চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড3%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 108652 / ডাউনলোড: 10081
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

4

5

ষষ্ঠ অধ্যায় : মহানবী (সা.)-এর শৈশবকাল

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে,ইসলাম ও মুসলমানদের মহান নেতা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সমগ্র জীবনটাই-শৈশবের শুরু থেকে যে দিন তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে নবুওয়াতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন সেই দিন পর্যন্ত আশ্চর্যজনক ঘটনাসমূহের সমন্বয়ে গঠিত। আর এ সব আশ্চর্যজনক ঘটনা অলৌকিকত্বের প্রমাণ বহন করে। এ সব কিছু থেকে প্রতীয়মান হয় যে,মহানবী (সা.)-এর জীবন ছিল একটি অসাধারণ জীবন।

মহানবীর এ সব অলৌকিক ঘটনা ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে সীরাত রচয়িতাগণ দু ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছেন :

১. বস্তুবাদী কতিপয় প্রাচ্যবিদের দৃষ্টিভঙ্গি : বস্তুবাদী বৈজ্ঞানিকগণ বস্তুবাদী ভূয়োদর্শন পোষণ করেন এবং অস্তিত্বকে কেবল বস্তুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ বলে মনে করেন। তাঁরা সকল প্রপঞ্চ ও ঘটনাকে বস্তুগত প্রপঞ্চ ও ঘটনা বলে বিশ্বাস করেন এবং প্রতিটি ঘটনা ও প্রপঞ্চেরই প্রাকৃতিক (বস্তুগত) কারণ নির্ধারণ করেন। তাঁরা এ সব অলৌকিক ঘটনা ও প্রপঞ্চের প্রতি মোটেও গুরুত্ব দেন না। কারণ বস্তুবাদী নীতিমালা অনুসারে এ ধরনের ঘটনা ও প্রপঞ্চের উৎপত্তি অসম্ভব;আর ইতিহাসের পাতায় পাতায় এ ধরনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেই তাঁরা এগুলোকে ধর্মের অনুসারীদের কল্পনা এবং ভক্তি-ভালোবাসাপ্রসূত বলে বিবেচনা করেন।

একদল প্রাচ্যবিদ যাঁরা নিজেদেরকে বাহ্যত তাওহীদবাদী ও খোদায় বিশ্বাসী বলে অভিহিত করেন এবং অতি প্রাকৃতিক (আধ্যাত্মিক) জগতের অস্তিত্বেও বিশ্বাস করেন,কিন্তু তাঁদের ঈমানী দুর্বলতা ও জ্ঞানগত গর্ব এবং তাঁদের চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণার ওপর বস্তুবাদিতার প্রাধান্য থাকার কারণে ঘটনা বিশ্লেষণ করার সময় তাঁরা বস্তুবাদী মূলনীতিসমূহের অনুসরণ করেন। আমরা বারবার তাঁদের বক্তব্য ও আলোচনার মধ্যে এ সব বাক্য লক্ষ্য করেছি যে, নবুওয়াত আসলে এক ধরনের মানবীয় প্রতিভা , নবী হচ্ছেন একজন সামাজিক প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব যিনি তাঁর নিজের আলোকিত চিন্তাধারা দিয়ে মানব জীবনের গতিধারা ও পথকে আলোকিত করেন’...।

প্রাচ্যবিদদের এ ধরনের বক্তব্য আসলে বস্তুবাদী চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উদ্ভূত যা সকল ধর্মকে মানব চিন্তা ও কল্পনাপ্রসূত বলে বিবেচনা করে। অথচ আস্তিক জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তিগণ সাধারণ নবুওয়াত সংক্রান্ত আলোচনায় প্রমাণ করেছেন যে,নবুওয়াত মহান আল্লাহর ঐশী দান ও অনুগ্রহ যা সকল আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণা (ইলহাম) ও যোগাযোগের উৎস। মহান নবীদের পরিকল্পনাসমূহ,তাঁদের চিন্তা,ধারণা ও প্রতিভা প্রসূত নয়;বরং অবস্তুগত আধ্যাত্মিকজগৎ থেকে প্রেরিত ইলহাম ও প্রত্যাদেশ ব্যতীত তাঁদের এ সব পরিকল্পনা ও কর্মসূচীর আর কোন উৎসমূল নেই। কিন্তু যখন খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী প্রাচ্যবিদগণ বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে এ সব বিষয়ে দৃক্পাত করেন এবং সমস্ত ঘটনা ও প্রপঞ্চকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অভিজ্ঞতালব্ধ বৈজ্ঞানিক মূলনীতি ও সূত্রের আলোকে পরিমাপ করেন তখন যে সব ঘটনা ও প্রপঞ্চের অলৌকিকত্বের দিক রয়েছে অর্থাৎ মুজিযা সেগুলোর কঠোর সমালোচনা করেন এবং মূল থেকে সেগুলো অস্বীকার করেন।

. স্রষ্টা পূজারিগণ : ঐ সব ব্যক্তি মহান আল্লাহর উপাসনাকারী যারা বিশ্বাস করে যে,বস্তুজগতের বৈশিষ্ট্য ও চি হ্নসমূহ অন্য জগতের পরিচালনাধীন এবং অতি প্রাকৃতিক অবস্তুগতজগৎ এ প্রাকৃতিক ও বস্তুগত বিশ্বের সার্বিক শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। অন্যভাবে বলা যায়,বস্তুজগৎ স্বাধীন ও সার্বভৌম নয়। সকল ব্যবস্থা এবং এগুলোর প্রাকৃতিক ও বৈজ্ঞানিক সূত্র উচ্চতর অস্তিত্বময় সত্তাসমূহ,বিশেষ করে মহান আল্লাহর ইচ্ছার সৃষ্টি। মহান আল্লাহ্ বস্তুর অস্তিত্ব প্রদান করেছেন। তিনি বস্তুর বিভিন্ন অংশের মাঝে কতগুলো সুষ্ঠু নিয়ম প্রবর্তন করেছেন এবং বস্তুর অস্তিত্বের স্থায়িত্বকে কতগুলো প্রাকৃতিক নিয়মের ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

যদিও এই গোষ্ঠী বৈজ্ঞানিক নিয়ম-কানুন ও সূত্রসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এবং প্রাকৃতিক বস্তুনিচয়ের মধ্যকার সম্পর্কসমূহ যেগুলো বিজ্ঞান কর্তৃক সমর্থিত ও স্বীকৃত হয়েছে সে সব ব্যাপারে বৈজ্ঞানিকদের বক্তব্যও আন্তরিকভাবে মেনে নিয়েছে,তারপরও তারা বিশ্বাস করে যে,এ ধরনের প্রাকৃতিক নিয়মাবলী ধ্রুব নয়। তারা বিশ্বাস করে যে,শ্রেষ্ঠ ও উচ্চতর জগৎ (যা বস্তুজগৎ থেকে উন্নত ও শ্রেষ্ঠ) যখনই চাইবে ঠিক তখনই কতিপয় মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুনের প্রয়োগ ও রেওয়াজের পথ পরিবর্তন করে দিতে সক্ষম;শুধু তা-ই নয় বরং কতিপয় ক্ষেত্রে উচ্চতর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য তা

বাস্তবে কার্যকরও করেছে।

অন্যভাবে বলতে গেলে অলৌকিক কাজসমূহ আসলে কারণহীন নয়;তবে এগুলোর সাধারণ প্রাকৃতিক কারণ নেই;আর স্বাভাবিক প্রাকৃতিক কারণ না থাকা কারণের অনস্তিত্ব নির্দেশ করে না। সৃষ্টিজগতের নিয়ম,সূত্র ও বিধানসমূহও এমন নয় যে,সেগুলো মহান স্রষ্টার ইচ্ছায় পরিবর্তিত হয় না।

তারা বলে যে,মহান নবিগণের অলৌকিক ও আশ্চর্যজনক কার্যাবলী যা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুনের সীমারেখার বাইরে,সেগুলো এ পথেই (স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মে) সংঘটিত ও বাস্তবায়িত হয়। এ গোষ্ঠীটি অতি প্রাকৃতিক কার্যসমূহ (মুজিযা ও কারামত) যেগুলো পবিত্র কোরআন ও হাদীসসমূহে অথবা বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে তা স্বাভাবিক বৈজ্ঞানিক ও প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুনের সাথে খাপ খায় না বলে প্রত্যাখ্যান করেছে বা এ সব ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেছে।

এখন আমরা মহানবী (সা.)-এর শৈশবকালের আশ্চর্যজনক ও রহস্যময় ঘটনাবলী উল্লেখ করব। এ বক্তব্য ও ব্যাখ্যাটি যদি আমরা বিবেচনায় রাখি,তাহলে এ ধরনের ঘটনাবলীর ক্ষেত্রে আমাদের আর কোন সংশয় থাকবে না।

১. ইতিহাস রচয়িতাগণ হালীমার কথা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, যখন আমি আমেনার নবজাতক শিশুর (মহানবী) প্রতিপালনের দায়িত্ব গ্রহণ করি তখন তার মায়ের উপস্থিতিতে তাকে স্তন্য দান করতে চাইলাম। আমার বাম স্তন যা দুধে পরিপূর্ণ ছিল তা তার মুখে রাখলাম,কিন্তু নবজাতক শিশুটি আমার ডান স্তনের প্রতি যেন বেশি আগ্রহান্বিত ছিল। কিন্তু আমি যে দিন সন্তান প্রসব করেছিলাম সে দিন থেকেই আমার ডান স্তনে দুধ ছিল না। নবজাতক শিশুর পীড়াপীড়িতে আমি আমার দুধবিহীন ডান স্তনটি তার মুখে রাখলাম। তখনই সে তা চুষতে লাগল এবং স্তনের শুষ্ক দুগ্ধগ্রন্থিগুলো দুধে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। এ ঘটনা উপস্থিত সকল ব্যক্তিকে আশ্চর্যান্বিত করেছিল। ১৪০

২. তাঁর নিকট থেকে আরো বর্ণিত আছে : যে দিন আমি শিশু মুহাম্মদকে আমার গৃহে আনলাম সে দিন থেকে আমার ঘরে কল্যাণ ও বরকত দিনের পর দিন বৃদ্ধি পেতে লাগল। আমার সম্পদ ও গবাদিপশুও বৃদ্ধি পেতে লাগল। ১৪১

নিশ্চিতভাবে বলতে গেলে বস্তুবাদীরা এবং যারা তাদের মূলনীতি ও বিশ্বাসের অনুসরণ করে তারা এ সব বিষয়ে তাওহীদপন্থী স্রষ্টায় বিশ্বাসীদের সাথে দ্বিমত পোষণ করে। বস্তুবাদী নীতিমালা ও দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারীরা যেহেতু এ ধরনের বিষয়াদি প্রকৃতিবিজ্ঞানের আলোকে ব্যাখ্যা করতে অক্ষম সেহেতু তারা তাৎক্ষণিকভাবে বলে যে,এ সব ঘটনা ও বিষয় মানুষের কল্পনাপ্রসূত। যদি তারা খুব ভদ্র ও মার্জিত হয় তাহলে বলে যে,মহানবী এ সব অলৌকিক কাজের মুখাপেক্ষী ছিলেন না। এতে কোন সন্দেহ নেই যে,তিনি এ সব বিষয়ের মুখাপেক্ষী ছিলেন না। তবে অমুখাপেক্ষিতা একটি বিষয় এবং কোন একটি বিষয় সত্য ও মিথ্যা হওয়ার ব্যাপারে ফায়সালা করা আরেকটি বিষয়। কিন্তু যে ব্যক্তি প্রকৃতিজগতে বিরাজমান ব্যবস্থাকে বিশ্ব-ব্র‏‏ হ্মাণ্ডের মহান স্রষ্টার ইচ্ছাশক্তির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন বলে জানে এবং বিশ্বাস করে যে,সবচেয়ে ক্ষুদ্র অস্তিত্ববান সত্তা (পরমাণু) থেকে শুরু করে সর্ববৃহৎ সৃষ্টি (নীহারিকাপুঞ্জ) পর্যন্ত সমগ্র বিশ্ব-ব্র হ্মাণ্ড তাঁর (স্রষ্টা) প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। তাই এ সব ঘটনা যাচাই-বাছাই এবং এগুলোর দলিল প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই সে এ সব ঘটনা ও বিষয়ের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করে;আর যদি সে এ সব ঘটনা যাচাই-বাছাই এবং এগুলোর দলিল-প্রমাণের ক্ষেত্রে নিশ্চিত হতে না-ও পারে তবুও সে এ সব বিষয় ও ঘটনাকে নিশ্চিতভাবে প্রত্যাখ্যান করে না।

আমরা পবিত্র কোরআনে হযরত ঈসা ইবনে মরিয়মের ক্ষেত্রে এ ধরনের অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করি। যেমন পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে : যখন হযরত মরিয়মের সন্তান প্রসবের সময় নিকটবর্তী হলো তখন তিনি একটি খেজুর গাছের কাছে আশ্রয় নিলেন এবং তিনি (তীব্র ব্যথা,একাকিত্ব ও দুর্নামের ভয়ে) মহান আল্লাহর কাছে মৃত্যু কামনা করলেন। ঐ সময় তিনি একটি আহবান ধ্বনি শুনতে পেলেন :

) لا تحزني قد جعل ربّك تحتك سريّا و هزّي إليك بجذع النّخلة تساقط عليك رطبا جنيّا(

“দুঃখভারাক্রান্ত হয়ো না। তোমার প্রভু তোমার পায়ের তলদেশে পানির ঝরনা প্রবাহিত করেছেন এবং (শুষ্ক) খেজুর গাছটি ঝাঁকি দাও তাহলে তাজা খেজুর তোমার ওপর পতিত হবে। (সূরা মরিয়ম : ২৪-২৫)

আমরা পবিত্র কোরআনে হযরত মরিয়ম সম্পর্কে অন্যান্য বিষয়ও জানতে পারি। তাঁর নিষ্পাপ হওয়া ও তাকওয়া তাঁকে এমন এক সুমহান স্থানে উন্নীত করেছিল যে,যখনই হযরত যাকারিয়া (আ.) হযরত মরিয়মের ইবাদাত-বন্দেগী করার স্থানে প্রবেশ করতেন তখনই তিনি তাঁর কাছে বেহেশতের খাবার দেখতে পেতেন। যখন তিনি এ ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞেস করতেন, এ রুজী (খাবার) কোথা থেকে এসেছে? হযরত মরিয়ম তাঁকে জবাবে বলতেন, মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। ১৪২

অতএব,এ ধরনের অলৌকিক বিষয়ের ক্ষেত্রে সন্দেহ পোষণ করা এবং এগুলো অসম্ভব বলে মনে করা অনুচিত।

মরুভূমিতে পাঁচ বছর

আবদুল মুত্তালিবের অনাথ নাতি মহানবী (সা.) বনি সা দ গোত্রের মাঝে পাঁচ বছর অতিবাহিত করলেন। এ সময় তিনি ভালোভাবে বেড়ে ওঠেন। এ দীর্ঘ পাঁচ বছর হযরত হালীমাহ্ তাঁকে দু তিন বার মা আমেনার কাছে এনেছিলেন এবং শেষ বারে তিনি তাঁকে তাঁর মায়ের কাছে অর্পণ করেছিলেন।

দুগ্ধপানকাল শেষ হওয়ার পর বিবি হালীমাহ্ তাঁকে প্রথম বারের মতো পবিত্র মক্কায় এনেছিলেন। জোরাজুরি করে হালীমাহ্ তাঁকে পুনরায় বনি সা দ গোত্রে ফিরিয়ে নিয়ে যান। ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে জোর করার কারণ ছিল এই যে,এ অনাথ শিশুর উসিলায় তাঁর প্রভূত কল্যাণ ও বরকত হয়েছিল এবং পবিত্র মক্কা নগরীতে কলেরা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ায় হযরত আমেনাও হালীমাহর অনুরোধ গ্রহণ করেছিলেন।

একদল আবিসিনীয় আলেম একবার হিজাযে এসেছিলেন। তখন তাঁরা বনি সা দ গোত্রে শিশু মহানবীকে দেখতে পেলেন। তাঁরা দেখতে পেলেন যে,হযরত ঈসা (আ.)-এর পরবর্তী নবীর নিদর্শনাদি যা আসমানী গ্রন্থসমূহে বর্ণিত আছে তা এ শিশুটির সাথে মিলে যাচ্ছে। এ কারণে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন যে,যেভাবেই হোক তাঁরা এ শিশুকে অপহরণ করে আবিসিনিয়ায় নিয়ে যাবেন এবং এ হবে তাঁদের গৌরবের বিষয়। তাই এ সব ব্যক্তির হাত থেকে শিশু হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিরাপদ রাখার জন্য বিবি হালীমাহ্ তাঁকে দ্বিতীয় বারের মতো পবিত্র মক্কা নগরীতে নিয়ে আসেন।১৪৩

এ ব্যাপারটি মোটেও অসম্ভব ও কাল্পনিক নয়। কারণ পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট বক্তব্য অনুসারে মহানবীর নিদর্শনসমূহ ইঞ্জিল শরীফে বর্ণিত হয়েছে। সে সময়ের আসমানী গ্রন্থাদির বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিগণ যে পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থসমূহে বর্ণিত নিদর্শনসমূহের ভিত্তিতে উক্ত নিদর্শনসমূহের অধিকারী ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে পেরেছিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে :

) و إذا قال عيسى بن مريم يا بني إسرائيل إنّي رسول الله إليكم مصدّقا لما بين يديّ من التّوراة و مبشّرا برسول يأتي من بعدي اسمه أحمد فلمّا جاءهم بالبيّنات قالوا هذا سحر مبين(

“আর স্মরণ করুন তখনকার কথা যখন ঈসা ইবনে মরিয়ম (বনি ইসরাইলকে) বলেছিল : নিশ্চয়ই আমি তোমাদের কাছে মহান আল্লাহর রাসূল। আমার সামনে বিদ্যমান আসমানী গ্রন্থ তাওরাতের সত্যায়নকারী এবং আমি তোমাদেরকে আমার পরে যে রাসূল আগমন করবে তার সুসংবাদ প্রদান করছি। উক্ত রাসূলের নাম হবে আহমাদ। অতঃপর সেই (প্রতিশ্রুত) রাসূল তাদের কাছে (নিদর্শন ও মুজিযাসহ) আগমন করল। তখন তারা বলল : এ (এ সব মুজিযা ও পবিত্র কোরআন) তো স্পষ্ট যাদু।” (সূরা সাফ : ৬)

এতৎসংক্রান্ত আরো বহু আয়াত রয়েছে যা থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে,মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চি হ্ন ও নিদর্শনাদি পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থসমূহে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং পূর্ববর্তী নবীদের উম্মতগণ এ ব্যাপারে অবগত ছিল।১৪৪

সপ্তম অধ্যায় : মাতৃক্রোড়ে প্রত্যাবর্তন

মহান আল্লাহ্ প্রত্যেক ব্যক্তিকে কোন না কোন দায়িত্ব পালনের জন্য সৃষ্টি করেছেন। কাউকে জ্ঞানার্জনের জন্য,কাউকে আবিষ্কার ও উদ্ভাবন করার জন্য,আবার কাউকে কর্ম ও পরিশ্রম করার জন্য,কোন কোন মানুষকে পরিচালনা ও নেতৃত্ব দান করার জন্য,আবার কিছু সংখ্যক মানুষকে শিক্ষা-প্রশিক্ষণ কার্য সম্পাদন করার জন্য এবং এভাবে তিনি বিভিন্ন মানুষকে জগতের বিভিন্ন কার্য সম্পাদন করার জন্য সৃষ্টি করেছেন।

আন্তরিক ও হৃদয়বান প্রশিক্ষকগণ যাঁরা ব্যক্তি ও সমাজের উন্নতি কামনা করেন তাঁরা কোন কাজের জন্য কোন ব্যক্তিকে নিযুক্ত করার আগেই তার অভিরুচি পরীক্ষা ও যাচাই-বাছাই করে থাকেন। আর যে ব্যক্তির যে কাজের প্রতি ঝোঁক এবং সামর্থ্য রয়েছে তাঁরা তাকে কেবল সেই কাজেরই দায়িত্ব দেন। কারণ এর অন্যথা হলে সমাজের দু টি ভয়ঙ্কর ক্ষতি হতে পারে :

ক. যে কাজ ঐ ব্যক্তি সম্পন্ন করতে পারত তা সে সম্পন্ন করতে পারবে না এবং

খ. যে কাজ সে আঞ্জাম দিয়েছে তা নিষ্ফল হতে বাধ্য।

বলা হয় যে,প্রতিটি রহস্যে একটি আনন্দ ও উদ্দীপনা আছে। ঐ ব্যক্তি সৌভাগ্যবান যে তার নিজ আনন্দ ও উদ্দীপনা উপলব্ধি করে।

এক শিক্ষক তাঁর এক অলস ছাত্রকে উপদেশ প্রদান করতেন এবং আলস্যের অনিষ্ট এবং যে সব ব্যক্তি জ্ঞানার্জন করেনি ও নিজেদের জীবনের বসন্তকাল অর্থাৎ যৌবনকে আলস্য ও প্রবৃত্তির পূজায় নিঃশেষ করেছে তাদের জীবনের করুণ পরিণতি সবিস্তারে ব্যাখ্যা করতেন। তিনি দেখতে পেলেন যে,ঐ ছাত্রটি তাঁর কথা শ্রবণরত অবস্থায় মাটির ওপর পড়ে থাকা এক টুকরা কয়লার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি হঠাৎ করে উপলব্ধি করতে পারলেন এ ছেলেটি লেখাপড়া শেখা ও জ্ঞানার্জন করার জন্য সৃষ্ট হয়নি;বরং স্রষ্টা তাকে চিত্রাঙ্কন করার মনোবৃত্তি ও রুচি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এ কারণেই উক্ত শিক্ষক ছাত্রটির পিতা-মাতাকে ডেকে বলেছিলেন, জ্ঞানার্জন ও লেখা-পড়া শেখার ব্যাপারে আপনাদের সন্তানের আগ্রহ অত্যন্ত কম,কিন্তু চিত্রাঙ্কন করার রুচি ও ঝোঁক তার মধ্যে বেশ ভালোভাবেই আছে এবং এ ব্যাপারে তার স্পৃহা ও আগ্রহ অত্যন্ত আশ্চর্যজনক।” শিক্ষকের পরামর্শ ছাত্রের পিতা-মাতার কাছে মনোঃপুত হলে অতি অল্প দিনের মধ্যে ছাত্রটি চিত্রাঙ্কন ও শিল্পকলা বেশ দ্রুত আয়ত্ত করে ফেলে এবং এ ক্ষেত্রে সে যুগশ্রেষ্ঠ শিল্পীতে পরিণত হয়।

শৈশবকাল শিশুদের অভিভাবকদের জন্য সন্তানদের রুচিবোধ ও সামর্থ্য পরীক্ষা এবং তাদের কাজ-কর্ম,আচার-আচরণ,চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা থেকে তাদের ব্যক্তিগত অভিরুচি সম্পর্কে ধারণা লাভ করার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। কারণ শিশুর চিন্তা-ভাবনা,কার্যকলাপ এবং মিষ্টি-মধুর কথা-বার্তা আসলে তার যোগ্যতা ও সামর্থ্যরেই আয়নাস্বরূপ। স্মর্তব্য যে,তার সামর্থ্য বিকাশের যাবতীয় পূর্বশর্ত ও ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে গেলে তা সর্বোত্তম পন্থায় কাজে লাগানো সম্ভব।

নবুওয়াত ঘোষণা পর্যন্ত হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনচরিত,আচার-আচরণ ও কার্যকলাপ তাঁর জীবন এবং তাঁর মহৎ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহের পটভূমি আমাদের মানসপটে চিত্রিত করে। তাঁর শৈশবের ইতিহাস অধ্যয়ন ও গভীর চিন্তা-ভাবনা করলে আমরা কেবল তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কেই অবগত হব না;বরং যে দিন তাঁর নবুওয়াত ঘোষিত হয়েছিল এবং তিনি নিজেকে সমাজের নেতা ও পথ-প্রদর্শক বলে ঘোষণা করেছিলেন সে দিন পর্যন্ত তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনেতিহাস তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদের অবগত করে এবং এ থেকে প্রতীয়মান হয়ে যায় যে,এ ব্যক্তি কোন্ কাজের জন্য সৃষ্ট হয়েছেন? আর তাঁর রিসালাত ও নেতৃত্বের দাবি কি তাঁর জীবন-কাহিনীর সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল? চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর জীবনেতিহাস,তাঁর আচার-আচরণ,চরিত্র,কর্ম,কথা এবং জনগণের সাথে দীর্ঘদিন মেলামেশা তাঁর সত্য নবী ও রাসূল হওয়ার বিষয়টি সমর্থন করে কি?

এ দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা এখানে মহানবীর জীবনের প্রথম দিনগুলো (শৈশব,কৈশোর ও যৌবন) সম্পর্কে আলোচনা করব।

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দাই-মা হযরত হালীমাহ্ তাঁকে পাঁচ বছর লালন-পালন করেছিলেন। এ সময় তিনি খাঁটি বলিষ্ঠ আরবী ভাষা রপ্ত করেছিলেন। সে কারণে তিনি পরবর্তীকালে গৌরববোধ করতেন। পাঁচ বছর পর হযরত হালীমাহ্ তাঁকে পবিত্র মক্কা নগরীতে নিয়ে আসেন। মক্কায় প্রত্যাবর্তন করার পর বেশ কিছুদিন তিনি মাতৃস্নেহ লাভ করেছিলেন এবং এ সময় তিনি দাদা আবদুল মুত্তালিবের তত্ত্বাবধান ও অভিভাবকত্বে লালিত-পালিত হন। হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মক্কাধিপতি হযরত আবদুল মুত্তালিবের কাছে পুত্র আবদুল্লাহর একমাত্র স্মৃতি।১৪৫

ইয়াসরিবে সফর

যে দিন আবদুল মুত্তালিবের পুত্রবধু (আমেনা) তাঁর যুবক স্বামীকে হারালেন সে দিন থেকে তিনি সর্বদা ইয়াসরিব গমন করে স্বামীর কবর যিয়ারত এবং সে সাথে ইয়াসরিবস্থ নিজ আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করার উপযুক্ত মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিলেন।

তিনি চিন্তা করে দেখলেন যে,একটি সঠিক সুযোগ এসে গেছে এবং তাঁর প্রাণাধিক পুত্রসন্তান (মুহাম্মদ)ও এখন বড় হয়েছে এবং সেও এ পথে তাঁর শোকের অংশীদার হতে পারবে। তাঁরা  উম্মে আইমানকে সাথে নিয়ে ইয়াসরিবের উদ্দেশে যাত্রা করেন এবং পূর্ণ এক মাস সেখানে অবস্থান করেন। শিশু মহানবীর জন্য এ সফর শোক ও বেদনা বয়ে এনেছিল। কারণ প্রথম বারের মতো তাঁর দৃষ্টি যে ঘরে তাঁর পিতা হযরত আবদুল্লাহ্ ইন্তেকাল করেছিলেন এবং চির নিদ্রায় শায়িত হয়েছিলেন সেই ঘরের দিকে নিবদ্ধ হয়েছিল।১৪৬

শিশু মহানবীর অন্তরে পিতৃশোক স্তিমিত হতে না হতেই হঠাৎ আরেকটি হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে গেল। এর ফলে শোক আরো বেড়ে গিয়েছিল। কারণ পবিত্র মক্কায় প্রত্যাবর্তনকালে মহানবীর স্নেহময়ী মা হযরত আমেনা পথিমধ্যে আবওয়া নামক স্থানে ইন্তেকাল করেন।১৪৭

এ ঘটনা বনি হাশিম ও আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে শিশু মহানবীকে স্নেহভাজন করেছিল এবং তাঁর প্রতি তাদের সহানুভূতি ও মমতাবোধের উদ্ভব ঘটিয়েছিল। তিনি ছিলেন হযরত আবদুল্লাহ্ ও হযরত আমেনার পুষ্পোদ্যানের একমাত্র পুষ্প-তাঁদের পুণ্যস্মৃতি। এ কারণেই শিশু মহানবী দাদা হযরত আবদুল মুত্তালিবের অশেষ ভালোবাসা ও স্নেহ পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন পিতামহের প্রাণাধিক প্রিয় নাতি। আবদুল মুত্তালিব তাঁকে তাঁর সকল সন্তান অপেক্ষা বেশি ভালোবাসতেন। তিনি সকলের ওপর তাঁকেই অগ্রাধিকার প্রদান করতেন।

কাবার চারদিকে কুরাইশপ্রধান আবদুল মুত্তালিবের জন্য কার্পেট বিছানো হতো। কুরাইশ নেতৃবৃন্দ এবং তাঁর সন্তানগণ তাঁর কার্পেটের চারপাশে বসত। আবদুল্লাহর কথা স্মরণ হলেই তিনি (আবদুল মুত্তালিব) যে কার্পেটের ওপর উপবিষ্ট থাকতেন সে কার্পেটে প্রয়াত পুত্র আবদুল্লাহর একমাত্র স্মৃতি-চি হ্ন শিশু হযরত মুহাম্মদকে এনে তাঁর পাশে বসানোর নির্দেশ দিতেন।১৪৮

পবিত্র কোরআনের সূরা দোহায় মহানবী (সা.)-এর শৈশব ও ইয়াতিম অবস্থার কথা উল্লিখিত হয়েছে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ্ বলেছেন,

) أ لم يجدك يتيما فآوى(

“তিনি কি আপনাকে ইয়াতিম পাওয়ার পর (প্রথমে পিতামহ আবদুল মুত্তালিব ও পরে পিতৃব্য হযরত আবু তালিবের) আশ্রয় দেন নি? (সূরা দোহা : ৬)

মহানবীর ইয়াতিম হওয়ার অন্তর্নিহিত মূল রহস্য আমাদের কাছে খুব একটা স্পষ্ট নয়। তবে আমরা এতটুকু জানি যে,ঘটনাসমূহ যা সংঘটিত হয়েছে তা প্রজ্ঞাবিহীন নয়। এতদসত্ত্বেও আমরা ধারণা করতে পারি যে,মহান আল্লাহ্ চেয়েছিলেন মানব জাতি ও বিশ্বের মহান নেতা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সকল দায়িত্বভার গ্রহণ এবং নেতৃত্বদান শুরু করার আগেই যেন জীবনের সুখ,শান্তি,মাধুর্য ও তিক্ততার স্বাদ আস্বাদন করেন এবং জীবনের উত্থান-পতনের সাথে পরিচিত হন। এর ফলে তিনি মহান আত্মা এবং অত্যন্ত ধৈর্যশীল হৃদয়ের অধিকারী হতে পারবেন,দুঃখ-কষ্ট ও বিপদাপদ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা অর্জন এবং নিজেকে কঠিন বিপদাপদ,কষ্ট এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য প্রস্তুত করতে পারবেন।

মহান আল্লাহ্ চেয়েছিলেন যেন কারও আনুগত্য তাঁর স্কন্ধের ওপর না থাকে;আর তিনি জন্মগ্রহণের পরপর অর্থাৎ জীবনের শুরু থেকেই যেন স্বাধীন থাকেন। তিনি যেন আত্মগঠনে নিয়োজিত মনীষীদের ন্যায় তাঁর আত্মিক-আধ্যাত্মিক উৎকর্ষের ভিত্তিসমূহ নিজ হাতে গঠন করতে সক্ষম হন। যার ফলে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে,তাঁর প্রতিভা আসলে সাধারণ মানবীয় প্রতিভা নয় এবং তাঁর ভাগ্য নির্মাণের ক্ষেত্রে তাঁর পিতা-মাতার কোন ভূমিকাই ছিল না। তাঁর সকল মর্যাদা আসলে ওহীর উৎসমূল থেকেই উৎসারিত হয়েছিল।

আবদুল মুত্তালিবের মৃত্যু

হৃদয়বিদারক ঘটনাসমূহ সব সময় মানব জীবনের পথ-পরিক্রমণে আবির্ভূত হয়। সেগুলো সমুদ্রের পর্বত প্রমাণ উত্থাল তরঙ্গমালার ন্যায় একের পর এক উত্থিত হয়ে মানুষের জীবন-তরীকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে এবং মানব মনের ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানে।

মহানবী (সা.)-এর অন্তঃকরণে (মায়ের মৃত্যুতে) শোক ও দুঃখ তখনও বিরাজ করছিল ঠিক এমতাবস্থায় তৃতীয় বারের মতো এক বড় বিপদ তাঁর ওপর আপতিত হয়েছিল। তাঁর জীবনের অষ্টম বসন্তকাল অতিবাহিত হতে না হতেই অভিভাবক ও পিতামহ হযরত আবদুল মুত্তালিবকে তিনি হারিয়েছিলেন। আবদুল মুত্তালিবের মৃত্যু তাঁর কোমল আত্মার ওপর এতটা গভীর দাগ কেটেছিল যে,দাদা আবদুল মুত্তালিব যে দিন মৃত্যুবরণ করেছিলেন সে দিন তিনি সমাধিস্থলে তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা পর্যন্ত অশ্রুপাত করেছিলেন এবং তিনি কখনই পিতামহ আবদুল মুত্তালিবকে ভুলেন নি।১৪৯

হীরা ও গাসসান রাজ্যসমূহ

আরব উপদ্বীপের যে সব অঞ্চলের জলবায়ু ও আবহাওয়া ভালো ছিল সে সব অঞ্চল ইসলামের অভ্যুদয়ের আগে সর্বশেষ শতাব্দীতে পুরোপুরি তিন বৃহৎ শক্তি অর্থাৎ ইরান,রোম ও আবিসিনিয়ার অধীন ছিল। আরব উপদ্বীপের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ইরানের প্রভাবাধীন,উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল রোমের অনুগত এবং মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চল হাবাশাহ্ অর্থাৎ আবিসিনিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল। এ সব সভ্য রাষ্ট্রের পাশে থাকার কারণে এবং ঐ সব রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্যের মধ্যে সর্বদা দ্বন্দ্ব থাকার কারণে আরব উপদ্বীপের সীমান্তবর্তী অঞ্চলসমূহে অর্ধ-স্বাধীন ও অর্ধ-সভ্য বেশ কিছু রাজ্যের পত্তন হয়েছিল যেগুলোর প্রতিটিই ছিল নিজ নিজ প্রতিবেশী সভ্য বৃহৎ সাম্রাজ্য ও রাষ্ট্রের অনুগত। হীরা,গাসসান ও কিন্দাহ্ ছিল ঐ ধরনের রাজ্য যেগুলোর প্রতিটি ছিল পারস্য,রোম ও আবিসিনীয় সাম্রাজ্যের যে কোন একটির প্রভাবাধীন।50

ঐতিহাসিক তথ্য ও বিবরণাদি অনুযায়ী খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর প্রথমাংশে আশকানীয় যুগের শেষের দিকে কতিপয় আরব গোত্র ফোরাত নদীর পাড়ে অবস্থিত এলাকায় বসতি স্থাপন করে এবং ইরাকের একটি অংশকে নিজেদের কর্তৃত্বে নিয়ে আসে। তারা ধীরে ধীরে এ সব বসতি স্থাপনকারী আরব গ্রাম,দুর্গ,শহর ও নগর প্রতিষ্ঠা করে যেগুলোর মধ্যে হীরা’নগরটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ নগরীটি বর্তমান কুফা নগরীর নিকটেই অবস্থিত ছিল।

এ শহরটি ছিল দুর্গ-নগরী। আর এ বিষয়টি এ শহরের নামকরণ থেকেও স্পষ্ট প্রতিভাত হয়ে যায়।51 এ নগরীতে আরবগণ বসবাস করত। তবে ধীরে ধীরে তা শহরে রূপান্তরিত হয়ে যায়। ফোরাত অঞ্চলের ভালো জলবায়ু এবং প্রচুর নদ-নদীর অস্তিত্ব ও প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুকূল হওয়ার কারণে অত্র অঞ্চল আবাদ হয়েছিল। ঐ অঞ্চলের অধিবাসিগণ মরুবাসী আরব সর্দারদেরকে কৃষ্টি ও সভ্যতার আহবান জানাতে সক্ষম হয়েছিল। হীরা অঞ্চলের অধিবাসিগণ পারস্যের প্রতিবেশী হওয়ার কারণে পারস্য সভ্যতা ও সংস্কৃতি দ্বারা উপকৃত হয়েছিল। খওরানাক প্রাসাদের ন্যায় হীরার সন্নিকটে বেশ কিছু প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়েছিল যা উক্ত নগরীকে এক বিশেষ সৌন্দর্য দান করেছিল। এ অঞ্চলের আরবগণ লিপি ও লিখনপ্রণালীর সাথে পরিচিত হয়েছিল এবং সম্ভবত সেখান থেকেই লিপি ও লিখনপ্রণালী আরব উপদ্বীপের অন্যান্য স্থানে প্রচলিত হয়েছিল।52

হীরার শাসনকর্তা ও আমীরগণ বনি লাখম গোত্রের আরব ছিলেন এবং পারস্যের সাসানীয় সম্রাটগণ তাঁদের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। হীরার আমীরদের সাসানীয় সম্রাটগণ এ কারণে সমর্থন করতেন যাতে করে তাঁরা তাঁদের (হীরার আমীরগণ) ইরান ও আরব বেদুইনদের মাঝে অন্তরায় হিসাবে গড়ে তুলতে এবং তাঁদের সহায়তায় পারস্য সাম্রাজ্যের সীমান্তবর্তী এলাকাসমূহে লুণ্ঠনকারী আরব বেদুইন ও যাযাবরদের আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হন। (হীরার) এ সব আমীরের নাম ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। হামযাহ্ ইসফাহানী এ সব আমীরের নাম ও আয়ুষ্কাল এবং যে সব সাসানীয় সম্রাট তাঁদের সমসাময়িক ছিলেন তাঁদের একটি তালিকা প্রদান করেছেন।53

যা হোক বনি লাখম বংশের রাজ্য ছিল হীরা অঞ্চলের বৃহত্তম আরবীয় রাজ্য যা ছিল অর্ধসভ্য। এ বংশের সর্বশেষ বাদশাহ্ ছিলেন নূমান বিন মুনযির যিনি পারস্য সম্রাট খসরু পারভেজ কর্তৃক অপসারিত ও নিহত হয়েছিলেন। তাঁর অপসারণ ও হত্যার কাহিনী ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে।54

পঞ্চম শতাব্দীর শেষে অথবা ষষ্ঠ শতকের প্রথম দিকে একদল বহিরাগত আরব আরব উপদ্বীপের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে এর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বসতি স্থাপন করে যা ছিল রোমান সাম্রাজ্যের সীমান্তবর্তী। এ দেশটি রোমান সাম্রাজ্যের ছত্রছায়ায় ছিল এবং ঠিক যেমনি হীরার শাসকবর্গ পারস্য সম্রাটদের তাঁবেদার ছিল ঠিক তেমনি গাসসানীয় রাজ্যের শাসকবর্গও বাইজান্টাইনীয় সম্রাটদের তাঁবেদার ছিল।

গাসসান দেশটি কিছুটা সভ্য ছিল। যেহেতু দেশটির সরকারের কেন্দ্র একদিকে দামেস্কের কাছাকাছি,অন্যদিকে বসরার নিকটবর্তী অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল সেহেতু এ দেশটি রোমান প্রভাবাধীন আরব অঞ্চলের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছিল। আর অত্র এলাকাতে রোমান সভ্যতা ও সংস্কৃতি ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল।

গাসসানিগণ হীরার লাখম গোত্রভুক্ত শাসকবর্গ এবং ইরানীদের সাথে মতবিরোধ ও দ্বন্দ্ব থাকার কারণে রোমান সাম্রাজ্যের মিত্র হয়েছিল। প্রায় 9 অথবা 10 গাসসানী আমীর একের পর এক এ দেশটিতে শাসনকার্য পরিচালনা করেছে।

হিজাযে প্রচলিত ধর্ম

হিজাযে যে ধর্ম প্রচলিত ছিল তা ছিল পৌত্তলিক ধর্ম। কেবল ইয়াসরিব (মদীনা) ও খাইবারে ইয়াহুদী সংখ্যালঘুরা বসবাস করত। ইয়েমেন ও হিজাযের সীমান্তবর্তী শহর নজরানের অধিবাসীরা যেমনি খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী ছিল,ঠিক তদ্রূপ আরব উপদ্বীপের উত্তরাঞ্চলীয় এলাকাসমূহ রোমান সাম্রাজ্যের প্রভাবাধীন এলাকা হওয়ার কারণে অত্র অঞ্চলেও খ্রিষ্টধর্ম প্রচলিত ছিল। যদি এ তিন সংবেদনশীল এলাকা বাদ দেই তাহলে হিজাযের অন্য সব এলাকায় মূলত বিভিন্ন আকার-অবয়বে মূর্তিপূজা এবং বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার ও বিশ্বাস প্রচলিত ছিল।

তবে হানীফ’(حنيف ) নামে পরিচিত অতি মুষ্টিমেয় ব্যক্তি তাওহীদী মতাদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল যারা নিজেদের হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর ধর্মের অনুসারী বলে জানত। তাদের সংখ্যা আসলেই খুব কম ছিল। তদানীন্তন পৌত্তলিক আরব জনসংখ্যার তুলনায় তাদের সংখ্যা অতি নগণ্য ছিল।55

হযরত ইবরাহীম (আ.) ও হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর সময় থেকে ধর্মীয় ও চারিত্রিক আচার-প্রথা ও বিধিসমন্বিত একত্ববাদী ধর্ম হিজাযে প্রবর্তিত ও প্রচলিত হয়েছিল। পবিত্র কাবার সম্মানার্থে হজ্বব্রত পালন ছিল ঐ সব প্রথারই অন্তর্ভুক্ত। পরবর্তীকালে আমর বিন কুসাই নামের খুযাআ গোত্রের এক ব্যক্তি-যার হাতে সর্বময় কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব ছিল তার মাধ্যমে পবিত্র মক্কা নগরীতে মূর্তিপূজার প্রচলন হয়। এ ব্যক্তি শাম (সিরিয়া) ভ্রমণ করার সময় দেখতে পেয়েছিল যে,আমালাকা সম্প্রদায় সুন্দর সুন্দর প্রতিমার পূজা করে। তাদের এ কাজ তার মনঃপূত হয় এবং সে হুবাল’নামের একটি সুন্দর প্রতিমা শাম থেকে মক্কায় আনয়ন করে এবং জনগণকে তা পূজা করার ব্যাপারে আহবান জানায়।56

প্রসিদ্ধ প্রতিমাসমূহ : 1. হুবাল 2. আসাফ 3. নায়েলাহ্ 4. লাত 5. উয্যা 6. মানাত 7. আমইয়ানুস 8. সা দ 9. যূল খালসাহ্ 10. মান্নাফ।

এগুলোই ছিল আরবদের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ প্রতিমা। এ সব প্রতিমা ছাড়াও আরবদের অন্যান্য প্রতিমার উপাসনাও প্রচলিত ছিল। কখনো কখনো কোন গোত্র,এমনকি কোন কোন বংশের নিজস্ব প্রতিমা ও মূর্তি ছিল যাকে তারা পূজা করত।

হিজাযে জ্ঞান ও শিক্ষা

হিজাযের জনগণ ও অধিবাসীদের উম্মী’বলা হতো। উম্মী’শব্দের অর্থ অশিক্ষিত। অর্থাৎ ঐ ব্যক্তিকে উম্মী বলা হয় যে মায়ের পেট থেকে যে অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হয়েছিল ঠিক সে অবস্থায়ই রয়েছে। (জাহেলিয়াতের যুগে) আরবদের মধ্যে জ্ঞান ও শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে হলে আমাদের জন্য এতটুকু জানাই যথেষ্ট যে,ইসলামের শুভ অভ্যুদয়ের লগ্নে কুরাইশ গোত্রে কেবল 17 ব্যক্তি লেখাপড়া জানত। আর মদীনায় আওস’ও খাযরাজ’গোত্রদ্বয়ের মধ্যে কেবল 11 জন লেখাপড়া জানত।57

আরব উপদ্বীপের অধিবাসীদের ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত এ আলোচনার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে মতাদর্শ,চিন্তা-চেতনা,বিশ্বাস,অর্থনীতি,চরিত্র,আচার-ব্যবহার এবং কৃষ্টি-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পবিত্র ইসলাম ধর্মের শিক্ষা-দীক্ষার মাহাত্ম্য স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় এবং সব সময় সভ্যতাসমূহের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদের ঐ সব সভ্যতার পূর্ববর্তী অধ্যায় অধ্যয়ন করতেই হবে। অধ্যয়নের পরই কেবল উক্ত সভ্যতার মহত্ত্বের প্রকৃত মূল্যায়ন করা উচিত।58

তৃতীয় অধ্যায় : দুই পরাশক্তি ইরান ও রোমের অবস্থা

ইসলাম ধর্মের পবিত্র আন্দোলনের প্রকৃত তাৎপর্য ও গুরুত্ব উপলব্ধি করার জন্য দু টি পরিবেশের সমুদয় অবস্থা অধ্যয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় :

1. পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার পরিবেশ অর্থাৎ যে পরিস্থিতি ও পরিবেশের মধ্যে ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব ও এর বিকাশ ঘটেছিল।

2. ঐ সময় পৃথিবীর সবচেয়ে সভ্য অঞ্চলসমূহে যে সব জাতি বসবাস করত তাদের চিন্তাধারা,চরিত্র,আচার,রীতি-নীতি,প্রথা ও সভ্যতা অধ্যয়ন।

ইতিহাস থেকে ঐ সময়ের পৃথিবীর সবচেয়ে আলোকিত যে অঞ্চলের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা জানতে পারি তা হলো রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যের সার্বিক অবস্থা ও পরিবেশ। আলোচনা পূর্ণ করার জন্য আমাদের অবশ্যই উক্ত দু দেশের অবস্থা ভিন্ন ভিন্ন অংশে আলোচনা ও অধ্যয়ন করতে হবে। যার ফলে ইসলাম ধর্ম যে সুমহান সভ্যতা মানব জাতিকে উপহার দিয়েছে তার গুরুত্ব ও তাৎপর্য স্পষ্ট হয়ে যাবে।

তখনকার রোমান সাম্রাজ্যের অবস্থা প্রতিদ্বন্দ্বী পারস্য সাম্রাজ্যের অবস্থা অপেক্ষা কোন অংশে কম ছিল না। গৃহযুদ্ধ এবং আর্মেনিয়া ও অন্যান্য এলাকাকে কেন্দ্র করে ইরানের সাথে সংঘটিত যুদ্ধসমূহ রোমান সাম্রাজ্যের জনগণকে এক নতুন বিপ্লব বরণ করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তুলেছিল। ধর্মীয় মতপার্থক্যসমূহ অন্য সব কিছুর চেয়ে বেশি এ সব বিরোধ ও পার্থক্যকে বিস্তৃত করেছিল। মূর্তিপূজক ও খ্রিষ্টানদের মধ্যে যুদ্ধের বহ্নিশিখা নির্বাপিত হতো না। যখন গির্জার পুরোহিতগণ শাসনকর্তৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন তখন তাঁরা তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী ও বিরোধীদের কঠিন চাপের মধ্যে রেখেছিলেন যা একটি অসন্তুষ্ট সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটিয়েছিল। যে বিষয়কে রোমান সাম্রাজ্যের জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত ইসলাম ধর্ম গ্রহণের অন্যতম বড় কারণ বলে গণ্য করা হয়েছে তা ছিল গির্জার পুরোহিতদের সহিংসতার কারণে উক্ত সাম্রাজ্যের বিভিন্ন গোষ্ঠীর বঞ্চনা ও নাগরিক অধিকারহীনতা। একদিকে পুরোহিত ও ধর্মযাজকদের মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং অন্যদিকে বিভিন্ন ধরনের পথ ও মত দিন দিন রোমান সাম্রাজ্যের শক্তি,ক্ষমতা ও আধিপত্য নিঃশেষ করে দিচ্ছিল।

এ সব ছাড়াও উত্তর-পূর্ব দিকের শ্বেতাঙ্গ ও পীতবর্ণের লোকেরা সর্বদা ইউরোপ মহাদেশের উর্বর অঞ্চলসমূহ নিজেদের করায়ত্তে আনার ইচ্ছা পোষণ করত এবং কখনো কখনো সামরিক সংঘর্ষ ও যুদ্ধসমূহে একে অপরের বিপুল ক্ষয়-ক্ষতি সাধন করত। এর ফলে রোমান সাম্রাজ্য দু ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ঐতিহাসিকগণ বিশ্বাস করেন যে,ষষ্ঠ শতাব্দীতে রোমের রাজনৈতিক,সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত বিশৃঙ্খল ও দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। এমনকি পারস্য সাম্রাজ্যের ওপর রোমান সাম্রাজ্যের বিজয়ী হওয়ার বিষয়টি উক্ত সাম্রাজ্যের সামরিক পরাশক্তি হওয়ার প্রমাণ বলে গণ্য করা হতো না,বরং বিশ্বাস করা হতো যে,ইরানের পরাজয় আসলে সে দেশটির প্রশাসনের বিশৃঙ্খলারই ফসল ছিল। এ দু টি দেশ যা নিজেদের ওপর বিশ্ব রাজনীতি ও নেতৃত্বের মুকুট পরিধান করেছিল তা ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব কালে চরম বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করছিল। এটি স্পষ্ট যে,এ ধরনের পরিবেশ-পরিস্থিতি একটি সঠিক ধর্ম গ্রহণ করার জন্য অসাধারণ প্রস্তুতি ও তীব্র আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করেছিল যা মানব জাতির জীবনের সার্বিক অবস্থা উন্নয়নে সক্ষম।

রোমের খণ্ডকালীন আলোচনাসভাসমূহ

কিছু কিছু দেশে একদল বেকার ও প্রবৃত্তিপূজারী ব্যক্তি নিজেদের অসদুদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য কতগুলো অন্তঃসারশূন্য বিষয় জনসমক্ষে উত্থাপন ও প্রচার করত এবং এভাবে তারা জনগণের মূল্যবান জীবন নষ্ট করত। প্রাচ্যের অনেক দেশেই আমাদের এ বক্তব্যের পক্ষে প্রচুর দলিল-প্রমাণ বিদ্যমান যা বর্তমানে আলোচনা করার কোন অবকাশ নেই। ঘটনাচক্রে তখনকার রোম অন্য সব দেশের চেয়ে বেশি এ ধরনের সমস্যায় জড়িয়ে পড়েছিল। যেমন রোমান সম্রাট ও রাজনীতিকগণ কিছু কিছু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অনুসারী হওয়ার কারণে বিশ্বাস করতেন যে,হযরত ঈসা মসীহ্ (আ.) দু ধরনের স্বভাব-প্রকৃতি ও ইচ্ছাশক্তির অধিকারী। কিন্তু কিছু সংখ্যক ইয়াকুবী সম্প্রদায়ভুক্ত খ্রিষ্টান বিশ্বাস করত যে,হযরত ঈসা (আ.) কেবল এক ধরনের স্বভাব-প্রকৃতি ও ইচ্ছাশক্তির অধিকারী। আর ভিত্তিহীন এ বিষয়টিই রোমান সাম্রাজ্যের স্বাধীনতা,সার্বভৌমত্ব,ঐক্য ও সংহতির ওপর তীব্র আঘাত হানে এবং তাদের মধ্যে এক গভীর ফাটলের উদ্ভব ঘটায় যার ফলে সরকার ও প্রশাসন নিজ আকীদা-বিশ্বাস সংরক্ষণ করতে বাধ্য হয়। আর এ কারণেই প্রশাসন বিরোধীদেরকে অতি নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয়। উৎপীড়ন ও চাপের কারণে বেশ কিছুসংখ্যক বিরোধী ইরান সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। এ সব বিরোধীই মুসলিম সেনাবাহিনীর সম্মুখে রণক্ষেত্র উন্মুক্ত করে দিয়েছিল এবং মনে-প্রাণে মুসলিম সেনাবাহিনীকে বরণ করে নিয়েছিল।

তদানীন্তন রোমান সাম্রাজ্য ঠিক মধ্যযুগীয় ইউরোপের মতো ছিল। প্রসিদ্ধ জ্যোতির্বিদ ফ্লামারীয়োন মধ্যযুগে ইউরোপীয় কৃষ্টির পর্যায় ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নিম্নোক্ত কাহিনীটি বর্ণনা করেছেন : আধ্যাত্মিক সমগ্র’নামক গ্রন্থটি মধ্যযুগে স্কলাসটিক দর্শনের পূর্ণ বহিঃপ্রকাশ ও নিদর্শন বলে গণ্য হতো। এ গ্রন্থটি চারশ’বছর ধরে আনুষ্ঠানিক পাঠ্যপুস্তক হিসাবে ইউরোপে পঠিত হতো। উক্ত গ্রন্থের একটি অংশে এ শিরোনামে আলোচনা করা হয়েছে : একটি সুঁইয়ের অগ্রভাগের সরু ছিদ্রের মধ্যে কত জন ফেরেশতার অবস্থান গ্রহণ করা সম্ভব?’‘ চিরন্তন পিতার বাম চোখের পুতুলী থেকে তাঁর ডান চোখের পুতুলী পর্যন্ত দূরত্ব কত ফারসাখ? (1 ফারসাখ = প্রায় 6 কিলোমিটার)

দুর্ভাগ্যপীড়িত রোমান সাম্রাজ্য বহিঃশক্তিগুলোর সাথে যুদ্ধে-বিগ্রহে লিপ্ত হওয়ার একই সময় অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ ও দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিল। এ সব দ্বন্দ্ব-সংঘাত ধর্মীয় রূপ পরিগ্রহ করেছিল। আর এর ফলে দিন দিন দেশটি পতনের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল। ইয়াহুদিগণ যারা ছিল একটি ষড়যন্ত্রকারী জাতি,তারা যখন দেখল,রোমের খ্রিষ্টান সম্রাট কর্তৃক আরোপিত চাপ সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে তখন তারা রোমান সাম্রাজ্য ধ্বংস ও এর মূলোৎপাটন করার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো। তারা একবার আনতাকীয়া নগরীও দখল করে নিয়েছিল এবং নগরীর প্রধান ধর্মযাজকের কান,নাক ও ঠোঁট কর্তন করেছিল। রোম সরকার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য আনতাকীয়ার ইয়াহুদীদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছিল। রোমে ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের মধ্যে এ ধরনের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের কয়েকবার পুনরাবৃত্তি হয়েছিল। আবার কখনো কখনো এ শত্রুতা দেশের বাইরেও বিস্তার লাভ করেছিল। উদাহরণস্বরূপ ইয়াহুদীরা একবার ইরান থেকে 80,000 খ্রিষ্টানকে ক্রয় করে দুম্বার মতো জবাই করেছিল।

এখানেই সম্মানিত পাঠকবর্গ ইসলাম ধর্মের অভ্যুদয়ের সমসাময়িক বিশ্বের অন্ধকারাচ্ছন্ন ও অরাজক পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করতে এবং স্বীকার করতে পারবেন যে,ইসলামের মুক্তিদানকারী শিক্ষা-দীক্ষা ও বিধি-বিধান ঐ অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ থেকে সৃষ্ট হয় নি এবং তা মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত চিন্তাধারারও ফসল নয়। ঐক্য ও সহমর্মিতার মৃদুমন্দ এ সমীরণ এবং শান্তি ও মৈত্রীর সুর যা পবিত্র ইসলাম ধর্মের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তা আসলে ঐশ্বরিক উৎস থেকেই উৎসারিত হয়েছে। কিভাবে বলা সম্ভব যে,যে ইসলাম ধর্ম জীবজন্তু ও প্রাণীকুলকে পর্যন্ত জীবনধারণ করার অধিকার দিয়েছে আসলে তা এ ধরনের রক্তপিপাসু পরিবেশ থেকে উদ্ভূত?

ইসলাম ধর্ম হযরত ঈসা (আ.)-এর ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষার ব্যাপারে ভিত্তিহীন এ সব আলোচনার অবসান ঘটিয়েছে এবং ঈসা (আ.)-কে ঠিক এভাবে পরিচিত করিয়েছে :

) ما المسيح بن مريم إلّا رسول قد خلت من قبله الرّسل و أمّه صدّيقة كانا يأكلان الطّعام(

“মরিয়ম তনয় মসীহ্ একজন নবীর চেয়ে বেশি কিছু নন যাঁর আগে অনেক নবী-রাসূল গত হয়েছেন। তাঁর মাতা ছিলেন একজন পূতঃপবিত্রা পরম সত্যবাদিনী। এমতাবস্থায় তাঁরা উভয়ই খাদ্য গ্রহণ করতেন এবং মানুষ ছিলেন।” (সূরা মায়েদাহ্ : 75)

পবিত্র কোরআনের এ আয়াত হযরত ঈসা (আ.)-এর আত্মা,রক্ত ও পরিচিতি সংক্রান্ত গীর্জার ধর্মযাজকদের অনর্থক আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের অবসান ঘটিয়েছে। এ ধর্মের সুমহান শিক্ষা ও আদর্শ এবং মহৎ মানবীয় গুণাবলী পুনরুজ্জীবিত করার মাধ্যমে মানব জাতিকে অযথা যুদ্ধ-বিগ্রহ ও রক্তপাত থেকে বিরত রেখেছে।


8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53

54

55

56

57

58

59

60

61