চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 103678
ডাউনলোড: 9120


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 103678 / ডাউনলোড: 9120
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

মুসলমানদের ওপর উৎপীড়ন ও নির্যাতন

নবুওয়াতের শুরুতেই ইসলামের যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল তার পেছনে বেশ কিছু কারণ ছিল। তন্মধ্যে একটি কারণ হচ্ছে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর সঙ্গী-সাথী ও সমর্থকদের দৃঢ়তা। আপনারা ইতোমধ্যে মুসলমানদের নেতৃবর্গের ধৈর্য ও সহনশীলতার কতিপয় উদাহরণের সাথে পরিচিত হয়েছেন। পবিত্র মক্কায় (যা ছিল শিরক ও মূর্তিপূজার কেন্দ্রবিন্দু) তাঁর যে সব সমর্থক জীবনযাপন করতেন তাঁদের ধৈর্য ও সহনশীলতাও ছিল বেশ প্রশংসনীয়। হিজরতোত্তর ঘটনাবলীর অধ্যায়সমূহে আপনারা তাঁদের ত্যাগ ও দৃঢ়তার কথা শুনবেন। এখন পবিত্র মক্কার অসহায় পরিবেশে মহানবী (সা.)-এর যে কয়জন ত্যাগী সঙ্গী অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করেছেন অথবা নির্যাতন ভোগ করার পর ধর্ম প্রচারের জন্য পবিত্র মক্কা নগরী ত্যাগ করেছেন তাঁদের জীবনী আমরা বিশ্লেষণ করব :

1. বিলাল হাবাশী : তাঁর পিতামাতা ঐ ব্যক্তিবর্গের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যাঁদেরকে হাবাশাহ্ (আবিসিনিয়া) থেকে জাযীরাতুল আরব অর্থাৎ আরব উপদ্বীপে বন্দী করে আনা হয়েছিল। বিলাল যিনি পরে মহানবী (সা.)-এর মুয়াযযিন হয়েছিলেন তিনি উমাইয়্যা বিন খালাফের ক্রীতদাস ছিলেন। উমাইয়্যা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর খুব বড় ভয়ঙ্কর শত্রু ছিল। যেহেতু বনি হাশিম মহানবী (সা.)-এর নিরাপত্তা ও রক্ষার দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিল,তাই সে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে তার সদ্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী ক্রীতদাসকে প্রকাশ্যে নির্যাতন করত। সে তাঁকে সবচেয়ে তপ্ত দিনগুলোতে খালি শরীরে তপ্ত বালুর ওপর শুইয়ে তাঁর বুকের ওপর একটি প্রকাণ্ড তপ্ত পাথর চাপা দিয়ে রাখত এবং তাকে নিম্নোক্ত কথাগুলো বলত :

لا تزالُ هكذا حتّى تموت أوْ تكفرَ بمُحمّدٍ و تعبدَ اللّاتَ و العُزّى

“তোমার মৃত্যু হওয়া পর্যন্ত অথবা মুহাম্মদের স্রষ্টায় অবিশ্বাস অথবা লাত ও উজ্জার ইবাদাত না করা পর্যন্ত তুমি এ অবস্থায় থাকবে।”

কিন্তু বিলাল এতসব উৎপীড়ন ও নির্যাতন সত্ত্বেও দু টি কথার মাধ্যমে উত্তর দিয়েছিলেন যা ছিল তাঁর দৃঢ় ঈমানী শক্তি ও প্রবল প্রতিরোধের পরিচায়ক। তিনি বলতেন,أحدٌ أحدٌ আহাদ! আহাদ (অর্থাৎ মহান আল্লাহ্ এক ও অদ্বিতীয়)! আমি কখনই শিরক ও মূর্তিপূজার দিকে প্রত্যাবর্তন করব না। এ কৃষ্ণাঙ্গ দাস যিনি পাষণ্ড হৃদয় উমাইয়্যার হাতে বন্দী ছিলেন তাঁর দৃঢ়তা ও তীব্র প্রতিরোধ অন্যদেরকে আশ্চর্যান্বিত করেছিল,এমনকি ওয়ারাকাহ্ ইবনে নওফেল তাঁর অতি দুরবস্থা দর্শন করে কেঁদেছিলেন এবং উমাইয়্যাকে বলেছিলেন, মহান আল্লাহর শপথ,যদি তুমি তাকে (বিলাল) এ অবস্থায় হত্যা করে ফেল তাহলে আমি তার সমাধিকে যিয়ারত গাহে (মাযার) পরিণত করব। 268

কখনো কখনো উমাইয়্যা অতি নিষ্ঠুর আচরণ প্রদর্শন করত। সে বিলালের ঘাড়ে মোটা রশি বেঁধে তাকে বালকদের হাতে তুলে দিত। আর ঐসব বালক তাকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরাত।269

ইসলামের প্রথম যুদ্ধ বদরে উমাইয়্যা তার পুত্রসহ বন্দী হয়েছিল। কতিপয় মুসলমান উমাইয়্যার হত্যার পক্ষে মত না দিলে বিলাল বলেছিলেন,সে কুফর ও কাফিরদের নেতা। তাই তাকে হত্যা করা উচিত। আর তাঁর পীড়াপীড়ি করার কারণে উমাইয়্যা ও তৎপুত্রকে তাদের নিজেদের অত্যাচারমূলক কার্যকলাপের শাস্তিস্বরূপ হত্যা করা হয়।

2. আম্মার ইবনে ইয়াসির তাঁর পিতা- মাতা : আম্মার ও তাঁর পিতামাতা (ইয়াসির ও সুমাইয়া) ইসলাম গ্রহণকারী অগ্রবর্তীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দীন প্রচার কেন্দ্র যখন আরকাম ইবনে আবি আরকামের বাড়িতে ছিল তখন তাঁরা (আম্মার ও তাঁর পিতা-মাতা) ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। মুশরিকরা যেদিন তাঁদের ঈমান আনয়ন ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার বিষয়টি জানতে পারল তখন তারা তাঁদের ওপর নির্যাতন ও উৎপীড়ন চালাতে মোটেও কুণ্ঠাবোধ করল না। ইবনে আসীর লিখেছেন, মুশরিকরা এ তিন ব্যক্তিকে দিনের সবচেয়ে উত্তপ্ত মুহূর্তে তাঁদের নিজেদের বাড়ী ঘর ছেড়ে মরুভূমির তপ্ত উষ্ণ বাতাস ও প্রখর রৌদ্রতাপের মধ্যে অবস্থান করতে বাধ্য করত। এ সব শারীরিক নির্যাতনের এতটা পুনরাবৃত্তি করা হতো যে,এর ফলে ইয়াসির প্রাণত্যাগ করেন। একদিন ইয়াসিরের স্ত্রী সুমাইয়া এ ব্যাপারে আবু জাহলের সাথে ঝগড়া করেছিলেন। তখন ঐ পাষণ্ড হৃদয় ব্যক্তিটি বর্শা নিয়ে সুমাইয়ার বক্ষে আঘাত করে তাঁকে হত্যা করে। এ নারী ও পুরুষের অতি শোচনীয় এ অবস্থা মহানবীকে তীব্রভাবে দুঃখভারাক্রান্ত করেছিল। একদিন মহানবী (সা.) এ দৃশ্য দেখে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাঁদের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, হে ইয়াসির পরিবার! ধৈর্যধারণ কর। কারণ তোমাদের স্থান হচ্ছে বেহেশত।”

ইয়াসির ও তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর আম্মারের সাথে তারা অত্যন্ত কঠোর আচরণ করে এবং তাঁকেও বিলালের মত নির্যাতন করতে থাকে। তিনি তাঁর প্রাণ রক্ষা করার জন্য বাহ্যত ইসলাম ত্যাগ করতে বাধ্য হন। কিন্তু সাথে সাথে তিনি অনুতপ্ত হন এবং অশ্রুসিক্ত নয়নে মহানবী (সা.)-এর কাছে ছুঁটে আসেন। ঐ সময় তিনি অত্যন্ত দুঃখভারাক্রান্ত ছিলেন। তিনি মহানবীর কাছে গিয়ে পুরো ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করেন। রাসূলে আকরাম (সা.) তাঁকে তখন জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তখন তোমার অভ্যন্তরীণ (আত্মিক) ঈমানে কি সামান্যতম দ্বিধা দেখা দিয়েছিল? তিনি বললেন, আমার হৃদয় তখন ঈমানে পরিপূর্ণ ছিল। রাসূল বললেন, একটুও ভয় পেয়ো না। আর তাদের অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য তোমার ঈমান গোপন রেখ। তখন এ আয়াতটি আম্মারের ঈমান প্রসঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছিল,

) إلّا مَنْ  أُكرِهَ و قلبُهُ مطمئنٌ بالأيمان(

“তবে যাকে বাধ্য করা হয়েছে,অথচ যার অন্তর ঈমানে পূর্ণ ছিল সে ব্যতীত। (সূরা নাহল : 106)

এটিই প্রসিদ্ধ যে,ইয়াসির পরিবার যাঁরা ছিলেন সবচেয়ে অসহায় তাঁদের ব্যাপারে আবু জাহল নির্যাতন ও উৎপীড়ন করার সিদ্ধান্ত নিল। এ কারণে সে আগুন ও চাবুক প্রস্তুত করার নির্দেশ দিল। তখন ইয়াসির,সুমাইয়া ও আম্মারকে টেনে-হিঁচড়ে সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো এবং খঞ্জরের আঘাত দিয়ে,প্রজ্বলিত আগুনে পুড়িয়ে এবং চাবুক মেরে তাঁদেরকে শাস্তি দেয়া হলো। এ ঘটনার এতবার পুনরাবৃত্তি করা হয় যে,এর ফলে সুমাইয়া ও ইয়াসির প্রাণত্যাগ করেন।

কুরাইশ যুবকগণ যারা এ ধরনের ভয়ঙ্কর লোমহর্ষক দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছিল তারা ইসলাম ধর্মের ধ্বংস সাধন করার ব্যাপারে তাদের যত অভিন্ন স্বার্থ ছিল তা সত্ত্বেও আম্মারকে ক্ষত-বিক্ষত দেহে আবু জাহলের নির্যাতন ও শাস্তি থেকে মুক্তি দিয়েছিল যাতে করে তিনি তাঁর নিহত পিতা-মাতার মৃতদেহ দাফন করতে পারেন।

3. আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ : যে সব মুসলমান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল তারা পরস্পর আলাপ-আলোচনা করছিল যে,কুরাইশরা পবিত্র কোরআন সম্পর্কে শোনে নি। যদি আমাদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি মসজিদুল হারামে গিয়ে যত উচ্চকণ্ঠে সম্ভব পবিত্র কোরআনের গুটিকতক আয়াত তেলাওয়াত করে তাহলে সেটি খুব ভালো হবে। আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ অত্যন্ত সুললিত ও বলিষ্ঠ কণ্ঠে (সূরা আর রাহমানের) নিম্নোক্ত আয়াতগুলো তেলাওয়াত করেন,

) بسم اللهِ الرَّحمان الرَّحيم، الرَّحْمانُ علَّمَ الْقُرْآنَ خَلَقَ الإنْسانَ علَّمهُ البَيانَ( ...

“পরম করুণাময় ও পরম দাতা মহান আল্লাহর নামে। পরম করুণাময় (মহান আল্লাহ্) পবিত্র কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। মানুষকে তিনি ভাষা ও কথা বলা শিক্ষা দিয়েছেন ...।

এ সূরার বলিষ্ঠ ও সাবলীল বাক্যগুলো কুরাইশ নেতৃবৃন্দের মধ্যে এক আশ্চর্যজনক ভীতির সঞ্চার করল। একজন অসহায় ব্যক্তির মাধ্যমে যে আসমানী আহবান তাদের কর্ণকুহরে পৌঁছেছিল তার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া প্রতিহত করার জন্য সকলে তাদের স্থান ছেড়ে উঠে দাঁড়াল এবং তাঁকে এতটা প্রহার করল যে,তাঁর সমগ্র দেহ থেকে রক্ত প্রবাহিত হতে লাগল এবং তিনি খুব মর্মান্তিক অবস্থার মধ্য দিয়ে মহানবী (সা.)-এর সাহাবীদের কাছে ফিরে গেলেন। তবে তাঁরা সবাই সন্তুষ্ট ছিলেন এ কারণে যে,অবশেষে পবিত্র কোরআনের জীবনসঞ্জীবনী আহবান শত্রুদের কর্ণে প্রবেশ করল।270

ইসলাম ধর্মের যে সব ত্যাগী সৈনিক নবুওয়াতের সূচনালগ্নে অত্যন্ত কঠিন অবস্থার মধ্যে থেকে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের পথে দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিলেন তাঁদের সংখ্যা আসলে এর চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু সংক্ষেপে এতটুকুই যথেষ্ট।

4. আবু যার : আবু যার ছিলেন চতুর্থ অথবা পঞ্চম মুসলমান।271 অতএব,তিনি ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের প্রথম দিনগুলোতেই ইসলাম ধর্ম কবুল করেছিলেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ক্ষেত্রে অগ্রবর্তীদের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হয়েছেন।

পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট বর্ণনা অনুসারে,মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াত ও রিসালাতের সূচনালগ্নে যাঁরা ঈমান এনেছেন ইসলামে তাঁদের বিরাট মর্যাদা রয়েছে।272 আর যাঁরা পবিত্র মক্কা বিজয়ের আগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন,আধ্যাত্মিক ফজীলত,মর্তবা ও মর্যাদার দিক থেকে তাঁরা যে সব ব্যক্তি ইসলামের প্রসার ও শক্তি অর্জনের পরে অর্থাৎ পবিত্র মক্কা বিজয়ের পরে ঈমান এনেছে তারা এক নয়। পবিত্র কোরআন এ সত্যটি বর্ণনা করেছে নিম্নোক্ত এ আয়াতে:

) لا يستوي منكم من انفق من قبل الفتح وقاتل أولئك أعظم درجة من الذين انفقوا من بعدُ وقاتلوا(

“তোমাদের মধ্য থেকে যারা মক্কা বিজয়ের আগে (মহান আল্লাহর পথে) দান করেছে এবং জিহাদ করেছে তারা ঐ সব ব্যক্তি অপেক্ষা অধিকতর উচ্চ মর্যাদার অধিকারী যারা মক্কা বিজয়ের পরে দান করেছে এবং জিহাদ করেছে। (সূরা হাদীদ : 10)

ইসলামের প্রথম আহবানকারী

আবু যার যখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তখন মহানবী (সা.) জনগণকে গোপনে ইসলাম ধর্মের দিকে আহবান করতেন। তখনও ইসলামের প্রকাশ্য দাওয়াতের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় নি। সে সময় ইসলামের অনুসারীদের সংখ্যা মহানবী (সা.) এবং যে পাঁচজন তাঁর প্রতি ঈমান এনেছিলেন তাঁদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এ সব পরিস্থিতি বিচার করে বাহ্যত আবু যারের কাছে তাঁর নিজ ঈমান গোপন রাখা এবং নীরবে পবিত্র মক্কা নগরী ত্যাগ করে নিজ গোত্রের দিকে প্রত্যাবর্তন করা ব্যতীত আর কোন পথই খোলা ছিল না।

কিন্তু আবু যার ছিলেন বিপ্লবী আবেগ ও সংগ্রামী মনোবৃত্তির অধিকারী;যেন তাঁকে সৃষ্টিই করা হয়েছে এতদুদ্দেশ্যে যে,তিনি যেখানেই থাকবেন সেখানেই মিথ্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবেন এবং বিচ্যুতি ও পথভ্রষ্টতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবেন। কতগুলো নিস্প্রাণ কাঠ ও পাথর নির্মিত প্রতিমাসমূহের সামনে মানুষের কুর্ণিশ ও সিজদাবনত হওয়ার চেয়ে বড় আর কোন মিথ্যা থাকতে পারে কি?

আবু যার এ অবস্থা মেনে নিতে পারছিলেন না। এ কারণেই পবিত্র মক্কায় সংক্ষিপ্ত (সময়ের জন্য) অবস্থান করার পর একদিন তিনি মহানবী (সা.)-কে বললেন, আমি কি করব এবং আমার জন্য আপনি কোন দায়িত্ব নির্ধারণ করে দেবেন কি?

মহানবী বললেন, তুমি তোমার গোত্রের ইসলামের একজন মুবাল্লিগ (প্রচারক) হতে পার। এখন তুমি তোমার নিজ গোত্রের কাছে ফিরে যাও এবং আমার পক্ষ থেকে পরবর্তী নির্দেশ আসা পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করতে থাক।”

আবু যার বললেন, মহান আল্লাহর শপথ,আমার গোত্রের কাছে প্রত্যাবর্তনের আগেই এ দেশের জনগণের কানে ইসলামের আহবানধ্বনি পৌঁছে দেব এবং এই বাধাটা অর্থাৎ মক্কায় ইসলাম ধর্ম ও একত্ববাদের মর্মবাণী প্রচার ও প্রসারের পথে বিদ্যমান বাধা অবশ্যই ভেঙ্গে দেব।

একদিন কুরাইশগণ যখন মসজিদুল হারামে কথাবার্তায় মশগুল ছিল তখন তিনি এ সিদ্ধান্ত মোতাবেক মসজিদুল হারামে প্রবেশ করে অতি উচ্চ ও বলিষ্ঠ কণ্ঠে বললেন,

أشهد أنْ لا إله إلّا اللهُ وأشهدُ أنَّ محمَّداً رسولُ اللهِ

“আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে,মহান আল্লাহ্ ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই এবং আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে,হযরত মুহাম্মদ (সা.) মহান আল্লাহর রাসূল।”

যেহেতু ইসলামের ইতিহাস থেকে প্রতীয়মান হয়ে যায় যে,এ আহবানধ্বনি আসলেই ছিল (জনসমক্ষে ইসলাম ও তাওহীদের) সর্বপ্রথম আহবানধ্বনি যা প্রকাশ্যে কুরাইশদের মর্যাদা ও সম্মানের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল। এ আহবান এমন এক আগন্তুক ব্যক্তির মুখ দিয়ে বের হয়েছিল পবিত্র মক্কা নগরীতে যার না ছিল কোন সমর্থক,না ছিল কোন জ্ঞাতি ও আত্মীয়।

ঘটনাক্রমে,মহানবী (সা.) যা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন বাস্তবে তা-ই ঘটল। আবু যারের এ ধ্বনি মসজিদুল হারামে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হলে কুরাইশগণ তাদের সমাবেশস্থল বা আসর থেকে উঠে এসে তাঁর ওপর চড়াও হয়। তাঁকে তারা নির্দয়ভাবে প্রহার করতে থাকে। তারা তাঁকে এতটা মেরেছিল যে,এর ফলে তিনি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যান।

মহানবী (সা.)-এর চাচা হযরত আব্বাসের কানে এ সংবাদ পৌঁছলে তিনি দ্রূত মসজিদুল হারামে চলে যান এবং তিনি আবু যারের ওপর লুটিয়ে পড়েন। আবু যারকে মুশরিকদের হাত থেকে উদ্ধার করার জন্য তিনি একটি সুন্দর চালাকির আশ্রয় নেন। তিনি কুরাইশদের লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা সবাই ব্যবসায়ী ও বণিক। তোমাদের বাণিজ্যিক রুট গিফার গোত্রের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে। এ যুবকটি গিফার গোত্রের। সে যদি নিহত হয় তাহলে কুরাইশদের ব্যবসা-বাণিজ্য বিপদগ্রস্ত হয়ে যাবে। তখন আর কোন বাণিজ্যিক কাফেলাই এ গোত্রের মধ্য দিয়ে যাতায়াত করতে পারবে না।”

আব্বাসের এ পরিকল্পনা কাজে আসল। কুরাইশগণ আবু যারকে ছেড়ে দিল। তবে আবু যার ছিলেন  অসাধারণ সাহসী ও সংগ্রামী যুবক। পরের দিন তিনি মসজিদুল হারামে প্রবেশ করে পুনরায় ইসলাম ও তাওহীদের স্লোগান দেন। আবারও কুরাইশগণ তাঁর ওপর হামলা করে তাঁকে মারতে মারতে মৃতবৎ করে ফেলে। এবারও আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব পূর্ব দিনের একই কৌশল অবলম্বন করে তাঁকে কুরাইশদের হাত থেকে রক্ষা করলেন।273

যেভাবে ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে তদনুযায়ী আব্বাস যদি না থাকতেন তাহলে আবু যার মুশরিকদের হাত থেকে রক্ষা পেতেন কি না তা জানা যেত না। কিন্তু আবু যারও এমন ব্যক্তি ছিলেন না যিনি অতি সত্বর ইসলাম ধর্মের বিজয়ের পথে সংগ্রামস্থল থেকে পশ্চাদপসরণ করবেন। এ কারণেই কিছুদিন পর আবু যার নতুন করে সংগ্রাম শুরু করলেন। অর্থাৎ একদিন এক রমণীকে দেখলেন যে,সে কাবাগৃহ তাওয়াফ করার সময় আসাফ (أساف ) ও নায়েলাহ্ (نائلة ) নামের আরবদের যে দু টি প্রকাণ্ড মূর্তি পবিত্র কাবার চারপাশে স্থাপন করা হয়েছিল সেগুলো লক্ষ্য করে অন্তরের আর্জি পেশ করছে এবং বিশেষ ধরনের আবেগ ও ভক্তিসহকারে তাদের কাছে হাজত প্রার্থনা করছে।

আবু যার উক্ত নারীর মূর্খতা দেখে খুবই ব্যথিত হলেন। ঐ দু টি মূর্তির যে কোন অনুভূতি নেই তা ঐ নারীকে বুঝানোর জন্য আবু যার তাকে বললেন, এ দু টি মূর্তিকে পরস্পর বিবাহ দিয়ে দাও।”

ঐ মহিলাটি আবু যারের কথায় খুবই রাগান্বিত হলো। সে চিৎকার করে বলে উঠল, তুমি সায়েবী। 274 ঐ মহিলার চিৎকার শুনে কুরাইশ বংশীয় যুবকগণ আবু যারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে নির্মমভাবে প্রহার করতে লাগল। বনি বকর গোত্রের একদল লোক তাঁর সাহায্যার্থে ছুটে আসল এবং তাঁকে কুরাইশদের হাত থেকে মুক্ত করল।275

গিফার গোত্রের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ

মহানবী (সা.) তাঁর নতুন এ শিষ্যের যোগ্যতা এবং মিথ্যার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার ক্ষেত্রে তাঁর চোখ ধাঁধানো শক্তি খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তবে তখনও তীব্র সংগ্রাম ও প্রতিরোধের সময় হয় নি বলে তিনি আবু যারকে তাঁর নিজ গোত্রে ফিরে গিয়ে তাদের মাঝে ইসলাম ধর্ম প্রচারের নির্দেশ দেন।

আবু যার তাঁর গোত্রের কাছে ফিরে গেলেন। যে নবী মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত হয়েছেন এবং জনগণকে এক-অদ্বিতীয় স্রষ্টার ইবাদাত ও উত্তম গুণাবলী অর্জন করার দিকে আহবান জানাচ্ছেন তাঁর আবির্ভাবের ব্যাপারে ধীরে ধীরে তাদের সাথে আলোচনা করলেন।

প্রথমে আবু যারের ভাই ও মা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। পরে গিফার গোত্রের অর্ধেক লোকই মুসলমান হয়ে গেল। মহানবী (সা.)-এর মদীনায় হিজরত করার পর গিফার গোত্রের অবশিষ্ট অর্ধেক লোকও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। আসলাম গোত্রও গিফার গোত্রের পদাঙ্ক অনুসরণ করে মদীনায় মহানবীর সান্নিধ্যে উপস্থিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল।

হযরত আবু যার বদর ও উহুদ যুদ্ধের পর মদীনায় মহানবী (সা.)-এর সাথে মিলিত হন এবং সেখানেই তিনি বসবাস করতে লাগলেন।276

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শত্রুগণ

হিজরতোত্তর যে সব ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল সে সব ঘটনার মধ্যে গুটিকতক ঘটনার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর কতিপয় শত্রুর পরিচিতি গুরুত্বহীন হবে না। আমরা এখানে সংক্ষেপে কতিপয় শত্রুর নাম ও বিশেষত্বগুলো তুলে ধরব :

1 . আবু লাহাব : মহানবী (সা.)-এর প্রতিবেশী ছিল। সে কখনই মহানবী ও মুসলমানদের প্রত্যাখ্যান ও নির্যাতন করা থেকে বিরত থাকত না।

2 . আসওয়াদ ইবনে আবদ ইয়াঘূস : সে ছিল একজন ভাঁড়। যখনই সে কোন নিঃস্ব ও সহায়-সম্বলহীন মুসলমানকে দেখতে পেত তখনই সে ভাঁড়ামিবশত বলত, এসব নিঃস্ব সহায়-সম্বলহীন নিজেদেরকে পৃথিবীর বুকে বাদশাহ্ বলে মনে করে এবং ভাবছে যে,তারা শীঘ্রই ইরানের শাহের রাজমুকুট ও সিংহাসন দখল করে নেবে। তবে মৃত্যু তাকে দেখার সুযোগ দেয় নি যে,মুসলমানরা কিভাবে কায়সার (রোমসম্রাট) ও কিসরার (পারস্যসম্রাট) রাজত্ব ও সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়েছে!

3 . ওয়ালীদ ইবনে মুগীরাহ্ : সে ছিল কুরাইশ বংশীয় বৃদ্ধ ধনাঢ্য ব্যক্তি যার ছিল অঢেল সম্পত্তি। মহানবী (সা.)-এর সাথে তার আলোচনা আগামী অধ্যায়ে আমরা বর্ণনা করব।

4 . উমাইয়্যা ইবনে খালাফ এবং উবাই ইবনে খালাফ : একদিন উবাই নরম ও পঁচে যাওয়া হাড্ডিগুলো হাতে নিয়ে মহানবীকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল,إنَّ ربَّك يُحيي هذه العظامَ তোমার প্রভু কি এ সব অস্থি পুনরুজ্জীবিত করবেন? তখন মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী অবতীর্ণ হলো :

) قل يحييها الّذي أنشأها أوّل مرّةٍ(

আপনি বলে দিন,প্রথমবার যিনি তা সৃষ্টি করেছেন তিনিই তা পুনরুজ্জীবিত করবেন। (সূরা ইয়াসীন : 78-79)

এ দু ভ্রাতা বদর যুদ্ধে নিহত হয়েছিল।

5 . আবুল হাকাম বিন হিশাম : ইসলাম ধর্মের প্রতি তার অযৌক্তিক শত্রুতা ও বিদ্বেষের কারণে মুসলমানরা আবুল হাকাম ইবনে হিশামকে আবু জাহল (মূর্খের পিতা) বলে অভিহিত করেছিল। সেও বদর যুদ্ধে নিহত হয়েছিল।

6 . আস ইবনে ওয়ায়েল : সে আমর ইবনে আসের পিতা যে মহানবীকে আবতার বা নির্বংশ বলেছিল।

7 . উকবাহ্ ইবনে আবি মুঈত : সে মহানবী (সা.)-এর ভয়ঙ্কর শত্রুদের মধ্যে অন্যতম ছিল। সে মহানবী ও মুসলমানদের ওপর জুলুম করা থেকে মুহূর্তের জন্যও বিরত থাকত না।277

আবু সুফিয়ানের মতো আরো একদল ব্যক্তি রয়েছে যাদের সকল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ঐতিহাসিকগণ লিপিবদ্ধ করেছেন। আর আমরা বর্ণনা সংক্ষেপ করার জন্য তা এখানে উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকলাম।