চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড4%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 106818 / ডাউনলোড: 9707
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

11

কুরাইশদের অদ্ভুত অজুহাত

একদিন সূর্যাস্তের পর উতবাহ্,শাইবাহ্,আবু সুফিয়ান,নযর বিন হারিস,আবদুল বুহতুরী,ওয়ালীদ বিন মুগীরাহ্,আবু জাহল,আস ইবনে ওয়ায়েল প্রমুখ কুরাইশ নেতৃবৃন্দ পবিত্র কাবার পাশে একটি সভার আয়োজন করে মহানবী (সা.)-কে ডেকে তাঁর সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিল। তারা এক ব্যক্তিকে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে পাঠাল যাতে সে তাঁকে তাদের সভায় যোগ দেয়ার জন্য অনুরোধ করে। মহানবী (সা.) ব্যাপারটি জানার পর তাদের হেদায়েত প্রাপ্তির আশায় ত্বরা করে উক্ত সভায় চলে আসেন। কোন একটি প্রসঙ্গে কথা শুরু হলেই কুরাইশরা তাদের অভিযোগগুলো বলতে থাকল। কুরাইশদের মাঝে যে বিভেদের সৃষ্টি হয়েছে সে সম্পর্কে তারা অনুযোগের সুরে কথা বলল এবং যে কোন ধরনের ত্যাগ স্বীকার করার ব্যাপারে তাদের প্রস্তুতির কথা ঘোষণা করল। শেষে তারা মহানবীর কাছে এমন সব আবেদন পেশ করেছিল যেগুলোর বর্ণনা পবিত্র কোরআনের সূরা ইসরার ৯০-৯৩ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। আমরা ঐ আয়াতসমূহের অনুবাদ নিচে তুলে ধরলাম২৮২ :

“হে মুহাম্মদ! নিম্নোক্ত কাজগুলো আঞ্জাম দেয়া ব্যতীত আমরা তোমার প্রতি ঈমান আনব না:

১. আমাদের দেশ শুষ্ক ও পানিবিহীন। তাই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা কর যাতে করে তিনি বালুকাময় এ মরু দেশের বুক চিরে নদী ও নহরসমূহ প্রবাহিত করেন;

২. তোমার হাতে অবশ্যই এমন এক উদ্যান থাকতে হবে যার ফলসমূহ আমরা ভক্ষণ করব এবং ঐ উদ্যানের মধ্য দিয়ে ঝরনা ও নহর প্রবাহমান থাকবে;

৩. তোমাকে অবশ্যই এ আকাশ চূর্ণ-বিচূর্ণ করে আমাদের ওপর ফেলতে হবে;

৪. মহান আল্লাহ্ ও ফেরেশতাদেরকে (আমাদের সামনে) উপস্থিত কর;

৫. তোমাকে স্বর্ণপ্রাসাদের অধিকারী হতে হবে;

৬. তোমাকে আকাশের দিকে উড়ে যেতে হবে। তোমার প্রতি আমরা কখনই ঈমান আনব না যদি না তুমি আকাশ থেকে একটি চিঠি আন যাতে লিখিত আকারে তোমার নবুওয়াতের সত্যায়ন করা হয়েছে।

যেহেতু পবিত্র কোরআনের এ আয়াতসমূহের অর্থ এবং কুরাইশদের এ সব আহবানের প্রতি মহানবীর (ইতিবাচক) সাড়া না দেয়ার বিষয়টি ইসলাম ও মহানবীর বিরুদ্ধে খ্রিষ্টান প্রাচ্যবিদদের মোক্ষম দলিলে পরিণত হয়েছে তাই এখন আমরা এ আয়াতগুলোর অন্তর্নিহিত অর্থ ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করব এবং কুরাইশদের এ সব দাবির প্রতি মহানবীর সাড়া না দেয়ার পেছনে বিদ্যমান যুক্তিপূর্ণ কারণগুলো স্পষ্ট করে দেব।

যে কোন অবস্থা ও প্রেক্ষাপটে মহান নবিগণ মুজিযা প্রদর্শন করেন না,বরং মুজিযা প্রদর্শনের ক্ষেত্রেও কতগুলো শর্ত রয়েছে যেগুলো এ সব দাবির ক্ষেত্রে অনুপস্থিত।

প্রথমত যে সব বিষয় আসলেই সত্তাগতভাবে অবাস্তব ও অসম্ভব সেগুলো শক্তি ও সামর্থ্যরে বাইরে এবং সেগুলো কখনই মহান আল্লাহ্ ইচ্ছা করেন না এবং কোন ইচ্ছাশক্তির অধিকারী সত্তাও এ সব ব্যাপারে ইচ্ছা পোষণ করেন না। অতএব,জনগণ মহান নবীদের কাছে কোন অসম্ভব বিষয় বা কাজ সম্পাদন করার আহবান জানালে নবিগণ যদি তা অগ্রাহ্য করেন তাহলে তা কখনই নবীদের মুজিযা অস্বীকার করার দলিল বলে গণ্য হবে না।

অথচ এ শর্তটি তাদের কতিপয় দাবির (চতুর্থ দাবির) ক্ষেত্রে বিদ্যমান নেই। কারণ তারা মহানবীর কাছে দাবি করেছিল যেন তিনি তাদেরকে মহান আল্লাহর মুখোমুখি দাঁড় করান যাতে করে তারা তাঁকে নিকট থেকে প্রত্যক্ষ করতে পারে। অথচ চর্মচোখে মহান আল্লাহকে দেখা অসম্ভব ও অবাস্তব বিষয়াদির অন্তর্ভুক্ত। কারণ তাঁকে দেখার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে এই যে,তিনি স্থান-কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যাবেন এবং তিনি আকার-আকৃতি ও বর্ণের অধিকারী হবেন;(আর স্থান-কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ হওয়া এবং নির্দিষ্ট আকার-আকৃতি ও বর্ণবিশিষ্ট হওয়া আসলে বস্তু ও পদার্থ হওয়ার লক্ষণস্বরূপ) মহান আল্লাহ্ বস্তু ও বস্তুর অবিচ্ছেদ্য বিষয়াদি ও গুণাবলী থেকে মুক্ত ও পবিত্র।

এমনকি তাদের তৃতীয় দাবির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যদি এটিই হয়ে থাকে যে,তাদের ওপর আসমান পতিত হোক (তবে আকাশ থেকে টুকরা পাথর তাদের ওপর বর্ষিত হয়ে তারা সবাই ধ্বংসপ্রাপ্ত হোক এটি উদ্দেশ্য নয়),তাহলে তাদের এ দাবি অবাস্তব ও অসম্ভব বলে গণ্য হবে। কারণ মহান আল্লাহর ঐশী ইচ্ছা অবধারিত করেছে যে,তিনি এ কাজটি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আয়ুষ্কাল যখন সমাপ্ত হবে তখন আঞ্জাম দেবেন। আর মহান নবিগণও মুশরিকদেরকে এ ব্যাপারে অবগত করেছেন। (كما زعمت ) তুমি যেমন ভেবেছ ঠিক তেমন-এ বাক্য থেকেও উক্ত বিষয়টি প্রতীয়মান হয়ে যায়।

সৌরমণ্ডল ও মহাকাশীয় বস্তুসমূহের পতন যদিও সত্তাগতভাবে অসম্ভব নয় তবুও তা এ পৃথিবীর বুকে মানব প্রজন্মসমূহের অস্তিত্ব বজায় থাকুক এবং কাঙ্ক্ষিত মানবীয় পূর্ণতার দিকে তারা অগ্রসর হোক-এতৎসংক্রান্ত মহান আল্লাহর যে প্রজ্ঞাময় ইচ্ছা রয়েছে সেই ইচ্ছার প্রেক্ষাপটে অসম্ভব বলে গণ্য হবে। আর যে কোন প্রজ্ঞাবান সত্তা কখনই তাঁর কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পরিপন্থী কোন কাজ সম্পাদন করেন না।

দ্বিতীয়ত যেহেতু মুজিযা প্রদর্শের আহবানের প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে নবীর কথা বা বাণীর সত্যতা প্রতিপন্ন করা এবং মুজিযা প্রদর্শনের মাধ্যমে অতি প্রাকৃতিক (ঊর্ধ্বতন ও আধ্যাত্মিক অবস্তুগত) জগতের সাথে তাঁর যোগসূত্র ও সম্পর্কের দৃঢ় ও শক্তিশালী দলিল অর্জিত হয় তাই যখনই কোন নবীর কাছে জনতার অলৌকিক বিষয় প্রদর্শনের দাবি এ ধরনের বৈশিষ্ট্য বিবর্জিত হবে (অর্থাৎ যদি ধরেও নেয়া হয় যে,নবী তাদের এ ধরনের আহবানে সাড়া দেবেন এবং মুজিযা প্রদর্শন করতে সম্মত হবেন তবুও) তখন আর তা অদৃশ্য অবস্তুগত জগতের সাথে তাঁর যোগসূত্র ও সম্পর্কের দলিল বলে গণ্য হবে না। এমতাবস্থায় কোন নবীই এমন কোন কাজ করবেন না যা তাঁর নবুওয়াতের মর্যাদার বিরোধী। আর এ ধরনের কাজ করার পক্ষে কোন যৌক্তিকতাও নেই।

ঘটনাচক্রে তাদের কিছু কিছু আহবান,যেমন নবী (সা.) কর্তৃক তাদের সামনে জমিনের বুকে ঝরনা ও নহর প্রবাহিত করা,আঙ্গুর ও খেজুর বাগান এবং স্বর্ণনির্মিত বাসগৃহের অধিকারী হওয়া ইত্যাদি আসলে উপরোল্লিখিত দাবি ও আহবানসমূহের অন্তর্ভুক্ত (যা অযৌক্তিক)। কারণ জমির বুকে নহর খনন করা অথবা খেজুর ও আঙ্গুর বাগানের মালিক হওয়া যার তলদেশ নিয়ে নহরসমূহ বয়ে যাচ্ছে অথবা স্বর্ণনির্মিত প্রাসাদ ও বাসগৃহের অধিকারী হওয়া এগুলোর স্বত্বাধিকারীর নবী হওয়ার দলিল হতে পারে না। কারণ অনেক লোকই এ সব সম্পত্তির মধ্যে কোন না কোনটির মালিক এবং তারা কখনই নবী নয়। বরং কখনো কখনো এমন সব ব্যক্তি পাওয়া যাবে যারা এর চাইতেও ধনবান,অথচ তাদের মধ্যে নবুওয়াত তো দূরের কথা ঈমানের বিন্দুমাত্র সৌরভও নেই। এখন যখন নবুওয়াতের সুউচ্চ মাকামের সাথে এ সব বিষয়ের অস্তিত্বের সামান্যতম যোগসূত্র নেই এবং এ সব বিষয় নবুওয়াতের দাবিদারের সত্যবাদিতার দলিল হতে পারে না তখন এ সব কাজ আঞ্জাম দেয়া ফালতু কাজ বলেই গণ্য হবে। আর নবুওয়াতের সুউচ্চ মাকাম এ ধরনের কাজ বা বিষয়সমূহ আঞ্জাম দেয়া হতে অতি উচ্চ ও মহান।

কখনো কখনো বলা হয় যে,কাফের-মুশরিকদের উপরিউক্ত প্রস্তাব তিনটি (ঝরনা,বাগান ও স্বর্ণনির্মিত প্রাসাদ) ঐ ক্ষেত্রে নবীর বাণী ও কথার সত্যতার দলিল হবে না যদি তিনি এ সব বিষয় স্বাভাবিক কারণ ও মাধ্যম ব্যবহার করে তৈরি করেন,তবে যদি তিনি অতি প্রাকৃতিক উপায়ে এ সব কাজে হাত দেন তখন নিঃসন্দেহে তা মুজিযা বলে গণ্য হবে এবং তা অবশ্যই নবুওয়াতের দাবিদারের সত্যবাদিতার দলিল বলেও গণ্য হবে।

কিন্তু বাহ্যত এ ধরনের চিন্তা-ভাবনা ঠিক নয়। কারণ মুশরিকদের এ ধরনের আহবানের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল নবীর অবশ্যই বস্তুগত শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী হওয়া। মহান আল্লাহর নবী যে একজন দরিদ্র ব্যক্তি হতে পারেন তা তাদের দৃষ্টিতে অসম্ভব বলে গণ্য হতো। তারা বিশ্বাস করত যে,মহান আল্লাহর ওহী অবশ্যই একজন ধনাঢ্য ব্যক্তির ওপর অবতীর্ণ হবে। তাই তারা বলত :

) و قالوا لولا نزّل هذا القرآن على رجل من القريتين عظيم(

“কেন এ কোরআন দু জনপদ অর্থাৎ মক্কা ও তায়েফের কোন ধনাঢ্য ব্যক্তির ওপর অবতীর্ণ করা হয় নি। (সূরা যুখরুফ : ৩১)

সুতরাং তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল নবী (সা.)-এর বাহ্যিক (বস্তুগত) ক্ষমতা ও শক্তি এবং বিত্ত-বৈভব,এমনকি তা যদি স্বাভাবিক পন্থায়ও অর্জিত হয়।

যে কোন পন্থায় এমনকি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পন্থায় হলেও নবীর এ ধরনের কাজ সম্পন্ন করাই যদি মুশরিকদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে এতৎসংক্রান্ত বিষয়ের দলিল হচ্ছে এই যে,বাগান ও স্বর্ণনির্মিত বাড়িঘর তারা স্বয়ং নবীর জন্য চাইত। তাই তারা বলত :

) أو يكون لك بيت من زخرف(

“যতক্ষণ পর্যন্ত না তুমি স্বর্ণনির্মিত গৃহের স্বত্বাধিকারী হবে সে পর্যন্ত আমরা তোমার প্রতি ঈমান আনব না। (সূরা ইসরা : ৯৩)

অর্থাৎ এ সব মুশরিক বলত : যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি বাগান ও স্বর্ণনির্মিত বাড়ির মালিক না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা তোমার প্রতি ঈমান আনব না। আর তাদের এ বক্তব্যের লক্ষ্য যদি এটিই হতো যে,তিনি উপরিউক্ত বিষয়দ্বয় (বাগান ও স্বর্ণনির্মিত বাসগৃহের অধিকারী হওয়া) অবস্তুগত অতি প্রাকৃতিক শক্তি দ্বারা অর্জন করবেন,তাহলে এ কথা বলার অবশ্যই কোন যুক্তি থাকত না যে,যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি স্বর্ণনির্মিত বাড়ি ও বাগান নির্মাণ না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা তোমার প্রতি ঈমান আনয়ন করব না।”

কিন্তু যেহেতু প্রথম প্রস্তাবে তারা বলেছিল,تفجرلنا من الأرض ينبوع ا আমাদের জন্য ভূপৃষ্ঠের ওপর একটি ঝরনা প্রবাহিত কর ২৮৩ ,তাই তাদের এ কথার উদ্দেশ্য এটিই ছিল না যে,তিনি তাদের জন্য ঝরনা প্রবাহিত করবেন যাতে করে তারা তা ব্যবহার করতে পারে। বরং তিনি তাদের ঈমান আনয়ন করার জন্যই এ ধরনের কাজ করতেন।

তৃতীয়ত মুজিযা প্রদর্শনের আহবান জানানোর প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে এর আলোকে তাঁর দাবির সত্যতা উপলব্ধি করা এবং তাঁর নবুওয়াতে বিশ্বাস স্থাপন। তাই যারা নবীর কাছে মুজিযা প্রদর্শন করার আহবান জানায় তাদের মধ্যে যদি এমন এক দল থাকে যারা মুজিযা প্রদর্শন করার কারণে নবীর প্রতি ঈমান আনয়ন করবে তাহলে ঠিক এমতাবস্থায় মুজিযা প্রদর্শন বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে নির্দোষ ও শোভন বলে গণ্য হবে। তবে মুজিযা প্রদর্শন করার আহবানকারী যদি একগুঁয়ে ও ভাঁড় গোছের ব্যক্তিবর্গ হয় এবং তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যাদুকরদের খেল-তামাসার মতো এক ধরনের বিনোদন ও ক্রীড়া-কৌতুক করাই হয়ে থাকে,তাহলে এমতাবস্থায় তাদের আহবানে ইতিবাচক সাড়া দেয়া মহানবী (সা.)-এর জন্য আবশ্যক বিষয় বলে গণ্য হবে না।

ঠিক একইভাবে যেহেতু তারা বলেছে, হে নবী! আপনি আকাশে উড্ডয়ন করুন’,আর এতটুকুও তারা যথেষ্ট মনে করে নি,বরং এরপরও তারা বলেছে, আপনি অবশ্যই আকাশ থেকে আমাদের জন্য গ্রন্থ আনয়ন করবেন ,সেহেতু বলা যায় যে,এ সব আহবানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সত্য উন্মোচন করা ছিল না। কারণ তারা যদি সত্যের সন্ধানী হতো কেন তারা তাঁর আকাশে উড্ডয়নকেই যথেষ্ট মনে করে নি এবং জোর দিয়ে বলেছে এর সাথে আরো কিছু (আকাশ থেকে গ্রন্থ আনয়ন) সংযোজন করতে হবে?

এ দু টি আয়াত ছাড়াও আরো কতিপয় আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে,আকাশ থেকে গ্রন্থ প্রেরণ করার পরও তারা তাদের একগুঁয়েমী পরিত্যাগ করবে না এবং সত্য অস্বীকার করার প্রবণতা অব্যাহত থাকবে। উদাহরণস্বরূপ নিম্নোক্ত আয়াতটি প্রকাশ্যভাবে এ সত্য প্রমাণ করেছে:

) و لو نزّلنا عليك كتابا في قرطاس فلمسوه بأيديهم لقال الّذين كفروا إن هذا إلّا سحر مّبين(

“আর যদি আমরা আপনার ওপর কাগজে লিখিত গ্রন্থ অবতীর্ণ করতাম,অতঃপর তা তারা নিজেদের হাতে স্পর্শও করত তাহলে যারা কুফর করেছে তারা বলত : এটি একটি স্পষ্ট যাদু ব্যতীত আর কিছুই নয়। (সূরা আনআম : ৭)

উপরিউক্ত আয়াতে কাগজে লিখিত গ্রন্থ অবতীর্ণ হওয়ার কাঙ্ক্ষিত অর্থ যে মুশরিকদের এ আহবান এতে কোন সন্দেহ নেই। আর মুশরিকদের এ আহবান সূরা ইসরার প্রাগুক্ত আয়াতসমূহে বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ মহানবী (সা.) আকাশের দিকে উড্ডয়ন করুন এবং তাদের জন্য (আকাশ থেকে) একটি গ্রন্থ আনয়ন করুন। মহান আল্লাহ্ এ আয়াতে বলেছেন, এ ধরনের কাজও যদি সম্পাদিত হয় তবু তারা ঈমান আনবে না।

চতুর্থত মুজিযা প্রদর্শনের আহবান এ জন্য করা হয় যে,মুজিযার আলোকে আহবানকারীরা ঈমান আনয়ন করবে এবং মহানবীর রিসালাতে বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হবে। যদি মুজিযা প্রদর্শনের পরিণতি আহবানকারীদের অস্তিত্ব বিলোপ করাই হয়ে থাকে তাহলে তা পরিণামে উদ্দেশ্যের পরিপন্থী হবে। তাদের মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়ুক -তাদের এ কথার কাঙ্ক্ষিত অর্থ এই যে,আসমানী পাথরসমূহ তাদেরকে ধ্বংস করুক। এ আহবান মুজিযা প্রদর্শনের লক্ষ্যের সাথে মোটেও খাপ খায় না এবং এটি হবে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পরিপন্থী হওয়ার উজ্জ্বল নমুনা।

শেষে এ বিষয়টি উল্লেখ না করেই পারছি না যে,মহানবী যুক্তি উপস্থাপনকারীর চিন্তার বিপক্ষে কখনই নিজেকে অক্ষম বলে পেশ করেন নি,বরংسبحان ربّي هل كنت إلّا بشرا رسولا আমার প্রভু পবিত্র,আমি কি একজন সংবাদ আনয়নকারী মানুষ ব্যতীত আর কিছু’-এ আয়াতটি দ্বারা তিনি দু টি বিষয় পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন। বিষয় দু টি হলো :

১. মহান আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা : আমার প্রভু পবিত্র’-এ বাক্যটি দিয়ে তিনি মহান আল্লাহকে সব ধরনের দুর্বলতা,অক্ষমতা ও দর্শন (চর্মচক্ষু দিয়ে দেখা) থেকে মুক্ত ও পবিত্র বলেছেন এবং তাঁকে সব ধরনের সম্ভব কাজ আঞ্জাম দেবার ব্যাপারে ক্ষমতাবান বলেছেন।

২. মহানবীর শক্তির সীমাবদ্ধতা : আমি একজন সংবাদ আনয়নকারী মানুষ হওয়ার চাইতে আর বেশি কিছু নই’-এ বাক্যটি দ্বারা তিনি বুঝাতে চেয়েছেন যে,তিনি একজন আদেশপ্রাপ্ত ব্যক্তি ব্যতীত আর কিছুই নন। তিনি মহান আল্লাহর আদেশের আজ্ঞাবহ। মহান আল্লাহ্ যা কিছু ইচ্ছা করেন তিনি সেটাই আঞ্জাম দেন। সকল কাজ আসলে মহান আল্লাহর হাতে। এমন নয় যে,মহানবী যে কোন আহবানের সামনে তাঁর নিজ ইচ্ছাশক্তিসমেত আত্মসমর্পণ করতে পারেন।

অন্যভাবে বলা যায় প্রাগুক্ত আয়াতটি উত্তর দেয়ার পর্যায়ে (সব ধরনের) দোষ-ত্রুটি,দুর্বলতা ও অক্ষমতা,চর্মচোখে দর্শন এবং পর্যবেক্ষণ করা থেকে মহান আল্লাহকে পবিত্র বলে ঘোষণা করার পর মানুষ’ ও রাসূল’ এ শব্দদ্বয়ের ওপর সবিশেষ জোর দিয়েছে। লক্ষ্য হচ্ছে এটিই যে,যেহেতু আমি একজন মানুষ সেহেতু এ দৃষ্টিকোণ থেকে তোমরা যদি এ সব কাজ আমা থেকে আহবান কর তাহলে এ ধরনের আহবান আসলে সঠিক আহবান হবে না। কারণ এ ধরনের কাজ ও বিষয়াদি মহান আল্লাহর শক্তির মুখাপেক্ষী এবং মানুষের শক্তি ও সামর্থ্যরে বাইরে। যেহেতু আমি একজন নবী সেহেতু একজন নবী হিসাবে যদি তোমরা এ আহবান করে থাক তাহলে জেনে রাখ যে,নবী একজন আদেশপ্রাপ্ত ও আজ্ঞাবহ হওয়ার চেয়ে বেশি কিছু নন। মহান আল্লাহ্ তাঁকে যা আদেশ দেন তিনি তা আঞ্জাম দেন;আর এ ক্ষেত্রে তাঁর নিজের কোন ইচ্ছাশক্তি ও চাওয়া-পাওয়াই নেই।

কুরাইশ নেতৃবর্গের বিরুদ্ধাচরণের কারণ

এ অংশটি ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম আলোচ্য বিষয়। কারণ মানুষ চিন্তা করে দেখে যে,যদিও হযরত মুহাম্মদকে সকল কুরাইশ সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত জানত এবং নবুওয়াতের ঘোষণা দেয়া পর্যন্ত তাঁর নিকট থেকে তারা এমনকি ছোট-খাটো স্খলনও প্রত্যক্ষ করে নি;তাঁর প্রাঞ্জল,সাবলীল ও বলিষ্ঠ বাণী (পবিত্র কোরআন) যা অন্তরসমূহকে আকৃষ্ট করত তারা তা শুনত;কখনো কখনো তারা তাঁর কাছ থেকে অলৌকিক কার্যাবলীও প্রত্যক্ষ করত যা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মবহির্ভূত ছিল। এত কিছু সত্ত্বেও তারা তাঁর বিরুদ্ধে কেন এতটা তীব্র বিরোধিতা করেছে?

তাদের বিরুদ্ধাচরণের কারণসমূহ নিম্নোক্ত কয়েকটি বিষয় হতে পারে :

১. মহানবীর প্রতি ঈর্ষা : একদল কুরাইশ মহানবীর প্রতি ঈর্ষা ও হিংসা পোষণ করার কারণে তাঁর অনুসরণ করতে পারে নি। আর তারা নিজেরাই নবুওয়াতের মতো ঐশী পদ ও দায়িত্ব লাভ করার দুরাশা পোষণ করত।

) و قالوا لولا نزّل هذا القرآن على رجل من القريتين عظيم(

“আর তারা বলত : দু জনপদ অর্থাৎ মক্কা ও তায়েফের কোন একজন ধনাঢ্য ব্যক্তির ওপর যদি এ কোরআন অবতীর্ণ হতো”২৮৪ -এ আয়াতটির শানে নুযূল প্রসঙ্গে মুফাসসিরগণ বলেছেন, ওয়ালীদ ইবনে মুগীরাহ্ মহানবীর সাথে দেখা করে বলেছিল : আমি তোমার চেয়ে নবুওয়াতের জন্য অধিকতর উপযুক্ত। কারণ আমি বয়স,ধন-সম্পদ এবং সন্তান-সন্ততির দিক থেকে তোমার চেয়ে অগ্রগামী ও শ্রেষ্ঠ। ২৮৫

উমাইয়্যাহ্ ইবনে আবীস সাল্ত ঐ সব ব্যক্তির অন্তর্ভুক্ত ছিল যারা ইসলাম ধর্মের আগেও মহানবীর ব্যাপারে আলোচনা করত। সে নিজেও এতটা আশাবাদী ছিল যে,সে নিজেই এ বিরাট পদমর্যাদা অর্থাৎ নবুওয়াতের মাকামের অধিকারী হবে। সে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মহানবীর অনুসরণ করে নি এবং জনগণকে মহানবীর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলত।

আখনাস ছিল মহানবীর আরেক শত্রু। সে আবু জাহলকে জিজ্ঞাসা করেছিল, মুহাম্মদ সম্পর্কে তোমার অভিমত কি? তখন সে বলেছিল, আমরা এবং আবদে মান্নাফ কৌলীন্য ও বংশগৌরবকে কেন্দ্র করে পরস্পর ঝগড়া করেছি। তাদের সাথে আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছি। আমরা বেশ কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করে তাদের সমকক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। এখন যখন আমরা তাদের সমকক্ষ হয়েছি তখন তারা দাবি করছে যে,আমাদের গোত্রভুক্ত এক ব্যক্তির ওপর ওহী নাযিল হচ্ছে। খোদার শপথ,আমরা কখনই তার প্রতি ঈমান আনব না। ২৮৬

এ সব উদাহরণ থেকে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি কুরাইশ নেতৃবৃন্দের হিংসা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। ইতিহাসের পাতায় পাতায় আরো উদাহরণ রয়েছে যা আমরা এখানে উল্লেখ করলাম না।

২. শেষ বিচার দিবস অর্থাৎ কিয়ামত দিবসের ভীতি : এ বিষয়টি কুরাইশদের বিরুদ্ধাচরণের ক্ষেত্রে অন্য সকল কারণের চেয়ে অধিকতর কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল। কারণ তারা ছিল স্ফূর্তিবাজ,আমোদ-প্রমোদপ্রিয় ও বন্ধনহীন। এ সব ব্যক্তি বছরের পর বছর অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করে আসছিল। তারা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ইসলাম ধর্মের প্রতি আহবানকে তাদের চিরাচরিত পুরানো অভ্যাসের পরিপন্থী বলে শনাক্ত করে। তাই নিজেদের পুরানো অভ্যাস যা তাদের প্রবৃত্তির তাড়না ও প্রবণতার সাথে পূর্ণরূপে খাপ খেত তা ত্যাগ করা ছিল তাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর।

৩. পরকালের শাস্তির ভয় : পবিত্র কোরআনের পারলৌকিক শাস্তি সংক্রান্ত আয়তসমূহ যা স্ফূর্তিবাজ,আমোদ-প্রমোদ ও বিলাস-ব্যসনে লিপ্ত,অত্যাচারী এবং উদাসীন লোকদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির ভয় দেখায় তা শোনার কারণে কুরাইশদের অন্তরে এক অদ্ভুত ভীতি ও শঙ্কার উদ্ভব হতো এবং তাদের চিন্তাধারা বিক্ষিপ্ত ও বিড়ম্বিত হয়ে যেত। যখন মহানবী (সা.) সুললিত কণ্ঠে পরকাল সংক্রান্ত আয়াতগুলো কুরাইশদের সাধারণ সভা ও সমাবেশগুলোতে তেলাওয়াত করতেন তখন এত বেশি হৈ চৈ পড়ে যেত যে,তাদের আমোদ-প্রমোদের আসরগুলো ভণ্ডুল হয়ে যেত। আরবগণ নিজেদেরকে যে কোন ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থা প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুত করে রাখত। জীবিকা নির্বাহের ব্যাপারে নিশ্চয়তা অর্জন করার জন্য তীর নিক্ষেপ করে লটারী করত,পাথর দিয়ে শুভ-অশুভ নির্ণয় করত এবং পাখিদের আনাগোনাকে ভবিষ্যৎ ঘটনাসমূহের নিদর্শন বলে কল্পনা করত। এ সব কুসংস্কারাচ্ছন্ন আরব নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ব্যতিরেকে হযরত মুহাম্মদ (সা.) যে শাস্তি সম্পর্কে তাদের ভয় দেখাতেন সে শাস্তি সম্পর্কে ধীরস্থির ও প্রশান্তভাবে বসে থাকতে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। এ কারণেই তারা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিরুদ্ধে তীব্র বিরোধিতায় লিপ্ত হয়। তারা জনগণের মাঝে প্রচার করত যাতে করে মুহাম্মদ (সা.)-এর সুসংবাদ ও ভীতি প্রদর্শনের প্রতি কর্ণপাত না করে। যে আয়াতগুলো কুরাইশদের আমোদ-প্রমোদপ্রিয় উদাসীন নেতৃবর্গের চিন্তা-চেতনা ও মন-মানসিকতাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল তন্মধ্যে কয়েকটি আয়াত নিচে উল্লেখ করছি :

) فإذا جاءت الصّاخّة يوم يفرّ المرء من أخيه و أمّه و أبيه و صاحبته و بنيه لكلّ امرئ مّنهم يومئذ شأن يُغنيه(

“যে দিন পুনরুত্থান সংঘটিত হবে সে দিন মানুষ তার ভাই,মা,পিতা,স্ত্রী ও সন্তানদের থেকে পালিয়ে বেড়াবে। সকল মানুষ সে দিন নিজেকে নিয়েই মহাব্যস্ত হয়ে যাবে। (সূরা আবাসা : ৩৩-৩৭)

যখন তারা পবিত্র কাবার পাশে মদের পানপাত্রগুলো নিয়ে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করত তখন এ আহবান তাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করত :

) كلّما نضجت جلودهم بدّلناهم جلودا غيرها ليذوقوا العذاب(

“যখনই আগুনের উত্তাপে তাদের দেহের চামড়াগুলো নষ্ট হয়ে যাবে তখন তা আমরা পরিবর্তন করে দেব যাতে করে তারা শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করে। (সূরা নিসা : ৫৬)

উক্ত আহবান শোনামাত্রই তারা মানসিকভাবে এতটা অস্থির হয়ে যেত যে,অনিচ্ছাকৃতভাবে তারা তাদের পানপাত্রগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিত এবং ভয়,শঙ্কা ও কম্পন তাদের পুরো দেহকে আচ্ছন্ন করে রাখত।

৪. আরব মুশরিক সমাজের ভীতি : হারেস বিন নওফেল ইবনে আবদে মান্নাফ মহানবীর সান্নিধ্যে উপস্থিত হয়ে আরজ করেছিল, আমরা জানি যে,তুমি যে ব্যাপারে ভয় প্রদর্শন করছ তা সত্য ও সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপিত। তবে যখনই আমরা ঈমান আনব তখনই মুশরিক আরবগণ আমাদেরকে আমাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করবে। এ ধরনের লোকদের বক্তব্যের জবাবে মহানবী (সা.)-এর ওপর নিম্নোক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছিল :

) و قالوا إن نتّبع الهدى معك نتخطّف من أرضنا أولم نمكّن لّهم حرما آمنا يُجبى إليه ثمرات كلّ شيء رّزقا مّن لّدنّا(

“তারা বলে যে,যখনই আমরা এ হেদায়েতের অনুসরণ করব তখনই আমাদেরকে আমাদের দেশ ও জনপদ থেকে বিতাড়িত করা হবে। তাদের কথার জবাবে আপনি বলে দিন : আমরা কি নিরাপদ হারাম (সংরক্ষিত অঞ্চল) অর্থাৎ পবিত্র মক্কা নগরী তাদের কর্তৃত্বে দেই নি যেখানে আমাদের পক্ষ থেকে সব ধরনের ফল জীবিকাস্বরূপ সরবরাহ করা হয়। (সূরা কাসাস : ৫৭)

মুশরিকদের কতিপয় আপত্তি

কখনো কখনো মুশরিকগণ বলত,শামদেশ এমনই এক দেশ যেখানে নবিগণ আবির্ভূত ও প্রেরিত হয়েছেন,অথচ এখন পর্যন্ত এ বালুকাময় মরু অঞ্চলে (মক্কায়) কোন নবী আবির্ভূত হয়েছেন তা প্রত্যক্ষ করা যায় নি।

ইয়াহুদীদের প্ররোচনায় প্ররোচিত হয়ে আরবের অনেক মুশরিক বলত যে,মুহাম্মদের ওপর কোরআন কেন পর্যায়ক্রমে অর্থাৎ ধাপে ধাপে অবতীর্ণ হয়? কেন তা তাওরাত ও ইঞ্জিলের মতো একত্রে একবারে অবতীর্ণ হয় না? পবিত্র কোরআন তাদের এ আপত্তিকে হুবহু উল্লেখ করে বলেছে:

) و قال الّذين كفروا لولا نزّل عليه القرآن جملة واحدة كذالك لنثبّت به فؤادك و رتّلناه ترتيلا(

“কাফেররা বলে : এ কোরআন কেন তার ওপর একত্রে একবারে অবতীর্ণ হয় না? তাদের এ কথার জবাবে আপনি বলে দিন : আর এভাবেই আমরা এর মাধ্যমে (অর্থাৎ ধীরে ধীরে পর্যায়ক্রমে অবতীর্ণ করার মাধ্যমে) আপনার অন্তঃকরণকে প্রশান্ত ও সুদৃঢ় রাখব। (সূরা ফুরকান : ৩২)

মুশরিকদের এ আপত্তির প্রতি পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে পবিত্র কোরআনের পর্যায়ক্রমিক অবতরণের বিষয়টি স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনের উপরিউক্ত বক্তব্য অসদুদ্দেশ্য পোষণকারী প্রাচ্যবিদদেরকে শক্তিশালী যুক্তি উপস্থাপন করার মাধ্যমে সম্পূর্ণরূপে নিরস্ত্র ও পরাভূত করেছে। এখন আমরা এ বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করব :

ষষ্ঠ অধ্যায় : মহানবী (সা.)-এর শৈশবকাল

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে,ইসলাম ও মুসলমানদের মহান নেতা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সমগ্র জীবনটাই-শৈশবের শুরু থেকে যে দিন তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে নবুওয়াতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন সেই দিন পর্যন্ত আশ্চর্যজনক ঘটনাসমূহের সমন্বয়ে গঠিত। আর এ সব আশ্চর্যজনক ঘটনা অলৌকিকত্বের প্রমাণ বহন করে। এ সব কিছু থেকে প্রতীয়মান হয় যে,মহানবী (সা.)-এর জীবন ছিল একটি অসাধারণ জীবন।

মহানবীর এ সব অলৌকিক ঘটনা ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে সীরাত রচয়িতাগণ দু ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছেন :

1. বস্তুবাদী কতিপয় প্রাচ্যবিদের দৃষ্টিভঙ্গি : বস্তুবাদী বৈজ্ঞানিকগণ বস্তুবাদী ভূয়োদর্শন পোষণ করেন এবং অস্তিত্বকে কেবল বস্তুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ বলে মনে করেন। তাঁরা সকল প্রপঞ্চ ও ঘটনাকে বস্তুগত প্রপঞ্চ ও ঘটনা বলে বিশ্বাস করেন এবং প্রতিটি ঘটনা ও প্রপঞ্চেরই প্রাকৃতিক (বস্তুগত) কারণ নির্ধারণ করেন। তাঁরা এ সব অলৌকিক ঘটনা ও প্রপঞ্চের প্রতি মোটেও গুরুত্ব দেন না। কারণ বস্তুবাদী নীতিমালা অনুসারে এ ধরনের ঘটনা ও প্রপঞ্চের উৎপত্তি অসম্ভব;আর ইতিহাসের পাতায় পাতায় এ ধরনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেই তাঁরা এগুলোকে ধর্মের অনুসারীদের কল্পনা এবং ভক্তি-ভালোবাসাপ্রসূত বলে বিবেচনা করেন।

একদল প্রাচ্যবিদ যাঁরা নিজেদেরকে বাহ্যত তাওহীদবাদী ও খোদায় বিশ্বাসী বলে অভিহিত করেন এবং অতি প্রাকৃতিক (আধ্যাত্মিক) জগতের অস্তিত্বেও বিশ্বাস করেন,কিন্তু তাঁদের ঈমানী দুর্বলতা ও জ্ঞানগত গর্ব এবং তাঁদের চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণার ওপর বস্তুবাদিতার প্রাধান্য থাকার কারণে ঘটনা বিশ্লেষণ করার সময় তাঁরা বস্তুবাদী মূলনীতিসমূহের অনুসরণ করেন। আমরা বারবার তাঁদের বক্তব্য ও আলোচনার মধ্যে এ সব বাক্য লক্ষ্য করেছি যে, নবুওয়াত আসলে এক ধরনের মানবীয় প্রতিভা , নবী হচ্ছেন একজন সামাজিক প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব যিনি তাঁর নিজের আলোকিত চিন্তাধারা দিয়ে মানব জীবনের গতিধারা ও পথকে আলোকিত করেন’...।

প্রাচ্যবিদদের এ ধরনের বক্তব্য আসলে বস্তুবাদী চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উদ্ভূত যা সকল ধর্মকে মানব চিন্তা ও কল্পনাপ্রসূত বলে বিবেচনা করে। অথচ আস্তিক জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তিগণ সাধারণ নবুওয়াত সংক্রান্ত আলোচনায় প্রমাণ করেছেন যে,নবুওয়াত মহান আল্লাহর ঐশী দান ও অনুগ্রহ যা সকল আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণা (ইলহাম) ও যোগাযোগের উৎস। মহান নবীদের পরিকল্পনাসমূহ,তাঁদের চিন্তা,ধারণা ও প্রতিভা প্রসূত নয়;বরং অবস্তুগত আধ্যাত্মিকজগৎ থেকে প্রেরিত ইলহাম ও প্রত্যাদেশ ব্যতীত তাঁদের এ সব পরিকল্পনা ও কর্মসূচীর আর কোন উৎসমূল নেই। কিন্তু যখন খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী প্রাচ্যবিদগণ বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে এ সব বিষয়ে দৃক্পাত করেন এবং সমস্ত ঘটনা ও প্রপঞ্চকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অভিজ্ঞতালব্ধ বৈজ্ঞানিক মূলনীতি ও সূত্রের আলোকে পরিমাপ করেন তখন যে সব ঘটনা ও প্রপঞ্চের অলৌকিকত্বের দিক রয়েছে অর্থাৎ মুজিযা সেগুলোর কঠোর সমালোচনা করেন এবং মূল থেকে সেগুলো অস্বীকার করেন।

2 . স্রষ্টা পূজারিগণ : ঐ সব ব্যক্তি মহান আল্লাহর উপাসনাকারী যারা বিশ্বাস করে যে,বস্তুজগতের বৈশিষ্ট্য ও চি হ্নসমূহ অন্য জগতের পরিচালনাধীন এবং অতি প্রাকৃতিক অবস্তুগতজগৎ এ প্রাকৃতিক ও বস্তুগত বিশ্বের সার্বিক শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। অন্যভাবে বলা যায়,বস্তুজগৎ স্বাধীন ও সার্বভৌম নয়। সকল ব্যবস্থা এবং এগুলোর প্রাকৃতিক ও বৈজ্ঞানিক সূত্র উচ্চতর অস্তিত্বময় সত্তাসমূহ,বিশেষ করে মহান আল্লাহর ইচ্ছার সৃষ্টি। মহান আল্লাহ্ বস্তুর অস্তিত্ব প্রদান করেছেন। তিনি বস্তুর বিভিন্ন অংশের মাঝে কতগুলো সুষ্ঠু নিয়ম প্রবর্তন করেছেন এবং বস্তুর অস্তিত্বের স্থায়িত্বকে কতগুলো প্রাকৃতিক নিয়মের ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

যদিও এই গোষ্ঠী বৈজ্ঞানিক নিয়ম-কানুন ও সূত্রসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এবং প্রাকৃতিক বস্তুনিচয়ের মধ্যকার সম্পর্কসমূহ যেগুলো বিজ্ঞান কর্তৃক সমর্থিত ও স্বীকৃত হয়েছে সে সব ব্যাপারে বৈজ্ঞানিকদের বক্তব্যও আন্তরিকভাবে মেনে নিয়েছে,তারপরও তারা বিশ্বাস করে যে,এ ধরনের প্রাকৃতিক নিয়মাবলী ধ্রুব নয়। তারা বিশ্বাস করে যে,শ্রেষ্ঠ ও উচ্চতর জগৎ (যা বস্তুজগৎ থেকে উন্নত ও শ্রেষ্ঠ) যখনই চাইবে ঠিক তখনই কতিপয় মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুনের প্রয়োগ ও রেওয়াজের পথ পরিবর্তন করে দিতে সক্ষম;শুধু তা-ই নয় বরং কতিপয় ক্ষেত্রে উচ্চতর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য তা

বাস্তবে কার্যকরও করেছে।

অন্যভাবে বলতে গেলে অলৌকিক কাজসমূহ আসলে কারণহীন নয়;তবে এগুলোর সাধারণ প্রাকৃতিক কারণ নেই;আর স্বাভাবিক প্রাকৃতিক কারণ না থাকা কারণের অনস্তিত্ব নির্দেশ করে না। সৃষ্টিজগতের নিয়ম,সূত্র ও বিধানসমূহও এমন নয় যে,সেগুলো মহান স্রষ্টার ইচ্ছায় পরিবর্তিত হয় না।

তারা বলে যে,মহান নবিগণের অলৌকিক ও আশ্চর্যজনক কার্যাবলী যা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুনের সীমারেখার বাইরে,সেগুলো এ পথেই (স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মে) সংঘটিত ও বাস্তবায়িত হয়। এ গোষ্ঠীটি অতি প্রাকৃতিক কার্যসমূহ (মুজিযা ও কারামত) যেগুলো পবিত্র কোরআন ও হাদীসসমূহে অথবা বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে তা স্বাভাবিক বৈজ্ঞানিক ও প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুনের সাথে খাপ খায় না বলে প্রত্যাখ্যান করেছে বা এ সব ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেছে।

এখন আমরা মহানবী (সা.)-এর শৈশবকালের আশ্চর্যজনক ও রহস্যময় ঘটনাবলী উল্লেখ করব। এ বক্তব্য ও ব্যাখ্যাটি যদি আমরা বিবেচনায় রাখি,তাহলে এ ধরনের ঘটনাবলীর ক্ষেত্রে আমাদের আর কোন সংশয় থাকবে না।

1. ইতিহাস রচয়িতাগণ হালীমার কথা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, যখন আমি আমেনার নবজাতক শিশুর (মহানবী) প্রতিপালনের দায়িত্ব গ্রহণ করি তখন তার মায়ের উপস্থিতিতে তাকে স্তন্য দান করতে চাইলাম। আমার বাম স্তন যা দুধে পরিপূর্ণ ছিল তা তার মুখে রাখলাম,কিন্তু নবজাতক শিশুটি আমার ডান স্তনের প্রতি যেন বেশি আগ্রহান্বিত ছিল। কিন্তু আমি যে দিন সন্তান প্রসব করেছিলাম সে দিন থেকেই আমার ডান স্তনে দুধ ছিল না। নবজাতক শিশুর পীড়াপীড়িতে আমি আমার দুধবিহীন ডান স্তনটি তার মুখে রাখলাম। তখনই সে তা চুষতে লাগল এবং স্তনের শুষ্ক দুগ্ধগ্রন্থিগুলো দুধে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। এ ঘটনা উপস্থিত সকল ব্যক্তিকে আশ্চর্যান্বিত করেছিল। 140

2. তাঁর নিকট থেকে আরো বর্ণিত আছে : যে দিন আমি শিশু মুহাম্মদকে আমার গৃহে আনলাম সে দিন থেকে আমার ঘরে কল্যাণ ও বরকত দিনের পর দিন বৃদ্ধি পেতে লাগল। আমার সম্পদ ও গবাদিপশুও বৃদ্ধি পেতে লাগল। 141

নিশ্চিতভাবে বলতে গেলে বস্তুবাদীরা এবং যারা তাদের মূলনীতি ও বিশ্বাসের অনুসরণ করে তারা এ সব বিষয়ে তাওহীদপন্থী স্রষ্টায় বিশ্বাসীদের সাথে দ্বিমত পোষণ করে। বস্তুবাদী নীতিমালা ও দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারীরা যেহেতু এ ধরনের বিষয়াদি প্রকৃতিবিজ্ঞানের আলোকে ব্যাখ্যা করতে অক্ষম সেহেতু তারা তাৎক্ষণিকভাবে বলে যে,এ সব ঘটনা ও বিষয় মানুষের কল্পনাপ্রসূত। যদি তারা খুব ভদ্র ও মার্জিত হয় তাহলে বলে যে,মহানবী এ সব অলৌকিক কাজের মুখাপেক্ষী ছিলেন না। এতে কোন সন্দেহ নেই যে,তিনি এ সব বিষয়ের মুখাপেক্ষী ছিলেন না। তবে অমুখাপেক্ষিতা একটি বিষয় এবং কোন একটি বিষয় সত্য ও মিথ্যা হওয়ার ব্যাপারে ফায়সালা করা আরেকটি বিষয়। কিন্তু যে ব্যক্তি প্রকৃতিজগতে বিরাজমান ব্যবস্থাকে বিশ্ব-ব্র‏‏ হ্মাণ্ডের মহান স্রষ্টার ইচ্ছাশক্তির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন বলে জানে এবং বিশ্বাস করে যে,সবচেয়ে ক্ষুদ্র অস্তিত্ববান সত্তা (পরমাণু) থেকে শুরু করে সর্ববৃহৎ সৃষ্টি (নীহারিকাপুঞ্জ) পর্যন্ত সমগ্র বিশ্ব-ব্র হ্মাণ্ড তাঁর (স্রষ্টা) প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। তাই এ সব ঘটনা যাচাই-বাছাই এবং এগুলোর দলিল প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই সে এ সব ঘটনা ও বিষয়ের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করে;আর যদি সে এ সব ঘটনা যাচাই-বাছাই এবং এগুলোর দলিল-প্রমাণের ক্ষেত্রে নিশ্চিত হতে না-ও পারে তবুও সে এ সব বিষয় ও ঘটনাকে নিশ্চিতভাবে প্রত্যাখ্যান করে না।

আমরা পবিত্র কোরআনে হযরত ঈসা ইবনে মরিয়মের ক্ষেত্রে এ ধরনের অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করি। যেমন পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে : যখন হযরত মরিয়মের সন্তান প্রসবের সময় নিকটবর্তী হলো তখন তিনি একটি খেজুর গাছের কাছে আশ্রয় নিলেন এবং তিনি (তীব্র ব্যথা,একাকিত্ব ও দুর্নামের ভয়ে) মহান আল্লাহর কাছে মৃত্যু কামনা করলেন। ঐ সময় তিনি একটি আহবান ধ্বনি শুনতে পেলেন :

) لا تحزني قد جعل ربّك تحتك سريّا و هزّي إليك بجذع النّخلة تساقط عليك رطبا جنيّا(

“দুঃখভারাক্রান্ত হয়ো না। তোমার প্রভু তোমার পায়ের তলদেশে পানির ঝরনা প্রবাহিত করেছেন এবং (শুষ্ক) খেজুর গাছটি ঝাঁকি দাও তাহলে তাজা খেজুর তোমার ওপর পতিত হবে। (সূরা মরিয়ম : 24-25)

আমরা পবিত্র কোরআনে হযরত মরিয়ম সম্পর্কে অন্যান্য বিষয়ও জানতে পারি। তাঁর নিষ্পাপ হওয়া ও তাকওয়া তাঁকে এমন এক সুমহান স্থানে উন্নীত করেছিল যে,যখনই হযরত যাকারিয়া (আ.) হযরত মরিয়মের ইবাদাত-বন্দেগী করার স্থানে প্রবেশ করতেন তখনই তিনি তাঁর কাছে বেহেশতের খাবার দেখতে পেতেন। যখন তিনি এ ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞেস করতেন, এ রুজী (খাবার) কোথা থেকে এসেছে? হযরত মরিয়ম তাঁকে জবাবে বলতেন, মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। 142

অতএব,এ ধরনের অলৌকিক বিষয়ের ক্ষেত্রে সন্দেহ পোষণ করা এবং এগুলো অসম্ভব বলে মনে করা অনুচিত।

মরুভূমিতে পাঁচ বছর

আবদুল মুত্তালিবের অনাথ নাতি মহানবী (সা.) বনি সা দ গোত্রের মাঝে পাঁচ বছর অতিবাহিত করলেন। এ সময় তিনি ভালোভাবে বেড়ে ওঠেন। এ দীর্ঘ পাঁচ বছর হযরত হালীমাহ্ তাঁকে দু তিন বার মা আমেনার কাছে এনেছিলেন এবং শেষ বারে তিনি তাঁকে তাঁর মায়ের কাছে অর্পণ করেছিলেন।

দুগ্ধপানকাল শেষ হওয়ার পর বিবি হালীমাহ্ তাঁকে প্রথম বারের মতো পবিত্র মক্কায় এনেছিলেন। জোরাজুরি করে হালীমাহ্ তাঁকে পুনরায় বনি সা দ গোত্রে ফিরিয়ে নিয়ে যান। ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে জোর করার কারণ ছিল এই যে,এ অনাথ শিশুর উসিলায় তাঁর প্রভূত কল্যাণ ও বরকত হয়েছিল এবং পবিত্র মক্কা নগরীতে কলেরা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ায় হযরত আমেনাও হালীমাহর অনুরোধ গ্রহণ করেছিলেন।

একদল আবিসিনীয় আলেম একবার হিজাযে এসেছিলেন। তখন তাঁরা বনি সা দ গোত্রে শিশু মহানবীকে দেখতে পেলেন। তাঁরা দেখতে পেলেন যে,হযরত ঈসা (আ.)-এর পরবর্তী নবীর নিদর্শনাদি যা আসমানী গ্রন্থসমূহে বর্ণিত আছে তা এ শিশুটির সাথে মিলে যাচ্ছে। এ কারণে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন যে,যেভাবেই হোক তাঁরা এ শিশুকে অপহরণ করে আবিসিনিয়ায় নিয়ে যাবেন এবং এ হবে তাঁদের গৌরবের বিষয়। তাই এ সব ব্যক্তির হাত থেকে শিশু হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিরাপদ রাখার জন্য বিবি হালীমাহ্ তাঁকে দ্বিতীয় বারের মতো পবিত্র মক্কা নগরীতে নিয়ে আসেন।143

এ ব্যাপারটি মোটেও অসম্ভব ও কাল্পনিক নয়। কারণ পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট বক্তব্য অনুসারে মহানবীর নিদর্শনসমূহ ইঞ্জিল শরীফে বর্ণিত হয়েছে। সে সময়ের আসমানী গ্রন্থাদির বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিগণ যে পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থসমূহে বর্ণিত নিদর্শনসমূহের ভিত্তিতে উক্ত নিদর্শনসমূহের অধিকারী ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে পেরেছিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে :

) و إذا قال عيسى بن مريم يا بني إسرائيل إنّي رسول الله إليكم مصدّقا لما بين يديّ من التّوراة و مبشّرا برسول يأتي من بعدي اسمه أحمد فلمّا جاءهم بالبيّنات قالوا هذا سحر مبين(

“আর স্মরণ করুন তখনকার কথা যখন ঈসা ইবনে মরিয়ম (বনি ইসরাইলকে) বলেছিল : নিশ্চয়ই আমি তোমাদের কাছে মহান আল্লাহর রাসূল। আমার সামনে বিদ্যমান আসমানী গ্রন্থ তাওরাতের সত্যায়নকারী এবং আমি তোমাদেরকে আমার পরে যে রাসূল আগমন করবে তার সুসংবাদ প্রদান করছি। উক্ত রাসূলের নাম হবে আহমাদ। অতঃপর সেই (প্রতিশ্রুত) রাসূল তাদের কাছে (নিদর্শন ও মুজিযাসহ) আগমন করল। তখন তারা বলল : এ (এ সব মুজিযা ও পবিত্র কোরআন) তো স্পষ্ট যাদু।” (সূরা সাফ : 6)

এতৎসংক্রান্ত আরো বহু আয়াত রয়েছে যা থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে,মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চি হ্ন ও নিদর্শনাদি পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থসমূহে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং পূর্ববর্তী নবীদের উম্মতগণ এ ব্যাপারে অবগত ছিল।144

সপ্তম অধ্যায় : মাতৃক্রোড়ে প্রত্যাবর্তন

মহান আল্লাহ্ প্রত্যেক ব্যক্তিকে কোন না কোন দায়িত্ব পালনের জন্য সৃষ্টি করেছেন। কাউকে জ্ঞানার্জনের জন্য,কাউকে আবিষ্কার ও উদ্ভাবন করার জন্য,আবার কাউকে কর্ম ও পরিশ্রম করার জন্য,কোন কোন মানুষকে পরিচালনা ও নেতৃত্ব দান করার জন্য,আবার কিছু সংখ্যক মানুষকে শিক্ষা-প্রশিক্ষণ কার্য সম্পাদন করার জন্য এবং এভাবে তিনি বিভিন্ন মানুষকে জগতের বিভিন্ন কার্য সম্পাদন করার জন্য সৃষ্টি করেছেন।

আন্তরিক ও হৃদয়বান প্রশিক্ষকগণ যাঁরা ব্যক্তি ও সমাজের উন্নতি কামনা করেন তাঁরা কোন কাজের জন্য কোন ব্যক্তিকে নিযুক্ত করার আগেই তার অভিরুচি পরীক্ষা ও যাচাই-বাছাই করে থাকেন। আর যে ব্যক্তির যে কাজের প্রতি ঝোঁক এবং সামর্থ্য রয়েছে তাঁরা তাকে কেবল সেই কাজেরই দায়িত্ব দেন। কারণ এর অন্যথা হলে সমাজের দু টি ভয়ঙ্কর ক্ষতি হতে পারে :

ক. যে কাজ ঐ ব্যক্তি সম্পন্ন করতে পারত তা সে সম্পন্ন করতে পারবে না এবং

খ. যে কাজ সে আঞ্জাম দিয়েছে তা নিষ্ফল হতে বাধ্য।

বলা হয় যে,প্রতিটি রহস্যে একটি আনন্দ ও উদ্দীপনা আছে। ঐ ব্যক্তি সৌভাগ্যবান যে তার নিজ আনন্দ ও উদ্দীপনা উপলব্ধি করে।

এক শিক্ষক তাঁর এক অলস ছাত্রকে উপদেশ প্রদান করতেন এবং আলস্যের অনিষ্ট এবং যে সব ব্যক্তি জ্ঞানার্জন করেনি ও নিজেদের জীবনের বসন্তকাল অর্থাৎ যৌবনকে আলস্য ও প্রবৃত্তির পূজায় নিঃশেষ করেছে তাদের জীবনের করুণ পরিণতি সবিস্তারে ব্যাখ্যা করতেন। তিনি দেখতে পেলেন যে,ঐ ছাত্রটি তাঁর কথা শ্রবণরত অবস্থায় মাটির ওপর পড়ে থাকা এক টুকরা কয়লার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি হঠাৎ করে উপলব্ধি করতে পারলেন এ ছেলেটি লেখাপড়া শেখা ও জ্ঞানার্জন করার জন্য সৃষ্ট হয়নি;বরং স্রষ্টা তাকে চিত্রাঙ্কন করার মনোবৃত্তি ও রুচি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এ কারণেই উক্ত শিক্ষক ছাত্রটির পিতা-মাতাকে ডেকে বলেছিলেন, জ্ঞানার্জন ও লেখা-পড়া শেখার ব্যাপারে আপনাদের সন্তানের আগ্রহ অত্যন্ত কম,কিন্তু চিত্রাঙ্কন করার রুচি ও ঝোঁক তার মধ্যে বেশ ভালোভাবেই আছে এবং এ ব্যাপারে তার স্পৃহা ও আগ্রহ অত্যন্ত আশ্চর্যজনক।” শিক্ষকের পরামর্শ ছাত্রের পিতা-মাতার কাছে মনোঃপুত হলে অতি অল্প দিনের মধ্যে ছাত্রটি চিত্রাঙ্কন ও শিল্পকলা বেশ দ্রুত আয়ত্ত করে ফেলে এবং এ ক্ষেত্রে সে যুগশ্রেষ্ঠ শিল্পীতে পরিণত হয়।

শৈশবকাল শিশুদের অভিভাবকদের জন্য সন্তানদের রুচিবোধ ও সামর্থ্য পরীক্ষা এবং তাদের কাজ-কর্ম,আচার-আচরণ,চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা থেকে তাদের ব্যক্তিগত অভিরুচি সম্পর্কে ধারণা লাভ করার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। কারণ শিশুর চিন্তা-ভাবনা,কার্যকলাপ এবং মিষ্টি-মধুর কথা-বার্তা আসলে তার যোগ্যতা ও সামর্থ্যরেই আয়নাস্বরূপ। স্মর্তব্য যে,তার সামর্থ্য বিকাশের যাবতীয় পূর্বশর্ত ও ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে গেলে তা সর্বোত্তম পন্থায় কাজে লাগানো সম্ভব।

নবুওয়াত ঘোষণা পর্যন্ত হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনচরিত,আচার-আচরণ ও কার্যকলাপ তাঁর জীবন এবং তাঁর মহৎ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহের পটভূমি আমাদের মানসপটে চিত্রিত করে। তাঁর শৈশবের ইতিহাস অধ্যয়ন ও গভীর চিন্তা-ভাবনা করলে আমরা কেবল তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কেই অবগত হব না;বরং যে দিন তাঁর নবুওয়াত ঘোষিত হয়েছিল এবং তিনি নিজেকে সমাজের নেতা ও পথ-প্রদর্শক বলে ঘোষণা করেছিলেন সে দিন পর্যন্ত তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনেতিহাস তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদের অবগত করে এবং এ থেকে প্রতীয়মান হয়ে যায় যে,এ ব্যক্তি কোন্ কাজের জন্য সৃষ্ট হয়েছেন? আর তাঁর রিসালাত ও নেতৃত্বের দাবি কি তাঁর জীবন-কাহিনীর সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল? চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর জীবনেতিহাস,তাঁর আচার-আচরণ,চরিত্র,কর্ম,কথা এবং জনগণের সাথে দীর্ঘদিন মেলামেশা তাঁর সত্য নবী ও রাসূল হওয়ার বিষয়টি সমর্থন করে কি?

এ দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা এখানে মহানবীর জীবনের প্রথম দিনগুলো (শৈশব,কৈশোর ও যৌবন) সম্পর্কে আলোচনা করব।

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দাই-মা হযরত হালীমাহ্ তাঁকে পাঁচ বছর লালন-পালন করেছিলেন। এ সময় তিনি খাঁটি বলিষ্ঠ আরবী ভাষা রপ্ত করেছিলেন। সে কারণে তিনি পরবর্তীকালে গৌরববোধ করতেন। পাঁচ বছর পর হযরত হালীমাহ্ তাঁকে পবিত্র মক্কা নগরীতে নিয়ে আসেন। মক্কায় প্রত্যাবর্তন করার পর বেশ কিছুদিন তিনি মাতৃস্নেহ লাভ করেছিলেন এবং এ সময় তিনি দাদা আবদুল মুত্তালিবের তত্ত্বাবধান ও অভিভাবকত্বে লালিত-পালিত হন। হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মক্কাধিপতি হযরত আবদুল মুত্তালিবের কাছে পুত্র আবদুল্লাহর একমাত্র স্মৃতি।145

ইয়াসরিবে সফর

যে দিন আবদুল মুত্তালিবের পুত্রবধু (আমেনা) তাঁর যুবক স্বামীকে হারালেন সে দিন থেকে তিনি সর্বদা ইয়াসরিব গমন করে স্বামীর কবর যিয়ারত এবং সে সাথে ইয়াসরিবস্থ নিজ আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করার উপযুক্ত মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিলেন।

তিনি চিন্তা করে দেখলেন যে,একটি সঠিক সুযোগ এসে গেছে এবং তাঁর প্রাণাধিক পুত্রসন্তান (মুহাম্মদ)ও এখন বড় হয়েছে এবং সেও এ পথে তাঁর শোকের অংশীদার হতে পারবে। তাঁরা  উম্মে আইমানকে সাথে নিয়ে ইয়াসরিবের উদ্দেশে যাত্রা করেন এবং পূর্ণ এক মাস সেখানে অবস্থান করেন। শিশু মহানবীর জন্য এ সফর শোক ও বেদনা বয়ে এনেছিল। কারণ প্রথম বারের মতো তাঁর দৃষ্টি যে ঘরে তাঁর পিতা হযরত আবদুল্লাহ্ ইন্তেকাল করেছিলেন এবং চির নিদ্রায় শায়িত হয়েছিলেন সেই ঘরের দিকে নিবদ্ধ হয়েছিল।146

শিশু মহানবীর অন্তরে পিতৃশোক স্তিমিত হতে না হতেই হঠাৎ আরেকটি হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে গেল। এর ফলে শোক আরো বেড়ে গিয়েছিল। কারণ পবিত্র মক্কায় প্রত্যাবর্তনকালে মহানবীর স্নেহময়ী মা হযরত আমেনা পথিমধ্যে আবওয়া নামক স্থানে ইন্তেকাল করেন।147

এ ঘটনা বনি হাশিম ও আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে শিশু মহানবীকে স্নেহভাজন করেছিল এবং তাঁর প্রতি তাদের সহানুভূতি ও মমতাবোধের উদ্ভব ঘটিয়েছিল। তিনি ছিলেন হযরত আবদুল্লাহ্ ও হযরত আমেনার পুষ্পোদ্যানের একমাত্র পুষ্প-তাঁদের পুণ্যস্মৃতি। এ কারণেই শিশু মহানবী দাদা হযরত আবদুল মুত্তালিবের অশেষ ভালোবাসা ও স্নেহ পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন পিতামহের প্রাণাধিক প্রিয় নাতি। আবদুল মুত্তালিব তাঁকে তাঁর সকল সন্তান অপেক্ষা বেশি ভালোবাসতেন। তিনি সকলের ওপর তাঁকেই অগ্রাধিকার প্রদান করতেন।

কাবার চারদিকে কুরাইশপ্রধান আবদুল মুত্তালিবের জন্য কার্পেট বিছানো হতো। কুরাইশ নেতৃবৃন্দ এবং তাঁর সন্তানগণ তাঁর কার্পেটের চারপাশে বসত। আবদুল্লাহর কথা স্মরণ হলেই তিনি (আবদুল মুত্তালিব) যে কার্পেটের ওপর উপবিষ্ট থাকতেন সে কার্পেটে প্রয়াত পুত্র আবদুল্লাহর একমাত্র স্মৃতি-চি হ্ন শিশু হযরত মুহাম্মদকে এনে তাঁর পাশে বসানোর নির্দেশ দিতেন।148

পবিত্র কোরআনের সূরা দোহায় মহানবী (সা.)-এর শৈশব ও ইয়াতিম অবস্থার কথা উল্লিখিত হয়েছে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ্ বলেছেন,

) أ لم يجدك يتيما فآوى(

“তিনি কি আপনাকে ইয়াতিম পাওয়ার পর (প্রথমে পিতামহ আবদুল মুত্তালিব ও পরে পিতৃব্য হযরত আবু তালিবের) আশ্রয় দেন নি? (সূরা দোহা : 6)

মহানবীর ইয়াতিম হওয়ার অন্তর্নিহিত মূল রহস্য আমাদের কাছে খুব একটা স্পষ্ট নয়। তবে আমরা এতটুকু জানি যে,ঘটনাসমূহ যা সংঘটিত হয়েছে তা প্রজ্ঞাবিহীন নয়। এতদসত্ত্বেও আমরা ধারণা করতে পারি যে,মহান আল্লাহ্ চেয়েছিলেন মানব জাতি ও বিশ্বের মহান নেতা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সকল দায়িত্বভার গ্রহণ এবং নেতৃত্বদান শুরু করার আগেই যেন জীবনের সুখ,শান্তি,মাধুর্য ও তিক্ততার স্বাদ আস্বাদন করেন এবং জীবনের উত্থান-পতনের সাথে পরিচিত হন। এর ফলে তিনি মহান আত্মা এবং অত্যন্ত ধৈর্যশীল হৃদয়ের অধিকারী হতে পারবেন,দুঃখ-কষ্ট ও বিপদাপদ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা অর্জন এবং নিজেকে কঠিন বিপদাপদ,কষ্ট এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য প্রস্তুত করতে পারবেন।

মহান আল্লাহ্ চেয়েছিলেন যেন কারও আনুগত্য তাঁর স্কন্ধের ওপর না থাকে;আর তিনি জন্মগ্রহণের পরপর অর্থাৎ জীবনের শুরু থেকেই যেন স্বাধীন থাকেন। তিনি যেন আত্মগঠনে নিয়োজিত মনীষীদের ন্যায় তাঁর আত্মিক-আধ্যাত্মিক উৎকর্ষের ভিত্তিসমূহ নিজ হাতে গঠন করতে সক্ষম হন। যার ফলে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে,তাঁর প্রতিভা আসলে সাধারণ মানবীয় প্রতিভা নয় এবং তাঁর ভাগ্য নির্মাণের ক্ষেত্রে তাঁর পিতা-মাতার কোন ভূমিকাই ছিল না। তাঁর সকল মর্যাদা আসলে ওহীর উৎসমূল থেকেই উৎসারিত হয়েছিল।

আবদুল মুত্তালিবের মৃত্যু

হৃদয়বিদারক ঘটনাসমূহ সব সময় মানব জীবনের পথ-পরিক্রমণে আবির্ভূত হয়। সেগুলো সমুদ্রের পর্বত প্রমাণ উত্থাল তরঙ্গমালার ন্যায় একের পর এক উত্থিত হয়ে মানুষের জীবন-তরীকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে এবং মানব মনের ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানে।

মহানবী (সা.)-এর অন্তঃকরণে (মায়ের মৃত্যুতে) শোক ও দুঃখ তখনও বিরাজ করছিল ঠিক এমতাবস্থায় তৃতীয় বারের মতো এক বড় বিপদ তাঁর ওপর আপতিত হয়েছিল। তাঁর জীবনের অষ্টম বসন্তকাল অতিবাহিত হতে না হতেই অভিভাবক ও পিতামহ হযরত আবদুল মুত্তালিবকে তিনি হারিয়েছিলেন। আবদুল মুত্তালিবের মৃত্যু তাঁর কোমল আত্মার ওপর এতটা গভীর দাগ কেটেছিল যে,দাদা আবদুল মুত্তালিব যে দিন মৃত্যুবরণ করেছিলেন সে দিন তিনি সমাধিস্থলে তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা পর্যন্ত অশ্রুপাত করেছিলেন এবং তিনি কখনই পিতামহ আবদুল মুত্তালিবকে ভুলেন নি।149

ষষ্ঠ অধ্যায় : মহানবী (সা.)-এর শৈশবকাল

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে,ইসলাম ও মুসলমানদের মহান নেতা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সমগ্র জীবনটাই-শৈশবের শুরু থেকে যে দিন তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে নবুওয়াতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন সেই দিন পর্যন্ত আশ্চর্যজনক ঘটনাসমূহের সমন্বয়ে গঠিত। আর এ সব আশ্চর্যজনক ঘটনা অলৌকিকত্বের প্রমাণ বহন করে। এ সব কিছু থেকে প্রতীয়মান হয় যে,মহানবী (সা.)-এর জীবন ছিল একটি অসাধারণ জীবন।

মহানবীর এ সব অলৌকিক ঘটনা ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে সীরাত রচয়িতাগণ দু ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছেন :

1. বস্তুবাদী কতিপয় প্রাচ্যবিদের দৃষ্টিভঙ্গি : বস্তুবাদী বৈজ্ঞানিকগণ বস্তুবাদী ভূয়োদর্শন পোষণ করেন এবং অস্তিত্বকে কেবল বস্তুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ বলে মনে করেন। তাঁরা সকল প্রপঞ্চ ও ঘটনাকে বস্তুগত প্রপঞ্চ ও ঘটনা বলে বিশ্বাস করেন এবং প্রতিটি ঘটনা ও প্রপঞ্চেরই প্রাকৃতিক (বস্তুগত) কারণ নির্ধারণ করেন। তাঁরা এ সব অলৌকিক ঘটনা ও প্রপঞ্চের প্রতি মোটেও গুরুত্ব দেন না। কারণ বস্তুবাদী নীতিমালা অনুসারে এ ধরনের ঘটনা ও প্রপঞ্চের উৎপত্তি অসম্ভব;আর ইতিহাসের পাতায় পাতায় এ ধরনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেই তাঁরা এগুলোকে ধর্মের অনুসারীদের কল্পনা এবং ভক্তি-ভালোবাসাপ্রসূত বলে বিবেচনা করেন।

একদল প্রাচ্যবিদ যাঁরা নিজেদেরকে বাহ্যত তাওহীদবাদী ও খোদায় বিশ্বাসী বলে অভিহিত করেন এবং অতি প্রাকৃতিক (আধ্যাত্মিক) জগতের অস্তিত্বেও বিশ্বাস করেন,কিন্তু তাঁদের ঈমানী দুর্বলতা ও জ্ঞানগত গর্ব এবং তাঁদের চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণার ওপর বস্তুবাদিতার প্রাধান্য থাকার কারণে ঘটনা বিশ্লেষণ করার সময় তাঁরা বস্তুবাদী মূলনীতিসমূহের অনুসরণ করেন। আমরা বারবার তাঁদের বক্তব্য ও আলোচনার মধ্যে এ সব বাক্য লক্ষ্য করেছি যে, নবুওয়াত আসলে এক ধরনের মানবীয় প্রতিভা , নবী হচ্ছেন একজন সামাজিক প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব যিনি তাঁর নিজের আলোকিত চিন্তাধারা দিয়ে মানব জীবনের গতিধারা ও পথকে আলোকিত করেন’...।

প্রাচ্যবিদদের এ ধরনের বক্তব্য আসলে বস্তুবাদী চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উদ্ভূত যা সকল ধর্মকে মানব চিন্তা ও কল্পনাপ্রসূত বলে বিবেচনা করে। অথচ আস্তিক জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তিগণ সাধারণ নবুওয়াত সংক্রান্ত আলোচনায় প্রমাণ করেছেন যে,নবুওয়াত মহান আল্লাহর ঐশী দান ও অনুগ্রহ যা সকল আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণা (ইলহাম) ও যোগাযোগের উৎস। মহান নবীদের পরিকল্পনাসমূহ,তাঁদের চিন্তা,ধারণা ও প্রতিভা প্রসূত নয়;বরং অবস্তুগত আধ্যাত্মিকজগৎ থেকে প্রেরিত ইলহাম ও প্রত্যাদেশ ব্যতীত তাঁদের এ সব পরিকল্পনা ও কর্মসূচীর আর কোন উৎসমূল নেই। কিন্তু যখন খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী প্রাচ্যবিদগণ বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে এ সব বিষয়ে দৃক্পাত করেন এবং সমস্ত ঘটনা ও প্রপঞ্চকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অভিজ্ঞতালব্ধ বৈজ্ঞানিক মূলনীতি ও সূত্রের আলোকে পরিমাপ করেন তখন যে সব ঘটনা ও প্রপঞ্চের অলৌকিকত্বের দিক রয়েছে অর্থাৎ মুজিযা সেগুলোর কঠোর সমালোচনা করেন এবং মূল থেকে সেগুলো অস্বীকার করেন।

2 . স্রষ্টা পূজারিগণ : ঐ সব ব্যক্তি মহান আল্লাহর উপাসনাকারী যারা বিশ্বাস করে যে,বস্তুজগতের বৈশিষ্ট্য ও চি হ্নসমূহ অন্য জগতের পরিচালনাধীন এবং অতি প্রাকৃতিক অবস্তুগতজগৎ এ প্রাকৃতিক ও বস্তুগত বিশ্বের সার্বিক শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। অন্যভাবে বলা যায়,বস্তুজগৎ স্বাধীন ও সার্বভৌম নয়। সকল ব্যবস্থা এবং এগুলোর প্রাকৃতিক ও বৈজ্ঞানিক সূত্র উচ্চতর অস্তিত্বময় সত্তাসমূহ,বিশেষ করে মহান আল্লাহর ইচ্ছার সৃষ্টি। মহান আল্লাহ্ বস্তুর অস্তিত্ব প্রদান করেছেন। তিনি বস্তুর বিভিন্ন অংশের মাঝে কতগুলো সুষ্ঠু নিয়ম প্রবর্তন করেছেন এবং বস্তুর অস্তিত্বের স্থায়িত্বকে কতগুলো প্রাকৃতিক নিয়মের ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

যদিও এই গোষ্ঠী বৈজ্ঞানিক নিয়ম-কানুন ও সূত্রসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এবং প্রাকৃতিক বস্তুনিচয়ের মধ্যকার সম্পর্কসমূহ যেগুলো বিজ্ঞান কর্তৃক সমর্থিত ও স্বীকৃত হয়েছে সে সব ব্যাপারে বৈজ্ঞানিকদের বক্তব্যও আন্তরিকভাবে মেনে নিয়েছে,তারপরও তারা বিশ্বাস করে যে,এ ধরনের প্রাকৃতিক নিয়মাবলী ধ্রুব নয়। তারা বিশ্বাস করে যে,শ্রেষ্ঠ ও উচ্চতর জগৎ (যা বস্তুজগৎ থেকে উন্নত ও শ্রেষ্ঠ) যখনই চাইবে ঠিক তখনই কতিপয় মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুনের প্রয়োগ ও রেওয়াজের পথ পরিবর্তন করে দিতে সক্ষম;শুধু তা-ই নয় বরং কতিপয় ক্ষেত্রে উচ্চতর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য তা

বাস্তবে কার্যকরও করেছে।

অন্যভাবে বলতে গেলে অলৌকিক কাজসমূহ আসলে কারণহীন নয়;তবে এগুলোর সাধারণ প্রাকৃতিক কারণ নেই;আর স্বাভাবিক প্রাকৃতিক কারণ না থাকা কারণের অনস্তিত্ব নির্দেশ করে না। সৃষ্টিজগতের নিয়ম,সূত্র ও বিধানসমূহও এমন নয় যে,সেগুলো মহান স্রষ্টার ইচ্ছায় পরিবর্তিত হয় না।

তারা বলে যে,মহান নবিগণের অলৌকিক ও আশ্চর্যজনক কার্যাবলী যা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুনের সীমারেখার বাইরে,সেগুলো এ পথেই (স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মে) সংঘটিত ও বাস্তবায়িত হয়। এ গোষ্ঠীটি অতি প্রাকৃতিক কার্যসমূহ (মুজিযা ও কারামত) যেগুলো পবিত্র কোরআন ও হাদীসসমূহে অথবা বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে তা স্বাভাবিক বৈজ্ঞানিক ও প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুনের সাথে খাপ খায় না বলে প্রত্যাখ্যান করেছে বা এ সব ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেছে।

এখন আমরা মহানবী (সা.)-এর শৈশবকালের আশ্চর্যজনক ও রহস্যময় ঘটনাবলী উল্লেখ করব। এ বক্তব্য ও ব্যাখ্যাটি যদি আমরা বিবেচনায় রাখি,তাহলে এ ধরনের ঘটনাবলীর ক্ষেত্রে আমাদের আর কোন সংশয় থাকবে না।

1. ইতিহাস রচয়িতাগণ হালীমার কথা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, যখন আমি আমেনার নবজাতক শিশুর (মহানবী) প্রতিপালনের দায়িত্ব গ্রহণ করি তখন তার মায়ের উপস্থিতিতে তাকে স্তন্য দান করতে চাইলাম। আমার বাম স্তন যা দুধে পরিপূর্ণ ছিল তা তার মুখে রাখলাম,কিন্তু নবজাতক শিশুটি আমার ডান স্তনের প্রতি যেন বেশি আগ্রহান্বিত ছিল। কিন্তু আমি যে দিন সন্তান প্রসব করেছিলাম সে দিন থেকেই আমার ডান স্তনে দুধ ছিল না। নবজাতক শিশুর পীড়াপীড়িতে আমি আমার দুধবিহীন ডান স্তনটি তার মুখে রাখলাম। তখনই সে তা চুষতে লাগল এবং স্তনের শুষ্ক দুগ্ধগ্রন্থিগুলো দুধে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। এ ঘটনা উপস্থিত সকল ব্যক্তিকে আশ্চর্যান্বিত করেছিল। 140

2. তাঁর নিকট থেকে আরো বর্ণিত আছে : যে দিন আমি শিশু মুহাম্মদকে আমার গৃহে আনলাম সে দিন থেকে আমার ঘরে কল্যাণ ও বরকত দিনের পর দিন বৃদ্ধি পেতে লাগল। আমার সম্পদ ও গবাদিপশুও বৃদ্ধি পেতে লাগল। 141

নিশ্চিতভাবে বলতে গেলে বস্তুবাদীরা এবং যারা তাদের মূলনীতি ও বিশ্বাসের অনুসরণ করে তারা এ সব বিষয়ে তাওহীদপন্থী স্রষ্টায় বিশ্বাসীদের সাথে দ্বিমত পোষণ করে। বস্তুবাদী নীতিমালা ও দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারীরা যেহেতু এ ধরনের বিষয়াদি প্রকৃতিবিজ্ঞানের আলোকে ব্যাখ্যা করতে অক্ষম সেহেতু তারা তাৎক্ষণিকভাবে বলে যে,এ সব ঘটনা ও বিষয় মানুষের কল্পনাপ্রসূত। যদি তারা খুব ভদ্র ও মার্জিত হয় তাহলে বলে যে,মহানবী এ সব অলৌকিক কাজের মুখাপেক্ষী ছিলেন না। এতে কোন সন্দেহ নেই যে,তিনি এ সব বিষয়ের মুখাপেক্ষী ছিলেন না। তবে অমুখাপেক্ষিতা একটি বিষয় এবং কোন একটি বিষয় সত্য ও মিথ্যা হওয়ার ব্যাপারে ফায়সালা করা আরেকটি বিষয়। কিন্তু যে ব্যক্তি প্রকৃতিজগতে বিরাজমান ব্যবস্থাকে বিশ্ব-ব্র‏‏ হ্মাণ্ডের মহান স্রষ্টার ইচ্ছাশক্তির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন বলে জানে এবং বিশ্বাস করে যে,সবচেয়ে ক্ষুদ্র অস্তিত্ববান সত্তা (পরমাণু) থেকে শুরু করে সর্ববৃহৎ সৃষ্টি (নীহারিকাপুঞ্জ) পর্যন্ত সমগ্র বিশ্ব-ব্র হ্মাণ্ড তাঁর (স্রষ্টা) প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। তাই এ সব ঘটনা যাচাই-বাছাই এবং এগুলোর দলিল প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই সে এ সব ঘটনা ও বিষয়ের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করে;আর যদি সে এ সব ঘটনা যাচাই-বাছাই এবং এগুলোর দলিল-প্রমাণের ক্ষেত্রে নিশ্চিত হতে না-ও পারে তবুও সে এ সব বিষয় ও ঘটনাকে নিশ্চিতভাবে প্রত্যাখ্যান করে না।

আমরা পবিত্র কোরআনে হযরত ঈসা ইবনে মরিয়মের ক্ষেত্রে এ ধরনের অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করি। যেমন পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে : যখন হযরত মরিয়মের সন্তান প্রসবের সময় নিকটবর্তী হলো তখন তিনি একটি খেজুর গাছের কাছে আশ্রয় নিলেন এবং তিনি (তীব্র ব্যথা,একাকিত্ব ও দুর্নামের ভয়ে) মহান আল্লাহর কাছে মৃত্যু কামনা করলেন। ঐ সময় তিনি একটি আহবান ধ্বনি শুনতে পেলেন :

) لا تحزني قد جعل ربّك تحتك سريّا و هزّي إليك بجذع النّخلة تساقط عليك رطبا جنيّا(

“দুঃখভারাক্রান্ত হয়ো না। তোমার প্রভু তোমার পায়ের তলদেশে পানির ঝরনা প্রবাহিত করেছেন এবং (শুষ্ক) খেজুর গাছটি ঝাঁকি দাও তাহলে তাজা খেজুর তোমার ওপর পতিত হবে। (সূরা মরিয়ম : 24-25)

আমরা পবিত্র কোরআনে হযরত মরিয়ম সম্পর্কে অন্যান্য বিষয়ও জানতে পারি। তাঁর নিষ্পাপ হওয়া ও তাকওয়া তাঁকে এমন এক সুমহান স্থানে উন্নীত করেছিল যে,যখনই হযরত যাকারিয়া (আ.) হযরত মরিয়মের ইবাদাত-বন্দেগী করার স্থানে প্রবেশ করতেন তখনই তিনি তাঁর কাছে বেহেশতের খাবার দেখতে পেতেন। যখন তিনি এ ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞেস করতেন, এ রুজী (খাবার) কোথা থেকে এসেছে? হযরত মরিয়ম তাঁকে জবাবে বলতেন, মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। 142

অতএব,এ ধরনের অলৌকিক বিষয়ের ক্ষেত্রে সন্দেহ পোষণ করা এবং এগুলো অসম্ভব বলে মনে করা অনুচিত।

মরুভূমিতে পাঁচ বছর

আবদুল মুত্তালিবের অনাথ নাতি মহানবী (সা.) বনি সা দ গোত্রের মাঝে পাঁচ বছর অতিবাহিত করলেন। এ সময় তিনি ভালোভাবে বেড়ে ওঠেন। এ দীর্ঘ পাঁচ বছর হযরত হালীমাহ্ তাঁকে দু তিন বার মা আমেনার কাছে এনেছিলেন এবং শেষ বারে তিনি তাঁকে তাঁর মায়ের কাছে অর্পণ করেছিলেন।

দুগ্ধপানকাল শেষ হওয়ার পর বিবি হালীমাহ্ তাঁকে প্রথম বারের মতো পবিত্র মক্কায় এনেছিলেন। জোরাজুরি করে হালীমাহ্ তাঁকে পুনরায় বনি সা দ গোত্রে ফিরিয়ে নিয়ে যান। ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে জোর করার কারণ ছিল এই যে,এ অনাথ শিশুর উসিলায় তাঁর প্রভূত কল্যাণ ও বরকত হয়েছিল এবং পবিত্র মক্কা নগরীতে কলেরা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ায় হযরত আমেনাও হালীমাহর অনুরোধ গ্রহণ করেছিলেন।

একদল আবিসিনীয় আলেম একবার হিজাযে এসেছিলেন। তখন তাঁরা বনি সা দ গোত্রে শিশু মহানবীকে দেখতে পেলেন। তাঁরা দেখতে পেলেন যে,হযরত ঈসা (আ.)-এর পরবর্তী নবীর নিদর্শনাদি যা আসমানী গ্রন্থসমূহে বর্ণিত আছে তা এ শিশুটির সাথে মিলে যাচ্ছে। এ কারণে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন যে,যেভাবেই হোক তাঁরা এ শিশুকে অপহরণ করে আবিসিনিয়ায় নিয়ে যাবেন এবং এ হবে তাঁদের গৌরবের বিষয়। তাই এ সব ব্যক্তির হাত থেকে শিশু হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিরাপদ রাখার জন্য বিবি হালীমাহ্ তাঁকে দ্বিতীয় বারের মতো পবিত্র মক্কা নগরীতে নিয়ে আসেন।143

এ ব্যাপারটি মোটেও অসম্ভব ও কাল্পনিক নয়। কারণ পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট বক্তব্য অনুসারে মহানবীর নিদর্শনসমূহ ইঞ্জিল শরীফে বর্ণিত হয়েছে। সে সময়ের আসমানী গ্রন্থাদির বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিগণ যে পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থসমূহে বর্ণিত নিদর্শনসমূহের ভিত্তিতে উক্ত নিদর্শনসমূহের অধিকারী ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে পেরেছিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে :

) و إذا قال عيسى بن مريم يا بني إسرائيل إنّي رسول الله إليكم مصدّقا لما بين يديّ من التّوراة و مبشّرا برسول يأتي من بعدي اسمه أحمد فلمّا جاءهم بالبيّنات قالوا هذا سحر مبين(

“আর স্মরণ করুন তখনকার কথা যখন ঈসা ইবনে মরিয়ম (বনি ইসরাইলকে) বলেছিল : নিশ্চয়ই আমি তোমাদের কাছে মহান আল্লাহর রাসূল। আমার সামনে বিদ্যমান আসমানী গ্রন্থ তাওরাতের সত্যায়নকারী এবং আমি তোমাদেরকে আমার পরে যে রাসূল আগমন করবে তার সুসংবাদ প্রদান করছি। উক্ত রাসূলের নাম হবে আহমাদ। অতঃপর সেই (প্রতিশ্রুত) রাসূল তাদের কাছে (নিদর্শন ও মুজিযাসহ) আগমন করল। তখন তারা বলল : এ (এ সব মুজিযা ও পবিত্র কোরআন) তো স্পষ্ট যাদু।” (সূরা সাফ : 6)

এতৎসংক্রান্ত আরো বহু আয়াত রয়েছে যা থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে,মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চি হ্ন ও নিদর্শনাদি পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থসমূহে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং পূর্ববর্তী নবীদের উম্মতগণ এ ব্যাপারে অবগত ছিল।144

সপ্তম অধ্যায় : মাতৃক্রোড়ে প্রত্যাবর্তন

মহান আল্লাহ্ প্রত্যেক ব্যক্তিকে কোন না কোন দায়িত্ব পালনের জন্য সৃষ্টি করেছেন। কাউকে জ্ঞানার্জনের জন্য,কাউকে আবিষ্কার ও উদ্ভাবন করার জন্য,আবার কাউকে কর্ম ও পরিশ্রম করার জন্য,কোন কোন মানুষকে পরিচালনা ও নেতৃত্ব দান করার জন্য,আবার কিছু সংখ্যক মানুষকে শিক্ষা-প্রশিক্ষণ কার্য সম্পাদন করার জন্য এবং এভাবে তিনি বিভিন্ন মানুষকে জগতের বিভিন্ন কার্য সম্পাদন করার জন্য সৃষ্টি করেছেন।

আন্তরিক ও হৃদয়বান প্রশিক্ষকগণ যাঁরা ব্যক্তি ও সমাজের উন্নতি কামনা করেন তাঁরা কোন কাজের জন্য কোন ব্যক্তিকে নিযুক্ত করার আগেই তার অভিরুচি পরীক্ষা ও যাচাই-বাছাই করে থাকেন। আর যে ব্যক্তির যে কাজের প্রতি ঝোঁক এবং সামর্থ্য রয়েছে তাঁরা তাকে কেবল সেই কাজেরই দায়িত্ব দেন। কারণ এর অন্যথা হলে সমাজের দু টি ভয়ঙ্কর ক্ষতি হতে পারে :

ক. যে কাজ ঐ ব্যক্তি সম্পন্ন করতে পারত তা সে সম্পন্ন করতে পারবে না এবং

খ. যে কাজ সে আঞ্জাম দিয়েছে তা নিষ্ফল হতে বাধ্য।

বলা হয় যে,প্রতিটি রহস্যে একটি আনন্দ ও উদ্দীপনা আছে। ঐ ব্যক্তি সৌভাগ্যবান যে তার নিজ আনন্দ ও উদ্দীপনা উপলব্ধি করে।

এক শিক্ষক তাঁর এক অলস ছাত্রকে উপদেশ প্রদান করতেন এবং আলস্যের অনিষ্ট এবং যে সব ব্যক্তি জ্ঞানার্জন করেনি ও নিজেদের জীবনের বসন্তকাল অর্থাৎ যৌবনকে আলস্য ও প্রবৃত্তির পূজায় নিঃশেষ করেছে তাদের জীবনের করুণ পরিণতি সবিস্তারে ব্যাখ্যা করতেন। তিনি দেখতে পেলেন যে,ঐ ছাত্রটি তাঁর কথা শ্রবণরত অবস্থায় মাটির ওপর পড়ে থাকা এক টুকরা কয়লার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি হঠাৎ করে উপলব্ধি করতে পারলেন এ ছেলেটি লেখাপড়া শেখা ও জ্ঞানার্জন করার জন্য সৃষ্ট হয়নি;বরং স্রষ্টা তাকে চিত্রাঙ্কন করার মনোবৃত্তি ও রুচি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এ কারণেই উক্ত শিক্ষক ছাত্রটির পিতা-মাতাকে ডেকে বলেছিলেন, জ্ঞানার্জন ও লেখা-পড়া শেখার ব্যাপারে আপনাদের সন্তানের আগ্রহ অত্যন্ত কম,কিন্তু চিত্রাঙ্কন করার রুচি ও ঝোঁক তার মধ্যে বেশ ভালোভাবেই আছে এবং এ ব্যাপারে তার স্পৃহা ও আগ্রহ অত্যন্ত আশ্চর্যজনক।” শিক্ষকের পরামর্শ ছাত্রের পিতা-মাতার কাছে মনোঃপুত হলে অতি অল্প দিনের মধ্যে ছাত্রটি চিত্রাঙ্কন ও শিল্পকলা বেশ দ্রুত আয়ত্ত করে ফেলে এবং এ ক্ষেত্রে সে যুগশ্রেষ্ঠ শিল্পীতে পরিণত হয়।

শৈশবকাল শিশুদের অভিভাবকদের জন্য সন্তানদের রুচিবোধ ও সামর্থ্য পরীক্ষা এবং তাদের কাজ-কর্ম,আচার-আচরণ,চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা থেকে তাদের ব্যক্তিগত অভিরুচি সম্পর্কে ধারণা লাভ করার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। কারণ শিশুর চিন্তা-ভাবনা,কার্যকলাপ এবং মিষ্টি-মধুর কথা-বার্তা আসলে তার যোগ্যতা ও সামর্থ্যরেই আয়নাস্বরূপ। স্মর্তব্য যে,তার সামর্থ্য বিকাশের যাবতীয় পূর্বশর্ত ও ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে গেলে তা সর্বোত্তম পন্থায় কাজে লাগানো সম্ভব।

নবুওয়াত ঘোষণা পর্যন্ত হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনচরিত,আচার-আচরণ ও কার্যকলাপ তাঁর জীবন এবং তাঁর মহৎ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহের পটভূমি আমাদের মানসপটে চিত্রিত করে। তাঁর শৈশবের ইতিহাস অধ্যয়ন ও গভীর চিন্তা-ভাবনা করলে আমরা কেবল তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কেই অবগত হব না;বরং যে দিন তাঁর নবুওয়াত ঘোষিত হয়েছিল এবং তিনি নিজেকে সমাজের নেতা ও পথ-প্রদর্শক বলে ঘোষণা করেছিলেন সে দিন পর্যন্ত তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনেতিহাস তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদের অবগত করে এবং এ থেকে প্রতীয়মান হয়ে যায় যে,এ ব্যক্তি কোন্ কাজের জন্য সৃষ্ট হয়েছেন? আর তাঁর রিসালাত ও নেতৃত্বের দাবি কি তাঁর জীবন-কাহিনীর সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল? চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর জীবনেতিহাস,তাঁর আচার-আচরণ,চরিত্র,কর্ম,কথা এবং জনগণের সাথে দীর্ঘদিন মেলামেশা তাঁর সত্য নবী ও রাসূল হওয়ার বিষয়টি সমর্থন করে কি?

এ দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা এখানে মহানবীর জীবনের প্রথম দিনগুলো (শৈশব,কৈশোর ও যৌবন) সম্পর্কে আলোচনা করব।

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দাই-মা হযরত হালীমাহ্ তাঁকে পাঁচ বছর লালন-পালন করেছিলেন। এ সময় তিনি খাঁটি বলিষ্ঠ আরবী ভাষা রপ্ত করেছিলেন। সে কারণে তিনি পরবর্তীকালে গৌরববোধ করতেন। পাঁচ বছর পর হযরত হালীমাহ্ তাঁকে পবিত্র মক্কা নগরীতে নিয়ে আসেন। মক্কায় প্রত্যাবর্তন করার পর বেশ কিছুদিন তিনি মাতৃস্নেহ লাভ করেছিলেন এবং এ সময় তিনি দাদা আবদুল মুত্তালিবের তত্ত্বাবধান ও অভিভাবকত্বে লালিত-পালিত হন। হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মক্কাধিপতি হযরত আবদুল মুত্তালিবের কাছে পুত্র আবদুল্লাহর একমাত্র স্মৃতি।145

ইয়াসরিবে সফর

যে দিন আবদুল মুত্তালিবের পুত্রবধু (আমেনা) তাঁর যুবক স্বামীকে হারালেন সে দিন থেকে তিনি সর্বদা ইয়াসরিব গমন করে স্বামীর কবর যিয়ারত এবং সে সাথে ইয়াসরিবস্থ নিজ আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করার উপযুক্ত মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিলেন।

তিনি চিন্তা করে দেখলেন যে,একটি সঠিক সুযোগ এসে গেছে এবং তাঁর প্রাণাধিক পুত্রসন্তান (মুহাম্মদ)ও এখন বড় হয়েছে এবং সেও এ পথে তাঁর শোকের অংশীদার হতে পারবে। তাঁরা  উম্মে আইমানকে সাথে নিয়ে ইয়াসরিবের উদ্দেশে যাত্রা করেন এবং পূর্ণ এক মাস সেখানে অবস্থান করেন। শিশু মহানবীর জন্য এ সফর শোক ও বেদনা বয়ে এনেছিল। কারণ প্রথম বারের মতো তাঁর দৃষ্টি যে ঘরে তাঁর পিতা হযরত আবদুল্লাহ্ ইন্তেকাল করেছিলেন এবং চির নিদ্রায় শায়িত হয়েছিলেন সেই ঘরের দিকে নিবদ্ধ হয়েছিল।146

শিশু মহানবীর অন্তরে পিতৃশোক স্তিমিত হতে না হতেই হঠাৎ আরেকটি হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে গেল। এর ফলে শোক আরো বেড়ে গিয়েছিল। কারণ পবিত্র মক্কায় প্রত্যাবর্তনকালে মহানবীর স্নেহময়ী মা হযরত আমেনা পথিমধ্যে আবওয়া নামক স্থানে ইন্তেকাল করেন।147

এ ঘটনা বনি হাশিম ও আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে শিশু মহানবীকে স্নেহভাজন করেছিল এবং তাঁর প্রতি তাদের সহানুভূতি ও মমতাবোধের উদ্ভব ঘটিয়েছিল। তিনি ছিলেন হযরত আবদুল্লাহ্ ও হযরত আমেনার পুষ্পোদ্যানের একমাত্র পুষ্প-তাঁদের পুণ্যস্মৃতি। এ কারণেই শিশু মহানবী দাদা হযরত আবদুল মুত্তালিবের অশেষ ভালোবাসা ও স্নেহ পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন পিতামহের প্রাণাধিক প্রিয় নাতি। আবদুল মুত্তালিব তাঁকে তাঁর সকল সন্তান অপেক্ষা বেশি ভালোবাসতেন। তিনি সকলের ওপর তাঁকেই অগ্রাধিকার প্রদান করতেন।

কাবার চারদিকে কুরাইশপ্রধান আবদুল মুত্তালিবের জন্য কার্পেট বিছানো হতো। কুরাইশ নেতৃবৃন্দ এবং তাঁর সন্তানগণ তাঁর কার্পেটের চারপাশে বসত। আবদুল্লাহর কথা স্মরণ হলেই তিনি (আবদুল মুত্তালিব) যে কার্পেটের ওপর উপবিষ্ট থাকতেন সে কার্পেটে প্রয়াত পুত্র আবদুল্লাহর একমাত্র স্মৃতি-চি হ্ন শিশু হযরত মুহাম্মদকে এনে তাঁর পাশে বসানোর নির্দেশ দিতেন।148

পবিত্র কোরআনের সূরা দোহায় মহানবী (সা.)-এর শৈশব ও ইয়াতিম অবস্থার কথা উল্লিখিত হয়েছে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ্ বলেছেন,

) أ لم يجدك يتيما فآوى(

“তিনি কি আপনাকে ইয়াতিম পাওয়ার পর (প্রথমে পিতামহ আবদুল মুত্তালিব ও পরে পিতৃব্য হযরত আবু তালিবের) আশ্রয় দেন নি? (সূরা দোহা : 6)

মহানবীর ইয়াতিম হওয়ার অন্তর্নিহিত মূল রহস্য আমাদের কাছে খুব একটা স্পষ্ট নয়। তবে আমরা এতটুকু জানি যে,ঘটনাসমূহ যা সংঘটিত হয়েছে তা প্রজ্ঞাবিহীন নয়। এতদসত্ত্বেও আমরা ধারণা করতে পারি যে,মহান আল্লাহ্ চেয়েছিলেন মানব জাতি ও বিশ্বের মহান নেতা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সকল দায়িত্বভার গ্রহণ এবং নেতৃত্বদান শুরু করার আগেই যেন জীবনের সুখ,শান্তি,মাধুর্য ও তিক্ততার স্বাদ আস্বাদন করেন এবং জীবনের উত্থান-পতনের সাথে পরিচিত হন। এর ফলে তিনি মহান আত্মা এবং অত্যন্ত ধৈর্যশীল হৃদয়ের অধিকারী হতে পারবেন,দুঃখ-কষ্ট ও বিপদাপদ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা অর্জন এবং নিজেকে কঠিন বিপদাপদ,কষ্ট এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য প্রস্তুত করতে পারবেন।

মহান আল্লাহ্ চেয়েছিলেন যেন কারও আনুগত্য তাঁর স্কন্ধের ওপর না থাকে;আর তিনি জন্মগ্রহণের পরপর অর্থাৎ জীবনের শুরু থেকেই যেন স্বাধীন থাকেন। তিনি যেন আত্মগঠনে নিয়োজিত মনীষীদের ন্যায় তাঁর আত্মিক-আধ্যাত্মিক উৎকর্ষের ভিত্তিসমূহ নিজ হাতে গঠন করতে সক্ষম হন। যার ফলে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে,তাঁর প্রতিভা আসলে সাধারণ মানবীয় প্রতিভা নয় এবং তাঁর ভাগ্য নির্মাণের ক্ষেত্রে তাঁর পিতা-মাতার কোন ভূমিকাই ছিল না। তাঁর সকল মর্যাদা আসলে ওহীর উৎসমূল থেকেই উৎসারিত হয়েছিল।

আবদুল মুত্তালিবের মৃত্যু

হৃদয়বিদারক ঘটনাসমূহ সব সময় মানব জীবনের পথ-পরিক্রমণে আবির্ভূত হয়। সেগুলো সমুদ্রের পর্বত প্রমাণ উত্থাল তরঙ্গমালার ন্যায় একের পর এক উত্থিত হয়ে মানুষের জীবন-তরীকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে এবং মানব মনের ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানে।

মহানবী (সা.)-এর অন্তঃকরণে (মায়ের মৃত্যুতে) শোক ও দুঃখ তখনও বিরাজ করছিল ঠিক এমতাবস্থায় তৃতীয় বারের মতো এক বড় বিপদ তাঁর ওপর আপতিত হয়েছিল। তাঁর জীবনের অষ্টম বসন্তকাল অতিবাহিত হতে না হতেই অভিভাবক ও পিতামহ হযরত আবদুল মুত্তালিবকে তিনি হারিয়েছিলেন। আবদুল মুত্তালিবের মৃত্যু তাঁর কোমল আত্মার ওপর এতটা গভীর দাগ কেটেছিল যে,দাদা আবদুল মুত্তালিব যে দিন মৃত্যুবরণ করেছিলেন সে দিন তিনি সমাধিস্থলে তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা পর্যন্ত অশ্রুপাত করেছিলেন এবং তিনি কখনই পিতামহ আবদুল মুত্তালিবকে ভুলেন নি।149


15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53

54

55

56

57

58

59

60

61