চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 103691
ডাউনলোড: 9120


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 103691 / ডাউনলোড: 9120
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

হাশিম-এর বিবাহ

আমর খাযরাজীর কন্যা সালমা ছিলেন সম্ভ্রান্ত ও ভদ্র রমণী যিনি স্বামীর কাছ থেকে তালাক নেয়ার পর অন্য কোন পুরুষের সাথে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হতে মোটেও রাজী ছিলেন না। একবার শাম সফর শেষে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করার সময় হাশিম কয়েক দিনের জন্য ইয়াসরিবে যাত্রাবিরতি করেছিলেন এবং তখন তিনি সালমাকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। হাশিমের মহৎ চরিত্র,মহানুভবতা,তাঁর বিত্তবিভব,দানশীলতা এবং কুরাইশদের ওপর তাঁর কথার প্রভাব সালমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং দু টি শর্তে তিনি হাশিমের সাথে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হতে রাজী হন। শর্তদ্বয়ের একটি ছিল এই যে,সন্তান প্রসবের সময় তিনি তাঁর গোত্রের কাছে থাকবেন। আর এই শর্তের কারণে মক্কায় হাশিমের সাথে কিছুদিন বসবাস করার পর যখন অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পেল তখন তিনি ইয়াসরিবে প্রত্যাবর্তন করলেন এবং সেখান একটি পুত্রসন্তান প্রসব করলেন যাঁর নাম রাখলেন শাইবাহ্। এ সন্তানই পরবর্তীকালে আবদুল মুত্তালিব নামে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। ঐতিহাসিকগণ তাঁর এ উপাধি লাভ করার কারণ সম্পর্কে ঠিক এ রকম লিখেছেন :

“যখন হাশিম বুঝতে পারলেন যে,তাঁর জীবনের অন্তিম সময় ঘনিয়ে আসছে তখন তিনি তাঁর ভাই মুত্তালিবকে বলেছিলেন : তোমার দাস শাইবাকে অবশ্য অবশ্যই দেখবে। যেহেতু হাশিম (শাইবার পিতা) তাঁর নিজ সন্তানকে মুত্তালিবের দাস বলেছেন এ কারণে তিনি (শাইবাহ্) আবদুল মুত্তালিব’নামে প্রসিদ্ধ হয়ে যান।”

কখনো কখনো তাঁরা বলেছেন, একদিন একজন মক্কাবাসী ইয়াসরিবের সড়কগুলো অতিক্রম করছিল। তখন সে দেখতে পেল যে,অনেক বালক তীর নিক্ষেপ করছে। যখন একটি বালক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হলো তখন সে তৎক্ষণাৎ বলে উঠল : আমি বাতহার নেতার পুত্র। ঐ মক্কাবাসী লোকটি সামনে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল : তুমি কে? তখন সে উত্তরে শুনতে পেল : শাইবাহ্ ইবনে হাশিম ইবনে আবদে মান্নাফ।”

ঐ লোকটি ইয়াসরিব থেকে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করার পর হাশিমের ভ্রাতা ও মক্কা শহরের প্রধান মুত্তালিবের কাছে পুরো ঘটনাটি খুলে বলল। চাচা (মুত্তালিব) তখন আপন ভ্রাতুষ্পুত্রের কথা চিন্তা করতে লাগলেন। এ কারণেই তিনি ইয়াসরিবের উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। ভ্রাতুষ্পুত্রের চেহারা দেখে মুত্তালিবের দু চোখে ভাই হাশিমের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠল,তাঁর দু চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। অত্যন্ত আবেগ,উষ্ণতা ও উদ্দীপনাসহকারে চাচা-ভাতিজা একে অপরকে চুম্বন করলেন। মুত্তালিব ভাতিজাকে মক্কায় নিয়ে যেতে চাইলে শাইবার মা সালমার তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হন। সবশেষে মুত্তালিবের আশা বাস্তবায়িত হলো। মায়ের কাছ থেকে অনুমতি পাবার পর শাইবাকে নিজ অশ্বের পিঠে বসিয়ে মুত্তালিব মক্কাভিমুখে রওয়ানা হলেন। আরবের প্রখর রৌদ্র ভাতিজা শাইবার রূপালী মুখমণ্ডলকে ঝলসে দিয়েছিল এবং তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদও প্রখর তাপে মলিন ও জীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। এ কারণেই মক্কাবাসীরা মক্কায় মুত্তালিবের প্রবেশের সময় ধারণা করল যে,অশ্বারোহী বালকটি মুত্তালিবের দাস। মুত্তালিব যদিও বারবার বলেছিলেন, হে লোকসকল! এ আমার ভাতিজা’,তবুও মানুষের ধারণা ও কথাই শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। পরিণতিতে মুত্তালিবের ভাতিজা শাইবাহ্ আবদুল মুত্তালিব’উপাধিতেই প্রসিদ্ধি লাভ করলেন।103

কখনো কখনো বলা হয় যে,শাইবাকে আবদুল মুত্তালিব’বলে অভিহিত করার কারণ ছিল এই যে,যেহেতু তিনি স্নেহশীল চাচা মুত্তালিবের তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হয়েছিলেন এবং আরবদের প্রচলিত রীতিনীতিতে পালনকারীর অবদান ও পৃষ্ঠপোষকতার কারণে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য এ ধরনের ব্যক্তিদেরকে (যারা পালিত হতো) পালনকারীর দাস বা গোলাম বলে অভিহিত করা হতো।

5. আবদুল মুত্তালিব

হাশিমের পুত্র আবদুল মুত্তালিব ছিলেন মহানবী (সা.)-এর পিতামহ,কুরাইশ গোত্রের অবিসংবাদিত নেতা ও বিরল ব্যক্তিত্ব। তাঁর গোটা সামাজিক জীবনটিই ছিল আলোকময় ঘটনাবলীতে পরিপূর্ণ। যেহেতু তাঁর নেতৃত্বকালীন ঘটনাবলীর সাথে ইসলামের ইতিহাসের অত্যন্ত গভীর সম্পর্ক আছে সেহেতু তাঁর জীবনের কতিপয় ঘটনা আমরা এখানে আলোচনা করব :

নিঃসন্দেহে মানুষের আত্মা যতই শক্তিশালী হোক না কেন পরিণামে সে খানিকটা হলেও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং পরিবেশ ও সমাজের রীতিনীতি তার চিন্তাধারায় অতি সামান্য হলেও প্রভাব বিস্তার করে থাকে। তবে কখনো কখনো এমন কিছু ব্যক্তি আবির্ভূত হন যাঁরা পূর্ণ সাহসিকতার সাথে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের বিভিন্ন প্রভাবকে প্রতিরোধ ও মোকাবিলা করেন এবং যে কোন ধরনের দূষণ দ্বারা বিন্দুমাত্র দূষিত হন না,বরং নিজেদেরকে তা থেকে পবিত্র ও মুক্ত রাখেন।

আমাদের আলোচিত বীরপুরুষ (আবদুল মুত্তালিব) এ ধরনের ব্যক্তিদের অন্যতম পূর্ণ নমুনা। তাঁর সমগ্র জীবন অগণিত আলোকমালায় উদ্ভাসিত। কোন ব্যক্তি আশি বছরের অধিককাল এমন এক সমাজ ও পরিবেশে বসবাস করেও মূর্তিপূজা,মদপান,সুদ খাওয়া,নরহত্যা ও অসৎ কার্যকলাপ ঐ সমাজের পূর্ব থেকে প্রতিষ্ঠিত রীতি-নীতি বলে গণ্য হওয়া সত্ত্বেও সমগ্র জীবনে যদি একবারও মদপান না করে থাকেন,জনগণকে নরহত্যা,মদ্যপান ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখেন,যাদের সাথে বিবাহ নিষিদ্ধ তাদেরকে বিবাহ করা এবং উলঙ্গ দেহে তাওয়াফ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখেন এবং জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজ মানত ও প্রতিজ্ঞার প্রতি অটল ও নিষ্ঠাবান থাকেন তাহলে এ ব্যক্তিটি অবশ্যই ঐ সব আদর্শবান ব্যক্তির অন্তর্ভুক্ত হবেন যাঁদেরকে সমাজে খুব কমই দেখা যায়।

হ্যাঁ,যে ব্যক্তির ঔরসে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র নূর আমানত হিসাবে রাখা হয়েছিল,তিনি অবশ্যই সব ধরনের পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হবেন।

তাঁর সংক্ষিপ্ত জ্ঞানগর্ভমূলক বাণী,ঘটনা ও কাহিনীসমূহ থেকে প্রতিভাত হয় যে,তিনি ঐ অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে থেকেও একত্ববাদী ও পরকালে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি সর্বদা বলতেন, জালেম ব্যক্তি এই ইহলৌকিক জীবনেই কৃতকর্মের শাস্তি পায়। আর ঘটনাক্রমে যদি তার ইহলৌকিক জীবন শেষ হয়ে যায় এবং তার কৃতকর্মের শাস্তি না পায়,তাহলে সে পরকালে শেষবিচার দিবসে অবশ্যই তার কৃতকর্মের সাজাপ্রাপ্ত হবে। 104

হারব ইবনে উমাইয়্যাহ্ আবদুল মুত্তালিবের নিকটাত্মীয় ছিল এবং সে কুরাইশ গোত্রের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হতো। এক ইয়াহুদী তার প্রতিবেশী ছিল। এই ইয়াহুদী একদিন ঘটনাক্রমে তিহামার একটি বাজারে অত্যন্ত নিষ্ঠুর আচরণ প্রদর্শন করে এবং তার ও হারবের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। অবস্থা এতদূর গড়ালো যে,হারবের প্ররোচনায় ঐ ইয়াহুদী নিহত হয়। আবদুল মুত্তালিব ব্যাপারটি জানতে পেরে হারবের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করলেন এবং তার কাছ থেকে ঐ ইয়াহুদীর রক্তমূল্য আদায় করে তা নিহতের আত্মীয়-স্বজনের নিকট পৌঁছে দিলেন। এ ছোট কাহিনী থেকে এ মহান ব্যক্তির দুর্বল-অত্যাচারিতদের রক্ষা ন্যায়পরায়ণতার এক অত্যুজ্জ্বল মনোবৃত্তিই প্রমাণিত হয়।

যমযম কূপ খনন

যে দিন যমযম কূপের উদ্ভব হয়েছিল সে দিন থেকেই জুরহুম গোত্র ঐ কূপের চারপাশে বসতি স্থাপন করেছিল এবং পবিত্র মক্কা নগরীর শাসনকর্তৃত্ব দীর্ঘ দিন তাদের হাতেই ছিল। তারা উক্ত কূপের পানি নিজেদের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করত। কিন্তু পবিত্র মক্কা নগরীতে ব্যবসায় ও জনগণের আমোদ-প্রমোদের প্রসার ঘটলে তাদের শৈথিল্য,উদাসীনতা এবং চারিত্রিক দুর্বলতা ধীরে ধীরে এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয় যে,এর ফলে যমযম কূপের পানি শুষ্ক হয়ে যায়।105

কখনো কখনো বলা হয় যে,জুরহুম গোত্র খুযাআহ্ গোত্রের হুমকির সম্মুখীন হয়ে নিজেদের আবাসস্থল ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। সেহেতু জুরহুম গোত্রপতি মাদ্দাদ ইবনে আমর নিশ্চিত বিশ্বাস করত যে,অতি শীঘ্রই সে তার নেতৃত্ব হারাবে এবং শত্রুদের আক্রমণে তার রাজ্য ও শাসনকর্তৃত্ব ধ্বংস হয়ে যাবে। এ কারণে সে পবিত্র মক্কার জন্য হাদিয়াস্বরূপ স্বর্ণনির্মিত যে দু টি হরিণ এবং খুব দামী যে কয়টি তলোয়ার আনা হয়েছিল তা যমযম কূপে নিক্ষেপ করে কূপটি মাটি দিয়ে ভরাট করে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল যাতে করে শত্রুরা এ মহামূল্যবান সম্পদ ব্যবহার করতে না পারে। এর কিছুদিন পরেই খুযাআহ্ গোত্রের আক্রমণ শুরু হয়। এর ফলে জুরহুম গোত্র এবং হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর অনেক বংশধরই পবিত্র মক্কা নগরী ত্যাগ করে ইয়েমেনের দিকে গমন করতে বাধ্য হয়। তাদের মধ্য থেকে আর কোন ব্যক্তি মক্কায় ফিরে আসে নি। এরপর থেকে মহানবী (সা.)-এর চতুর্থ ঊর্ধ্বতন পূর্বপুরুষ কুসাই বিন কিলাবের শাসনকর্তৃত্ব অর্জন করার মাধ্যমে কুরাইশদের জীবনাকাশে সৌভাগ্য-তারার উদয় হওয়া পর্যন্ত পবিত্র মক্কা নগরীর শাসনকর্তৃত্ব খুযাআহ্ গোত্রের হাতে থেকে যায়। কিছুকাল পরে শাসনকর্তৃত্ব আবদুল মুত্তালিবের হাতে চলে আসে। তিনি যমযম কূপ পুনরায় খনন করার সিদ্ধান্ত নেন। তবে তখনও যমযম কূপের আসল অবস্থান সূক্ষ্মভাবে কেউ জানত না। অনেক অনুসন্ধান চালানোর পর তিনি যমযম কূপের প্রকৃত অবস্থান সম্পর্কে তথ্য পেলেন এবং নিজ পুত্র হারেসকে নিয়ে কূপ খননের পূর্বপ্রস্তুতি সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

সাধারণত প্রতিটি গোত্র বা সমাজেই এমন কিছু মুষ্টিমেয় লোক পাওয়া যাবে যারা সব সময় যে কোন ভালো কাজ বাধাগ্রস্ত করার জন্য যে কোন ধরনের নেতিবাচক অজুহাত খুঁজে বেড়ায়। এ কারণেই আবদুল মুত্তালিবের প্রতিদ্বন্দ্বীরা ঘোর আপত্তি জানাতে থাকে যাতে করে তিনি এ বিরল সম্মান ও গৌরবের অধিকারী না হতে পারেন। তারা আবদুল মুত্তালিবকে লক্ষ্য করে বলেছিল, হে কুরাইশপ্রধান! যেহেতু এ কূপ আমাদের পূর্বপুরুষ হযরত ইসমাঈলের পুণ্যস্মৃতি এবং আমরা সবাই যেহেতু তাঁরই বংশধর তাই আমাদের সবাইকে এ কাজে শরীক করুন। বিশেষ কতিপয় কারণে হযরত আবদুল মুত্তালিব তাদের কথা মেনে নিলেন না। কারণ তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এটিই যে,তিনি একাই এ কূপটি খনন করবেন এবং এর পানি বিনামূল্যে সকলের হাতে ছেড়ে দেবেন। আর এভাবেই বাইতুল্লাহ্ যিয়ারতকারী হাজীদের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানিরও সুব্যবস্থা হয়ে যাবে। হাজীদের পানির বন্দোবস্ত করার বিষয়টি তাঁর তত্ত্বাবধানে থাকার কারণে তা সব ধরনের অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা থেকে মুক্ত হবে।

যখন তিনি স্বাধীনভাবে এ কাজের গুরুদায়িত্ব নিজ হাতে নেবেন ঠিক তখনই এ বিষয়টির পূর্ণ নিশ্চয়তা বিধান করা সম্ভব হবে।

অবশেষে তাঁরা একটি তীব্র বিরোধ ও টানাপড়েনের সম্মুখীন হলেন। আরবের একজন জ্ঞানী ভাববাদীর কাছে যাওয়া এবং এ ব্যাপারে তার বিচার মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। আবদুল মুত্তালিব ও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা সফরের উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। তাঁরা হিজায ও শামের মধ্যবর্তী ফুল-ফল,পত্র-পল্লবহীন ধূসর মরু এলাকাগুলো একের পর এক অতিক্রম করতে লাগলেন। পথিমধ্যে তাঁরা অত্যন্ত পিপাসার্ত ও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন এবং ধীরে ধীরে তাঁদের বিশ্বাস জন্মেছিল যে,তাঁরা তাঁদের অন্তিম মুহূর্তগুলো অতিবাহিত করছেন। এ কারণেই তাঁরা যখন মৃত্যুর কথা চিন্তা করতে থাকেন,তখন আবদুল মুত্তালিব এ অভিমত ব্যক্ত করলেন যে,প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজ কবর খনন করুক। যখন তার মৃত্যু হবে তখন অন্যরা তার মৃতদেহ উক্ত কবরে শায়িত করবে। আর এভাবে যদি পানি পাওয়া না যায় এবং সকলের তৃষ্ণা অব্যাহত থাকে এবং সবাই মৃত্যুবরণ করে তাহলে এভাবে সকলেই (কেবল শেষ ব্যক্তি ব্যতীত) কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত হবে এবং তাদের মৃতদেহ হিংস্র প্রাণী ও পাখির খাদ্যবস্তুতে পরিণত হবে না।

আবদুল মুত্তালিবের অভিমত সকলের কাছে মনঃপূত হলো। প্রতিটি ব্যক্তি তার নিজের কবর খনন করল এবং সকলেই বিষণ্ণ বদনে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। হঠাৎ করে আবদুল মুত্তালিব উচ্চকণ্ঠে বললেন, হে লোকসকল! এটি এমনই এক মৃত্যু যা হীনতা ও দীনতা বয়ে আনে। তাই এটি কতই না উত্তম যে,আমরা সবাই দলবদ্ধ হয়ে এ মরুভূমির চারপাশে পানির অন্বেষণে ঘুরে বেড়াব! আশা করা যায় যে,মহান আল্লাহ্পাকের অনুগ্রহ ও কৃপার দৃষ্টি আমাদের ওপর পতিত হবে। 106 সবাই পশুর পিঠে আরোহণ করে হতাশা নিয়ে পথ চলতে লাগল এবং তখন তারা একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিল। ঘটনাক্রমে সবাই অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে সুমিষ্ট পানির সন্ধান পেয়ে গেল এবং তারা সবাই মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেল। এরপর তারা যে পথে এসেছিল সে পথেই পবিত্র কাবার দিকে ফিরে গেল এবং পূর্ণ সন্তুষ্টচিত্তে যমযম কূপ খনন করার ব্যাপারে আবদুল মুত্তালিবের অভিমতের সাথে একমত পোষণ করল এবং সম্মত হলো।107

আবদুল মুত্তালিব একমাত্র পুত্রসন্তান হারেসকে সাথে নিয়ে কূপ খননে মশগুল হয়ে যান। খনন কার্য চালানোর ফলে কূপের চারদিকে মাটির একটি প্রকাণ্ড ঢিবি তৈরি হয়েছিল। হঠাৎ করে তিনি স্বর্ণনির্মিত দু টি হরিণ এবং কয়েকটি তলোয়ারের সন্ধান পান। কুরাইশগণ নতুন করে হৈ চৈ শুরু করে দিল এবং সকলেই প্রাপ্ত গুপ্তধনে নিজেদের অংশ আছে বলে দাবি করতে লাগল। তারা তাদের মাঝে লটারী করার সিদ্ধান্ত নিল। ঘটনাক্রমে লটারীতে ঐ দু টি স্বর্ণনির্মিত হরিণ এবং তরবারিগুলো যথাক্রমে পবিত্র কাবা ও আবদুল মুত্তালিবের নামেই উঠল। কুরাইশদের নামে লটারীতে কিছুই উঠল না এবং এ কারণে তারা উক্ত গুপ্তধন থেকে কোন অংশ পেল না। মহামতি আবদুল মুত্তালিব উক্ত তরবারিগুলো দিয়ে পবিত্র কাবার একটি দরজা নির্মাণ করে হরিণ দু টি ঐ দরজার ওপর স্থাপন করেছিলেন।

চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্দেশ্যে আত্মত্যাগ ও নিষ্ঠা

যদিও অন্ধকার যুগের আরবগণ ছিল চরম নৈতিক অবক্ষয়ের শিকার এবং চরমভাবে অধঃপতিত তবুও তাদের মধ্যে কতিপয় চারিত্রিক গুণ ছিল যা প্রশংসনীয়। যেমন চুক্তি ভঙ্গ করা তাদের কাছে সবচেয়ে ঘৃণ্য ও খারাপ কাজ বলে গণ্য হতো। কখনো কখনো আরব গোত্রগুলো নিজেদের মধ্যে অত্যন্ত কঠিন চুক্তি সম্পাদন করত এবং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সেগুলো মেনে চলত। কখনো কখনো তারা শক্তি নিঃশেষকারী নজর করত এবং চরম কষ্ট ও প্রাণান্তকর পরিশ্রমসহকারে তা বাস্তবায়ন করার ব্যাপারে চেষ্টা করত।

আবদুল মুত্তালিব যমযম কূপ খনন করার সময় উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে,বেশি সন্তান না থাকার কারণে কুরাইশদের মধ্যে তিনি দুর্বল ও অক্ষম। এ কারণেই তিনি নজর করেছিলেন যে,যখনই তিনি দশ সন্তানের পিতা হবেন তখন তিনি কাবা গৃহের সামনে যে কোন একজনকে কোরবানী করবেন। তিনি তাঁর এ নজর সম্পর্কে কাউকে অবহিত করেন নি। কিছুকাল পরে তাঁর সন্তানের সংখ্যা দশ হলে তাঁর নজর পূর্ণ করার সময়ও উপস্থিত হলো। আবদুল মুত্তালিবের জন্য এ বিষয়টি চিন্তা করা অত্যন্ত কঠিন ছিল। তবে তাঁর মধ্যে ভয়ও কাজ করছিল যে,পাছে তিনি যদি তাঁর এ নজর আদায় করার ক্ষেত্রে সফল না হন তাহলে এর পরিণতিতে তিনি প্রতিজ্ঞা ভঙ্গকারীদের কাতারে শামিল হয়ে যাবেন। এ কারণেই সন্তানদের সাথে বিষয়টি উত্থাপন ও আলোচনা এবং তাঁদের সম্মতি ও সন্তুষ্টি আদায় করার পর লটারীর মাধ্যমে তাঁদের মধ্য থেকে একজনকে কোরবানীর জন্য মনোনীত করবেন।108

লটারীর আয়োজন করা হলো। লটারীতে মহানবী (সা.)-এর পিতা হযরত আবদুল্লাহ্-এর নাম উঠলে আবদুল মুত্তালিব তৎক্ষণাৎ তাঁর হাত ধরে তাঁকে কোরবানী করার স্থানে নিয়ে গেলেন। কুরাইশ গোত্রের নর-নারীরা উক্ত নজর ও লটারী সম্পর্কে অবগত হলে যুবকদের চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। এক যুবক তখন বলছিল, হায় যদি এ যুবকের বদলে আমাকে জবাই করা হতো!

কুরাইশ দলপতিগণ বলতে লাগল, যদি আবদুল্লাহর পরিবর্তে সম্পদ উৎসর্গ করা যায় তাহলে আমরা আমাদের ধন-সম্পদ তার অধিকারে ছেড়ে দিতে প্রস্তুত আছি।” আবদুল মুত্তালিব জনতার আবেগ ও অনুভূতির উত্তাল তরঙ্গমালার সামনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন এবং চিন্তা করতে লাগলেন পাছে যদি তাঁর অঙ্গীকার ভঙ্গ হয়ে যায়,এতদ্সত্ত্বেও তিনি এর একটি উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে লাগলেন। তাদের মধ্যে থেকে একজন বলল, এ সমস্যাটি আরবের একজন জ্ঞানী ব্যক্তির কাছে উত্থাপন করুন,তাহলে এ ব্যাপারে তিনি একটি পথ বাতলে দিতে পারবেন।” আবদুল মুত্তালিব এবং কুরাইশ নেতৃবর্গ এ প্রস্তাবে সম্মত হলেন এবং ইয়াসরিবের উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। সেখানে ঐ জ্ঞানী ব্যক্তি বসবাস করতেন। সমস্যার সমাধান দেয়ার জন্য তিনি একদিন সময় চাইলেন। পরের দিন সবাই তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হলে তিনি বললেন, আপনাদের নিকট একজন লোকের রক্তমূল্য কত? তখন তাঁরা বললেন, 10টি উট।” গণক বললেন, দশটি উট ও যে ব্যক্তিকে আপনার কোরবানীর জন্য মনোনীত করেছেন তার মধ্যে লটারী করবেন। লটারীতে ঐ ব্যক্তির নাম উঠলে উটগুলোর সংখ্যা দ্বিগুণ করবেন এবং পুনরায় উটগুলো ও ঐ ব্যক্তির  মধ্যে লটারী করুন। এতে যদি লটারীতে পুনরায় ঐ ব্যক্তির নাম আসে তাহলে উটগুলোর সংখ্যা তিনগুণ করুন এবং পুনরায় ঐ ব্যক্তি ও উটগুলোর মধ্যে লটারী করুন। আর এভাবে লটারীতে উটগুলোর নাম ওঠা পর্যন্ত লটারী করে যান।

গণকের এ প্রস্তাব জনতার আবেগ-অনুভূতি ও উৎকণ্ঠাকে মুহূর্তের মধ্যে বিলীন করে দিল। কারণ আবদুল্লাহর মতো যুবককে রক্তাক্ত দেখার চাইতে তাদের কাছে শত শত উট কোরবানী করা অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল। মক্কায় ফেরার পর একদিন প্রকাশ্যে সকলের মাঝে লটারী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। দশম বারে উটসংখ্যা 100-এ উপনীত হলে লটারীতে উটগুলোর নাম উঠল। আবদুল্লাহর জবাই থেকে মুক্তি প্রাপ্তি এক অভিনব আবেগ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করল। কিন্তু আবদুল মুত্তালিব তখন বললেন, আমার স্রষ্টা এ কাজে পূর্ণ সন্তুষ্ট আছেন এ বিষয়টি নিশ্চিতরূপে না জানা পর্যন্ত আমি অবশ্যই লটারীটির পুনরাবৃত্তি করব।” তিনি তিন বার লটারী করলেন এবং তিন বারই উটগুলোর নাম উঠল। এভাবে তিনি পূর্ণরূপে নিশ্চিত হতে পারলেন যে,মহান আল্লাহ্ এ ব্যাপারে সন্তুষ্ট আছেন। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত উটগুলো থেকে 100টি উট কাবাগৃহের সামনে জবাই করার এবং কোন ব্যক্তি বা পশুকে তা ভক্ষণ করা থেকে বাধা না দেয়ার নির্দেশ দিলেন।109