চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড4%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 106814 / ডাউনলোড: 9707
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

মিরাজ কখন সংঘটিত হয়েছিল

যদিও মিরাজের ঘটনাটি একটি ঐতিহাসিক ও অলৌকিক ঘটনা হিসাবে স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল,তদুপরি এ বিষয়ে মতানৈক্য রয়েছে। মতানৈক্যের অন্যতম বিষয় ছিল এ ঘটনার সময়কাল নিয়ে। ইসলামের দু জন প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক ও হিশাম এ ঘটনাটি নবুওয়াতের দশম বছরে সংঘটিত হয়েছিল বলে উল্লেখ করেছেন। ঐতিহাসিক বায়হাকীর মতে এ ঘটনাটি নবুওয়াতের দ্বাদশ বর্ষে সংঘটিত হয়েছিল। ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ এ ঘটনাকে নবুওয়াতের প্রথম দিকের,আবার কেউ কেউ মাঝামাঝি সময়ের বলে উল্লেখ করেছেন। অনেক ঐতিহাসিক এ মতগুলোকে সমন্বিত করার উদ্দেশ্যে রাসূল (সা.)-এর মিরাজ একাধিকবার সংঘটিত হয়েছে বলে মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু আমার মনে হয়,যে মিরাজে প্রাত্যহিক নামাযসমূহ ফরজ করা হয় তা আবু তালিবের মৃত্যুর বছর অর্থাৎ নবুওয়াতের দশম বর্ষে সংঘটিত হয়েছিল। কারণ ইতিহাস ও হাদীস গ্রন্থসমূহ থেকে নিশ্চিতভাবে জানা যায় যে,মিরাজের রাত্রিতে নবীর উম্মতের ওপর পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরজ করা হয়েছে। তদুপরি ইতিহাস হতে জানা যায় আবু তালিবের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত নামায ফরজ করা হয় নি। কারণ তাঁর মৃত্যুর সময় কুরাইশ প্রধানগণ তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রের সঙ্গে তাদের মীমাংসা করিয়ে দিতে বলে যাতে করে নবী (সা.) তাঁর দাওয়াতী কর্ম থেকে নিবৃত্ত হন। নবী (সা.) ঐ বৈঠকে কুরাইশ প্রধানদের উদ্দেশে বলেন, আমি তোমাদের নিকট থেকে একটি জিনিসই শুধু চাই। আর তা হলো :

 تقولون لا إله إلّا الله و تخلعون ما تعبدون من دونه

তোমরা এ সাক্ষ্য দাও যে,আল্লাহ্ ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং তিনি ব্যতীত অন্য কিছুর উপাসনা করা থেকে বিরত হও। ৩৪৪

তিনি এখানে এ বিষয়ে তাদের মৌখিক স্বীকৃতি আদায়েরই চেষ্টা করেছেন এবং তা-ই যথেষ্ট মনে করেছেন। এটি তখনও নামায ফরজ না হওয়ার পক্ষে দলিল। কারণ শুধু এ ঈমান ব্যক্তির মুক্তির জন্য যথেষ্ট নয় যদি নামাযের মতো অপরিহার্য কর্ম এর সঙ্গে যুক্ত না হয়ে থাকে। কিন্তু কেন রাসূল (সা.) নিজ নবুওয়াতের স্বীকৃতির বিষয় উপস্থাপন করেন নি? এ প্রশ্নের জবাবে বলা যায় নবীর নির্দেশে আল্লাহর একত্বের স্বীকৃতি তাঁর রিসালাতের স্বীকৃতিও বটে। অর্থাৎ আল্লাহর একত্বকে স্বীকার করে নেয়া এ ক্ষেত্রে তাওহীদ ও রিসালাতকে এক সঙ্গে স্বীকার করে নেয়ারই শামিল।

তদুপরি ঐতিহাসিকগণ হিজরতের কিছু পূর্বে যে সকল ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছে,যেমন তোফাইল ইবনে আমর দুসীর ইসলাম গ্রহণের ঘটনার যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) শুধু শাহাদাতাইনের শিক্ষাই তাদের দিয়েছেন-নামাজের বিষয়ে কিছু বলেন নি। মিরাজের ঘটনাটি যে হিজরতের কিছু দিন পূর্বে হয়েছিল এটি তার অন্যতম প্রমাণ।

যে সকল ব্যক্তি মিরাজ নবুওয়াতের দশম বর্ষের পূর্বে হয়েছিল বলেছেন তাঁরা সঠিক বলেন নি। কারণ রাসূল (সা.) নবুওয়াতের অষ্টম হতে দশম বর্ষে শেবে আবি তালিব’-এ (আবু তালিবের উপত্যকায়) অবস্থান করছিলেন। তাই মুসলমানদের অবস্থা সে সময় বেশ সঙিন ছিল এবং নামাযের মতো গুরুদায়িত্ব কাঁধে নেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। নবুওয়াতের অষ্টম বছরের পূর্বেও কুরাইশদের চাপে মুসলমানদের অবস্থা সংকটজনক ছিল এবং তাদের সংখ্যাও ছিল স্বল্প। যেহেতু তখনও ঈমানের আলো ও এর মৌল শিক্ষা লক্ষণীয় সংখ্যক ব্যক্তির মাঝে প্রস্ফুটিত হয় নি সেহেতু নামাযের বিষয়টি তাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করত।

কোন কোন হাদীসে যে এসেছে হযরত আলী (আ.) হিজরতের তিন বছর পূর্ব হতেই রাসূলের সঙ্গে নামায পড়েছেন সেই নামায নির্দিষ্ট শর্তাধীন ও অপরিহার্য নামায ছিল না,বরং শর্তহীন বিশেষ নামায ছিল৩৪৫ ;সম্ভবত সেগুলো মুস্তাহাব নামায ছিল।

মহানবী (সা.)-এর মিরাজ কি দৈহিক ছিল?

মহানবী (সা.)-এর মিরাজের ধরন কি ছিল-দৈহিক না আত্মিক তা নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। যদিও কোরআনের আয়াত ও হাদীসসমূহ স্পষ্টভাবে রাসূলের মিরাজ দৈহিক ছিল বলে উল্লেখ করেছে৩৪৬ তদুপরি সাধারণ লোকদের চিন্তাপ্রসূত যুক্তিসমূহ এ ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা সৃষ্টি করেছে ও এর ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হয়ে মিরাজ আত্মিকভাবে হয়েছে বলে মনে করেছে। তাদের মতে শুধু নবীর আত্মাই অন্য জগতে ভ্রমণ করেছে এবং পরিভ্রমণশেষে তাঁর দেহে ফিরে এসেছে। কেউ কেউ আবার আরো বাড়িয়ে বলেছেন,রাসূলের মিরাজ স্বপ্নযোগে হয়েছিল এবং তিনি স্বপ্নে এ পরিভ্রমণ সম্পন্ন করেছিলেন।

শেষোক্ত দৃষ্টিভঙ্গিটি সত্য থেকে এতটা দূরে যে,এটি একটি মত হিসাবে উল্লেখের যোগ্যতা রাখে না। কারণ নবীর মিরাজ দৈহিক ছিল বলেই কুরাইশগণ এ দীর্ঘ পথ এক রাত্রিতে পাড়ি দেয়া সম্ভব নয় ভেবেই নবীর দাবিতে ক্ষুব্ধ হয়েছিল ও তাঁকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করেছিল। মিরাজের বিষয়টি দৈহিক হওয়ার কারণেই কুরাইশদের সভাসমূহে মুখে মুখে তা ঘুরছিল। যদি মিরাজ স্বপ্নযোগে হতো তাহলে কুরাইশরা তা মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে সচেষ্ট হতো না। যদি রাসূল (সা.) বলতেন যে,তিনি ঘুমের মধ্যে এমন স্বপ্ন দেখেছেন তাহলে তা বিতর্কের বিষয় হতো না। কারণ স্বপ্নে অনেক অসম্ভব বিষয়ও সম্ভব হয়ে থাকে এবং এতে বিতর্কের কিছু নেই। এরূপ ক্ষেত্রে বিষয়টিরও তেমন মূল্য থাকে না। তদুপরি আফসোসের বিষয় হলো কোন কোন মুসলিম মনীষী,যেমন মিশরীয় লেখক ফরিদ ওয়াজদী ও অন্যান্যরা এ মতকে গ্রহণ করে তা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভিত্তিহীন সকল যুক্তি উপস্থাপন করেছেন।৩৪৭

আত্মিক মিরাজ কী?

যে সকল ব্যক্তি দৈহিক মিরাজ সংঘটিত হওয়ার প্রতিবন্ধকতাসমূহের জবাব দানে ব্যর্থ হয়েছেন তাঁরা মিরাজ সম্পর্কিত আয়াত ও রেওয়ায়েতসমূহকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে মিরাজ আত্মিকভাবে হয়েছিল বলে প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়েছেন।

আত্মিক মিরাজের অর্থ হলো আল্লাহর সৃষ্টিতে গভীর চিন্তা,তাঁর সৌন্দর্য ও শক্তিমত্তার স্মরণে মগ্ন হওয়ার মাধ্যমে দুনিয়া ও বস্তুসংশ্লিষ্টতা থেকে মুক্ত হয়ে আত্মিকভাবে বিভিন্ন স্তর অতিক্রমের পর স্রষ্টার বিশেষ নৈকট্য লাভ-যা বর্ণনাতীত।

আত্মিক মিরাজের কথা বললেই আল্লাহর মহত্ত্ব ও তাঁর সৃষ্টিজগতের বিশালতার বিষয়ে চিন্তার মাধ্যমে উপরিউক্ত পর্যায়ে পৌঁছানো বুঝালে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে,এ মর্যাদা শুধু রাসূল (সা.)-এর জন্য নির্দিষ্ট নয়,বরং অধিকাংশ নবী এবং পবিত্র হৃদয়ের অধিকারী আল্লাহর অনেক ওলীই তা অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু আমরা জানি মিরাজকে আল্লাহ্পাক রাসূলের একটি বিশেষত্ব বলে উল্লেখ করেছেন যা অন্যদের জন্য প্রযোজ্য নয়। তা ছাড়া পূর্বোক্ত আত্মিক নৈকট্যের বিষয়টি নবী (সা.)-এর জন্য প্রতি রাত্রেই অর্জিত হতো৩৪৮ ,অথচ মিরাজের ঘটনাটি একটি বিশেষ রাত্রির সঙ্গে সম্পর্কিত।

যে বিষয়টি এ ব্যক্তিবর্গকে এরূপ চিন্তায় মগ্ন করেছে তা হলো গ্রীক জ্যোতির্বিদ টলেমীর তত্ত্ব যা দু হাজার বছরের অধিক সময় ধরে প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে প্রতিষ্ঠিত ও বহুল প্রচারিত ছিল এবং এ বিষয়ে অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। তাঁর মতে বিশ্ব দু ভাগে বিভক্ত : পার্থিব ও ঊর্ধ্বজগৎ। পার্থিবজগৎ চারটি উপাদানে গঠিত : পানি,মাটি,বায়ু ও অগ্নি। প্রথম যে উপাদানের সমাহার আমাদের চোখে পড়ে তা হলো স্থলভাগ এবং এটি বিশ্বের কেন্দ্র। এর পরবর্তী স্তরে রয়েছে জলভাগ যা স্থলভাগকে ঘিরে রেখেছে এবং তৃতীয় স্তরে জলভাগকে ঘিরে রেখেছে বায়ুর স্তর। পার্থিব জগতের শেষ ও চতুর্থ স্তরে রয়েছে অগ্নির স্তর যা বায়ুজগতকে আবৃত করে রেখেছে। বায়ুজগৎ পার্থিবজগতের সর্বশেষ স্তর। এরপর থেকে ঊর্ধ্বজগতের শুরু। ঊর্ধ্বজগৎ নয়টি স্তরের সমন্বয়ে গঠিত এবং এ স্তরসমূহ পিঁয়াজের ন্যায় পরস্পর অবিচ্ছিন্নভাবে সংযুক্ত। কোন বস্তুই এ স্তরসমূহ বিদীর্ণ করতে সক্ষম নয়। কারণ এতে সমগ্র ঊর্ধ্বজগতের উপাদানসমূহ বিক্ষিপ্ত ও ধ্বংস হয়ে যাবে।

মিরাজ যদি দৈহিক হয়ে থাকে তাহলে এর অর্থ নবী (সা.) বিশ্বের কেন্দ্র থেকে সরাসরি ঊর্ধ্ব দিকে পার্থিবজগতের চারটি স্তর অতিক্রম করে ঊর্ধ্বজগতে পৌঁছেছেন এবং ঊর্ধ্বজগতের স্তরসমূহ একের পর এক ছিন্ন করে গন্তব্যে পৌঁছেছেন। কিন্তু টলেমীর তত্ত্ব অনুসারে তা সম্ভব নয়। কারণ তাহলে সমগ্র ঊর্ধ্বজগতই ধ্বংস হয়ে যেত। এর ভিত্তিতেই তাঁরা মহানবী (সা.)-এর দৈহিক মিরাজকে অস্বীকার করে তা আত্মিক ছিল বলে ধরে নিয়েছেন।

উত্তর

উপরিউক্ত মতটি গ্রহণযোগ্য হতো যদি টলেমীর তত্ত্বটি আজও বিজ্ঞানশাস্ত্রে গ্রহণীয় একটি মতবাদ বলে পরিগণিত হতো। সে ক্ষেত্রে তাঁরা তাঁদের এ ভ্রান্ত মতের ওপর নির্ভর করে কোরআনের এ মহাসত্যের বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করে ভিন্ন ব্যাখ্যার কথা ভাবতে পারতেন। কিন্তু বর্তমানে এ তত্ত্বটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের গ্রন্থে তা একটি তত্ত্ব হিসাবে শুধু লিপিবদ্ধই রয়েছে। বিশেষত বর্তমানে উদ্ভাবিত শক্তিশালী টেলিস্কোপ যন্ত্রসমূহ যখন সূক্ষ্মভাবে গ্রহ-নক্ষত্রসমূহকে পর্যবেক্ষণ করছে,অ্যাপোলো ও লুনার মতো মহাশূন্যযানসমূহ চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করেছে,মঙ্গল,শনি প্রভৃতি গ্রহের তথ্য জানার জন্য ভয়েজারের মতো মহাশূন্যযান সৌরজগতে ঘুরে ফিরছে তখন এরূপ ভ্রান্ত তত্ত্বের পেছনে ছোটা অযৌক্তিক। তাই বর্তমানে টলেমীর কল্পনাপ্রসূত তত্ত্বের কোন মূল্য নেই।

সুরহীন সংগীত

শেখ আহমদ এহসায়ী ( শাইখীয়া ৩৪৯ নামে প্রসিদ্ধ বাতিল ফের্কার নেতা) তাঁর কাতিফিয়া’ নামক গ্রন্থে মিরাজের ভিন্ন এক ব্যাখ্যা উপস্থাপনের মাধ্যমে দৈহিক ও আত্মিক মিরাজে বিশ্বাসী ভিন্ন দু দলকেই সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন,মহানবী (সা.) বারযাখীরূপে (অর্থাৎ ঘুমন্ত ব্যক্তি যেমন স্বপ্নে সকল কাজ করে থাকে সেরূপে) মিরাজ সম্পন্ন করেছেন। এতে তিনি মনে করেছেন যে,দৈহিক মিরাজের পক্ষাবলম্বনকারীদের যেমন সন্তুষ্ট করতে পেরেছেন (যেহেতু মিরাজে নবীর দৈহিক উপস্থিতিও প্রমাণিত হয়েছে) তেমনি ঊর্ধ্বজগতে প্রবেশের অসুবিধাসমূহও দূরীভূত করতে সক্ষম হয়েছেন। কারণ বারযাখী দেহের ঊর্ধ্বজগৎ অতিক্রমের ফলে তা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।৩৫০

কুসংস্কারমুক্ত ও সত্যান্বেষী ব্যক্তিগণ নিঃসন্দেহে স্বীকার করবেন এ মতটিও পূর্বোক্ত মতের ন্যায় (আত্মিকভাবে মিরাজ সংঘটিত হওয়া) ভিত্তিহীন ও কোরাআন-হাদীসের পরিপন্থী। কারণ মিরাজ সম্পর্কিত কোরআনের আয়াতটি যে কোন আরবী ভাষাবিদকে দিলে তিনি বলবেন,যেহেতু আয়াতটিতেعبد শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে তা মানুষের দেহে বিদ্যমান সকল উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত সত্তাকে বুঝায়। কখনই তা হোরকুলায়ী’ দেহ নয়। কারণ এমন নামের সত্তার সঙ্গে আরবরা পরিচিত ছিল না,অথচ তাদের বুঝানোর উদ্দেশ্যেই সূরা বনি ইসরাইলেعبد (আবদ) শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।

যে বিষয়টি মতের প্রবক্তাকে এরূপ ধারণা পোষণে বাধ্য করেছে তা বিশ্বজগৎ সম্পর্কে প্রাচীন গ্রীক কল্পনাপ্রসূত উপসিদ্ধান্ত ( Hypothesis) ব্যতীত অন্য কিছু নয়। বর্তমানে বিশ্বের সকল জ্যোতির্বিদই মতকে অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন। তাই এমতাবস্থায় মতের অন্ধ অনুসরণ আমাদের জন্য কাঙ্ক্ষিত নয়। পূর্বে যদিও কেউ অজ্ঞতাবশত এ মতকে সমর্থন করে থাকেন বর্তমানে তা করা বুদ্ধিবৃত্তিক হবে না। কোনক্রমেই এমন উপসিদ্ধান্ত-যা বিজ্ঞানও অযৌক্তিক মনে করে তার ভিত্তিতে কোরআনের আয়াতকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা বৈধ নয়।

মিরাজ ও বর্তমানের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বসমূহ

কেউ কেউ মনে করেছেন,বর্তমানের বিজ্ঞান ও এর তত্ত্বসমূহ রাসূল (সা.)-এর মিরাজের সঙ্গে সংগতিশীল নয়। কারণ :

১. বর্তমানের বিজ্ঞান বলে, ভূপৃষ্ঠ থেকে কোন বস্তুকে ঊর্ধ্বে যেতে হলে পৃথিবীর অভিকর্ষ বলকে অতিক্রম করতে হয়। যদি কোন বলকে ঊর্ধ্বে ছোড়া হয় তাহলে অভিকর্ষ বলের কারণে তা ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসে। বলকে যত জোরেই নিক্ষেপ করা হোক না কেন এরূপ হয়ে থাকে। যদি বল তার গতিকে ঊর্ধ্বদিকে অব্যাহত রাখতে চায় তবে তাকে অভিকর্ষ বল অতিক্রম করতে হবে এবং এ লক্ষ্যে বলকে ২৫০০০ মাইল/ঘণ্টা গতিতে ছুঁড়তে হবে।

তাই মহানবী (সা.)-কে মিরাজে ঐ গতিতে যাত্রা করতে হয়েছে ফলে তাঁর দেহে ভরশূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। দ্বিতীয়ত এখানে প্রশ্ন আসে যে,তিনি কিরূপে কোন উপযোগী বাহন ব্যতিরেকে এ গতিতে যাত্রায় সক্ষম হলেন?

২. ভূমি হতে কয়েক কিলোমিটার ওপর হতে শ্বাস গ্রহণের উপযোগী বায়ু নেই। অর্থাৎ এর ঊর্ধ্বে যত ওপরে ওঠা হবে বায়ু ততই সূক্ষ্ম ও পাতলা হয়ে যাবে। ফলে শ্বাস-প্রশ্বাস কার্য সম্পাদন সম্ভব নয়। আরো ঊর্ধ্বে একেবারেই বায়ুর অস্তিত্ব নেই। তাই নবীর ঊর্ধ্বাকাশ ভ্রমণ অক্সিজেনের অভাবজনিত সমস্যার কারণে সম্ভব নয়।

৩. আকাশের সকল উল্কা ও ক্ষতিকর রশ্মি পৃথিবীতে পৌঁছলে সকল কিছু ধ্বংস করে ফেলত। কিন্তু সেগুলো হয় ঊর্ধ্ব বায়ুমণ্ডলে গোলাকার রূপ ধারণ করে ধরিত্রীর চারিদিকে ঘূর্ণায়মান থাকে নতুবা একটি স্তরে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এ স্তরটি ধরিত্রীর রক্ষক আবরণরূপে কাজ করে। রাসূল (সা.) এ স্তর ভেদ করে উল্কাপিণ্ড ও ক্ষতিকর রশ্মিসমূহ থেকে কিভাবে নিজেকে সংরক্ষণে সক্ষম হয়েছেন?

৪. বায়ুচাপ মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মানুষ নির্দিষ্ট বায়ুচাপে জীবন ধারণে সক্ষম যা ঊর্ধ্বলোকে অনুপস্থিত।

৫. মহানবী (সা.)-এর ঊর্ধ্ব যাত্রার গতি নিঃসন্দেহে আলোর গতি অপেক্ষা বেশি ছিল। বর্তমানে প্রমাণিত হয়েছে কোন বস্তুই আলোর গতি৩৫১ অপেক্ষা অধিক গতিসম্পন্ন হতে পারে না। তাই আলোর গতি থেকেও দ্রূতগতিতে যাত্রা করে নবী (সা.) কিরূপে জীবিত থাকতে পারেন?

আমাদের উত্তর

যদি আমরা প্রাকৃতিক নিয়মকে সমস্যা বলে ধরি তবে এরূপ সমস্যার কোন সীমা নেই। আমরা এ প্রাকৃতিক নিয়মের বাধা দ্বারা কি বুঝাতে চাচ্ছি? আমরা কি এ প্রাকৃতিক নিয়মকে অতিক্রমের বিষয়টিকে অসম্ভব বলে বিবেচনা করব এবং বলব যে,এ নিয়মসমূহের লঙ্ঘন সত্তাগতভাবে অসম্ভব। অবশ্যই না। কারণ বর্তমানের নভোবিজ্ঞানীরা এ বিষয়টিকে সম্ভব বলে প্রমাণে সক্ষম হয়েছেন। ১৯৫৭ সালে মহাশূন্যযান স্পুটনিক নিক্ষেপের মাধ্যমে অভিকর্ষ বলকে যে অতিক্রম করা সম্ভব তা প্রমাণিত হয়েছে। কৃত্রিম উপগ্রহ ও নভোযানে চড়ে মহাশূন্য পাড়ি দিয়ে মানুষ প্রমাণ করেছে মহাশূন্য পরিভ্রমণের প্রতিবন্ধকতাসমূহ বিজ্ঞানের কল্যাণে দূর করা সম্ভব। মানুষ তার জ্ঞানের দ্বারা অক্সিজেনের শূন্যতা,ক্ষতিকর রশ্মি,বায়ুচাপ ও অন্যান্য সমস্যা দূরীভূত করতে সক্ষম। বর্তমানে নভোবিজ্ঞানের বিস্তৃতির ফলে বিজ্ঞানীরা আশা করছেন খুব শীঘ্রই তাঁরা সৌরজগতের অন্য গ্রহেও অবতরণ ও ভ্রমণ করতে পারবেন।৩৫২

বিজ্ঞানের এ অভিযাত্রা প্রমাণ করেছে ঊর্ধ্ব যাত্রার বিষয়টি অসম্ভাব্যের পর্যায়ে পড়ে না। তবে যদি নবীর মিরাজ এরূপ বৈজ্ঞানিক উপকরণের অনুপস্থিতিতে কিরূপে সম্ভব হয়েছিল সে প্রশ্ন করা হয়,তাহলে উত্তরে আমরা বলব পূর্বে নবিগণের মুজিযা বিষয়ে,বিশেষত আবাবীল পাখির দ্বারা আবরাহার হস্তীবাহিনী ধ্বংসের আলোচনায় ঐশী সাহায্যে অলৌকিক ঘটনা সংঘটনের যে বিবরণ আমরা দিয়েছি তা হতে বিষয়টি স্পষ্ট হবে বলে আশা করি। যে কাজগুলো মানুষ তার জ্ঞান দ্বারা উদ্ভাবিত বৈজ্ঞানিক সরঞ্জামাদি দ্বারা সম্পাদন করে,নবিগণ তাঁদের প্রতিপালকের বিশেষ অনুগ্রহে বাহ্যিক উপকরণের সহযোগিতা ছাড়াই তা সম্পাদনে সক্ষম।

নবী (সা.) তাঁর প্রতিপালকের বিশেষ অনুগ্রহে মিরাজ সম্পন্ন করেছেন। মহান আল্লাহ্ সমগ্র অস্তিত্বজগতের অধিপতি এবং এ বিশ্বজগতের শৃঙ্খলা বিধানকারী। তিনিই এ পৃথিবীকে অভিকর্ষ বল দ্বারা সৃষ্টি করেছেন,বায়ুমণ্ডলের স্তরসমূহের বিন্যাস করেছেন এবং মহাশূন্যে বিভিন্ন রশ্মির বিকিরণ ঘটিয়েছেন। তাই তিনি যখন চান তখনই এগুলোর ক্রিয়াশক্তির বিলোপ সাধনে সক্ষম।

যখন মহানবী (সা.)-এর এ ঐতিহাসিক সফর স্রষ্টার বিশেষ অনুগ্রহের অধীনে সম্পন্ন হবে তখন তাঁর অসীম ক্ষমতার নিকট প্রাকৃতিক সকল নিয়ম আত্মসমর্পণ করবে এটিই স্বাভাবিক। কারণ এ সবই তাঁর ক্ষমতার অধীন। তাই তিনি তাঁর মনোনীত রাসূলকে পৃথিবী থেকে ঊর্ধ্বে নেয়ার উদ্দেশ্যে যদি পৃথিবীর অভিকর্ষ বলকে রহিত ও তাঁকে নিরাপদ রাখার লক্ষ্যে ক্ষতিকর উপাদানসমূহের ক্ষমতার অবলুপ্তি ঘটান তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। যে আল্লাহ্ অক্সিজেনের স্রষ্টা তিনি অক্সিজেনশূন্য স্তরে তাঁর প্রেরিত ব্যক্তির জন্য অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে কি সক্ষম নন? আল্লাহ্ কারণের উদ্গাতা ও বিলোপ সাধনকারী’ কথাটির অর্থ এটিই।

প্রকৃতপক্ষে মিরাজের বিষয়টি প্রাকৃতিক নিয়ম ও মানুষের ক্ষমতার বহির্ভূত একটি বিষয়। আল্লাহর ক্ষমতাকে আমাদের যোগ্যতা ও ক্ষমতার মানদণ্ডে বিচার করা কখনই উচিত হবে না। যদি আমরা কোন মাধ্যম ছাড়া কাজ করতে অক্ষম হই তাহলে এটি মনে করা ভুল হবে যে,অসীম ক্ষমতাবান স্রষ্টাও প্রাকৃতিক মাধ্যমের সাহায্য ব্যতীত তা করতে অক্ষম হবেন।

মৃতকে জীবিত করা,লাঠিকে সাপে পরিণত করা,গভীর সমুদ্রের নিচে মাছের পেটে হযরত ইউনুস (আ.)-কে জীবিত রাখা প্রভৃতি বিষয়ের সত্যতা বিভিন্ন ঐশীগ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে এবং এগুলোর বাস্তবতাকে স্বীকার মিরাজের বাস্তবতাকে স্বীকার হতে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে কম কঠিন নয়।

মোটকথা,সকল প্রাকৃতিক নিয়ম (কারণসমূহ) এবং বাহ্যিক প্রতিবন্ধকতাসমূহ মহান আল্লাহর ইচ্ছাশক্তি ও ক্ষমতার অধীন। তাঁর ইচ্ছাশক্তি কেবল সত্তাগত অসম্ভব বিষয়ের ওপর (বিষয়টির সত্তাগত অসম্ভাব্যতার কারণে) কার্যকর নয়। কিন্তু সত্তাগতভাবে সম্ভাব্য সকল বিষয়ের ওপর তাঁর ইচ্ছাশক্তি পূর্ণরূপে কার্যকর। সে ক্ষেত্রে মানুষের দ্বারা সেটি সম্ভব কি সম্ভব নয় তা আদৌ বিবেচ্য নয়।

অবশ্য এ বিষয়টিকে তারাই গ্রহণ করতে পারবে যারা আল্লাহকে তাঁর গুণাবলী থেকে যথার্থভাবে চিনতে পেরেছে এবং তাঁকে অসীম ক্ষমতাবান এক অস্তিত্ব হিসাবে মেনে নিয়েছে।

অস্তিত্বজগতের বিভিন্ন পর্যায়ে পরিভ্রমণের উদ্দেশ্য

এক ব্যক্তি ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.)-কে প্রশ্ন করে, আল্লাহর জন্য কোন স্থান নির্দিষ্ট রয়েছে কি? তিনি বললেন, না।? সে বলল, তবে কোন্ উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর রাসূলকে ঊর্ধ্বজগতে ভ্রমণ করালেন? তিনি বললেন, আল্লাহ্ স্থান ও কালের ঊর্ধ্বে। আল্লাহ্ মিরাজের মাধ্যমে চেয়েছেন ঊর্ধ্বজগতে তাঁর নবীর উপস্থিতির মাধ্যমে ফেরেশতা ও আকাশমণ্ডলীর অধিবাসীদের সম্মানিত করতে এবং তাঁর নবীকে বিশ্বজগতের ব্যাপকতা এবং তাঁর আশ্চর্য সৃষ্টিসমূহ-যা কোন চক্ষু কোন দিন অবলোকন করে নি ও কর্ণও কোন দিন শুনে নি তা দেখাতে যেন তিনি ফিরে এসে বিশ্ববাসীদের সে সম্পর্কে অবহিত করেন। ৩৫৩

অবশ্যই সর্বশেষ নবীর জন্য এমন মর্যাদাকর স্থানই নির্দিষ্ট। তিনি যেন বিংশ শতাব্দীর যে সকল ব্যক্তি চন্দ্র ও মঙ্গল গ্রহের উদ্দেশে যাত্রা করছে তাদের লক্ষ্য করে বলছেন, আমি কোন মাধ্যম ছাড়াই এরূপ যাত্রা করেছি এবং আমার প্রভু আমাকে বিশ্বজগতের পরিচালনা ব্যবস্থা ও শৃঙ্খলা অবলোকন করিয়েছেন।”

তেইশতম অধ্যায় : তায়েফ যাত্রা

অপচয়-অপব্যয় নিষিদ্ধ

কোরআন মজীদের উপরোক্ত আয়াতে এবং এ ধরনের আরো যে সব আয়াতে মানুষকে দানে উৎসাহিত ও কার্পণ্যে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে , তার পাশাপাশি এমন অনেক আয়াতের উল্লেখ করা যেতে পারে যাতে অপচয় ও অপব্যয়ে নিষেধ করা হয়েছে এবং এর ক্ষতিকারকতা সম্বন্ধে মানুষকে জানানো হয়েছে। যেমন , এরশাদ হয়েছে :

) ولا تسرفوا انه لا يحب المسرفي( .

আর তোমরা অপচয় করো না ; নিঃসন্দেহে তিনি (আল্লাহ্) অপচয়কারীদের ভালোবাসেন না। (সূরাহ্ আল্-আন্ আাম্ : 141)

) ان المبذرين کانوا اخوان الشياطين( .

নিঃসন্দেহে অপচয়কারীরা শয়তানদের ভাই। (সূরাহ্ বানী ইসরাাঈল্ : 27)

ধৈর্যধারণে উৎসাহ প্রদান

কোরআন মজীদ বিপদাপদের মুখে ধৈর্য-সহ্য ও দৃঢ়তার নির্দেশ প্রদান করেছে , ধৈর্যশীল ও অটল লোকদের প্রশংসা করেছে এবং তাদের জন্য বিরাট পুরষ্কারের সুসংবাদ দিয়েছে। যেমন , এরশাদ হয়েছে :

) انما يوفی الصابرون اجراهم بغير حساب( .

অবশ্যই ধৈর্যশীল লোকেরা তাদের প্রাপ্য সীমাহীন সুপ্রতিদান লাভ করবে। (সূরাহ্ আয্-যুমার : 10)

) و الله يحب الصابرين( .

আর আল্লাহ্ ধৈর্যশীলদেরকে ভালোবাসেন। (সূরাহ্ আালে ইমরাান্ : 146)

কিন্তু এখানে মনে রাখতে হবে যে , কোরআন মজীদ যালেমের মোকাবিলায় ময্লূমের হাত-পা বেঁধে রাখে নি এবং তাকে তার অধিকার আদায়েও নিষেধ করে নি। বরং যুলুমের মূলোৎপাটন ও ধরণীর বুকে সুবিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যালেম-অত্যাচারীর মোকাবিলায় রুখে দাঁড়ানো ও ন্যায়সঙ্গতভাবে যালেমের নিকট থেকে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য কোরআন মজীদ ময্লূমকে অনুমতি প্রদান করেছে। এ প্রসঙ্গে কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :

) فمن اعتدی عليکم فاعتدوا عليه بمثل ما اعتدی عليکم.(

অতএব , যে তোমাদের বিরুদ্ধে চড়াও হয়েছে তোমরাও তার বিরুদ্ধে চড়াও হও ঠিক যেভাবে সে তোমাদের বিরুদ্ধে চড়াও হয়েছে। (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : 194)

নরহত্যার শাস্তি

কেউ যদি স্বেচ্ছায়-সজ্ঞানে কাউকে হত্যা করে সে ক্ষেত্রে কোরআন মজীদের বিধানে ঘাতককে হত্যা করার জন্য নিহত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনদেরকে অধিকার দেয়া হয়েছে। কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :

) و من قتل مظلوماً فقد جعلنا لئليه سلطاناً فلا يسرف فی القتل( .

যে কেউ অন্যায়ভাবে নিহত হয়েছে আমি তার অভিভাবককে পরিপূর্ণ অধিকার প্রদান করেছি (প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য) , কিন্তু সে-ও যেন (ঘাতককে) হত্যার ব্যাপারে অপচয় না করে (বাড়াবাড়িমূলক কাজ না করে)। (সূরাহ্ বানী ইসরাাঈল্ : 33)

ইহ-পারলৌকিক বিধিবিধানের সমন্বয়

কোরআন মজীদ যেহেতু ভারসাম্য ও মধ্যম পন্থা ভিত্তিক আইন-কানূন্ ও শর ঈ বিধান প্রবর্তন করেছে , সেহেতু ইহজাগতিক সমাজব্যবস্থা ও সামাজিক বিধিবিধানে পরজাগতিক বিধিবিধানের সাথে সঙ্গতি বিধান করেছে এবং এ উভয় জগতের বিধিবিধানের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছে।

কোরআন মজীদ একদিকে যেমন মানুষের ইহজাগতিক বিষয়াদিকে সংশোধন ও পরিশুদ্ধ করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে , অন্যদিকে মানুষের পারলৌকিক সৌভাগ্যেরও নিশ্চয়তা বিধান করেছে। হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) এ সব মহান আইন-বিধান সম্বলিত কোরআন মজীদ নিয়ে এসেছেন যার উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বমানবতাকে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উভয় জগতের সৌভাগ্যে উপনীত করা।

কোরআন মজীদ বর্তমানে প্রচলিত তাওরাতের ন্যায় নয় যার আইন-বিধান সমূহ কেবল বস্তুগত জগতের সাথে সংশ্লিষ্ট - যাতে ইহজগতের প্রতি দৃষ্টি দেয়া হয়েছে , কিন্তু অপর জগতের প্রতি দৃষ্টি দেয়া হয় নি।

হ্যা , বর্তমানে প্রচলিত তাওরাত্ বস্তুজগতের মধ্যে এমনভাবে সীমাবদ্ধ যে , পরজগতের প্রতি সামান্যতম দৃষ্টিও প্রদান করে নি। এমনকি নেক কাজের পুরষ্কারকেও ইহজগতের মধ্যে সীমাবদ্ধ করেছে। বর্তমানে প্রচলিত তাওরাত্ বলেছে যে , নেক কাজের পুরস্কার হচ্ছে জাগতিক ধনসম্পদ বৃদ্ধি এবং ইহজগতে অন্যদের ওপর আধিপত্য। অন্যদিকে পাপের শাস্তিকেও ইহজগতের মধ্যে সীমাবদ্ধ রূপে দেখিয়েছে , বলেছে , পাপের শাস্তি হচ্ছে ধনসম্পদ ও ক্ষমতা-আধিপত্য হাতছাড়া হয়ে যাওয়া।

অন্যদিকে কোরআন মজীদ বর্তমানে প্রচলিত ইনজীলের অনুরূপও নয় - যার আইন-কানূন্ ও বিধিবিধান শুধু পরকালের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং ইহজাগতিক বিষয়াদি তথা সমাজব্যবস্থা ও জীবনবিধানের প্রতি যা উপেক্ষা প্রদর্শন করেছে।

বর্তমানে প্রচলিত তাওরাত্ ও ইনজীল্ উভয়ের বিপরীতে কোরআন মজীদের আইন-কানূন্ ও বিধিবিধান হচ্ছে সর্বাত্মক ও পূর্ণাঙ্গ - যাতে ইহকালীন বৈষয়িক জীবন ও সমাজব্যবস্থা যেমন শামিল রয়েছে , তেমনি পরকালীন জীবনের সাফল্য ও কল্যাণের নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে। কোরআন মজীদে মানুষের জীবনের বস্তুগত ও অবস্তুগত কোনো বিষয়ের প্রতিই উপেক্ষা প্রদর্শন করা হয় নি।

কোরআন মজীদ তার ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষার মাধ্যমে একদিকে যেমন মানুষকে পরকালীন জীবনের প্রতি মনোযোগী করে তুলেছে , অন্যদিকে তাকে পার্থিব জীবনের বিষয়াদির প্রতিও মনোযোগ দিতে বলেছে। যেমন , পরকালীন জীবনের প্রতি মানুষকে আগ্রহী করে তোলার জন্য কোরআন মজীদ এরশাদ করেছে :

) و من يطع الله و رسوله يدخله جنات تجری من تحتها الانهار خالدين فيها و ذالک الفوز العظيم.(

আর যে কেউ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে সে বেহেশতে প্রবেশ করবে - যার তলদেশ দিয়ে নহর প্রবাহিত হচ্ছে ; সেখানে সে চিরদিন থাকবে। আর এ হচ্ছে এক বিরাট সাফল্য। (সূরাহ্ আন্-নিসাা : 13)

) و من يعص الله و رسوله و يتعد حدوده يدخله ناراً خالداً فيها و له عذاب مهين(

আর যে কেউ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করবে ও তাঁর নির্ধারিত সীমারেখা লঙ্ঘন করবে সে দোযখে প্রবেশ করবে ও চিরদিন সেখানে থাকবে , আর তার জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি। (সূরাহ্ আন্-নিসাা : 14)

) فمن يعمل مثقال ذرة خيراً يره( .

অতএব , যে কেউ অণুমাত্রও সৎকর্ম করবে (পরকালে) সে তা দেখতে পাবে। (সূরাহ্ আয্-যিলযালাহ্ : 7)

) و من يعمل مثقال ذرة شراً يره(

আর যে কেউ অণুমাত্রও পাপকর্ম করবে (পরকালে) সে তা দেখতে পাবে। (সূরাহ্ আয্-যিলযালাহ্ : 8)

) و ابتغ فيما اتاک الله الدار الآخرة و لا تنس نصيبک من الدنيا(

(হে রাসূল!) আল্লাহ্ আপনাকে যে পরকালের গৃহ প্রদান করেছেন তাকে আঁকড়ে ধরুন (এবং তা ঠিক রাখার জন্য যথাযথ কাজ করুন) , আর পার্থিব জগতে আপনার অংশকেও ভুলে যাবেন না। (সূরাহ্ আল্-ক্বাছ্বাছ্ব্ : 77)

কোরআন মজীদের বহু আয়াতেই জ্ঞানার্জন ও তাক্ব্ওয়া-পরহেযগারীর জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে , একই সাথে পার্থিব জীবনের স্বাদ-আনন্দ ও আল্লাহর দেয়া নে আমত সমূহের সঠিক ব্যবহারকে বৈধ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কোরআন মজীদ এরশাদ করেছে :

) قل من حرم زينة الله التی اخرج لعباده و الطيبات من الرزق(

(হে রাসূল!) বলুন , আল্লাহ্ তাঁর বান্দাহদের জন্য যে সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছেন এবং যে সব পবিত্র রিয্ক্ব্ প্রদান করেছেন কে তা হারাম করেছে ? (সূরাহ্ আল্-আ রাাফ্ : 32)

পারস্পরিক সম্পর্ক

কোরআন মজীদ মানুষকে আল্লাহ্ তা আলার ইবাদত ও আনুগত্য করা , সৃষ্টিলোকের নিদর্শনাদি ও শর ঈ বিধিবিধান নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা এবং সৃষ্টিলোকের অস্তিত্ব , মানুষের রহস্য ও তার সত্তায় নিহিত বিভিন্ন সত্য সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করার জন্য বার বার আহবান জানিয়েছে। কিন্তু কোরআন মজীদ শুধু মানুষকে আল্লাহ্ তা আলার সান্নিধ্যে পৌঁছে দিয়ে তথা বান্দাহ্ ও স্রষ্টার মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টি করে দিয়েই নিজের দায়িত্ব শেষ করে নি , বরং মানবজীবনের অপর দিকটি অর্থাৎ মানুষের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কের প্রতিও দৃষ্টি প্রদান করেছে , বিশেষ করে মানুষের মধ্যে মায়া-মহব্বত ও আন্তরিক সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছে।

কোরআন মজীদ বেচাকিনা ও ব্যবসা-বাণিজ্যকে বৈধ ঘোষণা করেছে এবং রেবা ও নির্বিচার সম্পদ বৃদ্ধি করার প্রবণতাকে হারাম করেছে। যেমন , এরশাদ হয়েছে :

) و احل الله البيع و حرم الربا( .

আর আল্লাহ্ ব্যবসায়কে হালাল করেছেন এবং রেবাকে হারাম করেছেন। (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : 275)

[আভিধানিক অর্থে রেবা মানে বৃদ্ধি। কিন্তু পারিভাষিক অর্থে অবাণিজ্যিক প্রয়োজনে গৃহীত ঋণের ওপর আসলের চেয়ে অতিরিক্ত গ্রহণই হচ্ছে রেবা। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ধানের ওপর টাকা লাগানো র যে রেওয়াজ আছে যাতে ধান ওঠার আগে ব্যক্তিকে একটি নির্দিষ্ট দরে ধানের অগ্রিম মূল্য দেয়া হয় যার দর ঐ সময়কার ও ধান ওঠার সময়কার বাজার দরের চেয়ে কম। ইসলামের দৃষ্টিতে এ ধরনের লেনদেন বেচাকিনা হিসেবে ছ্বহীহ্ নয়। ফলে এর মাধ্যমে ঋণদাতা যে মুনাফা করে তা রেবা। অন্যদিকে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক , আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কিস্তিতে বাজার-মূল্যের চেয়ে বেশী মূল্যে গার্হস্থ্য সামগ্রী সরবরাহ করে যে অতিরিক্ত মুনাফা করে তা-ও রেবা। কোনো দোকানদার নগদ বেচাকিনার ক্ষেত্রে একই পণ্য বিভিন্ন মূল্যে বিক্রি করলে বাকী বিক্রির ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম মূল্যে বিক্রি না করলে হাদীছ অনুযায়ী এর অতিরিক্ত মুনাফা হবে রেবা।]

কোরআন মজীদ মানুষের প্রতি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা এবং তা ভঙ্গ না করার জন্য আদেশ দিয়েছে। যেমন , এরশাদ করেছে :

) يا ايها الذين آمنوا اوفوا بالعقود(

হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের প্রতিশ্রুতিসমূহ রক্ষা করো। (সূরাহ্ আল্-মাাএদাহ্ : 1)

অবশ্য এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে , কোনো যুলুম , অন্যায় বা পাপাচারের কাজের প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকার করলে বা ভালো কাজ না করার অঙ্গীকার করলে তা ভঙ্গ করা ও শর ঈ বিধান অনুযায়ী অঙ্গীকার ভঙ্গের কাফ্ফারাহ্ দেয়া ফরয ; এরূপ ক্ষেত্রে অঙ্গীকার রক্ষা করা কঠিন গুনাহ্। তেমনি কোনো মোবাহ্ কাজে (যেমন : তালাক্ব্ প্রদানের) অঙ্গীকার করার পর তা ভঙ্গ করার মধ্যে কল্যাণ মনে করলে তা ভঙ্গ করে কাফ্ফারাহ্ প্রদান জায়েয আছে।

বিবাহে উৎসাহ প্রদান

যেহেতু মানব প্রজাতির অস্তিত্ব ও ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য নারী ও পুরুষের মাঝে বৈবাহিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হওয়া অপরিহার্য , সেহেতু কোরআন মজীদ এ স্বভাবসম্মত কাজটি সম্পাদন অর্থাৎ বিবাহ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। এরশাদ হয়েছে :

) و انکحوا الايامی منکم و الصالحين من عبادکم و امائکم. ان يکونوا فقراء يغنهم الله من فضله و الله واسع عليم(

আর তোমরা তোমাদের মধ্যকার স্বামী বা স্ত্রী বিহীন নারী ও পুরুষদেরকে এবং তোমাদের বিবাহযোগ্য দাস-দাসীদেরকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে দাও। আর এরা যদি দরিদ্র ও নিঃসম্বল হয়ে থাকে তো আল্লাহ্ তাঁর অনুগ্রহ দ্বারা তাদেরকে সচ্ছলতা দান করবেন। আর আল্লাহ্ সীমাহীন উদারতার অধিকারী ও সর্ববিষয়ে সদা ওয়াকেফহাল। (সূরাহ্ আন্-নূর্ : 32)

) فانکحوا ما طاب لکم من النساء مثنی و ثلاث و رباع فان خفتم ان لا تعدلوا فواحدة( .

তোমাদের জন্য যারা উত্তম এমন নারীদের মধ্য থেকে বিবাহ করো দু জন , তিন জন বা চারজনকে , কিন্তু তোমরা যদি ভয় করো যে , তাদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারবে না তাহলে মাত্র একজনকে বিবাহ করো। (সূরাহ্ আন্-নিসাা : 3)

সদাচরণ ও কল্যাণকর কাজ

কোরআন মজীদ স্ত্রীর সাথে সদাচরণ করতে ও তার সমস্ত স্বাভাবিক প্রয়োজন পূরণের জন্য স্বামীর প্রতি নির্দেশ দিয়েছে। তেমনি কোরআন মজীদ সমস্ত মুসলমানের সাথে , বিশেষ করে পিতা-মাতা , আত্মীয়-স্বজন ও ঘনিষ্ঠ জনদের সাথে সদাচরণের জন্য আদেশ দিয়েছে। বরং কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে সদাচরণ হচ্ছে মানবজীবনের জন্য অপরিহার্য ব্যাপক ভিত্তিক ও সর্বজনীন কর্মসূচী। তাই শুধু মুসলমানদের সাথেই নয় , বরং মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে মানব প্রজাতির প্রতিটি সদস্যের সাথেই সদাচরণ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :

) و عاشروهن بالمعروف(

আর তোমরা তাদের (তোমাদের স্ত্রীদের) সাথে সদাচরণ করো। (সূরাহ্ আন্-নিসাা : 19)

) و لهن مثل الذی عليهن بالمعروف(

আর তাদের ওপরে যেভাবে (তোমাদের অধিকার) রয়েছে ঠিক সেভাবেই (তোমাদের ওপর) রয়েছে তাদের জন্য ন্যায়সঙ্গত অধিকার। (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : 228)

) و اعبدوا الله و لا تشرک به شيئاً و بالوالدين احساناً و بذی القربی و اليتامی و المساکين و الجاری ذی القربی و الجاری ذی الجنب و الصاحب بالجنب و ابن السبيل و ما ملکت ايمانکم ان الله لا يحب من کان مختالاً فخوراً(

তোমরা আল্লাহর বন্দেগী ও দাসত্ব করো এবং তাঁর সাথে কোনো কিছুকে শরীক করো না। আর পিতামাতার সাথে সদাচরণ করো এবং সদাচরণ করো আত্মীয়-স্বজন , ইয়াতীম , মিসকীন্ , নিকট প্রতিবেশী , দূর প্রতিবেশী , বন্ধু-বান্ধব , পথিক এবং তোমাদের দাস-দাসী (ও অধীনস্থ)দের সাথে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ উদ্ধত-অহঙ্কারী লোকদেরকে পসন্দ করেন না। (সূরাহ্ আন্-নিসাা : 36)

) و احسن کما احسن الله اليک و لا تبغ الفساد فی الارض ان الله لا يحب المفسدين(

আর (অন্যদের প্রতি) কল্যাণকামী ও দয়ার্দ্র হও ঠিক যেভাবে আল্লাহ্ তোমার প্রতি দয়া করেছেন। আর ধরণীর বুকে বিপর্যয় সৃষ্টি , দুষ্কৃতি ও পাপাচার করো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ বিপর্যয়সৃষ্টিকারী ও দুর্বৃত্ত-পাপাচারীদেরকে পসন্দ করেন না। (সূরাহ্ আল্-ক্বাছ্বাছ্ব্ : 77)

) ان رحمة الله قريب من المحسنين(

অবশ্যই আল্লাহর রহমত্ সৎকর্মশীল ও কল্যাণকারীদের অত্যন্ত কাছাকাছি অবস্থান করছে। (সূরাহ্ আল্-আ রাাফ্ : 56)

) و احسنوا ان الله يحب المحسنين(

আর তোমরা (অন্যদের) কল্যাণ সাধন করো ; নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ কল্যাণকারীদের পসন্দ করেন। (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : 195)

এ হচ্ছে কোরআন মজীদের ভারসাম্যপূর্ণ ও মধ্যম পন্থা অবলম্বনের শিক্ষাসমূহের কিছু দৃষ্টান্ত মাত্র।

ভালো কাজে আদেশ দান ও মন্দ কাজ প্রতিরোধ

কোরআন মজীদ মুসলিম উম্মাহর সমস্ত সদস্যের ওপর ভালো কাজের আদেশ দান ও মন্দ কাজের প্রতিরোধকে অপরিহার্য কর্তব্য রূপে নির্ধারণ করে দিয়েছে এবং এ দায়িত্বকে কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠী বা মুষ্টিমেয় সংখ্যক লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেয় নি। কোরআন মজীদ তার এ মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে ব্যাপক আইন-বিধান প্রণয়ন করেছে , বরং এর মাধ্যমেই স্বীয় শিক্ষাকে প্রাণময় ও চিরস্থায়ী করেছে।

ইসলাম সমাজের প্রতিটি ব্যক্তিকে এবং প্রতিটি পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে পরস্পরের জন্য পর্যবেক্ষক ও পথনির্দেশকের দায়িত্ব প্রদান করেছে এবং প্রতিটি ব্যক্তিকেই অন্যদের ওপর দায়িত্বশীল করেছে। প্রকৃত পক্ষে ইসলাম প্রতিটি মুসলিম ব্যক্তির ওপর একেক জন পুলিশের দায়িত্ব প্রদান করেছে যে অন্যদেরকে নেক কাজ , কল্যাণ ও চিরন্তন সৌভাগ্যের দিকে পথনির্দেশ প্রদান করবে এবং যুলুম-শোষণ , নির্যাতন , লুণ্ঠন , পাপ ও দুষ্কৃতি থেকে তাদেরকে ফিরিয়ে রাখবে। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে সমস্ত মুসলমানই ইসলামের প্রচার-প্রসার এবং ইসলামী আইন-বিধান বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বশীল।

এমতাবস্থায় , এর চেয়ে বৃহত্তর এবং এর চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী ও প্রভাবশালী কোনো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কথা কল্পনা করাও সম্ভব কি ?

বর্তমান যুগে যে কোনো দেশেই রাষ্ট্রীয় আইন-কানূন্ কার্যকরী করার জন্য বিরাট পরিচালকমণ্ডলী ও শান্তিশৃঙ্খলা বাহিনীর আশ্রয় নেয়া হয় , কিন্তু তা সত্ত্বেও আইনলঙ্ঘন প্রতিরোধ করা সম্ভবপর হয় না। কারণ , পরিচালনা ও শান্তিশৃঙ্খলা বাহিনী যতোই বিশাল এবং যতোই সুসজ্জিত হোক না কেন , তাদের পক্ষে জাতির প্রতিটি মানুষের সাথে প্রতিটি স্থানে ও প্রতিটি সময়ে অবস্থান করে তাদের সমস্ত কাজকর্মের ওপর দৃষ্টি রাখা সম্ভবপর নয়।

কিন্তু ইসলাম এক সমুন্নত মহান পরিকল্পনা ও কর্মসূচীর আশ্রয় নিয়ে এবং ভালো কাজের আদেশ দান ও মন্দ কাজ প্রতিরোধ কে প্রতিটি মুসলমানের জন্য বাধ্যতামূলক করে দিয়ে কার্যতঃ শক্তিশালী ও বিশালায়তন এক বাহিনী সৃষ্টি করেছে। আর অন্যান্য বাহিনী ও এ বাহিনীর মধ্যে রয়েছে এক বিরাট পার্থক্য। তা হচ্ছে , কোনোরূপ ব্যয়বাজেট ছাড়াই এ বাহিনী যথারীতি তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এবং সর্বত্র , সব সময় ও সব বিষয়ে দৃষ্টি রাখছে , আর সেই সাথে ইসলামের সমুন্নত আইন-বিধান বাস্তবায়নেরও নিশ্চয়তা বিধান করছে।

শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড জ্ঞান ও ন্যায়নিষ্ঠা

কোরআন মজীদ একের ওপর অন্যের প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্বের জন্য একমাত্র যে বিষয়টিকে মানদণ্ডরূপে গ্রহণ করেছে তা হচ্ছে জ্ঞান ও ন্যায়নিষ্ঠা - নীতিনিষ্ঠতা তথা খোদাভীরুতা। যেমন , কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :

) ان اکرمکم عند اببه اتقاکم(

অবশ্যই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সর্বাধিক সম্মানের পাত্র সেই ব্যক্তি যে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক ন্যায়নিষ্ঠ ও খোদাভীরু। (সূরাহ্ আল্-হুজুরাাত্ : 13)

) قل هل يستوی الذين يعلمون و الذين لا يعلمون( .

(হে রাসূল!) বলুন : , যারা জানে (জ্ঞানের অধিকারী) আর যারা জানে না (অজ্ঞ) তারা কি সমান হতে পারে ? (সূরাহ্ আয্-যুমার : 9)

সাম্য ও সমতা প্রতিষ্ঠা

কোরআন মজীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও গভীরতম আইন-বিধান ও শিক্ষাসমূহের অন্যতম হচ্ছে সাম্য ও সমতা। কোরআন মজীদ তার এ সাম্যের বিধানের আওতায় সমস্ত মুসলমানের মধ্যে ঐক্য , অভিন্নতা ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করেছে , সবাইকে এক কাতারে এনে দাঁড় করিয়েছে এবং যে কোনো ধরনের বিশেষ অগ্রাধিকার ও বর্ণগত ভেদাভেদের মূলোৎপাটন করেছে , তেমনি একের ওপর অন্যের প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্বের মূলোচ্ছেদ করেছে।

হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) এরশাদ করেন : জাহেলীয়াতের যুগে যারা ঘৃণ্য , নীচ ও পদদলিত ছিলো মহান আল্লাহ্ তা আলা ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় দান করে তাদেরকে সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী করেছেন এবং ইসলামের মাধ্যমে জাহেলী যুগের গর্ব-অহঙ্কার - বর্ণ , গোত্র আত্মীয়-স্বজন ও পূর্বপুরুষের গৌরব , আর সব রকমের বর্ণ ও শ্রেণীগত ভেদাভেদের মূলোৎপাটন করেছেন। সাদা-কালো , আরব-অনারব নির্বিশেষে সমস্ত মানুষই আদমের বংশধর , আর আল্লাহ্ আদমকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। বস্তুতঃ শেষ বিচারের দিনে আল্লাহর নিকট প্রিয়তম লোক হিসেবে তারাই গণ্য হবে যারা সর্বাধিক ন্যায়নিষ্ঠ - খোদাভীরু। (فروع کافی-٢، باب ٢١: ان المؤمن کفو المؤمنة .)

হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) আরো এরশাদ করেছেন : সাধারণ জনগণের ওপর জ্ঞানীদের মর্যাদার তুলনা হচ্ছে তোমাদের মধ্যকার মুষ্টিমেয় সংখ্যক (শ্রেষ্ঠতর) লোকদের ওপর আমার মর্যাদা। (الجامع الصغير با شرح مناوی ٤/٤٣٢ .)

ইসলাম ঈমানী পূর্ণতার কারণে হযরত সালমান ফার্সীকে অন্য মুসলমানদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেছে (যদিও তিনি ছিলেন অনারব) , এমনকি তাঁকে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর পরিবারের সদস্য হিসেবে পর্যন্ত ঘোষণা করেছে (بحار الانوار- ٤، باب ٧٦: فضائل سلمان .) , অন্যদিকে স্বয়ং হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর চাচা হওয়া সত্ত্বেও আবূ লাহাব্-কে তার কুফরী ও খোদাদ্রোহিতার কারণে জাহান্নামী হিসেবে ঘোষণা করেছে।

হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর জীবনচরিতও প্রমাণ করে যে , তিনি কখনোই এবং কোনো অবস্থায়ই স্বীয় বংশ-গোত্র বা বর্ণকে অন্যদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য প্রদান করেন নি। তেমনি ঐ যুগের মানুষ যে সব বিষয়কে গৌরবের কারণ রূপে গণ্য করতো এবং তৎকালে প্রচলিত গর্ব-অহঙ্কার , শ্রেষ্ঠত্ব , মর্যাদা ও বিশেষ সুবিধার আরো যে সব মানদণ্ড বিদ্যমান ছিলো সেগুলোর ভিত্তিতে তিনি কোনোদিনই গর্ব-অহঙ্কার করেন নি বা বিশেষ সুবিধা গ্রহণ করেন নি। বরং তিনি মানুষকে আল্লাহ্ তা আলার একত্ব , নবুওয়াত্ , পরকাল ও নেক আমলের দিকে আহবান করেছেন।

হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) লোকদেরকে চিন্তা ও কর্মের ঐক্য এবং এক খোদার ইবাদত্-বন্দেগী ও আনুগত্যের দিকে পথনির্দেশ দিয়েছেন ও পরিচালনা করেছেন। এ পন্থায় তিনি মানুষের অন্তঃকরণের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে , তাদের অন্তর থেকে অযৌক্তিক গর্ব-অহঙ্কারের মূলোৎপাটন করতে এবং তার পরিবর্তে তাদের হৃদয়ে প্রেম-ভালোবাসা , মায়া-মহব্বত , সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের অঙ্কুরোদ্গম ঘটাতে সক্ষম হন। এর ফলে দেখা গেছে , অনেক সম্পদশালী ও সম্ভ্রান্ত লোক , ইতিপূর্বে ছোটলোকরূপে পরিগণিত দরিদ্র পরিবারের ছেলেদের সাথে নিজেদের মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের সাথে আত্মীয়তার বন্ধন প্রতিষ্ঠা করেছেন।

কালোত্তীর্ণ পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান

সার্বিকভাবে আমরা বলতে পারি যে , কোরআন মজীদের ধর্মীয় বিধিবিধান ও পার্থিব আইন-কানূনে এবং ইসলামের নৈতিক শিক্ষায় ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের কল্যাণের প্রতি দৃষ্টি দেয়া হয়েছে। ইসলাম এমন আইন-বিধান ও সমাজব্যবস্থা প্রদান করেছে যা সকল যুগের সকল দেশের সকল মানবগোষ্ঠীর প্রয়োজন পূরণে তথা তাদের সকল সমস্যার সমাধানে সক্ষম।

ইসলামের আইন-বিধানে একদিকে যেমন মানুষের বস্তুগত ও পার্থিব জীবনের প্রতিটি দিক-বিভাগের প্রতি দৃষ্টি দেয়া হয়েছে , তেমনি মানুষের অবস্তুগত , মনোজাগতিক , নৈতিক , আধ্যাত্মিক ও পারলৌকিক প্রতিটি দিক-বিভাগের প্রতিও দৃষ্টি দেয়া হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে , যিনি এহেন নিখুঁত , পূর্ণাঙ্গ , সর্বাত্মক ও সর্বব্যাপক আইন-বিধান উপস্থাপন করেছেন তাঁর নবুওয়াতে কোনোরূপ সন্দেহের অবকাশ আছে কি ? বিশেষ করে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) যখন একদল সভ্যতার আলো বর্জিত ও নিরক্ষর মানুষের মাঝে দুনিয়ায় আগমন করেছেন এবং এমন লোকদের মধ্যে বড় হয়েছেন যারা আসমানী কিতাবের শিক্ষার সাথে এক বিন্দুও সম্পর্ক রাখতো না - এর সাথে পরিচিতও ছিলো না , ফলতঃ এ পর্যায়ের আইন-বিধান ও শিক্ষা ছিলো তাদের চিন্তাশক্তির , বরং তাদের কল্পনাশক্তিরও উর্ধে। তাই এ আইন-বিধান না তিনি কারো কাছ থেকে শিখে নিয়ে উপস্থাপন করেছিলেন , না নিজে রচনা করেছিলেন , বরং তা আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকেই তাঁকে প্রদান করা হয়েছিলো - এতে আর কোনোরূপ সন্দেহের অবকাশ থাকে কি ?

অপচয়-অপব্যয় নিষিদ্ধ

কোরআন মজীদের উপরোক্ত আয়াতে এবং এ ধরনের আরো যে সব আয়াতে মানুষকে দানে উৎসাহিত ও কার্পণ্যে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে , তার পাশাপাশি এমন অনেক আয়াতের উল্লেখ করা যেতে পারে যাতে অপচয় ও অপব্যয়ে নিষেধ করা হয়েছে এবং এর ক্ষতিকারকতা সম্বন্ধে মানুষকে জানানো হয়েছে। যেমন , এরশাদ হয়েছে :

) ولا تسرفوا انه لا يحب المسرفي( .

আর তোমরা অপচয় করো না ; নিঃসন্দেহে তিনি (আল্লাহ্) অপচয়কারীদের ভালোবাসেন না। (সূরাহ্ আল্-আন্ আাম্ : 141)

) ان المبذرين کانوا اخوان الشياطين( .

নিঃসন্দেহে অপচয়কারীরা শয়তানদের ভাই। (সূরাহ্ বানী ইসরাাঈল্ : 27)

ধৈর্যধারণে উৎসাহ প্রদান

কোরআন মজীদ বিপদাপদের মুখে ধৈর্য-সহ্য ও দৃঢ়তার নির্দেশ প্রদান করেছে , ধৈর্যশীল ও অটল লোকদের প্রশংসা করেছে এবং তাদের জন্য বিরাট পুরষ্কারের সুসংবাদ দিয়েছে। যেমন , এরশাদ হয়েছে :

) انما يوفی الصابرون اجراهم بغير حساب( .

অবশ্যই ধৈর্যশীল লোকেরা তাদের প্রাপ্য সীমাহীন সুপ্রতিদান লাভ করবে। (সূরাহ্ আয্-যুমার : 10)

) و الله يحب الصابرين( .

আর আল্লাহ্ ধৈর্যশীলদেরকে ভালোবাসেন। (সূরাহ্ আালে ইমরাান্ : 146)

কিন্তু এখানে মনে রাখতে হবে যে , কোরআন মজীদ যালেমের মোকাবিলায় ময্লূমের হাত-পা বেঁধে রাখে নি এবং তাকে তার অধিকার আদায়েও নিষেধ করে নি। বরং যুলুমের মূলোৎপাটন ও ধরণীর বুকে সুবিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যালেম-অত্যাচারীর মোকাবিলায় রুখে দাঁড়ানো ও ন্যায়সঙ্গতভাবে যালেমের নিকট থেকে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য কোরআন মজীদ ময্লূমকে অনুমতি প্রদান করেছে। এ প্রসঙ্গে কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :

) فمن اعتدی عليکم فاعتدوا عليه بمثل ما اعتدی عليکم.(

অতএব , যে তোমাদের বিরুদ্ধে চড়াও হয়েছে তোমরাও তার বিরুদ্ধে চড়াও হও ঠিক যেভাবে সে তোমাদের বিরুদ্ধে চড়াও হয়েছে। (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : 194)

নরহত্যার শাস্তি

কেউ যদি স্বেচ্ছায়-সজ্ঞানে কাউকে হত্যা করে সে ক্ষেত্রে কোরআন মজীদের বিধানে ঘাতককে হত্যা করার জন্য নিহত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনদেরকে অধিকার দেয়া হয়েছে। কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :

) و من قتل مظلوماً فقد جعلنا لئليه سلطاناً فلا يسرف فی القتل( .

যে কেউ অন্যায়ভাবে নিহত হয়েছে আমি তার অভিভাবককে পরিপূর্ণ অধিকার প্রদান করেছি (প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য) , কিন্তু সে-ও যেন (ঘাতককে) হত্যার ব্যাপারে অপচয় না করে (বাড়াবাড়িমূলক কাজ না করে)। (সূরাহ্ বানী ইসরাাঈল্ : 33)

ইহ-পারলৌকিক বিধিবিধানের সমন্বয়

কোরআন মজীদ যেহেতু ভারসাম্য ও মধ্যম পন্থা ভিত্তিক আইন-কানূন্ ও শর ঈ বিধান প্রবর্তন করেছে , সেহেতু ইহজাগতিক সমাজব্যবস্থা ও সামাজিক বিধিবিধানে পরজাগতিক বিধিবিধানের সাথে সঙ্গতি বিধান করেছে এবং এ উভয় জগতের বিধিবিধানের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছে।

কোরআন মজীদ একদিকে যেমন মানুষের ইহজাগতিক বিষয়াদিকে সংশোধন ও পরিশুদ্ধ করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে , অন্যদিকে মানুষের পারলৌকিক সৌভাগ্যেরও নিশ্চয়তা বিধান করেছে। হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) এ সব মহান আইন-বিধান সম্বলিত কোরআন মজীদ নিয়ে এসেছেন যার উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বমানবতাকে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উভয় জগতের সৌভাগ্যে উপনীত করা।

কোরআন মজীদ বর্তমানে প্রচলিত তাওরাতের ন্যায় নয় যার আইন-বিধান সমূহ কেবল বস্তুগত জগতের সাথে সংশ্লিষ্ট - যাতে ইহজগতের প্রতি দৃষ্টি দেয়া হয়েছে , কিন্তু অপর জগতের প্রতি দৃষ্টি দেয়া হয় নি।

হ্যা , বর্তমানে প্রচলিত তাওরাত্ বস্তুজগতের মধ্যে এমনভাবে সীমাবদ্ধ যে , পরজগতের প্রতি সামান্যতম দৃষ্টিও প্রদান করে নি। এমনকি নেক কাজের পুরষ্কারকেও ইহজগতের মধ্যে সীমাবদ্ধ করেছে। বর্তমানে প্রচলিত তাওরাত্ বলেছে যে , নেক কাজের পুরস্কার হচ্ছে জাগতিক ধনসম্পদ বৃদ্ধি এবং ইহজগতে অন্যদের ওপর আধিপত্য। অন্যদিকে পাপের শাস্তিকেও ইহজগতের মধ্যে সীমাবদ্ধ রূপে দেখিয়েছে , বলেছে , পাপের শাস্তি হচ্ছে ধনসম্পদ ও ক্ষমতা-আধিপত্য হাতছাড়া হয়ে যাওয়া।

অন্যদিকে কোরআন মজীদ বর্তমানে প্রচলিত ইনজীলের অনুরূপও নয় - যার আইন-কানূন্ ও বিধিবিধান শুধু পরকালের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং ইহজাগতিক বিষয়াদি তথা সমাজব্যবস্থা ও জীবনবিধানের প্রতি যা উপেক্ষা প্রদর্শন করেছে।

বর্তমানে প্রচলিত তাওরাত্ ও ইনজীল্ উভয়ের বিপরীতে কোরআন মজীদের আইন-কানূন্ ও বিধিবিধান হচ্ছে সর্বাত্মক ও পূর্ণাঙ্গ - যাতে ইহকালীন বৈষয়িক জীবন ও সমাজব্যবস্থা যেমন শামিল রয়েছে , তেমনি পরকালীন জীবনের সাফল্য ও কল্যাণের নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে। কোরআন মজীদে মানুষের জীবনের বস্তুগত ও অবস্তুগত কোনো বিষয়ের প্রতিই উপেক্ষা প্রদর্শন করা হয় নি।

কোরআন মজীদ তার ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষার মাধ্যমে একদিকে যেমন মানুষকে পরকালীন জীবনের প্রতি মনোযোগী করে তুলেছে , অন্যদিকে তাকে পার্থিব জীবনের বিষয়াদির প্রতিও মনোযোগ দিতে বলেছে। যেমন , পরকালীন জীবনের প্রতি মানুষকে আগ্রহী করে তোলার জন্য কোরআন মজীদ এরশাদ করেছে :

) و من يطع الله و رسوله يدخله جنات تجری من تحتها الانهار خالدين فيها و ذالک الفوز العظيم.(

আর যে কেউ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে সে বেহেশতে প্রবেশ করবে - যার তলদেশ দিয়ে নহর প্রবাহিত হচ্ছে ; সেখানে সে চিরদিন থাকবে। আর এ হচ্ছে এক বিরাট সাফল্য। (সূরাহ্ আন্-নিসাা : 13)

) و من يعص الله و رسوله و يتعد حدوده يدخله ناراً خالداً فيها و له عذاب مهين(

আর যে কেউ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করবে ও তাঁর নির্ধারিত সীমারেখা লঙ্ঘন করবে সে দোযখে প্রবেশ করবে ও চিরদিন সেখানে থাকবে , আর তার জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি। (সূরাহ্ আন্-নিসাা : 14)

) فمن يعمل مثقال ذرة خيراً يره( .

অতএব , যে কেউ অণুমাত্রও সৎকর্ম করবে (পরকালে) সে তা দেখতে পাবে। (সূরাহ্ আয্-যিলযালাহ্ : 7)

) و من يعمل مثقال ذرة شراً يره(

আর যে কেউ অণুমাত্রও পাপকর্ম করবে (পরকালে) সে তা দেখতে পাবে। (সূরাহ্ আয্-যিলযালাহ্ : 8)

) و ابتغ فيما اتاک الله الدار الآخرة و لا تنس نصيبک من الدنيا(

(হে রাসূল!) আল্লাহ্ আপনাকে যে পরকালের গৃহ প্রদান করেছেন তাকে আঁকড়ে ধরুন (এবং তা ঠিক রাখার জন্য যথাযথ কাজ করুন) , আর পার্থিব জগতে আপনার অংশকেও ভুলে যাবেন না। (সূরাহ্ আল্-ক্বাছ্বাছ্ব্ : 77)

কোরআন মজীদের বহু আয়াতেই জ্ঞানার্জন ও তাক্ব্ওয়া-পরহেযগারীর জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে , একই সাথে পার্থিব জীবনের স্বাদ-আনন্দ ও আল্লাহর দেয়া নে আমত সমূহের সঠিক ব্যবহারকে বৈধ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কোরআন মজীদ এরশাদ করেছে :

) قل من حرم زينة الله التی اخرج لعباده و الطيبات من الرزق(

(হে রাসূল!) বলুন , আল্লাহ্ তাঁর বান্দাহদের জন্য যে সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছেন এবং যে সব পবিত্র রিয্ক্ব্ প্রদান করেছেন কে তা হারাম করেছে ? (সূরাহ্ আল্-আ রাাফ্ : 32)

পারস্পরিক সম্পর্ক

কোরআন মজীদ মানুষকে আল্লাহ্ তা আলার ইবাদত ও আনুগত্য করা , সৃষ্টিলোকের নিদর্শনাদি ও শর ঈ বিধিবিধান নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা এবং সৃষ্টিলোকের অস্তিত্ব , মানুষের রহস্য ও তার সত্তায় নিহিত বিভিন্ন সত্য সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করার জন্য বার বার আহবান জানিয়েছে। কিন্তু কোরআন মজীদ শুধু মানুষকে আল্লাহ্ তা আলার সান্নিধ্যে পৌঁছে দিয়ে তথা বান্দাহ্ ও স্রষ্টার মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টি করে দিয়েই নিজের দায়িত্ব শেষ করে নি , বরং মানবজীবনের অপর দিকটি অর্থাৎ মানুষের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কের প্রতিও দৃষ্টি প্রদান করেছে , বিশেষ করে মানুষের মধ্যে মায়া-মহব্বত ও আন্তরিক সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছে।

কোরআন মজীদ বেচাকিনা ও ব্যবসা-বাণিজ্যকে বৈধ ঘোষণা করেছে এবং রেবা ও নির্বিচার সম্পদ বৃদ্ধি করার প্রবণতাকে হারাম করেছে। যেমন , এরশাদ হয়েছে :

) و احل الله البيع و حرم الربا( .

আর আল্লাহ্ ব্যবসায়কে হালাল করেছেন এবং রেবাকে হারাম করেছেন। (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : 275)

[আভিধানিক অর্থে রেবা মানে বৃদ্ধি। কিন্তু পারিভাষিক অর্থে অবাণিজ্যিক প্রয়োজনে গৃহীত ঋণের ওপর আসলের চেয়ে অতিরিক্ত গ্রহণই হচ্ছে রেবা। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ধানের ওপর টাকা লাগানো র যে রেওয়াজ আছে যাতে ধান ওঠার আগে ব্যক্তিকে একটি নির্দিষ্ট দরে ধানের অগ্রিম মূল্য দেয়া হয় যার দর ঐ সময়কার ও ধান ওঠার সময়কার বাজার দরের চেয়ে কম। ইসলামের দৃষ্টিতে এ ধরনের লেনদেন বেচাকিনা হিসেবে ছ্বহীহ্ নয়। ফলে এর মাধ্যমে ঋণদাতা যে মুনাফা করে তা রেবা। অন্যদিকে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক , আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কিস্তিতে বাজার-মূল্যের চেয়ে বেশী মূল্যে গার্হস্থ্য সামগ্রী সরবরাহ করে যে অতিরিক্ত মুনাফা করে তা-ও রেবা। কোনো দোকানদার নগদ বেচাকিনার ক্ষেত্রে একই পণ্য বিভিন্ন মূল্যে বিক্রি করলে বাকী বিক্রির ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম মূল্যে বিক্রি না করলে হাদীছ অনুযায়ী এর অতিরিক্ত মুনাফা হবে রেবা।]

কোরআন মজীদ মানুষের প্রতি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা এবং তা ভঙ্গ না করার জন্য আদেশ দিয়েছে। যেমন , এরশাদ করেছে :

) يا ايها الذين آمنوا اوفوا بالعقود(

হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের প্রতিশ্রুতিসমূহ রক্ষা করো। (সূরাহ্ আল্-মাাএদাহ্ : 1)

অবশ্য এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে , কোনো যুলুম , অন্যায় বা পাপাচারের কাজের প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকার করলে বা ভালো কাজ না করার অঙ্গীকার করলে তা ভঙ্গ করা ও শর ঈ বিধান অনুযায়ী অঙ্গীকার ভঙ্গের কাফ্ফারাহ্ দেয়া ফরয ; এরূপ ক্ষেত্রে অঙ্গীকার রক্ষা করা কঠিন গুনাহ্। তেমনি কোনো মোবাহ্ কাজে (যেমন : তালাক্ব্ প্রদানের) অঙ্গীকার করার পর তা ভঙ্গ করার মধ্যে কল্যাণ মনে করলে তা ভঙ্গ করে কাফ্ফারাহ্ প্রদান জায়েয আছে।

বিবাহে উৎসাহ প্রদান

যেহেতু মানব প্রজাতির অস্তিত্ব ও ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য নারী ও পুরুষের মাঝে বৈবাহিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হওয়া অপরিহার্য , সেহেতু কোরআন মজীদ এ স্বভাবসম্মত কাজটি সম্পাদন অর্থাৎ বিবাহ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। এরশাদ হয়েছে :

) و انکحوا الايامی منکم و الصالحين من عبادکم و امائکم. ان يکونوا فقراء يغنهم الله من فضله و الله واسع عليم(

আর তোমরা তোমাদের মধ্যকার স্বামী বা স্ত্রী বিহীন নারী ও পুরুষদেরকে এবং তোমাদের বিবাহযোগ্য দাস-দাসীদেরকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে দাও। আর এরা যদি দরিদ্র ও নিঃসম্বল হয়ে থাকে তো আল্লাহ্ তাঁর অনুগ্রহ দ্বারা তাদেরকে সচ্ছলতা দান করবেন। আর আল্লাহ্ সীমাহীন উদারতার অধিকারী ও সর্ববিষয়ে সদা ওয়াকেফহাল। (সূরাহ্ আন্-নূর্ : 32)

) فانکحوا ما طاب لکم من النساء مثنی و ثلاث و رباع فان خفتم ان لا تعدلوا فواحدة( .

তোমাদের জন্য যারা উত্তম এমন নারীদের মধ্য থেকে বিবাহ করো দু জন , তিন জন বা চারজনকে , কিন্তু তোমরা যদি ভয় করো যে , তাদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারবে না তাহলে মাত্র একজনকে বিবাহ করো। (সূরাহ্ আন্-নিসাা : 3)

সদাচরণ ও কল্যাণকর কাজ

কোরআন মজীদ স্ত্রীর সাথে সদাচরণ করতে ও তার সমস্ত স্বাভাবিক প্রয়োজন পূরণের জন্য স্বামীর প্রতি নির্দেশ দিয়েছে। তেমনি কোরআন মজীদ সমস্ত মুসলমানের সাথে , বিশেষ করে পিতা-মাতা , আত্মীয়-স্বজন ও ঘনিষ্ঠ জনদের সাথে সদাচরণের জন্য আদেশ দিয়েছে। বরং কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে সদাচরণ হচ্ছে মানবজীবনের জন্য অপরিহার্য ব্যাপক ভিত্তিক ও সর্বজনীন কর্মসূচী। তাই শুধু মুসলমানদের সাথেই নয় , বরং মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে মানব প্রজাতির প্রতিটি সদস্যের সাথেই সদাচরণ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :

) و عاشروهن بالمعروف(

আর তোমরা তাদের (তোমাদের স্ত্রীদের) সাথে সদাচরণ করো। (সূরাহ্ আন্-নিসাা : 19)

) و لهن مثل الذی عليهن بالمعروف(

আর তাদের ওপরে যেভাবে (তোমাদের অধিকার) রয়েছে ঠিক সেভাবেই (তোমাদের ওপর) রয়েছে তাদের জন্য ন্যায়সঙ্গত অধিকার। (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : 228)

) و اعبدوا الله و لا تشرک به شيئاً و بالوالدين احساناً و بذی القربی و اليتامی و المساکين و الجاری ذی القربی و الجاری ذی الجنب و الصاحب بالجنب و ابن السبيل و ما ملکت ايمانکم ان الله لا يحب من کان مختالاً فخوراً(

তোমরা আল্লাহর বন্দেগী ও দাসত্ব করো এবং তাঁর সাথে কোনো কিছুকে শরীক করো না। আর পিতামাতার সাথে সদাচরণ করো এবং সদাচরণ করো আত্মীয়-স্বজন , ইয়াতীম , মিসকীন্ , নিকট প্রতিবেশী , দূর প্রতিবেশী , বন্ধু-বান্ধব , পথিক এবং তোমাদের দাস-দাসী (ও অধীনস্থ)দের সাথে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ উদ্ধত-অহঙ্কারী লোকদেরকে পসন্দ করেন না। (সূরাহ্ আন্-নিসাা : 36)

) و احسن کما احسن الله اليک و لا تبغ الفساد فی الارض ان الله لا يحب المفسدين(

আর (অন্যদের প্রতি) কল্যাণকামী ও দয়ার্দ্র হও ঠিক যেভাবে আল্লাহ্ তোমার প্রতি দয়া করেছেন। আর ধরণীর বুকে বিপর্যয় সৃষ্টি , দুষ্কৃতি ও পাপাচার করো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ বিপর্যয়সৃষ্টিকারী ও দুর্বৃত্ত-পাপাচারীদেরকে পসন্দ করেন না। (সূরাহ্ আল্-ক্বাছ্বাছ্ব্ : 77)

) ان رحمة الله قريب من المحسنين(

অবশ্যই আল্লাহর রহমত্ সৎকর্মশীল ও কল্যাণকারীদের অত্যন্ত কাছাকাছি অবস্থান করছে। (সূরাহ্ আল্-আ রাাফ্ : 56)

) و احسنوا ان الله يحب المحسنين(

আর তোমরা (অন্যদের) কল্যাণ সাধন করো ; নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ কল্যাণকারীদের পসন্দ করেন। (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : 195)

এ হচ্ছে কোরআন মজীদের ভারসাম্যপূর্ণ ও মধ্যম পন্থা অবলম্বনের শিক্ষাসমূহের কিছু দৃষ্টান্ত মাত্র।

ভালো কাজে আদেশ দান ও মন্দ কাজ প্রতিরোধ

কোরআন মজীদ মুসলিম উম্মাহর সমস্ত সদস্যের ওপর ভালো কাজের আদেশ দান ও মন্দ কাজের প্রতিরোধকে অপরিহার্য কর্তব্য রূপে নির্ধারণ করে দিয়েছে এবং এ দায়িত্বকে কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠী বা মুষ্টিমেয় সংখ্যক লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেয় নি। কোরআন মজীদ তার এ মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে ব্যাপক আইন-বিধান প্রণয়ন করেছে , বরং এর মাধ্যমেই স্বীয় শিক্ষাকে প্রাণময় ও চিরস্থায়ী করেছে।

ইসলাম সমাজের প্রতিটি ব্যক্তিকে এবং প্রতিটি পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে পরস্পরের জন্য পর্যবেক্ষক ও পথনির্দেশকের দায়িত্ব প্রদান করেছে এবং প্রতিটি ব্যক্তিকেই অন্যদের ওপর দায়িত্বশীল করেছে। প্রকৃত পক্ষে ইসলাম প্রতিটি মুসলিম ব্যক্তির ওপর একেক জন পুলিশের দায়িত্ব প্রদান করেছে যে অন্যদেরকে নেক কাজ , কল্যাণ ও চিরন্তন সৌভাগ্যের দিকে পথনির্দেশ প্রদান করবে এবং যুলুম-শোষণ , নির্যাতন , লুণ্ঠন , পাপ ও দুষ্কৃতি থেকে তাদেরকে ফিরিয়ে রাখবে। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে সমস্ত মুসলমানই ইসলামের প্রচার-প্রসার এবং ইসলামী আইন-বিধান বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বশীল।

এমতাবস্থায় , এর চেয়ে বৃহত্তর এবং এর চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী ও প্রভাবশালী কোনো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কথা কল্পনা করাও সম্ভব কি ?

বর্তমান যুগে যে কোনো দেশেই রাষ্ট্রীয় আইন-কানূন্ কার্যকরী করার জন্য বিরাট পরিচালকমণ্ডলী ও শান্তিশৃঙ্খলা বাহিনীর আশ্রয় নেয়া হয় , কিন্তু তা সত্ত্বেও আইনলঙ্ঘন প্রতিরোধ করা সম্ভবপর হয় না। কারণ , পরিচালনা ও শান্তিশৃঙ্খলা বাহিনী যতোই বিশাল এবং যতোই সুসজ্জিত হোক না কেন , তাদের পক্ষে জাতির প্রতিটি মানুষের সাথে প্রতিটি স্থানে ও প্রতিটি সময়ে অবস্থান করে তাদের সমস্ত কাজকর্মের ওপর দৃষ্টি রাখা সম্ভবপর নয়।

কিন্তু ইসলাম এক সমুন্নত মহান পরিকল্পনা ও কর্মসূচীর আশ্রয় নিয়ে এবং ভালো কাজের আদেশ দান ও মন্দ কাজ প্রতিরোধ কে প্রতিটি মুসলমানের জন্য বাধ্যতামূলক করে দিয়ে কার্যতঃ শক্তিশালী ও বিশালায়তন এক বাহিনী সৃষ্টি করেছে। আর অন্যান্য বাহিনী ও এ বাহিনীর মধ্যে রয়েছে এক বিরাট পার্থক্য। তা হচ্ছে , কোনোরূপ ব্যয়বাজেট ছাড়াই এ বাহিনী যথারীতি তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এবং সর্বত্র , সব সময় ও সব বিষয়ে দৃষ্টি রাখছে , আর সেই সাথে ইসলামের সমুন্নত আইন-বিধান বাস্তবায়নেরও নিশ্চয়তা বিধান করছে।

শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড জ্ঞান ও ন্যায়নিষ্ঠা

কোরআন মজীদ একের ওপর অন্যের প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্বের জন্য একমাত্র যে বিষয়টিকে মানদণ্ডরূপে গ্রহণ করেছে তা হচ্ছে জ্ঞান ও ন্যায়নিষ্ঠা - নীতিনিষ্ঠতা তথা খোদাভীরুতা। যেমন , কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :

) ان اکرمکم عند اببه اتقاکم(

অবশ্যই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সর্বাধিক সম্মানের পাত্র সেই ব্যক্তি যে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক ন্যায়নিষ্ঠ ও খোদাভীরু। (সূরাহ্ আল্-হুজুরাাত্ : 13)

) قل هل يستوی الذين يعلمون و الذين لا يعلمون( .

(হে রাসূল!) বলুন : , যারা জানে (জ্ঞানের অধিকারী) আর যারা জানে না (অজ্ঞ) তারা কি সমান হতে পারে ? (সূরাহ্ আয্-যুমার : 9)

সাম্য ও সমতা প্রতিষ্ঠা

কোরআন মজীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও গভীরতম আইন-বিধান ও শিক্ষাসমূহের অন্যতম হচ্ছে সাম্য ও সমতা। কোরআন মজীদ তার এ সাম্যের বিধানের আওতায় সমস্ত মুসলমানের মধ্যে ঐক্য , অভিন্নতা ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করেছে , সবাইকে এক কাতারে এনে দাঁড় করিয়েছে এবং যে কোনো ধরনের বিশেষ অগ্রাধিকার ও বর্ণগত ভেদাভেদের মূলোৎপাটন করেছে , তেমনি একের ওপর অন্যের প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্বের মূলোচ্ছেদ করেছে।

হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) এরশাদ করেন : জাহেলীয়াতের যুগে যারা ঘৃণ্য , নীচ ও পদদলিত ছিলো মহান আল্লাহ্ তা আলা ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় দান করে তাদেরকে সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী করেছেন এবং ইসলামের মাধ্যমে জাহেলী যুগের গর্ব-অহঙ্কার - বর্ণ , গোত্র আত্মীয়-স্বজন ও পূর্বপুরুষের গৌরব , আর সব রকমের বর্ণ ও শ্রেণীগত ভেদাভেদের মূলোৎপাটন করেছেন। সাদা-কালো , আরব-অনারব নির্বিশেষে সমস্ত মানুষই আদমের বংশধর , আর আল্লাহ্ আদমকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। বস্তুতঃ শেষ বিচারের দিনে আল্লাহর নিকট প্রিয়তম লোক হিসেবে তারাই গণ্য হবে যারা সর্বাধিক ন্যায়নিষ্ঠ - খোদাভীরু। (فروع کافی-٢، باب ٢١: ان المؤمن کفو المؤمنة .)

হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) আরো এরশাদ করেছেন : সাধারণ জনগণের ওপর জ্ঞানীদের মর্যাদার তুলনা হচ্ছে তোমাদের মধ্যকার মুষ্টিমেয় সংখ্যক (শ্রেষ্ঠতর) লোকদের ওপর আমার মর্যাদা। (الجامع الصغير با شرح مناوی ٤/٤٣٢ .)

ইসলাম ঈমানী পূর্ণতার কারণে হযরত সালমান ফার্সীকে অন্য মুসলমানদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেছে (যদিও তিনি ছিলেন অনারব) , এমনকি তাঁকে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর পরিবারের সদস্য হিসেবে পর্যন্ত ঘোষণা করেছে (بحار الانوار- ٤، باب ٧٦: فضائل سلمان .) , অন্যদিকে স্বয়ং হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর চাচা হওয়া সত্ত্বেও আবূ লাহাব্-কে তার কুফরী ও খোদাদ্রোহিতার কারণে জাহান্নামী হিসেবে ঘোষণা করেছে।

হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর জীবনচরিতও প্রমাণ করে যে , তিনি কখনোই এবং কোনো অবস্থায়ই স্বীয় বংশ-গোত্র বা বর্ণকে অন্যদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য প্রদান করেন নি। তেমনি ঐ যুগের মানুষ যে সব বিষয়কে গৌরবের কারণ রূপে গণ্য করতো এবং তৎকালে প্রচলিত গর্ব-অহঙ্কার , শ্রেষ্ঠত্ব , মর্যাদা ও বিশেষ সুবিধার আরো যে সব মানদণ্ড বিদ্যমান ছিলো সেগুলোর ভিত্তিতে তিনি কোনোদিনই গর্ব-অহঙ্কার করেন নি বা বিশেষ সুবিধা গ্রহণ করেন নি। বরং তিনি মানুষকে আল্লাহ্ তা আলার একত্ব , নবুওয়াত্ , পরকাল ও নেক আমলের দিকে আহবান করেছেন।

হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) লোকদেরকে চিন্তা ও কর্মের ঐক্য এবং এক খোদার ইবাদত্-বন্দেগী ও আনুগত্যের দিকে পথনির্দেশ দিয়েছেন ও পরিচালনা করেছেন। এ পন্থায় তিনি মানুষের অন্তঃকরণের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে , তাদের অন্তর থেকে অযৌক্তিক গর্ব-অহঙ্কারের মূলোৎপাটন করতে এবং তার পরিবর্তে তাদের হৃদয়ে প্রেম-ভালোবাসা , মায়া-মহব্বত , সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের অঙ্কুরোদ্গম ঘটাতে সক্ষম হন। এর ফলে দেখা গেছে , অনেক সম্পদশালী ও সম্ভ্রান্ত লোক , ইতিপূর্বে ছোটলোকরূপে পরিগণিত দরিদ্র পরিবারের ছেলেদের সাথে নিজেদের মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের সাথে আত্মীয়তার বন্ধন প্রতিষ্ঠা করেছেন।

কালোত্তীর্ণ পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান

সার্বিকভাবে আমরা বলতে পারি যে , কোরআন মজীদের ধর্মীয় বিধিবিধান ও পার্থিব আইন-কানূনে এবং ইসলামের নৈতিক শিক্ষায় ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের কল্যাণের প্রতি দৃষ্টি দেয়া হয়েছে। ইসলাম এমন আইন-বিধান ও সমাজব্যবস্থা প্রদান করেছে যা সকল যুগের সকল দেশের সকল মানবগোষ্ঠীর প্রয়োজন পূরণে তথা তাদের সকল সমস্যার সমাধানে সক্ষম।

ইসলামের আইন-বিধানে একদিকে যেমন মানুষের বস্তুগত ও পার্থিব জীবনের প্রতিটি দিক-বিভাগের প্রতি দৃষ্টি দেয়া হয়েছে , তেমনি মানুষের অবস্তুগত , মনোজাগতিক , নৈতিক , আধ্যাত্মিক ও পারলৌকিক প্রতিটি দিক-বিভাগের প্রতিও দৃষ্টি দেয়া হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে , যিনি এহেন নিখুঁত , পূর্ণাঙ্গ , সর্বাত্মক ও সর্বব্যাপক আইন-বিধান উপস্থাপন করেছেন তাঁর নবুওয়াতে কোনোরূপ সন্দেহের অবকাশ আছে কি ? বিশেষ করে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) যখন একদল সভ্যতার আলো বর্জিত ও নিরক্ষর মানুষের মাঝে দুনিয়ায় আগমন করেছেন এবং এমন লোকদের মধ্যে বড় হয়েছেন যারা আসমানী কিতাবের শিক্ষার সাথে এক বিন্দুও সম্পর্ক রাখতো না - এর সাথে পরিচিতও ছিলো না , ফলতঃ এ পর্যায়ের আইন-বিধান ও শিক্ষা ছিলো তাদের চিন্তাশক্তির , বরং তাদের কল্পনাশক্তিরও উর্ধে। তাই এ আইন-বিধান না তিনি কারো কাছ থেকে শিখে নিয়ে উপস্থাপন করেছিলেন , না নিজে রচনা করেছিলেন , বরং তা আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকেই তাঁকে প্রদান করা হয়েছিলো - এতে আর কোনোরূপ সন্দেহের অবকাশ থাকে কি ?


17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53

54

55

56

57

58

59

60

61