চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড4%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 106803 / ডাউনলোড: 9707
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

11

দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমরের ইসলাম গ্রহণ

প্রত্যেক মুসলমানের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পেছনে কোন না কোন কারণ ছিল। কখনো কখনো ছোট একটি ঘটনা কোন ব্যক্তি বা দলের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কারণ হয়েছে। ইত্যবসরে দ্বিতীয় খলীফার ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ঘটনাও অত্যন্ত আকর্ষণীয়। যদিও ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর ক্রমধারাবাহিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে দ্বিতীয় খলীফা উমরের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের বিষয়টি হাবাশায় মহানবী (সা.)-এর সাহাবীদের হিজরত করার পরে উল্লেখ করা প্রয়োজন ছিল,কিন্তু যেহেতু এ ক্ষেত্রে মহানবীর সাহাবীদের কথা উত্থাপিত হয়েছে তাই ইসলামের দিকে দ্বিতীয় খলীফা উমর কিভাবে ঝুঁকলেন সেই কাহিনীটিই আমরা এখানে উল্লেখ করব।

ইবনে হিশাম লিখেছেন : হযরত উমরের পিতা খাত্তাবের পরিবারে কেবল তার মেয়ে ফাতিমা এবং তাঁর স্বামী সাঈদ ইবনে যাইদ ঈমান এনেছিলেন। ইসলামের সূচনালগ্নেই মুসলমানদের সাথে উমরের সম্পর্ক এতটা তিমিরাচ্ছন্ন ছিল যে,তিনি মহানবীর ভয়ানক শত্রু হিসাবে গণ্য হতেন। এ কারণেই খলীফার বোন ও তাঁর স্বামী সব সময় তাঁদের মুসলমান হওয়ার বিষয়টি তাঁর কাছে গোপন রাখতেন। এতদ্সত্ত্বেও খুবাব বিন আরত কতগুলো সময় ও উপলক্ষে তাঁদের বাড়িতে আসতেন এবং তাঁদের দু জনকে পবিত্র কোরআন শিখাতেন।

মক্কা নগরীর ভেঙে পড়া অবস্থা ও পরিস্থিতি উমরকে তীব্রভাবে অসন্তুষ্ট ও ক্রুদ্ধ করে তুলেছিল। কারণ তিনি দেখতে পেতেন যে,মক্কাবাসীদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি ও অনৈক্য প্রভাব বিস্তার করেছে এবং কুরাইশদের আলোকিত দিন যেন আঁধার রাতে পরিণত হয়েছে।

এ কারণেই তিনি চিন্তা করে দেখেন যে,মহানবীকে হত্যা করলেই এ মতবিরোধের উৎস কর্তিত হয়ে যাবে। এ লক্ষ্য বাস্তবায়ন করার জন্য তিনি মহানবীর বাসগৃহ কোথায় তা অনুসন্ধান করে দেখতে থাকেন। তাঁকে বলা হয়েছিল যে,সাফা বাজারের পাশে যে একটি ঘর আছে সেখানেই তিনি অবস্থান করছেন। তবে হামযাহ্,আবু বকর ও আলী (আ.) প্রমুখের মতো ৪০ জন তাঁর নিরাপত্তার জন্য সর্বদা নিয়োজিত আছেন।

নাঈম ইবনে আবদুল্লাহ্ উমরের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। সে বর্ণনা করেছে : উমরকে দেখলাম সে তার খোলা তলোয়ার হাতে নিয়ে কোথাও যাচ্ছে। আমি তার গন্তব্যস্থল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। সে আমাকে বলল,

أريد محمّداً الّذي فرّق أمر قريشٍ وسفّه احلامها وعاب دينها وسبّ آلهتها فأقتله

“আমি মুহাম্মদকে খুঁজছি,যে কুরাইশ গোত্রকে দু দলে বিভক্ত করেছে;তাদের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করেছে;তাদের ধর্মকে ভিত্তিহীন এবং তাদের দেবতাদের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছে। তাঁকে খুন করার জন্যই আমি যাচ্ছি।”

নাঈম বলল, আমি তাকে বললাম : তুমি নিজেকেই প্রতারিত করেছ তুমি কি ভাব নি যে,(যদি তুমি মুহাম্মদকে হত্যা কর তাহলে) আবদে মান্নাফের বংশধরগণ কি তোমাকে জীবিত রাখবে? যদি তুমি আসলেই শান্তি অন্বেষী হয়ে থাক তাহলে প্রথমে নিজের আত্মীয়-স্বজনদের সংশোধন কর। কারণ তোমার বোন ফাতিমা ও তার স্বামী মুসলমান হয়ে গেছে এবং মুহাম্মদের ধর্ম পালন করছে।”

নাঈমের এ কথায় যেন দ্বিতীয় খলীফার অস্তিত্বের মধ্যে ক্রোধের ঝড় বইতে লাগল। যার ফলে তিনি তাঁর কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের [হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে হত্যা] পরিকল্পনা বাতিল করে ভগ্নিপতির গৃহাভিমুখে রওয়ানা হলেন। যখনই তিনি তাঁদের ঘরের কাছাকাছি আসলেন তখন তিনি কারো নিচু শব্দের ধ্বনি শুনতে পেলেন যে খুব আকর্ষণীয় ও হৃদয়গ্রাহী কণ্ঠে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র কোরআন পাঠ করছে। নিজ বোনের ঘরে উমরের প্রবেশ এমনভাবে হয়েছিল যে,এর ফলে তাঁর বোন ও তাঁর স্বামী বুঝতে পারল যে,উমর ঘরে প্রবেশ করেছে। এ কারণেই তাঁরা পবিত্র কোরআনের শিক্ষককে ঘরের এমন একটি স্থানে লুকিয়ে রাখলেন যাতে করে উমরের দৃষ্টি তাঁর ওপর না পড়ে। ফাতিমাও যে কাগজ বা পত্রে পবিত্র কোরআন লিখিত ছিল তা লুকিয়ে রাখলেন।

উমর সালাম ও (সৌজন্যমূলক কথাবার্তা) কুশলাদি বিনিময় করা ছাড়াই তাঁদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, নিচু স্বরে তোমাদের গুঞ্জণ ধ্বনি যা আমার কানে পৌঁছেছে তা কি ছিল? তাঁরা বললেন, কোথায়,আমরা তো কিছুই শুনি নি। উমর বললেন, আমাকে বলা হয়েছে যে,তোমরা মুসলমান হয়ে গেছ এবং তোমরা মুহাম্মদের ধর্ম অনুসরণ করছ। তিনি এ কথা খুবই রাগত স্বরে বললেন এবং নিজ ভগ্নিপতিকে আক্রমণ করলেন। তাঁর বোনও স্বামীকে সাহায্য করার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। উমর নিজ বোনকেও তরবারির আগা দিয়ে মাথায় তীব্রভাবে আঘাত করলেন এবং তাঁকে আহত করলেন। যখন তাঁর মাথা থেকে অনবরত রক্ত ঝরছিল তখন সেই অসহায় মহিলাটি পূর্ণ ঈমান ও আস্থা সহকারে উমরকে বললেন, হ্যাঁ,আমরা মুসলমান হয়ে গেছি এবং মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছি। এখন আমাদের ব্যাপারে তোমার যা ইচ্ছা তা করার ক্ষমতা থাকলে করতে পার। রক্তে রঞ্জিত মুখে এবং রক্তাক্ত নয়নে ভাইয়ের সামনে দণ্ডায়মান বোনের এ হৃদয়বিদারক দৃশ্য খলীফা উমরের সমগ্র দেহে কম্পন সৃষ্টি করেছিল এবং তিনি যা করেছেন সে ব্যাপারে অনুতপ্ত হলেন।

এরপর উমর তাঁর বোনকে যা তাঁরা তিলাওয়াত করছিলেন তা তাঁকে দেখানোর জন্য অনুরোধ করলেন যাতে করে তিনি মুহাম্মদ (সা.)-এর বাণীসমূহের ব্যাপারে গভীরভাবে ভাবতে পারেন। যাতে উমর তা ছিঁড়ে না ফেলেন এই ভয়ে ফাতিমা তাঁকে শপথ করালেন। আর উমরও তাঁকে কথা দিলেন এবং শপথ করলেন যে,পাঠ করার পর তিনি তা তাঁদের কাছে ফিরিয়ে দেবেন। এরপর তাঁকে একটি ফলক দেয়া হলো যার মধ্যে সূরা ত্বাহার কয়েকটি আয়াত লিপিবদ্ধ ছিল। আর এগুলোর বঙ্গানুবাদ নিচে দেয়া হলো :

১. ত্বাহা,আপনার ওপর আমরা এ কোরআন এ জন্য অবতীর্ণ করি নি যে,আপনি নিজেকে কষ্টের মধ্যে ফেলবেন;

২. এ কোরআন ঐ ব্যক্তিদের জন্য স্মরণ যারা ভয় করে;

৩. (এ কোরআন) ঐ পবিত্র সত্তা যিনি পৃথিবী ও আসমানসমূহ সৃষ্টি করেছেন তাঁর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে;

৪. স্রষ্টা আরশ অর্থাৎ সমগ্র সৃষ্টিজগতের ওপর কর্তৃত্বশীল;যা কিছু আসমান ও যমীনের মাঝে আছে সে সব কিছু তাঁরই। তিনি প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত সকল বিষয় সম্পর্কে জ্ঞাত।

অতি বলিষ্ঠ ও প্রাঞ্জল ভাষাশৈলী সমৃদ্ধ ও গভীর তাৎপর্যমণ্ডিত এ সব আয়াত উমরকে তীব্রভাবে আলোড়িত ও প্রভাবিত করল। যে ব্যক্তি মাত্র কয়েক সেকেণ্ড আগেও পবিত্র কোরআন ও ইসলামের এক নাম্বার শত্রু ছিল সে তার নিজ পদ্ধতি পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিল। এ কারণেই যে গৃহে হযরত মুহাম্মদ (সা.) অবস্থান করছিলেন বলে তিনি আগে থেকেই জানতে পেরেছিলেন সে গৃহের দিকেই রওয়ানা হলেন। সেখানে পৌঁছে ঘরের দরজায় টোকা দিলেন। মহানবীর সাহাবীদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি উঠে এসে দরজার ফাঁক দিয়ে তাকালেন এবং উমরকে তরবারি হাতে দণ্ডায়মান দেখতে পেলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ মহানবীর কাছে গিয়ে তাঁকে বিস্তারিত জানালেন। হামযাহ্ ইবনে আবদুল মুত্তালিব বললেন, তাকে আসতে দাও। যদি সে সদুদ্দেশ্যে এসে থাকে তাহলে আমরা তার আগমনকে স্বাগত জানাব। আর যদি এর অন্যথা হয় তাহলে তাকে আমরা হত্যা করব।”

মহানবী (সা.)-এর সাথে উমরের আচরণে সেখানে উপস্থিত সাহাবিগণ আশ্বস্ত ও নিশ্চিত হলেন। এদিকে উমরের প্রশস্ত বদনমণ্ডল এবং পূর্বেকার কৃত কার্যকলাপের ব্যাপারে তাঁর অনুতাপ প্রকাশ তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে তাঁকে দৃঢ়পদ করেছিল এবং অবশেষে তিনি মহানবী (সা.)-এর একদল সাহাবীর সামনে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন এবং মুসলমানদের কাতারে শামিল হলেন।

ইবনে হিশাম তাঁর সীরাত গ্রন্থের ১ম খণ্ডের ৩৬৮ পৃষ্ঠায় উমরের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের বিষয়টি একটু অন্যভাবে বর্ণনা করেছেন। আগ্রহী পাঠকবর্গ তা জানার জন্য উক্ত গ্রন্থটি অধ্যয়ন করে দেখতে পারেন।

ষোড়শ অধ্যায় : কোরআন সম্পর্কে কুরাইশদের অভিমত

নিরঙ্কুশ ও সার্বিকভাবে মুজিযার স্বরূপ সংক্রান্ত আলোচনা এবং প্রকৃত প্রস্তাবে পবিত্র কোরআনের বিশেষ অলৌকিকত্ব সংক্রান্ত আলোচনা আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের বাইরে। আমরা আমাদের আকীদা-বিশ্বাস সংক্রান্ত লিখিত বই-পুস্তকে এ দু টি বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।২৭৮

কিন্তু ঐতিহাসিক আলোচনা-পর্যালোচনাসমূহ থেকে আমরা জানতে পারি যে,এ পবিত্র আসমানী গ্রন্থ (কোরআন) মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সবচেয়ে বড় ও কার্যকর হাতিয়ার ছিল। উদাহরণস্বরূপ বড় বড় বাগ্মী এবং কবি-সাহিত্যিক পবিত্র কোরআনের আয়াত,বাক্য ও শব্দাংশসমূহের অলংকার,ভাষার প্রাঞ্জলতা,মাধুর্য,আকর্ষণ ক্ষমতা ও লালিত্য প্রত্যক্ষ করে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতেন এবং তাঁদের সবাই স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে,পবিত্র কোরআন অলংকার,প্রাঞ্জলতা ও অনুপম ভাষাশৈলীর সর্বোচ্চ স্তরে রয়েছে। আর কখনই এ ধরনের বাচনভঙ্গি ও বাকরীতি মানব জাতির মধ্যে প্রচলিত ছিল না। পবিত্র কোরআনের প্রভাব অথবা আকর্ষণ শক্তি এমনই ছিল যে,মহানবীর সবচেয়ে কঠিন শত্রুও পবিত্র কোরআনের কিছু আয়াত শোনার পর কাঁপতে থাকত এবং কখনো কখনো তারা এতটা বেসামাল হয়ে যেত যে,দীর্ঘক্ষণ তারা বিস্ময়াভিভূত হয়ে নিজ স্থান থেকে নড়া-চড়া করার শক্তি হারিয়ে ফেলত। নিচে আমরা কয়েকটি উদাহরণ পেশ করছি :

ওয়ালীদের রায়

ওয়ালীদ আরব ছিল। আরবদের অনেক সমস্যার সমাধান তার হাতেই হয়েছে। তার অঢেল ধন-সম্পদ ছিল। পবিত্র মক্কা নগরীর ঘরে ঘরে ইসলামের প্রবেশ ও প্রভাবজনিত সমস্যা সমাধানের জন্য একদল কুরাইশ তার কাছে গমন করে পুরো বিষয়টি আদ্যোপান্ত তাকে অবহিত করে পবিত্র কোরআনের ব্যাপারে তার মতামত জানতে চায় এবং বলে, মুহাম্মদের কোরআন যাদু-টোনা অথবা গণকদের ভবিষ্যদ্বাণীর অনুরূপ অথবা তা এমন এক ধরনের বক্তৃতা,সম্বোধন ও বাণীসমূহের সমষ্টি যা সে রচনা করেছে। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত শ্রবণ করার পর এ গ্রন্থ সম্পর্কে নিজের অভিমত ব্যক্ত করার জন্য আরবদের এ জ্ঞানী ব্যক্তি কুরাইশ প্রতিনিধি দলের কাছে সময় চাইল। এরপর সে তার বাড়ি থেকে বের হয়ে হাজারে ইসমাঈলে মহানবীর পাশে বসে তাঁকে বলল, (হে মুহাম্মদ!) তোমার কবিতা থেকে কিছু আবৃত্তি করে শোনাও তো। মহানবী (সা.) বললেন, যা কিছু আমি এখন পাঠ করব তা কবিতা নয়,বরং তা মহান আল্লাহর বাণী যা তোমাদের হেদায়েতের জন্য তিনি অবতীর্ণ করেছেন। এরপর ওয়ালীদ কোরআন পাঠ করার জন্য বারবার অনুরোধ করতে থাকলে মহানবী সূরা ফুসসিলাতের প্রথম দিকের ১৩টি আয়াত পাঠ করলেন। যখন তিনি

) فإن أعرضوا فقل أنذرتكم صاعقة مثل صاعقة عاد و ثمود(

অতঃপর যদি তারা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে তাহলে তাদেরকে আপনি বলে দিন,আদ ও সামুদ জাতিদ্বয়ের বজ্রপাতের ন্যায় আমিও তোমাদের একটি বজ্রপাতের ব্যাপারে ভয় প্রদর্শন করছি’-এ আয়াতটিতে উপনীত হলেন তখন ওয়ালীদ ভীষণভাবে কেঁপে উঠল;তার দেহের পশমগুলো দাঁড়িয়ে গেল,বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তার নিজ স্থান ছেড়ে উঠে দাঁড়াল এবং সোজা নিজ বাসভবন অভিমুখে চলে গেল। কয়েকদিন সে ঘর থেকেই বের হলো না। এর ফলে কুরাইশরা তার সম্পর্কে ব্যঙ্গ করে বলতে লাগল : ওয়ালীদ পূর্বপুরুষদের পথ ত্যাগ করে মুহাম্মদের পথ অবলম্বন করেছে।২৭৯

প্রখ্যাত মুফাসসির তাবারসী বলেছেন, যে দিন সূরা গাফির মহানবী (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ হলো সে দিন মহানবী খুবই আকর্ষণীয় কণ্ঠে উক্ত সূরার আয়াতসমূহ জনগণের কাছে প্রচার করার জন্য তেলাওয়াত করছিলেন। ঘটনাক্রমে ওয়ালীদ মহানবীর পাশে বসেছিল এবং আনমনে নিম্নোক্ত আয়াতগুলো শুনছিল। আয়াতগুলো হলো :

) حم تنزيل الكتاب من الله العزيز العليم غافر الذّنب و قابل التّوب شديد العقاب ذي الطّول لا إله إلا هو إليه المصير ما يجادل في آيات الله إلّا الّذين كفروا فلا يغررك تقلّبهم في البلاد(

“হামীম। এ গ্রন্থটি মহাপরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। তিনিই পাপসমূহ ক্ষমাকারী,অনুশোচনা গ্রহণকারী,কঠোর শাস্তিদাতা,অফুরন্ত নেয়ামত দানকারী। তিনি ব্যতীত আর কোন উপাস্য নেই। সব কিছুর চূড়ান্ত পরিণতি একমাত্র তাঁর দিকেই। একমাত্র যারা কুফর করেছে কেবল তারাই মহান আল্লাহর নিদর্শনসমূহ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করে। তাই নগর ও শহরসমূহে তাদের জীবনযাপন ও কর্মতৎপরতা যেন আপনাকে বিমোহিত ও প্রতারিত না করে...।”

এ আয়াতগুলোর মধ্যে যে কয়টির এখানে উদ্ধৃতি দিয়েছি এবং অনুবাদ করেছি সেগুলো আরবের জ্ঞানী ব্যক্তিকে তীব্রভাবে প্রভাবিত করেছিল। যখন বনি মাখযুম গোত্র তাকে চারদিক থেকে ঘিরে তার কাছ থেকে পবিত্র কোরআনের ব্যাপারে অভিমত জানতে চেয়েছিল তখন সে পবিত্র কোরআন সম্পর্কে বলেছিল, আজ আমি মুহাম্মদের নিকট থেকে এমন কথা শুনেছি যা মানুষ ও জ্বিন জাতির বাণী নয়। সে বাণীর এক বিশেষ মাধুর্য ও সৌন্দর্য রয়েছে। এর ডাল-পালাগুলো ফলদানকারী এবং এর শিকড় খুবই কল্যাণকর। এটি এমন এক ধরনের বাণী যা বলিষ্ঠ,শ্রেষ্ঠ ও উন্নত যার চেয়ে অন্য কোন বাণী শ্রেষ্ঠ ও উন্নত হতে পারে না। ২৮০

و إنّ له لحلاوة و إنّ عليه لطلاوة و إنّ أعلاه لمثمر و إنّ أسفله لمغدق و إنّه يعلو و لا يُعلى عليه

একজন বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতের২৮১ মতে ওয়ালীদের উপরিউক্ত উক্তিটি ছিল পবিত্র কোরআন সম্পর্কে মানুষের পক্ষ থেকে প্রথম নিরপেক্ষ সমালোচনামূলক মূল্যায়ন। তার এ কথা যদি আমরা গভীরভাবে চিন্তা করি তাহলে সে যুগে পবিত্র কোরআনের অলৌকিকত্বের স্বরূপ আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে যাবে এবং সে সাথে জানা যাবে যে,তখনকার জনগণের কাছে পবিত্র কোরআনের অলৌকিকত্বের কারণ উক্ত গ্রন্থটির অসাধারণ ও অলৌকিক আকর্ষণক্ষমতা,মাধুর্য ও লালিত্য যা পবিত্র কোরআন ব্যতীত অন্য কোন গ্রন্থ ও সাহিত্য-কর্মে সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত।

অপর একটি উদাহরণ

উতবাহ্ ইবনে রাবীয়াহ্ : সে ছিল কুরাইশদের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি। যে দিন হামযাহ্ ইবনে আবদুল মুত্তালিব ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন সে দিন কুরাইশদের গোটা সভাস্থলের ওপর দুঃখ ও বেদনার ছায়া বিস্তার করেছিল এবং ইসলাম ধর্ম যে আরো বেশি বিস্তৃতি লাভ করবে এ কথা ভেবে কুরাইশ নেতৃবর্গ ভয়ে দিশাহারা হয়ে গিয়েছিল। সে সময় উতবাহ্ প্রস্তাব করল, আমি মুহাম্মদের কাছে যাব এবং কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে তাকে প্রস্তাব দেব। আশা করা যায় যে,সে এগুলোর মধ্য থেকে অন্তত একটি গ্রহণ করবে এবং তার নতুন ধর্ম প্রচার করা থেকে বিরত থাকবে। কুরাইশ নেতৃবৃন্দ উতবার বক্তব্য মেনে নিল। সে উঠে মহানবী (সা.)-এর কাছে গমন করল। তিনি তখন মসজিদুল হারামের পাশে বসেছিলেন। উতবাহ্ মহানবীর কাছে গিয়ে পবিত্র মক্কা নগরীর কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব এবং প্রচুর ধন-দৌলত তাঁর হাতে অর্পণ এবং ইসলাম ধর্ম প্রচার কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ার প্রস্তাব দিল। যখন উতবাহ্ তার কথা শেষ করল তখন মহানবী (সা.) বললেন, হে আবু ওয়ালীদ! তোমার বক্তব্য কি শেষ হয়েছে? সে বলল, হ্যাঁ। তখন মহানবী বললেন, এ আয়াতগুলো মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ কর। তাহলে তুমি তোমার যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে :

) بسم الله الرّحمان الرّحيم، حم تنزيل من الرّحمان الرّحيم، كتاب فصّلت آياته قرآنا عربيّا لقوم يعلمون، بشيرا و نذيرا فأعرض أكثرهم فهم لا يسمعون(

“পরম করুণাময় দাতা ও দয়ালু মহান আল্লাহর নামে। হামীম,এ গ্রন্থটি যেহেতু পরম করুণাময় দাতা ও দয়ালুর কাছে থেকে অবতীর্ণ তাই এটি এমন এক গ্রন্থ যার আয়াতসমূহ ঐ জাতি বা সম্প্রদায়ের জন্য বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে যারা জ্ঞানী। এ গ্রন্থটি হচ্ছে আরবী ভাষায় অবতীর্ণ সুপাঠ্য গ্রন্থ। সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারী। অতঃপর তাদের অধিকাংশের নিকট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন। কারণ তারা (সত্য বাণী) শ্রবণ করে না।”

মহানবী (সা.) এ সূরা থেকে কিছু আয়াত তেলাওয়াত করলেন। যখন ৩৭ নং আয়াতে পৌঁছলেন তখন তিনি সিজদাহ্ করলেন। সিজদাহ্ সমাপন করার পর উতবাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আবু ওয়ালীদ! মহান আল্লাহর বাণী কি শুনেছ? উতবাহ্ মহান আল্লাহর বাণী দ্বারা এতটা প্রভাবিত ও অভিভূত হয়ে গিয়েছিল যে,সে নিজ হাতের ওপর ভর দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ মহানবীর দিকে তাকিয়েছিল যেন কেউ তার বাকশক্তি কেড়ে নিয়েছে। এরপর সে সেখান থেকে উঠে কুরাইশদের সভাস্থলের দিকে গমন করল। কুরাইশ নেতৃবৃন্দ তার মুখের অভিব্যক্তি থেকে মনে করল যে,সেও হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কথা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে এবং নিরাশ ও পরাজিত হয়ে ফিরে এসেছে। তখন সকলের দৃষ্টি উতবার মুখমণ্ডলের দিকে নিবদ্ধ ছিল। সকলেই বলে উঠল, ব্যাপার কি,কি হলো? উতবাহ্ বলল, মহান আল্লাহর শপথ,না তা কবিতা,না তা যাদু,আর না তা গণকের ভবিষ্যদ্বাণী (و الله ما هو بالشعر و لا بالسّحر و لا بالكهانة )। তাকে ছেড়ে দেয়াই আমি কল্যাণকর বলে মনে করি যাতে করে সে নির্বিঘ্নে আরব গোত্রসমূহের মাঝে তার প্রচার কার্যক্রম চালাতে পারে। যদি সে সফলকাম ও বিজয়ী হয় এবং রাজ্য,নেতৃত্ব ও শাসনক্ষমতার অধিকারী হয় তাহলে তা তোমাদের জন্য গর্বের বিষয় বলে গণ্য হবে এবং তোমরাও তাতে তোমাদের অংশ পাবে। আর যদি সে নিহত হয় তাহলে তো তোমরা তখন এমনিতেই তার থেকে স্বস্তি লাভ করবে।”

কুরাইশরা উতবার এ অভিমত প্রকাশের কারণে বেশ ব্যঙ্গ করে বলল, তুমিও মুহাম্মদের কথা দ্বারা প্রভাবিত ও অভিভূত হয়েছ।”

উপরিউক্ত বর্ণনাদ্বয় পবিত্র কোরআন সংক্রান্ত জাহেলী যুগের প্রখ্যাত বাক্যবাগীশদের অভিমতের নমুনা। আরো নমুনা বিদ্যমান আছে। আগ্রহী পাঠকবর্গের আরো অবগতির জন্য তাঁদেরকে তাফসীর গ্রন্থগুলো পাঠ করার অনুরোধ জানাচ্ছি।

সৃষ্টিকর্তার জ্ঞান ও স্বাধীন সৃষ্টির ভবিষ্যৎ

এখানে একটি প্রশ্ন উঠতে পারে যে , অপরিহার্য সত্তা চিরজ্ঞানময় সৃষ্টিকর্তা যেহেতু অতীত ও ভবিষ্যৎ সব কিছু জানেন সেহেতু তিনি কথিত স্বাধীন সৃষ্টির ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও জানেন। আর তিনি যা জানেন তার অন্যথা হতে পারে না। এমনকি স্রষ্টা যদি কখনো কোনো সুনির্দিষ্ট সৃষ্টিসত্তার কোনো বিশেষ কাজে হস্তক্ষেপ করেন , তো নিঃসন্দেহে তা-ও তিনি আগে থেকেই জানতেন যে , তিনি তার ঐ কাজে হস্তক্ষেপ করবেন। অতএব , তা অনিবার্য ছিলো। ফলে এখানে স্বাধীনতার কোনো স্থান নেই।

এ বিষয়টি তাক্বদীর (تقدير ) বা ভাগ্যনির্ধারণ বিষয়ক আলোচনার অন্তর্ভুক্ত যা একটি বিস্তারিত আলোচনার বিষয় এবং যে আলোচনা কেবল বিচারবুদ্ধির ভিত্তিতে করা সম্ভব নয়।3 তবে এখানে বিচারবুদ্ধি ভিত্তিক আলোচনায় আমরা সংক্ষেপে এর কয়েকটি দিকের ওপরে আলোকপাত করতে পারি। প্রথমতঃ আমরা আমাদের বিচারবুদ্ধি দ্বারা অনুভব করি যে , আমরা জড় পদার্থ থেকে স্বতন্ত্র এবং প্রাণশীল সৃষ্টি হওয়ার কারণে আমাদের ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীনতা রয়েছে। দ্বিতীয়তঃ আমরা লক্ষ্য করি যে , মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীনতা প্রাণীর ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীনতার চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী যে কারণে অন্যান্য প্রাণীর ব্যতিক্রমে মানুষ তার সহজাত প্রবণতার বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ করতে পারে। যেমন: চরম ক্ষুধার্ত অবস্থায়ও এবং তার সামনে সুস্বাদু খাবার থাকা সত্ত্বেও ও তা খাওয়ার পথে কোনোরূপ বাধা না থাকা সত্ত্বেও সে তা খাওয়া থেকে বিরত থাকতে পারে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে , কারো ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভবিষ্যৎ-জ্ঞানের অধিকারী অপরিহার্য সত্তার জানা থাকার মানেই তো অনিবার্য হয়ে যাওয়া , এমতাবস্থায় ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীনতার কী মানে হতে পারে ?

এ প্রশ্নের জবাব হচ্ছে , সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি-ইচ্ছা বা নির্ধারণ বা ভবিষ্যৎ-জ্ঞান মানে এরূপ হওয়া অপরিহার্য নয় যে , অনন্ত ভবিষ্যতের ছোট-বড় প্রতিটি বিষয় তাতে অনিবার্য রূপে থাকবেই। কারণ , তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায় তাঁর অনাদিকালীন প্রথম ইচ্ছাকরণের পর সব কিছু স্বয়ংক্রিয়ভাবে হতেই থাকবে ; অতঃপর আর তাঁর ইচ্ছা করার মতো বা করণীয় বলতে কিছুই থাকবে না। এরূপ হলে স্বয়ং তাঁর ইচ্ছাশক্তি , সৃষ্টিক্ষমতা ও স্বাধীনতা অনিবার্যতার শিকারে পরিণত হবে - যা থেকে তিনি উর্ধে। বরং তাঁর ইচ্ছা ও সৃষ্টিসিদ্ধান্তের মধ্যে প্রত্যক্ষ কর্ম ও সৃষ্টি , প্রাকৃতিক বিধিবিধান সৃষ্টি , প্রাকৃতিক বিধানের আওতায় যান্ত্রিক কার্যক্রম , ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন সৃষ্টির মাধ্যমে পরোক্ষ কর্ম ও সৃষ্টি , তাঁর চিরন্তন নির্ধারণ এবং তাঁর উপস্থিত নিয়ন্ত্রণ সবই অন্তর্ভুক্ত রাখতে তিনি সক্ষম। আর ভবিষ্যৎ-জানা সম্পর্কে বলতে হয় যে , তিনি সৃষ্টির ভবিষ্যৎকে অংশতঃ অনিবার্য করে দিতে পারেন , অংশতঃ শর্তাধীন করে দিতে পারেন (যেমন: সে এরূপ করলে তার ফলে এই হবে , আর ঐরূপ করলে তার ফলে ঐ হবে) ও অংশতঃ পুরোপুরি অনির্ধারিত রেখে দিতে পারেন এবং সংশ্লিষ্ট সৃষ্টির ভবিষ্যৎ তাঁর জ্ঞানে এভাবেই অন্তর্ভুক্ত থাকবে - এটাই স্বাভাবিক।

বিষয়টি আরো কিছুটা সহজভাবে বুঝার জন্য বলা যেতে পারে যে , যেহেতু স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির পুরো ভবিষ্যতের দিক মনোযোগ দিলে তা অনিবার্য হয়ে যায় সেহেতু তিনি সংশ্লিষ্ট সৃষ্টির স্বাধীন ক্ষেত্রটির ভবিষ্যতের প্রতি মনোযোগ দেয়া থেকে বিরত থাকেন এবং এভাবে তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন।4

স্রষ্টার কর্মের সাথে কালের সম্পর্ক

আমরা যখন বলি যে , পরম জ্ঞানময় অপরিহার্য সত্তা সব সময় সৃষ্টি ও পরিচালনা করে চলেছেন তখন এ প্রসঙ্গে একটি কালগত প্রশ্ন উঠতে পারে। কারণ , সব সময় মানে অতীত , বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। কিন্তু অনাদি ও অনন্ত অপরিহার্য সত্তা কালের উর্ধে। অর্থাৎ তাঁর জন্য কাল প্রযোজ্য নয়। তাই প্রশ্ন উঠতে পারে যে , এমতাবস্থায় তিনি ছিলেন , আছেন ও থাকবেন অথবা তিনি সৃষ্টির সূচনা করেছেন , এখনো সৃষ্টি ও পরিচালনা করছেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন - এ জাতীয় কথা দ্বারা কি তাঁর সম্পর্কে কালগত সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয় না ?

এর জবাব হচ্ছে , প্রকৃত পক্ষে এ জাতীয় ক্রিয়ার ব্যবহার করা হয় সৃষ্টির কালগত সীমাবদ্ধতার কারণে। যেহেতু সৃষ্টিসমূহ কালের গর্ভে অস্তিত্ব লাভ করে ও এগিয়ে চলে সেহেতু কালভিত্তিক ক্রিয়াপদ ব্যবহার ব্যতিরেকে কোনো কার্য সৃষ্টিকুলের জন্য অনুধাবনযোগ্য নয়।

বস্তুতঃ কাল ও স্থান হচ্ছে এক ব্যাপকতর সৃষ্টি - যার গর্ভে সকল সৃষ্টিকে সৃষ্টি ও অগ্রগতি প্রদান করা হয়েছে। তবে এই স্থান ও কালের আপেক্ষিকতা রয়েছে - যা বর্তমান যুগের বিজ্ঞান , বিশেষতঃ কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান স্বীকার করছে। এই আপেক্ষিকতা বস্তুগত ও অবস্তুগত অনেক কিছুর সাথে সংশ্লিষ্ট। অতএব , সামগ্রিকভাবে কাল-কে কোনো একটি সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডে এবং স্থানকেও কোনো একটি সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডে পরিমাপ করা সম্ভব বলে মনে করা উচিত হবে না।

অতএব , প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে এই যে , একটি সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডের দৃষ্টিতে বা বিচারে কালের ও স্থানের যে ধারণা আমরা লাভ করি তার গর্ভে বিভিন্ন মানদণ্ডের অনেক কাল ও স্থান রয়েছে। আবার এ বৃহৎ কাল ও স্থানের ন্যায় অনেকগুলো বৃহৎ কাল ও স্থান একটি বৃহত্তর কাল ও স্থানের গর্ভে রয়েছে। এভাবে শেষ পর্যন্ত একটি সর্বব্যাপক কাল ও স্থান রয়েছে - অপরিহার্য সত্তা যাকে সৃষ্টি করে সকল সৃষ্টিকে তার গর্ভে স্থান দিয়েছেন। বলা বাহুল্য যে , নিম্নতর কাল ও স্থান দ্বারা উর্ধতর কাল ও স্থান প্রভাবিত হয় না। অতএব , উচ্চতর কাল ও স্থানের আওতাভুক্ত পর্যবেক্ষক নিম্নতর কাল ও স্থানকে পর্যবেক্ষণ করলে তার দ্বারা নিজে প্রভাবিত হয় না। এভাবে শেষ পর্যন্ত সর্বব্যাপক স্থান-কালেরও উর্ধে যে সত্তা তিনি সকল কাল ও স্থানেরই পর্যবেক্ষক , কিন্তু কোনো কাল ও স্থানই তাঁর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

সৃষ্টিসত্তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দু টি মাত্রা ( Dimension)হচ্ছে কাল ও স্থান। কালের স্বরূপ ও আপেক্ষিকতা অনুধাবন অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার এবং এ কারণে এর আপেক্ষিকতা সম্পর্কে অভিজ্ঞতাজাত উদাহণ দেয়াও প্রায় অসম্ভব। কারণ , অনেকে কর্তাভেদে অভিন্ন কালের বিভিন্ন অনুভূতি ও বিভিন্ন কর্মের ( Object)ওপর অভিন্ন কালের বিভিন্ন প্রভাবকে কালের আপেক্ষিকতার প্রমাণ হিসেবে গণ্য করলেও প্রকৃত পক্ষে কালের অনুভূতির প্রভাবের আপেক্ষিকতা কালের আপেক্ষিকতা প্রমাণ করতে সক্ষম নয়। তবে স্থানের আপেক্ষিকতা বোধগম্য বিষয় বটে।

বিষয়টিকে অপেক্ষাকৃত সহজবোধগম্য করার জন্য একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। বলা বাহুল্য যে , অপরিহার্য সত্তা স্রষ্টা , তাঁর বৈশিষ্ট্য ও তাঁর কাজ অনুধাবনের জন্য সৃষ্টি সম্পর্কিত উদাহরণ হচ্ছে দুর্বল উদাহরণ - যাতে প্রকৃত সত্য প্রতিফলিত হয় না , তবে প্রকৃত সত্যের কাছাকাছি পৌঁছা যায় ও মোটামুটি ধারণা লাভ করা যায়। এ কারণেই কেবল বিষয়টিকে সহজবোধগম্য করার লক্ষ্যে আমরা এ ধরনের দুর্বল উদাহরণের আশ্রয় নিতে পারি ।

কাল ও স্থানের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত একটি বিষয় হচ্ছে গতি। তাই এই গতি থেকেই বিষয়টি মোটামুটি বুঝা যেতে পারে। কাল ও স্থানের আওতাধীন প্রতিটি সৃষ্টিই কোনো না কোনোভাবে গতিশীল অবস্থায় রয়েছে। তবে প্রকৃত ব্যাপার হলো এ সৃষ্টিলোকে বহু ধরনের গতি রয়েছে। কিন্তু সকল গতি সকল সৃষ্টির ওপর প্রভাব বিস্তার করে না। যেমন: পরমাণুর অভ্যন্তরে প্রচণ্ড গতি রয়েছে , কিন্তু এ গতি অণুর গতিকে প্রভাবিত করে না। আবার স্বয়ং অণু গতিশীল , কিন্তু বহু অণু সমন্বয়ে গঠিত কোনো বস্তুর গতিকে অণুর গতি প্রভাবিত করতে পারে না।

এবার আরেকটি সহজবোধ্য দৃষ্টান্তে আসা যাক। একটি লোক একটি চলমান জাহাযের ডেকের ওপর একদিক থেকে আরেক দিকে হেঁটে যাচ্ছে , আর তার গায়ের ওপর , ধরুন , তার পিঠের ওপর , একটি পিঁপড়া একদিক থেকে আরেক দিকে হেঁটে যাচ্ছে।

এখানে পিঁপড়ার গতি দ্বারা লোকটির গতি প্রভাবিত হচ্ছে না , কিন্তু লোকটির হাঁটার কারণে পিঁপড়াটি দু টি গতির অধিকারী হচ্ছে। অন্যদিকে জাহাযটি গতিশীল , ফলে পিঁপড়ার তিনটি , লোকটির দু টি ও জাহাযের একটি গতি রয়েছে। এভাবে পৃথিবী , সৌরলোক , ছায়াপথ ও অসংখ্য ছায়াপথ সম্বলিত বৃহত্তর জগৎ এবং তদুর্ধ জগৎসমূহের গতি বিবেচনায় আনলে গতির সংখ্যা নিম্নতর পর্যায়ে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকবে এবং উর্ধতর পর্যায়ে ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকবে। অতঃপর আমরা উপনীত হবো গোটা সৃষ্টিলোকরূপ এককের স্রষ্টার কাছে যিনি গতির সম্পূর্ণ উর্ধে।

উপরোক্ত উদাহরণ থেকে যে কোনো সৃষ্টির গতির ও সেই সাথে স্থানগত অবস্থানের বহুত্ব ও আপেক্ষিকতা প্রমাণিত হয়।

একইভাবে তিনি কাল ও স্থানেরও উর্ধে। কিন্তু তিনি কাল , স্থান ও গতির [ প্রকৃত পক্ষে এ তিনটি হচ্ছে একটি অভিন্ন সৃষ্টির তিনটি মাত্রা ( Dimension)মাত্র ] স্রষ্টা ও পর্যবেক্ষক। এমতাবস্থায় সৃষ্টি ও পরিচালনার তিনটি কাল হচ্ছে সৃষ্টির অবস্থান থেকে উদ্ভূত , স্রষ্টার অবস্থান থেকে নয়। কারণ , তাঁর জন্য কাল বলতে কিছু নেই। বরং তাঁর কাছে সব কিছু সদা বর্তমান। [ বস্তুত : আমরা আমাদের জন্য তিনটি কালের প্রবক্তা হলেও প্রকৃত পক্ষে সৃষ্টির কাল মাত্র দু টি - অতীত ও ভবিষ্যৎ ; সৃষ্টির জন্য বর্তমান মানে হচ্ছে অতীত ও ভবিষ্যতের দুই প্রান্তিক কাল - বিন্দুর মিলনস্থল মাত্র। আর স্রষ্টা কালোর্ধ বিধায় সদা বর্তমান। ]

অপরিহার্য সত্তার সৃষ্টিকরণের তাৎপর্য

ওপরের আলোচনা থেকে এ বিষয়টিও সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে , অপরিহার্য সত্তার সৃষ্টিকরণরূপ কর্মের তাৎপর্য হচ্ছে তাঁর সৃষ্টিক্ষমতা ও সৃষ্টি-ইচ্ছার সাথে (যা তাঁর সত্তা থেকে স্বতন্ত্র কোনো গুণ নয় , বরং তাঁর সত্তাই) সৃষ্টির সম্পর্ক , যা সৃষ্টির কালগত বৈশিষ্ট্যের বিচারে অতীত ও ভবিষ্যৎ বলে প্রতিভাত হয়। তেমনি সৃষ্টির সাথে সম্পর্কের কারণেও কখনো তা প্রাকৃতিক বিধানরূপে , কখনো অবিলম্বে কার্যকরযোগ্য ইচ্ছারূপে , কখনো বিলম্বে কার্যকরযোগ্য ইচ্ছারূপে , কখনো বিলম্বে কার্যকরযোগ্য সিদ্ধান্তরূপে , কখনো প্রাকৃতিক বিধানে হস্তক্ষেপরূপে , কখনো কতক সৃষ্টির ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীনতা রূপে এবং কখনো ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীনতার অধিকারী সৃষ্টির কর্মে হস্তক্ষেপরূপে প্রতিভাত হয়।

অন্যদিকে যা কিছুকে আমরা প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যতিক্রম বলে মনে করি তা-ও ব্যতিক্রম নয়। বরং তা-ও স্রষ্টা কর্তৃক নির্ধারিত ভিন্ন এক ধরনের বিধান বটে , যদিও তা সচরাচর আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরে থেকে যায় বিধায় আমাদের জ্ঞান তার স্বরূপ ধরতে পারে না। অন্যথায় মহাবিজ্ঞানময় অপরিহার্য সত্তার সৃষ্টিকরণ ও পরিচালনা ব্যবস্থায় ইতিবাচক নিয়মাবলী বহির্ভূত কোনো কিছু বিচারবুদ্ধির কাছে বোধগম্য হতে পারে না।

সৃষ্টিলোকে অবাঞ্ছিত উপাদানসমূহের অস্তিত্বের তাৎপর্য

এ জগতের বুকে যা কিছু বিরাজমান মানুষ সে সবের মধ্য থেকে কোনো কোনো জিনিসকে তার নিজের জন্য কল্যাণকর দেখতে পায় এবং কোনো কোনো জিনিসকে অকল্যাণকর দেখতে পায়। সৃষ্টিপ্রকৃতিতে বিরাজমান প্রাণীকুল , প্রাণহীন বস্তু ও প্রাকৃতিক কারণ বা বিধিবিধান সমূহের কতককে মানুষ নিজের জন্য ক্ষতিকর , বিপজ্জনক , এমনকি প্রাণঘাতী রূপে দেখতে পায়। বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে তাকে টিকে থাকতে হয়। এ সব সংগ্রামে কখনো তার জয় হয় , কখনো পরাজয় ঘটে , এমনকি অনেক সময় তাকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয়।

অবশ্য স্বয়ং মানুষও মানুষের জন্য অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থা সৃষ্টির কারণ হয়ে থাকে। যেমন: অনেক রোগব্যাধি বংশানুক্রমে পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে প্রবাহিত হয়। পিতা-মাতার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য থেকে সন্তান-সন্ততিও সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের অধিকারী হয়। আবার মানুষ মানুষের ওপর যুলুম-অত্যাচার করে।

প্রাকৃতিক ও মানবিক নির্বিশেষে সমস্ত রকমের অবাঞ্ছিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত কার্যকারণ ও অবস্থা দর্শনে মানুষের মনে সততই এ প্রশ্ন জাগ্রত হয় যে , কেন এ সব কিছু আছে বা হচ্ছে ? সৃষ্টিকর্তা তাঁর সৃষ্টিতে এ সব অবাঞ্ছিত উপাদান , কারণ ও পরিস্থিতি রেখেছেন কী উদ্দেশ্যে ?

এ ধরনের প্রশ্ন থেকে মানুষের মনে বিভিন্ন ধরনের সংশয় জন্ম নেয়। কারো মনে হয় , এসব অসামঞ্জস্যের কারণ হয়তো এই যে , বিশ্বজগতের পিছনে আদৌ কোনো মহাজ্ঞানময় স্রষ্টার অস্তিত্ব নেই , তাই ইচ্ছাশক্তিহীন অন্ধ প্রকৃতির অন্ধ খেয়ালখুশীর পরিণতিতে এ সব কিছু ঘটছে। অন্যদিকে যারা সৃষ্টিপ্রকৃতি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং সৃষ্টিপ্রকৃতির পিছনে একজন মহাজ্ঞানময় স্রষ্টা ও পরিচালকের অস্তিত্ব অনুভব করে তাদের মধ্যেও অনেকে কথিত অসামঞ্জস্যসমূহ লক্ষ্য করে এ উপসংহারে উপনীত হয় যে , সৃষ্টিকর্তা কেবল তাঁর সৃষ্টিকরণজনিত আনন্দের (!?) জন্যই সব কিছু সৃষ্টি করেছেন ; এর পিছনে কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই এবং সৃষ্টির ভালো-মন্দ ও সুখ-দুঃখ তাঁর নিকট কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়।

মানুষের মনে এ সব সংশয়ের উদয় হয় অপরিহার্য সত্তা মহান সৃষ্টিকর্তার সঠিক পরিচয় এবং সৃষ্টিজগৎ ও তার অস্তিত্বের পিছনে নিহিত লক্ষ্য সম্বন্ধে সঠিক ধারণার অভাব থেকে।

সৃষ্টিকর্তা খামখেয়ালিপনা ও উদাসীনতা থেকে প্রমুক্ত

ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , কারণ ও ফলশ্রুতি বিধির অধীন পরিবর্তনশীল এ সৃষ্টিজগৎ এমন একজন সৃষ্টিকর্তা দাবী করে যিনি সকল প্রকার পূর্ণতাবাচক গুণের অধিকারী এবং সকল প্রকার অপূর্ণতা থেকে মুক্ত। অতএব , নিঃসন্দেহে তিনি মহাজ্ঞানময় , আর জ্ঞানময়তার দাবী হচ্ছে উদ্দেশ্যহীন কিছু না করা। খামখেয়ালিপনা ও উদাসীনতা জ্ঞানময়তা ও পূর্ণতার সাথে খাপ খায় না। আর যেহেতু তিনি সব রকমের অভাব ও প্রয়োজন থেকে মুক্ত , অতএব , তাঁর আনন্দ লাভের প্রয়োজন নেই। তাই তিনি আনন্দ লাভের জন্য অথবা উদ্দেশ্যহীনভাবে ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করবেন - এ কথা তাঁর সম্পর্কে কল্পনাও করা যায় না। অতএব , তিনি এমন কিছু করতে পারেন না যার পিছনে কোনো মহান উদ্দেশ্য নিহিত নেই বা চূড়ান্ত বিচারে যাতে সৃষ্টির জন্য কল্যাণ নিহিত নেই।

সকল সৃষ্টি অভিন্ন সৃষ্টিসত্তার অংশ

সৃষ্টিজগতে মানুষ যা কিছু অবাঞ্ছিত দেখতে পায় তার স্বরূপ অনুধাবন করতে হলে কয়েকটি বিষয়কে পটভূমি হিসেবে মনে রাখতে হবে। প্রথমতঃ সৃষ্টিলোকের প্রতিটি সৃষ্টিকে আপতঃদৃষ্টিতে পরস্পর বিচ্ছিন্ন , স্বতন্ত্র সৃষ্টি এবং স্বতন্ত্র উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের অধিকারী বলে মনে হলেও প্রকৃত পক্ষে তা নয়। প্রতিটি সৃষ্টি ব্যক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে স্বতন্ত্র ও নিজস্ব লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের অধিকারী হওয়ার পাশাপাশি সমগ্র সৃষ্টিলোকের একটি অংশ হিসেবে তার ভিন্নতর একটি অবস্থান ও ভূমিকা রয়েছে।

গোটা সৃষ্টিলোক অভিন্ন লক্ষ্যাভিসারী

ওপরে যেমন আভাস দেয়া হয়েছে , গভীর পর্যালোচনার মাধ্যমে বিচারবুদ্ধি এ সত্যে উপনীত হয় যে , আসলে সমগ্র সৃষ্টিলোক অসংখ্য স্বতন্ত্র সত্তার সমষ্টি হওয়ার পাশাপাশি সামগ্রিকভাবে একটি স্বতন্ত্র বৃহত্তর সত্তা। আর এ কারণে প্রতিটি সৃষ্টির নিজস্ব লক্ষ্যের পাশাপাশি স্বভাবতঃই গোটা সৃষ্টিলোকের একটি স্বতন্ত্র বৃহত্তর লক্ষ্য রয়েছে। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে সহযোগিতা করা প্রতিটি সৃষ্টির দায়িত্ব ; তাকে এ জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে এবং জেনে হোক বা না জেনে হোক , সে এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নেই নিয়োজিত রয়েছে। অতএব , সমগ্র সৃষ্টিলোকের চূড়ান্ত লক্ষ্য বাস্তবায়নে তার যে ভূমিকা তা-ই তার মুখ্য ভূমিকা। সুতরাং এ ভূমিকা পালন করতে গিয়ে তার ব্যষ্টিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বা স্বার্থ উৎসর্গ করা অপরিহার্য হয়ে পড়তে পারে এবং অপরিহার্য হয়ে পড়লে তাকে তা-ই করতে হবে। কারণ , এ বৃহত্তর লক্ষ্য বাস্তবায়নে ভূমিকা পালনেই তার অস্তিত্বের সার্থকতা নিহিত।

এ প্রসঙ্গে মানবদেহের উপমা দেয়া যেতে পারে। অসংখ্য লোহিত কণিকা , শ্বেত কণিকা , মাংসকোষ ও অন্যান্য উপাদানে মানবদেহ গঠিত। এমনকি রোগব্যাধির আক্রমণ বা দুর্ঘটনা সংঘটিত না হলেও মানুষের স্বাভাবিক কর্মতৎপরতার কারণেই তার দেহের বহু লোহিত কণিকা , শ্বেত কণিকা ও মাংসকোষ প্রতিনিয়ত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে নতুন নতুন লোহিত কণিকা , শ্বেত কণিকা ও মাংসকোষ সৃষ্টি হচ্ছে। এমতাবস্থায় ধ্বংসপ্রাপ্ত লোহিত কণিকা , শ্বেত কণিকা ও মাংসকোষের ধ্বংস হওয়ার বিষয়টিকে অন্যায় বা অবিচার মনে করা সম্ভব নয়। কারণ , এ সব লোহিত কণিকা , শ্বেত কণিকা ও মাংসকোষের অস্তিত্ব মানুষেরই প্রয়োজনে । আর স্বীয় প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে পরিচালিত মানুষের কর্মতৎপরতার অনিবার্য দাবী হচ্ছে এ সব লোহিত কণিকা , শ্বেত কণিকা ও মাংসকোষের কতকের ধ্বংসপ্রাপ্তি।

এখানে অনুধাবনযোগ্য দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে এই যে , সৃষ্টিলোকের প্রাকৃতিক বিধানসমূহ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং এ সব বিধানের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে সৃষ্টিলোকে বিবর্তন সংঘটিত হচ্ছে যা সৃষ্টিলোককে ক্রমান্বয়ে পূর্ণ থেকে পূর্ণতর অবস্থার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আর মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী যেহেতু এ প্রাকৃতিক জগতেই বসবাস করছে , সেহেতু এ থেকে তাদের ওপর ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে বাধ্য। এমতাবস্থায় সৃষ্টিলোকের চূড়ান্ত লক্ষ্যের জন্য অপরিহার্য প্রাকৃতিক বিধিবিধান ও তার ফলাফল সম্পর্কে আপত্তির কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।

অনুধাবনযোগ্য তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে , প্রাণীকুলের , বিশেষতঃ মানুষের স্বাধীনতা। সৃষ্টিলোকের প্রাকৃতিক বিধিবিধানের প্রতিক্রিয়া প্রাণহীন বস্তুনিচয়ের ওপর যা-ই হোক না কেন , সে ব্যাপারে প্রাণহীন বস্তুর ক্ষেত্রে ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন তোলা যায় না। কারণ , বোধশূন্য বস্তুর লাভ-ক্ষতির প্রশ্নই ওঠে না। এ প্রশ্ন কেবল প্রাণশীল সৃষ্টির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বস্তুতঃ প্রাকৃতিক কার্যকারণের প্রতিক্রিয়া কেবল প্রাণশীল সৃষ্টির জন্যই কল্যাণকর বা অকল্যাণকর হয়ে থাকে। অবশ্য প্রাণীকুল , বিশেষতঃ মানুষ সহজাত বা অর্জিত জ্ঞানের সহায়তায় প্রকৃতির অনেক অবাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। কিন্তু কারো জন্য অন্য প্রাণী বা অন্য মানুষের পক্ষ থেকে যে ক্ষতিকারকতা উদ্ভূত হয় তা সব সময় সুনির্দিষ্ট প্রাকৃতিক নিয়মের অনুবর্তী নয় এবং এ ধরনের ক্ষতিকারকতাই বিড়ম্বনার উৎস। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির কল্যাণময় লক্ষ্য থাকা সম্বন্ধে যাদের মনে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে তাদের সংশয়ের মূল কারণ এই প্রাণশীল সৃষ্টির ক্ষতিকারকতা। তাদের কথা হচ্ছে , এ সব অকল্যাণকর প্রাণশীল সৃষ্টির অথবা কোনো সৃষ্টির মধ্যকার অকল্যাণকর দিকের (যদিও কল্যাণের পাশাপাশি) কী প্রয়োজন ছিলো ?

প্রাণীকুলের স্বার্থসংঘাত স্বাধীনতার অনিবার্য দাবী

এ প্রশ্নের জবাব পেতে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। প্রথমতঃ প্রাণীকুল , বিশেষ করে মানুষের , প্রাণী বা মানুষ হবার অনিবার্য দাবী হচ্ছে , তার অস্তিত্বরক্ষা ও বিকাশের স্বার্থে তার কিছুটা স্বাধীনতা চাই। কম হোক বা বেশীই হোক , তৎপরতার স্বাধীনতা না থাকলে সে প্রাণী হিসেবেই পরিগণিত হতো না। আর স্বাধীনতার দাবী হচ্ছে , একদিকে বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে , অন্যদিকে প্রাণী ও মানুষের মধ্যে এবং মানুষের পরস্পরের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে। এ সংঘাতের প্রতিক্রিয়াও চূড়ান্ত পরিণতিতে সৃষ্টিলোকের চূড়ান্ত লক্ষ্যে উপনীত হবার পথে সহায়ক।

সৃষ্টিকর্তার জ্ঞান ও স্বাধীন সৃষ্টির ভবিষ্যৎ

এখানে একটি প্রশ্ন উঠতে পারে যে , অপরিহার্য সত্তা চিরজ্ঞানময় সৃষ্টিকর্তা যেহেতু অতীত ও ভবিষ্যৎ সব কিছু জানেন সেহেতু তিনি কথিত স্বাধীন সৃষ্টির ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও জানেন। আর তিনি যা জানেন তার অন্যথা হতে পারে না। এমনকি স্রষ্টা যদি কখনো কোনো সুনির্দিষ্ট সৃষ্টিসত্তার কোনো বিশেষ কাজে হস্তক্ষেপ করেন , তো নিঃসন্দেহে তা-ও তিনি আগে থেকেই জানতেন যে , তিনি তার ঐ কাজে হস্তক্ষেপ করবেন। অতএব , তা অনিবার্য ছিলো। ফলে এখানে স্বাধীনতার কোনো স্থান নেই।

এ বিষয়টি তাক্বদীর (تقدير ) বা ভাগ্যনির্ধারণ বিষয়ক আলোচনার অন্তর্ভুক্ত যা একটি বিস্তারিত আলোচনার বিষয় এবং যে আলোচনা কেবল বিচারবুদ্ধির ভিত্তিতে করা সম্ভব নয়।3 তবে এখানে বিচারবুদ্ধি ভিত্তিক আলোচনায় আমরা সংক্ষেপে এর কয়েকটি দিকের ওপরে আলোকপাত করতে পারি। প্রথমতঃ আমরা আমাদের বিচারবুদ্ধি দ্বারা অনুভব করি যে , আমরা জড় পদার্থ থেকে স্বতন্ত্র এবং প্রাণশীল সৃষ্টি হওয়ার কারণে আমাদের ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীনতা রয়েছে। দ্বিতীয়তঃ আমরা লক্ষ্য করি যে , মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীনতা প্রাণীর ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীনতার চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী যে কারণে অন্যান্য প্রাণীর ব্যতিক্রমে মানুষ তার সহজাত প্রবণতার বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ করতে পারে। যেমন: চরম ক্ষুধার্ত অবস্থায়ও এবং তার সামনে সুস্বাদু খাবার থাকা সত্ত্বেও ও তা খাওয়ার পথে কোনোরূপ বাধা না থাকা সত্ত্বেও সে তা খাওয়া থেকে বিরত থাকতে পারে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে , কারো ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভবিষ্যৎ-জ্ঞানের অধিকারী অপরিহার্য সত্তার জানা থাকার মানেই তো অনিবার্য হয়ে যাওয়া , এমতাবস্থায় ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীনতার কী মানে হতে পারে ?

এ প্রশ্নের জবাব হচ্ছে , সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি-ইচ্ছা বা নির্ধারণ বা ভবিষ্যৎ-জ্ঞান মানে এরূপ হওয়া অপরিহার্য নয় যে , অনন্ত ভবিষ্যতের ছোট-বড় প্রতিটি বিষয় তাতে অনিবার্য রূপে থাকবেই। কারণ , তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায় তাঁর অনাদিকালীন প্রথম ইচ্ছাকরণের পর সব কিছু স্বয়ংক্রিয়ভাবে হতেই থাকবে ; অতঃপর আর তাঁর ইচ্ছা করার মতো বা করণীয় বলতে কিছুই থাকবে না। এরূপ হলে স্বয়ং তাঁর ইচ্ছাশক্তি , সৃষ্টিক্ষমতা ও স্বাধীনতা অনিবার্যতার শিকারে পরিণত হবে - যা থেকে তিনি উর্ধে। বরং তাঁর ইচ্ছা ও সৃষ্টিসিদ্ধান্তের মধ্যে প্রত্যক্ষ কর্ম ও সৃষ্টি , প্রাকৃতিক বিধিবিধান সৃষ্টি , প্রাকৃতিক বিধানের আওতায় যান্ত্রিক কার্যক্রম , ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন সৃষ্টির মাধ্যমে পরোক্ষ কর্ম ও সৃষ্টি , তাঁর চিরন্তন নির্ধারণ এবং তাঁর উপস্থিত নিয়ন্ত্রণ সবই অন্তর্ভুক্ত রাখতে তিনি সক্ষম। আর ভবিষ্যৎ-জানা সম্পর্কে বলতে হয় যে , তিনি সৃষ্টির ভবিষ্যৎকে অংশতঃ অনিবার্য করে দিতে পারেন , অংশতঃ শর্তাধীন করে দিতে পারেন (যেমন: সে এরূপ করলে তার ফলে এই হবে , আর ঐরূপ করলে তার ফলে ঐ হবে) ও অংশতঃ পুরোপুরি অনির্ধারিত রেখে দিতে পারেন এবং সংশ্লিষ্ট সৃষ্টির ভবিষ্যৎ তাঁর জ্ঞানে এভাবেই অন্তর্ভুক্ত থাকবে - এটাই স্বাভাবিক।

বিষয়টি আরো কিছুটা সহজভাবে বুঝার জন্য বলা যেতে পারে যে , যেহেতু স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির পুরো ভবিষ্যতের দিক মনোযোগ দিলে তা অনিবার্য হয়ে যায় সেহেতু তিনি সংশ্লিষ্ট সৃষ্টির স্বাধীন ক্ষেত্রটির ভবিষ্যতের প্রতি মনোযোগ দেয়া থেকে বিরত থাকেন এবং এভাবে তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন।4

স্রষ্টার কর্মের সাথে কালের সম্পর্ক

আমরা যখন বলি যে , পরম জ্ঞানময় অপরিহার্য সত্তা সব সময় সৃষ্টি ও পরিচালনা করে চলেছেন তখন এ প্রসঙ্গে একটি কালগত প্রশ্ন উঠতে পারে। কারণ , সব সময় মানে অতীত , বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। কিন্তু অনাদি ও অনন্ত অপরিহার্য সত্তা কালের উর্ধে। অর্থাৎ তাঁর জন্য কাল প্রযোজ্য নয়। তাই প্রশ্ন উঠতে পারে যে , এমতাবস্থায় তিনি ছিলেন , আছেন ও থাকবেন অথবা তিনি সৃষ্টির সূচনা করেছেন , এখনো সৃষ্টি ও পরিচালনা করছেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন - এ জাতীয় কথা দ্বারা কি তাঁর সম্পর্কে কালগত সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয় না ?

এর জবাব হচ্ছে , প্রকৃত পক্ষে এ জাতীয় ক্রিয়ার ব্যবহার করা হয় সৃষ্টির কালগত সীমাবদ্ধতার কারণে। যেহেতু সৃষ্টিসমূহ কালের গর্ভে অস্তিত্ব লাভ করে ও এগিয়ে চলে সেহেতু কালভিত্তিক ক্রিয়াপদ ব্যবহার ব্যতিরেকে কোনো কার্য সৃষ্টিকুলের জন্য অনুধাবনযোগ্য নয়।

বস্তুতঃ কাল ও স্থান হচ্ছে এক ব্যাপকতর সৃষ্টি - যার গর্ভে সকল সৃষ্টিকে সৃষ্টি ও অগ্রগতি প্রদান করা হয়েছে। তবে এই স্থান ও কালের আপেক্ষিকতা রয়েছে - যা বর্তমান যুগের বিজ্ঞান , বিশেষতঃ কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান স্বীকার করছে। এই আপেক্ষিকতা বস্তুগত ও অবস্তুগত অনেক কিছুর সাথে সংশ্লিষ্ট। অতএব , সামগ্রিকভাবে কাল-কে কোনো একটি সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডে এবং স্থানকেও কোনো একটি সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডে পরিমাপ করা সম্ভব বলে মনে করা উচিত হবে না।

অতএব , প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে এই যে , একটি সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডের দৃষ্টিতে বা বিচারে কালের ও স্থানের যে ধারণা আমরা লাভ করি তার গর্ভে বিভিন্ন মানদণ্ডের অনেক কাল ও স্থান রয়েছে। আবার এ বৃহৎ কাল ও স্থানের ন্যায় অনেকগুলো বৃহৎ কাল ও স্থান একটি বৃহত্তর কাল ও স্থানের গর্ভে রয়েছে। এভাবে শেষ পর্যন্ত একটি সর্বব্যাপক কাল ও স্থান রয়েছে - অপরিহার্য সত্তা যাকে সৃষ্টি করে সকল সৃষ্টিকে তার গর্ভে স্থান দিয়েছেন। বলা বাহুল্য যে , নিম্নতর কাল ও স্থান দ্বারা উর্ধতর কাল ও স্থান প্রভাবিত হয় না। অতএব , উচ্চতর কাল ও স্থানের আওতাভুক্ত পর্যবেক্ষক নিম্নতর কাল ও স্থানকে পর্যবেক্ষণ করলে তার দ্বারা নিজে প্রভাবিত হয় না। এভাবে শেষ পর্যন্ত সর্বব্যাপক স্থান-কালেরও উর্ধে যে সত্তা তিনি সকল কাল ও স্থানেরই পর্যবেক্ষক , কিন্তু কোনো কাল ও স্থানই তাঁর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

সৃষ্টিসত্তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দু টি মাত্রা ( Dimension)হচ্ছে কাল ও স্থান। কালের স্বরূপ ও আপেক্ষিকতা অনুধাবন অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার এবং এ কারণে এর আপেক্ষিকতা সম্পর্কে অভিজ্ঞতাজাত উদাহণ দেয়াও প্রায় অসম্ভব। কারণ , অনেকে কর্তাভেদে অভিন্ন কালের বিভিন্ন অনুভূতি ও বিভিন্ন কর্মের ( Object)ওপর অভিন্ন কালের বিভিন্ন প্রভাবকে কালের আপেক্ষিকতার প্রমাণ হিসেবে গণ্য করলেও প্রকৃত পক্ষে কালের অনুভূতির প্রভাবের আপেক্ষিকতা কালের আপেক্ষিকতা প্রমাণ করতে সক্ষম নয়। তবে স্থানের আপেক্ষিকতা বোধগম্য বিষয় বটে।

বিষয়টিকে অপেক্ষাকৃত সহজবোধগম্য করার জন্য একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। বলা বাহুল্য যে , অপরিহার্য সত্তা স্রষ্টা , তাঁর বৈশিষ্ট্য ও তাঁর কাজ অনুধাবনের জন্য সৃষ্টি সম্পর্কিত উদাহরণ হচ্ছে দুর্বল উদাহরণ - যাতে প্রকৃত সত্য প্রতিফলিত হয় না , তবে প্রকৃত সত্যের কাছাকাছি পৌঁছা যায় ও মোটামুটি ধারণা লাভ করা যায়। এ কারণেই কেবল বিষয়টিকে সহজবোধগম্য করার লক্ষ্যে আমরা এ ধরনের দুর্বল উদাহরণের আশ্রয় নিতে পারি ।

কাল ও স্থানের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত একটি বিষয় হচ্ছে গতি। তাই এই গতি থেকেই বিষয়টি মোটামুটি বুঝা যেতে পারে। কাল ও স্থানের আওতাধীন প্রতিটি সৃষ্টিই কোনো না কোনোভাবে গতিশীল অবস্থায় রয়েছে। তবে প্রকৃত ব্যাপার হলো এ সৃষ্টিলোকে বহু ধরনের গতি রয়েছে। কিন্তু সকল গতি সকল সৃষ্টির ওপর প্রভাব বিস্তার করে না। যেমন: পরমাণুর অভ্যন্তরে প্রচণ্ড গতি রয়েছে , কিন্তু এ গতি অণুর গতিকে প্রভাবিত করে না। আবার স্বয়ং অণু গতিশীল , কিন্তু বহু অণু সমন্বয়ে গঠিত কোনো বস্তুর গতিকে অণুর গতি প্রভাবিত করতে পারে না।

এবার আরেকটি সহজবোধ্য দৃষ্টান্তে আসা যাক। একটি লোক একটি চলমান জাহাযের ডেকের ওপর একদিক থেকে আরেক দিকে হেঁটে যাচ্ছে , আর তার গায়ের ওপর , ধরুন , তার পিঠের ওপর , একটি পিঁপড়া একদিক থেকে আরেক দিকে হেঁটে যাচ্ছে।

এখানে পিঁপড়ার গতি দ্বারা লোকটির গতি প্রভাবিত হচ্ছে না , কিন্তু লোকটির হাঁটার কারণে পিঁপড়াটি দু টি গতির অধিকারী হচ্ছে। অন্যদিকে জাহাযটি গতিশীল , ফলে পিঁপড়ার তিনটি , লোকটির দু টি ও জাহাযের একটি গতি রয়েছে। এভাবে পৃথিবী , সৌরলোক , ছায়াপথ ও অসংখ্য ছায়াপথ সম্বলিত বৃহত্তর জগৎ এবং তদুর্ধ জগৎসমূহের গতি বিবেচনায় আনলে গতির সংখ্যা নিম্নতর পর্যায়ে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকবে এবং উর্ধতর পর্যায়ে ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকবে। অতঃপর আমরা উপনীত হবো গোটা সৃষ্টিলোকরূপ এককের স্রষ্টার কাছে যিনি গতির সম্পূর্ণ উর্ধে।

উপরোক্ত উদাহরণ থেকে যে কোনো সৃষ্টির গতির ও সেই সাথে স্থানগত অবস্থানের বহুত্ব ও আপেক্ষিকতা প্রমাণিত হয়।

একইভাবে তিনি কাল ও স্থানেরও উর্ধে। কিন্তু তিনি কাল , স্থান ও গতির [ প্রকৃত পক্ষে এ তিনটি হচ্ছে একটি অভিন্ন সৃষ্টির তিনটি মাত্রা ( Dimension)মাত্র ] স্রষ্টা ও পর্যবেক্ষক। এমতাবস্থায় সৃষ্টি ও পরিচালনার তিনটি কাল হচ্ছে সৃষ্টির অবস্থান থেকে উদ্ভূত , স্রষ্টার অবস্থান থেকে নয়। কারণ , তাঁর জন্য কাল বলতে কিছু নেই। বরং তাঁর কাছে সব কিছু সদা বর্তমান। [ বস্তুত : আমরা আমাদের জন্য তিনটি কালের প্রবক্তা হলেও প্রকৃত পক্ষে সৃষ্টির কাল মাত্র দু টি - অতীত ও ভবিষ্যৎ ; সৃষ্টির জন্য বর্তমান মানে হচ্ছে অতীত ও ভবিষ্যতের দুই প্রান্তিক কাল - বিন্দুর মিলনস্থল মাত্র। আর স্রষ্টা কালোর্ধ বিধায় সদা বর্তমান। ]

অপরিহার্য সত্তার সৃষ্টিকরণের তাৎপর্য

ওপরের আলোচনা থেকে এ বিষয়টিও সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে , অপরিহার্য সত্তার সৃষ্টিকরণরূপ কর্মের তাৎপর্য হচ্ছে তাঁর সৃষ্টিক্ষমতা ও সৃষ্টি-ইচ্ছার সাথে (যা তাঁর সত্তা থেকে স্বতন্ত্র কোনো গুণ নয় , বরং তাঁর সত্তাই) সৃষ্টির সম্পর্ক , যা সৃষ্টির কালগত বৈশিষ্ট্যের বিচারে অতীত ও ভবিষ্যৎ বলে প্রতিভাত হয়। তেমনি সৃষ্টির সাথে সম্পর্কের কারণেও কখনো তা প্রাকৃতিক বিধানরূপে , কখনো অবিলম্বে কার্যকরযোগ্য ইচ্ছারূপে , কখনো বিলম্বে কার্যকরযোগ্য ইচ্ছারূপে , কখনো বিলম্বে কার্যকরযোগ্য সিদ্ধান্তরূপে , কখনো প্রাকৃতিক বিধানে হস্তক্ষেপরূপে , কখনো কতক সৃষ্টির ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীনতা রূপে এবং কখনো ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীনতার অধিকারী সৃষ্টির কর্মে হস্তক্ষেপরূপে প্রতিভাত হয়।

অন্যদিকে যা কিছুকে আমরা প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যতিক্রম বলে মনে করি তা-ও ব্যতিক্রম নয়। বরং তা-ও স্রষ্টা কর্তৃক নির্ধারিত ভিন্ন এক ধরনের বিধান বটে , যদিও তা সচরাচর আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরে থেকে যায় বিধায় আমাদের জ্ঞান তার স্বরূপ ধরতে পারে না। অন্যথায় মহাবিজ্ঞানময় অপরিহার্য সত্তার সৃষ্টিকরণ ও পরিচালনা ব্যবস্থায় ইতিবাচক নিয়মাবলী বহির্ভূত কোনো কিছু বিচারবুদ্ধির কাছে বোধগম্য হতে পারে না।

সৃষ্টিলোকে অবাঞ্ছিত উপাদানসমূহের অস্তিত্বের তাৎপর্য

এ জগতের বুকে যা কিছু বিরাজমান মানুষ সে সবের মধ্য থেকে কোনো কোনো জিনিসকে তার নিজের জন্য কল্যাণকর দেখতে পায় এবং কোনো কোনো জিনিসকে অকল্যাণকর দেখতে পায়। সৃষ্টিপ্রকৃতিতে বিরাজমান প্রাণীকুল , প্রাণহীন বস্তু ও প্রাকৃতিক কারণ বা বিধিবিধান সমূহের কতককে মানুষ নিজের জন্য ক্ষতিকর , বিপজ্জনক , এমনকি প্রাণঘাতী রূপে দেখতে পায়। বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে তাকে টিকে থাকতে হয়। এ সব সংগ্রামে কখনো তার জয় হয় , কখনো পরাজয় ঘটে , এমনকি অনেক সময় তাকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয়।

অবশ্য স্বয়ং মানুষও মানুষের জন্য অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থা সৃষ্টির কারণ হয়ে থাকে। যেমন: অনেক রোগব্যাধি বংশানুক্রমে পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে প্রবাহিত হয়। পিতা-মাতার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য থেকে সন্তান-সন্ততিও সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের অধিকারী হয়। আবার মানুষ মানুষের ওপর যুলুম-অত্যাচার করে।

প্রাকৃতিক ও মানবিক নির্বিশেষে সমস্ত রকমের অবাঞ্ছিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত কার্যকারণ ও অবস্থা দর্শনে মানুষের মনে সততই এ প্রশ্ন জাগ্রত হয় যে , কেন এ সব কিছু আছে বা হচ্ছে ? সৃষ্টিকর্তা তাঁর সৃষ্টিতে এ সব অবাঞ্ছিত উপাদান , কারণ ও পরিস্থিতি রেখেছেন কী উদ্দেশ্যে ?

এ ধরনের প্রশ্ন থেকে মানুষের মনে বিভিন্ন ধরনের সংশয় জন্ম নেয়। কারো মনে হয় , এসব অসামঞ্জস্যের কারণ হয়তো এই যে , বিশ্বজগতের পিছনে আদৌ কোনো মহাজ্ঞানময় স্রষ্টার অস্তিত্ব নেই , তাই ইচ্ছাশক্তিহীন অন্ধ প্রকৃতির অন্ধ খেয়ালখুশীর পরিণতিতে এ সব কিছু ঘটছে। অন্যদিকে যারা সৃষ্টিপ্রকৃতি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং সৃষ্টিপ্রকৃতির পিছনে একজন মহাজ্ঞানময় স্রষ্টা ও পরিচালকের অস্তিত্ব অনুভব করে তাদের মধ্যেও অনেকে কথিত অসামঞ্জস্যসমূহ লক্ষ্য করে এ উপসংহারে উপনীত হয় যে , সৃষ্টিকর্তা কেবল তাঁর সৃষ্টিকরণজনিত আনন্দের (!?) জন্যই সব কিছু সৃষ্টি করেছেন ; এর পিছনে কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই এবং সৃষ্টির ভালো-মন্দ ও সুখ-দুঃখ তাঁর নিকট কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়।

মানুষের মনে এ সব সংশয়ের উদয় হয় অপরিহার্য সত্তা মহান সৃষ্টিকর্তার সঠিক পরিচয় এবং সৃষ্টিজগৎ ও তার অস্তিত্বের পিছনে নিহিত লক্ষ্য সম্বন্ধে সঠিক ধারণার অভাব থেকে।

সৃষ্টিকর্তা খামখেয়ালিপনা ও উদাসীনতা থেকে প্রমুক্ত

ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , কারণ ও ফলশ্রুতি বিধির অধীন পরিবর্তনশীল এ সৃষ্টিজগৎ এমন একজন সৃষ্টিকর্তা দাবী করে যিনি সকল প্রকার পূর্ণতাবাচক গুণের অধিকারী এবং সকল প্রকার অপূর্ণতা থেকে মুক্ত। অতএব , নিঃসন্দেহে তিনি মহাজ্ঞানময় , আর জ্ঞানময়তার দাবী হচ্ছে উদ্দেশ্যহীন কিছু না করা। খামখেয়ালিপনা ও উদাসীনতা জ্ঞানময়তা ও পূর্ণতার সাথে খাপ খায় না। আর যেহেতু তিনি সব রকমের অভাব ও প্রয়োজন থেকে মুক্ত , অতএব , তাঁর আনন্দ লাভের প্রয়োজন নেই। তাই তিনি আনন্দ লাভের জন্য অথবা উদ্দেশ্যহীনভাবে ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করবেন - এ কথা তাঁর সম্পর্কে কল্পনাও করা যায় না। অতএব , তিনি এমন কিছু করতে পারেন না যার পিছনে কোনো মহান উদ্দেশ্য নিহিত নেই বা চূড়ান্ত বিচারে যাতে সৃষ্টির জন্য কল্যাণ নিহিত নেই।

সকল সৃষ্টি অভিন্ন সৃষ্টিসত্তার অংশ

সৃষ্টিজগতে মানুষ যা কিছু অবাঞ্ছিত দেখতে পায় তার স্বরূপ অনুধাবন করতে হলে কয়েকটি বিষয়কে পটভূমি হিসেবে মনে রাখতে হবে। প্রথমতঃ সৃষ্টিলোকের প্রতিটি সৃষ্টিকে আপতঃদৃষ্টিতে পরস্পর বিচ্ছিন্ন , স্বতন্ত্র সৃষ্টি এবং স্বতন্ত্র উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের অধিকারী বলে মনে হলেও প্রকৃত পক্ষে তা নয়। প্রতিটি সৃষ্টি ব্যক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে স্বতন্ত্র ও নিজস্ব লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের অধিকারী হওয়ার পাশাপাশি সমগ্র সৃষ্টিলোকের একটি অংশ হিসেবে তার ভিন্নতর একটি অবস্থান ও ভূমিকা রয়েছে।

গোটা সৃষ্টিলোক অভিন্ন লক্ষ্যাভিসারী

ওপরে যেমন আভাস দেয়া হয়েছে , গভীর পর্যালোচনার মাধ্যমে বিচারবুদ্ধি এ সত্যে উপনীত হয় যে , আসলে সমগ্র সৃষ্টিলোক অসংখ্য স্বতন্ত্র সত্তার সমষ্টি হওয়ার পাশাপাশি সামগ্রিকভাবে একটি স্বতন্ত্র বৃহত্তর সত্তা। আর এ কারণে প্রতিটি সৃষ্টির নিজস্ব লক্ষ্যের পাশাপাশি স্বভাবতঃই গোটা সৃষ্টিলোকের একটি স্বতন্ত্র বৃহত্তর লক্ষ্য রয়েছে। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে সহযোগিতা করা প্রতিটি সৃষ্টির দায়িত্ব ; তাকে এ জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে এবং জেনে হোক বা না জেনে হোক , সে এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নেই নিয়োজিত রয়েছে। অতএব , সমগ্র সৃষ্টিলোকের চূড়ান্ত লক্ষ্য বাস্তবায়নে তার যে ভূমিকা তা-ই তার মুখ্য ভূমিকা। সুতরাং এ ভূমিকা পালন করতে গিয়ে তার ব্যষ্টিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বা স্বার্থ উৎসর্গ করা অপরিহার্য হয়ে পড়তে পারে এবং অপরিহার্য হয়ে পড়লে তাকে তা-ই করতে হবে। কারণ , এ বৃহত্তর লক্ষ্য বাস্তবায়নে ভূমিকা পালনেই তার অস্তিত্বের সার্থকতা নিহিত।

এ প্রসঙ্গে মানবদেহের উপমা দেয়া যেতে পারে। অসংখ্য লোহিত কণিকা , শ্বেত কণিকা , মাংসকোষ ও অন্যান্য উপাদানে মানবদেহ গঠিত। এমনকি রোগব্যাধির আক্রমণ বা দুর্ঘটনা সংঘটিত না হলেও মানুষের স্বাভাবিক কর্মতৎপরতার কারণেই তার দেহের বহু লোহিত কণিকা , শ্বেত কণিকা ও মাংসকোষ প্রতিনিয়ত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে নতুন নতুন লোহিত কণিকা , শ্বেত কণিকা ও মাংসকোষ সৃষ্টি হচ্ছে। এমতাবস্থায় ধ্বংসপ্রাপ্ত লোহিত কণিকা , শ্বেত কণিকা ও মাংসকোষের ধ্বংস হওয়ার বিষয়টিকে অন্যায় বা অবিচার মনে করা সম্ভব নয়। কারণ , এ সব লোহিত কণিকা , শ্বেত কণিকা ও মাংসকোষের অস্তিত্ব মানুষেরই প্রয়োজনে । আর স্বীয় প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে পরিচালিত মানুষের কর্মতৎপরতার অনিবার্য দাবী হচ্ছে এ সব লোহিত কণিকা , শ্বেত কণিকা ও মাংসকোষের কতকের ধ্বংসপ্রাপ্তি।

এখানে অনুধাবনযোগ্য দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে এই যে , সৃষ্টিলোকের প্রাকৃতিক বিধানসমূহ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং এ সব বিধানের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে সৃষ্টিলোকে বিবর্তন সংঘটিত হচ্ছে যা সৃষ্টিলোককে ক্রমান্বয়ে পূর্ণ থেকে পূর্ণতর অবস্থার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আর মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী যেহেতু এ প্রাকৃতিক জগতেই বসবাস করছে , সেহেতু এ থেকে তাদের ওপর ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে বাধ্য। এমতাবস্থায় সৃষ্টিলোকের চূড়ান্ত লক্ষ্যের জন্য অপরিহার্য প্রাকৃতিক বিধিবিধান ও তার ফলাফল সম্পর্কে আপত্তির কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।

অনুধাবনযোগ্য তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে , প্রাণীকুলের , বিশেষতঃ মানুষের স্বাধীনতা। সৃষ্টিলোকের প্রাকৃতিক বিধিবিধানের প্রতিক্রিয়া প্রাণহীন বস্তুনিচয়ের ওপর যা-ই হোক না কেন , সে ব্যাপারে প্রাণহীন বস্তুর ক্ষেত্রে ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন তোলা যায় না। কারণ , বোধশূন্য বস্তুর লাভ-ক্ষতির প্রশ্নই ওঠে না। এ প্রশ্ন কেবল প্রাণশীল সৃষ্টির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বস্তুতঃ প্রাকৃতিক কার্যকারণের প্রতিক্রিয়া কেবল প্রাণশীল সৃষ্টির জন্যই কল্যাণকর বা অকল্যাণকর হয়ে থাকে। অবশ্য প্রাণীকুল , বিশেষতঃ মানুষ সহজাত বা অর্জিত জ্ঞানের সহায়তায় প্রকৃতির অনেক অবাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। কিন্তু কারো জন্য অন্য প্রাণী বা অন্য মানুষের পক্ষ থেকে যে ক্ষতিকারকতা উদ্ভূত হয় তা সব সময় সুনির্দিষ্ট প্রাকৃতিক নিয়মের অনুবর্তী নয় এবং এ ধরনের ক্ষতিকারকতাই বিড়ম্বনার উৎস। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির কল্যাণময় লক্ষ্য থাকা সম্বন্ধে যাদের মনে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে তাদের সংশয়ের মূল কারণ এই প্রাণশীল সৃষ্টির ক্ষতিকারকতা। তাদের কথা হচ্ছে , এ সব অকল্যাণকর প্রাণশীল সৃষ্টির অথবা কোনো সৃষ্টির মধ্যকার অকল্যাণকর দিকের (যদিও কল্যাণের পাশাপাশি) কী প্রয়োজন ছিলো ?

প্রাণীকুলের স্বার্থসংঘাত স্বাধীনতার অনিবার্য দাবী

এ প্রশ্নের জবাব পেতে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। প্রথমতঃ প্রাণীকুল , বিশেষ করে মানুষের , প্রাণী বা মানুষ হবার অনিবার্য দাবী হচ্ছে , তার অস্তিত্বরক্ষা ও বিকাশের স্বার্থে তার কিছুটা স্বাধীনতা চাই। কম হোক বা বেশীই হোক , তৎপরতার স্বাধীনতা না থাকলে সে প্রাণী হিসেবেই পরিগণিত হতো না। আর স্বাধীনতার দাবী হচ্ছে , একদিকে বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে , অন্যদিকে প্রাণী ও মানুষের মধ্যে এবং মানুষের পরস্পরের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে। এ সংঘাতের প্রতিক্রিয়াও চূড়ান্ত পরিণতিতে সৃষ্টিলোকের চূড়ান্ত লক্ষ্যে উপনীত হবার পথে সহায়ক।


15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53

54

55

56

57

58

59

60

61