চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 103689
ডাউনলোড: 9120


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 103689 / ডাউনলোড: 9120
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

হাতির বছরের গোলযোগ

কোন জাতির মধ্যে যে মহাঘটনা সংঘটিত হয় এবং কখনো কখনো যা ধর্মীয় ভিত্তিমূল এবং কখনো কখনো জাতীয় ও রাজনৈতিক ভিত্তিমূলের অধিকারী তা সাধারণ জনগণের আশ্চর্য ও বিস্ময়বোধের কারণে তারিখ ও গণনার সূচনা বা উৎস বলে গণ্য হয়। যেমন ইয়াহুদী জাতির মুক্তির জন্য হযরত মূসা (আ.)-এর আন্দোলন,খ্রিষ্টানদের জন্য হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্ম তারিখ এবং মুসলমানদের ক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর হিজরত হচ্ছে তারিখ গণনার উৎস যা দিয়ে প্রতিটি ধর্মের অনুসারিগণ তাদের জীবনের ঘটনাসমূহের উদ্ভবের সময়কাল নির্ণয় ও পরিমাপ করে থাকে।

কখনো কখনো কোন জাতি মৌলিক ইতিহাস ও তারিখের অধিকারী হওয়ার কারণে কিছু কিছু ঘটনাকেও তাদের তারিখ গণনার ভিত্তি ও উৎস হিসাবে নির্ধারণ করেছে। যেমন পাশ্চাত্যের দেশসমূহে মহান ফরাসী বিপ্লব এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে 1917 খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরের কম্যুনিস্ট আন্দোলন ঐ সব দেশে যে সব ঘটনাপ্রবাহের উদ্ভব হয় সেগুলোর অনেক কিছুর তারিখ গণনার ভিত্তি বা উৎস হিসাবে গণ্য করা হযেছে। যে সব অনগ্রসর জাতি এ ধরনের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আন্দোলন থেকে বঞ্চিত সে সব জাতি স্বাভাবিকভাবে অসাধারণ ঘটনাবলীকে তাদের ইতিহাস ও তারিখ গণনার ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করে। এ কারণেই জাহেলী আরবগণ সঠিক কৃষ্টি ও সভ্যতার অধিকারী না হওয়ায় যুদ্ধ,ভূমিকম্প,দুর্ভিক্ষ অথবা অলৌকিক ঘটনাবলীকে নিজেদের ইতিহাস ও তারিখ গণনার উৎস হিসাবে গণ্য করেছে। এ কারণেই ইতিহাসের পাতায় পাতায় আমরা আরব জাতির তারিখ গণনার ভিন্ন ভিন্ন ভিত্তি দেখতে পাই। এসব ভিত্তির মধ্যে সর্বশেষ ভিত্তি হচ্ছে হাতির বছরের ঘটনা এবং পবিত্র কাবাগৃহকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে আবরাহার মক্কা আক্রমণের ঘটনা যা অন্যান্য ঘটনার তারিখ গণনার ভিত্তি হিসাবে গণ্য হয়েছে। এখন আমরা 570 খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত মহাঘটনাটির ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করব এবং এখানে স্মর্তব্য যে,মহানবী (সা.)ও এই একই বছরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

এ ঘটনার উৎস

আসহাবে ফীল অর্থাৎ হস্তিবাহিনীর ঘটনা পবিত্র কোরআনে সংক্ষিপ্তাকারে বর্ণিত হয়েছে। আর আমরা এ ঘটনা বর্ণনা করার পর যে সব আয়াত এ ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে তা উল্লেখ করব। ইতিহাস রচয়িতাগণ এ ঘটনার মূল কারণ সম্পর্কে লিখেছেন : ইয়েমেনের বাদশাহ্ যূনুওয়াস তার সরকারের ভিত্তি মজবুত করার পর কোন এক সফরে মদীনা অতিক্রম করছিল। তখন মদীনা এক অতি উত্তম ধর্মীয় মর্যাদার অধিকারী ছিল। সে সময় একদল ইয়াহুদী ঐ শহরে বসতি স্থাপন করে প্রচুর মন্দির ও ইবাদাতগাহ্ নির্মাণ করেছিল। সুযোগসন্ধানী ইয়াহুদিগণ বাদশার আগমনকে এক সুবর্ণ সুযোগ মনে করে বাদশাহকে ইয়াহুদী ধর্ম গ্রহণের আমন্ত্রণ জানায়। তাদের এ পদক্ষেপের উদ্দেশ্যে ছিল নব্য ইয়াহুদী ধর্মে দীক্ষিত বাদশাহ্ যূনুওয়াসের শাসনাধীনে রোমের খ্রিষ্টান ও পৌত্তলিক আরবের হামলা থেকে নিরাপদ থাকা এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করা। এ ব্যাপারে তাদের প্রচার খুব ফলপ্রসূ হয়েছিল। যূনুওয়াস ইয়াহুদী ধর্ম গ্রহণ করল এবং এ ধর্ম প্রসার ও প্রচারের ক্ষেত্রে অনেক অবদান রেখেছিল। অনেকেই ভীত হয়ে তার বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। সে একদল জনতাকে বিরোধিতা করার জন্য কঠোর শাস্তি প্রদান করে। তবে নাজরানের অধিবাসিগণ যারা বেশ কিছুদিন আগেই খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিল তারা কোনক্রমেই খ্রিষ্টধর্ম ত্যাগ করে ইয়াহুদী ধর্মের অনুশাসন অনুসরণ করতে প্রস্তুত ছিল না।ইয়েমেনের বাদশার বিরুদ্ধাচরণ এবং অবজ্ঞা করার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ ছিল। বাদশাহ্ যূনুওয়াস এক বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে নাজরানের বিদ্রোহীদেরকে দমন করার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়। সেনাপতি নাজরান শহরের পাশে সেনা শিবির ও তাঁবু স্থাপন করে এবং পরিখা খনন করার পর তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়;আর বিদ্রোহীদেরকে ঐ আগুনে জীবন্ত দগ্ধ করার হুমকি প্রদর্শন করতে থাকে। নাজরানের অকুতোভয় সাহসী জনতা যারা মনে-প্রাণে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিল তারা এতে মোটেও ভীত না হয়ে মৃত্যু ও জীবন্ত দগ্ধ হওয়াকে সানন্দে বরণ করে নেয়। তাদের দেহগুলো সেই আগুনে জীবন্ত দগ্ধ হয়েছিল।110

ইসলামী ইতিহাসবেত্তা ইবনে আসীর জাযারী লিখেছেন : এ সময় দূস নামক একজন নাজরানবাসী খ্রিষ্টধর্মের গোঁড়া সমর্থক রোমান সম্রাট কাইসারের কাছে গমন করে তাঁকে পুরো ঘটনা অবহিত করল এবং রক্তপিপাসু যূনুওয়াসকে শাস্তি প্রদান এবং অত্র এলাকায় খ্রিষ্টধর্মের ভিত মজবুত ও শক্তিশালী করার আবেদন জানাল। রোমের অধিপতি গভীর দুঃখ ও সমবেদনা প্রকাশ করে বলেন, আপনাদের দেশ থেকে আমার সাম্রাজ্যের রাজধানী অনেক দূরে অবস্থিত বিধায় এ ধরনের অত্যাচারের প্রতিকার বিধানার্থে হাবাশার বাদশাহ্ নাজ্জাশীর কাছে একটি চিঠি লিখছি যাতে করে তিনি ঐ রক্তপিপাসু নরপিশাচের কাছ থেকে নাজরানের নিহতদের প্রতিশোধ নিতে পারেন। ঐ নাজরানবাসী কাইসারের চিঠি নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব হাবাশার দিকে রওয়ানা হয়ে গেল এবং বাদশাহ্ নাজ্জাশীর কাছে পুরো ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করল। ফলে বাদশার শিরা ও ধমনীতে তীব্র আত্মসম্মানবোধ ও চেতনাবোধের রক্ত প্রবাহিত হয়ে গেল। তিনি আবরাহাতুল আশরাম নামক এক হাবাশী সেনাপতির নেতৃত্বে 70 হাজারের এক বিশাল সেনাবাহিনী ইয়েমেনের দিকে প্রেরণ করেন। হাবাশার উক্ত সুশৃঙ্খল ও সুসজ্জিত সেনাবাহিনীটি সমুদ্রপথে ইয়েমেনের সৈকতে তাঁবু স্থাপন করে। এ ব্যাপারে সচেতন না থাকার কারণে যূনুওয়াসের আর কিছুই করার ছিল না। সে যতই চেষ্টা করল তাতে কোন ফল হলো না। প্রতিরোধ ও যুদ্ধ করার জন্য যতই গোত্রপতিদের নিকট আহবান জানাল তাতে তাদের পক্ষ থেকে সে কোন সাড়া পেল না। পরিণতিতে আবরাহার এক সংক্ষিপ্ত আক্রমণের মুখে যূনুওয়াসের প্রশাসনের ভিত ধসে পড়ে এবং সমৃদ্ধ ও সম্পদশালী ইয়েমেন হাবাশাহ্ সাম্রাজ্যের অধীন হয়ে যায়।

আবরাহা প্রতিশোধ ও বিজয়ের মদমত্ততায় চূর ও মাতাল হয়েছিল। সে যৌনকামনা ও আমোদ-প্রমোদে নিমজ্জিত হওয়া থেকে মোটেও বিরত থাকত না। সে হাবাশার বাদশার নৈকট্য ও দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ইয়েমেনের রাজধানী সানআ নগরীতে একটি জমকালো গীর্জা নির্মাণ করে যা ছিল ঐ যুগে অতুলনীয়। তারপর সে বাদশাহ্ নাজ্জাশীর কাছে এই মর্মে পত্র লেখে, গীর্জা নির্মাণ কাজ প্রায় সমাপ্ত হওয়ার পথে। ইয়েমেনের সকল অধিবাসীকে কাবার যিয়ারত করা থেকে বিরত এবং এই গীর্জাকে সাধারণ জনগণের জন্য তাওয়াফস্থল করার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখছি।” চিঠিটির মূল বক্তব্য প্রচারিত হলে সমগ্র আরব গোত্রগুলোর মধ্যে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিল,এমনকি বনি আফকাম গোত্রের এক মহিলা উক্ত মন্দিরের চত্বরকে নোংরা করে দিল। এ ধরনের কাজ যার মাধ্যমে আবরাহার গীর্জার প্রতি আরবদের পূর্ণ অবজ্ঞা,শত্রুতা ও অবহেলা প্রকাশ পেয়েছে তা তদানীন্তন আবরাহা প্রশাসনকে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ করে তোলে। অন্যদিকে গীর্জার বাহ্যিক সৌন্দর্য ও সাজ-সজ্জার ক্ষেত্রে যত চেষ্টা চালানো হয়েছে ততই পবিত্র কাবার প্রতি জনগণের আকর্ষণ ও ভালোবাসা তীব্র হতে থাকে। এ সব ঘটনাপ্রবাহের কারণে আবরাহা পবিত্র কাবা ধ্বংস করার শপথ নেয়। এজন্য আবরাহা এক বিশাল বাহিনী গঠন করে যার সম্মুখভাগে ছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সুসজ্জিত অনেক লড়াকু হাতি। তাওহীদী মতাদর্শের প্রাণপুরুষ হযরত ইবরাহীম খলীল (আ.) যে গৃহটির পুননির্মাণ করেছিলেন আবরাহা তা ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরিস্থিতি যে অত্যন্ত ভয়াবহ ও অতি সংবেদনশীল তা প্রত্যক্ষকরতঃ আরবের গোত্রপতিদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল যে,আরব জাতির স্বাধীনতা ও ব্যক্তিত্ব পতনের সম্মুখীন। কিন্তু আবরাহার অতীত সাফল্যসমূহ তাদেরকে যে কোন উপকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা থেকে বিরত রেখেছিল। এতদ্সত্ত্বেও আবরাহার গমনপথের ওপর অরব গোত্রগুলোর কতিপয় আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন নেতা পূর্ণ বীরত্বসহকারে আবরাহার বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলে। যেমন যূনাফার যিনি নিজেও এক অভিজাত বংশোদ্ভূত ছিলেন তিনি জ্বালাময়ী বক্তৃতা প্রদান করে তাঁর নিজ গোত্রকে পবিত্র কাবাগৃহ রক্ষা করার উদাত্ত আহবান জানান। কিন্তু অতি অল্পদিনের মধ্যেই আবরাহার বিশাল বাহিনী তাঁদের ব্যুহসমূহ ভেদ করে দেয়। এরপর নুফাইল বিন হাবীব তীব্র প্রতিরোধ ও সংগ্রাম গড়ে তোলে,কিন্তু সেও পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয় এবং আবরাহার বাহিনীর হাতে বন্দী হয়। তাকে ক্ষমা করে দেয়ার জন্য সে (নুফাইল) আবরাহার কাছে আবেদন জানালে আবরাহা তাকে বলেছিল, আমাদেরকে মক্কা নগরী অভিমুখে যদি তুমি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাও তাহলে আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব।” তাই নুফাইল আবরাহাকে তায়েফ নগরী পর্যন্ত পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় এবং পবিত্র মক্কা নগরী পর্যন্ত অবশিষ্ট পথ দেখানোর দায়িত্ব নুফাইল আবু রাগাল নামক তারই এক বন্ধুর ওপর ন্যস্ত করে। নতুন পথ-প্রদর্শক আবরাহার সেনাবাহিনীকে পবিত্র মক্কা নগরীর নিকটবর্তী মাগমাস নামক স্থানে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। আবরাহার সেনাবাহিনী ঐ স্থানকে সেনা ছাউনি ও তাঁবু স্থাপন করার জন্য মনোনীত করে। আর আবরাহা তার চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ী একজন সেনাপতিকে তিহামার উট ও গবাদিপশু লুণ্ঠন করার দায়িত্ব দেয়। প্রায় 200টি উট লুণ্ঠন করা হয়। লুণ্ঠিত এ সব উটের মালিক ছিলেন মক্কাপ্রধান আবদুল মুত্তালিব। অতঃপর হানাতাহ্ নামীয় এক সেনাপতিকে আবরাহা মক্কার কুরাইশ নেতা ও প্রধানের কাছে তার বাণী পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব অর্পণ করে বলেছিল, কাবাগৃহ ধ্বংস করার প্রকৃত চিত্র যেন আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে! আর নিশ্চিতভাবে কুরাইশরা প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। তবে রক্তপাত এড়ানোর জন্য তাৎক্ষণিকভাবে মক্কার পথ ধরে এগিয়ে যাবে। সেখানে পৌঁছে কুরাইশ প্রধানের খোঁজ করে সরাসরি তার কাছে গিয়ে বলবে : আমাদের মূল লক্ষ্যই হলো কাবাগৃহ ধ্বংস করা। কুরাইশরা যদি প্রতিরোধ না করে তাহলে তারা যে কোন হামলা ও আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকবে।”

আবরাহার প্রেরিত দূত পবিত্র মক্কায় পৌঁছেই কুরাইশদের বিভিন্ন দলকে আবরাহার সামরিক অভিযান সম্পর্কে আলোচনারত দেখতে পেল। মক্কাপ্রধানের খোঁজ করলে তাকে আবদুল মুত্তালিবের গৃহে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। আবদুল মুত্তালিব আবরাহার বাণী শোনার পর বললেন, আমরা কখনই প্রতিরক্ষা ও প্রতিরোধ গড়ে তুলব না। কাবা মহান আল্লাহর গৃহ যার নির্মাতা হযরত ইবরাহীম খলীল (আ.)। মহান আল্লাহ্ যা কল্যাণকর তা-ই করবেন।” আবরাহার সেনাপতি কুরাইশপ্রধানের এ ধরনের কোমল ও শান্তিপূর্ণ যুক্তি যা প্রকৃত সুমহান আত্মিক ঈমানেরই পরিচায়ক তা শ্রবণ করে সন্তোষ প্রকাশ করল এবং তার সাথে আবরাহার তাঁবুতে আসার আমন্ত্রণ জানাল।

আবরাহার শিবিরে আবদুল মুত্তালিব-এর গমন

আবদুল মুত্তালিব তাঁর কয়েক সন্তানসহ আবরাহার শিবিরের দিকে রওয়ানা হলেন। কুরাইশপ্রধানের মহত্ত্ব,স্থিরতা,ধৈর্য,গাম্ভীর্য ও ব্যক্তিত্ব আবরাহাকে বিস্ময়াভিভূত করে ফেলে। এ কারণেই সে আবদুল মুত্তালিবের প্রতি অত্যন্ত ভক্তি,শ্রদ্ধা এবং সম্মান প্রদর্শন করেছিল। এর প্রমাণস্বরূপ,সে সিংহাসন থেকে নিচে নেমে এসে আবদুল মুত্তালিবের হাত ধরে তাঁকে তার নিজের পাশে বসিয়েছিল। এরপর সে পূর্ণ ভদ্রতা ও শিষ্টাচারসহকারে দোভাষীর মাধ্যমে আবদুল মুত্তালিবকে প্রশ্ন করেছিল যে,তিনি কেন এখানে এসেছেন এবং তিনি কী চাচ্ছেন? আবদুল মুত্তালিব আবরাহার প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, তিহামার উটগুলো এবং যে দু শ’উটের মালিক আমি সেগুলো আপনার সৈন্যদের দ্বারা লুণ্ঠিত হয়েছে। আপনার কাছে আমার অনুরোধ এটিই যে,অনুগ্রহপূর্বক ঐ সকল উট স্ব স্ব মালিকের কাছে ফেরত দেয়ার আদেশ দিন।” আবরাহা বলল, আপনার আলোকিত বদনমণ্ডল আপনাকে আমার কাছে এক জগৎ পরিমাণ মহান ও বিরাট করে তুলেছে,অথচ (যখন আমি এসেছি আপনার পূর্বপুরুষদের ইবাদাতগাহ্ ধ্বংস করতে) তখন আপনার ছোট ও অতি সামান্য আবেদন আপনার মহত্ত্ব,উচ্চ সম্মান ও মর্যাদাকে কমিয়ে দিয়েছে। আমি আশা করেছিলাম যে,আপনি কাবার ব্যাপারে আলোচনা করবেন এবং অনুরোধ জানাবেন যে,আমার যে লক্ষ্য আপনাদের স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনের ওপর মারাত্মক আঘাত হানবে তা থেকে অমি যেন বিরত থাকি। না,পক্ষান্তরে আপনি কয়েকটি মূল্যহীন উটের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন এবং সেগুলো ছেড়ে দেয়ার জন্য সুপারিশ করেছেন? আবদুল মুত্তালিব আবরাহার প্রশ্নের জবাবে একটি বাক্য বলেছিলেন যা আজও তাঁর নিজস্ব মহত্ত্ব,গৌরব এবং মান বজায় রেখেছে। আর ঐ বাক্যটি ছিল :

أنا ربّ الإبل و للبيت ربّ يمنعه

“আমি উটগুলোর প্রতিপালনকারী এবং পবিত্র কাবারও এমন এক প্রভু আছেন যিনি (সব ধরনের আগ্রাসন,আক্রমণ এবং ক্ষয়ক্ষতি থেকে) উক্ত গৃহকে রক্ষা করবেন।” আবরাহা এ কথা শোনার পর খুবই দাম্ভিকতার সাথে বলেছিল, এ পথে আমার লক্ষ্য অর্জনে বাধা দেয়ার শক্তি কারো নেই।” এরপর সে লুণ্ঠিত সব ধন-সম্পদ প্রকৃত মালিকদের কাছে ফেরত দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল।

অধীর আগ্রহে কুরাইশদের অপেক্ষা

সমগ্র কুরাইশ গোত্র অধীর আগ্রহে আবদুল মুত্তালিবের ফেরার অপেক্ষায় ছিল যাতে করে তারা শত্রুর সাথে তাঁর আলোচনার ফলাফল সম্পর্কে অবগত হতে পারে। যখন আবদুল মুত্তালিব কুরাইশ গোত্রপতিদের মুখোমুখি হলেন তখন তিনি তাদেরকে বললেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাদের গবাদিপশু নিয়ে উপত্যকা ও পাহাড়-পর্বতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ কর। এর ফলে তোমরা সবাই যে কোন ধরনের ক্ষতি ও বিপদাপদ থেকে নিরাপদে থাকতে পারবে।” এ কথা শোনার পর অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সকল মক্কাবাসী তাদের নিজেদের ঘর-বাড়ী ছেড়ে পাহাড়-পর্বতে গিয়ে আশ্রয় নিল। মধ্যরাত্রিতে শিশু ও নারীদের ক্রন্দনধবনি এবং পশুসমূহের আর্তনাদ সমগ্র পাহাড়-পর্বতে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। ঐ সময় আবদুল মুত্তালিব কয়েকজন কুরাইশসহ পর্বতশৃঙ্গ থেকে নেমে এসে পবিত্র কাবায় গেলেন। ঐ সময় তাঁর চোখের চারপাশে অশ্রুবিন্দু জমেছিল। তিনি ব্যথিত অন্তরে পবিত্র কাবার দরজার কড়া হাতে নিয়ে মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলেছিলেন, হে ইলাহী! তাদের (আবরাহা ও তার বিশাল সেনাবাহিনী) অনিষ্ট সাধন ও ক্ষয়ক্ষতি করা থেকে নিরাপদ থাকার ব্যাপারে কেবল তুমি ছাড়া আর কারো প্রতি আমাদের বিন্দুমাত্র আশা নেই। হে প্রভু! তাদেরকে তোমার পবিত্র গৃহের অঙ্গন ও সীমানা থেকে প্রতিহত কর। সে-ই কাবার দুশমন যে তোমার সাথে শত্রুতা পোষণ করে। হে প্রভু! তাদেরকে তোমার পবিত্র ঘর ধ্বংস করার ক্ষেত্রে ব্যর্থ করে দাও। হে প্রভু! তোমার বান্দা নিজের ঘরকে রক্ষা করে। তাই তুমিও তোমার ঘরকে রক্ষা কর। ঐ দিনকে (আমাদের কাছে) আসতে দিও না যে দিন তাদের ক্রুশ জয়যুক্ত হবে,আর তাদের প্রতারণাও সফল ও বিজয়ী হবে। 111

এরপর তিনি কাবাগৃহের দরজার কড়া ছেড়ে দিয়ে পর্বতশৃঙ্গে ফিরে আসলেন এবং সেখান থেকে পুরো ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে লাগলেন। প্রভাতে যখন আবরাহা ও তার সেনাবাহিনী মক্কাভিমুখে রওয়ানা হল তখন হঠাৎ ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি সমুদ্রের দিক থেকে আকাশে আবির্ভূত হলো যেগুলোর প্রতিটির মুখ ও পায়ে ছিল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পাথর। পাখিদের ছায়ায় সৈন্যশিবিরের আকাশ কালো হয়ে গিয়েছিল। বাহ্যিকভাবে এগুলোর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অস্ত্র অতি বিস্ময়কর প্রভাব ও ফলাফল সৃষ্টি করল। মহান আল্লাহর নির্দেশে ঐ সব পাখি আবরাহার বাহিনীর ওপর পাথর বর্ষণ করল যার ফলে তাদের মাথা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল এবং দেহের মাংসগুলো খসে পড়ল। একটি ক্ষুদ্র পাথর আবরাহার মাথায়ও আঘাত করলে সে খুব ভয় পেয়ে গেল এবং তার দেহে কম্পন শুরু হলো। সে নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারল যে,মহান আল্লাহর ক্রোধ ও গজব তাকে ঘিরে ফেলেছে। সেনাদলের দিকে তাকালে সে দেখতে পেল যে,তাদের মৃতদেহগুলো গাছের পাতা ঠিক যেভাবে মাটিতে পড়ে থাকে ঠিক সেভাবে মাটিতে পড়ে আছে। কালবিলম্ব না করে তার সেনাবাহিনীর যারা বেঁচে আছে,যে পথ ধরে তারা এসেছিল ঠিক সে পথেই ইয়েমেনের রাজধানী সানাআয় ফিরে যাবার জন্য সে নির্দেশ দিল। আবরাহার সেনাদলের মধ্যে থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া সৈন্যরা সানাআর দিকে রওয়ানা হলো। কিন্তু পথিমধ্যে অনেক সৈন্যই ক্ষত ও ভীতিজনিত কারণে প্রাণত্যাগ করল,এমনকি আবরাহাও যখন সানাআয় পৌঁছল তখন তার শরীরের মাংস খসে পড়ল এবং আশ্চর্যজনক অবস্থার মধ্যে তার মৃত্যু হলো।

বিস্ময়কর ও ভীতিপ্রদ এ ঘটনাটি পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি করল। হাতিওয়ালাদের কাহিনী পবিত্র কোরআনের সূরা ফীল-এ এভাবে বর্ণিত হয়েছে : আপনি কি দেখেন নি যে,আপনার প্রভু হাতিওয়ালাদের সাথে কিরূপ আচরণ করেছেন? তাদের ষড়যন্ত্র কি তিনি ব্যর্থ করে দেন নি? তিনি তাদের ওপর এক ঝাঁক পাখি প্রেরণ করেছিলেন যেগুলো তাদের ওপর পোড়ামাটির তৈরি কঙ্কর নিক্ষেপকরতঃ তাদেরকে চর্বিত ঘাস ও পাতার মতো পিষ্ট করে দিয়েছিল।”

) بسم الله الرّحمان الرّحيم -ألم تر كيف فعل ربّك بأصحاب الفيل-ألم يجعل كيدهم في تضليل-و أرسل عليهم طيرا أبابيل-ترميهم بحجارة من سجيل-فجعلهم كعصف مأكول(

আমরা এখন যা কিছু আলোচনা করলাম আসলে তা এ ক্ষেত্রে বর্ণিত ইসলামী ঐতিহাসিক বর্ণনাসমূহের সারসংক্ষেপ এবং পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট বর্ণনাও ঠিক এটিই। এখন আমরা প্রখ্যাত মিশরীয় মুফাসসির মুহাম্মদ আবদুহু’এবং মিশরের ভূতপূর্ব সংস্কৃতিমন্ত্রী প্রখ্যাত পণ্ডিত (ড. হাইকাল) এতৎসংক্রান্ত যা বলেছেন তা পর্যালোচনা করে দেখব।