চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড3%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 106812 / ডাউনলোড: 9707
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

আকাবার দ্বিতীয় শপথ

মদীনার মুসলমানদের মধ্যে আশ্চর্য উদ্দীপনা দেখা দিয়েছিল। তারা হজ্বের সময়ের প্রহর গুনছিল। কারণ হজ্বের সময় মহানবী (সা.)-এর সান্নিধ্য লাভ সম্ভব হবে এবং তাঁর সেবায় যে তারা অধিকতর প্রস্তুত হয়েছে এ কথা ঘোষণা করার সুযোগ ঘটবে। সে সাথে পূর্বোক্ত চুক্তিনামার সম্প্রসারণের (পরিমাণ ও মান উভয় ক্ষেত্রেই) ইচ্ছাটি ব্যক্ত করার অভিপ্রায়ও ছিল। মদীনা থেকে পাঁচশ’ ব্যক্তির কাফেলা হজ্বের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। এ কাফেলায় ৭৩ জন মুসলমান ছিলেন যাঁদের দু জন ছিলেন নারী। কাফেলার অন্যান্য সদস্যও হয় ইসলামের প্রতি দুর্বল,নতুবা নিরপেক্ষ ছিল। মুসলমানগণ মক্কায় মহানবীর সঙ্গে দেখা করে বাইয়াত (চুক্তিবদ্ধ হওয়া) অনুষ্ঠানের সময় নির্ধারণের অনুরোধ জানালেন। নবী (সা.) তাঁদের বললেন, আমরা মিনায় পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হব। ১৩ জিলহজ্ব যখন সকলে ঘুমিয়ে পড়বে তখন আকাবা’র গিরিপথে আমরা সংলাপে বসব।”

১৩ জিলহজ্ব মহানবী (সা.) চাচা আব্বাসকে সঙ্গে নিয়ে সকলের পূর্বেই আকাবায় পৌঁছলেন। তখন রাত্রির একাংশ অতিবাহিত হয়েছে;আরবের মুশরিকরা ঘুমে বিভোর হয়ে পড়েছে। মুসলমানরা একের পর এক ধীরে ধীরে গোপনে আকাবার পথ ধরল। সকলে সমবেত হওয়ার পর রাসূলের চাচা আব্বাস প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করে রাসূল (সা.) সম্পর্কে বললেন, হে খাজরাজ গোত্রীয়গণ! তোমরা মুহাম্মদের দীনের প্রতি নিজেদের সহায়তার ঘোষণা দিয়েছ। তোমরা জেনে রাখ,সে তার গোত্রের নিকট সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তি। বনি হাশিমের সকল সদস্য তার প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত। কিন্তু এখন মুহাম্মদ তোমাদের মধ্যে অবস্থান করাকে শ্রেয় মনে করেছে। যদি তোমরা নিজ চুক্তির প্রতি দৃঢ় থাক এবং তাকে শত্রুর আক্রমণ হতে রক্ষা কর তাহলে সে তোমাদের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করতে পারবে। কিন্তু যদি কোন কঠিন অবস্থায় তাকে প্রতিরক্ষা করতে অক্ষম হও তাহলে এখনই তা বল। এতে সে পূর্ণ সম্মান ও মর্যাদা সহকারে স্বীয় গোত্রেই অবস্থান করবে।”

তখন বাররা ইবনে মা রুর দাঁড়িয়ে বললেন, আল্লাহর শপথ! আমরা মুখে যা বলেছি অন্তরে এর বিপরীত কিছু নেই। আমরা আমাদের কথার সত্যতা ও শপথ রক্ষায় বদ্ধপরিকর। নবীর পথে প্রাণপণ সংগ্রাম ব্যতীত অন্য কোন চিন্তা আমরা করছি না। অতঃপর খাজরাজগণ মহানবীর দিকে লক্ষ্য করে কিছু বলার অনুরোধ জানাল। নবী (সা.) কোরআনের কয়েকটি আয়াত পাঠের মাধ্যমে তাদেরকে ইসলাম ধর্মের প্রতি অধিকতর নিবেদিত ভূমিকা রাখতে অনুপ্রাণিত করলেন। অতঃপর বললেন, তোমাদের সঙ্গে এ মর্মে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছি যে,তোমরা তোমাদের পরিবার ও সন্তানদের যেরূপ প্রতিরক্ষা কর আমাকেও সেরূপ প্রতিরক্ষা করবে। ৩৬৩

এখানে লক্ষণীয় যে,নবী (সা.) তাঁকে রক্ষার জন্য চুক্তি করেছেন (প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন),আল্লাহর পথে যুদ্ধ ও সংগ্রামের (জিহাদের) প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেন নি। তিনি বদর যুদ্ধের সময় যতক্ষণ আনসারদের সম্মতি লাভ করেন নি ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধের ঘোষণা দেন নি।

তখন বাররা দ্বিতীয় বারের মতো উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমরা যুদ্ধে প্রশিক্ষিত এবং যুদ্ধের উপযোগী হয়েই গড়ে উঠেছি। এ বিষয়টি আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেছি। এ সময় খাজরাজগণের কণ্ঠে নবী (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসার প্রচণ্ড প্রকাশ লক্ষ্য করা গেল। তাদের উদ্বেলিত অভিব্যক্তি সমগ্র পরিবেশকে আচ্ছাদিত করল। কারো কারো কণ্ঠ উচ্ছাসে কিছুটা উচ্চ হলে রাসূলের চাচা আব্বাস (তাঁর হস্ত রাসূলের হস্তকে ধারণ করেছিল) বললেন, আমাদের পেছনে গুপ্তচর লেগে আছে। সুতরাং আস্তে কথা বল। এ সময় বাররা ইবনে মা রুর,আবুল হাইসাম ইবনে তাইহান এবং আসআদ ইবনে জুরারাহ্ স্বীয় স্থান হতে উঠে রাসূলের হাতে বাইয়াত করলেন। তাঁদের অনুসরণে বাকী সবাই একে একে বাইয়াত নিলেন।

আবুল হাইসাম বাইয়াতের সময় রাসূলকে বললেন, হে রাসূলাল্লাহ্! আমরা ইয়াহুদীদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। এখন থেকে তার তেমন মূল্য দেব না। আপনার জন্যই আমরা সব কিছু করছি। এমন যেন না হয় যে,আপনি আমাদের ছেড়ে একদিন নিজ গোত্রের নিকট ফিরে যাবেন। নবী (সা.) বললেন, তোমরা যাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছ আমি সে চুক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকব। অতঃপর বললেন, তোমাদের মধ্য হতে বারো ব্যক্তিকে প্রতিনিধি নির্বাচিত কর যাতে করে তারা তোমাদের সমস্যার চূড়ান্ত সমাধানদাতা হতে পারে। (যেমনটি মূসা ইবনে ইমরান (আ.) বনি ইসরাইলের জন্য করেছিলেন।) আনসার প্রতিনিধিগণ খাজরাজ গোত্র হতে নয় ব্যক্তি এবং আওস গোত্র হতে তিন ব্যক্তিকে নির্বাচিত করলেন। এ ব্যক্তিবর্গের নাম ইতিহাসে উল্লিখিত হয়েছে। অতঃপর বাইয়াত পর্বের সমাপ্তি ঘটলে রাসূল (সা.) তাদের প্রতিশ্রুতি দিলেন সুবিধাজনক সময়ে মক্কা হতে মদীনায় হিজরত করবেন। বৈঠকশেষে সকলে নিজ নিজ পথে ফিরে গেলেন।৩৬৪

আকাবা চুক্তির পর মুসলমানদের অবস্থা

এখানে একটি প্রশ্ন প্রণিধানযোগ্য যে,কেন মদীনার অধিবাসীরা ইসলামের আবির্ভাবের কেন্দ্র হতে দূরে থাকা সত্ত্বেও মাত্র কয়েকটি বৈঠকের ফলে ইসলামকে আপন করে নিয়েছিল,অথচ মক্কাবাসীরা নবীর অত্যন্ত নিকট সম্পর্র্কীয় হওয়া সত্ত্বেও তের বছর প্রচার তাদের মধ্যে কোন প্রভাব রাখতে পারে নি? এ পার্থক্যের কারণ দু টি বিষয় বলা যেতে পারে।

প্রথমত ইয়াসরিববাসীরা দীর্ঘদিন ইয়াহুদীদের প্রতিবেশী থাকার কারণে সব সময়ই বিভিন্ন বৈঠক ও সভায় আরবদের মধ্যে একজন নবীর আগমনের কথা শুনত। ইয়াহুদীরা ইয়াসরিবের মূর্তিপূজকদের উদ্দেশে বলত,ঐ আরবীয় নবী ইয়াহুদী ধর্মকে প্রচার করবেন এবং বিশ্ব হতে মূর্তিপূজাকে রহিত করবেন। এরূপ সংলাপ ইয়াসরিবের অধিবাসীদের নতুন এ ধর্মকে গ্রহণের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছিল ও তারা এর প্রতীক্ষায় ছিল। বিষয়টি তাদেরকে এতটা প্রস্তুত করেছিল যে,তারা নবী (সা.)-এর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই ঈমান আনে ও নিজেদের মধ্যে কথোপকথনে বলে যে,ইনিই সেই প্রতিশ্রুত নবী যাঁর প্রতীক্ষায় ইয়াহুদীরা রয়েছে। তাই আমাদের উচিত হবে এ ক্ষেত্রে তাদের হতে অগ্রগামী হওয়া।

এ কারণেই পবিত্র কোরআন ইয়াহুদীদের সমালোচনা করে বলেছে,তোমরা মূর্তিপূজকদের আরব নবীর আগমনের কথা বলে ভীতি প্রদর্শন করতে এবং লোকদের তাঁর আগমনের সুসংবাদ দিতে। তোমরা তাওরাত হতে তাঁর আবির্ভাবের নিদর্শনসমূহ পড়ে শুনাতে। তবে কেন এখন তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছ? কোরআন বলেছে,

) و لَمّا جاءهم كتاب مّن عند الله مصدّق لما معهم و كانوا من قبل يستفتحون على الّذين كفروا فلمّا جاءهم ما عرفوا كفروا به فلعنة الله على الكافرين(

“যখন আল্লাহর পক্ষ হতে তাদের নিকট গ্রন্থ (কোরআন) প্রেরিত হলো যা তাদের নিকট বিদ্যমান গ্রন্থকে (তাওরাত) সত্যায়ন করে এবং তারা এর মাধ্যমে কাফিরদের (মূর্তিপূজক) ওপর বিজয়ী হওয়ার প্রতীক্ষায় ছিল। অতঃপর যখন তা আসল পূর্ব হতে তারা সে বিষয়ে জানার পরও তা অস্বীকার (গোপন) করল। কাফিরদের ওপর আল্লাহর লানত বর্ষিত হোক। (সূরা বাকারা : ৮৯)

দ্বিতীয় যে কারণটি মদীনাবাসীদের ইসলাম গ্রহণের পেছনে ভূমিকা রেখেছিল তা হলো দীর্ঘ একশ বিশ বছরের গোত্রীয় দ্বন্দ্ব তাদেরকে দৈহিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলেছিল,তারা জীবনের প্রতি হতাশ হয়ে পড়েছিল এবং মুক্তির আশা হারিয়ে ফেলেছিল। তাদের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধসমূহের মধ্যে শুধু বুয়া সের যুদ্ধের ইতিহাস পড়লেই তাদের প্রকৃত অবস্থা আমাদের দৃষ্টিতে ফুটে উঠবে। এ যুদ্ধে প্রথমে আওসরা পরাজিত হয় এবং নজদে পলায়নে বাধ্য হয়। বিজয়ী খাজরাজগণ তাদের তীব্র সমালোচনা করে। আওস গোত্রপতি হুজাইর এতে ভীষণভাবে মর্মাহত হন। তিনি নজদে পৌঁছে নিজ অশ্ব হতে অবতরণ করে নিজ গোত্রের উদ্দেশে বক্তব্যে বলেন, খোদার শপথ! নিহত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ করব। হুজাইরের দৃঢ়তা তাঁর গোত্রের পরাজিত সৈনিকদের আত্মরক্ষা,সাহসিকতা ও হৃত মর্যাদা পুনরুদ্ধারে উৎসাহিত করে। তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে কোন মূল্যে নিজেদের অধিকার রক্ষা করবে এবং মদীনায় ফিরে আসবে। তারা জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করে। আত্মোৎসর্গী দল সকল সময় বিজয়ী হয়-এ সত্যটি পরাজিত আওসরা আবার প্রমাণ করে। তারা খাজরাজদের পরাজিত করে এবং তাদের খেজুর বাগানসমূহ জ্বালিয়ে দেয়।

এরপর আওস ও খাজরাজদের মধ্যে পালাক্রমে যুদ্ধ ও সন্ধি হতে থাকে। তাদের জীবন সহস্র অপ্রীতিকর ও ক্লান্তিদায়ক ঘটনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এ অবস্থা উভয় গোত্রের জন্যই অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় ছিল এবং তারা অসন্তুষ্টির চরম সীমায় পৌঁছেছিল। তারা মুক্তির পথ ও আশার আলো খুঁজছিল। এ কারণেই খাজরাজের ঐ ছয় ব্যক্তি নবী (সা.)-এর কথায় তাদের হারানো বস্তুর সন্ধান পেয়েছিল এবং অভিব্যক্তি করেছিল যে,সম্ভবত আল্লাহ্ আপনার মাধ্যমে আমাদের অশান্তির অবসান ঘটাবেন এবং মুক্তি দেবেন। এ সকল কারণেই ইয়াসরিবের অধিবাসীরা উদার চিত্তে ইসলামকে গ্রহণ করেছিল।

আকাবা চুক্তি ও কুরাইশদের প্রতিক্রিয়া

যেহেতু ইসলাম মক্কায় তেমন প্রসার লাভ করে নি সেহেতু কুরাইশরা ভেবেছিল ইসলাম ক্রমাবনতির দিকে এগুচ্ছে ও অচিরেই এর প্রদীপ নিভে যাবে। এ কারণে তারা ইসলামের প্রতি অনেকটা উদাসীন হয়ে পড়েছিল। তাই দ্বিতীয় আকাবার চুক্তিটি কুরাইশদের কাছে এক বিস্ফোরণের মতো মনে হয়েছিল। যখন তারা জানতে পারল ইয়াসরিবের তিয়াত্তর ব্যক্তি রাসূলের সঙ্গে এ মর্মে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে যে,তাকে নিজ সন্তানের ন্যায় প্রতিরক্ষা করবে তখন তাদের হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার হলো। তারা বুঝতে পারল মুসলমানরা আরব উপদ্বীপের কেন্দ্রে ঘাঁটি স্থাপন করতে যাচ্ছে। তারা আশংকা করল মুসলমানরা তাদের সমগ্র শক্তিকে যা এতদিন বিক্ষিপ্ত ছিল তা কেন্দ্রীভূত করে একত্ববাদী ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে এবং এতে মক্কার মূর্তিপূজা হুমকির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে।

কুরাইশ গোত্রের প্রধান ব্যক্তিবর্গ পরদিন সকালে বিষয়টি জানার পর নিশ্চিত হওয়ার লক্ষ্যে খাজরাজ গোত্রের হজ্বযাত্রীদের নিকট গিয়ে বলল, আমরা জানতে পেরেছি তোমরা গত রাতে মুহাম্মদের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছ এবং তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছ যে,আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। খাজরাজগণ শপথ করে বলল, আমরা কখনই চাই না তোমাদের ও আমাদের মধ্যে যুদ্ধের অগ্নি প্রজ্বলিত হোক।”

ইয়াসরিবের হজ্ব কাফেলায় প্রায় পাঁচশ’ লোক ছিল। তাদের মধ্যে মাত্র তিয়াত্তর জন পূর্ব রাত্রিতে রাসূলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। অন্যরা সে সময় ঘুমে অচেতন ছিল এবং এ ঘটনা সম্পর্কে অবহিত ছিল না। যেহেতু তারা মুসলমান ছিল না তাই বিষয়টি তাদের জানা ছিল না। এ কারণে তারা শপথ করে এ ধরনের ঘটনাকে অস্বীকার করে বিষয়টিকে মিথ্যা বলে ঘোষণা করল। খাজরাজ নেতা আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই সমগ্র ইয়াসরিবের ওপর যার নেতৃত্বের প্রস্তুতি চলছিল সে বলল, এ ধরনের কোন ঘটনাই ঘটে নি এবং খাজরাজ গোত্রের লোকেরা আমার পরামর্শ ব্যতিরেকে এমন কাজ করতে পারে না। কুরাইশ দলপতিরা বিষয়টিকে আরো খতিয়ে দেখার জন্য অন্যদেরও প্রশ্ন করতে লাগল। সেখানে যে সব মুসলমান উপস্থিত ছিলেন তাঁরা বুঝলেন তাঁদের গোপন বৈঠকের বিষয়টি ফাঁস হয়ে গেছে। তাই সময়ের অপচয় না করে নিজেরা পরিচিত হওয়ার পূর্বেই মক্কা ত্যাগের পরিকল্পনা নিলেন ও ত্বরিৎ মদীনার পথ ধরলেন।

নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই বেশ কিছু মদীনাবাসীর মক্কা ত্যাগের বিষয়টি কুরাইশদের সন্দেহকে (চুক্তি হওয়া) আরো ঘনীভূত করল। তারা বুঝতে পারল যে,তারা সঠিক তথ্যই পেয়েছে। ফলে তারা ইয়াসরিববাসীদের পশ্চাদ্ধাবনে তৎপর হলো। কিন্তু এতে তারা তেমন সফল হলো না। কারণ প্রায় সকল ইয়াসরিববাসী তাদের সীমার বাইরে চলে গিয়েছিল। শুধু সা দ ইবনে উবাদা নামক এক ব্যক্তিকে তারা ধরতে সক্ষম হয়েছিল। অবশ্য ঐতিহাসিক ইবনে হিশামের মতে দু ব্যক্তিকে তারা নাগালে পেয়েছিল। তাদের একজন হলো সা দ ইবনে উবাদা এবং অপর জন হলো মুনজির ইবনে উমার। দ্বিতীয় জন তাদের হাত থেকে ছুটে পালায়। কুরাইশরা হিংস্রতার সাথে সা দ ইবনে উবাদার মাথার চুল ধরে টানতে লাগল ও তাঁকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল। কুরাইশদের এক ব্যক্তি তাঁর এ অবস্থাদৃষ্টে সহানুভূতিশীল হয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করল, মক্কার কোন ব্যক্তির সঙ্গে তোমার কি চুক্তি নেই? তিনি বললেন, হ্যাঁ। মুতয়েম ইবনে আদীর সঙ্গে আমার নিরাপত্তা চুক্তি রয়েছে। কারণ আমি ইয়াসরিবের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় তার জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান করতাম।”

এ কথা শুনে কুরাইশ ব্যক্তিটি তাঁকে মুক্তি দানের উদ্দেশ্যে মুতয়েম ইবনে আদীর শরণাপন্ন হলো এবং তাঁকে বলল, খাজরাজ গোত্রের এক ব্যক্তি বন্দী হয়েছে এবং কুরাইশরা তাকে নির্যাতন করছে। সে তোমার সাহায্য কামনা করছে ও তোমার সাহায্যের অপেক্ষায় রয়েছে। মুতয়েম ঐ ব্যক্তির সঙ্গে উক্ত স্থানে এসে দেখল ব্যক্তিটি অন্য কেউ নয় সা দ ইবনে উবাদা যাঁর নিরাপত্তায় মুতয়েমের বাণিজ্য কাফেলা নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছায়। তিনি তাঁকে কুরাইশদের হাত থেকে মুক্তি দিয়ে ইয়াসরিবে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। সা দ ইবনে উবাদার বন্দী হওয়ার বিষয়টি অন্যান্য মুসলমান ও তাঁর বন্ধুরা ইতোমধ্যে জেনেছিলেন। তাঁরা তাঁকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে মক্কায় ফিরে আসার পরিকল্পনা করছিলেন। এমন সময় তাঁরা সা দকে ফিরে আসতে দেখলেন। সা দ তাঁদের নিকট নিজ করুণ অবস্থার বর্ণনা দান করলেন।৩৬৫

ইসলামের নৈতিক প্রভাব

প্রাচ্যবিদরা প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকেন ইসলামের প্রসার ও প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি তরবারীর মাধ্যমে হয়েছিল তা প্রমাণ করার জন্য। এ দাবি কতটা ভিত্তিহীন পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ তা প্রমাণ করবে। আমরা এর উদাহরণ হিসাবে হিজরতের পূর্বে ইয়াসরিবে কি ঘটেছিল তা পাঠকদের সামনে এখানে উপস্থাপন করছি। এতে স্পষ্টরূপে প্রমাণিত হবে যে,ইসলামের প্রচার ও প্রসার প্রথম থেকেই এর আকর্ষণীয় আহবানের ফলশ্রুতিতে ঘটেছিল। এর আহবান যে কোন শ্রোতাকেই আকৃষ্ট করত। ইসলামের প্রসিদ্ধ মুখপাত্র ও প্রচারক মুসআব ইবনে উমাইর রাসূল (সা.)-এর পক্ষ হতে মদীনায় দীন প্রচারের ও শিক্ষাদানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন।

তিনি আসআদ ইবনে জুরারার আমন্ত্রণে রাসূলের পক্ষ হতে প্রেরিত হয়েছিলেন। এ দু ব্যক্তি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন ইয়াসরিবের প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদেরকে যুক্তি-প্রমাণের মাধ্যমে ইসলামের দিকে দাওয়াত দেবেন। একদিন তাঁরা মদীনার এক বাগানে মুসলমানদের সমাবেশে পৌঁছে দেখলেন সেখানে বনি আবদুল আশহাল গোত্রের দু প্রধান ব্যক্তি সা দ ইবনে মায়ায এবং উসাইদ ইবনে হাদ্বিরও রয়েছেন। এ সময় সা দ ইবনে মায়ায উসাইদকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমার তরবারি কোষমুক্ত কর এবং এ দু ব্যক্তির সামনে গিয়ে বল তারা যেন ইসলাম প্রচার করা হতে বিরত হয় ও নিজ বক্তব্যের মাধ্যমে আমাদের সহজ-সরল মানুষদের প্রতারিত না করে। তোমাকে এটি করতে বলার কারণ আমি খোলা অস্ত্র হাতে আসআদ ইবনে জুরারার মুখোমুখি হতে চাই না যেহেতু সে আমার খালাতো ভাই।”

উসাইদ উত্তেজিত ভঙ্গিতে তরবারি উন্মোচিত করে তাঁদের দু জনের সামনে উপস্থিত হয়ে কঠোর ভাষায় সা দ-এর উদ্ধৃত কথাগুলো পুনরাবৃত্তি করলেন। রাসূলের হাতে প্রশিক্ষিত দীন প্রচারক বাগ্মী মাসআব ইবনে উমাইর শান্ত কণ্ঠে তাঁকে বললেন, আমরা কি কিছু সময় সংলাপের জন্য বসতে পারি? যদি আমাদের কথা তোমার পছন্দ না হয় তাহলে আমরা যে পথে এসেছি সে পথেই ফিরে যাব। উসাইদ বললেন, যুক্তিপূর্ণ ও ন্যায্য কথা বলেছ। অতঃপর নিজ তরবারি কোষাবদ্ধ করে তাঁদের কথা শোনার জন্য কিছুক্ষণ বসলেন। মুসআব কোরআনের কয়েকটি আয়াত তেলাওয়াত করে ব্যাখ্যা দিলেন। একদিকে পবিত্র কোরআনের সুমধুর ও আকর্ষণীয় বাণী,অন্যদিকে মাসআবের যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য তাঁকে আকৃষ্ট করল। সে আত্মহারা হয়ে বলল,

كيف تصنعون إذا أردتم أن تدخلوا هذا الدّين

“কিভাবে এ দীনে প্রবেশ করা যায় (তোমরা প্রবেশ করেছ)? তাঁরা বললেন, আল্লাহর একত্বের সাক্ষী দাও,নিজ দেহ ও পোশাক পানি দ্বারা পবিত্র কর এবং নামায পড়।”

উসাইদ ইতিপূর্বে তাঁদের দু জনের রক্ত ঝরানোর উদ্দেশ্যে আসলেও এখন মুক্ত মনে আল্লাহর একত্ব ও রাসূলের নবুওয়াতের সাক্ষ্য দিলেন। নিকটবর্তী পানির আধার হতে পানি নিয়ে নিজ দেহ ও পোশাক পবিত্র করলেন এবং কালেমা পড়তে পড়তে সা দের নিকট এসে উপস্থিত হলেন। সা দ ইবনে মায়ায অধৈর্য হয়ে উসাইদের অপেক্ষায় বসেছিলেন। আকস্মিকভাবে উসাইদ হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে এলেন। সা দ ইবনে মায়ায তাঁর হাস্যোজ্জ্বল চেহারা দেখে সকলের উদ্দেশে বললেন,নিঃসন্দেহে উসাইদ তার ধর্মবিশ্বাস পরিবর্তন করেছে এবং যে উদ্দেশ্যে গিয়েছিল তাতে সফল হয় নি। উসাইদ পুরো ব্যাপারটি তাঁর নিকট বর্ণনা করলে সা দ ক্রোধে ফেটে পড়লেন এবং সিদ্ধান্ত নিলেন,যে করেই হোক এ দু ব্যক্তিকে দীন প্রচারের কাজ থেকে বিরত করবেন। কিন্তু উসাইদের ন্যায় তিনিও একই পরিণতির শিকার হলেন। তিনি মাসআবের প্রাঞ্জল,যুক্তিপূর্ণ,দৃঢ় ও আকর্ষণীয় বক্তব্যের দ্বারা প্রভাবিত হলেন। নিজ সিদ্ধান্তের জন্য মনে মনে অনুশোচনা করলেন এবং তার ক্রোধ প্রশমিত হয়ে সৌহার্দ্যে পরিণত হলো। তিনি একত্ববাদী ধর্ম ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং ঐ স্থানেই গোসল করে নিজ পোশাক ধৌত ও পবিত্র করে নিজ গোত্রে ফিরে এসে তাদের উদ্দেশে বললেন, তোমাদের মাঝে আমার অবস্থান কোথায়? তারা বলল, তুমি আমাদের গোত্রের প্রধান। তিনি বললেন, আমি আমার গোত্রের কোন পুরুষ বা নারীর সঙ্গে কোন কথা বলব না যতক্ষণ না তারা ইসলাম ধর্মকে গ্রহণ করে। গোত্র প্রধানের এ বক্তব্য গোত্রের সকলের মুখে মুখে প্রচারিত হতে লাগল এবং নবীকে স্বচক্ষে দেখার পূর্বেই একত্ববাদী এ ধর্মের প্রতিরক্ষায় তারা রত হলো।৩৬৬

ইসলামের ইতিহাসের এরূপ অসংখ্য উদাহরণ আমাদের নিকট রয়েছে যেগুলো প্রাচ্যবিদদের ইসলাম প্রসারের তথাকথিত ধারণাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। কারণ এ ঘটনাসমূহে না কোন শক্তি প্রয়োগের চি‎‎ হ্ন রয়েছে,না প্রমাণ রয়েছে অস্ত্র ব্যবহারের ও স্বাধীনতা হরণের। তারা নবীর কথাও শোনে নি,নবীকে দেখেও নি তদুপরি নবীর প্রেরিত এক প্রচারকের যুক্তিপূর্ণ কথায় কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তাদের ব্যাপক মানসিক পরিবর্তন ঘটেছিল। অন্য কোন কারণ সেখানে প্রভাব রাখে নি।

কুরাইশদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার

ইয়াসরিববাসীদের পক্ষ থেকে মুসলমানদের পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতার বিষয়টি কুরাইশদের উদাসীনতার ঘুম ভেঙে দিল। ফলে তারা নতুন করে মুসলমানদের নির্যাতন ও নিপীড়নের মাধ্যমে ইসলামের প্রসারের পথকে রুদ্ধ করার পরিকল্পনা করল।

মহানবী (সা.)-এর সাহাবিগণ মুশরিকদের নির্যাতনের বিষয়ে নবীর নিকট অভিযোগ করলেন। তাঁরা নবীর নিকট অন্য স্থানে হিজরত করার অনুমতি চাইলেন। নবী তাঁদের নিকট কয়েক দিনের সময় নিলেন। অতঃপর বললেন, তোমাদের হিজরতের জন্য সর্বোত্তম স্থান হলো ইয়াসরিব। তোমরা একে একে প্রশান্ত চিত্তে সেখানে চলে যাও। রাসূলের নির্দেশ পাওয়ার পর মুসলমানরা বিভিন্ন বাহানা দেখিয়ে একে একে মক্কা থেকে বেরিয়ে গেলেন ও মদীনার পথ ধরলেন। কুরাইশরা কিছু দিনের মধ্যেই বিষয়টি আঁচ করতে পারল এবং মুসলমানদের বহির্গমন রোধের পরিকল্পনা নিল। তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল মক্কা হতে কোন মুসলমানকে বেরিয়ে যেতে দেখলে তাকে জোরপূর্বক ফিরিয়ে আনা হবে এবং যদি বহির্গামী ব্যক্তিটির স্ত্রী ও সন্তান কুরাইশ বংশোদ্ভূত হয় ও সে তাদের সঙ্গে নিয়ে হিজরত করছে জানা যায় তবে তার স্ত্রীর বহির্গমনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। তবে কুরাইশরা কিছুটা ভীতও হয়েছিল। সে কারণে কাউকে হত্যা করা থেকে বিরত ছিল এবং হিজরত করছে এমন কোন ব্যক্তিকে পেলে তাকে বন্দী করা ও শারীরিক কিছু নির্যাতন করা ব্যতীত অন্য কিছু করত না। অবশ্য কুরাইশদের এ পরিকল্পনা তেমন সফল হয় নি।৩৬৭

অবশেষে দেখা গেল অনেকেই কুরাইশদের হাত গলিয়ে বেরিয়ে গেছেন এবং ইয়াসরিবে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছেন। কিছু দিনের মধ্যে অবস্থা এমন দাঁড়াল যে,মক্কায় নবী (সা.),হযরত আলীসহ কিছু বন্দী ও অসুস্থ মুসলমান ব্যতীত কেউই অবশিষ্ট রইল না। এ অবস্থা লক্ষ্য করে কুরাইশরা আরো শঙ্কিত হলো এবং তারা ইসলামের বিস্তার রোধের উদ্দেশ্যে দারুন নাদওয়া’ নামক মন্ত্রণাকক্ষে সভায় মিলিত হলো। তারা এ উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রস্তাব রাখল। কিন্তু তাদের সকল পরিকল্পনাই রাসূলের বিশেষ ব্যবস্থাপনার নিকট পরাস্ত হলো। পরিশেষে মহানবী (সা.) নবুওয়াতের চতুর্দশ বর্ষের রবিউল আউয়াল মাসে মদীনায় হিজরত করলেন।

রাসূল (সা.)-এর হিজরতকে বানচাল করার সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় এবং মুসলমানরা দ্বিতীয় প্রচার কেন্দ্র হস্তগত করায় তারা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। মক্কায় যে সকল মুসলমান অবশিষ্ট ছিলেন মহানবী তাঁদের মদীনায় হিজরত করে আনসারদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার নির্দেশ দিলেন এবং বললেন, আল্লাহ্ তোমাদের জন্য একদল ভাই সৃষ্টি করে দিয়েছেন এবং বাসস্থানও প্রস্তুত করেছেন।”

পঁচিশতম অধ্যায় : হিজরতের প্রথম বছরের ঘটনাপ্রবাহ

পঞ্চম অধ্যায় : বিশ্বনবী মুহাম্মদ মুস্তাফা (সা.)-এর শুভ জন্ম

এক মহান তারা ঝিলমিল করল ও সভার মধ্যমণি হলো

আমাদের ব্যথিত অন্তরের অন্তরঙ্গ বন্ধু ও সুহৃদ হলো।

জাহেলিয়াতের কালো মেঘ সমগ্র আরব উপদ্বীপের ওপর ছায়া মেলে রেখেছিল। অসৎ ও ঘৃণ্য কার্যকলাপ,রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ-বিগ্রহ,লুটতরাজ ও সন্তান হত্যা সব ধরনের নৈতিক গুণের বিলুপ্তি ঘটিয়েছিল। তাদের জীবন-মৃত্যুর মধ্যকার ব্যবধান মাত্রাতিরিক্তভাবে সংক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এহেন পরিস্থিতিতে সৌভাগ্যরবি উদিত হলো এবং সমগ্র আরব উপদ্বীপ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শুভ জন্মোপলক্ষে আলোকোজ্জ্বল হয়ে গেল। আর এ পথেই একটি অনগ্রসর জাতির সৌভাগ্যের ভিত্তিও স্থাপিত হলো। অনতিবিলম্বে এ নূরের বিচ্ছুরণে সমগ্র জগৎ আলোকোদ্ভাসিত হলো এবং সমগ্র বিশ্বে এক সুমহান মানব সভ্যতার ভিত্তিও নির্মিত হয়ে গেল।

মহান মনীষীদের শৈশব

প্রত্যেক মহামানব ও মনীষীর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় গভীরভাবে অধ্যয়ন করা উচিত। কখনো কখনো কোন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব এতটা মহান ও ব্যাপক যে,তাঁর জীবনের সমস্ত অধ্যায়,এমনকি তাঁর শৈশব ও মাতৃস্তন্য পান করার সময়কালের প্রতিও বিশেষ দৃষ্টি দেয়া হয়। যুগের প্রতিভাবান ব্যক্তিবর্গ,সমাজের নেতৃবৃন্দ ও সভ্যতার কাফেলার অগ্রবর্তীদের জীবন সাধারণত আকর্ষণীয়,সংবেদনশীল ও আশ্চর্যজনক পর্যায় ও দিক সম্বলিত। তাঁদের জীবনের প্রতিটি ছত্র যেদিন তাঁদের ভ্রুণ মাতৃজঠরে স্থাপিত হয় সেদিন থেকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রহস্যাবৃত। আমরা বিশ্বের মহামানবদের শৈশব ও বাল্যকাল অধ্যয়ন করলে দেখতে পাই যে,তা আশ্চর্যজনক ও অলৌকিক বিষয়াদি দিয়ে ভরপুর। আর আমরা যদি এ ধরনের বিষয় বিশ্বের সেরা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে মেনে নিই তাহলে মহান আল্লাহর প্রিয় নবী ও ওলীদের ক্ষেত্রে এতদসদৃশ বিষয়াদি মেনে নেয়াও খুব সহজ হবে।

পবিত্র কোরআন হযরত মূসা (আ.)-এর শৈশব ও বাল্যকাল অত্যন্ত রহস্যময় বলে ব্যাখ্যা করেছে এবং এ প্রসঙ্গে বলেছে : মূসা (আ.) যাতে জন্মগ্রহণ করতে না পারে সেজন্য ফিরআউন সরকারের নির্দেশে শত শত নিষ্পাপ শিশুর শিরোচ্ছেদ করা হয়েছিল। মূসা (আ.)-এর জন্মগ্রহণ ও এ পৃথিবীতে আগমনের সাথেই মহান আল্লাহর ঐশী ইচ্ছা জড়িত হয়েছিল বিধায় শত্রুরা তাঁর ক্ষতিসাধন তো করতে পারেই নি,বরং তাঁর সবচেয়ে বড় শত্রুও (ফিরআউন) তাঁর প্রতিপালনকারী ও পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হয়েছিল। পবিত্র কোরআন এরশাদ করেছে : আমরা মূসার মাকে ওহী করেছিলাম যে,সন্তানকে একটি বাক্সে রেখে সমুদ্রে ফেলে দাও,তাহলে সমুদ্রের তরঙ্গ ওকে মুক্তির সৈকতে পৌঁছে দেবে। আমার ও তার শত্রু তার প্রতিপালন করবে;আমি শত্রুর বুকে তার প্রতি গভীর ভালোবাসা ও মমত্ববোধের উদ্ভব ঘটাব। আর এভাবে আমি পুনরায় তোমার সন্তানকে তোমার কাছেই ফিরিয়ে দেব।”

মূসার বোন ফিরআউনের দেশে গিয়ে বলল, আমি এক মহিলার সন্ধান দেব যে আপনাদের প্রিয় এ শিশুটির লালন-পালনের দায়িত্ব নিতে পারে। তাই ফিরআউন-সরকারের পক্ষ থেকে মূসার মা তাদের (ফিরআউনের) প্রিয় শিশুর (মূসার) লালন-পালনের দায়িত্বভারপ্রাপ্ত হলেন। 124

হযরত ঈসা (আ.)-এর মাতৃগর্ভে বিকাশ,জন্মগ্রহণ এবং লালন-পালনকাল হযরত মূসা (আ.)-এর চেয়েও অধিকতর আশ্চর্যজনক। পবিত্র কোরআন হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্ম ও শৈশব কাল বর্ণনা করে বলেছে, ঈসার মা মরিয়ম নিজ সম্প্রদায় থেকে পৃথক হয়ে গেলেন। পবিত্র আত্মা (জিবরাইল) মানুষের আকৃতি ধারণ করে তাঁর সম্মুখে প্রকাশিত হলেন এবং তাঁকে সুসংবাদ দিলেন যে,আপনাকে একটি পবিত্র সন্তান দানের জন্য আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে।” মরিয়ম তখন আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললেন, কেউ আমাকে স্পর্শ করে নি এবং আমিও তো ব্যভিচারিণী নই।” আমাদের দূত তখন বললেন, এ কাজ মহান আল্লাহর কাছে অত্যন্ত সহজ।” পরিশেষে মহান আল্লাহর নির্দেশে ঈসা মসীহর নূর হযরত মরিয়মের গর্ভে স্থাপিত হলো। প্রসববেদনা তাঁকে খেজুর গাছের দিকে নিয়ে গেল। তিনি তাঁর নিজ অবস্থার ব্যাপারে দুঃখভারাক্রান্ত ছিলেন। আমরা বললাম, খেজুর গাছ বাঁকাও,তাহলে তাজা খেজুর নিচে পড়বে।” সন্তান জন্মগ্রহণ করলে মরিয়ম নবজাতক সন্তানসহ নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে আসলেন। আশ্চর্যান্বিত হয়ে জনগণের মুখের ভাষা যেন থেমে গিয়েছিল। এরপর মরিয়মের উদ্দেশ্যে তীব্র প্রতিবাদ,আপত্তি ও অসন্তোষের ঝড় উঠেছিল। মরিয়মকে পূর্বেই মহান আল্লাহ্ নির্দেশ দিয়েছিলেন যাতে করে তিনি বুঝিয়ে দেন যে,তারা যেন এই শিশুকে তাদের সকল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে। তারা বলেছিল, যে দুগ্ধপোষ্য শিশু দোলনায় শায়িত সে কি কথা বলতে সক্ষম? তখন হযরত ঈসা (আ.) ঠোঁট খুলে বলে উঠলেন, আমি মহান আল্লাহর বান্দা (দাস)। তিনি আমাকে কিতাব (ঐশী গ্রন্থ) দিয়েছেন এবং আমাকে নবীদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। 125

পবিত্র কোরআন,তাওরাত ও হযরত ঈসার অনুসারিগণ যখন এ দু মহান উলূল আযম নবী সংক্রান্ত যাবতীয় উল্লিখিত বিষয়ের সত্যতা সম্পর্কে সাক্ষ্য প্রদান করে তখন ইসলামের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শুভ জন্মোপলক্ষে যেসব আশ্চর্যজনক বিষয় ঘটেছিল সে সব ব্যাপারে বিস্মিত হওয়া এবং সেগুলোকে ভাসাভাসা ও অগভীর বলে বিবেচনা করা অনুচিত। আমরা হাদীস ও ইতিহাস গ্রন্থসমূহে দেখতে পাই :

মহানবীর জন্মগ্রহণের মুহূর্তে সম্রাট খসরুর প্রাসাদের দ্বারমণ্ডপ (ايوان ) ফেটে গিয়েছিল এবং এর কয়েকটি স্তম্ভ ধসে পড়েছিল। ফারস প্রদেশের অগ্নি উপাসনালয়ের প্রজ্বলিত অগ্নি নিভে গিয়েছিল। ইরানের সাভেহর হরদ শুকিয়ে গিয়েছিল। পবিত্র মক্কার প্রতিমালয়সমূহে রক্ষিত মূর্তি ও প্রতিমাসমূহ মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। তাঁর দেহ থেকে নূর (আলো) বের হয়ে তা আকাশের দিকে উত্থিত হয়েছিল যার রশ্মি ফারসাখের পর ফারসাখ (মাইলের পর মাইল) পথ আলোকিত করেছিল। সম্রাট আনুশিরওয়ান ও পুরোহিতগণ অতি ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দর্শন করেছিলেন।

মহানবী (সা.) খতনাকৃত ও নাভি কর্তিত অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তিনি বলেছিলেন :

الله أكبر و الحمد لله كثيرا سبحان الله بكرة و أصيلا

“আল্লাহ্ মহান,সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর,সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করছির।”

এ সব বিষয় ও তথ্য সকল মৌলিক নির্ভরযোগ্য হাদীস ও ইতিহাস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।126 হযরত মূসা ও হযরত ঈসার ব্যাপারে যে সব বিষয় আমরা বর্ণনা করেছি সেগুলো বিবেচনায় আনলে এ ধরনের ঘটনাসমূহ মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে সন্দেহ করার কোন অবকাশ থাকে না।

এখন প্রশ্ন করা যায় যে,এ ধরনের অলৌকিক ও অসাধারণ ঘটনাবলীর প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যই বা কি ছিল? এ প্রশ্নের জবাবে সংক্ষেপে অবশ্যই বলতে হয় : যেমনভাবে আমরা আলোচনা করেছি ঠিক তেমনি এ ধরনের অস্বাভাবিক ও অলৌকিক ঘটনাবলী কেবল মহানবী (সা.)-এর সাথেই বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট নয়,বরং অন্যান্য নবী-রাসূলের জন্মগ্রহণের সাথেও সম্পর্কযুক্ত ছিল। পবিত্র কোরআন ছাড়াও অন্য সকল জাতি,বিশেষ করে ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টান জাতির ইতিহাস তাদের নিজেদের নবীদের ব্যাপারে এ ধরনের বহু অলৌকিক ঘটনা বর্ণনা করেছে।

এ ছাড়াও এ ধরনের ঘটনাবলী ঐ সব অত্যাচারী ও স্বৈরাচারী শাসকের অনুভূতিকে জাগ্রত করে যারা বিভিন্ন জাতিকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রেখেছে। এ সব অত্যাচারী ক্ষমতাধর শাসক এ সব ঘটনা সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করে নিজেদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করতে উদ্বুদ্ধ হবে যে,কি হয়েছিল যে,একজন বৃদ্ধা রমণীর মাটি নির্মিত ঘরে চির ধরে নি,অথচ সম্রাট খসরু পারভেজের রাজপ্রাসাদের বৃহৎ বৃহৎ স্তম্ভ ধ্বসে পড়েছিল? ইরানের ফারস প্রদেশের অগ্নিমন্দিরের আগুন (অগ্নি প্রজ্বলিত থাকার) সকল উপকরণ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও কেন নিভে গিয়েছিল,অথচ তখন সব জিনিসই স্ব স্ব স্থানে বহাল ছিল? তারা এ ধরনের ঘটনার কারণ কি হতে পারে সে ব্যাপারে যদি চিন্তা-ভাবনা করত তাহলে বুঝতে পারত এ সব ঘটনা মূর্তিপূজার যুগের অবসান সম্পর্কে এবং খুব শীঘ্রই যে সকল শয়তানী শক্তি ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে সে ব্যাপারেও সুসংবাদ প্রদান করছে।

মূলনীতিগতভাবে ঐ একই দিনে ঘটে যাওয়া অলৌকিক ঘটনাবলী যে অত্যাচারী শাসকদের উপলব্ধি ও শিক্ষাগ্রহণের কারণ হতেই হবে এমনটি বোধ হয় জরুরী নয়,বরং যে ঘটনাটি কোন এক বছরে সংঘটিত হয়েছে তা বছরের পর বছর শিক্ষণীয় হতে পারে এবং তার কার্যকারিতা বহাল থাকতে পারে;আর এতটুকুই যথেষ্ট।

মহানবী (সা.) যে রাতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সে রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ঠিক এ রকমই। কারণ এ সব ঘটনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল ঐ সব মানুষের অন্তরে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দেয়া ও মনোযোগ সৃষ্টি করা যারা মূর্তিপূজা,অন্যায় ও জুলুমের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল।

মহানবীর রিসালাত বা নবুওয়াতী মিশনের সমসাময়িক জনগোষ্ঠী এবং এর পরবর্তী প্রজন্মসমূহ এমন একজন মানুষের আহবান শুনতে পাবে যিনি তাঁর সকল শক্তি প্রয়োগ করে মূর্তিপূজা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। যখন তারা তাঁর জীবনের প্রথম দিকের ঘটনাসমূহ অধ্যয়ন করবে তখন প্রত্যক্ষ করবে যে,এ ব্যক্তির জন্মগ্রহণের রাতে এমন সব ঘটনা ঘটেছিল যা তাঁর দাওয়াহ্ বা প্রচার কার্যক্রমের সাথে পূর্ণ সংগতিশীল। স্বাভাবিকভাবে এ ধরনের ঘটনার একই সাথে সংঘটিত হওয়ার বিষয়টি আসলে তাঁর সত্যবাদী হওয়ারই নিদর্শনস্বরূপ বলে তারা গ্রহণ করবে এবং এ কারণে তারা তাঁর প্রতিও বিশ্বাস স্থাপন করবে।

এ ধরনের ঘটনাবলী হযরত ইবরাহীম,হযরত মূসা,হযরত ঈসা ও হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মতো মহান নবীদের জন্মগ্রহণের সময় সংঘটিত হওয়া তাঁদের নবুওয়াত ও রিসালাতের যুগে ঐ সব অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হওয়ার চেয়ে কোন অংশে কম নয়;আর এ সব কিছু আসলে মহান আল্লাহর ঐশী কৃপা থেকেই উৎপত্তি লাভ করেছে এবং মানব জাতির হেদায়েত ও তাদেরকে মহান নবীদের দীন প্রচার কার্যক্রমের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্যই সংঘটিত হয়েছে।

মহানবীর জন্মের দিন,মাস ও বছর

সাধারণ সীরাত রচয়িতাগণ ঐকমত্য পোষণ করেন যে,মহানবী হাতির বছর (عام الفيل ) অর্থাৎ 570 খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কারণ তিনি অকাট্যভাবে 632 খ্রিষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেছিলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল 62 অথবা 63 বছর। অতএব,তিনি 570 খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

অধিকাংশ ঐতিহাসিক ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে,মহানবী (সা.) রবিউল আউয়াল মাসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তবে তাঁর জন্মদিন সম্পর্কে মতভেদ আছে। শিয়া মুহাদ্দিসদের মধ্যে প্রসিদ্ধ অভিমত হচ্ছে,মহানবী 17 রবিউল আউয়াল,শুক্রবার ফজরের সময় (ঊষালগ্নে) জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আর আহলে সুন্নাতের মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ অভিমত হচ্ছে তিনি 12 রবিউল আউয়াল,সোমবার জন্মগ্রহণ করেন।127

এ দু অভিমতের মধ্যে কোনটি সঠিক?

একটি দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে এই যে,ইসলাম ধর্মের মহান নেতার জন্ম ও মৃত্যুদিবস,বরং আমাদের অধিকাংশ ধর্মীয় নেতার জন্ম ও মৃত্যুদিবস সুনির্দিষ্ট নয়। এ অস্পষ্টতার কারণেই আমাদের বেশিরভাগ উৎসব ও শোকানুষ্ঠানের তারিখ অকাট্যভাবে জানা যায় নি। ইসলামের পণ্ডিত ও আলেমগণ বিগত শতাব্দীগুলোতে যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলো এক বিশেষ পদ্ধতিতে লিপিবদ্ধ করতেন। কিন্তু কি কারণে তাঁদের অধিকাংশেরই জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ খুব সূক্ষ্মভাবে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব হয়নি তা (আজও) জানা যায় নি।

আমি ভুলব না ঐ সময়ের কথা যখন ভাগ্যবিধি আমাকে (লেখক) কুর্দিস্তানের একটি সীমান্ত শহরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল;ঐ এলাকার একজন আলেম এ বিষয়টি (অর্থাৎ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সঠিক তারিখ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আলেমদের মধ্যে মতবিরোধ) উত্থাপন করেন এবং এজন্য তিনি অনেক দুঃখ প্রকাশও করেছিলেন। তিনি এ ব্যাপারে আলেমদের উদাসীনতা ও শৈথিল্য প্রদর্শন করার কারণে অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, এ ধরনের বিষয়ের ক্ষেত্রে কিভাবে তাঁদের মধ্যে এ রকম মতবিরোধ বিরাজ করা সম্ভব? তখন আমি তাঁকে বললাম, এ বিষয়টির কিছুটা সমাধান করা সম্ভব। আপনি যদি এ শহরের একজন আলেমের জীবনী রচনা করতে চান এবং আমরা ধরেও নিই যে,এ আলেম ব্যক্তি বেশ কিছুসংখ্যক সন্তান এবং অনেক আত্মীয়-স্বজন রেখে গেছেন তাহলে উক্ত আলেমের শিক্ষিত সন্তান-সন্ততি এবং বিরাট পরিবার যারা স্বাভাবিকভাবেই তাঁর জীবনের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জ্ঞাত তারা উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও তাঁর আত্মীয় যারা নয় তাদের থেকে কি আপনি তাঁর জীবনের প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী সংগ্রহ করবেন? নিশ্চিতভাবে আপনার বিবেক এ ধরনের কাজের অনুমতি দেবে না।

মহানবী (সা.) জনগণের মধ্য হতে বিদায় নিয়েছেন। মৃত্যুর সময় তিনি উম্মাহর মাঝে তাঁর আহলে বাইত ও অন্যান্য সন্তান-সন্ততি রেখে গেছেন। তাঁর নিকটাত্মীয়গণের বক্তব্য : মহানবী (সা.) যদি আমাদের শ্রদ্ধেয় পিতা হয়ে থাকেন এবং আমরাও যদি তাঁর ঘরে বয়ঃপ্রাপ্ত এবং তাঁর কোলে প্রতিপালিত হয়ে থাকি,তাহলে আমরাই সকলের চেয়ে এ বিষয়ে অধিক জ্ঞাত যে,আমাদের বংশের প্রধান (মহানবী) অমুক দিন অমুক সময় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

এমতাবস্থায় তাঁর সন্তান-সন্ততি ও বংশধরদের বক্তব্য উপেক্ষা করে দূর সম্পর্কের আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের বক্তব্যকে কি তাঁদের বক্তব্যের ওপর প্রাধান্য দেয়া সম্ভব হবে?

উপরোল্লিখিত আলেম আমার এ কথা শোনার পর মাথা নিচু করে বললেন, আপনার কথা আসলেأهل البيت أدرى بما في البيت (ঘরের লোক ঘরে যা আছে সে সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জ্ঞাত)-এ প্রবাদ বাক্যের অন্তর্নিহিত অর্থের অনুরূপ। আর আমিও মনে করি যে,মহানবী (সা.)-এর জীবনের যাবতীয় বিশেষত্ব ও খুঁটিনাটি দিক সম্বন্ধে শিয়া ইমামীয়াহ্ মাজহাবের বক্তব্য যা তাঁর সন্তান-সন্ততি,বংশধর ও নিকটাত্মীয়দের থেকে সংগৃহীত তা সত্যের নিকটবর্তী।” এরপর আমাদের মধ্যকার আলোচনা অন্যান্য বিষয় পর্যন্ত সম্প্রসারিত হলো যা এখানে উল্লেখ করার কোন সুযোগ নেই।

গর্ভধারণকাল

প্রসিদ্ধি আছে যে,হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র অস্তিত্বের নূর তাশরীকের (হজ্বের মাসের 11,12 ও 13 তারিখকে আইয়ামে তাশরীক অর্থাৎ তাশরীকের দিনসমূহ বলে অভিহিত করা হয়) দিনগুলোতে হযরত আমেনার জরায়ুতে স্থাপিত হয়েছিল।128 তবে 17 রবিউল আউয়ালে যে হযরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেছিলেন এতৎসংক্রান্ত ঐতিহাসিকদের মধ্যে প্রচলিত প্রসিদ্ধ অভিমতের সাথে এ বিষয়টির মিল নেই। কারণ এমতাবস্থায় হযরত আমেনার গর্ভধারণকাল 3 মাস অথবা 1 বছর 3 মাস বলে ধরতে হবে। আর এ বিষয়টি স্বয়ং প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মের পরিপন্থী। আর কোন ঐতিহাসিক বা আলেম তা মহানবীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য বলে উল্লেখ করেন নি।129

প্রখ্যাত গবেষক আলেম শহীদে সানী (911-966 খ্রি.) উপরিউক্ত আপত্তিটির এভাবে সমাধান করেছেন : ইসমাঈলের বংশধরগণ তাদের নিজ পূর্বপুরুষদের অনুকরণে যিলহজ্ব মাসেই হজ্বব্রত পালন করত। কিন্তু পরবর্তীকালে বিশেষ কিছু কারণে তারা প্রতি দু বছর একই মাসে হজ্বব্রত পালনের চিন্তা-ভাবনা করে। অর্থাৎ দুই বছর তারা যিলহজ্ব মাসে,এর পরের দু বছর মুহররম মাসে এবং এ ধারাক্রমানুসারে হজ্বব্রত পালন করার চিন্তা করেছিল। তাই 24 বছর গত হওয়ার মাধ্যমে পুনরায় হজ্বের দিনগুলো স্বস্থানে অর্থাৎ যিলহজ্ব মাসে ফিরে আসত। আরবদের রীতিনীতি এ ধারার ওপরই বহাল ছিল। অবশেষে 10 হিজরীতে প্রথম বারের মতো হজ্বের দিবসগুলো যিলহজ্ব মাসে ফিরে আসে। মহানবী (সা.) একটি ভাষণ দানের মাধ্যমে (হজ্ব সংক্রান্ত) যে কোন ধরনের পরিবর্তন জোরালোভাবে নিষিদ্ধ করেন। তিনি যিলহজ্ব মাসকে হজ্বের মাস হিসাবে অভিহিত করেন।130 আর নিম্নোক্ত এ আয়াতটি নিষিদ্ধ মাসগুলো পিছিয়ে দেয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞাস্বরূপ অবতীর্ণ হয়েছিল;আর নিষিদ্ধ মাসসমূহ পিছিয়ে দেয়া ছিল জাহেলী আরবদের অন্যতম প্রচলিত প্রথা। আয়াতটি নিম্নরূপ :

) إنّما النّسيئ في زيادة الكفر يُضلّ به الذين كفروا و يُحلّونه عاما و يحرّمونه عاما(

“হারাম মাসসমূহ পরিবর্তন করা হচ্ছে কুফর বৃদ্ধির নিদর্শন মাত্র। যারা কাফির তারা এ কাজের দ্বারা পথভ্রষ্ট হয়। তারা এক বছর ঐ কাজকে হালাল করে এবং আরেক বছর তা হারাম করে।” (সূরা তাওবাহ্ : 37)

এই পরিস্থিতিতেই প্রতি দু বছর তাশরীকের দিবসগুলো পরিবর্তিত হতো। যদি হাদীসে বর্ণিত হয়ে থাকে যে,হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নূর তাশরীকের দিবসগুলোতে হযরত আমেনার গর্ভে স্থাপিত হয়েছিল এবং তিনি 17 রবিউল আউয়াল জন্মগ্রহণ করেছিলেন তাহলে এ দু ব্যাপারে কোন স্ববিরোধিতা নেই। কারণ ঐ অবস্থায় স্ববিরোধিতার উদ্ভব হতে পারে যখন তাশরীকের দিবসগুলো বলতে যিলহজ্ব মাসের 11,12 ও 13 তারিখ বোঝাবে। তবে যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে তদনুযায়ী তাশরীকের দিনগুলো সর্বদা পরিবর্তিত হয়েছে এবং চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করার পর এ বিষয়ে আমরা পৌঁছেছি যে,মহানবী (সা.)-এর ভ্রুণ হযরত আমেনা কর্তৃক গর্ভে ধারণ এবং তাঁর জন্মগ্রহণের বছরে হজ্বের দিবসগুলো জমাদিউল উলা মাসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আর যেহেতু মহানবীর জন্ম রবিউল আউয়াল মাসেই হয়েছিল এমতাবস্থায় হযরত আমেনার গর্ভধারণকাল প্রায় 10 মাস হয়েছিল।131

এ বক্তব্যের ব্যাপারে আপত্তিসমূহ

মরহুম শহীদে সানী এ অভিমত থেকে যে ফলাফলে উপনীত হয়েছেন তা সঠিক নয়। তিনিنسيء (নাসি) শব্দের যে অর্থ ব্যক্ত করেছেন মুফাসসিরদের মধ্যে কেবল মুজাহিদই উক্ত অর্থ গ্রহণ করেছেন। অন্যান্য মুফাসসির তা ভিন্নভাবে ও ভিন্ন অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন। আর উপরিউক্ত ব্যাখ্যাটি ততটা দৃঢ় ও শক্তিশালী নয়। কারণ :

প্রথমত মক্কা নগরী সকল সমাজ ও গোত্রের কেন্দ্রস্থল ছিল এবং সমগ্র আরব জাতির একটি সাধারণ ইবাদাতগাহ্ বলে গণ্য হতো। বলার অপেক্ষা রাখে না যে,প্রতি দু বছর অন্তর হজ্বের দিন-ক্ষণ পরিবর্তন করা স্বাভাবিকভাবে আপামর জনতাকে ভুলের মধ্যে ফেলে দেবে এবং হজ্বব্রতের মহান সমাবেশ ও সামষ্টিক ইবাদাতের বিরল সম্মান ও মর্যাদাকেও সমূলে বিনষ্ট করে দেবে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে যা কিছু তাদের জন্য গৌরব ও সম্মানের ভিতস্বরূপ তা প্রতি দু বছর অন্তর পরিবর্তিত হয়ে যাক,হজ্বের সময় হারিয়ে যাক এবং উক্ত মহাসমাবেশ ধ্বংস হয়ে যাক-এ ব্যাপারে স্বাভাবিকভাবে মক্কাবাসীদের সম্মত হওয়ার প্রশ্নই আসে না।

দ্বিতীয়ত খুব সূক্ষ্মভাবে যদি হিসাব-নিকাশ করা হয় তাহলে শহীদে সানীর বক্তব্যের অপরিহার্য অর্থ দাঁড়ায় এটি যে,নবম হিজরীর হজ্বের দিবসগুলো যিলক্বদ মাসে পড়েছিল,অথচ ঐ বছরেই হয়রত আলী (আ.) মহানবীর পক্ষ থেকে হজ্বের দিনগুলোতে মুশরিকদের উদ্দেশ্যে সূরা তাওবাহ্ পাঠ করার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। মুফাসসির ও মুহাদ্দিসগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে,হযরত আলী উক্ত সূরা 10 যিলহজ্ব পাঠ করেন এবং মুশরিকদের 4 মাসের সুযোগ দেন। আর সকল মুফাসসির ও মুহাদ্দিস 10 যিলহজ্বকে সেই সুযোগের শুরু বলেই জানেন এবং তাঁদের মধ্য থেকে কেউ বলেন নি যে,সেটি ছিল যিলক্বদ মাসে।

তৃতীয়তنسيء শব্দের অর্থ হচ্ছে এই যে,যেহেতু জীবিকা নির্বাহের কোন সঠিক পথ ও পদ্ধতি ছিল না তাই তারা প্রধানত লুটতরাজ ও রাহাজানির মাধ্যমে তাদের জীবিকা নির্বাহ করত। এ কারণেই যিলক্বদ,যিলহজ্ব ও মুহররম এ তিন মাস যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ রাখা তাদের জন্য খুবই কঠিন ছিল। তাই মুহররম মাসে যুদ্ধ করা এবং তৎপরিবর্তে সফর মাসে যুদ্ধ বন্ধ রাখার অনুমতি দেয়ার জন্য কখনো কখনো তারা পবিত্র কাবার দায়িত্বশীলদের কাছে আবেদন করত।نسيء শব্দের অর্থও ঠিক এটিই। আর মুহররম ব্যতীত অন্য কোন মাসের ক্ষেত্রে কখনইنسيء ছিল না। তাই এ ব্যাপারে স্বয়ং আয়াতটিতেও ইঙ্গিত রয়েছে :يُحلّونه عاما و يحرّمونه عاما তারা এক বছর যুদ্ধ হালাল করত এবং আরেক বছর যুদ্ধ হারাম করত।”

আমরা মনে করি সমস্যা সমাধানের পথ হচ্ছে এই যে,আরবগণ বছরের দু টি সময়-একটি যিলহজ্ব মাসে ও একটি রজব মাসে-হজ্ব করত। এমতাবস্থায় হযরত আমেনা হজ্বের মাসে অথবা তাশরীকের দিবসগুলোতে রাসূলে খোদা (সা.)-এর নূর গর্ভে ধারণ করেছিলেন-এর উদ্দেশ্য সম্ভবত রজব মাসও হতে পারে। মহানবী (সা.) যদি 17 রবিউল আউয়াল জন্মগ্রহণ করে থাকেন তাহলে গর্ভধারণকাল 8 মাস ও কয়েকদিন হয়ে থাকবে।


18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53

54

55

56

57

58

59

60

61