চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 103723
ডাউনলোড: 9128


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 103723 / ডাউনলোড: 9128
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

আকাবার দ্বিতীয় শপথ

মদীনার মুসলমানদের মধ্যে আশ্চর্য উদ্দীপনা দেখা দিয়েছিল। তারা হজ্বের সময়ের প্রহর গুনছিল। কারণ হজ্বের সময় মহানবী (সা.)-এর সান্নিধ্য লাভ সম্ভব হবে এবং তাঁর সেবায় যে তারা অধিকতর প্রস্তুত হয়েছে এ কথা ঘোষণা করার সুযোগ ঘটবে। সে সাথে পূর্বোক্ত চুক্তিনামার সম্প্রসারণের (পরিমাণ ও মান উভয় ক্ষেত্রেই) ইচ্ছাটি ব্যক্ত করার অভিপ্রায়ও ছিল। মদীনা থেকে পাঁচশ’ ব্যক্তির কাফেলা হজ্বের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। এ কাফেলায় 73 জন মুসলমান ছিলেন যাঁদের দু জন ছিলেন নারী। কাফেলার অন্যান্য সদস্যও হয় ইসলামের প্রতি দুর্বল,নতুবা নিরপেক্ষ ছিল। মুসলমানগণ মক্কায় মহানবীর সঙ্গে দেখা করে বাইয়াত (চুক্তিবদ্ধ হওয়া) অনুষ্ঠানের সময় নির্ধারণের অনুরোধ জানালেন। নবী (সা.) তাঁদের বললেন, আমরা মিনায় পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হব। 13 জিলহজ্ব যখন সকলে ঘুমিয়ে পড়বে তখন আকাবা’র গিরিপথে আমরা সংলাপে বসব।”

13 জিলহজ্ব মহানবী (সা.) চাচা আব্বাসকে সঙ্গে নিয়ে সকলের পূর্বেই আকাবায় পৌঁছলেন। তখন রাত্রির একাংশ অতিবাহিত হয়েছে;আরবের মুশরিকরা ঘুমে বিভোর হয়ে পড়েছে। মুসলমানরা একের পর এক ধীরে ধীরে গোপনে আকাবার পথ ধরল। সকলে সমবেত হওয়ার পর রাসূলের চাচা আব্বাস প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করে রাসূল (সা.) সম্পর্কে বললেন, হে খাজরাজ গোত্রীয়গণ! তোমরা মুহাম্মদের দীনের প্রতি নিজেদের সহায়তার ঘোষণা দিয়েছ। তোমরা জেনে রাখ,সে তার গোত্রের নিকট সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তি। বনি হাশিমের সকল সদস্য তার প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত। কিন্তু এখন মুহাম্মদ তোমাদের মধ্যে অবস্থান করাকে শ্রেয় মনে করেছে। যদি তোমরা নিজ চুক্তির প্রতি দৃঢ় থাক এবং তাকে শত্রুর আক্রমণ হতে রক্ষা কর তাহলে সে তোমাদের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করতে পারবে। কিন্তু যদি কোন কঠিন অবস্থায় তাকে প্রতিরক্ষা করতে অক্ষম হও তাহলে এখনই তা বল। এতে সে পূর্ণ সম্মান ও মর্যাদা সহকারে স্বীয় গোত্রেই অবস্থান করবে।”

তখন বাররা ইবনে মা রুর দাঁড়িয়ে বললেন, আল্লাহর শপথ! আমরা মুখে যা বলেছি অন্তরে এর বিপরীত কিছু নেই। আমরা আমাদের কথার সত্যতা ও শপথ রক্ষায় বদ্ধপরিকর। নবীর পথে প্রাণপণ সংগ্রাম ব্যতীত অন্য কোন চিন্তা আমরা করছি না। অতঃপর খাজরাজগণ মহানবীর দিকে লক্ষ্য করে কিছু বলার অনুরোধ জানাল। নবী (সা.) কোরআনের কয়েকটি আয়াত পাঠের মাধ্যমে তাদেরকে ইসলাম ধর্মের প্রতি অধিকতর নিবেদিত ভূমিকা রাখতে অনুপ্রাণিত করলেন। অতঃপর বললেন, তোমাদের সঙ্গে এ মর্মে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছি যে,তোমরা তোমাদের পরিবার ও সন্তানদের যেরূপ প্রতিরক্ষা কর আমাকেও সেরূপ প্রতিরক্ষা করবে। 363

এখানে লক্ষণীয় যে,নবী (সা.) তাঁকে রক্ষার জন্য চুক্তি করেছেন (প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন),আল্লাহর পথে যুদ্ধ ও সংগ্রামের (জিহাদের) প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেন নি। তিনি বদর যুদ্ধের সময় যতক্ষণ আনসারদের সম্মতি লাভ করেন নি ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধের ঘোষণা দেন নি।

তখন বাররা দ্বিতীয় বারের মতো উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমরা যুদ্ধে প্রশিক্ষিত এবং যুদ্ধের উপযোগী হয়েই গড়ে উঠেছি। এ বিষয়টি আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেছি। এ সময় খাজরাজগণের কণ্ঠে নবী (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসার প্রচণ্ড প্রকাশ লক্ষ্য করা গেল। তাদের উদ্বেলিত অভিব্যক্তি সমগ্র পরিবেশকে আচ্ছাদিত করল। কারো কারো কণ্ঠ উচ্ছাসে কিছুটা উচ্চ হলে রাসূলের চাচা আব্বাস (তাঁর হস্ত রাসূলের হস্তকে ধারণ করেছিল) বললেন, আমাদের পেছনে গুপ্তচর লেগে আছে। সুতরাং আস্তে কথা বল। এ সময় বাররা ইবনে মা রুর,আবুল হাইসাম ইবনে তাইহান এবং আসআদ ইবনে জুরারাহ্ স্বীয় স্থান হতে উঠে রাসূলের হাতে বাইয়াত করলেন। তাঁদের অনুসরণে বাকী সবাই একে একে বাইয়াত নিলেন।

আবুল হাইসাম বাইয়াতের সময় রাসূলকে বললেন, হে রাসূলাল্লাহ্! আমরা ইয়াহুদীদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। এখন থেকে তার তেমন মূল্য দেব না। আপনার জন্যই আমরা সব কিছু করছি। এমন যেন না হয় যে,আপনি আমাদের ছেড়ে একদিন নিজ গোত্রের নিকট ফিরে যাবেন। নবী (সা.) বললেন, তোমরা যাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছ আমি সে চুক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকব। অতঃপর বললেন, তোমাদের মধ্য হতে বারো ব্যক্তিকে প্রতিনিধি নির্বাচিত কর যাতে করে তারা তোমাদের সমস্যার চূড়ান্ত সমাধানদাতা হতে পারে। (যেমনটি মূসা ইবনে ইমরান (আ.) বনি ইসরাইলের জন্য করেছিলেন।) আনসার প্রতিনিধিগণ খাজরাজ গোত্র হতে নয় ব্যক্তি এবং আওস গোত্র হতে তিন ব্যক্তিকে নির্বাচিত করলেন। এ ব্যক্তিবর্গের নাম ইতিহাসে উল্লিখিত হয়েছে। অতঃপর বাইয়াত পর্বের সমাপ্তি ঘটলে রাসূল (সা.) তাদের প্রতিশ্রুতি দিলেন সুবিধাজনক সময়ে মক্কা হতে মদীনায় হিজরত করবেন। বৈঠকশেষে সকলে নিজ নিজ পথে ফিরে গেলেন।364

আকাবা চুক্তির পর মুসলমানদের অবস্থা

এখানে একটি প্রশ্ন প্রণিধানযোগ্য যে,কেন মদীনার অধিবাসীরা ইসলামের আবির্ভাবের কেন্দ্র হতে দূরে থাকা সত্ত্বেও মাত্র কয়েকটি বৈঠকের ফলে ইসলামকে আপন করে নিয়েছিল,অথচ মক্কাবাসীরা নবীর অত্যন্ত নিকট সম্পর্র্কীয় হওয়া সত্ত্বেও তের বছর প্রচার তাদের মধ্যে কোন প্রভাব রাখতে পারে নি? এ পার্থক্যের কারণ দু টি বিষয় বলা যেতে পারে।

প্রথমত ইয়াসরিববাসীরা দীর্ঘদিন ইয়াহুদীদের প্রতিবেশী থাকার কারণে সব সময়ই বিভিন্ন বৈঠক ও সভায় আরবদের মধ্যে একজন নবীর আগমনের কথা শুনত। ইয়াহুদীরা ইয়াসরিবের মূর্তিপূজকদের উদ্দেশে বলত,ঐ আরবীয় নবী ইয়াহুদী ধর্মকে প্রচার করবেন এবং বিশ্ব হতে মূর্তিপূজাকে রহিত করবেন। এরূপ সংলাপ ইয়াসরিবের অধিবাসীদের নতুন এ ধর্মকে গ্রহণের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছিল ও তারা এর প্রতীক্ষায় ছিল। বিষয়টি তাদেরকে এতটা প্রস্তুত করেছিল যে,তারা নবী (সা.)-এর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই ঈমান আনে ও নিজেদের মধ্যে কথোপকথনে বলে যে,ইনিই সেই প্রতিশ্রুত নবী যাঁর প্রতীক্ষায় ইয়াহুদীরা রয়েছে। তাই আমাদের উচিত হবে এ ক্ষেত্রে তাদের হতে অগ্রগামী হওয়া।

এ কারণেই পবিত্র কোরআন ইয়াহুদীদের সমালোচনা করে বলেছে,তোমরা মূর্তিপূজকদের আরব নবীর আগমনের কথা বলে ভীতি প্রদর্শন করতে এবং লোকদের তাঁর আগমনের সুসংবাদ দিতে। তোমরা তাওরাত হতে তাঁর আবির্ভাবের নিদর্শনসমূহ পড়ে শুনাতে। তবে কেন এখন তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছ? কোরআন বলেছে,

) و لَمّا جاءهم كتاب مّن عند الله مصدّق لما معهم و كانوا من قبل يستفتحون على الّذين كفروا فلمّا جاءهم ما عرفوا كفروا به فلعنة الله على الكافرين(

“যখন আল্লাহর পক্ষ হতে তাদের নিকট গ্রন্থ (কোরআন) প্রেরিত হলো যা তাদের নিকট বিদ্যমান গ্রন্থকে (তাওরাত) সত্যায়ন করে এবং তারা এর মাধ্যমে কাফিরদের (মূর্তিপূজক) ওপর বিজয়ী হওয়ার প্রতীক্ষায় ছিল। অতঃপর যখন তা আসল পূর্ব হতে তারা সে বিষয়ে জানার পরও তা অস্বীকার (গোপন) করল। কাফিরদের ওপর আল্লাহর লানত বর্ষিত হোক। (সূরা বাকারা : 89)

দ্বিতীয় যে কারণটি মদীনাবাসীদের ইসলাম গ্রহণের পেছনে ভূমিকা রেখেছিল তা হলো দীর্ঘ একশ বিশ বছরের গোত্রীয় দ্বন্দ্ব তাদেরকে দৈহিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলেছিল,তারা জীবনের প্রতি হতাশ হয়ে পড়েছিল এবং মুক্তির আশা হারিয়ে ফেলেছিল। তাদের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধসমূহের মধ্যে শুধু বুয়া সের যুদ্ধের ইতিহাস পড়লেই তাদের প্রকৃত অবস্থা আমাদের দৃষ্টিতে ফুটে উঠবে। এ যুদ্ধে প্রথমে আওসরা পরাজিত হয় এবং নজদে পলায়নে বাধ্য হয়। বিজয়ী খাজরাজগণ তাদের তীব্র সমালোচনা করে। আওস গোত্রপতি হুজাইর এতে ভীষণভাবে মর্মাহত হন। তিনি নজদে পৌঁছে নিজ অশ্ব হতে অবতরণ করে নিজ গোত্রের উদ্দেশে বক্তব্যে বলেন, খোদার শপথ! নিহত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ করব। হুজাইরের দৃঢ়তা তাঁর গোত্রের পরাজিত সৈনিকদের আত্মরক্ষা,সাহসিকতা ও হৃত মর্যাদা পুনরুদ্ধারে উৎসাহিত করে। তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে কোন মূল্যে নিজেদের অধিকার রক্ষা করবে এবং মদীনায় ফিরে আসবে। তারা জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করে। আত্মোৎসর্গী দল সকল সময় বিজয়ী হয়-এ সত্যটি পরাজিত আওসরা আবার প্রমাণ করে। তারা খাজরাজদের পরাজিত করে এবং তাদের খেজুর বাগানসমূহ জ্বালিয়ে দেয়।

এরপর আওস ও খাজরাজদের মধ্যে পালাক্রমে যুদ্ধ ও সন্ধি হতে থাকে। তাদের জীবন সহস্র অপ্রীতিকর ও ক্লান্তিদায়ক ঘটনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এ অবস্থা উভয় গোত্রের জন্যই অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় ছিল এবং তারা অসন্তুষ্টির চরম সীমায় পৌঁছেছিল। তারা মুক্তির পথ ও আশার আলো খুঁজছিল। এ কারণেই খাজরাজের ঐ ছয় ব্যক্তি নবী (সা.)-এর কথায় তাদের হারানো বস্তুর সন্ধান পেয়েছিল এবং অভিব্যক্তি করেছিল যে,সম্ভবত আল্লাহ্ আপনার মাধ্যমে আমাদের অশান্তির অবসান ঘটাবেন এবং মুক্তি দেবেন। এ সকল কারণেই ইয়াসরিবের অধিবাসীরা উদার চিত্তে ইসলামকে গ্রহণ করেছিল।

আকাবা চুক্তি ও কুরাইশদের প্রতিক্রিয়া

যেহেতু ইসলাম মক্কায় তেমন প্রসার লাভ করে নি সেহেতু কুরাইশরা ভেবেছিল ইসলাম ক্রমাবনতির দিকে এগুচ্ছে ও অচিরেই এর প্রদীপ নিভে যাবে। এ কারণে তারা ইসলামের প্রতি অনেকটা উদাসীন হয়ে পড়েছিল। তাই দ্বিতীয় আকাবার চুক্তিটি কুরাইশদের কাছে এক বিস্ফোরণের মতো মনে হয়েছিল। যখন তারা জানতে পারল ইয়াসরিবের তিয়াত্তর ব্যক্তি রাসূলের সঙ্গে এ মর্মে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে যে,তাকে নিজ সন্তানের ন্যায় প্রতিরক্ষা করবে তখন তাদের হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার হলো। তারা বুঝতে পারল মুসলমানরা আরব উপদ্বীপের কেন্দ্রে ঘাঁটি স্থাপন করতে যাচ্ছে। তারা আশংকা করল মুসলমানরা তাদের সমগ্র শক্তিকে যা এতদিন বিক্ষিপ্ত ছিল তা কেন্দ্রীভূত করে একত্ববাদী ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে এবং এতে মক্কার মূর্তিপূজা হুমকির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে।

কুরাইশ গোত্রের প্রধান ব্যক্তিবর্গ পরদিন সকালে বিষয়টি জানার পর নিশ্চিত হওয়ার লক্ষ্যে খাজরাজ গোত্রের হজ্বযাত্রীদের নিকট গিয়ে বলল, আমরা জানতে পেরেছি তোমরা গত রাতে মুহাম্মদের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছ এবং তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছ যে,আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। খাজরাজগণ শপথ করে বলল, আমরা কখনই চাই না তোমাদের ও আমাদের মধ্যে যুদ্ধের অগ্নি প্রজ্বলিত হোক।”

ইয়াসরিবের হজ্ব কাফেলায় প্রায় পাঁচশ’ লোক ছিল। তাদের মধ্যে মাত্র তিয়াত্তর জন পূর্ব রাত্রিতে রাসূলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। অন্যরা সে সময় ঘুমে অচেতন ছিল এবং এ ঘটনা সম্পর্কে অবহিত ছিল না। যেহেতু তারা মুসলমান ছিল না তাই বিষয়টি তাদের জানা ছিল না। এ কারণে তারা শপথ করে এ ধরনের ঘটনাকে অস্বীকার করে বিষয়টিকে মিথ্যা বলে ঘোষণা করল। খাজরাজ নেতা আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই সমগ্র ইয়াসরিবের ওপর যার নেতৃত্বের প্রস্তুতি চলছিল সে বলল, এ ধরনের কোন ঘটনাই ঘটে নি এবং খাজরাজ গোত্রের লোকেরা আমার পরামর্শ ব্যতিরেকে এমন কাজ করতে পারে না। কুরাইশ দলপতিরা বিষয়টিকে আরো খতিয়ে দেখার জন্য অন্যদেরও প্রশ্ন করতে লাগল। সেখানে যে সব মুসলমান উপস্থিত ছিলেন তাঁরা বুঝলেন তাঁদের গোপন বৈঠকের বিষয়টি ফাঁস হয়ে গেছে। তাই সময়ের অপচয় না করে নিজেরা পরিচিত হওয়ার পূর্বেই মক্কা ত্যাগের পরিকল্পনা নিলেন ও ত্বরিৎ মদীনার পথ ধরলেন।

নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই বেশ কিছু মদীনাবাসীর মক্কা ত্যাগের বিষয়টি কুরাইশদের সন্দেহকে (চুক্তি হওয়া) আরো ঘনীভূত করল। তারা বুঝতে পারল যে,তারা সঠিক তথ্যই পেয়েছে। ফলে তারা ইয়াসরিববাসীদের পশ্চাদ্ধাবনে তৎপর হলো। কিন্তু এতে তারা তেমন সফল হলো না। কারণ প্রায় সকল ইয়াসরিববাসী তাদের সীমার বাইরে চলে গিয়েছিল। শুধু সা দ ইবনে উবাদা নামক এক ব্যক্তিকে তারা ধরতে সক্ষম হয়েছিল। অবশ্য ঐতিহাসিক ইবনে হিশামের মতে দু ব্যক্তিকে তারা নাগালে পেয়েছিল। তাদের একজন হলো সা দ ইবনে উবাদা এবং অপর জন হলো মুনজির ইবনে উমার। দ্বিতীয় জন তাদের হাত থেকে ছুটে পালায়। কুরাইশরা হিংস্রতার সাথে সা দ ইবনে উবাদার মাথার চুল ধরে টানতে লাগল ও তাঁকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল। কুরাইশদের এক ব্যক্তি তাঁর এ অবস্থাদৃষ্টে সহানুভূতিশীল হয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করল, মক্কার কোন ব্যক্তির সঙ্গে তোমার কি চুক্তি নেই? তিনি বললেন, হ্যাঁ। মুতয়েম ইবনে আদীর সঙ্গে আমার নিরাপত্তা চুক্তি রয়েছে। কারণ আমি ইয়াসরিবের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় তার জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান করতাম।”

এ কথা শুনে কুরাইশ ব্যক্তিটি তাঁকে মুক্তি দানের উদ্দেশ্যে মুতয়েম ইবনে আদীর শরণাপন্ন হলো এবং তাঁকে বলল, খাজরাজ গোত্রের এক ব্যক্তি বন্দী হয়েছে এবং কুরাইশরা তাকে নির্যাতন করছে। সে তোমার সাহায্য কামনা করছে ও তোমার সাহায্যের অপেক্ষায় রয়েছে। মুতয়েম ঐ ব্যক্তির সঙ্গে উক্ত স্থানে এসে দেখল ব্যক্তিটি অন্য কেউ নয় সা দ ইবনে উবাদা যাঁর নিরাপত্তায় মুতয়েমের বাণিজ্য কাফেলা নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছায়। তিনি তাঁকে কুরাইশদের হাত থেকে মুক্তি দিয়ে ইয়াসরিবে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। সা দ ইবনে উবাদার বন্দী হওয়ার বিষয়টি অন্যান্য মুসলমান ও তাঁর বন্ধুরা ইতোমধ্যে জেনেছিলেন। তাঁরা তাঁকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে মক্কায় ফিরে আসার পরিকল্পনা করছিলেন। এমন সময় তাঁরা সা দকে ফিরে আসতে দেখলেন। সা দ তাঁদের নিকট নিজ করুণ অবস্থার বর্ণনা দান করলেন।365

ইসলামের নৈতিক প্রভাব

প্রাচ্যবিদরা প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকেন ইসলামের প্রসার ও প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি তরবারীর মাধ্যমে হয়েছিল তা প্রমাণ করার জন্য। এ দাবি কতটা ভিত্তিহীন পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ তা প্রমাণ করবে। আমরা এর উদাহরণ হিসাবে হিজরতের পূর্বে ইয়াসরিবে কি ঘটেছিল তা পাঠকদের সামনে এখানে উপস্থাপন করছি। এতে স্পষ্টরূপে প্রমাণিত হবে যে,ইসলামের প্রচার ও প্রসার প্রথম থেকেই এর আকর্ষণীয় আহবানের ফলশ্রুতিতে ঘটেছিল। এর আহবান যে কোন শ্রোতাকেই আকৃষ্ট করত। ইসলামের প্রসিদ্ধ মুখপাত্র ও প্রচারক মুসআব ইবনে উমাইর রাসূল (সা.)-এর পক্ষ হতে মদীনায় দীন প্রচারের ও শিক্ষাদানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন।

তিনি আসআদ ইবনে জুরারার আমন্ত্রণে রাসূলের পক্ষ হতে প্রেরিত হয়েছিলেন। এ দু ব্যক্তি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন ইয়াসরিবের প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদেরকে যুক্তি-প্রমাণের মাধ্যমে ইসলামের দিকে দাওয়াত দেবেন। একদিন তাঁরা মদীনার এক বাগানে মুসলমানদের সমাবেশে পৌঁছে দেখলেন সেখানে বনি আবদুল আশহাল গোত্রের দু প্রধান ব্যক্তি সা দ ইবনে মায়ায এবং উসাইদ ইবনে হাদ্বিরও রয়েছেন। এ সময় সা দ ইবনে মায়ায উসাইদকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমার তরবারি কোষমুক্ত কর এবং এ দু ব্যক্তির সামনে গিয়ে বল তারা যেন ইসলাম প্রচার করা হতে বিরত হয় ও নিজ বক্তব্যের মাধ্যমে আমাদের সহজ-সরল মানুষদের প্রতারিত না করে। তোমাকে এটি করতে বলার কারণ আমি খোলা অস্ত্র হাতে আসআদ ইবনে জুরারার মুখোমুখি হতে চাই না যেহেতু সে আমার খালাতো ভাই।”

উসাইদ উত্তেজিত ভঙ্গিতে তরবারি উন্মোচিত করে তাঁদের দু জনের সামনে উপস্থিত হয়ে কঠোর ভাষায় সা দ-এর উদ্ধৃত কথাগুলো পুনরাবৃত্তি করলেন। রাসূলের হাতে প্রশিক্ষিত দীন প্রচারক বাগ্মী মাসআব ইবনে উমাইর শান্ত কণ্ঠে তাঁকে বললেন, আমরা কি কিছু সময় সংলাপের জন্য বসতে পারি? যদি আমাদের কথা তোমার পছন্দ না হয় তাহলে আমরা যে পথে এসেছি সে পথেই ফিরে যাব। উসাইদ বললেন, যুক্তিপূর্ণ ও ন্যায্য কথা বলেছ। অতঃপর নিজ তরবারি কোষাবদ্ধ করে তাঁদের কথা শোনার জন্য কিছুক্ষণ বসলেন। মুসআব কোরআনের কয়েকটি আয়াত তেলাওয়াত করে ব্যাখ্যা দিলেন। একদিকে পবিত্র কোরআনের সুমধুর ও আকর্ষণীয় বাণী,অন্যদিকে মাসআবের যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য তাঁকে আকৃষ্ট করল। সে আত্মহারা হয়ে বলল,

كيف تصنعون إذا أردتم أن تدخلوا هذا الدّين

“কিভাবে এ দীনে প্রবেশ করা যায় (তোমরা প্রবেশ করেছ)? তাঁরা বললেন, আল্লাহর একত্বের সাক্ষী দাও,নিজ দেহ ও পোশাক পানি দ্বারা পবিত্র কর এবং নামায পড়।”

উসাইদ ইতিপূর্বে তাঁদের দু জনের রক্ত ঝরানোর উদ্দেশ্যে আসলেও এখন মুক্ত মনে আল্লাহর একত্ব ও রাসূলের নবুওয়াতের সাক্ষ্য দিলেন। নিকটবর্তী পানির আধার হতে পানি নিয়ে নিজ দেহ ও পোশাক পবিত্র করলেন এবং কালেমা পড়তে পড়তে সা দের নিকট এসে উপস্থিত হলেন। সা দ ইবনে মায়ায অধৈর্য হয়ে উসাইদের অপেক্ষায় বসেছিলেন। আকস্মিকভাবে উসাইদ হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে এলেন। সা দ ইবনে মায়ায তাঁর হাস্যোজ্জ্বল চেহারা দেখে সকলের উদ্দেশে বললেন,নিঃসন্দেহে উসাইদ তার ধর্মবিশ্বাস পরিবর্তন করেছে এবং যে উদ্দেশ্যে গিয়েছিল তাতে সফল হয় নি। উসাইদ পুরো ব্যাপারটি তাঁর নিকট বর্ণনা করলে সা দ ক্রোধে ফেটে পড়লেন এবং সিদ্ধান্ত নিলেন,যে করেই হোক এ দু ব্যক্তিকে দীন প্রচারের কাজ থেকে বিরত করবেন। কিন্তু উসাইদের ন্যায় তিনিও একই পরিণতির শিকার হলেন। তিনি মাসআবের প্রাঞ্জল,যুক্তিপূর্ণ,দৃঢ় ও আকর্ষণীয় বক্তব্যের দ্বারা প্রভাবিত হলেন। নিজ সিদ্ধান্তের জন্য মনে মনে অনুশোচনা করলেন এবং তার ক্রোধ প্রশমিত হয়ে সৌহার্দ্যে পরিণত হলো। তিনি একত্ববাদী ধর্ম ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং ঐ স্থানেই গোসল করে নিজ পোশাক ধৌত ও পবিত্র করে নিজ গোত্রে ফিরে এসে তাদের উদ্দেশে বললেন, তোমাদের মাঝে আমার অবস্থান কোথায়? তারা বলল, তুমি আমাদের গোত্রের প্রধান। তিনি বললেন, আমি আমার গোত্রের কোন পুরুষ বা নারীর সঙ্গে কোন কথা বলব না যতক্ষণ না তারা ইসলাম ধর্মকে গ্রহণ করে। গোত্র প্রধানের এ বক্তব্য গোত্রের সকলের মুখে মুখে প্রচারিত হতে লাগল এবং নবীকে স্বচক্ষে দেখার পূর্বেই একত্ববাদী এ ধর্মের প্রতিরক্ষায় তারা রত হলো।366

ইসলামের ইতিহাসের এরূপ অসংখ্য উদাহরণ আমাদের নিকট রয়েছে যেগুলো প্রাচ্যবিদদের ইসলাম প্রসারের তথাকথিত ধারণাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। কারণ এ ঘটনাসমূহে না কোন শক্তি প্রয়োগের চি‎‎ হ্ন রয়েছে,না প্রমাণ রয়েছে অস্ত্র ব্যবহারের ও স্বাধীনতা হরণের। তারা নবীর কথাও শোনে নি,নবীকে দেখেও নি তদুপরি নবীর প্রেরিত এক প্রচারকের যুক্তিপূর্ণ কথায় কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তাদের ব্যাপক মানসিক পরিবর্তন ঘটেছিল। অন্য কোন কারণ সেখানে প্রভাব রাখে নি।

কুরাইশদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার

ইয়াসরিববাসীদের পক্ষ থেকে মুসলমানদের পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতার বিষয়টি কুরাইশদের উদাসীনতার ঘুম ভেঙে দিল। ফলে তারা নতুন করে মুসলমানদের নির্যাতন ও নিপীড়নের মাধ্যমে ইসলামের প্রসারের পথকে রুদ্ধ করার পরিকল্পনা করল।

মহানবী (সা.)-এর সাহাবিগণ মুশরিকদের নির্যাতনের বিষয়ে নবীর নিকট অভিযোগ করলেন। তাঁরা নবীর নিকট অন্য স্থানে হিজরত করার অনুমতি চাইলেন। নবী তাঁদের নিকট কয়েক দিনের সময় নিলেন। অতঃপর বললেন, তোমাদের হিজরতের জন্য সর্বোত্তম স্থান হলো ইয়াসরিব। তোমরা একে একে প্রশান্ত চিত্তে সেখানে চলে যাও। রাসূলের নির্দেশ পাওয়ার পর মুসলমানরা বিভিন্ন বাহানা দেখিয়ে একে একে মক্কা থেকে বেরিয়ে গেলেন ও মদীনার পথ ধরলেন। কুরাইশরা কিছু দিনের মধ্যেই বিষয়টি আঁচ করতে পারল এবং মুসলমানদের বহির্গমন রোধের পরিকল্পনা নিল। তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল মক্কা হতে কোন মুসলমানকে বেরিয়ে যেতে দেখলে তাকে জোরপূর্বক ফিরিয়ে আনা হবে এবং যদি বহির্গামী ব্যক্তিটির স্ত্রী ও সন্তান কুরাইশ বংশোদ্ভূত হয় ও সে তাদের সঙ্গে নিয়ে হিজরত করছে জানা যায় তবে তার স্ত্রীর বহির্গমনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। তবে কুরাইশরা কিছুটা ভীতও হয়েছিল। সে কারণে কাউকে হত্যা করা থেকে বিরত ছিল এবং হিজরত করছে এমন কোন ব্যক্তিকে পেলে তাকে বন্দী করা ও শারীরিক কিছু নির্যাতন করা ব্যতীত অন্য কিছু করত না। অবশ্য কুরাইশদের এ পরিকল্পনা তেমন সফল হয় নি।367

অবশেষে দেখা গেল অনেকেই কুরাইশদের হাত গলিয়ে বেরিয়ে গেছেন এবং ইয়াসরিবে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছেন। কিছু দিনের মধ্যে অবস্থা এমন দাঁড়াল যে,মক্কায় নবী (সা.),হযরত আলীসহ কিছু বন্দী ও অসুস্থ মুসলমান ব্যতীত কেউই অবশিষ্ট রইল না। এ অবস্থা লক্ষ্য করে কুরাইশরা আরো শঙ্কিত হলো এবং তারা ইসলামের বিস্তার রোধের উদ্দেশ্যে দারুন নাদওয়া’ নামক মন্ত্রণাকক্ষে সভায় মিলিত হলো। তারা এ উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রস্তাব রাখল। কিন্তু তাদের সকল পরিকল্পনাই রাসূলের বিশেষ ব্যবস্থাপনার নিকট পরাস্ত হলো। পরিশেষে মহানবী (সা.) নবুওয়াতের চতুর্দশ বর্ষের রবিউল আউয়াল মাসে মদীনায় হিজরত করলেন।

রাসূল (সা.)-এর হিজরতকে বানচাল করার সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় এবং মুসলমানরা দ্বিতীয় প্রচার কেন্দ্র হস্তগত করায় তারা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। মক্কায় যে সকল মুসলমান অবশিষ্ট ছিলেন মহানবী তাঁদের মদীনায় হিজরত করে আনসারদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার নির্দেশ দিলেন এবং বললেন, আল্লাহ্ তোমাদের জন্য একদল ভাই সৃষ্টি করে দিয়েছেন এবং বাসস্থানও প্রস্তুত করেছেন।”

পঁচিশতম অধ্যায় : হিজরতের প্রথম বছরের ঘটনাপ্রবাহ