চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড3%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 106801 / ডাউনলোড: 9707
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

আবু তালিবের সাহিত্যকর্ম

আমরা তাঁর দীর্ঘ কবিতা ও কাসীদাসমূহ থেকে কিছু অংশ মনোনীত করেছি এবং বিষয়বস্তু স্পষ্ট বোধগম্য হবার জন্য এগুলোর বঙ্গানুবাদ নিচে পেশ করছি :

ليعلم خيارُ النّاس إنّ محمّدا

نبي كموسى و المسيح بن مريم

أتانا بُهدى مثل ما أتيابه

فكلّ بأمر الله يهدي و يعصم

“ভালো মানুষেরা সবাই জানুক যে,মুহাম্মদ

মূসা ও ঈসা ইবনে মরিযমের মতো নবী। এই দুই নবী যে আসমানী নূর (অর্থাৎ হেদায়েত) নিয়ে এসেছিলেন

ঠিক সেই নূর তিনিও আমাদের জন্য আনয়ন করেছেন। কারণ সকল নবী-রাসূল মহান আল্লাহর নির্দেশে মানব জাতিকে

পথ প্রদর্শন করেন এবং তাদেরকে পাপ থেকে বিরত রাখেন।”

تمنّيتم أن تقتلوه و أنّما

أمانيّكم هذى كأحلام نائم

نبيّ أتاه الوحي من عند ربّه

و من قال لا يقرع بها سن نادم

“(হে কুরাইশ সর্দারগণ!) তোমরা তাঁকে হত্যা করতে চাও,

অথচ তোমাদের এ সব চিন্তা-ভাবনা ও আকাঙ্ক্ষা আসলে ঘুমন্ত ব্যক্তির অলীক স্বপ্নের মতো। তিনি একজন নবী। তাঁর প্রভুর কাছ থেকে তাঁর কাছে ওহী এসেছে।

আর যে ব্যক্তি না’ বলবে (অর্থাৎ এ বিষয়টি অস্বীকার করবে) সে আসলে অনুতাপ ও পরিতাপ করতঃ দাঁত দিয়ে নিজ আঙ্গুলই দংশন করবে। ৩৩৪

ألم تعلموا أنّا وجدنا محمّدا

رسولا كموسى خطّ في أوّل الكتب

و ان عليه في العباد محبة

و لاحيف فيمن خصه الله بالحبّ

(হে কুরাইশ!) তোমরা কি জান না যে,আমরা মুহাম্মদকে

মূসার মতো রাসূল হিসাবে পেয়েছি যাঁর কথা পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থসমূহে বর্ণিত হয়েছে। মহান আল্লাহর বান্দাগণ তাঁর প্রতি বিশেষ ভালোবাসা পোষণ করে।

মহান আল্লাহ্ যে ব্যক্তির ভালোবাসা অন্তঃকরণসমূহে স্থাপন করেছেন

তাঁর প্রতি অন্যায় ও অত্যাচার করা অনুচিত। ৩৩৫

و الله لن يصلوا إليك بجمعهم

حتّى اوسد في التراب دفينا

فاصدع بأمرك ما عليك غضاضة

و أبشر بذاك و قرّ منك عيونا

و دعوتني و علمت أنك ناصحي

و لقد دعوت و كنت ثمّ أمينا

و لقد علمت أنّ دين محمّد (ص)

من خير أديان البريّة دنيا

মহান আল্লাহর শপথ,আমার মাটিতে শায়িত হওয়া পর্যন্ত

(আমার মৃত্যুবরণ করা পর্যন্ত) তারা (কুরাইশ) কখনই তোমার নাগাল পাবে না।

(আর আমি তোমাকে সাহায্য করা থেকে কখনই আমার হাত গুটিয়ে নেব না।)

তুমি যা প্রচার করার জন্য আদিষ্ট হয়েছ তা স্পষ্ট ও প্রকাশ্যে প্রচার কর।

তোমার কোন ভয় নেই। সুসংবাদ প্রদান কর এবং নিজের চক্ষুকে শীতল কর।

তুমি আমাকে (তোমার ধর্মের প্রতি) আহবান করেছ

এবং আমি জানি যে,তুমি আমার সদুপদেশদানকারী

এবং দীন প্রচার করার ক্ষেত্রে তুমি সকল ধর্মের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। ৩৩৬

أوتؤمنوا بكتاب منزل عجب

على نبيّ كموسى او كذى النون

অথবা তোমরা মূসা ও যূননূনের (ইউনুস) মতো নবীর ওপর অবতীর্ণ

আশ্চর্যজনক গ্রন্থ পবিত্র কোরআনে বিশ্বাস স্থাপন করবে। ৩৩৭

চয়নকৃত এ সব টুকরো কবিতা আসলে আবু তালিবের দীর্ঘ মনোজ্ঞ কাসীদাসমূহের একটি ক্ষুদ্র অংশ যা দ্ব্যর্থহীনভাবে ভ্রাতুষ্পুত্রের ধর্মের প্রতি হযরত আবু তালিবের অগাধ বিশ্বাস ও ঈমানের কথাই ব্যক্ত করে। আমরা এখানে হযরত আবু তালিব (রা.)-এর ঈমান ও বিশ্বাসের সাক্ষ্য-প্রমাণস্বরূপ এগুলো উল্লেখ করেছি।

সংক্ষেপে এ সব কবিতা এগুলোর রচয়িতার ঈমান ও নিষ্ঠা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট। এ সব কবিতা ও কাসীদার রচয়িতা যদি এমন এক ব্যক্তি হতেন সব ধরনের শত্রুতামূলক এবং সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ও বিদ্বেষপূর্ণ পরিবেশের বাইরে যাঁর অবস্থান-তাহলে সবাই এক বাক্যে ঈমান ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কথা স্বীকার করে নিত। কিন্তু যেহেতু এ সব কবিতা ও কাসীদার রচয়িতা আবু তালিব এবং উমাইয়্যা ও আব্বাসীয় প্রশাসন যন্ত্র ও রাজনৈতিক ধারার প্রচার মাধ্যমগুলো সব সময় আবু তালিবের বংশধরদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাত সেহেতু একটি গোষ্ঠী চায় নি যে,হযরত আবু তালিবের এ ধরনের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা প্রমাণিত হোক।

একদিকে তিনি হযরত আলী (আ.)-এর পিতা। আর উমাইয়্যা ও আব্বসীয খলীফাদের প্রচার মাধ্যমগুলো সব সময় তাঁর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাত। কারণ তাঁর পিতার ঈমান ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণের বিষয়টি তাঁর জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদা বলে গণ্য হতো। অথচ খলীফাদের পূর্বপুরুষদের কাফির ও মুশরিক হওয়ার বিষয়টি ছিল তাদের সম্মান ও মর্যাদা হানিকর।

যা হোক এ সব কবিতা,কাসীদা এবং বাণী,কর্ম ও অবদান রাখা সত্ত্বেও একটি গোষ্ঠী আবু তালিব (রা.)-কে কাফির বলে আখ্যায়িত করার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে,এমনকি তারা এতেও ক্ষান্ত হয় নি এবং দাবি করেছে যে,পবিত্র কোরআনে কিছু আয়াতও অবতীর্ণ হয়েছে যেগুলো থেকে আবু তালিবের কাফির হওয়ার বিষয়টি প্রতিপন্ন হয়।

আবু তালিবের ঈমান প্রমাণ করার দ্বিতীয় পদ্ধতি

দ্বিতীয় পদ্ধতিটি মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে আবু তালিবের আচার-আচরণ এবং মহানবীকে রক্ষা করা ও তাঁর পথে তাঁর আত্মত্যাগ ও কোরবানীর প্রক্রিয়া ও ধরন। এ সব অবদানের প্রতিটি তাঁর (আবু তালিব) মানসিকতা,আত্মিক মনোবল এবং চিন্তাধারার বহিঃপ্রকাশকারী। কারণ আবু তালিব (রা.) এমন এক ব্যক্তি ছিলেন যিনি চাইতেন না তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র শিশু হযরত মুহাম্মদ (সা.) ভগ্ন হৃদয় হয়ে থাক। সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা ও সুযোগ-সুবিধার অভাব সত্ত্বেও তিনি নিজের সাথে তাঁকে শামে নিয়ে যাওয়ার কষ্ট স্বীকার করেছিলেন।

নিজ ভ্রাতুষ্পুত্রের প্রতি হযরত আবু তালিবের ঈমান ও বিশ্বাসের মাত্রা এতটা গভীর ছিল যে,তিনি দুর্ভিক্ষ ও অনাবৃষ্টির সময় তাঁকে নিজের সাথে মুসাল্লায় নিয়ে গিয়েছিলেন এবং তাঁর উসীলায় তিনি মহান আল্লাহর কাছে রহমতের বৃষ্টি প্রার্থনা করেছিলেন।

হযরত আবু তালিব (রা.) মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবন রক্ষা করার জন্য চেষ্টার কোন ত্রুটি করেন নি এবং হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকেন নি। তিনি মক্কা নগরীর নেতৃত্ব ও প্রশাসনিক প্রধানের পদমর্যাদার ওপর পাহাড়-পর্বতে এবং গিরি-উপত্যকায় দীর্ঘ তিন বছরের অবরুদ্ধ জীবনকে প্রাধান্য দিযেছিলেন। এ তিন বছরের শরণার্থী জীবন তাঁকে এতটা ক্লান্ত ও অবসাদগ্রস্ত করেছিল যে,তিনি এর ফলে শারীরিক সুস্থতা হারিয়ে ফেলেছিলেন। তাই অর্থনৈতিক অবরোধ তুলে নেয়া হলে নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করার পর অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি ইন্তেকাল করেন।

মহানবী (সা.)-এর প্রতি তাঁর ঈমান ও বিশ্বাস এতটা দৃঢ় ও শক্তিশালী ছিল যে,তাঁর সকল সন্তান নিহত হয়েও যেন মহানবী জীবিত থাকেন এটিই তিনি চাইতেন এবং এতেই তিনি সন্তষ্ট ছিলেন। তিনি আলীকে মহানবীর শয্যায় শোয়াতেন যাতে করে তাঁকে হত্যা করার কোন ষড়যন্ত্র করা হলে তা যেন কার্যকর না হয়। এর চেয়েও আরো উচ্চ ও মহান ছিল ঐ ঘটনা যে,একদিন তিনি প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য সকল কুরাইশ নেতা ও সর্দারকে হত্যা করার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। আর এর ফলশ্রুতিতে স্বাভাবিকভাবে বনি হাশিম গোত্রও সমূলে ধ্বংস হয়ে যেত।

মৃত্যুর সময় আবু তালিবের অসিয়ত

মৃত্যুর সময় তিনি তাঁর সন্তানদেরকে বলেছিলেন,‘‘ আমি মুহাম্মদের ব্যাপারে তোমাদেরকে অসিয়ত করছি। কারণ তিনি কুরাইশদের মধ্যে সবচেয়ে বিশ্বস্ত,আরবদের মধ্যে সবচেয়ে সত্যবাদী এবং সকল মানবীয় পূর্ণতা ও মহৎ গুণের অধিকারী। তিনি এমন এক ধর্ম আনয়ন করেছেন যার প্রতি জনগনের অন্তঃকরণসমূহ বিশ্বাস স্থাপন করেছে,কিন্তু কটাক্ষ,নিন্দা ও তিরস্কারের ভয়ে মুখে মুখে তারা এ ধর্মের বিরোধিতা এবং তা অস্বীকার করছে। আমি এখন দেখতে পাচ্ছি যে,আরবের দুর্বল ও অবহেলিত জনগণ তাঁকে সমর্থন এবং তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করছে। আর মুহাম্মদও তাদের সাহায্যে কুরাইশদের আধিপত্য ভেঙে দেয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছেন। তিনি কুরাইশ সর্দারদেরকে অপদস্থ ও তাদের বাড়িগুলোকে বিরান এবং আশ্রয়হীনদেরকে শক্তিশালী করেছেন। এরপর তিনি নিম্নোক্ত বাক্যগুলোর মাধ্যমে তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন,

كونوا له ولاة و لحزبه حماة، والله لا يسلك أحد سبيله إلا رشد و لا يأخذ رشد و لا يأخذ أحد بهداه إلّا سعد، و لو كان لنفسي مدة و في احلي تأخير لكففت عنه الهزاهز، و لدافعت عنه الدوافع

“হে আমার আত্মীয়স্বজনগণ! মুহাম্মদের দলের বন্ধু ও সমর্থক হয়ে যাও। মহান আল্লাহর শপথ,যে কেউ তাঁর অনুসরণ করবে,তাঁর পথে চলবে,সে সুপথপ্রাপ্ত ও সৌভাগ্যমণ্ডিত হবে। আমার জীবন যদি অবশিষ্ট থাকত এবং আমার মৃত্যু যদি পিছিয়ে যেত তাহলে আমি তাঁর নিকট থেকে সব ধরনের বিপদাপদ ও তিক্ত ঘটনা প্রতিহত করতাম এবং তাঁকে রক্ষা করতাম। ৩৩৮

আমাদের কোন সন্দেহ নেই যে,তিনি তাঁর এ আশা-আকাঙ্ক্ষার ক্ষেত্রে সত্যবাদী ছিলেন। কারণ  তাঁর দীর্ঘ দশ বছরের অবদান ও আত্মত্যাগ তাঁর বক্তব্য ও কথা সত্য হওয়ার সাক্ষ্য-প্রমাণস্বরূপ। তাঁর কথা ও বক্তব্যের সত্যতার সাক্ষ্যপ্রমাণ হচ্ছে (তাঁর) ঐ অঙ্গীকার যা তিনি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে তাঁর নবুওয়াতের সূচনালগ্নে দিয়েছিলেন। কারণ যে দিন হযরত মুহাম্মদ তাঁর সকল চাচা ও নিকটাত্মীয়কে নিজ গৃহে একত্র করে তাদের সামনে ইসলাম ধর্ম উপস্থাপন করেছিলেন সে দিন হযরত আবু তালিব (রা.) তাঁকে বলেছিলেন,

أخرج ابن أخي فإنّك الرّفيع كعبا، و المنيع حزبا والأعلى أبا و الله لا يسلقك لسان إلّا سلقته ألسن حداد، واجتذبته سيوف حداد، و الله لتذلّنّ لك العرب ذلّ البهم لحاضنها

“হে আমার ভ্রাতুষ্পুত্র! তুমি (দৃঢ়ভাবে) দাঁড়াও। কারণ তুমি সুউচ্চ মাকাম ও মর্যাদার অধিকারী,তোমার দলই অত্যন্ত সম্মানিত দল। তুমি অত্যন্ত সম্মানিত পিতার সন্তান। মহান আল্লাহর শপথ,যখন তোমাকে কোন কণ্ঠ কষ্ট দেবে তখন অত্যন্ত ধারালো কণ্ঠসমূহ তোমার পক্ষাবলম্বন করে সেই কণ্ঠকেই আঘাতে জর্জরিত করে দেবে এবং ধারালো তরবারিগুলো তাদেরকে বধ করবে। মহান আল্লাহর শপথ,পশুপালকের কাছে পশুগুলো যেভাবে নত হয় ঠিক সেভাবে আরবগণ তোমার কাছে নতজানু হবে ও বশ্যতা স্বীকার করবে। ৩৩৯

সর্বশেষ পথ

হযরত আবু তালিবের ঈমান ও নিষ্ঠা সম্পর্কে তাঁর নিরপেক্ষ নিকটাত্মীয়দেরকে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম পন্থা। কারণ ঘরে যা ঘটে সে সম্পর্কে ঘরের অধিবাসীরাই সবচেয়ে বেশি জ্ঞাত।

১. যখন হযরত আলী (আ.) মহানবী (সা.)-কে হযরত আবু তালিবের মৃত্যু সংবাদ জানালেন তখন মহানবী খুব কেঁদেছিলেন এবং তিনি হযরত আলীকে হযরত আবু তালিবের লাশের গোসল,কাফন ও দাফনের নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং মহান আল্লাহর কাছে তাঁর মাগফেরাত কামনা করেছিলেন।৩৪০

২. চতুর্থ ইমাম হযরত যয়নুল আবেদীন (আ.)-এর কাছে হযরত আবু তালিবের ঈমান প্রসঙ্গে কথা উঠলে তিনি বলেছিলেন, আমি আশ্চর্যান্বিত হচ্ছি যে,মানুষ কেন তাঁর ঈমান ও ইখলাসের ব্যাপারে সন্দিহান অথচ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর কোন মুসলিম নারী কাফির স্বামীর বিবাহবন্ধন ও তত্ত্বাবধানে থাকতে পারবে না (অর্থাৎ তাদের বিবাহ বন্ধনই টুটে যাবে)। ফাতিমা বিনতে আসাদ আস সাবিকুনাল আউওয়ালুন’-এর অন্তর্ভুক্ত এবং তিনি ঐ সব মহিলা ও নারীর অন্তর্ভুক্ত যাঁরা অনেক আগে মহানবী (সা.)-এর প্রতি ঈমান এনেছিলেন। আর হযরত আবু তালিবের মৃত্যু পর্যন্ত এ মহিলা তাঁর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন।

৩. ইমাম বাকির (আ.) বলতেন,‘‘ আবু তালিবের ঈমান বহু লোকের ঈমানের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) হযরত আবু তালিবের পক্ষ থেকে হজ্ব আদায় করার নির্দেশ দিতেন।৩৪১

৪. ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন, হযরত আবু তালিব (রা.) ছিলেন আসহাবে কাহাফসদৃশ যাঁদের অন্তরে ঈমান ছিল এং যাঁরা বাহ্যত (মুখে) শিরকের বাণী উচ্চারণ করতেন। এ কারণেই তাঁরা দু বার পুরস্কারপ্রাপ্ত হবেন (أسرّوا الإيمان و أظهروا الشّرك فأتاهم الله أجرهم مرّتين )। ৩৪২

শিয়া আলেমদের অভিমত

ইমামীয়াহ্ ও যায়েদীয়াহ্ আলেমগণ আহলে বাইতের অনুসরণ করে ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে,হযরত আবু তালিব (রা.) ইসলামের সুমহান ও ঊচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। যে দিন তিনি মৃত্যুবরণ করলেন সে দিন তাঁর অন্তর ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি বিশ্বাস ও নিষ্ঠার দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল। তাঁর ঈমান ও নিষ্ঠার ব্যাপারে অনেক বই ও প্রবন্ধ লিখা হয়েছে। পূর্ববর্তী যুগগুলো থেকে এ পর্যন্ত হযরত আবু তালিব (রা.)-এর ঈমান প্রসঙ্গে ১৮টি গ্রন্থ রচনা করা হয়েছে। এ ব্যাপারে অধিক অবগতির জন্য নাজাফ থেকে প্রকাশিত আল গাদীর’ গ্রন্থের ৭ম খণ্ডের ৪০২-৪০৪ পৃষ্ঠা অধ্যয়ন করুন।

বাইশতম অধ্যায় : মিরাজ

কোরআন,হাদীস ও ইতিহাসের দৃষ্টিতে মিরাজ

রাত্রির অন্ধকার দিগন্তকে আচ্ছাদন করে রেখেছিল। চারিদিকে তখন বিরাজ করছিল নিস্তব্ধতা। সকল প্রাণী দিবসের ক্লান্তি দূর করার উদ্দেশ্যে নিদ্রার কোলে ঢলে পড়েছিল। তারা যেন প্রকৃতি-দর্শন হতে সীমিত সময়ের জন্য বিরত হয়ে পরবর্তী দিবসের কর্মব্যস্ততার জন্য শক্তি সঞ্চয় করছিল। স্বয়ং মহানবীও প্রকৃতিজগতের এ নিয়ম থেকে ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনিও তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পাদনের পর খেজুর পাতার বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিলেন। হঠাৎ এক পরিচিত কণ্ঠস্বর তাঁর কানে ভেসে আসল। এ কণ্ঠ প্রত্যাদেশ বহনকারী ফেরেশতা জিবরাইলের। তিনি তাঁকে বললেন, আজ রাতে আপনার সামনে এক দীর্ঘ সফর রয়েছে। আপনি ঊর্ধ্বগামীযান বোরাকে আরোহণ করে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে পরিভ্রমণ করবেন। এ সফরে আমিও আপনার সহযাত্রী।”

মহানবী (সা.) তাঁর বোন উম্মে হানীর গৃহ হতে এ সফর শুরু করলেন। মহাশূন্যযান বোরাকে চেপে ফিলিস্তিনে অবস্থিত বায়তুল মোকাদ্দাসের উদ্দেশে যাত্রা করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে পৌঁছে মসজিদের নিকটবর্তী বিভিন্ন স্থান,যেমন ঈসা (আ.)-এর জন্মভূমি বেথেলহেম,অন্যান্য নবী-রাসূলের গৃহ ও স্মৃতিচি‎‎ হ্নসমূহ পরিদর্শন করেন। কোন কোন স্থানে দু রাকাত নামায পড়েন।

এরপর তাঁর দ্বিতীয় পর্যায়ের সফর শুরু হয়। এখান থেকেই ঊর্ধ্বজগতের উদ্দেশে যাত্রা করেন। তিনি গ্রহ-নক্ষত্র ও বিশ্বজগতের পরিচালনা ব্যবস্থা দেখেন,নবী ও ফেরেশতাদের সঙ্গে কথোপকথন করেন,আল্লাহর রহমত ও আযাবের প্রতিকৃতি (বেহেশত ও দোযখ) লক্ষ্য করেন। বেহেশতবাসী ও দোযখবাসীদের বিভিন্ন স্তর নিকট থেকে দেখেন। সর্বোপরি বিশ্বজগতের ব্যাপকতা,এর গুপ্ত রহস্য এবং মহান আল্লাহর অসীম ক্ষমতা সম্পর্কে পূর্ণরূপে অবহিত হন। অতঃপর তাঁর গন্তব্যের শেষ স্থান সিদরাতুল মুনতাহা য় পৌঁছেন এবং মহান আল্লাহর অসীমত্ব ও মহান মর্যাদাকে অনুভব করেন। এখানেই তাঁর ঊর্ধ্ব সফরের পরিসমাপ্তি ঘটে। পরে একই পথে তিনি বায়তুল মোকাদ্দাসে ফিরে আসেন। বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে মক্কায় ফেরার পথে কুরাইশ গোত্রের একটি কাফেলার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। তারা তাদের উট হারিয়ে ফেলেছিল এবং রাতের অন্ধকারে খুঁজছিল। তিনি তাদের রক্ষিত পাত্র থেকে কিছু পানি পান করে অবশিষ্ট পানি মাটিতে ছড়িয়ে দেন এবং পাত্রটি পুনরায় ঢেকে রাখেন। সুবহে সাদিকের পূর্বেই তিনি উম্মে হানীর গৃহে ফিরে আসেন। এ রাতের ঘটনাটি তিনি উম্মে হানীকেই প্রথম বলেন। পরবর্তী দিন সকালে কুরাইশদের সমাবেশে তিনি তাঁর এ সফরের ঘটনা বর্ণনা করেন। তাঁর এ আশ্চর্য সফরের ঘটনা-যা মিরাজ’ নামে অভিহিত তা তাদের নিকট অসম্ভব বলে প্রতীয়মান হয়,কিন্তু ঘটনাটি লোকমুখে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং কুরাইশদের ক্ষোভের উদ্রেক করে।

কুরাইশগণ তাদের প্রাচীন অভ্যাস অনুযায়ী তাঁকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে ও বলে, এখানে অনেকেই আছে যারা বায়তুল মোকাদ্দাস দেখেছে। যদি তুমি সত্য বলে থাক তাহলে এর গঠন কাঠামোর বর্ণনা দাও। তিনি শুধু বায়তুল মোকাদ্দাসের বৈশিষ্ট্যই বর্ণনা করলেন না,সে সাথে বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে মক্কার মধ্যবর্তী স্থানে যে সকল ঘটনা ঘটেছে তা বর্ণনা করে বললেন, আমি ফেরার পথে অমুক স্থানে অমুক গোত্রের কাফেলার সাথে দেখা হয়েছিল যারা তাদের উট হারিয়ে ফেলেছিল এবং আমি তাদের রক্ষিত পাত্র থেকে পানি পান করে পাত্রটি পুনরায় ঢেকে রাখি। অন্য স্থানে একদল লোকের সঙ্গে দেখা হয় যাদের উট ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে গিয়ে সামনের পা ভেঙে ফেলেছিল। কুরাইশরা খবর পেল একটি কাফেলা মক্কার নিকটবর্তী স্থানে পৌঁছেছে। একটি মেটে রঙের উট তাদের কাফেলার সম্মুখে রয়েছে। তারা রাগান্বিত হয়ে বলল, তোমার কথার সত্যতা এখনই প্রমাণিত হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবু সুফিয়ানসহ ঐ কাফেলার অগ্রগামী অংশ কাবা ঘরে পৌঁছল। তারা রাসূল (সা.) কর্তৃক বর্ণিত ঘটনাকে সত্যায়ন করল। উপরিউক্ত বর্ণনাটি তাফসীর ও হাদীস গ্রন্থসমূহের বর্ণনার সংক্ষিপ্ত রূপ। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য বিহারুল আনওয়ার’ গ্রন্থের মিরাজ’ অধ্যায় দ্রষ্টব্য।

মিরাজের কোরআনী ভিত্তি

রাসূল (সা.)-এর মিরাজ কোরআনের দু টি সূরায় স্পষ্টরূপে বর্ণিত হয়েছে। কোন কোন সূরায় এ বিষয়ে কিছুটা ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। আমরা এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে এরূপ একটি আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা উপস্থাপন করছি। মহান আল্লাহ্ সূরা বনি ইসরাইলের প্রথম আয়াতে বলেছেন,

) سبحان الّذي أسرى بعبده ليلا من المسجد الحرام إلى المسجد الأقصا الّذي باركنا حوله لنريه من ءاياتنا إنّه هو السّميع البصير(

পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি,যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রিবেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত-যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি যাতে আমি তাঁকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দিই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। (সূরা ইসরা : ১)

উপরিউক্ত আয়াতের বাহ্যিক অর্থ থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বোঝা যায় :

১.মহানবী (সা.) যে মানবীয় ক্ষমতা দ্বারা এ সফর করেন নি,বরং ঐশী শক্তির সাহায্যে স্বল্প সময়ে এ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছিলেন তা বুঝানোর জন্য আয়াতটিسبحان الّذي (সুবহানাল্লাযি) দ্বারা অর্থাৎ মহান আল্লাহর ত্রুটি ও অপূর্ণতা থেকে পবিত্রতা ঘোষণার মাধ্যমে শুরু হয়েছে। শুধু তা-ই নয় মহান আল্লাহ্ এ যাত্রার উদ্গাতা হিসাবে নিজেকে উল্লেখ করে বলেছেনأسرى (আসরা) অর্থাৎ তিনিই এ পরিভ্রমণ করিয়েছেন যাতে কেউ মনে না করে যে,সাধারণভাবে প্রাকৃতিক নিয়মে তা সম্পন্ন হয়েছে,বরং এ সফরটি মহান সত্তা ও প্রতিপালকের বিশেষ ক্ষমতায় সম্পাদিত হয়েছে।

২. এ সফরটি রাত্রিতে সম্পাদিত হয়েছিল। তাইليلا (লাইলা) শব্দটির পাশাপাশিأسرى (আসরা) শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে যা আরবগণ রাত্রিকালীন পরিভ্রমণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে থাকে।

৩. যদিও এ সফরের শুরু আবু তালিবের কন্যা উম্মে হানীর গৃহ থেকে হয়েছিল তদুপরি এ যাত্রার শুরুটি মসজিদুল হারাম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সম্ভবত আরবরা যেহেতু সমগ্র মক্কাকে হারাম বলে অভিহিত করে থাকে সেহেতু সমগ্র মক্কাই মসজিদে হারামের অন্তর্ভুক্ত বলে ধরা হয়েছে। সুতরাং তিনি মসজিদুল হারাম থেকে পরিভ্রমণ করিয়েছেন কথাটি সঠিক। অবশ্য কোন কোন হাদীসের বর্ণনায় মিরাজ মসজিদে হারাম থেকেই হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ আয়াতটিতে যদিও সফরের শুরু মসজিদে হারাম হতে এবং পরিসমাপ্তি মসজিদে আকসা উল্লেখ করা হয়েছে তদুপরি তা নবী (সা.)-এর ঊর্ধ্বজগতের পরিভ্রমণ সম্পর্কিত বর্ণনার পরিপন্থী নয়। কারণ এ আয়াতে এই পরিসীমার মধ্যে সফরের বর্ণনা থাকলেও সূরা নাজমের আয়াতসমূহে ঊর্ধ্বজগতের ভ্রমণের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।

৪. মহানবী (সা.)-এর এ পরিভ্রমণ দেহ ও আত্মার সমন্বয়ে হয়েছিল। কখনই তা শুধু আত্মিক ছিল না। এ কারণেই এ আয়াতেبعبده   (বিআবদিহি) বলা হয়েছে যা দেহ ও আত্মার সমন্বিত রূপের প্রতি ইঙ্গিত করে। মিরাজ যদি শুধু আত্মিক হতো তবে আল্লাহ্ বলতেনبروحه (বিরূউহিহি)।

৫. এ মহাসফরের উদ্দেশ্য ছিল অস্তিত্বজগতের বিশালতা ও এর উল্লেখযোগ্য নিদর্শনসমূহ রাসূলকে দেখানো।

অন্য যে সূরাটি মিরাজের ঘটনাকে স্পষ্টরূপে বর্ণনা করেছে তা হলো সূরা আন্ নাজম। এ সূরার নিম্নোক্ত আয়াতটির শানে নুযূল হলো যখন নবী (সা.) কুরাইশদের বললেন, আমি প্রত্যাদেশ বহনকারী ফেরেশতাকে তাঁর প্রকৃত চেহারায় প্রথম ওহী অবতীর্ণ হওয়ার সময় দেখেছিলাম’,তখন কুরাইশরা এ কথায় তাঁর সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হয়। কোরআন তাদের জবাবে বলে,

) أفتما رونه على ما يرى و لقد راه نزلة أخرى عند سدرة المنتهى عندها جنّة المأوى إذ يغشى السّدرة ما يغشى ما زاغ البصر و ما طغى لقد رأى من آيات ربّه الكبرى(

“রাসূল যা দেখেছেন তোমরা কেন সে বিষয়ে তাঁর সঙ্গে বিতর্ক কর? তিনি আরেকবার তাঁকে (ফেরেশতা) দেখেছিলেন সিদরাতুল মুনতাহার নিকট যা সৎকর্মশীলদের জন্য নির্ধারিত বেহেশতের সন্নিকটে অবস্থিত। তখন সিদরাতুল মুনতাহাকে যা আচ্ছাদিত করার ছিল পূর্ণরূপে আচ্ছাদিত করে রেখেছিল। তাঁর দৃষ্টি কোন ভুল করে নি এবং কোনরূপ বিচ্যুতও হয় নি এবং তিনি তাঁর প্রতিপালকের মহান নিদর্শনের কিয়দংশ প্রত্যক্ষ করেন।”

মিরাজ সম্পর্কিত হাদীসসমূহ

মুফাসসির ও মুহাদ্দিসগণ রাসূল (সা.)-এর মিরাজ ও তাতে তিনি কি দেখেছেন সে সম্পর্কে প্রচুর হাদীস বর্ণনা করেছেন। এর সবগুলোই অকাট্য ও নির্ভুল নয়। বিশিষ্ট শিয়া মুফাসসির আল্লামা তাবারসী এ সম্পর্কিত হাদীসসমূহকে চার ভাগে ভাগ করেছেন৩৪৩ :

১. অকাট্য হাদীসসমূহ যাতে মিরাজ সংঘটিত হওয়ার বিষয়টি কিছু বিশেষত্বসহ বর্ণিত হয়েছে।

২. যে সকল রেওয়ায়েত সহীহ হিসাবে বর্ণিত হয়েছে,তবে অকাট্য নয় এবং বুদ্ধিবৃত্তি ও প্রজ্ঞার পরিপন্থীও নয়। যেমন ঊর্ধ্বাকাশে পরিভ্রমণ,বেহেশত-দোযখ দর্শন এবং নবিগণের আত্মার সঙ্গে কথোপকথন।

৩. ঐ সকল হাদীস যেগুলোর বাহ্যিক অর্থ গ্রহণীয় নয়,তবে তা ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। যেমন মিরাজের রাত্রিতে বেহেশতবাসী ও দোযখবাসীদের সঙ্গে নবী করীম (সা.)-এর কথোপকথন। একে ব্যাখ্যা করে বলতে হয় তিনি তাদের অভ্যন্তরীণ আকৃতি ও বৈশিষ্ট্যের প্রতিকৃতির সঙ্গে কথা বলেছেন।

৪. এ সম্পর্কে মিথ্যাবাদী বর্ণনাকারীরা যে সকল জাল হাদীস তৈরি করেছে। যেমন কোন বর্ণনায় এ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে,রাসূল (সা.) আল্লাহর পাশে গিয়ে বসেন এবং তাঁর কলমের খসখস শব্দ শুনতে পান।

মুজিযা সংক্রান্ত আলোচনা

প্রকৃতিবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিদ্যায় মানব জাতির সর্বশেষ অগ্রগতিসমূহ এবং বহুসংখ্যক বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ভ্রান্ত প্রমাণিত হওয়ার বিষয়টি পাশ্চাত্যে এক অতি বিস্ময়কর হট্টগোল সৃষ্টি করেছিল,অথচ এ সব পরিবর্তন আসলে ছিল বৈজ্ঞানিক পরিবর্তন এবং তা প্রকৃতিবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিদ্যাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতো এবং ধর্মীয় আকীদা-বিশ্বাসের সাথে এ সব পরিবর্তনের মোটেও কোন সম্পর্ক ছিল না। এত কিছু সত্ত্বেও এ পরিবর্তন সকল শাস্ত্র ও বংশানুক্রমিক আকীদা-বিশ্বাসের প্রতি একদল মানুষের মধ্যে এক আশ্চর্যজনক নৈরাশ্যবাদের উদ্ভবের কারণ হয়েছিল।

এ নৈরাশ্যবাদের মূল রহস্য ছিল এই যে,বিজ্ঞানীরা দেখতে পেলেন,পুরানো তত্ত্বগুলো যা শত শত বছর ধরে মানব-চিন্তাধারা এবং বৈজ্ঞানিক মহলের ওপর একচেটিয়া প্রভুত্ব বিস্তার করে রেখেছিল তা আজ আধুনিক বিজ্ঞান,পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক মূল্যায়নে বাতিল ও ভ্রান্ত প্রমাণিত হচ্ছে। পৃথিবীকেন্দ্রিক ন টি জ্যোতিষ্কমণ্ডল এবং শত শত তত্ত্বের আজ আর কোন খবরই নেই। এ ধরনের পরিস্থিতিতে তাঁরা নিজেরাই নিজেদের কাছে প্রশ্ন করছেন, কোথা থেকে এবং কিভাবে আমরা বুঝতে ও জানতে পারব যে,আমাদের বাদবাকী ধর্মীয় বিশ্বাস ও বৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণাও ঠিক এমন হবে না? এ ধরনের ধ্যান-ধারণা একদল বৈজ্ঞানিক ও পণ্ডিতের মধ্যে সকল ধরনের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত আকীদা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে সন্দেহের বীজ বপন করে দিয়েছে এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে তা বেশ বিস্তৃতি লাভ করেছে এবং সংক্রামক ব্যাধির ন্যায় বৈজ্ঞানিক মহলগুলোর একাংশের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে।

এছাড়াও আকীদা-বিশ্বাস অনুসন্ধানকারী বিচারালয় এবং গীর্জার ধর্মযাজকদের কড়াকড়ি এ নৈরাশ্যবাদের উৎপত্তির মূল কারণ;বরং তা এ ধরনের মতবাদ বিকাশের ক্ষেত্রে পূর্ণ মাত্রায় অবদান রেখেছে। কারণ গীর্জা নিষেধাজ্ঞা ও নির্যাতন করার মাধ্যমে তদানীন্তন বৈজ্ঞানিক ও পণ্ডিতদেরকে,যাঁরা বৈজ্ঞানিক সূত্র ও নিয়ম-নীতি প্রণয়নে সফল হয়েছিলেন পবিত্র বাইবেলের সাথে বিরোধিতা করার অজুহাতে হত্যা করত। বলার অপেক্ষা রাখে না যে,এ ধরনের চাপ ও কার্যকলাপ প্রতিক্রিয়াবিহীন হতে পারে না। আর সেদিন থেকেই ভবিষ্যদ্বাণী ও ধারণা করা হতো যে,বৈজ্ঞানিক ও পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ যদি একদিন ক্ষমতা ফিরে পায়,তাহলে গীর্জার অব্যবস্থাপনা,অদক্ষতা এবং প্রয়োজনীয় পরিচালনাকারী ক্ষমতার অভাববশত সার্বিকভাবে ধর্ম ও ধার্মিকতারই ফাতিহা পাঠ করতে হবে।

ঘটনাচক্রে পুরো ব্যাপারটিই এমন হয়ে গিয়েছিল। বিজ্ঞান যতই উন্নতি লাভ করছিল এবং বৈজ্ঞানিকগণ প্রাকৃতিক বস্তু ও পদার্থসমূহের মধ্যকার বিভিন্ন সম্পর্ক যত (ভালোভাবে) বুঝতে পারছিলেন,আর বহু সংখ্যক প্রাকৃতিক প্রপঞ্চ ও বিভিন্ন জরা-ব্যাধির কারণগুলো যে হারে আবিষ্কৃত হচ্ছিল ঠিক সে হারে অতি প্রাকৃতিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়াদি,অস্তিত্বের উৎসমূল,পরকাল এবং নবীদের মুজিযা ও অলৌকিক কার্যাবলীর প্রতি সবচেয়ে কম গুরুত্ব দেয়া হচ্ছিল এবং সংশয়বাদী ও নাস্তিকদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল।

বিজ্ঞানীদের মহলে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ও সাফল্যকে কেন্দ্র করে যে গর্ব ও অহংকারের উদ্ভব হয়েছিল তার ফলে কতিপয় প্রকৃতিবিজ্ঞানী সকল ধর্মীয় বিষয়কেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখতে থাকেন এবং তাওরাত ও ইঞ্জিলের মুজিযাসমূহের কোন একটির নাম পর্যন্ত তাঁরা উচ্চারণ করা থেকে বিরত থাকেন।

তাঁরা হযরত মূসা (আ.)-এর লাঠি ও তাঁর শ্বেতশুভ্র হাতের কাহিনীকে গাঁজাখুরি উপাখ্যান বলে গণ্য করেছেন এবং মহান আল্লাহ্পাকের অনুমতি নিয়ে ঈসা (আ.)-এর ফুঁ দিয়ে মৃতদেরকে জীবিত করার কাহিনীকেও অবাস্তব কাহিনী বলে অভিহিত করেছেন। তাঁদের এ ধরনের অভিব্যক্তি ও বিশ্বাস করার কারণ হচ্ছে,তাঁরা নিজেদের কাছেই প্রশ্ন রেখে বলেন,কোন প্রাকৃতিক কারণ ছাড়াই কি এক টুকরা কাঠ একটি বিরাট অজগর সাপের রূপ ধারণ করতে পারে? একটি প্রার্থনার বদৌলতে কি কোন মৃত জীবিত হতে পারে? বৈজ্ঞানিকগণ যাঁরা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁদের সাফল্য ও কৃতকার্যতার মদমত্ততায় মাতাল হয়ে গিয়েছিলেন তাঁরাই এমন চিন্তা-ভাবনা করতে থাকেন যে,তাঁরা সকল জ্ঞান-বিজ্ঞান,শাস্ত্র ও বিদ্যার চাবিকাঠি পেয়ে গেছেন এবং সকল বস্তু ও ঘটনার মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কও ভালোভাবে উপলব্ধি করেছেন। এ কারণেই তাঁরা ভাবতে থাকেন যে,এক টুকরা শুষ্ক কাঠ ও সাপ অথবা এক ব্যক্তির প্রার্থনা ও মনোনিবেশ ও মৃতদের জীবিত হওয়ার মধ্যে কোন সম্পর্কই বিদ্যমান নেই। তাই তাঁরা এ ধরনের বিষয়ের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেছেন অথবা তাঁরা কখনো কখনো এগুলো অস্বীকারও করেছেন।

কিছু সংখ্যক বিজ্ঞানীর চিন্তা-ভাবনার ধরন

এ ধরনের চিন্তা-ভাবনা মিশরের কতিপয় বিজ্ঞানী ও সুধীমহলে অনুপ্রবেশ করেছিল এবং তাঁরাই এ ধরনের ধ্যান-ধারণা ও চিন্তাধারার দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন। এ কারণেই তাঁরা ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক বিষয়াদি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে এ ধরনের পথ ও পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। মূল বিষয় হচ্ছে এই যে,এ গোষ্ঠীটি সব কিছুর আগে পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানী ও পণ্ডিতদের চিন্তাধারা এবং ধ্যান-ধারণার সাথে পরিচিত হয়েছিলেন এবং পাশ্চাত্যের কিছু কিছু চিন্তা-দর্শন তাঁরা ঠিক এ পথেই মুসলিম বিশ্ব ও ইসলামী দেশসমূহে আমদানী করেছেন।

এদের মধ্যে কেউ কেউ এমন এক পথ বেছে নিয়েছেন যে,সে পথে তাঁরা পবিত্র কোরআন ও নির্ভুল হাদীসের প্রতি যেমন সম্মান প্রদর্শন করতে চান,ঠিক তেমনি নিজেদের প্রতিও প্রকৃতিবিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চান। অথবা ন্যূনতম পর্যায়ে তাঁরা এমন কোন তত্ত্ব গ্রহণ করতে চান না যা প্রকৃতিবিজ্ঞানের নিয়ম-কানুনের দ্বারা ব্যাখ্যা করা অসম্ভব।

এ দলটি প্রত্যক্ষ করেন যে,পবিত্র কোরআন কতগুলো মুজিযা বর্ণনা করেছে যা কখনই সাধারণ (প্রকৃতি) বিজ্ঞানের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায় না। কারণ বিরাট অজগর সাপে পরিণত হওয়ার সাথে কাঠের সম্পর্ককে বিজ্ঞান নির্ণয় করতে অপারগ। আবার অন্যদিকে তাঁদের পক্ষে এমন কোন তত্ত্ব মেনে নেয়াও অত্যন্ত কঠিন যা ইন্দ্রিয়ানুভূতি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মতো বৈজ্ঞানিক উপায়-উপকরণের সাহায্যে প্রমাণ করা সম্ভব নয়।

(ধর্মীয়) বিশ্বাস ও বিজ্ঞানের মধ্যে বাহ্যিক এ দ্বন্দ্বের কারণে তাঁরা এমন পথ অবলম্বন করেছেন যার মাধ্যমে এ ধরনের দ্বন্দ্বের নিষ্পত্তি করা সম্ভব। আর এভাবে পবিত্র কোরআন এবং অকাট্য হাদীসসমূহের বাহ্য অর্থসমূহ যেমন সংরক্ষিত হবে,ঠিক তেমনি তাঁদের বক্তব্যও বৈজ্ঞানিক সূত্র ও নীতিমালার বিরোধী হবে না। আর তা হলো তাঁরা মহান নবীদের সকল মুজিযা ও অলৌকিক কার্যকলাপকে যুগোপযোগী বৈজ্ঞানিক নীতিমালার আলোকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করবেন যে,সেগুলো স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক বিষয় বলে প্রতিভাত হবে। এমতাবস্থায় পবিত্র কোরআন ও অকাট্য হাদীসসমূহের সম্মান যেমন সংরক্ষিত হলো ঠিক তেমনি তা (মুজিযা সংক্রান্ত ব্যাখ্যা) বিজ্ঞানেরও পরিপন্থী হলো না। আমরা নমুনাস্বরূপ আবরাহার হস্তিবাহিনীর কাহিনী সংক্রান্ত যে ব্যাখ্যা মিশরের প্রসিদ্ধ আলেম শেখ মুহাম্মদ আবদুহু দিয়েছেন তা এখানে উল্লেখ করব :

পাথুরে মাটি ও ধুলা-বালিবাহিত বসন্ত ও হাম রোগ মশা-মাছির মতো উড়ন্ত কীট-পতঙ্গের মাধ্যমে আবরাহার সেনাবাহিনীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল।بحجارة من سجّيل 112   এর অর্থ প্রস্তরমিশ্রিত বিষাক্ত (দূষিত) কাদা যা বাতাসের মাধ্যমে বিস্তৃত হয়েছিল এবং ছড়িয়ে পড়েছিল। আবরাহার সৈন্যদের হাত ও পা ঐ দূষিত প্রস্তরমিশ্রিত কাদা ও ধুলা-বালি দ্বারা মেখে গিয়েছিল এবং ঐ সকল কীট-পতঙ্গের সংস্পর্শে এসে মানুষের দেহের ত্বকের সূক্ষ্ম রন্ধ্র ও রোমকূপসমূহে রোগজীবাণুর সংক্রমণ হয় যার ফলে দেহে মারাত্মক ক্ষতের সৃষ্টি হয়। এগুলোই হচ্ছে মহান আল্লাহর শক্তিশালী সেনাদল যেগুলোকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় জীবাণু’নামকরণ করা হয়েছে।

বর্তমান যুগের একজন লেখক উপরিউক্ত আলেমের বক্তব্য সমর্থন করে লিখেছেন, طين (তীন) যা পবিত্র কোরআনে উল্লিখিত হয়েছে তার অর্থ হচ্ছে উড়ন্ত প্রাণী যা মশা ও মাছিকেও শামিল করে।”

তাঁদের বক্তব্য পর্যালোচনা করার আগে আমাদেরকে বাধ্য হয়েই হস্তিবাহিনী সম্পর্কে যে সূরা অবতীর্ণ হয়েছে সেটি পুনরায় পাঠকবর্গের সামনে উপস্থাপন করতে হবে। মহান আল্লাহ্ সূরা ফীল-এ এরশাদ করেছেন :

) ألَمْ تر كيف فعل ربُّك بأصحاب الفيل، ألَم يجعل كيدهم في تضليل، و أرسل عليهم طيراً أبابيل، ترميهم بحجارة من سجّيل، فجعلهم كعصف مأْكول( .

“আপনি কি দেখেন নি যে,আপনার প্রভু হস্তিবাহিনীর সাথে কি আচরণ করেছেন? তিনি কি তাদের চক্রান্ত নস্যাৎ করে দেন নি? তিনি এক ঝাঁক পাখি তাদের (ঐ সেনাবাহিনীর) দিকে প্রেরণ করেছিলেন যেগুলো পোড়া-মাটিনির্মিত কঙ্কর তাদের ওপর নিক্ষেপ করেছিল এবং তিনি তাদের দেহকে চর্বিত ঘাসের ন্যায় ছিন্ন-ভিন্ন করে ফেলেছিলেন।”

এ আয়াতগুলোর বাহ্য অর্থ থেকে প্রতীয়মান হয় যে,আবরাহার জাতি ও সম্প্রদায় মহান আল্লাহর ক্রোধ ও গজবের শিকার হয়েছিল। এ সব ছোট ছোট কঙ্করই ছিল তাদের মৃত্যুর একমাত্র কারণ। এক ঝাঁক পাখি তাদের মাথা,মুখমণ্ডল ও দেহের ওপর এ সব কঙ্কর নিক্ষেপ করেছিল। এ আয়াতগুলোর অন্তর্নিহিত অর্থের দিকে গভীরভাবে দৃকপাত করলে প্রতীয়মান হয় যে,আবরাহার বিশাল হস্তিবাহিনীর ধ্বংস ও মৃত্যু কেবল এ অস্বাভাবিক অস্ত্রের দ্বারাই সংঘটিত হয়েছে। (এ অধমের দৃষ্টিতে উপরিউক্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কঙ্কর ছিল আসলে অত্যন্ত শক্তিশালী এবং ভিত্ উৎপাটনকারী) সুতরাং এ আয়াতগুলোর বাহ্য অর্থের পরিপন্থী যে কোন ব্যাখ্যাই অকাট্য দলিল-প্রমাণ এর পক্ষে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য হবে না।

উপরিউক্ত ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য কিছু বিষয়

1. পূর্বোক্ত ব্যাখ্যাটিও সমগ্র ঘটনাকে প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক বলে প্রকাশ করতে পারে নি। উক্ত কাহিনীতে এরপরও এমন কিছু বিষয় ও দিক আছে যেগুলো অদৃশ্য (গায়েবী) কার্যকারণসমূহের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা উচিত। কারণ যদি ধরেও নিই যে,বসন্ত ও টাইফয়েড জ্বরের রোগজীবাণুর দ্বারাই আবরাহার সেনাবাহিনীর মৃত্যু হয়েছে এবং তাদের মৃতদেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে তাহলে এ সব পাখি কোন্ সত্তার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও নির্দেশনা পেয়ে বুঝতে পেরেছিল যে,বসন্ত ও টাইফয়েড জ্বরের রোগজীবাণু ঐ সব কঙ্করের মধ্যে স্থান নিয়েছে এবং তখন পাখিগুলো তাদের নিজেদের খাদ্য ও দানা-পানি সংগ্রহ করার পরিবর্তে এক ঝাঁক একত্রে ঐ সব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কঙ্করের কাছে গিয়েছে এবং চঞ্চুর মধ্যে সেগুলো পুরে এক সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর ন্যায় আবরাহার সেনাবাহিনীর ওপর তা বর্ষণ করেছে? এমতাবস্থায় সমগ্র ঘটনাপ্রবাহকে স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক বলা যাবে কি? এ মহাঘটনার একটি অংশের ব্যাখ্যা যদি গায়েবী কার্যকারণসমূহের মাধ্যমেই করতে হয় এবং মহান আল্লাহর ইচ্ছা এ ক্ষেত্রে যদি কার্যকর থাকে তাহলে উক্ত ঘটনার আরেক অংশকে স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক বলে দেখানোর কি আর কোন প্রয়োজন আছে?

2. অণুজীব প্রাণীসমূহ যা বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় জীবাণু’নামে অভিহিত এবং মানুষের শত্রু বলে গণ্য,সেদিন (আবরাহার ওপর কঙ্কর বর্ষণের দিনে) কোন ব্যক্তির সাথে সেগুলোর কোন আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল না এতদ্সত্ত্বেও এ জঘন্য ভয়ঙ্কর শত্রু কিভাবে কেবল আবরাহার সৈন্যদেরকেই আক্রান্ত করেছিল এবং মক্কাবাসীদেরকে পুরোপুরি ভুলেই গিয়েছিল? আমাদের যে সব ইতিহাস জানা আছে সে সব কিছু থেকে প্রতীয়মান হয় যে,সকল ক্ষয়ক্ষতি কেবল আবরাহার সেনাবাহিনীরই হয়েছিল,অথচ বসন্ত ও টাইফয়েড হচ্ছে সংক্রামক ব্যাধি এবং বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক উপাদান ও পদার্থের মাধ্যমে উক্ত রোগ এক স্থান থেকে অন্যস্থানে বিস্তৃত ও স্থানান্তরিত হয়। পরিশেষে এ রোগ কখনো কখনো একটি দেশকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসও করে ফেলে।

তাহলে এরপর কি এ ঘটনাকে একটি স্বাভবিক প্রাকৃতিক ঘটনা বলে গণ্য করা যাবে?

3. সংক্রামক ব্যাধি সৃষ্টিকারী রোগজীবাণু কি ধরনের ছিল সে ব্যাপারেও এ সব ব্যাখ্যাকারীদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে। আর এ কারণেই তাঁদের প্রদত্ত তত্ত্বটি আরো বেশি নড়বড়ে ও ভিত্তিহীন হয়ে গেছে। কখনো বলা হয় যে,রোগজীবাণুটি ছিল কলেরার,কখনো বলা হয়েছে তা ছিল টাইফয়েড ও বসন্তের জীবাণু। অথচ এ ধরনের বক্তব্য ও মতপার্থক্যের কোন সঠিক ও নির্ভরযোগ্য দলিল-প্রমাণ আমরা খুঁজে পাই নি। মুফাসসিরদের মধ্যে কেবল ইকরামাহ্ এ সম্ভাবনা সম্পর্কে বলেছেন এবং ইতিহাস লেখকদের মধ্যে কেবল ইবনে আসীর তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে একটি দুর্বল বক্তব্য হিসাবে এ সম্ভাবনার উদ্ধৃতি দিয়েছেন এবং তিনি সাথে সাথে তা রদও করেছেন।113 এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে,মুফাসসির ইকরামাহ্ সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে যথেষ্ট কথা আছে।

সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাখ্যা হচ্ছে ঐ ব্যাখ্যা যা মিশরের ভূতপূর্ব সংস্কৃতিমন্ত্রী ড. হাইকাল রচিত হায়াতু মুহাম্মদ’অর্থাৎ মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনচরিত গ্রন্থে হস্তিবাহিনীর বিস্তারিত বিবরণ প্রসঙ্গে এসেছে। সূরা ফীলের আয়াতগুলো উল্লেখ করার পর এবং আর তাদের ওপর তিনি প্রেরণ করলেন এক ঝাঁক পাখি’-এ আয়াতটিও তার চোখের সামনে থাকা সত্ত্বেও তিনি আবরাহার সৈন্যদের মৃত্যুর ব্যাপারে লিখেছেন, সম্ভবত বাতাসের সাথে কলেরার রোগজীবাণু সমুদ্রের দিক থেকে এসেছিল।” রোগজীবাণু আনয়নকারী যদি বাতাসই হয়ে থাকে তাহলে পাখিগুলো কি কারণে আবরাহার সৈন্যদের মাথার ওপর উড়ছিল এবং এ সব কঙ্কর নিক্ষেপ করছিল? আর এ সব কঙ্কর আবরাহার সৈন্যদের মৃত্যু ঘটানোর ক্ষেত্রে কতটুকুই বা প্রভাব রেখেছিল?

সত্যি বলতে কি,আমরা এ ধরনের চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি মেনে নিতে পারি না এবং বিনা কারণে মহান নবী ও ওলীদের বড় বড় মুজিযার অপব্যাখ্যাও করতে পারি না। প্রকৃতিবিজ্ঞানের আলোচ্য বিভিন্ন বিষয় এবং মুজিযা ভিন্ন দু টি পথ। উপরন্তু প্রকৃতিবিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়াদির পরিধি কেবল প্রাকৃতিক প্রপঞ্চ ও পদার্থসমূহের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্কসমূহ নির্ণয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যে সব ব্যক্তির ধর্মসংক্রান্ত জ্ঞান খুবই সামান্য এবং এ ধরনের বিষয় সংক্রান্ত যাদের কোন জ্ঞান ও ধারণাই নেই তাদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্য আমাদের ধর্মের অকাট্য মূলনীতি ও আকীদা-বিশ্বাস বর্জন করা অনুচিত,অথচ আমরা এ ধরনের কাজ বাধ্যতামূলক বলে বিশ্বাস করি না। (অর্থাৎ ঐ সব ব্যক্তিকে সন্তুষ্ট করার জন্য আমাদের ধর্মীয় মৌলিক আকীদা-বিশ্বাস যা অকাট্য যুক্তি ও দলিল-প্রমাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত তা বর্জন করা অথবা ঐ সকল ব্যক্তির মর্জিমাফিক ব্যাখ্যা ও বিকৃত করা মোটেও বাধ্যতামূলক নয়)।

দু টি প্রয়োজনীয় বিষয়

এখানে দু টি বিষয় অবশ্যই উল্লেখ করা উচিত। বিষয়দ্বয় হচ্ছে :

1. বুঝতে যেন ভুল না হয় যে,যে সব কাজ ও ঘটনা জনগণের মুখে মুখে উচ্চারিত এবং মহান নবী ও সৎকর্মশীল বান্দাদের সাথে সম্পর্কিত বলে গণ্য হয়,অথচ যেগুলোর কোন সঠিক দলিল-প্রমাণ নেই এবং কখনো কখনো কুসংস্কারাচ্ছন্ন দিক সম্বলিত আমরা সেগুলোকে এ ধরনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে সঠিক বলে প্রমাণ করতে চাই না,বরং আমাদের প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচেছ এই যে,আমাদের হাতে বিদ্যমান অকাট্য দলিল-প্রমাণাদির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করব যে,অতিপ্রাকৃতিক জগতের সাথে নিজেদের সম্পর্ক ও যোগাযোগ প্রমাণ করার জন্য মহান নবিগণ অলৌকিক কাজ করে থাকেন যা আধুনিক প্রকৃতিবিজ্ঞানও এর কারণসমূহ উপলব্ধি করতে অপারগ। এ ধরনের মুজিযার ব্যাপারে আমাদের সমর্থনই হচ্ছে আমাদের প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

2. আমরা কখনই বলি না যে,মুজিযার অস্তিত্ব আসলে কার্যকারণ ও ফলাফল থেকে ব্যতিক্রম ও ভিন্ন। আমরা উপরিউক্ত সূত্রের ব্যাপারে সম্মান প্রদর্শন করার পাশাপাশি বিশ্বাস করি যে,এ নিখিল বিশ্বের সকল অস্তিত্ববান সত্তারই কারণ আছে। আর যে কোন অস্তিত্ববান সত্তাই কারণবিহীনভাবে অস্তিত্ববান হতে পারে না। তবে আমরা বলি,এ ধরনের ঘটনাবলীরও (মুজিযাসমূহের) আবার কতগুলো অস্বাভাবিক কারণ আছে। আর এ ধরনের আধ্যাত্মিক (অলৌকিক) কার্যকারণ সম্মানিত সৎকর্মশীল বান্দাদের ইখতিয়ারে। বৈজ্ঞানিক অভিজ্ঞতা ও ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত যেহেতু এ ধরনের কার্যকারণসমূহ অনাবিস্কৃত রয়ে গেছে-শুধু এ অজুহাত দেখিয়ে এগুলো অস্বীকার করা যাবে না। এখানে স্মর্তব্য যে,সকল নবীরই অলৌকিক কাজগুলোর কোন না কোন কারণ আছে যা সাধারণ প্রাকৃতিক কার্যকারণাদির দ্বারা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। আর এগুলো যদি এ পদ্ধতির আলোকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয় তাহলে তা আর মুজিযা বলে গণ্য হবে না।

আবরাহার পরাজয়ের পর

আবরাহার মৃত্যু এবং পবিত্র কাবা ও কুরাইশদের শত্রুদের জীবন বিনষ্ট ও ধ্বংস হওয়ার কারণে মক্কাবাসিগণ ও পবিত্র কাবা আরবদের দৃষ্টিতে বিরল ও বিপুল মর্যাদার অধিকারী হয়েছিল। এর ফলে কুরাইশদের এলাকা আক্রমণ,তাদেরকে কষ্ট দেয়া এবং তাওহীদের প্রাণকেন্দ্র পবিত্র কাবা ধ্বংস ও বিরান করার কথা কেউ আর ভেবে দেখারও সাহস করে নি। সাধারণ মানুষ ঠিক এমনই অভিমত ব্যক্ত করত যে,মহান আল্লাহ্ তাঁর নিজ ঘর পবিত্র কাবা এবং কুরাইশদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করার উদ্দেশ্যেই তাদের প্রধান শত্রুকে সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। কিন্তু কমসংখ্যক ব্যক্তিই চিন্তা করত যে,এ মহাঘটনা কেবল পবিত্র কাবা হিফাজত করার উদ্দেশ্যেই ঘটেছিল;আর কুরাইশদের বিরাটত্ব ও ক্ষুদ্রতা এ ক্ষেত্রে মোটেও প্রভাব রাখে নি। এর প্রমাণস্বরূপ,কুরাইশদের ওপর তদানীন্তন অন্যান্য গোত্রপতির পক্ষ থেকে সংঘটিত বারংবার আক্রমণসমূহ। এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে,আবরাহার আক্রমণের সময় যে অবস্থা ও পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল সে ধরনের অবস্থা ও পরিস্থিতি এ সব আক্রমণের ক্ষেত্রে হয় নি।

বিনা আয়েশে অর্জিত এ বিজয় যা কুরাইশদের ক্ষতি ও রক্তপাত ছাড়াই সংঘটিত হয়েছিল তা কুরাইশদের মাঝে নতুন নতুন চিন্তা-ভাবনার উদ্ভব ঘটিয়েছিল। তাদের গর্ব,অহংকার,উপেক্ষা ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার মনোবৃত্তি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছিল। তারা অন্যদের (অ-কুরাইশদের) ব্যাপারে সীমাবদ্ধতা আরোপের কথাও চিন্তা-ভাবনা করতে থাকে। কারণ তারা নিজেদেরকে আরবদের মধ্যে সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত,সম্মানিত ও শ্রেষ্ঠ শ্রেণী বলে মনে করত। তারা বিশ্বাস করত কেবল তারাই 360টি প্রতিমা ও বিগ্রহের সুদৃষ্টিতে রয়েছে এবং তাদের দ্বারা সাহায্যপ্রাপ্ত ও আশীর্বাদপুষ্ট।

এ কারণেই তারা নিজেদের আমোদ-প্রমোদ ও ভোগবিলাসের পরিধি আরো ব্যাপক ও বিস্তৃত করার সিদ্ধান্ত নেয়। তাই তারা খেজুরের তৈরি মদের পাত্রগুলো মাথায় করে বয়ে বেড়াত;কখনো কখনো তারা পবিত্র কাবার চারপাশে মদপানের আসর বসাত। তারা মনে করত যে,বিভিন্ন আরব গোত্রের কাঠ ও লৌহনির্মিত প্রতিমাসমূহের পাশে তাদের জীবনের সর্বোত্তম মুহূর্তগুলো কাটাচ্ছে। আর যারাই হীরা নগরীর মুনজেরি,শামের গাসসানীয় এবং ইয়েমেনের গোত্রগুলো সম্পর্কে যে সব গল্প ও কাহিনী শুনেছিল তারা সে সব কাহিনী ও গল্প সে সব আসরে উপস্থিত ব্যক্তিদের কাছে বর্ণনা করত। তারা বিশ্বাস করত,তাদের এ মধুর জীবন উক্ত প্রতিমা ও মূর্তিগুলোর সুদৃষ্টির প্রত্যক্ষ ফল যা সর্বসাধারণ আরব জাতিকে তাদের (কুরাইশদের) সামনে হীন ও অপদস্থ করেছে এবং তাদেরকে সকলের ওপর শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।


16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53

54

55

56

57

58

59

60

61