চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড3%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 108608 / ডাউনলোড: 10068
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

একাদশ অধ্যায় : সত্যের প্রথম প্রকাশ

ইসলামের প্রকৃত ইতিহাসের শুভ সূচনা ঐ দিন থেকে হয়েছিল যে দিন মহানবী (সা.) রিসালাত ও নবুওয়াতের দায়িত্ব লাভ করেন। এর ফলে অনেক স্মরণীয় ঘটনার উদ্ভব হয়। যে দিন মহানবী মানব জাতির হেদায়েতের দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেন এবং ওহীর ফেরেশতার মাধ্যমে

إنّك لرسول الله নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর রাসূল’-এ আহবানধ্বনি শুনতে পেলেন সে দিন তিনি এক গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করলেন যা অন্যান্য নবী-রাসূলও গ্রহণ করেছিলেন। ঐ দিন কুরাইশদের কাছে আল আমীন’ (বিশ্বস্ত) উপাধিতে ভূষিত হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নীতি এবং তাঁর মিশনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অধিকতর স্পষ্ট হয়ে গেল। নবুওয়াত ও রিসালাতের প্রাথমিক ঘটনাবলী ব্যাখ্যা করার আগে দু টি বিষয় সম্পর্কে কিছু ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অপরিহার্য। বিষয়দ্বয় নিম্নরূপ :

১. নবীদের রিসালাত ও বে সাতের (প্রেরণের) প্রয়োজনীয়তা।

২. সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে নবীদের ভূমিকা।

মহান আল্লাহ্ প্রতিটি অস্তিত্ববান সত্তার বিকাশ,উন্নতি ও পূর্ণতার সকল উপায়-উপকরণ ঐ সত্তার মাঝেই দিয়েছেন। আর পূর্ণতার বিভিন্ন পথ পরিক্রমণ করার উদ্দেশ্যে প্রতিটি অস্তিত্ববান সত্তাকে তিনি বিভিন্ন ধরনের উপায়-উপকরণ দ্বারা সজ্জিত করেছেন। একটি ক্ষুদ্র উদ্ভিদকে বিবেচনা করুন। বেশ কিছু নিয়ামক এ উদ্ভিদের বিকাশ ও পূর্ণতা বিধানের ক্ষেত্রে ক্রিয়াশীল রয়েছে। চারাটির মূল ঐ চারার খাদ্য সরবরাহ ও পুষ্টি বিধানের লক্ষ্যে সর্বোচ্চ মাত্রায় তৎপর হয়ে থাকে এবং চারাটির পুষ্টিজনিত সকল চাহিদা পূরণ করে। বিভিন্ন মূল,শিকড় ও চ্যানেলসমূহ অত্যন্ত ভারসাম্যতার সাথে মাটি থেকে আহরিত রস (গাছের) চারার সকল শাখা-প্রশাখা ও পত্রপল্লবে পৌঁছে দেয়।

(একটি) ফুলের গঠন নিয়ে চিন্তা করুন। উদ্ভিদের অন্য সকল অংশের গঠন থেকে এর গঠন স্বতন্ত্র ও বিস্ময়কর।

পুষ্পবৃতির কাজ হচ্ছে মুকুল বা কুঁড়ির তল ও উপরিভাগকে ঢেকে রাখা এবং ফুলের পাপড়ি ও অভ্যন্তরীণ অংশের সংরক্ষণ। এভাবে ফুলের বিভিন্নাংশ যা একটি জীবিত অস্তিত্ববান সত্তার (উদ্ভিদ) বিকাশের জন্য প্রস্তুত ও তৈরি করা হয়েছে তা খুব ভালোভাবে নিজ দায়িত্ব সম্পন্ন করে। যদি আমরা আরো একটু এগিয়ে যাই এবং জীবজগতের আশ্চর্যজনক ব্যবস্থার দিকে দৃকপাত করি তাহলে আমরা উপলব্ধি করতে পারব যে,জীবজগৎ (উদ্ভিদ ও প্রাণী) এমন কতিপয় নিয়ামক দ্বারা সজ্জিত যা এ জীবজগতকে পূর্ণতার দিকে পৌঁছে দিচ্ছে।

যখনই আমরা এ বিষয়টিকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করব তখন আমাদেরকে অবশ্যই বলতে হবে যে,হেদায়েতে তাকভীনী২০৩ যা আসলে অস্তিত্বজগতে মহান স্রষ্টার সর্বজনীন নেয়ামত ও অনুগ্রহ তা আসলে উদ্ভিদ,প্রাণী ও মানুষ নির্বিশেষে এ নিখিল-বিশ্বের সকল মাখলুক অর্থাৎ সৃষ্ট অস্তিত্ববান সত্তাসমূহকে অন্তর্ভুক্ত করে।

الّذي أعطى كلّ شيء خلقه ثمّ هدى

যিনি (মহান আল্লাহ্) সকল বস্তু ও পদার্থকে সৃষ্টি করে (জীবনযাপন করার) পথ প্রদর্শন করেছেন’-পবিত্র কোরআনের এ আয়াতটি থেকে প্রতীয়মান হয় যে,ক্ষুদ্র পরমাণু থেকে শুরু করে নীহারিকাপুঞ্জ পর্যন্ত বিশ্বের সকল অস্তিত্ববান সত্তা মহান আল্লাহর এ সর্বজনীন অনুগ্রহ থেকে প্রতিনিয়ত উপকৃত ও ধন্য হচ্ছে। মহান আল্লাহ্-সৃষ্ট অস্তিত্ববান সত্তার সঠিক সূক্ষ্ম পরিমাপ ও প্রয়োজনীয় সব কিছু নির্ধারণ করার পর পূর্ণতাপ্রাপ্তি,সুষ্ঠু বিকাশ,প্রতিপালন ও প্রশিক্ষণের পথ দেখিয়েছেন এবং প্রত্যেকের সুষ্ঠু প্রতিপালন এবং বিকাশের জন্য বিভিন্ন ধরনের নিয়ামক ব্যবহার করেছেন। এটিই সর্বজনীন সৃষ্টিগত হেদায়েত যা ব্যতিক্রম ছাড়াই সমগ্র সৃষ্টিজগতে ক্রিয়াশীল রয়েছে।

তবে এ সৃষ্টিজগৎ ও স্বভাবগত পথ প্রদর্শন কি সকল সৃষ্টির সেরা মানুষের মতো অস্তিত্ববান সত্তার জন্য যথেষ্ট? নিশ্চিতভাবে বলা যায়, না’। কারণ পার্থিব জীবন ছাড়াও মানুষের আরো একটি জীবন আছে যা তার প্রকৃত জীবন। উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের মতো মানুষের যদি কেবল একটি পার্থিব ও শুষ্ক জীবনই থাকত তাহলে তার পূর্ণতার জন্য বস্তুগত নিয়ামকসমূহই যথেষ্ট ছিল,অথচ মানুষ দু ধরনের জীবনের অধিকারী। এতদুভয়ের পূর্ণতা বিধানই তার সৌভাগ্য ও উন্নতির প্রতীক।

যেহেতু সহজ-সরল আদি গুহাবাসী এবং নির্মল স্বভাব ও প্রকৃতির অধিকারী মানুষের সত্তায় ক্ষুদ্রতম বিচ্যুতিরও উদ্ভব হয় নি সেহেতু সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাসকারী মানুষের মতো তার (আদি গুহাবাসী) শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ছিল না। তবে মানুষ যখন আরো এগিয়ে গেল (উন্নত হতে লাগল),সংঘবদ্ধ জীবনযাপন শুরু করল এবং তার মধ্যে সহযোগিতা ও সমবায়ধর্মী চিন্তাধারার বিকাশ ঘটল ঠিক তখন থেকেই সামাজিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও ঘাত-প্রতিঘাতের অনিবার্য পরিণতিস্বরূপ তার আত্মার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের বিচ্যুতিও শুরু হয়ে গেল। মন্দ চরিত্র ও স্বভাব এবং ভুল চিন্তাধারা তার স্বভাবগত চিন্তাধারাকে পরিবর্তিত করে দেয় এবং সমাজকে সাম্যাবস্থা থেকে বের করে আনে। এ সব বিচ্যুতির কারণে নিখিল বিশ্বের স্রষ্টা মানব সমাজের কর্মসূচী সুশৃঙ্খল ও সুবিন্যস্তকরণ এবং মানুষের সামাজিক হওয়ার প্রত্যক্ষ ফলস্বরূপ যে সব দুর্নীতি ও বিচ্যুতির উদ্ভব হয়েছে তা হ্রাস করার জন্য প্রশিক্ষকদের প্রেরণ করার সিদ্ধান্ত নেন। যাতে করে তাঁরা ওহীর প্রজ্বলিত প্রদীপের দ্বারা সমাজকে সঠিক পথ অর্থাৎ যে পথ তাদের সার্বিক সৌভাগ্য বিধান করবে সে পথে পরিচালিত করতে সক্ষম হন।

এ ক্ষেত্রে কোন কথার অবকাশ নেই যে,উপকারী হওয়া সত্ত্বেও সামাজিক জীবনের আরো কিছু ক্ষতিকর দিক আছে এবং তা ব্যাপক বিচ্যুতি বয়ে আনে। এ কারণেই মহান আল্লাহ্ যুগে যুগে এমন সব শিক্ষক-প্রশিক্ষককে প্রেরণ করেছেন যাঁরা যতটা সম্ভব বিচ্যুতি ও বিকৃতি অপসারণ এবং স্পষ্ট ঐশী বিধি-বিধান প্রবর্তন করার মাধ্যমে মানব সমাজকে সঠিক পথ ও ধারায় পরিচালিত করেছেন।২০৪

মহান নবীদের প্রেরণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আরো বেশি ব্যাখ্যা ও বিবরণের জন্য মৎ প্রণীত রিসালাতে জাহানী-ই পিয়ান্বারান (মহান নবীদের বিশ্বজনীন রিসালাত) নামক গ্রন্থটি অধ্যয়ন করুন।

সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে নবীদের ভূমিকা

সাধারণত মনে করা হয় যে,নবীরা হচ্ছেন ঐশী শিক্ষক যাঁরা মানব জাতিকে শিক্ষা দেয়ার জন্য প্রেরিত হয়েছেন। যেমনিভাবে একটি শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়,মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক বিদ্যালয়,কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা অর্জন করার সময় প্রাথমিক বিদ্যালয়,মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক স্কুলশিক্ষক,প্রভাষক ও অধ্যাপকদের কাছে বিভিন্ন বিষয় শিক্ষা লাভ ও জ্ঞানার্জন করে ঠিক তেমনি মানব জাতি নবীদের আদর্শিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করে এবং মহান নবীদের শিক্ষামালার সমান্তরালে তাদের নৈতিক চরিত্র এবং সামাজিক আচরণাদিও পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়ে থাকে।

কিন্তু আমরা মনে করি যে,নবিগণ মানব জাতির প্রশিক্ষক। তাঁদের মৌলিক কাজ ও দায়িত্ব হচ্ছে মানব জাতিকে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলা,তবে তা মানব জাতিকে শিক্ষা ও জ্ঞান দান নয়। তাঁদের প্রবর্তিত শরীয়তের মূল ভিত কোন নতুন কথা ও কোন নতুন অবদান নয়। মানবপ্রকৃতি বিচ্যুতির শিকার হলেই এবং অজ্ঞতার অশুভ কালো মেঘ তাদের ওপর ছায়া বিস্তার করলেই ঐশী ধর্ম ও বিধি-বিধানের মূল নির্যাস মানব জাতির কাছে স্পষ্ট করে দেয়া হতো।

তবে এ ধরনের কথা ও অভিমতের ভিত হচ্ছে ইসলাম ধর্মের সুমহান ইমামদের বক্তব্য ও বাণী। আমীরুল মুমিনীন ইমাম আলী (আ.) নাহজুল বালাগায় নবীদের প্রেরণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন :

أخذ على الوحي ميثاقهم و على تبليغ الرّسالة أمانتهم... ليستأدوهم ميثاق فطرته، و يذكّروهم منسيّ نعمته، و يحتجّوا عليهم بالتّبليغ و يثيروا لهم دفائن العقول

“মহান আল্লাহ্ মানব জাতির মধ্য থেকে মহান নবীদের মনোনীত করেছেন এবং তাঁদের কাছ থেকে ওহী এবং মহান আল্লাহর রিসালাত (জনগণের কাছে) পৌঁছে দেয়ার প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন যাতে করে তাঁরা মানব জাতির কাছ থেকে তাদের ফিতরাত অর্থাৎ মানবপ্রকৃতি ও স্বভাবভিত্তিক প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকারের পুনঃদাবি করেন,আল্লাহ্প্রদত্ত যে সব নেয়ামত (মানব জাতি) ভুলে গেছে সেগুলো তাদের পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেন,তাদের কাছে দীন প্রচার করার মাধ্যমে তাদের ওপর মহান আল্লাহর দলিল-প্রমাণ পূর্ণ করেন এবং তাদের বিবেক-বুদ্ধি যা চাপা পড়ে গিয়েছিল তা বের করে আনেন। ২০৫

একটি জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত

আমরা যদি বলি যে,একটি চারার পরিচর্যার ক্ষেত্রে একজন মালীর যে ভূমিকা আছে,মানুষের অন্তরাত্মার প্রশিক্ষণ ও সংশোধনের ক্ষেত্রে মহান নবীদেরও ঐ একই ভূমিকা ও দায়িত্ব রয়েছে অথবা মানব জাতির প্রকৃতিগত অনুভূতিসমূহের সুষ্ঠু পরিচালনার ক্ষেত্রে মহান নবীদের উপমা হচ্ছে একজন প্রকৌশলীর ভূমিকার ন্যায় যিনি পাহাড়-পর্বতের অভ্যন্তর থেকে মহামূল্যবান খনিজ পদার্থ উত্তোলন করেন,তাহলে আমাদের এ বক্তব্য বৃথা বলে গণ্য হবে না।

এ বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করতে চাই। একটি ক্ষুদ্র চারা গাছ দানা বা বীজের গঠনের সময় থেকে বিকশিত হয়ে পূর্ণাঙ্গ গাছে রূপান্তরিত হওয়ার সমুদয় সামর্থ্য ও সম্ভাবনার অধিকারী। যখন এ চারাটি শক্তিশালী শিকড় এবং বিভিন্ন ধরনের তন্ত্রসমেত উন্মুক্ত বাতাস এবং পর্যাপ্ত আলোয় ক্রিয়াশীল হয় অর্থাৎ জৈবিক কর্মতৎপরতা শুরু করে ঠিক তখন ঐ চারাটির সমগ্র অস্তিত্বের মাঝে এক অভিনব গতি ও আন্দোলনের সঞ্চার হয়। এ সময় মালীর দু টি কাজ আছে :

প্রথম কাজ : সুপ্ত সম্ভাবনাময় শক্তি যেন বিকশিত হয় সেজন্য চারা গাছটির মূল বা শিকড় দৃঢ় ও শক্তিশালী করার সমুদয় শর্ত ও পরিবেশ পূরণ করা।

দ্বিতীয় কাজ : যখন চারা গাছটির অন্তর্নিহিত শক্তিসমূহ উক্ত চারা গাছটির সুষ্ঠু বিকাশ ও প্রবৃদ্ধির বিপরীতে ভূমিকা রাখবে ঠিক তখনই সব ধরনের বিচ্যুতি প্রতিহত করা। এ কারণেই একজন মালীর কাজ উদ্ভিদের অঙ্কুরোদগম ঘটানো নয়,বরং উদ্ভিদ যাতে করে গুপ্ত ও সুপ্ত পূর্ণতা লাভ করতে পারে সেজন্য সতর্ক দৃষ্টি রাখা এবং যাবতীয় প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করা।

নিখিল বিশ্বের মহান স্রষ্টা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার প্রকৃতির মাঝে বিভিন্ন ধরনের শক্তি এবং প্রচুর ঝোঁক ও প্রবণতা আমানত হিসাবে স্থাপন ও সৃষ্টি করেছেন;মানবসত্তা ও ব্যক্তিত্বের মূল নির্যাসকে স্রষ্টান্বেষণ,স্রষ্টা পরিচিতি ও দর্শন,সত্যকামিতা ও সত্যান্বেষী অনুভূতি,ন্যায়পরায়ণ হওয়ার অনুভূতি,ন্যায়বিচার ও পৌরুষের অনুভূতি এবং কর্মচাঞ্চল্য ও কর্মতৎপরতার ঝোঁক ও প্রবণতার সাথে সংমিশ্রিত করেছেন। এ সব পবিত্র বীজ মানব হৃদয়ের মধ্যে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে থাকে,তবে সামাজিক জীবন মানুষের অস্তিত্বের মধ্যে কিছু কিছু বিচ্যুতি এনে দেয়। যেমন মানুষের মধ্যকার কর্মতৎপরতা ও পরিশ্রম করার ঝোঁক ও প্রবণতা লোভ-লালসাকারে,সৌভাগ্যবান ও চিরস্থায়ী হওয়ার ভালোবাসা একগুঁয়েমিপূর্ণ মনোবৃত্তি ও পদলিপ্সায় এবং তাওহীদ ও ইবাদাত-বন্দেগী মূর্তিপূজার আদলে আবির্ভূত হয়।

এ সময়েই ঐশী প্রশিক্ষকগণ ওহীর নূর এবং সঠিক পরিকল্পনা ও কর্মসূচীর মাধ্যমে বিকাশের যাবতীয় শর্ত ও পূর্বপ্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপের আয়োজন করেন এবং প্রকৃতিগত ঝোঁক ও প্রবণতাসমূহের সমুদয় বিচ্যুতি ও সীমা লঙ্ঘনকে প্রতিহত করে সেগুলোকে ভারসাম্যপূর্ণ করেছেন।

আমীরুল মুমিনীন ইমাম আলী (আ.) বলেছেন, স্রষ্টা সৃষ্টির প্রাক্কালে (মানুষের কাছ থেকে) সৃষ্টিগত প্রতিজ্ঞা’ (অর্থাৎ ফিতরাত বা স্বভাব-প্রকৃতিভিত্তিক প্রতিজ্ঞা) নামে একটি প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন। এই প্রতিজ্ঞা ও প্রতিশ্রুতির প্রকৃত উদ্দেশ্যই বা কি? এর প্রকৃত তাৎপর্য হচ্ছে যে,মহান আল্লাহ্ অগণিত উত্তম চারিত্রিক গুণের সাথে মানুষের স্বভাব ও প্রকৃতি সংমিশ্রিত করে তার (মানুষের) উপকারী ঝোঁক ও প্রবণতাসমূহ সৃষ্টি করে তার থেকে ফিতরাতভিত্তিক প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন যেন সে ভালো ও উপকারী ঝোঁক ও প্রবণতা এবং চারিত্রিক গুণাবলীর অনুসরণ করে।

চক্ষু (দৃষ্টিশক্তি) প্রদান করা যদি মানুষের কাছ থেকে এক ধরনের প্রতিশ্রুতি গ্রহণ হয়ে থাকে (অর্থাৎ এ প্রতিশ্রুতি হচ্ছে মানুষের গর্ত বা কুয়ার মধ্যে পতিত না হওয়া) তাহলে একইভাবে স্রষ্টার পরিচিতি অর্জন এবং ন্যায়পরায়ণ হবার অনুভূতি ইত্যাদি প্রদানের অর্থ হবে মানুষের কাছ থেকে মহান আল্লাহর প্রতিশ্রুতি গ্রহণ অর্থাৎ এ সব অনুভূতি প্রদান করে মানুষের কাছ থেকে আল্লাহ্ প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন যেন সে মহান স্রষ্টা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ও পরিচিতি লাভ করে এবং ন্যায়পরায়ণ হয়। মহান নবীদের দায়িত্ব হচ্ছে মানব জাতিকে তাদের সৃষ্টিপ্রকৃতিভিত্তিক প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার অনুযায়ী কাজ ও আচরণ করতে উদ্বুদ্ধ করা এবং যে সব অন্তরায় মানবপ্রকৃতির ওপর অশুভ কালো ছায়া বিস্তার করেছে তা অপসারণ ও বিদীর্ণ করা। এ কারণেই বলা হয় যে,সকল আসমানী ধর্ম ও শরীয়তের মূল ভিতই হচ্ছে মানবপ্রকৃতি এবং এতৎসংক্রান্ত বিষয়াদি।

মানুষের সম্পূর্ণ অস্তিত্ব যেন ঐ পাহাড়তুল্য যার অভ্যন্তরে মূল্যবান পাথর এবং স্বর্ণের আকরিক লুক্কায়িত আছে। ঠিক তদ্রূপ মানবপ্রকৃতির অভ্যন্তরে উত্তম ও মহৎ গুণাবলী,জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং প্রগাঢ় তত্ত্বজ্ঞান বিভিন্ন রূপ ও অবয়বে লুক্কায়িত আছে।

নবিগণ ছিলেন মানব জাতির মনস্তাত্ত্বিক প্রশিক্ষক। তাঁরা আমাদের আত্মা ও মন নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করার সময় ভালোভাবে অবগত আছেন যে,আমাদের আত্মা ও মন কতগুলো উচ্চতর বৈশিষ্ট্য,পবিত্র আবেগ ও অনুভূতি এবং মানসিক শক্তির সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। তাঁরা তাঁদের শিক্ষা-দীক্ষা,কর্মসূচী ও পরিকল্পনার দ্বারা এই মানব আত্মা ও মনকে সহজাত মানবপ্রকৃতির কাঙ্ক্ষিত ও বাঞ্ছিত অবস্থার দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যান। তাঁরা বিবেক ও সহজাত মানবপ্রকৃতির বিধানসমূহ বর্ণনা করেন এবং মানুষকে তার নিজ সত্তার মধ্যে তার যে ব্যক্তিত্ব এবং যে সব বৈশিষ্ট্য নিহিত রয়েছে সে সব সম্পর্কে অবগত করান।

হিরা পর্বতে মহানবী (সা.)

হিরা পর্বত পবিত্র মক্কা নগরীর উত্তরে অবস্থিত। আধা ঘন্টার ব্যবধানে এ পর্বতের শৃঙ্গে আরোহণ করা যায়। বাহ্যত এ পর্বত কৃষ্ণ প্রস্তর দ্বারা গঠিত এবং জীবনের সামান্যতম চি হ্নও এ পর্বতে দৃষ্টিগোচর হয় না। এ পর্বতের উত্তরাংশে একটি গুহা আছে। অনেক পাথর অতিক্রম করে অবশেষে সেখানে পৌঁছানো যায়। এ গুহার উচ্চতা একজন মানুষের উচ্চতার সমান। এ গুহার একটি অংশ সূর্যের আলোয় আলোকিত হয় এবং অন্যান্য অংশ সব সময় অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে।

কিন্তু এ গুহাটিই এমন সব (ঐতিহাসিক) ঘটনার সাক্ষী যে,আজও ঐ গুহার অব্যক্ত ভাষা থেকে এ সব ঘটনা শোনার তীব্র আকর্ষণ মানুষকে এ গুহার কাছে টেনে নিয়ে যায় এবং প্রচুর কষ্ট ও পরিশ্রম করে আগ্রহী দর্শনার্থী এ গুহার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতে সক্ষম হয়। এ গুহায় পৌঁছেই মানুষ ওহী অবতীর্ণ হওয়ার মহাঘটনা এবং বিশ্ব মানবতার মহান নেতা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ জানার আগ্রহ প্রকাশ করে। ঐ গুহাটি যেন তার অব্যক্ত ভাষায় (দর্শনার্থীদের) বলতে থাকে : এ স্থানটি কুরাইশ বংশের সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তিটির ইবাদাতগাহ্। তিনি নবুওয়াতের সুমহান মর্যাদায় সমাসীন হবার আগে বেশ কিছু দিবারাত্রি এখানে অতিবাহিত করেছিলেন। তিনি এ স্থানটি ইবাদাত-বন্দেগী করার জন্য পছন্দ ও মনোনীত করেছিলেন যা ছিল নগর জীবনের সকল কোলাহল থেকে মুক্ত। তিনি পুরো রামাযান মাস এখানেই কাটাতেন। অন্যান্য মাসেও তিনি কখনো কখনো এখানে অবস্থান করতেন। এমনকি তাঁর স্ত্রী খাদীজাহ্ও জানতেন,যখনই কুরাইশদের সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তি ঘরে আসতেন না তখন তিনি নিশ্চিত থাকতেন যে,তাঁর স্বামী হিরা গুহায় গভীর ধ্যান ও ইবাদাত-বন্দেগীতে লিপ্ত আছেন। তাই যখন তিনি কাউকে তাঁর সন্ধানে পাঠাতেন তখন তারা এ গুহায় এসে তাঁকে গভীর চিন্তা,ধ্যান ও ইবাদাত-বন্দেগীতে লিপ্ত দেখতে পেত।

নবুওয়াতের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হবার আগে মহানবী (সা.) দু টি বিষয়ে সবচেয়ে বেশি ভাবতেন। বিষয় দু টি ছিল :

১. তিনি পৃথিবী ও আকাশে বিদ্যমান ঐশ্বরিক শক্তি ও মহিমা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতেন। তিনি প্রতিটি সৃষ্ট অস্তিত্ববান সত্তার মুখাবয়বে মহান আল্লাহর নূর (আলো) এবং তাঁর সীমাহীন ক্ষমতা ও জ্ঞান প্রত্যক্ষ করতেন। আর এ পথেই অবস্তুগত ঊর্ধ্বলোক ও আধ্যাত্মিক জগতের প্রবেশদ্বারসমূহ তাঁর সামনে উন্মুক্ত হয়ে যেত।

২. যে গুরুদায়িত্ব তাঁর কাছে অর্পণ করা হবে সে ব্যাপারেও তিনি চিন্তা করতেন। এতসব নৈতিক অধঃপতন,বিশৃঙ্খলা ও ফিতনা-ফাসাদ থাকা সত্ত্বেও তাঁর দৃষ্টিতে তদানীন্তন সমাজের (কাঙ্ক্ষিত) সংস্কার ও সংশোধন কোন অসম্ভব কাজ বলে গণ্য হয় নি। তবে সঠিক সংস্কারমূলক কর্মসূচী ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করাও ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ও দুরূহ। এ দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি মক্কাবাসীদের পাপাচার ও বিলাসবহুল জীবনকে দেখেছেন এবং তাদের সংশোধন প্রক্রিয়ার ব্যাপারেও তিনি গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করেছেন।

তিনি নিস্প্রাণ ইচ্ছাশক্তিহীন প্রতিমা ও বিগ্রহসমূহের সামনে মক্কাবাসীদের নতজানু হওয়া ও ইবাদাত-বন্দেগী করার দৃশ্য দেখে খুবই মর্মাহত হতেন এবং তাঁর পবিত্র মুখমণ্ডলে এ ব্যাপারে তীব্র অসন্তোষ ও ক্ষোভের চি‎‎ হ্ন স্পষ্টরূপে ফুটে উঠত। কিন্তু যেহেতু তাঁকে জনসমক্ষে সত্য প্রকাশ করার অনুমতি তখনও দেয়া হয় নি সেজন্য তিনি তা প্রকাশ্যে বর্ণনা করা থেকে বিরত থেকেছেন।

ওহী অবতরণের শুভ সূচনা

মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন ফেরেশতা সৌভাগ্য ও হেদায়েতের গ্রন্থের (আল কোরআন) প্রারম্ভক ও শুভ সূচনা হিসাবে কিছু আয়াত মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে পাঠ করেন। আর এ কয়েকটি আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার মধ্য দিয়ে হযরত মুহাম্মদ (সা.) নবুওয়াতের মর্যাদাপূর্ণ স্থানে অধিষ্ঠিত হলেন (এ ঘটনার মধ্য দিয়ে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুওয়াত আনুষ্ঠানিকভাবে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়)। ঐ ফেরেশতা ছিলেন হযরত জিবরাইল (আ.)। আর ঐ দিনটি ছিল মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াতের অভিষেক (মাবআ স) দিবস। এ দিবসটির তারিখ নির্ধারণ করার ব্যাপারে আমরা সামনে বিস্তারিত আলোচনা করব।

নিঃসন্দেহে ফেরেশতার মুখোমুখি হওয়ার জন্য এক বিশেষ ধরনের প্রস্তুতি আবশ্যক। যতক্ষণ পর্যন্ত কোন ব্যক্তির আত্মা মহান ও আধ্যাত্মিকভাবে শক্তিশালী না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত নবুওয়াতের ভারী বোঝা বহন এবং ফেরেশতার সাথে সাক্ষাৎ করার ক্ষমতা তার হবে না। মহানবী মুহাম্মদ (সা.) দীর্ঘ ইবাদাত-বন্দেগী,চিন্তা ও ধ্যান এবং মহান আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ও আনুকূল্যের দ্বারা এ বিশেষ যোগ্যতা ও প্রস্তুতি অর্জন করেছিলেন। অধিকাংশ সীরাত রচয়িতার উদ্ধৃতি অনুযায়ী মাবআ স দিবসের আগে তিনি এমন সব স্বপ্ন দেখতেন যা ছিল আলোকোজ্জ্বল দিনের মতো বাস্তব।২০৬

দীর্ঘদিন তাঁর জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট ও সবচেয়ে উপভোগ্য মুহূর্তগুলো ছিল তাঁর হিরা গুহায় একাকী নির্জনবাস ও ইবাদাত-বন্দেগীর মুহূর্ত। এ অবস্থার মধ্য দিয়ে তাঁর সময় ও মুহূর্তগুলো অতিবাহিত হচ্ছিল। অবশেষে এক বিশেষ দিবসে এক ফেরেশতা একটি ফলকসহ অবতীর্ণ হয়ে ঐ ফলকটি তাঁর সামনে তুলে ধরে বলেছিলেন, পড়ুন। যেহেতু তিনি উম্মী (নিরক্ষর) ছিলেন এবং কখনই কোন বই পাঠ করেন নি সেহেতু তিনি বলেছিলেন, আমি তো পড়তে পারি না। ওহী বহনকারী ফেরেশতা তাঁকে জড়িয়ে ধরে খুব শক্তভাবে চাপ দিলেন। এরপর তাঁকে পুনরায় পড়তে বললে তিনি ঐ একই উত্তর দিয়েছিলেন। ঐ ফেরেশতা পুনরায় তাঁকে জড়িয়ে ধরে খুব শক্তভাবে চাপ দেন। এভাবে তিন বার চাপ দেয়ার পর মহানবী (সা.) নিজের মধ্যে অনুভব করলেন যে,ফেরেশতার হাতে যে ফলকটি আছে তা তিনি পড়তে পারছেন। এ সময় তিনি ঐ আয়াতসমূহ পাঠ করলেন যা ছিল বাস্তবে মানব জাতির সৌভাগ্যদানকারী গ্রন্থের অবতরণিকাস্বরূপ। নিচে ঐ আয়াতগুলো পেশ করা হলো :

) إقرأ باسم ربّك الّذي خلق، خلق الإنسان من علق، إقرأ و ربّك الأكرم، الّذي علّم بالقلم، علّم الإنسان ما لم يعلم(

“পড়ুন আপনার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে এক বিন্দু জমাট রক্ত থেকে। পড়ুন আর আপনার প্রভু মহান (অত্যন্ত সম্মানিত)। যিনি কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন। মানুষ যা জানত না তা তিনি তাকে শিক্ষা দিয়েছেন। (সূরা আলাক : ১-৫)

জিবরাইল (আ.) স্বীয় দায়িত্ব পালন করলেন। আর মহানবীও ওহী অবতীর্ণ হবার পর হিরা পর্বত থেকে নিচে নেমে আসলেন এবং হযরত খাদীজার গৃহের দিকে গমন করলেন।২০৭

উপরিউক্ত আয়াতসমূহ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সংক্ষিপ্ত কর্মসূচী ও পরিকল্পনা স্পষ্ট করে দেয় এবং প্রকাশ্যে প্রমাণ করে যে,তাঁর ধর্মের মূল ভিতই হচ্ছে অধ্যয়ন,জ্ঞান ও বিজ্ঞান এবং কলমের ব্যবহার।

সাসানী সম্রাটদের ব্যাপারে ইতিহাসের ফয়সালা

সাসানী সম্রাটগণ প্রধানত এবং বিশেষ করে প্রশাসনের ক্ষেত্রে অতি নিষ্ঠুর ও অমানবিক নীতি গ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁরা জনগণকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে নিজেদের অনুগত রাখতে চাইতেন।

তাঁরা জনগণ থেকে বিপুল পরিমাণ কর বলপূর্বক আদায় করতেন যা তাদের জন্য খুবই কঠিন ছিল। আর এ কারণে ইরানের জনগণ সার্বিকভাবে অসন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু প্রাণের ভয়ে তারা এ ব্যাপারে কথা বলতে পারত না,এমনকি সচেতন জনতা,সাসানী দরবারের বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গেরও কোন মূল্য ছিল না।

সাসানী শাসকগণ এতটা একগুঁয়ে ও স্বেচ্ছাচারী ছিলেন যে,(তাঁদের সামনে) কোন ব্যক্তিরই কোন কাজে নিজ মতামত ব্যক্ত করার অধিকার ছিল না।

প্রভাবশালী ও ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের মাধ্যমে ইতিহাসের বিকৃতি সাধন করা সত্ত্বেও অন্যায় অত্যাচারের পরিধি এতটা বিস্তৃতি লাভ করেছিল যে,ইতিহাসের পাতায় পাতায় অত্যাচারীদের অন্যায়-অত্যাচার সংক্রান্ত ঘটনা ও কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।

সম্রাট খসরু পারভেজ এতটা নিষ্ঠুর ছিলেন যে,ঐতিহাসিক সা লিবী লিখেছেন, সম্রাট খসরুকে একবার বলা হলো যে,অমুক শাসনকর্তাকে দরবারে আহবান করা হলে তিনি দরবারে উপস্থিত না হওয়ার ব্যাপারে টালবাহানা করছেন ও অজুহাত দেখাচ্ছেন। সম্রাট খসরু তৎক্ষণাৎ আদেশ দিলেন : আমাদের কাছে তার সশরীরে আসা যদি কষ্টসাধ্য হয় তাহলে তার দেহের একটি ক্ষুদ্র অংশই আমাদের জন্য যথেষ্ট যার ফলে তার কাজও তার জন্য সহজসাধ্য হয়ে যাবে। বলে দাও,কেবল তার মাথাটা যেন আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়।”74

সাসানী প্রশাসন ও সরকারের মধ্যে উত্তেজনা

সাসানী যুগের শেষভাগে যে বিষয়টি অবশ্যই উল্লেখ না করে পারা যায় না তা ছিল সাসানী প্রশাসনে গোলযোগ ও স্বেচ্ছাচারিতার প্রসার,ষড়যন্ত্র এবং রাজ্যজুড়ে বিশৃঙ্খলা। রাজপুত্রগণ,অভিজাতশ্রেণী এবং সেনাপতিগণ পরস্পর দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। যে দলই একজন রাজপুত্রকে মনোনীত করত আরেকটি দল তাকে হত্যা করত এবং তদস্থলে অন্য কোন রাজপুত্রকে সম্রাট মনোনীত করত। যখন মুসলমানরা ইরান জয় করার চিন্তা করছিল তখন সাসানী রাজকীয় পরিবার চরম দুর্বলতা ও কপটতা কবলিত হয়ে পড়েছিল।

সম্রাট খসরু পারভেজের নিহত হবার পর থেকে চার বছরের মধ্যে অর্থাৎ শীরাভেই-এর সিংহাসনে আরোহণ করার সময় থেকে সর্বশেষ সাসানী সম্রাট ইয়ায্দগারদের সিংহাসনে আরোহণ পর্যন্ত যাঁরা ইরানের শাহী তখ্তে আরোহণ করেছিলেন তাঁদের সংখ্যা 6 থেকে 14 জন পর্যন্ত (ইতিহাসে) উল্লেখ করা হয়েছে।

এভাবেই 4 বছরের মধ্যে 14 বার অথবা তার চেয়ে কিছু কমসংখ্যকবার ইরানের রাজকীয় ক্ষমতা হাতবদল হয়েছে। এটি খুবই স্পষ্ট,যে রাষ্ট্রে 4 বছরের মধ্যে 14 বার ক্যূদেঁতা সংঘটিত হয় এবং প্রতিবারই যদি একজন রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করে তদস্থলে অন্য এক ব্যক্তিকে সিংহাসনে বসানো হয় তাহলে ঐ রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্যের পরিণতি কি হতে পারে!

প্রত্যেক শাসনকর্তা ক্ষমতাগ্রহণ করার পর যারা রাজসিংহাসনের দাবিদার ছিল তাদের সবাইকে হত্যা করত। তারা নিজেদের রাজত্ব স্থায়ীভাবে নিজেদের করায়ত্তে রাখার জন্য কত জঘন্য কাজই না করেছে! পিতা পুত্রকে,পুত্র পিতাকে হত্যা করত। ভাই ভাইদের হত্যা করত।

শীরাভেই রাজকর্তৃত্ব হস্তগত করার জন্য নিজ পিতাকে হত্যা করেছিলেন।75 আর একই সাথে তিনি খসরু পারভেজের 40 পুত্রসন্তানকেও বধ করেছিলেন।76

‘শাহর বারায’কাউকে বিশ্বাস করতে না পারলেই তাকে হত্যা করতেন। পরিশেষে যারা রাজত্ব লাভ করেছিল তারা সবাই কি পুরুষ,কি মহিলা,কি বড় ও কি ছোট,সকল নিকটাত্মীয় অর্থাৎ সাসানী রাজপুত্রদেরকে (ঠাণ্ডা মাথায়) হত্যা করত যাতে করে সাম্রাজ্যে রাজসিংহাসনের কোন দাবিদার বিদ্যমান না থাকে।

সংক্ষেপে,সাসানী যুগে বিশৃঙ্খলা এতটা বৃদ্ধি পেয়েছিল যে,শিশু ও নারীদেরকে রাজসিংহাসনে বসানো হতো এবং কয়েক সপ্তাহ পরে তাদেরকে হত্যা করে অন্য কাউকে তার স্থলে বসানো হতো।

এভাবেই সাসানী সাম্রাজ্য বাহ্যিক শানশওকত ও জৌলুস থাকা সত্ত্বেও দিন দিন পতন ও ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছিল।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সাসানীয় ইরানের দুরবস্থা

সাসানী যুগে ইরানের দুর্দশা ও দুরবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণই ছিল ধর্মীয় মতভেদ।

সাসানী রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা আরদশীর বাবাকান’যেহেতু নিজেই পুরোহিতসন্তান ছিলেন এবং যারদোশতী ধর্মযাজকদের সহায়তায় রাজকর্তৃত্ব লাভ করেছিলেন সেহেতু তিনি সম্ভাব্য সকল পন্থায় ইরানে নিজ পূর্বপুরুষদের ধর্মের প্রচার ও প্রসার করেছিলেন।

সাসানী যুগে ইরানের জনগণের আনুষ্ঠানিক ধর্ম ছিল যারদোশত কর্তৃক প্রবর্তিত ধর্ম। যেহেতু সাসানী সালতানাত ধর্মযাজকদের সাহায্য ও সমর্থনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাই যারদোশতী ধর্মযাজকগণ সাসানী প্রশাসন কর্তৃক পরিপূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। পরিণতিতে সাসানী যুগে যারদোশতী ধর্মযাজকগণ তদানীন্তন ইরানের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও শক্তিশালী শ্রেণীতে পরিণত হয়েছিলেন।

সাসানী শাসকগণ সর্বদা যারদোশতী ধর্মযাজকদের হাতের ক্রীড়নক ছিলেন। তাই কোন শাসক যদি ধর্মযাজকদের আনুগত্য না করতেন তাহলে তিনি তাঁদের তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হতেন। এ কারণেই সাসানী বাদশাগণ সমাজের অন্য সকল শ্রেণীর চেয়ে ধর্মযাজকদের প্রতি বেশি মনোযোগ দিতেন। আর সাসানীদের পৃষ্ঠপোষকতা,সমর্থন ও সাহায্যের কারণে পুরোহিতদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল।

সাসানীরা নিজেদের রাজত্ব ও সাম্রাজ্য সুসংহত করার জন্য ধর্মযাজকদের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছিলেন। আর ইরানের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বিরাট বিরাট অগ্নি উপাসনালয় প্রতিষ্ঠা করতেন। প্রতিটি অগ্নি উপাসনালয়ে প্রচুর ধর্মযাজক অবস্থান করতেন।

ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে : খসরু পারভেজ এমন একটি অগ্নি উপাসনালয় নির্মাণ করেছিলেন এবং সেখানে 12000 ধর্মযাজক নিযুক্ত করেছিলেন যাঁরা ধর্মীয় সংগীত ও প্রার্থনার অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন।77

এভাবেই যারদোশতী ধর্ম আনুষ্ঠানিক ধর্মে পরিণত হয়েছিল। ধর্মযাজকগণ তাঁদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে সমাজের বঞ্চিত ও কষ্টসহিষ্ণু শ্রেণীগুলোকে শান্ত ও তৃপ্ত করার চেষ্টা করতেন। তাঁরা এমনভাবে চেষ্টা করতেন যাতে করে সাধারণ জনতা নিজেদের দুরবস্থা উপলব্ধি করতে সক্ষম না হয়।

ধর্মযাজকদের অসীম চাপ ও ক্ষমতা জনগণকে যারদোশতী ধর্ম সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। তাই সাধারণ জনগণ অভিজাতশ্রেণীর ধর্মমত বর্জন করে অন্য ধর্মের সন্ধান করতে থাকে।

‘ইরানের সামাজিক ইতিহাস’গ্রন্থের রচয়িতা লিখেছেন : বাধ্য হয়েই ইরানের জনগণ সম্ভ্রান্তশ্রেণী ও যাজক সম্প্রদায়ের চাপের কারণে এ সব অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে নিজেদেরকে বের করে আনার চেষ্টা করছিল। এ কারণেই রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক ধর্ম মাযদা ইয়াসতী যারতুশতী’

(مزديستى زرتشتي ) -যা বেহ্দীন’হিসাবে পরিচিত ছিল তার বিপরীতে যারদোশতী ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে দু টি পৃথক মতের আবির্ভাব হয়েছিল।”78

হ্যাঁ,অভিজাতশ্রেণী ও ধর্মযাজকদের চাপ ও কড়াকড়ির কারণেই সাসানী ইরানে একের পর এক বিভিন্ন মাযহাবের (ধর্মমত ও সম্প্রদায়) উদ্ভব হয়েছিল। ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক অবস্থাসমূহের মধ্যে সংস্কার ও পরিবর্তন সাধন করার জন্য মাযদাক (مزدك ) ও তাঁর পূর্বে মনী’প্রভূত চেষ্টা করেছিলেন,কিন্তু তাঁরা কেউ সফল হন নি।79

497 খ্রিষ্টাব্দে মাযদাক বিদ্রোহ করেছিলেন। একচেটিয়া মালিকানার বিলুপ্তি,বহু বিবাহ এবং হেরেম নিষিদ্ধকরণ তাঁর সংস্কারমূলক কর্মসূচীর শীর্ষে স্থান পেয়েছিল। যখন বঞ্চিত শ্রেণীগুলো এ ধরনের কর্মসূচী সম্পর্কে অবগত হলো তখন তারা পঙ্গপালের মতো তাঁর চারপাশে সমবেত হয়েছিল এবং তাঁর নেতৃত্বে একটি ব্যাপক বিপ্লবের সূচনা করেছিল। জনগণ যাতে করে তাদের স্রষ্টাপ্রদত্ত অধিকারসমূহ পেতে পারে সেজন্য এ বিপ্লব পরিচালিত হয়েছিল। অবশেষে মাযদাকের আন্দোলন যাজকশ্রেণীর প্রতিরোধ ও রাজকীয় সেনাবাহিনীর বিরোধিতার সম্মুখীন হয় এবং ইরানে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতার সৃষ্টি করে।

আর ঠিক একইভাবে সাসানী যুগের শেষে যারদোশতী ধর্মমত সম্পূর্ণরূপে নিজস্ব বাস্তব রূপ হারিয়ে ফেলেছিল। অগ্নি’কে পবিত্র মনে করার বিষয়টি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে,গলিত লোহা যা আগুনের সংস্পর্শে থাকার কারণে আগুনের প্রকৃতি গ্রহণ করত তাতে হাতুড়ি মারা অবৈধ বলে গণ্য করা হতো। যারদোশতী ধর্মমতের আকীদা-বিশ্বাসসমূহ ছিল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও পৌরাণিক। এ যুগে এ ধর্মের যাবতীয় বাস্তবতার স্থান কতগুলো নিস্প্রাণ,অনর্থক স্লোগান ও আচার-প্রথা দখল করে নিয়েছিল। ধর্মযাজকগণ সর্বদা নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য এ সব স্লোগান ও রীতিনীতির আনুষ্ঠানিকতা বৃদ্ধি করেছিলেন। অযৌক্তিক কল্পকাহিনী ও কুসংস্কারসমূহ এত পরিমাণে ধর্মে অনুপ্রবেশ করেছিল যে,এমনকি ধর্মযাজকগণ পর্যন্তও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ধর্মযাজকদের মধ্যে এমন সব ব্যক্তিও ছিলেন যাঁরা প্রথম থেকেই যারদোশতী ধর্মমতের আকীদা-বিশ্বাস,রীতিনীতি এবং আচার-প্রথার অসারত্ব বুঝতে পেরেছিলেন এবং এগুলো থেকে বের হয়ে এসেছিলেন।

অন্যদিকে আনুশীরওয়ানের শাসনামলের পর থেকেই ইরানে গভীরভাবে চিন্তা করার পথ উন্মুক্ত হয়েছিল;গ্রীক ও ভারতীয় কৃষ্টির অনুপ্রবেশ এবং একইভাবে খ্রিষ্টধর্ম ও অন্যান্য ধর্মমতের সাথে যারদোশতী ধর্মমত আসার কারণে এ বিষয়টি (অর্থাৎ গভীর চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা) আগের চেয়ে আরো বেশি শক্তিশালী হয়েছিল এবং এ কারণে ইরানী জাতির মধ্যে জাগরণ এসেছিল। আর এ জন্যই তারা যারদোশতী ধর্মমতের ভিত্তিহীন বিষয় ও কুসংস্কারসমূহের কারণে অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি কষ্ট পেতে থাকে।

অবশেষে যারদোশতী সমাজ ও ধর্মযাজক সম্প্রদায়ের মধ্যে যে দুর্নীতির উদ্ভব হয়েছিল এবং এ ধর্মে যে সব অযৌক্তিক কল্পকাহিনী অনুপ্রবেশ করেছিল তা ইরানী জাতির আকীদা-বিশ্বাসে মতবিরোধ ও অনৈক্যের সৃষ্টি করেছিল। এ ধরনের মতবিরোধ এবং বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উদ্ভবের ফলে চিন্তাশীল শ্রেণীর মধ্যে সন্দেহ ও সংশয়ের বীজ রোপিত হয়। আর তা তাদের মধ্য থেকে ধীরে ধীরে অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। পরিণতিতে ইরানী জাতি পূর্বের ধর্মীয় আকীদা-বিশ্বাস সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে ফেলে।

এভাবেই বিশৃঙ্খলা ও অধার্মিকতা সমগ্র ইরানে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ,সাসানী যুগের প্রসিদ্ধ চিকিৎসাবিজ্ঞানী বারযাওয়াইহ্ কালীলাহ্ ওয়া দিমনাহ্’গ্রন্থের প্রারম্ভিকায় সাসানী ইরানের শোচনীয় অবস্থা এবং তীব্র ধর্মীয় মতবিরোধের চিত্র অঙ্কন করেছেন।

ইরান ও রোম সাম্রাজের মধ্যকার যুদ্ধসমূহ

বুযুর্গমেহের যিনি অত্যন্ত বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান ছিলেন এবং আনুশীরওয়ানের প্রশাসনযন্ত্রের প্রধান (প্রধানমন্ত্রী) ছিলেন তিনি তাঁর বিচক্ষণতা ও অভিজ্ঞতার সদ্ব্যবহার করে অনেক সময় ইরানকে বড় বড় বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। কিন্তু কখনো কখনো ষড়যন্ত্রকারীরা সম্রাট আনুশীরওয়ানের সাথে তাঁর সম্পর্কের অবনতি ঘটাত এবং তাঁকে (আনুশীরওয়ানকে) তাঁর বিরুদ্ধে প্ররোচিত করে তাঁকে গ্রেফতার করার ফরমান জারি করাত।

এ সব বিবাদপ্রিয় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী রোম সম্রাট সম্পর্কে সম্রাট আনুশীরওয়ানকে ক্ষেপিয়ে তুলত। তারা দেশের সীমানা প্রসারিত করা এবং ইরানের বিপজ্জনক প্রতিদ্বন্দ্বীকে অর্থাৎ রোমান সাম্রাজ্যকে দুর্বল করার জন্য চিরস্থায়ী শান্তি ও অনাক্রমণ চুক্তি ভঙ্গ করে রোমানদের ওপর হামলা করার জন্য সম্রাট আনুশীরওয়ানকে প্ররোচিত করতে থাকে। অবশেষে যুদ্ধের শিখা প্রজ্বলিত হলো। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ইরানী সেনাবাহিনী সিরিয়া দখল করল এবং আনতাকীয়ার ওপর আক্রমণ চালিয়ে সমগ্র এশিয়া মাইনরে লুটতরাজ করল। 20 বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ইরান ও রোম শক্তি ও সম্পদ নিঃশেষ করে ফেলেছিল। প্রচুর রক্তপাতের পর দু দেশের মধ্যে পুনরায় সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং ইরান সরকারের কাছে রোমান প্রশাসনের প্রতি বছর 20,000 দীনার প্রদান করার শর্তে পূর্বেকার মতো দু দেশের মধ্যে সীমান্ত নির্ধারণ করা হয়।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে,এ ধরনের দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ,তা-ও আবার রাজধানী থেকে দূরবর্তী অঞ্চলসমূহে-একটি জাতির সম্পদ ও শিল্পের ওপর কি পরিমাণ ভয়ঙ্কর আঘাত হানতে পারে! সে সময়ের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনাকরতঃ দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি ও ধ্বংস অতি অল্প সময়ের মধ্যে সংস্কার করা অসম্ভব। এ যুদ্ধ ও লুণ্ঠন ইরান সরকারের অবশ্যম্ভাবী পতনের কারণ হয়েছিল।

উপরিউক্ত 20 বছরব্যাপী যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি পূরণ হতে না হতেই রোমান সম্রাট তি-বারিয়োস্ সিংহাসনে আরোহণ করার পর প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে তীব্র আক্রমণের দ্বারা ইরানের স্বাধীনতা হুমকির সম্মুখীন করেন। উভয় সেনাদলের অবস্থা স্পষ্ট হতে না হতেই সম্রাট আনুশীরওয়ান মৃত্যুমুখে পতিত হন এবং তাঁর পুত্র খসরু পারভেজ শাসনভার গ্রহণ করেন। 614 সালে তিনিও কতিপয় অজুহাত দাঁড় করিয়ে পুনরায় রোমানদের ওপর আক্রমণ করেন। প্রথম আক্রমণেই তিনি শাম,ফিলিস্তিন ও আফ্রিকা দখল করে নেন;জেরুজালেম লুণ্ঠন,কিয়ামত (পুনরুত্থান) গির্জা ও হযরত ঈসা মসীহর মাযার ধ্বংস করেন। পুরো শহরকে বিজয়ী ইরানী বাহিনী ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে এবং 90,000 খ্রিষ্টানকে হত্যা করার মাধ্যমে পারস্য সাম্রাজ্যের পক্ষে যুদ্ধ সমাপ্ত হয়।

এ সময় যখন তদানীন্তন সভ্যজগৎ যুদ্ধ ও অন্যায়ের বহ্নিশিখায় প্রজ্বলিত হচ্ছিল ঠিক তখন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) 610 খ্রিষ্টাব্দে রিসালাতের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তিনি বিশ্ববাসীর কর্ণে তাওহীদের অমিয় বাণী পৌঁছে দেন এবং মানব জাতিকে শান্তি,সমৃদ্ধি ও শৃঙ্খলার দিকে আহবান জানান।

অগ্নিপূজকদের হাতে আল্লাহ্পূজারী রোমানদের পরাজয়বরণকে মক্কার পৌত্তলিকগণ শুভ লক্ষণ হিসাবে গ্রহণ করে এবং তারা একে অপরকে বলতেও থাকে যে,আমরাও অচিরেই আল্লাহর পূজারীদেরকে (মুসলমানদেরকে) দমন করতে সক্ষম হব। মুসলমানগণ এ কথা শুনে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে।

মহানবী (সা.) মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহীর অপেক্ষায় ছিলেন। অবশেষে নিম্নোক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হয় :

) ألم غلبت الرُّوم في أدنى الأرضِ و لهم مِنْ بعدِ غلبهم سيغلبون(

“রোম আরবের নিকটবর্তী এক স্থানে পরাজিত হয়েছে। কিন্তু তারা তাদের পরাজয়ের কয়েক বছর পরেই পুনরায় বিজয়ী হবে।” (সূরা রূম : 1)

রোমানদের ব্যাপারে পবিত্র কোরআনের ভবিষ্যদ্বাণী 627 সালে বাস্তবায়িত হয়েছিল। রোমান সম্রাট হেরাক্লিয়াস ব্যাপক আক্রমণ চালিয়ে নেইনাভা (نينوا ) দখল করে নেন। প্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তিদ্বয় (পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্য) সর্বশেষ মুহূর্তগুলো অতিবাহিত করছিল এবং নিজেদের সামরিক শক্তি ও সেনাবাহিনী পুনর্গঠনে রত হয়েছিল। কিন্তু মহান আল্লাহর ইচ্ছা ছিল এ দু সাম্রাজ্য ইসলামের প্রাণসঞ্জীবনী সমীরণের প্রভাবে জীবন্ত হয়ে উঠবে। অল্প কিছু দিনের মধ্যে খসরু পারভেজ নিজ সন্তান শীরাভেইয়ের হাতে নিহত হন। আর শীরাভেইও খসরু পারভেজের মৃত্যুর 8 মাস পরে মৃত্যুমুখে পতিত হন। এ সময় ইরানে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা এতটা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে,শীরাভেইয়ের মৃত্যুর পরে চার বছরের মধ্যে বহু শাসনকর্তা ইরানের শাসনভার গ্রহণ করেছিলেন যাঁদের মধ্যে 4 জন নারীও ছিলেন। অবশেষে ইসলামী সেনাদলের আক্রমণের মাধ্যমে এ অবস্থার অবসান হয়। সাসানী ইরানের 50 বছরের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও সংঘাত মুসলমানদের পারস্য বিজয়ের পথ সুগম করে দেয়।

চতুর্থ অধ্যায় : মহানবী (সা.)-এর পূর্বপুরুষগণ


10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53

54

55

56

57

58

59

60

61