চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড3%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 108645 / ডাউনলোড: 10078
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

খাদীজার গর্ভজাত সন্তানগণ

সন্তানের অস্তিত্ব বৈবাহিক জীবন ও বন্ধনকে দৃঢ় করে,জীবনকে করে আলোকিত;আর এক বিশেষ ধরনের দ্যুতি বয়ে এনে জীবন থেকে আঁধারকে করে বিতাড়িত। হযরত খাদীজার গর্ভে মহানবীর ছয়টি সন্তানের জন্ম হয়। এদের দু টি ছিল পুত্রসন্তান;বড় ছেলের নাম ছিল কাসেম,এরপর আবদুল্লাহ্। কাসেম ও আবদুল্লাহকে যথাক্রমে তাহের ও তাইয়্যেবও বলা হতো। ৪ জন ছিল কন্যাসন্তান। ইবনে হিশাম লিখেছেন, জ্যেষ্ঠ কন্যার নাম ছিল রুকাইয়াহ্। পরবর্তীতে যয়নাব,উম্মে কুলসুম এবং ফাতিমা জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পুত্রসন্তানদ্বয় তাঁর নবুওয়াতপ্রাপ্তির আগেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর মেয়েরা তাঁর নবুওয়াতকাল প্রত্যক্ষ করেছেন। ১৯০

যে কোন অবস্থা ও পরিস্থিতিতে মহানবীর ধৈর্য তখন সকলের মুখে মুখে আলোচিত হতো। এতদ্সত্ত্বেও সন্তানদের মৃত্যুতে কখনো কখনো তাঁর অন্তরের বেদনা অশ্রুতে পরিণত হয়ে তাঁর চোখ থেকে পবিত্র গণ্ডদেশের ওপর ঝরে পড়ত। মারিয়ার গর্ভজাত তাঁর সন্তান ইবরাহীমের মৃত্যুতে মহানবী সবচেয়ে বেশি শোকাভিভূত হয়েছিলেন। তাঁর অন্তর তখন পুত্রবিয়োগের শোক ও বেদনায় মুহ্যমান ছিল,কিন্তু তাঁর কণ্ঠ ছিল মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে ব্যস্ত,এমনকি এক মরুচারী আরব ইসলাম ধর্মের নীতিমালা ও মৌলিক আকীদা-বিশ্বাস সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার কারণে যখন তাঁর কাঁদার ব্যাপারে আপত্তি করেছিল তখন মহানবী বলেছিলেন, এ ধরনের ক্রন্দন এক ধরনের রহমত।” এরপর তিনি বলেছিলেন,

و من لا يَرحم لا يُرحم

যে দয়া করে না তার প্রতিও দয়া প্রদর্শন করা হয় না। ১৯১

ভিত্তিহীন ধারণা

ড. হাসানাইন হাইকাল মুহাম্মদের জীবন ১৯২ গ্রন্থে লিখেছেন, নিঃসন্দেহে খাদীজাহ্ এদের প্রত্যেকের মৃত্যুকালে মূর্তিগুলোর দিকে মুখ করে সেগুলোকে জিজ্ঞাসা করতেন : খোদাগণ কেন তাঁর প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ প্রদর্শন করছেন না?

ড. হাইকাল কর্তৃক বর্ণিত হযরত খাদীজার এ উক্তির ক্ষুদ্রতম ঐতিহাসিক দলিল-প্রমাণ বা ভিত্তি নেই। এ ধরনের বক্তব্যের উৎস হচ্ছে এই যে,ঐ সময় অধিকাংশ লোকই মূর্তিপূজক ছিল;অতএব,খাদীজাও তাদের মতোই (নাউযুবিল্লাহ্) মুশরিক ও মূর্তিপূজারী ছিলেন! অথচ মহানবী (সা.) যৌবনকালের শুরু থেকেই মূর্তিপূজা ও শিরককে তীব্রভাবে ঘৃণা করতেন এবং যে সফরে তিনি শাম গিয়েছিলেন সেই সফরে এ বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কারণ এক ব্যবসায়ীর সাথে যখন তাঁর হিসাব নিয়ে মতপার্থক্য হয়েছিল তখন ঐ ব্যবসায়ী লাত ও উয্যার নামে শপথ করেছিল। মহানবী তাকে বলেছিলেন, আমার কাছে সবচেয়ে ঘৃণ্য বিষয় হচ্ছে এগুলোই (অর্থাৎ লাত,উয্যা এবং সকল প্রকার প্রতিমা ও মূর্তি যেগুলোর পূজা-অর্চনা করা হয়)।”

এমতাবস্থায় বলা যায় কি খাদীজার মতো নারী যাঁর নিজ স্বামীর প্রতি টান,ভালোবাসা ও ভক্তি সম্পর্কে কোন সন্দেহই নেই তিনি তাঁর সন্তানদের মৃত্যুতে মূর্তি ও প্রতিমা অর্থাৎ মিথ্যা দেব-দেবীর আশ্রয় নেবেন যেগুলো ছিল তাঁর স্বামীর কাছে সবচেয়ে ঘৃণার পাত্র? অধিকন্তু হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে বিবাহ করার ব্যাপারে তাঁর আগ্রহের কারণ ও ভিত্তি ছিল প্রধানত মহানবীর উত্তম চারিত্রিক গুণাবলী ও আধ্যাত্মিকতা। কারণ তিনি শুনেছিলেন যে,তিনিই শেষ নবী। এমতাবস্থায় এ ধরনের আকীদা-বিশ্বাস পোষণ করে তিনি যে পুত্রশোকে মুহ্যমান হয়ে মূর্তি ও প্রতিমাসমূহের কাছে তাঁর অন্তরের দুঃখ প্রকাশ করবেন তা কিভাবে সম্ভব?

মহানবীর পালক পুত্র

মহানবী (সা.) যাইদ ইবনে হারেসাকে হাজারুল আসওয়াদের কাছে নিজ পুত্র বলে সম্বোধন করেছিলেন। আরবের মরু-দস্যুরা যাইদকে শামের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে অপহরণ করে খাদীজার এক আত্মীয় হাকীম বিন হিযামের কাছে বিক্রি করে দেয়। তবে খাদীজাহ্ কিভাবে তাঁকে ক্রয় করেছিলেন তা স্পষ্ট নয়।

‘মুহাম্মদের জীবনী’গ্রন্থের রচয়িতা বলেন, মহানবী (সা.) পুত্রদের মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলেন বলেই তাঁকে (যাইদকে) ক্রয় করার জন্য খাদীজাকে অনুরোধ করেছিলেন যাতে পুত্রবিয়োগের শোক ও দুঃখ কিছুটা লাঘব হয়। হযরত খাদীজাহ্ যাইদকে ক্রয় করলে মহানবী তাঁকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করে দেন এবং সন্তান হিসাবে গ্রহণ করেন।

কিন্তু অধিকাংশ সীরাত রচয়িতা ও ঐতিহাসিক উল্লেখ করেছেন যে,মহানবীর সাথে হযরত খাদীজার বিবাহের সময় হাকীম বিন হিযাম যাইদকে হিবা বা উপহারস্বরূপ ফুফী খাদীজার হাতে অর্পণ করেছিলেন। যেহেতু যাইদ ছিলেন সব দিক থেকেই পবিত্র (চরিত্রবান) ও বুদ্ধিমান যুবক সেজন্য তিনি মহানবীর স্নেহভাজন হয়েছিলেন। আর হযরত খাদীজাহ্ও তাঁকে মহানবীর হাতে অর্পণ করেন। বেশ কিছুদিন পর যাইদের পিতা খোঁজ করতে করতে অপহৃত সন্তানের সন্ধান পেয়ে গেলেন। তিনি মহানবীকে অনুরোধ করলেন যেন তিনি তাঁকে পিতার সাথে নিজ এলাকায় ফেরার অনুমতি দেন। মহানবীও তাঁকে তাঁর নিজ এলাকায় প্রত্যাবর্তন অথবা মক্কা নগরীতে থেকে যাওয়ার মধ্য থেকে যে কোন একটি বেছে নেয়ার স্বাধীনতা দিলেন। মহানবীর স্নেহ ও দয়া তাঁকে মহানবীর কাছে থেকে যেতে আগ্রহী করে তোলে। এ কারণেই মহানবী তাঁকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করে সন্তান হিসাবে গ্রহণ করেন এবং তাঁর সাথে যয়নাব বিনতে জাহাশের বিবাহ দেন।১৯৩

মূর্তিপূজারীদের মধ্যে বিরোধের সূত্রপাত

মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াত কুরাইশদের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্যের সৃষ্টি করেছিল;কিন্তু সুদূর অতীত থেকেই তাদের মধ্যে এ বিরোধের নিদর্শনসমূহ ছড়িয়ে পড়েছিল। মহানবীর নবুওয়াতপ্রাপ্তির আগেই কতিপয় ব্যক্তি আরবদের ধর্মের প্রতি তাদের ঘৃণা প্রকাশ্যে ব্যক্ত করেছিলেন এবং আরব বিশ্বের আনাচে-কানাচে সর্বত্র এক আরবী নবীর আবির্ভাবের বিষয় সর্বদা আলোচিত হতে থাকে যে,তিনি অতি শীঘ্রই আত্মপ্রকাশ করবেন এবং তাওহীদ ও এক-অদ্বিতীয় স্রষ্টার উপাসনাকে পুনরুজ্জীবিত ও পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবেন। ইয়াহুদীরা বলত, আমরা তাঁর অনুসারী হব। কারণ আমাদের ধর্মের মূল ভিত্তি ও উক্ত আরব নবীর ধর্মের মূল ভিত্তি একই। তাঁর শক্তি ও ক্ষমতা ব্যবহার করে আমরা সকল প্রতিমা ভেঙ্গে ফেলব এবং মূর্তিপূজার ভিত ধ্বংস করব।”

ইবনে হিশাম লিখেছেন, ইয়াহুদীরা মূর্তিপূজারী আরব সমাজকে আরবীয় নবীর আবির্ভাবকাল নিকটবর্তী বলার মাধ্যমে হুমকি প্রদর্শন করত। এ সব বক্তব্য মূর্তিপূজার যুগ যে অচিরেই গত হতে চলেছে তার একটি পটভূমি তাদের চোখের সামনে তুলে ধরত। ব্যাপারটি এতদূর গড়ায় যে,ইয়াহুদীদের পূর্ববর্তী প্রচারণার ফলে মহানবী (সা.) যখন ইসলাম ধর্মের প্রচার কার্যক্রম শুরু করেন তখন আরবের কয়েকটি গোত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। কতিপয় কারণবশত ইয়াহুদীরা তাদের কুফরের ওপরই বহাল থাকে। নিম্নোক্ত আয়াতটি থেকেও তাদের অবস্থা পরিষ্কার হয়ে যায় :

) و لمّا جاء هم كتاب من عند الله مصدّق لما معهم و كانوا من قبل يستفتحون على الّذين كفروا فلمّا جاءهم ما عرفوا به فلعنة الله على الكافرين(

“যখন ঐশী গ্রন্থ (পবিত্র কোরআন) মহান আল্লাহর তরফ থেকে তাদের কাছে আসল যা তাদের কাছে বিদ্যমান গ্রন্থ তাওরাতের সত্যায়নকারী এবং তারা ইতিপূর্বে (মহানবীর নবুওয়াতপ্রাপ্তির পূর্বে) সর্বশেষ নবীর আবির্ভাবের মাধ্যমে কাফিরদের ওপর বিজয় লাভের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল,কিন্তু যখন তিনি (প্রতিশ্রুত শেষ নবী) তাদের কাছে আসলেন তখন তারা তাঁকে চিনল না,বরং তাঁকে অস্বীকার করল (অর্থাৎ তাঁর অস্তিত্ব যে মহানেয়ামত ছিল সেই নেয়ামতের প্রতি তারা অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল)। তাই মহান আল্লাহর লানত (ক্রোধ ও গজব) কাফির সম্প্রদায়ের ওপর বর্ষিত হোক।” (সূরা বাকারাহ্ : ৮৯)

মূর্তিপূজার ভিতসমূহ নড়বড়ে হয়ে গেল

একবার কুরাইশদের এক উৎসবে একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। সূক্ষ্মদর্শী ব্যক্তিদের দৃষ্টিতে ঐ ঘটনা ঘটার মাধ্যমে আসলে মূর্তিপূজকদের কর্তৃত্ব নির্মূল হওয়ার বিপদ ঘণ্টাই যেন বেজে উঠেছিল।

একদিন যখন মূর্তিপূজকরা একটি প্রতিমার চারপাশে সমবেত হয়ে তাদের কপাল সেটার সামনে মাটির ওপর রেখেছিল তখন তাদের নেতাদের মধ্য থেকে চার ব্যক্তি যাঁরা জ্ঞান ও বিদ্যা-বুদ্ধিতে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন তাঁরা তাদের এ কাজকে পছন্দ করলেন না এবং এক কোণে গিয়ে পরস্পর আলোচনায় লিপ্ত হলেন। তাঁদের বক্তব্য ও আলোচনা ছিল নিম্নরূপ :

“আমাদের জাতি হযরত ইবরাহীমের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে। এই পাথর যার চারপাশে আমাদের লোকেরা তাওয়াফ করে,আসলে তো তা শোনে না,দেখে না এবং উপকার বা ক্ষতিসাধনও করতে পারে না। ১৯৪

এই চার ব্যক্তি হলেন :

১. ওয়ারাকাহ্ ইবনে নওফেল যিনি ব্যাপক অধ্যয়ন করার পর খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং বাইবেলের পুরাতন ও নতুন নিয়ম সংক্রান্ত প্রচুর জ্ঞান ও তথ্য অর্জন করেছিলেন;

২. আবদুল্লাহ্ ইবনে জাহাশ যিনি ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের পর ঈমান এনেছিলেন এবং মুসলমানদের সাথে হাবাশায় হিজরত করেছিলেন;

৩. উসমান ইবনে হুওয়াইরিস যিনি রোম সম্রাটের দরবারে আশ্রয় নিয়ে খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী হয়ে যান এবং

৪. যাইদ ইবনে আমর ইবনে নুফাইল যিনি অনেক অধ্যয়ন ও গবেষণা করে হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর ধর্মের অনুসারী হয়েছিলেন।

মূর্তিপূজাবিরোধী এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভব এ বিষয়ের প্রমাণ হতে পারে না যে,মহানবী (সা.)-এর ইসলাম প্রচার কার্যক্রম ছিল প্রকৃতপক্ষে মুষ্টিমেয় ক্ষুদ্র এ দলটির আহ্বানেরই ফল। কারণ মহানবীর নবুওয়াত সংক্রান্ত এ ধরনের বিশ্লেষণ আসলে পবিত্র ইসলাম ধর্মের মর্মবাণী ও অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তু সম্পর্কে বিশ্লেষকের অজ্ঞতা থেকেই উদ্ভূত।

এ বিবাদ আসলে মূর্তিপূজা ত্যাগ ও এক স্রষ্টার উপাসনা ব্যতীত আর কিছুই ছিল না। আর এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির অন্তর্নিহিত বিষয় এর চেয়ে বেশি কিছু ছিল না যা এখন আমরা উল্লেখ করেছি। তাই মহানবী (সা.)-এর বিশ্বজনীন আহবান যা এক ভুবন পরিমাণ বিশাল তত্ত্বজ্ঞান ও বিধানসমেত উদিত হয়েছিল তাকে কিভাবে এ ধরনের কলহের ফল বলে অভিহিত করা যাবে?

মহানবীর নবুওয়াতপ্রাপ্তির সময় ইবরাহীম (আ.)-এর সুন্নাত (রীতিনীতি) বলে পরিচিত দীনে হানীফ’তখনও হিজায থেকে পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায় নি। হিজাযের এখানে-সেখানে দীনে হানীফের কিছু অনুসারী ছিল। তবে তাদের সংখ্যা এতটা ছিল না যে,যার ফলে তারা জনসমক্ষে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন অথবা একটি সামাজিক বিপ্লবের নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে অথবা কতিপয় ব্যক্তিকে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলবে অথবা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মতো কোন ব্যক্তিত্বের প্রবর্তিত ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষামালার প্রামাণিক উৎস হবে।

দীনে হানিফের অনুসারীদের নিকট থেকে এক-অদ্বিতীয় স্রষ্টায় বিশ্বাস,পারলৌকিক জীবনের প্রতি ঈমান এবং কখনো কখনো দু একটি নৈতিক শিক্ষা ও প্রবচন ব্যতীত আর কিছুই বর্ণিত হয় নি। আর যে তাওহীদী কাব্যসমূহ তাদের থেকে বর্ণিত বলে উল্লিখিত হয়েছে তা যে আসলে তাদের সাথেই সংশ্লিষ্ট অর্থাৎ তাদেরই রচিত তা সম্পূর্ণ অস্বীকার করা না গেলেও এখনও তা নিশ্চিতভাবে জানা যায় নি।১৯৫

এমতাবস্থায় কি সুমহান ইসলামী সংস্কৃতি,এ ধর্মের যুক্তিসংগত মৌলিক আকীদা-বিশ্বাস,নিয়ম-নীতি এবং এ ধর্মের নৈতিক,রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এ সব কিছুকে হিজাযের এখানে-সেখানে ছড়িয়ে থাকা গুটিকতক একেশ্বরবাদী দীনে হানীফের অনুসারীর সৃষ্টি ও কীর্তি বলে গণ্য করা সম্ভব? কারণ মহান আল্লাহ্,পারলৌকিক জীবন ও দু একটি নৈতিক প্রবচন ছাড়া আর কোন বিষয়ে তাদের (দীনে হানীফের অনুসারীদের) কোন বক্তব্য ছিল না।

কুরাইশদের অন্তর্নিহিত দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ

মহানবীর বয়স তখনও ৩৫ বছর অতিক্রম করে নি,ঠিক এ সময় কুরাইশদের মধ্যে তীব্র বিরোধ দেখা দেয়। মহানবীর দক্ষ হাতেই এ মহাবিরোধের নিষ্পত্তি হয়েছিল। এ ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় যে,মহানবী (সা.) আপামর জনতার কাছে তখন কত সম্মানের পাত্র ছিলেন! আর সবাই তাঁর বিশ্বস্ততা ও সত্যবাদিতায় আস্থাশীল ছিল। নিচে ঘটনাটির বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করা হলো :

একবার এক ভয়ঙ্কর বন্যার ঢল পবিত্র মক্কা নগরীর উঁচু উঁচু পাহাড় থেকে পবিত্র কাবার দিকে নেমে এসেছিল। যার ফলে মক্কা নগরীর কোন বাসগৃহ,এমনকি পবিত্র কাবাও অক্ষত থাকে নি। পবিত্র কাবার দেয়ালে বড় বড় ফাটল দেখা দেয়। কুরাইশরা পবিত্র কাবাগৃহ মেরামত করার সিদ্ধান্ত নেয়,তবে তারা তা (কাবার ক্ষতিগ্রস্ত দেয়াল) ভাঙতে ভয় পাচ্ছিল। ওয়ালীদ ইবনে মুগীরাই সর্বপ্রথম গাইতি হাতে নিয়ে কাবার দু টি স্তম্ভ ভেঙ্গে ফেলে। তখন এক অব্যক্ত ভীতি তার পুরো শরীরকে ঘিরে ধরেছিল। মক্কার লোকেরা (কাবাগৃহ ভেঙ্গে ফেলার কারণে) এক মারাত্মক অশুভ ঘটনা ঘটার অপেক্ষা করছিল। কিন্তু যখন তারা দেখতে পেল যে,ওয়ালীদ ইবনে মুগীরাহ্ মূর্তিসমূহের ক্রোধের শিকার হয় নি তখন তারা নিশ্চিত হলো যে,তার এ কাজে প্রতিমা ও মূর্তিগুলো অসন্তুষ্ট হয় নি। তাই পুরো কুরাইশ গোত্র পবিত্র কাবাগৃহ ভেঙ্গে পুনঃনির্মাণ করার কাজে অংশগ্রহণ করল। ঘটনাক্রমে ঐ দিনই এক রোমান ব্যবসায়ীর জাহাজ যা মিশর থেকে আসছিল তা মক্কার কাছে জেদ্দায় এক ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। কুরাইশগণ এ ঘটনা জানতে পেরে কয়েকজন লোককে ধ্বংসপ্রাপ্ত ঐ জাহাজের কাঠ কেনার জন্য জেদ্দায় প্রেরণ করে। আর পবিত্র কাবার কাঠের কাজ মক্কা নগরীতে বসবাসরত এক কিবতী কাঠমিস্ত্রীর হাতে সোপর্দ করা হয়। পবিত্র কাবার দেয়াল একজন মানুষের দেহের উচ্চতা সমান উঁচু করা হলে হজরে আসওয়াদ (কৃষ্ণ পাথর) যথাস্থানে স্থাপন করার সময় হয়ে যায়। এ সময় কুরাইশের শাখা গোত্রগুলোর গোত্রপতিদের মধ্যে তীব্র বিরোধ দেখা দেয় (কৃষ্ণ পাথরটি যথাস্থানে স্থাপন করাকে কেন্দ্র করে)। বনি আবদুর দার ও বনি আদী গোত্রদ্বয় পরস্পর চুক্তি ও প্রতিজ্ঞাই করে বসে যে,তারা অন্যদের এ বিরল মর্যাদার অধিকারী হতে দেবে না। তারা তাদের চুক্তি ও অঙ্গীকারকে আরো মজবুত করার জন্য একটি পাত্র রক্ত দিয়ে পূর্ণ করে তাতে তাদের হাত ডুবিয়ে রঞ্জিত করেছিল।

এ ঘটনার কারণে পাঁচ দিন কাবাগৃহের নির্মাণ কাজ স্থগিত থাকে। কুরাইশ গোত্রের অবস্থা অত্যন্ত সংকীর্ণ ও শোচনীয় হয়ে গিয়েছিল। কুরাইশগণ বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে মসজিদুল হারামে অবস্থান নিয়ে একটি ভয়াবহ রক্তপাতের আশংকায় প্রমাদ গুণতে থাকে। অবশেষে আবু উমাইয়্যাহ্ বিন মুগরীহ্ আল মাখযুমী নামক কুরাইশ বংশোদ্ভূত এক বৃদ্ধ লোক কুরাইশ গোত্রপতিদের একত্র করে প্রস্তাব করল যে,সাফার দরজা (কিছু কিছু ঐতিহাসিক বর্ণনায় সালাম দরজা) দিয়ে প্রথম যে ব্যক্তি প্রবেশ করবে তাকেই তারা তাদের এ বিরোধ নিষ্পত্তি করার জন্য মধ্যস্থতাকারী হিসাবে গ্রহণ করবে। ঐ বৃদ্ধের এ প্রস্তাব সবাই গ্রহণ করল। হঠাৎ মহানবী (সা.) ঐ দরজা দিয়ে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করলেন। তখন সবাই একসাথে বলে উঠল, এ ব্যক্তিই তো মুহাম্মদ যিনি সকলের আস্থাভাজন ও বিশ্বস্ত। আমরা তাঁর মধ্যস্থতা মেনে নিতে রাজী।” মহানবী (সা.) বিরোধ নিষ্পত্তি করার জন্য একটি কাপড় আনতে বললেন। কাপড় আনা হলে তিনি নিজ হাতে হাজারে আসওয়াদ ঐ কাপড়ের মাঝখানে বসালেন। এরপর তিনি মক্কার চার গোত্রপতিকে এ কাপড়ের চার প্রান্ত ধরতে বললেন। যখন হাজারে আসওয়াদকে স্তম্ভের কাছে বহন করে আনা হলো তখন মহানবী (সা.) তাঁর পবিত্র হাত দিয়ে তা যথাস্থানে রাখলেন। আর এভাবে তিনি কুরাইশদের ঝগড়া-বিবাদ সুন্দরভাবে মিটিয়ে দিলেন যা কুরাইশদের এক ভয়ঙ্কর রক্তপাতের দিকে ঠেলে দিয়েছিল।১৯৬

মহানবী হযরত আলীকে নিজ গৃহে নিয়ে আসেন

কোন এক বছর মক্কা ও এর আশেপাশের জায়গায় দুর্ভিক্ষ ও পানীয় জলের অভাব দেখা দিয়েছিল। মহানবী (সা.) সিদ্ধান্ত নিলেন যে,শ্রদ্ধেয় চাচা আবু তালিব (রা.)-এর কাছে তাঁকে সাহায্য করার প্রস্তাব দেবেন এবং এভাবে তিনি তাঁর যাবতীয় সাংসারিক খরচ ও ব্যয়ভার কমিয়ে আনবেন। তাই তিনি তাঁর আরেক চাচা আব্বাস-এর কাছে বিষয়টি উত্থাপন করলেন। সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে,তাঁদের প্রত্যেকেই আবু তালিবের এক-একজন সন্তানকে নিজেদের ঘরে নিয়ে প্রতিপালন করবেন। তাই মহানবী (সা.) আলীকে এবং আব্বাস জাফরকে নিজ নিজ গৃহে নিয়ে যান।

প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক আবুল ফারাজ ইসফাহানী লিখেছেন : আব্বাস তালিবকে,হামযাহ্ জাফরকে এবং মহানবী (সা.) আলীকে নিজ নিজ ঘরে নিয়ে গেলেন। তখন মহানবী বলেছিলেন : আমি তাকেই পছন্দ ও গ্রহণ করেছি যাকে মহান আল্লাহ্ আমার জন্য মনোনীত করেছেন। ১৯৭

যদিও দুর্ভিক্ষের সময় আবু তালিবকে সাহায্য করাই ছিল বাহ্যিক ব্যাপার,তবে চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল ভিন্ন একটি বিষয়। আর তা হলো মহানবীর ক্রোড়ে আলী (আ.)-এর প্রতিপালিত হওয়া এবং মহানবীর উন্নত চরিত্র তাঁর জীবনে বাস্তবায়ন করা।

আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) নাহজুল বালাগায় এ ব্যাপারে বলেছেন,

“তোমাদের সবাই মহানবীর সাথে আমার নিকট সম্পর্ক ও অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞাত আছ। তিনি আমাকে তাঁর ক্রোড়ে প্রতিপালন ও বড় করেছেন এবং যখন আমি ছোট ছিলাম তখন তিনি আমাকে তাঁর বুকে টেনে নিতেন এবং আমাকে তাঁর পাশে তাঁর বিছানায় শোয়াতেন। আমি তাঁর সুঘ্রাণ নিতাম এবং প্রতিদিন তাঁর চরিত্র থেকে এক একটি বিষয় শিক্ষাগ্রহণ করতাম। ১৯৮

নবুওয়াতের পূর্বে তাঁর ধর্ম

যে মুহূর্তে তিনি ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন তখন থেকে যে দিন তিনি মৃত্যুবরণ করলেন সে দিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন এক আল্লাহতে বিশ্বাসী। অর্থাৎ এক ইলাহ্ ব্যতীত আর কারো উপাসনা করেন নি। তাঁর অভিভাবকগণও,যেমন আবদুল মুত্তালিব ও আবু তালিব সবাই একত্ববাদী ছিলেন। আপনাদের হয়তো স্মরণ আছে যে,হাতি বাহিনীর আক্রমণকালে আবদুল মুত্তালিব পবিত্র কাবার কড়া ধরে নিজ স্রষ্টার সাথে একান্ত নিভৃতে একজন এক খোদায় বিশ্বাসীর ন্যায় প্রার্থনা করে বলেছিলেন, হে আল্লাহ্! একমাত্র তুমি ব্যতীত অন্য কারো প্রতি আমি আশা রাখি না...।”

ঠিক একইভাবে হযরত আবু তালিব (আ.) দুর্ভিক্ষ ও অনাবৃষ্টির সময় ভাতিজা হযরত মুহাম্মদকে নিয়ে ময়দানের দিকে যান এবং তাঁর উসীলায় আল্লাহর নামে শপথ করে বৃষ্টি প্রার্থনা করেন। এতৎসংক্রান্ত বেশ কিছু প্রসিদ্ধ কবিতাও আছে যা ইতিহাসের গ্রন্থাবলীতে বর্ণিত হয়েছে। এমনকি মহানবী বুসরার পুরোহিত বাহীরার সাথে আলাপকালে আরবের প্রসিদ্ধ সব প্রতিমার ব্যাপারে তাঁর ঘৃণা প্রকাশ করেছিলেন। যখন পুরোহিত বাহীরা তাঁর দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, লাত ও উয্যার শপথ,তোমাকে যা কিছু জিজ্ঞাসা করব আমাকে তার উত্তর দিবে”,তখন মহানবী তাঁকে তিরস্কার করে বলেছিলেন, আমার সামনে কখনই লাত ও উয্যার নামে শপথ করবেন না। এ পৃথিবীতে এতদুভয়ের উপাসনার ন্যায় আর কোন কিছুই আমার কাছে এত ঘৃণ্য নয়।” তখন বাহীরা বলেছিলেন, মহান আল্লাহর শপথ,আমি তোমাকে যা কিছু প্রশ্ন করব সে সম্পর্কে আমাকে অবগত করবে।” তখন মহানবী বলেছিলেন, আপনার যা ইচ্ছা তা আমাকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন। ১৯৯

এ সব কিছু থেকে প্রতীয়মান হয় যে,মহানবী (সা.) ও আবুদল মুত্তালিবের সন্তানগণ সবাই মহান আল্লাহর উপাসক এবং একত্ববাদী ছিলেন। আর তাঁর একত্ববাদী হবার সর্বোত্তম দলিল হচ্ছে হিরা গুহায় নবুওয়াতের আগে তাঁর নিভৃতে মহান আল্লাহর ইবাদাত ও ধ্যান। সীরাত রচয়িতাগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে,মহানবী (সা.) প্রতি বছর কয়েক মাস হিরা গুহায় মহান আল্লাহর ইবাদাত-বন্দেগী করতেন। এ ব্যাপারে আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) বলেছেন,

و لقد كان يُجاور في كلّ سنة بحراء فأراه و لا يراه غيره

“মহানবী প্রতি বছর হিরা গুহায় নিভৃতে অবস্থান করতেন;তাই কেবল আমিই (সেখানে) তাঁকে দেখতাম এবং অন্য কেউ তাঁকে দেখতে পেত না। ২০০

এমনকি যে দিন তিনি নবুওয়াতপ্রাপ্ত হলেন সে দিন তিনি হিরা গুহায় ইবাদাতে মশগুল ছিলেন।

আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) মহানবীর জীবনের এ অধ্যায় প্রসঙ্গে বলেছেন, যে দিন থেকে মহানবী (সা.) দুধপান করা থেকে বিরত হলেন সে দিন থেকে মহান আল্লাহ্ তাঁর শিক্ষা ও প্রতিপালনের জন্য সবচেয়ে বড় ফেরেশতাকে নিযুক্ত করেছিলেন এবং সে ফেরেশতাই দিবারাত্রি তাঁর দেখাশোনা করতেন এবং তাঁকে সুন্দর চরিত্র ও শিষ্টাচার শিক্ষা দিতেন। ২০১

সুতরাং এমন মহান পরিবারের মধ্যে প্রতিপালিত ব্যক্তি যিনি স্তন্যপান কালোত্তর সময় থেকে জগতের সবচেয়ে বড় ফেরেশতার তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষিত হয়েছেন তিনি অবশ্যই একত্ববাদী ছিলেন এবং মুহূর্তের জন্যও তিনি তাওহীদের পথ থেকে সামান্যতম বিচ্যুত হন নি।

এ ব্যাপারে আর কোন কথা নেই। তবে একটি বিষয়ে কথা আছে,আর তা হলো যে,তিনি এ সময় অর্থাৎ নবুওয়াতের ঘোষণা দেয়ার আগে কোন্ আসমানী ধর্ম অনুসরণ করতেন? তিনি কি হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর ধর্মের ওপর ছিলেন,না হযরত ঈসা মসীহর ধর্ম অথবা নিজ ধর্ম ও শরীয়তের ওপর বহাল ছিলেন? এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের অভিমত রয়েছে যে,এ ব্যাপারে আলোচনা করা আমাদের এ ক্ষুদ্র ও সীমিত পরিসরে সম্ভব নয়।২০২

হযরত ঈসা মসীর সাথে তুলনা

নিঃসন্দেহে সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সব দিক থেকেই অতীতের সকল নবী-রাসূলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আর কতিপয় নবী-রাসূলের ক্ষেত্রে পবিত্র কোরআন বলেছে, কিছু কিছু নবী শৈশবেই নবুওয়াতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং তাঁদের ওপর ঐশী গ্রন্থ অবতীর্ণ হয়েছিল।” যেমন হযরত ইয়াহ্ইয়া (আ.) সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের বক্তব্য নিম্নরূপ :

) يا يحيى خذ الكتاب بقوّة و آتيناه الحكم صبيّا(

“হে ইয়াহ্ইয়া! (খোদায়ী) শক্তির দ্বারা ঐশী গ্রন্থ দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধর এবং আমরা তাকে শৈশব অবস্থায় বিচার করার ক্ষমতা দিয়েছিলাম।”

যখন ঈসা ইবনে মরিয়ম দোলনায় ছিলেন তখন বনি ইসরাইলের নেতা ও গোত্রপতিগণ তাঁর মা মরিয়মকে চাপের মধ্যে রেখে তাঁর কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলেন যে,তিনি কিভাবে সন্তানের জননী হয়েছেন। হযরত মরিয়ম দোলনার দিকে নির্দেশ করে তাদের বুঝিয়ে দিলেন যেন তারা তাদের প্রশ্নের উত্তর দোলনায় শায়িত নবজাতক শিশু ঈসার কাছ থেকে জেনে নেয়। নবজাতক শিশু হযরত ঈসা (আ.) প্রাঞ্জল ও বলিষ্ঠ ভাষায় তাদেরকে সম্বোধন করে বলেছিলেন,

) إنّي عبد الله آتاني الكتاب و جعلني نبيّا، و جعلني مباركا أينما كنت و أوصاني بالصّلوة و الزّكوة ما دمت حيّا(

  আমি মহান আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে ঐশী গ্রন্থ দিয়েছেন,আমাকে নবী করেছেন এবং আমি যেখানেই থাকি না কেন তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন এবং যে পর্যন্ত আমি জীবিত আছি তত দিন পর্যন্ত তিনি আমাকে নামায পড়তে ও যাকাত আদায় করতে নির্দেশ দিয়েছেন।” (সূরা মরিয়ম : ৩১)

হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম তাঁর ধর্মের যাবতীয় মৌল ও শাখাগত বিষয় একদম সেই শৈশব ও মাতৃস্তন্য পানকালীন সময় জনতার কাছে স্পষ্ট করে ব্যক্ত করেছেন এবং তাদের কাছে তিনি যে তাওহীদের অনুসারী এবং মহান আল্লাহর দাস তা প্রকাশ্যে বলে দিয়েছেন। এখন আমরা আপনাদের বিবেককে সাক্ষী হিসাবে গ্রহণ করছি। আপনারাই বিচার করুন যেখানে ইয়াহ্ইয়া (আ.) ও ঈসা (আ.) শৈশব ও মাতৃস্তন্য পানকালীন সময় থেকেই আন্তরিকভাবে মুমিন (বিশ্বাসী) ছিলেন এবং তাঁদের মুখে বাস্তব মানবপ্রকৃতি বা স্বভাবধর্ম ঐ অতটুকু বয়সেই উচ্চারিত হয়েছে সেখানে আমরা কি বলতে পারি যে,বিশ্বাসীদের একমাত্র নেতা ও বিশ্বের সর্বোত্তম মানব ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত মুমিন ছিলেন না,অথচ তিনিই হিরা গুহায় ওহী অবতীর্ণ হওয়ার সময় মহান আল্লাহর ইবাদাত-বন্দেগী ও প্রার্থনায় রত ছিলেন!

ইরান : তদানীন্তন সভ্যতার লালনভূমি

যে কারণে আমরা রোমান সাম্রাজ্যের সার্বিক অবস্থা অধ্যয়ন করেছি সে একই কারণে আমরা সে সময়ের ইরানের সার্বিক পরিস্থিতি সম্মানিত পাঠকবর্গের সামনে তুলে ধরব। তবে এ বিষয়টির দিকেও দৃষ্টিপাত করা আবশ্যক যে,আমরা যদি আমাদের পূর্বপুরুষদের দেশের দুর্বল দিকগুলো বর্ণনা করে থাকি,তাহলে কেবল সত্য বিশ্লেষণ এবং ইসলাম ধর্মের সুমহান শিক্ষা ও আদর্শের প্রকৃত তাৎপর্য অনুধাবন করা ব্যতীত আমাদের আর কোন উদ্দেশ্য নেই। জাতীয় গর্ব ও স্বদেশপ্রেম যেন অবশ্যই আমাদের বাস্তববাদী হওয়া থেকে বিরত রাখতে না পারে। আমরা দেশকে ভালোবাসার পাশাপাশি পবিত্র ইসলাম ধর্মের অভ্যুদয়ের সমসাময়িক যে দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার ইরানে রাজত্ব করত তা বর্ণনা করতে,বাস্তবকে মেনে নিতে এবং (তদানীন্তন ইরানী সমাজে প্রচলিত) কুসংস্কারাচ্ছন্ন আকীদা-বিশ্বাস ব্যাখ্যা করার ব্যাপারে কোন কিছু পরোয়া করি না। অ্যারিস্টটল তাঁর শিক্ষক প্লেটোর সাথে তাঁর মতবিরোধ প্রসঙ্গে যা বলেছিলেন তা-ই পুনরাবৃত্তি করছি। তিনি তাঁর এ মতপার্থক্যের ব্যাপারে এভাবে একটি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন: আমি প্লেটোকে ভালোবাসি। তবে সত্যকে তার চেয়েও বেশি ভালোবাসি।”

সে যুগের ইরানী সরকার ও প্রশাসনের প্রধান দুর্বল দিকটি ছিল স্বৈরাচারী একনায়ক সরকার। নিঃসন্দেহে ব্যক্তিবিশেষের বিবেক-বুদ্ধি ও তাকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করা এবং একটি সংঘ বা দলের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করা মোটেও এক নয়। সামষ্টিক অর্থাৎ জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার ও প্রশাসনের মধ্যে ষড়যন্ত্র,পেশী প্রদর্শন ও জোর খাটানো অপেক্ষাকৃত কমই হয়ে থাকে। এ কারণেই ইরানীদের মহত্ত্ব,নেতৃত্ব অথবা দুর্বলতা ও অপদস্থ হওয়ার বিষয়টি তাদের কর্তৃত্বশীল একনায়কতন্ত্রের দুর্বলতা অথবা সামর্থ্যরে সাথে পূর্ণরূপে জড়িত। সাসানী সরকার ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা সংক্রান্ত আলোচনা ও অধ্যয়ন এবং তাদের প্রশাসনের ছায়ায় যে সব অস্থিতিশীলতার উদ্ভব হয়েছে সেগুলো আমাদের এ বক্তব্যের জীবন্ত দলিল।

ইসলামের আবির্ভাবকালে ইরানের সার্বিক অবস্থা

ইসলামের আবির্ভাব এবং 611 খ্রিষ্টাব্দে মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াতপ্রাপ্তি পারস্য সম্রাট খসরু পারভেজের (590-628 খ্রি.) শাসনামলের সমসাময়িক ঘটনা ছিল। মহানবী (সা.) সম্রাট খসরু পারভেজের রাজত্বকালেই মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেছিলেন। (সে দিনটি ছিল শুক্রবার,16 জুলাই,622 খ্রি.)। আর এ তারিখ অর্থাৎ মহানবীর হিজরত দিবস থেকেই মুসলমানদের সন ও তারিখ গণনা শুরু হয়েছিল।

দু টি বৃহৎ পরাশক্তি (প্রাচ্যের রোমান সাম্রাজ্য ও সাসানীয় পারস্য সাম্রাজ্য) ঐ সময়ের সভ্য দুনিয়ার বেশিরভাগ অংশ শাসন করত। সুদূর প্রাচীনকাল থেকে এ দু টি সাম্রাজ্য সমগ্র বিশ্বে শাসনকর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য একে অপরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতো।

পারস্য সম্রাট আনুশীরওয়ান (নওশেরওয়ান) [531-589 খ্রি.]-এর রাজত্বকাল থেকে রোমানদের সাথে ইরানীদের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ শুরু হয় এবং তা খসরু পারভেজের রাজত্বকাল পর্যন্ত দীর্ঘ 24 বছর স্থায়ী হয়েছিল।

পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্যদ্বয় এ দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে যে বিপুল সম্পদ ব্যয় করেছিল এবং ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল সে কারণে উক্ত সাম্রাজ্যদ্বয়ের সরকার ও প্রশাসন কার্যত পঙ্গু ও অচল হয়ে গিয়েছিল;আসলে খোলস ছাড়া এ পরাশক্তিদ্বয়ের আর কিছুই তখন অবশিষ্ট ছিল না।

বিভিন্ন দিক ও প্রেক্ষাপট থেকে ইরানের সার্বিক অবস্থা ও পরিস্থিতি আলোচনা করতে হলে সম্রাট আনুশীরওয়ানের রাজত্বকালের শেষভাগ থেকে মুসলমানদের আগমন ও পারস্যবিজয় পর্যন্ত সে দেশের সরকার ও প্রশাসনের অবস্থা আমরা আলোচনা করব।

সাসানী শাসনামলে জৌলুস ও বিলাসিতা

সাসানী সম্রাটগণ সাধারণত বিলাসী ও আনুষ্ঠানিকতাপ্রিয় ছিলেন। সাসানী সম্রাটদের জাঁকজমকপূর্ণ শাহী দরবার এবং এর জৌলুস দর্শনার্থীদের চোখ ঝলসে দিত।

সাসানী শাসনামলে দারাফশেশে কভীয়নী’নামে ইরানীদের একটি পতাকা ছিল যা সাধারণত যুদ্ধক্ষেত্রে অথবা সাসানীয়দের অতিরিক্ত আনুষ্ঠানিকতাপূর্ণ উৎসবসমূহের সময় রাজকীয় প্রাসাদসমূহে উত্তোলন করা হতো। পতাকাটি মূল্যবান মণিমুক্তা ও হীরা-জহরত দ্বারা সুশোভিত করা হতো। একজন লেখকের বক্তব্য অনুযায়ী,এ পতাকাটির মূল্যবান মণিমুক্তা ও হীরা-জহরত আসলেই অদ্বিতীয় ছিল যার মূল্য 12,00,000 দিরহাম অর্থাৎ 30,000 পাউন্ড।59

সাসানীদের কল্পকাহিনীর মতো জমকালো প্রাসাদসমূহে বিপুল সংখ্যক মূল্যবান দ্রব্য-সামগ্রী,হীরা-জহরত,মণিমুক্তা এবং বিস্ময়কর চিত্রকলা ও ছবির সংগ্রহ ছিল যা দর্শনার্থীদের বিস্ময়াভিভূত করত। আমরা যদি এ সব শাহী প্রাসাদের বিস্ময়কর বিষয়াদি জানতে চাই তাহলে কেবল একটি বৃহদাকার সাদা কার্পেটের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেই চলবে যা একটি (সাসানী) রাজপ্রাসাদে বিছিয়ে রাখা হয়েছিল। উক্ত কার্পেটের নাম ছিল বাহারিস্তানে কিসরা’অর্থাৎ সম্রাট কিসরা বা খসরুর বসন্তবাগান। সাসানী শাসকবর্গ এ কার্পেটটি এ কারণে তৈরি করিয়েছিলেন যাতে করে তাঁরা আমোদ-প্রমোদ করার সময় হর্ষোৎফুল্ল থাকতে পারেন এবং সর্বদা বসন্ত ঋতুর সুন্দর ও আনন্দদায়ক দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন।60

বর্ণনামতে এ কার্পেটের দৈর্ঘ্য ছিল 150 হাত এবং প্রস্থ 70 হাত;আর এর সমস্ত সুতা স্বর্ণ,হীরা-মুক্তা ও জহরত খচিত ছিল।61

সাসানী সম্রাটদের মধ্যে সম্রাট খসরু পারভেজই অন্য সকল সম্রাটের চেয়ে বেশি জাঁকজমক,বিলাসিতা ও জৌলুসপ্রিয় ছিলেন। তাঁর শাহী হেরেমে নারী,দাসী,গায়িকা ও নর্তকীদের সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

হামযাহ্ ইসফাহানী সানা মুলূকিল আরদ’গ্রন্থে সম্রাট খসরু পারভেজের শান-শওকত,জৌলুস ও বিলাসিতা ঠিক এভাবে বর্ণনা করেছেন :

পারস্য সম্রাট খসরু পারভেজের তিন হাজার স্ত্রী,12000 গায়িকা দাসী,6000 দেহরক্ষী পুরুষ সৈনিক,8500টি সওয়ারী ঘোড়া,960টি হাতী,মালপত্র বহন করার জন্য 12000টি গাধা এবং 1000টি উট ছিল।62

এরপর তাবারী আরো বলেছেন,এ সম্রাট অন্য সকলের চেয়ে বেশি মনিমুক্তা,হীরা-জহরত এবং মূল্যবান তৈজসপত্রের প্রতি আগ্রহ প্রদর্শন করতেন।63

ইরানের সামাজিক অবস্থা

সাসানী যুগে ইরানের সামাজিক অবস্থা সে দেশের দরবার ও রাজনৈতিক অবস্থার চেয়ে কোনভাবেই ভালো ছিল না। শ্রেণীশাসন ও শোষণ যা সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই ইরানে বিদ্যমান ছিল তা সাসানীদের যুগে সবচেয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করে।

অভিজাত ও পুরোহিতশ্রেণী অন্যান্য শ্রেণী অপেক্ষা অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত শ্রেণী বলে বিবেচিত হতো। সকল ধরনের সামাজিক সংবেদনশীল পদ ও পেশা তাদেরই করায়ত্তে ছিল। পেশাজীবী ও কৃষকগণ সকল প্রকার ন্যায্য অধিকারভিত্তিক ও সামাজিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল। কেবল কর প্রদান এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা ব্যতীত তাদের অন্য কোন পেশাই ছিল না।

সাসানীদের শ্রেণীবৈষম্যের বিষয়ে নাফীসী লিখেছেন :

“যে বিষয়টি ইরানী জনগণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কপটতার প্রসার ও প্রচলন করেছিল তা ছিল অতি নিষ্ঠুর শ্রেণীবৈষম্য যা সাসানীরা ইরানে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। আর শ্রেণীবৈষম্যের মূল পূর্বতন সভ্যতাসমূহের মাঝেই নিহিত ছিল। কিন্তু সাসানীদের যুগে কঠোরতা আরোপের বিষয়টি চরমভাবে বৃদ্ধি পায়।

পারস্য সমাজে প্রথম স্থানে অবস্থানকারী সাত অভিজাত বংশ এবং তাদের পর পাঁচটি শ্রেণী এমন সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত যা থেকে সাধারণ জনগণ বঞ্চিত ছিল। মালিকানা ও স্বত্বাধিকার প্রায় ঐ সাত পরিবার বা বংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সাসানী ইরানের জনসংখ্যা ছিল 140 মিলিয়ন (14 কোটি)। ঐ সাত বংশের প্রতিটির লোকসংখ্যা যদি এক লক্ষও ধরি তাহলে ঐ সাত বংশের সম্মিলিত লোকসংখ্যা 7,00,000 হবে। আর সৈন্য-সামন্ত এবং জমিদারশ্রেণী যাদেরও কিছুটা মালিকানা স্বীকৃত ছিল তাদের সংখ্যাও যদি আমরা 7,00,000 বলে অনুমান করি তাহলে এ চৌদ্দ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় 15,00,000 ব্যক্তির মালিকানা ছিল এবং বাকী জনগণ স্রষ্টাপ্রদত্ত এই স্বাভাবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল।64

পেশাজীবী ও কৃষিজীবিগণ যারা সকল প্রকার অধিকার সংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল,কিন্তু অভিজাতশ্রেণীর তাবৎ ব্যয়ভার যাদের স্কন্ধে অর্পিত হয়েছিল তারা এ অবস্থা বজায় রাখার ক্ষেত্রে নিজেদের কোন স্বার্থ বা লাভের কথা চিন্তাও করতে পারত না। এ কারণেই অধিকাংশ কৃষিজীবী এবং সমাজের নিম্নশ্রেণীর লোক নিজেদের পেশা ত্যাগ করে অসহনীয় কর থেকে বাঁচার জন্য মঠ অর্থাৎ সন্ন্যাসীদের আস্তানায় আশ্রয়গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল।65

‘সাসানীদের যুগে ইরান’নামক গ্রন্থের লেখক ইরানের কৃষিজীবী ও শ্রমিকশ্রেণীর দুর্ভাগ্য সম্পর্কে লিখেছেন : এমিয়ান মার্সেলিনোস নামক পাশ্চাত্যের এক ঐতিহাসিকের বাণী এভাবে উদ্ধৃত হয়েছে : ইরানের কৃষিজীবী ও শ্রমিকশ্রেণী সাসানীদের যুগে চরম দীনতা ও দুর্ভাগ্যের মধ্যে দুর্বিষহ জীবনযাপন করত। তারা যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর পেছনে পায়ে হেঁটে যাত্রা করত। তাদেরকে এমনভাবে মর্যাদাহীন বলে গণ্য করা হতো যেন তাদের ললাটে চিরকালের জন্য দাসত্ব লিখে দেয়া হয়েছে। তারা তাদের শ্রমের বিনিময়ে কোন মজুরি লাভ করত না।”66

সাসানী সাম্রাজ্যের একটি মুষ্টিমেয় শ্রেণী যারা জনসংখ্যায় শতকরা 1.5 ভাগের কম ছিল তারাই সব কিছুর অধিকারী ছিল। কিন্তু ইরানের জনসংখ্যার শতকরা 98 ভাগের বেশি দাসশ্রেণীর মতো জীবনের সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল।

অভিজাতশ্রেণীই শিক্ষাগ্রহণের অধিকার রাখত

সাসানী যুগে কেবল অভিজাত ও উচ্চ পদমর্যাদাসম্পন্ন শিশুরাই বিদ্যার্জন করার অধিকার রাখত। সাধারণ জনতা ও সমাজের মধ্যবিত্তশ্রেণী শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ছিল।

প্রাচীন ইরানের সংস্কৃতিতে সবচেয়ে বড় এ ত্রুটি এতটা প্রকট ছিল যে,এমনকি শাহনামা’ও রাজা-বাদশাদের উপাখ্যান রচয়িতাগণ যাঁদের একমাত্র লক্ষ্যই হচ্ছে বীরত্বগাথা রচনা করা তাঁরাও এ বিষয়টি স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন।

ইরানের বীরত্বগাথা রচয়িতা কবি ফেরদৌসী শাহনামা য় একটি কাহিনী বর্ণনা করেছেন যা এ বিষয়টির সর্বোত্তম সাক্ষ্য-প্রমাণ। কাহিনীটি সম্রাট আনুশীরওয়ানের শাসনামল অর্থাৎ যখন সাসানী সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ তখন সংঘটিত হয়েছিল। এ কাহিনী থেকে প্রমাণিত হয়ে যায় যে,তাঁর শাসনামলে প্রায় সকল অধিবাসীরই শিক্ষা ও বিদ্যার্জন করার অধিকার ছিল না,এমনকি জ্ঞানপ্রেমিক সম্রাট আনুশীরওয়ানও অন্যান্য শ্রেণীর জনসাধারণকে জ্ঞানার্জনের অধিকার দিতে প্রস্তুত ছিলেন না।

ফেরদৌসী লিখেছেন : ইরান ও রোমের যুদ্ধের ব্যয়ভার মেটানোর জন্য একজন জুতা নির্মাতা (মুচি) তার স্বর্ণ ও রূপার ভাণ্ডার দান করতে চেয়েছিল। সে সময় সম্রাট আনুশীরওয়ান আর্থিক সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতার তীব্র মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছিলেন। কারণ ইরানের প্রায় তিন লক্ষ সৈন্য তখন তীব্র খাদ্য ও অস্ত্র সংকটের মুখোমুখি হয়ে পড়েছিল। সম্রাট আনুশীরওয়ান এ অবস্থার কারণে খুবই উদ্বিগ্ন এবং তাঁর নিজ পরিণতি সম্পর্কেও শঙ্কিত হয়ে পড়েন। সম্রাট তাৎক্ষণিকভাবে জ্ঞানী প্রধানমন্ত্রী বুযুর্গমেহেরকে সংকট থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় খুঁজে বের করার জন্য ডেকে পাঠিয়ে নির্দেশ দেন যেন তিনি মাযেনদারান গমন করে যুদ্ধের খরচের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করেন। কিন্তু বুযুর্গমেহের সম্রাটকে বললেন, বিপদ অত্যাসন্ন। তাই তাৎক্ষণিকভাবে একটি উপায় খুঁজে বের করা আবশ্যক।” তখন বুযুর্গমেহের জাতীয় ঋণ’অর্থাৎ জাতির কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করার পরামর্শ দিলেন। সম্রাট আনুশীরওয়ানও তাঁর এ প্রস্তাবটি পছন্দ করলেন এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ ক্ষেত্রে বাস্তব পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশও জারী করলেন। বুযুর্গমেহের নিকটবর্তী শহর,গ্রাম ও জনপদে রাজকীয় কর্মকর্তাদের প্রেরণ করে ঐ সকল স্থানের সচ্ছল ব্যক্তিদের আসন্ন বিপদ সম্পর্কে অবগত করলেন।

তখন একজন জুতা নির্মাতা যুদ্ধের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করতে প্রস্তুত হয়ে যায়। তবে এ ক্ষেত্রে সে যা চেয়েছিল তা হলো : এর বিনিময়ে তার একমাত্র পুত্রসন্তান যে লেখাপড়া শিখতে অত্যন্ত আগ্রহী তাকে যেন লেখাপড়া শেখার অনুমতি দেয়া হয়। বুযুর্গমেহের ঐ মুচির আবেদনকে তার দানের তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য বলে মনে করেন এবং সম্রাটের কাছে ফিরে গিয়ে তার আর্জি সম্পর্কে সম্রাটকে অবহিত করেন। আনুশীরওয়ান এ কথা শুনে খুব রেগে যান এবং প্রধানমন্ত্রী বুযুর্গমেহেরকে তিরস্কার করে বলেন, তুমি এ কেমন আবেদন করছ? এ কাজ কল্যাণকর নয়। কারণ যে শ্রেণীবিন্যাসের আওতায় সে রয়েছে তা থেকে তার বের হয়ে আসার মাধ্যমে দেশের শ্রেণীপ্রথা ধসে পড়বে এবং তখন সে যে স্বর্ণ ও রৌপ্য দান করছে তার মূল্যমান অপেক্ষা তার এ আর্জি অনেক বেশি ক্ষতি বয়ে আনবে।”

এরপর ফেরদৌসী সম্রাট আনুশীরওয়ানের কণ্ঠে তাঁর (সম্রাটের) মেকিয়াভ্যালি দর্শন’ব্যাখ্যা করেছেন:

বণিকপুত্র যদি হয় সচিব

গুণী,জ্ঞানী ও শিক্ষানবীশ

তাই যখন বসবে মোদের যুবরাজ সিংহাসন পরি

অবশ্যই পাবে সে তখন এক (দক্ষ ও গুণী) ভাগ্যমান সহকারী

আর কভু যদি মোজা বিক্রেতা করে এ গুণ ও জ্ঞান অর্জন

এ জ্ঞান দেবে তারে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন চক্ষু

আর নীচ বংশজাত জ্ঞানীকে দেবে অনুধাবনকারী কর্ণ

ব্যস্,তখন পরিতাপ ও শীতল বায়ু ছাড়া রইবে না আর কিছু।

এভাবেই ন্যায়পরায়ণ (!) বাদশার নির্দেশে জুতা নির্মাতা লোকটির টাকা-পয়সা ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়। ঐ হতভাগা জুতা নির্মাতা তীব্র মনঃকষ্ট পায় এবং সে রাতের বেলা ন্যায়বিচারক স্রষ্টার দরবারে দু হাত উঠিয়ে এ ধরনের অত্যাচার ও ন্যায্য অধিকার হরণের বিরুদ্ধে প্রার্থনা করে-যা হচ্ছে মজলুমদেরই রীতি। আর এভাবে সে মহান আল্লাহর ন্যায়বিচারের ঘণ্টা ধ্বনিত করে।

প্রেরিত দূত ফিরে আসল এবং ঐ দিরহামগুলো দেখতে পেয়ে

ঐ মুচির অন্তর হলো তীব্র দুঃখভারাক্রান্ত

রাত হলে শাহের কথায় হলো সে দুঃখভারাক্রান্ত

মহান আল্লাহর দরবারে সে চাইল ঐশী আদালতের ঘণ্টাধ্বনি ধ্বনিত হোক। 67

এত কিছু সত্ত্বেও সম্রাট আনুশীরওয়ানের বিশাল প্রচারমাধ্যম ও প্রশাসন তাঁকে ন্যায়পরায়ণ বলে আখ্যায়িত করতে এবং ইরানী সমাজকে এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। কিন্তু তথাকথিত ন্যায়পরায়ণ এ শাহ তদানীন্তন ইরানী সমাজের মৌলিক সমস্যার জট খুলতে তো সক্ষম হননি;বরং ইরানীদের প্রভূত সামাজিক সমস্যার কারণও হয়েছিলেন। কেবল মাযদাক গোলযোগের ঘটনায় আশি হাজার এবং অপর একটি অভিমত অনুযায়ী এক লক্ষ ইরানীকে জীবন্ত মাটিতে পুঁতে হত্যা করা হয়েছিল। তিনি ধারণা করেছিলেন যে,উক্ত ফিতনা পুরোপুরি নির্মূল হয়ে গেছে।68 অথচ এ ফিতনা যে মূলোৎপাটিত হয় নি তা তিনি মোটেও উপলব্ধি করতে পারেন নি। এ ধরনের শাস্তি আসলে ফলাফলের অস্তিত্ব নিশ্চি‎‎ হ্ন করে দেয়,তা কারণের অস্তিত্ব বিলোপ করে না। এ হচ্ছে পাপীদের বিরুদ্ধে তথাকথিত সংগ্রাম-পাপ ও অপরাধের বিরুদ্ধে নয়। ফিতনার মূল কারণই ছিল সমাজে ভারসাম্যহীনতা,শ্রেণীবৈষম্য,দ্বন্দ্ব,বিশেষ একটি শ্রেণী কর্তৃক সম্পদ ও পদমর্যাদা কুক্ষিগতকরণ,নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দারিদ্র্য ও বঞ্চনা এবং অপরাপর দুর্নীতি ও অপরাধ। আর সম্রাট আনুশীরওয়ান অস্ত্র বল ও চাপ প্রয়োগ করে চাইতেন যে,জনগণ সন্তুষ্টি প্রকাশ করুক।

এডওয়ার্ড ব্রাউন সম্রাট আনুশীরওয়ানের ন্যায়পরায়ণতা সম্পর্কে লিখেছেন : সম্রাট আনুশীরওয়ান নাস্তিকদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন এবং এ কারণে তিনি যারথুস্ত্রীয় (যারদোশ্ত) ধর্মযাজকদের প্রশংসা ও সম্মতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর ঐ সব ধর্মযাজকের হাতেই জাতীয় ইতিহাস রচিত হয়েছে...।”69   এ সব আনুষ্ঠানিক স্বীকৃত ইতিহাসে সম্রাট আনুশিরওয়ানকে ন্যায়পরায়ণতা ও মানবতার পূর্ণ আদর্শ এক সম্রাট হিসাবে পরিচিত করানো হয়েছে। এ ব্যাপারে অনেক কাহিনীও রচনা করা হয়েছে।

খুবই আশ্চর্যজনক! এ দীর্ঘ সময় একমাত্র একটি বৃদ্ধ গাধা ব্যতীত আর কোন মজলুমই ন্যায়বিচারের ঘণ্টা বাজায় নি,অবশ্য এটিও জ্ঞাত বিষয় যে,ঐ গাধাটি তার নিজের সাহসের অপরাধের কথা জানত না;আর যদি সে তা জানত তাহলে সে ঘুণাক্ষরেও ন্যায়পরায়ণতার রজ্জুর নিকটবর্তী হতো না!!

আরো বলা হয় যে,একবার রোমের বাদশাহ্,আজম অর্থাৎ ইরানের বাদশাহ্ আনুশীরওয়ানের কাছে এক দূত প্রেরণ করেছিলেন। যখন ঐ দূত ইরানের বাদশার শানশওকত এবং বিশাল তাক-ই কিসরা প্রত্যক্ষ করলেন তখন তিনি দেখতে পেলেন যে,ইরানের বাদশাহ্ সিংহাসনে উপবিষ্ট;আর রাজারা তাঁর দরবারে উপস্থিত। তিনি এক ঝলক দৃষ্টি শাহী দ্বারমণ্ডপের ওপর নিবদ্ধ করলে উক্ত দ্বারমণ্ডপটি তাঁর দৃষ্টিতে খুবই জমকালো ও জাঁকজমকপূর্ণ বলে মনে হয়। কিন্তু ঐ দ্বারমণ্ডপের চারপাশ যেন একটু বাঁকা। দূত তখন দরবারে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তাঁরা তাঁকে বলেছিলেন : দ্বারমণ্ডপে যে সামান্য বক্রতা আপনি দেখতে পাচ্ছেন আসলে এর কারণ হচ্ছে এখানে এক বৃদ্ধার ঘর ছিল যা বাদশাহ্ কিনে নিয়ে দ্বারমণ্ডপের অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ঐ বৃদ্ধা তার ঘর বিক্রি করতে রাজী না হওয়ায় বাদশাহ্ আনুশীরওয়ানও তাকে বিক্রি করতে বাধ্য করেন নি। তাই ঐ বৃদ্ধার বাড়িটিই অবশেষে এ দ্বারমণ্ডপটির বক্রতার কারণ হয়েছে। তখন ঐ দূত শপথ করে বললেন যে,দ্বারমণ্ডপের এই বক্রতা আসলে এর সরল ও অবক্র হওয়া অপেক্ষা শ্রেয়।70

এটি আশ্চর্যজনক যে,এ ধরনের জাঁকজমকপূর্ণ ভবন ও দ্বারমণ্ডপ যে ব্যক্তি নির্মাণ করতে ইচ্ছুক তিনি কি পূর্ব থেকেই এর নকশা সংগ্রহ করবেন না এবং নকশা ও পর্যাপ্ত পরিমাণ ভূমি ব্যতীতই কেউ কি এ ধরনের ভবন ও স্থাপনা নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে! আর এর ফলে শাহী প্রাসাদ বাঁকা হবে। এ কি কখনো বিশ্বাস করা যায়?

আসলে এ ধরনের গালগল্প সম্রাটের দরবারের ব্যক্তিবর্গ ও যারথুস্ত্রীয় ধর্মযাজকগণ,মাযদাকী মতাবলম্বীদের দমন করে সম্রাট তাঁদের স্বার্থে যে মহামূল্যবান খেদমত আঞ্জাম দিয়েছিলেন সে কারণেই তাঁরা সম্রাটের অনুকূলেই রচনা করে থাকতে পারেন।

‘ইরান ও ইসলাম’গ্রন্থের লেখকের অভিমত অনুসারে এ সব কিছুর চেয়েও আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে এই যে,কেউ কেউ সম্রাট আনুশীরওয়ানের ন্যায়পরায়ণতাকে শারয়ী ও নির্ভরযোগ্য বলে প্রমাণ করার জন্য এ ক্ষেত্রে মহানবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের সূত্র থেকেও হাদীস বর্ণনা করতে বাধ্য হয়েছে। যেমন :ولدت في زمن الملك العادل আমি ন্যায়পরায়ণ বাদশার রাজত্বকালে জন্মগ্রহণ করেছি।”-প্রসিদ্ধ এ হাদীসটি। মহানবী (সা.) যেন এ কথা বলতে গর্ববোধ করতেন যে,তিনি ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ্ আনুশীরওয়ানের শাসনামলে জন্মগ্রহণ করেছেন,অথচ মহানবীর সাথে তাঁর (বাদশার) ন্যায়পরায়ণতার কি কোন সম্পর্ক আছে?

অপর একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী মাদায়েনে এসে কিসরার প্রাসাদে গমন করলেন। সেখানে তিনি আনুশীরওয়ানকে জীবিত করে তাঁর অবস্থা জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি তখন হযরত আলীকে বলেছিলেন যে,কুফ্রী করার কারণে তিনি বেহেশত থেকে বঞ্চিত হয়েছেন,তবে ন্যায়পরায়ণ হবার কারণে জাহান্নামে শাস্তিপ্রাপ্তও হচ্ছেন না।71 এখন আমরা পর্যালোচনা করব যে,সাসানীরা কি ধরনের অত্যাচার করেছে।

খসরু পারভেজের অপরাধসমূহের পর্দা উন্মোচন

সম্রাট খসরু পারভেজের অত্যাচারমূলক ও পাগলামিপূর্ণ আরেকটি কাজ ছিল প্রসিদ্ধ বুযুর্গমেহেরের সাথে তাঁর আচরণ। এ বুযুর্গমেহের আনুশীরওয়ানের দরবারে 13 বছর কর্মরত ছিলেন এবং তিনি প্রভূত যশ ও খ্যাতির অধিকারী হয়েছিলেন। অবশেষে সম্রাট খসরু পারভেজ তাঁকে বন্দী করে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। সম্রাট কারাগারে বন্দী বুযুর্গমেহেরের কাছে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন : তোমার জ্ঞান,বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতা অবশেষে তোমারই নিহত হবার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে।” বুযুর্গমেহেরও উত্তরে লিখেছিলেন : যে পর্যন্ত ভাগ্য আমার প্রতি প্রসন্ন ছিল সে পর্যন্ত আমি আমার বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়েছি। এখন যখন ভাগ্য আমার অনুকূলে নেই তখন আমার ধৈর্য ও সহ্যশক্তিকে কাজে লাগাব। আমার হাত দিয়ে যদি অগণিত সৎকর্মসম্পন্ন হয়ে থাকে তাহলে আমি আমার মন্দ কাজ থেকেও নিরাপদ ও নিশ্চিত হয়েছি। আমার কাছ থেকে মন্ত্রিত্ব পদ কেড়ে নেয়া হলেও আমা থেকে ঐ পদের অসংখ্য অন্যায় ও অত্যাচারের দুঃখ-কষ্টও দূর করা হয়েছে। অতএব,আমার আর ভয় কিসে?

যখন সম্রাট খসরু পারভেজের হাতে বুযুর্গমেহেরের উক্ত চিঠি পৌঁছালো তখন সম্রাট বুযুর্গমেহেরের নাক ও ঠোঁট কেটে ফেলার আদেশ দিলেন। যখন বুযুর্গমেহেরকে সম্রাটের এ আদেশ শুনানো হলো তখন তিনি উত্তরে বলেছিলেন : আমার ঠোঁট এর চেয়ে আরোও বেশি শাস্তি পাওয়ার যোগ্য।” সম্রাট খসরু পারভেজ তখন জিজ্ঞাসা করলেন : কি কারণে? বুযুর্গমেহের তখন বললেন : যেহেতু আপামর জনতার কাছে তোমার এমন সব গুণের প্রশংসা করেছি যা তোমার ছিল না এবং অসন্তুষ্ট অন্তঃকরণসমূহকে তোমার প্রতি আকৃষ্ট করেছিলাম। আমি তোমার এমন সব ভালো কাজ ও পুণ্যের কথা জনগণের মধ্যে প্রচার করেছি যার উপযুক্ত তুমি ছিলে না। হে নিকৃষ্ট অসৎকর্মশীল সম্রাট! যদিও আমার সততার ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত এতদ্সত্ত্বেও আমাকে কুধারণার বশবর্তী হয়ে হত্যা করছ? অতএব,তোমার কাছে সুবিচার আশা করা এবং তোমার কথায় ভরসা করা যায় কি?

সম্রাট খসরু পারভেজ বুযুর্গমেহেরের কথায় খুবই উত্তেজিত হয়ে তাঁর শিরচ্ছেদ করার আদেশ দিলেন।72

‘ইরানের সামাজিক ইতিহাস’গ্রন্থের রচয়িতা-যিনি জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রবক্তা সাসানী যুগের অরাজকতা,অধঃপতিত অবস্থা ও উত্তেজনাকর পরিস্থিতির কারণসমূহ বর্ণনা করতে গিয়ে কেবল দেশের অভিজাতশ্রেণীর জন্য শিক্ষাগ্রহণের অধিকার ও সুযোগ সীমিত থাকার বিষয়টি এভাবে চিত্রিত করেছেন :

“এ যুগে তখনকার প্রচলিত সকল জ্ঞান ও শাস্ত্র অধ্যয়ন এবং শিক্ষা কেবল পুরোহিত,যাজক ও অভিজাতশ্রেণীর সন্তানগণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল;আর ইরানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল।”73

হ্যাঁ,এ জাহেলী প্রথা সাসানী সম্রাটদের দৃষ্টিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হতো। আর তাঁরা কোনভাবেই এ বিষয়টি পরিহার করতে চাইতেন না ।

এ কারণেই সৌভাগ্য ও সুখের ক্রোড়ে প্রতিপালিত এ সংখ্যালঘু শ্রেণীটির অপরিপক্ব ও অসংযত প্রবৃত্তি ও রিপুর কামনা-বাসনা ইরানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে জ্ঞানার্জনের অধিকারসহ সকল বৈধ সামাজিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল।


9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53

54

55

56

57

58

59

60

61