চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 103667
ডাউনলোড: 9120


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 103667 / ডাউনলোড: 9120
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

মিরাজ কখন সংঘটিত হয়েছিল

যদিও মিরাজের ঘটনাটি একটি ঐতিহাসিক ও অলৌকিক ঘটনা হিসাবে স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল,তদুপরি এ বিষয়ে মতানৈক্য রয়েছে। মতানৈক্যের অন্যতম বিষয় ছিল এ ঘটনার সময়কাল নিয়ে। ইসলামের দু জন প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক ও হিশাম এ ঘটনাটি নবুওয়াতের দশম বছরে সংঘটিত হয়েছিল বলে উল্লেখ করেছেন। ঐতিহাসিক বায়হাকীর মতে এ ঘটনাটি নবুওয়াতের দ্বাদশ বর্ষে সংঘটিত হয়েছিল। ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ এ ঘটনাকে নবুওয়াতের প্রথম দিকের,আবার কেউ কেউ মাঝামাঝি সময়ের বলে উল্লেখ করেছেন। অনেক ঐতিহাসিক এ মতগুলোকে সমন্বিত করার উদ্দেশ্যে রাসূল (সা.)-এর মিরাজ একাধিকবার সংঘটিত হয়েছে বলে মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু আমার মনে হয়,যে মিরাজে প্রাত্যহিক নামাযসমূহ ফরজ করা হয় তা আবু তালিবের মৃত্যুর বছর অর্থাৎ নবুওয়াতের দশম বর্ষে সংঘটিত হয়েছিল। কারণ ইতিহাস ও হাদীস গ্রন্থসমূহ থেকে নিশ্চিতভাবে জানা যায় যে,মিরাজের রাত্রিতে নবীর উম্মতের ওপর পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরজ করা হয়েছে। তদুপরি ইতিহাস হতে জানা যায় আবু তালিবের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত নামায ফরজ করা হয় নি। কারণ তাঁর মৃত্যুর সময় কুরাইশ প্রধানগণ তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রের সঙ্গে তাদের মীমাংসা করিয়ে দিতে বলে যাতে করে নবী (সা.) তাঁর দাওয়াতী কর্ম থেকে নিবৃত্ত হন। নবী (সা.) ঐ বৈঠকে কুরাইশ প্রধানদের উদ্দেশে বলেন, আমি তোমাদের নিকট থেকে একটি জিনিসই শুধু চাই। আর তা হলো :

 تقولون لا إله إلّا الله و تخلعون ما تعبدون من دونه

তোমরা এ সাক্ষ্য দাও যে,আল্লাহ্ ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং তিনি ব্যতীত অন্য কিছুর উপাসনা করা থেকে বিরত হও। 344

তিনি এখানে এ বিষয়ে তাদের মৌখিক স্বীকৃতি আদায়েরই চেষ্টা করেছেন এবং তা-ই যথেষ্ট মনে করেছেন। এটি তখনও নামায ফরজ না হওয়ার পক্ষে দলিল। কারণ শুধু এ ঈমান ব্যক্তির মুক্তির জন্য যথেষ্ট নয় যদি নামাযের মতো অপরিহার্য কর্ম এর সঙ্গে যুক্ত না হয়ে থাকে। কিন্তু কেন রাসূল (সা.) নিজ নবুওয়াতের স্বীকৃতির বিষয় উপস্থাপন করেন নি? এ প্রশ্নের জবাবে বলা যায় নবীর নির্দেশে আল্লাহর একত্বের স্বীকৃতি তাঁর রিসালাতের স্বীকৃতিও বটে। অর্থাৎ আল্লাহর একত্বকে স্বীকার করে নেয়া এ ক্ষেত্রে তাওহীদ ও রিসালাতকে এক সঙ্গে স্বীকার করে নেয়ারই শামিল।

তদুপরি ঐতিহাসিকগণ হিজরতের কিছু পূর্বে যে সকল ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছে,যেমন তোফাইল ইবনে আমর দুসীর ইসলাম গ্রহণের ঘটনার যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) শুধু শাহাদাতাইনের শিক্ষাই তাদের দিয়েছেন-নামাজের বিষয়ে কিছু বলেন নি। মিরাজের ঘটনাটি যে হিজরতের কিছু দিন পূর্বে হয়েছিল এটি তার অন্যতম প্রমাণ।

যে সকল ব্যক্তি মিরাজ নবুওয়াতের দশম বর্ষের পূর্বে হয়েছিল বলেছেন তাঁরা সঠিক বলেন নি। কারণ রাসূল (সা.) নবুওয়াতের অষ্টম হতে দশম বর্ষে শেবে আবি তালিব’-এ (আবু তালিবের উপত্যকায়) অবস্থান করছিলেন। তাই মুসলমানদের অবস্থা সে সময় বেশ সঙিন ছিল এবং নামাযের মতো গুরুদায়িত্ব কাঁধে নেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। নবুওয়াতের অষ্টম বছরের পূর্বেও কুরাইশদের চাপে মুসলমানদের অবস্থা সংকটজনক ছিল এবং তাদের সংখ্যাও ছিল স্বল্প। যেহেতু তখনও ঈমানের আলো ও এর মৌল শিক্ষা লক্ষণীয় সংখ্যক ব্যক্তির মাঝে প্রস্ফুটিত হয় নি সেহেতু নামাযের বিষয়টি তাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করত।

কোন কোন হাদীসে যে এসেছে হযরত আলী (আ.) হিজরতের তিন বছর পূর্ব হতেই রাসূলের সঙ্গে নামায পড়েছেন সেই নামায নির্দিষ্ট শর্তাধীন ও অপরিহার্য নামায ছিল না,বরং শর্তহীন বিশেষ নামায ছিল345 ;সম্ভবত সেগুলো মুস্তাহাব নামায ছিল।

মহানবী (সা.)-এর মিরাজ কি দৈহিক ছিল?

মহানবী (সা.)-এর মিরাজের ধরন কি ছিল-দৈহিক না আত্মিক তা নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। যদিও কোরআনের আয়াত ও হাদীসসমূহ স্পষ্টভাবে রাসূলের মিরাজ দৈহিক ছিল বলে উল্লেখ করেছে346 তদুপরি সাধারণ লোকদের চিন্তাপ্রসূত যুক্তিসমূহ এ ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা সৃষ্টি করেছে ও এর ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হয়ে মিরাজ আত্মিকভাবে হয়েছে বলে মনে করেছে। তাদের মতে শুধু নবীর আত্মাই অন্য জগতে ভ্রমণ করেছে এবং পরিভ্রমণশেষে তাঁর দেহে ফিরে এসেছে। কেউ কেউ আবার আরো বাড়িয়ে বলেছেন,রাসূলের মিরাজ স্বপ্নযোগে হয়েছিল এবং তিনি স্বপ্নে এ পরিভ্রমণ সম্পন্ন করেছিলেন।

শেষোক্ত দৃষ্টিভঙ্গিটি সত্য থেকে এতটা দূরে যে,এটি একটি মত হিসাবে উল্লেখের যোগ্যতা রাখে না। কারণ নবীর মিরাজ দৈহিক ছিল বলেই কুরাইশগণ এ দীর্ঘ পথ এক রাত্রিতে পাড়ি দেয়া সম্ভব নয় ভেবেই নবীর দাবিতে ক্ষুব্ধ হয়েছিল ও তাঁকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করেছিল। মিরাজের বিষয়টি দৈহিক হওয়ার কারণেই কুরাইশদের সভাসমূহে মুখে মুখে তা ঘুরছিল। যদি মিরাজ স্বপ্নযোগে হতো তাহলে কুরাইশরা তা মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে সচেষ্ট হতো না। যদি রাসূল (সা.) বলতেন যে,তিনি ঘুমের মধ্যে এমন স্বপ্ন দেখেছেন তাহলে তা বিতর্কের বিষয় হতো না। কারণ স্বপ্নে অনেক অসম্ভব বিষয়ও সম্ভব হয়ে থাকে এবং এতে বিতর্কের কিছু নেই। এরূপ ক্ষেত্রে বিষয়টিরও তেমন মূল্য থাকে না। তদুপরি আফসোসের বিষয় হলো কোন কোন মুসলিম মনীষী,যেমন মিশরীয় লেখক ফরিদ ওয়াজদী ও অন্যান্যরা এ মতকে গ্রহণ করে তা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভিত্তিহীন সকল যুক্তি উপস্থাপন করেছেন।347

আত্মিক মিরাজ কী?

যে সকল ব্যক্তি দৈহিক মিরাজ সংঘটিত হওয়ার প্রতিবন্ধকতাসমূহের জবাব দানে ব্যর্থ হয়েছেন তাঁরা মিরাজ সম্পর্কিত আয়াত ও রেওয়ায়েতসমূহকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে মিরাজ আত্মিকভাবে হয়েছিল বলে প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়েছেন।

আত্মিক মিরাজের অর্থ হলো আল্লাহর সৃষ্টিতে গভীর চিন্তা,তাঁর সৌন্দর্য ও শক্তিমত্তার স্মরণে মগ্ন হওয়ার মাধ্যমে দুনিয়া ও বস্তুসংশ্লিষ্টতা থেকে মুক্ত হয়ে আত্মিকভাবে বিভিন্ন স্তর অতিক্রমের পর স্রষ্টার বিশেষ নৈকট্য লাভ-যা বর্ণনাতীত।

আত্মিক মিরাজের কথা বললেই আল্লাহর মহত্ত্ব ও তাঁর সৃষ্টিজগতের বিশালতার বিষয়ে চিন্তার মাধ্যমে উপরিউক্ত পর্যায়ে পৌঁছানো বুঝালে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে,এ মর্যাদা শুধু রাসূল (সা.)-এর জন্য নির্দিষ্ট নয়,বরং অধিকাংশ নবী এবং পবিত্র হৃদয়ের অধিকারী আল্লাহর অনেক ওলীই তা অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু আমরা জানি মিরাজকে আল্লাহ্পাক রাসূলের একটি বিশেষত্ব বলে উল্লেখ করেছেন যা অন্যদের জন্য প্রযোজ্য নয়। তা ছাড়া পূর্বোক্ত আত্মিক নৈকট্যের বিষয়টি নবী (সা.)-এর জন্য প্রতি রাত্রেই অর্জিত হতো348 ,অথচ মিরাজের ঘটনাটি একটি বিশেষ রাত্রির সঙ্গে সম্পর্কিত।

যে বিষয়টি এ ব্যক্তিবর্গকে এরূপ চিন্তায় মগ্ন করেছে তা হলো গ্রীক জ্যোতির্বিদ টলেমীর তত্ত্ব যা দু হাজার বছরের অধিক সময় ধরে প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে প্রতিষ্ঠিত ও বহুল প্রচারিত ছিল এবং এ বিষয়ে অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। তাঁর মতে বিশ্ব দু ভাগে বিভক্ত : পার্থিব ও ঊর্ধ্বজগৎ। পার্থিবজগৎ চারটি উপাদানে গঠিত : পানি,মাটি,বায়ু ও অগ্নি। প্রথম যে উপাদানের সমাহার আমাদের চোখে পড়ে তা হলো স্থলভাগ এবং এটি বিশ্বের কেন্দ্র। এর পরবর্তী স্তরে রয়েছে জলভাগ যা স্থলভাগকে ঘিরে রেখেছে এবং তৃতীয় স্তরে জলভাগকে ঘিরে রেখেছে বায়ুর স্তর। পার্থিব জগতের শেষ ও চতুর্থ স্তরে রয়েছে অগ্নির স্তর যা বায়ুজগতকে আবৃত করে রেখেছে। বায়ুজগৎ পার্থিবজগতের সর্বশেষ স্তর। এরপর থেকে ঊর্ধ্বজগতের শুরু। ঊর্ধ্বজগৎ নয়টি স্তরের সমন্বয়ে গঠিত এবং এ স্তরসমূহ পিঁয়াজের ন্যায় পরস্পর অবিচ্ছিন্নভাবে সংযুক্ত। কোন বস্তুই এ স্তরসমূহ বিদীর্ণ করতে সক্ষম নয়। কারণ এতে সমগ্র ঊর্ধ্বজগতের উপাদানসমূহ বিক্ষিপ্ত ও ধ্বংস হয়ে যাবে।

মিরাজ যদি দৈহিক হয়ে থাকে তাহলে এর অর্থ নবী (সা.) বিশ্বের কেন্দ্র থেকে সরাসরি ঊর্ধ্ব দিকে পার্থিবজগতের চারটি স্তর অতিক্রম করে ঊর্ধ্বজগতে পৌঁছেছেন এবং ঊর্ধ্বজগতের স্তরসমূহ একের পর এক ছিন্ন করে গন্তব্যে পৌঁছেছেন। কিন্তু টলেমীর তত্ত্ব অনুসারে তা সম্ভব নয়। কারণ তাহলে সমগ্র ঊর্ধ্বজগতই ধ্বংস হয়ে যেত। এর ভিত্তিতেই তাঁরা মহানবী (সা.)-এর দৈহিক মিরাজকে অস্বীকার করে তা আত্মিক ছিল বলে ধরে নিয়েছেন।

উত্তর

উপরিউক্ত মতটি গ্রহণযোগ্য হতো যদি টলেমীর তত্ত্বটি আজও বিজ্ঞানশাস্ত্রে গ্রহণীয় একটি মতবাদ বলে পরিগণিত হতো। সে ক্ষেত্রে তাঁরা তাঁদের এ ভ্রান্ত মতের ওপর নির্ভর করে কোরআনের এ মহাসত্যের বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করে ভিন্ন ব্যাখ্যার কথা ভাবতে পারতেন। কিন্তু বর্তমানে এ তত্ত্বটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের গ্রন্থে তা একটি তত্ত্ব হিসাবে শুধু লিপিবদ্ধই রয়েছে। বিশেষত বর্তমানে উদ্ভাবিত শক্তিশালী টেলিস্কোপ যন্ত্রসমূহ যখন সূক্ষ্মভাবে গ্রহ-নক্ষত্রসমূহকে পর্যবেক্ষণ করছে,অ্যাপোলো ও লুনার মতো মহাশূন্যযানসমূহ চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করেছে,মঙ্গল,শনি প্রভৃতি গ্রহের তথ্য জানার জন্য ভয়েজারের মতো মহাশূন্যযান সৌরজগতে ঘুরে ফিরছে তখন এরূপ ভ্রান্ত তত্ত্বের পেছনে ছোটা অযৌক্তিক। তাই বর্তমানে টলেমীর কল্পনাপ্রসূত তত্ত্বের কোন মূল্য নেই।

সুরহীন সংগীত

শেখ আহমদ এহসায়ী ( শাইখীয়া 349 নামে প্রসিদ্ধ বাতিল ফের্কার নেতা) তাঁর কাতিফিয়া’ নামক গ্রন্থে মিরাজের ভিন্ন এক ব্যাখ্যা উপস্থাপনের মাধ্যমে দৈহিক ও আত্মিক মিরাজে বিশ্বাসী ভিন্ন দু দলকেই সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন,মহানবী (সা.) বারযাখীরূপে (অর্থাৎ ঘুমন্ত ব্যক্তি যেমন স্বপ্নে সকল কাজ করে থাকে সেরূপে) মিরাজ সম্পন্ন করেছেন। এতে তিনি মনে করেছেন যে,দৈহিক মিরাজের পক্ষাবলম্বনকারীদের যেমন সন্তুষ্ট করতে পেরেছেন (যেহেতু মিরাজে নবীর দৈহিক উপস্থিতিও প্রমাণিত হয়েছে) তেমনি ঊর্ধ্বজগতে প্রবেশের অসুবিধাসমূহও দূরীভূত করতে সক্ষম হয়েছেন। কারণ বারযাখী দেহের ঊর্ধ্বজগৎ অতিক্রমের ফলে তা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।350

কুসংস্কারমুক্ত ও সত্যান্বেষী ব্যক্তিগণ নিঃসন্দেহে স্বীকার করবেন এ মতটিও পূর্বোক্ত মতের ন্যায় (আত্মিকভাবে মিরাজ সংঘটিত হওয়া) ভিত্তিহীন ও কোরাআন-হাদীসের পরিপন্থী। কারণ মিরাজ সম্পর্কিত কোরআনের আয়াতটি যে কোন আরবী ভাষাবিদকে দিলে তিনি বলবেন,যেহেতু আয়াতটিতেعبد শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে তা মানুষের দেহে বিদ্যমান সকল উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত সত্তাকে বুঝায়। কখনই তা হোরকুলায়ী’ দেহ নয়। কারণ এমন নামের সত্তার সঙ্গে আরবরা পরিচিত ছিল না,অথচ তাদের বুঝানোর উদ্দেশ্যেই সূরা বনি ইসরাইলেعبد (আবদ) শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।

যে বিষয়টি মতের প্রবক্তাকে এরূপ ধারণা পোষণে বাধ্য করেছে তা বিশ্বজগৎ সম্পর্কে প্রাচীন গ্রীক কল্পনাপ্রসূত উপসিদ্ধান্ত ( Hypothesis) ব্যতীত অন্য কিছু নয়। বর্তমানে বিশ্বের সকল জ্যোতির্বিদই মতকে অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন। তাই এমতাবস্থায় মতের অন্ধ অনুসরণ আমাদের জন্য কাঙ্ক্ষিত নয়। পূর্বে যদিও কেউ অজ্ঞতাবশত এ মতকে সমর্থন করে থাকেন বর্তমানে তা করা বুদ্ধিবৃত্তিক হবে না। কোনক্রমেই এমন উপসিদ্ধান্ত-যা বিজ্ঞানও অযৌক্তিক মনে করে তার ভিত্তিতে কোরআনের আয়াতকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা বৈধ নয়।

মিরাজ ও বর্তমানের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বসমূহ

কেউ কেউ মনে করেছেন,বর্তমানের বিজ্ঞান ও এর তত্ত্বসমূহ রাসূল (সা.)-এর মিরাজের সঙ্গে সংগতিশীল নয়। কারণ :

1. বর্তমানের বিজ্ঞান বলে, ভূপৃষ্ঠ থেকে কোন বস্তুকে ঊর্ধ্বে যেতে হলে পৃথিবীর অভিকর্ষ বলকে অতিক্রম করতে হয়। যদি কোন বলকে ঊর্ধ্বে ছোড়া হয় তাহলে অভিকর্ষ বলের কারণে তা ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসে। বলকে যত জোরেই নিক্ষেপ করা হোক না কেন এরূপ হয়ে থাকে। যদি বল তার গতিকে ঊর্ধ্বদিকে অব্যাহত রাখতে চায় তবে তাকে অভিকর্ষ বল অতিক্রম করতে হবে এবং এ লক্ষ্যে বলকে 25000 মাইল/ঘণ্টা গতিতে ছুঁড়তে হবে।

তাই মহানবী (সা.)-কে মিরাজে ঐ গতিতে যাত্রা করতে হয়েছে ফলে তাঁর দেহে ভরশূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। দ্বিতীয়ত এখানে প্রশ্ন আসে যে,তিনি কিরূপে কোন উপযোগী বাহন ব্যতিরেকে এ গতিতে যাত্রায় সক্ষম হলেন?

2. ভূমি হতে কয়েক কিলোমিটার ওপর হতে শ্বাস গ্রহণের উপযোগী বায়ু নেই। অর্থাৎ এর ঊর্ধ্বে যত ওপরে ওঠা হবে বায়ু ততই সূক্ষ্ম ও পাতলা হয়ে যাবে। ফলে শ্বাস-প্রশ্বাস কার্য সম্পাদন সম্ভব নয়। আরো ঊর্ধ্বে একেবারেই বায়ুর অস্তিত্ব নেই। তাই নবীর ঊর্ধ্বাকাশ ভ্রমণ অক্সিজেনের অভাবজনিত সমস্যার কারণে সম্ভব নয়।

3. আকাশের সকল উল্কা ও ক্ষতিকর রশ্মি পৃথিবীতে পৌঁছলে সকল কিছু ধ্বংস করে ফেলত। কিন্তু সেগুলো হয় ঊর্ধ্ব বায়ুমণ্ডলে গোলাকার রূপ ধারণ করে ধরিত্রীর চারিদিকে ঘূর্ণায়মান থাকে নতুবা একটি স্তরে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এ স্তরটি ধরিত্রীর রক্ষক আবরণরূপে কাজ করে। রাসূল (সা.) এ স্তর ভেদ করে উল্কাপিণ্ড ও ক্ষতিকর রশ্মিসমূহ থেকে কিভাবে নিজেকে সংরক্ষণে সক্ষম হয়েছেন?

4. বায়ুচাপ মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মানুষ নির্দিষ্ট বায়ুচাপে জীবন ধারণে সক্ষম যা ঊর্ধ্বলোকে অনুপস্থিত।

5. মহানবী (সা.)-এর ঊর্ধ্ব যাত্রার গতি নিঃসন্দেহে আলোর গতি অপেক্ষা বেশি ছিল। বর্তমানে প্রমাণিত হয়েছে কোন বস্তুই আলোর গতি351 অপেক্ষা অধিক গতিসম্পন্ন হতে পারে না। তাই আলোর গতি থেকেও দ্রূতগতিতে যাত্রা করে নবী (সা.) কিরূপে জীবিত থাকতে পারেন?

আমাদের উত্তর

যদি আমরা প্রাকৃতিক নিয়মকে সমস্যা বলে ধরি তবে এরূপ সমস্যার কোন সীমা নেই। আমরা এ প্রাকৃতিক নিয়মের বাধা দ্বারা কি বুঝাতে চাচ্ছি? আমরা কি এ প্রাকৃতিক নিয়মকে অতিক্রমের বিষয়টিকে অসম্ভব বলে বিবেচনা করব এবং বলব যে,এ নিয়মসমূহের লঙ্ঘন সত্তাগতভাবে অসম্ভব। অবশ্যই না। কারণ বর্তমানের নভোবিজ্ঞানীরা এ বিষয়টিকে সম্ভব বলে প্রমাণে সক্ষম হয়েছেন। 1957 সালে মহাশূন্যযান স্পুটনিক নিক্ষেপের মাধ্যমে অভিকর্ষ বলকে যে অতিক্রম করা সম্ভব তা প্রমাণিত হয়েছে। কৃত্রিম উপগ্রহ ও নভোযানে চড়ে মহাশূন্য পাড়ি দিয়ে মানুষ প্রমাণ করেছে মহাশূন্য পরিভ্রমণের প্রতিবন্ধকতাসমূহ বিজ্ঞানের কল্যাণে দূর করা সম্ভব। মানুষ তার জ্ঞানের দ্বারা অক্সিজেনের শূন্যতা,ক্ষতিকর রশ্মি,বায়ুচাপ ও অন্যান্য সমস্যা দূরীভূত করতে সক্ষম। বর্তমানে নভোবিজ্ঞানের বিস্তৃতির ফলে বিজ্ঞানীরা আশা করছেন খুব শীঘ্রই তাঁরা সৌরজগতের অন্য গ্রহেও অবতরণ ও ভ্রমণ করতে পারবেন।352

বিজ্ঞানের এ অভিযাত্রা প্রমাণ করেছে ঊর্ধ্ব যাত্রার বিষয়টি অসম্ভাব্যের পর্যায়ে পড়ে না। তবে যদি নবীর মিরাজ এরূপ বৈজ্ঞানিক উপকরণের অনুপস্থিতিতে কিরূপে সম্ভব হয়েছিল সে প্রশ্ন করা হয়,তাহলে উত্তরে আমরা বলব পূর্বে নবিগণের মুজিযা বিষয়ে,বিশেষত আবাবীল পাখির দ্বারা আবরাহার হস্তীবাহিনী ধ্বংসের আলোচনায় ঐশী সাহায্যে অলৌকিক ঘটনা সংঘটনের যে বিবরণ আমরা দিয়েছি তা হতে বিষয়টি স্পষ্ট হবে বলে আশা করি। যে কাজগুলো মানুষ তার জ্ঞান দ্বারা উদ্ভাবিত বৈজ্ঞানিক সরঞ্জামাদি দ্বারা সম্পাদন করে,নবিগণ তাঁদের প্রতিপালকের বিশেষ অনুগ্রহে বাহ্যিক উপকরণের সহযোগিতা ছাড়াই তা সম্পাদনে সক্ষম।

নবী (সা.) তাঁর প্রতিপালকের বিশেষ অনুগ্রহে মিরাজ সম্পন্ন করেছেন। মহান আল্লাহ্ সমগ্র অস্তিত্বজগতের অধিপতি এবং এ বিশ্বজগতের শৃঙ্খলা বিধানকারী। তিনিই এ পৃথিবীকে অভিকর্ষ বল দ্বারা সৃষ্টি করেছেন,বায়ুমণ্ডলের স্তরসমূহের বিন্যাস করেছেন এবং মহাশূন্যে বিভিন্ন রশ্মির বিকিরণ ঘটিয়েছেন। তাই তিনি যখন চান তখনই এগুলোর ক্রিয়াশক্তির বিলোপ সাধনে সক্ষম।

যখন মহানবী (সা.)-এর এ ঐতিহাসিক সফর স্রষ্টার বিশেষ অনুগ্রহের অধীনে সম্পন্ন হবে তখন তাঁর অসীম ক্ষমতার নিকট প্রাকৃতিক সকল নিয়ম আত্মসমর্পণ করবে এটিই স্বাভাবিক। কারণ এ সবই তাঁর ক্ষমতার অধীন। তাই তিনি তাঁর মনোনীত রাসূলকে পৃথিবী থেকে ঊর্ধ্বে নেয়ার উদ্দেশ্যে যদি পৃথিবীর অভিকর্ষ বলকে রহিত ও তাঁকে নিরাপদ রাখার লক্ষ্যে ক্ষতিকর উপাদানসমূহের ক্ষমতার অবলুপ্তি ঘটান তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। যে আল্লাহ্ অক্সিজেনের স্রষ্টা তিনি অক্সিজেনশূন্য স্তরে তাঁর প্রেরিত ব্যক্তির জন্য অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে কি সক্ষম নন? আল্লাহ্ কারণের উদ্গাতা ও বিলোপ সাধনকারী’ কথাটির অর্থ এটিই।

প্রকৃতপক্ষে মিরাজের বিষয়টি প্রাকৃতিক নিয়ম ও মানুষের ক্ষমতার বহির্ভূত একটি বিষয়। আল্লাহর ক্ষমতাকে আমাদের যোগ্যতা ও ক্ষমতার মানদণ্ডে বিচার করা কখনই উচিত হবে না। যদি আমরা কোন মাধ্যম ছাড়া কাজ করতে অক্ষম হই তাহলে এটি মনে করা ভুল হবে যে,অসীম ক্ষমতাবান স্রষ্টাও প্রাকৃতিক মাধ্যমের সাহায্য ব্যতীত তা করতে অক্ষম হবেন।

মৃতকে জীবিত করা,লাঠিকে সাপে পরিণত করা,গভীর সমুদ্রের নিচে মাছের পেটে হযরত ইউনুস (আ.)-কে জীবিত রাখা প্রভৃতি বিষয়ের সত্যতা বিভিন্ন ঐশীগ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে এবং এগুলোর বাস্তবতাকে স্বীকার মিরাজের বাস্তবতাকে স্বীকার হতে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে কম কঠিন নয়।

মোটকথা,সকল প্রাকৃতিক নিয়ম (কারণসমূহ) এবং বাহ্যিক প্রতিবন্ধকতাসমূহ মহান আল্লাহর ইচ্ছাশক্তি ও ক্ষমতার অধীন। তাঁর ইচ্ছাশক্তি কেবল সত্তাগত অসম্ভব বিষয়ের ওপর (বিষয়টির সত্তাগত অসম্ভাব্যতার কারণে) কার্যকর নয়। কিন্তু সত্তাগতভাবে সম্ভাব্য সকল বিষয়ের ওপর তাঁর ইচ্ছাশক্তি পূর্ণরূপে কার্যকর। সে ক্ষেত্রে মানুষের দ্বারা সেটি সম্ভব কি সম্ভব নয় তা আদৌ বিবেচ্য নয়।

অবশ্য এ বিষয়টিকে তারাই গ্রহণ করতে পারবে যারা আল্লাহকে তাঁর গুণাবলী থেকে যথার্থভাবে চিনতে পেরেছে এবং তাঁকে অসীম ক্ষমতাবান এক অস্তিত্ব হিসাবে মেনে নিয়েছে।

অস্তিত্বজগতের বিভিন্ন পর্যায়ে পরিভ্রমণের উদ্দেশ্য

এক ব্যক্তি ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.)-কে প্রশ্ন করে, আল্লাহর জন্য কোন স্থান নির্দিষ্ট রয়েছে কি? তিনি বললেন, না।? সে বলল, তবে কোন্ উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর রাসূলকে ঊর্ধ্বজগতে ভ্রমণ করালেন? তিনি বললেন, আল্লাহ্ স্থান ও কালের ঊর্ধ্বে। আল্লাহ্ মিরাজের মাধ্যমে চেয়েছেন ঊর্ধ্বজগতে তাঁর নবীর উপস্থিতির মাধ্যমে ফেরেশতা ও আকাশমণ্ডলীর অধিবাসীদের সম্মানিত করতে এবং তাঁর নবীকে বিশ্বজগতের ব্যাপকতা এবং তাঁর আশ্চর্য সৃষ্টিসমূহ-যা কোন চক্ষু কোন দিন অবলোকন করে নি ও কর্ণও কোন দিন শুনে নি তা দেখাতে যেন তিনি ফিরে এসে বিশ্ববাসীদের সে সম্পর্কে অবহিত করেন। 353

অবশ্যই সর্বশেষ নবীর জন্য এমন মর্যাদাকর স্থানই নির্দিষ্ট। তিনি যেন বিংশ শতাব্দীর যে সকল ব্যক্তি চন্দ্র ও মঙ্গল গ্রহের উদ্দেশে যাত্রা করছে তাদের লক্ষ্য করে বলছেন, আমি কোন মাধ্যম ছাড়াই এরূপ যাত্রা করেছি এবং আমার প্রভু আমাকে বিশ্বজগতের পরিচালনা ব্যবস্থা ও শৃঙ্খলা অবলোকন করিয়েছেন।”

তেইশতম অধ্যায় : তায়েফ যাত্রা