাস-দাসীদের মানুষ গণ্য করার তো প্রশ্নই ওঠে না। তৎকালীন অভিজাত লোকেরা-কোরআন মজীদে যাদেরকে মালা’
(مَلأ
) বলা হয়েছে,তারা নিজেদেরকে সব কিছুর মালিক-মোখতার ও অধিকারী বলে মনে করতো এবং যাদের কিছুই ছিলো না তাদের কিছু পাবার অধিকার আছে বলে মনে করতো না। শুধু তা-ই নয়,তারা এটা মনে করতো না এবং স্বীকার করতো না যে,তারা এ দুনিয়ার বুকে সব কিছুর অধিকারী হলেও এবং অন্যরা কিছুরই অধিকারী না হলেও পরকালীন জীবনে হয়তো এর বিপরীত অবস্থা হতে পারে। বরং তারা বলতো যে,দুনিয়া হচ্ছে আখেরাতের অবস্থার নিদর্শন;যেহেতু দুনিয়ার জীবনে আমরা সব কিছুর অধিকারী,সেহেতু তা এটাই প্রমাণ করে যে,আমরা আল্লাহ তা‘
আলার প্রিয়;আল্লাহ আমাদেরকে ভালোবাসেন এবং এ কারণেই আমাদেরকে সব কিছু দিয়েছেন। অতএব,আখরাতের অবস্থাও এমনই হবে;তোমরাও আখরাতে এ রকম অবস্থারই সম্মুখীন হবে। যে ব্যক্তি দুনিয়ার জীবনে হতভাগ্য সে পরকালীন জীবনেও হতভাগ্য ।
আরবের অভিজাত লোকেরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বলতোঃ তোমার কাজে ত্রুটি কোথায় জানো? তুমি জানো,কেন আমরা তোমার রিসালাতের দাবী মেনে নিতে প্রস্তুত নই? এর কারণ হলো এই যে,তুমি নীচ স্তরের ও ইতর শ্রেণীর লোকেদেরকে তোমার চারদিকে জমায়েত করেছো। এদেরকে দূরে সরিয়ে দাও,তখন আমরা অভিজাত লোকেরা তোমার কাছে চলে আসবো। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে সম্বোধন করে এরশাদ করেনঃ হে রাসূল! আপনি তাদেরকে বলে দিন,
)
وَ مَا اَنَا بِطَارِدِ الْمُؤْمِنيِنَ(
.
‘‘
আমি মু’
মিনদেরকে বিতাড়নকারী নই।’’
(সূরা শুআরাঃ 114) অর্থাৎ আমি এমন লোক নই যে,এই লোকেরা আমার ওপর ঈমান আনা সত্ত্বেও কেবল দরিদ্র ও ক্রীতদাস হওয়ার কারণে আমি তাদেরকে আমার কাছ থেকে বিতাড়িত করবো। আল্লাহ তা‘
আলা অন্য এক আয়াতেও রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে সম্বোধন করে এরশাদ করেনঃ .
)
وَ لَا تَطْرُدِ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاوَةِ وَ الْعَشِیِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ.(
‘‘
(হে রাসূল!) আপনি তাদেরকে দূরে সরিয়ে দেবেন না যারা তাদের প্রতিপালকের সন্তুষ্টি লাভের আশায় সকাল-বিকাল তাকে ডাকে।’’
(সূরা আনআমঃ 52) অর্থাৎ এতে অভিজাত লোকেরা যদি আপনার কাছ থেকে সরে যায় তো যাক;ইসলাম গ্রহণ করতে চাইলে অবশ্যই তাদের মন-মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে এবং মানুষকে মানুষ বলে গণ্য করতে হবে।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রবর্তিত এবং তার নিজের জীবনে আচরিত একটি নিয়ম ছিলো এই যে,প্রথমতঃ তার মজলিসে বসার ক্ষেত্রে মর্যাদাগত উুঁচু-নীচু অবস্থার অস্তিত্ব ছিলো না;সাধারণতঃ তার মজলিসে আগমনকারীরা গোল হয়ে বসতেন। ফলে মর্যাদাগত উঁচু-নীচু অবস্থার সৃষ্টি হতো না। দ্বিতীয়তঃ তিনি মজলিসে প্রবেশ করলে লোকেদেরকে তার সম্মানার্থে দাঁড়াতে নিষেধ করতেন। তিনি বলতেন যে,এটা আ‘
জামীদের অর্থাৎ অনারবদের রীতি। তিনি আরো বলতেনঃ যে ব্যক্তি যখনই মজলিসে প্রবেশ করবে সে যে জায়গাই খালি পাবে সেখানেই বসে পড়বে;লোকেরা যেন কাউকে সম্মানজনক জায়গায় তথা মর্যাদাগত বিচারে উচ্চতর বিবেচিত স্থানে,যেমনঃ সামনে,বসতে দেয়ার জন্যে তাদের জায়গা থেকে সরে বসতে বাধ্য না হয়। কারণ,এটা ইসলামের রীতি নয়।
একবার ইসলাম গ্রহণকারী একজন অভিজাত ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মজলিসে বসে ছিলেন। এ সময় জীর্ণবাস পরিহিত একজন গরীব লোক মজলিসে প্রবেশ করলেন এবং উক্ত অভিজাত ব্যক্তির পাশে খালি জায়গা পেয়ে সেখানে বসে পড়লেন। দরিদ্র ব্যক্তি সেখানে বসে পড়ার সাথে সাথেই অভিজাত ব্যক্তি জাহেলিয়াত যুগের অভ্যাস অনুযায়ী নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে তার কাছ থেকে কিছুটা দূরে সরে বসলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ঘটনাটি লক্ষ্য করলেন;তিনি অভিজাত ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে বললেনঃ তুমি এরূপ করলে কেন? তুমি কি এ ভয়ে সরে গেলে যে,তোমার ধনসম্পদ থেকে কিছুটা তার গায়ে লেগে যাবে? অভিজাত ব্যক্তি জবাব দিলেনঃ না,হে আল্লাহর রাসূল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ তুমি কি এ ভয় করেছো যে,তার দারিদ্রের কিছুটা তোমার গায়ে লেগে যাবে? অভিজাত ব্যক্তি বললেনঃ না,হে আল্লাহর রাসূল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ তাহলে তুমি এমন করলে কেন? তখন অভিজাত ব্যক্তি বললেনঃ আমি ভুল করেছি;অন্যায় করেছি। এ ধরনের অন্যায়ের শাস্তি স্বরূপ আমি আপনার এই মজলিসেই আমার সমস্ত ধন সম্পদের অর্ধেক আমার এই মুসলমান ভাইকে দান করলাম। তখন উপস্থিত লোকেরা তার দরিদ্র মু’
মিন ভাইকে বললেনঃ এবার তোমার সম্পদ নিয়ে নাও। জবাবে দরিদ্র ব্যক্তি বললেনঃ না,নেবো না। উপস্থিত লোকেরা বললেনঃ তোমার তো ধন সম্পদ নেই,তাহলে নেবে না কেন?
তিনি বললেনঃ ভয় করছি যে,তা গ্রহণ করলে একদিন হয়তো এই ব্যক্তির ন্যায় অহঙ্কারী হয়ে পড়বো।
দীন প্রচারের পদ্ধতির সাথে সংশ্লিষ্ট আরেকটি বিষয় হচ্ছে ধৈর্য-স্থৈর্য ও দৃঢ়তা। মহান আল্লাহ এরশাদ করেনঃ
)
فَاصْبِرْلِحُکْمِ رَبِّکَ وَلَا تَکُنْ کَصَاحِبِ الْحُوتِ(
.
‘‘
অতএব,(হে রাসূল!) আপনি আপনার প্রতিপালকের ফয়সালার জন্য অপেক্ষা করুন এবং সেই মাছওয়ালার (ইউনুসের) ন্যায় হবেন না।’’
(সূরা নূন ওয়াল কালামঃ 48) আল্লাহ তা‘
আলা আরো এরশাদ করেন :
)
فَاصْبِرْ کَمَا صَبَرَ اُولُوا الْعَزْمِ مِنَ الرُسُلِ.(
‘‘
অতএব,(হে রাসূল!) আপনি দৃঢ়তার অধিকারী রাসূলগণের ন্যায় ধৈর্য ধারণ করুন।’’
(
সূরা আহকাফঃ 35
)
আরো এরশাদ হয়েছেঃ
)
فَاسْتَقِمْ کَمَا اُمِرْتَ(
.
‘‘
অতএব,(হে রাসূল!) আপনাকে যেভাবে আদেশ দেয়া হয়েছে সেভাবে অবিচল থাকুন।’’
(
সূরা হূদঃ 112
)
.
فَاسْتَقِمْ کَمَا اُمِرْتَ
. কথাটি দুটি সূরায় এসেছেঃ সূরা আশ্-শূরায় এবং সূরা-হূদে কথাটি এভাবে এসেছেঃ
)
فَاسْتَقِمْ کَمَا اُمِرْتَ وَ مَنْ تَابَ مَعَکَ(
‘‘
অতএব,(হে রাসূল!) আপনাকে যেভাবে আদেশ দেয়া হয়েছে সেভাবে আপনি নিজে এবং আপনার সঙ্গী-সাথী তাওবাকারীগণ অবিচল থাকুন।’’
(
সূরা হূদঃ 112
)
আর সূরা আশ-শূরায় কেবল হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) কে উদ্দেশ্য করে এ আদেশ দেয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে,তিনি এরশাদ করেছেনঃ
شَيَّبَتْنِی سُورَةُ هُودٍ
‘‘
সূরা হূদ আমার দাড়িকে সাদা করে দিয়েছে।(
মাজমাউল বায়ান
,
খণ্ড 5
,
পৃষ্ঠা 140
)
যেখানে বলা হয়েছেঃ
)
فَاسْتَقِمْ کَمَا اُمِرْتَ وَ مَنْ تَابَ(
‘‘
অতএব,(হে রাসূল!) আপনাকে যেভাবে আদশ দেয়া হয়েছে সেভাবে আপনি নিজে এবং আপনার সঙ্গী-সাথী তাওবাকারীগণ অবিচল থাকুন।’’
তবে কেবল আমাকেই বলা হয়নি,বরং স্বয়ং আমার ও অন্যদের কথা বলা হয়েছে;বলা হয়েছেঃ তাদেরকেও অবিচল রাখো।’’
এবার আমরা হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) প্রসঙ্গে ফিরে যাবো এবং তার প্রচার পদ্ধতির প্রতি দৃষ্টি দেবো।
আবু আব্দুল্লাহ হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) তার আন্দোলন ও সংগ্রামে এমন কতগুলো কাজ করেন যেগুলোকে কর্মপদ্ধতি হিসেবে গণ্য করা চলে। এ ব্যাপারে পরবর্তিতে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হবে। এখানে আমরা রণাঙ্গনের অবস্থার প্রতি দৃষ্টিপাত করবো। অবশ্য এটা একটা রীতিতে পরিণত হয়েছে যে,মহররমের নবম দিবস (তাসূ‘
আ) উপলক্ষে হযরত আবুল ফজল আব্বাস (সালামুল্লাহি আলাইহ)কে স্মরণ করা হয়।
হযরত আবুল ফাজল আব্বাস-এর মর্যাদা অত্যন্ত। আমাদের নিস্পাপ ইমামগণ বলেছেনঃ
. اِنَّ لِلْعَبَّاسِ مَنْزِلَةً عِنْدَ اللهِ يَغْبَطُهُ بِهَا جَمِيعُ الشُّهَدَاءِ.
‘‘
অবশ্যই আল্লাহর নিকট আব্বাসের মর্যাদা এমন যে,সমস্ত শহীদ তাতে গর্ব করবে।’’
(
আবসারুল আইন ফি আনসারিল হোসাইন
,
পৃষ্ঠাঃ 27
;
বিহারুল আনোয়ার
,
খণ্ড 44
,
পৃষ্ঠা 29
;
আমালী সাদুক
,
মজিলসঃ 70
,
নম্বরঃ 10
)
দুঃখের বিষয় এই যে,ইতিহাস এ মহান শহীদ সম্বন্ধে যথেষ্ট তথ্য সরবরাহ করে নি। অর্থাৎ কেউ যদি তার জীবন কাহিনী সম্বন্ধে গ্রন্থ রচনা করতে চায় তাহলে তিনি যথেষ্ট তথ্য খুজে পাবেন না। কিন্তু অনেক বেশী তথ্যের প্রয়োজন কী? ক্ষেত্রবিশেষে একজন মানুষের জীবনের একটি দিন বা দু’
টি দিন বা পাঁচ দিনের ঘটনাবলী-যার পূর্ণ বিবরণ হয়তো পাঁচ পৃষ্ঠার বেশী হবে না,এমনই প্রোজ্জ্বল হতে পারে যে,যা সেই ব্যক্তির এমন মর্যাদার পরিচায়ক যার গুরুত্ব কয়েক ডজন খণ্ড সম্বলিত জীবনী গ্রন্থের চেয়ে অনেক বেশী। আর হযরত আবুল ফজল আব্বাস ছিলেন এ ধরনেরই একজন ব্যক্তি ।
কারবালার ঘটনার সময় আবুল ফজল আব্বাসের বয়স ছিলো প্রায় 45 বছরের মতো। তিনি ছিলেন কয়েক জন সন্তানের পিতা;এদের মধ্যে একজন ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ইবনে আলী ইবনে আবি তালেব যিনি অত্যন্ত দীর্ঘজীবী ছিলেন। বর্ণিত আছে যে,একিদন হযরত ইমাম যায়নুল আবদীন (আঃ) তাকে দেখলেন;তখন কারবালার ঘটনাবলী তার মনে পড়ে গেলো এবং ইমামের’
চোখ বেয়ে অশ্রুধারা নেমে এলো। .
আমীরুল মু’
মিনীন হযরত আলী (আঃ)-এর শাহাদাতের সময় আবুল ফজল আব্বাস ছিলেন চৌদ্দ বছরের কিশোর।‘‘
নাসেখুত তাওয়ারীখ’’
গ্রন্থে বলা হয়েছে যে,আবুল ফজল আব্বাস সিফফীনের যুদ্ধে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু যেহেতু তখন তিনি অপ্রাপ্ত বয়স্ক কিশোর ছিলেন (মোটামুটি বারো বছরের ছিলেন,কারণ,আমীরুল মু’
মিনীনের শাহাদাতের প্রায় তিন বছর আগে সিফফীনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়),সেহেতু আমীরুল মু’
মিনীন তাকে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য অনুমতি দেন নি। উক্ত গ্রন্থে বলা হয়েছে,সিফফীনের যুদ্ধের সময় যদিও তিনি বালক মাত্র ছিলেন তথাপি তিনি এক কালো রঙ্গের ঘোড়ায় সওয়ার হয়েছিলেন। এর বেশী কিছু জানা যায় না। তবে এ বিষয়টি অনেকেই লিখেছেন। যুদ্ধ বিষয়ক নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাবলীতে লিখিত আছে যে,আমীরুল মু’
মিনীন হযরত আলী (আঃ) এক সময় তার ভাই‘
আক্বীলকে বলেনঃ‘‘
আমার জন্য এমন একজন স্ত্রী নির্বাচন করে দাও যে বীর বংশধর জন্ম দেবে।’’
‘
আক্বীল ছিলেন নসবনামা (বংশধারা শাস্ত্রীয়) বিশেষজ্ঞ । আর এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন বিস্ময়কর দক্ষতার অধিকারী। তিনি লোকদের গোত্র পরিচয় ও পিতা-মাতা সম্বন্ধে এবং কখন কোথায় সংশ্লিষ্ট গোত্রের উদ্ভব ঘটে সে সম্পর্কে বিস্তারিত অবগত ছিলেন। তাই আমীরুল মু’
মিনীন হযরত আলী (আঃ) স্ত্রী নির্বাচনের ব্যাপারে তার সহায়তা চাইলে সাথে সাথেই তিনি বলেনঃ
. عنَیِّ لَکَ بِاُمِّ الْبَنِينَ بِنْتِ خَالِدٍ
‘‘
আমি তোমার জন্য উম্মুল বানীন বিনতে খালেদ-এর প্রস্তাব দিচ্ছি ।’’
উল্লেখ্য ,‘‘
উম্মুল বানীন’’
মানে‘
কয়েক জন পুত্রের জননী’
। তবে এটা‘‘
উম্মে কুলসুম’’
-এরই অনুরূপ;বর্তমানে আমরা এর দ্বারা নাম রেখে থাকি। ইতিহাসে আছে যে,উম্মুল বানীন-এর পূর্ববর্তী বংশধারায় তার পরদাদী বা আরো পূর্ববর্তী কারো নাম ছিলো উম্মুল বানীন;হয়তো তার কথা স্মরণ করেই এর নাম উম্মুল বানীন রাখা হয়েছিলো।
যা-ই হোক,আমীরুল মু’
মিনীন হযরত আলী (আঃ) উম্মুল বানীনকে বিবাহ করেন এবং তার গর্ভে চারজন পুত্রসন্তান জন্ম গ্রহণ করে। প্রাপ্ত তথ্যাদি থেকে মনে হয় যে,তিনি কোনো কন্যা সন্তান জন্ম দেননি। এভাবে তিনি শুধু নামে নয়,কার্যতঃও উম্মুল বানীন বা কয়েক জন পুত্র সন্তানের মাতা হিসেবে প্রমাণিত হন।
আমীরুল মু’
মিনীন হযরত আলী (আঃ) আরো কয়েক জন বীর সন্তানের অধিকারী ছিলেন। প্রথমতঃ স্বয়ং হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) উভয়ই ছিলেন বীরপুরুষ। বিশেষ করে হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) যে কত বড় সাহসী ছিলেন কারবালায় তিনি তার প্রমাণ রাখেন। প্রমাণিত হয় যে,তিনি তার পিতার সাহসিকতা ও বীরত্ব উত্তরাধিকার হিসাবে লাভ করেছেন। দ্বিতীয় আমীরুল মু’
মিনীনের আরেক পুত্র মুহাম্মাদ বিন হানাফীয়াও বীরপুরুষ ছিলেন। তিনি আবুল ফজলের চেয়ে অনেক বড় ছিলেন। তিনি জঙ্গে জামালে (উটের যুদ্ধে ) অংশগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন অসাধারণ বীরত্বের অধিকারী,খুবই শক্তিশালী ও শৌর্যের অধিকারী। বলা হয় যে,আমীরুল মু’
মিনীন (আঃ) তাকে বিশেষভাবে স্নেহ করতেন।
সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী কারবালার রণাঙ্গনে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পরিবার থেকে সর্ব প্রথম যিনি শাহাদাত বরণ করেন তিনি হলেন হযরত আলী আকবর,আর হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর শাহাদাতের পূর্বে সর্বশেষ যিনি শাহাদাত বরণ করেন তিনি হলেন হযরত আবুল ফজল আব্বাস। অর্থাৎ আবুল ফজল যখন শহীদ হন অতঃপর হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর পুরুষ সঙ্গীসাথী ও অনুসারীদের মধ্যে একমাত্র তার অসুস্থ পুত্র হযরত ইমাম যায়নুল আবেদীন (আঃ) ছাড়া আর কেউ বেঁচে ছিলেন না।
বর্ণিত হয়েছে,আবুল ফজল আব্বাস রণাঙ্গনে যাবার আগে এ জন্য হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর নিকট অনুমতি চাইতে আসনে এবং বলেনঃ‘‘
প্রিয় ভাইজান! আমাকে রণাঙ্গনে যাবার অনুমতি দিন। আমি বেঁচে থাকাতে খুবই অশান্তি বোধ করছি।’’
আবুল ফজল আব্বাস নিজে রণাঙ্গনে যাবার আগে তার তিন সহোদর ভাইকে (যাদের সকলেই বয়সে তার চেয়ে ছোট ছিলেন) রণাঙ্গনে পাঠান। তিনি তাদেরকে বলেনঃ‘‘
ভাইেয়রা! তোমারা যাও;আমি আমার ভাইদের বিপদের (শাহাদাতের) বিনিময়ে পুরস্কার পেতে চাই।’’
তিনি নিশ্চিত হতে চাচ্ছিলেন যে,তার তিন সহোদর ভাই তার আগেই শহীদ হয়েছেন এবং তিনি মনস্থ করেছিলেন যে,এরপরই তিনি তাদের সাথে যুক্ত হবেন।
এই হলো উম্মুল বানীন ও তার চার পুত্রের ঘটনা। তবে আশূরার সময় উম্মুল বানীন কারবালায় ছিলেন না। তিনি তখন মদীনায় ছিলেন। যারা মদীনায় ছিলেন তারা কারবালার ঘটনার কোনো খবরই রাখতেন না। চারটি পুত্র সন্তানের জননী এই মহিলার গোটা জীবন বলতে তার এই পুত্রগণই ছিলেন। তার নিকট সংবাদ পৌঁছলো যে,তার চার সন্তানই কারবালায় শহীদ হয়েছেন। বস্তুতঃ তিনি ছিলেন একজন পূণ্যবতী মহিলা। তিনি ছিলেন একজন বিধবা,যার একমাত্র সম্বল ছিলো তার এই পুত্রগণ,কিন্তু তাদের সকলেই শহীদ হয়ে গেলেন। তিনি অনেক সময় মদীনা থেকে কুফা অভিমুখী পথের পাশে বসে তার সন্তানদের স্মরণে শোকগাঁথা গাইতেন।
ইতিহাসে লেখা হয়েছে যে,এই মহিলা স্বয়ং ছিলেন বনি উমাইয়্যার প্রশাসনের বিরুদ্ধে এক বিলষ্ঠ প্রচার। যে কেউ ঐ পথ দিয়ে অতিক্রম করতো সে-ই থমকে থেমে যেতো এবং তার শোকগাঁথা শুনে অশ্রু বিসর্জন করতো। এমন কি আহলে বাইতের ঘোরতর দুশমনদের অন্যতম মারওয়ান ইবনে হাকাম যখন মদীনার আমীর (গভর্ণর) ছিলো,সে যখনই ঐ পথ দিয়ে অতিক্রম করতো তখন উম্মুল বানীনের শোকগাঁথা শুনে নিজের মনের অজান্তই বসে পড়তো এবং উম্মুল বানীনের বিলাপের সাথে সাথে ক্রন্দন করতো।
উম্মুল বানীন বেশ কিছু কবিতা রচনা করেন। এর মধ্যে একটি কবিতায় তিনি বলেনঃ
لَا تَدْعُونِی وَيْکَ اُمَّ الْبَنِينِ
|
|
تُذَکِّرِينِی بِلُيُوثِ الْعَرِينِ
|
کَانَتْ بَنُونَ لِی اُدْعَی بِهِمْ
|
|
وَ الْيَوْمَ اَصْبَحْتُ وَ لَا مِنْ بَنِينٍ
|
‘‘
হে আর আমাকে ডেকো না উম্মুল বানীন বলে
এ ডাক তাজা করে দেয় বেদনার স্মৃতি মোর
ছিলো মোর ক’
টি পুত্র,ডাকা হতো তাই এই নামে মোরে
আজ আমি আছি শুধু মোর কোনো পুত্র নেই।’’
(মুন্তাহাল আমাল,খণ্ড 1,পৃষ্ঠা 386)
উম্মুল বানীনের জৈষ্ঠ পুত্র ছিলেন হযরত আবুল ফজল আব্বাস। তাই তিনি বিশেষভাবে আবুল ফজলের স্মরণে এক মর্মবিদারক শোকগাঁথা রচনা করেন। এতে তিনি বলেনঃ
يَا مَنْ رَأَی الْعَبَّاسَ کَرَّ عَلَی جَمَاهِيرِ النَّقَدِ
وَ وَرَاهُ مِنْ اَبْنَاءِ حَيْدَرَ کُلُّ لَيْثٍ ذِی لَبَدٍ
اُنْبِئْتُ اَنَّ ابْنِی اُصِيبَ بِرَأْسِهِ مَقْطُوعَ يَدٍ
وَيْلِی عَلَی شِبْلِی اَمَالَ بِرَأْسِهِ ضَرْبُ الْعَمَدِ
لَوْ کَانَ سِيْفُکَ فِی يَدَيْکَ لِمَا دَنَی مِنْهُ اَحَدٌ
‘‘
হে,যে জন দেখেছো আব্বাসকে নীচ গোষ্ঠীর মোকাবিলায়
আর তার পশ্চাতে ছিলো হায়দারের পুত্রগণ প্রত্যেকেই সিংহ দৃঢ়পদ
আমাকে জানানো হলো,আমার কর্তিতহস্ত পুত্রের শিরোপরি আপতিত হলো
আফসোস তবু সে সিংহ শাবকের শিরে স্বেচ্ছায় হেনেছে আঘাত
হায়! তোমার হাতে থাকলে তরবারী কেউই আসতো না তার কাছে।’’
(প্রাগুক্ত)
উম্মুল বানীন জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ আমার পুত্র সাহসী বীরপুরুষ আব্বাস কীভাবে শহীদ হলো? বস্তুতঃ হযরত আবুল ফজল আব্বাসের সাহসিকতা ও বীরত্বের বিষয় ইতিহাসের অকাট্য বিষয় সমূহের অন্যতম। তিনি ছিলেন অসাধারণ সুন্দর। এ কারণে শৈশব কালেই তাকে‘‘
ক্বামারে বানী হাশেম’’
(বনি হাশেমের পূর্ণচন্দ্র ) বলা হতো যিনি বনি হাশেমের মাঝে পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় সমুদ্ভাসিত ছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দীর্ঘদেহী। অনেক নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিকের বর্ণনা অনুযায়ী,তিনি যখন ঘোড়ায় সওয়ার হতেন তখন রেকাব থেকে পা বের করে ঝুলিয়ে দিলে তার পায়ের আব্দুল ভূমি স্পর্শ করতো। তার বাহুও ছিল অত্যন্ত দীর্ঘ ও শক্তিশালী এবং বক্ষ ছিলো খুবই প্রশস্ত। উম্মুল বানীন বলতেন যে,এ ধরনের বৈশিষ্ট্যের অধিকারী তার পুত্র নিহত হবেন না। উম্মুল বানীন লোকদের জিজ্ঞেস করেন,তার পুত্রকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছিলো? তাকে জানানো হয় যে,প্রথমে তার হাত দু’
টি কেটে ফেলা হয়,এরপর তাকে হত্যা করা হয়। একথা শুনে উম্মুল বানীন এ নিয়ে মার্সিয়া (শোকগাঁথা) রচনা করেন। তিনি বলতেনঃ‘‘
হে কারবালা প্রত্যক্ষকারী নয়নগুলো! হে কারবালা থেকে আগত লোকেরা! তোমরা তো আমার আব্বাসকে দেখেছো যে,সে শৃগালদের দলের ওপর হামলা করেছিলো এবং দুশমন পক্ষের লোকেরা শৃগালের মতো তার সামনে থেকে পলায়ন করছিলো।’’
তিনি বলেনঃ
يَا مَنْ رَأَی الْعَبَّاسَ کَرَّ عَلَی جَمَاهِيرِ النَّقَدِ
وَ وَرَاهُ مِنْ اَبْنَاءِ حَيْدَرَ کُلُّ لَيْثٍ ذِی لَبَدٍ
‘‘
হে,যে জন দেখেছো আব্বাসকে নীচ গোষ্ঠীর মোকাবিলায়
আর তার পশ্চাতে ছিলো হায়দারের পুত্রগণ প্রত্যেকেই সিংহ দঢ়পদ।’’
তিনি তার শোকগাঁথায় বলেনঃ‘‘
আলীর অন্যান্য পুত্র তার পিছনে দাড়িয়ে ছিলো;তারা সিংহের পিছনে সিংহের ন্যায় আব্বাসের পিছনে দাড়িয়ে ছিলো। আফসোস! আমাকে জানানো হয়েছে,তোমার নরিসংহ পুত্রের শরীরে লৌহশলাকা ঢুকানো হয়েছিলো। আব্বাস! প্রাণপ্রিয় পুত্র আমার! আমি জানি,তোমার শরীরে যদি হাত থাকতো তাহলে কেউই তোমার সামনে আসতে সাহসী হতো না।’’