চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 103682
ডাউনলোড: 9120


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 103682 / ডাউনলোড: 9120
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

জনগণের ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধা দান

‘পবিত্র কোরআন শ্রবণ করা বর্জন ও বাধা দান’ কর্মসূচীর পরপরই অপর একটি কর্মসূচী নেয়া হয়। দূরের ও কাছের যে সব ব্যক্তি ইসলাম ধর্মের প্রতি ঝুঁকতে থাকে এবং পবিত্র মক্কায় আগমন করতে থাকে,কুরাইশদের নিযুক্ত গুপ্তচররা পথিমধ্যে অথবা পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রবেশ করার মুহূর্তে তাদের সাথে যোগাযোগ করে বিভিন্নভাবে তাদেরকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখত। এখানে আমরা দু টি জীবন্ত ঐতিহাসিক দলিল উপস্থাপন করব :

1. জাহেলী যুগের অন্যতম প্রসিদ্ধ কবি ছিলেন আ শা (أعشى )। তাঁর কবিতা কুরাইশদের উৎসবগুলোয় মিসরি দানার মতো গণ্য হতো (অর্থাৎ তাদের উৎসব ও ভোজসভাগুলোতে তাঁর কবিতাগুলো ব্যাপকভাবে আবৃত্তি করা না হলে সেগুলো জমতোই না)। জীবন সায়া হ্ন বার্ধক্য যখন তাঁর ওপর জেকে বসে তখন তাওহীদ ও ইসলাম ধর্মের কিছু সুমহান শিক্ষা ও বাণী তাঁর কাছে পৌঁছেছিল। তিনি পবিত্র মক্কা থেকে দূরে অবস্থিত একটি এলাকায় জীবনযাপন করতেন এবং তখনও ঐ সব এলাকায় মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াতের আহবান ও বাণী ভালোভাবে প্রচারিত হয় নি। কিন্তু তিনি ইসলাম ধর্মের সুমহান শিক্ষার সাথে যতটুকু পরিচিত হয়েছিলেন ততটুকুই তাঁর অস্তিত্বের মাঝে প্রবল ঝড় ও আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল। এ কারণেই তিনি মহানবীর প্রশংসায় একটি কাসীদাহ্ রচনা করেছিলেন যা মহানবী (সা.)-এর সামনে আবৃত্তি করার চেয়ে উত্তম আর কোন উপহার তাঁর দৃষ্টিতে বিবেচিত হয় নি। যদিও এ কাসীদাহ্ 24টি পঙ্ক্তিবিশিষ্ট তবুও এটি ছিল সর্বোত্তম কবিতা ও কাসীদাসমূহের অন্তর্ভুক্ত যেগুলো ঐ দিনগুলোতে মহানবী (সা.) সম্পর্কে রচিত হয়েছিল। এ কাসীদাটি শার দেওয়ান’ (আ শার কবিতাসমগ্র)-এর 101-103 পৃষ্ঠায় পাওয়া যাবে।309

মহানবী (সা.)-এর খেদমতে উপস্থিত হবার সৌভাগ্য অর্জন করার আগেই কুরাইশদের গুপ্তচর কবি আ শার সাথে যোগাযোগ করে তাঁর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে পরিচিত হয়। তারা খুব ভালোভাবে জানত যে,আ শা ইন্দ্রিয়াসক্ত এবং মদ ও নারীর প্রতি তাঁর চরম আসক্তি আছে। তারা তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর দুর্বল দিকটিকে কাজে লাগিয়ে বলল, হে আবু বসীর! আপনার চারিত্রিক ও আত্মিক অবস্থার সাথে মুহাম্মদের ধর্ম মোটেও সংগতিপূর্ণ নয়। তিনি বললেন, কেন? তখন তারা বলেছিল, সে যিনা (ব্যভিচার) হারাম (নিষিদ্ধ) করেছে। তিনি উত্তরে বলেছিলেন, এ কাজে (যিনা) আমার কোন প্রয়োজন নেই। এ বিষয়টি (ব্যভিচার নিষিদ্ধকরণ) তাঁর ধর্ম গ্রহণ করার পথে আমার জন্য কোন বাধা নয়। তারা বলল, সে মদ হারাম করেছে। শা এ কথা শুনে কিছুটা দুঃখ পেলেন এবং বললেন, আমি এখনও মদ পান করে তৃপ্তি লাভ করি নাই। আমি এখন ফিরে গিয়ে টানা এক বছর পরিপূর্ণ তৃপ্ত হওয়া পর্যন্ত মদপান করব এবং পরের বছর এসে তাঁর হাতে বাইআত করব। এ কথা বলে আ শা ফিরে গেলেন। কিন্তু মৃত্যু তাঁকে আর সে সুযোগ দেয় নি এবং ঐ বছরই তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন।310

2. তুফাইল ইবনে আমর : তিনি ছিলেন একজন মিষ্টভাষী জ্ঞানী কবি। নিজ গোত্রের মধ্যে তাঁর কথার বেশ প্রভাব ছিল। তিনি একদা পবিত্র মক্কা নগরীতে গমন করলেন। কিন্তু তুফাইলের মতো ব্যক্তিবর্গের ইসলাম গ্রহণ মক্কার কুরাইশদের জন্য ছিল অত্যন্ত মারাত্মক ও দুর্বিষহ। এ কারণেই কুরাইশ নেতৃবর্গ এবং রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিগণ তাঁর কাছে এসে বলেছিল, এ লোকটি যে পবিত্র কাবার পাশে নামায পড়ছে একটি নতুন ধর্ম প্রবর্তন করে সে আমাদের ঐক্য ও সংহতি নষ্ট করে দিয়েছে। আর সে তার কথার যাদু দিয়ে আমাদের মধ্যে অনৈক্য ও বিভেদের ভিত রচনা করেছে। আমরা ভয় পাচ্ছি যে,আপনাদের গোত্রের মধ্যেও সে বিভেদ ও অনৈক্যের সৃষ্টি করবে। তাই কতই না উত্তম হবে যদি আপনি এ লোকের সাথে কথা না বলেন!

তুফাইল বলেন, তাদের কথা আমার ওপর এতটা প্রভাব বিস্তার করেছিল যে,তাঁর ভাষার যাদুর প্রভাব বিস্তারের ভীতিবশত আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে,তাঁর সাথে কোন কথাই বলব না। আর তাঁর ভাষার যাদুর প্রভাব প্রতিহত করার জন্য তাওয়াফ করার সময় আমার কানের ভেতরে কিছু তুলা ভরে রাখলাম পাছে তাঁর নিচু স্বরে কোরআন তিলাওয়াত ও নামাযের ধ্বনি আমার কানে না পৌঁছায়। প্রত্যুষে আমার দু কানে তুলা থাকা অবস্থায় আমি মসজিদে প্রবেশ করি এবং তাঁর কথা শোনার কোন ইচ্ছা আমার ছিল না। কিন্তু আমার জানা নেই যে,কিভাবে আমার কানে অতি চমৎকার মিষ্টি বাণী তখন প্রবেশ করেছিল। আর আমিও সীমাহীন পুলকিত ও আনন্দিত হলাম। তখন আমি নিজেকেই বললাম : তোমার মা তোমার জন্য শোক প্রকাশ করুক। কারণ তুমি নিজেই একজন কবি ও বুদ্ধিমান। এ ব্যক্তির কথা শুনতে তোমার আপত্তি ও বাধাটা কোথায়? তাঁর কথা যদি সত্য হয় তাহলে তা গ্রহণ করবে। আর যদি তা মন্দ হয় তাহলে তা তুমি প্রত্যাখ্যান করবে। তাঁর সাথে প্রকাশ্যে যোগাযোগ না করে বরং একটু অপেক্ষা করতে লাগলাম। যখন তিনি সেখান থেকে বের হয়ে বাড়ির দিকে গমন করলেন এবং যে মুহূর্তে তিনি বাড়িতে প্রবেশ করতে যাবেন তখন আমিও তাঁর অনুমতি নিয়ে তাঁর ঘরে প্রবেশ করলাম। আমার ঘটনাটা আদ্যপান্ত তাঁকে শুনালাম এবং বললাম : কুরাইশগণ আপনার ব্যাপারে এরকম বলে থাকে এবং আমি মক্কায় আসার শুরুতে আপনার সাথে সাক্ষাৎ করার সিদ্ধান্ত নিই নি। কিন্তু আপনার ওপর অবতীর্ণ পবিত্র কোরআনের সুমিষ্টতা ও মাধুর্য আমাকে আপনার কাছে টেনে এনেছে। এখন আমি চাই আপনি আপনার ধর্মের প্রকৃত তাৎপর্য আমাকে ব্যাখ্যা করে শুনান।”

মহানবী (সা.) তুফাইলের কাছে ইসলাম ধর্মের প্রকৃত তাৎপর্য তুলে ধরলেন এবং পবিত্র কোরআন থেকে কিছু অংশ তিলাওয়াত করে শুনালেন। তুফাইল বলেন, মহান আল্লাহর শপথ,এর চাইতে সুন্দর কোন বাণী আমি শুনি নি এবং এ ধর্মের চেয়ে অধিকতর ভারসাম্যপূর্ণ ধর্ম আর দ্বিতীয়টি দেখি নি।

فلا والله ما سمعت قولاً قطُّ أحسن منه ولا أمراً أعدل منه

এরপর তুফাইল মহানবী (স.) এর কাছে অনুরোধ করে বললেন, আমি আমার গোত্রের মাঝে একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি। আমি আপনার ধর্ম প্রচারের জন্য কাজ করব।”

ইবনে হিশাম লিখেছেন, তুফাইল খায়বর যুদ্ধের দিবস পর্যন্ত তাঁর গোত্রের মধ্যে ইসলাম ধর্ম প্রচারে মশগুল ছিলেন। ঐ দিবসে প্রায় 87টি মুসলিম পরিবার তুফাইলের গোত্র থেকে মহানবী (সা.)-এর সাথে যোগ দেয়। তুফাইল ইবনে আমর মহানবীর ওফাতের পর খলীফাদের যুগে ইয়ামামার যুদ্ধে শাহাদাতের শরবত পান করা পর্যন্ত ইসলাম ধর্মের ওপর দৃঢ় ছিলেন।”

ঊনবিংশ অধ্যায় : গারানিক - এর উপাখ্যান

পাঠকদের মধ্যে সম্ভবত এমন ব্যক্তিও আছেন যাঁরা গারানিক -এর উপাখ্যানের উৎসমূল উদ্ধার করতে চান এবং বুঝতে চান যে,এ ধরনের মিথ্যা কল্প-কাহিনী তৈরি ও প্রসার করার ক্ষেত্রে কাদের হাত রয়েছে। স্মর্তব্য যে,গারানিকের এ উপাখ্যানটি আহলে সুন্নাত মাজহাবভুক্ত ঐতিহাসিকগণ বর্ণনা করেছেন।

ইয়াহুদীরা,বিশেষ করে তাদের নেতা ও ধর্মীয় পণ্ডিতগণ (আহবার) ইসলাম ধর্মের এক নম্বর শত্রু ছিল এবং আছে। কাবুল আহবার ও অন্যান্যের মতো একদল ব্যক্তি বাহ্যত ঈমান এনে মহান নবীদের নামে উদ্ধৃতি দিয়ে ভিত্তিহীন রেওয়ায়েতসমূহ প্রচার করে এবং মিথ্যা কল্প-কাহিনী বানিয়ে সত্য ঘটনাবলীর বিকৃতি সাধনে লিপ্ত হয়েছে। কতিপয় মুসলমান লেখক সকল মুসলিম ভাইয়ের প্রতি সুধারণা পোষণ করার কারণে গবেষণা ও অনুসন্ধান ব্যতিরেকেই তাদের বানোয়াট কাহিনীগুলোকে বিশুদ্ধ হাদীস ও ইতিহাসের সমপর্যায়ভুক্ত বিবেচনা করে লিপিবদ্ধ করেছেন।

কিন্তু এখন যখন এ ধরনের বিষয় অধ্যয়ন ও গবেষণা করার জন্য বিদগ্ধ পণ্ডিতগণের অপেক্ষাকৃত বেশি সময় ও সুযোগ রয়েছে এবং বিশেষ করে একদল ইসলামী গবেষকের বহু চেষ্টা-সাধনার ফলশ্রুতিতে কাল্পনিক উপাখ্যানসমূহ থেকে সঠিক ঐতিহাসিক ঘটনাবলী পৃথক করার মূলনীতিসমূহ প্রণীত হয়েছে তখন এ কারণেই একজন ধর্মীয় আলেম লেখকের জন্য যে কোন বই-পুস্তকে যা কিছু তিনি দেখতে পাবেন তা অকাট্য সত্য বিষয় হিসাবে গণ্য করা এবং যাচাই-বাছাই না করে তা গ্রহণ ও মেনে নেয়া অনুচিত।

গারানিকের উপাখ্যান কি?

বলা হয় যে,ওয়ালীদ,আ স,আসওয়াদ ও উমাইয়্যার মতো কুরাইশ নেতৃবর্গ ও গোত্রপতিগণ মহানবী (সা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁকে অনুরোধ জানায় যে,মতপার্থক্য ও বিরোধ নিষ্পত্তি করার জন্য উভয় পক্ষই একে অন্যের উপাস্যদেরকে মেনে নেবে। এ সময়ই সূরা আল কাফিরূন তাদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হয় এবং মহানবী (সা.) এ ধরনের কথা বলার জন্য আদিষ্ট হন যে, তোমরা যার ইবাদাত কর,আমি তার ইবাদাত করি না এবং আমিও যাঁর ইবাদাত করি,তোমরা তাঁর ইবাদাতকারী নও।”

এতদ্সত্ত্বেও মহানবী (সা.) কুরাইশদের সাথে একটি সমঝোতায় উপনীত হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন;তাই তিনি মনে মনে বলছিলেন, হায় যদি এমন কোন বিধান অবতীর্ণ হতো যা আমাদের ও কুরাইশদের মধ্যকার ব্যবধান কমিয়ে আনত।”

একদিন তিনি কাবার পাশে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও হৃদয়গ্রাহী কণ্ঠে সূরা নাজম তিলাওয়াত করছিলেন। যখন তিনি

) أفرأيتم اللّاتَ والعزّى ومناة الثّالثة الأخرى(

 (অতঃপর তোমরা কি লাত,উয্যা এবং অপর তৃতীয় প্রতিমা মানাতকে দেখেছ? অর্থাৎ আমাকে লাত,উয্যা ও মানাত সম্পর্কে তথ্য দিতে পারবে?)-এ দুই আয়াতে (সূরা নাজমের 19 ও 20 আয়াত) উপনীত হলেন তখন হঠাৎ শয়তান তাঁর (সা.) কণ্ঠে নিম্নোক্ত দু টি বাক্য উচ্চারিত করায়:

تلك الغرانيق العلى، منها الشّفاعةُ ترتجى

“এগুলো (লাত,উযযা ও মানাত) হচ্ছে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন মহান গারানিক311 এদের শাফায়াতই কাম্য।”

এরপর তিনি সূরা নাজমের অবশিষ্ট আয়াতগুলোও তিলাওয়াত করলেন। যখন তিনি সিজদার আয়াতে পৌঁছলেন312 তখন স্বয়ং তিনি,মুসলমান ও মুশরিক নির্বিশেষে সকল উপস্থিত ব্যক্তি প্রতিমাগুলোর সামনে সিজদাহ্ করলেন। কেবল ওয়ালীদ বার্ধক্যজনিত কারণে সিজদা করতে পারে নি।

মসজিদুল হারামে তুমুল হৈ চৈ ও আনন্দের বান বয়ে গেল। আর মুশরিকরা বলতে লাগল : মুহাম্মদ আমাদের উপাস্যদের প্রশংসা এবং সম্মানের সাথে স্মরণ করেছে। কুরাইশদের সাথে মুহাম্মদ (সা.)-এর সন্ধি-চুক্তির খবর হাবাশায় হিজরতকারী মুসলমানদের কানে গিয়েও পৌঁছায়। আর কুরাইশদের সাথে মুহাম্মদ (সা.)-এর সন্ধি ও শান্তি চুক্তি একদল মুহাজির মুসলমানের নিজেদের আবাসস্থল (হাবাশা) থেকে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করার কারণ ছিল। কিন্তু মক্কায় প্রত্যাবর্তন করার পর তাঁরা দেখতে পেলেন যে,অবস্থা পুনরায় পরিবর্তিত হয়ে গেছে এবং ওহীর ফেরেশতা মহানবীর ওপর অবতীর্ণ হয়ে তাঁকে পুনরায় মুশরিকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও জিহাদ করার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, এ দু টি বাক্য শয়তান আপনার কণ্ঠে জারী করেছে। আর আমি কখনই এ ধরনের কথা বলি নি। আর এতদ্প্রসঙ্গে সূরা হজ্বের 52-54 নং আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়।

এটিই ছিল গারানিক উপাখ্যান যা তাবারী তাঁর313 ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন এবং প্রাচ্যবিদগণও তা ঢাক-ঢোল বাজিয়ে বর্ণনা করেছেন।

উপাখ্যান সংক্রান্ত একটি সাদামাটা পর্যালোচনা

আপনারা ধরে নিন যে,হযরত মুহাম্মদ (সা.) নির্বাচিত আসমানী ব্যক্তিত্বদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না;কিন্তু তাই বলে তাঁর বুদ্ধিমত্তা,দক্ষতা এবং জ্ঞান কখনই অস্বীকার করা সম্ভব নয়। কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তিই কি এ ধরনের কাজ করবে? যিনি জ্ঞানী,বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান এবং দেখতে পাচ্ছেন যে,প্রতিদিনই তাঁর অনুসারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং শত্রু শিবিরে বিরোধ ও ফাটল ব্যাপকতর হচ্ছে তখন কি এ ধরনের পরিস্থিতিতে তিনি এমন কোন কাজ করবেন যার ফলে তাঁর ব্যাপারে বন্ধু ও শত্রু সবাই হতাশ হয়ে পড়বে? আপনারা কি বিশ্বাস করবেন,যে ব্যক্তি তাওহীদী ধর্ম ইসলামের পথে কুরাইশদের প্রস্তাবিত সকল পদ ও বিত্ত-বৈভব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তিনিই আবার শিরক ও প্রতিমাপূজার প্রবর্তক হয়ে যাবেন? আমরা একজন সংস্কারক ও সাধারণ রাজনীতিবিদের ব্যাপারেই এ ধরনের সম্ভাবনা আরোপ করি না,আর সেখানে মহানবী (সা.)-এর ক্ষেত্রে তো প্রশ্নই আসে না।

এ উপাখ্যান প্রসঙ্গে বিবেক-বুদ্ধির ফায়সালা

1. ঐশ্বরিক শিক্ষকগণ (অর্থাৎ নবী-রাসূলগণ) বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে সব সময় ইসমাত অর্থাৎ পবিত্রতার শক্তির বদৌলতে সব ধরনের পাপ,স্খলন ও ভুল-ভ্রান্তি থেকে সংরক্ষিত ও নিরাপদ। আর যদি অবধারিত থাকে যে,তাঁরা ধর্মীয় বিষয়াদির ক্ষেত্রেও ভুল-ভ্রান্তির শিকার হবেন,তাহলে তাঁদের কথা ও বাণীর প্রতি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস ধ্বংস হয়ে যাবে।

অতএব,এ ধরনের ঐতিহাসিক ঘটনাবলীকে আমাদের যুক্তিভিত্তিক আকীদা-বিশ্বাস দিয়ে অবশ্যই বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। আমাদের দৃঢ় আকীদা-বিশ্বাসের আলোকে ইতিহাসের অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য বিষয় ও ঘটনাবলীর সমাধান করতে হবে। নিশ্চিতভাবে খোদায়ী ধর্ম প্রচার মহানবী (সা.)-এর ইসমাত এ ধরনের ঘটনাবলী ঘটার ক্ষেত্রে অন্তরায়স্বরূপ।

2. এ উপাখ্যানের ভিত্তি হচ্ছে এরূপ : মহান আল্লাহ্ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাঁধে যে দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন তিনি তা পালন করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। মূর্তিপূজক ও পৌত্তলিকদের বিচ্যুতি তাঁর কাছে খুবই দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। তাই তিনি তাদের অবস্থার পরিবর্তন ও সংস্কার সাধনের উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু বিবেক ও বুদ্ধিবৃত্তির আলোকে নবী-রাসূলদেরকে অবশ্যই সীমাহীনভাবে ধৈর্যশীল হতে হবে। ধৈর্যাবলম্বনের ক্ষেত্রে তাঁদেরকে নিরঙ্কুশভাবে সকলের জন্য অনুসরণীয় উদাহরণে পরিণত হতে হবে। বাস্তবতা ও ময়দান থেকে পলায়ন করার চিন্তা যেন তাঁরা কখনই মাথায় না আনেন।

আর গারানিকের উপাখ্যানটি যদি সত্য হয় তাহলে এ থেকে প্রতীয়মান হয়ে যাবে যে,আমাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু মহানায়ক পুরুষটি তাঁর ধৈর্য-ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন,তাঁর মন ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল। আর এ বিষয়টি বুদ্ধিবৃত্তির আলোকে মহান নবী-রাসূলদের ক্ষেত্রে মোটেও খাপ খায় না। আর তা মহানবী (সা.)-এর জীবনীর সাথে মোটেও সংগতিশীল নয় যা ইতোমধ্যে আলোচনা করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও আলোচনা করা হবে।

এ কাহিনী ও উপাখ্যানের রচয়িতা ভেবেও দেখে নি যে,পবিত্র কোরআন এ ঘটনাটি বানোয়াট ও ভিত্তিহীন হওয়ার জন্য উৎকৃষ্ট সাক্ষী। কারণ মহান আল্লাহ্ তাঁর নবীকে সুসংবাদ দিয়েছেন যে,এতে কখনই বাতিল অনুপ্রবেশ করতে পারবে না। যেমন পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে :

) لا يأتيه الباطلُ من بين يديه ولا من خلفه(

“বাতিল (মিথ্যা) না সামনে থেকে এতে (পবিত্র কোরআনে) আসতে পারবে,না পেছন থেকে। (সূরা ফুসসিলাত : 42)।

পবিত্র কোরআনে আরো বর্ণিত হয়েছে :

) إنّا نحنُ نزّلنا الذِّكرَ وإنّا له لحافظون(

“নিশ্চয়ই আমরা যিকর (আল-কোরআন) অবতীর্ণ করেছি এবং আমরাই এর হিফাযতকারী। (সূরা হিজর : 9)।

এতদ্সত্ত্বেও মহান আল্লাহর দরবার থেকে বিতাড়িত (শয়তান) কিভাবে মহান আল্লাহর মনোনীত বান্দার ওপর বিজয়ী হবে এবং তাঁর ওপর অবতীর্ণ কোরআনে বাতিলের অনুপ্রবেশ করাবে। আর যে কোরআনের ভিত্তি হচ্ছে মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে সংগ্রাম সে কোরআনটিকেই সে মূর্তিপূজা ও পৌত্তলিকতার প্রচারক বানিয়ে দিয়েছে।

খুবই আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এই যে,এ কাহিনী ও উপাখ্যানের রচয়িতা অনুপযুক্ত স্থানে একটি বেমানান গীত তৈরি করেছে এবং এমন এক স্থানে তাওহীদের ওপর অপবাদ আরোপ করেছে যে,অল্প কিছুক্ষণ আগে স্বয়ং কোরআনই তা প্রত্যাখ্যান করেছে। কারণ মহান আল্লাহ্ এ সূরায় এরশাদ করেছেন,

) وما ينطقُ عن الهوى إنْ هو إلّا وحيٌ يوحى(

“তিনি নিজ প্রবৃত্তির কামনা-বাসনাবশত কথা বলেন না;যা কিছু বলেন তা তাঁর কাছে প্রেরিত ও অবতীর্ণ ওহী।”

কিন্তু কিভাবে মহান আল্লাহ্ এত অকাট্য ও নিশ্চিত সুসংবাদ দিয়েও তাঁর নবীকে অরক্ষিত রাখবেন এবং শয়তানকে তাঁর হৃদয়,চিন্তা-চেতনা ও মন-মানসিকতায় প্রভাব বিস্তার করার অনুমতি দেবেন?

এ সব বুদ্ধিবৃত্তিক দলিল-প্রমাণ ঐ সব ব্যক্তির জন্য উপকারী যারা মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াত ও রিসালাতে ঈমান রাখে। তবে যে সব প্রাচ্যবিদ তাঁর নবুওয়াত ও রিসালাতে বিশ্বাসী নন এবং ইসলাম ধর্মের অবমূল্যায়ন করার জন্য এ ধরনের ভিত্তিহীন উপাখ্যান বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করে থাকেন তাঁদের জন্য এগুলো যথেষ্ট নয়। অবশ্যই আরেক পদ্ধতিতে তাঁদের বক্তব্যের সমুচিত জবাব দিতে হবে।

উপাখ্যানটি ভিত্তিহীন প্রমাণ করা

ইতিহাসে বর্ণিত আছে যে,যখন মহানবী (সা.) এ সূরাটি তিলাওয়াত করছিলেন তখন কুরাইশ নেতৃবর্গ যাদের অধিকাংশই ছিল প্রথিতযশা সাহিত্যিক,কথাশিল্পী এবং ভাষার প্রাঞ্জলতা,সাবলীলতা ও অলংকারশাস্ত্রের দিকপাল তারা মসজিদুল হারামে উপস্থিত ছিল। তাদের মধ্যে সেখানে ওয়ালীদও উপস্থিত ছিল। এই ওয়ালীদ ছিল আরবের প্রজ্ঞাবান কথাশিল্পী ও সাহিত্যিক। সে বিচক্ষণতা,বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞার জন্য আরব জাতির মাঝে অত্যন্ত খ্যাতি অর্জন করেছিল। সে সহ উপস্থিত সকল ব্যক্তি এ সূরাটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ এ সূরার সর্বশেষ আয়াতটি যা হচ্ছে সিজদার আয়াত তা সহ শুনেছে এবং সিজদা করেছে।

কিন্তু এ গোষ্ঠীটি যারা ছিল অলংকারশাস্ত্রের স্থপতি এবং তুখোড় সাহিত্য ও কাব্য সমালোচক তারা কিভাবে মাত্র এ দু টি বাক্যের ওপর নির্ভর করেছে যেগুলোয় তাদের উপাস্যদের স্তুতি বিদ্যমান? অথচ এ দু টি বাক্যের পূর্বের ও পরবর্তী বাক্যগুলোয় আদ্যোপান্ত তাদের উপাস্যদের তীব্র নিন্দা,তিরস্কার ও দোষারোপ করা হয়েছে।

স্পষ্ট এ বানোয়াট কাহিনীর রচয়িতা তাদেরকে কি ধরনের ব্যক্তি বলে মনে করেছে? যে গোষ্ঠীটির ভাষা আরবী এবং সমগ্র আরব সমাজে যাদেরকে ভাষাবিদ ও অলংকারশাস্ত্রের স্থপতি বলে গণ্য করা হতো এবং যারা স্পষ্ট অর্থবোধক বাক্য ও উক্তিসহ নিজেদের মাতৃভাষার সকল ইশারা-ইঙ্গিত এবং পরোক্ষ অর্থবোধক উক্তি অন্যদের চেয়ে ভালোভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম তারা কিভাবে মাত্র দু টি বাক্যের ওপর নির্ভর করতে পারল যেগুলোয় তাদের দেব-দেবী ও উপাস্যদের প্রশংসা ও স্তুতি রয়েছে এবং কিভাবে তারা এ দু টি বাক্যের পূর্ববর্তী বাক্যগুলোর ব্যাপারে সম্পূর্ণ অমনোযোগী থেকে গেল? যেখানে সাধারণ মানুষকে ঐ সব বাক্য যেগুলোয় আদ্যোপান্ত তাদের আকীদা-বিশ্বাস ও আচার-আচরণের তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে সেগুলোর মধ্যে কেবল এ দু টি বাক্য দিয়ে ধোঁকা দেয়া সম্ভব নয় সেখানে অসাধারণ ব্যক্তিদেরকে এ দু টি বাক্য দিয়ে ধোঁকা দেয়া কিভাবে সম্ভব?

এখন আমরা সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলো এখানে উল্লেখ করছি এবং এ দু টি বাক্যের স্থানে বিন্দু স্থাপন করছি অর্থাৎ তা খালি রাখছি;এরপর এগুলোর বঙ্গানুবাদ করছি। আপনারা ভালোভাবে লক্ষ্য করবেন যে,আসলেই কি এ বাক্যদ্বয় (تلك الغرانيق العلى، منها الشّفاعةُ ترتجى অর্থাৎ এরা হচ্ছে উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন সুন্দর যুবক যাদের কাছ থেকেই কেবল শাফায়াত প্রত্যাশা করা যায়) এ সব আয়াতের মাঝে স্থান দেয়া যায় যেগুলোয় প্রতিমা ও মূর্তিসমূহের নিন্দা ও ভর্ৎসনা করা হয়েছে?

أفرأيتمُ اللّاتَ والعُزّى ومناةَ الثّالثةَ الأخرى ألكمُ الذّكرُ وله الأُنثى تلكَ إذاً قِسْمةٌ ضيزى إنْ هي إلّا أسماءٌ سمَّيتموها أنتم وآباؤكم ما أنزلَ اللهُ بها مِنْ سلطانٍ

“আমাকে লাত,উয্যা ও মানাত যা হচ্ছে তৃতীয় প্রতিমা সে সম্পর্কে বল...314   পুত্রসন্তান কি তোমাদের এবং কন্যাসন্তান মহান আল্লাহর? (তাহলে) এ তো এক ধরনের অন্যায্য বণ্টন-রীতি। প্রতিমাগুলো নিছক কতগুলো নাম ছাড়া আর কিছুই নয় যেগুলো তোমরা ও তোমাদের পূর্বপুরুষগণই রেখেছ;আর মহান আল্লাহ্ এ ব্যাপারে (এ প্রতিমার ব্যাপারে) কোন স্পষ্ট দলিল-প্রমাণ অবতীর্ণ করেন নি?

একজন সাধারণ মানুষও কি মহানবী (সা.)-এর মতো-যে শত্রু দশ বছর যাবত তাঁর ধর্মের ওপর তীব্র আঘাত হেনেছে এবং তার অস্তিত্ব ও স্বাধীনতা বিপন্ন করে তুলেছে সেই শত্রুর পক্ষ থেকে এ ধরনের পরস্পরবিরোধী কতিপয় বাক্য শুনেই তার বিরুদ্ধাচরণ করা থেকে হাত গুটিয়ে নেবে এবং তার সাথে সকল বিরোধের নিষ্পত্তি করবে?