চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 103680
ডাউনলোড: 9120


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 103680 / ডাউনলোড: 9120
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)

প্রথম খণ্ড

আয়াতুল্লাহ্ জা ফার সুবহানী

অনুবাদ : মোহাম্মদ মুনীর হোসেন খান

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)

মূল : আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী

অনুবাদ : মোহাম্মদ মুনীর হোসেন খান

সম্পাদনা : অধ্যাপক সিরাজুল হক

তত্ত্বাবধানে : শাহাবুদ্দীন দারায়ী

কালচারাল কাউন্সেলর

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাস,ঢাকা

প্রকাশকাল : ররিউস সানী-1425,জ্যৈষ্ঠ-1411,জুন-2004

প্রকাশনায় :

কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাস

বাড়ী নং 54, সড়ক নং 8/এ ,

ধানমন্ডি আ/এ ,ঢাকা-1209,বাংলাদেশ

প্রচ্ছদ:রফিকউল্লাহ গাযালী

মুদ্রণে:চৌকস প্রিন্টার্স লিঃ

131 ডিআইটি এক্সটেনশন রোড (4র্থ তলা),ঢাকা-1000

Chira Vashwar Mahanabi (Sm.),Written by: Ayatollah Zafar Sobhani;Translated by: Mohammad Munir Hossain Khan;Edited by: Prof. Shirazul Haque;Supervised by: Shahaboddin Daraei,Cultural Counsellor,Embassy of the Islamic Republic of Iran,Dhaka;Published by: Office of the Cultural Counsellor,Embassy of the Islamic Republic of Iran,Dhaka,Bangladesh;Published on: Rabiuth Thani,1425,Jaishtha,1411,June,2004;

প্রকাশকের কথা

বিস্মিল্লাহির রাহমানির রাহীম

মানব জাতির শ্রেষ্ঠতম পথ প্রদর্শক ইসলামের মহান পয়গাম্বর (সা.)-এর জীবনী সম্পর্কে প্রচুর বই-পুস্তক লেখা হয়েছে,যদিও ইতিহাসের সকল শ্রেষ্ঠ মানবের জীবন তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বের কারণে বিরাট ঔজ্জ্বল্যের অধিকারী এবং একই সাথে শিক্ষণীয় গুঢ়তত্ত্ব ও রহস্যে পরিপূর্ণ। তাঁরা যেহেতু সৃষ্টিজগতের এবং সকল মানুষের সেরা,তাঁদের জীবনও ইতিহাসের সোনালী অধ্যায় এবং সৃষ্টিলোকের বিস্ময়কর বীরত্বে পরিপূর্ণ। কিন্তু ইতিহাসের এ মহামানবদের মাঝে কেউই ইসলামের মহান পয়গাম্বর হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মতো এতখানি ঘটনাবহুল,তরঙ্গায়িত ও বিপ্লবমুখর জীবনের অধিকারী ছিলেন না। অন্য কেউ এত দ্রুত তাঁর পরিবেশে এবং পরে গোটা বিশ্বে এত গভীর প্রভাব সৃষ্টি করেন নি। তাঁদের মধ্যে কেউই এতখানি অধঃপতিত ও পশ্চাৎপদ সমাজ থেকে এত উন্নত সভ্যতার উন্মেষ ঘটান নি। এ ধরনের মহাপুরুষের জীবন ও ইতিহাস পর্যালোচনা আমাদেরকে অনেক কিছু শিক্ষা দিতে পারে এবং আমাদের চোখের সামনে বিভিন্ন শিক্ষণীয় বিষয় ফুটিয়ে তুলতে পারে। এ দৃষ্টিকোণ থেকেই তাঁর পবিত্র জীবনকে যদি আমরা ইতিহাসের সবচেয়ে তরঙ্গবহুল বীরত্বের ইতিহাস এবং মানব জাতির ইতিহাসে মানবীয় উন্নতির চূড়ান্ত শিখর বলে আখ্যায়িত করি,তাহলে কোনরূপ অতিরঞ্জিত করা হবে না।

এই গ্রন্থে পয়গাম্বর (আ.)-এর শিক্ষাগত,সামাজিক,সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে এবং মানব জাতির হেদায়েতের ক্ষেত্রে নবুওয়াতের পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব পালনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে অতি উত্তম পন্থায় পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সত্যিকার অর্থে এ দেশে আমার অবস্থানকালে এ ধরনের একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করেছি,যেখানে ইতিহাসের সকল ঘটনা ইসলামের সোনালী যুগের প্রথম স্তরের তথ্যসূত্র ব্যবহার করে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

এ কারণেই মহান আল্লাহ্ তায়ালার তাওফীক-এর সাহায্য নিয়ে এবং একদল সহকর্মীর সহায়তায় কোমের দীনী মাদ্রাসার নেতৃস্থানীয় শিক্ষক,গবেষক ও ইসলামী চিন্তাবিদ হযরত আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানীর লেখা ফুরুগে আবাদিয়াত’গ্রন্থটি চিরভাস্বর মহানবী’নামে অনুবাদ ও প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছি। এই গ্রন্থের বিশ্লেষণগুলো বাংলাদেশের বিজ্ঞ মুসলিম গবেষক ও চিন্তাবিদদের জন্য ইসলামের রাজনৈতিক ইতিহাস বিশেষ করে মানব জাতির দিক-নির্দেশনার ক্ষেত্রে এই মহান আদর্শের প্রবর্তক ও স্থপতি পয়গাম্বর আকরামের অনুসৃত ভূমিকাকে নতুনভাবে দেখা ও পর্যালোচনার সুযোগ করে দেবে।

সত্যের অনুসারীদের প্রতি সালাম জানাচ্ছি।

শাহাবুদ্দীন দারায়ী

কালচারাল কাউন্সেলর

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাস,ঢাকা

15 খোরদাদ (ফার্সী),1383

4 জুন,2004

লেখকের তৃতীয় সংস্করণের ভূমিকা

বিস্মিল্লাহির রাহমানির রাহীম

ঐতিহাসিক ঘটনাবলী লিপিবদ্ধকরণ ও সেগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ

মানব জাতির পথ প্রদর্শক সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা এবং মহানবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (সা.)-এর জীবনী সম্পর্কে এ পর্যন্ত অগণিত গ্রন্থ ও সন্দর্ভ লেখা হয়েছে। এ ব্যাপারে লিখিত গ্রন্থাবলী যদি এক জায়গায় সংগ্রহ করি,তাহলে এগুলোর দ্বারা একটি বিশাল গ্রন্থাগার স্থাপন করা যাবে এবং নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে,মহানবী (সা.)-এর মতো আর কোন মনীষী বা মহামানবই ইতিহাস-লেখক এবং উন্নত চিন্তাধারার অধিকারী বুদ্ধিজীবীদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেন নি। বিশ্বের আর কোন মহামানবের ক্ষেত্রে এত গ্রন্থ লেখা হয় নি।

তবে অধিকাংশ গ্রন্থে নিম্নোক্ত দু টি ত্রুটির যে কোন একটি আছেই। হয় জীবনী গ্রন্থসমূহকে শুধু ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর বিবরণ লিপিবদ্ধকরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে,যেখানে ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সঠিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ,যুক্তিপূর্ণ মন্তব্য,গভীর অধ্যয়ন ও ব্যাপক গবেষণা করা তো হয়ই নি,এমনকি একদল লেখক ও জীবনচরিত রচয়িতা ইসলামের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীর অন্তনির্হিত মূল কারণ এবং এগুলোর সুদূরপ্রসারী প্রভাব,পরিণতি ও ফলাফল বর্ণনা করা থেকেও বিরত থেকেছেন।

অথবা ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা ও পর্যালোচনা হিসাবে নিছক কতগুলো ভিত্তিহীন ধারণা,প্রমাণবিহীন গবেষণাকর্ম এবং ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর বর্ণনা ও এগুলোর বিবরণের সাথে বিচার-বিশ্লেষণকে মিলিয়ে ফেলা হয়েছে। আর এগুলোকে ঐতিহাসিক গবেষণাধর্র্মী গ্রন্থ’হিসাবে ইসলামের ইতিহাসের আগ্রহী পাঠকবর্গের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে।

জীবনী সংক্রান্ত প্রথম ধরনের গ্রন্থগুলোর ক্ষেত্রে আপত্তি হচ্ছে এই যে,ইতিহাসের মূল লক্ষ্য শুধু বিভিন্ন ঘটনা লেখা ও বর্ণনা করাই নয়;বরং বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক তথ্য,সাক্ষ্য-প্রমাণ ও উৎসের ভিত্তিতে অতীতের ঘটনাবলী এবং এগুলোর মূল কারণ ও (সুদূরপ্রসারী) ফলাফলসমূহের বিবরণ লিপিবদ্ধ করা। এতদর্থে ইতিহাস আসলে সবচেয়ে সমৃদ্ধ তথ্যভাণ্ডার যা পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে আজও স্মৃতি হিসাবে আমাদের কাছে বিদ্যমান রয়েছে। আর মানবতার শ্রেষ্ঠ নেতা হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (সা.)-এর জীবনী সংক্রান্ত এ ধরনের ইতিহাস খুব কমই লেখা হয়েছে। অনেক মুসলিম ইতিহাসবিদ ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর মূল পাঠ (Text) রক্ষা করার অজুহাতে (ঐতিহাসিক ঘটনাবলী সংক্রান্ত) যে কোন ধরনের মন্তব্য এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ থেকে বিরত থেকেছেন। অথচ এ ধরনের অজুহাত এ কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য যথেষ্ট নয়। কারণ এ ধরনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সংরক্ষণ করার জন্য তাঁরা দু’ধরনের গ্রন্থ রচনা করতে পারতেন। এক ধরনের গ্রন্থ তাঁরা ইতিহাসের মূল বিষয়বস্তু বর্ণনা করার জন্য নির্দিষ্ট করতে পারতেন এবং কোন ধরনের মন্তব্য ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা থেকে বিরত থাকতেন এবং তাঁরা আরেক ধরনের গ্রন্থে ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সঠিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ বর্ণনা করতে পারতেন অথবা একই গ্রন্থে ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহ থেকে এতৎসংক্রান্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও অভিমতগুলো পৃথকভাবেও লিখতে পারতেন।

যা হোক প্রাচীন যুগের মুসলিম আলেমগণের দ্বারা মহানবী (সা.)-এর বিশ্লেষণধর্মী জীবনচরিত খুব কমই লেখা হয়েছে। কেবল মহানবী (সা.)-এর জীবনী সংক্রান্তই নয়,বরং মন্তব্য ও সূক্ষ্ম আলোচনা ব্যতিরেকেই বিগত শতাব্দীগুলোতে ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহও (ঐতিহাসিক গ্রন্থসমূহে) লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তবে হ্যাঁ,প্রথম যিনি বিশ্বের লেখক সমাজের সামনে এ পথ উন্মুক্ত করেছেন তিনি হলেন মরক্কোর প্রসিদ্ধ আলেম ইবনে খালদুন।1 তিনি তাঁর প্রসিদ্ধ আল মুকাদ্দামাহ্ ওয়াত তারিখ’গ্রন্থে বিশ্লেষণধর্মী ইতিহাসশাস্ত্রের গোড়াপত্তন করেন।

জীবনী সংক্রান্ত দ্বিতীয় ধরনের গ্রন্থসমূহে যদিও ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং গবেষণা ও পর্যালোচনার ছাপ রয়েছে,তবুও যেহেতু কতিপয় রচয়িতা গবেষণা ও অধ্যয়নের কষ্ট স্বীকার করতে চান নি সেহেতু তাঁরা এ সব গ্রন্থে অনির্ভরযোগ্য দলিল-প্রমাণ এবং অশুদ্ধ বিবরণের ভিত্তিতে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার বিচার ও বিশ্লেষণ করেছেন। এর ফলে তাঁরা বিস্ময়কর ভুল-ভ্রান্তির শিকার হয়েছেন। প্রাচ্যবিদদের রচিত অধিকাংশ গ্রন্থ যেগুলো কদাচিৎ সত্য অনুধাবন ও বাস্তবতা উন্মোচন করার জন্য রচিত হয়ে থাকে সেগুলোই হচ্ছে এ ধরনের গ্রন্থের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

উপরিউক্ত ত্রুটিগুলোর দিকে লক্ষ্য রেখেই আমি আমার সামর্থ্য অনুযায়ী এ পুস্তকে এ দু ধরনের গ্রন্থের যে সব ত্রুটি রয়েছে সেগুলো দূর করার চেষ্টা করেছি।

এ গ্রন্থের বৈশিষ্ট্যসমূহ

ভূমিকায় গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠ দিকগুলো উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। এটি এমন এক বিষয় যা শ্রদ্ধেয় পাঠকবর্গ গ্রন্থ পাঠ করার মাধ্যমেই অনুধাবন করতে পারবেন। তবে পাঠকবর্গের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য এ গ্রন্থের দু টি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য এখানে উল্লেখ করতে চাই :

প্রথম বৈশিষ্ট্য : এ গ্রন্থে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এবং যে সব ঘটনা অত্যধিক শিক্ষণীয় সেগুলোই কেবল আলোচনা করেছি এবং অনেক সময় সারীয়ার [মুসলমানদের ঐ সব যুদ্ধকে বলা হয় যেগুলোয় মহানবী (সা.) উপস্থিত ছিলেন না] ন্যায় খুঁটিনাটি ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দান করা থেকে বিরত থেকেছি। আমরা ইসলামের ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল শতাব্দীগুলোতে রচিত নির্ভরযোগ্য অকাট্য ঐতিহাসিক উৎস থেকে সকল ঐতিহাসিক ঘটনা গ্রহণ ও বর্ণনা করেছি। আমরা ঘটনাসমূহের বিবরণ দানকালে আমাদের হাতে যে সব তথ্য ও প্রমাণ বিদ্যমান ছিল সেগুলোর শরণাপন্ন হয়েছি এবং আমরা এ সব তথ্যপ্রমাণের সংক্ষিপ্তসার হিসাবে প্রতিটি ঐতিহাসিক ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছি এবং এ সব তথ্যপ্রমাণের মধ্যে যে দু একটিতে ঘটনার বিশদ বিররণ পাওয়া যায় কেবল সেগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করেছি।

সম্ভবত কতিপয় পাঠক ভাবতে পারেন যে,আমার ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণ দানকালে পাদটীকাসমূহে যে সব প্রামাণ্য উৎসের কথা উল্লেখ করেছি কেবল সেগুলোরই শরণাপন্ন হয়েছি,অথচ বাস্তবতা হচ্ছে এর সম্পূর্ণ বিপরীত,বরং যে কোন ঘটনা তা যত ছোটই হোক না কেন তা বর্ণনাকালে যাবতীয় প্রসিদ্ধ ও মৌলিক প্রামাণ্য উৎস ব্যবহার ও অধ্যয়ন করা হয়েছে এবং নিশ্চিত হবার পরই আমরা যাবতীয় প্রামাণ্য তথ্য,সূত্র ও বিবরণের সংক্ষিপ্তসার হিসাবে ঐতিহাসিক ঘটনা বর্ণনা করেছি।

সকল ঐতিহাসিক ঘটনা বর্ণনা করার ক্ষেত্রে যদি এগুলোর যাবতীয় উৎস উল্লেখ করতাম তাহলে গ্রন্থটির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ প্রমাণপঞ্জি ও তথ্যসূত্রের বিবরণ দ্বারাই ভরে যেত এবং এমতাবস্থায় সকল পাঠকের জন্য বইটি অধ্যয়ন করা খুবই বিরক্তিকর হয়ে যেত। সুধী পাঠক যাতে এ বই পাঠ করতে গিয়ে বিরক্ত ও ক্লান্ত হয়ে না পড়েন এবং আরেক দিক থেকে বইটির মৌলিকত্ব ও বলিষ্ঠতা বজায় থাকে সেজন্য প্রমাণপঞ্জি ও তথ্যসমূহ যতটুকু উল্লেখ করা প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই আমরা এ বইয়ে উল্লেখ করেছি।

দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য : যে সব আলোচনা ও পর্যালোচনা প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য সেগুলোর ক্ষেত্রে আমরা প্রাচ্যবিদদের আপত্তি এবং কখনো কখনো তাঁদের দুরভিসন্ধিগুলোও উল্লেখকরতঃ তাঁদের যাবতীয় অবৈধ ও অযৌক্তিক সমালোচনার সঠিক জবাব দিয়েছি এবং সবাইকে নিরস্ত করেছি। আর এ বিষয়টি শ্রদ্ধেয় পাঠকবর্গের কাছে যথাস্থানে স্পষ্ট হয়ে যাবে বলে আশা করি।

এই একই কারণে শিয়া ও সুন্নী ঐতিহাসিকদের মধ্যে যে সব ক্ষেত্রে মতপার্থক্য বিদ্যমান রয়েছে সে সব ক্ষেত্রে প্রামাণ্য ঐতিহাসিক তথ্য,সাক্ষ্য ও দলিলের ভিত্তিতে শিয়া ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিমতের বিশুদ্ধতা প্রমাণ করেছি এবং শিয়া দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিমতের সত্যতা ও বিশুদ্ধতা সংক্রান্ত যে কোন ধরনের প্রশ্ন,সন্দেহ ও আপত্তির অপনোদনও করেছি।

এ গ্রন্থটি ইতোমধ্যে দারস-ই আয মাকতাবে ইসলাম’নামক একটি সমৃদ্ধ গবেষণা-সাময়িকীতে ধারাবাহিকভাবে প্রবন্ধাকারে প্রকাশিত হয়েছে। তবে কতিপয় শ্রদ্ধেয় পাঠকের অনুরোধ পুনর্বিবেচনা করার পর ধারাবাহিক প্রবন্ধগুলো পূর্ণরূপে একটি নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ আকারে আগ্রহী পাঠকবর্গের কাছে পেশ করা হলো। এ ধরনের গ্রন্থ ফার্সী ভাষায়ও খুবই বিরল।

কোম,হাওযা-ই এলমীয়াহ্

জা ফার সুবহানী

26 জামাদিউস সানী,1392 হি.

15 তীর,1351 (ফার্সী সাল)

প্রথম অধ্যায় : আরব উপদ্বীপ : ইসলামী সভ্যতার সূতিকাগার

দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় অবস্থিত আরব ভূখণ্ড একটি বৃহৎ উপদ্বীপ। এর আয়তন 30,00,000 বর্গ কিলোমিটার অর্থাৎ তা ইরানের প্রায় দ্বিগুণ,ফ্রান্সের 6 গুণ,ইটালীর 10 গুণ এবং সুইজারল্যান্ডের 80 গুণ বড়।

এ উপদ্বীপটি অসমান্তরাল বাহুবিশিষ্ট চতুর্ভূজের ন্যায় এবং উত্তরে ফিলিস্তিন ও সিরিয়ার (শামের) মরুভূমি;পূর্বদিকে হীরা,দজলা,ফোরাত ও পারস্য উপসাগর;দক্ষিণে ভারত মহাসাগর ও ওমান সাগর এবং পশ্চিমে লোহিত সাগর দ্বারা বেষ্টিত।

অতএব,পশ্চিম ও দক্ষিণ দিক থেকে আরব উপদ্বীপ সমুদ্র দ্বারা এবং উত্তর ও পূর্ব দিক থেকে মরুভূমি ও পারস্য উপসাগর দ্বারা বেষ্টিত।

সুদূর অতীতকাল থেকেই এ ভূখণ্ডকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা : 1. উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল যা হিজায’(حجاز ) নামে পরিচিত;2. মধ্য ও পূর্বাঞ্চল যা আরব মরুভূমি’নামে এবং 3. দক্ষিণাঞ্চল যা ইয়েমেন’(يمن ) নামে পরিচিত।

উপদ্বীপের ভিতরে অনেক বড় বড় মরুভূমি এবং তপ্ত ও বসবাসের অযোগ্য বালুকাময়

প্রান্তরও আছে। এ ধরনের একটি মরুভূমি হচ্ছে বাদিয়াতুস্ সামাওয়াহ্ (بادية السّماوة ) মরুভূমি যা আজ নুফূয’(نفوذ ) নামে পরিচিত। পারস্য উপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত আরেকটি বিশাল মরুভূমি আছে যা আর রুবুল খালী’(الربع الخالي ) নামে পরিচিত। অতীতে এ সব মরুভূমির একাংশ আহ্কাফ’(أحقاف ) এবং অপর অংশ দাহানা’(دهنا ) নামে পরিচিত ছিল।

এ সব মরুভূমির কারণে আরব উপদ্বীপের এক-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড পানি ও উদ্ভিদবিহীন হওয়ায় বসবাসের অযোগ্য। কখনো কখনো বৃষ্টিপাতের কারণে মরুভূমির ভিতর অতি অল্প পানি পাওয়া যায়। আর এ কারণে কতিপয় আরব গোত্র অল্প সময়ের জন্য উট ও চতুষ্পদ পশু চরানোর জন্য সেখানে নিয়ে যায়।

আরব উপদ্বীপের জলবায়ু ও আবহাওয়া মরুভূমির আবহাওয়া। মধ্যাঞ্চলীয় এলাকাসমূহ অত্যন্ত উষ্ণ ও শুষ্ক এবং সমুদ্র তীরবর্তী এলাকাসমূহের আবহাওয়া আর্দ্র। আর কিছু কিছু এলাকার আবহাওয়া সমভাবাপন্ন। খারাপ আবহাওয়ার দরুন আরব উপদ্বীপের জনসংখ্যা 1,50,00,000 (দেড় কোটি)-এর বেশি হবে না।

এখানে একটি পর্বতমালা আছে যা দক্ষিণ থেকে উত্তর পর্যন্ত বিস্তৃত। এর সর্বোচ্চ উচ্চতা হচ্ছে 2470 মিটার।

প্রাচীনকাল থেকেই স্বর্ণ,রৌপ্য এবং মূল্যবান পাথরসমূহের খনি ছিল আরব উপদ্বীপের প্রাকৃতিক সম্পদ। পশুর মধ্যে উট ও ঘোড়াই সবচেয়ে বেশি পালন করা হতো। আর পাখির মধ্যে কবুতর ও উটপাখিই অন্যান্য পাখির চেয়ে সংখ্যায় বেশি ছিল।

বর্তমানে আরবের আয় ও সম্পদের প্রধান উৎস হচ্ছে খনিজ তেল ও পেট্রোলিয়াম। যাহরান’(ظهران ) শহর আরব উপদ্বীপের খনিজ তেল ও পেট্রোলিয়ামের কেন্দ্রস্থল। আর এ যাহরান নগরী ইউরোপীয়দের কাছে দাহরান’নামে পরিচিত। এ শহরটি আরবের আল আহসা (الأحساء ) অঞ্চলে পারস্য উপসাগরের তীরে অবস্থিত।

সম্মানিত পাঠকবর্গ যাতে আরব উপদ্বীপের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে সঠিকরূপে অবহিত হতে পারেন সেজন্য আমরা আরবের তিনটি অঞ্চল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব :

1. হিজায : আরব উপদ্বীপের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল হচ্ছে হিজায যা লোহিত সাগরের তীর দিয়ে ফিলিস্তিন থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত বিস্তৃত। হিজায একটি পার্বত্য এলাকা;এর রয়েছে অনুর্বর ও চাষাবাদের অনুপযোগী মরুভূমি এবং প্রচুর প্রস্তরময় ভূমি।

ইতিহাসে হিজায আরবের অন্য সকল এলাকার চেয়ে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। কিন্তু এ সুখ্যাতি যে ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার কারণে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আর বর্তমানে যে কাবা কোটি কোটি মুসলমানের কিবলা’তা এ হিজায এলাকায় অবস্থিত।

পবিত্র কাবার অবস্থান হিজাযের যে অঞ্চলে তা ইসলামের বহু বছর আগে থেকেই আরব ও অনারব জাতিসমূহের কাছে সম্মানিত ছিল। এর সম্মান রক্ষার্থে পবিত্র কাবার নিকটে যুদ্ধ করা নিষিদ্ধ (হারাম) ছিল। আর পবিত্র ধর্ম ইসলামও পবিত্র কাবার জন্য সীমারেখা নির্ধারণ ও এর প্রতি যাথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেছে।

হিজাযের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর মধ্যে পবিত্র মক্কা (مكة ),পবিত্র মদীনা (مدينة ) ও তায়েফ (طائف ) নগরী উল্লেখযোগ্য। অতীতকাল থেকেই হিজাযের দু টি বন্দর আছে : 1. জেদ্দা (جدة ) : পবিত্র মক্কার অধিবাসীরা এটি ব্যবহার করে এবং 2. ইয়ানবূ (ينبوع ) : মদীনাবাসীরা তাদের প্রয়োজনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ এ বন্দরের মাধ্যমে পূরণ করে থাকে। এ দু টি বন্দরই লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত।

পবিত্র মক্কা নগরী

পৃথিবীর সবচেয়ে প্রসিদ্ধ শহরসমূহের একটি হচ্ছে এ মক্কা নগরী। এ নগরী হিজাযের সবচেয়ে জনবহুল শহর। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় 300 মিটার।

যেহেতু পবিত্র মক্কা নগরী দু পর্বতমালার মাঝে অবস্থিত সেহেতু দূর থেকে এ নগরী দৃষ্টিগোচর হয় না। বর্তমানে মক্কা নগরীর লোকসংখ্যা প্রায় দেড় লক্ষ (1,50,000)।

পবিত্র মক্কার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

মক্কা নগরীর ইতিহাস হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর যুগ থেকে শুরু হয়েছে। তিনি তাঁর সন্তান ইসমাঈলকে মা হাজেরার সাথে মক্কায় বসবাসের জন্য পাঠিয়ে দেন। হযরত ইসমাঈল (আ.) মক্কার আশে-পাশে বসবাসকারী গোত্রসমূহের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। হযরত ইবরাহীম (আ.) মহান আল্লাহর নির্দেশে পবিত্র কাবা নির্মাণ করেন। আর কতগুলো বিশুদ্ধ বর্ণনা ও হাদীস অনুযায়ী পবিত্র কাবা-যা ছিল হযরত নূহ (আ.)-এর পুণ্যস্মৃতি তা হযরত ইবরাহীম (আ.) পুনঃনির্মাণ ও সংস্কার করেন। আর এর পর থেকেই মক্কা নগরীতে জনবসতি গড়ে ওঠে।

পবিত্র মক্কা নগরীর চারদিকের ভূমি এতটা লবণাক্ত যে,তা চাষাবাদের অযোগ্য। আর কতিপয় প্রাচ্যবিদের মতে খারাপ ভৌগোলিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ নগরীসদৃশ স্থান পৃথিবীর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।