চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড1%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 107477 / ডাউনলোড: 9828
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

ইবনে তাইমিয়ার বক্তব্য

আহমদ ইবনে আবদুল হালীম হারানী হাম্বালী আহলে সুন্নাতের অন্যতম আলেম যিনি মরক্কোর একটি জেলখানায় ৭২৮ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। ওয়াহাবী চিন্তাধারার অনেক কিছুরই মূল এ ব্যক্তি। তিনি নবী (সা.) এবং তাঁর আহলে বাইতের বিষয়ে বিশেষ আকীদা পোষণ করতেন। তিনি তাঁর মিনহাজুস্ সুন্নাহ্ গ্রন্থে এ আকীদাসমূহ নিয়ে কথা বলেছেন। তাঁর বিকৃত আকীদার কারণে তাঁর সমসাময়িক অনেক আলেমই তাঁর সমালোচনা করেছেন। এ ক্ষুদ্র পরিসরে তা বর্ণনার সুযোগ আমাদের নেই। এ ব্যক্তি হযরত আলী (আ.)-এর ফজিলতের এ ঘটনা সম্পর্কে নিজস্ব মত দিয়েছেন।৩৭৯ তাঁর মতটি সংক্ষিপ্ত আকারে এখানে আমরা তুলে ধরছি। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে স্বল্প জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিরা তাঁর কথায় প্রভাবিত হয়েছে এবং কোনরূপ গবেষণা ও যাচাই-বাছাই ছাড়াই (অর্থাৎ বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন না হয়েই) তাঁর মতকে সাধারণের মধ্যে প্রচার করেছে। সাধারণ মানুষও তাদের কথাকে গবেষক আলেমের কথা মনে করে গ্রহণ করেছে,অথচ তারা জানে না এ কথাগুলো এমন এক ব্যক্তির যাঁকে তাঁর সমসাময়িক সুন্নী আলেমরাই প্রত্যাখ্যান করেছেন। ইবনে তাইমিয়ার বক্তব্যটি হলো নিম্নরূপ :

রাসূল (সা.)-এর শয্যায় আলীর শয়নের বিষয়টিতে ফজিলতের কিছুই নেই। কারণ আলী দু টি সূত্রে জানতে পেরেছিলেন যে,সে রাত্রিতে তাঁর কোন ক্ষতি হবে না।

প্রথমত সত্যবাদী ও সত্যপরায়ণ নবীর নিকট তিনি জানতে পেরেছিলেন তাঁর শয্যায় ঘুমানোর কারণে তাঁর কোন ক্ষতি হবে না।৩৮০

দ্বিতীয়ত মহানবী (সা.) তাঁর ঋণ ও আমানতসমূহ আদায় ও পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব তাঁকে দিয়েছিলেন। তাই আলী বুঝতে পেরেছিলেন যে,তিনি নিহত হবেন না। যদি তিনি নিহত হতেন তবে নবী (সা.) অন্য কাউকে সে দায়িত্ব অর্পণ করতেন। তাই তিনি নিশ্চিত জানতেন যে,তিনি জীবিত থাকবেন এবং উপরিউক্ত দায়িত্বসমূহ পালন করবেন।

প্রশ্নগুলোর উত্তর প্রদানের পূর্বে বলতে চাই ইবনে তাইমিয়া হযরত আলীর ফজিলতকে অস্বীকার করতে গিয়ে বরং তাঁর মর্যাদাকেই সমুন্নত করেছেন। কারণ হয় রাসূলের কথার প্রতি হযরত আলীর বিশ্বাস সাধারণের ন্যায় ছিল,নতুবা তাঁর কথার প্রতি আলীর বিশ্বাস ছিল অগাধ ও অপরিসীম এবং নবীর কথাকে তিনি তাঁর শক্তিশালী ঈমানের আলোয় স্পষ্টরূপে উদ্ভাসিত দেখতেন। ইবনে তাইমিয়ার প্রথম যুক্তিতে নবী (সা.) সত্যবাদী হলেও আলী (আ.)-এর তাঁর কথায় বিশ্বাসের বিষয়ে সন্দেহ থাকা স্বাভাবিক। তাই তিনি সুস্থ ও নিরাপদ থাকবেন এ বিশ্বাস তাঁর হওয়ার কথা নয়। কারণ সাধারণ পর্যায়ের ব্যক্তিদের নবীর কথায় অকাট্য বিশ্বাস হওয়া সম্ভব নয়। যদিও সে ক্ষেত্রে তারা বাহ্যিকভাবে মেনে নিতে পারে,কিন্তু তাদের মনে সব সময়ই সন্দেহ থাকবে। বিপদের আশংকা তাদের হৃদয়কে সম্পূর্ণ আচ্ছাদিত করে রাখবে। কারণ প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর আশংকা রয়েছে। তাই প্রথম যুক্তি অনুযায়ী আলী (আ.) বিশেষ ঈমানের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন না হওয়াই স্বাভাবিক,তদুপরি তিনি মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী জেনেও এ কর্মে রাজী হয়েছেন- সুস্থ ও নিরাপদ থাকার বিশ্বাস নিয়ে নয়। দ্বিতীয় যুক্তির ভিত্তিতে হযরত আলীর জন্য উচ্চতর এক ফজিলত প্রতিষ্ঠিত হয়। কারণ যদি ব্যক্তির ঈমান ঐ পর্যায়ে থাকে যে,যা কিছুই নবীর নিকট থেকে শুনবে তা তার নিকট দিবালোকের ন্যায় সত্য প্রতিভাত হবে,তবে এরূপ ব্যক্তির ঈমানের সঙ্গে কোন কিছুই তুল্য হতে পারে না। কারণ এ পর্যায়ের ঈমানের কারণে নবী যখন তাকে বলবেন, আমার শয্যায় তুমি ঘুমাও। সন্ত্রাসীদের হামলায় তোমার কোন ক্ষতিই হবে না ,তখন সে স্থির ও প্রশান্ত হৃদয় নিয়ে নবীর শয্যায় শোবে এবং তার মনে বিপদের বিন্দুমাত্র ভয় থাকবে না। যদি ইবনে তাইমিয়ার মতানুযায়ী এমনটিই হয়ে থাকে যে,আলী (আ.) তাঁর নিরাপদ থাকার বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন। কারণ মহাসত্যবাদী রাসূল (সা.) তাঁকে এরূপ নিশ্চয়তা দান করেছিলেন,তবে তা আলীর সর্বোচ্চ পর্যায়ের ঈমানকে প্রমাণ করে। তিনি আলীর ফজিলতকে উপেক্ষা করতে গিয়ে বরং তাঁর জন্য উচ্চতর ফজিলতকেই প্রমাণ করেছেন।

এখন আসি বিস্তারিত আলোচনায়। প্রথম যুক্তিতে যে বলা হয়েছে : রাসূল (সা.) আলীকে বলেছেন, তোমার কোন ক্ষতি হবে না - প্রাচীন ও মৌলিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী অনেক ইতিহাস গ্রন্থে এ বর্ণনাটি আসে নি। যেমন ইবনে সা দ (জন্ম ১৬৮ হিজরী এবং মৃত্যু ২৩০ হিজরী) তাঁর তাবাকাতুল কুবরা গ্রন্থের ২২৭-২২৮ পৃষ্ঠায় এ ঘটনাটি বর্ণনা করলেও এরূপ কোন কথা উল্লেখ করেন নি। তদ্রূপ মাকরিজী তাঁর আল ইমতা গ্রন্থে এ কথাটি বর্ণনা করেন নি।

তবে ইবনে আসির (মৃত্যু ৬৩০ হি.),তাবারী (মৃত্যু ৩১০ হি.) প্রভৃতি ঐতিহাসিক এ কথাটি তাঁদের বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন। সম্ভবত তাঁরা সীরাতে ইবনে হিশাম হতে এটি বর্ণনা করেছেন। কারণ ইবনে হিশামের বর্ণনা ও তাঁদের বর্ণনা হুবহু একই।

তদুপরি এ ধরনের বর্ণনা আমার জানামতে কোন শিয়া সূত্রে উল্লিখিত হয় নি। বিশিষ্ট শিয়া আলেম ও ফকীহ্ শেখ মুহাম্মদ ইবনে হাসান তুসী (মৃত্যু ৪৬০ হি.) তাঁর আমালী গ্রন্থে হিজরতের ঘটনাটির বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন,কিন্তু তাঁর বর্ণনায় উপরিউক্ত বাক্যটি সামান্য পার্থক্যসহ বর্ণিত হয়েছে। তবে ঘটনাটি আহলে সুন্নাতের বর্ণনায় ভিন্ন ধারায় বর্ণিত হয়েছে। কারণ তিনি স্পষ্ট বর্ণনা করেছেন যে,হিজরতের রাত্রির দু রাত্রি পরেই হযরত আলী হযরত খাদীজার পূর্ববর্তী স্বামীর পুত্র হিন্দ ইবনে আবি হালিকে সঙ্গে নিয়ে নবীর সঙ্গে মিলিত হন। তখনই নবী তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেন, হে আলী! তারা এখন তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এ বাক্যটি ইবনে হিশাম,ইবনে আসির ও তাবারী বর্ণিত বাক্যের সদৃশ। কিন্তু শেখ তুসীর বর্ণনানুযায়ী নিরাপত্তার সুসংবাদবাহী এ বাক্যটি নবী (সা.) হিজরতের দ্বিতীয় বা তৃতীয় রাত্রিতে দিয়েছিলেন- প্রথম রাত্রিতে নয়। তদুপরি আমাদের যুক্তির সপক্ষে শক্তিশালী প্রমাণ স্বয়ং আলী (আ.)-এর কথা। হযরত আলী তাঁর এ ভূমিকাকে নিজেই আত্মত্যাগ ও জীবন বাজী রাখা বলে উল্লেখ করেছেন। যেমন নিম্নোক্ত এ কবিতায় তিনি বলেছেন :

وقيت بنفسي خير من وطا الحصا

و اكرم خلق طاف بالبيت العتيق بالحجر

محمّد لما خاف ان يمكروا به

فوقاه ربى ذو الجلال من المكر

و بت أراعى منهم يسؤفى

و قد نفس على القتل و الاسر

و بات رسول الله فى الغار آمنا

و مازال في حفظ الاله و في الستر

কবিতার ভাবার্থ এরূপ : আমি জীবন বাজি রেখে পৃথিবীর ওপর বিচরণকারী সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি;যিনি আল্লাহর ঘর ও হাজারে আসওয়াদকে তাওয়াফকারী সর্বোত্তম চরিত্রের মানুষ,তাঁর জীবন রক্ষা করেছি। তিনি মুহাম্মদ ছাড়া আর কেউ নন। আমি তখনই এ কাজ করেছি যখন কাফেররা তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল। আল্লাহ্ তাঁকে এ ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করেন। আমি তাঁর শয্যায় ঘুমিয়েছিলাম সকাল পর্যন্ত এবং শত্রুর প্রতীক্ষায় ছিলাম। আমি নিজেকে নিহত অথবা বন্দী হতে প্রস্তুত রেখেছিলাম। রাসূল তখন গুহায় নিরাপদে কাটিয়েছিলেন রাত।

উপরিউক্ত পঙ্ক্তিগুলো আল ফুসুল আল মুহিম্মাহ্ নামক গ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ রয়েছে।

হযরত আলী (আ.)-এর উপরিউক্ত স্পষ্ট বক্তব্য থেকে যা বোঝা যায় তা আমাদের ইবনে হিশামের ত্রুটিপূর্ণ বর্ণনার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা হতে বাধা দেয়। অধিকাংশ বর্ণনার ত্রুটিই তাঁর ওপর বর্তায়। সম্ভবত তাঁর এ ত্রুটির কারণ হলো তিনি সীরাতে ইবনে ইসহাক গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত সংকলন করেছেন। যেহেতু তিনি ইবনে ইসহাকের বর্ণনাকে সংক্ষেপ করতে চেয়েছেন সেহেতু বর্ণনার পারিপার্শ্বিকতা বাদ দিয়ে শুধু মূল বাক্যটিই বর্ণনায় এনেছেন। এ কারণেই হয়তো তিনি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দানকারী বাক্যটিকে হিজরতের দ্বিতীয় না তৃতীয় রাত্রিতে বলেছেন তা উল্লেখ করেন নি,বরং এমনভাবে বর্ণনা করেছেন যা থেকে মনে হয় সমগ্র ঘটনাটি হিজরতের রাত্রিতেই ঘটেছিল।

আমাদের যুক্তির সপক্ষে অন্যতম দলিল হলো একটি প্রসিদ্ধ হাদীস যা শিয়া ও সুন্নী উভয় হাদীস গ্রন্থেই এসেছে। হাদীসটি এরূপ যে,ঐ রাত্রিতে আল্লাহ্ হযরত জিবরাইল ও হযরত মিকাঈল (আ.)-কে সম্বোধন করে বলেন, যদি আমি তোমাদের একজনকে জীবিত রাখতে এবং অপর জনকে মৃত্যুদান করতে চাই তবে তোমাদের কে রাজী আছ নিজে মৃত্যুকে বেছে নিয়ে অপর জনকে জীবনদান করতে? তাঁরা কেউই এ কাজে সম্মত হন নি। তখন তিনি তাঁদের নির্দেশ দেন, গিয়ে দেখ আলী নবীর প্রাণ রক্ষার্থে তাঁর শয্যায় ঘুমিয়েছে,তোমরা গিয়ে আলীর নিরাপত্তার দায়িত্ব নাও। ৩৮১

ইবনে তাইমিয়া দ্বিতীয় যে দলিলটি এনেছেন তাতে বলা হয়েছে,হযরত আলী ঘটনার নিরাপদ পরিসমাপ্তি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। কারণ যেহেতু রাসূল (সা.) তাঁকে কুরাইশদের আমানতসমূহ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন সেহেতু তিনি জানতেন তিনি নিরাপদে থেকে আমানতের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। আমরা নবীর হিজরতের পরবর্তী ঘটনাসমূহ বর্ণনা করলে উত্থিত সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে।

নবী (সা.)-এর হিজরত পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ

মহানবী (সা.)-এর নিরাপত্তার প্রাথমিক পর্যায় সঠিক পরিকল্পনার ফলে সফলতা পেল। মহানবী সওর পর্বতের গুহায় আশ্রয় নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করে দিলেন। নবীর অন্তরে বিন্দুমাত্র অস্থিরতা ছিল না। এ কারণেই শত্রুরা গুহার মুখে এসে পড়লেও তিনি নিশ্চিন্তে তাঁর সঙ্গীকে বলেছেন,لا تحزن إنّ الله معنا শঙ্কিত হয়ো না,আল্লাহ্ আমাদের সঙ্গে রয়েছেন৩৮২

নবী (সা.) তিন দিবারাত্রি মহান আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ লাভ করেছিলেন। শেখ তুসীর আমালী গ্রন্থের বর্ণনানুসারে এ তিন দিনে হযরত আলী ও হিন্দ ইবনে আবি হালে রাসূলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। আহলে সুন্নাতের অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে এ সময় হযরত আবু বকরের পুত্র আবদুল্লাহ্ ইবনে আবি বকর এবং তাঁর রাখাল আমের ইবনে ফাহিরা রাসূলের নিকট নিয়মিত যেতেন।

ইবনে আসির৩৮৩ বর্ণনা করেছেন, হযরত আবু বকরের পুত্র আবদুল্লাহ্ রাত্রিতে তাঁদের নিকট গিয়ে কুরাইশদের পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত করতেন। আমের ইবনে ফাহিরা সন্ধ্যা লগ্নে মেষগুলোকে গুহার নিকটবর্তী স্থান দিয়ে ফিরিয়ে আনত যাতে করে নবী (সা.) ও তাঁর সঙ্গী মেষের দুধ পান করতে পারেন। আবদুল্লাহ্ মেষপালের অগ্রভাগে পথ চলতেন যাতে করে তাঁর পদচি হ্ন মুছে যায়।

শেখ তুসী তাঁর আমালী গ্রন্থে বলেছেন,হিজরতের পরবর্তী কোন এক রাত্রিতে হযরত আলী এবং হিন্দ ইবনে আবি হালে মহানবী (সা.)-এর নিকট গেলে তিনি তাঁদের নির্দেশ দেন পরবর্তী রাত্রিতে তাঁরা যেন দু টি উট নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন। এ সময় হযরত আবু বকর বলেন : আমি পূর্ব হতেই আমাদের জন্য দু টি উট প্রস্তুত রেখেছি যদি আপনি সেগুলো গ্রহণ করেন। নবী উটের মূল্য পরিশোধের শর্তে তা গ্রহণে রাজী হন। অতঃপর হযরত আলীকে উটের মূল্য পরিশোধের নির্দেশ দেন।

মহান রাসূল ঐ রাত্রিতে (সওর পর্বতের গুহায়) অপর যে নির্দেশটি দেন তা হলো পরবর্তী দিবসে যেন তিনি (আলী) স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ্যে এ ঘোষণা দান করেন যে,রাসূলের নিকট যে সকল ব্যক্তির ঋণ ও আমানত রয়েছে সেগুলো যেন তারা বুঝে নিয়ে যায়। রাসূল (সা.) হযরত আলীকে আরো বলেন,স্বীয় কন্যা ফাতিমা,আলীর মাতা ফাতিমা বিনতে আসাদ এবং ফাতিমা বিনতে যুবাইরসহ বনি হাশিমের যারা হিজরত করতে চায় তাদের সফরের ব্যবস্থা করার। এ সময়েই রাসূলإنّهم لن يصلوا إليك من الآن بشيء تكرهه এখন থেকে তোমার কোন ক্ষতির সম্ভাবনা নেই - এ কথাটি বলেন যেটি ইবনে তাইমিয়া তাঁর প্রথম যুক্তি হিসাবে এনেছেন।

নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন,রাসূল আলীকে আমানত ফিরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন হিজরতের রাত্রির দু রাত্রি পরে অর্থাৎ যখন তিনি সওর পর্বতের গুহা হতে মদীনার দিকে যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

হালাবী তাঁর সীরাত গ্রন্থে৩৮৪ বর্ণনা করেছেন,নবী (সা.) সওর পর্বতের গুহায় অবস্থানকালে আলী এক রাত্রিতে তাঁর নিকট উপস্থিত হন। তখন রাসূল আলীকে যে সকল নির্দেশ দেন তন্মধ্যে আমানতসমূহ ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়টিও ছিল।

হালাবী আদ্ দার গ্রন্থের রচয়িতার সূত্রে হিজরতের পরবর্তী এক রাত্রিতে রাসূলের সঙ্গে আলীর সাক্ষাতের বিষয়টি উদ্ধৃত করেছেন।

প্রকৃতপক্ষে যখন আমরা দেখি শেখ তুসীর মতো বিশিষ্ট আলেম নির্ভরযোগ্য সূত্রে আমানত ফিরিয়ে দেয়ার রাসূলের নির্দেশের ঘটনাটি হিজরতের রাত্রির পরবর্তী সময়ে সংঘটিত হয়েছিল বলেছেন তখন আমরা এরূপ নির্ভরযোগ্য বর্ণনা ত্যাগ করে অনির্ভরযোগ্য সূত্র নিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার অবকাশ রাখি না। আহলে সুন্নাতের ঐতিহাসিকগণ এ ঘটনাকে এমনভাবে বর্ণনা করেছেন যেন মনে হয় রাসূলের নির্দেশসমূহ এক রাত্রিতেই (হিজরতের রজনী) এসেছিল। অসম্ভব নয় যে,তাঁরা সমগ্র বিষয়টি বিস্তারিত বর্ণনা না করে শুধু মূলকথা ও বক্তব্যটিই বর্ণনা করতে চেয়েছেন এবং রাসূলের নির্দেশনাসমূহের সময়ের বিষয়ে বিশেষ কোন গুরুত্ব তাঁরা দেন নি।

গুহা হতে বহির্গমন

হযরত আলী রাসূল (সা.)-এর নির্দেশ অনুযায়ী তিনটি উট প্রস্তুত করে উরাইকাত নামে এক বিশ্বস্ত পথপ্রদর্শক ব্যক্তির হাতে সমর্পণ করে চতুর্থ রাত্রিতে গুহায় উপস্থিত হতে বলেন। উটের অথবা পথপ্রদর্শকের শব্দে রাসূল সঙ্গীসহ গুহা হতে বেরিয়ে এলেন এবং উটের পিঠে আরোহণ করলেন। তাঁরা লোহিত সাগরের নিকটবর্তী অঞ্চল দিয়ে মদীনার পথ ধরলেন। ইবনে আসিরের ইতিহাস গ্রন্থের পাদটীকা এবং ইবনে হিশামের সীরাত গ্রন্থে৩৮৫ রাসূলের হিজরতের পথটি খুঁটিনাটি বিষয়সহ বর্ণিত হয়েছে।

হিজরী সালের প্রথম পৃষ্ঠা উন্মোচিত হলো

রাত্রির অন্ধকার নেমে এল এবং সূর্য তখন পৃথিবীর অন্য পৃষ্ঠে (অন্য অর্ধাংশে) আলো বিকিরণে নিয়োজিত হলো। কুরাইশদের বিভিন্ন দল তিন দিবারাত্রি মক্কা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকা চষে বেরিয়ে নবীকে খুঁজে পাওয়ার বিষয়ে নিরুৎসাহিত হয়ে গৃহে ফিরে গেল। একশ উটের পুরস্কার লাভের সম্ভাবনাও ক্ষীণ দেখে তারা নিরাশ হয়ে ক্লান্ত মনে প্রত্যাবর্তন করল। ফলে মদীনার পথে নিযুক্ত প্রহরীরাও ফিরে গিয়েছিল এবং মদীনার পথ উন্মুক্ত হয়ে পড়েছিল।৩৮৬

এমন সময়ই পথপ্রদর্শকের অনুচ্চ কণ্ঠস্বর নবীর কানে পৌঁছে। তার সঙ্গে তিনটি উট ছাড়াও কিছু খাদ্য ছিল। সে অনুচ্চ স্বরে নবীকে বলল, আমাদের রাত্রির অন্ধকারকে কাজে লাগিয়েই দ্রুত মক্কার সীমানা পেরিয়ে যেতে হবে এবং এমন এক পথ ধরতে হবে যে পথে লোকজন কম চলাচল করে।

মুসলিম ইতিহাসের বর্ণনাক্রম হিজরতের এ রাত্রিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে এবং মুসলমানগণ এ রাত্রিকে তাদের ইতিহাসের প্রথম দিন বলে ধরে পরবর্তী সকল ঘটনা বর্ণনা করেছে।

কেন হিজরী বর্ষকে কেন্দ্র করে ইসলামী ইতিহাস আবর্তিত হয়েছে

ইসলাম ধর্ম ঐশী শরীয়তের পূর্ণতম রূপ। এ শরীয়ত হযরত মূসা ও হযরত ঈসা (আ.)-এর শরীয়তকে পূর্ণত্ব দিয়ে সকল যুগে ও সময়ে প্রয়োগপোযোগী হয়ে মানব জাতির জন্য অবতীর্ণ হয়েছে যদিও হযরত ঈসা ও তাঁর জন্মদিবস মুসলমানদের নিকট সম্মানিত,কিন্তু তাঁর জন্মদিবস ইসলামী ইতিহাস বর্ণনার কেন্দ্র হয় নি। কারণ মুসলমানগণ স্বতন্ত্র চিন্তা-বিশ্বাসের এক জাতি। তাই অন্য জাতির দিনপঞ্জী তারা গ্রহণ করতে পারে না। যে দিনটিতে আবরাহার হস্তীবাহিনী (কাবা ধ্বংসের উদ্দেশ্যে) মক্কা আক্রমণ করতে এসে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল সে দিনটি দীর্ঘ দিন আরবদের নিকট তাদের দিনপঞ্জীর প্রথম দিবস বলে বিবেচিত হতো।

যদিও মহানবী একই বছর জন্মগ্রহণ করেছিলেন তদুপরি তা ইসলামী ইতিহাসের প্রথম দিবস বলে পরিগণিত হয় নি। কারণ সে সময় ইসলাম ও ঈমানের কোন চি হ্নই বিদ্যমান ছিল না। একই কারণে মুসলমানগণ নবুওয়াতের বর্ষটিকেও (যখন মুসলমানের সংখ্যা তিনজনে সীমাবদ্ধ ছিল) তাদের ইতিহাসের শুরু বলে ধরে নি। কিন্তু হিজরতের প্রথম বছরেই ইসলাম ও মুসলমানদের এক বিরাট বিজয় অর্জিত হয় এবং মদীনায় ইসলামের স্বাধীন কেন্দ্র স্থাপন সম্ভব হয়। যার ফলশ্রুতিতে মুসলমানরা বিচ্ছিন্ন অবস্থা থেকে মুক্তি লাভ করে স্বীয় শক্তিকে কেন্দ্রীভূত করার অবকাশ পায়। এ বিজয়ের কারণেই এ বছরকে তারা তাদের ইতিহাসের শুরু হিসাবে ধরেছে এবং তাদের সকল উত্থান-পতনকে এ দিনপঞ্জীর আবর্তেই মূল্যায়ন করেছে। এ গ্রন্থটি লেখার সময় হিজরী সালের (চান্দ্র বর্ষ) ১৩৮২ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে যা সৌর বর্ষ অনুযায়ী ১৩৪২ বছরের সমান।৩৮৭

মহানবীর হিজরতকে কেন্দ্র করে মুসলিম বিশ্বের নিজস্ব তারিখের সূচনা

মহানবী স্বয়ং হিজরী বর্ষের সূচনা ঘোষণা করেন। তাই হিজরী সালের স্থলে অন্য সালের প্রচলন একরূপ নবীর সুন্নাত থেকে প্রত্যাবর্তন।

মানুষের সামাজিক জীবনে বছর,মাস ও সপ্তাহের হিসাব অপরিহার্য। এ হিসাব ছাড়া মানব জীবন অচল। বিষয়টি এতটা স্পষ্ট যে,এর সপক্ষে যুক্তি প্রদর্শনের প্রয়োজন নেই।

যদি আমাদের প্রশ্ন করা হয় যে,রাজনৈতিক,সামাজিক ও অর্থনৈতিক চুক্তি,বাণিজ্যিক চেক,সনদ ও অন্যান্য লেন-দেন,বিচারকার্য,পারিবারিকসহ সকল ধরনের পত্র ইত্যাদি বিষয় নির্দিষ্ট তারিখ ব্যতীত মূল্যহীন নয় কি? উত্তরে বলা যায়,অবশ্যই।

যখন মহানবীর সাহাবিগণ বিভিন্ন সময়ে চন্দ্রের আকৃতির পরিবর্তন নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করেন অর্থাৎ কেন চন্দ্র প্রথমে শীর্ণকায়,অতঃপর ধীরে ধীরে স্ফীত হয়ে পূর্ণ রূপ নেয় তখন মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী অবতীর্ণ হয় চন্দ্রের বিবর্তনের অন্যতম দর্শন বর্ণনা করে,যাতে বলা হয়

قل هي مواقيت للنّاس এর মাধ্যমে মানুষ সময় নির্ধারণ করতে পারে অর্থাৎ মাসের শুরু ও শেষ নির্ণয় করার মাধ্যমে সামাজিক ও ধর্মীয় দায়িত্বসমূহ পালনে সক্ষম হয়। ঋণদাতা ঋণ আদায় এবং ঋণগ্রহীতা ঋণ পরিশোধের সময় জানতে পারে,ঈমানদার রোযা ও হজ্বের মতো ধর্মীয় বিভিন্ন দায়িত্ব যথার্থভাবে পালন করতে পারে।

সব জাতিরই যে নিজস্ব দিনপঞ্জী থাকা উচিত সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো তারা তাদের অফিস-আদালতে কোন্ পঞ্জিকা ব্যবহার করবে? অন্যভাবে বলা যায়,কোন্ ঘটনাকে তাদের ইতিহাসের শুরু বলে ধরে ভবিষ্যতের ঘটনাপ্রবাহকে তার মানদণ্ডে লিপিবদ্ধ করবে? এর উত্তর খুবই সহজ। স্বাভাবিকভাবেই যে জাতির উজ্জ্বল অতীত রয়েছে,যাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি মৌলিক,স্বাধীন ধর্মের অনুসারী,বিশিষ্ট রাজনৈতিক ও জ্ঞানী ব্যক্তিত্বের গর্ব করার মতো ঐতিহাসিক ঘটনার অধিকারী অর্থাৎ ব্যাঙের ছাতার ন্যায় অগভীর মূলের জাতি নয় তাদের উচিত তাদের জাতির সামাজিক ও ধর্মীয় ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বছরকে ইতিহাসের শুরু বলে গ্রহণ করা এবং এর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল ঘটনাপ্রবাহকে তার সঙ্গে তুলনা করে ইতিহাস রচনা করা। এভাবেই তারা নিজ জাতি ও ব্যক্তিত্বের শিকড়কে সুদৃঢ় করতে পারবে এবং অন্য জাতির মধ্যে বিলীন হওয়া থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারবে।

মুসলিম জাতির ইতিহাসে মহানবী (সা.) অপেক্ষা বড় কোন ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটে নি এবং তাঁর হিজরত অপেক্ষা বড় ও লাভজনক ঘটনাও ঘটে নি। কারণ নবীর হিজরতের মাধ্যমেই মানবতার ইতিহাসের নতুন এক পাতা উন্মোচিত হয়েছিল এবং মহানবী ও তাঁর অনুসারী মুসলমানরা শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ থেকে মুক্তিলাভ করে স্বাধীন ও অনুকূল পরিবেশে নব যাত্রার সুযোগ পেয়েছিলেন। মদীনার স্থানীয় জনসাধারণ মুসলমানদের নেতাকে উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়েছিল এবং তাদের সমগ্র শক্তিকে তাঁর সেবায় নিবেদন করেছিল। কিছুদিন না যেতেই এ হিজরতের বরকতে ইসলাম এক স্বাধীন রাজনৈতিক ও সামরিক ভিত্তি পেয়েছিল। ফলশ্রুতিতে ইসলাম আরব উপদ্বীপে শক্তিশালী রাষ্ট্রব্যবস্থা স্থাপনে সক্ষম হয় এবং এমন এক নতুন সভ্যতার জন্মদান করে যা মানব ইতিহাসে বিরল। যদি হিজরতের ঘটনা না ঘটত তবে ইসলাম মক্কায়ই

স্তিমিত ও প্রোথিত হতো। ফলে মানবতা এক বিরাট নেয়ামত থেকে বঞ্চিত হতো।

এ কারণেই মুসলমানগণ হিজরতকে তাদের ইতিহাসের সূচনা বলে ধরেছে। সে দিন হতে এখন পর্যন্ত প্রায় চৌদ্দ শতাব্দী অতিক্রান্ত হয়েছে এবং মুসলমানগণ গর্বময় সব ইতিহাস রচনা করে পঞ্চদশ হিজরী শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে এসে উপস্থিত হয়েছে।

হিজরী বর্ষের প্রবর্তনকারী কে?

অধিকাংশ ঐতিহাসিকের বর্ণনা অনুযায়ী হযরত আলী (আ.)-এর পরামর্শ অনুযায়ী দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর রাসূল (সা.)-এর হিজরতের বছরকে সূচনা ধরে হিজরী বর্ষের প্রবর্তন করেন এবং বিভিন্ন প্রদেশ ও দফতরে নির্দেশ পাঠান সে অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় পত্র ও দলিলসমূহ সংরক্ষণের। কিন্তু কেউ যদি সীরাত ও হাদীস গ্রন্থসমূহে বর্ণিত রাসূল (সা.)-এর পত্রসমূহ লক্ষ্য করেন (যার অধিকাংশই এখনও ইতিহাস ও হাদীস গ্রন্থসমূহে বিদ্যমান),তাহলে তাঁদের নিকট স্পষ্ট হবে যে,স্বয়ং রাসূলই হিজরী বর্ষের প্রবর্তন করেছিলেন। তিনি আরবের বিভিন্ন গোত্রপ্রধানের নিকট যে পত্র প্রেরণ করেন তাতে স্পষ্টভাবে হিজরী তারিখ সংযুক্ত করেছেন।

আমরা এ অধ্যায়ে মহানবী কর্তৃক লিখিত কয়েকটি পত্রের উল্লেখ করব যাতে হিজরী তারিখ সংযোজিত হয়েছিল। এরপর এর সপক্ষে কয়েকটি দলিল উপস্থাপন করব। সম্ভবত এর বাইরেও প্রমাণসমূহ রয়েছে যা আমরা অবগত নই।


17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53

54

55

56

57

58

59

60

61