চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড3%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 106807 / ডাউনলোড: 9707
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

11

মহানবীকে পাগল বলে আখ্যায়িত করা

ইতিহাসে অকাট্যভাবে প্রতিষ্ঠিত আছে যে,মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) যৌবনের সূচনালগ্ন থেকেই জনগণের মাঝে সত্যবাদিতা ও সৎকর্মের জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। এমনকি তাঁর শত্রুরাও তাঁর উত্তম চারিত্রিক গুণাবলীর সামনে শ্রদ্ধাবনত হয়ে যেত। তাঁর অন্যতম মহৎ গুণ ছিল এই যে,সকল মানুষ তাঁকে আস সাদেকুল আমীন’ অর্থাৎ পরম সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত বলে সম্বোধন করত। এমনকি মুশরিকগণও প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের দশ বছর পরেও তাঁর কাছে তাদের অতি মূল্যবান সম্পদ আমানত হিসাবে গচ্ছিত রাখত। যেহেতু তাঁর ইসলাম ধর্ম প্রচার কার্যক্রম শত্রুদের কাছে চরম অসহনীয় হয়ে গিয়েছিল তাই তাদের সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা এ বিষয়ে নিয়োজিত করেছিল যে,যে সব সম্পর্কের দ্বারা জনগণের অন্তরকে সম্পূর্ণরূপে প্রভাবান্বিত করা সম্ভব সেগুলোর মধ্য থেকে কিছু সম্পর্ককে তারা তাঁর থেকে ঘুরিয়ে দেবে। কারণ তারা জানত যে,অন্যান্য সম্পর্ক মুশরিকদের চিন্তা-চেতনায় গুরুত্বহীন হওয়ার কারণে সেগুলো কোন কাঙ্ক্ষিত প্রভাব রাখতে পারবে না। এ কারণেই তারা ইসলামের প্রতি তাঁর আহবান প্রত্যাখ্যান করার কারণ দর্শিয়ে বলতে বাধ্য হয়েছিল যে,তাঁর দাবিগুলোর উৎসমূল হচ্ছে কতকগুলো পাগলামিপূর্ণ চিন্তা-ভাবনা ও কল্পনা যেগুলো তাঁর যুহ্দ (পার্থিব আয়েশ বর্জন) ও সত্যবাদিতার মোটেও পরিপন্থী হবে না এবং এই লোক-দেখানো সম্পর্ক প্রচার করার ক্ষেত্রে তারা (কুরাইশগণ) বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল।

চরম লোক দেখানোর কারণে অপবাদ আরোপের সময় তারা (কুরাইশগণ) পবিত্রতার ভাব ধারণ করত। তারা মহানবীর নবুওয়াতের বিষয়টি সন্দেহ ও সংশয়সহ প্রকাশ করত এবং বলত :

) إفترى على الله كذبا أم به جنّة(

“সে মহান আল্লাহর ওপর অপবাদ আরোপ করছে অথবা উন্মাদনা তার ওপর জেঁকে বসেছে অর্থাৎ সে উম্মাদ ও পাগল হয়ে গেছে।”-(সূরা সাবা : ৮)

এটিই হচ্ছে সত্যের শত্রুদের ব্যবহৃত শয়তানী প্রক্রিয়া যা তারা সর্বদা মহান ব্যক্তিবর্গ ও সমাজ-সংস্কারকদেরকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য ব্যবহার ও প্রয়োগ করে থাকে। আর পবিত্র কোরআন থেকেও আমরা জানতে পারি যে,এ নিন্দিত প্রক্রিয়াটি মহানবীর রিসালাতের যুগের ব্যক্তিদের সাথেই সম্পর্কিত নয়,বরং পূর্ববর্তী যুগসমূহের শত্রুরাও নবীদেরকে প্রত্যাখ্যান করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছে।

উদাহরণস্বরূপ পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে :

) وكذلك ما أتى الذين مِن قبلهم مِن رسولٍ إلّا قالوا ساحرٌ أوْ مجنونٌ، أتواصوا به بل هم قومٌ طاغونَ(

“আর ঠিক একইভাবে পূর্ববর্তী উম্মতসমূহে যখনই কোন রাসূল প্রেরিত হয়েছে তখনই তাঁকে যাদুকর অথবা পাগল বলা হয়েছে;তারা (পূর্ববর্তী উম্মতগণ) কি এ কথা বলার ব্যাপারে অনুরোধ করে নি,বরং তারাই ছিল অবাধ্য-সীমা লঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়। (সূরা যারিয়াত : ৫২-৫৩)

বর্তমানে বিদ্যমান ইঞ্জিলসমূহেও উল্লিখিত আছে যে,হযরত ঈসা মাসীহ্ (আ.) যখন ইয়াহুদী জাতিকে উপদেশ দিলেন তখন তারা বলেছিল, তার মধ্যে শয়তান আছে এবং সে প্রলাপ বকছে। তাহলে কেন তোমরা তাঁর কথা শুনবে? ৩০৩

তাই নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে,কুরাইশরা যদি এ সব অপবাদ ব্যতীত অন্য কোন অপবাদ আরোপ করতে পারত,তাহলে তারা কখনই ঐ অপবাদ আরোপ করা থেকে পিছপা হতো না। কিন্তু মহানবীর  চল্লিশোর্ধ নির্মল পবিত্র গৌরবোজ্জ্বল জীবন তাদেরকে অন্যান্য অপবাদ ও রটনা আরোপ করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করেছে। খুবই ছোট-খাট ও তুচ্ছ ঘটনাকে মহানবীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য কুরাইশগণ সদা প্রস্তুত থাকত। উদাহরণস্বরূপ কখনো কখনো মহানবী (সা.) মারওয়া’ পাহাড়ের কাছে জাবর’ নামের এক খ্রিষ্টান গোলামের সাথে বসতেন। রিসালাতের যুগের শত্রুরা এ ব্যাপারকে তৎক্ষণাৎ পুঁজি করে বলত,এই খ্রিষ্টান গোলামই মহানবীকে পবিত্র কোরআন শিখাচ্ছে। পবিত্র কোরআন তাদের ভিত্তিহীন কথা ও বক্তব্যের জবাব দিয়েছে এভাবে :

) ولقد نعلمُ أنّهم يقولون إنّما يعلِّمه بشرٌ لسانُ الّذي يُلحدون إليه أعجميٌّ وهذا لسانٌ عربيٌّ مبينٌ(

“আমরা নিশ্চিতভাবে জানি যে,তারা (কুরাইশগণ) বলে : একজন মানুষ তাঁকে কোরআন শিখায়;যে ব্যক্তির প্রতি তারা ইঙ্গিত করছে তার ভাষা আজামী (অনারব ভাষা) এবং এ গ্রন্থটি (কোরআন) হচ্ছে অত্যন্ত স্পষ্ট আরবী ভাষায় অবতীর্ণ। (সূরা নাহল : ১০৩)

অবচেতন মনের কাল্পনিক ওহী মতবাদ : পাগলামীর অপবাদ আরোপের উন্নততর ধরন

মহান নবীদের ওহী,বিশেষ করে মহানবী (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ ওহী সম্পর্কে মনগড়া ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য ধর্মবিরোধী নাস্তিক গোষ্ঠীসমূহের অন্যতম প্রচেষ্টা হলো অবচেতন মনের কাল্পনিক ওহী মতবাদ

বিভিন্ন কারণে এ গোষ্ঠীটি মহানবীকে একজন মিথ্যাবাদী ও অপরাধী বলে অভিহিত করতে চায় না;কারণ তাঁর আচার-আচরণ ও কথাবার্তা,তাঁর নিজের বাণীর সত্যতার ব্যাপারে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ও আস্থাকে স্পষ্ট করে উত্থাপন করে। এ কারণেই তারা বিশ্বাস করে যে,তিনি আসলেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন,তিনি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত এবং তাঁর যাবতীয় শিক্ষাও তাঁর কাছ থেকেই প্রাপ্ত। কিন্তু তারা তাঁর ঈমানকে ভিন্ন আরেকটি পথে ব্যাখ্যা করে থাকে। তারা বলে যে,ওহী হচ্ছে মুহাম্মদ (সা.)-এর আত্মারই এক ধরনের আহবান ব্যতীত আর কিছুই নয়। কারণ বছরের পর বছর ধরে চিন্তা-ভাবনা এবং ঐ একই চিন্তা দ্বারা তাঁর আত্মার পরিতুষ্টির কারণে ঐ চিন্তা-ভাবনা তাঁর কাছে বাস্তবরূপ পরিগ্রহ করত এবং যে ব্যক্তি সর্বদা কোন ব্যাপার ও চিন্তার মধ্যে মগ্ন হয়ে যায় তার অন্তরে এ ধরনের শব্দ ঝংকৃত হতে থাকে এবং তার অবচেতন মনের ফেরেশতা ছিল তাঁর অস্তিত্বের সুগভীরে লুক্কায়িত তাঁর আশা-আকাঙ্ক্ষা।

তবে অবশ্যই আমাদের মনে রাখা উচিত যে,এ ধরনের অপব্যাখ্যাও নতুন নয়। রিসালাতের যুগের মুশরিকগণ মহানবী (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ ওহীকে এভাবেও ব্যাখ্যা করত এবং বলত :

) بل قالوا أضْغاثٌ أحلامٍ بلِ افتراه(

“যা কিছু সে (মুহাম্মদ) বলে তা হচ্ছে সব ইতস্তত বিক্ষিপ্ত চিন্তাধারা যা তার কল্পনাপ্রসূত,বরং সে মিথ্যারোপ করেছে। (সূরা আম্বিয়া : ৫)

তারা পবিত্র কোরআনকে কতগুলো ইতস্তত বিক্ষিপ্ত চিন্তাধারা হিসাবে বিবেচনা করত যা অনিচ্ছাকৃতভাবে তাঁর মস্তিষ্কে উদিত হতো এবং তারা তাঁকে এ সব বিষয় সৃষ্টি ও রচনা করার ইচ্ছা পোষণকারী এবং ক্ষমতাবান বলে মনেও করত না। যদিও এ পর্যায় ছাড়িয়েও আরো বহুদূর এগিয়ে গিয়ে কেউ কেউ তাঁর ওপর মিথ্যা বলারও অপবাদ আরোপ করেছে।

পবিত্র কোরআন সূরা নাজমে মহানবী (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ ওহীর বিষয়টি বর্ণনা এবং ওহীর প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচন করেছে। এ গ্রন্থ এ মতবাদটি (অবচেতন মনের কাল্পনিক ওহী মতবাদ) অপনোদন করে বলেছে যে,একদল ব্যক্তি পবিত্র কোরআন ও মহানবীর নবুওয়াতের দাবিকে তাঁর নিজেরই কল্পনার ফসল বলে অভিহিত করে বলে যে,তিনি কল্পনা করেন তাঁর ওপর ওহী অবতীর্ণ হয় অথবা তিনি কোন ফেরেশতাকে দেখতে পান,অথচ কেবল তাঁর কল্পনার জগৎ ব্যতীত আর কোথাও এ ধরনের জিনিসের বাস্তবে কোন অস্তিত্ব নেই।

সূরা নাজমের এ আয়াতগুলো এক ধরনের অনবদ্য শৃঙ্খলা ও সামঞ্জস্যের অধিকারী এবং এমন এক ব্যক্তির আধ্যাত্মিকতা বর্ণনা করছে যিনি বিশেষ বিশেষ অবস্থা ও পরিস্থিতিতে মহান আল্লাহর আধ্যাত্মিক দান ও আশীর্বাদপুষ্ট। পবিত্র কোরআন এ সূরায় অবচেতন মনের কাল্পনিক মতবাদ অপনোদন করে বলেছে :

) والنّجمِ إذا هوى ما ضلَّ صاحبكم وما غوى وما ينطقُ عنِ الهوى إنْ هو إلّا وحيٌ يوحى علّمه شديد القوى ذو مرّةٍ فاستوى وهو بالأُفقِ الأعلى ثمّ دنا فتدلّى فكان قاب قوسينِ أو أدنى فأوحى إلى عبده مآ أوحى ما كذب الفؤادُ ما رأى أفتمارونه على ما يرى ولقد رءاه نزلةً أُخرى عند سدرة المنتهى عندها جنّةُ المأْوى إذ يغشى السّدرةَ ما يغشى مازاغَ البصرُ و ما طغى لقد رأى مِن آياتِ ربِّه الكبرى(

“ঐ তারকার শপথ যখন তা অস্তগামী হয়,তোমাদের বন্ধু পথভ্রষ্ট (হন নি) এবং বিপথগামীও হন নি,তিনি প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার বশবর্তী হয়ে কথা বলেন না,যা কিছু তিনি বলেন তা ওহী ব্যতীত আর কিছুই নয় যা (তাঁর কাছে) প্রেরিত (প্রত্যাদেশ) হয়,এক শক্তিমান সত্তা (ওহীর ফেরেশতা) তাঁকে শিক্ষা দিয়েছেন,সহজাত শক্তিসম্পন্ন,তিনি নিজ আকৃতিতে প্রকাশ পেলেন ঊর্ধ্ব দিগন্তে৩০৪ ,অতঃপর নিকটবর্তী হলেন ও ঝুলে গেলেন,তখন দুই ধনুকের ব্যবধান ছিল অথবা আরো কম,তখন তিনি (ফেরেশতা) তাঁর (মহান আল্লাহর) বান্দার প্রতি যা প্রত্যাদেশ করার তা প্রত্যাদেশ করলেন,(মহানবীর) অন্তর মিথ্যা বলে নি যা তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন,তিনি যা দেখেছেন সে ব্যাপারে কি তোমরা তাঁর সাথে তর্ক করবে? নিশ্চয়ই তিনি আরেকবার তাঁকে দেখেছিলেন সিদরাতুল মুনতাহার (সর্বশেষ দূরত্বে অবস্থিত কুলবৃক্ষ) কাছে,যার কাছে অবস্থিত বসবাসের বেহেশত,যা আচ্ছাদন করে তা-ই কুলবৃক্ষটিকে আচ্ছাদন করে,তাঁর দৃষ্টিভ্রম হয় নি এবং সীমা লঙ্ঘনও করে নি,নিশ্চয়ই তিনি নিজ প্রভুর মহান নিদর্শনসমূহ অবলোকন করেছেন।”

পবিত্র কোরআন এ সব আয়াতে অবচেতন মনের কাল্পনিক ওহী মতবাদ’ এবং পবিত্র কোরআন তাঁর কল্পনার ফসল’-এ ধরনের ধারণার তীব্র নিন্দা করেছে। আর এ মতবাদের সমর্থকগণকে অহেতুক তর্কবিতর্ককারী ও কলহপ্রিয় বলে বিবেচনা করে। তাই পবিত্র কোরআন দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছে যে,মহানবী (সা.)-এর অন্তর যেমন ভুল করে নি,ঠিক তেমনি তাঁর চোখ ও দৃষ্টিশক্তিও ভুল করে নি। উভয় ক্ষেত্রেই দর্শনকার্য সঠিক ও বাস্তব অর্থেই সম্পন্ন হয়েছে। তাই পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে :

) ما كذب الفؤاد ما رأى(

অন্তর যা দেখেছে তা ভুল দেখে নি।

) مازاغ البصرُ وما طغى(

চোখ ও দৃষ্টিশক্তি ভ্রষ্ট ও বিচ্যুত হয় নি এবং (দর্শন ও দৃষ্টি সংক্রান্ত নীতিমালার) লঙ্ঘন করে নি।

আর সব কিছুই সম্পূর্ণরূপেই বাস্তব ছিল;কোন কিছুই এ ক্ষেত্রে অলীক স্বপ্ন ছিল না।

পরোক্ষভাবে মহানবীকে পাগল বলার অপচেষ্টা

জাহেলী আরবগণ যদিও বিভিন্নভাবে মহান আল্লাহর ওহীর অপব্যাখ্যা দিত এবং মহানবীকে মিথ্যারোপকারী বলত অথবা তাঁকে যাদুকর বলে অভিহিত করত;তবু তারা জোর করে মহানবীকে পাগল ও গণক হিসাবেও পরিচিত করাতে চাইত।

তাদের পরিভাষায় পাগল হচ্ছে জ্বিনের আছরগ্রস্ত ব্যক্তি যে তার ওপর জ্বিনের হস্তক্ষেপের ফলে অনুধাবন করার ক্ষমতা ও বোধশক্তি হারিয়ে ফেলে এবং আবোল-তাবোল বকতে থাকে।

গণক হচ্ছে অদৃষ্টবক্তা কোন একটি জ্বিনের সাথে যার সম্পর্ক রয়েছে এবং যাকে বিভিন্ন অবস্থা ও ঘটনার সাথে পরিচিত করায়।

অবশেষে এক পাগল অথবা অদৃষ্টবক্তা গণকের বাণীগুলো কেবল তার নিজের সাথে জড়িত নয়,বরং সেগুলো হচ্ছে ঐ জ্বিনের পক্ষ থেকে প্রক্ষেপস্বরূপ যে তার মন ও কণ্ঠের ওপর আরোপ করে যদিও সে এ ব্যাপারে সচেতন নয়।

জাহেলী আরবগণ জ্ঞান ও বিদ্যা থেকে দূরে থাকা,ধোঁকাবাজি,কূটকৌশল ও ছলচাতুরী থেকে দূরে থাকার কারণে যা কিছু তাদের হৃদয়ে পোষণ করত তা অবাধে বলে ফেলত এবং মহানবী (সা.)-এর সামনে দাঁড়িয়েই বলত :

) وقالوا يا أيُّها الّذي نزّل عليه الذّكرُ إنّك لمجنون(

“হে ঐ ব্যক্তি যার ওপর কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে! নিশ্চয়ই তুমি পাগল। (সূরা হিজর : ৬)

এই অভিযোগ কেবল মহানবী (সা.)-এর সাথেই সংশ্লিষ্ট নয়,বরং মানব জাতির ইতিহাসে বিদ্যমান সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে দেখা যায় যে,সংস্কারকদেরকে অজ্ঞ ও পাগল বলে অভিহিত করা হতো এবং এ ধরনের সম্পর্ক ও উপাধি আরোপ করার অন্তর্নিহিত কারণ ছিল এই যে,জনগণকে তাঁদের কাছ থেকে বিক্ষিপ্ত করে দেয়া যাতে তারা তাঁদের কথা শ্রবণ না করে। পবিত্র কোরআনে মহানবী (সা.)-এর ব্যাপারে এ ধরনের উপাধি ও সম্পর্ক আরোপের বিষয়টি সূরা হিজরের ৬ নং আয়াত,সূরা সাবার ৮ নং আয়াত,সূরা সাফফাতের ৩৬ নং আয়াত,সূরা দুখানের ১৪ নং আয়াত,সূরা তূরের ২৯ নং আয়াত,সূরা কলমের ২ নং আয়াত ও সূরা তাকভীরের ২২ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।

২. পবিত্র কোরআনের বিরোধিতা করার চিন্তা

অপবাদ আরোপের মরিচাধরা হাতিয়ার মহানবী (সা.)-এর ওপর তেমন একটা কার্যকর হয় নি;কারণ জনগণ পূর্ণ বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতা সহকারে অনুভব করতে পেরেছিল যে,পবিত্র কোরআনের এক আশ্চর্যজনক আত্মিক আকর্ষণ ক্ষমতা আছে। আর তারা কখনই এ ধরনের মিষ্টি মধুর বাণী শুনে নি। এ কোরআনের বাণী এতটা গভীর ও মৌলিক যে,তা হৃদয়ে গেঁথে যায়। মহানবীকে দোষী সাব্যস্ত ও তাঁর ওপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে লাভবান না হওয়ার ফলশ্রুতিতেই শত্রুরা আরেক ধরনের শিশুসুলভ ফন্দি-ফিকিরে লিপ্ত হয়। তারা ভেবেছিল যে,তা প্রয়োগ করার মাধ্যমে তারা মহানবীর প্রতি জনগণের মনোযোগ নষ্ট করে দিতে সক্ষম হবে।

নযর বিন হারেস কুরাইশদের অন্যতম বুদ্ধিমান,চতুর ও বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের ব্যক্তিত্ব ছিল। এ ব্যক্তি তার জীবনের একাংশ হীরা ও ইরাকে কাটিয়েছিল। সে ইরানের রাজা-বাদশাহ্ এবং রুস্তম ও ইসফানদিয়ারের মতো সেখানকার সাহসী বীরের অবস্থা এবং মঙ্গল ও অমঙ্গল সংক্রান্ত ইরানীদের বিশ্বাস সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞাত ছিল। মহানবীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য কুরাইশরা তাকে নির্বাচিত করে। তারা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে,নযর বিন হারেস হাটে-বাজারে,পথে-ঘাটে ও অলিতে-গলিতে ইরানী জাতি ও তাদের রাজা-বাদশাহ্দের গল্প ও কাহিনী বর্ণনা করে মহানবী (সা.)-এর বাণী শ্রবণ করা থেকে জনগণকে বিরত রাখবে এবং তাদেরকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করবে। মহানবীর মর্যাদা ও সম্মান কমানোর জন্য এবং পবিত্র কোরআনের বাণী অর্থহীন দেখানোর জন্য সে সব সময় বলত : হে জনগণ! মুহাম্মদের বাণীগুলোর সাথে কি আমার কথাগুলোর কোন পার্থক্য আছে? সে তোমাদের কাছে এমন সম্প্রদায়ের গল্প ও কাহিনী বর্ণনা করে যারা মহান আল্লাহর ক্রোধ,গজব ও আযাবের শিকার হয়েছিল। আর আমিও এমন এক গোষ্ঠীর গল্প ও কাহিনী বর্ণনা করি যারা বিত্তবিভব ও প্রাচুর্যে নিমজ্জিত ছিল এবং দীর্ঘকাল পৃথিবীর বুকে রাজত্ব করেছে।”

এ পরিকল্পনাটি এতটা নির্বুদ্ধিতাপূর্ণ ছিল যে,তা গুটিকতক দিনের বেশি চলে নি। আর স্বয়ং কুরাইশরাও তার কথা শুনে ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং তার থেকে দূরে সরে যায়।

এ প্রসঙ্গে বেশ কিছু আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল। তন্মধ্যে কেবল একটি আয়াতের তরজমা নিচে দেয়া হলো :

) وقالوا أساطيرُ الأوّلينَ اكْتتبَها فهي تملى عليه بكرةً و أصيلاً، قل أنزلَه الّذي يعلمُ السِّرَّ في السّماوات والأرضِ إنّه كان غفوراً رحيما(

“আর তারা বলেছে : এগুলো হচ্ছে পূর্ববর্তীদের গল্প ও কাহিনী যেগুলো সে রচনা করেছে;আর এগুলো সকাল ও সন্ধ্যায় তার ওপর আরোপ করা হয়। আপনি বলে দিন যিনি আকাশসমূহ ও পৃথিবীর সকল রহস্য সম্পর্কে জ্ঞাত তিনিই তা অবতীর্ণ করেছেন;নিশ্চয়ই তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়ালু। (সূরা ফুরকান ৫ ও ৬)৩০৫

বিরোধিতা সত্ত্বেও নিজস্ব অভিমত বজায় রাখা

মহানবী (সা.) খুব ভালোভাবেই জানতেন যে,অধিকাংশ মানুষের মূর্তিপূজা আসলে গোত্রপতিদের অন্ধ অনুসরণ থেকেই উদ্ভূত এবং তাদের অন্তরে তা প্রোথিত নয়। যদি গোত্রপতিদের মধ্যে এমন কোন বিপ্লব সংঘটিত এবং তা সফল হয় যার ফলে দু একজন গোত্রপতি (এ বিপ্লবের সাথে) একাত্ম হয়ে যায় তাহলে অগণিত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এ কারণেই তিনি ওয়ালীদ বিন মুগীরার ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হবার ব্যাপারে বেশ গুরুত্ব দিতেন। এই ওয়ালীদ বিন মুগীরার ছেলে খালিদ ইবনে ওয়ালীদ পরবর্তীতে মুসলমানদের দিগ্বিজয়ী সেনাপতি হয়েছিলেন। ওয়ালীদ ছিল সবচেয়ে বর্ষীয়ান ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব-কুরাইশ বংশের মধ্যে যার ছিল মর্যাদা ও নেতৃত্ব। তাকে আরবদের মধ্যে জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি বলে অভিহিত করা হতো এবং মতবিরোধের ক্ষেত্রে তার অভিমতের প্রতি সম্মান প্রদান করা হতো।

একদিন এক উপযুক্ত মুহূর্তে মহানবী তার সাথে কথা বলছিলেন। ঠিক সে সময় অন্ধ সাহাবী ইবনে উম্মে মাকতূম মহানবী (সা.)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে তাঁকে পবিত্র কোরআনের কিছু অংশ পাঠ করে শোনাতে অত্যন্ত জোরালোভাবে অনুরোধ করলেন। এ কারণেই তিনি ইবনে উম্মে মাকতূম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন,ভ্রূকুটি করলেন এবং তাঁর সাথে কথা বললেন না।

এ ঘটনা ঘটে গেল। কিন্তু মহানবী (সা.) এ অবস্থা ও পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তা করেছিলেন এমনি অবস্থায় সূরা আবাসার প্রথম দিকের ১৪টি আয়াত অবতীর্ণ হলো। এখানে কয়েকটি আয়াতের অনুবাদ দেয়া হলো :

“সে ভ্রূকুটি করল এবং পিঠ ফিরিয়ে নিল এ কারণে যে,তাঁর কাছে একজন অন্ধ (ইবনে উম্মে মাকতূম) এসেছে। আপনি কি জানেন যে,তার অন্তঃকরণ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে পবিত্র হবে এবং তাকে স্মরণ করিয়ে দিলে কি তার কোন লাভ হবে? কিন্তু যে ব্যক্তি নিজের অভাবহীনতা প্রদর্শন করে সে কি আপনার প্রতি আকৃষ্ট হবে ও ঝুঁকে পড়বে? কিন্তু যে ব্যক্তি আপনার কাছে দ্রূত ছুটে আসে এবং (মহান আল্লাহকে) ভয় করে,আপনি কি তাঁর ব্যাপারে উদাসীন থাকবেন? এরকম করবেন না। কারণ এ কোরআন হচ্ছে স্মরণকারী ঐ ব্যক্তির জন্য,যে তা শিখতে চায়...। ৩০৬

প্রখ্যাত শিয়া গবেষক ও পণ্ডিতগণ ইতিহাসের এ অংশটিকে ভিত্তিহীন বলে জানেন এবং এ থেকে মহানবী (সা.)-এর চরিত্র পবিত্র বলে গণ্য করেন। তাঁরা বলেছেন,স্বয়ং এ সব আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় না যে,যে ব্যক্তি ভ্রূকুটি করেছে ও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সে ব্যক্তি ছিল স্বয়ং মহানবী (সা.)। ইমাম জাফর সাদেক (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে,এ সূরায় যে ভ্রূকুটি করেছে ও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সে ব্যক্তিটি ছিল আসলে উমাইয়্যা বংশোদ্ভূত এক ব্যক্তি;যখন ইবনে উম্মে মাকতূম মহানবীর কাছে উপস্থিত হলেন তখন সে-ই তাঁর (ইবনে উম্মে মাকতূমের) প্রতি চরম অবজ্ঞা ও ঘৃণা প্রদর্শন করেছিল।৩০৭

৩. কুরাইশগণ কর্তৃক পবিত্র কোরআন শ্রবণ বর্জন

তাওহীদভিত্তিক ইসলাম ধর্মের প্রসারে বাধা দেয়া এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও সংগ্রামের যে ব্যাপক পরিকল্পনা মক্কার পৌত্তলিকগণ গ্রহণ করেছিল তা একের পর এক বাস্তবায়ন করা হলো। কিন্তু তারা এ সব প্রতিরোধ ও সংগ্রামে ততটা সফল হয় নি এবং তাদের সকল পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র একের পর এক ব্যর্থ হয়ে যায়।

এক যুগ তারা মহানবী (সা.)-এর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাল;কিন্তু কখনই তারা পরিপূর্ণভাবে সফল হয় নি এবং মহানবী (সা.)-কে তারা তাঁর পথ ও আদর্শে অধিকতর অটল ও দৃঢ়তর পেয়েছে এবং প্রত্যক্ষ করেছে যে,ইসলাম ধর্ম দিন দিন প্রসার লাভ করেছে।

কুরাইশ নেতৃবর্গ জনগণকে পবিত্র কোরআন শ্রবণ করা থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের ষড়যন্ত্র যাতে করে পূর্ণরূপে সফল হয় সেজন্য তারা পবিত্র মক্কার সর্বত্র গুপ্তচরদের নিয়োগ করে মহান আল্লাহর ঘর যিয়ারতকারী ও ব্যবসা-বাণিজ্য উপলক্ষে মক্কায় আগত ব্যবসায়ীদেরকে মহানবী (সা.)-এর সাথে যোগাযোগ এবং সম্ভাব্য সকল পন্থায় তাদেরকে পবিত্র কোরআন শ্রবণ করা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছে। এ সব কুরাইশ নেতৃবৃন্দের মুখপাত্র মক্কাবাসীদের মাঝে একটি ঘোষণাপত্র প্রচার করেছিল যার বিষয়বস্তু পবিত্র কোরআন বর্ণনা করেছে :

) وقال الذين كفروا لا تسمعوا لهذا القرآنِ وألْغَوا فيه لعلّكم تغلبون(

“কাফিরগণ বলেছে : এ কোরআন শ্রবণ করো না এবং (কোরআন) তিলাওয়াত করার সময় হৈ চৈ করো,আশা করা যায় যে,তোমরাই বিজয়ী হবে। (সূরা ফুসসিলাত : ২৬)

মহানবী (সা.)-এর সবচেয়ে সফল ও কার্যকর হাতিয়ার যা শত্রুদের মনে এক আশ্চর্যজনক ভীতি ও ত্রাসের সঞ্চার করেছিল তা ছিল এই কোরআন। কুরাইশ নেতৃবর্গ দেখতে পেল যে,মহানবীর অগণিত শত্রু তাঁকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও কষ্ট দেয়ার জন্য তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে যেত;যখনই তাদের কর্ণকুহরে পবিত্র কোরআনের গুটিকতক আয়াতের সুললিত তিলাওয়াত ধ্বনি পৌঁছে যেত তখনই তারা নিজেদের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলত এবং তখন থেকেই তারা তাঁর একনিষ্ঠ সমর্থক হয়ে যেত। এ ধরনের ঘটনাগুলোর যাতে পুনরাবৃত্তি না হয় সেজন্য তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে,পবিত্র কোরআনের আয়াতসমূহ শ্রবণ করা থেকে তারা তাদের অনুসারী ও সমর্থকদেরকে নিষেধ করবে এবং মহানবীর সাথে কথা বলা থেকে তারা বিরত থাকবে।

আইন ভঙ্গকারী আইন প্রণেতাগণ

যে গোষ্ঠীটি তীব্র একগুঁয়েমিবশত জনগণকে মহানবী (সা.)-এর পবিত্র কোরআন শোনা থেকে বিরত রাখত এবং যে ব্যক্তি তাদের গৃহীত এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধাচরণ করত তাকেই তারা অপরাধী বলে গণ্য করত,তারাই কয়েকদিন পরে আইনভঙ্গকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। তারা সর্বসম্মতিক্রমে যে আইনটি অনুমোদন করেছিল কার্যত তারা নিজেরাই গোপনে আইনটি ভঙ্গ করেছিল।

আবু সুফিয়ান,আবু জাহল ও আখনাস বিন শুরাইক একে অপরের অজান্তে এক রাতে ঘর থেকে বের হয়ে মহানবী (সা.)-এর গৃহাভিমুখে রওয়ানা হয়। তাদের প্রত্যেকেই এক এক কোণায় লুকিয়ে থাকে। মহানবী (সা.) যখন রাতের বেলা নামাযে অত্যন্ত আকর্ষণীয় কণ্ঠে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করবেন তখন তা শোনাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। ঐ তিন ব্যক্তি একে অপরের অজান্তে প্রভাত পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করে পবিত্র কোরআন শ্রবণ করতে থাকে। প্রভাতে তারা নিজেদের ঘরে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। পথিমধ্যে তাদের একে অপরের সাথে সাক্ষাৎ হলে তারা পরস্পরকে তিরস্কার করে এবং বলতে থাকে, সরলমনা লোকেরা যদি আমাদের এ কাজের কথা জানতে পারে তাহলে তারা আমাদের ব্যাপারে কি বলবে?

দ্বিতীয় রাতেও এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়। যেন এক অভ্যন্তরীণ আকর্ষণী ক্ষমতা তাদেরকে মহানবীর গৃহাভিমুখে টেনে নিয়ে যেত। ফেরার সময় আবার তিনজনেরই একে অপরের সাথে সাক্ষাৎ হয় এবং তারা নিজেরা একে অপরকে তিরস্কার করতে থাকে। তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে,তারা এ কাজের আর পুনরাবৃত্তি করবে না। কিন্তু পবিত্র কোরআনের আকর্ষণী ক্ষমতা তাদেরকে তৃতীয়বারের মতো পুনরায় একে অপরের অজান্তেই মহানবীর ঘরের চারপাশে জড়ো করেছিল এবং তারা প্রভাত পর্যন্ত মহানবীর পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত শুনতে থাকে। প্রতি মুহূর্তে তাদের মনে ভয়-ভীতি বেড়ে যেতে লাগল এবং তারা নিজেদেরকে নিজেরাই বলতে লাগল যে,যদি মুহাম্মদের পুরস্কার ও শাস্তির অঙ্গীকার সত্য হয় তাহলে জীবনে তারা পাপী ও অপরাধী বলে গণ্য হবে।

দিনের আলোয় চারদিক উজ্জ্বল হয়ে গেলে সরলমনা লোকদের ভয়ে তারা মহানবীর ঘর ত্যাগ করে এবং প্রথম দু বারের মতো এবারেও ফেরার পথে একে অপরের সাথে সাক্ষাৎ হয় এবং তারা স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে,পবিত্র কোরআনের আকর্ষণী ক্ষমতা,আহবান ও বিধি-বিধানের সামনে তাদের প্রতিরোধ করার ক্ষমতা নেই। কিন্তু অপ্রীতিকর ঘটনাবলী প্রতিহত করার জন্য তারা পরস্পর অঙ্গীকারবদ্ধ হয় যে,তারা চিরকালের জন্য এ অভ্যাস ত্যাগ করবে।৩০৮

হাশিম-এর বিবাহ

আমর খাযরাজীর কন্যা সালমা ছিলেন সম্ভ্রান্ত ও ভদ্র রমণী যিনি স্বামীর কাছ থেকে তালাক নেয়ার পর অন্য কোন পুরুষের সাথে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হতে মোটেও রাজী ছিলেন না। একবার শাম সফর শেষে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করার সময় হাশিম কয়েক দিনের জন্য ইয়াসরিবে যাত্রাবিরতি করেছিলেন এবং তখন তিনি সালমাকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। হাশিমের মহৎ চরিত্র,মহানুভবতা,তাঁর বিত্তবিভব,দানশীলতা এবং কুরাইশদের ওপর তাঁর কথার প্রভাব সালমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং দু টি শর্তে তিনি হাশিমের সাথে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হতে রাজী হন। শর্তদ্বয়ের একটি ছিল এই যে,সন্তান প্রসবের সময় তিনি তাঁর গোত্রের কাছে থাকবেন। আর এই শর্তের কারণে মক্কায় হাশিমের সাথে কিছুদিন বসবাস করার পর যখন অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পেল তখন তিনি ইয়াসরিবে প্রত্যাবর্তন করলেন এবং সেখান একটি পুত্রসন্তান প্রসব করলেন যাঁর নাম রাখলেন শাইবাহ্। এ সন্তানই পরবর্তীকালে আবদুল মুত্তালিব নামে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। ঐতিহাসিকগণ তাঁর এ উপাধি লাভ করার কারণ সম্পর্কে ঠিক এ রকম লিখেছেন :

“যখন হাশিম বুঝতে পারলেন যে,তাঁর জীবনের অন্তিম সময় ঘনিয়ে আসছে তখন তিনি তাঁর ভাই মুত্তালিবকে বলেছিলেন : তোমার দাস শাইবাকে অবশ্য অবশ্যই দেখবে। যেহেতু হাশিম (শাইবার পিতা) তাঁর নিজ সন্তানকে মুত্তালিবের দাস বলেছেন এ কারণে তিনি (শাইবাহ্) আবদুল মুত্তালিব’নামে প্রসিদ্ধ হয়ে যান।”

কখনো কখনো তাঁরা বলেছেন, একদিন একজন মক্কাবাসী ইয়াসরিবের সড়কগুলো অতিক্রম করছিল। তখন সে দেখতে পেল যে,অনেক বালক তীর নিক্ষেপ করছে। যখন একটি বালক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হলো তখন সে তৎক্ষণাৎ বলে উঠল : আমি বাতহার নেতার পুত্র। ঐ মক্কাবাসী লোকটি সামনে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল : তুমি কে? তখন সে উত্তরে শুনতে পেল : শাইবাহ্ ইবনে হাশিম ইবনে আবদে মান্নাফ।”

ঐ লোকটি ইয়াসরিব থেকে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করার পর হাশিমের ভ্রাতা ও মক্কা শহরের প্রধান মুত্তালিবের কাছে পুরো ঘটনাটি খুলে বলল। চাচা (মুত্তালিব) তখন আপন ভ্রাতুষ্পুত্রের কথা চিন্তা করতে লাগলেন। এ কারণেই তিনি ইয়াসরিবের উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। ভ্রাতুষ্পুত্রের চেহারা দেখে মুত্তালিবের দু চোখে ভাই হাশিমের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠল,তাঁর দু চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। অত্যন্ত আবেগ,উষ্ণতা ও উদ্দীপনাসহকারে চাচা-ভাতিজা একে অপরকে চুম্বন করলেন। মুত্তালিব ভাতিজাকে মক্কায় নিয়ে যেতে চাইলে শাইবার মা সালমার তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হন। সবশেষে মুত্তালিবের আশা বাস্তবায়িত হলো। মায়ের কাছ থেকে অনুমতি পাবার পর শাইবাকে নিজ অশ্বের পিঠে বসিয়ে মুত্তালিব মক্কাভিমুখে রওয়ানা হলেন। আরবের প্রখর রৌদ্র ভাতিজা শাইবার রূপালী মুখমণ্ডলকে ঝলসে দিয়েছিল এবং তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদও প্রখর তাপে মলিন ও জীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। এ কারণেই মক্কাবাসীরা মক্কায় মুত্তালিবের প্রবেশের সময় ধারণা করল যে,অশ্বারোহী বালকটি মুত্তালিবের দাস। মুত্তালিব যদিও বারবার বলেছিলেন, হে লোকসকল! এ আমার ভাতিজা’,তবুও মানুষের ধারণা ও কথাই শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। পরিণতিতে মুত্তালিবের ভাতিজা শাইবাহ্ আবদুল মুত্তালিব’উপাধিতেই প্রসিদ্ধি লাভ করলেন।103

কখনো কখনো বলা হয় যে,শাইবাকে আবদুল মুত্তালিব’বলে অভিহিত করার কারণ ছিল এই যে,যেহেতু তিনি স্নেহশীল চাচা মুত্তালিবের তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হয়েছিলেন এবং আরবদের প্রচলিত রীতিনীতিতে পালনকারীর অবদান ও পৃষ্ঠপোষকতার কারণে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য এ ধরনের ব্যক্তিদেরকে (যারা পালিত হতো) পালনকারীর দাস বা গোলাম বলে অভিহিত করা হতো।

5. আবদুল মুত্তালিব

হাশিমের পুত্র আবদুল মুত্তালিব ছিলেন মহানবী (সা.)-এর পিতামহ,কুরাইশ গোত্রের অবিসংবাদিত নেতা ও বিরল ব্যক্তিত্ব। তাঁর গোটা সামাজিক জীবনটিই ছিল আলোকময় ঘটনাবলীতে পরিপূর্ণ। যেহেতু তাঁর নেতৃত্বকালীন ঘটনাবলীর সাথে ইসলামের ইতিহাসের অত্যন্ত গভীর সম্পর্ক আছে সেহেতু তাঁর জীবনের কতিপয় ঘটনা আমরা এখানে আলোচনা করব :

নিঃসন্দেহে মানুষের আত্মা যতই শক্তিশালী হোক না কেন পরিণামে সে খানিকটা হলেও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং পরিবেশ ও সমাজের রীতিনীতি তার চিন্তাধারায় অতি সামান্য হলেও প্রভাব বিস্তার করে থাকে। তবে কখনো কখনো এমন কিছু ব্যক্তি আবির্ভূত হন যাঁরা পূর্ণ সাহসিকতার সাথে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের বিভিন্ন প্রভাবকে প্রতিরোধ ও মোকাবিলা করেন এবং যে কোন ধরনের দূষণ দ্বারা বিন্দুমাত্র দূষিত হন না,বরং নিজেদেরকে তা থেকে পবিত্র ও মুক্ত রাখেন।

আমাদের আলোচিত বীরপুরুষ (আবদুল মুত্তালিব) এ ধরনের ব্যক্তিদের অন্যতম পূর্ণ নমুনা। তাঁর সমগ্র জীবন অগণিত আলোকমালায় উদ্ভাসিত। কোন ব্যক্তি আশি বছরের অধিককাল এমন এক সমাজ ও পরিবেশে বসবাস করেও মূর্তিপূজা,মদপান,সুদ খাওয়া,নরহত্যা ও অসৎ কার্যকলাপ ঐ সমাজের পূর্ব থেকে প্রতিষ্ঠিত রীতি-নীতি বলে গণ্য হওয়া সত্ত্বেও সমগ্র জীবনে যদি একবারও মদপান না করে থাকেন,জনগণকে নরহত্যা,মদ্যপান ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখেন,যাদের সাথে বিবাহ নিষিদ্ধ তাদেরকে বিবাহ করা এবং উলঙ্গ দেহে তাওয়াফ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখেন এবং জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজ মানত ও প্রতিজ্ঞার প্রতি অটল ও নিষ্ঠাবান থাকেন তাহলে এ ব্যক্তিটি অবশ্যই ঐ সব আদর্শবান ব্যক্তির অন্তর্ভুক্ত হবেন যাঁদেরকে সমাজে খুব কমই দেখা যায়।

হ্যাঁ,যে ব্যক্তির ঔরসে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র নূর আমানত হিসাবে রাখা হয়েছিল,তিনি অবশ্যই সব ধরনের পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হবেন।

তাঁর সংক্ষিপ্ত জ্ঞানগর্ভমূলক বাণী,ঘটনা ও কাহিনীসমূহ থেকে প্রতিভাত হয় যে,তিনি ঐ অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে থেকেও একত্ববাদী ও পরকালে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি সর্বদা বলতেন, জালেম ব্যক্তি এই ইহলৌকিক জীবনেই কৃতকর্মের শাস্তি পায়। আর ঘটনাক্রমে যদি তার ইহলৌকিক জীবন শেষ হয়ে যায় এবং তার কৃতকর্মের শাস্তি না পায়,তাহলে সে পরকালে শেষবিচার দিবসে অবশ্যই তার কৃতকর্মের সাজাপ্রাপ্ত হবে। 104

হারব ইবনে উমাইয়্যাহ্ আবদুল মুত্তালিবের নিকটাত্মীয় ছিল এবং সে কুরাইশ গোত্রের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হতো। এক ইয়াহুদী তার প্রতিবেশী ছিল। এই ইয়াহুদী একদিন ঘটনাক্রমে তিহামার একটি বাজারে অত্যন্ত নিষ্ঠুর আচরণ প্রদর্শন করে এবং তার ও হারবের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। অবস্থা এতদূর গড়ালো যে,হারবের প্ররোচনায় ঐ ইয়াহুদী নিহত হয়। আবদুল মুত্তালিব ব্যাপারটি জানতে পেরে হারবের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করলেন এবং তার কাছ থেকে ঐ ইয়াহুদীর রক্তমূল্য আদায় করে তা নিহতের আত্মীয়-স্বজনের নিকট পৌঁছে দিলেন। এ ছোট কাহিনী থেকে এ মহান ব্যক্তির দুর্বল-অত্যাচারিতদের রক্ষা ন্যায়পরায়ণতার এক অত্যুজ্জ্বল মনোবৃত্তিই প্রমাণিত হয়।

যমযম কূপ খনন

যে দিন যমযম কূপের উদ্ভব হয়েছিল সে দিন থেকেই জুরহুম গোত্র ঐ কূপের চারপাশে বসতি স্থাপন করেছিল এবং পবিত্র মক্কা নগরীর শাসনকর্তৃত্ব দীর্ঘ দিন তাদের হাতেই ছিল। তারা উক্ত কূপের পানি নিজেদের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করত। কিন্তু পবিত্র মক্কা নগরীতে ব্যবসায় ও জনগণের আমোদ-প্রমোদের প্রসার ঘটলে তাদের শৈথিল্য,উদাসীনতা এবং চারিত্রিক দুর্বলতা ধীরে ধীরে এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয় যে,এর ফলে যমযম কূপের পানি শুষ্ক হয়ে যায়।105

কখনো কখনো বলা হয় যে,জুরহুম গোত্র খুযাআহ্ গোত্রের হুমকির সম্মুখীন হয়ে নিজেদের আবাসস্থল ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। সেহেতু জুরহুম গোত্রপতি মাদ্দাদ ইবনে আমর নিশ্চিত বিশ্বাস করত যে,অতি শীঘ্রই সে তার নেতৃত্ব হারাবে এবং শত্রুদের আক্রমণে তার রাজ্য ও শাসনকর্তৃত্ব ধ্বংস হয়ে যাবে। এ কারণে সে পবিত্র মক্কার জন্য হাদিয়াস্বরূপ স্বর্ণনির্মিত যে দু টি হরিণ এবং খুব দামী যে কয়টি তলোয়ার আনা হয়েছিল তা যমযম কূপে নিক্ষেপ করে কূপটি মাটি দিয়ে ভরাট করে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল যাতে করে শত্রুরা এ মহামূল্যবান সম্পদ ব্যবহার করতে না পারে। এর কিছুদিন পরেই খুযাআহ্ গোত্রের আক্রমণ শুরু হয়। এর ফলে জুরহুম গোত্র এবং হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর অনেক বংশধরই পবিত্র মক্কা নগরী ত্যাগ করে ইয়েমেনের দিকে গমন করতে বাধ্য হয়। তাদের মধ্য থেকে আর কোন ব্যক্তি মক্কায় ফিরে আসে নি। এরপর থেকে মহানবী (সা.)-এর চতুর্থ ঊর্ধ্বতন পূর্বপুরুষ কুসাই বিন কিলাবের শাসনকর্তৃত্ব অর্জন করার মাধ্যমে কুরাইশদের জীবনাকাশে সৌভাগ্য-তারার উদয় হওয়া পর্যন্ত পবিত্র মক্কা নগরীর শাসনকর্তৃত্ব খুযাআহ্ গোত্রের হাতে থেকে যায়। কিছুকাল পরে শাসনকর্তৃত্ব আবদুল মুত্তালিবের হাতে চলে আসে। তিনি যমযম কূপ পুনরায় খনন করার সিদ্ধান্ত নেন। তবে তখনও যমযম কূপের আসল অবস্থান সূক্ষ্মভাবে কেউ জানত না। অনেক অনুসন্ধান চালানোর পর তিনি যমযম কূপের প্রকৃত অবস্থান সম্পর্কে তথ্য পেলেন এবং নিজ পুত্র হারেসকে নিয়ে কূপ খননের পূর্বপ্রস্তুতি সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

সাধারণত প্রতিটি গোত্র বা সমাজেই এমন কিছু মুষ্টিমেয় লোক পাওয়া যাবে যারা সব সময় যে কোন ভালো কাজ বাধাগ্রস্ত করার জন্য যে কোন ধরনের নেতিবাচক অজুহাত খুঁজে বেড়ায়। এ কারণেই আবদুল মুত্তালিবের প্রতিদ্বন্দ্বীরা ঘোর আপত্তি জানাতে থাকে যাতে করে তিনি এ বিরল সম্মান ও গৌরবের অধিকারী না হতে পারেন। তারা আবদুল মুত্তালিবকে লক্ষ্য করে বলেছিল, হে কুরাইশপ্রধান! যেহেতু এ কূপ আমাদের পূর্বপুরুষ হযরত ইসমাঈলের পুণ্যস্মৃতি এবং আমরা সবাই যেহেতু তাঁরই বংশধর তাই আমাদের সবাইকে এ কাজে শরীক করুন। বিশেষ কতিপয় কারণে হযরত আবদুল মুত্তালিব তাদের কথা মেনে নিলেন না। কারণ তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এটিই যে,তিনি একাই এ কূপটি খনন করবেন এবং এর পানি বিনামূল্যে সকলের হাতে ছেড়ে দেবেন। আর এভাবেই বাইতুল্লাহ্ যিয়ারতকারী হাজীদের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানিরও সুব্যবস্থা হয়ে যাবে। হাজীদের পানির বন্দোবস্ত করার বিষয়টি তাঁর তত্ত্বাবধানে থাকার কারণে তা সব ধরনের অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা থেকে মুক্ত হবে।

যখন তিনি স্বাধীনভাবে এ কাজের গুরুদায়িত্ব নিজ হাতে নেবেন ঠিক তখনই এ বিষয়টির পূর্ণ নিশ্চয়তা বিধান করা সম্ভব হবে।

অবশেষে তাঁরা একটি তীব্র বিরোধ ও টানাপড়েনের সম্মুখীন হলেন। আরবের একজন জ্ঞানী ভাববাদীর কাছে যাওয়া এবং এ ব্যাপারে তার বিচার মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। আবদুল মুত্তালিব ও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা সফরের উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। তাঁরা হিজায ও শামের মধ্যবর্তী ফুল-ফল,পত্র-পল্লবহীন ধূসর মরু এলাকাগুলো একের পর এক অতিক্রম করতে লাগলেন। পথিমধ্যে তাঁরা অত্যন্ত পিপাসার্ত ও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন এবং ধীরে ধীরে তাঁদের বিশ্বাস জন্মেছিল যে,তাঁরা তাঁদের অন্তিম মুহূর্তগুলো অতিবাহিত করছেন। এ কারণেই তাঁরা যখন মৃত্যুর কথা চিন্তা করতে থাকেন,তখন আবদুল মুত্তালিব এ অভিমত ব্যক্ত করলেন যে,প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজ কবর খনন করুক। যখন তার মৃত্যু হবে তখন অন্যরা তার মৃতদেহ উক্ত কবরে শায়িত করবে। আর এভাবে যদি পানি পাওয়া না যায় এবং সকলের তৃষ্ণা অব্যাহত থাকে এবং সবাই মৃত্যুবরণ করে তাহলে এভাবে সকলেই (কেবল শেষ ব্যক্তি ব্যতীত) কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত হবে এবং তাদের মৃতদেহ হিংস্র প্রাণী ও পাখির খাদ্যবস্তুতে পরিণত হবে না।

আবদুল মুত্তালিবের অভিমত সকলের কাছে মনঃপূত হলো। প্রতিটি ব্যক্তি তার নিজের কবর খনন করল এবং সকলেই বিষণ্ণ বদনে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। হঠাৎ করে আবদুল মুত্তালিব উচ্চকণ্ঠে বললেন, হে লোকসকল! এটি এমনই এক মৃত্যু যা হীনতা ও দীনতা বয়ে আনে। তাই এটি কতই না উত্তম যে,আমরা সবাই দলবদ্ধ হয়ে এ মরুভূমির চারপাশে পানির অন্বেষণে ঘুরে বেড়াব! আশা করা যায় যে,মহান আল্লাহ্পাকের অনুগ্রহ ও কৃপার দৃষ্টি আমাদের ওপর পতিত হবে। 106 সবাই পশুর পিঠে আরোহণ করে হতাশা নিয়ে পথ চলতে লাগল এবং তখন তারা একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিল। ঘটনাক্রমে সবাই অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে সুমিষ্ট পানির সন্ধান পেয়ে গেল এবং তারা সবাই মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেল। এরপর তারা যে পথে এসেছিল সে পথেই পবিত্র কাবার দিকে ফিরে গেল এবং পূর্ণ সন্তুষ্টচিত্তে যমযম কূপ খনন করার ব্যাপারে আবদুল মুত্তালিবের অভিমতের সাথে একমত পোষণ করল এবং সম্মত হলো।107

আবদুল মুত্তালিব একমাত্র পুত্রসন্তান হারেসকে সাথে নিয়ে কূপ খননে মশগুল হয়ে যান। খনন কার্য চালানোর ফলে কূপের চারদিকে মাটির একটি প্রকাণ্ড ঢিবি তৈরি হয়েছিল। হঠাৎ করে তিনি স্বর্ণনির্মিত দু টি হরিণ এবং কয়েকটি তলোয়ারের সন্ধান পান। কুরাইশগণ নতুন করে হৈ চৈ শুরু করে দিল এবং সকলেই প্রাপ্ত গুপ্তধনে নিজেদের অংশ আছে বলে দাবি করতে লাগল। তারা তাদের মাঝে লটারী করার সিদ্ধান্ত নিল। ঘটনাক্রমে লটারীতে ঐ দু টি স্বর্ণনির্মিত হরিণ এবং তরবারিগুলো যথাক্রমে পবিত্র কাবা ও আবদুল মুত্তালিবের নামেই উঠল। কুরাইশদের নামে লটারীতে কিছুই উঠল না এবং এ কারণে তারা উক্ত গুপ্তধন থেকে কোন অংশ পেল না। মহামতি আবদুল মুত্তালিব উক্ত তরবারিগুলো দিয়ে পবিত্র কাবার একটি দরজা নির্মাণ করে হরিণ দু টি ঐ দরজার ওপর স্থাপন করেছিলেন।

চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্দেশ্যে আত্মত্যাগ ও নিষ্ঠা

যদিও অন্ধকার যুগের আরবগণ ছিল চরম নৈতিক অবক্ষয়ের শিকার এবং চরমভাবে অধঃপতিত তবুও তাদের মধ্যে কতিপয় চারিত্রিক গুণ ছিল যা প্রশংসনীয়। যেমন চুক্তি ভঙ্গ করা তাদের কাছে সবচেয়ে ঘৃণ্য ও খারাপ কাজ বলে গণ্য হতো। কখনো কখনো আরব গোত্রগুলো নিজেদের মধ্যে অত্যন্ত কঠিন চুক্তি সম্পাদন করত এবং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সেগুলো মেনে চলত। কখনো কখনো তারা শক্তি নিঃশেষকারী নজর করত এবং চরম কষ্ট ও প্রাণান্তকর পরিশ্রমসহকারে তা বাস্তবায়ন করার ব্যাপারে চেষ্টা করত।

আবদুল মুত্তালিব যমযম কূপ খনন করার সময় উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে,বেশি সন্তান না থাকার কারণে কুরাইশদের মধ্যে তিনি দুর্বল ও অক্ষম। এ কারণেই তিনি নজর করেছিলেন যে,যখনই তিনি দশ সন্তানের পিতা হবেন তখন তিনি কাবা গৃহের সামনে যে কোন একজনকে কোরবানী করবেন। তিনি তাঁর এ নজর সম্পর্কে কাউকে অবহিত করেন নি। কিছুকাল পরে তাঁর সন্তানের সংখ্যা দশ হলে তাঁর নজর পূর্ণ করার সময়ও উপস্থিত হলো। আবদুল মুত্তালিবের জন্য এ বিষয়টি চিন্তা করা অত্যন্ত কঠিন ছিল। তবে তাঁর মধ্যে ভয়ও কাজ করছিল যে,পাছে তিনি যদি তাঁর এ নজর আদায় করার ক্ষেত্রে সফল না হন তাহলে এর পরিণতিতে তিনি প্রতিজ্ঞা ভঙ্গকারীদের কাতারে শামিল হয়ে যাবেন। এ কারণেই সন্তানদের সাথে বিষয়টি উত্থাপন ও আলোচনা এবং তাঁদের সম্মতি ও সন্তুষ্টি আদায় করার পর লটারীর মাধ্যমে তাঁদের মধ্য থেকে একজনকে কোরবানীর জন্য মনোনীত করবেন।108

লটারীর আয়োজন করা হলো। লটারীতে মহানবী (সা.)-এর পিতা হযরত আবদুল্লাহ্-এর নাম উঠলে আবদুল মুত্তালিব তৎক্ষণাৎ তাঁর হাত ধরে তাঁকে কোরবানী করার স্থানে নিয়ে গেলেন। কুরাইশ গোত্রের নর-নারীরা উক্ত নজর ও লটারী সম্পর্কে অবগত হলে যুবকদের চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। এক যুবক তখন বলছিল, হায় যদি এ যুবকের বদলে আমাকে জবাই করা হতো!

কুরাইশ দলপতিগণ বলতে লাগল, যদি আবদুল্লাহর পরিবর্তে সম্পদ উৎসর্গ করা যায় তাহলে আমরা আমাদের ধন-সম্পদ তার অধিকারে ছেড়ে দিতে প্রস্তুত আছি।” আবদুল মুত্তালিব জনতার আবেগ ও অনুভূতির উত্তাল তরঙ্গমালার সামনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন এবং চিন্তা করতে লাগলেন পাছে যদি তাঁর অঙ্গীকার ভঙ্গ হয়ে যায়,এতদ্সত্ত্বেও তিনি এর একটি উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে লাগলেন। তাদের মধ্যে থেকে একজন বলল, এ সমস্যাটি আরবের একজন জ্ঞানী ব্যক্তির কাছে উত্থাপন করুন,তাহলে এ ব্যাপারে তিনি একটি পথ বাতলে দিতে পারবেন।” আবদুল মুত্তালিব এবং কুরাইশ নেতৃবর্গ এ প্রস্তাবে সম্মত হলেন এবং ইয়াসরিবের উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। সেখানে ঐ জ্ঞানী ব্যক্তি বসবাস করতেন। সমস্যার সমাধান দেয়ার জন্য তিনি একদিন সময় চাইলেন। পরের দিন সবাই তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হলে তিনি বললেন, আপনাদের নিকট একজন লোকের রক্তমূল্য কত? তখন তাঁরা বললেন, 10টি উট।” গণক বললেন, দশটি উট ও যে ব্যক্তিকে আপনার কোরবানীর জন্য মনোনীত করেছেন তার মধ্যে লটারী করবেন। লটারীতে ঐ ব্যক্তির নাম উঠলে উটগুলোর সংখ্যা দ্বিগুণ করবেন এবং পুনরায় উটগুলো ও ঐ ব্যক্তির  মধ্যে লটারী করুন। এতে যদি লটারীতে পুনরায় ঐ ব্যক্তির নাম আসে তাহলে উটগুলোর সংখ্যা তিনগুণ করুন এবং পুনরায় ঐ ব্যক্তি ও উটগুলোর মধ্যে লটারী করুন। আর এভাবে লটারীতে উটগুলোর নাম ওঠা পর্যন্ত লটারী করে যান।

গণকের এ প্রস্তাব জনতার আবেগ-অনুভূতি ও উৎকণ্ঠাকে মুহূর্তের মধ্যে বিলীন করে দিল। কারণ আবদুল্লাহর মতো যুবককে রক্তাক্ত দেখার চাইতে তাদের কাছে শত শত উট কোরবানী করা অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল। মক্কায় ফেরার পর একদিন প্রকাশ্যে সকলের মাঝে লটারী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। দশম বারে উটসংখ্যা 100-এ উপনীত হলে লটারীতে উটগুলোর নাম উঠল। আবদুল্লাহর জবাই থেকে মুক্তি প্রাপ্তি এক অভিনব আবেগ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করল। কিন্তু আবদুল মুত্তালিব তখন বললেন, আমার স্রষ্টা এ কাজে পূর্ণ সন্তুষ্ট আছেন এ বিষয়টি নিশ্চিতরূপে না জানা পর্যন্ত আমি অবশ্যই লটারীটির পুনরাবৃত্তি করব।” তিনি তিন বার লটারী করলেন এবং তিন বারই উটগুলোর নাম উঠল। এভাবে তিনি পূর্ণরূপে নিশ্চিত হতে পারলেন যে,মহান আল্লাহ্ এ ব্যাপারে সন্তুষ্ট আছেন। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত উটগুলো থেকে 100টি উট কাবাগৃহের সামনে জবাই করার এবং কোন ব্যক্তি বা পশুকে তা ভক্ষণ করা থেকে বাধা না দেয়ার নির্দেশ দিলেন।109


14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53

54

55

56

57

58

59

60

61