চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড3%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 108640 / ডাউনলোড: 10077
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

হাশিম-এর বিবাহ

আমর খাযরাজীর কন্যা সালমা ছিলেন সম্ভ্রান্ত ও ভদ্র রমণী যিনি স্বামীর কাছ থেকে তালাক নেয়ার পর অন্য কোন পুরুষের সাথে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হতে মোটেও রাজী ছিলেন না। একবার শাম সফর শেষে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করার সময় হাশিম কয়েক দিনের জন্য ইয়াসরিবে যাত্রাবিরতি করেছিলেন এবং তখন তিনি সালমাকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। হাশিমের মহৎ চরিত্র,মহানুভবতা,তাঁর বিত্তবিভব,দানশীলতা এবং কুরাইশদের ওপর তাঁর কথার প্রভাব সালমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং দু টি শর্তে তিনি হাশিমের সাথে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হতে রাজী হন। শর্তদ্বয়ের একটি ছিল এই যে,সন্তান প্রসবের সময় তিনি তাঁর গোত্রের কাছে থাকবেন। আর এই শর্তের কারণে মক্কায় হাশিমের সাথে কিছুদিন বসবাস করার পর যখন অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পেল তখন তিনি ইয়াসরিবে প্রত্যাবর্তন করলেন এবং সেখান একটি পুত্রসন্তান প্রসব করলেন যাঁর নাম রাখলেন শাইবাহ্। এ সন্তানই পরবর্তীকালে আবদুল মুত্তালিব নামে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। ঐতিহাসিকগণ তাঁর এ উপাধি লাভ করার কারণ সম্পর্কে ঠিক এ রকম লিখেছেন :

“যখন হাশিম বুঝতে পারলেন যে,তাঁর জীবনের অন্তিম সময় ঘনিয়ে আসছে তখন তিনি তাঁর ভাই মুত্তালিবকে বলেছিলেন : তোমার দাস শাইবাকে অবশ্য অবশ্যই দেখবে। যেহেতু হাশিম (শাইবার পিতা) তাঁর নিজ সন্তানকে মুত্তালিবের দাস বলেছেন এ কারণে তিনি (শাইবাহ্) আবদুল মুত্তালিব’নামে প্রসিদ্ধ হয়ে যান।”

কখনো কখনো তাঁরা বলেছেন, একদিন একজন মক্কাবাসী ইয়াসরিবের সড়কগুলো অতিক্রম করছিল। তখন সে দেখতে পেল যে,অনেক বালক তীর নিক্ষেপ করছে। যখন একটি বালক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হলো তখন সে তৎক্ষণাৎ বলে উঠল : আমি বাতহার নেতার পুত্র। ঐ মক্কাবাসী লোকটি সামনে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল : তুমি কে? তখন সে উত্তরে শুনতে পেল : শাইবাহ্ ইবনে হাশিম ইবনে আবদে মান্নাফ।”

ঐ লোকটি ইয়াসরিব থেকে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করার পর হাশিমের ভ্রাতা ও মক্কা শহরের প্রধান মুত্তালিবের কাছে পুরো ঘটনাটি খুলে বলল। চাচা (মুত্তালিব) তখন আপন ভ্রাতুষ্পুত্রের কথা চিন্তা করতে লাগলেন। এ কারণেই তিনি ইয়াসরিবের উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। ভ্রাতুষ্পুত্রের চেহারা দেখে মুত্তালিবের দু চোখে ভাই হাশিমের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠল,তাঁর দু চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। অত্যন্ত আবেগ,উষ্ণতা ও উদ্দীপনাসহকারে চাচা-ভাতিজা একে অপরকে চুম্বন করলেন। মুত্তালিব ভাতিজাকে মক্কায় নিয়ে যেতে চাইলে শাইবার মা সালমার তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হন। সবশেষে মুত্তালিবের আশা বাস্তবায়িত হলো। মায়ের কাছ থেকে অনুমতি পাবার পর শাইবাকে নিজ অশ্বের পিঠে বসিয়ে মুত্তালিব মক্কাভিমুখে রওয়ানা হলেন। আরবের প্রখর রৌদ্র ভাতিজা শাইবার রূপালী মুখমণ্ডলকে ঝলসে দিয়েছিল এবং তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদও প্রখর তাপে মলিন ও জীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। এ কারণেই মক্কাবাসীরা মক্কায় মুত্তালিবের প্রবেশের সময় ধারণা করল যে,অশ্বারোহী বালকটি মুত্তালিবের দাস। মুত্তালিব যদিও বারবার বলেছিলেন, হে লোকসকল! এ আমার ভাতিজা’,তবুও মানুষের ধারণা ও কথাই শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। পরিণতিতে মুত্তালিবের ভাতিজা শাইবাহ্ আবদুল মুত্তালিব’উপাধিতেই প্রসিদ্ধি লাভ করলেন।১০৩

কখনো কখনো বলা হয় যে,শাইবাকে আবদুল মুত্তালিব’বলে অভিহিত করার কারণ ছিল এই যে,যেহেতু তিনি স্নেহশীল চাচা মুত্তালিবের তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হয়েছিলেন এবং আরবদের প্রচলিত রীতিনীতিতে পালনকারীর অবদান ও পৃষ্ঠপোষকতার কারণে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য এ ধরনের ব্যক্তিদেরকে (যারা পালিত হতো) পালনকারীর দাস বা গোলাম বলে অভিহিত করা হতো।

৫. আবদুল মুত্তালিব

হাশিমের পুত্র আবদুল মুত্তালিব ছিলেন মহানবী (সা.)-এর পিতামহ,কুরাইশ গোত্রের অবিসংবাদিত নেতা ও বিরল ব্যক্তিত্ব। তাঁর গোটা সামাজিক জীবনটিই ছিল আলোকময় ঘটনাবলীতে পরিপূর্ণ। যেহেতু তাঁর নেতৃত্বকালীন ঘটনাবলীর সাথে ইসলামের ইতিহাসের অত্যন্ত গভীর সম্পর্ক আছে সেহেতু তাঁর জীবনের কতিপয় ঘটনা আমরা এখানে আলোচনা করব :

নিঃসন্দেহে মানুষের আত্মা যতই শক্তিশালী হোক না কেন পরিণামে সে খানিকটা হলেও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং পরিবেশ ও সমাজের রীতিনীতি তার চিন্তাধারায় অতি সামান্য হলেও প্রভাব বিস্তার করে থাকে। তবে কখনো কখনো এমন কিছু ব্যক্তি আবির্ভূত হন যাঁরা পূর্ণ সাহসিকতার সাথে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের বিভিন্ন প্রভাবকে প্রতিরোধ ও মোকাবিলা করেন এবং যে কোন ধরনের দূষণ দ্বারা বিন্দুমাত্র দূষিত হন না,বরং নিজেদেরকে তা থেকে পবিত্র ও মুক্ত রাখেন।

আমাদের আলোচিত বীরপুরুষ (আবদুল মুত্তালিব) এ ধরনের ব্যক্তিদের অন্যতম পূর্ণ নমুনা। তাঁর সমগ্র জীবন অগণিত আলোকমালায় উদ্ভাসিত। কোন ব্যক্তি আশি বছরের অধিককাল এমন এক সমাজ ও পরিবেশে বসবাস করেও মূর্তিপূজা,মদপান,সুদ খাওয়া,নরহত্যা ও অসৎ কার্যকলাপ ঐ সমাজের পূর্ব থেকে প্রতিষ্ঠিত রীতি-নীতি বলে গণ্য হওয়া সত্ত্বেও সমগ্র জীবনে যদি একবারও মদপান না করে থাকেন,জনগণকে নরহত্যা,মদ্যপান ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখেন,যাদের সাথে বিবাহ নিষিদ্ধ তাদেরকে বিবাহ করা এবং উলঙ্গ দেহে তাওয়াফ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখেন এবং জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজ মানত ও প্রতিজ্ঞার প্রতি অটল ও নিষ্ঠাবান থাকেন তাহলে এ ব্যক্তিটি অবশ্যই ঐ সব আদর্শবান ব্যক্তির অন্তর্ভুক্ত হবেন যাঁদেরকে সমাজে খুব কমই দেখা যায়।

হ্যাঁ,যে ব্যক্তির ঔরসে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র নূর আমানত হিসাবে রাখা হয়েছিল,তিনি অবশ্যই সব ধরনের পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হবেন।

তাঁর সংক্ষিপ্ত জ্ঞানগর্ভমূলক বাণী,ঘটনা ও কাহিনীসমূহ থেকে প্রতিভাত হয় যে,তিনি ঐ অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে থেকেও একত্ববাদী ও পরকালে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি সর্বদা বলতেন, জালেম ব্যক্তি এই ইহলৌকিক জীবনেই কৃতকর্মের শাস্তি পায়। আর ঘটনাক্রমে যদি তার ইহলৌকিক জীবন শেষ হয়ে যায় এবং তার কৃতকর্মের শাস্তি না পায়,তাহলে সে পরকালে শেষবিচার দিবসে অবশ্যই তার কৃতকর্মের সাজাপ্রাপ্ত হবে। ১০৪

হারব ইবনে উমাইয়্যাহ্ আবদুল মুত্তালিবের নিকটাত্মীয় ছিল এবং সে কুরাইশ গোত্রের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হতো। এক ইয়াহুদী তার প্রতিবেশী ছিল। এই ইয়াহুদী একদিন ঘটনাক্রমে তিহামার একটি বাজারে অত্যন্ত নিষ্ঠুর আচরণ প্রদর্শন করে এবং তার ও হারবের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। অবস্থা এতদূর গড়ালো যে,হারবের প্ররোচনায় ঐ ইয়াহুদী নিহত হয়। আবদুল মুত্তালিব ব্যাপারটি জানতে পেরে হারবের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করলেন এবং তার কাছ থেকে ঐ ইয়াহুদীর রক্তমূল্য আদায় করে তা নিহতের আত্মীয়-স্বজনের নিকট পৌঁছে দিলেন। এ ছোট কাহিনী থেকে এ মহান ব্যক্তির দুর্বল-অত্যাচারিতদের রক্ষা ন্যায়পরায়ণতার এক অত্যুজ্জ্বল মনোবৃত্তিই প্রমাণিত হয়।

যমযম কূপ খনন

যে দিন যমযম কূপের উদ্ভব হয়েছিল সে দিন থেকেই জুরহুম গোত্র ঐ কূপের চারপাশে বসতি স্থাপন করেছিল এবং পবিত্র মক্কা নগরীর শাসনকর্তৃত্ব দীর্ঘ দিন তাদের হাতেই ছিল। তারা উক্ত কূপের পানি নিজেদের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করত। কিন্তু পবিত্র মক্কা নগরীতে ব্যবসায় ও জনগণের আমোদ-প্রমোদের প্রসার ঘটলে তাদের শৈথিল্য,উদাসীনতা এবং চারিত্রিক দুর্বলতা ধীরে ধীরে এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয় যে,এর ফলে যমযম কূপের পানি শুষ্ক হয়ে যায়।১০৫

কখনো কখনো বলা হয় যে,জুরহুম গোত্র খুযাআহ্ গোত্রের হুমকির সম্মুখীন হয়ে নিজেদের আবাসস্থল ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। সেহেতু জুরহুম গোত্রপতি মাদ্দাদ ইবনে আমর নিশ্চিত বিশ্বাস করত যে,অতি শীঘ্রই সে তার নেতৃত্ব হারাবে এবং শত্রুদের আক্রমণে তার রাজ্য ও শাসনকর্তৃত্ব ধ্বংস হয়ে যাবে। এ কারণে সে পবিত্র মক্কার জন্য হাদিয়াস্বরূপ স্বর্ণনির্মিত যে দু টি হরিণ এবং খুব দামী যে কয়টি তলোয়ার আনা হয়েছিল তা যমযম কূপে নিক্ষেপ করে কূপটি মাটি দিয়ে ভরাট করে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল যাতে করে শত্রুরা এ মহামূল্যবান সম্পদ ব্যবহার করতে না পারে। এর কিছুদিন পরেই খুযাআহ্ গোত্রের আক্রমণ শুরু হয়। এর ফলে জুরহুম গোত্র এবং হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর অনেক বংশধরই পবিত্র মক্কা নগরী ত্যাগ করে ইয়েমেনের দিকে গমন করতে বাধ্য হয়। তাদের মধ্য থেকে আর কোন ব্যক্তি মক্কায় ফিরে আসে নি। এরপর থেকে মহানবী (সা.)-এর চতুর্থ ঊর্ধ্বতন পূর্বপুরুষ কুসাই বিন কিলাবের শাসনকর্তৃত্ব অর্জন করার মাধ্যমে কুরাইশদের জীবনাকাশে সৌভাগ্য-তারার উদয় হওয়া পর্যন্ত পবিত্র মক্কা নগরীর শাসনকর্তৃত্ব খুযাআহ্ গোত্রের হাতে থেকে যায়। কিছুকাল পরে শাসনকর্তৃত্ব আবদুল মুত্তালিবের হাতে চলে আসে। তিনি যমযম কূপ পুনরায় খনন করার সিদ্ধান্ত নেন। তবে তখনও যমযম কূপের আসল অবস্থান সূক্ষ্মভাবে কেউ জানত না। অনেক অনুসন্ধান চালানোর পর তিনি যমযম কূপের প্রকৃত অবস্থান সম্পর্কে তথ্য পেলেন এবং নিজ পুত্র হারেসকে নিয়ে কূপ খননের পূর্বপ্রস্তুতি সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

সাধারণত প্রতিটি গোত্র বা সমাজেই এমন কিছু মুষ্টিমেয় লোক পাওয়া যাবে যারা সব সময় যে কোন ভালো কাজ বাধাগ্রস্ত করার জন্য যে কোন ধরনের নেতিবাচক অজুহাত খুঁজে বেড়ায়। এ কারণেই আবদুল মুত্তালিবের প্রতিদ্বন্দ্বীরা ঘোর আপত্তি জানাতে থাকে যাতে করে তিনি এ বিরল সম্মান ও গৌরবের অধিকারী না হতে পারেন। তারা আবদুল মুত্তালিবকে লক্ষ্য করে বলেছিল, হে কুরাইশপ্রধান! যেহেতু এ কূপ আমাদের পূর্বপুরুষ হযরত ইসমাঈলের পুণ্যস্মৃতি এবং আমরা সবাই যেহেতু তাঁরই বংশধর তাই আমাদের সবাইকে এ কাজে শরীক করুন। বিশেষ কতিপয় কারণে হযরত আবদুল মুত্তালিব তাদের কথা মেনে নিলেন না। কারণ তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এটিই যে,তিনি একাই এ কূপটি খনন করবেন এবং এর পানি বিনামূল্যে সকলের হাতে ছেড়ে দেবেন। আর এভাবেই বাইতুল্লাহ্ যিয়ারতকারী হাজীদের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানিরও সুব্যবস্থা হয়ে যাবে। হাজীদের পানির বন্দোবস্ত করার বিষয়টি তাঁর তত্ত্বাবধানে থাকার কারণে তা সব ধরনের অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা থেকে মুক্ত হবে।

যখন তিনি স্বাধীনভাবে এ কাজের গুরুদায়িত্ব নিজ হাতে নেবেন ঠিক তখনই এ বিষয়টির পূর্ণ নিশ্চয়তা বিধান করা সম্ভব হবে।

অবশেষে তাঁরা একটি তীব্র বিরোধ ও টানাপড়েনের সম্মুখীন হলেন। আরবের একজন জ্ঞানী ভাববাদীর কাছে যাওয়া এবং এ ব্যাপারে তার বিচার মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। আবদুল মুত্তালিব ও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা সফরের উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। তাঁরা হিজায ও শামের মধ্যবর্তী ফুল-ফল,পত্র-পল্লবহীন ধূসর মরু এলাকাগুলো একের পর এক অতিক্রম করতে লাগলেন। পথিমধ্যে তাঁরা অত্যন্ত পিপাসার্ত ও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন এবং ধীরে ধীরে তাঁদের বিশ্বাস জন্মেছিল যে,তাঁরা তাঁদের অন্তিম মুহূর্তগুলো অতিবাহিত করছেন। এ কারণেই তাঁরা যখন মৃত্যুর কথা চিন্তা করতে থাকেন,তখন আবদুল মুত্তালিব এ অভিমত ব্যক্ত করলেন যে,প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজ কবর খনন করুক। যখন তার মৃত্যু হবে তখন অন্যরা তার মৃতদেহ উক্ত কবরে শায়িত করবে। আর এভাবে যদি পানি পাওয়া না যায় এবং সকলের তৃষ্ণা অব্যাহত থাকে এবং সবাই মৃত্যুবরণ করে তাহলে এভাবে সকলেই (কেবল শেষ ব্যক্তি ব্যতীত) কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত হবে এবং তাদের মৃতদেহ হিংস্র প্রাণী ও পাখির খাদ্যবস্তুতে পরিণত হবে না।

আবদুল মুত্তালিবের অভিমত সকলের কাছে মনঃপূত হলো। প্রতিটি ব্যক্তি তার নিজের কবর খনন করল এবং সকলেই বিষণ্ণ বদনে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। হঠাৎ করে আবদুল মুত্তালিব উচ্চকণ্ঠে বললেন, হে লোকসকল! এটি এমনই এক মৃত্যু যা হীনতা ও দীনতা বয়ে আনে। তাই এটি কতই না উত্তম যে,আমরা সবাই দলবদ্ধ হয়ে এ মরুভূমির চারপাশে পানির অন্বেষণে ঘুরে বেড়াব! আশা করা যায় যে,মহান আল্লাহ্পাকের অনুগ্রহ ও কৃপার দৃষ্টি আমাদের ওপর পতিত হবে। ১০৬ সবাই পশুর পিঠে আরোহণ করে হতাশা নিয়ে পথ চলতে লাগল এবং তখন তারা একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিল। ঘটনাক্রমে সবাই অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে সুমিষ্ট পানির সন্ধান পেয়ে গেল এবং তারা সবাই মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেল। এরপর তারা যে পথে এসেছিল সে পথেই পবিত্র কাবার দিকে ফিরে গেল এবং পূর্ণ সন্তুষ্টচিত্তে যমযম কূপ খনন করার ব্যাপারে আবদুল মুত্তালিবের অভিমতের সাথে একমত পোষণ করল এবং সম্মত হলো।১০৭

আবদুল মুত্তালিব একমাত্র পুত্রসন্তান হারেসকে সাথে নিয়ে কূপ খননে মশগুল হয়ে যান। খনন কার্য চালানোর ফলে কূপের চারদিকে মাটির একটি প্রকাণ্ড ঢিবি তৈরি হয়েছিল। হঠাৎ করে তিনি স্বর্ণনির্মিত দু টি হরিণ এবং কয়েকটি তলোয়ারের সন্ধান পান। কুরাইশগণ নতুন করে হৈ চৈ শুরু করে দিল এবং সকলেই প্রাপ্ত গুপ্তধনে নিজেদের অংশ আছে বলে দাবি করতে লাগল। তারা তাদের মাঝে লটারী করার সিদ্ধান্ত নিল। ঘটনাক্রমে লটারীতে ঐ দু টি স্বর্ণনির্মিত হরিণ এবং তরবারিগুলো যথাক্রমে পবিত্র কাবা ও আবদুল মুত্তালিবের নামেই উঠল। কুরাইশদের নামে লটারীতে কিছুই উঠল না এবং এ কারণে তারা উক্ত গুপ্তধন থেকে কোন অংশ পেল না। মহামতি আবদুল মুত্তালিব উক্ত তরবারিগুলো দিয়ে পবিত্র কাবার একটি দরজা নির্মাণ করে হরিণ দু টি ঐ দরজার ওপর স্থাপন করেছিলেন।

চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্দেশ্যে আত্মত্যাগ ও নিষ্ঠা

যদিও অন্ধকার যুগের আরবগণ ছিল চরম নৈতিক অবক্ষয়ের শিকার এবং চরমভাবে অধঃপতিত তবুও তাদের মধ্যে কতিপয় চারিত্রিক গুণ ছিল যা প্রশংসনীয়। যেমন চুক্তি ভঙ্গ করা তাদের কাছে সবচেয়ে ঘৃণ্য ও খারাপ কাজ বলে গণ্য হতো। কখনো কখনো আরব গোত্রগুলো নিজেদের মধ্যে অত্যন্ত কঠিন চুক্তি সম্পাদন করত এবং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সেগুলো মেনে চলত। কখনো কখনো তারা শক্তি নিঃশেষকারী নজর করত এবং চরম কষ্ট ও প্রাণান্তকর পরিশ্রমসহকারে তা বাস্তবায়ন করার ব্যাপারে চেষ্টা করত।

আবদুল মুত্তালিব যমযম কূপ খনন করার সময় উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে,বেশি সন্তান না থাকার কারণে কুরাইশদের মধ্যে তিনি দুর্বল ও অক্ষম। এ কারণেই তিনি নজর করেছিলেন যে,যখনই তিনি দশ সন্তানের পিতা হবেন তখন তিনি কাবা গৃহের সামনে যে কোন একজনকে কোরবানী করবেন। তিনি তাঁর এ নজর সম্পর্কে কাউকে অবহিত করেন নি। কিছুকাল পরে তাঁর সন্তানের সংখ্যা দশ হলে তাঁর নজর পূর্ণ করার সময়ও উপস্থিত হলো। আবদুল মুত্তালিবের জন্য এ বিষয়টি চিন্তা করা অত্যন্ত কঠিন ছিল। তবে তাঁর মধ্যে ভয়ও কাজ করছিল যে,পাছে তিনি যদি তাঁর এ নজর আদায় করার ক্ষেত্রে সফল না হন তাহলে এর পরিণতিতে তিনি প্রতিজ্ঞা ভঙ্গকারীদের কাতারে শামিল হয়ে যাবেন। এ কারণেই সন্তানদের সাথে বিষয়টি উত্থাপন ও আলোচনা এবং তাঁদের সম্মতি ও সন্তুষ্টি আদায় করার পর লটারীর মাধ্যমে তাঁদের মধ্য থেকে একজনকে কোরবানীর জন্য মনোনীত করবেন।১০৮

লটারীর আয়োজন করা হলো। লটারীতে মহানবী (সা.)-এর পিতা হযরত আবদুল্লাহ্-এর নাম উঠলে আবদুল মুত্তালিব তৎক্ষণাৎ তাঁর হাত ধরে তাঁকে কোরবানী করার স্থানে নিয়ে গেলেন। কুরাইশ গোত্রের নর-নারীরা উক্ত নজর ও লটারী সম্পর্কে অবগত হলে যুবকদের চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। এক যুবক তখন বলছিল, হায় যদি এ যুবকের বদলে আমাকে জবাই করা হতো!

কুরাইশ দলপতিগণ বলতে লাগল, যদি আবদুল্লাহর পরিবর্তে সম্পদ উৎসর্গ করা যায় তাহলে আমরা আমাদের ধন-সম্পদ তার অধিকারে ছেড়ে দিতে প্রস্তুত আছি।” আবদুল মুত্তালিব জনতার আবেগ ও অনুভূতির উত্তাল তরঙ্গমালার সামনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন এবং চিন্তা করতে লাগলেন পাছে যদি তাঁর অঙ্গীকার ভঙ্গ হয়ে যায়,এতদ্সত্ত্বেও তিনি এর একটি উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে লাগলেন। তাদের মধ্যে থেকে একজন বলল, এ সমস্যাটি আরবের একজন জ্ঞানী ব্যক্তির কাছে উত্থাপন করুন,তাহলে এ ব্যাপারে তিনি একটি পথ বাতলে দিতে পারবেন।” আবদুল মুত্তালিব এবং কুরাইশ নেতৃবর্গ এ প্রস্তাবে সম্মত হলেন এবং ইয়াসরিবের উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। সেখানে ঐ জ্ঞানী ব্যক্তি বসবাস করতেন। সমস্যার সমাধান দেয়ার জন্য তিনি একদিন সময় চাইলেন। পরের দিন সবাই তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হলে তিনি বললেন, আপনাদের নিকট একজন লোকের রক্তমূল্য কত? তখন তাঁরা বললেন, ১০টি উট।” গণক বললেন, দশটি উট ও যে ব্যক্তিকে আপনার কোরবানীর জন্য মনোনীত করেছেন তার মধ্যে লটারী করবেন। লটারীতে ঐ ব্যক্তির নাম উঠলে উটগুলোর সংখ্যা দ্বিগুণ করবেন এবং পুনরায় উটগুলো ও ঐ ব্যক্তির  মধ্যে লটারী করুন। এতে যদি লটারীতে পুনরায় ঐ ব্যক্তির নাম আসে তাহলে উটগুলোর সংখ্যা তিনগুণ করুন এবং পুনরায় ঐ ব্যক্তি ও উটগুলোর মধ্যে লটারী করুন। আর এভাবে লটারীতে উটগুলোর নাম ওঠা পর্যন্ত লটারী করে যান।

গণকের এ প্রস্তাব জনতার আবেগ-অনুভূতি ও উৎকণ্ঠাকে মুহূর্তের মধ্যে বিলীন করে দিল। কারণ আবদুল্লাহর মতো যুবককে রক্তাক্ত দেখার চাইতে তাদের কাছে শত শত উট কোরবানী করা অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল। মক্কায় ফেরার পর একদিন প্রকাশ্যে সকলের মাঝে লটারী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। দশম বারে উটসংখ্যা ১০০-এ উপনীত হলে লটারীতে উটগুলোর নাম উঠল। আবদুল্লাহর জবাই থেকে মুক্তি প্রাপ্তি এক অভিনব আবেগ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করল। কিন্তু আবদুল মুত্তালিব তখন বললেন, আমার স্রষ্টা এ কাজে পূর্ণ সন্তুষ্ট আছেন এ বিষয়টি নিশ্চিতরূপে না জানা পর্যন্ত আমি অবশ্যই লটারীটির পুনরাবৃত্তি করব।” তিনি তিন বার লটারী করলেন এবং তিন বারই উটগুলোর নাম উঠল। এভাবে তিনি পূর্ণরূপে নিশ্চিত হতে পারলেন যে,মহান আল্লাহ্ এ ব্যাপারে সন্তুষ্ট আছেন। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত উটগুলো থেকে ১০০টি উট কাবাগৃহের সামনে জবাই করার এবং কোন ব্যক্তি বা পশুকে তা ভক্ষণ করা থেকে বাধা না দেয়ার নির্দেশ দিলেন।১০৯

আরব জাতির মাঝে নারীর সামাজিক অবস্থান

আরব সমাজে নারীদেরকে পণ্যের মতো কেনা-বেচা করা হতো। তারা সব ধরনের ব্যক্তিগত ও সামাজিক অধিকার,এমনকি উত্তরাধিকার থেকেও বঞ্চিত ছিল। আরব বুদ্ধিজীবীরা নারীদেরকে পশু বলে মনে করত। আর এ কারণেই তাদেরকে দৈনন্দিন জীবনের পণ্য-সামগ্রী ও আসবাবপত্রের মধ্যে গণ্য করা হতো। এ ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়েইو إنّما أمّهات النّاس أوعية মায়েরা ঘটি-বাটি ও থালা-বাসনের মতো’-এ প্রবাদ বাক্যটি আরবদের মধ্যে প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল।

প্রধানত দুর্ভিক্ষের ভয়ে এবং কখনো কখনো কলুষতা ও অশূচিতার ভয়ে আরবরা মেয়েদেরকে জন্মগ্রহণের পর পরই হত্যা করে ফেলত। কখনো পাহাড়ের ওপরে তুলে সেখান থেকে নিচে ফেলে দিত এবং কখনো কখনো পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করত। আমাদের মহান ঐশী গ্রন্থ যা অমুসলিম প্রাচ্যবিদদের দৃষ্টিতে ন্যূনপক্ষে একটি অবিকৃত ঐতিহাসিক তাত্ত্বিক গ্রন্থ যা এতৎসংক্রান্ত একটি অভিনব কাহিনী বর্ণনা করেছে। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে : যখন তাদের কোন এক ব্যক্তিকে কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণের সুসংবাদ দেয়া হতো তখন তার বর্ণ কালো হয়ে যেত এবং বাহ্যত সে যেন তার ক্রোধকে চাপা দিত। আর এই জঘন্য সংবাদ শোনার কারণে সে (লজ্জায়) তার সম্প্রদায়ের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াত। আর সে জানত না যে,সে কি অপমান ও লাঞ্ছনা সহকারে তার এ নবজাতক কন্যাসন্তান প্রতিপালন করবে,নাকি তাকে মাটির নিচে জীবন্ত পুঁতে ফেলবে? সত্যিই তাদের ফয়সালা কতই না জঘন্য! 27

সবচেয়ে দুঃখজনক ছিল আরবদের বৈবাহিক ব্যবস্থা। পৃথিবীতে এর কোন নজির বিদ্যমান নেই। যেমন আরবদের কাছে স্ত্রীর কোন সুনির্দিষ্ট সংখ্যা ছিল না। স্ত্রীর মোহরানা যাতে আদায় করতে না হয় সেজন্য তারা স্ত্রীদেরকে নির্যাতন ও উৎপীড়ন করত। কোন মহিলা চারিত্রিক সততার পরিপন্থী কোন কাজ করলেই তার মোহরানা সম্পূর্ণরূপে বাতিল হয়ে যেত। কখনো কখনো আরবরা এনিয়মের অপব্যবহার করত। মোহরানা যাতে আদায় করতে না হয় সেজন্য তারা নিজেদের স্ত্রীদের ওপর অপবাদ আরোপ করত। পুত্রসন্তানগণ পিতার মৃত্যুর পর বা পিতা তালাক দিলে পিতার স্ত্রীদেরকে নিজের স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করতে পারত এবং এতে কোন অসুবিধা ছিল না। যখন মহিলা তার স্বামী কর্তৃক তালাকপ্রাপ্তা হতো তখন প্রাক্তন তথা প্রথম স্বামীর অনুমতির ওপর তার পুনর্বিবাহ নির্ভর করত। আর কেবল অর্থ প্রদানের মাধ্যমেই প্রথম স্বামীর অনুমতি পাওয়া যেত। উত্তরাধিকারিগণ ঘরের আসবাবপত্রের মতো উত্তরাধিকারসূত্রে মহিলাদের ( পিতার স্ত্রীদের ) মালিক হতো এবং তাদের মাথার ওপর রোসারী ( Scarf) নিক্ষেপ করে উত্তরাধিকারিগণ তাদের নিজ নিজ স্বত্বাধিকার ঘোষণা করত।

ছোট একটি তুলনা

সম্মানিত পাঠকবর্গ যদি ইসলামে নারীর অধিকার লক্ষ্য করেন তাহলে তাঁরা ভালোভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন যে,নারীর অধিকার সংক্রান্ত এত সব বিধান প্রবর্তন এবং এগুলো সংস্কার ও সংরক্ষণ সংক্রান্ত উদ্যোগ যা মহানবী (সা.) কর্তৃক গৃহীত হয়েছে তা থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে,মহানবী (সা.) সত্যনবী এবং ঐশী জগতের সাথে তাঁর যোগসূত্র ছিল। কারণ পবিত্র কোরআনের বহু আয়াত এবং মহানবী (সা.)-এর অগণিত হাদীসে নারীর অধিকারসমূহের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে এবং তিনিও তাঁর অনুসারীদেরকে নারীদের প্রতি সদাচরণ ও দয়া প্রদর্শন করার আহবান জানিয়েছেন। এছাড়াও তিনি বিদায় হজ্বের ভাষণে নারীদের ব্যাপারে পুরুষদেরকে নিম্নোক্ত যে উপদেশ দিয়েছেন তার চেয়ে বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে? তিনি বিদায় হজ্বের ভাষণে বলেছেন,

أيّها النّاس فإنّ لكم على نسائكم حقّا و لهنّ عليكم حقّا و استوصوا بالنّساء خيرا فإنّهنّ عندكم عوان... أطعموهنّ ممّا تأكلون و ألبسوهنّ ممّا تلبسون

“হে লোকসকল! নারীদের ওপর যেমন তোমাদেরকে অধিকার দেয়া হয়েছে,ঠিক তদ্রূপ তোমাদের ওপরও তাদের অধিকার রয়েছে। তাদের ব্যাপারে তোমরা একে অপরের প্রতি সদাচরণ করার আদেশ দেবে। কারণ তারা (নারীরা) তোমাদের কাজকর্মে তোমাদের সাহায্যকারী। ...তোমরা যা খাবে তাদেরকে তা খেতে দেবে। আর তোমরা যা পরিধান করবে তাদেরকেও তা-ই পরিধান করতে দেবে।”28

আরবদের সাহস ও বীরত্ব

বলা যেতে পারে যে,মানসিকভাবে জাহেলিয়াত যুগের আরবগণ লোভী মানুষের পূর্ণাঙ্গ উপমা ছিল। পার্থিব বস্তুসামগ্রীর প্রতি ছিল তাদের দুর্বার আকর্ষণ। তারা প্রতিটি বস্তু বা বিষয়কেই তার অন্তর্নিহিত লাভ ও উপকারের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করত (অর্থাৎ যে জিনিসে যত বেশি লাভ ও উপকার পাওয়া যেত সেটিই তাদের কাছে প্রিয় ও কাম্য হতো)। তারা সর্বদা অন্যদের চেয়ে নিজেদের এক ধরনের উচ্চমর্যাদা,সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ব আছে বলে বিশ্বাস করত। তারা সীমাহীনভাবে স্বাধীন থাকতে ভালবাসত। তাই যে সব বিষয় তাদের স্বাধীনতাকে সীমিত করে দিত তা তারা মোটেও পছন্দ করত না।29

ইবনে খালদুন আরবদের অবস্থা প্রসঙ্গে বলেছেন, স্বভাবপ্রকৃতির দিক থেকে এ জাতিটি অসভ্য,বর্বর এবং লুটতরাজপ্রিয় ছিল। তাদের মধ্যে অসভ্যতা ও বর্বরতার কারণগুলো এতটা গভীরে প্রোথিত ছিল যে সেগুলো যেন তাদের স্বভাব-চরিত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। তারা তাদের এ ধরনের অসভ্য স্বভাব-চরিত্রকে বেশ মজা করে উপভোগ করত। কারণ তাদের এই চারিত্রিক বর্বরতা ও অসভ্যতার কারণেই তারা কোন শাসকের শাসন বা আইন-কানুনের আনুগত্য ও সকল ধরনের বাধ্যতামূলক বন্ধন থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে পারত এবং রাজ্যশাসন নীতির বিরুদ্ধাচরণ করত। আর এটি স্পষ্ট প্রমাণিত যে,এ ধরনের স্বভাব-চরিত্র সভ্যতা ও কৃষ্টির সম্পূর্ণ পরিপন্থী।...

এরপর তিনি আরো বলেছেন, তাদের স্বভাবে ছিল লুণ্ঠন ও দস্যুবৃত্তি। তারা অন্যদের কাছে যা পেত তা ছিনিয়ে নিত। বর্শা ও তরবারির মাধ্যমেই তাদের জীবিকা নির্বাহ হতো। অন্যের সম্পদ লুণ্ঠন করার ক্ষেত্রে তারা কোন সীমারেখার ধার ধারত না,বরং যে কোন সম্পদ ও জীবনযাপনের উপকরণের ওপর দৃষ্টি পড়লেই তারা তা লুণ্ঠন করত।”30

আসলে লুটতরাজ ও যুদ্ধ-বিগ্রহ আরবদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছিল। কথিত আছে,মহানবী (সা.)-এর কণ্ঠে বেহেশতের সুখ-শান্তির কথা শোনার পর এক আরব বেহেশতে যুদ্ধ-বিগ্রহের অস্তিত্ব আছে কিনা এ ব্যাপারে প্রশ্ন করেছিল। যখন তাকে এর উত্তরে বলা হলো : না সেখানে যুদ্ধ-বিগ্রহের কোন অস্তিত্ব নেই,তখন সে বলেছিল, তাহলে বেহেশত থাকলেই বা লাভ কি? আরব জাতির ইতিহাসে 1700-এর বেশি যুদ্ধের কাহিনী লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। কোন কোন যুদ্ধ 100 বছর বা তার চেয়েও বেশি সময় ধরে চলেছে। অর্থাৎ কয়েকটি প্রজন্ম পরস্পর যুদ্ধ-বিগ্রহ করেই কালাতিপাত করেছে। কখনো কখনো অত্যন্ত তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ,রক্তপাত ও হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে।31 ইসলামপূর্ব আরব জাতির অন্যতম ঘটনা হচ্ছে একটি দীর্ঘ যুদ্ধ যা ইতিহাসে হারবু দাহিস ওয়া গাবরা’নামে প্রসিদ্ধ। দাহিস ও গাবরা দু গোত্রপতির দু টি ঘোড়ার নাম ছিল। দাহিস বনি আবেস গোত্রের প্রধান কাইস বিন যুহাইরের ঘোড়ার নাম এবং গাবরা ছিল বনি ফিরাযাহ্ গোত্রপতি হুযাইফার ঘোড়ার নাম। উক্ত গোত্রপতিদ্বয়ের প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ ঘোড়াকে অন্যের ঘোড়া অপেক্ষা অধিকতর দ্রুতগতিসম্পন্ন বলে মনে করত। অবশেষে তাদের মধ্যে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়;কিন্তু প্রতিযোগিতা শেষ হওয়ার পর প্রত্যেকেই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হওয়ার দাবি করল। এই ত্চ্ছু বিষয়কে কেন্দ্র করে একটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলো। নিহতের গোত্রও হত্যাকারী গোত্রের এক ব্যক্তিকে হত্যা করল। কিন্তু ঘটনাটি এখানেই শেষ হলো না,বরং এ হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে দু বৃহৎ গোত্রের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা  হলো যা 568 খ্রিষ্টাব্দ থেকে 608 খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চলতে থাকে এবং এর ফলে উভয় পক্ষের অগণিত লোক নিহত হয়।32

জাহেলী যুগের আরবরা বিশ্বাস করত যে,রক্ত ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে রক্তকে ধুয়ে সাফ করা যায় না। শানফারা-এর ঘটনা যা একটি উপাখ্যানসদৃশ তা জাহেলী গোত্রপ্রীতির মাত্রার নির্দেশক হতে পারে। সে (শানফারাহ্) বনি সালমান গোত্রের এক ব্যক্তির হাতে লাঞ্ছিত হলে এর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য উক্ত গোত্রের 100 জনকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। অবশেষে দীর্ঘকাল দিগ্বিদিক ঘোরাঘুরি ও চোরাগুপ্তা হামলা চালিয়ে অপমানকারী গোত্রের 99 জনকে হত্যা করে। এরপর একদল দস্যু একটি কূপের কাছে তাকেও হত্যা করে। বহু বছর পর নিহত শানফারা-এর হাড় ও মাথার খুলি অপমানকারী গোত্রের শততম ব্যক্তির হত্যার কারণে পর্যবসিত হয়। কাহিনীটি এরূপ : বনি সালমান গোত্রের এক পথিক সেখান দিয়ে অতিক্রম করছিল। হঠাৎ মরুঝড় মাথার খুলি উড়িয়ে এনে ঐ পথিকটির পায়ে কঠিনভাবে আঘাত করে। ফলে সে পায়ের তীব্র ব্যথায় মৃত্যুমুখে পতিত হয়।33

আরব বেদুইনরা রক্তপাত,খুন-খারাবি,লুটতরাজ ও দস্যুবৃত্তিতে এতটা অভ্যস্ত ছিল যে,পরস্পর গর্ব-অহংকার করার সময় তারা অন্যদের ধন-সম্পদ লুণ্ঠনকে তাদের অন্যতম গর্ব ও অহংকারের বিষয় বলে গণ্য করত। এক জাহেলী আরব কবি লুটতরাজ করার ক্ষেত্রে নিজ গোত্রের অপারগতা দেখে মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে আকাঙ্ক্ষা করেছিল :

“হায় যদি সে এ গোত্রের না হয়ে অন্য কোন গোত্রের হতো যারা অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করে লুটতরাজ করত।”34

এ জাতি সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে এ রকম বলা হয়েছে :

) و كنتم على شفا حفرة من النّار فأنقذكم منها(

“আর তোমরা,হে আরব জাতি! অগ্নিকুণ্ডের ধারে ছিলে। মহান আল্লাহ্ তোমাদেরকে তা থেকে পরিত্রাণ দিয়েছেন।”35

জাহেলিয়াত যুগের আরবদের সাধারণ চরিত্র

যা হোক অজ্ঞতা,মূর্খতা,সংকীর্ণ জীবনযাত্রা,জীবনযাপনের সঠিক পদ্ধতি ও ব্যবস্থা না থাকা,হিংস্রতা,পাশবিকতা,অলসতা,বেহাল অবস্থা এবং আরো অন্যান্য চারিত্রিক দোষ-ত্রুটির ন্যায় বিভিন্ন ধরনের প্রভাব বিস্তারকারী উপাদান আরব উপদ্বীপের সার্বিক পরিবেশ ও পরিস্থিতিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রেখেছিল এবং ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে প্রকাশ্যে লজ্জাজনক বিষয়াদি স্বাভাবিক ও বৈধ হয়ে যায়।

লুণ্ঠন,দস্যুবৃত্তি,জুয়া,সুদ ও মানুষকে বন্দী করা জাহেলী আরবীয় জীবনে বহুল প্রচলিত নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। তাদের আরেকটি জঘন্য কুঅভ্যাস ছিল মদ্যপান। এ ঘৃণ্য অভ্যাসটি জাহেলী আরব সমাজে এতটা বিস্তৃতি লাভ করেছিল যে,তা তাদের ভাগ্য ও জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছিল। আরবের কবিরা মদের গুণ এবং মদ্যপান বর্ণনায় তাদের অধিকাংশ কাব্যপ্রতিভা ব্যবহার করত। পানশালা রাতদিন 24 ঘণ্টাই উন্মুক্ত থাকত। এগুলোর ছাদের ওপর বিশেষ ধরনের পতাকা উড়ত। ইসলামপূর্ব আরব সমাজে মদের কেনা-বেচার ব্যাপক প্রচলনের কারণে তাদের কাছে ব্যবসা-বাণিজ্য মদ বিক্রির সমার্থক ছিল।

আরবগণ চারিত্রিক নীতিমালাকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করত। যেমন মহানুভবতা,সাহস ও তীব্র আত্মসম্ভ্রমবোধ আরবদের কাছে প্রশংসনীয় ছিল। তবে তাদের দৃষ্টিতে সাহসের অর্থ ছিল যুদ্ধে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও রক্তপাত ঘটানো। আত্মসম্ভ্রমবোধ তাদের দৃষ্টিতে এমনভাবে ব্যাখ্যা করা হতো যার ফলে কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবরস্থ করা তাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের আত্মসম্ভ্রমবোধ বলে গণ্য হতো। আরবদের দৃষ্টিতে বিশ্বস্ততা ও সংহতি ছিল নিজ গোত্র ও চুক্তিবদ্ধ মিত্র গোত্রগুলোকে সমর্থন করা-তা সত্যই হোক,আর অন্যায়ই হোক।36 তারা মদ,নারী ও যুদ্ধের প্রতি তীব্রভাবে আসক্ত ছিল।

জাহেলিয়াত যুগের আরবগণ কুসংস্কার পূজারী ছিল

পবিত্র কোরআনে মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াত ও রিসালাতের পবিত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ নাতিদীর্ঘ বাক্যসমূহের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে (যদিও বাক্যগুলো ছোট,কিন্তু গভীর অর্থ ও তাৎপর্যমণ্ডিত)। ঐ সকল আয়াত যা দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য তন্মধ্যে এ আয়াতটি এখানে উল্লেখ করা হলো :

) و يضع عنهم إصرهم و الأغلال الّتى كانت عليهم(

“তিনি (মহানবী) তাদের থেকে তাদের বোঝা এবং শিকল ও বেড়ী থেকে মুক্ত করেন যা তাদের ওপর (বাঁধা) রয়েছে।” (সূরা আরাফ : 157)

এখানে অবশ্যই দেখতে হবে যে,যে শিকল ও বেড়ীতে ইসলাম ধর্মের শুভ সূচনালগ্নে জাহেলিয়াতের যুগের আরব জাতির হাত ও পা বাঁধা ছিল তা কি? নিঃসন্দেহে এই শিকল ও বেড়ী লৌহ নির্মিত ছিল না,বরং এ সব শিকল ও বেড়ী বলতে কুসংস্কার,অলীক কল্পনা এবং ধ্যান-ধারণাকে বোঝানো হয়েছে যা মানুষের চিন্তাশক্তি ও বিবেকবুদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে। এ ধরনের বাঁধন যদি মানুষের চিন্তাশক্তির পাখার সাথে বেঁধে দেয়া হয় তাহলে তা লোহার বেড়ী ও শিকল হতে বেশি ক্ষতিকর হবে। কারণ লৌহনির্মিত শিকল কিছুদিন অতিবাহিত হলে বন্দীর হাত ও পা থেকে খুলে নেয়া হয়। আর জেলে বন্দী ব্যক্তিটি সুস্থ চিন্তাধারাসহকারে এবং কুসংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে বাস্তব জীবনে প্রত্যাবর্তন করে। কিন্তু অমূলক চিন্তা,ধারণা এবং ভ্রান্ত কল্পনার শিকলে যদি মানুষের বিবেক-বুদ্ধি,আবেগ-অনুভূতি এবং অনুধাবন শক্তি বাঁধা হয়ে যায় তাহলে তা আমৃত্যু তার সাথে থেকেই যেতে পারে এবং তাকে যে কোন ধরনের তৎপরতা ও প্রচেষ্টা,এমনকি তা এ ধরনের বাঁধন খোলার জন্যও যদি হয়ে থাকে তা থেকে তাকে বিরত রাখে। মানুষ সুস্থ চিন্তাধারা এবং বিবেক ও জ্ঞানের ছত্রছায়ায় যে কোন ধরনের কঠিন বাঁধন ও শৃঙ্খল ভেঙে ফেলতে সক্ষম। তবে সুস্থ চিন্তাধারা ছাড়া এবং সব ধরনের অলীক ও ভ্রান্ত ধ্যান-ধারণা থেকে মুক্ত না হলে মানুষের সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা ও কর্মতৎপরতা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য।

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অন্যতম গৌরব ও কৃতিত্ব হচ্ছে,তিনি সকল প্রকার কুসংস্কার,অমূলক চিন্তাভাবনা ও অলীক কল্প-কাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। তিনি মানব জাতির বিবেক-বুদ্ধিকে কুসংস্কারের মরিচা ও ধুলোবালি থেকে ধৌত করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেছেন। তিনি বলেছেন, মানুষের চিন্তাশৈলীকে শক্তিশালী করতে এবং সব ধরনের কুসংস্কার,এমনকি যে কুসংস্কার আমার লক্ষ্য অর্জনের পথে সহায়ক সেটিরও বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতেই আমি এসেছি।”

বিশ্বের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ,জনগণের ওপর শাসনকর্তৃত্ব চালানো ছাড়া যাদের আর কোন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে নেই তারা সব সময় যে কোন অবস্থা ও পরিস্থিতিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে;এমনকি প্রাচীন কল্পকাহিনী এবং জাতির কুসংস্কারাচ্ছন্ন আকীদা-বিশ্বাস যদি নেতৃত্ব ও শাসনকর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়ক হয় তাহলে তারা তা প্রসার ও প্রচার করতে দ্বিধাবোধ করে না। আর তারা যদি চিন্তাশীল ও যুক্তিবাদীও হয় তাহলেও তারা সাধারণ জনতার ধ্যান-ধারণা ও সংখ্যাগরিষ্ঠের আকীদা-বিশ্বাসের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নামে বিবেক-বুদ্ধির পরিপন্থী ঐ সকল অমূলক কল্প-কাহিনী ও ধ্যান-ধারণাকে সমর্থন করতে থাকে।

তবে মহানবী (সা.) যে সব কুসংস্কারাচ্ছন্ন আকীদা-বিশ্বাস তাঁর ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর কেবল সেগুলোর বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করেন নি,বরং যে কোন ধরনের আঞ্চলিক কল্প-কাহিনী ও উপাখ্যান অথবা ভিত্তিহীন চিন্তা ও বিশ্বাস যা তাঁর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য সহায়ক সেটির বিরুদ্ধেও তাঁর সকল শক্তি ও ক্ষমতা নিয়োগ করে সংগ্রাম করেছেন। তিনি সব সময় চেষ্টা করেছেন মানুষ যেন সত্যপূজারী হয়। ভিত্তিহীন কল্প-কাহিনী,উপাখ্যান ও কুসংস্কারের পূজারীতে যেন পরিণত না হয়। এখন উদাহরণস্বরূপ নিম্নোক্ত কাহিনীটি মনোযোগ সহকারে পাঠ করুন :

মহানবী (সা.)-এর এক পুত্রসন্তান মারা গেলেন যাঁর নাম ছিল ইবরাহীম। তিনি পুত্রবিয়োগে শোকাহত ও দুঃখভারাক্রান্ত ছিলেন এবং তাঁর পবিত্র নয়নযুগল থেকে অশ্রু ঝরছিল। ইবরাহীমের মৃত্যুর দিনে সূর্যগ্রহণ হয়েছিল। আরবের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও অলীক কল্প-কাহিনীর পূজারী জাতি সূর্যগ্রহণকে মহানবী (সা.)-এর ওপর আপতিত বিপদের চরম ও বিরাট হওয়ার প্রমাণ বলে মনে করল এবং বলতে লাগল : মহানবী (সা.)-এর পুত্রের মৃত্যুতে সূর্যগ্রহণ হয়েছে। মহানবী (সা.) তাদের এ কথা শুনে বললেন, চন্দ্র ও সূর্য মহান আল্লাহর অসীম শক্তি ও ক্ষমতার দু টি বড় নিদর্শন এবং তারা সর্বদা আদেশ পালনকারী। কারো জীবন ও মৃত্যু উপলক্ষে সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ হয় না। যখনই চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ হবে তখন তোমরা সবাই নিদর্শনসমূহের নামায আদায় করবে।” এ কথা বলে তিনি মিম্বার থেকে নিচে নেমে আসলেন এবং উপস্থিত ব্যক্তিবর্গকে সাথে নিয়ে আয়াতের নামায পড়লেন।37

মহানবী (সা.)-এর পুত্রের মৃত্যুতে সূর্যগ্রহণ হয়েছে চিন্তা করা যদিও মহানবী (সা.)-এর প্রতি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসকে দৃঢ়তর করত এবং পরিণতিতে তাঁর ধর্মের অগ্রগতি ও প্রসারের ক্ষেত্রে সহায়কও হতো,কিন্তু তিনি চান নি এবং সন্তুষ্ট হতে পারেন নি যে,অলীক কল্প-কাহিনীর দ্বারা জনগণের অন্তরে তাঁর স্থান দৃঢ় ও শক্তিশালী হোক। অলীক কল্প-কাহিনী ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম যার জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হচ্ছে মূর্তিপূজা এবং আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন সত্তার উপাস্য হওয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। তা কেবল তাঁর রিসালাতের পদ্ধতি ছিল না,বরং তিনি তাঁর জীবনের সব ক টি পর্বেই,এমনকি তাঁর শৈশবকালেও কুসংস্কার ও ভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন।

যে সময় মহানবী (সা.)-এর বয়স ছিল চার বছর এবং মরুভূমিতে দুধ মা হালিমার তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হচ্ছিলেন তখন তিনি তাঁর দুধ মা হালিমার কাছে তাঁর দু ভাইয়ের সাথে মরুভূমিতে যাওয়ার ব্যাপারে অনুরোধ করেছিলেন। হালিমা এ ব্যাপার বলেন, পরের দিন মুহাম্মদকে গোসল দিলাম। তার চুলে তেল ও চোখে সুরমা দিলাম। যাতে করে মরুর শয়তানগুলো তার অনিষ্ট সাধন করতে না পারে সেজন্য একটি ইয়েমেনী পাথর সুতায় ভরে তাকে রক্ষা করার জন্য তার গলায় পরিয়ে দিলাম।” মহানবী (সা.) ঐ পাথরটি গলা থেকে খুলে এনে দুধ মা হালিমাকে বললেন,مهلا يا إمّاه، فإنّ معي من يحفظني মা,শান্ত হোন,আমার আল্লাহ্ সর্বদা আমার সাথে আছেন। তিনি আমার রক্ষাকারী।”38


6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53

54

55

56

57

58

59

60

61