চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড3%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 106816 / ডাউনলোড: 9707
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

9

কুরাইশ বংশের উৎপীড়নের একটি নমুনা

একদিন মহানবী (সা.) নীরবতা ভঙ্গ করলেন এবং কুরাইশ গোত্রপতিদেরকে তাঁর প্রসিদ্ধ উক্তির মাধ্যমে তাদের কোন প্রস্তাব গ্রহণ করার ব্যাপারে হতাশ করে দিলেন। তাঁর সেই প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক উক্তি, খোদার শপথ,যদি সূর্যকে আমার ডান হাতে এবং চন্দ্রকে আমার বাম হাতে বসানো হয় এ শর্তে যে,আমি ইসলাম প্রচার কার্যক্রম থেকে বিরত থাকব,তাহলে মহান আল্লাহ্ যে পর্যন্ত আমার ধর্ম ইসলামকে জয়যুক্ত ও প্রচারিত না করবেন অথবা এ পথে আমার জীবন নিঃশেষ না হবে সে পর্যন্ত আমি এ কাজ থেকে বিরত থাকব না। আর এরই সাথে তাঁর জীবনের সবচেয়ে কঠিন অধ্যায় শুরু হয়ে যায়। কারণ ঐ দিন পর্যন্ত কুরাইশ গোত্র তাদের সকল আচার-আচরণে মহানবী (সা.)-এর সম্মান বজায় রাখত এবং তখনও তাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে নি। কিন্তু যখন তারা দেখলো যে,তাদের সংশোধন পরিকল্পনাসমূহ ভেস্তে গেছে তখন তারা তাদের কর্মসূচী ও পরিকল্পনা পরিবর্তন করে ফেলে এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ধর্মের প্রভাব ও বিস্তারকে যেভাবেই হোক বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়। তারা এ পথে যে কোন ধরনের উপায় ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকে নি। এ কারণেই কুরাইশ গোত্রপতিগণ সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেয় যে,তারা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ,নির্যাতন ও উৎপীড়ন এবং ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে তাঁকে ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসার কার্যক্রম থেকে বিরত রাখবে।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে,সংস্কারক নেতা যিনি বিশ্ববাসীকে পথ-প্রদর্শন করার চিন্তা-ভাবনা করছেন তিনি অবশ্যই সকল অগ্রহণযোগ্য কার্যক্রম ও আচরণ,শারীরিক ও মানসিক আঘাত ও ক্ষতির বরাবরে ধৈর্যাবলম্বন করবেন যাতে করে তিনি ধীরে ধীরে সকল সমস্যা ও জটিলতা সমাধান করতে সক্ষম হন। আর অন্যান্য সকল সংস্কারকের কর্মপদ্ধতিও ঠিক এমনই ছিল। আমরা এ কয়টি পাতায় কুরাইশদের অত্যাচার ও নির্যাতনের কিছু ঘটনা ও কাহিনী বর্ণনা করব। আর এর ফলে আমাদের সামনে মহানবী (সা.)-এর ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা স্পষ্ট হয়ে যাবে।

মহানবী (সা.) এক আত্মিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি (অর্থাৎ তাঁর বিশ্বাস,ধৈর্য,দৃঢ়তা এবং অবিচলতা ) যা তাঁকে ভেতর থেকে সাহায্য করত তা ছাড়াও এক বাহ্য শক্তির অধিকারী ছিলেন যা তাঁকে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করত। আর সে শক্তি ছিল বনি হাশিমের সাহায্য ও সমর্থন যার শীর্ষে ছিলেন হযরত আবু তালিব। কারণ আবু তালিব যখন তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রকে কষ্ট ও যাতনা দেয়া সংক্রান্ত মারাত্মক সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অবহিত হয়েছিলেন তখন তিনি বনি হাশিম গোত্রের সকল ব্যক্তিকে ডেকে হযরত মুহাম্মদকে রক্ষা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তাঁদের মধ্য হতে একদল ঈমানদার হওয়ার কারণে,আবার কেউ কেউ আত্মীয়তা ও রক্তসম্পর্ক থাকার কারণে হযরত মুহাম্মদকে রক্ষা ও সমর্থনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে থেকে কেবল আবু লাহাব এবং আরো দু ব্যক্তি যারা মুহাম্মদ (সা.)-এর শত্রুদের মধ্যে গণ্য হয়েছে তারাই আবু তালিবের এ ধরনের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে এবং তা বাস্তবায়ন করা থেকে বিরত থেকেছে। কিন্তু বনি হাশিম গোত্রের এ প্রতিরক্ষা ব্যূহ মহানবী (সা.)-কে কতিপয় অনভিপ্রেত ঘটনা থেকে নিরাপদ রাখতে পারে নি। কারণ কুরাইশরা যেখানেই মহানবীকে একাকী পেত সেখানেই তারা তাঁর অনিষ্ট সাধন করা থেকে বিরত থাকত না। এখানে কুরাইশদের নির্যাতন ও যন্ত্রণা দেয়ার কয়েকটি নমুনা উল্লেখ করা হলো :

ক. আবু জাহল একদিন মহানবী (সা.)-কে সাফা পর্বতে দেখে অশালীন ও কটুক্তি করল এবং তাঁকে নির্যাতন ও কষ্ট দিল। মহানবী (সা.) তার সাথে কোন কথা বললেন না এবং সোজা বাড়ির দিকে গমন করলেন। আবু জাহল পবিত্র কাবার পাশে কুরাইশদের সভায় রওয়ানা হলো। হামযাহ্,যিনি রাসূলের চাচা ও দুধ ভ্রাতা ছিলেন,তিনি ঐ দিনই যখন শিকার থেকে ধনুক কাঁধে ঝুলিয়ে প্রত্যাবর্তন করছিলেন তখন তিনি তাঁর পুরানো অভ্যাসবশত মক্কায় প্রবেশ করার পর নিজ সন্তান ও পরিবার-পরিজনের সাথে সাক্ষাৎ করার পূর্বেই পবিত্র কাবা তাওয়াফ ও যিয়ারত করতে গেলেন। এরপর কাবার চারপাশে কুরাইশদের যে বিভিন্ন সভা বসত সেখানে গেলেন এবং তাদের সাথে সালাম ও কুশলাদি বিনিময় করলেন।

তিনি এ সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার পর নিজ ঘরের দিকে প্রত্যাবর্তন করলেন। ঘটনাক্রমে আবদুল্লাহ্ ইবনে জাদআনের দাসী যে আবু জাহল কর্তৃক মহানবী (সা.)-কে নির্যাতন করার বিষয়টি প্রত্যক্ষ করেছিল সে হযরত হামযাকে বলল, হে আবু আম্মারাহ্ (হযরত হামযার কুনিয়াহ্)! হায় যদি কয়েক মিনিট পূর্বে এ স্থান থেকে আমি যেমনভাবে ঘটনাটি ঘটতে দেখেছি ঠিক তেমনভাবে আপনি দেখতেন যে,আবু জাহল কিভাবে আপানার ভ্রাতুষ্পুত্রকে গালিগালাজ ও কটুক্তি করেছে এবং তাকে কষ্ট ও যাতনা দিয়েছে! ঐ দাসীর কথাগুলো হযরত হামযার মনে বিস্ময়কর প্রভাব ফেলেছিল এবং তিনি পরিণতির কথা চিন্তা-ভাবনা না করে আবু জাহল থেকে নিজ ভ্রাতুষ্পুত্রের প্রতিশোধ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন।

এ কারণেই যে পথে তিনি এসেছিলেন সেপথেই ফিরে গেলেন। আবু জাহলকে তিনি কুরাইশ গোত্রের মিলনায়তনে দেখতে পেলেন এবং তার কাছে গেলেন। কারো সাথে কোন কথা বলার পূর্বেই তিনি তাঁর ধনুক উঠিয়ে আবু জাহলের মাথার ওপর এমনভাবে আঘাত করতে লাগলেন যার ফলে তার মাথা ফেটে গেল। তিনি বললেন, তুমি মুহাম্মদের বিরুদ্ধে কটুক্তি ও কুৎসা করছ,অথচ আমি তার প্রতি ঈমান এনেছি এবং যে পথে তিনি গিয়েছেন সে পথে আমিও যাব। যদি তোমার কোন কিছু করার ক্ষমতা থাকে তাহলে আমার সাথে লড়াই করে দেখ। ২৫৯

ঐ সময় বনি মাখযূম গোত্রের একদল ব্যক্তি আবু জাহলের সাহায্যার্থে অগ্রসর  হলো। কিন্তু যেহেতু সে একজন সুযোগ-সন্ধানী ও রাজনৈতিকভাবে বিচক্ষণ ছিল তাই সে সব ধরনের যুদ্ধ ও সংঘর্ষ এড়িয়ে গেল এবং বলল, আমি মুহাম্মদের সাথে খারাপ আচরণ করেছি এবং হামযারও অধিকার রয়েছে অসন্তুষ্ট হওয়ার। ২৬০

অকাট্য সত্য ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে,হামযার মতো সাহসী বীর পুরুষের অস্তিত্ব মহানবী (সা.)-এর জীবন রক্ষা এবং মুসলমানদের আত্মিক মনোবলের ওপর যথোপযুক্ত প্রভাব ফেলেছিল। উল্লেখ্য যে,হযরত হামযাহ্ পরবর্তীকালে ইসলামের অন্যতম প্রধান সেনাপতি ও সমরবিদ ছিলেন। ইবনে আসীর এতদ্প্রসঙ্গে লিখেছেন : কুরাইশগণ হযরত হামযার ইসলাম ধর্ম গ্রহণের বিষয়কে মুসলমানদের উন্নতি ও মনোবল বৃদ্ধির কারণ বলে বিবেচনা করত। ২৬১

ইবনে কাসীর শামীর মতো কতিপয় ঐতিহাসিক২৬২ জোর দিয়ে বলেছেন, হযরত আবু বকর ও হযরত উমরের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের প্রভাব হযরত হামযার ইসলাম গ্রহণের প্রভাবের চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না। এ দুই খলীফার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ মুসলমানদের মান-মর্যাদা ও মনোবল বৃদ্ধি এবং তাদের স্বাধীনতা ও মুক্তির উপায় হয়েছিল। তবে নিঃসন্দেহে প্রতিটি ব্যক্তি তাঁর যোগ্যতা অনুসারে ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রভাব বিস্তার করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন। তবে কখনই এ কথা বলা সম্ভব নয় যে,হযরত হামযার ইসলাম ধর্ম গ্রহণের প্রভাব ও ফলাফল যে মাত্রায় দৃষ্টিগোচর হয়েছিল ঠিক সেই মাত্রায় এ দু খলীফার  ইসলাম ধর্ম গ্রহণের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়েছে। কারণ হামযাহ্ ছিলেন ঐ ব্যক্তি যখন তিনি জানতে পারলেন যে,কুরাইশ নেতা আবু জাহল মহানবী সম্পর্কে অশালীন উক্তি করেছে তখন তিনি কোন ব্যক্তিকে তাঁর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে সম্পর্কে অবহিত না করেই হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর আঘাতকারী ব্যক্তির কাছে সরাসরি গিয়েছেন এবং তীব্র প্রতিশোধ গ্রহণ করেছেন। তখন কোন ব্যক্তি তাঁর সাথে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার সাহস পর্যন্ত করে নি। কিন্তু ইবনে হিশামের মতো বড় বড় সীরাত রচয়িতাগণ আবু বকর সম্বন্ধে এমন বিষয়ও বর্ণনা করেছেন যে,যে দিন হযরত আবু বকর মুসলমানদের পরামর্শস্থলে উপস্থিত হয়েছিলেন সেদিন না তিনি নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন,না তিনি মহানবী (সা.)-কে রক্ষা করতে পেরেছিলেন। নিম্নে আমরা ঘটনাটি বর্ণনা করব :

একদিন মহানবী (সা.) কুরাইশদের সমাবেশের পাশ দিয়ে গমন করছিলেন। হঠাৎ একত্রে কুরাইশগণ চতুর্দিকে থেকে তাঁকে ঘিরে ধরল এবং সবাই ব্যঙ্গচ্ছলে মহানবীর সাথে প্রতিমা ও কিয়ামত দিবসের ব্যাপারে কথা বলা শুরু করে এবং বলতে থাকে, তুমিই কি এরকম কথা বল? মহানবী (সা.) তাদের কথার প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন,نعم أنا الّذي أقول ذلك হ্যাঁ,আমিই এসব কথা বলি। যেহেতু কুরাইশগণ দেখতে পেল যে,মহানবী (সা.)-কে রক্ষা করবে এমন কোন ব্যক্তি ময়দানে নেই তখন তারা মহানবীকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। তাদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি সামনে এসে মহানবীর পোশাকের প্রান্ত ধরলে পাশে দণ্ডায়মান আবু বকর মহানবীর সাহায্যার্থে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গেলেন এবং তিনি বলেছিলেন,

 أ تقتلون رجلا أن يقول ربّي الله তোমরা কি এমন এক ব্যক্তিকে আমার প্রভু আল্লাহ্’-এ কথা বলার জন্য হত্যা করতে চাও? এরপর (বিভিন্ন কারণবশত) তারা মহানবীকে হত্যার পরিকল্পনা বাদ দেয়। মহানবী (সা.) নিজ পথে গমন করলেন এবং হযরত আবু বকর ঐ অবস্থায় নিজ গৃহমুখে রওয়ানা হলেন যখন তাঁর মাথা ফেটে গিয়েছিল।২৬৩

এ ঐতিহাসিক বর্ণনা যতটা মহানবীর প্রতি খলীফা আবু বকরের ভক্তি,ভালোবাসা ও আবেগের সাক্ষ্য দেয় তার চেয়ে ঢের বেশি খলীফা আবু বকরের অক্ষমতা ও দুর্বলতাকে বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরে। এ ঘটনা থেকে যে বিষয়টি প্রমাণিত হয় তা হলো : ঐ দিন খলীফা আবু বকর না শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন,আর না তিনি তেমন কোন সামাজিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। আবার যেহেতু মহানবী (সা.)-এর বিরুদ্ধে যে কোন পদক্ষেপ গ্রহণের পরিণতি খুব খারাপ ছিল এ কারণেই কুরাইশগণ তাঁকে ছেড়ে দিয়ে তাঁর সহযোগীকে তীব্রভাবে মারধর করেছিল এবং তাঁর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল। যখনই আপনারা হযরত হামযাহ্ ও তাঁর সাহস,বিক্রম ও বীরত্বের ঘটনাটি এ ঘটনার পাশাপাশি তুলনা করবেন তখন আপনারাই ফায়সালা করতে পারবেন যে,ইসলামের প্রাথমিক যুগে আসলে এ দু ব্যক্তির মধ্যে কার ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ফলে ইসলাম ধর্মের সম্মান ও শক্তি এবং কাফিরদের ভয়-ভীতি ও দুশ্চিন্তার উদ্ভব হয়েছিল।

অতিসত্বর আপনারা হযরত উমরের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ঘটনাটি পড়বেন। তাঁর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ তাঁর পুরানো বন্ধুর (আবু বকর) ইসলাম ধর্ম গ্রহণের মতোই মুসলমানদের প্রতিরক্ষা ক্ষমতা বৃদ্ধি করে নি এবং তাদেরকে শক্তিশালী করে নি। যে দিন তিনি (উমর) ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন সে দিন যদি আস ইবনে ওয়ায়েল না থাকত তাহলে খলীফা উমরের প্রহৃত ও নিহত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। কারণ যে দলটি হযরত উমরের প্রাণনাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তিনি তাদেরকে সম্বোধন করে বলেছিলেন,

رجل اختار لنفسه أمرا فماذا تريدون؟ أترون بني عدي بن كعب يسلمون لكم صاحبه هكذا؟

“যে ব্যক্তি নিজের জন্য একটি ধর্ম পছন্দ ও গ্রহণ করেছে তার কাছে তোমরা কি চাও? তোমরা কি ভাবছ যে,আদী বিন কাবের গোত্র তাকে এত সহজেই তোমাদের কাছে সোপর্দ করবে? ২৬৪

এ কথা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে,তাঁর গোত্রকে ভয় পাওয়ার কারণে কুরাইশগণ তাঁর ওপর থেকে হাত তুলে নিয়েছিল এবং নিজেদের আত্মীয়-স্বজনকে গোত্রসমূহ কর্তৃক রক্ষা করার বিষয়টি একটি স্বভাব-প্রকৃতিগত সাধারণ আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছিল যে ক্ষেত্রে ছোট-বড় সকল মানুষই সমান।

হ্যাঁ,মুসলমানদের প্রতিরক্ষার প্রকৃত ঘাঁটি বা কেন্দ্র ছিল বনি হাশিম গৃহ এবং এ গুরুদায়িত্বভার হযরত আবু তালিব ও তাঁর পরিবারের ওপরই ন্যস্ত ছিল। আর যদি তা না হয় তাহলে যে সব ব্যক্তি মুসলমানদের সাথে যোগ দিয়েছিল এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল নিজেদেরকে রক্ষা করার মতো তাদের প্রচুর শক্তি ও ক্ষমতা ছিল না। আর তাদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ কিভাবে মুসলমানদের সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধির কারণ হতে পারে?

মহানবী (সা.)-এর পিছনে আবু জাহলের ওঁৎ পেতে থাকা

ইসলাম ধর্মের উত্তরোত্তর প্রসার ও উন্নতি কুরাইশদেরকে তীব্রভাবে অসন্তুষ্ট করেছিল। প্রতিদিনই কুরাইশ বংশীয় কোন না কোন ব্যক্তির ইসলাম ধর্ম গ্রহণের সংবাদ তাদের কাছে পৌঁছত। এর ফলে তাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও ক্রোধের অগ্নিশিখা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। মক্কা নগরীর ফিরআউন বলে খ্যাত আবু জাহল একদিন কুরাইশদের সমাবেশে বলেই ফেলল,

إنّ محمّدا قد أتى ما ترون من عيب ديننا و شتم أبائنا و تسفيه أحلامنا و شتم آلهتنا

“(হে কুরাইশগণ!) তোমরা কি দেখছ না যে,মুহাম্মদ কিভাবে আমাদের ধর্মকে মন্দ বলে বিবেচনা করছে। আমাদের বাপ-দাদা অর্থাৎ পূর্বপুরুষদের ধর্ম এবং তাদের দেবতাদেরকে মন্দ বলছে এবং আমাদেরকে নির্বোধ ও বুদ্ধিহীন বলে গণ্য করছে। মহান আল্লাহর শপথ,আমি আগামীকালই তার জন্য ওঁৎ পেতে বসে থাকব এবং আমার পাশে একটি পাথর রাখব। মুহাম্মদ যখন সিজদাহ্ করবে তখন ঐ পাথরটি দিয়ে তার মাথা ফাটিয়ে দেব। ২৬৫

পরের দিন মহানবী (সা.) নামায পড়ার জন্য মসজিদুল হারামে আসলেন এবং রুকনে ইয়েমেনী ও হাজারে আসওয়াদের মাঝখানে নামাযে দাঁড়ালেন। একদল কুরাইশ আবু জাহলের দুরভিসন্ধি সম্পর্কে জ্ঞাত ছিল। আবু জাহল কি এ প্রতিরোধ সংগ্রামে শেষ পর্যন্ত সফল ও বিজয়ী হতে পারবে-এ ব্যাপারে তারা চিন্তামগ্ন হয়েছিল। মহানবী সিজদাহ্ করার জন্য মাটির ওপর মাথা রাখলেন। ঐ পুরানো শত্রু লুকিয়ে ওঁৎ পেতে থাকার স্থান থেকে বেরিয়ে আসল এবং মহানবীর দিকে এগিয়ে গেল। তবে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তার অন্তরের মধ্যে এক আশ্চর্যজনক ভীতির সঞ্চার হলো। সে ভয় পেয়ে কাঁপতে কাঁপতে পাংশুটে মুখ নিয়ে কুরাইশদের কাছে ফিরে গেল। সবাই দৌঁড়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, হে আবুল হাকাম! কী খবর? সে খুব দুর্বল কণ্ঠে বলল, এমন এক দৃশ্য আমার সামনে ফুটে উঠেছিল যা আমি আমার সমগ্র জীবনেও দেখি নি। এ কারণে আমি আমার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেছি। আবু জাহলের এ উক্তিটি থেকে প্রমাণিত হয় যে,সে এ ক্ষেত্রে কতটা ভীত ও আতংকগ্রস্ত হয়েছিল!

এ ক্ষেত্রে কোন সন্দেহ নেই যে,মহান আল্লাহর আদেশে একটি গায়েবী শক্তি মহানবীর সাহায্যার্থে অগ্রসর হয়ে এ ধরনের ভীতিকর দৃশ্যের অবতারণা করেছিল এবং মহানবী (সা.)-এর অস্তিত্বকে মহান আল্লাহরই প্রদত্ত অকাট্য ঐশী অঙ্গীকার অনুযায়ী শত্রুদের দংশন থেকে হেফাজত করেছিল। এ ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ্ কর্তৃক ওয়াদাটিأنّا كفيناك المستهزئين আমরা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপকারীদের অনিষ্ট থেকে তোমাকে রক্ষা করব’-এ আয়াতে উল্লিখিত হয়েছে।

কুরাইশদের অকথ্য উৎপীড়ন ও নির্যাতনের কাহিনীর নমুনাগুলো ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হয়েছে। ইবনে আসীর২৬৬ এ প্রসঙ্গে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ের অবতারণা করেছেন। তিনি মক্কায় মহানবীর ভীষণ একগুঁয়ে শত্রুদের নাম এবং তাদের বিভিন্ন ধরনের উৎপীড়ন ও নির্যাতনপদ্ধতির একটি বর্ণনা দিয়েছেন। যা কিছু ওপরে উল্লিখিত হয়েছে তা ছিল আসলে কয়েকটি নমুনা মাত্র। তবে মহানবী (সা.) প্রতিদিনই নতুন করে বিশেষ ধরনের উৎপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হতেন। যেমন একদিন উকবা ইবনে আবু মুঈত মুহাম্মদ (সা.)-কে তাওয়াফরত অবস্থায় দেখে বেশ গালিগালাজ করল। তাঁর মাথার পাগড়ি তাঁর গর্দানে পেঁচিয়ে তাঁকে মসজিদুল হারামের বাইরে আনলে বনি হাশিমের ভয়ে একদল লোক মহানবী (সা.)-কে তার হাত থেকে মুক্ত করেছিল।২৬৭

মহানবী (সা.) তাঁর নিজ চাচা আবু লাহাব ও তার স্ত্রী উম্মে জামীলের পক্ষ থেকে যে উৎপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তা ছিল সত্যিই বেদনাদায়ক। মহানবী (সা.)-এর বাড়ি তাদের বাড়ির পাশেই ছিল। তারা মহানবীর পবিত্র মাথা ও বদনমণ্ডলে ময়লা-আবর্জনা ফেলতে দ্বিধাবোধ করত না। একদিন তারা তাঁর মাথার ওপর একটি দুম্বার জরায়ু নিক্ষেপ করেছিল। অবশেষে অবস্থা এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল যে,হযরত হামযাহ্ প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য ঠিক ঐ জিনিসই আবু লাহাবের মাথার ওপর ফেলেছিল।

সংলাপ ও আলোচনায় মহান নবীদের পদ্ধতি

পূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে,হযরত ইবরাহীম (আ.) গুহা থেকে বের হবার পর তাওহীদের পথ থেকে বিচ্যুত দু টি গোষ্ঠীর মুখোমুখি হয়েছিলেন। উক্ত গোষ্ঠীদ্বয়  হলো :

ক. মূর্তিপূজকগণ এবং         খ. নভোমণ্ডলীয় বস্তুসমূহের পূজকগণ।

দ্বিতীয় গোষ্ঠীর সাথে হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর আলোচনা আমরা শুনেছি। এখন অবশ্যই দেখা উচিত যে,তিনি কিভাবে মূর্তিপূজকদের সাথে বিতর্ক করেছিলেন?

মহান নবীদের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে,তাঁরা তাঁদের প্রচার কার্যক্রমের শুরুতে নিজেদের আত্মীয়-স্বজনদের থেকেই সংস্কার ও সংশোধনমূলক কর্মকাণ্ড শুরু করতেন। এরপর তাঁরা তাঁদের প্রচার কার্যক্রমের পরিধি বিস্তৃত করতেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর নবুওয়াতের সূচনালগ্নে সর্বাগ্রে নিজের নিকটাত্মীয় ও জ্ঞাতিগোষ্ঠীকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আহবান জানিয়েছিলেন। তিনি মহান আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী (( و أنذر عشيرتك الأقربين ) এবং আপনার অতি নিকটাত্মীয়দেরকে ভয় প্রদর্শন করুন”-সূরা শুআরা : 214) তাঁর দাওয়াহ্ বা প্রচার কার্যক্রমের ভিত্তি নিজ আত্মীয়-স্বজন ও জ্ঞাতির সংশোধন করার ওপর স্থাপন করেছিলেন।

ইবরাহীম (আ.)-এর প্রচার পদ্ধতিও ঠিক এমনই ছিল। তাঁর সমাজসংস্কার ও সংশোধনমূলক কার্যক্রম নিকটাত্মীয়দের থেকে শুরু করেছিলেন।

আযর তাঁর গোত্রের মধ্যে অত্যন্ত উঁচুমর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী ছিল। তাত্ত্বিক (বৈজ্ঞানিক) ও শৈল্পিক তথ্য,জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা ছাড়াও সে অতি দক্ষ জ্যোতির্বিদও ছিল। তাই নমরুদের শাহী দরবারে তার ভীষণ প্রভাব ছিল। তার জ্যোতির্বিদ্যাভিত্তিক গণনা এবং ভবিষ্যদ্বাণীসমূহ নমরুদের দরবারে সকলের কাছে সমাদৃত হতো। ইবরাহীম (আ.) বুঝতে পেরেছিলেন যে,তাকে তাওহীদী ধর্মে দীক্ষিত করা গেলে মূর্তিপূজকদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ দখল করা সম্ভব হবে। এ কারণেই তিনি সর্বোত্তম পন্থায় তাকে মূর্তিপূজা থেকে বিরত রাখলেন। কিন্তু কতিপয় কারণবশত আযর ইবরাহীম (আ.)-এর আহবান,বাণী ও উপদেশ গ্রহণ করে নি। যে বিষয়টি অতি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো আযরের সাথে হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর কথোপকথন পদ্ধতি। পবিত্র কোরআনের যে সব আয়াতে আযরের সাথে হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর কথোপকথন বর্ণনা করা হয়েছে সে সব আয়াত যদি আমরা সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করি তাহলে প্রচারপদ্ধতির ক্ষেত্রে মহান নবীদের রীতিনীতি স্পষ্ট হয়ে যাবে। এখন আমরা হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর প্রচারপদ্ধতি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব।

) إذ قال لأبيه يا أبت لم تعبد ما لا يسمع و لا يبصر و لا يغني عنك شيئا يا أبت إنّي قد جاءني من العلم ما لم يأتك فاتّبعني أهدك صراطا سويّا يا أبت لا تعبد الشّيطان إنّ الشّيطان كان للرّحمان عصيا. يا أبت إنّي أخاف أن يمسّك عذاب من الرّحمان فتكون للشّيطان وليّا(

“হে পিতা! যে বস্তু শোনেও না,দেখেও না এবং তোমাকে কোন কিছু থেকে অমুখাপেক্ষী করে না,কেন তুমি তার উপাসনা কর? হে আমার পিতা! নিশ্চয়ই আমি ওহীর মাধ্যমে যে সব বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেছি সে সব বিষয় সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই। তাই তুমি যদি আমার অনুসরণ কর তাহলে তোমাকে আমি সত্য পথে পরিচালিত করব। হে আমার পিতা! শয়তানের উপাসনা কর না। কারণ শয়তান পরম দয়ালু আল্লাহর অবাধ্য। আমার ভয় হয় যে,মহান আল্লাহর আযাব তোমার কাছে পৌঁছবে আর এমতাবস্থায় তুমি শয়তানের বন্ধু ও মিত্রে পরিণত হবে।” (সূরা মরিয়ম : 44-47)

আযর ইবরাহীম (আ.)-এর এ আহ্বানে এ রকম বলেছিল, ইবরাহীম! আমার খোদাদের87 থেকে কি তুমি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ? যদি তুমি এ কাজ বর্জন না কর তাহলে আমি তোমাকে রজম (প্রস্তর নিক্ষেপ) করে হত্যা করব। আর এ ধরনের বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য কিছু সময় তোমাকে অবশ্যই আমার নিকট থেকে দূরে থাকতে হবে।”

যেহেতু ইবরাহীম (আ.) মহান আত্মা ও প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন তাই তিনি আযরের কটুক্তিগুলো নিজের মধ্যে হজম করে নিলেন এবং তিনি এমনই উত্তর দিলেন, আপনার ওপর সালাম (শান্তি)। অচিরেই আমি আপনার জন্য আমার প্রভুর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করব।” এ ধরনের বর্ণনার চেয়ে উত্তম জবাব আর কি হতে পারে;আর এ ধরনের কথা অপেক্ষা আর কোন্ বক্তব্য ভদ্রতাপূর্ণ এবং আকর্ষণীয় হবে?

আযর কি ইবরাহীম (আ.)-এর পিতা ছিল?

উপরিউক্ত আয়াতসমূহ,সূরা তাওবার 115 নং আয়াত এবং সূরা মুমতাহিনার 14 নং আয়াতের বাহ্য অর্থ হচ্ছে আযর ইবরাহীম (আ.)-এর পিতৃস্থানীয় ছিল এবং হযরত ইবরাহীমও তাকে পিতা বলে সম্বোধন করতেন। কিন্তু মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং সকল নবী-রাসূলের পূর্বপুরুষগণ তাওহীদবাদী ও খোদায় বিশ্বাসী ছিলেন-এতৎসংক্রান্ত সকল শিয়া আলেমের ঐকমত্যের (ইজমা) সাথে মূর্তিপূজক আযরের ইবরাহীম (আ.)-এর পিতা হওয়া মোটেও খাপ খায় না। প্রসিদ্ধ আলেম শেখ মুফিদ (রহ.) তাঁর আওয়ায়েলুল মাকালাত’নামক গ্রন্থে উপরিউক্ত বিষয়টিতে যে ইমামীয়া শিয়া আলেমদের ইজমা রয়েছে তা লিখেছেন। এমনকি অনেক সুন্নী আলেমও এ ব্যাপারে তাঁদের সাথে অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। এমতাবস্থায় উপরিউক্ত আয়াতসমূহের বাহ্য অর্থের অবস্থাই বা কি হবে এবং কিভাবে এ সমস্যাটি সমাধান করতে হবে?

অনেক মুফাসসির বলেছেন যে,أب (আব) শব্দটি যদিও সাধারণত আরবী ভাষায় পিতা’র ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়,তবুও এ শব্দটির ব্যবহার কেবল পিতা’র মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় এবং কখনো কখনো আরবী ভাষা ও পবিত্র কোরআনের পরিভাষায় চাচা’অর্থেও ব্যবহৃত হয়,যেমন নিচের আয়াতেأب শব্দটি চাচা’অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে :

) إذ قال لبنيه ما تعبدون من بعدي قالوا نعبد إلهك و إله ءابائك إبراهيم و إسماعيل و إسحاق إلها واحدا و نحن له مسلمون(

“যখন ইয়াকুব নিজ সন্তানদেরকে বললেন : আমার পরে তোমরা কার উপাসনা করবে? তখন তারা বলেছিল : আমরা আপনার ও আপনার পূর্বপুরুষগণ ইবরাহীম,ইসমাঈল ও ইসহাকের এক-অদ্বিতীয় উপাস্যের উপাসনা করব। আর আমরা তাঁর প্রতি আত্মসমর্পণকারী।” (সূরা বাকারা:  132)

নিঃসন্দেহে হযরত ইসমাঈল হযরত ইয়াকুব (আ.)-এর চাচা ছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন না। কারণ হযরত ইয়াকুব হযরত ইসহাকের সন্তান। আর হযরত ইসহাক হযরত ইসমাঈলের ভাই ছিলেন। এতদ্সত্ত্বেও হযরত ইয়াকুবের সন্তানগণ হযরত ইয়াকুবের চাচা হযরত ইসমাঈলকে পিতা বলেছে। অর্থাৎ তারাأب শব্দটি তাঁর (ইসমাঈল) ওপরও প্রয়োগ করেছে। এ দু ধরনের ব্যবহার সত্ত্বেও এ সম্ভাবনা থেকে যায় যে,আযরকে হেদায়েত করা সংক্রান্ত যে সব আয়াত রয়েছে সেগুলোতে উল্লিখিতأب শব্দটির কাঙ্ক্ষিত অর্থ হচ্ছে চাচা,বিশেষ করে শেখ মুফীদ যে ইজমার কথা বর্ণনা করেছেন তা থেকে। আর আযরকে ইবরাহীম (আ.) পিতা বলেছিলেন তা সম্ভবত এ কারণে যে,ইবরাহীম (আ.)-এর অভিভাবকত্বের দায়িত্ব দীর্ঘদিন আযরের ওপর ছিল। এ কারণেই হযরত ইবরাহীম (আ.) তাকে পিতার ন্যায় সম্মান প্রদর্শন করতেন।

কোরআন আযরকে ইবরাহীম (আ.)-এর পিতা বলে নি

হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর সাথে আযরের আত্মীয়তার সম্পর্ক সংক্রান্ত পবিত্র কোরআনের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করার জন্য নিম্নোক্ত দু টি আয়াতের ব্যাখ্যার দিকে আমরা সম্মানিত পাঠকবর্গের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করব :

1. আরব উপদ্বীপের পরিবেশ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অপার আত্মত্যাগের কারণে ঈমান ও ইসলামের নির্মল আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। অধিকাংশ অধিবাসীই আন্তরিকতার সাথে ঈমান আনয়ন করেছিল এবং বুঝতে পেরেছিল যে,শিরক ও মূর্তিপূজার চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে দোযখ এবং শাস্তি। তারা যদিও ঈমান আনয়ন করার কারণে আনন্দিত ও প্রফুল্ল ছিল কিন্তু তাদের পিতা-মাতাদের মূর্তিপূজারী হওয়ার তিক্ত স্মৃতি স্মরণ করে তারা কষ্ট পেত। যে সব আয়াতে কিয়ামত দিবসে মুশরিকদের জীবন সংক্রান্ত বিশদ বিবরণ ও ব্যাখ্যা এসেছে সেগুলো শ্রবণ করা তাদের জন্য ছিল খুবই কষ্টকর ও বেদনাদায়ক। নিজেদের এ আত্মিক যন্ত্রণা লাঘব ও দূর করার জন্য তারা মহানবী (সা.)-এর কাছে অনুরোধ জানাত যেন তিনি তাদের প্রয়াত অতি নিকটাত্মীয় যারা কাফির ও মুশরিক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে তাদের জন্য মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। আর ঠিক এভাবেই হযরত ইবরাহীম (আ.) তাঁর চাচা আযরের জন্যও এ কাজটিই করেছিলেন। নিম্নোক্ত আয়াতটি তাদের (আরবের নবদীক্ষিত মুসলমানগণ) অনুরোধের প্রতি উত্তরস্বরূপ অবতীর্ণ হয়েছিল :

) ما كان للنَّبِيِّ وَ الّذين آمنوا أنْ يَسْتَغْفِروا للمشرِكين و لو كانوا أولي قُربى مِن بعدِ ما تبيَّن لهم أنَّهم أصحابُ الجحيم و ما كان استغفارُ إبراهيمَ لأبيه إلّا عن موعدةٍ وعدها إيّاه فلمّا تبيَّن له إنَّه عدوٌّ للهِ تبرَّأ منه إنَّ إبراهيمَ لأوّاهٌ حليم(

“নবী ও যারা ঈমান এনেছে তাদের জন্য শোভনীয় নয় যে,তারা মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে যদি তারা অতি নিকটাত্মীয়ও হয়,যখন তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে,ঐ সব মুশরিক জাহান্নামের অধিবাসী। আর নিজ পিতার জন্য ইবরাহীমের ক্ষমা প্রার্থনা ছিল ঐ প্রতিজ্ঞার কারণে যা তিনি তাকে (চাচা আযরকে) করেছিলেন। তবে যখন ইবরাহীমের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল যে,সে (আযর) আল্লাহর শত্রু তখন তিনি তার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করলেন। নিশ্চয়ই ইবরাহীম অত্যন্ত দয়ালু ও ধৈর্যশীল।” (সূরা তাওবা : 113-114)

অগণিত দলিল-প্রমাণ থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে,আযরের সাথে ইবরাহীম (আ.)-এর কথোপকথন এবং তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার অঙ্গীকার ইবরাহীম (আ.)-এর যৌবনেই হয়েছিল। অবশেষে ইবরাহীম (আ.) চাচা আযরের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছিলেন। অর্থাৎ এটি ঐ সময় হয়েছিল যখন ইবরাহীম (আ.) তাঁর জন্মভূমি বাবেল ত্যাগ করে ফিলিস্তিন,মিশর ও হিজাযে গমন করেন নি। এ আয়াত থেকে এ ধরনের সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে,যখন আযর কুফর ও শিরকের মধ্যে দৃঢ়পদ থেকেছে তখন ইবরাহীম (আ.) তার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাকে মোটেও স্মরণ করেন নি।

2. ইবরাহীম (আ.) তাঁর জীবনের শেষভাগে একটি মহান দায়িত্ব পালন (অর্থাৎ পবিত্র কাবার পুনঃনির্মাণ কার্য সমাপ্ত করার পর) এবং পবিত্র মক্কার শুষ্ক ও মরুপ্রান্তরে নিজ স্ত্রী ও সন্তানকে আনয়ণ করার পর এমন সব ব্যক্তি সম্পর্কে আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করেন যার মধ্যে তাঁর পিতা-মাতাও ছিলেন। তিনি মহান আল্লাহর কাছে তাঁর প্রার্থনা কবুল হওয়ার জন্য এ ধরনের দোয়াও করেছিলেন,

) ربَّنا اغْفِرْلي وَلِوالِدَيَّ و للمُؤْمنين يومَ يقومُ الحِساب(

“হে আমার প্রভু! আমাদেরকে,আমার পিতা-মাতা এবং মুমিনদেরকে যেদিন বিচার (হিসাব-নিকাশ) করা হবে সেদিন ক্ষমা করে দিন।” (সূরা ইবরাহীম : 41)

এ আয়াত থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে,পবিত্র কাবাগৃহ নির্মাণ করার পরই ইবরাহীম (আ.) বৃদ্ধাবস্থায় এ প্রার্থনা করেছিলেন। যদি উক্ত আয়াতে বর্ণিতوالديَّ (আমার পিতা-মাতা) যাঁরা ছিলেন হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর দয়া,ভালোবাসা এবং ভক্তিশ্রদ্ধার পাত্র এবং তাঁদের মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করেছেন তিনিই যদি আযর হন তাহলে স্পষ্ট হয়ে যায় যে,ইবরাহীম (আ.) আমৃত্যু এবং তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলো পর্যন্ত আযরের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেন নি এবং কখনো কখনো তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনাও করেছেন,অথচ যে আয়াতটি মুশরিকদের অনুরোধের উত্তরে বর্ণিত হয়েছে তা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে,হযরত ইবরাহীম (আ.) তাঁর যৌবনকালেই আযরের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছিলেন এবং তার থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছিলেন। আর ক্ষমা প্রার্থনার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ মোটেও সংগতিসম্পন্ন নয়।

এ দু টি আয়াত পরস্পর সংযোজন করলে স্পষ্ট হয়ে যায় যে,যে ব্যক্তি যৌবনকালে ইবরাহীম (আ.)-এর ঘৃণার পাত্র হয়েছিল এবং যার সাথে তিনি সম্পর্কচ্ছেদ করেছিলেন সেই ব্যক্তিটি ঐ ব্যক্তি থেকে ভিন্ন  যাঁকে তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সর্বদা স্মরণ করেছিলেন এবং যাঁর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন।88

মূর্তি ধ্বংসকারী ইবরাহীম

উৎসবের মুহূর্ত সমাগত হয়েছে। বাবেল শহরের অমনোযোগী জনগণ ক্লান্তি দূর করা,উদ্যম পুনঃসঞ্চার ও উৎসব উদযাপন করার জন্য মরুভূমির দিকে গমন করল এবং শহর সম্পূর্ণরূপে জনশূন্য হয়ে গেল। হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর উজ্জ্বল ইতিহাস এবং শিরক ও মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে তাঁর বক্তব্য ও নিন্দাবাদ বাবেলের জনগণকে ভীষণভাবে চিন্তিত করে তুলেছিল। এ কারণেই তারা সবাই অনুরোধ করেছিল যে,ইবরাহীমও যেন তাদের সাথে ঐ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। তবে তারা এ ব্যাপারে জোর-জবরদস্তি করতে থাকলে ইবরাহীম (আ.) অসুস্থতার সম্মুখীন হন। তখন তিনিإنِّي سقيم (আমি অসুস্থ অথবা আমার শরীর ভালো নেই) এ কথা বলে তাদের কথার উত্তর দিয়েছিলেন এবং উৎসবে যোগদান করা থেকে বিরত ছিলেন।

সত্যিই ঐ দিন ছিল তাওহীদবাদী ও মুশরিকদের জন্য আনন্দের দিন। মুশরিকদের জন্য ঐ দিন ছিল প্রাচীন উৎসব উদযাপনের। উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা উদযাপন এবং পূর্বপুরুষদের আচার-অনুষ্ঠান পুনরুজ্জীবিত করার জন্য তারা পাহাড়ের পাদদেশ ও চিরসবুজ ক্ষেত-খামারে গিয়েছিল।

আর তাওহীদের বীর পুরুষের জন্যও এটি ছিল অতি প্রাথমিক ও অভূতপূর্ব উৎসবের দিন যার আগমনের জন্য তিনি (ইবরাহীম) দীর্ঘদিন যাবত অপেক্ষা করছিলেন। তিনি চাচ্ছিলেন শহর জনশূন্য হয়ে যাক এবং সে সুযোগে শিরক ও কুফরের যাবতীয় নিদর্শন তিনি ধ্বংস করে দেবেন।

যখন জনতার সর্বশেষ দলটি শহর থেকে বের হয়ে গেল তখন হযরত ইবরাহীম (আ.) সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন। তিনি মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং তাঁর ওপর পূর্ণ ভরসাসহকারে মন্দিরে প্রবেশ করলেন। তিনি মন্দিরের মধ্যে নিস্প্রাণ মূর্তি ও কাষ্ঠনির্মিত প্রতিমাসমূহ দেখতে পেলেন। তাবাররুক হিসাবে মূর্তিপূজকরা যে সব খাবার মন্দিরে রেখে যেত তা হযরত ইবরাহীমের দৃষ্টি আকর্ষণ করল এবং তিনি সরাসরি খাদ্যের নিকটে গেলেন। তিনি এক টুকরা রুটি হাতে নিয়ে ঐ সব মূর্তির দিকে বিদ্রূপের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, কেন তোমরা বিভিন্ন ধরনের খাবার খাচ্ছ না? বলার অপেক্ষা রাখে না যে,মুশরিকদের হস্তনির্মিত প্রতিমাসমূহের সামান্য নড়া-চড়া করার ক্ষমতাও ছিল না। তারা খাবে কি? মন্দিরের বিরাট অঙ্গনে সুনশান নীরবতা বিরাজ করছিল। কিন্তু ইবরাহীম (আ.) মূর্তিগুলোর হাত,পা ও দেহের ওপর কুঠার দিয়ে একের পর এক আঘাত হানতে লাগলেন। যার ফলে সেখানকার নীরবতা ভেঙ্গে গেল। তিনি মূর্তিগুলোকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে ফেললেন। আর এভাবে মন্দিরের মধ্যে কাঠ ও ধাতুর একটি বিরাট স্তূপের সৃষ্টি হলো। তিনি কেবল বড় মূর্তিটিকে অক্ষত রেখে দিলেন এবং ঐ মূর্তিটির কাঁধে কুড়াল ঝুলিয়ে রাখলেন। তাঁর কাজের লক্ষ্য ছিল এটিই যে,তিনি বোঝাতে চেয়েছেন স্বয়ং বড় মূর্তিটিই মূর্তিগুলো ধ্বংস করেছে। কিন্তু তাঁর এ বাহ্য কার্যকলাপের পেছনে একটি সুমহান উদ্দেশ্য ছিল যা বর্ণিত হওয়া উচিত। ইবরাহীম (আ.) ভালোভাবেই জানতেন যে,মুশরিকরা উৎসবস্থল থেকে ফিরে আসার পর মন্দিরগুলোর মূর্তিসমূহ ধ্বংস করার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করবে এবং তারা এ ঘটনার বাহ্য রূপকে এক ধরনের অন্তঃসারশূন্য অবাস্তব কার্যকলাপ বলে অভিহিত করবে। কারণ তারা বিশ্বাস করবে না যে,এ বড় মূর্তিটিই এ সব আঘাত হেনেছে যার নড়াচড়া ও কাজ করার কোন ক্ষমতাই নেই। এমতাবস্থায় হযরত ইবরাহীম (আ.) প্রচারণার দৃষ্টিকোণ থেকে এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে বলতে পারবেন যে,তোমাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী যখন এ বড় মূর্তিটির সামান্যতম ক্ষমতাই নেই তখন কিভাবে তোমরা তার উপাসনা করছ?

দিকচক্রবাল রেখার ওপর সূর্যোদয় হলো। সূর্যের আলোয় মরুপ্রান্তর ও সমতলভূমি সবকিছু আলোকিত হলো। জনগণ দলে দলে শহরে রওয়ানা হলো। প্রতিমাপূজার লগ্ন উপস্থিত হলো। একদল মন্দিরে প্রবেশ করল। এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যা দেবতাদের হীনতা ও অপদস্থতা প্রকাশ করছিল তা যুবা-বৃদ্ধ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। মন্দিরে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছিল। এক ব্যক্তি সেই নীরবতা ভেঙ্গে বলল, কোন্ ব্যক্তি এ কাজ করেছে?   ইবরাহীম (আ.) প্রতিমাসমূহকে যে পূর্ব হতেই মন্দ বলতেন এবং মূর্তিপূজার স্পষ্ট বিরোধিতা করতেন তা সকলের জানা ছিল। তাই তারা নিশ্চিত হতে পারল যে,ইবরাহীম (আ.)-ই এ কাজ করেছেন। নমরুদের তত্ত্বাবধানে একটি বিচারসভার আয়োজন করা হলো। যুবক ইবরাহীমকে মায়ের সাথে এক সর্বসাধারণ বিচার অধিবেশনে জেরা করা হলো।

মায়ের অপরাধ ছিল এই যে,কেন তিনি তাঁর সন্তানকে গোপন রেখেছিলেন এবং শিরোচ্ছেদ করার জন্য কেন তিনি সরকারের বিশেষ দফতরে তাঁর সন্তানের পরিচিতি প্রদান করেন নি? তখন ইবরাহীম (আ.)-এর মা জেরাকারীর প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, আমি দেখতে পেলাম এ দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তাই আমার এ সন্তানের ভবিষ্যৎ কি হবে তা না জানা পর্যন্ত আমি তার ব্যাপারে কোন তথ্য প্রদান করি নি। যদি এ ব্যক্তি (ইবরাহীম) গণক ও ভবিষ্যদ্বক্তাদের ভবিষ্যদ্বাণীতে বর্ণিত ঐ ব্যক্তিই হয়ে থাকে তাহলে আমি পুলিশকে তার ব্যাপারে অবশ্যই তথ্য প্রদান করতাম যাতে করে তারা অন্যদের রক্তপাত সংঘটিত করা থেকে বিরত থাকে। আর এ যদি ঐ ব্যক্তি না হয়ে থাকে তাহলে আমি এ দেশের এক ভবিষ্যৎ যুবপ্রজন্মকেই রক্ষা করেছি। ইবরাহীম (আ.)-এর মায়ের যুক্তি বিচারকদের দৃষ্টি সম্পূর্ণরূপে আকর্ষণ করেছিল।

এরপর ইবরাহীম (আ.)-কে জেরা করার পালা আসে। তিনি বললেন, বাহ্যিক অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে,এটি বড় প্রতিমারই কাজ। আর আপনারা ঘটনা সম্পর্কে তাকেই জিজ্ঞাসা করুন। যদি তাদের (প্রতিমাদের) বাকশক্তি থেকে থাকে! তেজোদ্দীপ্ত এ জবাব যা ব্যঙ্গ ও অবজ্ঞাপূর্ণ ছিল তা আসলে অন্য উদ্দেশ্যেই দেয়া হয়েছিল;আর তা হলো : ইবরাহীম (আ.) নিশ্চিত ছিলেন যে,তারা তাঁর জবাবে এটিই বলবে, ইবরাহীম! তুমি তো জান,এ সব প্রতিমার বাকশক্তি নেই।” তখন তিনি একটি মৌলিক বিষয়ের দিকে বিচারকমণ্ডলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হবেন। ঘটনাক্রমে তিনি যা পূর্ব হতে উপলব্ধি করেছিলেন তা-ই হলো। তাদের এ কথা মূর্তিগুলোর দুর্বলতা,অপদস্থতা ও অসামর্থ্যরেই পরিচায়ক ছিল। ইবরাহীম (আ.) জবাবে বললেন, আসলেই যদি প্রতিমাগুলোর অবস্থা এমন হয় যা তোমরা বর্ণনা করেছ তাহলে কেন তোমরা তাদের উপাসনা করছ এবং তাদের কাছে নিজেদের মনস্কামনা প্রার্থনা করছ?!

অজ্ঞতা,গোঁড়ামি,অন্ধভক্তি ও অনুসরণ বিচারকদের মন-মানসিকতার ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছিল এবং ইবরাহীম (আ.)-এর দাঁতভাঙ্গা জবাবে তারা একদম নিরুপায় হয়ে পড়ে;তাই তারা ইবরাহীম (আ.)-কে জীবন্ত দগ্ধ করে হত্যা করার পক্ষে রায় দিল। অগ্নিকুণ্ড প্রজ্বলিত করা হলো এবং তাওহীদের অমিত বিক্রম পুরুষ ইবরাহীম (আ.)-কে অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে নিক্ষেপ করা হলো। কিন্তু ইবরাহীম (আ.)-এর প্রতি মহান আল্লাহ্ দয়া ও অনুগ্রহের হস্ত প্রসারিত করলেন এবং তাঁকে তাদের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করলেন। মহান আল্লাহ্ মনুষ্য নির্মিত দোযখকে (অগ্নিকুণ্ডকে) চিরসবুজ পুষ্পোদ্যানে রূপান্তরিত করলেন।89

এ কাহিনীর শিক্ষণীয় দিকসমূহ

যেহেতু ইয়াহুদিগণ নিজেদেরকে তাওহীদের অনুসারী বলে বিবেচনা করে তাই তাদের মধ্যে এ কাহিনীটি প্রসিদ্ধ এবং তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ তাওরাতে বিদ্যমান এবং ঐশী গ্রন্থসমূহের মধ্যে কেবল পবিত্র কোরআনই বর্ণনার দায়িত্ব নিয়েছে। এ কারণেই এ গল্পের কতিপয় শিক্ষণীয় দিক যা হচ্ছে পবিত্র কোরআন কর্তৃক নবীদের কাহিনী বর্ণনা করারই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তা আমরা এখানে উল্লেখ করব :

1. এ কাহিনী হযরত ইবরাহীম খলীল (আ.)-এর অসাধারণ সাহস ও বীরত্বের শক্তিশালী দলিল। মূর্তি ভাঙা এবং শিরকের যাবতীয় নিদর্শন ও উপায়-উপকরণ ধ্বংস করার ব্যাপারে হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর সিদ্ধান্ত এমন কোন কিছু ছিল না যা নমরুদের অনুসারীদের কাছে গোপন থাকবে। কারণ তিনি মূর্তি ও প্রতিমাসমূহের নিন্দা ও কটূক্তি করে মূর্তিপূজার ব্যাপারে তাঁর পূর্ণ ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি খুব স্পষ্ট ভাষায় বলতেন, তোমরা যদি এ গর্হিত কাজ থেকে বিরত না হও তাহলে আমি নিজেই এ সব মূর্তি ও প্রতিমার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।” যেদিন সবাই মরুভূমিতে গমন করেছিল সেদিন তিনি প্রকাশ্যে বলেছিলেন, তোমাদের অনুপস্থিতিতে আমি এ সব মূর্তি ও প্রতিমার ব্যাপারে একটি চিন্তা-ভাবনা করব। 90

ইমাম সাদেক (আ.) বলেছেন, কয়েক সহস্রাধিক কাফির-মুশরিকের সংঘবদ্ধ দল ও চক্রের বিরুদ্ধে একজন তাওহীদবাদী ব্যক্তির আন্দোলন ও সংগ্রাম হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর পূর্ণ সাহসিকতা ও দৃঢ়পদ থাকার জীবন্ত দলিল। তিনি তাওহীদের বাণী উন্নীতকরণ এবং এক উপাস্যের উপাসনার মূলনীতি ও ভিত্তিসমূহ দৃঢ় করার পথে যে কোন ধরনের ঘটনায় মোটেও ভীত হন নি। 91

2. হযরত ইবরাহীমের তীব্র আঘাতসমূহ : যদিও বাহ্যত এক ধরনের সশস্ত্র ও বৈরীসুলভ বিপ্লব ছিল,তবে বিচারকমণ্ডলীর সাথে হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর কথোপকথন থেকে যেমন প্রতিভাত হয় তদনুযায়ী এ বিপ্লব ও আন্দোলনের প্রকৃত স্বরূপের কেবল প্রচার পর্যায়ই রয়েছে। কারণ তাঁর জনপদের অধিবাসীদের ঘুমন্ত বিবেক ও স্বভাব-প্রকৃতি জাগ্রত করার সর্বশেষ উপায় হিসাবে তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে,তিনি যাবতীয় মূর্তি ধ্বংস করবেন,সবচেয়ে বড় বিগ্রহটিকে অক্ষত রাখবেন এবং তার কাঁধেই কুঠারটি ঝুলিয়ে রাখবেন যাতে করে এ জনগণ এ ধরনের বিষয়ের প্রকৃত উৎস ও কারণসমূহের ব্যাপারে আরো বেশি অনুসন্ধান ও গবেষণা করতে সচেষ্ট হয় এবং পরিশেষে যখন তারা এ কাজকে (মূর্তি ভাঙা) পূর্বপরিকল্পিত ঘটনার চেয়ে বেশি কিছু মনে করবে না এবং কখনই তারা বিশ্বাস করবে না যে,বড় মূর্তিটি এ সব আঘাত করতে পারে তখন হযরত ইবরাহীম (আ.) এ কাজটি থেকে সত্যধর্ম প্রচার কার্যক্রমের ফায়দা উঠাতে সক্ষম হবেন এবং বলতে পারবেন যে,তোমাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী এ বড় মূর্তিটির সামান্য ক্ষমতাও নেই;তাহলে তোমরা কিভাবে এগুলোর উপাসনা করছ? ঘটনাচক্রে হযরত ইবরাহীম (আ.) এ সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললেন এবং তাঁর (হযরত ইবরাহীমের) কথাগুলো শোনার পর তাদের বিবেকবোধ জাগ্রত হলো এবং নিজেদেরকে তারা জালেম’বলে অভিহিত করেছিল। পবিত্র কোরআনে ঘটনাটি এভাবে বর্ণিত হয়েছে :

) فرجعوا إلى أنفسهم فقالوا إنّكم أنتم الظّالمون( ...

“তারা নিজেদের বিবেকের দিকে প্রত্যাবর্তন করল (অর্থাৎ তাদের বিবেকবোধ জাগ্রত হলো)। অতঃপর তারা বলল : নিঃসন্দেহে তোমরাই তো জালেম। আর তারা লজ্জাবশত নিজেদের মাথা নিচে নামিয়ে বলল : তুমি তো জান,মূর্তিগুলোর বাকশক্তি নেই।” (সূরা আম্বিয়া : 64)

আর এ থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে,শুরু থেকেই নবীদের সাফল্য ও বিজয়ের সোপান যুক্তি ও দলিল-প্রমাণ ব্যতীত আর কিছুই ছিল না। তবে প্রতিটি যুগে তা ছিল সে যুগেরই উপযোগী। আর যদি তা না হয় তাহলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হযরত ইবরাহীম (আ.) প্রতিমাগুলো যে ভেঙ্গেছিলেন তারই বা কি মূল্য থাকে? অবশ্যই তাঁর এ কাজের মাধ্যমে একটি বিরাট খেদমত সম্পন্ন হয়েছে যার জন্য নিজ প্রাণ উৎসর্গ করা বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত প্রশংসনীয়।

3. হযরত ইবরাহীম (আ.) বেশ ভালোভাবেই বুঝতেন যে,এ কাজ তাঁর জীবনকে বিপন্ন ও নিঃশেষ করে দেবে এবং স্বাভাবিকভাবে তিনি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন থাকবেন ও পালিয়ে যাবেন। অথবা তিনি অন্ততঃপক্ষে ঠাট্টা-মশকরা ও আজে-বাজে কথা বলায় লিপ্ত হবেন। কিন্তু এর বিপরীতে নিজ আত্মা,বিবেক-বুদ্ধি ও স্নায়ুর ওপর তাঁর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল। যেমন যখন তিনি মন্দিরে প্রবেশ করছিলেন তখন তিনি বিদ্রূপাত্মক কণ্ঠে প্রতিমাগুলোর কাছে গিয়ে প্রতিটিকে রুটি খেতে আহবান জানিয়েছিলেন। এরপর তিনি মন্দিরকে ভাঙ্গা কাঠ ও লাকড়ির ছোট-খাটো একটি স্তূপ বা টিলায় পরিণত করলেন। তিনি এ কাজকে অত্যন্ত সাদামাটা ও স্বাভাবিক কাজ বলে গণ্য করেছিলেন যেন তাঁর এ কাজের ফলশ্রুতিতে তাঁকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে না। যখন হযরত ইবরাহীম (আ.) বিচারকমণ্ডলীর সম্মুখীন হলেন তখন তিনি এমন উত্তরই দিয়েছিলেন, এটি আমার কাজ নয়,বরং এ হচ্ছে সবচেয়ে বড় মূর্তিটিরই কাজ। আপনারা তো তার কাছ থেকেই প্রকৃত ঘটনা জেনে নিতে পারেন।” বিচারালয়ে এ ধরনের রসিকতাপূর্ণ উক্তি আসলে ঐ ব্যক্তিরই সাজে যে নিজেকে যে কোন ধরনের পরিস্থিতি ও অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য পূর্ণ প্রস্তুত করেছে এবং (যে কোন পরিণতি বরণ করার জন্য) সে মোটেও ভীত ও শঙ্কিত হয় না।

এ সব কিছুর চেয়ে আশ্চর্যজনক হচ্ছে ইবরাহীম (আ.)-এর অবস্থা পর্যালোচনা করা ঐ মুহূর্তে যখন তাঁকে মিনজানিকের ওপর স্থাপন করা হয়েছিল এবং তখন তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে,আর কয়েক মিনিট পরেই তাঁকে ঐ আগুনের লেলিহান শিখার মধ্যে নিক্ষেপ করা হবে যার জ্বালানি কাষ্ঠ দেবতাদের সাহায্যার্থে এবং একটি পবিত্র ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করার জন্য ব্যাবিলনের অধিবাসীরা পূর্ব হতে একত্র ও স্তূপীকৃত করেছিল। আর আগুনের লেলিহান শিখাগুলো এতটা লকলকিয়ে উঠছিল যে,তার ওপর উড্ডয়নের ক্ষমতা শকুনেরও ছিল না। ঠিক ঐ মুহূর্তে ওহীর ফেরেশতা হযরত জিবরাইল (আ.) অবতীর্ণ হলেন এবং যে কোন সাহায্য করার ব্যাপারে যে তিনি প্রস্তুত এ কথা হযরত ইবরাহীমকে জানালেন এবং বললেন, আপনার যদি কোন বক্তব্য থেকে থাকে তাহলে তা বলুন।” হযরত ইবরাহীম (আ.) বললেন, আমার আর্জি আছে,তবে তা আপনার কাছে নয়,বরং তা মহান আল্লাহর কাছেই বলব।” ঐ কঠিন পরিস্থিতিতে হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর এ উত্তর তাঁর আত্মা ও চিত্তের মহত্ত্বকে সম্পূর্ণরূপে পরিস্ফুটিত করে।

বাদশাহ্ নমরুদের প্রাসাদ যে স্থানে অগ্নিকুণ্ড প্রজ্বলিত করা হয়েছিল সেখান থেকে কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত ছিল। বাদশাহ্ নমরুদ তার সেই প্রাসাদে বসে খুব সূক্ষ্মভাবে এবং অধীর আগ্রহে প্রতিশোধ গ্রহণের প্রতীক্ষা করছিল। আর সে মনে-প্রাণে দেখতে চাচ্ছিল যে,আগুনের লেলিহান শিখাগুলো কিভাবে ইবরাহীমকে দগ্ধ ও ভস্মীভূত করে ফেলছে। মিনজানিক সচল করা হলো। এক প্রচণ্ড ঝাঁকুনির পরপরই তাওহীদের অমিত বিক্রম বীর পুরুষের দেহ প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হলো। কিন্তু মহান আল্লাহর অপ্রতিরোধ্য ইচ্ছাশক্তি ঐ কৃত্রিম (মানবনির্মিত) দোযখকে পুষ্পোদ্যানে রূপান্তরিত করল। এ দৃশ্য দেখে সবাই আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেল। এমনকি বাদশাহ্ নমরুদ পর্যন্ত অনিচ্ছাকৃতভাবে আযরের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলেই ফেলল, ইবরাহীম তার নিজ প্রভুর কাছেও দেখছি সম্মানিত।”

কার্যকারণের স্রষ্টা এবং কার্যকারণের অস্তিত্ব বিলোপকারী মহান আল্লাহরই নির্দেশে অগ্নিকুণ্ডটি হযরত ইবরাহীমের জন্য পুষ্পোদ্যানে পরিণত হয়েছিল। যেহেতু মহান আল্লাহ্ই আগুনকে দহন করার ক্ষমতা,সূর্যকে আলোকোজ্জ্বল্য এবং চন্দ্রকে স্নিগ্ধতা দান করেছেন সেহেতু তিনি এ সব পদার্থ ও বস্তুর এ সব গুণ ও ক্ষমতা কেড়ে নিতে সক্ষম। আর এ কারণেই মহান আল্লাহকে কার্যকারণের স্রষ্টা এবং ঐ একই কার্যকারণের অস্তিত্বলোপকারী বলে অভিহিত করা যায়।

পুনশ্চ এ সব ঘটনাপ্রবাহ দীন প্রচারের ক্ষেত্রে হযরত ইবরাহীমকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে পারে নি। অবশেষে নমরুদ-সরকার পরামর্শ করার পর হযরত ইবরাহীমকে দেশ থেকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নিল। আর এভাবে শাম (সিরিয়া),ফিলিস্তিন,মিশর ও হিজাযের পবিত্র ভূমির দিকে হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর হিজরতের পটভূমি তৈরি হয়ে গেল।


12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53

54

55

56

57

58

59

60

61