চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড1%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 107480 / ডাউনলোড: 9830
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

4

মুজিযা সংক্রান্ত আলোচনা

প্রকৃতিবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিদ্যায় মানব জাতির সর্বশেষ অগ্রগতিসমূহ এবং বহুসংখ্যক বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ভ্রান্ত প্রমাণিত হওয়ার বিষয়টি পাশ্চাত্যে এক অতি বিস্ময়কর হট্টগোল সৃষ্টি করেছিল,অথচ এ সব পরিবর্তন আসলে ছিল বৈজ্ঞানিক পরিবর্তন এবং তা প্রকৃতিবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিদ্যাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতো এবং ধর্মীয় আকীদা-বিশ্বাসের সাথে এ সব পরিবর্তনের মোটেও কোন সম্পর্ক ছিল না। এত কিছু সত্ত্বেও এ পরিবর্তন সকল শাস্ত্র ও বংশানুক্রমিক আকীদা-বিশ্বাসের প্রতি একদল মানুষের মধ্যে এক আশ্চর্যজনক নৈরাশ্যবাদের উদ্ভবের কারণ হয়েছিল।

এ নৈরাশ্যবাদের মূল রহস্য ছিল এই যে,বিজ্ঞানীরা দেখতে পেলেন,পুরানো তত্ত্বগুলো যা শত শত বছর ধরে মানব-চিন্তাধারা এবং বৈজ্ঞানিক মহলের ওপর একচেটিয়া প্রভুত্ব বিস্তার করে রেখেছিল তা আজ আধুনিক বিজ্ঞান,পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক মূল্যায়নে বাতিল ও ভ্রান্ত প্রমাণিত হচ্ছে। পৃথিবীকেন্দ্রিক ন টি জ্যোতিষ্কমণ্ডল এবং শত শত তত্ত্বের আজ আর কোন খবরই নেই। এ ধরনের পরিস্থিতিতে তাঁরা নিজেরাই নিজেদের কাছে প্রশ্ন করছেন, কোথা থেকে এবং কিভাবে আমরা বুঝতে ও জানতে পারব যে,আমাদের বাদবাকী ধর্মীয় বিশ্বাস ও বৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণাও ঠিক এমন হবে না? এ ধরনের ধ্যান-ধারণা একদল বৈজ্ঞানিক ও পণ্ডিতের মধ্যে সকল ধরনের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত আকীদা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে সন্দেহের বীজ বপন করে দিয়েছে এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে তা বেশ বিস্তৃতি লাভ করেছে এবং সংক্রামক ব্যাধির ন্যায় বৈজ্ঞানিক মহলগুলোর একাংশের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে।

এছাড়াও আকীদা-বিশ্বাস অনুসন্ধানকারী বিচারালয় এবং গীর্জার ধর্মযাজকদের কড়াকড়ি এ নৈরাশ্যবাদের উৎপত্তির মূল কারণ;বরং তা এ ধরনের মতবাদ বিকাশের ক্ষেত্রে পূর্ণ মাত্রায় অবদান রেখেছে। কারণ গীর্জা নিষেধাজ্ঞা ও নির্যাতন করার মাধ্যমে তদানীন্তন বৈজ্ঞানিক ও পণ্ডিতদেরকে,যাঁরা বৈজ্ঞানিক সূত্র ও নিয়ম-নীতি প্রণয়নে সফল হয়েছিলেন পবিত্র বাইবেলের সাথে বিরোধিতা করার অজুহাতে হত্যা করত। বলার অপেক্ষা রাখে না যে,এ ধরনের চাপ ও কার্যকলাপ প্রতিক্রিয়াবিহীন হতে পারে না। আর সেদিন থেকেই ভবিষ্যদ্বাণী ও ধারণা করা হতো যে,বৈজ্ঞানিক ও পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ যদি একদিন ক্ষমতা ফিরে পায়,তাহলে গীর্জার অব্যবস্থাপনা,অদক্ষতা এবং প্রয়োজনীয় পরিচালনাকারী ক্ষমতার অভাববশত সার্বিকভাবে ধর্ম ও ধার্মিকতারই ফাতিহা পাঠ করতে হবে।

ঘটনাচক্রে পুরো ব্যাপারটিই এমন হয়ে গিয়েছিল। বিজ্ঞান যতই উন্নতি লাভ করছিল এবং বৈজ্ঞানিকগণ প্রাকৃতিক বস্তু ও পদার্থসমূহের মধ্যকার বিভিন্ন সম্পর্ক যত (ভালোভাবে) বুঝতে পারছিলেন,আর বহু সংখ্যক প্রাকৃতিক প্রপঞ্চ ও বিভিন্ন জরা-ব্যাধির কারণগুলো যে হারে আবিষ্কৃত হচ্ছিল ঠিক সে হারে অতি প্রাকৃতিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়াদি,অস্তিত্বের উৎসমূল,পরকাল এবং নবীদের মুজিযা ও অলৌকিক কার্যাবলীর প্রতি সবচেয়ে কম গুরুত্ব দেয়া হচ্ছিল এবং সংশয়বাদী ও নাস্তিকদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল।

বিজ্ঞানীদের মহলে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ও সাফল্যকে কেন্দ্র করে যে গর্ব ও অহংকারের উদ্ভব হয়েছিল তার ফলে কতিপয় প্রকৃতিবিজ্ঞানী সকল ধর্মীয় বিষয়কেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখতে থাকেন এবং তাওরাত ও ইঞ্জিলের মুজিযাসমূহের কোন একটির নাম পর্যন্ত তাঁরা উচ্চারণ করা থেকে বিরত থাকেন।

তাঁরা হযরত মূসা (আ.)-এর লাঠি ও তাঁর শ্বেতশুভ্র হাতের কাহিনীকে গাঁজাখুরি উপাখ্যান বলে গণ্য করেছেন এবং মহান আল্লাহ্পাকের অনুমতি নিয়ে ঈসা (আ.)-এর ফুঁ দিয়ে মৃতদেরকে জীবিত করার কাহিনীকেও অবাস্তব কাহিনী বলে অভিহিত করেছেন। তাঁদের এ ধরনের অভিব্যক্তি ও বিশ্বাস করার কারণ হচ্ছে,তাঁরা নিজেদের কাছেই প্রশ্ন রেখে বলেন,কোন প্রাকৃতিক কারণ ছাড়াই কি এক টুকরা কাঠ একটি বিরাট অজগর সাপের রূপ ধারণ করতে পারে? একটি প্রার্থনার বদৌলতে কি কোন মৃত জীবিত হতে পারে? বৈজ্ঞানিকগণ যাঁরা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁদের সাফল্য ও কৃতকার্যতার মদমত্ততায় মাতাল হয়ে গিয়েছিলেন তাঁরাই এমন চিন্তা-ভাবনা করতে থাকেন যে,তাঁরা সকল জ্ঞান-বিজ্ঞান,শাস্ত্র ও বিদ্যার চাবিকাঠি পেয়ে গেছেন এবং সকল বস্তু ও ঘটনার মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কও ভালোভাবে উপলব্ধি করেছেন। এ কারণেই তাঁরা ভাবতে থাকেন যে,এক টুকরা শুষ্ক কাঠ ও সাপ অথবা এক ব্যক্তির প্রার্থনা ও মনোনিবেশ ও মৃতদের জীবিত হওয়ার মধ্যে কোন সম্পর্কই বিদ্যমান নেই। তাই তাঁরা এ ধরনের বিষয়ের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেছেন অথবা তাঁরা কখনো কখনো এগুলো অস্বীকারও করেছেন।

কিছু সংখ্যক বিজ্ঞানীর চিন্তা-ভাবনার ধরন

এ ধরনের চিন্তা-ভাবনা মিশরের কতিপয় বিজ্ঞানী ও সুধীমহলে অনুপ্রবেশ করেছিল এবং তাঁরাই এ ধরনের ধ্যান-ধারণা ও চিন্তাধারার দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন। এ কারণেই তাঁরা ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক বিষয়াদি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে এ ধরনের পথ ও পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। মূল বিষয় হচ্ছে এই যে,এ গোষ্ঠীটি সব কিছুর আগে পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানী ও পণ্ডিতদের চিন্তাধারা এবং ধ্যান-ধারণার সাথে পরিচিত হয়েছিলেন এবং পাশ্চাত্যের কিছু কিছু চিন্তা-দর্শন তাঁরা ঠিক এ পথেই মুসলিম বিশ্ব ও ইসলামী দেশসমূহে আমদানী করেছেন।

এদের মধ্যে কেউ কেউ এমন এক পথ বেছে নিয়েছেন যে,সে পথে তাঁরা পবিত্র কোরআন ও নির্ভুল হাদীসের প্রতি যেমন সম্মান প্রদর্শন করতে চান,ঠিক তেমনি নিজেদের প্রতিও প্রকৃতিবিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চান। অথবা ন্যূনতম পর্যায়ে তাঁরা এমন কোন তত্ত্ব গ্রহণ করতে চান না যা প্রকৃতিবিজ্ঞানের নিয়ম-কানুনের দ্বারা ব্যাখ্যা করা অসম্ভব।

এ দলটি প্রত্যক্ষ করেন যে,পবিত্র কোরআন কতগুলো মুজিযা বর্ণনা করেছে যা কখনই সাধারণ (প্রকৃতি) বিজ্ঞানের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায় না। কারণ বিরাট অজগর সাপে পরিণত হওয়ার সাথে কাঠের সম্পর্ককে বিজ্ঞান নির্ণয় করতে অপারগ। আবার অন্যদিকে তাঁদের পক্ষে এমন কোন তত্ত্ব মেনে নেয়াও অত্যন্ত কঠিন যা ইন্দ্রিয়ানুভূতি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মতো বৈজ্ঞানিক উপায়-উপকরণের সাহায্যে প্রমাণ করা সম্ভব নয়।

(ধর্মীয়) বিশ্বাস ও বিজ্ঞানের মধ্যে বাহ্যিক এ দ্বন্দ্বের কারণে তাঁরা এমন পথ অবলম্বন করেছেন যার মাধ্যমে এ ধরনের দ্বন্দ্বের নিষ্পত্তি করা সম্ভব। আর এভাবে পবিত্র কোরআন এবং অকাট্য হাদীসসমূহের বাহ্য অর্থসমূহ যেমন সংরক্ষিত হবে,ঠিক তেমনি তাঁদের বক্তব্যও বৈজ্ঞানিক সূত্র ও নীতিমালার বিরোধী হবে না। আর তা হলো তাঁরা মহান নবীদের সকল মুজিযা ও অলৌকিক কার্যকলাপকে যুগোপযোগী বৈজ্ঞানিক নীতিমালার আলোকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করবেন যে,সেগুলো স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক বিষয় বলে প্রতিভাত হবে। এমতাবস্থায় পবিত্র কোরআন ও অকাট্য হাদীসসমূহের সম্মান যেমন সংরক্ষিত হলো ঠিক তেমনি তা (মুজিযা সংক্রান্ত ব্যাখ্যা) বিজ্ঞানেরও পরিপন্থী হলো না। আমরা নমুনাস্বরূপ আবরাহার হস্তিবাহিনীর কাহিনী সংক্রান্ত যে ব্যাখ্যা মিশরের প্রসিদ্ধ আলেম শেখ মুহাম্মদ আবদুহু দিয়েছেন তা এখানে উল্লেখ করব :

পাথুরে মাটি ও ধুলা-বালিবাহিত বসন্ত ও হাম রোগ মশা-মাছির মতো উড়ন্ত কীট-পতঙ্গের মাধ্যমে আবরাহার সেনাবাহিনীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল।بحجارة من سجّيل ১১২   এর অর্থ প্রস্তরমিশ্রিত বিষাক্ত (দূষিত) কাদা যা বাতাসের মাধ্যমে বিস্তৃত হয়েছিল এবং ছড়িয়ে পড়েছিল। আবরাহার সৈন্যদের হাত ও পা ঐ দূষিত প্রস্তরমিশ্রিত কাদা ও ধুলা-বালি দ্বারা মেখে গিয়েছিল এবং ঐ সকল কীট-পতঙ্গের সংস্পর্শে এসে মানুষের দেহের ত্বকের সূক্ষ্ম রন্ধ্র ও রোমকূপসমূহে রোগজীবাণুর সংক্রমণ হয় যার ফলে দেহে মারাত্মক ক্ষতের সৃষ্টি হয়। এগুলোই হচ্ছে মহান আল্লাহর শক্তিশালী সেনাদল যেগুলোকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় জীবাণু’নামকরণ করা হয়েছে।

বর্তমান যুগের একজন লেখক উপরিউক্ত আলেমের বক্তব্য সমর্থন করে লিখেছেন, طين (তীন) যা পবিত্র কোরআনে উল্লিখিত হয়েছে তার অর্থ হচ্ছে উড়ন্ত প্রাণী যা মশা ও মাছিকেও শামিল করে।”

তাঁদের বক্তব্য পর্যালোচনা করার আগে আমাদেরকে বাধ্য হয়েই হস্তিবাহিনী সম্পর্কে যে সূরা অবতীর্ণ হয়েছে সেটি পুনরায় পাঠকবর্গের সামনে উপস্থাপন করতে হবে। মহান আল্লাহ্ সূরা ফীল-এ এরশাদ করেছেন :

) ألَمْ تر كيف فعل ربُّك بأصحاب الفيل، ألَم يجعل كيدهم في تضليل، و أرسل عليهم طيراً أبابيل، ترميهم بحجارة من سجّيل، فجعلهم كعصف مأْكول( .

“আপনি কি দেখেন নি যে,আপনার প্রভু হস্তিবাহিনীর সাথে কি আচরণ করেছেন? তিনি কি তাদের চক্রান্ত নস্যাৎ করে দেন নি? তিনি এক ঝাঁক পাখি তাদের (ঐ সেনাবাহিনীর) দিকে প্রেরণ করেছিলেন যেগুলো পোড়া-মাটিনির্মিত কঙ্কর তাদের ওপর নিক্ষেপ করেছিল এবং তিনি তাদের দেহকে চর্বিত ঘাসের ন্যায় ছিন্ন-ভিন্ন করে ফেলেছিলেন।”

এ আয়াতগুলোর বাহ্য অর্থ থেকে প্রতীয়মান হয় যে,আবরাহার জাতি ও সম্প্রদায় মহান আল্লাহর ক্রোধ ও গজবের শিকার হয়েছিল। এ সব ছোট ছোট কঙ্করই ছিল তাদের মৃত্যুর একমাত্র কারণ। এক ঝাঁক পাখি তাদের মাথা,মুখমণ্ডল ও দেহের ওপর এ সব কঙ্কর নিক্ষেপ করেছিল। এ আয়াতগুলোর অন্তর্নিহিত অর্থের দিকে গভীরভাবে দৃকপাত করলে প্রতীয়মান হয় যে,আবরাহার বিশাল হস্তিবাহিনীর ধ্বংস ও মৃত্যু কেবল এ অস্বাভাবিক অস্ত্রের দ্বারাই সংঘটিত হয়েছে। (এ অধমের দৃষ্টিতে উপরিউক্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কঙ্কর ছিল আসলে অত্যন্ত শক্তিশালী এবং ভিত্ উৎপাটনকারী) সুতরাং এ আয়াতগুলোর বাহ্য অর্থের পরিপন্থী যে কোন ব্যাখ্যাই অকাট্য দলিল-প্রমাণ এর পক্ষে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য হবে না।

উপরিউক্ত ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য কিছু বিষয়

১. পূর্বোক্ত ব্যাখ্যাটিও সমগ্র ঘটনাকে প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক বলে প্রকাশ করতে পারে নি। উক্ত কাহিনীতে এরপরও এমন কিছু বিষয় ও দিক আছে যেগুলো অদৃশ্য (গায়েবী) কার্যকারণসমূহের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা উচিত। কারণ যদি ধরেও নিই যে,বসন্ত ও টাইফয়েড জ্বরের রোগজীবাণুর দ্বারাই আবরাহার সেনাবাহিনীর মৃত্যু হয়েছে এবং তাদের মৃতদেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে তাহলে এ সব পাখি কোন্ সত্তার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও নির্দেশনা পেয়ে বুঝতে পেরেছিল যে,বসন্ত ও টাইফয়েড জ্বরের রোগজীবাণু ঐ সব কঙ্করের মধ্যে স্থান নিয়েছে এবং তখন পাখিগুলো তাদের নিজেদের খাদ্য ও দানা-পানি সংগ্রহ করার পরিবর্তে এক ঝাঁক একত্রে ঐ সব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কঙ্করের কাছে গিয়েছে এবং চঞ্চুর মধ্যে সেগুলো পুরে এক সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর ন্যায় আবরাহার সেনাবাহিনীর ওপর তা বর্ষণ করেছে? এমতাবস্থায় সমগ্র ঘটনাপ্রবাহকে স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক বলা যাবে কি? এ মহাঘটনার একটি অংশের ব্যাখ্যা যদি গায়েবী কার্যকারণসমূহের মাধ্যমেই করতে হয় এবং মহান আল্লাহর ইচ্ছা এ ক্ষেত্রে যদি কার্যকর থাকে তাহলে উক্ত ঘটনার আরেক অংশকে স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক বলে দেখানোর কি আর কোন প্রয়োজন আছে?

২. অণুজীব প্রাণীসমূহ যা বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় জীবাণু’নামে অভিহিত এবং মানুষের শত্রু বলে গণ্য,সেদিন (আবরাহার ওপর কঙ্কর বর্ষণের দিনে) কোন ব্যক্তির সাথে সেগুলোর কোন আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল না এতদ্সত্ত্বেও এ জঘন্য ভয়ঙ্কর শত্রু কিভাবে কেবল আবরাহার সৈন্যদেরকেই আক্রান্ত করেছিল এবং মক্কাবাসীদেরকে পুরোপুরি ভুলেই গিয়েছিল? আমাদের যে সব ইতিহাস জানা আছে সে সব কিছু থেকে প্রতীয়মান হয় যে,সকল ক্ষয়ক্ষতি কেবল আবরাহার সেনাবাহিনীরই হয়েছিল,অথচ বসন্ত ও টাইফয়েড হচ্ছে সংক্রামক ব্যাধি এবং বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক উপাদান ও পদার্থের মাধ্যমে উক্ত রোগ এক স্থান থেকে অন্যস্থানে বিস্তৃত ও স্থানান্তরিত হয়। পরিশেষে এ রোগ কখনো কখনো একটি দেশকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসও করে ফেলে।

তাহলে এরপর কি এ ঘটনাকে একটি স্বাভবিক প্রাকৃতিক ঘটনা বলে গণ্য করা যাবে?

৩. সংক্রামক ব্যাধি সৃষ্টিকারী রোগজীবাণু কি ধরনের ছিল সে ব্যাপারেও এ সব ব্যাখ্যাকারীদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে। আর এ কারণেই তাঁদের প্রদত্ত তত্ত্বটি আরো বেশি নড়বড়ে ও ভিত্তিহীন হয়ে গেছে। কখনো বলা হয় যে,রোগজীবাণুটি ছিল কলেরার,কখনো বলা হয়েছে তা ছিল টাইফয়েড ও বসন্তের জীবাণু। অথচ এ ধরনের বক্তব্য ও মতপার্থক্যের কোন সঠিক ও নির্ভরযোগ্য দলিল-প্রমাণ আমরা খুঁজে পাই নি। মুফাসসিরদের মধ্যে কেবল ইকরামাহ্ এ সম্ভাবনা সম্পর্কে বলেছেন এবং ইতিহাস লেখকদের মধ্যে কেবল ইবনে আসীর তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে একটি দুর্বল বক্তব্য হিসাবে এ সম্ভাবনার উদ্ধৃতি দিয়েছেন এবং তিনি সাথে সাথে তা রদও করেছেন।১১৩ এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে,মুফাসসির ইকরামাহ্ সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে যথেষ্ট কথা আছে।

সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাখ্যা হচ্ছে ঐ ব্যাখ্যা যা মিশরের ভূতপূর্ব সংস্কৃতিমন্ত্রী ড. হাইকাল রচিত হায়াতু মুহাম্মদ’অর্থাৎ মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনচরিত গ্রন্থে হস্তিবাহিনীর বিস্তারিত বিবরণ প্রসঙ্গে এসেছে। সূরা ফীলের আয়াতগুলো উল্লেখ করার পর এবং আর তাদের ওপর তিনি প্রেরণ করলেন এক ঝাঁক পাখি’-এ আয়াতটিও তার চোখের সামনে থাকা সত্ত্বেও তিনি আবরাহার সৈন্যদের মৃত্যুর ব্যাপারে লিখেছেন, সম্ভবত বাতাসের সাথে কলেরার রোগজীবাণু সমুদ্রের দিক থেকে এসেছিল।” রোগজীবাণু আনয়নকারী যদি বাতাসই হয়ে থাকে তাহলে পাখিগুলো কি কারণে আবরাহার সৈন্যদের মাথার ওপর উড়ছিল এবং এ সব কঙ্কর নিক্ষেপ করছিল? আর এ সব কঙ্কর আবরাহার সৈন্যদের মৃত্যু ঘটানোর ক্ষেত্রে কতটুকুই বা প্রভাব রেখেছিল?

সত্যি বলতে কি,আমরা এ ধরনের চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি মেনে নিতে পারি না এবং বিনা কারণে মহান নবী ও ওলীদের বড় বড় মুজিযার অপব্যাখ্যাও করতে পারি না। প্রকৃতিবিজ্ঞানের আলোচ্য বিভিন্ন বিষয় এবং মুজিযা ভিন্ন দু টি পথ। উপরন্তু প্রকৃতিবিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়াদির পরিধি কেবল প্রাকৃতিক প্রপঞ্চ ও পদার্থসমূহের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্কসমূহ নির্ণয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যে সব ব্যক্তির ধর্মসংক্রান্ত জ্ঞান খুবই সামান্য এবং এ ধরনের বিষয় সংক্রান্ত যাদের কোন জ্ঞান ও ধারণাই নেই তাদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্য আমাদের ধর্মের অকাট্য মূলনীতি ও আকীদা-বিশ্বাস বর্জন করা অনুচিত,অথচ আমরা এ ধরনের কাজ বাধ্যতামূলক বলে বিশ্বাস করি না। (অর্থাৎ ঐ সব ব্যক্তিকে সন্তুষ্ট করার জন্য আমাদের ধর্মীয় মৌলিক আকীদা-বিশ্বাস যা অকাট্য যুক্তি ও দলিল-প্রমাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত তা বর্জন করা অথবা ঐ সকল ব্যক্তির মর্জিমাফিক ব্যাখ্যা ও বিকৃত করা মোটেও বাধ্যতামূলক নয়)।

দু টি প্রয়োজনীয় বিষয়

এখানে দু টি বিষয় অবশ্যই উল্লেখ করা উচিত। বিষয়দ্বয় হচ্ছে :

১. বুঝতে যেন ভুল না হয় যে,যে সব কাজ ও ঘটনা জনগণের মুখে মুখে উচ্চারিত এবং মহান নবী ও সৎকর্মশীল বান্দাদের সাথে সম্পর্কিত বলে গণ্য হয়,অথচ যেগুলোর কোন সঠিক দলিল-প্রমাণ নেই এবং কখনো কখনো কুসংস্কারাচ্ছন্ন দিক সম্বলিত আমরা সেগুলোকে এ ধরনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে সঠিক বলে প্রমাণ করতে চাই না,বরং আমাদের প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচেছ এই যে,আমাদের হাতে বিদ্যমান অকাট্য দলিল-প্রমাণাদির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করব যে,অতিপ্রাকৃতিক জগতের সাথে নিজেদের সম্পর্ক ও যোগাযোগ প্রমাণ করার জন্য মহান নবিগণ অলৌকিক কাজ করে থাকেন যা আধুনিক প্রকৃতিবিজ্ঞানও এর কারণসমূহ উপলব্ধি করতে অপারগ। এ ধরনের মুজিযার ব্যাপারে আমাদের সমর্থনই হচ্ছে আমাদের প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

২. আমরা কখনই বলি না যে,মুজিযার অস্তিত্ব আসলে কার্যকারণ ও ফলাফল থেকে ব্যতিক্রম ও ভিন্ন। আমরা উপরিউক্ত সূত্রের ব্যাপারে সম্মান প্রদর্শন করার পাশাপাশি বিশ্বাস করি যে,এ নিখিল বিশ্বের সকল অস্তিত্ববান সত্তারই কারণ আছে। আর যে কোন অস্তিত্ববান সত্তাই কারণবিহীনভাবে অস্তিত্ববান হতে পারে না। তবে আমরা বলি,এ ধরনের ঘটনাবলীরও (মুজিযাসমূহের) আবার কতগুলো অস্বাভাবিক কারণ আছে। আর এ ধরনের আধ্যাত্মিক (অলৌকিক) কার্যকারণ সম্মানিত সৎকর্মশীল বান্দাদের ইখতিয়ারে। বৈজ্ঞানিক অভিজ্ঞতা ও ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত যেহেতু এ ধরনের কার্যকারণসমূহ অনাবিস্কৃত রয়ে গেছে-শুধু এ অজুহাত দেখিয়ে এগুলো অস্বীকার করা যাবে না। এখানে স্মর্তব্য যে,সকল নবীরই অলৌকিক কাজগুলোর কোন না কোন কারণ আছে যা সাধারণ প্রাকৃতিক কার্যকারণাদির দ্বারা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। আর এগুলো যদি এ পদ্ধতির আলোকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয় তাহলে তা আর মুজিযা বলে গণ্য হবে না।

আবরাহার পরাজয়ের পর

আবরাহার মৃত্যু এবং পবিত্র কাবা ও কুরাইশদের শত্রুদের জীবন বিনষ্ট ও ধ্বংস হওয়ার কারণে মক্কাবাসিগণ ও পবিত্র কাবা আরবদের দৃষ্টিতে বিরল ও বিপুল মর্যাদার অধিকারী হয়েছিল। এর ফলে কুরাইশদের এলাকা আক্রমণ,তাদেরকে কষ্ট দেয়া এবং তাওহীদের প্রাণকেন্দ্র পবিত্র কাবা ধ্বংস ও বিরান করার কথা কেউ আর ভেবে দেখারও সাহস করে নি। সাধারণ মানুষ ঠিক এমনই অভিমত ব্যক্ত করত যে,মহান আল্লাহ্ তাঁর নিজ ঘর পবিত্র কাবা এবং কুরাইশদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করার উদ্দেশ্যেই তাদের প্রধান শত্রুকে সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। কিন্তু কমসংখ্যক ব্যক্তিই চিন্তা করত যে,এ মহাঘটনা কেবল পবিত্র কাবা হিফাজত করার উদ্দেশ্যেই ঘটেছিল;আর কুরাইশদের বিরাটত্ব ও ক্ষুদ্রতা এ ক্ষেত্রে মোটেও প্রভাব রাখে নি। এর প্রমাণস্বরূপ,কুরাইশদের ওপর তদানীন্তন অন্যান্য গোত্রপতির পক্ষ থেকে সংঘটিত বারংবার আক্রমণসমূহ। এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে,আবরাহার আক্রমণের সময় যে অবস্থা ও পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল সে ধরনের অবস্থা ও পরিস্থিতি এ সব আক্রমণের ক্ষেত্রে হয় নি।

বিনা আয়েশে অর্জিত এ বিজয় যা কুরাইশদের ক্ষতি ও রক্তপাত ছাড়াই সংঘটিত হয়েছিল তা কুরাইশদের মাঝে নতুন নতুন চিন্তা-ভাবনার উদ্ভব ঘটিয়েছিল। তাদের গর্ব,অহংকার,উপেক্ষা ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার মনোবৃত্তি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছিল। তারা অন্যদের (অ-কুরাইশদের) ব্যাপারে সীমাবদ্ধতা আরোপের কথাও চিন্তা-ভাবনা করতে থাকে। কারণ তারা নিজেদেরকে আরবদের মধ্যে সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত,সম্মানিত ও শ্রেষ্ঠ শ্রেণী বলে মনে করত। তারা বিশ্বাস করত কেবল তারাই ৩৬০টি প্রতিমা ও বিগ্রহের সুদৃষ্টিতে রয়েছে এবং তাদের দ্বারা সাহায্যপ্রাপ্ত ও আশীর্বাদপুষ্ট।

এ কারণেই তারা নিজেদের আমোদ-প্রমোদ ও ভোগবিলাসের পরিধি আরো ব্যাপক ও বিস্তৃত করার সিদ্ধান্ত নেয়। তাই তারা খেজুরের তৈরি মদের পাত্রগুলো মাথায় করে বয়ে বেড়াত;কখনো কখনো তারা পবিত্র কাবার চারপাশে মদপানের আসর বসাত। তারা মনে করত যে,বিভিন্ন আরব গোত্রের কাঠ ও লৌহনির্মিত প্রতিমাসমূহের পাশে তাদের জীবনের সর্বোত্তম মুহূর্তগুলো কাটাচ্ছে। আর যারাই হীরা নগরীর মুনজেরি,শামের গাসসানীয় এবং ইয়েমেনের গোত্রগুলো সম্পর্কে যে সব গল্প ও কাহিনী শুনেছিল তারা সে সব কাহিনী ও গল্প সে সব আসরে উপস্থিত ব্যক্তিদের কাছে বর্ণনা করত। তারা বিশ্বাস করত,তাদের এ মধুর জীবন উক্ত প্রতিমা ও মূর্তিগুলোর সুদৃষ্টির প্রত্যক্ষ ফল যা সর্বসাধারণ আরব জাতিকে তাদের (কুরাইশদের) সামনে হীন ও অপদস্থ করেছে এবং তাদেরকে সকলের ওপর শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।


6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53

54

55

56

57

58

59

60

61