চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 103709
ডাউনলোড: 9128


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 103709 / ডাউনলোড: 9128
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

হাবাশা থেকে প্রত্যাবর্তন

পূর্বে আমরা উল্লেখ করেছিলাম যে,হাবাশায় হিজরতকারী মুসলমানদের প্রথম দলটি কুরাইশরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে’-এ মর্মে একটি মিথ্যা সংবাদ শুনে হাবাশা ত্যাগ করে হিজাযে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। কিন্তু হিজাযে প্রবেশকালে তাঁরা জানতে পারলেন যে,ঐ সংবাদটি মিথ্যা ছিল;বরং মুসলমানদের প্রতি কুরাইশদের কঠিন-অমানবিক আচরণ ও চাপ পূর্বের মতো এখনও বহাল আছে। তাই তাঁদের মধ্য থেকে অধিকাংশ হাবাশায় ফিরে গেলেন এবং খুব মুষ্টিমেয় কয়েকজন গোপনে অথবা নেতৃত্বস্থানীয় কুরাইশ ব্যক্তিদের আশ্রয়াধীনে মক্কায় প্রবেশ করলেন।

উসমান ইবনে মাযউন,ওয়ালীদ ইবনে মুগীরার আশ্র্রয়ে মক্কায় প্রবেশ করলেন;আর এ কারণে তিনি শত্রুদের নির্যাতন থেকে নিরাপদ ছিলেন। কিন্তু তিনি নিজ চোখে দেখতে পেতেন যে,অন্যান্য মুসলমান কুরাইশদের দ্বারা অত্যাচারিত ও নির্যাতিত হচ্ছে। এ ধরনের বৈষম্য হযরত উসমানের মনকে খুবই ব্যথিত করল। তিনি ওয়ালীদকে অনুরোধ করলেন যেন সে একটি সাধারণ সমাবেশে ঘোষণা দেয় যে,এরপর থেকে মাযউন তনয় উসমান তার তত্ত্বাবধান ও আশ্রয়ে নেই। এ কথা বলার উদ্দেশ্য ছিল এটি যে,তিনি যেন অন্যান্য মুসলমানের সাথে তাঁদের দুঃখ-কষ্টের অংশীদার হন। তাই ওয়ালীদ মসজিদুল হারামে ঘোষণা করল যে,এখন থেকে উসমান ইবনে মাযউন তার আশ্রয়ে নেই। আর তিনিও (উসমান) বললেন, আমিও তা সত্যায়ন করছি। আর ঠিক তখনই আরবের প্রসিদ্ধ বাগ্মী-কবি লাবীদ মসজিদুল হারামে প্রবেশ করে কুরাইশদের বৃহৎ সমাবেশে তার প্রসিদ্ধ কাসীদা আবৃত্তি শুরু করল। যখন লাবীদ বলল,

ألا كلّ شيء ما خلا الله باطل জেনে রাখ,মহান আল্লাহ্ ব্যতীত সকল বস্তু অমূলক তখন উসমান ইবনে মাযউন বললেন,صدّقت তুমি সত্য বলেছ। লাবীদ দ্বিতীয় পঙ্ক্তি পড়লেন :

و كلّ نعيم لا محالة زائل সকল নেয়ামতই ক্ষণস্থায়ী।’ উসমান ইবনে মাযউন এ কথা শুনে খুবই উত্তেজিত হয়ে বললেন, তুমি ভুল করছ। পরকালের নেয়ামতসমূহ স্থায়ী। উসমানের এ প্রতিবাদ লাবীদের কাছে খুবই অসহনীয় বোধ হলো। তাই সে বলল, হে কুরাইশ গোত্র! তোমাদের অবস্থা দেখছি পরিবর্তিত হয়ে গেছে;এ লোকটি কে? উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি বলল, এ বোকা লোকটি আমাদের ধর্ম থেকে বের হয়ে তার নিজের মতো এক ব্যক্তির অনুসরণ করছে। তার কথায় কান দিও না। এরপর সে উঠে দাঁড়িয়ে উসমান ইবনে মাযউনের মুখে জোরে একটি চড় মারল। আঘাতে তাঁর মুখমণ্ডল কালো হয়ে গেল। ওয়ালীদ ইবনে মুগীরাহ্ তখন উসমান ইবনে মাযউনকে লক্ষ্য করে বলল, উসমান! যদি তুমি আমার আশ্রিত থাকতে তাহলে কখনই কেউ তোমার অনিষ্ট সাধন করতে পারত না। তখন তিনি বললেন, আমি মহান আল্লাহর আশ্রয়ে আছি। ওয়ালীদ তখন পুনরায় বলল, আবারও আমি তোমাকে আশ্রয় দিতে প্রস্তুত। তখন উসমান বললেন, আমি কখনই তা গ্রহণ করব না। 297

মক্কা নগরীতে খ্রিষ্টানদের অনুসন্ধানী দল

মুসলমান মুহাজিরদের প্রচার কার্যের ফলে হাবাশার খ্রিষ্টান ধর্মযাজকদের কেন্দ্রীয় সংস্থার পক্ষ থেকে 20 সদস্য বিশিষ্ট একটি অনুসন্ধানী দল পবিত্র মক্কা নগরী আগমন করে মসজিদুল হারামে মহানবী (সা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করলেন এবং তাঁর কাছে বেশ কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন। মহানবী (সা.) তাঁদের প্রশ্নগুলোর উত্তর দিলেন এবং তাঁদেরকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার আহবান জানালেন। তিনি তাঁদেরকে পবিত্র কোরআনের কতিপয় আয়াত তিলাওয়াত করে শুনালেন।

পবিত্র কোরআনের আয়াতসমূহ তাঁদের মন-মানসিকতার ওপর এতটা প্রভাব বিস্তার করেছিল যে,তাঁরা তাঁদের নয়নাশ্রু থামিয়ে রাখতে পারলেন না। তাঁদের সবাই প্রতিশ্রুত নবীর যে সব নিদর্শন ইঞ্জিল শরীফে পাঠ করেছিলেন সেগুলোর সব ক টি তাঁর মধ্যে বিদ্যমান দেখতে পেলেন।

এ অনুসন্ধানী দলের আগমন ও সাক্ষাৎ আবু জাহলের জন্য খুবই অসহনীয় ও যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার ছিল। সে সম্পূর্ণ উগ্র মেজাজ সহকারে বলল, হাবাশার জনগণ আপনাদেরকে একটি অনুসন্ধানী প্রতিনিধি দল হিসাবে পবিত্র মক্কায় প্রেরণ করেছেন,এটি তো নির্ধারিত ছিল না যে,আপনারা আপনাদের পূর্বপুরুষদের ধর্ম ত্যাগ করবেন। আপনাদের চেয়ে অধিকতর বোকা জনগণ এ ধরণীর বুকে আছে কি না তা আমি ভাবতেই পারছি না।”

মক্কার ফিরআউন আবু জাহল যে উদীয়মান সূর্যের রশ্মি প্রতিহত করতে চেয়েছিল তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের জবাবে হাবাশার অনুসন্ধানী দল অত্যন্ত ধীর ও শান্ত কণ্ঠে বললেন, আমরা আমাদের ধর্মের ওপর এবং আপনারা আপনাদের ধর্মের ওপর বহাল থাকুন,তবে আমরা যে জিনিস বা বিষয় আমাদের জন্য কল্যাণকর বলে চি হ্নিত করব তা আমরা কখনই উপেক্ষা করব না। আর তাঁরা এ কথা বলে আবু জাহলের সাথে আর বিতর্কে জড়ালেন না।298

কুরাইশদের প্রেরিত প্রতিনিধিদল

হাবাশার জনগণের পক্ষ থেকে প্রেরিত অনুসন্ধানী দলটি কুরাইশদের জাগরণের কারণ হয়েছিল। তাই তারাও অনুসন্ধান ও যাচাই-বাছাই করার জন্য হারিস ইবনে নাসর,উকবা ইবনে আবি মুয়ীত প্রমুখ ব্যক্তিগণকে কুরাইশদের তরফ থেকে প্রতিনিধি হিসাবে ইয়াসরিব প্রেরণ করল। উদ্দেশ্য ইয়াসরিব গমন করে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর রিসালাত ও ইসলাম ধর্ম প্রচারের বিষয়টি নিয়ে ইয়াহুদী পণ্ডিতদের সাথে আলোচনা করা। ইয়াহুদী পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ প্রেরিত প্রতিনিধি দলকে বলেছিলেন, নিম্নোক্ত বিষয়গুলো প্রসঙ্গে মুহাম্মদকে জিজ্ঞাসা করবে :

1. আত্মার স্বরূপ (হাকীকত) কি?

2. পূর্ববর্তী যুগে যে সব যুবক জনগণের কাছ থেকে আত্মগোপন করেছিলেন তাঁদের (আসহাব-ই কাহাফ) কাহিনী।

3. যে ব্যক্তি পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিমে ভ্রমণ করেছিলেন তাঁর (যূলকারনাইন) জীবনী।

মুহাম্মদ যদি এ তিনটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে সক্ষম হন তাহলে আপনারা নিশ্চিত বিশ্বাস করবেন যে,সে মহান আল্লাহর মনোনীত। আর এর অন্যথা হলে বুঝতে হবে যে,সে মিথ্যাবাদী। তখন তাকে যত শীঘ্র সম্ভব হত্যা করতে হবে।”

প্রেরিত কুরাইশ প্রতিনিধিগণ অত্যন্ত আনন্দের সাথে মক্কায় ফিরে এসে ঐ তিনটি প্রশ্ন সম্পর্কে কুরাইশদেরকে অবহিত করল। কুরাইশগণ একটি সভার আয়োজন করে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সেখানে আসার আমন্ত্রণ জানাল। মহানবী (সা.) তাদেরকে বললেন, আমি এ তিনটি প্রশ্নের ব্যাপারে ওহীর অপেক্ষা করছি। 299 মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী অবতীর্ণ হলো। আত্মা বিষয়ক তাদের প্রশ্নের উত্তর সূরা ইসরার 85নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। আর তাদের অপর দু টি প্রশ্নের উত্তর সূরা কাহাফে 9-28 নং এবং 83-98 নং আয়াতসমূহে বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। এ তিনটি বিষয়ে মহানবী (সা.)-এর উত্তরের বিস্তারিত বিবরণ তাফসীর গ্রন্থগুলোতে বিদ্যমান রয়েছে।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ না করে পারছি না। আর তা হলো : প্রশ্নের মধ্যে আত্মার (روح ) অর্থ মানবীয় আত্মা’ নয়,বরং যেহেতু এ সব প্রশ্নের উপস্থাপকরা ছিল ইয়াহুদী এবং রুহুল আমীনের সাথে তাদের সম্পর্ক ভালো ছিল না তাই প্রশ্নে উত্থাপিতروح (রূহ) বলতে হযরত জিবরাইল আমীনকেই বুঝানো হয়েছে।

এতৎসংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনা মানশুর-ই জভীদ’ গ্রন্থের 3য় খণ্ডের 204-216 পৃষ্ঠাসমূহে বর্ণিত হয়েছে। আগ্রহী পাঠকবর্গ তা অধ্যয়ন করতে পারেন।

অষ্টাদশ অধ্যায় : মরিচাপড়া অস্ত্রশস্ত্র

কুরাইশ নেতৃবর্গ একত্ববাদী ধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য নিজেদের সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত করছিল। শুরুতে তারা ধনসম্পদ ও নেতৃত্বের প্রলোভন দিয়ে মহানবী (সা.)-কে তাঁর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা থেকে বিরত রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের এ প্রচেষ্টা নিষ্ফল ও ব্যর্থ হয়েছিল। তারা মহান আল্লাহর শপথ,যদি আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চন্দ্রও স্থাপন কর (অর্থাৎ সমগ্র পৃথিবী আমার কর্তৃত্বের মুঠোয় দিয়ে দাও) তবুও এ কাজ (ইসলামের প্রচার) থেকে বিরত থাকব না”-ঐ সংগ্রামী মহাপুরুষের এ প্রসিদ্ধ বাক্যের মুখোমুখি হলো। এরপর তারা তাঁর সঙ্গীসাথীদের হেয় প্রতিপন্ন করতে তাঁদের ওপর নির্যাতন চালাতে লাগল। আর তারা মহানবী (সা.) এবং তাঁর সাহাবীদেরকে একটি মুহূর্তের জন্যও কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকত না। কিন্তু তাঁর ও তাঁর নিষ্ঠাবান সঙ্গী-সাথীদের দৃঢ়তা,সাহসিকতার কারণে এ ক্ষেত্রেও বিজয়ী হয়েছিলেন। এমনকি ইসলাম ধর্মে তাঁদের অবিচল থাকার জন্য তাঁরা নিজেদের বসত-বাটি,দেশ ও জন্মভূমি ত্যাগ করে হাবাশায় হিজরত পর্যন্ত করেছিলেন এবং এভাবে তাঁরা সত্য ধর্ম ইসলাম প্রচার করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছিলেন। তাওহীদের পবিত্র বৃক্ষের মূলোৎপাটন করার জন্য কুরাইশ নেতৃবর্গের বিভিন্ন পরিকল্পনা তখনও সমাপ্ত হয় নি,বরং এবার তারা এগুলোর চাইতেও আরো ধারালো হাতিয়ার ব্যবহার করল।

আর এই হাতিয়ারটি ছিল মহানবী (সা.)-এর বিরুদ্ধে প্রচারণা। কারণ এটি ঠিক যে,যারা মক্কায় বসবাস করত,নির্যাতন করে ও অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদেরকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখা যেত;কিন্তু পবিত্র কাবায় যিয়ারতকারিগণ যারা নিষিদ্ধ মাসগুলোতে পবিত্র মক্কা নগরীতে আসত তারা শান্ত ও নিরাপদ পরিবেশের মধ্যে মহানবীর সাথে দেখা করত এবং তাঁর ধর্ম প্রচার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যেত। আর তারা যদি তাঁর ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন নাও করত তবুও তারা তাদের নিজেদের ধর্মের (মূর্তিপূজা ও শিরক) ব্যাপারে শিথিল ও সন্দিহান হয়ে যেত। নিজেদের জন্মভূমিতে প্রত্যাবর্তন করার পর তারা মহানবীর বার্তাবাহক হয়ে যেত এবং মহানবীর আবির্ভাবের সুসংবাদ প্রদান করত। আর এভাবে মহানবী (সা.) ও ইসলাম ধর্মের নাম আরব উপদ্বীপের সকল স্থানে পৌঁছে যেত। আর এটি মূর্তিপূজারীদের ওপর একটি বিরাট আঘাত এবং তাওহীদ ও ইসলাম ধর্মের প্রসার ও প্রচারের ক্ষেত্রে একটি কার্যকর কারণ বলে বিবেচিত হতো।

কুরাইশ নেতৃবর্গ আরো একটি ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমে হাত দেয়। তারা এর দ্বারা ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসারের পথ বন্ধ করতে এবং মহানবী (সা.)-এর সাথে আরব জাতির সম্পর্কচ্ছেদ করতে চেয়েছিল।

আমরা এখন কুরাইশদের সে সকল ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনা ও কার্যক্রম পাঠকবর্গের সামনে তুলে ধরব।

1. ভিত্তিহীন অপবাদ

কোন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব তার প্রতি তার শত্রুদের গালিগালাজ,কটুক্তি,অপবাদ আরোপ ও অন্যায় আচরণ দ্বারা মূল্যায়ন ও যাচাই করা যেতে পারে। শত্রুরা সর্বদা (জনগণকে) জনমতকে বিভ্রান্ত করার জন্য প্রতিপক্ষকে এমনভাবে দোষী সাব্যস্ত করে যে,এর ফলে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বিষয়াদি প্রচার করে প্রতিপক্ষের মান-মর্যাদা ধ্বংস অথবা ন্যূনতম পর্যায়ে হলেও যতটা সম্ভব তার মর্যাদা ও সম্মান খাটো করতে চায়। জ্ঞানী শত্রু নিজ প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে এমন সব বিষয় সম্পর্কযুক্ত করার চেষ্টা করে যে,অন্তত সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণী সেগুলো বিশ্বাস করবে অথবা সেগুলোর সত্য-মিথ্যা হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করবে। যে সব সম্পর্ক ও সংশ্লিষ্টতা কখনই প্রতিপক্ষের সাথে খাপ খায় না এবং তার মন-মানসিকতা,মানসিক শক্তি এবং প্রসিদ্ধ কার্যকলাপসমূহের সাথে কোন বাস্তব সম্পর্ক নেই শত্রুরা সেই সব বিষয় তার ওপর আরোপ করে না;কারণ এমতাবস্থায় এর পরিণতি হবে উল্টো ও অনাকাঙ্ক্ষিত।

এতৎসংক্রান্ত গবেষক ঐতিহাসিক এ সব মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অপবাদ আরোপের পেছনে প্রতিপক্ষের প্রকৃত চেহারাটিই দেখতে পান,এমনকি শত্রুর দৃষ্টিকোণ থেকেই তাঁর সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদা এবং তাঁর মানসিকতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হন। কারণ কোন বেপরোয়া শত্রু-যে অপবাদ তার নিজের স্বার্থানুকূলে রয়েছে-প্রতিপক্ষের ওপর তা আরোপ করার ব্যাপারে চেষ্টার কোন ত্রুটি করবে না। আর সে প্রচারণার তীক্ষ্ণ অস্ত্র যতদূর পর্যন্ত তার চিন্তা-ভাবনা,উপলব্ধি ও সঠিক সুযোগ সংক্রান্ত জ্ঞান তাকে অনুমতি দেবে ততদূর সে তা সর্বোচ্চ মাত্রায় সদ্ব্যবহার করবেই। অতঃপর শত্রু যদি তার প্রসঙ্গে কোন অশালীন উক্তি ও অপবাদ আরোপ না করে তা আসলে এ দৃষ্টিকোণ থেকে যে,তার ব্যক্তিসত্তা আসলে এসব অবৈধ-অনৈতিক চারিত্রিক দোষ ও সম্পর্কের দ্বারাই সজ্জিত;আর সমাজও তার কথা ও আদর্শের খরিদ্দার নয়।

আমরা যদি ইসলামের ইতিহাসের পাতা উল্টাই তাহলে দেখতে পাব যে,কুরাইশগণ অস্বাভাবিক ধরনের শত্রুতা ও জিঘাংসার মনোবৃত্তির অধিকারী হয়েও যেমন করেই হোক না কেন নব্য প্রতিষ্ঠিত ইসলাম ধর্মের ধ্বংস সাধন এবং এ ধর্মের প্রবর্তনকারীর ব্যক্তিত্ব ও মান-মর্যাদা ক্ষুন্ন করতে চাইত এতদ্সত্ত্বেও তারা পূর্ণরূপে এ হাতিয়ার বা অস্ত্র (অর্থাৎ প্রচারণা) ব্যবহার করতে সক্ষম হয় নি। তারা নিজেরাই চিন্তা করে কূল পেত না যে,তারা কি বলবে? তারা কি তাঁকে অর্থ কেলেঙ্কারী ও আত্মসাতের অভিযোগে অভিযুক্ত করবে,অথচ তখনও তাদের (কুরাইশদের) কারো কারো ধন-সম্পদ তাঁর ঘরেই আমানত হিসাবে গচ্ছিত ছিল এবং তাঁর চল্লিশ বছরের জীবন আপামর জনতার চোখে তাঁকে আল আমীন’ বলে প্রতীয়মান ও প্রতিষ্ঠিত করেছিল?

তারা কি তাঁকে কামুক ইন্দ্রিয়পরায়ণ’ বলে অভিযুক্ত করবে? তারা কিভাবে এ কথা মুখে উচ্চারণ করবে? কারণ তিনি কিছুটা হলেও তাঁর যৌবনকাল একজন বয়স্কা রমণীর সাথে শুরু করেছিলেন এবং ঐ দিন পর্যন্তও যখন তাঁর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালনোর জন্য কুরাইশদের পরামর্শ সভার আয়োজন করা হয়েছিল তিনি ঐ স্ত্রী নিয়েই বৈবাহিক জীবনযাপন করে যাচ্ছিলেন। অবশেষে তারা চিন্তা-ভাবনা করল যে,তারা কি বলবে যা মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে ভালোভাবে খাপ খায় এবং যার ফলে ন্যূনতম হলেও জনগণ তা শতকরা এক ভাগ সত্য হতে পারে বলে ধারণা করবে। অবশেষে দারুন নাদওয়ার নেতারা কিভাবে এ ধরনের হাতিয়ার ব্যবহার করবে সে ব্যাপারে বিভ্রান্ত ছিল। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে,তারা এ ব্যাপারটি একজন কুরাইশ নেতার কাছে উত্থাপন করে এ ব্যাপারে তার অভিমতটিই বাস্তবায়ন করবে। সভা অনুষ্ঠিত হলো। ওয়ালীদ কুরাইশদের দিকে মুখ করে বলল, হজ্বের দিনগুলো অতি নিকটে। আর এ দিনগুলোতে হজ্বের করণীয় ও আমলসমূহ আঞ্জাম দেয়ার জন্য (বিভিন্ন স্থান থেকে) জনগণ শহরে সমবেত হবে। আর মুহাম্মদও হজ্ব মওসূমের স্বাধীনতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে তার নিজ ধর্ম প্রচার কাজে আত্মনিয়োগ করবে। কতই না উত্তম হবে যদি কুরাইশ নেতৃবর্গ তার ও তার নতুন ধর্মের ব্যাপারে তাদের চূড়ান্ত অভিমত ব্যক্ত করেন এবং তার ব্যাপারে একটি ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেন! কারণ তাদের মধ্যকার মতবিরোধ তাদের বক্তব্য ও অভিমতকে অকার্যকর করে দেবে।”

আরবদের প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিটি চিন্তায় ডুবে গেল এবং বলতে লাগল, আমাদের কি বলা উচিত? একজন বলল, তাকে (মুহাম্মদকে) আমরা গণক বলতে পারি। 300 সে এ ব্যক্তির বক্তব্য অপছন্দ করে বলল, মুহাম্মদ যা কিছু বলে তা জ্যোতিষী ও গণকদের বাণীর মতো নয়। আরেকজন প্রস্তাব দিয়ে বলল, আমরা তাকে পাগল বলতে পারি। এ প্রস্তাবটিও ওয়ালীদের পক্ষ থেকে প্রত্যাখ্যাত হলো এবং সে বলল, তার মধ্যে পাগলামীর লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। অনেক আলোচনা-পর্যালোচনার পর সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হলো যে,তারা তাঁকে যাদুকর’ বলে অভিহিত করবে। কারণ তাঁর কথায় যাদু আছে। আর এর দলিল হচ্ছে এই যে,তিনি তাঁর কোরআনের মাধ্যমে মক্কাবাসীদের মধ্যে অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টি করেছেন301 ,অথচ এর আগে মক্কাবাসীদের মধ্যকার ঐক্য প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়েছিল।

সূরা মুদ্দাসসিরের তাফসীর প্রসঙ্গে মুফাসসিরগণ এ বিষয়টি আরেকভাবেও বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন, যখন ওয়ালীদ সূরা ফুসসিলাতের কয়েকটি আয়াত মহানবী (সা.)-এর কাছ থেকে শুনল তখন সে অত্যন্ত প্রভাবিত হলো এবং তার শরীরের লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেল। সে বাড়ির দিকে ছুটে পালাল এবং বাড়ি থেকে বাইরে বের হলো না। কুরাইশরা তাকে মস্করা করে বলেছিল : ওয়ালীদ মুহাম্মদের ধর্ম গ্রহণ করেছে। তারা দলবেঁধে ওয়ালীদের বাড়িতে গেল এবং তার কাছে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র কোরআনের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইল। উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের মধ্য থেকে যে কেউই উল্লিখিত বিষয়াদির কোন একটি উল্লেখ করেছিল ওয়ালীদ সেটিই প্রত্যাখ্যান করছিল। অবশেষে সে অভিমত ব্যক্ত করে বলল, তাদের মধ্যে সে যে অনৈক্য ও বিভেদ ঘটিয়েছে সে কারণেই তাকে তোমরা যাদুকর বলবে এবং বলবে : তার কণ্ঠে যাদু আছে।”

মুফাসসিরগণ বিশ্বাস করেন যে,নিম্নলিখিত আয়াতগুলো তার (ওয়ালীদ) ব্যাপারেই অবতীর্ণ হয়েছে :

) ذَرني ومَنْ خلقْتُ وحيداً وجعلْتُ له مالاً ممْدوداً(

“যেহেতু আমি তাকে অনন্য করে সৃষ্টি করেছি এবং তাকে প্রভূত ধন-সম্পদ দিয়েছি সেহেতু আমাকে ছেড়ে দাও ...। (সূরা মুদ্দাসসির,50 নং আয়াত পর্যন্ত)

সে পবিত্র কোরআন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা ও মূল্যায়ন করল। ধ্বংস হয়ে যাক সে কিভাবেই বা মূল্যায়ন করবে,পুনশ্চঃ সে নিহত হোক সে কিভাবেই মূল্যায়ন করবে;সে ভ্রূকুটি করল এবং মুখ পেচিয়ে বলল এটি স্রেফ একটি যাদু যা সে বর্ণনা করে।302