চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড4%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 106819 / ডাউনলোড: 9707
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

11

হাবাশা থেকে প্রত্যাবর্তন

পূর্বে আমরা উল্লেখ করেছিলাম যে,হাবাশায় হিজরতকারী মুসলমানদের প্রথম দলটি কুরাইশরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে’-এ মর্মে একটি মিথ্যা সংবাদ শুনে হাবাশা ত্যাগ করে হিজাযে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। কিন্তু হিজাযে প্রবেশকালে তাঁরা জানতে পারলেন যে,ঐ সংবাদটি মিথ্যা ছিল;বরং মুসলমানদের প্রতি কুরাইশদের কঠিন-অমানবিক আচরণ ও চাপ পূর্বের মতো এখনও বহাল আছে। তাই তাঁদের মধ্য থেকে অধিকাংশ হাবাশায় ফিরে গেলেন এবং খুব মুষ্টিমেয় কয়েকজন গোপনে অথবা নেতৃত্বস্থানীয় কুরাইশ ব্যক্তিদের আশ্রয়াধীনে মক্কায় প্রবেশ করলেন।

উসমান ইবনে মাযউন,ওয়ালীদ ইবনে মুগীরার আশ্র্রয়ে মক্কায় প্রবেশ করলেন;আর এ কারণে তিনি শত্রুদের নির্যাতন থেকে নিরাপদ ছিলেন। কিন্তু তিনি নিজ চোখে দেখতে পেতেন যে,অন্যান্য মুসলমান কুরাইশদের দ্বারা অত্যাচারিত ও নির্যাতিত হচ্ছে। এ ধরনের বৈষম্য হযরত উসমানের মনকে খুবই ব্যথিত করল। তিনি ওয়ালীদকে অনুরোধ করলেন যেন সে একটি সাধারণ সমাবেশে ঘোষণা দেয় যে,এরপর থেকে মাযউন তনয় উসমান তার তত্ত্বাবধান ও আশ্রয়ে নেই। এ কথা বলার উদ্দেশ্য ছিল এটি যে,তিনি যেন অন্যান্য মুসলমানের সাথে তাঁদের দুঃখ-কষ্টের অংশীদার হন। তাই ওয়ালীদ মসজিদুল হারামে ঘোষণা করল যে,এখন থেকে উসমান ইবনে মাযউন তার আশ্রয়ে নেই। আর তিনিও (উসমান) বললেন, আমিও তা সত্যায়ন করছি। আর ঠিক তখনই আরবের প্রসিদ্ধ বাগ্মী-কবি লাবীদ মসজিদুল হারামে প্রবেশ করে কুরাইশদের বৃহৎ সমাবেশে তার প্রসিদ্ধ কাসীদা আবৃত্তি শুরু করল। যখন লাবীদ বলল,

ألا كلّ شيء ما خلا الله باطل জেনে রাখ,মহান আল্লাহ্ ব্যতীত সকল বস্তু অমূলক তখন উসমান ইবনে মাযউন বললেন,صدّقت তুমি সত্য বলেছ। লাবীদ দ্বিতীয় পঙ্ক্তি পড়লেন :

و كلّ نعيم لا محالة زائل সকল নেয়ামতই ক্ষণস্থায়ী।’ উসমান ইবনে মাযউন এ কথা শুনে খুবই উত্তেজিত হয়ে বললেন, তুমি ভুল করছ। পরকালের নেয়ামতসমূহ স্থায়ী। উসমানের এ প্রতিবাদ লাবীদের কাছে খুবই অসহনীয় বোধ হলো। তাই সে বলল, হে কুরাইশ গোত্র! তোমাদের অবস্থা দেখছি পরিবর্তিত হয়ে গেছে;এ লোকটি কে? উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি বলল, এ বোকা লোকটি আমাদের ধর্ম থেকে বের হয়ে তার নিজের মতো এক ব্যক্তির অনুসরণ করছে। তার কথায় কান দিও না। এরপর সে উঠে দাঁড়িয়ে উসমান ইবনে মাযউনের মুখে জোরে একটি চড় মারল। আঘাতে তাঁর মুখমণ্ডল কালো হয়ে গেল। ওয়ালীদ ইবনে মুগীরাহ্ তখন উসমান ইবনে মাযউনকে লক্ষ্য করে বলল, উসমান! যদি তুমি আমার আশ্রিত থাকতে তাহলে কখনই কেউ তোমার অনিষ্ট সাধন করতে পারত না। তখন তিনি বললেন, আমি মহান আল্লাহর আশ্রয়ে আছি। ওয়ালীদ তখন পুনরায় বলল, আবারও আমি তোমাকে আশ্রয় দিতে প্রস্তুত। তখন উসমান বললেন, আমি কখনই তা গ্রহণ করব না। ২৯৭

মক্কা নগরীতে খ্রিষ্টানদের অনুসন্ধানী দল

মুসলমান মুহাজিরদের প্রচার কার্যের ফলে হাবাশার খ্রিষ্টান ধর্মযাজকদের কেন্দ্রীয় সংস্থার পক্ষ থেকে ২০ সদস্য বিশিষ্ট একটি অনুসন্ধানী দল পবিত্র মক্কা নগরী আগমন করে মসজিদুল হারামে মহানবী (সা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করলেন এবং তাঁর কাছে বেশ কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন। মহানবী (সা.) তাঁদের প্রশ্নগুলোর উত্তর দিলেন এবং তাঁদেরকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার আহবান জানালেন। তিনি তাঁদেরকে পবিত্র কোরআনের কতিপয় আয়াত তিলাওয়াত করে শুনালেন।

পবিত্র কোরআনের আয়াতসমূহ তাঁদের মন-মানসিকতার ওপর এতটা প্রভাব বিস্তার করেছিল যে,তাঁরা তাঁদের নয়নাশ্রু থামিয়ে রাখতে পারলেন না। তাঁদের সবাই প্রতিশ্রুত নবীর যে সব নিদর্শন ইঞ্জিল শরীফে পাঠ করেছিলেন সেগুলোর সব ক টি তাঁর মধ্যে বিদ্যমান দেখতে পেলেন।

এ অনুসন্ধানী দলের আগমন ও সাক্ষাৎ আবু জাহলের জন্য খুবই অসহনীয় ও যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার ছিল। সে সম্পূর্ণ উগ্র মেজাজ সহকারে বলল, হাবাশার জনগণ আপনাদেরকে একটি অনুসন্ধানী প্রতিনিধি দল হিসাবে পবিত্র মক্কায় প্রেরণ করেছেন,এটি তো নির্ধারিত ছিল না যে,আপনারা আপনাদের পূর্বপুরুষদের ধর্ম ত্যাগ করবেন। আপনাদের চেয়ে অধিকতর বোকা জনগণ এ ধরণীর বুকে আছে কি না তা আমি ভাবতেই পারছি না।”

মক্কার ফিরআউন আবু জাহল যে উদীয়মান সূর্যের রশ্মি প্রতিহত করতে চেয়েছিল তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের জবাবে হাবাশার অনুসন্ধানী দল অত্যন্ত ধীর ও শান্ত কণ্ঠে বললেন, আমরা আমাদের ধর্মের ওপর এবং আপনারা আপনাদের ধর্মের ওপর বহাল থাকুন,তবে আমরা যে জিনিস বা বিষয় আমাদের জন্য কল্যাণকর বলে চি হ্নিত করব তা আমরা কখনই উপেক্ষা করব না। আর তাঁরা এ কথা বলে আবু জাহলের সাথে আর বিতর্কে জড়ালেন না।২৯৮

কুরাইশদের প্রেরিত প্রতিনিধিদল

হাবাশার জনগণের পক্ষ থেকে প্রেরিত অনুসন্ধানী দলটি কুরাইশদের জাগরণের কারণ হয়েছিল। তাই তারাও অনুসন্ধান ও যাচাই-বাছাই করার জন্য হারিস ইবনে নাসর,উকবা ইবনে আবি মুয়ীত প্রমুখ ব্যক্তিগণকে কুরাইশদের তরফ থেকে প্রতিনিধি হিসাবে ইয়াসরিব প্রেরণ করল। উদ্দেশ্য ইয়াসরিব গমন করে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর রিসালাত ও ইসলাম ধর্ম প্রচারের বিষয়টি নিয়ে ইয়াহুদী পণ্ডিতদের সাথে আলোচনা করা। ইয়াহুদী পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ প্রেরিত প্রতিনিধি দলকে বলেছিলেন, নিম্নোক্ত বিষয়গুলো প্রসঙ্গে মুহাম্মদকে জিজ্ঞাসা করবে :

১. আত্মার স্বরূপ (হাকীকত) কি?

২. পূর্ববর্তী যুগে যে সব যুবক জনগণের কাছ থেকে আত্মগোপন করেছিলেন তাঁদের (আসহাব-ই কাহাফ) কাহিনী।

৩. যে ব্যক্তি পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিমে ভ্রমণ করেছিলেন তাঁর (যূলকারনাইন) জীবনী।

মুহাম্মদ যদি এ তিনটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে সক্ষম হন তাহলে আপনারা নিশ্চিত বিশ্বাস করবেন যে,সে মহান আল্লাহর মনোনীত। আর এর অন্যথা হলে বুঝতে হবে যে,সে মিথ্যাবাদী। তখন তাকে যত শীঘ্র সম্ভব হত্যা করতে হবে।”

প্রেরিত কুরাইশ প্রতিনিধিগণ অত্যন্ত আনন্দের সাথে মক্কায় ফিরে এসে ঐ তিনটি প্রশ্ন সম্পর্কে কুরাইশদেরকে অবহিত করল। কুরাইশগণ একটি সভার আয়োজন করে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সেখানে আসার আমন্ত্রণ জানাল। মহানবী (সা.) তাদেরকে বললেন, আমি এ তিনটি প্রশ্নের ব্যাপারে ওহীর অপেক্ষা করছি। ২৯৯ মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী অবতীর্ণ হলো। আত্মা বিষয়ক তাদের প্রশ্নের উত্তর সূরা ইসরার ৮৫নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। আর তাদের অপর দু টি প্রশ্নের উত্তর সূরা কাহাফে ৯-২৮ নং এবং ৮৩-৯৮ নং আয়াতসমূহে বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। এ তিনটি বিষয়ে মহানবী (সা.)-এর উত্তরের বিস্তারিত বিবরণ তাফসীর গ্রন্থগুলোতে বিদ্যমান রয়েছে।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ না করে পারছি না। আর তা হলো : প্রশ্নের মধ্যে আত্মার (روح ) অর্থ মানবীয় আত্মা’ নয়,বরং যেহেতু এ সব প্রশ্নের উপস্থাপকরা ছিল ইয়াহুদী এবং রুহুল আমীনের সাথে তাদের সম্পর্ক ভালো ছিল না তাই প্রশ্নে উত্থাপিতروح (রূহ) বলতে হযরত জিবরাইল আমীনকেই বুঝানো হয়েছে।

এতৎসংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনা মানশুর-ই জভীদ’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ২০৪-২১৬ পৃষ্ঠাসমূহে বর্ণিত হয়েছে। আগ্রহী পাঠকবর্গ তা অধ্যয়ন করতে পারেন।

অষ্টাদশ অধ্যায় : মরিচাপড়া অস্ত্রশস্ত্র

কুরাইশ নেতৃবর্গ একত্ববাদী ধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য নিজেদের সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত করছিল। শুরুতে তারা ধনসম্পদ ও নেতৃত্বের প্রলোভন দিয়ে মহানবী (সা.)-কে তাঁর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা থেকে বিরত রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের এ প্রচেষ্টা নিষ্ফল ও ব্যর্থ হয়েছিল। তারা মহান আল্লাহর শপথ,যদি আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চন্দ্রও স্থাপন কর (অর্থাৎ সমগ্র পৃথিবী আমার কর্তৃত্বের মুঠোয় দিয়ে দাও) তবুও এ কাজ (ইসলামের প্রচার) থেকে বিরত থাকব না”-ঐ সংগ্রামী মহাপুরুষের এ প্রসিদ্ধ বাক্যের মুখোমুখি হলো। এরপর তারা তাঁর সঙ্গীসাথীদের হেয় প্রতিপন্ন করতে তাঁদের ওপর নির্যাতন চালাতে লাগল। আর তারা মহানবী (সা.) এবং তাঁর সাহাবীদেরকে একটি মুহূর্তের জন্যও কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকত না। কিন্তু তাঁর ও তাঁর নিষ্ঠাবান সঙ্গী-সাথীদের দৃঢ়তা,সাহসিকতার কারণে এ ক্ষেত্রেও বিজয়ী হয়েছিলেন। এমনকি ইসলাম ধর্মে তাঁদের অবিচল থাকার জন্য তাঁরা নিজেদের বসত-বাটি,দেশ ও জন্মভূমি ত্যাগ করে হাবাশায় হিজরত পর্যন্ত করেছিলেন এবং এভাবে তাঁরা সত্য ধর্ম ইসলাম প্রচার করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছিলেন। তাওহীদের পবিত্র বৃক্ষের মূলোৎপাটন করার জন্য কুরাইশ নেতৃবর্গের বিভিন্ন পরিকল্পনা তখনও সমাপ্ত হয় নি,বরং এবার তারা এগুলোর চাইতেও আরো ধারালো হাতিয়ার ব্যবহার করল।

আর এই হাতিয়ারটি ছিল মহানবী (সা.)-এর বিরুদ্ধে প্রচারণা। কারণ এটি ঠিক যে,যারা মক্কায় বসবাস করত,নির্যাতন করে ও অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদেরকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখা যেত;কিন্তু পবিত্র কাবায় যিয়ারতকারিগণ যারা নিষিদ্ধ মাসগুলোতে পবিত্র মক্কা নগরীতে আসত তারা শান্ত ও নিরাপদ পরিবেশের মধ্যে মহানবীর সাথে দেখা করত এবং তাঁর ধর্ম প্রচার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যেত। আর তারা যদি তাঁর ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন নাও করত তবুও তারা তাদের নিজেদের ধর্মের (মূর্তিপূজা ও শিরক) ব্যাপারে শিথিল ও সন্দিহান হয়ে যেত। নিজেদের জন্মভূমিতে প্রত্যাবর্তন করার পর তারা মহানবীর বার্তাবাহক হয়ে যেত এবং মহানবীর আবির্ভাবের সুসংবাদ প্রদান করত। আর এভাবে মহানবী (সা.) ও ইসলাম ধর্মের নাম আরব উপদ্বীপের সকল স্থানে পৌঁছে যেত। আর এটি মূর্তিপূজারীদের ওপর একটি বিরাট আঘাত এবং তাওহীদ ও ইসলাম ধর্মের প্রসার ও প্রচারের ক্ষেত্রে একটি কার্যকর কারণ বলে বিবেচিত হতো।

কুরাইশ নেতৃবর্গ আরো একটি ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমে হাত দেয়। তারা এর দ্বারা ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসারের পথ বন্ধ করতে এবং মহানবী (সা.)-এর সাথে আরব জাতির সম্পর্কচ্ছেদ করতে চেয়েছিল।

আমরা এখন কুরাইশদের সে সকল ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনা ও কার্যক্রম পাঠকবর্গের সামনে তুলে ধরব।

১. ভিত্তিহীন অপবাদ

কোন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব তার প্রতি তার শত্রুদের গালিগালাজ,কটুক্তি,অপবাদ আরোপ ও অন্যায় আচরণ দ্বারা মূল্যায়ন ও যাচাই করা যেতে পারে। শত্রুরা সর্বদা (জনগণকে) জনমতকে বিভ্রান্ত করার জন্য প্রতিপক্ষকে এমনভাবে দোষী সাব্যস্ত করে যে,এর ফলে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বিষয়াদি প্রচার করে প্রতিপক্ষের মান-মর্যাদা ধ্বংস অথবা ন্যূনতম পর্যায়ে হলেও যতটা সম্ভব তার মর্যাদা ও সম্মান খাটো করতে চায়। জ্ঞানী শত্রু নিজ প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে এমন সব বিষয় সম্পর্কযুক্ত করার চেষ্টা করে যে,অন্তত সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণী সেগুলো বিশ্বাস করবে অথবা সেগুলোর সত্য-মিথ্যা হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করবে। যে সব সম্পর্ক ও সংশ্লিষ্টতা কখনই প্রতিপক্ষের সাথে খাপ খায় না এবং তার মন-মানসিকতা,মানসিক শক্তি এবং প্রসিদ্ধ কার্যকলাপসমূহের সাথে কোন বাস্তব সম্পর্ক নেই শত্রুরা সেই সব বিষয় তার ওপর আরোপ করে না;কারণ এমতাবস্থায় এর পরিণতি হবে উল্টো ও অনাকাঙ্ক্ষিত।

এতৎসংক্রান্ত গবেষক ঐতিহাসিক এ সব মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অপবাদ আরোপের পেছনে প্রতিপক্ষের প্রকৃত চেহারাটিই দেখতে পান,এমনকি শত্রুর দৃষ্টিকোণ থেকেই তাঁর সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদা এবং তাঁর মানসিকতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হন। কারণ কোন বেপরোয়া শত্রু-যে অপবাদ তার নিজের স্বার্থানুকূলে রয়েছে-প্রতিপক্ষের ওপর তা আরোপ করার ব্যাপারে চেষ্টার কোন ত্রুটি করবে না। আর সে প্রচারণার তীক্ষ্ণ অস্ত্র যতদূর পর্যন্ত তার চিন্তা-ভাবনা,উপলব্ধি ও সঠিক সুযোগ সংক্রান্ত জ্ঞান তাকে অনুমতি দেবে ততদূর সে তা সর্বোচ্চ মাত্রায় সদ্ব্যবহার করবেই। অতঃপর শত্রু যদি তার প্রসঙ্গে কোন অশালীন উক্তি ও অপবাদ আরোপ না করে তা আসলে এ দৃষ্টিকোণ থেকে যে,তার ব্যক্তিসত্তা আসলে এসব অবৈধ-অনৈতিক চারিত্রিক দোষ ও সম্পর্কের দ্বারাই সজ্জিত;আর সমাজও তার কথা ও আদর্শের খরিদ্দার নয়।

আমরা যদি ইসলামের ইতিহাসের পাতা উল্টাই তাহলে দেখতে পাব যে,কুরাইশগণ অস্বাভাবিক ধরনের শত্রুতা ও জিঘাংসার মনোবৃত্তির অধিকারী হয়েও যেমন করেই হোক না কেন নব্য প্রতিষ্ঠিত ইসলাম ধর্মের ধ্বংস সাধন এবং এ ধর্মের প্রবর্তনকারীর ব্যক্তিত্ব ও মান-মর্যাদা ক্ষুন্ন করতে চাইত এতদ্সত্ত্বেও তারা পূর্ণরূপে এ হাতিয়ার বা অস্ত্র (অর্থাৎ প্রচারণা) ব্যবহার করতে সক্ষম হয় নি। তারা নিজেরাই চিন্তা করে কূল পেত না যে,তারা কি বলবে? তারা কি তাঁকে অর্থ কেলেঙ্কারী ও আত্মসাতের অভিযোগে অভিযুক্ত করবে,অথচ তখনও তাদের (কুরাইশদের) কারো কারো ধন-সম্পদ তাঁর ঘরেই আমানত হিসাবে গচ্ছিত ছিল এবং তাঁর চল্লিশ বছরের জীবন আপামর জনতার চোখে তাঁকে আল আমীন’ বলে প্রতীয়মান ও প্রতিষ্ঠিত করেছিল?

তারা কি তাঁকে কামুক ইন্দ্রিয়পরায়ণ’ বলে অভিযুক্ত করবে? তারা কিভাবে এ কথা মুখে উচ্চারণ করবে? কারণ তিনি কিছুটা হলেও তাঁর যৌবনকাল একজন বয়স্কা রমণীর সাথে শুরু করেছিলেন এবং ঐ দিন পর্যন্তও যখন তাঁর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালনোর জন্য কুরাইশদের পরামর্শ সভার আয়োজন করা হয়েছিল তিনি ঐ স্ত্রী নিয়েই বৈবাহিক জীবনযাপন করে যাচ্ছিলেন। অবশেষে তারা চিন্তা-ভাবনা করল যে,তারা কি বলবে যা মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে ভালোভাবে খাপ খায় এবং যার ফলে ন্যূনতম হলেও জনগণ তা শতকরা এক ভাগ সত্য হতে পারে বলে ধারণা করবে। অবশেষে দারুন নাদওয়ার নেতারা কিভাবে এ ধরনের হাতিয়ার ব্যবহার করবে সে ব্যাপারে বিভ্রান্ত ছিল। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে,তারা এ ব্যাপারটি একজন কুরাইশ নেতার কাছে উত্থাপন করে এ ব্যাপারে তার অভিমতটিই বাস্তবায়ন করবে। সভা অনুষ্ঠিত হলো। ওয়ালীদ কুরাইশদের দিকে মুখ করে বলল, হজ্বের দিনগুলো অতি নিকটে। আর এ দিনগুলোতে হজ্বের করণীয় ও আমলসমূহ আঞ্জাম দেয়ার জন্য (বিভিন্ন স্থান থেকে) জনগণ শহরে সমবেত হবে। আর মুহাম্মদও হজ্ব মওসূমের স্বাধীনতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে তার নিজ ধর্ম প্রচার কাজে আত্মনিয়োগ করবে। কতই না উত্তম হবে যদি কুরাইশ নেতৃবর্গ তার ও তার নতুন ধর্মের ব্যাপারে তাদের চূড়ান্ত অভিমত ব্যক্ত করেন এবং তার ব্যাপারে একটি ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেন! কারণ তাদের মধ্যকার মতবিরোধ তাদের বক্তব্য ও অভিমতকে অকার্যকর করে দেবে।”

আরবদের প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিটি চিন্তায় ডুবে গেল এবং বলতে লাগল, আমাদের কি বলা উচিত? একজন বলল, তাকে (মুহাম্মদকে) আমরা গণক বলতে পারি। ৩০০ সে এ ব্যক্তির বক্তব্য অপছন্দ করে বলল, মুহাম্মদ যা কিছু বলে তা জ্যোতিষী ও গণকদের বাণীর মতো নয়। আরেকজন প্রস্তাব দিয়ে বলল, আমরা তাকে পাগল বলতে পারি। এ প্রস্তাবটিও ওয়ালীদের পক্ষ থেকে প্রত্যাখ্যাত হলো এবং সে বলল, তার মধ্যে পাগলামীর লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। অনেক আলোচনা-পর্যালোচনার পর সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হলো যে,তারা তাঁকে যাদুকর’ বলে অভিহিত করবে। কারণ তাঁর কথায় যাদু আছে। আর এর দলিল হচ্ছে এই যে,তিনি তাঁর কোরআনের মাধ্যমে মক্কাবাসীদের মধ্যে অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টি করেছেন৩০১ ,অথচ এর আগে মক্কাবাসীদের মধ্যকার ঐক্য প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়েছিল।

সূরা মুদ্দাসসিরের তাফসীর প্রসঙ্গে মুফাসসিরগণ এ বিষয়টি আরেকভাবেও বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন, যখন ওয়ালীদ সূরা ফুসসিলাতের কয়েকটি আয়াত মহানবী (সা.)-এর কাছ থেকে শুনল তখন সে অত্যন্ত প্রভাবিত হলো এবং তার শরীরের লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেল। সে বাড়ির দিকে ছুটে পালাল এবং বাড়ি থেকে বাইরে বের হলো না। কুরাইশরা তাকে মস্করা করে বলেছিল : ওয়ালীদ মুহাম্মদের ধর্ম গ্রহণ করেছে। তারা দলবেঁধে ওয়ালীদের বাড়িতে গেল এবং তার কাছে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র কোরআনের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইল। উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের মধ্য থেকে যে কেউই উল্লিখিত বিষয়াদির কোন একটি উল্লেখ করেছিল ওয়ালীদ সেটিই প্রত্যাখ্যান করছিল। অবশেষে সে অভিমত ব্যক্ত করে বলল, তাদের মধ্যে সে যে অনৈক্য ও বিভেদ ঘটিয়েছে সে কারণেই তাকে তোমরা যাদুকর বলবে এবং বলবে : তার কণ্ঠে যাদু আছে।”

মুফাসসিরগণ বিশ্বাস করেন যে,নিম্নলিখিত আয়াতগুলো তার (ওয়ালীদ) ব্যাপারেই অবতীর্ণ হয়েছে :

) ذَرني ومَنْ خلقْتُ وحيداً وجعلْتُ له مالاً ممْدوداً(

“যেহেতু আমি তাকে অনন্য করে সৃষ্টি করেছি এবং তাকে প্রভূত ধন-সম্পদ দিয়েছি সেহেতু আমাকে ছেড়ে দাও ...। (সূরা মুদ্দাসসির,৫০ নং আয়াত পর্যন্ত)

সে পবিত্র কোরআন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা ও মূল্যায়ন করল। ধ্বংস হয়ে যাক সে কিভাবেই বা মূল্যায়ন করবে,পুনশ্চঃ সে নিহত হোক সে কিভাবেই মূল্যায়ন করবে;সে ভ্রূকুটি করল এবং মুখ পেচিয়ে বলল এটি স্রেফ একটি যাদু যা সে বর্ণনা করে।৩০২

ষষ্ঠ অধ্যায় : মহানবী (সা.)-এর শৈশবকাল

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে,ইসলাম ও মুসলমানদের মহান নেতা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সমগ্র জীবনটাই-শৈশবের শুরু থেকে যে দিন তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে নবুওয়াতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন সেই দিন পর্যন্ত আশ্চর্যজনক ঘটনাসমূহের সমন্বয়ে গঠিত। আর এ সব আশ্চর্যজনক ঘটনা অলৌকিকত্বের প্রমাণ বহন করে। এ সব কিছু থেকে প্রতীয়মান হয় যে,মহানবী (সা.)-এর জীবন ছিল একটি অসাধারণ জীবন।

মহানবীর এ সব অলৌকিক ঘটনা ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে সীরাত রচয়িতাগণ দু ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছেন :

1. বস্তুবাদী কতিপয় প্রাচ্যবিদের দৃষ্টিভঙ্গি : বস্তুবাদী বৈজ্ঞানিকগণ বস্তুবাদী ভূয়োদর্শন পোষণ করেন এবং অস্তিত্বকে কেবল বস্তুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ বলে মনে করেন। তাঁরা সকল প্রপঞ্চ ও ঘটনাকে বস্তুগত প্রপঞ্চ ও ঘটনা বলে বিশ্বাস করেন এবং প্রতিটি ঘটনা ও প্রপঞ্চেরই প্রাকৃতিক (বস্তুগত) কারণ নির্ধারণ করেন। তাঁরা এ সব অলৌকিক ঘটনা ও প্রপঞ্চের প্রতি মোটেও গুরুত্ব দেন না। কারণ বস্তুবাদী নীতিমালা অনুসারে এ ধরনের ঘটনা ও প্রপঞ্চের উৎপত্তি অসম্ভব;আর ইতিহাসের পাতায় পাতায় এ ধরনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেই তাঁরা এগুলোকে ধর্মের অনুসারীদের কল্পনা এবং ভক্তি-ভালোবাসাপ্রসূত বলে বিবেচনা করেন।

একদল প্রাচ্যবিদ যাঁরা নিজেদেরকে বাহ্যত তাওহীদবাদী ও খোদায় বিশ্বাসী বলে অভিহিত করেন এবং অতি প্রাকৃতিক (আধ্যাত্মিক) জগতের অস্তিত্বেও বিশ্বাস করেন,কিন্তু তাঁদের ঈমানী দুর্বলতা ও জ্ঞানগত গর্ব এবং তাঁদের চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণার ওপর বস্তুবাদিতার প্রাধান্য থাকার কারণে ঘটনা বিশ্লেষণ করার সময় তাঁরা বস্তুবাদী মূলনীতিসমূহের অনুসরণ করেন। আমরা বারবার তাঁদের বক্তব্য ও আলোচনার মধ্যে এ সব বাক্য লক্ষ্য করেছি যে, নবুওয়াত আসলে এক ধরনের মানবীয় প্রতিভা , নবী হচ্ছেন একজন সামাজিক প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব যিনি তাঁর নিজের আলোকিত চিন্তাধারা দিয়ে মানব জীবনের গতিধারা ও পথকে আলোকিত করেন’...।

প্রাচ্যবিদদের এ ধরনের বক্তব্য আসলে বস্তুবাদী চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উদ্ভূত যা সকল ধর্মকে মানব চিন্তা ও কল্পনাপ্রসূত বলে বিবেচনা করে। অথচ আস্তিক জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তিগণ সাধারণ নবুওয়াত সংক্রান্ত আলোচনায় প্রমাণ করেছেন যে,নবুওয়াত মহান আল্লাহর ঐশী দান ও অনুগ্রহ যা সকল আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণা (ইলহাম) ও যোগাযোগের উৎস। মহান নবীদের পরিকল্পনাসমূহ,তাঁদের চিন্তা,ধারণা ও প্রতিভা প্রসূত নয়;বরং অবস্তুগত আধ্যাত্মিকজগৎ থেকে প্রেরিত ইলহাম ও প্রত্যাদেশ ব্যতীত তাঁদের এ সব পরিকল্পনা ও কর্মসূচীর আর কোন উৎসমূল নেই। কিন্তু যখন খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী প্রাচ্যবিদগণ বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে এ সব বিষয়ে দৃক্পাত করেন এবং সমস্ত ঘটনা ও প্রপঞ্চকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অভিজ্ঞতালব্ধ বৈজ্ঞানিক মূলনীতি ও সূত্রের আলোকে পরিমাপ করেন তখন যে সব ঘটনা ও প্রপঞ্চের অলৌকিকত্বের দিক রয়েছে অর্থাৎ মুজিযা সেগুলোর কঠোর সমালোচনা করেন এবং মূল থেকে সেগুলো অস্বীকার করেন।

2 . স্রষ্টা পূজারিগণ : ঐ সব ব্যক্তি মহান আল্লাহর উপাসনাকারী যারা বিশ্বাস করে যে,বস্তুজগতের বৈশিষ্ট্য ও চি হ্নসমূহ অন্য জগতের পরিচালনাধীন এবং অতি প্রাকৃতিক অবস্তুগতজগৎ এ প্রাকৃতিক ও বস্তুগত বিশ্বের সার্বিক শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। অন্যভাবে বলা যায়,বস্তুজগৎ স্বাধীন ও সার্বভৌম নয়। সকল ব্যবস্থা এবং এগুলোর প্রাকৃতিক ও বৈজ্ঞানিক সূত্র উচ্চতর অস্তিত্বময় সত্তাসমূহ,বিশেষ করে মহান আল্লাহর ইচ্ছার সৃষ্টি। মহান আল্লাহ্ বস্তুর অস্তিত্ব প্রদান করেছেন। তিনি বস্তুর বিভিন্ন অংশের মাঝে কতগুলো সুষ্ঠু নিয়ম প্রবর্তন করেছেন এবং বস্তুর অস্তিত্বের স্থায়িত্বকে কতগুলো প্রাকৃতিক নিয়মের ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

যদিও এই গোষ্ঠী বৈজ্ঞানিক নিয়ম-কানুন ও সূত্রসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এবং প্রাকৃতিক বস্তুনিচয়ের মধ্যকার সম্পর্কসমূহ যেগুলো বিজ্ঞান কর্তৃক সমর্থিত ও স্বীকৃত হয়েছে সে সব ব্যাপারে বৈজ্ঞানিকদের বক্তব্যও আন্তরিকভাবে মেনে নিয়েছে,তারপরও তারা বিশ্বাস করে যে,এ ধরনের প্রাকৃতিক নিয়মাবলী ধ্রুব নয়। তারা বিশ্বাস করে যে,শ্রেষ্ঠ ও উচ্চতর জগৎ (যা বস্তুজগৎ থেকে উন্নত ও শ্রেষ্ঠ) যখনই চাইবে ঠিক তখনই কতিপয় মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুনের প্রয়োগ ও রেওয়াজের পথ পরিবর্তন করে দিতে সক্ষম;শুধু তা-ই নয় বরং কতিপয় ক্ষেত্রে উচ্চতর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য তা

বাস্তবে কার্যকরও করেছে।

অন্যভাবে বলতে গেলে অলৌকিক কাজসমূহ আসলে কারণহীন নয়;তবে এগুলোর সাধারণ প্রাকৃতিক কারণ নেই;আর স্বাভাবিক প্রাকৃতিক কারণ না থাকা কারণের অনস্তিত্ব নির্দেশ করে না। সৃষ্টিজগতের নিয়ম,সূত্র ও বিধানসমূহও এমন নয় যে,সেগুলো মহান স্রষ্টার ইচ্ছায় পরিবর্তিত হয় না।

তারা বলে যে,মহান নবিগণের অলৌকিক ও আশ্চর্যজনক কার্যাবলী যা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুনের সীমারেখার বাইরে,সেগুলো এ পথেই (স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মে) সংঘটিত ও বাস্তবায়িত হয়। এ গোষ্ঠীটি অতি প্রাকৃতিক কার্যসমূহ (মুজিযা ও কারামত) যেগুলো পবিত্র কোরআন ও হাদীসসমূহে অথবা বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে তা স্বাভাবিক বৈজ্ঞানিক ও প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুনের সাথে খাপ খায় না বলে প্রত্যাখ্যান করেছে বা এ সব ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেছে।

এখন আমরা মহানবী (সা.)-এর শৈশবকালের আশ্চর্যজনক ও রহস্যময় ঘটনাবলী উল্লেখ করব। এ বক্তব্য ও ব্যাখ্যাটি যদি আমরা বিবেচনায় রাখি,তাহলে এ ধরনের ঘটনাবলীর ক্ষেত্রে আমাদের আর কোন সংশয় থাকবে না।

1. ইতিহাস রচয়িতাগণ হালীমার কথা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, যখন আমি আমেনার নবজাতক শিশুর (মহানবী) প্রতিপালনের দায়িত্ব গ্রহণ করি তখন তার মায়ের উপস্থিতিতে তাকে স্তন্য দান করতে চাইলাম। আমার বাম স্তন যা দুধে পরিপূর্ণ ছিল তা তার মুখে রাখলাম,কিন্তু নবজাতক শিশুটি আমার ডান স্তনের প্রতি যেন বেশি আগ্রহান্বিত ছিল। কিন্তু আমি যে দিন সন্তান প্রসব করেছিলাম সে দিন থেকেই আমার ডান স্তনে দুধ ছিল না। নবজাতক শিশুর পীড়াপীড়িতে আমি আমার দুধবিহীন ডান স্তনটি তার মুখে রাখলাম। তখনই সে তা চুষতে লাগল এবং স্তনের শুষ্ক দুগ্ধগ্রন্থিগুলো দুধে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। এ ঘটনা উপস্থিত সকল ব্যক্তিকে আশ্চর্যান্বিত করেছিল। 140

2. তাঁর নিকট থেকে আরো বর্ণিত আছে : যে দিন আমি শিশু মুহাম্মদকে আমার গৃহে আনলাম সে দিন থেকে আমার ঘরে কল্যাণ ও বরকত দিনের পর দিন বৃদ্ধি পেতে লাগল। আমার সম্পদ ও গবাদিপশুও বৃদ্ধি পেতে লাগল। 141

নিশ্চিতভাবে বলতে গেলে বস্তুবাদীরা এবং যারা তাদের মূলনীতি ও বিশ্বাসের অনুসরণ করে তারা এ সব বিষয়ে তাওহীদপন্থী স্রষ্টায় বিশ্বাসীদের সাথে দ্বিমত পোষণ করে। বস্তুবাদী নীতিমালা ও দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারীরা যেহেতু এ ধরনের বিষয়াদি প্রকৃতিবিজ্ঞানের আলোকে ব্যাখ্যা করতে অক্ষম সেহেতু তারা তাৎক্ষণিকভাবে বলে যে,এ সব ঘটনা ও বিষয় মানুষের কল্পনাপ্রসূত। যদি তারা খুব ভদ্র ও মার্জিত হয় তাহলে বলে যে,মহানবী এ সব অলৌকিক কাজের মুখাপেক্ষী ছিলেন না। এতে কোন সন্দেহ নেই যে,তিনি এ সব বিষয়ের মুখাপেক্ষী ছিলেন না। তবে অমুখাপেক্ষিতা একটি বিষয় এবং কোন একটি বিষয় সত্য ও মিথ্যা হওয়ার ব্যাপারে ফায়সালা করা আরেকটি বিষয়। কিন্তু যে ব্যক্তি প্রকৃতিজগতে বিরাজমান ব্যবস্থাকে বিশ্ব-ব্র‏‏ হ্মাণ্ডের মহান স্রষ্টার ইচ্ছাশক্তির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন বলে জানে এবং বিশ্বাস করে যে,সবচেয়ে ক্ষুদ্র অস্তিত্ববান সত্তা (পরমাণু) থেকে শুরু করে সর্ববৃহৎ সৃষ্টি (নীহারিকাপুঞ্জ) পর্যন্ত সমগ্র বিশ্ব-ব্র হ্মাণ্ড তাঁর (স্রষ্টা) প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। তাই এ সব ঘটনা যাচাই-বাছাই এবং এগুলোর দলিল প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই সে এ সব ঘটনা ও বিষয়ের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করে;আর যদি সে এ সব ঘটনা যাচাই-বাছাই এবং এগুলোর দলিল-প্রমাণের ক্ষেত্রে নিশ্চিত হতে না-ও পারে তবুও সে এ সব বিষয় ও ঘটনাকে নিশ্চিতভাবে প্রত্যাখ্যান করে না।

আমরা পবিত্র কোরআনে হযরত ঈসা ইবনে মরিয়মের ক্ষেত্রে এ ধরনের অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করি। যেমন পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে : যখন হযরত মরিয়মের সন্তান প্রসবের সময় নিকটবর্তী হলো তখন তিনি একটি খেজুর গাছের কাছে আশ্রয় নিলেন এবং তিনি (তীব্র ব্যথা,একাকিত্ব ও দুর্নামের ভয়ে) মহান আল্লাহর কাছে মৃত্যু কামনা করলেন। ঐ সময় তিনি একটি আহবান ধ্বনি শুনতে পেলেন :

) لا تحزني قد جعل ربّك تحتك سريّا و هزّي إليك بجذع النّخلة تساقط عليك رطبا جنيّا(

“দুঃখভারাক্রান্ত হয়ো না। তোমার প্রভু তোমার পায়ের তলদেশে পানির ঝরনা প্রবাহিত করেছেন এবং (শুষ্ক) খেজুর গাছটি ঝাঁকি দাও তাহলে তাজা খেজুর তোমার ওপর পতিত হবে। (সূরা মরিয়ম : 24-25)

আমরা পবিত্র কোরআনে হযরত মরিয়ম সম্পর্কে অন্যান্য বিষয়ও জানতে পারি। তাঁর নিষ্পাপ হওয়া ও তাকওয়া তাঁকে এমন এক সুমহান স্থানে উন্নীত করেছিল যে,যখনই হযরত যাকারিয়া (আ.) হযরত মরিয়মের ইবাদাত-বন্দেগী করার স্থানে প্রবেশ করতেন তখনই তিনি তাঁর কাছে বেহেশতের খাবার দেখতে পেতেন। যখন তিনি এ ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞেস করতেন, এ রুজী (খাবার) কোথা থেকে এসেছে? হযরত মরিয়ম তাঁকে জবাবে বলতেন, মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। 142

অতএব,এ ধরনের অলৌকিক বিষয়ের ক্ষেত্রে সন্দেহ পোষণ করা এবং এগুলো অসম্ভব বলে মনে করা অনুচিত।

মরুভূমিতে পাঁচ বছর

আবদুল মুত্তালিবের অনাথ নাতি মহানবী (সা.) বনি সা দ গোত্রের মাঝে পাঁচ বছর অতিবাহিত করলেন। এ সময় তিনি ভালোভাবে বেড়ে ওঠেন। এ দীর্ঘ পাঁচ বছর হযরত হালীমাহ্ তাঁকে দু তিন বার মা আমেনার কাছে এনেছিলেন এবং শেষ বারে তিনি তাঁকে তাঁর মায়ের কাছে অর্পণ করেছিলেন।

দুগ্ধপানকাল শেষ হওয়ার পর বিবি হালীমাহ্ তাঁকে প্রথম বারের মতো পবিত্র মক্কায় এনেছিলেন। জোরাজুরি করে হালীমাহ্ তাঁকে পুনরায় বনি সা দ গোত্রে ফিরিয়ে নিয়ে যান। ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে জোর করার কারণ ছিল এই যে,এ অনাথ শিশুর উসিলায় তাঁর প্রভূত কল্যাণ ও বরকত হয়েছিল এবং পবিত্র মক্কা নগরীতে কলেরা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ায় হযরত আমেনাও হালীমাহর অনুরোধ গ্রহণ করেছিলেন।

একদল আবিসিনীয় আলেম একবার হিজাযে এসেছিলেন। তখন তাঁরা বনি সা দ গোত্রে শিশু মহানবীকে দেখতে পেলেন। তাঁরা দেখতে পেলেন যে,হযরত ঈসা (আ.)-এর পরবর্তী নবীর নিদর্শনাদি যা আসমানী গ্রন্থসমূহে বর্ণিত আছে তা এ শিশুটির সাথে মিলে যাচ্ছে। এ কারণে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন যে,যেভাবেই হোক তাঁরা এ শিশুকে অপহরণ করে আবিসিনিয়ায় নিয়ে যাবেন এবং এ হবে তাঁদের গৌরবের বিষয়। তাই এ সব ব্যক্তির হাত থেকে শিশু হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিরাপদ রাখার জন্য বিবি হালীমাহ্ তাঁকে দ্বিতীয় বারের মতো পবিত্র মক্কা নগরীতে নিয়ে আসেন।143

এ ব্যাপারটি মোটেও অসম্ভব ও কাল্পনিক নয়। কারণ পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট বক্তব্য অনুসারে মহানবীর নিদর্শনসমূহ ইঞ্জিল শরীফে বর্ণিত হয়েছে। সে সময়ের আসমানী গ্রন্থাদির বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিগণ যে পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থসমূহে বর্ণিত নিদর্শনসমূহের ভিত্তিতে উক্ত নিদর্শনসমূহের অধিকারী ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে পেরেছিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে :

) و إذا قال عيسى بن مريم يا بني إسرائيل إنّي رسول الله إليكم مصدّقا لما بين يديّ من التّوراة و مبشّرا برسول يأتي من بعدي اسمه أحمد فلمّا جاءهم بالبيّنات قالوا هذا سحر مبين(

“আর স্মরণ করুন তখনকার কথা যখন ঈসা ইবনে মরিয়ম (বনি ইসরাইলকে) বলেছিল : নিশ্চয়ই আমি তোমাদের কাছে মহান আল্লাহর রাসূল। আমার সামনে বিদ্যমান আসমানী গ্রন্থ তাওরাতের সত্যায়নকারী এবং আমি তোমাদেরকে আমার পরে যে রাসূল আগমন করবে তার সুসংবাদ প্রদান করছি। উক্ত রাসূলের নাম হবে আহমাদ। অতঃপর সেই (প্রতিশ্রুত) রাসূল তাদের কাছে (নিদর্শন ও মুজিযাসহ) আগমন করল। তখন তারা বলল : এ (এ সব মুজিযা ও পবিত্র কোরআন) তো স্পষ্ট যাদু।” (সূরা সাফ : 6)

এতৎসংক্রান্ত আরো বহু আয়াত রয়েছে যা থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে,মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চি হ্ন ও নিদর্শনাদি পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থসমূহে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং পূর্ববর্তী নবীদের উম্মতগণ এ ব্যাপারে অবগত ছিল।144

সপ্তম অধ্যায় : মাতৃক্রোড়ে প্রত্যাবর্তন

মহান আল্লাহ্ প্রত্যেক ব্যক্তিকে কোন না কোন দায়িত্ব পালনের জন্য সৃষ্টি করেছেন। কাউকে জ্ঞানার্জনের জন্য,কাউকে আবিষ্কার ও উদ্ভাবন করার জন্য,আবার কাউকে কর্ম ও পরিশ্রম করার জন্য,কোন কোন মানুষকে পরিচালনা ও নেতৃত্ব দান করার জন্য,আবার কিছু সংখ্যক মানুষকে শিক্ষা-প্রশিক্ষণ কার্য সম্পাদন করার জন্য এবং এভাবে তিনি বিভিন্ন মানুষকে জগতের বিভিন্ন কার্য সম্পাদন করার জন্য সৃষ্টি করেছেন।

আন্তরিক ও হৃদয়বান প্রশিক্ষকগণ যাঁরা ব্যক্তি ও সমাজের উন্নতি কামনা করেন তাঁরা কোন কাজের জন্য কোন ব্যক্তিকে নিযুক্ত করার আগেই তার অভিরুচি পরীক্ষা ও যাচাই-বাছাই করে থাকেন। আর যে ব্যক্তির যে কাজের প্রতি ঝোঁক এবং সামর্থ্য রয়েছে তাঁরা তাকে কেবল সেই কাজেরই দায়িত্ব দেন। কারণ এর অন্যথা হলে সমাজের দু টি ভয়ঙ্কর ক্ষতি হতে পারে :

ক. যে কাজ ঐ ব্যক্তি সম্পন্ন করতে পারত তা সে সম্পন্ন করতে পারবে না এবং

খ. যে কাজ সে আঞ্জাম দিয়েছে তা নিষ্ফল হতে বাধ্য।

বলা হয় যে,প্রতিটি রহস্যে একটি আনন্দ ও উদ্দীপনা আছে। ঐ ব্যক্তি সৌভাগ্যবান যে তার নিজ আনন্দ ও উদ্দীপনা উপলব্ধি করে।

এক শিক্ষক তাঁর এক অলস ছাত্রকে উপদেশ প্রদান করতেন এবং আলস্যের অনিষ্ট এবং যে সব ব্যক্তি জ্ঞানার্জন করেনি ও নিজেদের জীবনের বসন্তকাল অর্থাৎ যৌবনকে আলস্য ও প্রবৃত্তির পূজায় নিঃশেষ করেছে তাদের জীবনের করুণ পরিণতি সবিস্তারে ব্যাখ্যা করতেন। তিনি দেখতে পেলেন যে,ঐ ছাত্রটি তাঁর কথা শ্রবণরত অবস্থায় মাটির ওপর পড়ে থাকা এক টুকরা কয়লার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি হঠাৎ করে উপলব্ধি করতে পারলেন এ ছেলেটি লেখাপড়া শেখা ও জ্ঞানার্জন করার জন্য সৃষ্ট হয়নি;বরং স্রষ্টা তাকে চিত্রাঙ্কন করার মনোবৃত্তি ও রুচি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এ কারণেই উক্ত শিক্ষক ছাত্রটির পিতা-মাতাকে ডেকে বলেছিলেন, জ্ঞানার্জন ও লেখা-পড়া শেখার ব্যাপারে আপনাদের সন্তানের আগ্রহ অত্যন্ত কম,কিন্তু চিত্রাঙ্কন করার রুচি ও ঝোঁক তার মধ্যে বেশ ভালোভাবেই আছে এবং এ ব্যাপারে তার স্পৃহা ও আগ্রহ অত্যন্ত আশ্চর্যজনক।” শিক্ষকের পরামর্শ ছাত্রের পিতা-মাতার কাছে মনোঃপুত হলে অতি অল্প দিনের মধ্যে ছাত্রটি চিত্রাঙ্কন ও শিল্পকলা বেশ দ্রুত আয়ত্ত করে ফেলে এবং এ ক্ষেত্রে সে যুগশ্রেষ্ঠ শিল্পীতে পরিণত হয়।

শৈশবকাল শিশুদের অভিভাবকদের জন্য সন্তানদের রুচিবোধ ও সামর্থ্য পরীক্ষা এবং তাদের কাজ-কর্ম,আচার-আচরণ,চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা থেকে তাদের ব্যক্তিগত অভিরুচি সম্পর্কে ধারণা লাভ করার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। কারণ শিশুর চিন্তা-ভাবনা,কার্যকলাপ এবং মিষ্টি-মধুর কথা-বার্তা আসলে তার যোগ্যতা ও সামর্থ্যরেই আয়নাস্বরূপ। স্মর্তব্য যে,তার সামর্থ্য বিকাশের যাবতীয় পূর্বশর্ত ও ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে গেলে তা সর্বোত্তম পন্থায় কাজে লাগানো সম্ভব।

নবুওয়াত ঘোষণা পর্যন্ত হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনচরিত,আচার-আচরণ ও কার্যকলাপ তাঁর জীবন এবং তাঁর মহৎ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহের পটভূমি আমাদের মানসপটে চিত্রিত করে। তাঁর শৈশবের ইতিহাস অধ্যয়ন ও গভীর চিন্তা-ভাবনা করলে আমরা কেবল তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কেই অবগত হব না;বরং যে দিন তাঁর নবুওয়াত ঘোষিত হয়েছিল এবং তিনি নিজেকে সমাজের নেতা ও পথ-প্রদর্শক বলে ঘোষণা করেছিলেন সে দিন পর্যন্ত তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনেতিহাস তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদের অবগত করে এবং এ থেকে প্রতীয়মান হয়ে যায় যে,এ ব্যক্তি কোন্ কাজের জন্য সৃষ্ট হয়েছেন? আর তাঁর রিসালাত ও নেতৃত্বের দাবি কি তাঁর জীবন-কাহিনীর সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল? চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর জীবনেতিহাস,তাঁর আচার-আচরণ,চরিত্র,কর্ম,কথা এবং জনগণের সাথে দীর্ঘদিন মেলামেশা তাঁর সত্য নবী ও রাসূল হওয়ার বিষয়টি সমর্থন করে কি?

এ দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা এখানে মহানবীর জীবনের প্রথম দিনগুলো (শৈশব,কৈশোর ও যৌবন) সম্পর্কে আলোচনা করব।

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দাই-মা হযরত হালীমাহ্ তাঁকে পাঁচ বছর লালন-পালন করেছিলেন। এ সময় তিনি খাঁটি বলিষ্ঠ আরবী ভাষা রপ্ত করেছিলেন। সে কারণে তিনি পরবর্তীকালে গৌরববোধ করতেন। পাঁচ বছর পর হযরত হালীমাহ্ তাঁকে পবিত্র মক্কা নগরীতে নিয়ে আসেন। মক্কায় প্রত্যাবর্তন করার পর বেশ কিছুদিন তিনি মাতৃস্নেহ লাভ করেছিলেন এবং এ সময় তিনি দাদা আবদুল মুত্তালিবের তত্ত্বাবধান ও অভিভাবকত্বে লালিত-পালিত হন। হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মক্কাধিপতি হযরত আবদুল মুত্তালিবের কাছে পুত্র আবদুল্লাহর একমাত্র স্মৃতি।145

ইয়াসরিবে সফর

যে দিন আবদুল মুত্তালিবের পুত্রবধু (আমেনা) তাঁর যুবক স্বামীকে হারালেন সে দিন থেকে তিনি সর্বদা ইয়াসরিব গমন করে স্বামীর কবর যিয়ারত এবং সে সাথে ইয়াসরিবস্থ নিজ আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করার উপযুক্ত মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিলেন।

তিনি চিন্তা করে দেখলেন যে,একটি সঠিক সুযোগ এসে গেছে এবং তাঁর প্রাণাধিক পুত্রসন্তান (মুহাম্মদ)ও এখন বড় হয়েছে এবং সেও এ পথে তাঁর শোকের অংশীদার হতে পারবে। তাঁরা  উম্মে আইমানকে সাথে নিয়ে ইয়াসরিবের উদ্দেশে যাত্রা করেন এবং পূর্ণ এক মাস সেখানে অবস্থান করেন। শিশু মহানবীর জন্য এ সফর শোক ও বেদনা বয়ে এনেছিল। কারণ প্রথম বারের মতো তাঁর দৃষ্টি যে ঘরে তাঁর পিতা হযরত আবদুল্লাহ্ ইন্তেকাল করেছিলেন এবং চির নিদ্রায় শায়িত হয়েছিলেন সেই ঘরের দিকে নিবদ্ধ হয়েছিল।146

শিশু মহানবীর অন্তরে পিতৃশোক স্তিমিত হতে না হতেই হঠাৎ আরেকটি হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে গেল। এর ফলে শোক আরো বেড়ে গিয়েছিল। কারণ পবিত্র মক্কায় প্রত্যাবর্তনকালে মহানবীর স্নেহময়ী মা হযরত আমেনা পথিমধ্যে আবওয়া নামক স্থানে ইন্তেকাল করেন।147

এ ঘটনা বনি হাশিম ও আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে শিশু মহানবীকে স্নেহভাজন করেছিল এবং তাঁর প্রতি তাদের সহানুভূতি ও মমতাবোধের উদ্ভব ঘটিয়েছিল। তিনি ছিলেন হযরত আবদুল্লাহ্ ও হযরত আমেনার পুষ্পোদ্যানের একমাত্র পুষ্প-তাঁদের পুণ্যস্মৃতি। এ কারণেই শিশু মহানবী দাদা হযরত আবদুল মুত্তালিবের অশেষ ভালোবাসা ও স্নেহ পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন পিতামহের প্রাণাধিক প্রিয় নাতি। আবদুল মুত্তালিব তাঁকে তাঁর সকল সন্তান অপেক্ষা বেশি ভালোবাসতেন। তিনি সকলের ওপর তাঁকেই অগ্রাধিকার প্রদান করতেন।

কাবার চারদিকে কুরাইশপ্রধান আবদুল মুত্তালিবের জন্য কার্পেট বিছানো হতো। কুরাইশ নেতৃবৃন্দ এবং তাঁর সন্তানগণ তাঁর কার্পেটের চারপাশে বসত। আবদুল্লাহর কথা স্মরণ হলেই তিনি (আবদুল মুত্তালিব) যে কার্পেটের ওপর উপবিষ্ট থাকতেন সে কার্পেটে প্রয়াত পুত্র আবদুল্লাহর একমাত্র স্মৃতি-চি হ্ন শিশু হযরত মুহাম্মদকে এনে তাঁর পাশে বসানোর নির্দেশ দিতেন।148

পবিত্র কোরআনের সূরা দোহায় মহানবী (সা.)-এর শৈশব ও ইয়াতিম অবস্থার কথা উল্লিখিত হয়েছে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ্ বলেছেন,

) أ لم يجدك يتيما فآوى(

“তিনি কি আপনাকে ইয়াতিম পাওয়ার পর (প্রথমে পিতামহ আবদুল মুত্তালিব ও পরে পিতৃব্য হযরত আবু তালিবের) আশ্রয় দেন নি? (সূরা দোহা : 6)

মহানবীর ইয়াতিম হওয়ার অন্তর্নিহিত মূল রহস্য আমাদের কাছে খুব একটা স্পষ্ট নয়। তবে আমরা এতটুকু জানি যে,ঘটনাসমূহ যা সংঘটিত হয়েছে তা প্রজ্ঞাবিহীন নয়। এতদসত্ত্বেও আমরা ধারণা করতে পারি যে,মহান আল্লাহ্ চেয়েছিলেন মানব জাতি ও বিশ্বের মহান নেতা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সকল দায়িত্বভার গ্রহণ এবং নেতৃত্বদান শুরু করার আগেই যেন জীবনের সুখ,শান্তি,মাধুর্য ও তিক্ততার স্বাদ আস্বাদন করেন এবং জীবনের উত্থান-পতনের সাথে পরিচিত হন। এর ফলে তিনি মহান আত্মা এবং অত্যন্ত ধৈর্যশীল হৃদয়ের অধিকারী হতে পারবেন,দুঃখ-কষ্ট ও বিপদাপদ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা অর্জন এবং নিজেকে কঠিন বিপদাপদ,কষ্ট এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য প্রস্তুত করতে পারবেন।

মহান আল্লাহ্ চেয়েছিলেন যেন কারও আনুগত্য তাঁর স্কন্ধের ওপর না থাকে;আর তিনি জন্মগ্রহণের পরপর অর্থাৎ জীবনের শুরু থেকেই যেন স্বাধীন থাকেন। তিনি যেন আত্মগঠনে নিয়োজিত মনীষীদের ন্যায় তাঁর আত্মিক-আধ্যাত্মিক উৎকর্ষের ভিত্তিসমূহ নিজ হাতে গঠন করতে সক্ষম হন। যার ফলে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে,তাঁর প্রতিভা আসলে সাধারণ মানবীয় প্রতিভা নয় এবং তাঁর ভাগ্য নির্মাণের ক্ষেত্রে তাঁর পিতা-মাতার কোন ভূমিকাই ছিল না। তাঁর সকল মর্যাদা আসলে ওহীর উৎসমূল থেকেই উৎসারিত হয়েছিল।

আবদুল মুত্তালিবের মৃত্যু

হৃদয়বিদারক ঘটনাসমূহ সব সময় মানব জীবনের পথ-পরিক্রমণে আবির্ভূত হয়। সেগুলো সমুদ্রের পর্বত প্রমাণ উত্থাল তরঙ্গমালার ন্যায় একের পর এক উত্থিত হয়ে মানুষের জীবন-তরীকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে এবং মানব মনের ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানে।

মহানবী (সা.)-এর অন্তঃকরণে (মায়ের মৃত্যুতে) শোক ও দুঃখ তখনও বিরাজ করছিল ঠিক এমতাবস্থায় তৃতীয় বারের মতো এক বড় বিপদ তাঁর ওপর আপতিত হয়েছিল। তাঁর জীবনের অষ্টম বসন্তকাল অতিবাহিত হতে না হতেই অভিভাবক ও পিতামহ হযরত আবদুল মুত্তালিবকে তিনি হারিয়েছিলেন। আবদুল মুত্তালিবের মৃত্যু তাঁর কোমল আত্মার ওপর এতটা গভীর দাগ কেটেছিল যে,দাদা আবদুল মুত্তালিব যে দিন মৃত্যুবরণ করেছিলেন সে দিন তিনি সমাধিস্থলে তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা পর্যন্ত অশ্রুপাত করেছিলেন এবং তিনি কখনই পিতামহ আবদুল মুত্তালিবকে ভুলেন নি।149

ষষ্ঠ অধ্যায় : মহানবী (সা.)-এর শৈশবকাল

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে,ইসলাম ও মুসলমানদের মহান নেতা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সমগ্র জীবনটাই-শৈশবের শুরু থেকে যে দিন তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে নবুওয়াতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন সেই দিন পর্যন্ত আশ্চর্যজনক ঘটনাসমূহের সমন্বয়ে গঠিত। আর এ সব আশ্চর্যজনক ঘটনা অলৌকিকত্বের প্রমাণ বহন করে। এ সব কিছু থেকে প্রতীয়মান হয় যে,মহানবী (সা.)-এর জীবন ছিল একটি অসাধারণ জীবন।

মহানবীর এ সব অলৌকিক ঘটনা ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে সীরাত রচয়িতাগণ দু ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছেন :

1. বস্তুবাদী কতিপয় প্রাচ্যবিদের দৃষ্টিভঙ্গি : বস্তুবাদী বৈজ্ঞানিকগণ বস্তুবাদী ভূয়োদর্শন পোষণ করেন এবং অস্তিত্বকে কেবল বস্তুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ বলে মনে করেন। তাঁরা সকল প্রপঞ্চ ও ঘটনাকে বস্তুগত প্রপঞ্চ ও ঘটনা বলে বিশ্বাস করেন এবং প্রতিটি ঘটনা ও প্রপঞ্চেরই প্রাকৃতিক (বস্তুগত) কারণ নির্ধারণ করেন। তাঁরা এ সব অলৌকিক ঘটনা ও প্রপঞ্চের প্রতি মোটেও গুরুত্ব দেন না। কারণ বস্তুবাদী নীতিমালা অনুসারে এ ধরনের ঘটনা ও প্রপঞ্চের উৎপত্তি অসম্ভব;আর ইতিহাসের পাতায় পাতায় এ ধরনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেই তাঁরা এগুলোকে ধর্মের অনুসারীদের কল্পনা এবং ভক্তি-ভালোবাসাপ্রসূত বলে বিবেচনা করেন।

একদল প্রাচ্যবিদ যাঁরা নিজেদেরকে বাহ্যত তাওহীদবাদী ও খোদায় বিশ্বাসী বলে অভিহিত করেন এবং অতি প্রাকৃতিক (আধ্যাত্মিক) জগতের অস্তিত্বেও বিশ্বাস করেন,কিন্তু তাঁদের ঈমানী দুর্বলতা ও জ্ঞানগত গর্ব এবং তাঁদের চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণার ওপর বস্তুবাদিতার প্রাধান্য থাকার কারণে ঘটনা বিশ্লেষণ করার সময় তাঁরা বস্তুবাদী মূলনীতিসমূহের অনুসরণ করেন। আমরা বারবার তাঁদের বক্তব্য ও আলোচনার মধ্যে এ সব বাক্য লক্ষ্য করেছি যে, নবুওয়াত আসলে এক ধরনের মানবীয় প্রতিভা , নবী হচ্ছেন একজন সামাজিক প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব যিনি তাঁর নিজের আলোকিত চিন্তাধারা দিয়ে মানব জীবনের গতিধারা ও পথকে আলোকিত করেন’...।

প্রাচ্যবিদদের এ ধরনের বক্তব্য আসলে বস্তুবাদী চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উদ্ভূত যা সকল ধর্মকে মানব চিন্তা ও কল্পনাপ্রসূত বলে বিবেচনা করে। অথচ আস্তিক জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তিগণ সাধারণ নবুওয়াত সংক্রান্ত আলোচনায় প্রমাণ করেছেন যে,নবুওয়াত মহান আল্লাহর ঐশী দান ও অনুগ্রহ যা সকল আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণা (ইলহাম) ও যোগাযোগের উৎস। মহান নবীদের পরিকল্পনাসমূহ,তাঁদের চিন্তা,ধারণা ও প্রতিভা প্রসূত নয়;বরং অবস্তুগত আধ্যাত্মিকজগৎ থেকে প্রেরিত ইলহাম ও প্রত্যাদেশ ব্যতীত তাঁদের এ সব পরিকল্পনা ও কর্মসূচীর আর কোন উৎসমূল নেই। কিন্তু যখন খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী প্রাচ্যবিদগণ বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে এ সব বিষয়ে দৃক্পাত করেন এবং সমস্ত ঘটনা ও প্রপঞ্চকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অভিজ্ঞতালব্ধ বৈজ্ঞানিক মূলনীতি ও সূত্রের আলোকে পরিমাপ করেন তখন যে সব ঘটনা ও প্রপঞ্চের অলৌকিকত্বের দিক রয়েছে অর্থাৎ মুজিযা সেগুলোর কঠোর সমালোচনা করেন এবং মূল থেকে সেগুলো অস্বীকার করেন।

2 . স্রষ্টা পূজারিগণ : ঐ সব ব্যক্তি মহান আল্লাহর উপাসনাকারী যারা বিশ্বাস করে যে,বস্তুজগতের বৈশিষ্ট্য ও চি হ্নসমূহ অন্য জগতের পরিচালনাধীন এবং অতি প্রাকৃতিক অবস্তুগতজগৎ এ প্রাকৃতিক ও বস্তুগত বিশ্বের সার্বিক শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। অন্যভাবে বলা যায়,বস্তুজগৎ স্বাধীন ও সার্বভৌম নয়। সকল ব্যবস্থা এবং এগুলোর প্রাকৃতিক ও বৈজ্ঞানিক সূত্র উচ্চতর অস্তিত্বময় সত্তাসমূহ,বিশেষ করে মহান আল্লাহর ইচ্ছার সৃষ্টি। মহান আল্লাহ্ বস্তুর অস্তিত্ব প্রদান করেছেন। তিনি বস্তুর বিভিন্ন অংশের মাঝে কতগুলো সুষ্ঠু নিয়ম প্রবর্তন করেছেন এবং বস্তুর অস্তিত্বের স্থায়িত্বকে কতগুলো প্রাকৃতিক নিয়মের ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

যদিও এই গোষ্ঠী বৈজ্ঞানিক নিয়ম-কানুন ও সূত্রসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এবং প্রাকৃতিক বস্তুনিচয়ের মধ্যকার সম্পর্কসমূহ যেগুলো বিজ্ঞান কর্তৃক সমর্থিত ও স্বীকৃত হয়েছে সে সব ব্যাপারে বৈজ্ঞানিকদের বক্তব্যও আন্তরিকভাবে মেনে নিয়েছে,তারপরও তারা বিশ্বাস করে যে,এ ধরনের প্রাকৃতিক নিয়মাবলী ধ্রুব নয়। তারা বিশ্বাস করে যে,শ্রেষ্ঠ ও উচ্চতর জগৎ (যা বস্তুজগৎ থেকে উন্নত ও শ্রেষ্ঠ) যখনই চাইবে ঠিক তখনই কতিপয় মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুনের প্রয়োগ ও রেওয়াজের পথ পরিবর্তন করে দিতে সক্ষম;শুধু তা-ই নয় বরং কতিপয় ক্ষেত্রে উচ্চতর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য তা

বাস্তবে কার্যকরও করেছে।

অন্যভাবে বলতে গেলে অলৌকিক কাজসমূহ আসলে কারণহীন নয়;তবে এগুলোর সাধারণ প্রাকৃতিক কারণ নেই;আর স্বাভাবিক প্রাকৃতিক কারণ না থাকা কারণের অনস্তিত্ব নির্দেশ করে না। সৃষ্টিজগতের নিয়ম,সূত্র ও বিধানসমূহও এমন নয় যে,সেগুলো মহান স্রষ্টার ইচ্ছায় পরিবর্তিত হয় না।

তারা বলে যে,মহান নবিগণের অলৌকিক ও আশ্চর্যজনক কার্যাবলী যা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুনের সীমারেখার বাইরে,সেগুলো এ পথেই (স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মে) সংঘটিত ও বাস্তবায়িত হয়। এ গোষ্ঠীটি অতি প্রাকৃতিক কার্যসমূহ (মুজিযা ও কারামত) যেগুলো পবিত্র কোরআন ও হাদীসসমূহে অথবা বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে তা স্বাভাবিক বৈজ্ঞানিক ও প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুনের সাথে খাপ খায় না বলে প্রত্যাখ্যান করেছে বা এ সব ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেছে।

এখন আমরা মহানবী (সা.)-এর শৈশবকালের আশ্চর্যজনক ও রহস্যময় ঘটনাবলী উল্লেখ করব। এ বক্তব্য ও ব্যাখ্যাটি যদি আমরা বিবেচনায় রাখি,তাহলে এ ধরনের ঘটনাবলীর ক্ষেত্রে আমাদের আর কোন সংশয় থাকবে না।

1. ইতিহাস রচয়িতাগণ হালীমার কথা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, যখন আমি আমেনার নবজাতক শিশুর (মহানবী) প্রতিপালনের দায়িত্ব গ্রহণ করি তখন তার মায়ের উপস্থিতিতে তাকে স্তন্য দান করতে চাইলাম। আমার বাম স্তন যা দুধে পরিপূর্ণ ছিল তা তার মুখে রাখলাম,কিন্তু নবজাতক শিশুটি আমার ডান স্তনের প্রতি যেন বেশি আগ্রহান্বিত ছিল। কিন্তু আমি যে দিন সন্তান প্রসব করেছিলাম সে দিন থেকেই আমার ডান স্তনে দুধ ছিল না। নবজাতক শিশুর পীড়াপীড়িতে আমি আমার দুধবিহীন ডান স্তনটি তার মুখে রাখলাম। তখনই সে তা চুষতে লাগল এবং স্তনের শুষ্ক দুগ্ধগ্রন্থিগুলো দুধে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। এ ঘটনা উপস্থিত সকল ব্যক্তিকে আশ্চর্যান্বিত করেছিল। 140

2. তাঁর নিকট থেকে আরো বর্ণিত আছে : যে দিন আমি শিশু মুহাম্মদকে আমার গৃহে আনলাম সে দিন থেকে আমার ঘরে কল্যাণ ও বরকত দিনের পর দিন বৃদ্ধি পেতে লাগল। আমার সম্পদ ও গবাদিপশুও বৃদ্ধি পেতে লাগল। 141

নিশ্চিতভাবে বলতে গেলে বস্তুবাদীরা এবং যারা তাদের মূলনীতি ও বিশ্বাসের অনুসরণ করে তারা এ সব বিষয়ে তাওহীদপন্থী স্রষ্টায় বিশ্বাসীদের সাথে দ্বিমত পোষণ করে। বস্তুবাদী নীতিমালা ও দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারীরা যেহেতু এ ধরনের বিষয়াদি প্রকৃতিবিজ্ঞানের আলোকে ব্যাখ্যা করতে অক্ষম সেহেতু তারা তাৎক্ষণিকভাবে বলে যে,এ সব ঘটনা ও বিষয় মানুষের কল্পনাপ্রসূত। যদি তারা খুব ভদ্র ও মার্জিত হয় তাহলে বলে যে,মহানবী এ সব অলৌকিক কাজের মুখাপেক্ষী ছিলেন না। এতে কোন সন্দেহ নেই যে,তিনি এ সব বিষয়ের মুখাপেক্ষী ছিলেন না। তবে অমুখাপেক্ষিতা একটি বিষয় এবং কোন একটি বিষয় সত্য ও মিথ্যা হওয়ার ব্যাপারে ফায়সালা করা আরেকটি বিষয়। কিন্তু যে ব্যক্তি প্রকৃতিজগতে বিরাজমান ব্যবস্থাকে বিশ্ব-ব্র‏‏ হ্মাণ্ডের মহান স্রষ্টার ইচ্ছাশক্তির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন বলে জানে এবং বিশ্বাস করে যে,সবচেয়ে ক্ষুদ্র অস্তিত্ববান সত্তা (পরমাণু) থেকে শুরু করে সর্ববৃহৎ সৃষ্টি (নীহারিকাপুঞ্জ) পর্যন্ত সমগ্র বিশ্ব-ব্র হ্মাণ্ড তাঁর (স্রষ্টা) প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। তাই এ সব ঘটনা যাচাই-বাছাই এবং এগুলোর দলিল প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই সে এ সব ঘটনা ও বিষয়ের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করে;আর যদি সে এ সব ঘটনা যাচাই-বাছাই এবং এগুলোর দলিল-প্রমাণের ক্ষেত্রে নিশ্চিত হতে না-ও পারে তবুও সে এ সব বিষয় ও ঘটনাকে নিশ্চিতভাবে প্রত্যাখ্যান করে না।

আমরা পবিত্র কোরআনে হযরত ঈসা ইবনে মরিয়মের ক্ষেত্রে এ ধরনের অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করি। যেমন পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে : যখন হযরত মরিয়মের সন্তান প্রসবের সময় নিকটবর্তী হলো তখন তিনি একটি খেজুর গাছের কাছে আশ্রয় নিলেন এবং তিনি (তীব্র ব্যথা,একাকিত্ব ও দুর্নামের ভয়ে) মহান আল্লাহর কাছে মৃত্যু কামনা করলেন। ঐ সময় তিনি একটি আহবান ধ্বনি শুনতে পেলেন :

) لا تحزني قد جعل ربّك تحتك سريّا و هزّي إليك بجذع النّخلة تساقط عليك رطبا جنيّا(

“দুঃখভারাক্রান্ত হয়ো না। তোমার প্রভু তোমার পায়ের তলদেশে পানির ঝরনা প্রবাহিত করেছেন এবং (শুষ্ক) খেজুর গাছটি ঝাঁকি দাও তাহলে তাজা খেজুর তোমার ওপর পতিত হবে। (সূরা মরিয়ম : 24-25)

আমরা পবিত্র কোরআনে হযরত মরিয়ম সম্পর্কে অন্যান্য বিষয়ও জানতে পারি। তাঁর নিষ্পাপ হওয়া ও তাকওয়া তাঁকে এমন এক সুমহান স্থানে উন্নীত করেছিল যে,যখনই হযরত যাকারিয়া (আ.) হযরত মরিয়মের ইবাদাত-বন্দেগী করার স্থানে প্রবেশ করতেন তখনই তিনি তাঁর কাছে বেহেশতের খাবার দেখতে পেতেন। যখন তিনি এ ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞেস করতেন, এ রুজী (খাবার) কোথা থেকে এসেছে? হযরত মরিয়ম তাঁকে জবাবে বলতেন, মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। 142

অতএব,এ ধরনের অলৌকিক বিষয়ের ক্ষেত্রে সন্দেহ পোষণ করা এবং এগুলো অসম্ভব বলে মনে করা অনুচিত।

মরুভূমিতে পাঁচ বছর

আবদুল মুত্তালিবের অনাথ নাতি মহানবী (সা.) বনি সা দ গোত্রের মাঝে পাঁচ বছর অতিবাহিত করলেন। এ সময় তিনি ভালোভাবে বেড়ে ওঠেন। এ দীর্ঘ পাঁচ বছর হযরত হালীমাহ্ তাঁকে দু তিন বার মা আমেনার কাছে এনেছিলেন এবং শেষ বারে তিনি তাঁকে তাঁর মায়ের কাছে অর্পণ করেছিলেন।

দুগ্ধপানকাল শেষ হওয়ার পর বিবি হালীমাহ্ তাঁকে প্রথম বারের মতো পবিত্র মক্কায় এনেছিলেন। জোরাজুরি করে হালীমাহ্ তাঁকে পুনরায় বনি সা দ গোত্রে ফিরিয়ে নিয়ে যান। ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে জোর করার কারণ ছিল এই যে,এ অনাথ শিশুর উসিলায় তাঁর প্রভূত কল্যাণ ও বরকত হয়েছিল এবং পবিত্র মক্কা নগরীতে কলেরা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ায় হযরত আমেনাও হালীমাহর অনুরোধ গ্রহণ করেছিলেন।

একদল আবিসিনীয় আলেম একবার হিজাযে এসেছিলেন। তখন তাঁরা বনি সা দ গোত্রে শিশু মহানবীকে দেখতে পেলেন। তাঁরা দেখতে পেলেন যে,হযরত ঈসা (আ.)-এর পরবর্তী নবীর নিদর্শনাদি যা আসমানী গ্রন্থসমূহে বর্ণিত আছে তা এ শিশুটির সাথে মিলে যাচ্ছে। এ কারণে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন যে,যেভাবেই হোক তাঁরা এ শিশুকে অপহরণ করে আবিসিনিয়ায় নিয়ে যাবেন এবং এ হবে তাঁদের গৌরবের বিষয়। তাই এ সব ব্যক্তির হাত থেকে শিশু হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিরাপদ রাখার জন্য বিবি হালীমাহ্ তাঁকে দ্বিতীয় বারের মতো পবিত্র মক্কা নগরীতে নিয়ে আসেন।143

এ ব্যাপারটি মোটেও অসম্ভব ও কাল্পনিক নয়। কারণ পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট বক্তব্য অনুসারে মহানবীর নিদর্শনসমূহ ইঞ্জিল শরীফে বর্ণিত হয়েছে। সে সময়ের আসমানী গ্রন্থাদির বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিগণ যে পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থসমূহে বর্ণিত নিদর্শনসমূহের ভিত্তিতে উক্ত নিদর্শনসমূহের অধিকারী ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে পেরেছিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে :

) و إذا قال عيسى بن مريم يا بني إسرائيل إنّي رسول الله إليكم مصدّقا لما بين يديّ من التّوراة و مبشّرا برسول يأتي من بعدي اسمه أحمد فلمّا جاءهم بالبيّنات قالوا هذا سحر مبين(

“আর স্মরণ করুন তখনকার কথা যখন ঈসা ইবনে মরিয়ম (বনি ইসরাইলকে) বলেছিল : নিশ্চয়ই আমি তোমাদের কাছে মহান আল্লাহর রাসূল। আমার সামনে বিদ্যমান আসমানী গ্রন্থ তাওরাতের সত্যায়নকারী এবং আমি তোমাদেরকে আমার পরে যে রাসূল আগমন করবে তার সুসংবাদ প্রদান করছি। উক্ত রাসূলের নাম হবে আহমাদ। অতঃপর সেই (প্রতিশ্রুত) রাসূল তাদের কাছে (নিদর্শন ও মুজিযাসহ) আগমন করল। তখন তারা বলল : এ (এ সব মুজিযা ও পবিত্র কোরআন) তো স্পষ্ট যাদু।” (সূরা সাফ : 6)

এতৎসংক্রান্ত আরো বহু আয়াত রয়েছে যা থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে,মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চি হ্ন ও নিদর্শনাদি পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থসমূহে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং পূর্ববর্তী নবীদের উম্মতগণ এ ব্যাপারে অবগত ছিল।144

সপ্তম অধ্যায় : মাতৃক্রোড়ে প্রত্যাবর্তন

মহান আল্লাহ্ প্রত্যেক ব্যক্তিকে কোন না কোন দায়িত্ব পালনের জন্য সৃষ্টি করেছেন। কাউকে জ্ঞানার্জনের জন্য,কাউকে আবিষ্কার ও উদ্ভাবন করার জন্য,আবার কাউকে কর্ম ও পরিশ্রম করার জন্য,কোন কোন মানুষকে পরিচালনা ও নেতৃত্ব দান করার জন্য,আবার কিছু সংখ্যক মানুষকে শিক্ষা-প্রশিক্ষণ কার্য সম্পাদন করার জন্য এবং এভাবে তিনি বিভিন্ন মানুষকে জগতের বিভিন্ন কার্য সম্পাদন করার জন্য সৃষ্টি করেছেন।

আন্তরিক ও হৃদয়বান প্রশিক্ষকগণ যাঁরা ব্যক্তি ও সমাজের উন্নতি কামনা করেন তাঁরা কোন কাজের জন্য কোন ব্যক্তিকে নিযুক্ত করার আগেই তার অভিরুচি পরীক্ষা ও যাচাই-বাছাই করে থাকেন। আর যে ব্যক্তির যে কাজের প্রতি ঝোঁক এবং সামর্থ্য রয়েছে তাঁরা তাকে কেবল সেই কাজেরই দায়িত্ব দেন। কারণ এর অন্যথা হলে সমাজের দু টি ভয়ঙ্কর ক্ষতি হতে পারে :

ক. যে কাজ ঐ ব্যক্তি সম্পন্ন করতে পারত তা সে সম্পন্ন করতে পারবে না এবং

খ. যে কাজ সে আঞ্জাম দিয়েছে তা নিষ্ফল হতে বাধ্য।

বলা হয় যে,প্রতিটি রহস্যে একটি আনন্দ ও উদ্দীপনা আছে। ঐ ব্যক্তি সৌভাগ্যবান যে তার নিজ আনন্দ ও উদ্দীপনা উপলব্ধি করে।

এক শিক্ষক তাঁর এক অলস ছাত্রকে উপদেশ প্রদান করতেন এবং আলস্যের অনিষ্ট এবং যে সব ব্যক্তি জ্ঞানার্জন করেনি ও নিজেদের জীবনের বসন্তকাল অর্থাৎ যৌবনকে আলস্য ও প্রবৃত্তির পূজায় নিঃশেষ করেছে তাদের জীবনের করুণ পরিণতি সবিস্তারে ব্যাখ্যা করতেন। তিনি দেখতে পেলেন যে,ঐ ছাত্রটি তাঁর কথা শ্রবণরত অবস্থায় মাটির ওপর পড়ে থাকা এক টুকরা কয়লার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি হঠাৎ করে উপলব্ধি করতে পারলেন এ ছেলেটি লেখাপড়া শেখা ও জ্ঞানার্জন করার জন্য সৃষ্ট হয়নি;বরং স্রষ্টা তাকে চিত্রাঙ্কন করার মনোবৃত্তি ও রুচি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এ কারণেই উক্ত শিক্ষক ছাত্রটির পিতা-মাতাকে ডেকে বলেছিলেন, জ্ঞানার্জন ও লেখা-পড়া শেখার ব্যাপারে আপনাদের সন্তানের আগ্রহ অত্যন্ত কম,কিন্তু চিত্রাঙ্কন করার রুচি ও ঝোঁক তার মধ্যে বেশ ভালোভাবেই আছে এবং এ ব্যাপারে তার স্পৃহা ও আগ্রহ অত্যন্ত আশ্চর্যজনক।” শিক্ষকের পরামর্শ ছাত্রের পিতা-মাতার কাছে মনোঃপুত হলে অতি অল্প দিনের মধ্যে ছাত্রটি চিত্রাঙ্কন ও শিল্পকলা বেশ দ্রুত আয়ত্ত করে ফেলে এবং এ ক্ষেত্রে সে যুগশ্রেষ্ঠ শিল্পীতে পরিণত হয়।

শৈশবকাল শিশুদের অভিভাবকদের জন্য সন্তানদের রুচিবোধ ও সামর্থ্য পরীক্ষা এবং তাদের কাজ-কর্ম,আচার-আচরণ,চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা থেকে তাদের ব্যক্তিগত অভিরুচি সম্পর্কে ধারণা লাভ করার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। কারণ শিশুর চিন্তা-ভাবনা,কার্যকলাপ এবং মিষ্টি-মধুর কথা-বার্তা আসলে তার যোগ্যতা ও সামর্থ্যরেই আয়নাস্বরূপ। স্মর্তব্য যে,তার সামর্থ্য বিকাশের যাবতীয় পূর্বশর্ত ও ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে গেলে তা সর্বোত্তম পন্থায় কাজে লাগানো সম্ভব।

নবুওয়াত ঘোষণা পর্যন্ত হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনচরিত,আচার-আচরণ ও কার্যকলাপ তাঁর জীবন এবং তাঁর মহৎ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহের পটভূমি আমাদের মানসপটে চিত্রিত করে। তাঁর শৈশবের ইতিহাস অধ্যয়ন ও গভীর চিন্তা-ভাবনা করলে আমরা কেবল তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কেই অবগত হব না;বরং যে দিন তাঁর নবুওয়াত ঘোষিত হয়েছিল এবং তিনি নিজেকে সমাজের নেতা ও পথ-প্রদর্শক বলে ঘোষণা করেছিলেন সে দিন পর্যন্ত তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনেতিহাস তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদের অবগত করে এবং এ থেকে প্রতীয়মান হয়ে যায় যে,এ ব্যক্তি কোন্ কাজের জন্য সৃষ্ট হয়েছেন? আর তাঁর রিসালাত ও নেতৃত্বের দাবি কি তাঁর জীবন-কাহিনীর সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল? চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর জীবনেতিহাস,তাঁর আচার-আচরণ,চরিত্র,কর্ম,কথা এবং জনগণের সাথে দীর্ঘদিন মেলামেশা তাঁর সত্য নবী ও রাসূল হওয়ার বিষয়টি সমর্থন করে কি?

এ দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা এখানে মহানবীর জীবনের প্রথম দিনগুলো (শৈশব,কৈশোর ও যৌবন) সম্পর্কে আলোচনা করব।

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দাই-মা হযরত হালীমাহ্ তাঁকে পাঁচ বছর লালন-পালন করেছিলেন। এ সময় তিনি খাঁটি বলিষ্ঠ আরবী ভাষা রপ্ত করেছিলেন। সে কারণে তিনি পরবর্তীকালে গৌরববোধ করতেন। পাঁচ বছর পর হযরত হালীমাহ্ তাঁকে পবিত্র মক্কা নগরীতে নিয়ে আসেন। মক্কায় প্রত্যাবর্তন করার পর বেশ কিছুদিন তিনি মাতৃস্নেহ লাভ করেছিলেন এবং এ সময় তিনি দাদা আবদুল মুত্তালিবের তত্ত্বাবধান ও অভিভাবকত্বে লালিত-পালিত হন। হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মক্কাধিপতি হযরত আবদুল মুত্তালিবের কাছে পুত্র আবদুল্লাহর একমাত্র স্মৃতি।145

ইয়াসরিবে সফর

যে দিন আবদুল মুত্তালিবের পুত্রবধু (আমেনা) তাঁর যুবক স্বামীকে হারালেন সে দিন থেকে তিনি সর্বদা ইয়াসরিব গমন করে স্বামীর কবর যিয়ারত এবং সে সাথে ইয়াসরিবস্থ নিজ আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করার উপযুক্ত মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিলেন।

তিনি চিন্তা করে দেখলেন যে,একটি সঠিক সুযোগ এসে গেছে এবং তাঁর প্রাণাধিক পুত্রসন্তান (মুহাম্মদ)ও এখন বড় হয়েছে এবং সেও এ পথে তাঁর শোকের অংশীদার হতে পারবে। তাঁরা  উম্মে আইমানকে সাথে নিয়ে ইয়াসরিবের উদ্দেশে যাত্রা করেন এবং পূর্ণ এক মাস সেখানে অবস্থান করেন। শিশু মহানবীর জন্য এ সফর শোক ও বেদনা বয়ে এনেছিল। কারণ প্রথম বারের মতো তাঁর দৃষ্টি যে ঘরে তাঁর পিতা হযরত আবদুল্লাহ্ ইন্তেকাল করেছিলেন এবং চির নিদ্রায় শায়িত হয়েছিলেন সেই ঘরের দিকে নিবদ্ধ হয়েছিল।146

শিশু মহানবীর অন্তরে পিতৃশোক স্তিমিত হতে না হতেই হঠাৎ আরেকটি হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে গেল। এর ফলে শোক আরো বেড়ে গিয়েছিল। কারণ পবিত্র মক্কায় প্রত্যাবর্তনকালে মহানবীর স্নেহময়ী মা হযরত আমেনা পথিমধ্যে আবওয়া নামক স্থানে ইন্তেকাল করেন।147

এ ঘটনা বনি হাশিম ও আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে শিশু মহানবীকে স্নেহভাজন করেছিল এবং তাঁর প্রতি তাদের সহানুভূতি ও মমতাবোধের উদ্ভব ঘটিয়েছিল। তিনি ছিলেন হযরত আবদুল্লাহ্ ও হযরত আমেনার পুষ্পোদ্যানের একমাত্র পুষ্প-তাঁদের পুণ্যস্মৃতি। এ কারণেই শিশু মহানবী দাদা হযরত আবদুল মুত্তালিবের অশেষ ভালোবাসা ও স্নেহ পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন পিতামহের প্রাণাধিক প্রিয় নাতি। আবদুল মুত্তালিব তাঁকে তাঁর সকল সন্তান অপেক্ষা বেশি ভালোবাসতেন। তিনি সকলের ওপর তাঁকেই অগ্রাধিকার প্রদান করতেন।

কাবার চারদিকে কুরাইশপ্রধান আবদুল মুত্তালিবের জন্য কার্পেট বিছানো হতো। কুরাইশ নেতৃবৃন্দ এবং তাঁর সন্তানগণ তাঁর কার্পেটের চারপাশে বসত। আবদুল্লাহর কথা স্মরণ হলেই তিনি (আবদুল মুত্তালিব) যে কার্পেটের ওপর উপবিষ্ট থাকতেন সে কার্পেটে প্রয়াত পুত্র আবদুল্লাহর একমাত্র স্মৃতি-চি হ্ন শিশু হযরত মুহাম্মদকে এনে তাঁর পাশে বসানোর নির্দেশ দিতেন।148

পবিত্র কোরআনের সূরা দোহায় মহানবী (সা.)-এর শৈশব ও ইয়াতিম অবস্থার কথা উল্লিখিত হয়েছে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ্ বলেছেন,

) أ لم يجدك يتيما فآوى(

“তিনি কি আপনাকে ইয়াতিম পাওয়ার পর (প্রথমে পিতামহ আবদুল মুত্তালিব ও পরে পিতৃব্য হযরত আবু তালিবের) আশ্রয় দেন নি? (সূরা দোহা : 6)

মহানবীর ইয়াতিম হওয়ার অন্তর্নিহিত মূল রহস্য আমাদের কাছে খুব একটা স্পষ্ট নয়। তবে আমরা এতটুকু জানি যে,ঘটনাসমূহ যা সংঘটিত হয়েছে তা প্রজ্ঞাবিহীন নয়। এতদসত্ত্বেও আমরা ধারণা করতে পারি যে,মহান আল্লাহ্ চেয়েছিলেন মানব জাতি ও বিশ্বের মহান নেতা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সকল দায়িত্বভার গ্রহণ এবং নেতৃত্বদান শুরু করার আগেই যেন জীবনের সুখ,শান্তি,মাধুর্য ও তিক্ততার স্বাদ আস্বাদন করেন এবং জীবনের উত্থান-পতনের সাথে পরিচিত হন। এর ফলে তিনি মহান আত্মা এবং অত্যন্ত ধৈর্যশীল হৃদয়ের অধিকারী হতে পারবেন,দুঃখ-কষ্ট ও বিপদাপদ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা অর্জন এবং নিজেকে কঠিন বিপদাপদ,কষ্ট এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য প্রস্তুত করতে পারবেন।

মহান আল্লাহ্ চেয়েছিলেন যেন কারও আনুগত্য তাঁর স্কন্ধের ওপর না থাকে;আর তিনি জন্মগ্রহণের পরপর অর্থাৎ জীবনের শুরু থেকেই যেন স্বাধীন থাকেন। তিনি যেন আত্মগঠনে নিয়োজিত মনীষীদের ন্যায় তাঁর আত্মিক-আধ্যাত্মিক উৎকর্ষের ভিত্তিসমূহ নিজ হাতে গঠন করতে সক্ষম হন। যার ফলে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে,তাঁর প্রতিভা আসলে সাধারণ মানবীয় প্রতিভা নয় এবং তাঁর ভাগ্য নির্মাণের ক্ষেত্রে তাঁর পিতা-মাতার কোন ভূমিকাই ছিল না। তাঁর সকল মর্যাদা আসলে ওহীর উৎসমূল থেকেই উৎসারিত হয়েছিল।

আবদুল মুত্তালিবের মৃত্যু

হৃদয়বিদারক ঘটনাসমূহ সব সময় মানব জীবনের পথ-পরিক্রমণে আবির্ভূত হয়। সেগুলো সমুদ্রের পর্বত প্রমাণ উত্থাল তরঙ্গমালার ন্যায় একের পর এক উত্থিত হয়ে মানুষের জীবন-তরীকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে এবং মানব মনের ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানে।

মহানবী (সা.)-এর অন্তঃকরণে (মায়ের মৃত্যুতে) শোক ও দুঃখ তখনও বিরাজ করছিল ঠিক এমতাবস্থায় তৃতীয় বারের মতো এক বড় বিপদ তাঁর ওপর আপতিত হয়েছিল। তাঁর জীবনের অষ্টম বসন্তকাল অতিবাহিত হতে না হতেই অভিভাবক ও পিতামহ হযরত আবদুল মুত্তালিবকে তিনি হারিয়েছিলেন। আবদুল মুত্তালিবের মৃত্যু তাঁর কোমল আত্মার ওপর এতটা গভীর দাগ কেটেছিল যে,দাদা আবদুল মুত্তালিব যে দিন মৃত্যুবরণ করেছিলেন সে দিন তিনি সমাধিস্থলে তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা পর্যন্ত অশ্রুপাত করেছিলেন এবং তিনি কখনই পিতামহ আবদুল মুত্তালিবকে ভুলেন নি।149


15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53

54

55

56

57

58

59

60

61