চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড3%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 106663 / ডাউনলোড: 9682
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

আরবের ধর্মীয় অবস্থা

যখন হযরত ইবরাহীম (আ.) তাওহীদের পতাকা হিজায অঞ্চলে উড্ডীন এবং পুত্র ইসমাঈল (আ.)-এর সহায়তায় পবিত্র কাবা পুনঃর্নিমাণ করলেন তখন একদল লোক তাঁর সাথে যোগ দিয়েছিল এবং তাঁর বরকতময় পবিত্র অস্তিত্বের আলোক প্রভায় অনেক মানুষের অন্তর আলোকিত হয়েছিল। তবে সঠিকভাবে জানা যায় নি যে,স্বর্গীয় ব্যক্তিত্ব হযরত ইবরাহীম (আ.) কতদূর ও কি পরিমাণ তাওহীদী ধর্ম ও মতাদর্শ প্রচার এবং সেখানে তাওহীদবাদী পূজারীদের দৃঢ় সমাজ গঠন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। হযরত আলী (আ.) আরব জাতি ও গোত্রসমূহের ধর্মীয় অবস্থার বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন :

و أهل الأرض يومئذ ملل متفرّقة و الهواء منتشرة و طوائف متشتّتة بين مشبّه لله بخلقه أو ملحد في اسمه أو مشير إلى غيره فهداهم به من الضّلالة و انقذهم من الجهالة

“তখন (অন্ধকার যুগে) আরব জাতি বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী ছিল। তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের বিদআত (ধর্ম বহির্ভূত প্রথা) প্রচলিত ছিল এবং তারা বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল। একদল লোক মহান আল্লাহকে তাঁর সৃষ্টির সাথে তুলনা করত (এবং মহান আল্লাহর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অস্তিত্বে বিশ্বাস করত)। কেউ কেউ মহান আল্লাহর নামের ক্ষেত্রেও হস্তক্ষেপ করত [যেমন মূর্তিপূজকরা লাত (لات ) মূর্তির নাম আল্লাহ্’শব্দ থেকে এবং প্রতিমা উয্যার (عزّى ) নাম নবী উযাইর’(عزير ) থেকে নিয়েছিল]। আবার কতিপয় ব্যক্তি আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য সত্তার দিকে ইশারা-ইঙ্গিত করত;অতঃপর এদের সবাইকে আল্লাহ্ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে সৎ পথের সন্ধান দিলেন-সৎ পথে পরিচালিত করলেন এবং তাদেরকে পথভ্রষ্টতা ও অজ্ঞতা থেকে মুক্তি দিলেন। ২১

আরবের চিন্তাশীল শ্রেণীও চাঁদের উপাসনা করত। আরবের প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক কালবী ( মৃত্যু ২০৬ হি .) লিখেছেন : বনি মালীহ্ গোত্র ( بني مليح ) জ্বিনপূজারী ছিল। হিময়ার গোত্র   (حمير )সূর্য , কিনানাহ্ গোত্র  (كنانة )চাঁদ , তামীম গোত্র (تميم )আলদেবারান ( Al-debaran ),লাখম গোত্র (لخم )বৃহস্পতি , তাই গোত্র ( طي ) শুকতারা , কাইস গোত্র   ( قيس ) শে রা নক্ষত্র ( Dogstar) এবং আসাদ গোত্র ( أسد ) বুধ গ্রহের পূজা করত।

কিন্তু নিম্নশ্রেণীর লোক যারা আরবের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল তারা তাদের গোত্রীয় ও পারিবারিক প্রতিমা ছাড়াও বছরের দিবসসমূহের সংখ্যা অনুসারে ৩৬০টি মূর্তির পূজা করত এবং প্রতিদিনের ঘটনাসমূহকে ঐ ৩৬০টি মূর্তির যে কোন একটির সাথে জড়িত বলে বিশ্বাস করত।

হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর পরে আমর বিন কুসাই-এর দ্বারা মক্কায় মূর্তিপূজার প্রচলন হয়েছিল। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে,শুরুতে তা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল না;বরং প্রথম দিকে আরবগণ মূর্তিগুলোকে সুপারিশকারী বলে বিশ্বাস করত। এরপর তারা আরো এক ধাপ এগিয়ে এ সব প্রতিমাকে খোদায়ী শক্তির অধিকারী বলে ভাবতে থাকে। যে সব মূর্তি পবিত্র কাবার চারপাশে স্থাপিত ছিল সেগুলো আরবের সকল গোত্রের শ্রদ্ধাভাজন ও আরাধ্য ছিল। তবে গোত্রীয় প্রতিমাসমূহ ছিল কেবল নির্দিষ্ট কোন গোত্র বা দলের কাছেই শ্রদ্ধাভাজন ও পূজনীয়। প্রতিটি গোত্রের প্রতিমা ও মূর্তি যাতে সংরক্ষিত থাকে সেজন্য তারা প্রতিমাসমূহের জন্য নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণ করত। মন্দিরসমূহের তদারকির দায়িত্ব উত্তরাধিকারসূত্রে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের হাতে স্থানান্তর হতো।

পারিবারিক প্রতিমা ও মূর্তিসমূহের পূজা প্রতি দিন-রাত একটি পরিবারের মধ্যে সম্পন্ন হতো। ভ্রমণে যাওয়ার সময় তারা নিজেদের দেহকে পারিবারিক প্রতিমাসমূহের সাথে রগড়াতো। ভ্রমণ অবস্থায় তারা মরুভূমির পাথরসমূহের পূজা করত। যে স্থানেই তারা অবতরণ করত সেখানে চারটি পাথর বাছাই করে এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরটিকে নিজের উপাস্য এবং অবশিষ্ট পাথরগুলোকে বেদীর পদমূল হিসাবে গণ্য করত।

মক্কার অধিবাসীদের হারাম শরীফের প্রতি চরম আকর্ষণ ছিল। ভ্রমণের সময় তারা হারামের পাথর সাথে নিয়ে যেত এবং যে স্থানেই তারা যাত্রাবিরতি করত সেখানে তা স্থাপন করে পূজা করত। সম্ভবত এগুলোই আনসাব’(أنصاب ) হতে পারে যেগুলোকে মসৃণ ও অবয়বহীন পাথর হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আর এগুলোর বরাবরে আছে আওসান’(أوثان ) যার অর্থ হচ্ছে আকার-আকৃতি ও নকশাবিশিষ্ট এবং চেঁচে ফেলা হয়েছে এমন পাথর। আসনাম’(أصنام ) হচ্ছে ঐ সকল প্রতিমা যা স্বর্ণ ও রৌপ্যকে গলিয়ে অথবা কাঠ খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে।

মূর্তিসমূহের সামনে আরবদের বিনয়াবনত হওয়া আসলে মোটেও আশ্চর্যজনক বিষয় নয়। আরবগণ বিশ্বাস করত যে,কোরবানী করার মাধ্যমে এ সব মূর্তির সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব। কোরবানী করার পর তারা কোরবানীকৃত পশুর রক্ত প্রতিমার মাথা ও মুখমণ্ডলে মর্দন করত। গুরুত্বপূর্ণ কাজসমূহের ক্ষেত্রে তারা এ সব প্রতিমার সাথে পরামর্শ করত। তারা পরামর্শের জন্য কতগুলো কাঠ (লাঠি) ব্যবহার করত। এগুলোর একটিতে লেখা থাকতإفعل অর্থাৎ কর;অন্যটিতে লেখা থাকতلا تفعل (করো না)। এরপর তারা হাত বাড়িয়ে দিত,অতঃপর যে লাঠিটি বেরিয়ে আসত তাতে যা লেখা থাকত তদনুসারে তারা কাজ করত।

সংক্ষেপে : মূর্তিপূজা সমগ্র আরবে প্রচলিত হয়ে পড়েছিল। বিভিন্নরূপে তাদের মাঝে এ মূর্তিপূজা অনুপ্রবেশ করেছিল। পবিত্র কাবা জাহেলী আরবদের পূজ্য প্রতিমা ও বিগ্রহের আবাসস্থলে পরিণত হয়েছিল। প্রতিটি গোত্রেরই সেখানে একটি করে মূর্তি ছিল। কা বাঘরে বিভিন্ন আকার-আকৃতির ৩৬০টির বেশি মূর্তি ছিল,এমনকি খ্রিষ্টানরাও কাবার স্তম্ভ ও দেয়ালসমূহে হযরত মরিয়ম ও হযরত ঈসা (আ.)-এর চিত্র,ফেরেশতাদের ছবি এবং হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর কাহিনী চিত্রিত করে রেখেছিল।

লাত,মানাত ও উয্যা-এ তিন প্রতিমাকে কুরাইশরা আল্লাহর কন্যা বলে বিশ্বাস করত। কুরাইশরা বিশেষভাবে এ তিন প্রতিমার পূজা করত। লাত দেবতাদের মা হিসাবে গণ্য হতো। লাতের মন্দির তায়েফে অবস্থিত ছিল। এ লাত ছিল সাদা পাথরের মতো। মানাতকে ভাগ্যদেবী ও মৃত্যুর প্রভু বলে বিশ্বাস করা হতো। মানাতের মন্দির মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী একটি স্থানে অবস্থিত ছিল।

আবু সুফিয়ান উহুদের যুদ্ধের দিবসে লাত ও উয্যার মূর্তি সাথে নিয়ে এসেছিল এবং এগুলোর কাছে সাহায্য চেয়েছিল। কথিত আছে যে,আবু আহীহাহ্ সাঈদ বিন আস নামের এক উমাইয়্যা বংশীয় ব্যক্তি মৃত্যুশয্যায় শায়িত অবস্থায় কাঁদছিল। আবু জাহল তাকে দেখতে গেল। আবু জাহল তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, এ কান্না কিসের জন্য? মৃত্যুকে ভয় করছ,অথচ এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কি কোন উপায় নেই? সে বলল, মৃত্যুর ভয়ে কাঁদছি না;বরং আমি ভয় পাচ্ছি যে,আমার মৃত্যুর পর জনগণ উয্যার পূজা করবে না।” তখন আবু জাহল বলল, তোমার কারণে জনগণ উয্যার পূজা করেনি যে,তোমার মৃত্যুতেও তারা উয্যার পূজা করা থেকে বিরত থাকবে। ২২

এ সব মূর্তি ছাড়াও অন্যান্য দেবতার পূজা আরবদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। যেমন কুরাইশরা পবিত্র কাবার ভিতরে হুবাল (هبل ) নামের একটি মূর্তি রেখেছিল। প্রতিটি গোত্রের নিজস্ব বিশেষ মূর্তিই ছিল না,বরং প্রতিটি পরিবারেরও গোত্রীয় প্রতিমার পূজা করা ছাড়াও নিজস্ব পারিবারিক প্রতিমা থাকত। নক্ষত্র,চন্দ্র,সূর্য,পাথর,কাঠ,মাটি,খেজুর এবং বিভিন্ন ধরনের মূর্তি প্রতিটি গোত্রের কাছে আরাধ্য ও পূজনীয় ছিল। পবিত্র কাবা ও অন্যান্য মন্দিরে রক্ষিত এ সব প্রতিমা বা মূর্তি কুরাইশ ও সকল আরব গোত্রের নিকট পরম শ্রদ্ধেয় ও সম্মানিত ছিল। এগুলোর চারদিকে তারা তাওয়াফ (প্রদক্ষিণ) করত এবং এগুলোর নামে পশু কোরবানী করত। প্রত্যেক গোত্র প্রতি বছর কোন না কোন ব্যক্তিকে আনুষ্ঠানিকতার দ্বারা নির্বাচিত করে তাদের দেবদেবী ও প্রতিমাসমূহের বেদীমূলে কোরবানী করত এবং তার রক্তাক্ত মৃতদেহ বলিদানের স্থানের নিকটেই দাফন করা হতো।

সংক্ষিপ্ত এ বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে,সমগ্র জাযিরাতুল আরবের (আরব উপদ্বীপের) প্রতিটি গৃহ ও প্রান্তর,এমনকি বাইতুল্লাহ্ অর্থাৎ পবিত্র কাবাও সে যুগে দেবদেবী দিয়ে পরিপূর্ণ ছিল।

কবির ভাষায় :

উপাসনাস্থলসমূহ বিরান ধ্বংসপ্রাপ্ত,কাবার পবিত্র অঙ্গন হয়ে গিয়েছিল প্রতিমালয়

তখন জনগণ ছিল মহান স্রষ্টা থেকে বিমুখ-কি সুখে কি দুঃখে সর্বাবস্থায়।

এ সব অর্থহীন প্রতিমা ও দেবদেবীর পূজা করার ফলে আরবে দ্বন্দ্ব-সংঘাত,যুদ্ধ-বিগ্রহ,মতভেদ,হানাহানি ও হত্যাকাণ্ড বিরাজ করত। আর এর ফলে অসভ্য-বর্বর মরুচারী আরবদের জীবনে নেমে এসেছিল ভয়ঙ্কর দুর্ভাগ্য ও দুর্দশা এবং চরম পার্থিব ও আত্মিক ক্ষতি।

হযরত আলী (আ.) তাঁর এক ভাষণে ইসলামপূর্ব আরব জাতির অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন : মহান আল্লাহ্ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে রিসালাতের দায়িত্বসহকারে জগদ্বাসীকে ভয় প্রদর্শন করার জন্য প্রেরণ এবং তাঁকে তাঁর ঐশী বিধি-বিধান ও নির্দেশাবলীর বিশ্বস্ত সংরক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন। হে আরব জাতি! তখন তোমরা নিকৃষ্টতম ধর্মের অনুসারী ছিলে;তোমরা সর্পকুলের মাঝে শয়ন করতে,ময়লা-আবর্জনাযুক্ত পানি পান করতে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ও বন্ধন ছিন্ন করতে,তখন তোমাদের মধ্যে প্রতিমা ও মূর্তিসমূহ প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং তোমাদের আপদমস্তক জুড়ে ছিল পাপ,অন্যায় ও অপরাধ। ২৩

মৃত্যুর পরবর্তী জীবন সম্পর্কে আরবদের চিন্তা

আরবরা এই দার্শনিক সমস্যাকে ঠিক এভাবে বর্ণনা করেছে : মানবাত্মা মৃত্যুর পর পেঁচাসদৃশ একটি পাখির আকৃতিতে দেহ থেকে বের হয়ে আসে যার নাম হামা’(هامَة ) ও সাদা’(صَدَى )। এরপর তা মানুষের নিস্প্রাণ দেহের পাশে অনবরত অত্যন্ত করুণ স্বরে ও ভয়ঙ্করভাবে কাঁদতে থাকে। যখন মৃতের আত্মীয়-স্বজনরা ঐ মরদেহকে কবরে শায়িত করে তখন যেভাবে বলা হয়েছে ঠিক সেভাবে তার আত্মা তার সমাধিস্থলে আবাসন গ্রহণ করে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। কখনো কখনো সন্তান ও বংশধরদের অবস্থা জানার জন্য তাদের ঘরের ছাদে এসে বসে।

মানুষ যদি অস্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করে তাহলে উক্ত প্রাণীটি (অস্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণকারী মানুষের আত্মা যা পেঁচাসদৃশ পাখির আকৃতি ধারণ করেছে) অনবরত চিৎকার করে বলতে থাকে, আমাকে পান করাও,আমাকে পান করাও’অর্থাৎ আমার হত্যাকারীর রক্তপাত করে আমার তৃষ্ণা নিবারণ কর। আর যতক্ষণ পর্যন্ত হত্যাকারী থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করা না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত তা নীরব হবে না। ঠিক এভাবে সম্মানিত পাঠকবর্গের কাছে প্রকৃত অবস্থা পরিষ্কার হয়ে যাবে এবং তাঁরা অবগত হতে পারবেন যে,প্রাক-ইসলাম যুগে আরব জাতির ইতিহাস এবং ইসলামোত্তর আরব জাতির ইতিহাস আসলে দু টি সম্পূর্ণ ভিন্ন ইতিহাস।

কারণ প্রাক-ইসলাম অর্থাৎ অন্ধকার যুগে আরবগণ কন্যাসন্তানকে হত্যা করত এবং তাদেরকে জীবন্ত কবর দিত। অনাথ শিশুদেরকে দয়া-মায়া দেখানো হতো না। লুটতরাজ করা হতো এবং কাঠ ও পাথরের প্রতিমাসমূহের পূজা করা হতো। তখন এক-অদ্বিতীয় আল্লাহর ব্যাপারে বিন্দুমাত্র চিন্তা-ভাবনা করা হতো না। (অথচ ইসলামোত্তর যুগে এ সব কুসংস্কার ও কুপ্রথা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যায়। তাই ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের পরে আরব জাতির ইতিহাস প্রাক-ইসলাম যুগের আরব জাতির ইতিহাস থেকে সম্পূর্ণ আলাদা)।

সাহিত্য একটি জাতির মন-মানসিকতা প্রকাশকারী দর্পণ

একটি জাতির মন-মানসিকতা ও ধ্যান-ধারণা বিশ্লেষণ করার সর্বোত্তম পন্থা সেই জাতির

চিন্তামূলক কর্মসমূহ এবং বংশ পরম্পরায় কথিত ও বর্ণিত গল্প ও কাহিনীসমূহ। কোন জাতি,গোষ্ঠী বা জনপদের সাহিত্য-কর্ম তথা কবিতা,গল্প ও উপকথাসমূহ তাদের চিন্তা ও ধ্যান-ধারণার প্রতিচ্ছবি,কৃষ্টি ও সভ্যতার মাপকাঠি এবং তাদের চিন্তা-পদ্ধতির ওপর আলোকপাতকারী। প্রতিটি জাতির সাহিত্যকর্মসমূহ যেন অংকিত চিত্রের ন্যায় যা পারিবারিক জীবন এবং কতগুলো কোলাহলপূর্ণ প্রাকৃতিক ও সামাজিক দৃশ্য অথবা যুদ্ধ-বিগ্রহের চিত্র বর্ণনা করে।

আরবদের কাব্য এবং তাদের মাঝে প্রচলিত প্রবচনসমূহ অন্য সব কিছুর চেয়ে বেশি তাদের ইতিহাসের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচন করে। যে ঐতিহাসিক কোন জাতির মন-মানসিকতা এবং ধ্যান-ধারণার সাথে সম্পূর্ণরূপে পরিচিত হতে আগ্রহী তার উচিত যতদূর সম্ভব ঐ জাতির বিভিন্ন চিন্তামূলক কর্ম ও নিদর্শন,যেমন কাব্য,গদ্য,প্রবাদবাক্য,গল্প,লোককাহিনী ও উপকথার প্রতি সবিশেষ দৃষ্টি দেয়া। সৌভাগ্যক্রমে মুসলিম পণ্ডিত ও মনীষিগণ জাহেলী যুগের আরবী সাহিত্য যথাসাধ্য সংরক্ষণ করেছেন।

আবু তাম্মাম হাবিব ইবনে আওস (মৃত্যু ২৩১ হিজরী) যিনি একজন শিয়া সাহিত্যিক হিসাবে গণ্য এবং শিয়া মাজহাবের ইমামদের প্রশংসায় অনেক কবিতা রচনা করেছেন তিনি নিম্নোক্ত দশটি অধ্যায় বা শিরোনামে জাহেলী যুগের আরবী সাহিত্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেছিলেন। অধ্যায় ও শিরোনামসমূহ হলো :

১. বীরত্ব ও বীরত্বগাথা;

২. শোকগাথা;

৩. গদ্য;

৪. যৌবন উদ্রিক্তকারী গজল (প্রেম ও গীতি কবিতা);

৫. ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোত্রের তিরস্কার ও নিন্দা;

৬. আপ্যায়ন এবং দানশীলতার উপযোগী কাব্য ও কবিতা;

৭. প্রশংসা গীতি;

৮. জীবনী;

৯. কৌতুক ও সূক্ষ্ম রসাত্মক ঘটনা ও রম্য কথাসমূহ এবং

১০. নারীদের প্রতি নিন্দাসূচক কাব্য।

মুসলিম জ্ঞানী,পণ্ডিত ও সাহিত্যিকগণ সংগৃহীত উক্ত কাব্যসমূহের রচয়িতাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং ব্যবহৃত শব্দসমূহের বিস্তারিত ব্যাখ্যাসম্বলিত প্রভূত গ্রন্থ রচনা করছেন। আর আবু তাম্মাম হাবিব ইবনে আওস কর্তৃক সংকলিত ও সংগৃহীত কাব্যগ্রন্থটিও বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে যার একটি অংশ সংবাদপত্র ও প্রকাশিত বিষয়াদির অভিধানে উল্লিখিত হয়েছে।২৪

জাহেলী আরব সমাজে নারীর মর্যাদা

কবি আবু তাম্মাম হাবিব ইবনে আওস কর্তৃক সংকলিত জাহেলিয়াত যুগের আরব কাব্য গ্রন্থের দশম অধ্যায় তদানীন্তন আরব সমাজে নারীর মর্যাদার প্রকৃত চিত্র উন্মোচন করার একটি উজ্জ্বল প্রামাণ্য দলিল। গ্রন্থটির এই অধ্যায় পাঠ করলে প্রতীয়মান হয় যে,আরব সমাজে নারী এক আশ্চর্যজনক বঞ্চনার শিকার ছিল এবং তারা বেদনাদায়ক জীবনযাপন করত। এ ছাড়াও জাহেলিয়াত যুগের আরবদের নিন্দায় পবিত্র কোরআনের যেসব আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে সেসব আয়াতে তাদের নৈতিক অধঃপতনের বিষয়টি স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে।

পবিত্র কোরআন কন্যাসন্তান হত্যা করার মতো আরবদের জঘন্য কাজকে ঠিক এভাবে বর্ণনা করেছে : কিয়ামত দিবস এমনই এক দিবস যে দিবসে যে সব কন্যাসন্তানকে কবরে জীবন্ত পুঁতে হত্যা করা হয়েছে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।২৫ সত্যিই মানুষ নৈতিকভাবে কতটা অধঃপতিত হলে তার নিজ কলিজার টুকরা সন্তানকে বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পর অথবা জন্মগ্রহণ করার পরই মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে পারে এবং সন্তানের বুকফাটা করুণ চিৎকারেও তার পাষাণ হৃদয় বিন্দুমাত্র বিচলিত হয় না!

সর্বপ্রথম যে গোত্রটি এ জঘন্য প্রথাটির প্রচলন করেছিল তারা ছিল বনি তামীম গোত্র। ইরাকের শাসনকর্তা নূমান বিন মুনযির বিদ্রোহীদেরকে দমন করার জন্য এক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে বিদ্রোহী তামীম গোত্রের ওপর আক্রমণ চালিয়ে সবকিছু ধ্বংস করে দেয়। তামীম গোত্রের যাবতীয় ধন-সম্পদ জব্দ করা হয় এবং নারীদেরকে বন্দী করা হয়। তামীম গোত্রের প্রতিনিধিগণ নূমান বিন মুনযিরের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের নারী এবং কন্যাসন্তানদেরকে বন্দীদশা থেকে মুক্তি দিয়ে ফেরত দেয়ার আবেদন করে। কিন্তু বন্দিশালায় তামীম গোত্রের কতিপয় যুদ্ধ-বন্দিনীর বিবাহ হয়ে যাওয়ায় নূমান তাদেরকে তাদের পিতা ও পরিবারের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করিয়ে স্বামীদের সাথে বসবাস অথবা স্বামীদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কচ্ছেদ করে নিজেদের মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করার স্বাধীনতা দেয়। কাইস বিন আসেমের মেয়ে বৈবাহিক সম্পর্ক অর্থাৎ স্বামীর সাথে বসবাস করাকে অগ্রাধিকার দিলে ঐ বৃদ্ধলোকটি অত্যন্ত ব্যথিত হয়। সে ছিল তামীম গোত্রের প্রেরিত প্রতিনিধিদের অন্যতম। সে এরপর প্রতিজ্ঞা করল যে,এখন থেকে সে তার কন্যাসন্তানদেরকে তাদের জীবনের ঊষালগ্নেই হত্যা করবে। ধীরে ধীরে এ জঘন্য প্রথা অনেক গোত্রের মধ্যেই প্রচলিত হয়ে যায়।

কাইস বিন আসেম যখন মহানবী (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হয়েছিল তখন একজন আনসার সাহাবী তাকে তার মেয়েদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেছিল। কাইস জবাবে বলেছিল, আমি আমার সকল কন্যাসন্তানকে জীবন্ত দাফন করেছি,কেবল একবার ব্যতীত। আর কখনই এ কাজ করতে গিয়ে আমি একটুও কষ্ট পাই নি। আর সেটি ছিল : একবার আমি সফরে ছিলাম। আমার স্ত্রীর সন্তান প্রসবকাল অতি নিকটবর্তী হয়ে গিয়েছিল। দৈবক্রমে আমার সফর বেশ দীর্ঘায়িত হলো। সফর থেকে প্রত্যাবর্তনের পর আমি আমার স্ত্রীকে সন্তান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। সে আমাকে বলল : কোন কারণে সে মৃত সন্তান প্রসব করেছে। আসলে সে একটি কন্যাসন্তান প্রসব করেছিল,কিন্তু সে আমার ভয়ে ঐ কন্যাসন্তানকে জন্মের পর পরই তার বোনদের কাছে রেখেছিল। অনেক বছর কেটে গেলে ঐ মেয়েটি যৌবনে পা দিল,অথচ তখনও আমি জানতাম না যে,আমার একটি মেয়ে আছে। একদিন আমি আমার ঘরে বসে আছি,হঠাৎ একটি মেয়ে ঘরে প্রবেশ করে তার মাকে খোঁজ করতে লাগল। ঐ মেয়েটি ছিল সুন্দরী। তার চুলগুলো বেনী করা ছিল এবং তার গলায় ছিল একটি হার। আমি আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলাম,এই মেয়েটি কে? তখন তার নয়নযুগল অশ্রুজলে পূর্ণ হয়ে গেল এবং সে বলল : এ তোমার ঐ মেয়ে যখন তুমি সফরে ছিলে তখন তার জন্ম হয়েছিল। কিন্তু আমি তোমার ভয়ে তাকে এতদিন লুকিয়ে রেখেছিলাম। আমার স্ত্রীর এ কথায় আমার নীরব থাকার বিষয়টি এতে আমার সন্তুষ্টি ও মৌন সম্মতি বলেই সে মনে করল। সে ভাবল যে,আমি এ মেয়েকে হত্যা করব না। এ কারণেই আমার স্ত্রী একদিন নিশ্চিন্ত মনে ঘর থেকে বাইরে গেল। আর আমিও যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তা পালন করার জন্য আমার মেয়েকে হাত ধরে দূরবর্তী একটি স্থানে নিয়ে গেলাম। সেখানে আমি একটি গর্ত খুঁড়তে লাগলাম। গর্ত খোঁড়ার সময় সে আমাকে বার বার জিজ্ঞাসা করেছিল,কেন আমি এ গর্ত খনন করছি? খনন শেষে আমি তার হাত ধরে টেনেহিঁচড়ে গর্তের ভিতরে ফেলে দিলাম এবং তার দেহের ওপর মাটি ফেলতে লাগলাম। তার করুণ আর্তনাদের প্রতি মোটেও ভ্রুক্ষেপ করলাম না। সে কেঁদেই যাচ্ছিল এবং বলছিল : বাবা! আমাকে মাটির নিচে চাপা দিয়ে এখানে একাকী রেখে আমার মায়ের কাছে ফিরে যাবে? আমি তার ওপর মাটি ফেলেই যাচ্ছিলাম এবং তাকে সম্পূর্ণরূপে মাটির মধ্যে জীবন্ত পুঁতেই ফেললাম। হ্যাঁ,কেবল এই একবারই আমার হৃদয় কেঁদেছিল-আমার অন্তর জ্বলে-পুড়ে গিয়েছিল।” কাইসের কথা শেষ হলে মহানবী (সা.)-এর দু চোখ অশ্রুজলে ভরে গিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, এটি পাষাণ হৃদয়ের কাজ। যে জাতির দয়া-মায়া নেই সে জাতি কখনই মহান আল্লাহর দয়া ও করুণা লাভ করতে পারে না।২৬

মদীনা আল মুনাওয়ারাহ্

পবিত্র মক্কা নগরীর উত্তরে এ নগরী অবস্থিত। মক্কা থেকে এ নগরীর দূরত্ব 90 ফারসাখ (540 কি.মি.)। এ নগরীর চারপাশে খেজুর ও অন্যান্য ফলের বাগান আছে। মদীনার ভূমি বনায়ন ও চাষাবাদের জন্য অধিকতর উপযোগী।

প্রাক ইসলামী যুগে এ নগরী ইয়াসরিব’(يثرب ) নামে পরিচিত ছিল। মহানবী (সা.)-এর হিজরতের পর এ নগরীর নামকরণ করা হয় মদীনাতুর রাসূল’(مدينة الرّسول ) অর্থাৎ রাসূলের নগরী;পরে সংক্ষেপ করার জন্য এর নামের শেষাংশ বাদ দেয়া হলে এ নগরী মদীনা’নামে অভিহিত হয়। ইতিহাস পাঠে জানা যায় যে,প্রথম যারা এ নগরীতে বসতি স্থাপন করেছিল তারা আমালিকাহ্ (عمالقة ) গোত্রীয় ছিল। এদের পর এখানে ইয়াহুদী,আওস (أوس ) ও খাযরাজ (خزرج ) গোত্র বসতি স্থাপন করে। আওস ও খাযরাজ গোত্র মুসলমানদের কাছে আনসার’(أنصار ) নামে পরিচিত।

একমাত্র হিজায এলাকাই অন্য সকল এলাকার বিপরীতে বহিরাগত বিজেতাদের হাত থেকে সুরক্ষিত ছিল। তৎকালীন বিশ্বের দু পরাশক্তি পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্যের সভ্যতার নিদর্শন হিজাযে দেখা যায় না। কারণ হিজাযের অনুর্বর ও বসবাসের অযোগ্য ভূমিসমূহ বিজেতাদের কাছে মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ না হওয়ায় তারা সেখানে কোন সেনা অভিযান পরিচালনা করে নি। আর অত্র এলাকায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে যে,হাজারো সমস্যা ও প্রতিকূলতা দেখা দেয়ার পর তাদেরকে অবশ্যই ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে হবে।

এতৎসংক্রান্ত একটি গল্প প্রচলিত আছে। এ গল্পটি ডিওডোরাস (ديودور ) বর্ণনা করেছেন : গ্রীক সেনাপতি ডিমিত্রিউস্ যখন আরব উপদ্বীপ দখল করার জন্য পেট্রা নগরীতে (হিজাযের একটি প্রাচীন নগরী) প্রবেশ করেন তখন সেখানকার অধিবাসীরা তাঁকে বলেছিল, হে গ্রীক সেনাপতি! আপনি কেন আমাদের সাথে যুদ্ধ করতে চান? আমরা বালুকাময় অঞ্চলের অধিবাসী যা জীবনযাপনের সব ধরনের উপায়-উপকরণ থেকে বঞ্চিত। যেহেতু আমরা কারো বশ্যতা স্বীকার করতে রাজী নই সেহেতু আমরা জীবনযাপনের জন্য এ ধরনের শুষ্ক এবং পানি ও উদ্ভিদবিহীন মরুভূমিকেই বেছে নিয়েছি। অতএব,আমাদের যৎসামান্য উপঢৌকন গ্রহণ করে আমাদের দেশ জয়ের চিন্তা ত্যাগ করুন। আর আপনি যদি আপনার পূর্ব ইচ্ছার ওপর বহাল থাকেন তাহলে আমরা আপনাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিতে চাই যে,অচিরেই আপনাকে হাজারো সমস্যা ও বিপদের সম্মুখীন হতে হবে। আপনার জানা থাকা প্রয়োজন যে, নাবতী রা কখনই তাদের জীবনযাত্রা ত্যাগ করবে না। কয়েকটি পর্যায় অতিক্রম করার পর আপনি কতিপয় নাবতীকে যুদ্ধবন্দী হিসাবে যদি নিজের সাথে নিয়ে যান এরপরও তারা (বন্দীরা) আপনার কোন উপকারে আসবে না। কারণ তারা কুচিন্তা ও কর্কশ আচরণের অধিকারী এবং তারা তাদের জীবনযাত্রা পরিবর্তন করতে মোটেও ইচ্ছুক নয়।”

গ্রীক সেনাপতি তাদের শান্তিকামী আহ্বানে সাড়া দিয়ে আরব উপদ্বীপে সেনা অভিযান এবং আধিপত্য বিস্তারের পরিকল্পনা বাদ দিয়েছিলেন।2

2.আরব উপদ্বীপের মধ্য পূর্বাঞ্চলীয় অংশ : এ অংশটি আরব মরুভূমি (صحراء العرب ) নামে পরিচিত। নজদ’(النّجد ) এলাকা এ অংশেরই অন্তর্গত এবং তা উচ্চভূমি। এখানে লোকবসতি খুবই কম। আরব উপদ্বীপে সৌদী রাজবংশের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর তাদের রাজধানী রিয়াদ নগরী আরব উপদ্বীপের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

3. আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ- পশ্চিমাংশ : যা ইয়েমেন নামে প্রসিদ্ধ। এ ভূখণ্ডের দৈর্ঘ্য উত্তর থেকে দক্ষিণে 750 কি.মি. এবং পশ্চিম থেকে পূর্বে প্রায় 400 কি.মি.। বর্তমানে এ দেশের আয়তন 60,000 বর্গমাইল। কিন্তু অতীতে এর আয়তন এর চেয়েও বেশি ছিল। এ ভূখণ্ডের একটি অংশ বিগত 50 বছর ধরে ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল। এ কারণে ইয়েমেনের উত্তর সীমান্ত নজদ এবং দক্ষিণ সীমান্ত এডেন,পশ্চিমে লোহিত সাগর এবং পূর্বে আর রুবুল খালী মরুভূমি।3

ঐতিহাসিক সানা (صنعاء ) নগরী ইয়েমেনের অন্যতম প্রসিদ্ধ নগরী। আর আল হাদীদাহ্ (الحديدة ) বন্দর হচ্ছে ইয়েমেনের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ বন্দর যা লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত।

ইয়েমেন আরব উপদ্বীপের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী অঞ্চল। এর রয়েছে অত্যুজ্জ্বল সভ্যতা। ইয়েমেন তুব্বা’রাজাদের কেন্দ্রস্থল ছিল। এ তুব্বা রাজবংশ দীর্ঘকাল ইয়েমেন শাসন করেছিল। এ দেশটি ইসলামের অভ্যুদয়ের পূর্বে ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল। প্রকৃতপক্ষে ইয়েমেনকে আরব ভূখণ্ডের চৌরাস্তার মোড়’বলে গণ্য করা হতো। ইয়েমেনে অনেক আশ্চর্যজনক স্বর্ণের খনি ছিল। ইয়েমেনের স্বর্ণ,রৌপ্য ও মূল্যবান পাথর বিদেশে রফতানী করা হতো।

ইয়েমেনের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনাদি আজও বিদ্যমান। যে যুগে মানব জাতির হাতে ভারী কাজ করার যন্ত্রপাতি ছিল না তখন ইয়েমেনের বুদ্ধিমান জনগোষ্ঠী সাহস করে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও সুউচ্চ অট্টালিকা নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিল।

ইয়েমেনের সুলতানদের শাসনকর্তৃত্বের কোন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। কিন্তু তাঁরা জ্ঞানী-গুণী ও সুধীজন কর্তৃক প্রণয়নকৃত ও গৃহীত সংবিধান বা শাসনকার্য পরিচালনা করার বিধি-বিধান বাস্তবায়ন করা থেকে বিরত থাকতেন না। তারা কৃষি ও উদ্যান ব্যবস্থাপনায় অন্যদের চেয়ে অনেক অগ্রসর ছিল। তারা জমি চাষাবাদ এবং ক্ষেত-খামার ও বাগানসমূহে সেচ দেয়া সংক্রান্ত সূক্ষ্ম বিধিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবে তা প্রয়োগ করেছিল। এ কারণে তাদের দেশ ঐ সময় অন্যতম উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসাবে গণ্য হতো।

প্রসিদ্ধ ফরাসী ইতিহাসবিদ গোস্তাব লোবোঁ ইয়েমেন সম্পর্কে লিখেছেন : সমগ্র আরব উপদ্বীপ জুড়ে ইয়েমেন অপেক্ষা আর কোন উর্বর ও মনোরম অঞ্চল নেই।”

দ্বাদশ শতাব্দীর ঐতিহাসিক ইদ্রিসী সানা নগরী সম্পর্কে লিখেছেন : সেখানে আরব উপদ্বীপ ও ইয়েমেনের রাজধানী অবস্থিত। এ নগরীর প্রাসাদ ও অট্টালিকাসমূহ বিশ্বখ্যাত। শহরের সাধারণ বাড়ি-ঘরও মসৃণ ও কারুকার্যময় পাথর দ্বারা নির্মিত।”

যে সব আশ্চর্যজনক ঐতিহাসিক নিদর্শন প্রাচ্যবিদ ও প্রত্নতত্ত্ববিদদের সর্বশেষ অনুসন্ধান ও খনন কার্যের দ্বারা আবিস্কৃত হয়েছে তা ইয়েমেনের বিভিন্ন এলাকা,যেমন মারাব,সানা ও বিলকীসে ইয়েমেনের গৌরবোজ্জ্বল অতীতের বিস্ময়কর সভ্যতাকেই প্রমাণ করে।

মারাব শহরে (প্রসিদ্ধ সাবা নগরী) গগনচুম্বী প্রাসাদসমূহের ফটকসমূহ এবং ঐগুলোর খিলান ও তাক স্বর্ণের কারুকার্য দ্বারা সুশোভিত ছিল। এ শহরে প্রচুর স্বর্ণ ও রৌপ্যনির্মিত পাত্র এবং ধাতুনির্মিত খাট ও বিছানা ছিল।4

মারাবের ঐতিহাসিক নিদর্শনাদির অন্যতম হচ্ছে মারাবের প্রসিদ্ধ বাঁধ যার ধ্বংসাবশেষ আজও বিদ্যমান। এ শহরটি জলোচ্ছ্বাসের দ্বারা বিলুপ্ত হয়ে যায়। এ জলোচ্ছ্বাসের নাম পবিত্র কোরআনে র্আম’(عرم ) বলা হয়েছে।5

দ্বিতীয় অধ্যায় : প্রাক ইসলামী যুগে আরব জাতি

ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের পূর্বে আরব জাতির অবস্থা জানার জন্য নিম্নোক্ত সূত্রসমূহ ব্যবহার করা যেতে পারে :

1. তাওরাত যদিও এতে সকল ধরনের বিকৃতি রয়েছে;

2. মধ্যযুগীয় গ্রীক ও রোমান সাহিত্য ও বিবরণাদি;

3. মুসলিম পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক প্রণীত ইসলামের ইতিহাস;

4. প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান ও খনন কার্য এবং প্রাচ্যবিদগণের গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত প্রাচীন নিদর্শনাদি। আর এগুলো সীমিত পরিসরে হলেও বেশ কিছু অজানা বিষয়ের ওপর থেকে রহস্যের জট খুলেছে।

এ সব সূত্র থাকা সত্ত্বেও আরব জাতির ইতিহাসের অনেক দিক ও বিষয় এখনো অস্পষ্ট থেকে গেছে এবং এমন এক ঐতিহাসিক ধাঁধার রূপ পরিগ্রহ করেছে যা সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু যেহেতু ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরব জাতির অবস্থা কিরূপ ছিল তা অধ্যয়ন আমাদের অত্র গ্রন্থের ভূমিকার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং আমাদের প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে মহানবী (সা.)-এর জীবনী বিশ্লেষণ,সেহেতু ইসলামপূর্ব আরব জাতির জীবনের উজ্জ্বল দিকগুলো খুব সংক্ষেপে আমরা এখানে বর্ণনা করব।

নিঃসন্দেহে আরব উপদ্বীপে সুদূর অতীতকাল থেকেই বহু গোত্র বসতি স্থাপন করেছে। এ সব গোত্রের মধ্য থেকে কতিপয় গোত্র বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহে ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু এ ভূখণ্ডের ইতিহাসে কেবল তিনটি প্রধান গোত্র অন্য সকল গোত্রের চেয়ে বেশি খ্যাতি লাভ করেছে। আর এ তিন গোত্র থেকে বহু শাখাগোত্রের উৎপত্তি হয়েছিল। এ গোত্র তিনটি হলো :

1. বায়েদাহ্ (بائدة ) : বায়েদাহ্ শব্দের অর্থ ধ্বংসপ্রাপ্ত। কারণ এ গোত্র অবাধ্যতা ও পাপাচারের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাধ্যমে নিশ্চি‎‎‎ হ্ন হয়ে গেছে। সম্ভবত ধ্বংসপ্রাপ্ত গোত্রগুলো আদ ও সামুদ জাতি হয়ে থাকবে-যাদের বর্ণনা পবিত্র কোরআনে বহুবার এসেছে।

2. কাহ্তানিগণ (القحطانيون ) : এরা ইয়া রব বিন কাহ্তানের বংশধর। এরা আরব ভূখণ্ডের দক্ষিণাঞ্চল অর্থাৎ ইয়েমেনে বসবাস করত। এদেরকেই খাঁটি আরব বলা হয়। আজকের ইয়েমেনের অধিবাসীরা এবং আওস ও খাযরাজ গোত্র যারা ইসলামের আবির্ভাবের শুরুতে মদীনায় বসবাস করত তারা কাহ্তানেরই বংশধর। কাহ্তানিগণ অনেক সরকার ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল। তারা ইয়েমেনকে সমৃদ্ধশালী ও আবাদ করার ক্ষেত্রে অনেক অবদান রেখেছে। তারা বহু সভ্যতারও গোড়াপত্তন করেছিল এবং সেগুলোর নিদর্শনাদি আজও বিদ্যমান। তাদের রেখে যাওয়া প্রাচীন শিলালিপিসমূহ বৈজ্ঞানিক নীতিমালার ভিত্তিতে পাঠোদ্ধার করা হচ্ছে। এর ফলে কাহ্তানীদের ইতিহাস কিছুটা হলেও পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরব জাতির সভ্যতা সম্পর্কে যা কিছু আলোচনা করা হয় আসলে তার সবই এ কাহ্তানীদের সাথেই সংশ্লিষ্ট এবং এ সভ্যতার বিকাশস্থল হচ্ছে ইয়েমেন।

3. আদনানিগণ (العدنانيّون ) : এরা হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর বংশধর। ইসমাঈল (আ.) ছিলেন হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর পুত্র। এ গোত্রের উৎসমূল আমরা পরবর্তী আলোচনাসমূহে স্পষ্ট করে দেব। তবে উক্ত আলোচনাসমূহের সারসংক্ষেপ নিম্নরূপ : পুত্র ইসমাঈলকে তাঁর মা হাজেরাসহ পবিত্র মক্কায় পুনর্বাসন করার ব্যাপারে হযরত ইবরাহীম (আ.) আদিষ্ট হন। তিনি ইসমাঈল ও তাঁর মা হাজেরাকে ফিলিস্তিন থেকে একটি গভীর উপত্যকায় নিয়ে আসলেন যা মক্কা নামে অভিহিত। এ উপত্যকা ছিল পানি ও উদ্ভিদবিহীন মরুপ্রান্তর। মহান আল্লাহ্ তাঁদের ওপর করুণা ও রহমতস্বরূপ সেখানে যমযম’ঝরনা সৃষ্টি করে তাঁদের হাতে অর্পণ করেন। ইসমাঈল (আ.) মক্কার অদূরে বসতি স্থাপনকারী জুরহুম গোত্রের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। তিনি অনেক সন্তান-সন্ততি লাভ করেছিলেন। হযরত ইসমাঈলের এ সব বংশধরের একজন ছিলেন আদনান। কয়েকজন ঊর্ধ্বতন পিতৃপুরুষের মাধ্যমে আদনানের বংশ হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর সাথে মিলিত হয়।

আদনানের সন্তান ও বংশধরগণ বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত হয়ে যায়। এ সব গোত্রের মধ্যে যে গোত্রটি সর্বাধিক খ্যাতি লাভ করেছিল তা হলো কুরাইশ গোত্র। আর বনি হাশিম ছিল কুরাইশ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত।

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর যুগে আরব উপদ্বীপ

আরবদের সাধারণ চরিত্র

আরবদের ঐ সকল স্বভাব-চরিত্র এবং সামাজিক রীতি-নীতি তুলে ধরাই এখানে লক্ষ্য যা ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে তাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। এ সব রীতি-নীতির মধ্যে বেশ কিছু রীতি গোটা আরব জাতির মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। সার্বিকভাবে আরবদের সাধারণ এবং প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্য নিম্নোক্ত কয়েকটি বাক্যের মাধ্যমে বর্ণনা করা যেতে পারে :

জাহেলীয়াতের যুগে আরবগণ,বিশেষ করে আদনানের বংশধরগণ স্বভাবতঃই দানশীল ও অতিথিপরায়ণ ছিল। তারা কদাচিৎ আমানতের খিয়ানত করত। তারা প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করাকে ক্ষমার অযোগ্য পাপ বলে গণ্য করত। তারা আকীদা-বিশ্বাসের জন্য আত্মোৎসর্গ করতে কুণ্ঠাবোধ করত না। তারা স্পষ্টভাষী ছিল। তাদের মাঝে শক্তিশালী ধী ও স্মরণশক্তিসম্পন্ন এমন ব্যক্তিবর্গ ছিল যারা আরবের কবিতা এবং বক্তৃতাসমূহ কণ্ঠস্থ করে রেখেছিল। আরবগণ কাব্যচর্চা এবং বক্তৃতায় সে যুগে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছিল। তাদের সাহস প্রবাদে পরিণত হয়েছিল। তারা অশ্বচালনা এবং তীর নিক্ষেপে সিদ্ধহস্ত ছিল। পলায়ন এবং শত্রুর প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শনকে তারা মন্দ ও গর্হিত কাজ বলে বিবেচনা করত।

এ সব গুণের পাশাপাশি অনেক চারিত্রিক দোষ তাদেরকে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফেলেছিল যে,তাদের সব ধরনের মানবীয় পূর্ণতার দীপ্তি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। আর অদৃশ্যলোক থেকে যদি তাদের ওপর করুণা ও দয়ার বাতায়ন উন্মুক্ত করা না হতো তাহলে নিঃসন্দেহে তাদের জীবনপ্রদীপ নির্বাপিত হতো। আপনারা বর্তমানে কোন আদনানী আরবের অস্তিত্বই খুঁজে পেতেন না এবং অতীতের বিলুপ্ত আরব গোত্রসমূহের কাহিনীরই পুনরাবৃত্তি হতো।

একদিকে যোগ্য নেতৃত্বের অভাব ও সঠিক কৃষ্টি-সংস্কৃতির অনুপস্থিতি এবং অন্যদিকে চরিত্রহীনতা ও কুসংস্কারের ব্যাপক প্রসারের কারণে আরব জাতির জীবন মানবেতর জীবনে পরিণত হয়েছিল। ইতিহাসের পাতা আরবদের পঞ্চাশ বছর ও একশ’বছর স্থায়ী যুদ্ধের কাহিনী ও বিবরণে পূর্ণ। এ সব যুদ্ধ তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করেই সংঘটিত হয়েছে। বিশৃঙ্খলা ও গোলযোগ এবং বিভিন্ন পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং বিদ্রোহীদেরকে দমন করতে সক্ষম কোন শক্তিশালী সরকার ও প্রশাসন না থাকার কারণে আরব জাতি যাযাবর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছিল। এর ফলে তারা প্রতি বছর তাদের পশু ও অশ্বসমেত মরুভূমিতে এমন সব এলাকার সন্ধানে ঘুরে বেড়াত যেখানে প্রচুর পানি ও লতাগুল্মের অস্তিত্ব আছে। এ কারণে যেখানেই তারা পানি ও বসতির নিদর্শন দেখতে পেত সেখানেই অবতরণ করে তাঁবু স্থাপন করত। আর যখনই অধিকতর উত্তম কোন স্থানের সন্ধান পেত তখনই সেখানে যাওয়ার জন্য মরুপ্রান্তর পাড়ি দিত।

তাদের এ যাযাবর জীবনের পেছনে দু টি কারণ রয়েছে : 1. পানি,জলবায়ু-আবহাওয়া এবং চারণভূমির দিক থেকে আরবের খারাপ ও প্রতিকূল ভৌগোলিক অবস্থা এবং 2. প্রচুর রক্তপাত ও হানাহানি যা তাদেরকে ভ্রমণ ও এক জায়গা ত্যাগ করে অন্যত্র গমন করতে বাধ্য করত।


3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53

54

55

56

57

58

59

60

61