চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড3%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 108635 / ডাউনলোড: 10076
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

সফরের কর্মসূচীতে পরিবর্তন

তখনও মহানবী (সা.)-এর জীবনের ১২টি বসন্ত গত হয় নি,ঠিক ঐ সময় হযরত আবু তালিব (রা.) কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলার সাথে শাম দেশ গমন করেছিলেন। যে মুহূর্তে মালপত্র উটের পিঠে বেঁধে উটগুলোকে যাত্রার জন্য প্রস্তুত করা হলো এবং যাত্রা করার ঘণ্টা বেজে উঠল ঠিক তখনই মহানবী (সা.) হঠাৎ হযরত আবু তালিবের উটের দড়ি হাতে নিয়ে নিলেন;আর সেই মুহূর্তে তাঁর (মহানবীর) নয়ন যুগল অশ্রুসিক্ত হয়ে গেল এবং ছল ছল করতে লাগল। তিনি বললেন, হে চাচা! আপনার সাথে আমিও অবশ্যই যাব। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চোখে অশ্রু দেখতে পেয়ে হযরত আবু তালিবেরও দু নয়ন বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল।

হযরত আবু তালিবও এ ধরনের অতি সংবেদনশীল মুহূর্তে অত্যাবশ্যকীয় পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই ভ্রাতুষ্পুত্রকে নিজের সাথে সফরে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। যদিও ঐ কাফেলায় তাঁর জন্য কোন স্থান আগে থেকেই নির্দিষ্ট করা হয় নি তবুও তিনি (আবু তালিব) তাঁর (মহানবীর) সফরের যাবতীয় চাপ ও ঝামেলা নিজেই সামাল দিয়েছিলেন। তিনি মহানবীকে নিজের উটের পিঠেই সওয়ার করলেন। আর সফরে তিনি সব সময় তাঁর জন্য চিন্তা করতেন। এই সফরে তিনি মহানবী (সা.)-এর বেশ কিছু মু’জিযা প্রত্যক্ষ করে কিছু কবিতা রচনা করেছিলেন যেগুলো আবু তালিবের কাব্য সমগ্র অর্থাৎ দিওয়ানে সংকলিত হয়েছে।৩২৯

বিশ্বাসের সংরক্ষণ ও সুরক্ষা

ঈমানী শক্তির মতো আর কোন শক্তিই হতে পারে না যা দৃঢ়তা,স্থিরতা ও অবিচলতা দানকারী। জীবনে মানুষের প্রগতি ও উন্নতির শক্তিশালী কারণ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রতি তার শক্তিশালী আস্থা ও বিশ্বাস যা সব ধরনের দুঃখ-কষ্ট ও যন্ত্রণাকে বিলীন করে দেয় এবং মানুষকে তার পবিত্র ও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য মৃত্যুরও মুখোমুখি করে।

ঈমানী শক্তিবলে বলীয়ান সৈনিক শতকরা একশ’ ভাগ বিজয়ী হবেই। যে যোদ্ধা বিশ্বাস করে যে,আকীদা-বিশ্বাস ও আদর্শের পথে হত্যা করা ও নিহত হওয়াই হচ্ছে প্রকৃত সৌভাগ্য,আসলে বিজয় ও সাফল্য তার হবেই। যুগোপযোগী অস্ত্র ও হাতিয়ারে সজ্জিত হবার আগেই যোদ্ধার হৃদয় অবশ্যই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা দ্বারা পরিপূর্ণ হতে হবে;তার অন্তঃকরণ সত্যের প্রতি প্রেম ও ভালোবাসার আলোকবর্তিকা দ্বারা অবশ্যই আলোকিত হতে হবে। তার যাবতীয় কর্মকাণ্ড,স্থিতি,যুদ্ধ ও সন্ধি অবশ্যই ঈমান ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে হতে হবে;তার যুদ্ধ,সংগ্রাম ও সন্ধি সবকিছুই অবশ্যই ঈমান ও বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।

চিন্তা-চেতনা ও আকীদা-বিশ্বাস আমাদের আত্মা থেকেই উদ্ভূত। আর প্রকৃতপক্ষে মানুষের চিন্তা-ভাবনার উৎপত্তিও তার বিবেক-বুদ্ধি থেকেই। মানুষ যেমন তার ঔরসজাত সন্তানকে ভালোবাসে ঠিক তেমনি সে তার চিন্তা-ভাবনার প্রতিও ভালোবাসা প্রদর্শন করে যা তার বিবেক-বুদ্ধি ও আত্মা হতে উদ্ভূত। বরং নিজ আকীদা-বিশ্বাসের প্রতি মানুষের টান ও ভালোবাসা নিজের ঔরসজাত সন্তানের প্রতি টান ও ভালোবাসার চেয়েও বেশি। এ কারণেই মানুষ তার নিজ আকীদা-বিশ্বাস সংরক্ষণ করার জন্য মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। সে নিজ আকীদা-বিশ্বাসের বেদীমূলে তার সব কিছু উৎসর্গ করতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। অথচ সে তার সন্তান-সন্ততি ও আপনজনদেরকে রক্ষা করার জন্য এতটা আত্মত্যাগ করে না।

অর্থ,ধনসম্পদ ও পদমর্যাদার প্রতি মানুষের টান ও আগ্রহ সীমিত। যে পর্যন্ত না নিশ্চিত মৃত্যু তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে সে পর্যন্ত সে অর্থ,সম্পদ ও পদমর্যাদা প্রাপ্তির চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু সে-ই আবার আকীদা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে মৃত্যুর মুখোমুখি হয় এবং এ পথে বেঁচে থাকার চেয়ে সম্মানজনক মৃত্যুকেই অগ্রাধিকার প্রদান করে। এভাবে সে মুজাহিদ বীর পুরুষদের বদনমণ্ডলে প্রকৃত জীবনের প্রতিচ্ছবি প্রত্যক্ষ করে। তাইإنّما الحياةَ عقيدةٌ وَجِهادٌ নিশ্চয়ই জীবনই হচ্ছে আকীদা-বিশ্বাস ও জিহাদ’-এ বাক্যটি তার জপমালায় পরিণত হয়।৩৩০

(প্রিয় পাঠকবর্গ!) আমাদের কাহিনীর মহানায়কের (পবিত্র ইসলাম ধর্ম ও মহানবীর একমাত্র পৃষ্ঠপোষক ও সংরক্ষণকারী) জীবনীর দিকে একটু দৃষ্টি দিন;এ পথে কোন্ জিনিসটি তাঁকে প্রেরণা দিয়েছে এবং কোন্ কারণের বশবর্তী হয়ে তিনি মৃত্যু ও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এগিয়ে গিয়েছেন,নিজের জীবন,ধন-সম্পদ,সম্মান,পদমর্যাদা ও গোত্রের মায়াও ত্যাগ করেছেন এবং মহানবী (সা.)-এর জন্য তাঁর সবকিছু উৎসর্গ করেছেন? নিশ্চিত করে বলা যায় যে,তাঁর (আবু তালিব) কোন বস্তুবাদী কারণ ও উদ্দেশ্য ছিল না এবং তিনি তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রকে ব্যবহার করে দুনিয়াবী কোন স্বার্থ উদ্ধার অর্থাৎ কোন পার্থিব সম্পদ অর্জন করতে চান নি। কারণ ঐ সময় মহানবী রিক্ত হস্ত ছিলেন এবং তাঁর কোন ক্ষমতা ও বিত্ত-বিভব ছিল না। আর আবু তালিবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য (মহানবীকে ব্যবহার করে) সামাজিক প্রতিপত্তি,পদ ও মর্যাদা অর্জনও ছিল না। কারণ তখনকার সমাজে তিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক পদ ও মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। তিনি ছিলেন পবিত্র মক্কা ও বাতহা অঞ্চলের প্রধান। বরং মহানবীকে সাহায্য ও সমর্থন করার কারণে তিনি তাঁর অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও পদমর্যাদা প্রায় হারাতে বসেছিলেন। কারণ মহানবী (সা.)-কে রক্ষা করতে গিয়েই তো মক্কার গোত্রপতিগণ তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল এবং তারা তাঁর ও বনি হাশিম গোত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

বাতিল ও অমূলক চিন্তা

সম্ভবত কোন কোন সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণকারী ব্যক্তি চিন্তা করতে পারে যে,হযরত আবু তালিবের আত্মত্যাগের কারণই হচ্ছে আত্মীয়তা ও রক্তসম্পর্ক। অর্থাৎ আরেকভাবে বলা যায় যে,অন্ধ সাম্প্রদায়িকতা ও গোত্রীয় গোঁড়ামি তাঁকে এ কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে এবং বংশীয় গোঁড়ামি ও গোত্রীয় বন্ধনের কারণেই তিনি তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রের পথে নিজ অস্তিত্ব পর্যন্ত বিলীন করে দিতে প্রস্তুত ছিলেন।

কিন্তু এ ধরনের ধারণা ও কল্পনা এতটা বৃথা ও ভিত্তিহীন যে সামান্য একটু অনুসন্ধান ও গবেষণা করলেই এর ভিত্তিহীনতা দিব্য পরিষ্কার হয়ে যায়। কারণ নিছক আত্মীয়তার সম্পর্ক ও বন্ধন কখনই মানুষকে তার পুরো অস্তিত্ব তারই এক আত্মীয়ের জন্য বিসর্জন দিতে,নিজ পুত্র আলীকে ভ্রাতুষ্পুত্রের পথে উৎসর্গ করতে এবং ভ্রাতুষ্পুত্রের পথে নিজ সন্তানকে টুকরো টুকরো করতে মোটেও উদ্বুদ্ধ করবে না।

যদিও কখনো কখনো বংশীয় গোঁড়ামি মানুষকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায় তবুও বিশেষভাবে কোন একজন নির্দিষ্ট আত্মীয়ের প্রতি এত তীব্র মাত্রায় বংশীয় গোঁড়ামি পোষণ করার কোন অর্থই থাকতে পারে না। অথচ হযরত আবু তালিব (রা.) একজন নির্দিষ্ট আত্মীয়ের জন্যই কেবল এতটা আত্মত্যাগ করেছিলেন যা তিনি আবদুল মুত্তালিব ও হাশিমের আর কোন বংশধরের জন্য কখনই করেন নি।

আবু তালিবকে উদ্বুদ্ধ করার প্রকৃত কারণ

এ মূলনীতির ভিত্তিতে (সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে) যে কারণ আবু তালিব (রা.)-কে উদ্বুদ্ধ করেছিল তা নিছক কোন বস্তুগত বিষয়,পদমর্যাদার লোভ বা গোত্রীয় সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামি ছিল না। বরং কোন একটি আধ্যাত্মিক কারণ বা বিষয় তাঁকে আত্মোৎসর্গ করার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। আর শত্রুদের চাপ ও ক্ষমতা তাঁকে সব ধরনের আত্মত্যাগ করার জন্য পূর্ণ প্রস্তুত রাখত। সেই কারণ যা তাঁকে আত্মোৎসর্গ করার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে তা ছিল মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি তাঁর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস। কারণ তিনি মহানবীকে মহৎ গুণাবলী ও মানবতার পূর্ণ বহিঃপ্রকাশ ও নিদর্শন বলে বিশ্বাস করতেন। যেহেতু তিনি সত্যের প্রেমিক ছিলেন সেহেতু তিনি স্বভাবতই সত্যকে সমর্থন ও পক্ষাবলম্বন করবেন।

হযরত আবু তালিবের কবিতাসমূহ থেকে এ সত্যটি স্পষ্ট বোধগম্য হয়। তিনি প্রকাশ্যে মহানবীকে হযরত মূসা ও হযরত ঈসা (আ.)-এর মতো নবী মনে করতেন। এখানে তাঁর কয়েকটি কবিতার বঙ্গানুবাদ পেশ করা হলো যেগুলো দ্বারা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি তাঁর ঈমান প্রমাণিত হয়ে যায় :

ليعلمْ خيارُ النّاسِ أنّ محمّداً

نبيٌّ كموسى والمسيح بن مريم

اتانا بهدىً مثل ما أتيا به

فكل بأمر الله يهدي ويعصم

সকল শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি জেনে নিক যে,নিশ্চয়ই মুহাম্মদ

মূসা ও ঈসা ইবনে মরিয়মের মতো একজন নবী

তাঁরা দু জন যে হেদায়েত আনয়ন করেছিলেন,সেরূপ হেদায়েত তিনিও আমাদের জন্য এনেছেন

তাই তাঁদের প্রত্যেকেই মহান আল্লাহর নির্দেশে হেদায়েত করেন এবং পাপ থেকে মুক্ত।”

وإنّكم تتْلونه في كتابكم

بصدقِ حديثٍ لا حديث المرجم

আর তোমরা তোমাদের গ্রন্থে তাঁর সত্যবাদিতার কথা

অবশ্যই পাঠ কর তিনি না জেনে শুনে কথা বলেন না।

আরেকটি কাসীদায় হযরত আবু তালিব নিজ ভাতিজার ব্যাপারে তাঁর নিজস্ব আকীদা-বিশ্বাস এভাবে ব্যাক্ত করেছেন :

ألم تعلموا أنّا وجدنا محمّداً

رسولاً كموسى خطَّ في أوّل الكتبِ

“তোমাদের কি জানা নেই যে,আমরা মুহাম্মদকে মূসা ইবনে ইমরানের মতো একজন রাসূল হিসাবে পেয়েছি। আর তাঁর নবুওয়াত সংক্রান্ত বিবরণ পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থসমূহে লিপিবদ্ধ রয়েছে। ৩৩১

পূর্বোল্লিখিত কবিতাসমূহ এবং অন্যান্য কবিতা যেগুলো দিওয়ানে আবু তালিব তা ইতিহাসের পাতায় পাতায় এবং হাদীস ও তাফসীরের গ্রন্থাবলীতে লিপিবদ্ধ আছে। সেগুলো থেকে স্পষ্ট প্রমাণ মেলে যে,যে লক্ষ্য ও কারণ মহানবী (সা.) ও ইসলাম ধর্মকে রক্ষা করার জন্য তাঁকে উদ্দীপ্ত করেছে তা ছিল আসলে তাঁর বিশুদ্ধ বিশ্বাস এবং ইসলাম ধর্মের প্রতি তাঁর প্রকৃত আত্মসমর্পণ। কেবল তাঁর আকীদা ও ঈমান ব্যতীত আর কোন কারণ ও লক্ষ্য বিদ্যমান ছিল না। আমরা মহানবী ও ইসলাম ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে তাঁর আত্মত্যাগ,অকুণ্ঠ সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা দানের গুটিকতক নিদর্শন তুলে ধরব এবং আপনারা এ ধরনের আত্মোৎসর্গ ও ত্যাগের ব্যাপারে নিজেরাই গভীর ও সূক্ষ্মভাবে চিন্তা ও গবেষণা করবেন তাহলে তখন আপনারা নিজেরাই বিচার করতে পারবেন যে,এ ধরনের আত্মোৎসর্গ ও ত্যাগের উৎস মূল খাঁটি আকীদা-বিশ্বাস ও ঈমান ব্যতীত আর কিছুই হতে পারে না।

আবু তালিব (রা.)-এর ত্যাগের কতিপয় নমুনা

কুরাইশ নেতৃবর্গ মহানবী (সা.)-এর উপস্থিতিতে হযরত আবু তালিবের ঘরে একটি সভার আয়োজন করে। তাদের মধ্যে সেখানে বাক্য বিনিময় ও আলোচনা অনুষ্ঠিত হবার পর কুরাইশ নেতৃবৃন্দ তাদের আলোচনার ফলাফলের অপেক্ষা না করেই সেখান থেকে উঠে গেল। ঐ অবস্থায় উকবা ইবনে আবি মুঈত উচ্চৈঃস্বরে চেঁচিয়ে বলতে লাগল : তাকে (মহানবী) তার অবস্থার ওপর ছেড়ে দাও। তাকে সদুপদেশ দিয়ে কোন লাভ হবে না। তাকে অবশ্যই হত্যা করা উচিত

(لا نعود إليه أبداً وما خير من ان نقتال محمّداً )।”

হযরত আবু তালিব (রা.) এ কথা শুনে খুবই মর্মাহত হলেন। তবে তিনি কিইবা করতে পারতেন। তারা (কুরাইশ সর্দারগণ) তাঁর ঘরে অতিথি হিসাবে এসেছিল। ঘটনাক্রমে মহানবী সেদিন ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন এবং আর ঘরে ফিরলেন না। সন্ধ্যার দিকে মহানবী (সা.)-এর চাচারা তাঁর ঘরে যান কিন্তু তাঁরা তাঁকে সেখানে দেখতে পেলেন না। হঠাৎ উকবার কথা হযরত আবু তালিবের মনে পড়ে গেল। তখন তিনি মনে মনে বললেন, অবশ্যই আমার ভাতিজাকে তারা হত্যা করে ফেলেছে।”

তখন তিনি চিন্তা করলেন যে,যা হবার তা হয়ে গিয়েছে। এখন অবশ্যই মক্কার ফিরআউনদের কাছ থেকে মুহাম্মদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে হবে। তাই তিনি পুরো বনি হাশিম গোত্র এবং আবদুল মুত্তালিবের বংশধরদের তাঁর নিজ গৃহে ডেকে প্রত্যেককেই ধারালো অস্ত্র তাঁদের পোশাকের নিচে লুকিয়ে রেখে একত্রে মসজিদুল হারামে গমন করার নির্দেশ দিলেন। তিনি তাঁদেরকে বললেন তাঁরা যেন প্রত্যেকেই প্রতি একজন করে কুরাইশ নেতার পাশে বসে। আর যখনই আবু তালিবের স্বর উচ্চকিত হবে এবং তিনি বলতে থাকবেন : হে কুরাইশ সম্প্রদায়! আমি মুহাম্মদকে চাচ্ছি (يا معشر قريش أبغي محمّداً ) তখন তাৎক্ষণিকভাবে তাঁরা তাঁদের জায়গা থেকে উঠে দাঁড়াবেন এবং প্রত্যেকে যে ব্যক্তির কাছে বসেছেন তাকে হত্যা করে ফেলবেন;আর এভাবে সকল কুরাইশ নেতৃবৃন্দ একত্রে এক দফায় নিহত হবে।

হযরত আবু তালিব (রা.) যখন মসজিদুল হারামে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছিলেন ঠিক তখন অকস্মাৎ যায়েদ ইবনে হারেসা সেখানে উপস্থিত হলেন এবং তাঁদের প্রস্তুতি প্রত্যক্ষ করলেন। তিনি এতটা আশ্চর্যান্বিত হলেন যে,তাঁর বাকশক্তি যেন রহিত হয়ে গেল এবং বললেন, মহানবী (সা.)-এর কোন ক্ষতি হয়নি। তিনি এক মুসলমানের ঘরে ধর্ম প্রচার কার্যে মশগুল আছেন। এ কথা বলেই তিনি মহানবীর কাছে দৌড়ে চলে গেলেন এবং তাঁকে হযরত আবু তালিবের অত্যন্ত বিপজ্জনক এ সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অবগত করলেন। মহানবীও অতি দ্রূতগতিতে ঘরে পৌঁছলেন। হযরত আবু তালিব (রা.)-এর দৃষ্টি ভ্রাতুষ্পুত্র মহানবীর পবিত্র সুন্দর ও আকর্ষণীয় চেহারার ওপর পড়লে তাঁর দু চোখ বেয়ে আনন্দাশ্রু বয়ে যেতে লাগল। তিনি তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, হে আমার ভাতিজা! তুমি কোথায় ছিলে? তুমি ভাল ছিলে তো? মহানবী চাচার প্রশ্নের জবাব দিলেন এবং বললেন যে,কেউ তাঁর কোন ক্ষতি করে নি।

হযরত আবু তালিব (রা.) পুরো ঐ রাতটা চিন্তামগ্ন ছিলেন। তিনি চিন্তা করছিলেন, আজ আমার ভ্রাতুষ্পুত্র শত্রুর আক্রমণের শিকার হয় নি। তবে কুরাইশরা তাকে যতক্ষণ পর্যন্ত হত্যা না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত স্থির ও শান্ত হতে পারবে না। তিনি এ উদ্যোগের মাঝে কল্যাণ ও মঙ্গল দেখতে পেলেন যে,তিনি পরের দিন প্রভাতে সূর্যোদয়ের পর যখন কুরাইশদের সভা ও জমায়েতগুলো জমজমাট হতে থাকবে তখন তিনি বনি হাশিম ও আবদুল মুত্তালিবের বংশধর যুবকদের সাথে মসজিদুল হারামে যাবেন এবং আগের দিন তিনি যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন সে সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কুরাইশদেরকে অবহিত করবেন। আশা করা যায় যে,তাদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার হবে এবং এরপর থেকে তারা মুহাম্মদ (সা.)-কে হত্যার পরিকল্পনা ত্যাগ করবে। সূর্য কিছুটা উঁচুতে উঠলে কুরাইশদের ঘরবাড়ি থেকে বের হয়ে সভা ও সমবেত হওয়ার স্থানগুলোতে যাওয়ার সময় হলো। তারা তখনও কথাবার্তায় রত হয় নি ঠিক ঐ মুহূর্তে হযরত আবু তালিবকে দূর থেকে দেখা গেল। কুরাইশগণ দেখতে পেল যে,তাঁর পেছনে বেশ কিছু সাহসী যুবক আসছে। তারা হাত-পা গুটিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল যে,আবু তালিব (রা.) কি বলতে চান এবং কোন্ উদ্দেশ্যে তিনি লোকজন নিয়ে মসজিদুল হারামে এসেছেন?

হযরত আবু তালিব (রা.) কুরাইশদের সভার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, গতকাল মুহাম্মদ বেশ কয়েক ঘণ্টা আমাদের মধ্যে অনুপস্থিত ছিল। আমি ভেবেছিলাম,তোমরা উকবার কথানুযায়ী তাকে হত্যা করে ফেলেছ। এ কারণে আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম যে,এ সব যুবককে সাথে নিয়ে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করব। এদের প্রত্যেককে আমি নির্দেশ দিয়েছিলাম যে,তারা তোমাদের প্রত্যেকের পাশে বসে পড়বে এবং যখনই আমার কণ্ঠ উচ্চকিত হবে ঠিক তখনই বিলম্ব না করে তারা নিজেদের স্থান থেকে উঠে দাঁড়াবে এবং লুক্কায়িত অস্ত্র বের করে তোমাদেরকে হত্যা করবে। কিন্তু সৌভাগ্যবশত মুহাম্মদকে আমি জীবিত এবং তোমাদের অনিষ্ট থেকে নিরাপদ পেয়েছি। এরপর তিনি তাঁর সাহসী যুবকদেরকে তাঁদের লুকানো অস্ত্র বের করে আনার নির্দেশ দিলেন। তিনি এ কথা বলার মাধ্যমে তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন, মহান আল্লাহর শপথ,যদি তোমরা তাকে হত্যা করতে তাহলে আমি তোমাদের কাউকে আর জীবিত রাখতাম না এবং সর্বশক্তি নিয়োগ করে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতাম এবং...। ৩৩২

শ্রদ্ধেয় পাঠকবৃন্দ! আপনারা যদি হযরত আবু তালিবের জীবনী অধ্যয়ন করেন তাহলে আপনারা দেখতে পাবেন যে,তিনি পুরো ৪২ বছর মহানবী হযরত মুহাম্মদকে সাহায্য করেছেন এবং বিশেষ করে তাঁর জীবনের সর্বশেষ দশ বছর (অর্থাৎ যা ছিল ঐ সময় পর্যন্ত মহানবীর নবুওয়াত ও ধর্ম প্রচার সময়কালের সমান) তিনি মহানবীর জন্য মাত্রাতিরিক্ত আত্মত্যাগ ও কোরবানী করেছিলেন। একমাত্র যে কারণটি তাঁকে এতটা দৃঢ়,স্থির ও অবিচল রেখেছিল তা ছিল তাঁর ঈমানী শক্তি ও মহানবী (সা.)-এর প্রতি বিশুদ্ধ বিশ্বাস। আর আপনারা যদি তাঁর প্রিয় পুত্র আলী (আ.)-এর আত্মত্যাগ পিতার খেদমত ও অবদানের সাথে যোগ করেন তাহলে নিম্নোক্ত কবিতাসমূহের প্রকৃত তাৎপর্য ও অর্থ আপনাদের কাছে স্পষ্ট হযে যাবে যা ইবনে আবীল হাদীদ এতদ্প্রসঙ্গে রচনা করেছিলেন। এখানে ঐ কবিতাগুলোর কিয়দংশের অনুবাদ  উল্লেখ করা হলো :

و لولا أبو طالب و ابنه

لما مثل الدّين شخصا و قاما

فذاك بمكة آوى و حامى

و هذا بيثرب جس الحماما

যদি আবু তালিব ও তাঁর সন্তান না থাকতেন,

তাহলে দীন কখনই প্রতিষ্ঠিত হতে পারত না।

তিনি পবিত্র মক্কায় (মহানবীকে) আশ্রয় এবং সমর্থন দিয়েছেন

আর তাঁর সন্তান ইয়াসরিবে মৃত্যুর ভয়াল ঘূর্ণাবর্তের গভীরে প্রবেশ করেছেন। ৩৩৩

আলোচনার রাজনৈতিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

এতে কোন সন্দেহ নেই যে,আবু তালিবের ঈমান ও মুসলিম হওয়ার ব্যাপারে যে সব সাক্ষ্য-প্রমাণ বিদ্যমান সেগুলোর এক দশমাংশও যদি রাজনীতি,ঘৃণা ও শত্রুতা থেকে মুক্ত অন্য কোন ব্যক্তির ব্যাপারে বিদ্যমান থাকত তাহলে শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে সকলেই সর্বসম্মতিক্রমে তাঁর ঈমান ও মুসলিম হবার বিষয়টি মেনে নিত;অথচ হযরত আবু তালিবের ঈমান ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ সংক্রান্ত অগণিত সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কিভাবে একটি গোষ্ঠী তাঁকে কাফির বলতে পেরেছে? এমনকি কেউ কেউ বলেছে যে,আযাব সংক্রান্ত আয়াতসমূহের মধ্য থেকে গুটিকতক আয়াতও তাঁর সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে;আবার আরেকটি গোষ্ঠী এ ব্যাপারে মন্তব্য করা থেকে বিরত থেকেছে। আর অত্যন্ত মুষ্টিমেয় সুন্নী আলেমও তাঁর ঈমান ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কথা স্বীকার করেছেন। তাঁদের অন্যতম আল্লামা যায়নী দাহলান যিনি পবিত্র মক্কা নগরীর মুফতী ছিলেন (মৃত্যু ১৩০৪ হি.)। তবে অবশ্যই ইনসাফ করতে হবে যে,এ ধরনের আলোচনা উত্থাপন করার প্রকৃত উদ্দেশ্য হযরত আবু তালিবের সন্তানগণ,বিশেষ করে আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর প্রতি বক্র ও কটাক্ষ উক্তি ও মন্তব্য করা ছাড়া আর কিছুই নয়।

কতিপয় সুন্নী আলেম হযরত আবু তালিবকে যাতে করে ভালোভাবে কাফির বলে অভিহিত করতে পারেন সেজন্য মহানবী (সা.)-এর ঊর্ধতন পূর্বপুরুষগণ পর্যন্ত এ আলোচনা সম্প্রসারিত করেছেন এবং তাঁর (মহানবীর) পিতা-মাতাকেও তাঁরা অবিশ্বাসী বলে অভিহিত করেছেন।

মহানবী (সা.)-এর পিতা-মাতাকে অবিশ্বাসী অভিহিত করার বিষয়টি ইমামীয়াহ্,যায়দীয়াহ্ এবং কতিপয় গবেষক সুন্নী আলেমের অভিমতের পরিপন্থী। কিন্তু কথা হচ্ছে ঐ সব ব্যক্তির ক্ষেত্রে যাঁরা সহজেই মহানবী (সা.)-এর একমাত্র সমর্থক,পৃষ্ঠপোষক,সাহায্যকারী এবং রক্ষককে কাফির বলে সাব্যস্ত করেছেন।

আবু তালিবের ঈমানের প্রমাণ

যে কোন ব্যক্তির আকীদা-বিশ্বাস ও চিন্তাধারা নিম্নোক্ত তিনটি পদ্ধতিতে জানা ও শনাক্ত করা যায়:

১. তার থেকে যে সব তত্ত্বমূলক রচনা ও সাহিত্যকর্ম বিদ্যমান সেগুলো অধ্যয়ন করা,

২. সমাজে তার আচার-আচরণ ও কর্মকাণ্ড এবং

৩. তার ব্যাপারে তার নিরপেক্ষ বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের আকীদা-বিশ্বাস।

আমরা উপরিউক্ত তিনটি পদ্ধতিতে হযরত আবু তালিবের ঈমান ও আকীদা-বিশ্বাস প্রমাণ করতে পারব।

হযরত আবু তালিবের কবিতাসমূহ পুরোপুরি তাঁর ঈমান ও নিষ্ঠার সাক্ষ্য দেয়। ঠিক একইভাবে তাঁর জীবনের সর্বশেষ দশ বছরে তিনি যে সব মূল্যবান অবদান রেখেছিলেন সেগুলোও তাঁর অসাধারণ ঈমান ও বিশ্বাসের শক্তিশালী সাক্ষী। তাঁর নিরপেক্ষ নিকটবর্তী ব্যক্তি ও আত্মীয়-স্বজনদের আকীদা ও বিশ্বাস হচ্ছে এই যে,তিনি একজন বিশ্বাসী মুসলমান ছিলেন। তাঁর বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনদের মধ্য থেকে কোন ব্যক্তিই তাঁর ঈমান ও ইখলাসের স্বীকৃতি দেয়া ছাড়া আর কিছুই বলেন নি। এখন আমরা উপরিউক্ত তিন পদ্ধতিতে এ বিষয়টি পূর্ণরূপে অধ্যয়ন ও আলোচনা করব :

হাতির বছরের গোলযোগ

কোন জাতির মধ্যে যে মহাঘটনা সংঘটিত হয় এবং কখনো কখনো যা ধর্মীয় ভিত্তিমূল এবং কখনো কখনো জাতীয় ও রাজনৈতিক ভিত্তিমূলের অধিকারী তা সাধারণ জনগণের আশ্চর্য ও বিস্ময়বোধের কারণে তারিখ ও গণনার সূচনা বা উৎস বলে গণ্য হয়। যেমন ইয়াহুদী জাতির মুক্তির জন্য হযরত মূসা (আ.)-এর আন্দোলন,খ্রিষ্টানদের জন্য হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্ম তারিখ এবং মুসলমানদের ক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর হিজরত হচ্ছে তারিখ গণনার উৎস যা দিয়ে প্রতিটি ধর্মের অনুসারিগণ তাদের জীবনের ঘটনাসমূহের উদ্ভবের সময়কাল নির্ণয় ও পরিমাপ করে থাকে।

কখনো কখনো কোন জাতি মৌলিক ইতিহাস ও তারিখের অধিকারী হওয়ার কারণে কিছু কিছু ঘটনাকেও তাদের তারিখ গণনার ভিত্তি ও উৎস হিসাবে নির্ধারণ করেছে। যেমন পাশ্চাত্যের দেশসমূহে মহান ফরাসী বিপ্লব এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে 1917 খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরের কম্যুনিস্ট আন্দোলন ঐ সব দেশে যে সব ঘটনাপ্রবাহের উদ্ভব হয় সেগুলোর অনেক কিছুর তারিখ গণনার ভিত্তি বা উৎস হিসাবে গণ্য করা হযেছে। যে সব অনগ্রসর জাতি এ ধরনের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আন্দোলন থেকে বঞ্চিত সে সব জাতি স্বাভাবিকভাবে অসাধারণ ঘটনাবলীকে তাদের ইতিহাস ও তারিখ গণনার ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করে। এ কারণেই জাহেলী আরবগণ সঠিক কৃষ্টি ও সভ্যতার অধিকারী না হওয়ায় যুদ্ধ,ভূমিকম্প,দুর্ভিক্ষ অথবা অলৌকিক ঘটনাবলীকে নিজেদের ইতিহাস ও তারিখ গণনার উৎস হিসাবে গণ্য করেছে। এ কারণেই ইতিহাসের পাতায় পাতায় আমরা আরব জাতির তারিখ গণনার ভিন্ন ভিন্ন ভিত্তি দেখতে পাই। এসব ভিত্তির মধ্যে সর্বশেষ ভিত্তি হচ্ছে হাতির বছরের ঘটনা এবং পবিত্র কাবাগৃহকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে আবরাহার মক্কা আক্রমণের ঘটনা যা অন্যান্য ঘটনার তারিখ গণনার ভিত্তি হিসাবে গণ্য হয়েছে। এখন আমরা 570 খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত মহাঘটনাটির ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করব এবং এখানে স্মর্তব্য যে,মহানবী (সা.)ও এই একই বছরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

এ ঘটনার উৎস

আসহাবে ফীল অর্থাৎ হস্তিবাহিনীর ঘটনা পবিত্র কোরআনে সংক্ষিপ্তাকারে বর্ণিত হয়েছে। আর আমরা এ ঘটনা বর্ণনা করার পর যে সব আয়াত এ ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে তা উল্লেখ করব। ইতিহাস রচয়িতাগণ এ ঘটনার মূল কারণ সম্পর্কে লিখেছেন : ইয়েমেনের বাদশাহ্ যূনুওয়াস তার সরকারের ভিত্তি মজবুত করার পর কোন এক সফরে মদীনা অতিক্রম করছিল। তখন মদীনা এক অতি উত্তম ধর্মীয় মর্যাদার অধিকারী ছিল। সে সময় একদল ইয়াহুদী ঐ শহরে বসতি স্থাপন করে প্রচুর মন্দির ও ইবাদাতগাহ্ নির্মাণ করেছিল। সুযোগসন্ধানী ইয়াহুদিগণ বাদশার আগমনকে এক সুবর্ণ সুযোগ মনে করে বাদশাহকে ইয়াহুদী ধর্ম গ্রহণের আমন্ত্রণ জানায়। তাদের এ পদক্ষেপের উদ্দেশ্যে ছিল নব্য ইয়াহুদী ধর্মে দীক্ষিত বাদশাহ্ যূনুওয়াসের শাসনাধীনে রোমের খ্রিষ্টান ও পৌত্তলিক আরবের হামলা থেকে নিরাপদ থাকা এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করা। এ ব্যাপারে তাদের প্রচার খুব ফলপ্রসূ হয়েছিল। যূনুওয়াস ইয়াহুদী ধর্ম গ্রহণ করল এবং এ ধর্ম প্রসার ও প্রচারের ক্ষেত্রে অনেক অবদান রেখেছিল। অনেকেই ভীত হয়ে তার বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। সে একদল জনতাকে বিরোধিতা করার জন্য কঠোর শাস্তি প্রদান করে। তবে নাজরানের অধিবাসিগণ যারা বেশ কিছুদিন আগেই খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিল তারা কোনক্রমেই খ্রিষ্টধর্ম ত্যাগ করে ইয়াহুদী ধর্মের অনুশাসন অনুসরণ করতে প্রস্তুত ছিল না।ইয়েমেনের বাদশার বিরুদ্ধাচরণ এবং অবজ্ঞা করার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ ছিল। বাদশাহ্ যূনুওয়াস এক বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে নাজরানের বিদ্রোহীদেরকে দমন করার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়। সেনাপতি নাজরান শহরের পাশে সেনা শিবির ও তাঁবু স্থাপন করে এবং পরিখা খনন করার পর তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়;আর বিদ্রোহীদেরকে ঐ আগুনে জীবন্ত দগ্ধ করার হুমকি প্রদর্শন করতে থাকে। নাজরানের অকুতোভয় সাহসী জনতা যারা মনে-প্রাণে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিল তারা এতে মোটেও ভীত না হয়ে মৃত্যু ও জীবন্ত দগ্ধ হওয়াকে সানন্দে বরণ করে নেয়। তাদের দেহগুলো সেই আগুনে জীবন্ত দগ্ধ হয়েছিল।110

ইসলামী ইতিহাসবেত্তা ইবনে আসীর জাযারী লিখেছেন : এ সময় দূস নামক একজন নাজরানবাসী খ্রিষ্টধর্মের গোঁড়া সমর্থক রোমান সম্রাট কাইসারের কাছে গমন করে তাঁকে পুরো ঘটনা অবহিত করল এবং রক্তপিপাসু যূনুওয়াসকে শাস্তি প্রদান এবং অত্র এলাকায় খ্রিষ্টধর্মের ভিত মজবুত ও শক্তিশালী করার আবেদন জানাল। রোমের অধিপতি গভীর দুঃখ ও সমবেদনা প্রকাশ করে বলেন, আপনাদের দেশ থেকে আমার সাম্রাজ্যের রাজধানী অনেক দূরে অবস্থিত বিধায় এ ধরনের অত্যাচারের প্রতিকার বিধানার্থে হাবাশার বাদশাহ্ নাজ্জাশীর কাছে একটি চিঠি লিখছি যাতে করে তিনি ঐ রক্তপিপাসু নরপিশাচের কাছ থেকে নাজরানের নিহতদের প্রতিশোধ নিতে পারেন। ঐ নাজরানবাসী কাইসারের চিঠি নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব হাবাশার দিকে রওয়ানা হয়ে গেল এবং বাদশাহ্ নাজ্জাশীর কাছে পুরো ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করল। ফলে বাদশার শিরা ও ধমনীতে তীব্র আত্মসম্মানবোধ ও চেতনাবোধের রক্ত প্রবাহিত হয়ে গেল। তিনি আবরাহাতুল আশরাম নামক এক হাবাশী সেনাপতির নেতৃত্বে 70 হাজারের এক বিশাল সেনাবাহিনী ইয়েমেনের দিকে প্রেরণ করেন। হাবাশার উক্ত সুশৃঙ্খল ও সুসজ্জিত সেনাবাহিনীটি সমুদ্রপথে ইয়েমেনের সৈকতে তাঁবু স্থাপন করে। এ ব্যাপারে সচেতন না থাকার কারণে যূনুওয়াসের আর কিছুই করার ছিল না। সে যতই চেষ্টা করল তাতে কোন ফল হলো না। প্রতিরোধ ও যুদ্ধ করার জন্য যতই গোত্রপতিদের নিকট আহবান জানাল তাতে তাদের পক্ষ থেকে সে কোন সাড়া পেল না। পরিণতিতে আবরাহার এক সংক্ষিপ্ত আক্রমণের মুখে যূনুওয়াসের প্রশাসনের ভিত ধসে পড়ে এবং সমৃদ্ধ ও সম্পদশালী ইয়েমেন হাবাশাহ্ সাম্রাজ্যের অধীন হয়ে যায়।

আবরাহা প্রতিশোধ ও বিজয়ের মদমত্ততায় চূর ও মাতাল হয়েছিল। সে যৌনকামনা ও আমোদ-প্রমোদে নিমজ্জিত হওয়া থেকে মোটেও বিরত থাকত না। সে হাবাশার বাদশার নৈকট্য ও দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ইয়েমেনের রাজধানী সানআ নগরীতে একটি জমকালো গীর্জা নির্মাণ করে যা ছিল ঐ যুগে অতুলনীয়। তারপর সে বাদশাহ্ নাজ্জাশীর কাছে এই মর্মে পত্র লেখে, গীর্জা নির্মাণ কাজ প্রায় সমাপ্ত হওয়ার পথে। ইয়েমেনের সকল অধিবাসীকে কাবার যিয়ারত করা থেকে বিরত এবং এই গীর্জাকে সাধারণ জনগণের জন্য তাওয়াফস্থল করার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখছি।” চিঠিটির মূল বক্তব্য প্রচারিত হলে সমগ্র আরব গোত্রগুলোর মধ্যে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিল,এমনকি বনি আফকাম গোত্রের এক মহিলা উক্ত মন্দিরের চত্বরকে নোংরা করে দিল। এ ধরনের কাজ যার মাধ্যমে আবরাহার গীর্জার প্রতি আরবদের পূর্ণ অবজ্ঞা,শত্রুতা ও অবহেলা প্রকাশ পেয়েছে তা তদানীন্তন আবরাহা প্রশাসনকে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ করে তোলে। অন্যদিকে গীর্জার বাহ্যিক সৌন্দর্য ও সাজ-সজ্জার ক্ষেত্রে যত চেষ্টা চালানো হয়েছে ততই পবিত্র কাবার প্রতি জনগণের আকর্ষণ ও ভালোবাসা তীব্র হতে থাকে। এ সব ঘটনাপ্রবাহের কারণে আবরাহা পবিত্র কাবা ধ্বংস করার শপথ নেয়। এজন্য আবরাহা এক বিশাল বাহিনী গঠন করে যার সম্মুখভাগে ছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সুসজ্জিত অনেক লড়াকু হাতি। তাওহীদী মতাদর্শের প্রাণপুরুষ হযরত ইবরাহীম খলীল (আ.) যে গৃহটির পুননির্মাণ করেছিলেন আবরাহা তা ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরিস্থিতি যে অত্যন্ত ভয়াবহ ও অতি সংবেদনশীল তা প্রত্যক্ষকরতঃ আরবের গোত্রপতিদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল যে,আরব জাতির স্বাধীনতা ও ব্যক্তিত্ব পতনের সম্মুখীন। কিন্তু আবরাহার অতীত সাফল্যসমূহ তাদেরকে যে কোন উপকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা থেকে বিরত রেখেছিল। এতদ্সত্ত্বেও আবরাহার গমনপথের ওপর অরব গোত্রগুলোর কতিপয় আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন নেতা পূর্ণ বীরত্বসহকারে আবরাহার বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলে। যেমন যূনাফার যিনি নিজেও এক অভিজাত বংশোদ্ভূত ছিলেন তিনি জ্বালাময়ী বক্তৃতা প্রদান করে তাঁর নিজ গোত্রকে পবিত্র কাবাগৃহ রক্ষা করার উদাত্ত আহবান জানান। কিন্তু অতি অল্পদিনের মধ্যেই আবরাহার বিশাল বাহিনী তাঁদের ব্যুহসমূহ ভেদ করে দেয়। এরপর নুফাইল বিন হাবীব তীব্র প্রতিরোধ ও সংগ্রাম গড়ে তোলে,কিন্তু সেও পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয় এবং আবরাহার বাহিনীর হাতে বন্দী হয়। তাকে ক্ষমা করে দেয়ার জন্য সে (নুফাইল) আবরাহার কাছে আবেদন জানালে আবরাহা তাকে বলেছিল, আমাদেরকে মক্কা নগরী অভিমুখে যদি তুমি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাও তাহলে আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব।” তাই নুফাইল আবরাহাকে তায়েফ নগরী পর্যন্ত পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় এবং পবিত্র মক্কা নগরী পর্যন্ত অবশিষ্ট পথ দেখানোর দায়িত্ব নুফাইল আবু রাগাল নামক তারই এক বন্ধুর ওপর ন্যস্ত করে। নতুন পথ-প্রদর্শক আবরাহার সেনাবাহিনীকে পবিত্র মক্কা নগরীর নিকটবর্তী মাগমাস নামক স্থানে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। আবরাহার সেনাবাহিনী ঐ স্থানকে সেনা ছাউনি ও তাঁবু স্থাপন করার জন্য মনোনীত করে। আর আবরাহা তার চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ী একজন সেনাপতিকে তিহামার উট ও গবাদিপশু লুণ্ঠন করার দায়িত্ব দেয়। প্রায় 200টি উট লুণ্ঠন করা হয়। লুণ্ঠিত এ সব উটের মালিক ছিলেন মক্কাপ্রধান আবদুল মুত্তালিব। অতঃপর হানাতাহ্ নামীয় এক সেনাপতিকে আবরাহা মক্কার কুরাইশ নেতা ও প্রধানের কাছে তার বাণী পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব অর্পণ করে বলেছিল, কাবাগৃহ ধ্বংস করার প্রকৃত চিত্র যেন আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে! আর নিশ্চিতভাবে কুরাইশরা প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। তবে রক্তপাত এড়ানোর জন্য তাৎক্ষণিকভাবে মক্কার পথ ধরে এগিয়ে যাবে। সেখানে পৌঁছে কুরাইশ প্রধানের খোঁজ করে সরাসরি তার কাছে গিয়ে বলবে : আমাদের মূল লক্ষ্যই হলো কাবাগৃহ ধ্বংস করা। কুরাইশরা যদি প্রতিরোধ না করে তাহলে তারা যে কোন হামলা ও আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকবে।”

আবরাহার প্রেরিত দূত পবিত্র মক্কায় পৌঁছেই কুরাইশদের বিভিন্ন দলকে আবরাহার সামরিক অভিযান সম্পর্কে আলোচনারত দেখতে পেল। মক্কাপ্রধানের খোঁজ করলে তাকে আবদুল মুত্তালিবের গৃহে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। আবদুল মুত্তালিব আবরাহার বাণী শোনার পর বললেন, আমরা কখনই প্রতিরক্ষা ও প্রতিরোধ গড়ে তুলব না। কাবা মহান আল্লাহর গৃহ যার নির্মাতা হযরত ইবরাহীম খলীল (আ.)। মহান আল্লাহ্ যা কল্যাণকর তা-ই করবেন।” আবরাহার সেনাপতি কুরাইশপ্রধানের এ ধরনের কোমল ও শান্তিপূর্ণ যুক্তি যা প্রকৃত সুমহান আত্মিক ঈমানেরই পরিচায়ক তা শ্রবণ করে সন্তোষ প্রকাশ করল এবং তার সাথে আবরাহার তাঁবুতে আসার আমন্ত্রণ জানাল।

আবরাহার শিবিরে আবদুল মুত্তালিব-এর গমন

আবদুল মুত্তালিব তাঁর কয়েক সন্তানসহ আবরাহার শিবিরের দিকে রওয়ানা হলেন। কুরাইশপ্রধানের মহত্ত্ব,স্থিরতা,ধৈর্য,গাম্ভীর্য ও ব্যক্তিত্ব আবরাহাকে বিস্ময়াভিভূত করে ফেলে। এ কারণেই সে আবদুল মুত্তালিবের প্রতি অত্যন্ত ভক্তি,শ্রদ্ধা এবং সম্মান প্রদর্শন করেছিল। এর প্রমাণস্বরূপ,সে সিংহাসন থেকে নিচে নেমে এসে আবদুল মুত্তালিবের হাত ধরে তাঁকে তার নিজের পাশে বসিয়েছিল। এরপর সে পূর্ণ ভদ্রতা ও শিষ্টাচারসহকারে দোভাষীর মাধ্যমে আবদুল মুত্তালিবকে প্রশ্ন করেছিল যে,তিনি কেন এখানে এসেছেন এবং তিনি কী চাচ্ছেন? আবদুল মুত্তালিব আবরাহার প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, তিহামার উটগুলো এবং যে দু শ’উটের মালিক আমি সেগুলো আপনার সৈন্যদের দ্বারা লুণ্ঠিত হয়েছে। আপনার কাছে আমার অনুরোধ এটিই যে,অনুগ্রহপূর্বক ঐ সকল উট স্ব স্ব মালিকের কাছে ফেরত দেয়ার আদেশ দিন।” আবরাহা বলল, আপনার আলোকিত বদনমণ্ডল আপনাকে আমার কাছে এক জগৎ পরিমাণ মহান ও বিরাট করে তুলেছে,অথচ (যখন আমি এসেছি আপনার পূর্বপুরুষদের ইবাদাতগাহ্ ধ্বংস করতে) তখন আপনার ছোট ও অতি সামান্য আবেদন আপনার মহত্ত্ব,উচ্চ সম্মান ও মর্যাদাকে কমিয়ে দিয়েছে। আমি আশা করেছিলাম যে,আপনি কাবার ব্যাপারে আলোচনা করবেন এবং অনুরোধ জানাবেন যে,আমার যে লক্ষ্য আপনাদের স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনের ওপর মারাত্মক আঘাত হানবে তা থেকে অমি যেন বিরত থাকি। না,পক্ষান্তরে আপনি কয়েকটি মূল্যহীন উটের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন এবং সেগুলো ছেড়ে দেয়ার জন্য সুপারিশ করেছেন? আবদুল মুত্তালিব আবরাহার প্রশ্নের জবাবে একটি বাক্য বলেছিলেন যা আজও তাঁর নিজস্ব মহত্ত্ব,গৌরব এবং মান বজায় রেখেছে। আর ঐ বাক্যটি ছিল :

أنا ربّ الإبل و للبيت ربّ يمنعه

“আমি উটগুলোর প্রতিপালনকারী এবং পবিত্র কাবারও এমন এক প্রভু আছেন যিনি (সব ধরনের আগ্রাসন,আক্রমণ এবং ক্ষয়ক্ষতি থেকে) উক্ত গৃহকে রক্ষা করবেন।” আবরাহা এ কথা শোনার পর খুবই দাম্ভিকতার সাথে বলেছিল, এ পথে আমার লক্ষ্য অর্জনে বাধা দেয়ার শক্তি কারো নেই।” এরপর সে লুণ্ঠিত সব ধন-সম্পদ প্রকৃত মালিকদের কাছে ফেরত দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল।

অধীর আগ্রহে কুরাইশদের অপেক্ষা

সমগ্র কুরাইশ গোত্র অধীর আগ্রহে আবদুল মুত্তালিবের ফেরার অপেক্ষায় ছিল যাতে করে তারা শত্রুর সাথে তাঁর আলোচনার ফলাফল সম্পর্কে অবগত হতে পারে। যখন আবদুল মুত্তালিব কুরাইশ গোত্রপতিদের মুখোমুখি হলেন তখন তিনি তাদেরকে বললেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাদের গবাদিপশু নিয়ে উপত্যকা ও পাহাড়-পর্বতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ কর। এর ফলে তোমরা সবাই যে কোন ধরনের ক্ষতি ও বিপদাপদ থেকে নিরাপদে থাকতে পারবে।” এ কথা শোনার পর অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সকল মক্কাবাসী তাদের নিজেদের ঘর-বাড়ী ছেড়ে পাহাড়-পর্বতে গিয়ে আশ্রয় নিল। মধ্যরাত্রিতে শিশু ও নারীদের ক্রন্দনধবনি এবং পশুসমূহের আর্তনাদ সমগ্র পাহাড়-পর্বতে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। ঐ সময় আবদুল মুত্তালিব কয়েকজন কুরাইশসহ পর্বতশৃঙ্গ থেকে নেমে এসে পবিত্র কাবায় গেলেন। ঐ সময় তাঁর চোখের চারপাশে অশ্রুবিন্দু জমেছিল। তিনি ব্যথিত অন্তরে পবিত্র কাবার দরজার কড়া হাতে নিয়ে মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলেছিলেন, হে ইলাহী! তাদের (আবরাহা ও তার বিশাল সেনাবাহিনী) অনিষ্ট সাধন ও ক্ষয়ক্ষতি করা থেকে নিরাপদ থাকার ব্যাপারে কেবল তুমি ছাড়া আর কারো প্রতি আমাদের বিন্দুমাত্র আশা নেই। হে প্রভু! তাদেরকে তোমার পবিত্র গৃহের অঙ্গন ও সীমানা থেকে প্রতিহত কর। সে-ই কাবার দুশমন যে তোমার সাথে শত্রুতা পোষণ করে। হে প্রভু! তাদেরকে তোমার পবিত্র ঘর ধ্বংস করার ক্ষেত্রে ব্যর্থ করে দাও। হে প্রভু! তোমার বান্দা নিজের ঘরকে রক্ষা করে। তাই তুমিও তোমার ঘরকে রক্ষা কর। ঐ দিনকে (আমাদের কাছে) আসতে দিও না যে দিন তাদের ক্রুশ জয়যুক্ত হবে,আর তাদের প্রতারণাও সফল ও বিজয়ী হবে। 111

এরপর তিনি কাবাগৃহের দরজার কড়া ছেড়ে দিয়ে পর্বতশৃঙ্গে ফিরে আসলেন এবং সেখান থেকে পুরো ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে লাগলেন। প্রভাতে যখন আবরাহা ও তার সেনাবাহিনী মক্কাভিমুখে রওয়ানা হল তখন হঠাৎ ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি সমুদ্রের দিক থেকে আকাশে আবির্ভূত হলো যেগুলোর প্রতিটির মুখ ও পায়ে ছিল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পাথর। পাখিদের ছায়ায় সৈন্যশিবিরের আকাশ কালো হয়ে গিয়েছিল। বাহ্যিকভাবে এগুলোর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অস্ত্র অতি বিস্ময়কর প্রভাব ও ফলাফল সৃষ্টি করল। মহান আল্লাহর নির্দেশে ঐ সব পাখি আবরাহার বাহিনীর ওপর পাথর বর্ষণ করল যার ফলে তাদের মাথা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল এবং দেহের মাংসগুলো খসে পড়ল। একটি ক্ষুদ্র পাথর আবরাহার মাথায়ও আঘাত করলে সে খুব ভয় পেয়ে গেল এবং তার দেহে কম্পন শুরু হলো। সে নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারল যে,মহান আল্লাহর ক্রোধ ও গজব তাকে ঘিরে ফেলেছে। সেনাদলের দিকে তাকালে সে দেখতে পেল যে,তাদের মৃতদেহগুলো গাছের পাতা ঠিক যেভাবে মাটিতে পড়ে থাকে ঠিক সেভাবে মাটিতে পড়ে আছে। কালবিলম্ব না করে তার সেনাবাহিনীর যারা বেঁচে আছে,যে পথ ধরে তারা এসেছিল ঠিক সে পথেই ইয়েমেনের রাজধানী সানাআয় ফিরে যাবার জন্য সে নির্দেশ দিল। আবরাহার সেনাদলের মধ্যে থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া সৈন্যরা সানাআর দিকে রওয়ানা হলো। কিন্তু পথিমধ্যে অনেক সৈন্যই ক্ষত ও ভীতিজনিত কারণে প্রাণত্যাগ করল,এমনকি আবরাহাও যখন সানাআয় পৌঁছল তখন তার শরীরের মাংস খসে পড়ল এবং আশ্চর্যজনক অবস্থার মধ্যে তার মৃত্যু হলো।

বিস্ময়কর ও ভীতিপ্রদ এ ঘটনাটি পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি করল। হাতিওয়ালাদের কাহিনী পবিত্র কোরআনের সূরা ফীল-এ এভাবে বর্ণিত হয়েছে : আপনি কি দেখেন নি যে,আপনার প্রভু হাতিওয়ালাদের সাথে কিরূপ আচরণ করেছেন? তাদের ষড়যন্ত্র কি তিনি ব্যর্থ করে দেন নি? তিনি তাদের ওপর এক ঝাঁক পাখি প্রেরণ করেছিলেন যেগুলো তাদের ওপর পোড়ামাটির তৈরি কঙ্কর নিক্ষেপকরতঃ তাদেরকে চর্বিত ঘাস ও পাতার মতো পিষ্ট করে দিয়েছিল।”

) بسم الله الرّحمان الرّحيم -ألم تر كيف فعل ربّك بأصحاب الفيل-ألم يجعل كيدهم في تضليل-و أرسل عليهم طيرا أبابيل-ترميهم بحجارة من سجيل-فجعلهم كعصف مأكول(

আমরা এখন যা কিছু আলোচনা করলাম আসলে তা এ ক্ষেত্রে বর্ণিত ইসলামী ঐতিহাসিক বর্ণনাসমূহের সারসংক্ষেপ এবং পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট বর্ণনাও ঠিক এটিই। এখন আমরা প্রখ্যাত মিশরীয় মুফাসসির মুহাম্মদ আবদুহু’এবং মিশরের ভূতপূর্ব সংস্কৃতিমন্ত্রী প্রখ্যাত পণ্ডিত (ড. হাইকাল) এতৎসংক্রান্ত যা বলেছেন তা পর্যালোচনা করে দেখব।


15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53

54

55

56

57

58

59

60

61