চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড4%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 106802 / ডাউনলোড: 9707
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

4

5

আবু তালিবের অভিভাবকত্ব

আবু তালিবের মহান ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদা প্রসঙ্গে আমরা এ গ্রন্থের একটি বিশেষ অংশে (নবুওয়াতের ১০ম বর্ষের ঘটনাবলী সংক্রান্ত অধ্যায়) আলোচনা করব। সেখানে আমরা বিশুদ্ধ দলিল ও সূত্রের ভিত্তিতে মহানবী (সা.)-এর প্রতি তাঁর ঈমান এবং আত্মসমর্পণের বিষয়েও আলোচনা করব। কিন্তু এখন আমরা মহানবীর অভিভাবক হিসাবে হযরত আবু তালিবের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু ঘটনা উল্লেখ করব।

কতিপয় গৌরবোজ্জ্বল কারণে হযরত আবু তালিব মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অভিভাবকত্বের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। কারণ আবু তালিব ছিলেন মহানবীর পিতা হযরত আবদুল্লাহর সহোদর ভ্রাতা।১৫০ তিনি দানশীলতা,বদান্যতা,পরোপকার ও জনহিতকর কাজে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এ কারণেই হযরত আবদুল মুত্তালিব তাঁর অনাথ নাতির লালন-পালন করার জন্য আবু তালিবকে মনোনীত করেছিলেন। স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাস তাঁর অতীব মূল্যবান অবদানের সাক্ষী যা আমরা পর্যায়ক্রমে আলোচনা করব।

কথিত আছে যে,মহানবী (সা.) দশ বছর বয়সে পিতৃব্য আবু তালিবের সাথে একটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আর যেহেতু এ যুদ্ধ নিষিদ্ধ মাসসমূহে সংঘটিত হয়েছিল সেহেতু উক্ত যুদ্ধের নামকরণ করা হয়েছিল ফিজার’। ইতিহাসে ফিজার যুদ্ধ সংক্রান্ত বিশদ বর্ণনা এসেছে।১৫১

শামদেশ (সিরিয়া) সফর

কুরাইশ বংশীয় বণিকগণ যথারীতি প্রতি বছর অন্তত একবার শামদেশে গমন করত। হযরত আবু তালিব কুরাইশদের বাৎসরিক এ বাণিজ্যিক সফরে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। যে ভ্রাতুষ্পুত্রকে তিনি মুহূর্তের জন্য নিজের কাছ থেকে পৃথক হতে দিতেন না তাঁকে কার কাছে রেখে যাবেন এতৎসংক্রান্ত সমস্যাটির এভাবে সমাধান করলেন যে,তিনি তাঁকে মক্কায় রেখে যাবেন এবং কতিপয় ব্যক্তিকে তাঁর দেখাশোনার দায়িত্ব দেবেন। কিন্তু কাফেলার প্রস্থানের মুহূর্তে মহানবীর চোখ অশ্রুজলে সিক্ত হয়ে গেল এবং তাঁর অভিভাবক আবু তালিবের কাছ থেকে (কিছুদিনের জন্য হলেও) এ বিচ্ছেদ তাঁর কাছে অত্যন্ত কঠিন বলে গণ্য হলো। মহানবীর দুঃখভারাক্রান্ত মুখমণ্ডল হযরত আবু তালিবের অন্তরে আবেগ-অনুভূতির প্রলয়ঙ্কর তুফানের সৃষ্টি করল। তিনি অবশেষে কষ্ট সংবরণ করে হলেও হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিজের সাথে নিলেন।১৫২

মহানবীর বারো বছর বয়সের এ সফর ছিল তাঁর অন্যতম আনন্দঘন ভ্রমণ। কারণ এ সফরে তিনি মাদইয়ান,ওয়াদী-উল কুরা ও সামুদ জাতির আবাসস্থল অতিক্রম করেছিলেন। তিনি শাম দেশের মনোজ্ঞ প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীও অবলোকন করেছিলেন। কুরাইশ কাফেলাটি তখনও গন্তব্যস্থলে পৌঁছে নি ঠিক তখন বুসরা নামক স্থানে এমন এক ঘটনা সংঘটিত হয় যার জন্য হযরত আবু তালিবের সফর সংক্রান্ত কর্মসূচীর মধ্যে এক ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। নিচে এতৎসংক্রান্ত বিশদ বিবরণ প্রদান করা হলো :

অনেক বছর যাবৎ বাহীরা নামের একজন খ্রিষ্টান পাদরী বুসরা নামক স্থানে একটি বিশেষ ধর্মীয় উপাসনালয়ে উপাসনা করতেন এবং তিনি সেখানকার খ্রিষ্টানদের কাছে অত্যন্ত সম্মানিত ছিলেন। বাণিজ্যিক কাফেলাসমূহ যাত্রাপথে ঐ স্থানে বিশ্রামের জন্য যাত্রাবিরতি করত এবং কল্যাণ ও বরকত লাভের জন্য তাঁর কাছে যেত। সৌভাগ্যবশত বাহীরা কুরাইশ বাণিজ্য কাফেলার মুখোমুখি হন। তাঁর দৃষ্টি আবু তালিবের ভ্রাতুষ্পুত্রের ওপর পড়লে তিনি খুবই আকৃষ্ট হন। শিশু মহানবীর দৃষ্টিতে এমন এক রহস্যের নিদর্শন ছিল যা তাঁর অন্তরে লুক্কায়িত ছিল। বেশ কিছুক্ষণ তিনি মহানবীর দিকে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে তাকিয়েছিলেন। হঠাৎ তিনি নীরবতা ভঙ্গ করে বললেন, এ শিশুটি আপনাদের মধ্যে কার সন্তান? ঐ কাফেলার কতিপয় ব্যক্তি আবু তালিবের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, (শিশুটি) আবু তালিবের আত্মীয়।” আবু তালিব তখন বললেন, সে আমার ভ্রাতুষ্পুত্র।” বাহীরা বললেন, এ শিশুর এক অতি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আছে। এ সেই প্রতিশ্রুত নবী যাঁর সর্বজনীন নবুওয়াত ও বিশাল হুকুমত (রাজত্ব) সম্পর্কে আসমানী গ্রন্থসমূহে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। এ সেই নবী যাঁর নাম এবং যাঁর পিতা ও পরিবারের নামও আমি ধর্মীয় গ্রন্থাদিতে পড়েছি এবং আমি জানি তিনি কোথা থেকে উত্থিত হবেন এবং কিভাবে তিনি তাঁর নব্য প্রতিষ্ঠিত ধর্মকে পৃথিবীতে বিস্তৃত করবেন১৫৩ ,তবে আপনাদের কর্তব্য হচ্ছে তাঁকে ইয়াহুদীদের চোখের আড়ালে রাখা। কারণ তারা যদি বুঝতে পারে,তাহলে তারা তাঁকে হত্যা করবে।”

অধিকাংশ ইতিহাসবেত্তা বিশ্বাস করেন যে,শামদেশ সফরকালে আবু তালিবের ভ্রাতুষ্পুত্র ঐ স্থানটিই আসলে অতিক্রম করেন নি। তবে একটি বিষয় পরিষ্কার নয় যে,মুহাম্মদ (সা.)-এর চাচা আবু তালিব তাঁকে কোন ব্যক্তির সাথে পবিত্র মক্কায় ফেরত পাঠিয়ে ছিলেন কি না? আর এ বিষয়টি অসম্ভব বলেই মনে হয় যে,সন্ন্যাসীর কথা শোনার পর আবু তালিব তাঁকে নিজের কাছ থেকে পৃথক করে দেবেন অথবা তিনি শামদেশ যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করে ভ্রাতুষ্পুত্র মুহাম্মদের সাথে পবিত্র মক্কার পথে রওয়ানা হয়ে যেতে পারেন।  আবার কখনো বলা হয় যে,আবু তালিব বাহীরার কাছ থেকে শোনার পরও হযরত মুহাম্মদকে নিজের সাথে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে শামদেশে নিয়ে গিয়েছিলেন।

প্রাচ্যবিদদের মিথ্যাচার

আমরা মহান আল্লাহর অনুগ্রহে এ গ্রন্থে পাশ্চাত্যের প্রাচ্যবিদদের ভুল-ভ্রান্তি এবং কখনো কখনো তাঁদের অবৈধ মিথ্যাচার ও অপবাদের ওপরও হাত দেব। যার ফলে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে,তাঁরা কতটা জেনে-শুনে ও ইচ্ছা প্রণোদিত হয়ে সরল ব্যক্তিদের মন-মানসিকতা ও চিন্তা-চেতনায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার প্রয়াস চালিয়েছেন!

পাদ্রী বাহীরার সাথে শিশু মহানবীর সাক্ষাৎ আসলে একটি অত্যন্ত সাদামাটা ঘটনা। কিন্তু প্রাচ্যবিদরা বহু শতাব্দী পরে এ ঘটনাকে তাঁদের বক্তব্যের দলিল হিসাবে উত্থাপন করে জোর দিয়ে বলতে চান যে,হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর উন্নত ও মহান শিক্ষামালা যা তিনি ২৮ বছর পরে জনসমক্ষে প্রকাশ ও প্রচার করেছিলেন এবং আবে হায়াতের (অমৃত) মতো মৃতপ্রায় আরব জাতিকে উজ্জীবিত করেছিলেন আসলে তা তিনি উপরিউক্ত সফরেই বাহীরা থেকে শিখেছিলেন। এ ব্যাপারে তাঁরা বলতে চান যে,হযরত মুহাম্মদ (সা.) যেহেতু নির্মল,পবিত্র,স্বচ্ছ হৃদয়,পুণ্য আত্মা এবং প্রকৃতি প্রদত্ত অসাধারণ স্মরণশক্তির অধিকারী এবং সূক্ষ্মভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে সক্ষম ছিলেন তাই তিনি উক্ত সাক্ষাতেই পূর্ববর্তী নবী ও আদ-সামূদের মতো ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিসমূহের কাহিনী এবং তাঁর ধর্মের অধিকাংশ প্রাণসঞ্জীবনী শিক্ষা ও বিধান এ খ্রিষ্টান পাদ্রীর কাছ থেকে গ্রহণ করেছিলেন।

নিঃসন্দেহে উপরিউক্ত বক্তব্য অলীক কল্পনা বৈ আর কিছুই নয় এবং মহানবীর জীবনেতিহাসের সাথে তা বিন্দুমাত্র খাপ খায় না। আর বুদ্ধিবৃত্তিক মাপকাঠি ও নীতিমালাও তা প্রত্যাখ্যান করে। আমাদের এ বক্তব্যের পক্ষে দলিলগুলো নিচে তুলে ধরা হলো :

১. হযরত মুহাম্মদ (সা.) সকল ঐতিহাসিকের মতে নিরক্ষর (উম্মী) ছিলেন। তিনি লিখতে-পড়তে জানতেন না। আর শামদেশ সফরের সময় তাঁর বয়স ১২ বছরও পূর্ণ হয় নি। এমতাবস্থায় কোন বিবেকবান ব্যক্তি কি বিশ্বাস করতে পারবে যে,যে শিশু লেখাপড়া করে নি এবং যার বয়সের বারোটি বসন্তও অতিক্রান্ত হয় নি সে কি তাওরাত ও ইঞ্জিল থেকে বেশ কিছু বিষয় শিখে নিয়ে ৪০ বছর বয়সে তা ওহী হিসাবে প্রচার এবং এক নতুন শরীয়তের প্রবর্তন করেছে? এ ধরনের বিষয় স্বাভাবিক নিয়ম-নীতিমালার বাইরে এবং মানুষের সামর্থ্য ও ক্ষমতা বিবেচনা করলে তা অসম্ভব বলেই গণ্য করা যায়।

২. যে সময়ের মধ্যে হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাওরাত ও ইঞ্জিল সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারবেন এ সফরের সময়কাল তার চেয়েও অতি সংক্ষিপ্ত ছিল। কারণ এ সফর ছিল বাণিজ্যিক সফর। যাওয়া-আসা এবং বিদেশে অবস্থানকাল সর্বসাকুল্যে ৪ মাসের বেশি লাগত না। কারণ কুরাইশগণ বছরে দু বার সফরে বের হতো। শীতকালে তারা ইয়েমেনের দিকে এবং গ্রীষ্মকালে শামদেশের দিকে সফর করত। তাই এত অল্প সময়ের মধ্যে যে,তাদের পুরো সফর কাল ৪ মাসের বেশি হতে পারে এ কথা কল্পনা করা যায় না। আর পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ব্যক্তিগণও এত অল্প সময়ের মধ্যে এ দু বৃহৎ ধর্মীয় গ্রন্থ শিক্ষা ও আয়ত্ত করতে সক্ষম হবেন না। একজন নিরক্ষর শিশুর পক্ষে তো এ কাজ মোটেও সম্ভব নয়। এ ছাড়াও তিনি পুরো এ চার মাস পাদ্রী বাহীরার সাথে ছিলেন না;বরং শামদেশ যাওয়ার পথে কোন এক স্থানে এ সাক্ষাৎটি হয়েছিল। আর গোটা সাক্ষাৎকাল বড় জোর কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী হয়েছিল।

৩. ঐতিহাসিক তথ্য ও বিবরণাদি থেকে প্রমাণিত হয় যে,শিশু মহানবীকে নিজের সাথে শামদেশে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারেই আবু তালিব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁদের প্রকৃত গন্তব্যস্থল বুসরা ছিল না;বরং বুসরা ছিল শামে যাওয়ার পথে অবস্থিত একটি এলাকা যেখানে বাণিজ্যিক কাফেলাসমূহ বিশ্রাম করার জন্য কখনো কখনো যাত্রাবিরতি করত। তাই এটি কিভাবে সম্ভব যে,মহানবী সেখানে অবস্থান করে তাওরাত ও ইঞ্জিল শিক্ষায় ব্রত হবেন? আর যদি বলি যে,আবু তালিব তাঁকে নিজের সাথে শামে নিয়ে গিয়েছিলেন অথবা সেখান থেকে তাঁকে নিয়ে মক্কায় ফিরে গিয়েছিলেন অথবা অন্য কোন ব্যক্তির সাথে তিনি তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রকে মক্কায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তাহলে কোন অবস্থায়ই বুসরা আবু তালিবের বাণিজ্যিক কাফেলার প্রকৃত গন্তব্যস্থল ছিল না। যার ফলে কাফেলা উক্ত অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যস্ত হয়ে পড়বে আর মহানবীও সেখানে লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করবেন।

৪. যদি মহানবী উক্ত পাদ্রীর কাছ থেকে কতিপয় বিষয় শিখে থাকেন তাহলে তা অবশ্যই কুরাইশদের মধ্যে খ্যাতি লাভ করত এবং সকলেই ফেরার পর তা বর্ণনা করত। তা ছাড়া মহানবীও তাঁর সম্প্রদায়ের কাছে দাবি করতে পারতেন না যে, হে লোকসকল! আমি নিরক্ষর ও লেখাপড়া শিখি নি।” অথচ মহানবী তাঁর রিসালাত ও নবুওয়াত উক্ত শিরোনামেই শুরু করেছিলেন। আর তখন মক্কার কোন ব্যক্তি তাঁকে বলেনি যে, হে মুহাম্মদ! তুমি তোমার বারো বছর বয়সে বুসরায় এক পাদরীর কাছে পাঠ নিয়েছিলে (তাওরাত ও ইঞ্জিল শিখেছিলে)। আর এ সব উজ্জ্বল সত্যসমূহ তাঁর কাছ থেকেই আয়ত্ত করেছ।”

মক্কার মুশরিকগণ তাঁর প্রতি সকল প্রকার অপবাদ আরোপ করেছিল। যাতে করে তারা মহানবীর বিরুদ্ধে কোন দলিল-প্রমাণ পেতে পারে সেজন্য তারা পবিত্র কোরআনের ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করত। এমনকি তারা যখন দেখতে পেত যে,মহানবী কখনো কখনো মারওয়া পাহাড়ের একজন খ্রিষ্টান দাসের পাশে বসে রয়েছেন তখন তারা এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে বলত, মুহাম্মদ তার বাণী এ গোলামটির কাছ থেকে শিখেছে।” তাই পবিত্র কোরআন তাদের এ অযৌক্তিক অপবাদ খণ্ডন করে বলেছে :

) و لقد نعلم أنّهم يقولون إنّما يعلّمه بشر لسان الذي يلحدون إليه أعجميّ و هذا لسان عربيّ مبين(

“তাদের এ বক্তব্যের ব্যাপারে আমরা অবগত আছি। তারা বলে যে,এক মানুষ তাকে এ কোরআন শিক্ষা দেয়,কিন্তু যে ব্যক্তির (খ্রিষ্টান দাস) প্রতি তারা ইঙ্গিত করেছে তার ভাষা তো অনারবীয় (আজামী) আর এ গ্রন্থটি পরম বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় অবতীর্ণ।” (সূরা নাহল : ১০৩)

কিন্তু প্রাচ্যবিদদের এ অপবাদ না পবিত্র কোরআনে উল্লিখিত হয়েছে,আর না কোন সুযোগসন্ধানী কুরাইশ তা মহানবীর বিরুদ্ধে দলিল হিসাবে ব্যবহার করেছে। আর এ থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে,এ অপবাদ আসলে আমাদের সমসাময়িক কালের প্রাচ্যবিদদের মস্তিষ্কপ্রসূত।

৫. পবিত্র কোরআনে পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের যে সব কাহিনী ব্যাপকভাবে বর্ণিত হয়েছে সেগুলো তাওরাত ও ইঞ্জিলে বর্ণিত কাহিনীগুলোর সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এ দু গ্রন্থে নবী-রাসূলদের কাহিনী অত্যন্ত জঘন্য ও ঘৃণ্যভাবে বর্ণিত হয়েছে যা কখনই বুদ্ধিবৃত্তিক ও যৌক্তিক নীতিমালার সাথে খাপ খায় না। পবিত্র কোরআনের সাথে এ দু গ্রন্থের তুলনা করলে প্রমাণিত হয়ে যাবে যে,পবিত্র কোরআনের বিষয়বস্তু এ দু গ্রন্থ থেকে নেয়া হয় নি। আর যদি ধরেও নেয়া হয় যে,হযরত মুহাম্মদ (সা.) পূর্ববর্তী জাতি ও উম্মতদের কাহিনী সংক্রান্ত তথ্য ও জ্ঞান বাইবেলের পুরাতন ও নতুন নিয়ম অর্থাৎ তাওরাত ও ইঞ্জিলের বিভিন্ন গ্রন্থ ও অধ্যায় হতে গ্রহণ করেছেন তাহলে অবশ্যই তাঁর বক্তব্য ও বাণীর সাথে কুসংস্কার ও কল্পকাহিনী মিশ্রিত হয়ে যাবে।১৫৫

৬. শামদেশ গমনের পথে অবস্থিত বুসরা এলাকার খ্রিষ্টান পাদরী যদি মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মতো একজন নবীকে প্রশিক্ষিত করে সমাজকে উপহার দেয়ার মতো এতটা ধর্মীয় ও তাত্ত্বিক জ্ঞান ও তথ্যাবলীর অধিকারী হতেন তাহলে কেন তিনি খ্যাতি অর্জন করেন নি? কেন তিনি অজ্ঞাত রয়ে গেলেন? কেন তিনি মুহাম্মদ (সা.) ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তিকে প্রশিক্ষিত করেন নি,অথচ তাঁর আশ্রম ও উপাসনালয়ে সর্বদা জনতা যিয়ারত করতে আসত?

৭. খ্রিষ্টান লেখকগণও মহানবী হযরত মুহাম্মদকে একজন বিশ্বস্ত ও সত্যবাদী ব্যক্তি হিসাবেই জানেন। আর পবিত্র কোরআনের বক্তব্য অনুযায়ী পূর্ববর্তী নবী-রাসূল এবং জাতিসমূহের কাহিনী ও ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর কোন তথ্যই জানা ছিল না। ঐ সব নবী-রাসূল এবং জাতি সংক্রান্ত জ্ঞান তিনি কেবল ওহী মারফত লাভ করেছেন-অন্য কোন সূত্র থেকে পান নি। সূরা কাসাসের ৪৪ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে :

) و ما كنت بجانب الغربي إذ قضينا إلى موسى الأمر و ما كنت من الشّاهدين(

“যখন আমি মূসাকে রিসালাতের দায়িত্বভার প্রদান করেছিলাম তখন আপনি তুর পাহাড়ের পশ্চিম প্রান্তে ছিলেন না এবং আপনি তা প্রত্যক্ষও করেন নি।”

সূরা হুদের ৪৯ নং আয়াতে হযরত নূহ (আ.)-এর কাহিনী বর্ণনা করার পর বলা হয়েছে :

) تلك من أنباء الغيب نوحيها إليك ما كنت تعلمها أنت و لا قومك من قبل هذا(

“এগুলো হচ্ছে অদৃশ্যজগতের সংবাদ যা আমরা আপনার প্রতি ওহী করেছি। না আপনি এর আগে এ সব সংবাদ ও কাহিনী সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন,আর না আপনার সম্প্রদায় (এগুলো জানত)।”

এ সব আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয়ে যায় যে,মহানবী এ সব ঘটনা ও কাহিনী সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন না। সূরা আলে ইমরানের ৪৪ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে :

) ذلك من أنباء الغيب نوحيه إليك و ما كنت لديهم إذ يُلقون أقلامهم أيّهم يكفل مريم و ما كنت لديهم إذ يختصمون(

“এটি হচ্ছে অদৃশ্য জগতের সংবাদ যা আপনার প্রতি আমরা ওহী করেছি;আর আপনি তাদের কাছে ছিলেন না যখন তারা লটারী করছিল যে,কে তাদের মধ্য থেকে মরিয়মের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করবে? (তাদের প্রত্যেকেই চাচ্ছিল যে,সে এ গৌরবের অধিকারী হবে) এবং তারা যখন এ ব্যাপারে পরস্পর বিবাদ করছিল তখনও আপনি তাদের নিকট ছিলেন না।”

তাওরাত গ্রন্থ সম্পর্কে একটি পর্যালোচনা

নবী-রাসূলদের কাহিনী বর্ণনা করার ক্ষেত্রে এ গ্রন্থ এতটা অসংলগ্ন কথাবার্তা,আলোচনা ও বক্তব্যে ভরপুর যে,তা কখনই ওহীর সাথে সম্পর্কিত করা সম্ভব নয়। আমরা এতৎসংক্রান্ত তাওরাত থেকে কিছু নমুনা পেশ করব যার ফলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হবে যে,মহানবী (সা.) যদি খ্রিষ্টান পাদ্রী বাহীরার কাছ থেকেই পবিত্র কোরআন শিখে থাকবেন তাহলে পবিত্র কোরআনে কেন তাওরাতে বর্ণিত জঘন্য ও ঘৃণ্য বিষয়সমূহের কোন অস্তিত্ব নেই? যেমন :

১. তাওরাতের সৃষ্টি’সংক্রান্ত পুস্তিকার ৩২ নং অধ্যায়ের ২৫-৩০ নং বাক্যে বর্ণিত আছে,মহান আল্লাহ্ এক রাতে প্রভাত হওয়া পর্যন্ত হযরত ইয়াকুব (আ.)-এর সাথে কুস্তি লড়েছিলেন!

২. মহান আল্লাহ্ হযরত আদম (আ.)-কে মিথ্যা বলেছিলেন, যদি এ গাছের ফল খাও তাহলে তুমি মারা যাবে? অথচ যদি তাঁরা ঐ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করতেন তাহলে মহান আল্লাহর ন্যায় ভালো-মন্দ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতেন! যেহেতু তাঁরা (ঐ নিষিদ্ধ গাছের ফল) খেয়েছিলেন তাই তাঁরা (ভালো-মন্দ সম্পর্কে) জ্ঞাত হয়েছিলেন!১৫৬

৩. তাওরাত হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর ওপর দু জন ফেরেশতার অবতীর্ণ হওয়ার বিষয়টি এভাবে বর্ণনা করেছে : খোদা দু জন ফেরেশতার সাথে নিচে (ভূপৃষ্ঠে) অবতরণ করলেন যাতে করে তিনি মানব জাতির ব্যাপারে যাচাই করতে পারেন যে,যা কিছু তাঁর কাছে পৌঁছায় তা সত্য না মিথ্যা। এ কারণেই তিনি ইবরাহীমের কাছে প্রকাশিত হলেন। ইবরাহীম বললেন, আপনাদের পা ধুয়ে দেয়ার জন্য কি পানি আনব? খোদা ও ফেরেশতাদ্বয় ক্লান্ত ছিলেন। তাই তাঁরা বিশ্রাম করলেন এবং খাদ্য গ্রহণ করলেন।১৫৭

সম্মানিত পাঠকবর্গ! আপনারা পবিত্র কোরআনের কাহিনীগুলো অধ্যয়ন করে বিচার করুন যে,এ কথা বলা কি সম্ভব,পবিত্র কোরআন যা এত বড় সম্মানের অধিকারী সে গ্রন্থটি নবী-রাসূলদের সাথে সংশ্লিষ্ট কাহিনীগুলো তাওরাত থেকে ধার করেছে? যদি তাওরাত থেকেই নিয়ে থাকে তাহলে তাওরাতের উপরিউক্ত কুসংস্কারগুলোর লেশমাত্রও কেন পবিত্র কোরআনের মধ্যে নেই?

ইঞ্জিলের প্রতি দৃষ্টিপাত

আমরা এখানে ইঞ্জিল থেকে তিনটি বিষয় বর্ণনা করব যার ফলে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হবে যে,মুসলমানদের পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থ কোরআনের উৎস কি এ ইঞ্জিল না অন্য কোথাও?

হযরত ঈসা মসীহ্ (আ.)-এর মুজিযা

হযরত ঈসা (আ.) মা এবং শিষ্যদের সাথে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন। ইত্যবসরে মদ শেষ হয়ে গেলে তিনি সাত মশক পানি অলৌকিকভাবে মদে রূপান্তরিত করে দিলেন।১৫৮ ঈসা (আ.) একটি পেয়ালা নিয়ে তাদের হাতে দিয়ে বললেন, পান কর। কারণ এটি হচ্ছে আমার রক্ত। ১৫৯

কিন্তু সম্মানিত পাঠকবর্গ! আপনার ইতোমধ্যে জেনেছেন যে,মদ্যপান সংক্রান্ত পবিত্র কোরআনের যুক্তি এতৎসংক্রান্ত ইঞ্জিলের বক্তব্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, হে লোকসকল! মদ ও জুয়া যে কোন ধরনেরই হোক না কেন-তা অপবিত্র এবং শয়তানের কর্ম। তাই এগুলো থেকে দূরে থাক। তাহলে তোমরা সফলকাম হবে। ১৬০ তাই এমতাবস্থায় হযরত মুহাম্মদ (সা.) কি পবিত্র কোরআন বুসরার খ্রিষ্টান পাদ্রী বাহীরার কাছ থেকে গ্রহণ করেছিলেন?

বর্তমানে বিদ্যমান ইঞ্জিল হযরত ঈসাকে একজন দুর্ভাগা ব্যক্তি’হিসাবে পরিচিত করিয়ে দেয় যিনি ছিলেন তাঁর মায়ের প্রতি নির্দয়।১৬১ অথচ পবিত্র কোরআন ঈসা (আ.)-এর ব্যাপারে ইঞ্জিলের উপরিউক্ত বক্তব্যের ঠিক বিপরীতটিই উল্লেখ করেছে :

) وبّرا بوالدتي و لم يجعلني جبّارا شقيّا(

“...আমাকে আমার জন্মদাত্রী মায়ের প্রতি পুণ্য করার আদেশ দিয়েছেন এবং তিনি আমাকে দুর্ভাগা,অত্যাচারী ও অবাধ্য করেন নি।” (সূরা মরিয়ম : ৩২)

ন্যায়পরায়ণ এবং সকল গোঁড়ামি ও সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত ব্যক্তিগণ পবিত্র কোরআনের কাহিনী ও বিধি-বিধানসমূহ যদি তাওরাত ও ইঞ্জিলের সাথে তুলনা করেন তাহলে স্পষ্টভাবে অনুধাবন করবেন যে,তাওরাত ও ইঞ্জিল পবিত্র কোরআনের ক্ষুদ্রতম প্রামাণিক উৎস হওয়ারও যোগ্যতা রাখে না।১৬২

 

অষ্টম অধ্যায় : মহানবী (সা.)-এর যৌবনকাল

সমাজপতি ও নেতাদের অবশ্যই ধৈর্যশীল,শক্তিশালী,সাহসী,বীর এবং সুমহান উদার আত্মার অধিকারী হতে হবে।

ভীরু,কাপুরুষ,দুর্বল চিত্তের অধিকারী,ইচ্ছাহীন ও ঢিলাঢালা ব্যক্তিগণ কিভাবে সমাজকে আঁকা-বাঁকা পথ অতিক্রম করিয়ে (ইপ্সিত লক্ষ্যপানে) নিয়ে যেতে পারবে? তারা কিভাবে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবে? তারা কিভাবে তাদের নিজ অস্তিত্ব ও ব্যক্তিত্বকে অন্যদের বিকৃতি সাধন করা থেকে রক্ষা করবে?

নেতার হৃদয় ও আত্মার উদারতা ও মহত্ত্ব এবং তাঁর শারীরিক ও মানসিক শক্তি তাঁর অনুসারীদের ওপর আশ্চর্যজনক ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। যখন আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তিকে মিশরের প্রাদেশিক শাসনকর্তা হিসাবে নিযুক্ত করেন তখন তিনি মিশরের মজলুম জনগণের কাছে একটি চিঠি লিখেছিলেন। এখানে উল্লেখ্য যে,তদানীন্তন স্বৈরাচারী প্রশাসনের অত্যাচারে মিশরের জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। তিনি উক্ত চিঠিতে তাঁর নিযুক্ত প্রাদেশিক শাসনকর্তাকে আত্মিকভাবে সাহসী ও বীর বলে অভিহিত করেছিলেন। এখন আমরা উক্ত চিঠি থেকে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অংশ বর্ণনা করছি। হযরত আলী (আ.) এ চিঠিতে একজন দায়িত্বশীল নেতার প্রয়োজনীয় গুণাবলী বর্ণনা করেছেন :

أمّا بعد فقد بعثت إليكم عبدا من عباد الله لا ينام أيّام الخوف و لا ينكل عن الأعداء ساعات الرّوع. أشدّ على الفجّار من حريق النّار و هو مالك بن الحارث أخو مذحج فاسمعوا له و اطيعوا أمره فيما طابق الحقّ,فإنّه سيف من سيوف الله لا كليل الظّبة و لا نابى الضّريبة.

আমি তোমাদের কাছে মহান আল্লাহর একজন বান্দাকে প্রেরণ করেছি যে ভয়ের দিনগুলোতে ঘুমায় না এবং ভীতিপ্রদ মুহূর্তগুলোতে শত্রুদের থেকে বিরত থাকে না (পলায়ন করে না);অপরাধীদের প্রতি আগুনের দহন ক্ষমতার চেয়ে সে অধিকতর কঠোর। এ ব্যক্তিটি মাযহাজ গোত্রভুক্ত মালেক ইবনে হারেস (আল আশতার)। তোমরা তার কথা শুনবে এবং তার আদেশ পালন করবে যদি তা সত্য ও ন্যায়সংগত হয়;কারণ সে হচ্ছে মহান আল্লাহর তরবারি যার ধার কখনই নষ্ট হবে না এবং যার আঘাত কখনই ব্যর্থ হবে না। ১৬৩

মহানবীর আধ্যাত্মিক শক্তি

কুরাইশদের প্রিয়ভাজন ব্যক্তিটির (মুহাম্মদ) ললাটে শৈশব ও কৈশোর থেকেই শক্তি,সাহস ও দৃঢ়তার নিদর্শন স্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়েছিল। তিনি ১৫ বছর বয়সে হাওয়াযিন গোত্রের বিরুদ্ধে কুরাইশদের একটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন যা ফিজারের যুদ্ধ নামে খ্যাতি লাভ করেছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর দায়িত্ব ছিল চাচাদের কাছে তীর সরবরাহ করা। ইবনে হিশাম তাঁর সীরাত গ্রন্থে এ বাক্যটি মহানবীর নিকট থেকে উদ্ধৃত করে বলেছেন : মহানবী (সা.) বলেছেন,

كنت أنبّل على أعمامي

“আমি আমার চাচাদের কাছে তীর পৌঁছে দিতাম যাতে করে তাঁরা তা নিক্ষেপ করেন। ১৬৪

ঐ অতি অল্প বয়সে মহানবীর যুদ্ধে যোগদান আমাদেরকে তাঁর অসীম সাহসের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় এবং এ থেকে প্রমাণিত হয়ে যায় যে,কেন আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) মহানবীর ব্যাপারে বলেছেন,

كنّا إذا احمرّ البأس اتّقينا برسول الله (ص) فلم يكن أحد منّا أقرب إلى العدوّ منه

“যখনই যুদ্ধের বিভীষিকা তীব্র হয়ে যেত তখনই আমরা রাসূল (সা.)-এর কাছে আশ্রয় গ্রহণ করতাম। কারণ আমাদের মধ্য হতে কোন ব্যক্তি তাঁর চেয়ে শত্রুর অধিকতর নিকটবর্তী ছিল না। ১৬৫

আমরা ইনশাল্লাহ্ মুশরিকদের সাথে মুসলমানদের জিহাদ’সংক্রান্ত অধ্যায়ে ইসলামের সমরনীতির দিকে ইঙ্গিত করব। আর সেখানে আমরা মুসলমানদের যুদ্ধ ও সংগ্রাম করার পদ্ধতি নিয়েও আলোচনা করব। এ সব যুদ্ধ ও সামরিক অভিযান মহানবী (সা.)-এর নির্দেশেই বাস্তবায়িত হয়েছে। আর ঠিক এ বিষয়টিই ইসলামের ইতিহাসের অত্যন্ত আকর্ষণীয় আলোচ্য বিষয়াদির অন্তর্ভুক্ত।

আরেফগণের দৃষ্টিতে পূর্ণ মানুষের পথ পরিক্রমা

 আরেফগণ কেমন সুন্দর রূপে ইনসানে কামেলের পথ পরিক্রমাকে চিহ্নিত করেছেন! তারা বলেছেন,ইনসানে কামেলের পথ পরিক্রমায় চারটি সফর রয়েছে :

১. মানুষের নিজ থেকে খোদার দিকে যাত্রা।

২. আল্লাহর সঙ্গে আল্লাহর দিকে যাত্রা (আল্লাহর পরিচয় জানা)।

৩. আল্লাহর সঙ্গে তার সৃষ্টির যাত্রা (একা নয়)।

৪. আল্লাহর সঙ্গে তার সৃষ্টির মধ্যে সফর তার সৃষ্টিকে মুক্তিদানের জন্য।

এর চেয়ে সুন্দরভাবে বলা সম্ভব নয়। প্রথমত সফর হচ্ছে মানুষের আল্লাহর দিকে যাত্রা অর্থাৎ যতক্ষণ মানুষ স্রষ্টা থেকে বিচ্ছিন্ন ততক্ষণ সব কিছুই অর্থহীন। যখন সে খোদাকে জানবে ও চিনবে,তার নৈকট্য অনুভব করবে ও নিজের মধ্যে তাকে অনুভব করবে তখন খোদার সঙ্গে তার সৃষ্টির দিকে ফিরে আসবে এবং সে ব্যক্তিই স্রষ্টার সৃষ্টির মুক্তির জন্য সৃষ্টির মধ্যে ঘুরবে ও তাদেরকে স্রষ্টার নৈকট্যদানের জন্য চেষ্টা চালাবে।

যদি বলি মানুষের পথ পরিক্রমা সৃষ্টি থেকে খোদার দিকে,এখানেই থেমে গেলে মানুষকে চিনতে পারিনি। যদি বলি মানুষকে খোদার দিকে যাত্রা না করে বরং মানুষের দিকে যাত্রা করা উচিত (যেমন বিভিন্ন বস্তুবাদী মতবাদ বলে থাকে),তবে মানুষের মুক্তির জন্য কিছুই করতে পারবে না এবং একাজও নিছক ভাঁওতা হবে। তারাই মানুষকে মুক্তি দিতে পারেন যারা নিজেরা পূর্বে মুক্তি পেয়েছেন। তাহলে মানুষের মুক্তির অর্থ কি? কি থেকে মানুষের মুক্তি? পৃথিবীর বন্দিত্ব থেকে,না অন্যান্য মানুষের বন্ধন থেকে? যার অর্থ মানুষ থেকে মানুষের মুক্তি। এগুলো ঠিক,তবে এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানুষের আমিত্ব ও নাফ্সে আম্মারা এবং নিজের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি। যতক্ষণ মানুষ নিজের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি না পাবে ততক্ষণ পৃথিবীর বন্দিত্ব ও অন্যান্য মানুষের বন্দিত্ব থেকেও মুক্তিপাবে না।

বহিঃপ্রবণতা ও অন্তঃপ্রবণতার সহাবস্থানের প্রয়োজনীয়তা

আমরা এখনও আমাদের আলোচনার প্রথম পর্যায়ে রয়েছি। আজ রাত মোবারক মাস রমযানের একুশের রাত্রি,রমযানের শেষ দশ রাত্রির প্রথম রাত্রি। যখন রমযানের শেষ দশ দিন আসত তখন রাসূল (সা.) নির্দেশ দিতেন শোবার বিছানা গুটিয়ে ফেলতে এবং শওয়াল মাসে তা খুলতে। অর্থাৎ রাসূল এ শেষ দশ দিনের কোন রাত্রিতেই ঘুমাতেন না। এ রাতগুলো ইবাদত,দোয়া,মোনাজাত ও আল্লাহর সঙ্গে একাকী কাটানোর রাত।

যা হোক আমরা যে বিষয় নিয়ে পূর্ববর্তী বৈঠকে আলোচনা করেছি,বলেছি যে,কখনো কখনো কোন কোন মূল্যবোধ অন্যান্য মূল্যবোধকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। এক সময় ইসলামী সমাজ ইবাদতের মূল্যবোধের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল এবং বাড়াবাড়ি এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে,অন্যান্য মূল্যবোধ ধ্বংস করছিল। বর্তমানে আমি লক্ষ্য করছি অন্য আরেক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে; কেউ কেউ ইসলামের সামাজিক মূল্যবোধের দিকে দেখেন,কিন্তু এর খোদায়ী দিককে ভুলে যান। তারা আরেকটি ভুল ও বিচ্যুতির মধ্যে পড়েছেন- এক আরবের গাধায় চড়ার মতো যে গাধায় উঠার জন্য এমন জোরে লাফদিল ফলে অন্য পার্শ্বে গিয়ে পড়ল। ফলে প্রথম প্রচেষ্টায় সে গাধায় উঠতে পারল না। দ্বিতীয় বারও সেতা-ই করল। তখন নিজেই বলল,ك الاوّل অর্থাৎ প্রথম বারের মতোই।

যদি এমন অবস্থা হয় যে,ইসলামের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা থেকে বের হয়ে যাব,তবে সমাজবিমুখ ইবাদতকারী আর ইবাদতবিমুখ সমাজমুখিতার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।

দেখুন,মহান আল্লাহ্ সূরা ফাতহের শেষ রুকুতে কি বলছেন (এমন নমুনা কোরআনে আরও রয়েছে),

( مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ)

রাসূলল্লাহর প্রশিক্ষিত সাহাবীরা কিরূপ? মুসলমানদের প্রকৃত শত্রু অর্থাৎ কাফেরদের মোকাবিলায় কঠিন,কঠোর,দৃঢ় ও মজবুত যেমন সীশা ঢালা প্রাচীর।

) إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِهِ صَفًّا كَأَنَّهُمْ بُنْيَانٌ مَرْصُوصٌ (

(সূরা ছফ : ৪)

কিন্তু এরা দু রূপের অধিকারী- ইসলামের প্রকৃত শত্রুদের মোকাবিলায় তারা কঠোর ও মজবুত,কিন্তু নিজেদের মধ্যে স্নেহশীল,দয়ালু,ঐক্যবদ্ধ,ভালবাসায় সম্পর্কিত। কোরআনের ভাষায় এটা ইসলামী সমাজের বৈশিষ্ট্য (আমরা কয়েক শতাব্দী হলো সেটাকে ভুলতে বসেছি)। কোরআন সূরা ফাতহের শেষ আয়াতে বলছে-

) تَرَاهُمْ رُكَّعًا سُجَّدًا يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِنَ اللَّهِ وَرِضْوَانًا سِيمَاهُمْ فِي وُجُوهِهِمْ مِنْ أَثَرِ السُّجُودِ (

সাথে সাথেই খোদায়ী মূল্যবোধের কথা বলছে। ঐ ব্যক্তিটি যে সমাজমুখী সে ব্যক্তিটিই খোদার মোকাবিলায় নত,সেজদাবনত,নিজের মনের কথা ও বেদনা খোদার নিকট ব্যক্ত করে। তার নিকট থেকে এর থেকে উত্তরণের জন্য সাহায্য চায় যেন নিজের উন্নয়ন ঘটাতে পারে। যা তার আছে তাতে সে সন্তুষ্ট নয়,বরং প্রতি মুহূর্তে নিজের অবস্থার উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষী। তার সকল ইবাদতের লক্ষ্য স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্থাৎ ইবাদতের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থায় সে আল্লাহর ইবাদত করে এবং তাদের চেহারায় ইবাদতের চিহ্ন লক্ষণীয়।

) ذَلِكَ مَثَلُهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَمَثَلُهُمْ فِي الْإِنْجِيلِ كَزَرْعٍ أَخْرَجَ شَطْأَهُ(

অতঃপর ইসলামী সমাজকে বর্ণনা করছে এটা কেমন? বলছে,এটা এমন এক সমাজ যাকে তুলনা করা যায় একটি বৃক্ষের সঙ্গে; প্রাথমিক অবস্থায় তা দুর্বল ও ক্ষুদ্র থাকলেও পরবর্তীতে বৃদ্ধি পেয়ে ফুলে-ফলে পূর্ণতা লাভ করে,কৃষকের চোখে আনন্দের জোয়ার আনে।

দেখুন,কোরআন অন্য একটি স্থানে এ দু প্রবণতার (বহির্মুখী ও অন্তর্মুখী) সহাবস্থানের কথা কিভাবে বলছে,

) التَّائِبُونَ الْعَابِدُونَ الْحَامِدُونَ السَّائِحُونَ الرَّاكِعُونَ السَّاجِدُونَ(

খোদায়ী দিকগুলো,যেমন পরিশুদ্ধতা অবলম্বনকারী,ইবাদতকারী,খোদার প্রশংসাকারী,রোযা পালনকারী,রুকুকারী,সেজদাকারী বলার সাথে সাথে আবার উল্লেখ করছে,

) الْآمِرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَالنَّاهُونَ عَنِ الْمُنْكَرِ(

তারাই সমাজের সংস্কারকারী,সমাজে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধকারী।

অন্য আয়াতে বলছে,

) الصَّابِرِينَ وَالصَّادِقِينَ وَالْقَانِتِينَ وَالْمُنْفِقِينَ(

ধৈর্যধারণকারীরা (দৃঢ়তা অবলম্বনকারী বিশেষ করে যুদ্ধের মযদানে),সত্যবাদীরা,দানকারীরা,সত্যপন্থীরা।এর পরপরই বলছে,( وَالْمُسْتَغْفِرِينَ بِالْأَسْحَارِ ) অর্থাৎ শেষ রাত্রিতে ক্ষমা প্রার্থনাকারীরা। অর্থাৎ ইসলামে এ বৈশিষ্ট্যগুলো একটি আরেকটি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। কেউ যদি এগুলোর যে কোন একটিকে ছোট করে দেখে তবে অন্যগুলোকেও ছোট করে দেখছে।

ইমাম মাহদী (আ.)-এর সঙ্গী-সাথীদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে (যা শুধু একটি নয় অনেক হাদীসেই আমি দেখেছি) বলছে,رهبان بالیل لیوث بالنّهار রাত্রিতে তারা দুনিয়াত্যাগী উপাসক অর্থাৎ রাত্রি যখন আসে তখন তাদেরকে দেখলে মনে হয় একদল খোদা উপাসক আবার যখন দিনে তাদেরকে দেখবে তখন তারা যেন একদল সিংহ।

ইসলামের ইতিহাসের নমুনা

রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সাহাবীরা কিরূপ অবস্থায় ছিলেন সে ব্যাপারে আল কাফীর একটি প্রসিদ্ধ হাদীস (মাওলানা রূমী তা কবিতায় বর্ণনা করেছেন) যা শিয়া-সুন্নী হাদীস বর্ণনাকারীরা সবাই বর্ণনা করেছেন,খুবই শিক্ষণীয়।

একদিন রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ফজরের নামাজের পর আসহাবে ছোফফার নিকট গেলেন। রাসূলুল্লাহ্ প্রায়ই তাদের দেখতে যেতেন। সে দিন হঠাৎ এক যুবকের উপর রাসূলের চোখ আটকে গেল। তিনি দেখলেন এ যুবকের মধ্যে অন্য রকম অবস্থা বিরাজ করছে- পা দু টি টলায়মান,চোখ দু টি কোটরের মধ্যে ঢুকে গেছে। তার রং ও স্বাভাবিক নেই।

তার কাছে গিয়ে রাসূলুল্লাহ্ জিজ্ঞেস করলেন,کیف أصبحت কিরূপে রাত কাটিয়েছ? সে জবাব দিল,أصبحت موقنا یا رسول الله হে রাসূলুল্লাহ্! এমনভাবে সকালে প্রবেশ করেছি যে,ইয়াকীনের অধিকারী হয়েছি। যা আপনি মুখে বলেছেন ও আমি কান দিয়ে শুনেছি তা এখন চোখ দিয়ে দেখতে পাই। রাসূল চাইলেন সে আরো কিছু বলুক। তিনি বললেন, সব কিছুরই আলামত (চিহ্ন) থাকে। তোমার ইয়াকীনের আলামত কি?

সে বলল,إنّ یقینی یا رسول اله  هو الذی أحزننی و أسهر لیلی و أظمأ هوا جری আমার ইয়াকীনের আলামত হলো দিনগুলো আমাকে তৃষ্ণার্ত করে রাখে আর রাতগুলো আমাকে জাগ্রত করে রাখে (অর্থাৎ দিনে রোযা আর রাত্রিতে ইবাদত আমার ইয়াকীনের আলামত। আমার ইয়াকীন আমাকে রাত্রে বিছানায় শুতে দেয় না,আর দিনগুলোতে খাদ্যগ্রহণ থেকে বিরত রাখে।) রাসূল বললেন, এটা যথেষ্ট নয়,আরো কোন আলামত আছে কি? সে বলল, হে রাসূলুল্লাহ্! যদিও এখন এ পৃথিবীতে আছি কিন্তু ঐ দুনিয়াকে (অর্থাৎ আখেরাত) দেখতে পাই,সেখানকার শব্দ শুনতে পাই। বেহেশত থেকে বেহেশতবাসীদের কণ্ঠ আর জাহান্নাম থেকে দোযখবাসীদের চীৎকার শুনতে পাই। ইয়া রাসূলাল্লাহ্! যদি অনুমতি দেন,তবে আপনার সাহাবীদের একে একে পরিচয় বলে দিই,কে বেহেশতী,আর কেজাহান্নামী। রাসূল বললেন, নীরব হও। আর কোন কথা বল না। মাওলানা রূমী বলছেন,

বললেন রাসূল সাহাবী যায়েদকে কিভাবে রাত কাটিয়েছো বন্ধু হে!

ইয়াকীনের অধিকারী হয়ে বলল সে।

পুনঃ শুধায় চিহ্ন সে বাগানের দেখাও আমায়।

বলে তৃষ্ণার্ত আমি এই দিনগুলোতে হায়,

না ঘুমিয়ে কাটাই কষ্ট আর ভালবাসায়।

বললেন বল যা অর্জন করেছো তায়,

তা থেকে যেন বুঝতে পারে এরা সবাই।

বলল দু সৃষ্টি যখন দেখে এ আকাশ,

আমি দেখি তার অধিবাসীদের যেথায় বাস।

বলব কি কিছু কথা রয়েছে খাছ

ঠোঁট কামড়ে বলেন রাসূল,হয়েছে ব্যাস।

অতঃপর রাসূল তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার ইচ্ছা কি? কি করতে চাও? সে বলল, ইয়ারাসূলাল্লাহ্! আল্লাহর পথে শাহাদাত বরণ করতে চাই।

তার ইবাদত আর ইচ্ছা হলো এ রকম,তার রাত্রি হলো ইবাদত,আর দিন জিহাদ আর শাহাদাতের জন্য। এটাই ইসলামের কথিত মুমিন,ইসলামের মানুষ। দু টি ভিন্নমুখী কষ্ট,কিন্তু দ্বিতীয় কষ্টটি তার প্রথম কষ্ট থেকে উৎসারিত। আর সেটা হলো স্রষ্টাকে পাওয়ার বেদনা।

আমার বক্তব্যের শুরুতে যে আয়াতটি তেলাওয়াত করেছি তা হলো :

) وَاسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى الْخَاشِعِينَ(

কোরআনের বর্ণনা সত্যিই আশ্চর্যজনক। বলছে, হে ঈমানদারগণ! নামাজ ও ধৈর্যের মাধ্যমে সাহায্য চাও। তাফসীরকারগণ বলছেন,ধৈর্যের অর্থ রোযা,যেহেতু রোযা এক ধরনের সবর। তাই নামায ও রোযা থেকে সাহায্য নাও। নামায থেকে কি ধরনের সাহায্য পাওযা যায়? আল্লাহর ইবাদত ও উপাসনার মাধ্যমে কি শক্তি পাওয়া যায়? উত্তর আল্লাহর ইবাদত নিজেই একটি শক্তি। প্রকৃত পক্ষে যেকোন প্রেরণাই এখান থেকে পাওযা যায়। যদি আপনি চান সমাজে প্রকৃত মুসলমান হিসেবে থাকবেন,যদি চান একজন সংগ্রামী হতে,তবে অবশ্যই আপানাকে প্রকৃত নামাযী হতে হবে।

অনেকে বলেন,নামায পড়ার কি আছে? ইবাদতের প্রয়োজন কি? এগুলো বৃদ্ধ-বৃদ্ধার কাজ। যুবকদের অবশ্যই সামাজিক হতে হবে। এগুলো এক ধরনের বুদ্ধিজীবীদের কথা যার নজীর ইতিহাসে পুরাতন। হয়তো জানেন,হযরত উমর (হাইয়া আলা খাইরিল আমাল) বাক্যটিকে আযান থেকে প্রত্যাহার করেন। কেন? তার নিজের যুক্তিতে মনে হয়েছে এটা করা দরকার। যেহেতু তার শাসনকাল ইসলামের বিজয় ও সংগ্রামের সময় এবং মুসলমানদের দলে দলে যুদ্ধে যোগদান করতে হচ্ছে,অল্প সৈনিক নিয়ে অধিক সংখ্যক সৈন্যের মোকাবিলায় জয়ী হতে হবে (কখনো সমগ্র যোদ্ধা মুসলমানের সংখ্যা পঞ্চাশ বা ষাট হাজার আর তা নিয়ে রোম বা পারস্য সাম্রাজ্যের লক্ষসৈনিকের মোকাবিলায় দাঁড়াতে হয়েছে),তাই মুজাহিদদের নিকট যুদ্ধের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। যখন মুয়াজ্জিন আযানের সময় চীৎকার করে আল্লাহু আকবার ও দু শাহাদাতের পর(হাইয়া আলাস সালাহ্-নামাযের দিকে এসো) এবং (হাইয়া আলাল ফালাহ-কল্যাণেরদিকে এসো) বলে,তার মধ্যে কোন সমস্যা নেই কিন্তু হাইয়া আলা খাইরিল আমাল (সর্বশ্রেষ্ঠ আমলের দিকে এসো) যার অর্থ সর্বশ্রেষ্ঠ আমল হলো নামায,এটা বলা হবে তখন মুজাহিদদের মনদুর্বল হয়ে যাবে। কেননা তাদের নিজেদের কাছে মনে হবে নামায যেহেতু সর্বশ্রেষ্ঠ আমল আমরা যুদ্ধের ময়দানে বা জিহাদে যাওয়ার চেয়ে মদীনার মসজিদে বসে নামায পড়ি,কি প্রয়োজন অন্যদের হত্যা করে,নিজেদের নিহত হতে দিয়ে,আহত হয়ে,কারো চোখ অন্ধ হবে,কারো হাত বা পা কাটা যাবে,অভুক্ত থাকার কষ্ট করতে হবে,বরং আমরা এখানে স্ত্রী-পুত্র-পরিজনের পাশে বসে চার রাকাত নামায পড়ে তাদের চেয়ে উত্তম হতে পারি। তাই আযান থেকে এ অংশটি বাদ দিতে হবে। তার চেয়ে বরং বলব (আস সালাতু খাইরুম মিনান নাওম-নামায ঘুম থেকে উত্তম)। যখন ঘুমাব তখন মনে করতে হবে ঘুমানোর চেয়ে মসজিদে গিয়ে নামায পড়ি।

কিন্তু এ রহস্য আমাদের জানতে হবে কোন্ শক্তির বলে মুসলমানরা (যাদের সংখ্যা এক লক্ষেরও কম) তাদের থেকে কয়েকগুণ শক্তিশালী (সংখ্যায় কয়েক লক্ষ) প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হয়। এ জয় কিরূপে সম্ভব অনেকেই চিন্তা করে দেখেনি। এ জয় তো অস্ত্রের বলে নয়। যদি তাই হতো তবে আরবদের অস্ত্র কি রোমানদের বা পারসিকদের চেয়ে অধিক ধারালো ছিল? অবশ্যই নয়। বরং রোমান ও পারসিকরা সমসাময়িক যুগের শ্রেষ্ঠ অস্ত্রের অধিকারী ছিল। অপর পক্ষে আরবদের অস্ত্র সেরকম ছিল না। জাতি হিসেবেও আরবরা কি রোম ও ইরানের মোকাবিলায় শক্তিশালী ছিল? অবশ্যই নয়। শাপুর জুল আকতাফ ইসলাম-পূর্ব যুগে আরবদের পদদলিত করেছিল। শত-সহস্র আরবকে বন্দিকরে নিয়ে গিয়েছিল। তাদের কপালে কালিমা লেপন করে দিয়েছিল। তখন আরবদের শক্তি কোথায়ছিল? কিন্তু মাত্র একশ বছর পর সেই আরবরাই ইরানকে পরাজিত করেছিল। তাহলে কোন্ শক্তির বলে আরবরা ইরান ও রোমের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ের মালা পড়েছিল আর তাদের মুখে পরাজয়ের চিহ্ন এঁকে দিয়েছিল? এ শক্তি ঈমানের শক্তি ছিল। যে শক্তি সেحی علی خیر العمل থেকে লাভ করেছে। তার নামায থেকে সে এ শক্তি অর্জন করেছে স্রষ্টার কাছে একান্ত প্রার্থনার মাধ্যমে। কোরআনে বর্ণিত মানুষ রাত্রিতে তার স্রষ্টার সম্মুখে দাঁড়িয়ে মনের গোপন আকাঙ্ক্ষাপেশ করে,তার নিকট এ শক্তি চায়। সেই মহান প্রভু থেকেই সে এ আত্মিক শক্তি লাভ করেছে অর্থাৎ আরবরা যখন স্রষ্টার নিকট থেকে এ আত্মিক শক্তি অর্জন করেছে তখন এর বলেই সে ইরান ও রোমকে পরাজিত করেছে। এ আত্মিক শক্তি সে কিভাবে পেয়েছে? তার ঈমান থেকে পেয়েছে। নামায কি? নামায হলো ঈমানের ঝালাই। নামাযের আল্লাহু আকবার থেকেই সে এ শক্তি অর্জন করেছে। যখন সে নামাযে কয়েকবার বলে, আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ ,তখনই অনুভব করে বাকী সকল কিছুই তুচ্ছ। যখন যুদ্ধের ময়দানে কয়েকলক্ষ যোদ্ধাকে তাদের মোকাবিলায় দেখে তখন বলে, লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিলআলিয়্যিল আজিম। সকল ক্ষমতা আল্লাহর হাতে। মানুষের অবশ্যই তার উপর নির্ভর করা উচিত। তার থেকে শক্তি ও সাহায্য চাওয়া উচিত। নামাযই তাকে এ শক্তি ও সাহস দান করেছে। যদি এ নামায না থাকতো তবে এ ধরনের মুজাহিদ (জিহাদকারী) যোদ্ধা তৈরি হতো না।

ইসলাম কি এটা বলে না যে,ইসলামের বিধি-বিধান একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যার উপর জিহাদ ফরয করা হয়েছে তার নামাযের জন্য মদীনার মসজিদে পড়ে থাকা হারাম। তাকে অবশ্যই জিহাদের জন্য যেতে হবে। তার নামায কবুল হওয়ার শর্ত হলো জিহাদ। আবার জিহাদ কবুল হওয়ার শর্তও নামায। কোন মুজাহিদের জন্য শর্তাবলী উপস্থিত হলে তার জন্য জিহাদ ফরয। কিন্তু তাকে বলতে হবে,ইসলাম বলে নামায ব্যতীত জিহাদ বাতিল ও মূল্যহীন,তেমনি জিহাদ ব্যতীত নামাযও বাতিল। তখন এটা খাইরুল আমাল বা সর্বোত্তম ইবাদত না হয়ে শাররুল আমাল বা নিকৃষ্ট ইবাদতে পরিণত হবে। নামায মুসলমানকে ইসলাম কি তা শেখায়। যে নামায মুসলমানকে জিহাদ থেকে পালানোর জন্য মসজিদে বসে থাকার কথা বলে সেটা ইসলামের নামায নয়। ইসলামের নামায সর্বোত্তম কর্ম (খাইরুল আমাল)। তাই এটা ঠিক নয় যে,حی علی خیر العمل -কে আযান থেকে এ যুক্তিতে বাদ দেয়া হবে যে,এর খারাপ প্রভাব রয়েছে,যেহেতু মুসলমানরা জিহাদ বাদ দিয়ে নামায পড়তে যাবে। এটা ভুল। এটাই ইসলামের যুক্তি। বর্তমানের পরিভাষায় যদি বলি,ইসলামী মূল্যবোধের দৃষ্টিতে সকল মূল্যবোধের মূল্য ইবাদতে নিহিত,তবে বলতে হবে সে ইবাদত হলো শর্তযুক্ত ইবাদত। কোরআন আমাদের বলছে নামায তখনই নামায হবে যখন তার প্রভাব স্বতঃপ্রকাশিত। কিরূপে তা প্রকাশিত হবে? নিশ্চয়ই নামায মন্দ ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে। প্রকৃত নামায এটাই যা মানুষকে মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। যদি দেখ নামায পড়ছ সে সাথে অন্যায় কাজও করছ,তবে জেনে রাখ,তোমার নামায নামায নয়। সুতরাং তোমার নামাযকে ঠিক কর। নামায তোমাকে সকল মূল্যবোধ দান করবে এ শর্তে যে,তোমার নামায প্রকৃতই নামায হয়।

এ সকল শিক্ষা হযরত আলী (আ.)-এর নিকট থেকে শিক্ষণীয়। আলী (আ.) ইসলামের সকল মূল্যবোধের সমষ্টি। নাহজুল বালাগাহ্ তার বাণী। যা এমন এক গ্রন্থ মানুষ এর যেখানেই লক্ষ্য করে যেন নতুন এক যুক্তি খুজে পায়,খুজে পায় নতুন এক মানুষকে- এর প্রতিটি অধ্যায়ে যেন নতুন নতুন মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে। প্রতিটি স্থানেই আলী (আ.) সামগ্রিক মূল্যবোধের প্রতিভূ এক ব্যক্তিত্ব। কোথাও তার যুক্তি বীরোচিত যেন এক নবযুবক যে সামরিক প্রশিক্ষণ শেষ করে সমর নেতা হয়েছে;যে সমরবিদ্যা ছাড়া কিছুই বোঝে না। কোথাও সে আলীকেই মনে হবে এক আরেফ ও সূফী যে স্রষ্টার সঙ্গে গভীর প্রেমে লিপ্ত,অন্য কিছুর প্রতি তার খেয়াল নেই।

আলী (আ.)-এর পৌরুষত্ব ও সাহসিকতা

আজ একুশে রমযানের রাত হযরত আলী (আ)-এর শাহাদাতের রজনী। যাতে ইসলামের বৈশিষ্ট্যের সাথে পুরোপুরি পরিচিত হতে পারি এজন্য নাহজুল বালাগায় দ্বৈত বৈশিষ্ট্যের আলীর পরিচয় রয়েছে এমন দু টি অংশ থেকে আলাচনা রাখছি। সিফফিনের যুদ্ধে আলী (আ.)-এর সৈন্যরা ফোরাত কিনারায় পৌছার পূর্বেই মুয়াবিয়ার সৈন্যবাহিনী সেখানে পৌছায়। মুয়াবিয়া নির্দেশ দেয় পানির পথগুলো আলী ও তার সৈন্যদের জন্য বন্ধ করে রাখতে। আলীর সৈন্যদের পরাস্ত করার খুব ভালো এক কৌশল হস্তগত করেছে এটা ভেবে মুয়াবিয়ার সৈন্যবাহিনী মনে মনে খুব আনন্দিত হলো। হযরত আলী যখন সেখানে পৌছে এ অবস্থা দেখলেন তখন বললেন,পরস্পর আলোচনা করে বিষয়টি ফয়সালা করবেন যাতে করে এ বিষয়টি নিয়ে দু পক্ষের মুসলমানদের মধ্যে রক্তক্ষয় না হয়। তাই মুয়াবিয়াকে লক্ষ্য করে বললেন, আমরা এখনও এসে পৌছাইনি,তুমি এ ধরনের কাজ করলে! (পানি পথ ছেড়ে দাও যাতে এ পক্ষও পানি পায়)। মুয়াবিয়া পরামর্শ সভা ডেকে নিজের সেনাপ্রধানদের কাছে পরামর্শ চাইল। কেউ বলল পানির পথ ছেড়ে দেয়াই উত্তম,কেউ বলল,না। আমর ইবনে আস বলল, ছেড়ে দাও। কারণ যদি তুমি না ছাড় তবে বল প্রয়োগে তোমার নিকট থেকে সে নিয়ে নেবে। তখন তোমার সম্মান ভূলুন্ঠিত হবে। কিন্তু মুয়াবিয়া সিদ্ধান্ত নিল পানি পথ ছাড়া হবে না। তখন হযরত আলী (আ.) তার সৈন্যদের উদ্দেশ্যে এক বিপ্লবী ভাষণ দিলেন যার প্রভাব শত রণতুর্য আর দামামা থেকেও অনেক বেশি। তিনি বললেন, তারা যুদ্ধ চায়,এখন তোমরা ভেবেদেখ অপমান ও অমর্যাদাকে গ্রহণ করে সাহস ও সম্মান হারাবে,নাকি তোমাদের তরবারীকে তাদের রক্তে পূর্ণ করে নিজেরা পানির তৃষ্ণা মেটাবে। (নাহজুল বালাগাহ্,খুতবা নং ৫১)

মুয়াবিয়া তোমাদের জন্য পানি বন্ধ করেছে। আমার সহযোগীরা! তোমরা তৃষ্ণার্ত। পানি চাও। আমার কাছে এসেছ,পানি চাও। যদি পানি চাও তবে কি করা উচিত? তোমাদের তরবারীগুলোকে প্রথমে এই শত্রুদের দূষিত রক্ত দ্বারা পূর্ণ কর। তারপর নিজেরা তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারবে। এর পর এমন এক বাক্য উচ্চারণ করলেন যা সবার মধ্যে উত্তেজনা ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করল। জীবন ও মৃত্যুকে যুদ্ধ ও বিপ্লবের ভাষায় সংজ্ঞায়িত করলেন। হে জনগণ! জীবন কি? বেঁচে থাকার অর্থ কি? মৃত্যু কি? বেঁচে থাকার অর্থ কি পৃথিবীর উপর বিচরণ,খাদ্য গ্রহণ আর বিশ্রাম? মৃত্যুর অর্থ কি কবরে শয়ন? না,ঐ জীবনকেও জীবন বলা যায় না,ঐ মৃত্যুকেও মৃত্যু বলা যায় না।

فالموت فی حیاتکم مقهورین و الحیات فی موتکم فاهرون

  জীবন হচ্ছে মৃত্যুবরণের মাধ্যমে জয়ী হওয়া। আর মৃত্যু হলো বেঁচে থাকা,কিন্তু অপরের অধীনে থাকা।

এ বাক্যটি কতটা বিপ্লবী ও উঁচু পর্যায়ের! এরপর কি শক্তির মাধ্যমে আলী (আ.)-এর সৈনিকদের প্রতিরোধ করা সম্ভব? কিছুক্ষণের মধ্যেই আলীর সেনাবাহিনী হামলার মাধ্যমে মুয়াবিয়ার সেনাবাহিনীকে নদীকূল থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে বিতাড়িত করল। আলীর সহযোগীরা নদীকূলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করল। এবার মুয়াবিয়ার সেনাবাহিনী পানির জন্য আবেদন করল। আলীর সৈন্যরা বলল, অসম্ভব। আমরা পানি দিতে রাজী নই। আমরা প্রথমে এ ধরনের কাজ করিনি,বরং তোমরাই এ পথ বেছে নিয়েছিলে। হযরত আলী এ কথা শুনে বললেন, না,আমি পানি বন্ধ করতে রাজী নই। কারণ এ কাজ কাপুরুষোচিত। যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর সাথে মোকাবিলা ভিন্ন কথা। কিন্তু এপথে জয়লাভ করা কোন সম্মানিত মুসলমানের জন্য ঠিক নয়। এটাকেই বলে পৌরুষত্ব। পৌরুষত্ব সাহসিকতার থেকেও উচ্চ পর্যায়ের। হযরত আলীকে উদ্দেশ্য করে মাওলানা রুমী কত সুন্দর বলেছেন (হযরত আলীর শানে ও প্রশংসায় রচিত তার শ্রেষ্ঠ কবিতা)!

সাহসিকতায় তুমি শেরে খোদা জানি

পৌরুষত্বে কি তুমি,জানেন শুধু অন্তর্যামী।

অর্থাৎ সাহসিকতায় তিনি শেরে খোদা সকলে জানলেও পৌরুষত্বে কেউই আলীকে চিনতে পারেনি। এখানে আমরা হযরত আলীকে তার এক বিশেষ রূপে দেখতে পাই।

হযরত আলী (আ.)-এর মোনাজাত

যখন আলী (আ.) মানুষ থেকে দূরে- একান্তে স্রষ্টার সাথে ইবাদত ও গোপন সংলাপে লিপ্ত তখন দেখি অন্য এক আলী। যেমন নাহজুল বালাগায় পাই

اللهم انّک آنس الآنسین لاولیائک

হে আল্লাহ্! আপনি আপনার আউলিয়াদের নিকটতম বন্ধুর থেকেও নিকটে অবস্থান করছেন। অর্থাৎ কোন বন্ধুর সঙ্গেই আপনার মতো নৈকট্য অনুভব করি না। আপনি আমার নিকটতম সাথী। আপনি ব্যতীত যার সঙ্গেই থাকি যেন একাকিত্ব অনুভব করি। শুধু যখন আপনার সঙ্গে থাকি তখনই অনুভব করি নিকটতম কারো সঙ্গে আছি।

و احضرهم بالکفایة للمتوکلین علیک

যে কেউ আপনার প্রতি নির্ভর করে,অনুভব করে অন্য সকল কিছুর থেকে আপনি তার নিকটতর উপস্থিত অস্তিত্ব যেন আপনি আপনার উপর নির্ভরকারী ব্যক্তির নিকট উপস্থিত হন।

تشاهدهم فی سرائرهم و تطلع علیهم فی ضمائرهم و تعلم مبلغ بصائرهم

হে প্রভূ! আপনি আপনার বন্ধু ও প্রেমিকদের হৃদয়ের অন্তস্তলের রহস্যও পর্যবেক্ষণ করেন এবং তাদের অন্তঃকরণের অপ্রকাশ্য বিষয় সম্পর্কেও অবহিত। তাদের জ্ঞান ও অন্তদৃষ্টি কোন্ পর্যায়ে অবস্থান করছে তাও আপনার জানা।

فاسرارهم لک مکشوفه و قلوبهم إلیک ملهوفة

তাদের রহস্য আপনার নিকট প্রকাশিত ও তাদের অন্তর আপনার প্রতি উড্ডয়নশীল।

আলী (আ.)-এর দোয়াগুলোর মধ্যে দোয়ায়ে কুমাইল জুমআর রাতগুলোতে পড়বেন। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এ দোয়াটি পড়ুন। দেখবেন,না এর মধ্যে দুনিয়া আছে,না আখেরাত (আখেরাত বলতে বেহেশত ও দোযখ)। যা দেখবেন তা দুনিয়া ও আখেরাতের ঊর্ধ্বে। স্রষ্টার সাথে একজন খাঁটি বান্দা,উপাসক ও প্রেমিকের সম্পর্ক এটাই যে,তার প্রেমে নিমগ্ন থাকবে। প্রকৃত ইবাদত এটাই। আলী নিজেই তা বলছেন। দোয়ায়ে কুমাইলে আলী (আ.) নিজের স্রষ্টার সাথে কিরূপে কথোপকথন করছেন লক্ষ্য করুন,কিভাবে মোনাজাত করছেন দেখুন,তেমনিভাবে ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) রমযানমাসের সুবহে সাদিকের পূর্বে সেহরীর সময় কিভাবে আল্লাহর নিকট আবেদন-নিবেদন করছেন তা আবু হামযা সোমালীর দোয়ায় লক্ষ্য করুন। মুসলমানের প্রথম ধাপ এটাই যে,সে তার স্রষ্টার নিকটবর্তী হবে। স্রষ্টার নৈকট্যের মাধ্যমেই অন্যান্য দায়িত্ব,বিশেষ করে সামাজিক দায়িত্বসমূহ সুন্দরভাবে আঞ্জাম দিতে পারব।

আমাদের চেষ্টা করতে হবে যাতে আমাদের প্রবণতাগুলো এককেন্দ্রিক না হয়ে পড়ে- যে সমস্যায় বর্তমানে মুসলিম উম্মাহ্ আক্রান্ত। আমাদের এ এককেন্দ্রিকতা পরিহার করে সামগ্রিকতা অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। ইবাদতের গুরুত্বকে কম করে দেখলে চলবে না। ইমাম সাদিক (আ.) তার মৃত্যুলগ্নে তার সকল নিকটাত্মীয়কে ডেকে সমবেত করে একটি মাত্র বাক্য উচ্চারণ করে বিদায় নেন। তিনি বলেন, যারা নামাযকে ছোট করে দেখে (কম গুরুত্ব দেয়),আমার শাফায়াত তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়।

আরেফগণের দৃষ্টিতে পূর্ণ মানুষের পথ পরিক্রমা

 আরেফগণ কেমন সুন্দর রূপে ইনসানে কামেলের পথ পরিক্রমাকে চিহ্নিত করেছেন! তারা বলেছেন,ইনসানে কামেলের পথ পরিক্রমায় চারটি সফর রয়েছে :

১. মানুষের নিজ থেকে খোদার দিকে যাত্রা।

২. আল্লাহর সঙ্গে আল্লাহর দিকে যাত্রা (আল্লাহর পরিচয় জানা)।

৩. আল্লাহর সঙ্গে তার সৃষ্টির যাত্রা (একা নয়)।

৪. আল্লাহর সঙ্গে তার সৃষ্টির মধ্যে সফর তার সৃষ্টিকে মুক্তিদানের জন্য।

এর চেয়ে সুন্দরভাবে বলা সম্ভব নয়। প্রথমত সফর হচ্ছে মানুষের আল্লাহর দিকে যাত্রা অর্থাৎ যতক্ষণ মানুষ স্রষ্টা থেকে বিচ্ছিন্ন ততক্ষণ সব কিছুই অর্থহীন। যখন সে খোদাকে জানবে ও চিনবে,তার নৈকট্য অনুভব করবে ও নিজের মধ্যে তাকে অনুভব করবে তখন খোদার সঙ্গে তার সৃষ্টির দিকে ফিরে আসবে এবং সে ব্যক্তিই স্রষ্টার সৃষ্টির মুক্তির জন্য সৃষ্টির মধ্যে ঘুরবে ও তাদেরকে স্রষ্টার নৈকট্যদানের জন্য চেষ্টা চালাবে।

যদি বলি মানুষের পথ পরিক্রমা সৃষ্টি থেকে খোদার দিকে,এখানেই থেমে গেলে মানুষকে চিনতে পারিনি। যদি বলি মানুষকে খোদার দিকে যাত্রা না করে বরং মানুষের দিকে যাত্রা করা উচিত (যেমন বিভিন্ন বস্তুবাদী মতবাদ বলে থাকে),তবে মানুষের মুক্তির জন্য কিছুই করতে পারবে না এবং একাজও নিছক ভাঁওতা হবে। তারাই মানুষকে মুক্তি দিতে পারেন যারা নিজেরা পূর্বে মুক্তি পেয়েছেন। তাহলে মানুষের মুক্তির অর্থ কি? কি থেকে মানুষের মুক্তি? পৃথিবীর বন্দিত্ব থেকে,না অন্যান্য মানুষের বন্ধন থেকে? যার অর্থ মানুষ থেকে মানুষের মুক্তি। এগুলো ঠিক,তবে এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানুষের আমিত্ব ও নাফ্সে আম্মারা এবং নিজের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি। যতক্ষণ মানুষ নিজের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি না পাবে ততক্ষণ পৃথিবীর বন্দিত্ব ও অন্যান্য মানুষের বন্দিত্ব থেকেও মুক্তিপাবে না।

বহিঃপ্রবণতা ও অন্তঃপ্রবণতার সহাবস্থানের প্রয়োজনীয়তা

আমরা এখনও আমাদের আলোচনার প্রথম পর্যায়ে রয়েছি। আজ রাত মোবারক মাস রমযানের একুশের রাত্রি,রমযানের শেষ দশ রাত্রির প্রথম রাত্রি। যখন রমযানের শেষ দশ দিন আসত তখন রাসূল (সা.) নির্দেশ দিতেন শোবার বিছানা গুটিয়ে ফেলতে এবং শওয়াল মাসে তা খুলতে। অর্থাৎ রাসূল এ শেষ দশ দিনের কোন রাত্রিতেই ঘুমাতেন না। এ রাতগুলো ইবাদত,দোয়া,মোনাজাত ও আল্লাহর সঙ্গে একাকী কাটানোর রাত।

যা হোক আমরা যে বিষয় নিয়ে পূর্ববর্তী বৈঠকে আলোচনা করেছি,বলেছি যে,কখনো কখনো কোন কোন মূল্যবোধ অন্যান্য মূল্যবোধকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। এক সময় ইসলামী সমাজ ইবাদতের মূল্যবোধের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল এবং বাড়াবাড়ি এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে,অন্যান্য মূল্যবোধ ধ্বংস করছিল। বর্তমানে আমি লক্ষ্য করছি অন্য আরেক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে; কেউ কেউ ইসলামের সামাজিক মূল্যবোধের দিকে দেখেন,কিন্তু এর খোদায়ী দিককে ভুলে যান। তারা আরেকটি ভুল ও বিচ্যুতির মধ্যে পড়েছেন- এক আরবের গাধায় চড়ার মতো যে গাধায় উঠার জন্য এমন জোরে লাফদিল ফলে অন্য পার্শ্বে গিয়ে পড়ল। ফলে প্রথম প্রচেষ্টায় সে গাধায় উঠতে পারল না। দ্বিতীয় বারও সেতা-ই করল। তখন নিজেই বলল,ك الاوّل অর্থাৎ প্রথম বারের মতোই।

যদি এমন অবস্থা হয় যে,ইসলামের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা থেকে বের হয়ে যাব,তবে সমাজবিমুখ ইবাদতকারী আর ইবাদতবিমুখ সমাজমুখিতার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।

দেখুন,মহান আল্লাহ্ সূরা ফাতহের শেষ রুকুতে কি বলছেন (এমন নমুনা কোরআনে আরও রয়েছে),

( مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ)

রাসূলল্লাহর প্রশিক্ষিত সাহাবীরা কিরূপ? মুসলমানদের প্রকৃত শত্রু অর্থাৎ কাফেরদের মোকাবিলায় কঠিন,কঠোর,দৃঢ় ও মজবুত যেমন সীশা ঢালা প্রাচীর।

) إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِهِ صَفًّا كَأَنَّهُمْ بُنْيَانٌ مَرْصُوصٌ (

(সূরা ছফ : ৪)

কিন্তু এরা দু রূপের অধিকারী- ইসলামের প্রকৃত শত্রুদের মোকাবিলায় তারা কঠোর ও মজবুত,কিন্তু নিজেদের মধ্যে স্নেহশীল,দয়ালু,ঐক্যবদ্ধ,ভালবাসায় সম্পর্কিত। কোরআনের ভাষায় এটা ইসলামী সমাজের বৈশিষ্ট্য (আমরা কয়েক শতাব্দী হলো সেটাকে ভুলতে বসেছি)। কোরআন সূরা ফাতহের শেষ আয়াতে বলছে-

) تَرَاهُمْ رُكَّعًا سُجَّدًا يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِنَ اللَّهِ وَرِضْوَانًا سِيمَاهُمْ فِي وُجُوهِهِمْ مِنْ أَثَرِ السُّجُودِ (

সাথে সাথেই খোদায়ী মূল্যবোধের কথা বলছে। ঐ ব্যক্তিটি যে সমাজমুখী সে ব্যক্তিটিই খোদার মোকাবিলায় নত,সেজদাবনত,নিজের মনের কথা ও বেদনা খোদার নিকট ব্যক্ত করে। তার নিকট থেকে এর থেকে উত্তরণের জন্য সাহায্য চায় যেন নিজের উন্নয়ন ঘটাতে পারে। যা তার আছে তাতে সে সন্তুষ্ট নয়,বরং প্রতি মুহূর্তে নিজের অবস্থার উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষী। তার সকল ইবাদতের লক্ষ্য স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্থাৎ ইবাদতের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থায় সে আল্লাহর ইবাদত করে এবং তাদের চেহারায় ইবাদতের চিহ্ন লক্ষণীয়।

) ذَلِكَ مَثَلُهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَمَثَلُهُمْ فِي الْإِنْجِيلِ كَزَرْعٍ أَخْرَجَ شَطْأَهُ(

অতঃপর ইসলামী সমাজকে বর্ণনা করছে এটা কেমন? বলছে,এটা এমন এক সমাজ যাকে তুলনা করা যায় একটি বৃক্ষের সঙ্গে; প্রাথমিক অবস্থায় তা দুর্বল ও ক্ষুদ্র থাকলেও পরবর্তীতে বৃদ্ধি পেয়ে ফুলে-ফলে পূর্ণতা লাভ করে,কৃষকের চোখে আনন্দের জোয়ার আনে।

দেখুন,কোরআন অন্য একটি স্থানে এ দু প্রবণতার (বহির্মুখী ও অন্তর্মুখী) সহাবস্থানের কথা কিভাবে বলছে,

) التَّائِبُونَ الْعَابِدُونَ الْحَامِدُونَ السَّائِحُونَ الرَّاكِعُونَ السَّاجِدُونَ(

খোদায়ী দিকগুলো,যেমন পরিশুদ্ধতা অবলম্বনকারী,ইবাদতকারী,খোদার প্রশংসাকারী,রোযা পালনকারী,রুকুকারী,সেজদাকারী বলার সাথে সাথে আবার উল্লেখ করছে,

) الْآمِرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَالنَّاهُونَ عَنِ الْمُنْكَرِ(

তারাই সমাজের সংস্কারকারী,সমাজে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধকারী।

অন্য আয়াতে বলছে,

) الصَّابِرِينَ وَالصَّادِقِينَ وَالْقَانِتِينَ وَالْمُنْفِقِينَ(

ধৈর্যধারণকারীরা (দৃঢ়তা অবলম্বনকারী বিশেষ করে যুদ্ধের মযদানে),সত্যবাদীরা,দানকারীরা,সত্যপন্থীরা।এর পরপরই বলছে,( وَالْمُسْتَغْفِرِينَ بِالْأَسْحَارِ ) অর্থাৎ শেষ রাত্রিতে ক্ষমা প্রার্থনাকারীরা। অর্থাৎ ইসলামে এ বৈশিষ্ট্যগুলো একটি আরেকটি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। কেউ যদি এগুলোর যে কোন একটিকে ছোট করে দেখে তবে অন্যগুলোকেও ছোট করে দেখছে।

ইমাম মাহদী (আ.)-এর সঙ্গী-সাথীদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে (যা শুধু একটি নয় অনেক হাদীসেই আমি দেখেছি) বলছে,رهبان بالیل لیوث بالنّهار রাত্রিতে তারা দুনিয়াত্যাগী উপাসক অর্থাৎ রাত্রি যখন আসে তখন তাদেরকে দেখলে মনে হয় একদল খোদা উপাসক আবার যখন দিনে তাদেরকে দেখবে তখন তারা যেন একদল সিংহ।

ইসলামের ইতিহাসের নমুনা

রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সাহাবীরা কিরূপ অবস্থায় ছিলেন সে ব্যাপারে আল কাফীর একটি প্রসিদ্ধ হাদীস (মাওলানা রূমী তা কবিতায় বর্ণনা করেছেন) যা শিয়া-সুন্নী হাদীস বর্ণনাকারীরা সবাই বর্ণনা করেছেন,খুবই শিক্ষণীয়।

একদিন রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ফজরের নামাজের পর আসহাবে ছোফফার নিকট গেলেন। রাসূলুল্লাহ্ প্রায়ই তাদের দেখতে যেতেন। সে দিন হঠাৎ এক যুবকের উপর রাসূলের চোখ আটকে গেল। তিনি দেখলেন এ যুবকের মধ্যে অন্য রকম অবস্থা বিরাজ করছে- পা দু টি টলায়মান,চোখ দু টি কোটরের মধ্যে ঢুকে গেছে। তার রং ও স্বাভাবিক নেই।

তার কাছে গিয়ে রাসূলুল্লাহ্ জিজ্ঞেস করলেন,کیف أصبحت কিরূপে রাত কাটিয়েছ? সে জবাব দিল,أصبحت موقنا یا رسول الله হে রাসূলুল্লাহ্! এমনভাবে সকালে প্রবেশ করেছি যে,ইয়াকীনের অধিকারী হয়েছি। যা আপনি মুখে বলেছেন ও আমি কান দিয়ে শুনেছি তা এখন চোখ দিয়ে দেখতে পাই। রাসূল চাইলেন সে আরো কিছু বলুক। তিনি বললেন, সব কিছুরই আলামত (চিহ্ন) থাকে। তোমার ইয়াকীনের আলামত কি?

সে বলল,إنّ یقینی یا رسول اله  هو الذی أحزننی و أسهر لیلی و أظمأ هوا جری আমার ইয়াকীনের আলামত হলো দিনগুলো আমাকে তৃষ্ণার্ত করে রাখে আর রাতগুলো আমাকে জাগ্রত করে রাখে (অর্থাৎ দিনে রোযা আর রাত্রিতে ইবাদত আমার ইয়াকীনের আলামত। আমার ইয়াকীন আমাকে রাত্রে বিছানায় শুতে দেয় না,আর দিনগুলোতে খাদ্যগ্রহণ থেকে বিরত রাখে।) রাসূল বললেন, এটা যথেষ্ট নয়,আরো কোন আলামত আছে কি? সে বলল, হে রাসূলুল্লাহ্! যদিও এখন এ পৃথিবীতে আছি কিন্তু ঐ দুনিয়াকে (অর্থাৎ আখেরাত) দেখতে পাই,সেখানকার শব্দ শুনতে পাই। বেহেশত থেকে বেহেশতবাসীদের কণ্ঠ আর জাহান্নাম থেকে দোযখবাসীদের চীৎকার শুনতে পাই। ইয়া রাসূলাল্লাহ্! যদি অনুমতি দেন,তবে আপনার সাহাবীদের একে একে পরিচয় বলে দিই,কে বেহেশতী,আর কেজাহান্নামী। রাসূল বললেন, নীরব হও। আর কোন কথা বল না। মাওলানা রূমী বলছেন,

বললেন রাসূল সাহাবী যায়েদকে কিভাবে রাত কাটিয়েছো বন্ধু হে!

ইয়াকীনের অধিকারী হয়ে বলল সে।

পুনঃ শুধায় চিহ্ন সে বাগানের দেখাও আমায়।

বলে তৃষ্ণার্ত আমি এই দিনগুলোতে হায়,

না ঘুমিয়ে কাটাই কষ্ট আর ভালবাসায়।

বললেন বল যা অর্জন করেছো তায়,

তা থেকে যেন বুঝতে পারে এরা সবাই।

বলল দু সৃষ্টি যখন দেখে এ আকাশ,

আমি দেখি তার অধিবাসীদের যেথায় বাস।

বলব কি কিছু কথা রয়েছে খাছ

ঠোঁট কামড়ে বলেন রাসূল,হয়েছে ব্যাস।

অতঃপর রাসূল তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার ইচ্ছা কি? কি করতে চাও? সে বলল, ইয়ারাসূলাল্লাহ্! আল্লাহর পথে শাহাদাত বরণ করতে চাই।

তার ইবাদত আর ইচ্ছা হলো এ রকম,তার রাত্রি হলো ইবাদত,আর দিন জিহাদ আর শাহাদাতের জন্য। এটাই ইসলামের কথিত মুমিন,ইসলামের মানুষ। দু টি ভিন্নমুখী কষ্ট,কিন্তু দ্বিতীয় কষ্টটি তার প্রথম কষ্ট থেকে উৎসারিত। আর সেটা হলো স্রষ্টাকে পাওয়ার বেদনা।

আমার বক্তব্যের শুরুতে যে আয়াতটি তেলাওয়াত করেছি তা হলো :

) وَاسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى الْخَاشِعِينَ(

কোরআনের বর্ণনা সত্যিই আশ্চর্যজনক। বলছে, হে ঈমানদারগণ! নামাজ ও ধৈর্যের মাধ্যমে সাহায্য চাও। তাফসীরকারগণ বলছেন,ধৈর্যের অর্থ রোযা,যেহেতু রোযা এক ধরনের সবর। তাই নামায ও রোযা থেকে সাহায্য নাও। নামায থেকে কি ধরনের সাহায্য পাওযা যায়? আল্লাহর ইবাদত ও উপাসনার মাধ্যমে কি শক্তি পাওয়া যায়? উত্তর আল্লাহর ইবাদত নিজেই একটি শক্তি। প্রকৃত পক্ষে যেকোন প্রেরণাই এখান থেকে পাওযা যায়। যদি আপনি চান সমাজে প্রকৃত মুসলমান হিসেবে থাকবেন,যদি চান একজন সংগ্রামী হতে,তবে অবশ্যই আপানাকে প্রকৃত নামাযী হতে হবে।

অনেকে বলেন,নামায পড়ার কি আছে? ইবাদতের প্রয়োজন কি? এগুলো বৃদ্ধ-বৃদ্ধার কাজ। যুবকদের অবশ্যই সামাজিক হতে হবে। এগুলো এক ধরনের বুদ্ধিজীবীদের কথা যার নজীর ইতিহাসে পুরাতন। হয়তো জানেন,হযরত উমর (হাইয়া আলা খাইরিল আমাল) বাক্যটিকে আযান থেকে প্রত্যাহার করেন। কেন? তার নিজের যুক্তিতে মনে হয়েছে এটা করা দরকার। যেহেতু তার শাসনকাল ইসলামের বিজয় ও সংগ্রামের সময় এবং মুসলমানদের দলে দলে যুদ্ধে যোগদান করতে হচ্ছে,অল্প সৈনিক নিয়ে অধিক সংখ্যক সৈন্যের মোকাবিলায় জয়ী হতে হবে (কখনো সমগ্র যোদ্ধা মুসলমানের সংখ্যা পঞ্চাশ বা ষাট হাজার আর তা নিয়ে রোম বা পারস্য সাম্রাজ্যের লক্ষসৈনিকের মোকাবিলায় দাঁড়াতে হয়েছে),তাই মুজাহিদদের নিকট যুদ্ধের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। যখন মুয়াজ্জিন আযানের সময় চীৎকার করে আল্লাহু আকবার ও দু শাহাদাতের পর(হাইয়া আলাস সালাহ্-নামাযের দিকে এসো) এবং (হাইয়া আলাল ফালাহ-কল্যাণেরদিকে এসো) বলে,তার মধ্যে কোন সমস্যা নেই কিন্তু হাইয়া আলা খাইরিল আমাল (সর্বশ্রেষ্ঠ আমলের দিকে এসো) যার অর্থ সর্বশ্রেষ্ঠ আমল হলো নামায,এটা বলা হবে তখন মুজাহিদদের মনদুর্বল হয়ে যাবে। কেননা তাদের নিজেদের কাছে মনে হবে নামায যেহেতু সর্বশ্রেষ্ঠ আমল আমরা যুদ্ধের ময়দানে বা জিহাদে যাওয়ার চেয়ে মদীনার মসজিদে বসে নামায পড়ি,কি প্রয়োজন অন্যদের হত্যা করে,নিজেদের নিহত হতে দিয়ে,আহত হয়ে,কারো চোখ অন্ধ হবে,কারো হাত বা পা কাটা যাবে,অভুক্ত থাকার কষ্ট করতে হবে,বরং আমরা এখানে স্ত্রী-পুত্র-পরিজনের পাশে বসে চার রাকাত নামায পড়ে তাদের চেয়ে উত্তম হতে পারি। তাই আযান থেকে এ অংশটি বাদ দিতে হবে। তার চেয়ে বরং বলব (আস সালাতু খাইরুম মিনান নাওম-নামায ঘুম থেকে উত্তম)। যখন ঘুমাব তখন মনে করতে হবে ঘুমানোর চেয়ে মসজিদে গিয়ে নামায পড়ি।

কিন্তু এ রহস্য আমাদের জানতে হবে কোন্ শক্তির বলে মুসলমানরা (যাদের সংখ্যা এক লক্ষেরও কম) তাদের থেকে কয়েকগুণ শক্তিশালী (সংখ্যায় কয়েক লক্ষ) প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হয়। এ জয় কিরূপে সম্ভব অনেকেই চিন্তা করে দেখেনি। এ জয় তো অস্ত্রের বলে নয়। যদি তাই হতো তবে আরবদের অস্ত্র কি রোমানদের বা পারসিকদের চেয়ে অধিক ধারালো ছিল? অবশ্যই নয়। বরং রোমান ও পারসিকরা সমসাময়িক যুগের শ্রেষ্ঠ অস্ত্রের অধিকারী ছিল। অপর পক্ষে আরবদের অস্ত্র সেরকম ছিল না। জাতি হিসেবেও আরবরা কি রোম ও ইরানের মোকাবিলায় শক্তিশালী ছিল? অবশ্যই নয়। শাপুর জুল আকতাফ ইসলাম-পূর্ব যুগে আরবদের পদদলিত করেছিল। শত-সহস্র আরবকে বন্দিকরে নিয়ে গিয়েছিল। তাদের কপালে কালিমা লেপন করে দিয়েছিল। তখন আরবদের শক্তি কোথায়ছিল? কিন্তু মাত্র একশ বছর পর সেই আরবরাই ইরানকে পরাজিত করেছিল। তাহলে কোন্ শক্তির বলে আরবরা ইরান ও রোমের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ের মালা পড়েছিল আর তাদের মুখে পরাজয়ের চিহ্ন এঁকে দিয়েছিল? এ শক্তি ঈমানের শক্তি ছিল। যে শক্তি সেحی علی خیر العمل থেকে লাভ করেছে। তার নামায থেকে সে এ শক্তি অর্জন করেছে স্রষ্টার কাছে একান্ত প্রার্থনার মাধ্যমে। কোরআনে বর্ণিত মানুষ রাত্রিতে তার স্রষ্টার সম্মুখে দাঁড়িয়ে মনের গোপন আকাঙ্ক্ষাপেশ করে,তার নিকট এ শক্তি চায়। সেই মহান প্রভু থেকেই সে এ আত্মিক শক্তি লাভ করেছে অর্থাৎ আরবরা যখন স্রষ্টার নিকট থেকে এ আত্মিক শক্তি অর্জন করেছে তখন এর বলেই সে ইরান ও রোমকে পরাজিত করেছে। এ আত্মিক শক্তি সে কিভাবে পেয়েছে? তার ঈমান থেকে পেয়েছে। নামায কি? নামায হলো ঈমানের ঝালাই। নামাযের আল্লাহু আকবার থেকেই সে এ শক্তি অর্জন করেছে। যখন সে নামাযে কয়েকবার বলে, আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ ,তখনই অনুভব করে বাকী সকল কিছুই তুচ্ছ। যখন যুদ্ধের ময়দানে কয়েকলক্ষ যোদ্ধাকে তাদের মোকাবিলায় দেখে তখন বলে, লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিলআলিয়্যিল আজিম। সকল ক্ষমতা আল্লাহর হাতে। মানুষের অবশ্যই তার উপর নির্ভর করা উচিত। তার থেকে শক্তি ও সাহায্য চাওয়া উচিত। নামাযই তাকে এ শক্তি ও সাহস দান করেছে। যদি এ নামায না থাকতো তবে এ ধরনের মুজাহিদ (জিহাদকারী) যোদ্ধা তৈরি হতো না।

ইসলাম কি এটা বলে না যে,ইসলামের বিধি-বিধান একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যার উপর জিহাদ ফরয করা হয়েছে তার নামাযের জন্য মদীনার মসজিদে পড়ে থাকা হারাম। তাকে অবশ্যই জিহাদের জন্য যেতে হবে। তার নামায কবুল হওয়ার শর্ত হলো জিহাদ। আবার জিহাদ কবুল হওয়ার শর্তও নামায। কোন মুজাহিদের জন্য শর্তাবলী উপস্থিত হলে তার জন্য জিহাদ ফরয। কিন্তু তাকে বলতে হবে,ইসলাম বলে নামায ব্যতীত জিহাদ বাতিল ও মূল্যহীন,তেমনি জিহাদ ব্যতীত নামাযও বাতিল। তখন এটা খাইরুল আমাল বা সর্বোত্তম ইবাদত না হয়ে শাররুল আমাল বা নিকৃষ্ট ইবাদতে পরিণত হবে। নামায মুসলমানকে ইসলাম কি তা শেখায়। যে নামায মুসলমানকে জিহাদ থেকে পালানোর জন্য মসজিদে বসে থাকার কথা বলে সেটা ইসলামের নামায নয়। ইসলামের নামায সর্বোত্তম কর্ম (খাইরুল আমাল)। তাই এটা ঠিক নয় যে,حی علی خیر العمل -কে আযান থেকে এ যুক্তিতে বাদ দেয়া হবে যে,এর খারাপ প্রভাব রয়েছে,যেহেতু মুসলমানরা জিহাদ বাদ দিয়ে নামায পড়তে যাবে। এটা ভুল। এটাই ইসলামের যুক্তি। বর্তমানের পরিভাষায় যদি বলি,ইসলামী মূল্যবোধের দৃষ্টিতে সকল মূল্যবোধের মূল্য ইবাদতে নিহিত,তবে বলতে হবে সে ইবাদত হলো শর্তযুক্ত ইবাদত। কোরআন আমাদের বলছে নামায তখনই নামায হবে যখন তার প্রভাব স্বতঃপ্রকাশিত। কিরূপে তা প্রকাশিত হবে? নিশ্চয়ই নামায মন্দ ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে। প্রকৃত নামায এটাই যা মানুষকে মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। যদি দেখ নামায পড়ছ সে সাথে অন্যায় কাজও করছ,তবে জেনে রাখ,তোমার নামায নামায নয়। সুতরাং তোমার নামাযকে ঠিক কর। নামায তোমাকে সকল মূল্যবোধ দান করবে এ শর্তে যে,তোমার নামায প্রকৃতই নামায হয়।

এ সকল শিক্ষা হযরত আলী (আ.)-এর নিকট থেকে শিক্ষণীয়। আলী (আ.) ইসলামের সকল মূল্যবোধের সমষ্টি। নাহজুল বালাগাহ্ তার বাণী। যা এমন এক গ্রন্থ মানুষ এর যেখানেই লক্ষ্য করে যেন নতুন এক যুক্তি খুজে পায়,খুজে পায় নতুন এক মানুষকে- এর প্রতিটি অধ্যায়ে যেন নতুন নতুন মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে। প্রতিটি স্থানেই আলী (আ.) সামগ্রিক মূল্যবোধের প্রতিভূ এক ব্যক্তিত্ব। কোথাও তার যুক্তি বীরোচিত যেন এক নবযুবক যে সামরিক প্রশিক্ষণ শেষ করে সমর নেতা হয়েছে;যে সমরবিদ্যা ছাড়া কিছুই বোঝে না। কোথাও সে আলীকেই মনে হবে এক আরেফ ও সূফী যে স্রষ্টার সঙ্গে গভীর প্রেমে লিপ্ত,অন্য কিছুর প্রতি তার খেয়াল নেই।

আলী (আ.)-এর পৌরুষত্ব ও সাহসিকতা

আজ একুশে রমযানের রাত হযরত আলী (আ)-এর শাহাদাতের রজনী। যাতে ইসলামের বৈশিষ্ট্যের সাথে পুরোপুরি পরিচিত হতে পারি এজন্য নাহজুল বালাগায় দ্বৈত বৈশিষ্ট্যের আলীর পরিচয় রয়েছে এমন দু টি অংশ থেকে আলাচনা রাখছি। সিফফিনের যুদ্ধে আলী (আ.)-এর সৈন্যরা ফোরাত কিনারায় পৌছার পূর্বেই মুয়াবিয়ার সৈন্যবাহিনী সেখানে পৌছায়। মুয়াবিয়া নির্দেশ দেয় পানির পথগুলো আলী ও তার সৈন্যদের জন্য বন্ধ করে রাখতে। আলীর সৈন্যদের পরাস্ত করার খুব ভালো এক কৌশল হস্তগত করেছে এটা ভেবে মুয়াবিয়ার সৈন্যবাহিনী মনে মনে খুব আনন্দিত হলো। হযরত আলী যখন সেখানে পৌছে এ অবস্থা দেখলেন তখন বললেন,পরস্পর আলোচনা করে বিষয়টি ফয়সালা করবেন যাতে করে এ বিষয়টি নিয়ে দু পক্ষের মুসলমানদের মধ্যে রক্তক্ষয় না হয়। তাই মুয়াবিয়াকে লক্ষ্য করে বললেন, আমরা এখনও এসে পৌছাইনি,তুমি এ ধরনের কাজ করলে! (পানি পথ ছেড়ে দাও যাতে এ পক্ষও পানি পায়)। মুয়াবিয়া পরামর্শ সভা ডেকে নিজের সেনাপ্রধানদের কাছে পরামর্শ চাইল। কেউ বলল পানির পথ ছেড়ে দেয়াই উত্তম,কেউ বলল,না। আমর ইবনে আস বলল, ছেড়ে দাও। কারণ যদি তুমি না ছাড় তবে বল প্রয়োগে তোমার নিকট থেকে সে নিয়ে নেবে। তখন তোমার সম্মান ভূলুন্ঠিত হবে। কিন্তু মুয়াবিয়া সিদ্ধান্ত নিল পানি পথ ছাড়া হবে না। তখন হযরত আলী (আ.) তার সৈন্যদের উদ্দেশ্যে এক বিপ্লবী ভাষণ দিলেন যার প্রভাব শত রণতুর্য আর দামামা থেকেও অনেক বেশি। তিনি বললেন, তারা যুদ্ধ চায়,এখন তোমরা ভেবেদেখ অপমান ও অমর্যাদাকে গ্রহণ করে সাহস ও সম্মান হারাবে,নাকি তোমাদের তরবারীকে তাদের রক্তে পূর্ণ করে নিজেরা পানির তৃষ্ণা মেটাবে। (নাহজুল বালাগাহ্,খুতবা নং ৫১)

মুয়াবিয়া তোমাদের জন্য পানি বন্ধ করেছে। আমার সহযোগীরা! তোমরা তৃষ্ণার্ত। পানি চাও। আমার কাছে এসেছ,পানি চাও। যদি পানি চাও তবে কি করা উচিত? তোমাদের তরবারীগুলোকে প্রথমে এই শত্রুদের দূষিত রক্ত দ্বারা পূর্ণ কর। তারপর নিজেরা তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারবে। এর পর এমন এক বাক্য উচ্চারণ করলেন যা সবার মধ্যে উত্তেজনা ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করল। জীবন ও মৃত্যুকে যুদ্ধ ও বিপ্লবের ভাষায় সংজ্ঞায়িত করলেন। হে জনগণ! জীবন কি? বেঁচে থাকার অর্থ কি? মৃত্যু কি? বেঁচে থাকার অর্থ কি পৃথিবীর উপর বিচরণ,খাদ্য গ্রহণ আর বিশ্রাম? মৃত্যুর অর্থ কি কবরে শয়ন? না,ঐ জীবনকেও জীবন বলা যায় না,ঐ মৃত্যুকেও মৃত্যু বলা যায় না।

فالموت فی حیاتکم مقهورین و الحیات فی موتکم فاهرون

  জীবন হচ্ছে মৃত্যুবরণের মাধ্যমে জয়ী হওয়া। আর মৃত্যু হলো বেঁচে থাকা,কিন্তু অপরের অধীনে থাকা।

এ বাক্যটি কতটা বিপ্লবী ও উঁচু পর্যায়ের! এরপর কি শক্তির মাধ্যমে আলী (আ.)-এর সৈনিকদের প্রতিরোধ করা সম্ভব? কিছুক্ষণের মধ্যেই আলীর সেনাবাহিনী হামলার মাধ্যমে মুয়াবিয়ার সেনাবাহিনীকে নদীকূল থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে বিতাড়িত করল। আলীর সহযোগীরা নদীকূলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করল। এবার মুয়াবিয়ার সেনাবাহিনী পানির জন্য আবেদন করল। আলীর সৈন্যরা বলল, অসম্ভব। আমরা পানি দিতে রাজী নই। আমরা প্রথমে এ ধরনের কাজ করিনি,বরং তোমরাই এ পথ বেছে নিয়েছিলে। হযরত আলী এ কথা শুনে বললেন, না,আমি পানি বন্ধ করতে রাজী নই। কারণ এ কাজ কাপুরুষোচিত। যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর সাথে মোকাবিলা ভিন্ন কথা। কিন্তু এপথে জয়লাভ করা কোন সম্মানিত মুসলমানের জন্য ঠিক নয়। এটাকেই বলে পৌরুষত্ব। পৌরুষত্ব সাহসিকতার থেকেও উচ্চ পর্যায়ের। হযরত আলীকে উদ্দেশ্য করে মাওলানা রুমী কত সুন্দর বলেছেন (হযরত আলীর শানে ও প্রশংসায় রচিত তার শ্রেষ্ঠ কবিতা)!

সাহসিকতায় তুমি শেরে খোদা জানি

পৌরুষত্বে কি তুমি,জানেন শুধু অন্তর্যামী।

অর্থাৎ সাহসিকতায় তিনি শেরে খোদা সকলে জানলেও পৌরুষত্বে কেউই আলীকে চিনতে পারেনি। এখানে আমরা হযরত আলীকে তার এক বিশেষ রূপে দেখতে পাই।

হযরত আলী (আ.)-এর মোনাজাত

যখন আলী (আ.) মানুষ থেকে দূরে- একান্তে স্রষ্টার সাথে ইবাদত ও গোপন সংলাপে লিপ্ত তখন দেখি অন্য এক আলী। যেমন নাহজুল বালাগায় পাই

اللهم انّک آنس الآنسین لاولیائک

হে আল্লাহ্! আপনি আপনার আউলিয়াদের নিকটতম বন্ধুর থেকেও নিকটে অবস্থান করছেন। অর্থাৎ কোন বন্ধুর সঙ্গেই আপনার মতো নৈকট্য অনুভব করি না। আপনি আমার নিকটতম সাথী। আপনি ব্যতীত যার সঙ্গেই থাকি যেন একাকিত্ব অনুভব করি। শুধু যখন আপনার সঙ্গে থাকি তখনই অনুভব করি নিকটতম কারো সঙ্গে আছি।

و احضرهم بالکفایة للمتوکلین علیک

যে কেউ আপনার প্রতি নির্ভর করে,অনুভব করে অন্য সকল কিছুর থেকে আপনি তার নিকটতর উপস্থিত অস্তিত্ব যেন আপনি আপনার উপর নির্ভরকারী ব্যক্তির নিকট উপস্থিত হন।

تشاهدهم فی سرائرهم و تطلع علیهم فی ضمائرهم و تعلم مبلغ بصائرهم

হে প্রভূ! আপনি আপনার বন্ধু ও প্রেমিকদের হৃদয়ের অন্তস্তলের রহস্যও পর্যবেক্ষণ করেন এবং তাদের অন্তঃকরণের অপ্রকাশ্য বিষয় সম্পর্কেও অবহিত। তাদের জ্ঞান ও অন্তদৃষ্টি কোন্ পর্যায়ে অবস্থান করছে তাও আপনার জানা।

فاسرارهم لک مکشوفه و قلوبهم إلیک ملهوفة

তাদের রহস্য আপনার নিকট প্রকাশিত ও তাদের অন্তর আপনার প্রতি উড্ডয়নশীল।

আলী (আ.)-এর দোয়াগুলোর মধ্যে দোয়ায়ে কুমাইল জুমআর রাতগুলোতে পড়বেন। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এ দোয়াটি পড়ুন। দেখবেন,না এর মধ্যে দুনিয়া আছে,না আখেরাত (আখেরাত বলতে বেহেশত ও দোযখ)। যা দেখবেন তা দুনিয়া ও আখেরাতের ঊর্ধ্বে। স্রষ্টার সাথে একজন খাঁটি বান্দা,উপাসক ও প্রেমিকের সম্পর্ক এটাই যে,তার প্রেমে নিমগ্ন থাকবে। প্রকৃত ইবাদত এটাই। আলী নিজেই তা বলছেন। দোয়ায়ে কুমাইলে আলী (আ.) নিজের স্রষ্টার সাথে কিরূপে কথোপকথন করছেন লক্ষ্য করুন,কিভাবে মোনাজাত করছেন দেখুন,তেমনিভাবে ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) রমযানমাসের সুবহে সাদিকের পূর্বে সেহরীর সময় কিভাবে আল্লাহর নিকট আবেদন-নিবেদন করছেন তা আবু হামযা সোমালীর দোয়ায় লক্ষ্য করুন। মুসলমানের প্রথম ধাপ এটাই যে,সে তার স্রষ্টার নিকটবর্তী হবে। স্রষ্টার নৈকট্যের মাধ্যমেই অন্যান্য দায়িত্ব,বিশেষ করে সামাজিক দায়িত্বসমূহ সুন্দরভাবে আঞ্জাম দিতে পারব।

আমাদের চেষ্টা করতে হবে যাতে আমাদের প্রবণতাগুলো এককেন্দ্রিক না হয়ে পড়ে- যে সমস্যায় বর্তমানে মুসলিম উম্মাহ্ আক্রান্ত। আমাদের এ এককেন্দ্রিকতা পরিহার করে সামগ্রিকতা অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। ইবাদতের গুরুত্বকে কম করে দেখলে চলবে না। ইমাম সাদিক (আ.) তার মৃত্যুলগ্নে তার সকল নিকটাত্মীয়কে ডেকে সমবেত করে একটি মাত্র বাক্য উচ্চারণ করে বিদায় নেন। তিনি বলেন, যারা নামাযকে ছোট করে দেখে (কম গুরুত্ব দেয়),আমার শাফায়াত তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়।


9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53

54

55

56

57

58

59

60

61