পঞ্চম অধ্যায় : বিশ্বনবী মুহাম্মদ মুস্তাফা (সা.)-এর শুভ জন্ম
“
এক মহান তারা ঝিলমিল করল ও সভার মধ্যমণি হলো
আমাদের ব্যথিত অন্তরের অন্তরঙ্গ বন্ধু ও সুহৃদ হলো।”
জাহেলিয়াতের কালো মেঘ সমগ্র আরব উপদ্বীপের ওপর ছায়া মেলে রেখেছিল। অসৎ ও ঘৃণ্য কার্যকলাপ,রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ-বিগ্রহ,লুটতরাজ ও সন্তান হত্যা সব ধরনের নৈতিক গুণের বিলুপ্তি ঘটিয়েছিল। তাদের জীবন-মৃত্যুর মধ্যকার ব্যবধান মাত্রাতিরিক্তভাবে সংক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এহেন পরিস্থিতিতে সৌভাগ্যরবি উদিত হলো এবং সমগ্র আরব উপদ্বীপ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শুভ জন্মোপলক্ষে আলোকোজ্জ্বল হয়ে গেল। আর এ পথেই একটি অনগ্রসর জাতির সৌভাগ্যের ভিত্তিও স্থাপিত হলো। অনতিবিলম্বে এ নূরের বিচ্ছুরণে সমগ্র জগৎ আলোকোদ্ভাসিত হলো এবং সমগ্র বিশ্বে এক সুমহান মানব সভ্যতার ভিত্তিও নির্মিত হয়ে গেল।
মহান মনীষীদের শৈশব
প্রত্যেক মহামানব ও মনীষীর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় গভীরভাবে অধ্যয়ন করা উচিত। কখনো কখনো কোন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব এতটা মহান ও ব্যাপক যে,তাঁর জীবনের সমস্ত অধ্যায়,এমনকি তাঁর শৈশব ও মাতৃস্তন্য পান করার সময়কালের প্রতিও বিশেষ দৃষ্টি দেয়া হয়। যুগের প্রতিভাবান ব্যক্তিবর্গ,সমাজের নেতৃবৃন্দ ও সভ্যতার কাফেলার অগ্রবর্তীদের জীবন সাধারণত আকর্ষণীয়,সংবেদনশীল ও আশ্চর্যজনক পর্যায় ও দিক সম্বলিত। তাঁদের জীবনের প্রতিটি ছত্র যেদিন তাঁদের ভ্রুণ মাতৃজঠরে স্থাপিত হয় সেদিন থেকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রহস্যাবৃত। আমরা বিশ্বের মহামানবদের শৈশব ও বাল্যকাল অধ্যয়ন করলে দেখতে পাই যে,তা আশ্চর্যজনক ও অলৌকিক বিষয়াদি দিয়ে ভরপুর। আর আমরা যদি এ ধরনের বিষয় বিশ্বের সেরা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে মেনে নিই তাহলে মহান আল্লাহর প্রিয় নবী ও ওলীদের ক্ষেত্রে এতদসদৃশ বিষয়াদি মেনে নেয়াও খুব সহজ হবে।
পবিত্র কোরআন হযরত মূসা (আ.)-এর শৈশব ও বাল্যকাল অত্যন্ত রহস্যময় বলে ব্যাখ্যা করেছে এবং এ প্রসঙ্গে বলেছে : মূসা (আ.) যাতে জন্মগ্রহণ করতে না পারে সেজন্য ফিরআউন সরকারের নির্দেশে শত শত নিষ্পাপ শিশুর শিরোচ্ছেদ করা হয়েছিল। মূসা (আ.)-এর জন্মগ্রহণ ও এ পৃথিবীতে আগমনের সাথেই মহান আল্লাহর ঐশী ইচ্ছা জড়িত হয়েছিল বিধায় শত্রুরা তাঁর ক্ষতিসাধন তো করতে পারেই নি,বরং তাঁর সবচেয়ে বড় শত্রুও (ফিরআউন) তাঁর প্রতিপালনকারী ও পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হয়েছিল। পবিত্র কোরআন এরশাদ করেছে :“
আমরা মূসার মাকে ওহী করেছিলাম যে,সন্তানকে একটি বাক্সে রেখে সমুদ্রে ফেলে দাও,তাহলে সমুদ্রের তরঙ্গ ওকে মুক্তির সৈকতে পৌঁছে দেবে। আমার ও তার শত্রু তার প্রতিপালন করবে;আমি শত্রুর বুকে তার প্রতি গভীর ভালোবাসা ও মমত্ববোধের উদ্ভব ঘটাব। আর এভাবে আমি পুনরায় তোমার সন্তানকে তোমার কাছেই ফিরিয়ে দেব।”
মূসার বোন ফিরআউনের দেশে গিয়ে বলল,“
আমি এক মহিলার সন্ধান দেব যে আপনাদের প্রিয় এ শিশুটির লালন-পালনের দায়িত্ব নিতে পারে। তাই ফিরআউন-সরকারের পক্ষ থেকে মূসার মা তাদের (ফিরআউনের) প্রিয় শিশুর (মূসার) লালন-পালনের দায়িত্বভারপ্রাপ্ত হলেন।”
হযরত ঈসা (আ.)-এর মাতৃগর্ভে বিকাশ,জন্মগ্রহণ এবং লালন-পালনকাল হযরত মূসা (আ.)-এর চেয়েও অধিকতর আশ্চর্যজনক। পবিত্র কোরআন হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্ম ও শৈশব কাল বর্ণনা করে বলেছে,“
ঈসার মা মরিয়ম নিজ সম্প্রদায় থেকে পৃথক হয়ে গেলেন। পবিত্র আত্মা (জিবরাইল) মানুষের আকৃতি ধারণ করে তাঁর সম্মুখে প্রকাশিত হলেন এবং তাঁকে সুসংবাদ দিলেন যে,আপনাকে একটি পবিত্র সন্তান দানের জন্য আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে।” মরিয়ম তখন আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললেন,“
কেউ আমাকে স্পর্শ করে নি এবং আমিও তো ব্যভিচারিণী নই।” আমাদের দূত তখন বললেন,“
এ কাজ মহান আল্লাহর কাছে অত্যন্ত সহজ।” পরিশেষে মহান আল্লাহর নির্দেশে ঈসা মসীহর নূর হযরত মরিয়মের গর্ভে স্থাপিত হলো। প্রসববেদনা তাঁকে খেজুর গাছের দিকে নিয়ে গেল। তিনি তাঁর নিজ অবস্থার ব্যাপারে দুঃখভারাক্রান্ত ছিলেন। আমরা বললাম,“
খেজুর গাছ বাঁকাও,তাহলে তাজা খেজুর নিচে পড়বে।” সন্তান জন্মগ্রহণ করলে মরিয়ম নবজাতক সন্তানসহ নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে আসলেন। আশ্চর্যান্বিত হয়ে জনগণের মুখের ভাষা যেন থেমে গিয়েছিল। এরপর মরিয়মের উদ্দেশ্যে তীব্র প্রতিবাদ,আপত্তি ও অসন্তোষের ঝড় উঠেছিল। মরিয়মকে পূর্বেই মহান আল্লাহ্ নির্দেশ দিয়েছিলেন যাতে করে তিনি বুঝিয়ে দেন যে,তারা যেন এই শিশুকে তাদের সকল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে। তারা বলেছিল,“
যে দুগ্ধপোষ্য শিশু দোলনায় শায়িত সে কি কথা বলতে সক্ষম?”
তখন হযরত ঈসা (আ.) ঠোঁট খুলে বলে উঠলেন,“
আমি মহান আল্লাহর বান্দা (দাস)। তিনি আমাকে কিতাব (ঐশী গ্রন্থ) দিয়েছেন এবং আমাকে নবীদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।”
পবিত্র কোরআন,তাওরাত ও হযরত ঈসার অনুসারিগণ যখন এ দু’
মহান উলূল আযম নবী সংক্রান্ত যাবতীয় উল্লিখিত বিষয়ের সত্যতা সম্পর্কে সাক্ষ্য প্রদান করে তখন ইসলামের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শুভ জন্মোপলক্ষে যেসব আশ্চর্যজনক বিষয় ঘটেছিল সে সব ব্যাপারে বিস্মিত হওয়া এবং সেগুলোকে ভাসাভাসা ও অগভীর বলে বিবেচনা করা অনুচিত। আমরা হাদীস ও ইতিহাস গ্রন্থসমূহে দেখতে পাই :
মহানবীর জন্মগ্রহণের মুহূর্তে সম্রাট খসরুর প্রাসাদের দ্বারমণ্ডপ (ايوان
) ফেটে গিয়েছিল এবং এর কয়েকটি স্তম্ভ ধসে পড়েছিল। ফারস প্রদেশের অগ্নি উপাসনালয়ের প্রজ্বলিত অগ্নি নিভে গিয়েছিল। ইরানের সাভেহর হরদ শুকিয়ে গিয়েছিল। পবিত্র মক্কার প্রতিমালয়সমূহে রক্ষিত মূর্তি ও প্রতিমাসমূহ মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। তাঁর দেহ থেকে নূর (আলো) বের হয়ে তা আকাশের দিকে উত্থিত হয়েছিল যার রশ্মি ফারসাখের পর ফারসাখ (মাইলের পর মাইল) পথ আলোকিত করেছিল। সম্রাট আনুশিরওয়ান ও পুরোহিতগণ অতি ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দর্শন করেছিলেন।
মহানবী (সা.) খতনাকৃত ও নাভি কর্তিত অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তিনি বলেছিলেন :
الله أكبر و الحمد لله كثيرا سبحان الله بكرة و أصيلا
“আল্লাহ্ মহান,সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর,সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করছির।”
এ সব বিষয় ও তথ্য সকল মৌলিক নির্ভরযোগ্য হাদীস ও ইতিহাস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।
হযরত মূসা ও হযরত ঈসার ব্যাপারে যে সব বিষয় আমরা বর্ণনা করেছি সেগুলো বিবেচনায় আনলে এ ধরনের ঘটনাসমূহ মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে সন্দেহ করার কোন অবকাশ থাকে না।
এখন প্রশ্ন করা যায় যে,এ ধরনের অলৌকিক ও অসাধারণ ঘটনাবলীর প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যই বা কি ছিল? এ প্রশ্নের জবাবে সংক্ষেপে অবশ্যই বলতে হয় : যেমনভাবে আমরা আলোচনা করেছি ঠিক তেমনি এ ধরনের অস্বাভাবিক ও অলৌকিক ঘটনাবলী কেবল মহানবী (সা.)-এর সাথেই বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট নয়,বরং অন্যান্য নবী-রাসূলের জন্মগ্রহণের সাথেও সম্পর্কযুক্ত ছিল। পবিত্র কোরআন ছাড়াও অন্য সকল জাতি,বিশেষ করে ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টান জাতির ইতিহাস তাদের নিজেদের নবীদের ব্যাপারে এ ধরনের বহু অলৌকিক ঘটনা বর্ণনা করেছে।
এ ছাড়াও এ ধরনের ঘটনাবলী ঐ সব অত্যাচারী ও স্বৈরাচারী শাসকের অনুভূতিকে জাগ্রত করে যারা বিভিন্ন জাতিকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রেখেছে। এ সব অত্যাচারী ক্ষমতাধর শাসক এ সব ঘটনা সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করে নিজেদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করতে উদ্বুদ্ধ হবে যে,কি হয়েছিল যে,একজন বৃদ্ধা রমণীর মাটি নির্মিত ঘরে চির ধরে নি,অথচ সম্রাট খসরু পারভেজের রাজপ্রাসাদের বৃহৎ বৃহৎ স্তম্ভ ধ্বসে পড়েছিল? ইরানের ফারস প্রদেশের অগ্নিমন্দিরের আগুন (অগ্নি প্রজ্বলিত থাকার) সকল উপকরণ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও কেন নিভে গিয়েছিল,অথচ তখন সব জিনিসই স্ব স্ব স্থানে বহাল ছিল? তারা এ ধরনের ঘটনার কারণ কি হতে পারে সে ব্যাপারে যদি চিন্তা-ভাবনা করত তাহলে বুঝতে পারত এ সব ঘটনা মূর্তিপূজার যুগের অবসান সম্পর্কে এবং খুব শীঘ্রই যে সকল শয়তানী শক্তি ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে সে ব্যাপারেও সুসংবাদ প্রদান করছে।
মূলনীতিগতভাবে ঐ একই দিনে ঘটে যাওয়া অলৌকিক ঘটনাবলী যে অত্যাচারী শাসকদের উপলব্ধি ও শিক্ষাগ্রহণের কারণ হতেই হবে এমনটি বোধ হয় জরুরী নয়,বরং যে ঘটনাটি কোন এক বছরে সংঘটিত হয়েছে তা বছরের পর বছর শিক্ষণীয় হতে পারে এবং তার কার্যকারিতা বহাল থাকতে পারে;আর এতটুকুই যথেষ্ট।
মহানবী (সা.) যে রাতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সে রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ঠিক এ রকমই। কারণ এ সব ঘটনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল ঐ সব মানুষের অন্তরে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দেয়া ও মনোযোগ সৃষ্টি করা যারা মূর্তিপূজা,অন্যায় ও জুলুমের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল।
মহানবীর রিসালাত বা নবুওয়াতী মিশনের সমসাময়িক জনগোষ্ঠী এবং এর পরবর্তী প্রজন্মসমূহ এমন একজন মানুষের আহবান শুনতে পাবে যিনি তাঁর সকল শক্তি প্রয়োগ করে মূর্তিপূজা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। যখন তারা তাঁর জীবনের প্রথম দিকের ঘটনাসমূহ অধ্যয়ন করবে তখন প্রত্যক্ষ করবে যে,এ ব্যক্তির জন্মগ্রহণের রাতে এমন সব ঘটনা ঘটেছিল যা তাঁর দাওয়াহ্ বা প্রচার কার্যক্রমের সাথে পূর্ণ সংগতিশীল। স্বাভাবিকভাবে এ ধরনের ঘটনার একই সাথে সংঘটিত হওয়ার বিষয়টি আসলে তাঁর সত্যবাদী হওয়ারই নিদর্শনস্বরূপ বলে তারা গ্রহণ করবে এবং এ কারণে তারা তাঁর প্রতিও বিশ্বাস স্থাপন করবে।
এ ধরনের ঘটনাবলী হযরত ইবরাহীম,হযরত মূসা,হযরত ঈসা ও হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মতো মহান নবীদের জন্মগ্রহণের সময় সংঘটিত হওয়া তাঁদের নবুওয়াত ও রিসালাতের যুগে ঐ সব অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হওয়ার চেয়ে কোন অংশে কম নয়;আর এ সব কিছু আসলে মহান আল্লাহর ঐশী কৃপা থেকেই উৎপত্তি লাভ করেছে এবং মানব জাতির হেদায়েত ও তাদেরকে মহান নবীদের দীন প্রচার কার্যক্রমের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্যই সংঘটিত হয়েছে।
মহানবীর জন্মের দিন,মাস ও বছর
সাধারণ সীরাত রচয়িতাগণ ঐকমত্য পোষণ করেন যে,মহানবী হাতির বছর (عام الفيل
) অর্থাৎ 570 খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কারণ তিনি অকাট্যভাবে 632 খ্রিষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেছিলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল 62 অথবা 63 বছর। অতএব,তিনি 570 খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
অধিকাংশ ঐতিহাসিক ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে,মহানবী (সা.) রবিউল আউয়াল মাসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তবে তাঁর জন্মদিন সম্পর্কে মতভেদ আছে। শিয়া মুহাদ্দিসদের মধ্যে প্রসিদ্ধ অভিমত হচ্ছে,মহানবী 17 রবিউল আউয়াল,শুক্রবার ফজরের সময় (ঊষালগ্নে) জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আর আহলে সুন্নাতের মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ অভিমত হচ্ছে তিনি 12 রবিউল আউয়াল,সোমবার জন্মগ্রহণ করেন।
এ দু’
অভিমতের মধ্যে কোনটি সঠিক?
একটি দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে এই যে,ইসলাম ধর্মের মহান নেতার জন্ম ও মৃত্যুদিবস,বরং আমাদের অধিকাংশ ধর্মীয় নেতার জন্ম ও মৃত্যুদিবস সুনির্দিষ্ট নয়। এ অস্পষ্টতার কারণেই আমাদের বেশিরভাগ উৎসব ও শোকানুষ্ঠানের তারিখ অকাট্যভাবে জানা যায় নি। ইসলামের পণ্ডিত ও আলেমগণ বিগত শতাব্দীগুলোতে যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলো এক বিশেষ পদ্ধতিতে লিপিবদ্ধ করতেন। কিন্তু কি কারণে তাঁদের অধিকাংশেরই জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ খুব সূক্ষ্মভাবে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব হয়নি তা (আজও) জানা যায় নি।
আমি ভুলব না ঐ সময়ের কথা যখন ভাগ্যবিধি আমাকে (লেখক) কুর্দিস্তানের একটি সীমান্ত শহরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল;ঐ এলাকার একজন আলেম এ বিষয়টি (অর্থাৎ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সঠিক তারিখ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আলেমদের মধ্যে মতবিরোধ) উত্থাপন করেন এবং এজন্য তিনি অনেক দুঃখ প্রকাশও করেছিলেন। তিনি এ ব্যাপারে আলেমদের উদাসীনতা ও শৈথিল্য প্রদর্শন করার কারণে অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন,“
এ ধরনের বিষয়ের ক্ষেত্রে কিভাবে তাঁদের মধ্যে এ রকম মতবিরোধ বিরাজ করা সম্ভব?”
তখন আমি তাঁকে বললাম,“
এ বিষয়টির কিছুটা সমাধান করা সম্ভব। আপনি যদি এ শহরের একজন আলেমের জীবনী রচনা করতে চান এবং আমরা ধরেও নিই যে,এ আলেম ব্যক্তি বেশ কিছুসংখ্যক সন্তান এবং অনেক আত্মীয়-স্বজন রেখে গেছেন তাহলে উক্ত আলেমের শিক্ষিত সন্তান-সন্ততি এবং বিরাট পরিবার যারা স্বাভাবিকভাবেই তাঁর জীবনের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জ্ঞাত তারা উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও তাঁর আত্মীয় যারা নয় তাদের থেকে কি আপনি তাঁর জীবনের প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী সংগ্রহ করবেন? নিশ্চিতভাবে আপনার বিবেক এ ধরনের কাজের অনুমতি দেবে না।
মহানবী (সা.) জনগণের মধ্য হতে বিদায় নিয়েছেন। মৃত্যুর সময় তিনি উম্মাহর মাঝে তাঁর আহলে বাইত ও অন্যান্য সন্তান-সন্ততি রেখে গেছেন। তাঁর নিকটাত্মীয়গণের বক্তব্য : মহানবী (সা.) যদি আমাদের শ্রদ্ধেয় পিতা হয়ে থাকেন এবং আমরাও যদি তাঁর ঘরে বয়ঃপ্রাপ্ত এবং তাঁর কোলে প্রতিপালিত হয়ে থাকি,তাহলে আমরাই সকলের চেয়ে এ বিষয়ে অধিক জ্ঞাত যে,আমাদের বংশের প্রধান (মহানবী) অমুক দিন অমুক সময় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
এমতাবস্থায় তাঁর সন্তান-সন্ততি ও বংশধরদের বক্তব্য উপেক্ষা করে দূর সম্পর্কের আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের বক্তব্যকে কি তাঁদের বক্তব্যের ওপর প্রাধান্য দেয়া সম্ভব হবে?”
উপরোল্লিখিত আলেম আমার এ কথা শোনার পর মাথা নিচু করে বললেন,“
আপনার কথা আসলেأهل البيت أدرى بما في البيت
(ঘরের লোক ঘরে যা আছে সে সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জ্ঞাত)-এ প্রবাদ বাক্যের অন্তর্নিহিত অর্থের অনুরূপ। আর আমিও মনে করি যে,মহানবী (সা.)-এর জীবনের যাবতীয় বিশেষত্ব ও খুঁটিনাটি দিক সম্বন্ধে শিয়া ইমামীয়াহ্ মাজহাবের বক্তব্য যা তাঁর সন্তান-সন্ততি,বংশধর ও নিকটাত্মীয়দের থেকে সংগৃহীত তা সত্যের নিকটবর্তী।” এরপর আমাদের মধ্যকার আলোচনা অন্যান্য বিষয় পর্যন্ত সম্প্রসারিত হলো যা এখানে উল্লেখ করার কোন সুযোগ নেই।
গর্ভধারণকাল
প্রসিদ্ধি আছে যে,হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র অস্তিত্বের নূর তাশরীকের (হজ্বের মাসের 11,12 ও 13 তারিখকে আইয়ামে তাশরীক অর্থাৎ তাশরীকের দিনসমূহ বলে অভিহিত করা হয়) দিনগুলোতে হযরত আমেনার জরায়ুতে স্থাপিত হয়েছিল।
তবে 17 রবিউল আউয়ালে যে হযরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেছিলেন এতৎসংক্রান্ত ঐতিহাসিকদের মধ্যে প্রচলিত প্রসিদ্ধ অভিমতের সাথে এ বিষয়টির মিল নেই। কারণ এমতাবস্থায় হযরত আমেনার গর্ভধারণকাল 3 মাস অথবা 1 বছর 3 মাস বলে ধরতে হবে। আর এ বিষয়টি স্বয়ং প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মের পরিপন্থী। আর কোন ঐতিহাসিক বা আলেম তা মহানবীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য বলে উল্লেখ করেন নি।
প্রখ্যাত গবেষক আলেম শহীদে সানী (911-966 খ্রি.) উপরিউক্ত আপত্তিটির এভাবে সমাধান করেছেন : ইসমাঈলের বংশধরগণ তাদের নিজ পূর্বপুরুষদের অনুকরণে যিলহজ্ব মাসেই হজ্বব্রত পালন করত। কিন্তু পরবর্তীকালে বিশেষ কিছু কারণে তারা প্রতি দু’
বছর একই মাসে হজ্বব্রত পালনের চিন্তা-ভাবনা করে। অর্থাৎ দুই বছর তারা যিলহজ্ব মাসে,এর পরের দু’
বছর মুহররম মাসে এবং এ ধারাক্রমানুসারে হজ্বব্রত পালন করার চিন্তা করেছিল। তাই 24 বছর গত হওয়ার মাধ্যমে পুনরায় হজ্বের দিনগুলো স্বস্থানে অর্থাৎ যিলহজ্ব মাসে ফিরে আসত। আরবদের রীতিনীতি এ ধারার ওপরই বহাল ছিল। অবশেষে 10 হিজরীতে প্রথম বারের মতো হজ্বের দিবসগুলো যিলহজ্ব মাসে ফিরে আসে। মহানবী (সা.) একটি ভাষণ দানের মাধ্যমে (হজ্ব সংক্রান্ত) যে কোন ধরনের পরিবর্তন জোরালোভাবে নিষিদ্ধ করেন। তিনি যিলহজ্ব মাসকে হজ্বের মাস হিসাবে অভিহিত করেন।
আর নিম্নোক্ত এ আয়াতটি নিষিদ্ধ মাসগুলো পিছিয়ে দেয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞাস্বরূপ অবতীর্ণ হয়েছিল;আর নিষিদ্ধ মাসসমূহ পিছিয়ে দেয়া ছিল জাহেলী আরবদের অন্যতম প্রচলিত প্রথা। আয়াতটি নিম্নরূপ :
)
إنّما النّسيئ في زيادة الكفر يُضلّ به الذين كفروا و يُحلّونه عاما و يحرّمونه عاما(
“হারাম মাসসমূহ পরিবর্তন করা হচ্ছে কুফর বৃদ্ধির নিদর্শন মাত্র। যারা কাফির তারা এ কাজের দ্বারা পথভ্রষ্ট হয়। তারা এক বছর ঐ কাজকে হালাল করে এবং আরেক বছর তা হারাম করে।” (সূরা তাওবাহ্ : 37)
এই পরিস্থিতিতেই প্রতি দু’
বছর তাশরীকের দিবসগুলো পরিবর্তিত হতো। যদি হাদীসে বর্ণিত হয়ে থাকে যে,হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নূর তাশরীকের দিবসগুলোতে হযরত আমেনার গর্ভে স্থাপিত হয়েছিল এবং তিনি 17 রবিউল আউয়াল জন্মগ্রহণ করেছিলেন তাহলে এ দু’
ব্যাপারে কোন স্ববিরোধিতা নেই। কারণ ঐ অবস্থায় স্ববিরোধিতার উদ্ভব হতে পারে যখন তাশরীকের দিবসগুলো বলতে যিলহজ্ব মাসের 11,12 ও 13 তারিখ বোঝাবে। তবে যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে তদনুযায়ী তাশরীকের দিনগুলো সর্বদা পরিবর্তিত হয়েছে এবং চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করার পর এ বিষয়ে আমরা পৌঁছেছি যে,মহানবী (সা.)-এর ভ্রুণ হযরত আমেনা কর্তৃক গর্ভে ধারণ এবং তাঁর জন্মগ্রহণের বছরে হজ্বের দিবসগুলো জমাদিউল উলা মাসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আর যেহেতু মহানবীর জন্ম রবিউল আউয়াল মাসেই হয়েছিল এমতাবস্থায় হযরত আমেনার গর্ভধারণকাল প্রায় 10 মাস হয়েছিল।
এ বক্তব্যের ব্যাপারে আপত্তিসমূহ
মরহুম শহীদে সানী এ অভিমত থেকে যে ফলাফলে উপনীত হয়েছেন তা সঠিক নয়। তিনিنسيء
(নাসি) শব্দের যে অর্থ ব্যক্ত করেছেন মুফাসসিরদের মধ্যে কেবল মুজাহিদই উক্ত অর্থ গ্রহণ করেছেন। অন্যান্য মুফাসসির তা ভিন্নভাবে ও ভিন্ন অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন। আর উপরিউক্ত ব্যাখ্যাটি ততটা দৃঢ় ও শক্তিশালী নয়। কারণ :
প্রথমত মক্কা নগরী সকল সমাজ ও গোত্রের কেন্দ্রস্থল ছিল এবং সমগ্র আরব জাতির একটি সাধারণ ইবাদাতগাহ্ বলে গণ্য হতো। বলার অপেক্ষা রাখে না যে,প্রতি দু’
বছর অন্তর হজ্বের দিন-ক্ষণ পরিবর্তন করা স্বাভাবিকভাবে আপামর জনতাকে ভুলের মধ্যে ফেলে দেবে এবং হজ্বব্রতের মহান সমাবেশ ও সামষ্টিক ইবাদাতের বিরল সম্মান ও মর্যাদাকেও সমূলে বিনষ্ট করে দেবে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে যা কিছু তাদের জন্য গৌরব ও সম্মানের ভিতস্বরূপ তা প্রতি দু’
বছর অন্তর পরিবর্তিত হয়ে যাক,হজ্বের সময় হারিয়ে যাক এবং উক্ত মহাসমাবেশ ধ্বংস হয়ে যাক-এ ব্যাপারে স্বাভাবিকভাবে মক্কাবাসীদের সম্মত হওয়ার প্রশ্নই আসে না।
দ্বিতীয়ত খুব সূক্ষ্মভাবে যদি হিসাব-নিকাশ করা হয় তাহলে শহীদে সানীর বক্তব্যের অপরিহার্য অর্থ দাঁড়ায় এটি যে,নবম হিজরীর হজ্বের দিবসগুলো যিলক্বদ মাসে পড়েছিল,অথচ ঐ বছরেই হয়রত আলী (আ.) মহানবীর পক্ষ থেকে হজ্বের দিনগুলোতে মুশরিকদের উদ্দেশ্যে সূরা তাওবাহ্ পাঠ করার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। মুফাসসির ও মুহাদ্দিসগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে,হযরত আলী উক্ত সূরা 10 যিলহজ্ব পাঠ করেন এবং মুশরিকদের 4 মাসের সুযোগ দেন। আর সকল মুফাসসির ও মুহাদ্দিস 10 যিলহজ্বকে সেই সুযোগের শুরু বলেই জানেন এবং তাঁদের মধ্য থেকে কেউ বলেন নি যে,সেটি ছিল যিলক্বদ মাসে।
তৃতীয়তنسيء
শব্দের অর্থ হচ্ছে এই যে,যেহেতু জীবিকা নির্বাহের কোন সঠিক পথ ও পদ্ধতি ছিল না তাই তারা প্রধানত লুটতরাজ ও রাহাজানির মাধ্যমে তাদের জীবিকা নির্বাহ করত। এ কারণেই যিলক্বদ,যিলহজ্ব ও মুহররম এ তিন মাস যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ রাখা তাদের জন্য খুবই কঠিন ছিল। তাই মুহররম মাসে যুদ্ধ করা এবং তৎপরিবর্তে সফর মাসে যুদ্ধ বন্ধ রাখার অনুমতি দেয়ার জন্য কখনো কখনো তারা পবিত্র কাবার দায়িত্বশীলদের কাছে আবেদন করত।نسيء
শব্দের অর্থও ঠিক এটিই। আর মুহররম ব্যতীত অন্য কোন মাসের ক্ষেত্রে কখনইنسيء
ছিল না। তাই এ ব্যাপারে স্বয়ং আয়াতটিতেও ইঙ্গিত রয়েছে :يُحلّونه عاما و يحرّمونه عاما
“
তারা এক বছর যুদ্ধ হালাল করত এবং আরেক বছর যুদ্ধ হারাম করত।”
আমরা মনে করি সমস্যা সমাধানের পথ হচ্ছে এই যে,আরবগণ বছরের দু’
টি সময়-একটি যিলহজ্ব মাসে ও একটি রজব মাসে-হজ্ব করত। এমতাবস্থায় হযরত আমেনা হজ্বের মাসে অথবা তাশরীকের দিবসগুলোতে রাসূলে খোদা (সা.)-এর নূর গর্ভে ধারণ করেছিলেন-এর উদ্দেশ্য সম্ভবত রজব মাসও হতে পারে। মহানবী (সা.) যদি 17 রবিউল আউয়াল জন্মগ্রহণ করে থাকেন তাহলে গর্ভধারণকাল 8 মাস ও কয়েকদিন হয়ে থাকবে।